১৫. বিপত্তি

১৫. বিপত্তি

মন্তাজ ওস্তাদ ছোট গ্রিনরুমটার একপাশ থেকে অন্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ফিনিশ করে দিতে হবে।”

দবির মিয়া তার ঘাড়বিহীন মাথা নাড়ল, বলল, “জে ওস্তাদ। ফিনিশ করে দিতে হবে।”

“একেবারে ফিনিশ না করলে বিপদ। এইটুকুন দুইটা পিচ্চি কিন্তু কী ডেঞ্জারাস . দেখেছিস?”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “অসম্ভব ডেঞ্জারাস।”

দবির মিয়া বলল, “কীভাবে ফিনিশ করবেন ওস্তাদ? গুল্লি?”

“উঁহু।” মন্তাজ ওস্তাদ খুব চিন্তিত মুখে বলল, “এমনভাবে ফিনিশ করতে হবে যেন কেউ সন্দেহ না করে।”

কালাচান বলল, “সেইটা কীরকম?”

“দেখে যেন মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।” “অ্যাক্সিডেন্ট?”

“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এইখানে আজকে যারা শো করছে তারা আসল জিনিস জানে না। আসল জিনিস জানি খালি আমরা কয়েকজন। আর জানে এই দুই পিচ্চি। আসল জিনিস জানাজানি হয়ে গেলে কিন্তু আমরা কোনো বিজনেস করতে পারব না।”

কালাচান আর দবির মিয়া একসাথে মাথা নাড়ল।

“কাজেই এমনভাবে এই দুই পিচ্চিরে মার্ডার করতে হবে যেন কেউ বুঝতে না পারে। সবাই যেন মনে করে অ্যাক্সিডেন্ট।”

“সেইটা কীভাবে করবে ওস্তাদ?”

“এই স্টেজে করতে হবে। সবার সামনে। আজকেই।”

 “আজকেই?”

 “হ্যাঁ। শো শুরু হলেই।”

 কালাচান আর দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কীভাবে করবে ওস্তাদ?”

“দেখি–আমাকে একটু চিন্তা করতে দে।” মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একবার থুতু ফেলে একটা সিগারেট ধরাল। কালাচান আর দবির মিয়া ধৈর্য ধরে ওস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

.

ঠিক এই সময়ে টুশি আর তপু ছোট একটা ঘরে একটা প্যাকিংবাক্সের উপর বসে ছিল। ঘরটিতে কোনো জানালা নেই–নানারকম জঞ্জালে ভরতি। উপরে একটা উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে, সেই আলোতে জঞ্জালভরা এই নোংরা ঘরটাকে দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তপু বলল, “টু-টুশি আপু, এখন কী হবে?”

টুশির নিজেরও খুব ভয় করছিল, কী হবে সে জানে না, এই মানুষগুলো এত খারাপ যে ভয়ংকর কিছু হতে পারে। টুশি অবশ্যি সেটা তপুকে বুঝতে দিল না। বলল, “কী আর হবে, আমাদেরকে কিছুক্ষণ আটকে রেখে ছেড়ে দেবে।”

“য-যদি না দেয়?”

প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন, কিন্তু টুশি হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “না দেবে কেন? কাবিল কোহকাফীর অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমাদেরকে ছেড়ে দেবে।”

তপু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর কা-কাবিল কোহকাফীর কী হবে?”

টুশি একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “দেখিস আমরা ঠিক চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।”

ঠিক এই সময়ে তারা খুব জোরে জোরে একটা বাজনার শব্দ শুনতে পেল, তার সাথে প্রচণ্ড হাততালি। টুশি বলল, “নিশ্চয়ই পরদা তুলেছে।”

.

টুশির ধারণা সত্যি। ঠিক তখন বিশাল লাল ভেলভেটের পরদা টেনে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, ভেতরে আলো-আঁধারের খেলা। স্টেজে গাছপালা এবং পুরনো একটা প্রাসাদের মতো একটা সেট। মাঝখানে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লোহার খাঁচা। ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুজন ছুটে স্টেজে এল, একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। তারা মাথা নুইয়ে অভিভাদন করে বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর সবচেয়ে বিচিত্র এবং সবচেয়ে ভয়ংকর অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। আপনারা এখন দেখবেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে অভাবনীয় সৃষ্টি। অদৃশ্য দানব।”

সবার প্রচণ্ড হাততালির শব্দের মাঝে দুজন কালো পরদাটা সরিয়ে নিতেই বিস্ময়করভাবে সবার হাততালি থেমে গেল কারণ খাঁচার ভিতরে কিছু নেই, শুধু কয়েকটি শিকল ঝুলছে। পুরুষমানুষটি বলল, “আপনারা ভাবছেন এখানে কি সত্যিই কেউ আছে? আমরা যদি দেখতেই না পাই তা হলে বিশ্বাস করব কেমন করে?”

মহিলাটি বলল, “আপনাদের সেই অবিশ্বাস দূর করার জন্যে এই খাঁচার ভেতরে আমরা স্প্রে পেইন্ট করব–অদৃশ্য মানুষের শরীরে সেই ক্ষণস্থায়ী পেইন্ট থেকে আপনারা তাকে দেখবেন–সবচেয়ে ভয়ংকর সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে বিচিত্র এক অদৃশ্য দানব।”

জোরে জোরে বাজনা বাজতে থাকে তখন সুসজ্জিত কিছু মানুষ বাজনার তালে তালে এসে প্রবেশ করে। তাদের পিঠে ব্যাকপেকে পেইন্ট, হাতে স্প্রে করার টিউব। খাঁচার কাছাকাছি এসে তারা ভেতরে উজ্জ্বল লাল রঙের স্প্রে করতে থাকে। হাজার হাজার দর্শক তখন অবাক হয়ে দেখে খাঁচার ভেতরে রক্তের মতো লাল একটি অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই বিচিত্র অবয়ব নড়ছে, ঝাঁঝালো কটু গন্ধের স্প্রে থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে! বাইরে থেকে শেকলে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেই বিচিত্র অবয়বটি সোজা হয়ে দাঁড়াল–লাল রঙের পেইন্টে ঢাকা বিচিত্র ভয়ংকর একটি মূর্তি। হাজার হাজার দর্শক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে তারপর বিস্ময়ের একটা ধ্বনি করে প্রচণ্ড হাততালিতে পুরো হলঘরটিকে কাঁপিয়ে দেয়।

কেউ জানতেও পারল না যে-ভয়ংকর অদৃশ্য দানবকে দেখে সবাই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠেছে, শিকল-বাঁধা অবস্থায় যাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছে সেই দানবটি আসলে ছিল একটি অত্যন্ত দুঃখী প্রাণী–গভীর কষ্টে তখন তার বুকটি ভেঙে যাচ্ছিল। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধের উজ্জ্বল লাল রঙের পেইন্ট ছাপিয়ে তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে আসছিল, কিন্তু কোনো মানুষ তার চোখের সেই অশ্রু দেখতে পাচ্ছিল না।

.

মন্তাজ ওস্তাদ সিগারেটটা পায়ে পিষে বলল, “তা হলে আমার প্ল্যানটা বুঝতে পেরেছিস তো?”

“বুঝেছি ওস্তাদ।”

“ব্যাক স্ক্রিনের মইটা দিয়ে দুইজনকে স্টেজের উপরে তুলে দে। স্টেজ থেকে কমপক্ষে তিরিশ ফুট। তারপর ভয় দেখিয়ে বল স্পটলাইটের র‍্যাকটা দিয়ে স্টেজের মাঝামাঝি যেতে। দরকার হলে ভয় দেখা।”

কালাচান দাঁত বের করে মিহি গলায় বলল, “ওইটা কোনো ব্যাপারই না।”

“তারপর আমরা ভান করব তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। করব উলটোটা, ঝাঁকিয়ে উপর থেকে নিচে ফেলে দেব। খাঁচার ধারালো শিকে গেঁথে যাবে দুইজন। বুঝলি?”

“একেবারে পানির মতন।”

 “যা তা হলে। দেরি করিস না।”

কালাচান আর দবির মিয়া হেঁটে হেঁটে জঞ্জাল রাখার ছোট ঘরটার কাছে গিয়ে সাবধানে ছিটকিনি খুলে ভিতরে উঁকি দিল। টুশির শরীরে হেলান দিয়ে তপু বসে ছিল, দরজা খুলতেই দুজনেই সোজা হয়ে বসল। দবির মিয়া তার গরিলার মতো ভারী শরীরটা ঘরের ভেতরে অর্ধেক ঢুকিয়ে হাত নেড়ে বলল, “আয়।”

টুশি দাঁড়িয়ে বলল, “কোথায়?”

 “নিজেরাই দেখবি কোথায়।”

টুশি আর তপু তবুও অনিশ্চিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, তখন দবির মিয়া ভিতরে ঢুকে খপ করে দুইজনের ঘাড় ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে বলল, “তোদের সাহস খুব বেশি বেড়েছে?”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আমাদের কী করবে?”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে তোদের একটু শিক্ষা দিতে চাই।”

টুশি ভয়ে ভয়ে বলল, “কী শিক্ষা?”

“এমন শিক্ষা যেন জীবনে আর আমাদের সাথে তেড়িবেড়ি না করিস।”

তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “কে-কেমন করে?”

তপুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে টুশি আর তপুর ঘাড় ধরে কালাচান আর দবির মিয়া ততক্ষণে তাদেরকে স্টেজের পেছনে মইটার কাছে দাঁড় করিয়েছে। দুজনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই মইটা দিয়ে উপরে উঠে যাবি, তারপর ঐ যে র‍্যাকটা দেখছিস সেইটার উপর দিয়ে স্টেজের ঠিক মাঝখানে চলে যাবি।

টুশি উপরে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! যদি পড়ে যাই?”

“সেইটাই তোদের শাস্তি। পড়তে পারবি না, পড়ে গেলে নিচের শিকে গেঁথে মরে যাবি। বুঝেছিস?”

তপু মাথা নেড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “আমি পা-পারব না।”

কালাচান কোমর থেকে একটা রিভলবার বের করে তপুর মাথায় ধরে বলল, “না পারলে এখানেই খুন করে ফেলব হারামজাদার বাচ্চা।”

তপু কেঁদে ফেলতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এদের সামনে কেঁদে কোনো লাভ নেই। এরা দয়ামায়াহীন পশু।

কালাচান টুশির ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মইয়ের উপরে ফেলে দিয়ে বলল, “ওঠ।”

দবির মিয়া বলল, “ঐ র‍্যাক থেকে সবগুলো লাইট জ্বলছে–জায়গাটা আগুনের মতো গরম। ঐ গরমে এক ঘণ্টা বসে থাকবি, সেইটা হচ্ছে তোদের শাস্তি।”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “এখন বল, তোরা কী চাস? এখানেই খুন হয়ে যেতে চাস নাকি ঐ র‍্যাকে বসে এক ঘণ্টা শাস্তি ভোগ করতে চাস?”

টুশি বলল, “তারপর আমাদের ছেড়ে দেবে?”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে না দিয়ে কী করব? তোদেরকে কি আমরা সারাজীবন পালব নাকি?”

দবির মিয়া বলল, “লাথি মেরে বিদায় করব যেন আর কখনও আমাদের সাথে লাগতে না আসিস।”

তপু উপরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল “আমার ভয় করছে আপু।”

টুশি মুখে সাহসের একটা ভাব করে বলল, “ভয়ের কী আছে? আমি তোকে ধরে রাখব, আয়।”

কালাচান রিভলবার দিয়ে তপুর পিঠে একটা পুঁতো দিয়ে বলল, “ওঠ।”

তখন প্রথমে তপু তার পিছুপিছু টুশি মই দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে গিয়ে তারা র‍্যাকটার নাগাল পেল। অ্যালুমিনিয়ামের সরু একটা ব্ল্যাক, তার সাথে ব্র্যাকেট লাগানো এবং সেই ব্র্যাকেট থেকে ফ্লাডলাইটগুলো ঝুলছে। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তার ভেতর থেকে আগুনের হলকার মতো গরম বাতাস আসছে–টুশি আর তপুর মনে হতে থাকে তারা বুঝি গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবে।

টুশি আর তপু উপর থেকে নিচে তাকাল, স্টেজের উপর তখন কাবিল কোহকাফীকে দিয়ে একটা নৃশংস খেলা দেখানো হচ্ছে, সে স্টেজ ভেঙে বের হয়ে আসতে চাইছে এরকম একটা কথা বলে তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে খাঁচার মাঝখানে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বলে টুশি আর তপু ভালো করে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পাচ্ছে না–কিন্তু যেটুকু দেখছে সেটা দেখেই কাবিল কোহকাফীর কষ্টে তাদের বুক ভেঙে যেতে লাগল।

টুশি তপুকে বলল, “সামনে যা তপু।”

তপু কোনোরকমে কান্না আটকাতে আটকাতে বলল, “আমার ভ-ভয় করছে। আপু। য-যদি পড়ে যাই?”।

“পড়ে গেলে মরে যাবি তাই খবরদার পড়ে যাবি না। দুই হাতে শক্ত করে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যা। খবরদার নিচে তাকাবি না, নিচে তাকালেই কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যাবি।”

“আমি পা-পারব না আপু।”

নিচে কালাচান রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছে, সেদিকে একনজর তাকিয়ে টুশি বলল, “নিচে বদমাইশগুলো রিভলবার ধরে রেখেছে। পরে গুলি করে দেবে। সামনে আগাতে থাক। আমি তোকে ধরে রাখছি।”

তপু চোখ মুছে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে শুরু করে। র‍্যাকটা প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে স্টেজের দুইপাশ থেকে ঝোলানো, তারা এগুতে শুরু করা মাত্র সেটা বিপজ্জনকভাবে দুলতে শুরু করল। তপু সাথে সাথে বুক লাগিয়ে শুয়ে পড়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। টুশির বুকও ভয়ে ধকধক করতে থাকে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি উপর থেকে নিচে পড়ে যাবে।

দুলুনি একটু কমে আসতেই টুশি আবার তপুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ভয় পাবি না। আর একটু এগিয়ে যা।”

তপু তখন খুব সাবধানে প্রায় বুক আর পেটে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করল। টুশি পিছনে পিছনে যেতে থাকে, নিচে তাকাবে না তাকাবে না করেও হঠাৎ করে নিচে তাকিয়ে টুশির মাথা ঘুরে গেল, একটা আর্তচিৎকার করে সে থেমে যায়। তপু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে টু-টুশি আপু?”

টুশি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু না।”

খুব সাবধানে র‍্যাকটির উপর বুক লাগিয়ে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে দুজনে মাঝামাঝি এসে হাজির হল। নিচে আগুনের মতো গরম বাতাস, মনে হয় সারা শরীর বুঝি পুড়ে যাবে, তাদের মুখ শুকিয়ে যায়, সমস্ত শরীর ঝা ঝা করতে থাকে। তপু বলল, “আপু আর পারি না।”

টুশি বলল, “দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাক। দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কেটে যাবে।”

ঠিক তখন নিচে কাবিল কোহকাফীকে নিয়ে একটা ভয়ংকর খেলা হচ্ছে, মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে কেমন করে একটা অদৃশ্য দানবকে আগুনের হলকা দিয়ে ভয় দেখানো যায়। পুরো ব্যাপারটি আরও ভয়ংকর করার জন্যে আলোর ঝলকানিতে চারদিক ঝলসে উঠছে, কান-ফাটানো ভয়ংকর একধরনের সংগীতে পুরো স্টেজ কেঁপে কেঁপে উঠছে।

হঠাৎ করে সবকিছু থেমে গেল, আলোর ঝলকানিও নেই, ভয়ংকর সংগীতও নেই, চারিদিকে একধরনের সুনসান নীরবতা। সুন্দর কাপড় পরা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কাঁপা গলায় বলল, “উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, একটি অত্যন্ত জরুরি কারণে আমাদের কিছুক্ষণের জন্যে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে হচ্ছে। আমাদের এই অনির্ধারিত বিরতির জন্যে আমরা দুঃখিত। আপনারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা আবার অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব।”

কী হয়েছে অনুমান করার জন্যে হলভরতি সব মানুষ নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। স্টেজের উপর নিরাপত্তা পোশাক পরা কিছু মানুষ এসে টুশি আর তপুর দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে কথা বলতে থাকে। উপস্থাপক এগিয়ে আসে, তাদের সাথে কথা বলে সে উপরে তাকায়, ফ্লাডলাইটের র‍্যাক ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা টুশি আর তপুকে দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে আবার দর্শকদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আমাদের স্টেজে একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা কেউ নিজেদের আসন থেকে উঠবেন না। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা এইমাত্র আমাদের জানিয়েছে একটি ছোট ছেলে এবং একটি ছোট মেয়ে এই স্টেজ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচুতে ঝোলানো একটি র‍্যাকের উপরে উঠে পড়েছে। এই মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে তার পোষা ইঁদুরকে হারিয়ে ফেলেছিল বলে জানিয়েছে, সম্ভবত সে তার পোষা ইঁদুরকে খুঁজতে এই বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে।”

উপস্থিত সব দর্শক আতঙ্কের একধরনের শব্দ করল। উপস্থাপক, বলল, “আপনারা ভয় পাবেন না। শিশু দুজনকে উদ্ধার করার জন্যে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা উপরে উঠে যাচ্ছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন অবুঝ এই দুটি শিশুর এই বিপজ্জনক কাজের জন্যে আমাদের অনুষ্ঠানে এই বিঘ্ন ঘটেছে বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

টুশি এবং তপু উপস্থাপকের কথা শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কী বলছে এই মানুষগুলো–তারা তো এখানে নিজে থেকে ওঠেনি, তাদেরকে এখানে জোর করে তুলেছে। তপু কাঁপা গলায় বলল, “আমাদেরকে এখন কে উদ্ধার ক করবে আপু?”

ঠিক তখন টুশির মাথায় ভয়ংকর একটা চিন্তা এসেছে–সে জোর করে সেই চিন্তাটা দূর করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। শুনলি না–তা-ই তো বলছে।”

“কি-কি-কিন্তু আপু আমরা তো নি-নিজে উঠিনি। এরা মি-মিথ্যা কথা বলছে কেন?”

এরা কেন মিথ্যা কথা বলছে কয়েক সেকেন্ড পরেই টুশি আর তপু বুঝতে পারল। তারা দেখল র‍্যাকের দুইপাশ থেকে কালাচান আর দবির মিয়া উঠে আসছে। তাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসার ভান করতে করতে কালাচান আর দবির মিয়া র‍্যাকটা দোলাতে শুরু করেছে, তাদের দুজনকে উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য। প্রচণ্ড আতঙ্কে তপু আর্তনাদ করে ওঠে, র‍্যাক থেকে সে প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে সরু র‍্যাকটা সে আঁকড়ে ধরল, তার সমস্ত শরীর পিছনে পড়ে গেছে, কোনোমতে শুধু দুই হাত দিয়ে র‍্যাকটা ধরে ঝুলে আছে। তপুকে বাঁচাতে টুশি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল, সে নিজেও তখন তাল সামলিয়ে পড়ে গেল। নিচে খাঁচার ধারালো শিক, ত্রিশ ফুট উপর থেকে পড়লে তারা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। টুশি শেষ মুহূর্তে র‍্যাকটা ধরে ঝুলে পড়ল। উপস্থিত দর্শকেরা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে পেল একটা সরু র‍্যাক থেকে ছোট একটা ছেলে আর মেয়ে কোনোমতে ঝুলে আছে। নিচে একটি খাঁচা–সেই খাঁচা থেকে ধারালো শিক উদ্যত হয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে এই বাচ্চা দুটি পড়ে সেখানে গেঁথে যেতে পারে। দর্শকেরা দেখতে পেল শিশু দুটিকে উদ্ধার করার জন্যে দুই পাশ থেকে দুজন বিশাল মানুষ এগিয়ে আসছে–কিন্তু তারা কাছে আসতে পারছে না। কারণ র‍্যাকটি বিপজ্জনকভাবে দুলছে। কেউ জানতেও পারল না পাহাড়ের মতো এই দুটি মানুষ আসলে বাচ্চা দুটিকে উদ্ধার করতে আসছে না–র‍্যাকটি তালে তালে দুলিয়ে বাচ্চা দুটিকে উপর থেকে ফেলে খুন করার চেষ্টা করছে।

টুশি আর তপু তখন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল–”কা-বি-লি- কো-হ-কা ফী “।

কাবিল কোহকাফী চমকে উঠল। সে হতবুদ্ধি হয়ে এতক্ষণ উপরে তাকিয়ে ছিল, বিস্ফারিত চোখে দেখছিল কী ভয়ংকর অসহায় আর নিরুপায়ভাবে ত্রিশ ফুট উঁচুতে টুশি আর তপু ঝুলছে। সে দেখছিল মুখে কী ভয়ানক একটি জিঘাংসা নিয়ে দুইদিক থেকে কালাচান আর দবির মিয়া র‍্যাকটিকে আঁকিয়ে তাদেরকে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে তপু আর টুশির চিৎকার শুনে কাবিল কোহকাফী থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল তার শরীরের ভেতর যেন কী-একটা ঘটে গেছে। তার মাথার মাঝে যেন ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, সমস্ত শরীরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলতে শুরু করে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ যেন ফেটে গেল, হঠাৎ সে দুই হাত উপরে তুলে ভয়ংকর জান্তব একটা ক্রোধে অমানুষিক গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। হলভরতি দর্শকেরা হতবাক হয়ে দেখতে পেল খাঁচার ভেতরে আটকে-থাকা অদৃশ্য মানবটির সমস্ত শরীর হঠাৎ করে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে তার সমস্ত শরীর ফুলে ফেঁপে উঠছে, তাকে ঘিরে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে শুরু করেছে। সারা শরীর ঘিরে আগুনের ফুলকি ছুটছে। হাতের ঝটকা দিয়ে সেই মূর্তিটি তার শিকল ভেঙে ফেলল, তারপর লাথি দিয়ে খাঁচাটিকে ভেঙে ফেলে। হলঘরের সবাই দেখল তার সমস্ত দেহ ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো বড় হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, গগনবিদারী চিৎকারে সমস্ত হলঘর থরথর করে কেঁপে উঠছে।

টুশি আর তপু নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারল না। হাত ফসকে তারা নিচে পড়ে গেল কিন্তু কাবিল কোহকাফীর বিশাল এক মূর্তি দুই হাতে তাদের ধরে ফেলল। তাদেরকে নিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে সেই বিশাল মূর্তি মঞ্চটিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়–স্টেজের মানুষ ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে থাকে। টুশি আর তপুকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাবিল কোহকাফীর এই ভয়ংকর প্রতিমূর্তি বিকট চিৎকার করতে করতে জ্বলন্ত আগুনের মতো ঘুরতে থাকে তার বিশাল দেহ। থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, ভয়ংকর ক্রোধে তার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে, মুখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে।

উপস্থিত দর্শকেরা এবারে প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে শুরু করল, মানুষের চিৎকার আর হুটোপুটিতে হলঘরের মাঝে একটা নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। টুশি বুঝতে পারল কাবিল কোহকাফীকে না থামালে এখানে একটা ভয়ংকর অবস্থা হয়ে যাবে। মানুষের পায়ের চাপেই কয়েকশ মানুষ মারা যাবে।

টুশি তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, “থামো। কাবিল কোহকাফী তুমি থামো। প্লিজ!”

তপুও চিৎকার করে বলল, “থা-থা-থামো তুমি। থামো।”

 টুশি তপুকে বলল, “বোতলটা দে, তাড়াতাড়ি।”

তপু পকেট থেকে বোতলটা বের করে দেয়, টুশি ছিপিটা খুলে উঁচু করে ধরে বলল, “কাবিল, আসো এখানে। এই বোতলের ভেতরে। এক্ষুনি। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

ছুটোছুটি করতে-থাকা দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখল ভয়ংকর সেই প্রতিমূর্তি হঠাৎ ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে ছোট মেয়েটির হাতে ধরে রাখা বোতলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই ভয়ংকর মূর্তি পুরোটুকু বাধ্য প্রাণীর মতো একটা ছোট মেয়ের হাতে ধরে থাকা বোতলের ভেতরে ঢুকে গেল।

টুশি বোতলটি মুখের কাছে এনে বলল, “থ্যাংক ইউ কাবিল কোহকাফী। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

তারপর বোতলের ছিপিটা লাগিয়ে সামনে তাকাল। কয়েক হাজার নারী-পুরুষ দর্শক হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কারও মুখে একটা কথা নেই, নিজের চোখে দেখেও কেউ এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। টুশি শক্ত করে বোতলটা ধরে তপুকে বলল, “আয় তপু। আমরা যাই।”

“চ-চলো আপু।”

তারা স্টেজ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকে, সব মানুষ সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেয়। টুশি তপুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো তাদের দুজনের দিকে মুখ করে ধরে রেখেছে কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ করল না। অসংখ্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো আর ক্লিক ক্লিক শব্দের মাঝে তারা ছুটতে লাগল। হঠাৎ সাহস করে একজন সাংবাদিক এগিয়ে এসে। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ?”

টুশি আর তপু সাংবাদিকের কথার উত্তর না দিয়ে এবারে ছুটতে থাকে– তাদের পিছুপিছু অসংখ্য সাংবাদিক ছুটে আসছে, তারা চিৎকার করে প্রশ্ন করছে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারা ছুটতে থাকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখে বোতলটাকে যার ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে কাবিল কোহকাফী। তাকে এবারে মুক্ত করে দিতে হবে। চিরদিনের মতো।

১৫. বিপত্তি

১৫. বিপত্তি

১৫. বিপত্তি

মন্তাজ ওস্তাদ ছোট গ্রিনরুমটার একপাশ থেকে অন্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ফিনিশ করে দিতে হবে।”

দবির মিয়া তার ঘাড়বিহীন মাথা নাড়ল, বলল, “জে ওস্তাদ। ফিনিশ করে দিতে হবে।”

“একেবারে ফিনিশ না করলে বিপদ। এইটুকুন দুইটা পিচ্চি কিন্তু কী ডেঞ্জারাস . দেখেছিস?”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “অসম্ভব ডেঞ্জারাস।”

দবির মিয়া বলল, “কীভাবে ফিনিশ করবেন ওস্তাদ? গুল্লি?”

“উঁহু।” মন্তাজ ওস্তাদ খুব চিন্তিত মুখে বলল, “এমনভাবে ফিনিশ করতে হবে যেন কেউ সন্দেহ না করে।”

কালাচান বলল, “সেইটা কীরকম?”

“দেখে যেন মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।” “অ্যাক্সিডেন্ট?”

“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এইখানে আজকে যারা শো করছে তারা আসল জিনিস জানে না। আসল জিনিস জানি খালি আমরা কয়েকজন। আর জানে এই দুই পিচ্চি। আসল জিনিস জানাজানি হয়ে গেলে কিন্তু আমরা কোনো বিজনেস করতে পারব না।”

কালাচান আর দবির মিয়া একসাথে মাথা নাড়ল।

“কাজেই এমনভাবে এই দুই পিচ্চিরে মার্ডার করতে হবে যেন কেউ বুঝতে না পারে। সবাই যেন মনে করে অ্যাক্সিডেন্ট।”

“সেইটা কীভাবে করবে ওস্তাদ?”

“এই স্টেজে করতে হবে। সবার সামনে। আজকেই।”

 “আজকেই?”

 “হ্যাঁ। শো শুরু হলেই।”

 কালাচান আর দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কীভাবে করবে ওস্তাদ?”

“দেখি–আমাকে একটু চিন্তা করতে দে।” মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একবার থুতু ফেলে একটা সিগারেট ধরাল। কালাচান আর দবির মিয়া ধৈর্য ধরে ওস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

.

ঠিক এই সময়ে টুশি আর তপু ছোট একটা ঘরে একটা প্যাকিংবাক্সের উপর বসে ছিল। ঘরটিতে কোনো জানালা নেই–নানারকম জঞ্জালে ভরতি। উপরে একটা উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে, সেই আলোতে জঞ্জালভরা এই নোংরা ঘরটাকে দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তপু বলল, “টু-টুশি আপু, এখন কী হবে?”

টুশির নিজেরও খুব ভয় করছিল, কী হবে সে জানে না, এই মানুষগুলো এত খারাপ যে ভয়ংকর কিছু হতে পারে। টুশি অবশ্যি সেটা তপুকে বুঝতে দিল না। বলল, “কী আর হবে, আমাদেরকে কিছুক্ষণ আটকে রেখে ছেড়ে দেবে।”

“য-যদি না দেয়?”

প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন, কিন্তু টুশি হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “না দেবে কেন? কাবিল কোহকাফীর অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমাদেরকে ছেড়ে দেবে।”

তপু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর কা-কাবিল কোহকাফীর কী হবে?”

টুশি একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “দেখিস আমরা ঠিক চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।”

ঠিক এই সময়ে তারা খুব জোরে জোরে একটা বাজনার শব্দ শুনতে পেল, তার সাথে প্রচণ্ড হাততালি। টুশি বলল, “নিশ্চয়ই পরদা তুলেছে।”

.

টুশির ধারণা সত্যি। ঠিক তখন বিশাল লাল ভেলভেটের পরদা টেনে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, ভেতরে আলো-আঁধারের খেলা। স্টেজে গাছপালা এবং পুরনো একটা প্রাসাদের মতো একটা সেট। মাঝখানে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লোহার খাঁচা। ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুজন ছুটে স্টেজে এল, একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। তারা মাথা নুইয়ে অভিভাদন করে বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর সবচেয়ে বিচিত্র এবং সবচেয়ে ভয়ংকর অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। আপনারা এখন দেখবেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে অভাবনীয় সৃষ্টি। অদৃশ্য দানব।”

সবার প্রচণ্ড হাততালির শব্দের মাঝে দুজন কালো পরদাটা সরিয়ে নিতেই বিস্ময়করভাবে সবার হাততালি থেমে গেল কারণ খাঁচার ভিতরে কিছু নেই, শুধু কয়েকটি শিকল ঝুলছে। পুরুষমানুষটি বলল, “আপনারা ভাবছেন এখানে কি সত্যিই কেউ আছে? আমরা যদি দেখতেই না পাই তা হলে বিশ্বাস করব কেমন করে?”

মহিলাটি বলল, “আপনাদের সেই অবিশ্বাস দূর করার জন্যে এই খাঁচার ভেতরে আমরা স্প্রে পেইন্ট করব–অদৃশ্য মানুষের শরীরে সেই ক্ষণস্থায়ী পেইন্ট থেকে আপনারা তাকে দেখবেন–সবচেয়ে ভয়ংকর সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে বিচিত্র এক অদৃশ্য দানব।”

জোরে জোরে বাজনা বাজতে থাকে তখন সুসজ্জিত কিছু মানুষ বাজনার তালে তালে এসে প্রবেশ করে। তাদের পিঠে ব্যাকপেকে পেইন্ট, হাতে স্প্রে করার টিউব। খাঁচার কাছাকাছি এসে তারা ভেতরে উজ্জ্বল লাল রঙের স্প্রে করতে থাকে। হাজার হাজার দর্শক তখন অবাক হয়ে দেখে খাঁচার ভেতরে রক্তের মতো লাল একটি অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই বিচিত্র অবয়ব নড়ছে, ঝাঁঝালো কটু গন্ধের স্প্রে থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে! বাইরে থেকে শেকলে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেই বিচিত্র অবয়বটি সোজা হয়ে দাঁড়াল–লাল রঙের পেইন্টে ঢাকা বিচিত্র ভয়ংকর একটি মূর্তি। হাজার হাজার দর্শক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে তারপর বিস্ময়ের একটা ধ্বনি করে প্রচণ্ড হাততালিতে পুরো হলঘরটিকে কাঁপিয়ে দেয়।

কেউ জানতেও পারল না যে-ভয়ংকর অদৃশ্য দানবকে দেখে সবাই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠেছে, শিকল-বাঁধা অবস্থায় যাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছে সেই দানবটি আসলে ছিল একটি অত্যন্ত দুঃখী প্রাণী–গভীর কষ্টে তখন তার বুকটি ভেঙে যাচ্ছিল। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধের উজ্জ্বল লাল রঙের পেইন্ট ছাপিয়ে তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে আসছিল, কিন্তু কোনো মানুষ তার চোখের সেই অশ্রু দেখতে পাচ্ছিল না।

.

মন্তাজ ওস্তাদ সিগারেটটা পায়ে পিষে বলল, “তা হলে আমার প্ল্যানটা বুঝতে পেরেছিস তো?”

“বুঝেছি ওস্তাদ।”

“ব্যাক স্ক্রিনের মইটা দিয়ে দুইজনকে স্টেজের উপরে তুলে দে। স্টেজ থেকে কমপক্ষে তিরিশ ফুট। তারপর ভয় দেখিয়ে বল স্পটলাইটের র‍্যাকটা দিয়ে স্টেজের মাঝামাঝি যেতে। দরকার হলে ভয় দেখা।”

কালাচান দাঁত বের করে মিহি গলায় বলল, “ওইটা কোনো ব্যাপারই না।”

“তারপর আমরা ভান করব তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। করব উলটোটা, ঝাঁকিয়ে উপর থেকে নিচে ফেলে দেব। খাঁচার ধারালো শিকে গেঁথে যাবে দুইজন। বুঝলি?”

“একেবারে পানির মতন।”

 “যা তা হলে। দেরি করিস না।”

কালাচান আর দবির মিয়া হেঁটে হেঁটে জঞ্জাল রাখার ছোট ঘরটার কাছে গিয়ে সাবধানে ছিটকিনি খুলে ভিতরে উঁকি দিল। টুশির শরীরে হেলান দিয়ে তপু বসে ছিল, দরজা খুলতেই দুজনেই সোজা হয়ে বসল। দবির মিয়া তার গরিলার মতো ভারী শরীরটা ঘরের ভেতরে অর্ধেক ঢুকিয়ে হাত নেড়ে বলল, “আয়।”

টুশি দাঁড়িয়ে বলল, “কোথায়?”

 “নিজেরাই দেখবি কোথায়।”

টুশি আর তপু তবুও অনিশ্চিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, তখন দবির মিয়া ভিতরে ঢুকে খপ করে দুইজনের ঘাড় ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে বলল, “তোদের সাহস খুব বেশি বেড়েছে?”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আমাদের কী করবে?”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে তোদের একটু শিক্ষা দিতে চাই।”

টুশি ভয়ে ভয়ে বলল, “কী শিক্ষা?”

“এমন শিক্ষা যেন জীবনে আর আমাদের সাথে তেড়িবেড়ি না করিস।”

তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “কে-কেমন করে?”

তপুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে টুশি আর তপুর ঘাড় ধরে কালাচান আর দবির মিয়া ততক্ষণে তাদেরকে স্টেজের পেছনে মইটার কাছে দাঁড় করিয়েছে। দুজনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই মইটা দিয়ে উপরে উঠে যাবি, তারপর ঐ যে র‍্যাকটা দেখছিস সেইটার উপর দিয়ে স্টেজের ঠিক মাঝখানে চলে যাবি।

টুশি উপরে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! যদি পড়ে যাই?”

“সেইটাই তোদের শাস্তি। পড়তে পারবি না, পড়ে গেলে নিচের শিকে গেঁথে মরে যাবি। বুঝেছিস?”

তপু মাথা নেড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “আমি পা-পারব না।”

কালাচান কোমর থেকে একটা রিভলবার বের করে তপুর মাথায় ধরে বলল, “না পারলে এখানেই খুন করে ফেলব হারামজাদার বাচ্চা।”

তপু কেঁদে ফেলতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এদের সামনে কেঁদে কোনো লাভ নেই। এরা দয়ামায়াহীন পশু।

কালাচান টুশির ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মইয়ের উপরে ফেলে দিয়ে বলল, “ওঠ।”

দবির মিয়া বলল, “ঐ র‍্যাক থেকে সবগুলো লাইট জ্বলছে–জায়গাটা আগুনের মতো গরম। ঐ গরমে এক ঘণ্টা বসে থাকবি, সেইটা হচ্ছে তোদের শাস্তি।”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “এখন বল, তোরা কী চাস? এখানেই খুন হয়ে যেতে চাস নাকি ঐ র‍্যাকে বসে এক ঘণ্টা শাস্তি ভোগ করতে চাস?”

টুশি বলল, “তারপর আমাদের ছেড়ে দেবে?”

কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে না দিয়ে কী করব? তোদেরকে কি আমরা সারাজীবন পালব নাকি?”

দবির মিয়া বলল, “লাথি মেরে বিদায় করব যেন আর কখনও আমাদের সাথে লাগতে না আসিস।”

তপু উপরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল “আমার ভয় করছে আপু।”

টুশি মুখে সাহসের একটা ভাব করে বলল, “ভয়ের কী আছে? আমি তোকে ধরে রাখব, আয়।”

কালাচান রিভলবার দিয়ে তপুর পিঠে একটা পুঁতো দিয়ে বলল, “ওঠ।”

তখন প্রথমে তপু তার পিছুপিছু টুশি মই দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে গিয়ে তারা র‍্যাকটার নাগাল পেল। অ্যালুমিনিয়ামের সরু একটা ব্ল্যাক, তার সাথে ব্র্যাকেট লাগানো এবং সেই ব্র্যাকেট থেকে ফ্লাডলাইটগুলো ঝুলছে। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তার ভেতর থেকে আগুনের হলকার মতো গরম বাতাস আসছে–টুশি আর তপুর মনে হতে থাকে তারা বুঝি গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবে।

টুশি আর তপু উপর থেকে নিচে তাকাল, স্টেজের উপর তখন কাবিল কোহকাফীকে দিয়ে একটা নৃশংস খেলা দেখানো হচ্ছে, সে স্টেজ ভেঙে বের হয়ে আসতে চাইছে এরকম একটা কথা বলে তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে খাঁচার মাঝখানে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বলে টুশি আর তপু ভালো করে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পাচ্ছে না–কিন্তু যেটুকু দেখছে সেটা দেখেই কাবিল কোহকাফীর কষ্টে তাদের বুক ভেঙে যেতে লাগল।

টুশি তপুকে বলল, “সামনে যা তপু।”

তপু কোনোরকমে কান্না আটকাতে আটকাতে বলল, “আমার ভ-ভয় করছে। আপু। য-যদি পড়ে যাই?”।

“পড়ে গেলে মরে যাবি তাই খবরদার পড়ে যাবি না। দুই হাতে শক্ত করে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যা। খবরদার নিচে তাকাবি না, নিচে তাকালেই কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যাবি।”

“আমি পা-পারব না আপু।”

নিচে কালাচান রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছে, সেদিকে একনজর তাকিয়ে টুশি বলল, “নিচে বদমাইশগুলো রিভলবার ধরে রেখেছে। পরে গুলি করে দেবে। সামনে আগাতে থাক। আমি তোকে ধরে রাখছি।”

তপু চোখ মুছে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে শুরু করে। র‍্যাকটা প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে স্টেজের দুইপাশ থেকে ঝোলানো, তারা এগুতে শুরু করা মাত্র সেটা বিপজ্জনকভাবে দুলতে শুরু করল। তপু সাথে সাথে বুক লাগিয়ে শুয়ে পড়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। টুশির বুকও ভয়ে ধকধক করতে থাকে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি উপর থেকে নিচে পড়ে যাবে।

দুলুনি একটু কমে আসতেই টুশি আবার তপুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ভয় পাবি না। আর একটু এগিয়ে যা।”

তপু তখন খুব সাবধানে প্রায় বুক আর পেটে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করল। টুশি পিছনে পিছনে যেতে থাকে, নিচে তাকাবে না তাকাবে না করেও হঠাৎ করে নিচে তাকিয়ে টুশির মাথা ঘুরে গেল, একটা আর্তচিৎকার করে সে থেমে যায়। তপু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে টু-টুশি আপু?”

টুশি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু না।”

খুব সাবধানে র‍্যাকটির উপর বুক লাগিয়ে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে দুজনে মাঝামাঝি এসে হাজির হল। নিচে আগুনের মতো গরম বাতাস, মনে হয় সারা শরীর বুঝি পুড়ে যাবে, তাদের মুখ শুকিয়ে যায়, সমস্ত শরীর ঝা ঝা করতে থাকে। তপু বলল, “আপু আর পারি না।”

টুশি বলল, “দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাক। দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কেটে যাবে।”

ঠিক তখন নিচে কাবিল কোহকাফীকে নিয়ে একটা ভয়ংকর খেলা হচ্ছে, মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে কেমন করে একটা অদৃশ্য দানবকে আগুনের হলকা দিয়ে ভয় দেখানো যায়। পুরো ব্যাপারটি আরও ভয়ংকর করার জন্যে আলোর ঝলকানিতে চারদিক ঝলসে উঠছে, কান-ফাটানো ভয়ংকর একধরনের সংগীতে পুরো স্টেজ কেঁপে কেঁপে উঠছে।

হঠাৎ করে সবকিছু থেমে গেল, আলোর ঝলকানিও নেই, ভয়ংকর সংগীতও নেই, চারিদিকে একধরনের সুনসান নীরবতা। সুন্দর কাপড় পরা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কাঁপা গলায় বলল, “উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, একটি অত্যন্ত জরুরি কারণে আমাদের কিছুক্ষণের জন্যে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে হচ্ছে। আমাদের এই অনির্ধারিত বিরতির জন্যে আমরা দুঃখিত। আপনারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা আবার অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব।”

কী হয়েছে অনুমান করার জন্যে হলভরতি সব মানুষ নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। স্টেজের উপর নিরাপত্তা পোশাক পরা কিছু মানুষ এসে টুশি আর তপুর দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে কথা বলতে থাকে। উপস্থাপক এগিয়ে আসে, তাদের সাথে কথা বলে সে উপরে তাকায়, ফ্লাডলাইটের র‍্যাক ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা টুশি আর তপুকে দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে আবার দর্শকদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আমাদের স্টেজে একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা কেউ নিজেদের আসন থেকে উঠবেন না। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা এইমাত্র আমাদের জানিয়েছে একটি ছোট ছেলে এবং একটি ছোট মেয়ে এই স্টেজ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচুতে ঝোলানো একটি র‍্যাকের উপরে উঠে পড়েছে। এই মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে তার পোষা ইঁদুরকে হারিয়ে ফেলেছিল বলে জানিয়েছে, সম্ভবত সে তার পোষা ইঁদুরকে খুঁজতে এই বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে।”

উপস্থিত সব দর্শক আতঙ্কের একধরনের শব্দ করল। উপস্থাপক, বলল, “আপনারা ভয় পাবেন না। শিশু দুজনকে উদ্ধার করার জন্যে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা উপরে উঠে যাচ্ছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন অবুঝ এই দুটি শিশুর এই বিপজ্জনক কাজের জন্যে আমাদের অনুষ্ঠানে এই বিঘ্ন ঘটেছে বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

টুশি এবং তপু উপস্থাপকের কথা শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কী বলছে এই মানুষগুলো–তারা তো এখানে নিজে থেকে ওঠেনি, তাদেরকে এখানে জোর করে তুলেছে। তপু কাঁপা গলায় বলল, “আমাদেরকে এখন কে উদ্ধার ক করবে আপু?”

ঠিক তখন টুশির মাথায় ভয়ংকর একটা চিন্তা এসেছে–সে জোর করে সেই চিন্তাটা দূর করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। শুনলি না–তা-ই তো বলছে।”

“কি-কি-কিন্তু আপু আমরা তো নি-নিজে উঠিনি। এরা মি-মিথ্যা কথা বলছে কেন?”

এরা কেন মিথ্যা কথা বলছে কয়েক সেকেন্ড পরেই টুশি আর তপু বুঝতে পারল। তারা দেখল র‍্যাকের দুইপাশ থেকে কালাচান আর দবির মিয়া উঠে আসছে। তাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসার ভান করতে করতে কালাচান আর দবির মিয়া র‍্যাকটা দোলাতে শুরু করেছে, তাদের দুজনকে উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য। প্রচণ্ড আতঙ্কে তপু আর্তনাদ করে ওঠে, র‍্যাক থেকে সে প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে সরু র‍্যাকটা সে আঁকড়ে ধরল, তার সমস্ত শরীর পিছনে পড়ে গেছে, কোনোমতে শুধু দুই হাত দিয়ে র‍্যাকটা ধরে ঝুলে আছে। তপুকে বাঁচাতে টুশি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল, সে নিজেও তখন তাল সামলিয়ে পড়ে গেল। নিচে খাঁচার ধারালো শিক, ত্রিশ ফুট উপর থেকে পড়লে তারা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। টুশি শেষ মুহূর্তে র‍্যাকটা ধরে ঝুলে পড়ল। উপস্থিত দর্শকেরা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে পেল একটা সরু র‍্যাক থেকে ছোট একটা ছেলে আর মেয়ে কোনোমতে ঝুলে আছে। নিচে একটি খাঁচা–সেই খাঁচা থেকে ধারালো শিক উদ্যত হয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে এই বাচ্চা দুটি পড়ে সেখানে গেঁথে যেতে পারে। দর্শকেরা দেখতে পেল শিশু দুটিকে উদ্ধার করার জন্যে দুই পাশ থেকে দুজন বিশাল মানুষ এগিয়ে আসছে–কিন্তু তারা কাছে আসতে পারছে না। কারণ র‍্যাকটি বিপজ্জনকভাবে দুলছে। কেউ জানতেও পারল না পাহাড়ের মতো এই দুটি মানুষ আসলে বাচ্চা দুটিকে উদ্ধার করতে আসছে না–র‍্যাকটি তালে তালে দুলিয়ে বাচ্চা দুটিকে উপর থেকে ফেলে খুন করার চেষ্টা করছে।

টুশি আর তপু তখন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল–”কা-বি-লি- কো-হ-কা ফী “।

কাবিল কোহকাফী চমকে উঠল। সে হতবুদ্ধি হয়ে এতক্ষণ উপরে তাকিয়ে ছিল, বিস্ফারিত চোখে দেখছিল কী ভয়ংকর অসহায় আর নিরুপায়ভাবে ত্রিশ ফুট উঁচুতে টুশি আর তপু ঝুলছে। সে দেখছিল মুখে কী ভয়ানক একটি জিঘাংসা নিয়ে দুইদিক থেকে কালাচান আর দবির মিয়া র‍্যাকটিকে আঁকিয়ে তাদেরকে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে তপু আর টুশির চিৎকার শুনে কাবিল কোহকাফী থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল তার শরীরের ভেতর যেন কী-একটা ঘটে গেছে। তার মাথার মাঝে যেন ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, সমস্ত শরীরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলতে শুরু করে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ যেন ফেটে গেল, হঠাৎ সে দুই হাত উপরে তুলে ভয়ংকর জান্তব একটা ক্রোধে অমানুষিক গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। হলভরতি দর্শকেরা হতবাক হয়ে দেখতে পেল খাঁচার ভেতরে আটকে-থাকা অদৃশ্য মানবটির সমস্ত শরীর হঠাৎ করে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে তার সমস্ত শরীর ফুলে ফেঁপে উঠছে, তাকে ঘিরে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে শুরু করেছে। সারা শরীর ঘিরে আগুনের ফুলকি ছুটছে। হাতের ঝটকা দিয়ে সেই মূর্তিটি তার শিকল ভেঙে ফেলল, তারপর লাথি দিয়ে খাঁচাটিকে ভেঙে ফেলে। হলঘরের সবাই দেখল তার সমস্ত দেহ ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো বড় হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, গগনবিদারী চিৎকারে সমস্ত হলঘর থরথর করে কেঁপে উঠছে।

টুশি আর তপু নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারল না। হাত ফসকে তারা নিচে পড়ে গেল কিন্তু কাবিল কোহকাফীর বিশাল এক মূর্তি দুই হাতে তাদের ধরে ফেলল। তাদেরকে নিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে সেই বিশাল মূর্তি মঞ্চটিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়–স্টেজের মানুষ ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে থাকে। টুশি আর তপুকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাবিল কোহকাফীর এই ভয়ংকর প্রতিমূর্তি বিকট চিৎকার করতে করতে জ্বলন্ত আগুনের মতো ঘুরতে থাকে তার বিশাল দেহ। থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, ভয়ংকর ক্রোধে তার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে, মুখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে।

উপস্থিত দর্শকেরা এবারে প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে শুরু করল, মানুষের চিৎকার আর হুটোপুটিতে হলঘরের মাঝে একটা নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। টুশি বুঝতে পারল কাবিল কোহকাফীকে না থামালে এখানে একটা ভয়ংকর অবস্থা হয়ে যাবে। মানুষের পায়ের চাপেই কয়েকশ মানুষ মারা যাবে।

টুশি তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, “থামো। কাবিল কোহকাফী তুমি থামো। প্লিজ!”

তপুও চিৎকার করে বলল, “থা-থা-থামো তুমি। থামো।”

 টুশি তপুকে বলল, “বোতলটা দে, তাড়াতাড়ি।”

তপু পকেট থেকে বোতলটা বের করে দেয়, টুশি ছিপিটা খুলে উঁচু করে ধরে বলল, “কাবিল, আসো এখানে। এই বোতলের ভেতরে। এক্ষুনি। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

ছুটোছুটি করতে-থাকা দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখল ভয়ংকর সেই প্রতিমূর্তি হঠাৎ ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে ছোট মেয়েটির হাতে ধরে রাখা বোতলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই ভয়ংকর মূর্তি পুরোটুকু বাধ্য প্রাণীর মতো একটা ছোট মেয়ের হাতে ধরে থাকা বোতলের ভেতরে ঢুকে গেল।

টুশি বোতলটি মুখের কাছে এনে বলল, “থ্যাংক ইউ কাবিল কোহকাফী। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

তারপর বোতলের ছিপিটা লাগিয়ে সামনে তাকাল। কয়েক হাজার নারী-পুরুষ দর্শক হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কারও মুখে একটা কথা নেই, নিজের চোখে দেখেও কেউ এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। টুশি শক্ত করে বোতলটা ধরে তপুকে বলল, “আয় তপু। আমরা যাই।”

“চ-চলো আপু।”

তারা স্টেজ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকে, সব মানুষ সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেয়। টুশি তপুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো তাদের দুজনের দিকে মুখ করে ধরে রেখেছে কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ করল না। অসংখ্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো আর ক্লিক ক্লিক শব্দের মাঝে তারা ছুটতে লাগল। হঠাৎ সাহস করে একজন সাংবাদিক এগিয়ে এসে। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ?”

টুশি আর তপু সাংবাদিকের কথার উত্তর না দিয়ে এবারে ছুটতে থাকে– তাদের পিছুপিছু অসংখ্য সাংবাদিক ছুটে আসছে, তারা চিৎকার করে প্রশ্ন করছে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারা ছুটতে থাকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখে বোতলটাকে যার ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে কাবিল কোহকাফী। তাকে এবারে মুক্ত করে দিতে হবে। চিরদিনের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *