৪. কাবিল কোহকাফী

. কাবিল কোহকাফী

টুশি এবং তপু যত জোরে চিৎকার করল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই কিম্ভুতকিমার মূর্তি তার থেকে একশ গুণ জোরে চিৎকার করে লাফ দিয়ে পিছনে সরে গেল। ভয়ের চোটে টুশি কী করছে বলতে পারে না–বেলুনটা উপরে তুলে সে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, সেই ভয়ানক মূর্তিটা ছুটে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল, কোনোমতে উঠে পা চেপে ধরে কঁকাতে কঁকাতে লাফাতে থাকে, হঠাৎ করে আবার টুশি আর তপুর দিকে চোখ পড়ে যায় তখন আবার বিকট চিৎকার করে লাফাতে থাকে এবং কিছু বোঝার আগেই টান দিয়ে কোমরে ঝুলিয়ে রাখা তরবারিটা টেনে বের করে নিয়ে আসে। দুই হাতে তরবারি ধরে সে ঘোরাতে থাকে এবং একবার বিকট চিৎকার করে সামনে কোপ বসিয়ে দেয়। তরবারিটা তাদের পড়ার টেবিলে দুই আঙুল গেঁথে গেল, মূর্তিটা সেটা টেনে বের করে নিয়ে টুশি আর তপুর দিকে এগিয়ে এসে তরবারিটা ঘোরাতে থাকে–বাতাশে শাঁই শাঁই শব্দ হতে থাকে–ভয়ে আর আতঙ্কে টুশির মনে হল সে বুঝি মরেই যাবে। তপু যদি টুশিকে জাপটে ধরে চিৎকার করতে না থাকত তা হলে সে মনে হয় মরেই যেত–শুধুমাত্র তপুকে সাহস দেবার জন্যে মনে হয় সে কোনোভাবে বেঁচে রইল, বিশাল শরীরের সেই মূর্তি তরবারি হাতে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল এবং তার বিরুদ্ধে টুশি রুটি বানানোর বেলুনটা অস্ত্র হিসেবে ধরে চিৎকার করতে থাকে।

মূর্তিটা আরও কাছে এসে একটা লাফ দিয়ে তরবারি দিয়ে একটা কোপ মারার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ কেমন যেন কুঁজো হয়ে যন্ত্রণায় কোঁকাতে থাকে। টুশি এবং তপু অবাক হয়ে দেখল ভয়ংকরদর্শন মূর্তিটা তার কোমরটা ধরে যন্ত্রণায় কাতর শব্দ করতে করতে এগিয়ে সোফার উপর ধড়াম করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। হাত থেকে তরবারি ছিটকে পড়ল নিচে এবং মূর্তিটি যন্ত্রণার কে কে শব্দ করতে লাগল।

টুশি এবং তপু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রূদ্ধশ্বাসে এই মানুষটাকে দেখে। খানিকক্ষণ পর টুশি একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? তোমার কী হয়েছে?”

মানুষটা কোঁ কোঁ করতে করতে বলল, “রগে টান পড়েছে।”

 “কোথায় টান পড়েছে?”

“রগে। রগে। অনেকদিন থেকে এক্সারসাইজ নাই তো–বডি ফিট নাই।”

 টুশি ঢোক গিলে বলল, “এক্সারসাইজ নাই?”

“নাহ্! কীভাবে করব? এইটুকু বোতলের মাঝে মানুষ এক্সারসাইজ করে কীভাবে?” বোতলটা দেখাতে গিয়ে মানুষটার রগে আবার টান পড়ল–যন্ত্রণার শব্দ করে আর্তনাদ করে ওঠে, “ও বাবাগো! গেলাম গো! মা গো।”

টুশি আর তপু একজন আরেকজনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল, দুইজন একসাথে বলল, “বোতলের মাঝে?”

“হ্যাঁ, বোতলের মাঝে।”

টুশি এবারে তপুর মতো তোতলাতে শুরু করল, “বো-বো-বোতলের মাঝে?”

 মানুষটা মুখ ভেংচে বলল, “হ্যাঁ, বো-বো-বোতলের মাঝে?”

 টুশি এবার রেগে গিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ভ্যাঙাচ্ছ কেন?”

“কেন ভ্যাঙাব না, পিঠের যন্ত্রণায় মারা যাচ্ছি, তার মাঝে এক কথা একশবার বলতে হচ্ছে!”

টুশি এক পা এগিয়ে এসে বলল, “বাজে কথা বললে এক কথা একশবার কেন হাজার বার বলতে হবে।”

টুশির কথা শুনে মানুষটা যন্ত্রণা সহ্য করে কোনোমতে বাঁকা হয়ে টুশির দিকে তাকাল, তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, “মেয়েমানুষ তো, এইজন্যে তেজ বেশি!”

টুশি রেগে গিয়ে বলল, “কী বললে? কী বললে তুমি?”

“আমি কী ভুল বলেছি? এইটুকুন একটা বোতলের মাঝে আমাকে এক হাজার বছর কে আটকে রেখেছিল?”

“কে?”

“আবার কে? একজন মেয়েমানুষ। শাহজাদি দুনিয়া।”

টুশি আর তপু আবার একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারা এখনও ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। টুশি জিজ্ঞেস করল, “তুমি বোতলের মাঝে থাকো?”

মানুষটা রেগে উঠে বলল, “ইচ্ছা করে থাকি নাকি?” বেকায়দা নড়ে উঠে আবার কোথায় জানি যন্ত্রণা করে ওঠে, মানুষটা কাতর শব্দ করে বলল, “ও বাবাগো–গেলাম গো! মরলাম গো!”

টুশি জিজ্ঞেস করে বলল, “বোতলের মাঝে কেন থাকো?”

মানুষটা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “সব শাহজাদি দুনিয়ার কারসাজি। আমাকে ট্রিক্স করে বোতলের মাঝে ঢুকিয়েছিল। আমি বুঝতে পারি নাই”।

 “তার পর থেকে তুমি বোতলের মাঝে থাকো?”

“ইচ্ছে করে কি আর থাকি। আটকা পড়ে থাকি।” মানুষটা একটু নড়ে উঠে আবার যন্ত্রণায় কে কে করে ওঠে। খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, এই মেয়ে আমার পিঠটা একটু ডলে দাও না। প্লিজ!”

টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “তোমার পিঠ ডলে দেব আমি? তোমার তো সাহস কম না–একটু আগে ঐ তরবারি দিয়ে আমাদের মারতে গিয়েছিলে মনে আছে?”

মানুষটা তার লম্বা দাড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে দুর্বলভাবে হাসল, বলল, “আহা হা, তুমি ঠাট্টাও বোঝ না? প্রথম দেখা হলে একটু ভয় দেখাতে হয় না? হাজার হলেও আমি জিন–মানুষকে যদি একটু ভয় না দেখাই” ।

“তুমি জিন?” চিৎকার করে টুশি আর তপু এক লাফে পিছনে সরে যায়। “জিন? তুমি জিন?”

“একশ ভাগ খাঁটি জিন। কোনো ভেজাল নাই।”

টুশি তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না, “তু-তুমি জিন?”

 “হ্যাঁ। আমার নাম কাবিল বিন মুগাবালি মাহিন্দর কোহকাফী।”

“এত বড় নাম?”

“আগে আরও বড় ছিল। শাহজাদি দুনিয়া পুরোটা মনে রাখতে পারত না বলে ছোট করেছি।”

“ছোট করেই এই! নাম হতে হয় দুই শব্দের তা হলে বলা যায়, মনে রাখা যায়।

“ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। আরও ছোট করে দিই।” জিনটা বিরক্ত হয়ে বলল, “কাবিল কোহকাফী। হয়েছে?”

“হয়েছে। কাবিল কোহকাফী।”

“এখন বকবক না করে পিঠটা ডলে দাও। আচ্ছা করে মালিশ করে দাও। যা টাটাচ্ছে সেটা আর বলার মতো না । ভেড়ার চর্বি গরম করে তার মাঝে দুই ফোঁটা তাৰ্পিন দাও। সেখানে এক রতি কর্পূর আর ধানকুচি পাতার রস।”

টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “এইসব আমি কোথায় পাব?”

তপু এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি, এবারে সাহস করে বলল, “আ-আ আব্দুর পা ম-ম-মচকে গিয়েছিল। তখন একটা ম-ম-মলম লাগিয়েছিল। সে-সে সেটা দিয়ে হবে?”

টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হবে। কোথায় আছে?”

“ড-ড-ড্রয়ারের মাঝে।”

 “যা নিয়ে আয়।”

.

একটু পর টুশি সাবধানে কাবিল কোহকাফীর পিঠে সেই ঝাঁঝালো গন্ধের মলম ডলে দিতে থাকে। কাবিলের চোখ আরামে বন্ধ হয়ে আসে, মুখে বলতে থাকে, “আ-হা-হা-! উ-ম-ম-ম-ম! আ-আ-আ–।”

টুশিকে দেখে সাহস পেয়ে তপুও এগিয়ে আসে, সেও টুশির সাথে হাত লাগায় এবং কিছুক্ষণের মাঝে কাবিল কোহকাফী সোজা হয়ে সোফার মাঝে উঠে বসে। দুই হাত উপরে তুলে একটা হুংকার দিয়ে হঠাৎ করে সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ভয়ে আতঙ্কে টুশি আর তপু ছিটকে সরে গেল। তারা ভয় পাচ্ছিল কাবিল কোহকাফী বুঝি তরবারিটি তুলে নিয়ে তাদের দিকে তেড়ে আসবে, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কাবিল কোহকাফী তার বুকে থাবা দিয়ে হঠাৎ করে বিকট গলায় গান গাইতে শুরু করে,

“শাহাজাদী দুনিয়া পেয়ারের মুনিয়া
বুক ভেঙে কই গেলি খুনিয়া
কলিজার টুকরা
ছাতিনার হাড়ি
বাগদাদি কুকরা
ওরে ও শাজহাদী দুনিয়া আ-আ-আ-”

 কাবিল কোহকাফী ঘরের মাঝে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে টুশি আর তপুর দিকে তাকাল, তারপর পেটে হাত দিয়ে বলল, “খিদে লেগেছে।”

টুশি বলল, “খিদে?”

কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। এক হাজার বছর কিছু খাই নাই, মনে হচ্ছে তোমাদের দুইজনকে ধরে কচমচ করে খেয়ে ফেলি!”

“আ-আমাদের?” টুশি এক লাফে দুই পা পিছিয়ে গেল, তপু তার চাইতেও বড় লাফ দিয়ে টুশির পিছনে লুকিয়ে গেল।

কাবিল হাত নেড়ে বলল, “জলদি জলদি খানা লাগাও। শিক কাবাব, বোখরা মিঠাই, তন্দুরি রুটি, বেদানার রস–”

টুশি ঢোক গিলে বলল, “আ-আসলে তো বাসায় খাবার তো সেরকম নেই। একটা বিস্কুটের প্যাকেট–”।

তপু বাধা দিয়ে বলল, “টু-টু-টুশি আপু। খি-খি-খিচুড়িটা দিয়ে দাও।”

 “ও হ্যাঁ।” টুশি মাথা নাড়ল, “একটু খিচুড়ি আছে। তুমি খাবে?”

“খিচুড়ি ঘিচুড়ি ফিচুড়ি মিচুড়ি যা আছে তাই নিয়ে আসো। যত খিদে লেগেছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারি।”

টুশি দৌড়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল, পিছুপিছু কাবিল কোহকাফী ছুটে আসে। ফ্রিজটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “এইটা কিসের বাক্স?”

“এইটা বাক্স না। এইটার নাম ফ্রিজ। এর ভিতরে খাবার রাখে।” টুশি ফ্রিজের দরজা খুলে খিচুড়ির বড় ডেকচিটা টেনে বের করে এনে ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখল। কাবিল ঢাকনা খুলে উল্লসিত চোখে বলল, “মারহাবা! মারহাবা।” হঠাৎ করে ফ্রিজের ভিতরে কাবিল কোহকাফীর চোখ পড়ল, ফ্রিজের দরজায় সাজানো ডিমগুলো দেখে তার চোখ গোল গোল হয়ে ওঠে, চিৎকার দিয়ে বলল, “ডিম! ডিম! ডিম! আহাহা কত দিন ডিম দেখি নাই” সে খাবলা দিয়ে একটা ডিম হাতে নিয়ে সেটাকে চুমো খেতে থাকে।

টুশি বলল, “তোমার ডিম খেতে ভালো লাগে?”

“ডিম আমার জান।” কাবিল কোহকাফী হাত ছড়িয়ে বলল, “ডিম আমার প্রাণ। ডিম আমার চানকে চান, মানকে মান।”

“তোমাকে একটা ডিম ভাজা করে দেব?”

“ভাজা করে ভালো একটা ডিমকে তুমি নষ্ট করতে চাও?” বলে কাবিল কোহকাফী আস্ত একটা ডিম ভেঙে কোঁৎ করে পুরোটা খেয়ে ফেলল।

সুমি কিংবা অপু এর আগে কখনও কাউকে কাঁচা ডিম খেতে দেখে নি, কাবিলকে এভাবে একটা কাঁচা ডিম গিলে ফেলতে দেখে তাদের গা গুলিয়ে আসে।

কাবিল কোহকাফী সবগুলো ডিম কোলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর লাফ দিয়ে উঠে বসল–চেয়ারে বসে যে খেতে হয় ব্যাপারটা সে মনে হয় জানেই না। তার ভারী শরীরের ওজনে মনে হল পুরো টেবিলটা মট মট করে ভেঙে পড়বে– কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ল না। কাবিল একহাত দিয়ে এক খাবলা খিচুড়ি নিয়ে মুখে পারে, অন্য হাত দিয়ে একটা ডিম ভেঙে তার শাস কুসুম মুখে ঢেলে দিয়ে হুম হাম শব্দ করে খেতে থাকে। সারা মুখ থেকে খাবার ছিটকে পড়তে থাকে– তার গোঁফদাড়িতে খিচুড়ি ডিম লেগে কিছুক্ষণেই তার চেহারা কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যায়।

টুশি আর তপু একটা বিস্ময় নিয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এর আগে তারা কখনওই একজন মানুষকে এত তৃপ্তি নিয়ে কিছু খেতে দেখে নি। এক হাজার বছর না খেয়ে থাকলেই বুঝি শুধু মানুষ এত তৃপ্তি করে কিছু খেতে পারে। যে খিচুড়িটুকু আগামী এক সপ্তাহে সবাই মিলে খেয়ে শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় নি কাবিল কোহকাফী একবারে সেটা চেটেপুটে খেয়ে বিশাল একটি ঢেকুর তুলল।

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমার পেট ভরেছে?”

কাবিল কোহকাফী তার বড় পেটে হাত বুলিয়ে বলল, “আপাতত। ফাসক্লাস রান্না। শাহজাদি দুনিয়ার বাবুর্চিও এত ভালো রান্না করতে পারত না। আর তিতির পাখির ডিমগুলিও একেবারে অমৃত–”।

“এগুলো তিতির পাখির ডিম না, এগুলো মুরগির ডিম।”

“মুরগির ডিম? মুরগির আবার ডিম হয় নাকি?” কাবিল কোহকাফী আবার গগনবিদারী একটা ঢেকুর তুলে লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে বলল, “এখন ঘুম।”

টুশি বলল, “ঘুম?”

“হ্যাঁ, এক হাজার বছর ঐ চিপা বোতলের ভিতর আমি আটকা পড়েছিলাম। পেরেছি দাঁড়াতে না পেরেছি বসতে না পেরেছি হাত-পা ছড়িয়ে শুতে।” কাবিল কোহকাফী দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে এক পাক ঘুরে বলল, “আজ আমি দুই : হাত দুই পা ছড়িয়ে ঘুমাব।” কথা বলতে বলতে তার দুই চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। কোনোমতে খোলা রেখে টুশিকে জিজ্ঞেস করল, “বিছানা কোথায়?”

“বিছানা?”

“হ্যাঁ। বালিশ তুলতুলে নরম তো? কোলবালিশ আছে তো? আমি কোলবালিশ ছাড়া কিন্তু ঘুমাতে পারি না।” কাবিল কোহকাফী ঢুলুঢুলু চোখে বলল, “কোথায় বিছানা?”

টুশি কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে বেডরুমে চাচা-চাচির বড় বিছানাটা তার চোখে পড়ল। সে টলতে টলতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল এবং কিছু বোঝার আগেই ধড়াম করে বিছানার মাঝে আছাড় খেয়ে পড়ল। বিছানায় মাথা স্পর্শ করার আগেই সম্ভবত সে ঘুমিয়ে পড়েছিল কারণ এক মুহূর্ত পরেই টুশি আর তপু প্লেনের ইঞ্জিনের গর্জনের মতো তার নাকডাকার শব্দ শুনতে পেল।

টুশি আর তপু কিছুক্ষণ কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার বিশাল পেটটা নাকডাকার শব্দের সাথে সাথে একবার উপরে উঠছে একবার নিচে নামছে। চুল দাড়ি গোঁফে খিচুড়ি আর ডিম লেগে আছে। দুই হাত দুই দিকে ছড়ানো, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জুতো না খুলেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

তপু ফিসফিস করে বলল, “এ-এ-এখন কী হবে?”

 টুশি মাথা চুলকাল, বলল, “পুলিশে খবর দিতে হবে মনে হয়।”

 “পু-পু-পুলিশে? কে-কে-কেন?”

“তা হলে কাকে খবর দেব?”

তপু কোনো উত্তর দিল না, অবাক হয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বলল, “আ-আমি ভেবেছিলাম সত্যিকারের জি-জিন দেখলে ভ ভয় লাগবে। এখন এ-এ-একটুও ভয় লাগছে না।”

“ভয় লাগছে না? এখন যদি চাচা-চাচি আসে? এসে যদি থেকে তাদের বিছানায় খিচুড়ি-মাখা এই জিন এরকম মোটা পেট নিয়ে শুয়ে আছে তখন কী হবে?”

টুশির এই কথা শুনে তপুর মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, “স-স-সর্বনাশ! ত-তখন কী হবে?”

“বলেছেন তো আজ রাত্রে আসবেন না। না আসলেই ভালো। কাল সকালে দেখা যাবে।”

“এ-এখন আমরা কী করব?”

“কী আর করব? ঘুমাব।”

“রাত্রে য-যদি জিন জেগে ওঠে?”

“উঠলে উঠবে। যেভাবে ঘুমাচ্ছে মনে হয় উঠবে না।”

তপু মাথা নাড়ল, যেভাবে গভীর ঘুমে কাবিল কোহকাফী অচেতন হয়ে আছে, আজ রাত্রে তার ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না। রাত্রিবেলা তপু আর টুশির ঘুম হল ছাড়া ছাড়া। একটু পরেপরে তাদের ঘুম ভেঙে গেল এবং শুনতে পেল পাশের ঘর থেকে প্লেনের ইঞ্জিনের মতো শব্দ করে কাবিল কোহকাফী ঘুমাচ্ছে। টুশি কখনও চিন্তাও করে নি যে সে কোনোদিন একটা জিনকে পাশের ঘরে নিয়ে ঘুমাবে! এই জিন নিয়ে যে তাদের কপালে কত দুর্ভোগ আছে তখনও তারা তার কিছুই জানত না।