৩.৪ আবার পুজোর ছুটি

আবার পুজোর ছুটি, আবার কলকাতার বাইরে যাওয়ার ধুম। রেলটিকিট এবার যেন অন্যবারের চেয়ে সস্তা। রাস্তায় বেরোলেই চোখে পড়ে পিছনে মাল-বাঁধা ট্যাক্সি। শাশ্বতীর শ্বশুরবাড়ির দল দেওঘর গেছে, শ্বশুরের বাড়ি আছে সেখানে। হারীত-শাশ্বতীরও যাবার কথা ছিল হারীতের ছুটি হলেই, কিন্তু আপিশের শেষ দিনটিতে বাড়ি ফিরে হারীত জানাল, তার যাওয়া হল না। শাশ্বতী বলল–কী হল?

এখানেই থাকতে হচ্ছে আমাকে।

কেন?

অগ্রণী-সংঘের নাম বদলে প্রতিরোধ-সংঘ হল, কিন্তু তাতেই তো হল না, নতুন করে গড়তে হবে সমস্তটা। কথা হচ্ছে কবে থেকেই, কাজ কিছু হয়নি। কিন্তু এখন আর দেরি না। এই ছুটিতেই—বম্বে থেকে ঠান্ডানি আসছেন এইজন্য। এদিকে মকরন্দ চলে যাচ্ছে বিল্লিবকম। তাহলে তুমি কেন যেতে পার না?

সেইজন্যেই। মকরন্দ বড়ো খেটেছে ক-মাস, ডাক্তার বলেছে বিশ্রাম নিতে। ওকে যেতেই হবে। মকরন্দ মুখুয্যের তিন-ডবল তো তুমি খাটো।

তর্ক কোরো না। হারীত কথা বলছিল ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে। প্রথমে কোট খুলে হ্যাঙ্গারে এঁটে ব্রাকেটে লটকাল, তারপর আলনার ধারে এসে জুতো ছাড়ল, টাইটাকে ঝুলিয়ে দিল আলনার গলায়, তারপর টেবিলের ধারে এসে দেখল কোনো চিঠিপত্র আছে কিনা। তার চেয়ারটায় শাশ্বতী বসে ছিল হাতলে হাত রেখে। জিগেস করল—বসবে?

না না, তুমি বোসো। আমি— হারীত আবার চলল বাথরুমের দিকে আমার যাওয়া হল না তা তো দেখছ, তুমি যাও। শেষের কথাটা বলল বাথরুমের দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে। কিন্তু হারীতের কথা শোনার জন্য ঘরের মধ্যে নানা জায়গায় শাশ্বতী তার চোখকে আর পরিশ্রম করাল না।

চা খেতে খেতে হারীত আবার কথা তুলল—আগে জানলে ওদের সঙ্গেই তোমাকে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু ঠাভানির টেলিগ্রাম আজই মাত্র এল। শাশ্বতী বলল—এখান থেকে দেওঘর আমি একাও যেতে পারি।

নিশ্চয়ই! হারীত খুশি হল—দিনের গাড়িতে যাবে, এখান থেকে আমি তুলে দেব, ওখানে ওরা স্টেশনে থাকবে। দল-টদল নেই—মুশকিল আর কী! কবে যেতে চাও? কাল?

আমি যাব না।

যাবে না? কেন?

না যাব না।

হারীত পর-পর তিনটে-চারটে বেগুনি খেয়ে ফেলল। কেন যে এসব মান-অভিমানগুলো এখনও যাচ্ছে না দেশ থেকে! হারীত একদম পছন্দ করে না এসব। শুধু যে পছন্দ করে না তা নয়, এর সামনে পড়লে অসহায় লাগে নিজেকে। কী করতে হবে, বলতে হবে বোঝে না, যেন বোকা বনে যায় আর তাইতে ভিতরে ভিতরে এমন রাগতে থাকে যে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত বিশ্রী হয়ে ওঠে তার জন্যই। রাগের চড়তি মুখটাকে মনে মনে চেপে ধরে নরম সুরে বলল–যাবে না কেন? ভাল লাগবে তোমার, আর শরীরও সারবে।

আমার কি অসুখ নাকি, যে সারবে?

না, না—এই তো একঘেঁয়ে জীবন, আর খাঁচার মতো ফ্ল্যাট-মাঝে মাঝে বাইরে একটু ঘুরে এলে তবু–

মার একঘেঁয়ে লাগে না।

হারীত বিলেতি ধরনে হাতের পাতা উল্টিয়ে বুঝিয়ে দিল এসব বাজে কথার সময় তার নেই। ইংরেজিতে বলল–যা তোমার খুশি। তারপর বাংলায় বলল–আমি শুধু এই বলতে চেয়েছিলাম, যে আমার জন্য তোমাকে আটকে থাকতে হবে না। তুমি স্বাধীন, নিজের ইচ্ছেমত চলবে।

যদি বলি তুমি যাবে না বলেই আমার যাবার ইচ্ছে নেই? হারীত নিচু হয়ে চা খাচ্ছিল, একটানে মুখ তুলল স্ত্রীর দিকে। বাঁকা হেসে জবাব দিল—তাহলে আমি বলব তোমার অসুখ করেছে, আর সে অসুখ সারাবার জন্যই তোমার যাওয়া উচিত। এবার শাশ্বতীও হাসল একটু বাঁকা করে।—আমি গেলেই তুমি যেন খুশি হও?

ও! ঐ একটিমাত্র জোরালো আওয়াজ করেই হারীত তার মনের ভাব ব্যক্ত করল। আবার জুতো-টুতো পরে হারীত পাঁচ মিনিটের মধ্যে বীরদর্পে বেরিয়ে গেল। কোথাও যাবার কথা ছিল না সেদিন; বাড়িতেও কোনো কাজ ছিল না, অনেকদিনের মধ্যে এই একটা সন্ধ্যা কঁকা ছিল তার, আর সত্যি বলতে, মনে মনে সে এ-ই ভেবেছিল যে সন্ধের পর শাশ্বতীকে নিয়ে বেরোবে দরকারি কয়েকটা জিনিস কিনতে নিউ মার্কেট আসবে, শাশ্বতী আবার ভালবাসে নিউ মার্কেটে বেড়াতে। সব ঠিক হয়েও দেওঘরে যাওয়া হল না, এটা শাশ্বতীর খারাপ লাগবে বলেই তার খারাপ লাগছিল, তবে শাশ্বতীর আশাভঙ্গ হবে না, তার যাবার ব্যবস্থা করে দেবে, এমনকি, দুটো দিন ছিনিয়ে তাকে দেওঘরে রেখেও আসবে—এও সে ভেবেছিল মনে মনে। কিন্তু যে রকম ভেবেছিল সে রকম কিছুই হল না। উল্টোটাই হল। তার দোষ? শাশ্বতীর দোষ? হারীত একা-একাই নিউ মার্কেটে এল। নিজের জন্য দুটো গেঞ্জি, ক্যালিকো মিলের আধ-ডজন রুমাল, আর শাশ্বতীর জন্য দুটো রঙিন কাচুলি আর একটা খোঁপার জাল কিনল—এসব আবার বালিগঞ্জে পাওয়া যায় না—আর ফাঁকে ফাঁকে এ-কথাটা ভাবল একটু। না, কারোরই দোষ না, এ-ই নিয়ম। এরকম হয়েছে অনেকবার এর আগে—এরকমই হবে এরপরে অনেকবার, আরো অনেকবার। যা ভাবা যায়, যার জন্য মন তৈরি থাকে, ঠিক তার উল্টোটাই হবার। পর-পর সাজানো আছে সব-গুম হয়ে থাকা, থমথমে হাওয়া, তারপর রাত্রে, কোনো এক রাত্রে সব ভুলে যাওয়া, সব ফিরে পাওয়া। কিন্তু সে আর কতক্ষণ, কমিনিট? তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘু, আর ঘুমের পরে দিন। আর পরের দিনই যদি আবার কিছু ঘটে, তুচ্ছতম কিছু, তাহলে আবার তা-ই, ভাবনার উল্টো, ইচ্ছার উল্টো, মুখ-ভার, মন-ভার, অস্বাস্থ্যকর স্যাঁৎসেঁতে হাওয়া, তারপর আবার রাত্রি। কী ক্লান্তিকর দাম্পত্য!

সে রাত্রেও তাই হল। আর তারপর শাশ্বতী খুব ছোট্টো গলায় বলল—আমি চলে গেলে তুমি খুশি হও?

কী সব বাজে–!

আমি থাকলে তুমি খুশি হও? আমি চলে গেলে তোমার কষ্ট হবে আমার জন্য? হারীত বিছানার মধ্যে নড়ল একটু। কী সব প্রশ্ন-মাথায় একটু মগজ থাকলে কী হয়?

বলো না!

বাজে কথার আমি জবাব দিই নাহারীত এমনভাবে কথাটা বলল যেন উত্তরটা স্বতঃসিদ্ধ, তাই না বললেও চলে। কিন্তু শাশ্বতী তাতে তৃপ্ত হল না। না, বলো। আমি চলে গেলে কষ্ট হবে তোমার? অন্ধকারে শাশ্বতীর চোখ স্পষ্ট দেখতে পেল হারীত। নিজের চোখ বুজে ফেলল, ভাবল মিথ্যে… মিথ্যে না বলিয়ে কিছুতে ছাড়বে না? আর মিথ্যেটা শুনলেই কি খুশি হবে? এড়িয়ে বলল—কর্তব্যের কাছে কষ্টকে আমি গণ্য করি না।

কোনটা তোমার কর্তব্য?

ছুটিতে কলকাতায় থাকা।

আর আমার কর্তব্য দেওঘর যাওয়া?

না, তোমার কর্তব্য এই বলে হারীত সরে এসে স্ত্রীর বালিশে মাথা রাখল। কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারল না শাশ্বতী। প্রায় এক মিনিট পরে নিশ্বাস ছাড়ল, লম্বা নিশ্বাস, সুখের। আর হায়ীতও ছোট্টো, গোপন একটা নিশ্বাস ছাড়ল একেবারে স্পষ্ট মিথ্যেটা বলতে হল না বলে। তার জিতটাকে পাকা করার জন্য ওখানেই শুয়ে থাকল। গুনগুন নরম আওয়াজে শাশ্বতী বলল-দ্যাখো, আমাদের যাওয়া হল না, ভালই হল।

ভাল কেন?

এই সেদিন বদির এ রকম—আর এর মধ্যেই আমরা ফুর্তি করে বেড়াতে যাব–মনটা কেমন লাগছিল আমার। জীবনের উষ্ণতা, পরম উষ্ণতার তলানিটুকু চাখতে চাখতে হঠাৎ বড়দির জন্য একটা বুকভাঙা কষ্ট হল শাশ্বতীর, তার এখনকার এই সুখটাকে যেন অপরাধের মতো লাগল। সুখের সঙ্গে দুঃখ মিলে সুখের স্বাদ বাড়ল। স্বামীর সঙ্গে নিজেকে একেবারে এক মনে হল, যেমন আগে কখনো হয়নি। মুখ-চাপা আবছা গলায় বলল-সত্যি, স্বামী না থাকলে মেয়েদের কিছুই থাকে না। সেই পুরোনো কথা! হিন্দুধর্মের ভূত! কিন্তু তার যুক্তি, তর্ক, আপত্তির তৈরি ফৌজটাকে হারীত হুকুম ছাড়লো না, ঘুম ছড়াচ্ছিল চোখে, তাছাড়া সেই মুহূর্তটিতে তারও অলস লাগছিল, তারও…অলস আর সুখী। ছোট্টো নিশ্বাসের সঙ্গে শাশ্বতীর কথা বেরোল–বড়দির দেওরদের কথা তো শুনেছ? কী যেন একবার শুনেছিল, ঘুমের সিঁড়িতে হোঁচট খেল। হারীত। হ্যাঁ—এ-রকমই তো বলতে বলতে হারীত নেমে এল জাগার সমতলে–হিন্দু বিধবাকে কে না ঠকিয়েছে, মনু-মান্ধাতার আমল থেকে আজ পর্যন্ত। ভূতের ল্যাজে শুড়শুড়ি দেবার সুখটাকেও শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া করল না–আর এই ভাইদের জন্য জামাইবাবু শুনেছি…বৈমাত্রেয় তো, বয়সে অনেক ছোটো, বলতে গেলে বড়দির কাছেই মানুষ তারা। —সেই তো! হারীত কথা বলার জন্য সরে এল নিজের বালিশে।–আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি মানেই তো এই! সকলের জন্য সব করো, নিজের স্ত্রীপুত্র ভাসিয়ে দাও! তবু কি চোখ খোলে আমাদের! প্রমথেশবাবু বোধহয় রেখেও যাননি বেশি কিছু?

সে রকমই তো শুনলাম-শাশ্বতী সরু গলায় কবুল করল, যেন তারই দোষ এটা। হারীত একটু গড়াল, তারপর বালিশের তলায় হাত দুটো ঢুকিয়ে উপুড় হল। এটা তার ঘুমের আগের সবচেয়ে আরামের শোওয়া। শাশ্বতীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল—এত অপব্যয়! হারীতের কথায় অনেকটা সহানুভূতিও ছিল, কিন্তু শাশ্বতীর একটু ব্যথা লাগল। জামাইবাবুর অপব্যয়ের ফলে সেও তো সুখী হয়েছিল কত, আর এই সুখী হওয়া সুখী করাটাই কি পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে? বাবার কাছে যা শুনেছিল তাই শোনাতে চাইল স্বামীকে। খুব নিচু গলায়, যে সুরে কোনো ভদ্রলোকের কোনো গোপন বদভ্যাসের উল্লেখ করে আরেকজন ভদ্রলোক, সে রকম লাজুক সুরে বলল–শুধু অপব্যয় নয়, অনেক দিয়েও দিতেন।

দিয়ে দিতেন!

এই সাহায্য করতেন আর কি অনেককে। অনেক দুঃস্থ পরিবার, গরিব ছাত্র–যে এসে যখন চাইতো—

সেটা তো আরো অপব্যয়! হারীত অস্ফুট হাসল। এত অভাব সংসারে—কতটুকু তার মেটাতে পারে একজন মানুষ? কিছুই হয় না, লাভের মধ্যে সেও গরিব হয়ে পড়ে। এর একমাত্র উপায় হচ্ছে এমন ব্যবস্থা যাতে গরীব কেউ থাকবে না… অবশ্য বড়োলোকও না! কথাটা শেষ করে হারীত ভাবল যে—ব্যাঙ্কে যেটা সে মাসে মাসে জমাচ্ছে, সেটাকে আদ্ধেক করে আর একটা ইনশিওরেন্স পলিসি নিলে হয়। হঠাৎই মরে গেলে কিন্তু ইনশিওরেন্সেই দারুণ লাভ। এর পর শাশ্বতী আর কথা বলল না, চুড়ির রুনঠুন আওয়াজ করে পাশ ফিরল। হারীতও চোখ বুজল, ভাবতে আরম্ভ করল–প্রতিরোধ-সংঘের ব্যাপারে কী-কী করবে। কিন্তু একটু পরে আবার শুনল চুড়ির আওয়াজ। শাশ্বতীর গলা এল-ঘুমোলে?

না–হারীত চোখ বুজেই জবাব দিল। একটু নড়েচড়ে শাশ্বতী বলল–বিজুকেও দু-হাজার টাকা দিয়েছিলেন জামাইবাবু।

বিজনকে? হারীত চোখ খুলে তাকাল—কেন?

বিজু চেয়েছিল আর কি। এতদিন কেউ জানত না, বিজু নিজেই বলে ফেলল সেদিন।

ঘুম ছুটে গেল হারীতের, অনুশোচনার কামড় পড়ল মনে। এত সোজা! তাহলে সেও তো পারত পার্টির জন্য মোটারকম একটা চাঁদা বাগাতে। পার্টির ঠিক নাম না করে একটু ঘুরিয়ে বললেই নিশ্চয়ই দিতেন। ঈশশ—এমন একটা সুযোগ পেয়েও হারাল! ঐ বিজন—তাকে এক কথায় দু-হাজার! আর তার কিনা একবার মনেও হল না কথাটা! লোকটাকে ফ্যাসিস্ট ঠাউরে গর্জাল শুধু! সত্যি—ঠান্ডানির মতো ঠান্ডা মাথা হলে তবে তো কাজ হয়। বিছানায় উঠে বসে হারীত বলল—বিজন করছে কী টাকা দিয়ে?

ওতো বলে ব্যবসা করছে।

কীসের? হারীত এ প্রসঙ্গ ছাড়তে পারল না।

আমি ঠিক জানি না। কী সব যুদ্ধের—

যুদ্ধের? ভাল।

ভাল? এ নিয়ে তো বাবার আর এক অশান্তি—

কেন? ওসব নাকি চুরি-জোচ্চুরির হরির লুঠ? হারীত দরাজ হাসল। অন্ধকারে শাশ্বতী দেখতে পেল তার সাদা দাঁতের সারি। জিগেস করল–তা নয়?

বাবাদের ও-রকম মনে হলেও ছেলেরা কি আর বসে থাকবে? আর যুদ্ধের কাজে সাহায্য করা এখন প্রত্যেকেরই কর্তব্য। রাশিয়াকে বাঁচাতে হবে, যেমন করে হোক! বিজু কিছু একটা করে হিটলারকে হটিয়ে দিচ্ছে, এটা কল্পনা করা শাশ্বতীর পক্ষে শক্ত হল। চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বলল—তুমি বসে আছ কেন? শোও না।

হ্যাঁ, শুই। শুতে-শুতে বলল—বিজু বেশ কাজের ছেলে দেখছি।

সে কি আর এমনি-এমনি—ওকে চালাচ্ছে প্রবীর মজুমদার।

কে? ও—সেই মজুমদার! তাহলে তো স্বাতীর সঙ্গে তার বিয়ে হলে ভালই হত। হল না কেন? কথা শুনে শাশ্বতী স্তম্ভিত হল। একটু পরে বলল—বিয়ে তো দু-জনের। তার মধ্যে একজনের অমত থাকলে কী করে হয়! হারীতের মনে পড়ল, এরকম একটা কথা কবে যেন সে-ই বলেছিল শাশ্বতীকে। তাড়াতাড়ি বলল—তাও তো বটে। স্বাতী আবার বেজায় রোমান্টিক। কবিতা-টবিতা পড়ে। ভাল না।

ভাল না কেন?

প্রশ্নের উত্তর দিল না হারীত। একটু এপাশ-ওপাশ করে স্থির হল বিছানায়, ঘুম-জড়ানো গলায় জিগেস করল-মজুমদারের আর সাড়া-শব্দ নেই?

নাঃ!

আর স্বাতী কী বলে?

কী আবার বলবে! শাশ্বতী পা গুটিয়ে শুলো ঘুমের জন্য তৈরি হয়ে। কাল একবার যাবে?

উঁ?

ও বাড়িতে কাল—

হুঁ।

যাবে?

হ্যাঁ, চুপ করো এখন…বড্ডো–কথা শেষ না করেই হারীত ঘুমিয়ে পড়ল।

শাশ্বতী একা জেগে রইল চোখ বুজে। রাত্রে শুয়ে-শুয়ে এতগুলি কথা স্বামীর সঙ্গে বলল অনেকদিন পর। বোধহয় সেইজন্যই, আর স্বামীর সঙ্গে একটা নতুন, নিবিড় ঐক্যবোধের ফলে চোখে যেন একটুও আঠা ছিল না তার। এতক্ষণ যাদের নিয়ে কথা বলেছে তাদের কথা আবার ভাবল, পর-পর ভেসে উঠল তাদের মুখ বোজা-চোখের অন্ধকারে। বড়দি-জামাইবাবু-বাবাবিজু-মজুমদার-স্বাতী। আর তারপর, যদিও তাকে নিয়ে কোনো কথা হয়নি, তবু সত্যেন রায়কেও মনে পড়ল শাশ্বতীর, ঘুমোবার আগে সত্যেন রায়কেও সে ভাবল একটু।

রাত্রে শেষ যে কথা বলেছিল, বলতে চেয়েছিল, পরদিন সকালে সে-কথাই আবার বলল–একবার যাবে নাকি ও-বাড়িতে?

এখন? তক্ষুনি পৌঁছনো একটা চিঠি পড়তে পড়তে হারীত জবাব দিল।এখন আমাকে ছুটতে হচ্ছে শ্যামবাজার। চিঠিটা খামে ভরে বলল—তুমি যাও।

আমি তো যাবই। রোজই যাচ্ছি।

আমিও যাব, হারীত শ্লাপসা হাসল, কাল—নিশ্চয়ই!

বড়দি আসার পর সেই একদিনের পর তো আর যাওনি। এখন ছুটি হল, গেলে পারো মাঝে মাঝে।

যাব।

বড়দি, মনে হচ্ছে, এখানেই থেকে যাবেন, বলে শাশ্বতী হারীতের দিকে তাকাল, কিন্তু মুখ দেখতে পেল না, কারণ হারীত তখন নিচু হয়ে টেবিলের দেরাজে কী খুঁজছে। নিচু হয়েই জবাব দিল, তাহলে আর তাড়া কী। কথাটা হারীত বুঝল না দেখে শাশ্বতী একটু দেরি করল। দেরাজ থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে যখন সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন আবার বললবাবা বোধহয় বড়দিকে তার কাছেই রাখবেন।

বরাবর?

তাই তো মনে হয়। আর তাই তো ভাল–কী বল?

একটু হেসে হারীত যেন বোঝাতে চাইল এ বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তার মতভেদ নেই। হারীত শুনতে চাচ্ছে না, অন্য কথা ভাবছে, তা বুঝেও শাশ্বতী কথা না বলে পারল না। নিজেই প্রশ্নের জবাব দিল—ভাল বইকি! দেওরদের দয়ার চাইতে হাজারগুণে ভাল। কিন্তু বাবার আর ছুটি হল না। কোথায় এখন পেনশন নিয়ে জিরোবেন, এর মধ্যে কী হয়ে গেল!

শিগগিরই পেনশন?

বাঃ, তোমাকে বললাম না সেদিন—

ও, হ্যাঁ। হয়েই গেছে, না?

তা বলতে পারো। লম্বা ছুটি চলছে এখন, তারপরেই—

তাহলে তো–হারীতের কপালে রেখা পড়তে পড়তে মিলিয়ে গেল, তখনই আলোর দিকটা দেখতে পেল সে। তা পেনশন তো আছে–বসে বসে… তাদ্ধেক মাইনে কম কথা না, আমাদের সব চাকরিতে তো কিছুই নেই—কী যে হবে বুড়ো বয়সে! আর তোমার বড়দিও ওখান থেকে কিছু তো পাবেন?

—কিন্তু দায়িত্ব বাবারই তো, প্রকাণ্ড দায়িত্ব। তাই তো আমি বলি বাবাকে-তুমি ভেবো না, আমরা তো আছি। আমরা মানে এখানে কে-কে, আর আছি অর্থই বা কী, সেটা একটু চিন্তা করে হারীত সাবধানে জবাব দিল—এসব নিয়ে বেশি ভাবাই ভুল, কিছু করবার নেই যখন।

তা কেন? শাশ্বতী তখনই বলল। আমরা যে কাছেই আছি, সুখে-দুঃখে সবটাতেই আছি, এই তো অনেক। আর বড়দির দিকটাও ভেবে দ্যাখো! চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, সেই বাড়ি… সেই সব, তারই সব—আজ হঠাৎ এক কথায় ছেড়ে চলে আসা কি সোজা কথা? স্ত্রীর মুখে আছির ব্যাখ্যা শুনে হারীত আশ্বস্ত হয়েছিল, অমায়িকভাবে বলল—সে তো সত্যি। আর তাই তো ওখানে যেতে কেমন অপ্রস্তুত লাগে আমার। ওসব সান্ত্বনা-টানা আমার আসে না, জানো তে। সান্ত্বনা! শাশ্বতী গম্ভীর হয়েই কথা বলছিল, এবার আরো গম্ভীর হল এর কি কোনো সান্ত্বনা আছে, আর কাকেই বা সান্ত্বনা? দরকার হলে তোমাকেই সান্ত্বনা দিতে পারেন বড়দি। বড়দি আশ্চর্য! হারীত আলগোছে একটু বসেছিল চেয়ারটায়, হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। অনেক হয়েছে গার্হস্থ্য জীবন—এখন পৃথিবী তাকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি বলল—আচ্ছা, চলি। শাশ্বতী বলল–আমিও যাই।

নড়াচড়ার হাওয়া দিল ঘরের মধ্যে। দু-জনে দু-কোণে পরস্পরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে কাপড় পরল। শাশ্বতীর পিছনে দাঁড়িয়ে আলমারির লম্বা আয়নায় চুল আঁচড়ে নিল হারীত। হারীতের মনিব্যাগ থেকে শাশ্বতী কিছু খুচরো নিল তার হলদে হাতব্যাগে। ট্রামস্টপে দাঁড়িয়ে শাশ্বতী জিজ্ঞেস করল তোমার ফিরতে ক-টা হবে?

ঠিক নেই। অনেক ঘোরাঘুরি আছে।

আমি বারোটার মধ্যে ফিরব।

বেশ।

ট্রাম খালি ছিল, পাশাপাশি বসতে পেল দুজনে। হারীত ভাবল-যা ভাবতে গিয়ে কাল রাত্রে বাধা পেয়েছিল—ঠান্ডানি পৌঁছবার আগেই কতটা গুছিয়ে রাখতে পারবে চারদিক; আর শাশ্বতী ভাবল-সেই বড়দির কথাই ভাবল। তারও ভয় ছিল হারীতের মতোই, কিন্তু হারীত তো সেদৃশ্য দ্যাখেনি, বিজুর সেই হাত-পা ছোঁড়া চ্যাঁচামেচির দৃশ্য! এক ঘর স্তম্ভিত মানুষের মধ্যে বড়দিই টেনে তুললেন বিজুকে, হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন, কথা বলে-বলৈ ঠান্ডা করলেনযেন এটা বিজুরই ব্যাপার! ঠিক আগের মতোই—না, ঠিক না—শান্ত, মানুষটা যেন শান্ত হয়ে গেছে মনের মধ্যে, তাছাড়া আগের মতোই। কাছে গেলেই ভাল লাগে—তেমনি–কিন্তু তার কেমন লাগছে কে জানে। আগে ভাবতাম বড়দি খুব সুখী মানুষ, ভরপুর সুখী, আর সেই সুখই চলতে ফিরতে উপচে পড়ে সাবধানে। কিন্তু এখন? নিজে যে সুখী না, সে কি পারে অন্যকে সুখী করতে? না কি নিজের সুখী হবার কথাই নেই এতে? না কি সুখ বলতে যেটাকে ভাবছি… কে জানে!…এই যে এসে পড়লাম। হারীতের কাছে চোখে বিদায় নিয়ে শাশ্বতী নামল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল হারীতের ট্রাম বেঁকে গেল ডান দিকে। প্রতিরোধ-সংঘের খুঁটিনাটিতে ড়ুবে ছিল হারীত, কিন্তু একটু পরে যখন বুড়োমতো একজন লোক পোঁটলা-হাতে তার পাশে বসল, তখন তার শাশ্বতীকে মনে পড়ল। মনে হল, এইরকম একটা ট্রামেই সে শাশ্বতীর সঙ্গে চলেছে কিংবা ট্রেনের কামরায়—লম্বা পথ, স্টেশন কম, মাঝে-মাঝেই এমন হয় যে কামরাটায় আর কেউ থাকে না, তখন বাধ্য হয়েই কাছাকাছি হতে হয় দুজনকে। কিন্তু হারীতের এ-সব ভাবনার শাশ্বতী কিছু জানল না, নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে টালিগঞ্জের ট্রামের জন্য দাঁড়াল।

******

দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখতে পেল সত্যেনকে। সত্যেন লাজুক হেসে উঠে দাঁড়াল।

বসুন, বসুন। আপনি কতক্ষণ?

এই তো।

একা যে? শাশ্বতী এদিক-ওদিক তাকাল। ওরা জানে না?

জানি না।

উত্তরটা মজার লাগল শাশ্বতীর। একটু হেসে —আচ্ছা আমি–বলে পা বাড়াল সে। তার ঘুরে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা, সত্যেন দেখল, কোথায় যেন একটুখানি স্বাতীর মতো। তাড়াতাড়ি বলল-বলে ফেলল—বসুন না এখানে।

বসব? আচ্ছা— একটু দ্বিধা শাশ্বতীর গলায়, সেই সঙ্গে খুশিও। আপনি বসুন! এসব সৌজন্যবিনিময়ের পর দুজনেই বসল, আর তারপর সত্যেন সৌজন্যসূচক প্রশ্ন করল— হারীতবাবু ভাল আছেন?

হ্যাঁ–আমাদের ওখানে আসুন না একদিন–ফশ করে বলে ফেলল শাশ্বতী। আর সঙ্গেসঙ্গে সত্যেন সাড়া দিল নিশ্চয়ই! কবে বলুন? এতটা উৎসাহ শাশ্বতী আশা করেনি, মনেমনে একটু ফাঁপরে পড়ল। এদিকে হারীতের আবার ঠান্ডানি, আর তাকে না জানিয়ে ভদ্রলোককে আসতে বলে কি বিপদে পড়বে আবার? কয়েক সেকেন্ড পরে বলল—আপনি কবে ফ্রি আছেন?

ফ্রি? আমি রোজই ফ্রি। আপনি কি ভাবছেন আমি মস্ত একজন এনগেজমেন্টওয়ালা?

আমিও না। আমার মতে একদিনে একটাই যথেষ্ট।

সত্যেন হঠাৎ একটু লাল হল। শাশ্বতী আড়চোখে সেটা লক্ষ্য করে আবার বলল—সেই একটা অবশ্য খুব মনের মতো হওয়া চাই।

আমার কোনো-কোনোদিন একটাও থাকে না।

সেই আপনার ফাঁকা তারিখের একটাই বলুন আমাকে শাশ্বতী চমৎকার সুযোগ নিল। শাশ্বতীর হাসি-হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যেনের যেন বোকা লাগল নিজেকে, আর সেটাও মনেমনে ভাল লাগল। কিন্তু বাইরে দুটো ভাবই লুকোবার জন্য গম্ভীর হয়ে বলল-এর পরে সবই ফাঁকা তারিখ, আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায়— শাশ্বতী যেন চমকাল একটু। প্র

থমে রাঁচি—

ও, তা-ই বলুন। আমি ভাবলাম..কবে যাচ্ছেন? আগের কথাটার গুরুত্ব বজায় রাখতে হলে এখন খুব কাছের একটা নির্দিষ্ট তারিখ জানাতে হয়, কিন্তু সত্যেনের মুখে কথা জুটল শুধু একটা অস্পষ্ট শিগগিরই। এবার সত্যি তার মন খারাপ হয়ে গেল। ছ-টা দিন কেটে গেল কলেজ ছুটির পর। এবার সে তাক করেছে ছোটোনাগপুর। রাঁচি-তোপচাঁচি-হাজারিবাগ, সেখান থেকে বাসে করে গিরিডি। পরেশনাথ পাহাড়ে উঠবে, পাহাড়চূড়োর ডাকবাংলোয় রাত কাটাবে, সবশেষে মহেশমন্ডায় ক-দিন বিশ্রাম—সেখানে চেনা একজনের বাড়ি আছে—চমৎকার সাজিয়েছিল সব মনে-মনে। এত শুনেছে ও অঞ্চলটার কথা, আর এত ভাল লেগেছিল সেবার দিল্লি থেকে ফেরার পথে সেই পাহাড়ি দেশের ভিতর দিয়ে ঘণ্টা-দুই দুপুর। ট্রেন বোঝাই হয়ে সবাই চলে গেল কলকাতা ছেড়ে, আর এখন এই দুর্গাপূজার কদিন তো শুধু ঢাকঢোলের ডামাডোল—ছি, এ সময়টায় কোনো ভদ্রলোক থাকে কলকাতায়?—থাকে না? এ বাড়ির সবাই তো আছে, থাকে।

আপনারা যাচ্ছেন না কোথাও? বলবার একটা কথা খুঁজে পেল সত্যেন।

আমরা? না আমাদের যাওয়া কি সোজা?

আমার তো সোজা, সত্যেন ভাবল, আমার তো কোনো বাধা নেই। কিন্তু যাচ্ছি না কেন? ছটা দিন কেটে গেল ছুটির! এই পুজোভিড়ের বিচ্ছিরি কলকাতা–ওদিকে টোল-পড়া সবুজ পৃথিবী। রোজ ভাবছি আজ যাব, রোজ ভাবছি কাল। ভাবছি কেন?

******

ছোড়দি! কখন?

এই এলাম। আমাদের যাওয়া হল না রে দেওঘর।

হল না তো? আমি আগেই ভেবেছিলাম—

আমারও বেশি ইচ্ছে ছিল না এবার হারীতের অনুপস্থিতিতে শাশ্বতী স্বচ্ছন্দে স্বীকার করল।—বিশ্রামের দরকার তো হারীতের, কিন্তু তিনি নড়বেন না।

অগ্রণী-সংঘ বুঝি?

অগ্রণী না রে, প্রতিবোধ।

প্রতিরোধ! স্বাতী হেসে উঠল, আর শাশ্বতীও নির্ভয়ে হাসল এই সঙ্গে। দু-বোনের এই কথাবার্তার সময়টুকুতে সত্যেন প্রথমে স্বাতীর তারপর শাশ্বতীর মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু একজনের চোখও যখন তার দিকে ফিরল না, তখন সে উদাসভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। অন্তত চেষ্টা করল ভাবটা যাতে উদাস দেখায়। স্বাতীকে আজ বড্ডো সুখী মনে হল সত্যেনের, ছোড়দিকে দেখে বড্ডো খুশি—এত খুশি হবার কী আছে ভেবে পেল না সে। তার মনে তো সুখ নেই, তার মন তো অবিরত অস্বস্তিতে কাটা হয়ে আছে। দু-বোনের মিলিত হাসির শব্দটাও যেন কাটার মতো তাকে বিঁধল। সে কেন সে কোথায়? এই সকালবেলায় এখানে বসে আছে কেন? আর কিছু কি তার করবার নেই? কেমন করে সময় কেটে যাচ্ছে। ইয়েটসের অ্যালজিটা কিনেছে সেদিন–পাতাও ওল্টায়নি—মম-এর গল্পের বইটারও না—সেটা অবশ্য পথে পড়বে বলেই কিনেছে। সত্যেন নিজেকে দেখতে পেল চলতি ট্রেনের জানলা-কোণে ছোটোগল্পের বই হাতে, আর মাঝপথের ডাকবাংলোর ভোরবেলায় বারান্দায় বসে কবিতার বই… আঃ!—সে যাবে–কাল-হা, কালই—

চলো, ভিতরে চলো– স্বাতী বলল শাশ্বতীকে।

আপনি—শাশ্বতী সত্যেনকে লক্ষ্য করল। স্বাতী বলল-উনি একটু বসবেন— তারপর সত্যেনের দিকে, এই প্রথম তাকিয়ে আবার বলল—একটু বসুন।

আমি–সত্যেন কী যে বলতে চাইল, কিন্তু পরের কথাটা তার মুখ দিয়ে বেরোবার আগেই বোনেরা চলে গেল ভিতরে।

একটু পরে স্বাতী ফিরে এসে সত্যেনের মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়েই একসঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল। আবার যখন চোখাচোখি হল, স্বাতী স্থির চোখে আবছা গলায় বলল—কী? সত্যেন দেখতে লাগল, তার একটু-লাল-হওয়া মুখ, ভিজে ভিজে চিকচিকে চোখ, আর ভিজে ভিজে ঠোঁট দুটির একটু-বাঁকানো ভঙ্গি। রোজ দ্যাখে এ-রকম, তবু কত যেন দেখার বাকি।

আজ যে সকালেই? এবারেও সত্যেন কথা বলল না। ভাবল, এই ছাড়দির সঙ্গে কথা বলছিল আর এই এখন—কত আলাদা এ দুটো। কোনটা বেশি ভাল? দুটোই দুটোর চেয়ে ভাল। স্বাতী বলল-খুব গল্প জমেছিল আপনাদের। আমাদের?

বলেই কথাটার মানে বুঝল। হ্যাঁ—কিন্তু তোমাকে দেখেই তোমার ছোড়দি আমাকে একদম ভুলে গেলেন।

আমি ভাবলাম ছোড়দির গলা না? কিন্তু কার সঙ্গে? এই নির্জলা মিথ্যেটা স্বাতী অক্লেশে উচ্চারণ করল। জানলা দিয়ে রাস্তাতেই দেখেছিল সত্যেনকে–দাদাও ছিল সেখানে, আর দাদাই মিটিমিটি হাসছিল আর বেশি-বেশি কথা বলছিল তার সঙ্গে। কথা কিছু না–এই আরকি… দাদাটা এমন! সত্যি, ছোড়দির গলা! সত্যেন হাসল—আর চোখে দেখলে তো কথাই নেই।

তাই তো দেখলাম— স্বাতী না হেসে জবাব দিল। বাইরে থেকে ডালিম এলো ঘরে। ছোটোমাসি— সত্যেনকে দেখে থমকাল।

এনেছিস? ডালিম গলা নামিয়ে বলল—বিলিতি পেলাম না–লালিমলি।

দেখি।

লম্বা ডালিম একটু আড় হয়ে দাঁড়াল—যাতে সত্যেনবাবুর দিকে পিঠ পিছন-ফেরানোনা হয়, অথচ তিনি দেখতে না পান। এতদিনে তার মাথায় আঁটো কালো টুপির মতো নতুন চুল গজিয়েছে। মৈমনসিং থেকে নতুন করে যে শ্যামলিমা নিয়ে এসেছিল কলকাতার কলের জলে তা ধুয়ে গেছে আবার। মুখের ভাবটা আগের চেয়েও গম্ভীর, কিন্তু গালের এখানে-ওখানে হঠাৎ এক-একটা পাৎলা কোঁকড়া চুল নির্ভুল জানিয়ে দেয় তার অতি তরুণ বয়সটাকে। তার আধখানা মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যেনের মনে পড়ল তারও একদিন ও-বয়স ছিল কিন্তু ও রকম কোনো মাসি ছিল না। স্বাতী ডালিমের হাত থেকে জিনিসটা নিল, উপরের কাগজটা সরিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল একটু। উদ্বিগ্ন চাপা গলায় ডালিম জিগেস করল—ঠিক আছে?

হ্যাঁ।

রং মিলবে তো?

মনে তো হয়।

ঐ রং মেলাবার জন্য কত দোকান সে ঘুরেছে, ভবানীপুরেও না পেয়ে ধরমতলায় চলে যেতে হয়েছিল, এ সব আর বলা হল না, তার পরিশ্রমের আপাতত ঐটুকু মাত্র পুরস্কার নিয়ে সত্যেনবাবুর দিকে একটা দ্রুত কটাক্ষ নিক্ষেপ করে, নিজেই একটু লাল হয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল ভিতরে। স্বাতীর কোলের উপর ছড়ানো সাদা আর ব্রাউন উলের দিকে তাকিয়ে সত্যেন বলল—তুমি বোনো নাকি?

আমি কি আর বুনি—তবে ডালিম ধরেছে তার একটা জম্পর চাই। ব্রাউন উলটাকে তীক্ষ্ম চোখে নিরীক্ষণ করল স্বাতী। নিচু মুখেই আবার বলল-ভালোই হল আমার, ডালিমের তাড়া বড়দির কাছে শেখা হচ্ছে।

মা-র চেয়ে মাসির হাতই বুঝি ওর পছন্দ?

বড়দির বানানো একটা আছে ওর—তবে সাংঘাতিক লম্বা হয়ে গেছে কিনা হঠাৎ। আমি ভাবছি সেইটা খুলে ফেলে—আচ্ছা, হাতের দুটো উল দু-হাতে রেখে স্বাতী মুখ তুলল–আপনার কোন রংটা পছন্দ?

আমি ঠিক—মেয়েদের এ সব বোনা-টোনার ব্যাপারে তার মনের আদিম গভীর অবজ্ঞার চোখে সত্যেন তাকাল, কিন্তু তাকিয়ে দেখতে পেল, স্পষ্ট বুঝল, যে মানবজীবনে এই উলবোনা ব্যাপারটিরও গুরুত্ব কম না।

আমার যেটা পছন্দ ডালিমের কি আর সেটা হবে?

হবে না। ডালিমের আদর্শই তো—সত্যেনবাবু।

স্বাতী নামটা উচ্চারণ করল একটু নিচু গলায়, একটু অস্পষ্ট করে, আর স্বাতীর মুখে নামটা শুনে সত্যেনের প্রায় বিশ্বাসই হল না, যে ঐ সত্যেনবাবু আর কেউ না, সে নিজেই। একটু পরে বলল—তা তো জানতাম না।

বাঃ, ওর প্রাণপণ চেষ্টাই তো…কী রকম কেঁচা ঝুলিয়েছে আর পাঞ্জাবি পরেছে দেখলেন তো, একটুও মানায়নি কিন্তু।

আদর্শমতো চললে উলের জামা কিন্তু পরাই হয় না ওর। স্বাতী কপট সরলভাবে বলল— কেন? আপনি ও-সব পরেন না?

আমি! কপটতা বুঝেও, কিংবা সেইজন্যই, সত্যেনের আত্মসম্মান আহত হল।

পরুন না একটা। বড়দিকে বলব বুনে দিতে? এত সুন্দর বোনেন বড়দি বলে স্বাতী হাত দিয়ে কপাল থেকে চুল সরাল। ধক্ করে উঠল সত্যেনের বুকের মধ্যে। কতবার দেখেছে হাতের ঐ ভঙ্গি, আর যতবারই দেখেছে! কিন্তু ভাল যত লাগল, খারাপও তত লাগল তার। স্বাতীর স্বাধীনতায়, অবাধ সাহসে সে যেন মরমে মরে গেল। আরো, আরো প্রবল, আগের চেয়ে আরো অনেক তীব্র হয়ে তার মনে ফিরে এল চলতি ট্রেন, মস্ত রাত, অচেনা-সবুজ ভোরবেলায় কবিতার বই। কবে যাবে? কাল-কাল কেন? আঙ্গ—আজই যাবে। সত্যেনের নিচু-হওয়া মুখের দিকে একটু ঝুঁকে তাকিয়ে স্বাতী আবার বলল—পরবেন? তাহলে আজই বলি বড়দিকে? সত্যেন মুখ তুলে বলল—না। সত্যেনের ভাবের বদলটা তখন না বোঝার ভান করল স্বাতী। তেমনি সহজ সুরে বলল—আচ্ছা, বোনা তো হোক। যদি আপনার ভাল না লাগে, তখন না হয়–

শোনো—সত্যেনের গম্ভীর গলা স্বাতীর কথায় বাধা দিল—আজ যে সকালেই এসেছি তার কারণ আছে! এসেছি এইজন্য যে পরে আর সময় হবে না। আমি আজই চলে যাচ্ছি। স্বাতী একটু চুপ করে থাকল, তারপর বলল–ও!

রাঁচি এক্সপ্রেসে যাচ্ছি, অকারণে জানাল সত্যেন। প্রথমে রাঁচি যাব—তারপর–

সে-সব আপনার লম্বা-লম্বা চিঠিতেই জানতে পারব আশা করি। সত্যেন বলল আমার চিঠি তোমার ভাল লাগে না, জানি।

লাগে না? এত সুন্দর বর্ণনা আপনার।

সত্যি, চিঠি লিখতে আমি পারি না।

স্বাতী মুখ নামিয়ে উলের বল দুটোকে কাগজে জড়াতে লাগল। একটু অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে সত্যেন নধর বল-দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল। কিন্তু একটু পরেই জড়ানো শেষ হল, সাদা আর ব্রাউন রং আর দেখা গেল না। একটু অপেক্ষা করল–সত্যি যাচ্ছেন? কথা শোনার জন্য, কিন্তু ডালিমের কেনা প্যাকেটটি হাতে করে স্বাতী উঠে দাঁড়াল। সত্যেনও উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। স্বাতী বলল–যাচ্ছেন?

হ্যাঁ—তা—বড়দির সঙ্গে কি দেখা হতে পারে একবার?

বসুন।

আর পরের মুহূর্তেই সত্যেন দেখল সে একা বসে আছে ঘরের মধ্যে। বসে-বসে চেষ্টা করল আজ রাত্রের রেলভ্রমণের কথা ভাবতে ভোরবেলা মুরিতে চাক-ঘণ্টা পরে রাঁচি-খুব উৎসাহ নিয়ে ভাবোর চেষ্টা করল। আর যেই পরদার এ-পাশে শ্বেতার আভাস দেখল শ্বেতা ভাল করে ঘরে আসবার আগেই দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল—বাইরে চলে যাচ্ছি আজ, তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই আপনার সঙ্গে। আজ? পিছন থেকে প্রশ্ন করল শাশ্বতী। সত্যেনের মনে পড়ল একটু আগেই এঁর কাছে সে। অন্যরকম বলেছিল। তাড়াতাড়ি বলল—হ্যাঁ, আজই যাই। ছুটির দিনগুলো নষ্ট হচ্ছে মিছিমিছি কথাটা উপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষে সম্মানের নয় তা বুঝতে পেরে তখনই আবার জুড়ল—ফিরে এসে—যদি তখন আপনার অনুমতি থাকে—একদিন যাব আপনার ওখানে। হারীতের এই অনিশ্চিত ব্যস্ততার মধ্যে সত্যেনকে নিমন্ত্রণ করার প্রশ্ন যে আর উঠল না, শাশ্বতী মনে-মনে তাতে স্বস্তি পেল, কিন্তু মুখে বলল—আমার অনুমতির জন্য আপনার ব্যস্ততা তো দেখতেই পাচ্ছি। পাছে সত্যি যেতে হয়, সে ভয়ে আজই কলকাতা ছাড়ছেন।

শ্বেতা বলল–বসো।

বেশিক্ষণ বসব না।

একটু বসো। সকলে বসবার পর শ্বেতা বলল—দেশে যাচ্ছো বুঝি? ঈষৎ হেসে সত্যেন তার প্রিয় জবাব দিল–দেশ বলে আমার কিছু নেই। শ্বেতাও হাসল কথা শুনে। দেশ কি আর আলাদা কিছু? যার যেখানে স্বজন, সেখানেই দেশ।

স্বজন মানে আত্মীয়?

করুণা ফুটল শ্বেতার চোখে, দেখতে কৌতুকের মতো তুমি বুঝি আত্মীয় ভালবাস না?

কারা-কারা আমার আত্মীয় তা প্রায় মনেই নেই, একটু বাহাদুরির সুর লাগল সত্যেনের কথায়। তাঁরাও খোঁজ-খবর নেন না তোমার?

নীল পরদাটার দিকে এটুকু সময়ের মধ্যে তৃতীয়বার তাকাল সত্যেন। মুহূর্তমাত্র দেরি করে একটু নিস্তেজ গলায় জবাব দিল—খোঁজ-খবর আর কী!

কে আছেন তোমার এখানে?

এখানে? সত্যেন একটু থামল। —এক মামা ছিলেন, তিনি… তিনি আর নেই।

মামিমা? মামাতো ভাইবোন?

তারা আছে।

ক-জন?

শ্বেতার এত খবর জানতে চাওয়ায় সত্যেন অবাক হল। অনিচ্ছায় জবাব দিল—এক বোন, দু-ভাই।

বোন ছোটো?

না, না, মামিমার মেয়েই বড়ো—তার বিয়েও হয়ে গেছে।

এখানেই থাকে?

না। সে থাকে কোথায় না থাকে বুলু? বাজিতপুর? পাবনা? যাকগে—সে পাবনায় থাকে–বলে কথা শেষ করল সত্যেন।

মামিমার কাছে যাও না মাঝে-মাঝে?

হ্যাঁ-না—মাঝে-মাঝে ঠিক না–এই— সত্যেনের গলা মিইয়ে এল শেষের দিকে। এইমাত্র সে বুঝল যে মামিমার কাছে শেষ কবে গিয়েছিল সত্যিই তা মনে করতে পারে না।

মামিমা তো আসেন তোমাকে দেখতে?

না, তিনি ঠিক মানে, অনেক দূরে থাকেন তা, সে-ই বরানগর।…আর সে-ই বরানগর থেকে মামিমার দশ বছরের ছেলে খুঁজে খুঁজে এই টালিগঞ্জে এসেছিল একদিন, টুকরো কাগজে জোলো কালিতে দশটা টাকা চেয়েছিলেন মামিমা। টাকা সে তক্ষুনি দিয়েছিল, আর বলে দিয়েছিল মা-কে বোললা আমি শিগগিরই একদিন যাব। আর তারপর কতদিন কেটে গেল!

এর পরে শ্বেতা বলল—এক মামাই তোমার?

হ্যাঁ। সত্যেন ওখানেই থামতে চেয়েছিল, কিন্তু ইচ্ছাকে ডিঙিয়ে তার ভিতর থেকে যেন অন্য কেউ কথা বলে ফেলল—বড়ো ভাল মানুষ ছিলেন মামা-আর অনেকটা অল্প বয়সেই–নিজের কথাটা নিজের কানে শুনতে পেয়ে সত্যেন প্রায় জিভ কামড়ে থেমে গেল। এসব কেন বলছে আর কাকে বলছে? যে নিজেও…আর এই সেদিন! প্রমথেশবাবুর গোলগাল হাসিমুখটা একবার মনে পড়ল তার, সেই সঙ্গে মামাকেও মনে পড়ল—ভালবাসতেন তাকে, খুব টানাটানির সংসারেও বাড়িতে আর হৃদয়ে একটু জায়গা রেখেছিলেন তার জন্য–তারপর তার অসতর্কতার পরিণাম দেখার জন্য একটু ভয়ে-ভয়ে শ্বেতার মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু শ্বেতা জিগেস করল—কী করতেন তিনি?

মামা? স্কুলমাস্টার ছিলেন। আর তাই মামিমা এখন বলতে বলতে আবার থেমে গেল সত্যেন—সত্যি, কী কষ্টে পড়েছেন মামিমা। বরানগরে ঐ একটা বস্তিপাড়ায়–!

বড়ো ছেলে কত বড়ো?

বড়দির মুখে সত্যেন দেখল যে কথা সে বলেনি তা তিনি বুঝেছেন। খুব ছোটো না— সে যেন আশ্বাস দিল নিজেকেই-বড়োটি একটা কাজও পেয়ে গেছে। কিন্তু কী বা কাজ-কারখানায়। মজুর খাটা! আর যে বয়সে কলেজে পড়ার কথা সে বয়সেই! কী হবে এদের? তবু… এই তবৃটা যেন তার নিজের কোনো কিছুর সাফাই—ওদের কথা ভাবলেই খারাপ লাগে। আর যা-ই হোব, পড়াশুনা তো হল না! শেষের কথাটায় এমন সত্যিকার দুঃখের সুর লাগল যে সত্যেনের মুখটা অন্যরকম দেখাল মুহুর্তের জন্য। শাশ্বতী—এতক্ষণ সে চুপ করে শুনছিল কথাবার্তা—একটু অবাক হল, ঐ একটা কথায় ইস্ত্রি করা ভদ্রতা পেরিয়ে সত্যেনের ভিতরকার মানুষকে সে যেন দেখতে পেল, ঐ একটা মুহূর্তে অনেক বেশি চিনে ফেলল তাকে। আর, বড়দির কাছে এলেই কেন ভাল লাগে তাও বুঝল সঙ্গে সঙ্গে। বড়দি নিজের কথা বলেন না, অন্যজনের বিষয়েই কথা বলেন—যেন সকলের জীবনেই তারও কিছু অংশ আছে-আর এটাই তার স্বভাব, যেমন সুখের সময়ে, তেমনি দুঃখের দিনেও, আর এজন্যেই দুঃখী মানুষ তাকে মনে হয় না কখনো এখনো। শাশ্বতী আর একবার তাকাল সত্যেনের ঈষৎ-লজ্জা-পাওয়া মুখের দিকে, দৈবাৎ সত্যেনও তাকাল তখন-ত্ৰস্তে চোখ সরিয়ে নিল। সেও বুঝল এখন তাকে অন্যরক দেখাচ্ছে এঁদের চোখে, যে রকমটা সে দেখাতে চায় না, লুকোতে চায়, লজ্জর ভাব ছড়াল তার মুখে। তার অভ্যাস, তার চেষ্টা কোনো কাজে লাগল না, যা বলতে চায়নি, চায় না, কখনো কোথাও বলে না, তাই বলে ফেলল…! কখনো কোথাও বলে না? কিন্তু আর কোথাও, আর কখনো কেউ শুনতে চেয়েছে এসব? নীল পরদা নড়ল, ঘরে এল আতা। চা-বাসন-সাজানো একটি পিতলের ট্রে সাবধানে দুহাতে ধরে সে ঘরে এল। মুখ নিচু রেখে টিপিটিপি পায়ে এগিয়ে এসে মাঝের গোল টেবিলে ট্রেটা নামাল, তার পরেই ক্ষিপ্রতর গতিতে অন্তর্হিত হল আবার পরদার ওপারে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, তাতা বিদ্যুতের মতো ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ল মার গায়ের উপর। তার বাবরি চুলে হাত রেখে শ্বেতা বলল—কী রে?

ম্‌মা–

কী?

মা–! তাতা মার কোলে মুখ ঘষল দু-বার।

মেয়ের মাথাটি দুহাতে তুলে ধরে নিজের মুখ তার কাছে নামিয়ে শ্বেতা বলল–কী? চুপিচুপি বল…উঃ…ও, বুঝেছি। হ্যাঁ, খুব দোষ হয়েছে দিদির… আমি বকে দেব। শাশ্বতী বলল–দিদি চায়ের ট্রে এনেছে, তাই বুঝি?

সত্যি তো, ও বুঝি আর পারত না আনতে? দিদির চেয়ে ভালোই পারত। তা তুমি এক কাজ করো, খুব ভাল ভাল মশলা নিয়ে এসো তো একটা প্লেটে সাজিয়ে। আর ছোটোমাসিকে এখানে আসতে বলো।

ছোটোমাসি রাগ করেছে।

রাগ করেছে? কেন?

দিদির উপর রাগ করেছে। শোনো মা, আগে চা দিয়ে পরে তো গরম জল ঢালতে হয়এ আর কে না জানে? আর দিদিটা এমন—

সত্যি দিদি কিচ্ছু পারে না! ছোটোমাসিকে বল গিয়ে এখন আর রাগ করতে হবে না—মা তোমাকে ডাকছেন। তাতা খুশি হয়ে বাবরি দুলিয়ে চলে গেল, যেতে যেতে এক পলক বাঁকা-চোখ হানল সত্যেনের দিকে। শাশ্বতী বলল—ওদের তুমি কী আদরটাই দিতে পারো, বড়দি!

তোর মনে পড়ে, শাশ্বতী–একটু পরে শ্বেতা বলল–স্বাতী ঠিক এরকম করত তোর সঙ্গে? শুধু আমার সঙ্গে?

মেজদি-সেজদিকেও কম জ্বালিয়েছে স্বাতীটা!

তাতার খুব ইচ্ছে— সত্যেনের দিকে তাকাল শ্বেতা-তোমার সঙ্গে ভাব করার, কিন্তু লজ্জা ভীষণ। আতাও… দেখলে-না কোনোরকমে ট্রেটা নামিয়েই পালাল!

******

এতক্ষণ এ ঘরে যা কিছু হচ্ছিল তা সত্যেনকে প্রায় একটা আবিষ্টতার মধ্যে টেনে এনেলে, শ্বেতার শেষ কথাটা যে তাকেই বলা, তা বুঝতে একটু দেরি হল তার। আস্তে আস্তে বলল–আমার অনেক দোষের মধ্যে এও একটা যে ছোটোদের সঙ্গে ভাব জমাতে আমি মোট পারি না। বলে চোখ নামাল শ্বেতার দুটি সাদা পায়ের দিকে। কৌতুক ছিল না কথাটায়, সত্যি তখন তার মনে হচ্ছিল জীবনের অনেক কিছুই সে জানে না, বোঝে না, পারে না…।

চা-টা বোধহয়–শাশ্বতী টি-পটের দিকে তাকাল।–এই যে স্বাতী। আয়, চা ঢাল। তুমি থাকতে আমি কেন? শাশ্বতী হাসল—তাতা ঠিকই বলেছিল! সত্যি রেগে আছিস! শ্বেত বলল—দেখলি তো, স্বাতীই এখনো ছেলেবেলার অভ্যেস ছাড়তে পারল না, আর তাতা তো তাতা!

আচ্ছা আমিই ঢালি, শাশ্বতী এগোলক-চামচ চিনি আপনার?

স্বাতী ওসব জানে ঠিক, বলল শ্বেতা–ও তুই ওকেই দে।

ওকেই তো বলছি— শাশ্বতী সরে এল। কিন্তু স্বাতী একটু দুরে বসল।

স্বাতী, আয়! ডাকল শ্বেতা।

স্বাতী উঠল, কোনো কথা না বলে কাছে এসে চা ঢালল নিচুমুখে। চায়ের খয়েরি রংটাকে দুধ কেমন আস্তে আস্তে সোনালি করে দেয়, সেইটে দেখতে দেখতে নিজের মুখের রংটা লুকোবার চেষ্টা করল। সত্যেন বোধহয় চায়ের রং দেখছিল, কিন্তু এক পেয়ালা ঢেলেই স্বাতী যখন টেবিলটা আস্তে একটু ঠেলে দিল তার দিকে, তখন চোখ তুলে, চোখ সরিয়ে বললআর কেউ–আপনারা—আপনি, মিসেস নন্দী?

আপনার মুখে মিসেস নন্দীটা কিন্তু ভাল শুনলাম না।

তাহলে-–শাশ্বতী দেবী?

একেবারে দেবী? শাশ্বতী হাসল।

কেনই বা ওসব হাঙ্গামা! তুমি ওকে ছোড়দিই ডেকো শ্বেতা খুব সহজে সমস্যার সমাধান করে দিল।

ঐ আমার আরেক দোষ, শ্বেতা-শাশ্বতীর মাঝামাঝিতাকাল সত্যেনও ডাক-টাক আমার আসে না। তাছাড়া বয়সে তো আমিই বড়ো।

কত আর বড়ো?

সেটা বলতে হলে একটা নিষিদ্ধ প্রশ্ন করতে হয়।

শাশ্বতী বলল—আমার চব্বিশ। আপনার?

আমার ছাব্বিশ। চব্বিশে আর ছাব্বিশে কি তুলনা হয়?

মেয়েদের চব্বিশে আর পুরুষের বত্রিশেও তুলনা হয় না।

হারীতবাবুর বয়স বুঝি বত্রিশ? শ্বেতা হেসে ফেলল কথা শুনে, শাশ্বতী লাল হয়ে হাসল, স্বাতীও একটু না হেসে পারল না। শ্বেতা বলল—তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাও।

একেবারে একাই খাব? বড়দি একটু বলুন না ওঁকে সত্যেন চোখ দিয়ে শাশ্বতীকে দেখাল। শাশ্বতী হেসে উঠে বলল—এই না বললেন আপনার ডাক-টাক আসে না।

আসে না মানে কি আর—সত্যেনের লাল হওয়া মুখ থেকে শ্বেতা চোখ সরিয়ে আনল।–শাশ্বতী খা না একটু চা। স্বাতী, তুই–

না—এতক্ষণে একটি কথা উচ্চারণ করল স্বাতী।

আমরা অবশ্য তেমন চা-পিয়াসি নই, তবে… আচ্ছা, স্বাতীর হাতের চা খাওয়া যাক একটু শাশ্বতী তার চেয়ারটা সরিয়ে আনল—বড়দি, তুমি সত্যেনবাবুকে কিছু খেতে বল।

না—না—আর কিছু না। শুধু-শুধু চা-ই ভাল লাগে আমার। শ্বেতা বলল–থাক, ইচ্ছা না হলে খেয়ো না।

আমি আবার শুধু চা খেতে পারি না বলে শাশ্বতী হাত বাড়িয়ে একখানা বিস্কুট নিল। শাশ্বতীর হাতে ধরা বিস্কুটটার চেহারা হঠাৎ খুব ভাল লেগে গেল সত্যেমের, নিজেও নিল একটা। তারপর-যদিও মিষ্টিতে তার ঘোর অভক্তি-কথা বলতে বলতে একটা সন্দেশও খেয়ে ফেলল, আর চায়ের পরে—যদিও কোনো কিছু দিয়েই মুখের চায়ের স্বাদ নষ্ট করা তার পছন্দ না—লজ্জাজড়োসড়ো তাতার হাত থেকে মশলা নিয়েও মুখে দিল। শুধু তা-ই নয়, চুলে হাত রেখে মুখ কাছে নিয়ে—নিজেও অবশ্য জড়োসড়োভাবে–তাতাকে একটা বা! পর্যন্ত বলল। আর সঙ্গে-সঙ্গে এ কথাটা তার মনে হল যে আত্মীয়তাকে মুখে সে এত অবজ্ঞা করে, তারই রস এখানে বসে বসে ভোগ করছে সে। তারপরেই ভাবল, কিন্তু এখন আর বসে থাকার কোনো কারণ থাকল না, এখন যেতেই হবে।-আচ্ছা, যাই। সে চায়নি, তখনই বলতে চায়নি, কিন্তু কেউ যেন ঠেলে বের করে দিল কথাটা তার মুখ দিয়ে। আর বলা যখন হয়েই গেছে উঠতেই হল। শাশ্বতী বলল—তাহলে আজই যাচ্ছেন? তা-ই তো, আজ তো সে যাচ্ছে! কোথায় না? হ্যাঁ, রাঁচি। আজই যাচ্ছি। একটু কড়া শোনাল সত্যেনের গলা।

কবে ফিরবেন?

ছুটি ফুরোলে। একটু আগে উচ্ছল ছিল যে মানুষটা, সে হঠাৎ কঠোর গম্ভীর স্বল্পভাষী হয়ে গেল। —আপনাদের ছুটি তো লম্বা। শাশ্বতী আর একটু কথাবার্তার চেষ্টা করল—আর দুচারদিন পরে গেলেও—

সে আর হয় না— সত্যেন পাতলা একটু হাসি ফোঁটাল ঠোঁটে। শ্বেতা বলল—সত্যি তো, যাওয়া যখন স্থির করেছ..। ব্যাপারটাতে কোথাও যাতে ফাঁক না থাকে, সত্যেন তাই আলাদা করে শ্বেতার আর শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল—ফিরে এসেই দেখা করব আপনাদের সঙ্গে। আচ্ছা যাই— শেষের কথাটা বলে—এতক্ষণে, এতক্ষণ পরে-স্বাতীর দিকে চোখ ফেরাল, যেন এইমাত্রই তার মনে পড়ল যে দিদি দু-জন ছাড়া আরো কেউ ঘরে আছে। শেষ বিদায়টা সে নিয়েছিল দরজার কাছে, তার সামনে শাশ্বতী, একটু পিছনে তাতার হাত ধরে শ্বেতা, আরো একটু পিছনে… বড়দির অর্ধেক আড়ালে স্বাতী। সে তাকাতে স্বাতী একটু সরে এল, ফিরে তাকাল। আর রাস্তায় এসে সত্যেনের মনে হল স্বাতীর সেই দৃষ্টি শেষ হয়নি, এখনো চলছে, আসছে তার পিছনে, সঙ্গে সঙ্গে ক্রুর মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এইমাত্র ঢুকে গেল তার শরীরে। প্রায় কষ্টের মতো লাগল তার, শরীরের কষ্ট, কষ্টে প্রায় চোখে জল এল। দ্রুত হাঁটল, দ্রুত এল ট্রাম-রাস্তায়, ট্রামে উঠে বসল হাজরা-মোড়ে রাঁচির টিকিট কিনবে বলে।

******

ভিতরে এসে স্বাতী ডাকলোটন! লোটম কাছেই ছিল, ডাক শুনে ছুটে এল হামাগুড়ি দিয়ে। চল-স্নান! মাসির কাছে স্নান করবি না?

মাসির হাঁটুর কাছের কাপড় ধরে লোটন টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। মুখ তুলে চকচকে চোখে আওয়াজ ছাড়ল-মাতি-ই! তা–ন। বলতে বলতে দুই ছড়ানো হাতে চাপড় দিল মাথায়, অল্প ভাষা তাতে পুষিয়ে বেশি হল, কিন্তু এমন বেগ দিল যে দাঁড়ানো থেকে ধপাশ হল মেঝের উপর। স্বাতী হেসে উঠে বলল-মাসির কাছে তো? বসে-বসে হাত বাড়িয়ে দিল লোটন–মাতি! কোয়ে?

না, কোলে নয়! স্বাতী কয়েক পা পিছনে সরল। চলে এসো হেঁটে-হেঁটে.. এসো! লোটন নাকি সুরে গলা চড়াল—কোঞে!

আচ্ছা কোলে নেব—আগে বলো কার কাছে স্নান করবে!

ম্‌মা—

মা! তা-আ-আ হলে তোমার সঙ্গে আড়ি! স্বাতী গাল ফুলিয়ে চোখ ঘোরাল। —মাতি-ই-ই। ই টাকে টানতে গিয়ে লোটনংকান থেকে কান পর্যন্ত ঠোঁট দুটোকে ছড়িয়ে দিল, বুড়বুড়ি উঠল তার, চোখ গোল-গোল হল। না! তোমার সঙ্গে আড়ি! স্বাতী ভুরু বাঁকাল, মুখ ফেরাল। নে রঙ্গ রাখ—শ্বেতা হাসল। আর ঐ তো এক রঙ্গ রোজ-রোজ! এবার চোখ বড়ো করে ধমকের সুরে স্বাতী বলল–ঠিক করে বলো কার কাছে স্নান করবে! মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল লোটন।

মা-র কাছে? লোটন জোরে মাথা নাড়ল, যেমন করে মানুষ না বলে।

মাসির কাছে তো? তেমনি করেই আরো জোরে মাথা নাড়ল লোটন।

দূর বোক। কিছু পারিস না এখনো! স্বাতী রাজি হওয়ার মাথা-নাড়া দেখাল আর লোটন তক্ষুনি সেটা শিখে নিয়ে সেই যে দম-দেয়া পুতুলের মতো মাথা নাড়তে লাগল, সে আর থামেই না। হয়েছে, হয়েছে, আর না। এবার চলো… তান! স্বাতী কোমরে আঁচল জড়িয়ে তৈরি হল। বড়দি! সত্যি দেখি স্বাতী ওকে নিয়ে চলল–ব্যস্ত হল শাশ্বতী। শেতা বলল মেয়েটাও কম না! আর কাউকে যে চেনেই না এখন।

আর স্বাতীর ভাবটা! সত্যি যেন পাররে স্নান করাতে! শাশ্বতী হাসল।

করায় তো দেখি মাঝে মাঝে। পারে?

স্বাতী পারে? ঠিক এ সময়টায় শাশ্বতী এল অনেকদিন পর, ব্যাপারটা তাই তার কাছে নতুন। পারি কিনা দ্যাখো! বলে স্বাতী লোটনকে পিঠে নিয়ে চলে এল ভিতরদিকের বারান্দায়। শাশ্বতী নিজে কোনো শিশুকে নাড়াচাড়া করেনি—করতে হয়নি এখনো—তাই বড়দির নিশ্চিন্ত ভাব দেখেও তার অবিশ্বাস ঘুচল না।

ভাল করলে না বড়দি, ওর একটা হাত-পা না ভেঙে ফেলে স্বাতী।

আরে না!

চলো, দেখি—শাশ্বতী বারান্দায় এলো, শ্বেতাও এল একটু পরে। ততক্ষণে স্বাতীর দুই সহকারিণী মহা উৎসাহে লাফাতে লেগেছে। আতা একটানে খুলে ফেলেছে লোটনের গায়ের ফ্রক, তাতা একছুটে নিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে সাবান-তোয়ালে-তেলের বাটি, আর তাদের সোর শুনে ছোটন হাপ্ল্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মজা দেখতে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাতীর গা ঘেঁষে উদাসভাবে হেঁটে যেতে যেতে বিজন বলল কী রে, চলে যাচ্ছে নাকি আজ? স্বাতী না শোনার ভান করল। একটু দূরে সরে, ঠিক স্বাতীর দিকে না তাকিয়ে বিজন আবার বলল—সত্যি যাচ্ছে নাকি? কী বলছিস তুই! স্বাতী অর্ধেক চোখ তুলল বিজনের দিকে।

সত্যেন নাকি চলে যাচ্ছে?

চলে আবার যাবে কোথায়? মনের কথাটা স্বাতী প্রায় মুখেই বলে ফেলেছিল, সামলে নিয়ে বলল–তুই আজকাল বড়ো বাড়ি থাকিস, দাদা?

শ্বেতা বলল, বেচারা! বাড়িতে থাকে-না বলেও বকুনি খায়, আবার থাকলেও কেউ খুশি না। দেখলে তো বড়দি! ছুটির দিনেও যে নিশ্চিন্তে জিরোবো—

এই না তোর এত কাজ যে রোববারেও ছুটি নেই? বিজন তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে বলল— ছুটি-অছুটি আমার ইচ্ছে মতো। চাকরি তো করি না কারো।

তাই বলে ঐ ঘেঁড়া গেঞ্জিটা পরে ঘুরঘুর করছিস কেন এখানে? দেখাচ্ছে কী! হাত বেঁকিয়ে গেঞ্জির ফুটোয় পিঠ চুলকোতে-চুলকোতে বিজন বলল—যাই, সত্যেনকে একটা কথা বলে আসি। বাড়ি গেল নাকি রে এখন? শাশ্বতী নিচু গলায় শ্বেতাকে বলল–ভারি ফাজিল হয়েছে বিজুটা। স্বাতী কিছুই বলল না, মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে লোটনকে জাপটে শোওয়াল কোলের মধ্যে, আর লোটন তার অভ্যেস মতো হাত-পা ছুঁড়ে আসর জমাল।

কী মজা। হাতোলি দিয়ে বলে উঠল তাতা। ছোটন বলল—এ মা! এ আবার একটা মজা কী!

মজা না? খুব মজা!

মোটেও না!

তবে তুই যা এখান থেকে।

কিন্তু ছোটন নড়ল না, না-মজাটাই দেখতে লাগল। তার বোন বলে পরিচিত ঐ ছোট্টো মানুষটাকে সে খুব ভাল চোখে দ্যাখে না। বিচ্ছিরি, নোংরা, এখনো বিছানায় ইয়ে করেছি। আর বুদ্ধিও তেমনি, সেদিন তার লাটুটাই মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে—জিভ-টিভ কেটে এক কাণ্ড মা আবার উল্টে তাকেই বকলেন! এদিকে ও যে অমন বোকা, লাটু খেতে হয় না তা পর্যন্ত জানে না—তার আর কিছু না।

মাসির তেল-মাখা হাতটা গায়ে লাগতেই লোটন এমন এক ডিলিক দিল যেন উল্টে ডিগবাজি খাবে। আতা তাড়াতাড়ি বলল—হাত ধরব ছোটোমাসি?

আমি পা! জুড়ল তাতা।

না, বড়দি, শাশ্বতী শাসাল-আজ কিছু আছে তোমার মেয়ের কপালে!

স্বাতী এবার মন দিয়ে কাজে লাগল। প্রথমে আস্তে, সাবধানে, তারপর নির্ভয়ে, স্বচ্ছন্দে লোটনের মিষ্টি, নরম, গরম শরীরটার উপর দিয়ে নানা ভঙ্গিতে নাড়তে লাগল তার হাত। প্রথমে এক হাতে, তারপর লোটন যখন ছটফটানি থামিয়ে আরামে গা এলিয়ে গরর আওয়াজ করে করে দর্শকদের খুশি করতে লাগল, তখন দু-হাতে-বড়দিকে যে রকম দেখেছে, ঠিক সে রকম করেই চেষ্টা করল বুলোতে, চাপড়াতে, রগড়াতে, গলার ভাঁজে ভাজে, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে তেলের ফোঁটা মিশিয়ে দিল, ছোট্টো টুকটুকে কান দুটিকেও ভুলল না। চুপচাপ নিচু চোখে, চুপচাপ গম্ভীর মুখে নিজেরই অজান্তে তৈরি হতে লাগল ভবিষ্যতের জন্য। ভবিষ্যৎ কাছে এসে গেছে, সে জানে। ভিতরে ভিতরে কাঁপছে সে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম যেমন দূর-চাকার মাটি-তলার ধাক্কায়, অনেক আগে থেকেই একটু একটু কাপে। আর তাই, ট্রেনের ঘণ্টা পড়লে প্ল্যাটফর্মে যেমন ব্যস্ততা, তেমনি তারও সমস্ত শরীরে কাজের ঢেউ উঠেছে এখন, হাতের কাজ, নড়াচড়ার, চলাফেরার। সে এত বেশি বেঁচে আছে যে খানিকটা তার খরচ করে না দিলে বাঁচে না। টান হয়ে আছে বুকের মধ্যে সব সময়, দপদপ করছে আঙুলের ডগা, ক্লান্তি কাকে বলে ভুলে গেছে, শান্তি কাকে বলে তাও ভুলেছে। চলে যাবে? আজ চলে যাবে? না, যাবে না, যাবে মা… আমি বলছি যাবে না। লোটন ছুঁচোলো গলায় কেঁদে উঠল হঠাৎ।

এই রে! শাশ্বতী বলল—চোখে গিয়েছে।

না, না কিছু হয়নি! বাবা কী সুন্দর তেল মাখে লোটন বড়দির সুর অবিকল নকল করল স্বাতী—একটুও কাঁদে না-দ্যাখো তোমরা সব—কেউ পারে না এরকম—

ভারি তো! ছোটনের গলা শোনা গেল—আমি ওর চেয়ে কত ভাল পারি!

সে তো সত্যি! লোটন তো দাদাকে দেখেই শিখেছে এত সুন্দর নাইতে। এ কথা শুনে দায়িত্বপূর্ণ দাদার মতোই গম্ভীর হলো ছোটন। শ্বেতা বলল—দিস তো ওকে ধরে একদিন ভাল করে নাইয়ে। আমি ডাকলে তো মাথা পাতে না, তা তোর কাছে বোধহয়—

ছোটন বলল—ধ্যেৎ!

ছোটনের বুঝি স্নানে তেমন উৎসাহ নেই— বলল শাশ্বতী।

মামার ধাত। শ্বেতা হাসল। যা কাণ্ড করে এক-একদিন নাওয়াতে হত বিজুকে!

আমার বিষয়ে কী বলছ তোমরা? বলতে-বলতে বিজু দরজার ধারে দাঁড়াল। ছেড়া-গেঞ্জি ঢাকবার জন্য কুঁচকানো একটা সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছে–আরো বদ দেখাচ্ছে তাতে হাতে জ্বলছে সিগারেট। শাশ্বতী শ্বেতার দিকে তাকিয়ে বলল—তুমি ওকে কিছু বলছ না, বড়দি, তোমার সামনেই সিগারেট খাচ্ছে!

বড়দি ও-সব মাইন্ড করেন না। বিজন গম্ভীরভাবে সিগারেটে টান দিল, তারপর দু-পা এগিয়ে লোটনের দিকে তাকাল। এ! বিজন নাক কুঁচকে বলল—সর্ষের তেল!

দ্যাখো বড়দি, হয়েছে ঠিক? বলে স্বাতী আর একবার হাত বুলিয়ে গেল ছোট, নগ্ন, নরম, মসৃণ শরীরটাতে। সেদিকে তাকিয়ে শাশ্বতী ভাবল ও রকম একটা হয়ে-টয়ে পড়লে মন্দ কী— কিন্তু হারীত কিছুতেই রাজি না। বিজন বলল—সর্ষের তেলে রং কালো হয়, অলিভ অয়েল মাখাতে হয় বাচ্চাদের।

নাকি? আর কী-কী করতে হয় বল তো?

বিজন খোশমেজাজে হাসল—আচ্ছা, সব এনে দেব তোমাকে বড়দি, ভেব না।

যাক। এতদিনে, বড়দি, তুমি নিশ্চিন্ত হলে—বলে চিকন লোটনকে কোলে করে স্বাতী উঠে দাঁড়াল।

দেখবি, দেখবি। আধ-পোড়া সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলিয়ে চোখ মিটমিট করল বিজন। স্বাতী উঠোনে নামল, সেখানে টবে করে লোটনের স্নানের জল রোদে গরম হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। লোটন গলাজলে বসে থাবা মেরে-মেরে জল ছিটোতে লাগল, আর কণ্ঠের আশ্চর্য করৎ দেখিয়ে সব কটা ব্যঞ্জনবর্ণ অভ্যাস করতে লাগল তারস্বরে, আর তাকে দেখতে-দেখতে, তার খুশিতে খুশি হতে-হতে স্বাতীর মনে একটু আগে যে উদ্বেগ উঠেছিল, তা হঠাৎ একেবারে মিলিয়ে গেল মনের মধ্যে। নিশ্চিত জানল যে সত্যেন যাবেনা, যেতে পারে না। আতা ঘটি করে জল ঢালল লোটনের মাথায়, তাতা গায়ে একটুসাবান না বুলিয়ে ছাড়লই না, ওদের দু-জনেরও আদ্ধেক স্নান হয়ে গেল লোটনের দাপাদাপিতে, আর ওদের হাত থেকে লোটনকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রায় স্বাতীরও লোটন হাসল, আতা-তাতা হাসল, স্বাতীও হাসল সঙ্গে সঙ্গে, আর মাথার উপর আকাশে ভেসে বেড়ালো শরতের সাদা মেঘ, আর শান্ত একটি আকাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওরে! আর না, তোল! শ্বেতা ডাল বারান্দা থেকে। কিন্তু ভোলা কি সোজা? লোটন কেবল বলে-না—তান। আর টবের কড়া আঁকড়ে থাকে দু-হাতে-ঐটুকু-টুকু তো মুঠি, কিন্তু জোর কী!—মাসিকে একদম হারিয়ে দিল দু-বার, মুখ-টুখ ভিজিয়ে দিল, আর তাতে স্বাতীর এত মজা লাগল যে পরের বার আর চেষ্টাই করতে পারল না। রোজই এরকম করে, বড়দি? শাশ্বতী জানতে চাইল।

মাসির কাছে একটু বেশি করে। সব বিদ্যে দেখানো চাই তো।

শাশ্বতী উশখুশ করল। অতক্ষণ ভিজে গায়ে থেকে জ্বর-টর হবে না তো মেয়েটার? কড়া ধরে নাচতে নাচতে উল্টে পড়বে না তো হঠাৎ? চেঁচিয়ে বলল–স্বাতী, তোল! তারপর নিজেই উঠে দাঁড়াল। মনের মধ্যে আবছা একটা ইচ্ছা জাগছিল তার উঠোনে গিয়ে ওদের সঙ্গে দাঁড়াবার, লোটনকে একটু কোলে নেবার, এতক্ষণে যেন নিজের কাছেই একটা ছুতো পেল। আমি ওকে নিয়ে আসি, বড়দি, বলে সিড়ির দিকে এগোল সে, কিন্তু স্বাতী তখনই নিয়ে এল লোটনকে, গলার চিৎকার আর গায়ের জল সুষ্ঠু মেঝেতে নামিয়ে দিল, হাঁটু ভেঙে বসে মুছিয়ে দিতে লাগল তোয়ালে দিয়ে। বড়দি আস্তে বলল—স্বাতী আমাকে দে।

আমিই পারব, স্বাতী ঘাড় বেঁকিয়ে নিজের ভিজে মুখটা কাঁধের কাপড়ে মুছে নিল—কী-দুষ্টু বড়দি, তোমার-কথা থেমে গেল মুখের দিকে তাকিয়ে। বড়দির চোখের ভাব বদলে গেছে…কী? স্বাতীর চোখ দ্রুত সরলো ছোড়দির, দাদার দিকে, দুজনেই কেমন সামনের দিকে তাকিয়ে—কী হয়েছে? স্বাতী ললাটনকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আর তখনই ফিরে তাকানোর আগেই তার মনের তলায় লাফিয়ে উঠল কী হয়েছে; তাই উঠোনের মধ্যিখানে রোদ-লাগা লালচে মুখে সত্যেনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুও অবাক হল না। বিজন তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে অভ্যর্থনা করল—আসুন! এতক্ষণে-স্নানের টবটা দেখে, সকলকে দেখে সত্যেন বুঝল যে পিছনের দরজা দিয়ে হঠাৎ এ রকম বাড়ির মধ্যে চলে আসাটা একেবারেই শোভন হয়নি। আমি—আমি–এটুকু বলেই থেমে গেল।

আসুন–আরো দরাজ গলায় বিজন বলল।

ওদিকের দরজাটা বন্ধ ছিল—কারো সাড়া পেলাম না তাই ভাবলাম…ভাবলাম একবার…। কী ভেবেছিল? সকালবেলায় অতক্ষণ কাটিয়ে গিয়ে এক্ষুনি কেন আবার এসেছে এই ব্যস্ত চড়া-বেলার অসময়ে? আর একবার, শুধু আর একবার চোখে দেখতে!

তাতে কী হয়েছে? আসুন, বসুন এসে।

না, না এখন আর–সত্যেনের মন চাইল দৌড়ে আবার বেরিয়ে যেতে, কিন্তু তার শরীর নড়তে পারল না—মানে, কলের মতো নড়ল, পা টিপে টিপে উঠে এল বিজনের পিছনে সিঁড়ি ক-টা। বসুন। এই যে—না, ও-ঘরে চলুন— বিজনের নড়াচড়ায় ভদ্রতা ঝরে পড়ল। কেন, এখানেই বোসোনা, লোটনকে জাঙিয়া পরিয়ে শ্বেতা উঠে দাঁড়াল।

না, না, এখানে কী—আসুন—আমার সঙ্গে। মানে, বিজন একটু থামল—আপনার যা ইচ্ছে। ইচ্ছে! কথাটার অর্থ সত্যেন যেন বুঝতে পারল না, কেমন নিঃসাড়মতো বসে পড়ল সেই ভেনেস্তা চেয়ারটাতেই, বিজন যেটা প্রথমে এগিয়ে দিয়েছিল। বিজনও বসল, ঘরোয়াভাবে আলাপ আরম্ভ করল—কোথায় গিয়েছিলেন?

এখন? টিকিট কিনে আনলাম। এই যে কোনো দরকার ছিল না, এরকম কেউ করেও না সাধারণত, তবু পকেট থেকে বের করল সবুজ রঙের রেল-টিকিটটা। অনর্থক, কতগুলি টাকা একদম জলে ফেলে, একেবারে সেকেন্ড ক্লাসই কেটেছে, যাতে এরপর কিছুতেই তার না-যাওয়া না হয়, যাতে অন্তত ঐ টাকা ক-টাই তাকে হিচড়ে নিয়ে যায় রাঁচিতে। টিকিটটা আঙুলে ধরে ঘোরাল একটু যেন সবাইকে দেখাতে চায়—তারপর নিজে চোখ ফেরাল এদিক ওদিক। দেখল দিদি দু-জনকে দরজার ধারে পাশাপাশি, স্বাতীকেও দেখল—আবছা দেখল—একটু দূরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো। আড়ষ্ট, অস্পষ্ট, স্বাতী দাঁড়িয়ে ছিল অর্ধেক মুখ ফিরিয়ে। সত্যেনকে চোখে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন আয়নার মধ্যে নিজের চেহারাটা দেখতে পেয়েছিল সে—চুলটুল খুলে একাকার, শাড়িটা তেলে-জলে মাখামাখি—বদলে আসবে?—না চলে যাবে এখান থেকে?-না এখানেই থাকবে?—না, থাকল ওখানেই আর প্রতি মুহূর্তে ভাবল কেন আছি, আর ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে থাকল—না নড়ে, না বলে, না দেখে।

যাচ্ছেন বুঝি কোথাও? বিজন ভালমানুষ, জিগ্যেস করল। সত্যেন খুব গম্ভীর গলায় বলল–আজ যাচ্ছি রাঁচি। আপনি রাঁচি গিয়েছেন, বিজনবাবু?

বোসো তোমরা— শ্বেতা ভিতরে এল লোটনকে নিয়ে, আর একটু পরে শাশ্বতীও এল সেখানে, মুখে আঁচল চেপে নিঃশব্দে কিন্তু প্রবলবেগে হাসতে লাগল।

কী রে? কী হল? শাশ্বতী কথা বলতে পারল না, হাসির ঠেলায় কাঁপতে কাঁপতে দিদির কাঁধে মুখ গুজল। ললাটনের গায়ে পাউডর দিতে দিতে শেতা বলল-দ্যাখো কাণ্ড! হাসছিস কেন ও রকম?

আবার বিজনবাবু—! হাসির ফাঁকে ঠাশ করে আওয়াজ বেরল শাশ্বতীর।

ভাল তো বিজুকে বাবু বলার একজন হল এতদিনে।

আর বিজুটাও কম না! কেমন আলাপ জুড়ল—এদিকে সাত-জন্মে একটা কথা বলে না সত্যেনের সঙ্গে!

তা এতদিন তো আর—শ্বেতা কথা শেষ না করে লোটনের ভাঁজ-করা জামাগুলি তুলে তুলে দেখতে লাগল।

সত্যি! হাসি-থামা অন্য গলায় শাশ্বতী বলল—কেন যে সত্যেন যাচ্ছে—

কেন, ঘুরে আসা তো ভালই।

ভাল? এদিকে….বাবার গলা না? পাতলা সাদা মলমলের একটা বেনিয়ান শ্বেতা পরিয়ে দিল লোটনকে।

বাবা গিয়েছিলেন কোথায়?

তোর নাকি পুজোর শাড়ি পছন্দ হয়নি—

ও মা! পছন্দ আবার হল না কবে? আমি শুধু বলেছিলাম—

ঐ হল, এটুকু খুঁতই বা থাকে কেন!

তাই বলে আবার বদলাতে গেলেন? সত্যি। শ্রান্ত চেহারা নিয়ে রাজেনবাবু ঘরে এলেন। তার হাতের কাগজের বাক্সটা দেখেই শাশ্বতী বলে উঠল-এ তোমার ভারি অন্যায় বাবা! দ্যাখ-তত অন্যায়টা কেমন, বাক্সটা মেয়ের হাতে দিলেন রাজেনবাবু। ডালাটা অল্প তুলে উঁকি দিয়েই শাশ্বতী তার মত জানাল-খুব সুন্দর!

দেখেই? খুলে ভাল করে দেখার জন্য তার মনের চঞ্চলতা শাশ্বতী সামলে নিল। মনে পড়ল এসব শাড়ি বড়দি আর পবেন না, পরবেন না; তাই লজ্জা করল একটু। আমি একটু দেখেই ভাল জিনিস চিনতে পারি। কিন্তু কেন বল তো তুমি আবার-বরং ঐ জরিপাড় ধুতিটা বদলে আনলে ঠিক হত।

কেন? জিগ্যেস করল শ্বেতা।

উনি ওসব ভালবাসেন না, বলেন জামাই-কাপড়।

তবে ঠিকই আছে, শ্বেতা বলল-এখানকার তো জামাই সে।

আর ধুতি পরেই বা কদিন বহরে! মিছিমিছি–। শ্বেতা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল—কম পরে বলেই তো ভাল পরতে হয়।

হ্যাঁ! ঐ আওয়াজটা করে কী যেন একটা বলতে না পারা কথাকে শাশ্বতী পিষে দিল, আর তারপরেই বলল—সত্যেনকে দেখলে, বাবা?

হ্যাঁ, দেখা হল।

আমরা সবাই চলে এলাম–ভাল দেখাচ্ছে কি?

সত্যেনের কথা বলছিস? তাকে তো চলে যেতে দেখলাম।

চলে গেল এর মধ্যে? এলই তো এইমাত্র।

রাজেনবাবু কিছু বললেন না।

সকালে এসেছিল একবার।রাজেনবাবু এবারেও কিছু বললেন না। শাশ্বতীও কথা পেল না আর, শ্বেত ছোট্টো লাল চিরুনি দিয়ে ললাটনের চুল আঁচড়ে দিতে লাগল, আর একটু পরে রামের-মা এল লোটনের দুধের বাটি নিয়ে। শাশ্বতী হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকল—স্বাতী? উত্তর না পেয়ে আবার ডাকল। তারপর একটু নড়ে-চড়ে একটু যেন উদ্বিগ্ন স্বরেই বলল–স্বাতী কোথায়?

দিদিমণি তো নাইতে ঢুকলেন, রামের-মার ফিশফিশে গলা শোনা গেল। আবার চুপ। তিনজনের একজনও অন্যজনের দিকে তাকাল না। আর মিনিটখানেক এ রকম কাটবার পর রাজেনবাবু আস্তে আস্তে অন্য ঘরে চলে গেলেন। শাশ্বতী তখনো কথা বলল না, শ্বেতাও না। মা-র কোলে শুয়ে ললাটন দুধ খেতে লাগল ঢকঢক করে আর বাটি খালি হবার সঙ্গে সঙ্গেই ছবির মতো ঘুমিয়ে পড়ল।

******

শাশ্বতী বাড়ি ফিরল। বাড়ির খাওয়া-দাওয়া চুল, সারা পাড়া দুপুর-চুপ। তারও মধ্যে আরো চুপ রাজেনবাবুর বাড়িতে স্বাতীর ঘরটি। সেখানে শাশ্বতীর পুরনো খাট আবার পড়েছে—আত-তাতা রাত্রে শোয়—আর এখন সেখানে ঘুমিয়ে আছে লোটন। তার বোজা চোখের ফোলা-ফোলা, ফিকে গোলাপি, আবার একটু নীলচে পাতা দুটি মস্ত দেখাচ্ছে এখন। কিন্তু ঘরে আর যে দুজন আছে, এই সুন্দর দৃশ্যটি তারা দেখছেনা। শ্বেতা বসে আছে মেয়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে উঁচুকরা হাঁটুতে থুতনি রেখে আর স্বাতীর নভেল-পড়া বেতের চেয়ারটিতে বসে রাজেনবাবু মেঝের একটা বিশেষ অংশ মন দিয়ে দেখছেন। দেখে মনে হয় এভাবেই কিছুক্ষণ বসে আছে দুজনে, চুপ, যেন চিন্তিত। একটু পরে শেতা নিচু গলায় বলল–তা হলে বাবা? রাজেনবাবু মেঝে থেকে চোখ তুললেন। শ্বেতা বলল—সবই তো ভাল, এক—কেউ নেই ছেলেটির—

কেউ নেই কেন? আমরা আছি। বলে রাজেনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। যেতে-যেতে থামলেন স্বাতীর ছোট্টো আলনার কাছে। শাড়ি, জামা, তলায় রাখা তিন জোড়া জুতো, দু-জোড়াই কোন জন্মের পুরোনো, কিছু ফেলতে ওর মন সরে না। সরে এলেন টেবিলের কাছে, সেই কবেকার বেতের শেলফটি বইয়ের ভারে বাঁকা, নিচের তাকে স্কুলের বইগুলি ধুলোপড়া-নীল মলাটের অ্যাটলাসটা টেবিলে এখনকার বই, গল্পের বই, খাতা। একটা খাতা খুললেন, পোর্শিয়ার চরিত্র লিখেছে, তা-ই পড়লেন একটু, চশমা ছাড়া ঝাপসা দেখলেন, তবু দেখতেই লাগলেন, আর সামনের দেয়াল থেকে তাঁকে দেখতে লাগল ধুলো-পড়া কাচের আড়ালে ছবি হয়ে যাওয়া শিশিরকশার ঝাপসা চোখ। রাজেনবাবু তা জানলেন না। খাতা বন্ধ করে জায়গা মতো রেখে পাশের ঘরে এলেন। আতা-তাতা ছোটন লুডো খেলছে সেখানে, তাকে দেখেই তাতা আহ্লাদি গলায় বলে উঠল—দাদু খেলবে আমাদের সঙ্গে খেলবে? আতা তাকাল। তাহলে আবার প্রথম থেকে আরম্ভ করি। ছোটমাসিকে এত বললাম–চারজন না হলে তো জমে না খেলা।

আমি আর দাদু! ছোটন আসনপিঁড়ি হয়ে জাকিয়ে বসল।

আচ্ছা তোমাদের এ পাট্টি শেষ হোক বলে রাজেনবাবু বারান্দায় এলেন। উঠোনে অর্ধেকটা ছায়া পড়েছে, তারে কাপড় শুকোচ্ছে, কোথায় একটা কাক ডাকছে কা-কা, আর স্বাতী বসে আছে সিঁড়িতে চুপ করে। রাজেনবাবু ডাকলেন না, কাছে গেলেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে দেখতে লাগলেন। একটু পরে স্বাতী ফিরে তাকাল। রাজেনবাবু তাড়াতাড়ি বললেন–আমার পানের ডিবেটা দেখেছিস নাকি রে?

ছিল তো এখানেই–দেখছি–স্বাতীও তাড়াতাড়ি উঠল।

আচ্ছা থাক, আমিই খুঁজে নেব।

আমি এনে দিচ্ছি—

স্বাতী–

স্বাতী যেতে যেতে থামল। রাজেনবাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, কিন্তু স্বাতী দাঁড়াল না, তাকাল না, বাবার চোখ এড়িয়ে চলে এল সেখান থেকে। এই প্রথম, জীবনে এই প্রথম বাবার কাছে তার লজ্জা করল। এল বড়দির কাছে, ঘুমোচ্ছেন। আর একবার তাকিয়ে ভুল ভাঙল। বড়দি শুয়ে আছেন কপালে হাত রেখে, আর চোখ-চাপা হাতটির তলা দিয়ে চোখের দু-কোণ বেয়ে বেয়ে পরিষ্কার দুটি জলের রেখা নেমে এসেছে নাকের ধার দিয়ে বেঁকে ঠোঁটের কাছে, ঠোঁট একটু ফাঁক, সাদা গলার উপর সরু একটি নীল শিরা খুব আস্তে কাঁপছে। স্বাতী থমকাল, অবাক হল, চোখ ফেরাতে পারল না। বড়দিও কাঁদেন?আর সে ভেবেছিল—ভেবে নিশ্চিন্ত ছিল—যে বড়দি মনের দুঃখ চমৎকার লুকোতে পারেন। লুকোতে!-দুঃখ না লুকিয়ে উপায় কী এই পৃথিবীতে-দুঃখের জায়গা কোথায়, সময় কোথায়? কিন্তু যদি কখনো সময় হয়? এই রকম নিরিবিলি দুপুরবেলা আর সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে, সেইসব অন্ধকার বড়ো বড়ো রাতগুলি–সে কী জানে, তার বড়দির দিন-রাত্রির কথা সে কী জানে? আর দুঃখেরই বা কী জানে—কী জানতো, আজকের আগে পর্যন্ত দুঃখেরই বা কী জানতে সে? যেই কথাটা ভাবল, যেই মনে পড়ল সত্যেন আজ ঠিকই চলে যাচ্ছে, অমনি যেন সত্যি তার বুক ফেটে কান্না এল। কিন্তু কোথায় গিয়ে কাঁদবে, কোথায় লুকোবে, কেউ-কেউ দেখে ফেলবেই, কী বলবে তখন? বড়দির কাছেই সে সবচেয়ে নিশ্চিন্ত—ছিল-কিন্তু বড়দিও যদি নিজের কান্না দিয়ে তাকে পর করে দেন! স্বাতী ফিরে যাচ্ছিল কিন্তু তোর চোখ খুলে গেল। একটু তাকিয়ে থেকেভিজে ভিজে গলায় শ্বেতা ডাকল—স্বাতী আয়। স্বাতী দাঁড়াল। আয়— শ্বেতা, আস্তে কেশে, আবার ডাকল। সে যে কাঁদছিল সেটা মেনে নিল তার চোখের দৃষ্টি, কিন্তু কান্না থেমেও গেল তখনই, শুধু গলার আওয়াজে তার স্মৃতি রইল। স্বাতী এগিয়ে এল, বসল বড়দির শিয়রে।-শুবি? শো। শেতা একটু সরল, আর সেই সঙ্গে হাতের উল্টো পিঠে আস্তে মুখ মুছল। স্বাতী শুয়ে পড়ল, বড়দির পাশে, গায়ে গা লাগিয়ে, দু-বোন পাশাপাশি শুয়ে থাকল কেউ কোনো কথা না বলে।-হিয়াওঁ! ঘুমোনো লোটন কেঁদে উঠল। শ্বেতার বাঁহাতটি নড়ল একবার। ইশ! ভিজিয়ে একেবারে উঠে বসে কথা বদলে দিল, মেয়ের পিঠে চাপড় দিতে দিতে বলল–এ মেয়েটা বিষম হিশুনি! এ জন্যই দেখতে পারি না এটাকে! ও কথা শুনে স্বাতীর মনে হল বড়দি তার কাছে ফিরে এলেন। আবার সহজ হল, হেসে বলল—তুমি কেবল ওর নিন্দে কর, বড়দি! লক্ষ্মী মেয়ে–সেই কখন থেকে ঘুমাচ্ছে।

খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আছেই বা কী!

কী-ই বললা। স্বাতীর গলায় ঢেউ দিলো—রোজ কথা শিখছে না নতুন-নতুন? আর দেখতে কী সুন্দর!

নাকি? শ্বেতা আড়চোখে মেয়েকে দেখলো।

ও তোমার সকলের চেয়ে সুন্দর হবে দেখো«বেমালুম বাবার কথা চুরি করে স্বাতী বললো। আমি তো দেখি না। কুচ্ছিৎ কপালটা! বলে শ্বেতা সেই কুচ্ছিৎ কপালে তিনটি আঙুল ছোঁওয়ালো। লোটনের ফোলা-ফোলা চোখের লালচে মুখে চোখ রেখে স্বাতী বললো—আমার ওকে এত ভালো লাগে বলব কী, বড়দি!

কদিন আর! এর পরেই একঝুড়ি দাঁত, টাশ-টাশ কথা আর ঠাশ ঠাশ চড়!

স্বাতী আওয়াজ করে হেসে উঠল।তখন বুঝি আর ভালো না?

এ রকম কি আর?

স্বাতী একটু ভাবল। শিশু সুন্দর, খুব সুন্দর, কিন্তু সে তো অন্যদের—বড়দের—উপভোগের; তাতে তার নিজের কী? সে তো জানে না সে সুন্দর, সে-যে আছে তা-ই ভালো করে জানে না, আর তা যেদিন জানবে সেদিনই এই সুন্দরের খতম। না, লোটনকে দেখতেই ভালো, লোটন হওয়াটা ভালো না। বেচারা ঘুমিয়েই চব্বিশ ঘণ্টার যোল ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে। কত বছর, আরো কত বছর লাগবে তার এখানে পৌঁছতে, যেখানে আমি এখন আছি, যেখানে এসে মানুষ জানতে পারে সে বেঁচে আছে, জানতে পারে সে কী চায়, সত্যি কী চায়, আর শুনতে পায় বুকের মধ্যে এই ঢিপঢিপ কথা যে সত্যি সে যা চায় তা-ই পাবে, সত্যি যা চায় তা-ই হবে, হতেই হবে, না হয়েই পারে না। নিজের বুকের ঢিপঢিপ কথা কানে কানে শুনতে-শুনতে স্বাতী বলল—আমার কিন্তু মনে হয় বড়ো হওয়াটা আরো ভাল।

হ্যাঁ, ভালই তো, শ্বেতা সায় দিল। নিজের হাতে-পায়ে চলে–নির্ঝঞ্ঝাট।

বেশি যেন তুমি খুশি না তাতে?

খুব একটা খুশিরই বা কী? শ্বেতা আবার শুয়ে পড়ল স্বাতীর পাশে—প্রথম তিন বছরের মতো কি আর কিছু?

কী বলতে গিয়ে স্বাতী থেমে গেল। অন্য একটা কথা–অদ্ভুত কথা—মনে হল তার। এই প্রথম তিন বছর বড়দির জীবনে লোটনই শেষ, আর বাবার জীবনে শেষ হয়েছিল তারই সঙ্গে। বড়দির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে যেন বাবার মুখটা দেখতে পেল, একটু আগে যে দেখা হল সেই কেমন-কেমন বলতে-না-পারা মুখটা, তারপর বাবা যেন মা হয়ে গেলেন, অসুখ না, কষ্ট না, পান-খাওয়া টুকটুকে ঠোঁটের ঝলমলে মা। আর দেখতে দেখতেই রং মুছে গিয়ে আবার সব সাদা হল। হঠাৎ বলে উঠল আচ্ছা, বড়দি, পান খাও না কেন?

শ্বেতা উত্তর দিল না।

কেন খাও না? ওতে কী দোষ?

দোষ আর কী।

তবে?–কেন?–স্বাতী আবেগ দিয়ে বলতে লাগল, যেন এই পান খাওয়া আর না-খাওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। কেন খাও না? তুমি তো ভালবাসতে–

উনিও খুব ভালবাসতেন—ছোট্টো গলায় শ্বেতা বলল। এই প্রথম স্বাতী শুনল বড়দির মুখে সেই মানুষের কোনো কথা, যে মানুষ আর নেই, আর যার না থাকাটা এর মধ্যেই সবাই মেনে নিয়েছে। সবাই-কিন্তু একজন না, আর সেই একজনের কাছে কেমন লাগে অন্য সকলকে? স্বাতী আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিল, তার মনের অনেক তলার চুপি-চুপি কান্না আবার যেন বেরিয়ে আসার ছুতো পেল। পাশের ঘর থেকে উঠে এল ফুর্তির আওয়াজ–লুডো খেলছে ওরা। সময় কাটাবার কত উপায় বার করেছে মানুষ, তবু সময়টাই সমস্যা। তবু জীবনে এমন সময় আসেই, যখন সময় আর কাটে না।—চলে যাবে। চলে যাবে!—একটা হাতুড়ির বাড়ি দিল স্বাতীর হৃৎপিণ্ড—চলে যাবে? তাহলে আমি এখন কী করি?

******

কী করি, সত্যেনও তখন ভাবছিল, কী করি। রাত্রি দূরে এখন, স্টেশনে রওনা হবার সময় হতে আরো অনেক দেরি। অন্তত ছ-ঘন্টা! আর এই ছ-ঘন্টা তাকে এমনি করেই কাটাতে হবে, এমনি চুপচাপ আরাম-চেয়ারে এলিয়ে, না-জেগে, না-ঘুমিয়ে, না-বেঁচে।কেননা সবচেয়ে যেটাকে সে ভয় করেছে, প্রাণপণে যেটাকে সে এড়িয়েছে, আজ এত দিন পর হঠাৎ তারই খপ্পরে সে পড়ে গেছে, আর এই ছ-ঘন্টা সময়–যতক্ষণ না হাওড়ায় বাসে চড়ে বসতে পারে—ততক্ষণ তার কিছু নেই, কিছু করার নেই। সত্যেন এদিক-ওদিক তাকাল। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ঘর, বইবোঝাই শেলফ দুটোয় সাহিত্যের অধিপতিরা সারি-দাঁড়িয়ে টেবিলে, হাতের কাছে টাটকা কয়েকটা। তার মনে পড়ল ভবানীপুরের মেস থেকে এসে স্বর্গ মনে হয়েছিল এই ঘর-মনে পড়ল কোনো এক সময়ে ভেবেছিল শুধু বই পড়েই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। জীবন! জীবন কত বড়ো? সে যা চায় তাই তো পেয়েছে। বেশি কিছু চায়নি, কিন্তু যা চেয়েছে তা-ই পেয়েছে। পেয়েছে কম-টাকার বেশি-ছুটির চাকরি, নিরিবিলি ঘর, কলকাতার জ্যান্ত হাওয়া, পেয়েছে সেই স্বাধীনতা আর সেই মন যাতে নিজের কথা সবচেয়ে কম ভাবতে হয়। কিন্তু অন্য যেসব ভাবনা–তার মনের বই হজম-করা সতেজ পায়চারি—কোথায় তারা? বই, তোমরা আজ ফেল হলে কেন? যে সুন্দর, ছোটো ফ্রেমটাতে জীবনটাকে সে বেঁধে নিয়েছিল— যার মধ্যে, আর যাই হোক, সময় কাটাতে ভাবতে হত না কখনোতাতে কি আর কুলোচ্ছে না? জীবনটা কি বেড়ে গেল হঠাৎ? আর কোনো চাওয়া কি তার বাকি আছে? কিন্তু চাওয়া তো শুধু না, চাওয়া মানেই পাওয়া, নয়তো চাই-চাহ বলে গলা শুকিয়ে মরতে পারে না তো। চাওয়া মানেই পাওয়া বেশি কমের কথা নেই এতে। কেননা যার কাছে যেটা বেশি…বড়ো, সে তা-ই চায়—চাইলেই পাওয়া যায়, আর তা যদি না হয় তবে তো না-চাওয়া ছাড়া উপায় নেই মানুষের।

ছবি ভেসে উঠল সত্যেনের মনে। সেই যেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়েকে দেখেছিল মাঠ পার হয়ে হেঁটে আসতে। বর্ষাকাল তখন। নতুন এসেছে এ-বাড়িতে। বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে বিকেলে। একই সঙ্গে দেখেছিল লাল আকাশ, ছড়ানো মাঠ আর মেয়েটি যখন কাছে এল, চিনল, তার কালো চুলে হলদে রোদের ফিতে। কত আত্মস্থ ছিল তখন, নির্লিপ্ত, সুন্দরকে সুন্দর বলেই ভালবাসত। আর এখন? অন্য ছবি এবার। চড়তি-বেলা, ব্যস্ত-বাড়ি, তার মধ্যে হঠাৎ…উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে….সে …কী ভেবেছিল সবাই? কী ভেবেছিল যখন সে ঐ টিকিটটা বের করেছিল পকেট থেকে! একটা কথা হল না, ভাল করে চোখেও যেন দেখল না..অনর্থক সব অনর্থক। কোনো মানুষকে দেখে-দেখে আরো যদি দেখতে শুধু ইচ্ছে করে তবে তো তাকে না দেখলেই ভাল। তারপর, তখনই, আরও হঠাৎ তার চলে আসাটা। ঠিক বেরোবার মুখে ওর বাবার সঙ্গে দেখা কী যেন তিনি বলেছিলেন…কোনো জবাব দেয়নি, পাছে কথা বলতে দাড়ালেই তিনি আবার বসতে বলেন আর সেও রাজি হয়ে যায়। বোকামি-সমস্তটাই বোকামি। সুন্দরের ধই ক্ষণিকতা। কষ্টিপাথরের পার্বতী মন্দিরেই মানায়, পুরীতে যারা বারো মাস থাকে তারা সমুদ্রের দিকে ফিরে তাকায় না…তাই রক্তমাংসের মানুষ সুন্দর হতে পারে না…যদি সুন্দর লাগে, ভাল লাগে, যে কোনো কারণে কোনো জ্যান্ত মানুষকে ভাল লাগে যদি, তাহলে তাকে আমরা যদি চাই—চাই—আর সেই তাথৈ ইচ্ছায় কোথায় সুন্দর! আর তাই মানুষকে ভালবাসতে সাবধান—কবিতা ভালবাসো, প্রজ্ঞা ভালবাসো, আকাশ ভালবাসো-কিন্তু কোনো জীবন্ত মানুষকে ভালবাসতে খুব সাবধান। এই তো সে–সভ্য মানুষ, শিক্ষিত ভদ্রলোক, সতেরো বছরের বাচ্চা ছেলের মতো আকাট বোকামি করে এল তখন, আর এখন—যদিও তার কোনো অভাব নেই, দুঃখ নেই—যেন চেয়ারে বসে বসে অথই জলে খাবি খাচ্ছে।

একটা উপমা মনে এল সত্যেনের। তীরে দাঁড়িয়ে নদীর সুন্দর দৃশ্য দেখছিল, ভাল লাগছিল, আরো… আরো ভাল, যত ভাল লাগছে ততই আরো ভাল করে দেখতে গিয়ে সরে আসতে আসতে হঠাৎ জলের মধ্যেই পড়ে গেছে। বাঁকা, চোরা, কুটিল, পিছল জল। এখানে চাপ, ওখানে টান, সেখানে ধাক্কা, যত নরম, তত নাছোড়-আর যদি কখনো পায়ের তলায় মাটি ঠেকে, তাও পিছল। কিন্তু তুমি তো জানতে…সত্যেন নিজেকে নিজে বলল, তুমি কি জানতে না যে জল এ রকম? নিজেই উত্তর দিল, কী করে জানব, আগে তো কখনো জলে পড়িনি। তবে এটা তো জানতে জলের অত কাছে গেলে পড়ে যেতে পার? এবার আর উত্তর দিল না সত্যেন। মরিয়া হয়ে হাত তুলল সে। আঙুলের ভঙ্গী হল যেন টেবিলে পর পর শোওয়ানো তিনটি বইয়ের উপরেরটিকে আঁকড়ে ধরবে, কিন্তু তারপরেই সেই হাত ভিজে ন্যাতার মতো ঢলে পড়ল কোলের উপর…বৃথা! বই দিয়ে মুখ লুকোবে কার কাছে? কার কাছে লুকোবে যে তার সমস্ত মন পড়ে আছে ঐখানে, ঐ বাড়িটায়, দু-মিনিট দূরে… কিন্তু এখন যেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। লুকোতে হবে না, আর ভাবতে হবে না, আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপরেই রাত্রি, রেলগাড়ি, অন্য দেশ। কী আছে সেই দেশে? শাস্তি আছে? মুক্তি আছে? আশ্রয় আছে? না–তার এই ঘরে এখন যা আছে সেখানেও তাই আছে—শূন্যতা, শুধু শূন্যতা। তবু, এই যাওয়াটা একটা চেষ্টা অন্তত। একজন মানুষ, মাত্র একজন মানুষ যেখানে নেই, সেখানে কিছুই নেইএই অসম্ভব অবস্থাটাকে স্বীকারের চেষ্টা—আর চেষ্টা করতে গিয়ে হয়তো তার শক্তি বাড়বে, খুঁজে পাবে নিজেরই মনের পলিমাটির তলায় আরো পুরোনো পাথর। কিন্তু ফিরে তো আসবে? তারপর আবার? না, ফিরে এসে এ-বাড়ি ছাড়বে, এ-পাড়া ছাড়বে, ছেড়ে দেবে কলেজে মেয়েদের ক্লাস। দেখা না হলেই ঠিক হবে সব। শূন্যতার ধু-ধু রাজ্য পার হয়ে আবার ফিরে পাবে নিয়মের আরাম, অভ্যাসের আশ্রয়, তার সম্পূর্ণ সত্তা, তার স্বাধীন মন। ঠিক, এই ঠিক। নিজের ছাড়পত্র নিজেই লিখে, সই করে তার একটু হালকা লাগল। একটু বেশি হালকা, যেন ডাক্তার বলেছে ভয় নেই, ব্যানো সারবে কিন্তু একটি পা কেটে ফেলা চাই। তারপরেই মনে হল–আর তো দেখা হবে না, তাহলে আজ আর একবার। মনে হতেই উঠে বসল চেয়ারে, হঠাৎ যেন বেঁচে উঠল, ফিরে পেল বাস্তবের পৃথিবীটাকে। আবার যাবে? ঐ দুপুরবেলার পর আবার! সত্যেন মনের চোখে দেখল সেই তিনটে ছাইরঙের সিঁড়ি, সবুজ দরজা, উল্টোদিকের নীল পরদাটা, আর সেই পরদা সরিয়ে স্বাতী এসে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে। কী বলবে? কোনো কথা নেই, আর নয়তো এত কথা আছে যা কখনো শেষ হবে না। এতদিন ধরে এত কথার পরেও তবু তো সব কথাই বাকি থাকল–বাকিই থাক। কী হবে গিয়ে…সত্যেন আবার এলিয়ে পড়ল চেয়ারে গিয়ে তো সেই চলেই আসতে হবে আবার। বাড়ি, সিঁড়ি, দরজা মিলিয়ে গেল তবু দাঁড়িয়ে থাকল স্বাতী। তার পিছনে নীল পরদাটা, শূন্য-হয়ে-যাওয়া বিশ্বে শুধু স্বাতী। যেমন মাঠের মধ্যে শুয়ে থাকলে মনে হয় আকাশের গায়ে ঐ সাদা মেঘ ছাড়া কোথাও কিছু নেই। নড়ল না, সরল না, স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। স্বাতীর চোখ, চোখের ভিজেভিজে আভা, তাও দেখতে পেল সত্যেন—যে অপেক্ষা করছে; কেউ কিছু বলবে বলে, কোথাও কিছু ঘটবে বলে অপেক্ষা করছে। স্বাতী অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিছু সে বলেনি, কিছু সে ভুলে গেছে—আর সেইটে মনে পড়লে, সেইটে বলা হলেই সব মিটে যাবে, সব ঠিক হবে। এতক্ষণ শূন্যতা ছিল, অশান্তি জায়গা জুড়ল এবার। এটা তার একার ব্যাপার নয়; আর একজনেরও অংশ আছে, তার সমান-সমানই অংশ। অথচ এতক্ষণ সে নিজের কথাই শুধু ভাবছিল, সে কেমন করে ফিরে পাবে তার শান্ত জীবন, তা-ই ভাবছিল শুধু আর সেজন্য দুঃখ মেনে নিতে প্রস্তুত করছিল নিজেকে। তার জীবন! আর কি তার জীবনের উপর কর্তৃত্ব আছে তার? সে কি ইচ্ছে করলেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে, যদি ইচ্ছাটাও তার একলার না হয়, আর একজনের? নিজেকে দুঃখ দিতে পারে? দায়িত্ব, দায়িত্বের ভার সত্যেনের মাথা নামিয়ে দিল কাঁধের উপর, চোখ বুজিয়ে দিল। চেষ্টা করলো না-ভাবতে, কিছু না-ভাবতে, একটা ঝাপসা, ঝিমোনো ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে যেতে। কিন্তু চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে, ভিজে ভিজে আভার চিকচিকে চোখ, বোজা চোখের অন্ধকারে জেগে আছে, দেখছে তার চোখের ভিতরে, মনের ভিতরে, বিধছে তার শরীরে…বিধছে। সেই চোখ থেকে ছাড়া পেতে সত্যেন চোখ খুলে ফেলল আর সামনের মেঝেটার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল যে এখন একটিমাত্র উপায় আছে তার। তাদের সে উপায় বিয়ে। বিয়ে! কথাটা অদ্ভুত শোনাল তার কানে। কেন, নিজেকে প্রশ্ন করল, এর মধ্যে কখনো কি কথাটা উঁকি দেয়নি তোমার মনে? হয়তো কিন্তু তাই বলে সত্যি? সত্যি তো হবেই কখনো। তাই বলে এখনই! তা-ই তো ভাল, সবচেয়ে ভাল—স্বাভাবিক। স্বাভাবিক? না গতানুগতিক? তা হলে তো সবচেয়ে গতানুগতিক বেঁচে থাকাটা।

সত্যেন একবার মনটাকে দৌড় করিয়ে আনল তার প্রথম যৌবনের বছরগুলির উপর দিয়ে। সব অর্থেই স্ত্রীলোকবর্জিত জীবন তার। অভাববোধ ছিল? হয়তো, কিন্তু অধৈর্য ছিল না। অনেক দেখেছে সহপাঠীদের মধ্যে—যুবতীদের সঙ্গ পেতে অন্তহীন উদ্যম তাদের। আরো সাহসী যারা, তাদেরও দেখেছে। বীরদের বিদ্রপ মেনে নিয়ে নিজেকে বাজে খরচ না করে ঐ বছরগুলি সে কাটিয়ে দিতে পেরেছিল কীসের জোরে? অন্যদের চেয়ে সে ভাল বলে না—ঈশ্বর জানেন— বুদ্ধিমান বলেও না—নিঃসাড় বলে তো নিশ্চয়ই না, তার কারণ বোধহয় এই যে অল্প বয়স থেকে কবিতা পড়ে পড়ে এ বিষয়ে একটা কল্পনা জেগেছিল তার, আর সেই কল্পনার কাছে গোপন, খুব গোপন একটা প্রতিজ্ঞায় সে আবদ্ধ ছিল। কখনো মনে হয়েছে সেই কল্পনার ছবি হয়তো কোনো মানুষের মধ্যে দেখবে কিন্তু তার মধ্যে বিয়ের কোনো কথা ছিল না, অন্তত বাধ্যতা ছিল না। বিয়ে? না-ই বা হল—আর হয় যদি তো হবে কোনো একদিন—এই রকমের টোকায় এতদিন সে কথাটাকে মনের এপাশ থেকে ওপাশে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এখন আর পারল না, কথাটা হঠাৎ কাটার মতো এঁটে বসল। হঠাৎ? হঠাৎ বলে কিছু নেই, সবই আমরাইচ্ছে করে ঘটাই। বলো, সত্যি বলো, তিন বছর আগে এক সকালবেলায় কলেজের ক্লাসঘরে বই থেকে চোখ তুলে তুমি কি তোমার কল্পনার ছবি বাস্তবে দেখেছিলে? না কি এই তিন বছরে একটু একটু করে তুমি তোমার কল্পনাকেই ঘেঁটে কেটে মিলিয়ে নিয়েছ তার সঙ্গে? বলল, কবুল করো—এটা কি আকাশ থেকে পড়ল তোমার উপর না কি তুমিই দিনে দিনে এটাকে বানিয়েছ, তারপর খড়-মাটি-রঙের মধ্যে প্রাণ দিয়েছ তুমি! শুধু আমি? দুজনেই…দুজনেই, দুজন ছাড়া কিয়? কিন্তু দুজন আর কোথায়, দুজনের এখন এক জীবন। এখন তোমরা একা সত্যেনের মেরুদণ্ড বেয়ে শিউরানি নামল ঠাণ্ডা। তারা এক! কখনো আর আলাদা হবে না? আর তার মানেই বিয়ে? হৈ-চৈ, পৈতে-পরা মূর্খ পুরুৎ, নতুন ফার্নিচারের মদ-মদ গন্ধ। দুজনের মধ্যে যা জন্মাল, বড়ো হল, সেই জীবন্ত সুন্দরকে ঢোল পিটিয়ে বিশ্বসংসারে রটানো। কিন্তু তা ছাড়া আর উপায় কী? আর কোন উপায় আছে যাতে চোখ হরে দেখা যায়, সব কথা বলা যায়, চলে আসতে হয় না? আর কোন পথ আছে যাতে ফিরে আসা নেই? প্রশ্নটি একটু যেন ভেসে থাকল তার মনের উপর, কোনোদিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আস্তে ড়ুবে যেতে লাগল আর তখনই মস্ত ঘোলা ঢেউ তুলে ফিরে এল সব–সেই সব, তার রাঁচির টিকিট, দু-বার করে বিদায় নেয়া, তার একটু আগের কত কিছু সংকল্প। কোনটা? তাকে মনস্থির করতে হবে—আজই, এখনই। যদি যায়, সেটা শুধু কলকাতা ছেড়ে বেড়াতে যাওয়া হবে না, ছেড়ে যেতে হবে এই সমস্তটা জীবন। যে জীবন তার হতে পারত, হতে পারে। আর আজ যদি না হয় তাহলে আর দেরি করতেও পারবে না। কোনটা? সত্যেন চেয়ার ছেড়ে উঠল। মনে হল তার শরীরের কোনো ওজন নেই, মেঝের উপর দিয়ে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। শোবার ঘরে এল, আয়নার সামনে চুল আঁচড়াল, অচেনা লাগল নিজের মুখ। বসে বসে আর ভাবতে পারে না—বাইরে, যেখানে হয় কাটিয়ে আসবে। আর তো কয়েক ঘন্টা সময় আছে, অন্তত কয়েকটা ঘন্টা তাকে নিশ্চিত কিছু করতে হবে না। পকেটে টাকা নিল, হঠাৎ মনে পড়ল শিলং… যেদিন শেষ চিঠিটা পেয়েছিল আর পেয়েই ট্রেন ধরতে ছুটেছিল। সেদিনই বুঝেছিল আজকের মতো একটা দিন আসবে, আসবেই। সব বুঝেছে, সব জানে, স্বাতীও জানে। ও বাড়ির সকলেই বুঝেছে এতদিনে—এতক্ষণে; শুধু ভান, নিজের কাছে নিজের মান বাড়ানো। যা-ই করুক, যা-ই ভাবুক, পারবে নাকি এখন কলকাতা ছাড়তে? পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে! সত্যেন বেগে বেরিয়ে এল রাস্তায়। দ্রুত হাঁটল রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে, ডান দিকের গলিটার দিকে সাদা একতলাটার দিকে ফিরেও তাকাল না। সোজা চলে এল ট্রামরাস্তায়, ট্রামে উঠে একেবারে এসপ্লানেড়। মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়াল, যেন সে এ জন্যই এসেছে। সেখানে টিকিট না পেয়েই এল অন্য একটায়, ঢুকে পড়ল। ছবি আরম্ভ হয়ে গেছে তখন। ঘরে নীলচে অন্ধকার। অতগুলি একভাবের মানুষ আর পরদার উপর কড়া আলোয় দেখানো ছায়াছবি–সব মিলিয়ে একটু উপশম আনল তার মনে। নিবিষ্ট হতে চেষ্টা করল। দুই বন্ধু একই মেয়েকে ভালবাসে। একজনকে সে বিয়ে করল, আর একজন দেশ ছাড়ল নাবিক হয়। সময় কাটল। নাবিক ফিরল, আবার দেখা হল, আর দেখামাত্র তার প্রেমেই পড়ে গেল মেয়েটি। নাবিক কিন্তু বন্ধুকে ঠকাতে রাজি না। এদিকে স্বামী ব্যাপার বুঝে সান্ত্বনা খুঁজল এক নাচওয়ালিতে, তাতে আবার স্ত্রীর আঁতে ঘা লাগল। টানাপোড়েন চলল, সময় আর কাটে না। সত্যেনের মনে হতে লাগল চেয়ারটা তেমন আরামের না, লোকেরা বড়ো কাশছে, এবার তো শেষ হলেই পারে। যুদ্ধ বাধল—সব সমস্যার সমাধান—স্বামী আকাশে পাইলট, নাবিক ড়ুবোজাহাজে কাপ্তান, আর দুই বীরের ফটোগ্রাফ নিয়ে মেয়েটি গদগদ—এবার গড সেভ দি কিং বাজলেই হয়, কিন্তু সত্যেন তার আগেই উঠল, বেবিয়ে এল মিটমিটে চোখে হলদে-হওয়া রোদ্দুরে। এখন তো বেলা! তাহলে? আচ্ছা, এক পেয়ালা চা। চৌরঙ্গিতে এসে প্রথম যে রেস্তোটা, সেটাতেই ঢুকে পড়ল। সে বসতেই পাশের টেবিল থেকে একজন বলে উঠলআ-রে সত্যেন! সত্যেন মুখ ফিরিয়ে দেখল, মটন-চপের গায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিরণ বক্সি। কিন্তু যে কিরণকে সে চিনত, যে তার সঙ্গে চার বছর কলেজে পড়েছিল, সেই খদ্দর-পরা খেচাঁদাড়ি কিরণ বক্সি না। গরদের পাঞ্জাবি, সোনার বোম, ফিটফাট চুল, সবসুদ্ধ একটা একদম-নতুনের চোখে-পড়া চকচকানি।—এস না এই টেবিলেই-কিরণ অন্য হাতটা শূন্যে নাড়াল আর সত্যেন তার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসতে বসতেই আবার বলল কতকাল পর দেখা! তারপর—কী খবর?

খবর তো তোমার—সত্যেন একচোখে তাকাল কিরণের গালের দিকে–দাড়ি তো কামায়নি, যেন ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে, আবার পাউডারও!—কী ব্যাপার?

আর বোলো না ভাই, একটা কাণ্ড হয়ে গেল এর মধ্যে—বলতে বলতে কিরণের চিকচিকে গালে হাসির দুটো বড় বড়ড়া ভাঁজ পড়ল।

কবে?

ষোলোই শ্রাবণ। কিরণ গম্ভীর গলায় দিন-ক্ষণ জানাল, যেন তার বিয়ের তারিখটা সত্যেনের কাছেও সকলের কাছেই বিশেষ একটা দিন। তোমাকে খবর দিতে পারিনি… বড়ো… হঠাৎ.. আর কোথায় আছ তাও ঠিক–

তাতে কী হয়েছে, চপটা খাও।

হ্যাঁ, এই যে, তুমি তুমি কী খাবে বল।

চা।

আর–কিছু না কিছু না কিছু খাও! যা তোমার ইচ্ছে। আমি খাওয়াচ্ছি! সত্যেন একটু হাসল। আহাখাও না কিছু!– কিরণ সহৃদয়তায় উদ্বেল হল-চপ কাটলেট ভাল না লাগে অন্য কিছু? স্যাণ্ডউইচ? কেক? ঠিক—কেকটাই তোমার পছন্দ—মনে নেই কর্ণফুলি কেবিন? সত্যেন ভাবল, কিরণ যে রকম বলছে সে রকম ঘনিষ্ঠতা ওর সঙ্গে আমার ছিল কি? আর সেই ফাঁকে কিরণ হাঁক দিল-বোয়! বোয় এনে সত্যেনের সামনে কেক রাখল, কিশমিশঘন পুষ্ট একটি আধো চাঁদ। কিরণ খুশি হয়ে বলল-বে-শ! একা বসে খেতে কি ভাল লাগে? একাই তো খাচ্ছিলে।

তুমি তো আসনি তখন— এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে কিরণ ফিরে গেল তার মটন-চপে—আর আগের কথায়। চিবোত চিবোতে বলল-হ্যাঁ, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই বাদ পড়ে গেল। আর দেখাশোনাও হয় না—সবাই ব্যস্ত বেশ ছিল স্টুডেন্ট লাইফটাকী বলে? বলে পিঠচাপড়ানো হাসল। সত্যেন বলল–তোমার ওকালতি কেমন?

আর সে কথা! আলিপুরে বেরোচ্ছিলাম—ট্রামভাড়াটাও পোত না। এখন ইনকাম-ট্যাক্স ধরেছি, এটাতে একটু আশা আছে আমার শশুর আবার আই. টি. ও. কিনা।

আই. টি. ও?

ইনকাম-ট্যান্স-অফিসার। বুঝছ না—এটা একটা মস্ত ব্যাকিং। আর ইনকাম-ট্যাক্সের প্র্যাকটিসে পয়সাও চটপট-ইশ, একটু ধার নেই ছুরিটায়..

কেনই বা ও সব হাঙ্গামা, হাত দিয়েই খাও! সত্যেন আঙ্গুলে ভেঙে একটু কেক মুখে দিল।

সত্যি! ছুরি কাঁটা দিয়ে কি ঠিক মতো খাওয়া যায়! কিরণ ওসব সরিয়ে রেখে হাত লাগাল, কিন্তু একটু পরেই বলে উঠল–এঃ!

কী হল?

কিরণ ভরামুখে দুঃখীসুরে বলল—ঝোল পড়ে গেল পাঞ্জাবির হাতায়। সত্যেন তাকিয়ে দেখল কিরণের মুখে একটা সত্যিকার হায়-হায় ভাব। তার জামার হাতার দিকে চোখ নামিয়ে বলল— কই বোঝা তো যাচ্ছে না কিছু।

যাচ্ছে না?—মুখের মটনটা ভাল করে না চিবিয়েই কিরণ গিলে ফেলল। হাতটা উঁচু করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, তার আংটির হিরে ঝিলিক দিল সত্যেনের মুখে। একটু পরে বলল—এখন জামার রঙে মিশে গেছে, কিন্তু শুকোলেই…ধুয়ে ফেলব এখনইঃ সত্যেন বলল—না না, তাতে আরও ছড়াবে, আর ইস্ত্রিও নষ্ট হবে।

ঠিক! তাহলে এই থাক—কী বলে? ইশশ! গরদের উপর ঈষৎ ভারি রঙের ক্ষুদ্র বিন্দুটির দিকে শশাকের চোখে শেষবার তাকিয়ে কিরণ হাত নামাল, ঠিক হয়ে বসল। অনেকটা নিস্তেজ গলায় বলল–তারপর… তুমি তো সেই কলেজেই…এখন কোত্থেকে?

একটা ফিল্ম দেখে এলাম।

কোনটা? সত্যেনের মনে পড়ল, যে ফিল্মটার নাম সে জানে না, বাইরের দেয়াল-ছবিও লক্ষ করেনি। অগত্যা হাউসটার নাম করল।—ও এন্ডস মিটিং দেখে এলে! কেমন?

মন্দ না।

ভাল শুনেছিলাম—জ্যানেট গ্রীন আছে—আমার আর দেখা হল না।

কেন?

আর বোলো না। অনীতা আবার বাংলা-ফিল্মের পোকা-অনীতা আমার স্ত্রীর নাম। কেমন নাম?

অমিতা খুব ভাল নাম।

অমিতা না, অ-নীতা। কিরণ আওয়াজ করে হেসে উঠল। সব্বাই এ ভুলটা করে। বেশ নতুন না?

সত্যেন বলল—হ্যাঁ। ভাবল–মা-বাবারা একটু ভেবেচিন্তে নাম রাখলে তো পারেন, যাতে একটা মানে অন্তত হয়। অনিলেন্দু আর অনীতায় দেশ তত ছেয়ে গেল।

হ্যাঁ—ঐ বাংলা-ফিল্মগুলো জানো তো দু-চক্ষের বিষ আমার, কিন্তু কী করব, দায়ে পড়ে যেতেই হয়—এই সপ্তাহেই দুটো হয়ে গেল। আর এও ভাবি যে আমরা কেউই যদি না যাই তাহলে একটা দিশি-ইন্ডাস্ট্রি গড়েই বা উঠবে কী করে!

সত্যেন বলল—সে তো ঠিক।

না হে, বিয়ে করলে আর স্বাধীনতা থাকে না। এই তো এই ছুটিটা—ছুটিতে তো মানুষ একটু বিশ্রাম করে—আমার কেটে যাচ্ছে কেবল শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরে ঘুরে। এখন যেতে হবে দু-জায়গায়। প্রথমে ক্রিক রো, সেখান থেকে ফড়েপুকুর। এক বাড়িতে অসুখ, আর এক বাড়িতে এক বৌদির নতুন বাচ্চা হয়েছে–কেমন আছে-টাছে এই আরকি। খুব যেন বিরক্ত ভাব করে কিরণ প্লেটটার দিকে তাকাল, তারপর চপের শেষ অংশটুকু মুখে পুরল। সত্যেন বলল-সেইজন্য মজবুত হয়ে নিচ্ছ? হ্যাঁ—তা—তা বলতে পার। কিরণ খুব হাসল কথাটা উপভোগ করে। কিন্তু একা যে? কিরণের হাসিমুখ নিমেষে গম্ভীর হল। একটু নিচু গলায় বলল—সেই তত! সব ঠিকঠাক, মার হঠাৎ শখ উঠল বৌকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাবেন। বোয়! রাগি আওয়াজে হাঁক দিল—ফিঙ্গার বোল?

তাই বুঝি রাগ করে বাড়িতে চা খাওনি? কিরণ জলের বাটিতে আঙুলে আঙুল ঘষে হাত পরিষ্কার করল। রুমালে মুছে বলল—মায়েদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই, আর স্ত্রীরা—তারা সকলকে খুশি রেখে চলবেন-তোমাকে ছাড়া। দ্যাখো না, অসুখও এমন কিছু নয়, বাচ্চার মা-ও ভাল আছে—আমার একলা যাবার কি কোনো মানে হয়? কিন্তু না যদি যাই— কিরণ মাথা নাড়ল, ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চা-টা এক টেকে গিলে কথা শেষ করল—বেশ আছ হে, বেশ আছ!

সত্যেন একটু পরে বলল—তোমার হয়েছে?

হ্যাঁ—চল! কেকটা তো খেলেই না দেখছি—বিল কিন্তু আমি। কিরণ বিল মিটিয়ে উঠল, আস্তিন সরিয়ে সোনার কব্জিঘড়ি দেখল। তার চোখের ভাব বদলে গেল, একটু আপশোষের ছোট্টো আওয়াজ বেরোল। সত্যেন বলল–ওটা কিন্তু চোখেই পড়বে না কারও, যদি-না তুমি দেখিয়ে দাও।

হ্যাঁ। কিরণ সোজা হয়ে দাঁড়াল, নড়ে চড়ে বলল—আর কাচালে তত উঠেই যাবে।

হ্যাঁ, কাচালে নিশ্চয়ই উঠবে।–সত্যেন আগে রাস্তায় নামল। তুমি তো এখন ক্রিক-রো? আর বল কেন! কিরণের গালে আবার হাসির ভাঁজ পড়ল। চৌরঙ্গি পার হতে হতে বলল–তা তোমার খবর তো কিছুই শোনা হল না। সেই মেসে-ই—? বেদম আওয়াজে একটা লরি গেল, জবাব দেবার দরকার হল না। বেশ লাগল তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে কিরণ কথা চালাল। এসো না একদিন আমার ওখানে-মনে আছে তো সর্দার শঙ্কর রোড? কালই এসো না, অনীতাও খুশি হবে খুব। এসে চা খাবে বিকেল বেলা, ঠিক? ফুটপাতে উঠে সত্যেন বলল খুব সুখের কথা, কিন্তু আমি আজ রাঁচি চলে যাচ্ছি।

রাঁচি যাচ্ছ? তা যাবেই-বা না কেন? স্বাধীন মানুষ তুমি–আর আমরা এদিকে—এই যে তিন নম্বর বাস। তাহলে ফিরে এসে—মনে থাকবে তো? আচ্ছা। কিরণ তাড়াতাড়ি বাসে উঠে পড়ল, জানলায় হাত নেড়ে বিদায় নিল আর একবার।

বাসটা চলে গেলে, সত্যেন দাঁড়িয়ে থাকল সেখানেই। দিন চলেছে। পশ্চিম-খোলা চৌরঙ্গি সোনার পাতের মতো জ্বলজ্বলে, এক-একটা দোকানের কাচের জানলায় রোদ ঠিকরে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল গাড়ির স্রোত, একটার পর একটা বাসে দাঁড়ানো, চলে যাওয়া। রোদের রঙ ঘন হল, ল্যাম্পপোস্টের ট্যারচা ছায়া ফুটপাত পেরিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে দোকানের সিঁড়িতে উঠল। সত্যেন ফিরল ট্রাম-স্টপের দিকে। পশ্চিমে মুখ করে দাঁড়াল। সবুজ ছড়িয়ে আছে ময়দানে, সোনালি—ঘাস, গাছ, রাস্তা, বেঞ্চি, বাচ্চাদের খেলা, পাথরের মূর্তি, সব নিয়ে সোনালি-কমলারঙের লালচে। দূরে আবছা ঢিপির মতো ফোর্টটাকে স্পষ্ট দেখা গেল পলকে। ইডেন-গার্ডেনের দিকটা সবুজ থেকে নীলচে হল। সত্যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল একটার পর একটা ট্রামের দাঁড়ানো, চলে যাওয়া। আয়ারা আচ্ছা ছেড়ে উঠল, বিলেতি বাচ্চাদের ঘরে ফেরা শুরু হল, দূরে একটি মূর্তির কালো পাথরে হঠাৎ রক্ত-রঙের রোদ পড়ল। ক শব্দ উঠল তার মাথার উপর, পাখি উড়ে এসে বসল সামনের গাছটায়। সত্যেন ট্রামে উঠে পড়ল।

******

ছোটোমাসি, যাবে না?

হ্যাঁ, চলো।

চলো না! স্বাতী বলল-চলল। তাতা বলল কখন থেকে চলো বলছ! সন্ধে হয়ে গেল না এদিকে? শ্বেতা বলল-আঃ! কেন বিরক্ত করিস ছোটোমাসিকে। আতা ঠোঁট ফুলিয়ে বললবা রে! ছোটোমাসিই তো বলছিল কাল–। স্বাতী শাড়িটা ঘুরিয়ে পরে নিল, চুলে চিরুনি ছোঁওয়াল, দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

আজ চিলড্রেন্স পার্কে, ছোটোমাসি? স্বাতী বলল-আজ চলো ঐ মাঠটায়।

না, ছোটোমাসি—

একটা শিউলি গাছ আছে ওখানে। বেশ ফুল কুড়োবে। ওঃ শিউলি! কত শিউলি আমাদের মৈমনসিঙে! শিউলি দিয়ে কী হবে!

কী দিয়েই বা কী হবে তাহলে?–তাতার কথা উড়িয়ে দিলো আতা। আমার খুব ফুল কুড়োতে ভাল লাগে, চলো। ছোটোমাসির মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে তাতা বলল—আমি অনেক বেশি কুড়োব দিদির চেয়ে—দেখো। একটু জোরে হাঁটো ছোটোমাসি।

দুই বোনঝিকে দু-পাশে নিয়ে স্বাতী মাঠে এলো। মাঠ আর নেই, পাড়া হয়ে গেছে। লাল শুরকি রাস্তা, ইলেকট্রিকের তার, টাটকা-রঙ-করা ছোটো-ছোটো বাড়ি। কোনোটা এখনো হচ্ছে, কোনোটা শেষ হয়েও খালি, কোনোটায় শেষ না হতেই লোক এসে গেছে, আর তার সেই অনুকূলকাকার বাড়িটা—ভাড়াটে আছে সেখানে বাইরের সাদা রঙে কালচে ধরেছে এর মধ্যেই। না, মাঠ নেই, তবু মাঝে মাঝে ফাঁকা, আর একেবারে পশ্চিমটায় খানিকটা মাঠ আছে এখনো। জায়গাটা কেমন ছিল আগে, তিন বছর আগে? কিন্তু এটাই যে সে জায়গা তা আর মনে হল না স্বাতীর-সেই মস্ত মাঠ, ঘন গাছ-বাড়ির জানলা দিয়েই দেখতে পেত তখন–সে সব বদলে এখন এই হয়েছে… তা যেন ঠিক না… সে সবও আছে, অন্য কোথাও আছে, চিরকাল থাকবে সেখানে। নিজের পাড়ায় নিজেকে তার আগন্তুক লাগল, শুরকির রাস্তা পার হল তাড়াতাড়ি, বাড়িগুলির দিকে আর তাকাল না। পশ্চিমের এবড়োখেবড়ো মরা ঘাসের মাঠে এসে দাঁড়াল।—কই ছোটোমাসি, শিউলি গাছ?

এই যে।

ও মা, এই! দিদি, আমাদের সেই পুকুরপাড়ের শিউলি গাছটা কত্ত বড়! আতা সঙ্গে সঙ্গে বললো—মোটেও না! মোটেও খুব বেশি বড়ো না।

বড়ো না! দ্যাখো দিদি। স্বাতী বলল—ঐ দ্যাখো ফুল পড়ে আছে।

কই?

খুঁজলেই পাবে।

ছোটোমাসি, তুমি তুলবে না আমাদের সঙ্গে?

আমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকি, দেখি তোমরা কে কত আনতে পারো। স্বাতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল–কখনো আতা-তাতাকে, কখনো অন্য সব দিকে। জায়গাটা সুন্দর না, বরং উল্টোই, কিন্তু তারও কেমন একটা ছবি হয়েছে। একটা দিক গাছপালায় কালো, আবার আর একদিকে রসা-রোডের উঁচু-উঁচু হাতও দেখা যাচ্ছে, আর ঐ কোণে কয়েকটা সুপুরি গাছের ছাতছাড়ানো ঝাকড়া মাথায় সূর্যাস্তের একটু রঙ আটকে আছে এখনো। স্বাতীর চোখের সামনে একটা দিন, আরো একটা দিন আস্তে আস্তে মরে গেল। জায়গাটার চেহারা বদলে গেল হঠাৎ। আলো নেই, কেউ নেই, শূন্য। আশ্বিন মাসে যেমন হয়, সারাদিন ঝকঝকে গরমের পর শীত-করা কুয়াশার সন্ধ্যা দুঃখী মুখে পাশে এসে দাঁড়ায়। স্বাতী ডাকল—আতা! তাতা!

যা–ই। স্বাতী ওদের কাছে গিয়ে বলল—বাড়ি এবার।

না ছোটোমাসি, আর একটু—বলে আবার অন্যদিকে সরে গেল ওরা। স্বাতী আবার একটু পরে ডাকল ওদের। আতা আগে এসে বলল—বেশি ফুল নেই ছোটোমাসি, এই কটা মোটে পেলাম। আর যা ধুলো আর ময়লা! তাতা তক্ষুনি ছুটে এসে বলল—এই দ্যাখো আমি বেশি পেয়েছি। কেমন, বেশি না?

অনে–ক বেশি!–কিন্তু স্বাতীর গলায় কিশোর উৎসাহ ঠিক ফুটল না।

কোথায় রাখি, ছোটোমাসি, ফুলগুলি? আতা বলল—আমাকে দে। আঁচলে বেঁধে রাখি সব।

না! আমারটা তুমি রাখো ছোটোমাসি।

স্বাতী হাতের মুঠোয় ফুল নিয়ে বলল চলো। আতা বলল—বাড়ি তো ওদিকে।

চলো একটু ঘুরে যাই।

হ্যাঁ–তা-ই ভালো! জানো ছোটোমাসি, এখানকার শিউলি কেমন রোগা-লোগা! আর আমাদের সেই পুকুরপাড়ের শিউলিতলা ইশ! তুমি যদি একবার দেখতে, ছোটোমাসি! মাসির হাত ধরে আতা তাড়াতাড়ি বলল—তুমি বুঝি ফুল খুব ভালবাসো? আচ্ছা কোন ফুল তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?

আমি জানি!—স্বাতীর অন্য পাশে বলে উঠল আতা।

তুমি চুপ করো তো দিদি। বলল ছোটোমাসি, কোন ফুল?

কোন ফুল?…কোন ফুল?… স্বাতী হঠাৎ থামল, শুধু কথায় না, চলাতেও থামল। একটা দূর আওয়াজ শোনা গেল, গুমগুম। আতা-তাতাও থামল। আতা বলল কী হল?

শুনছ?

ও-তো ট্রেন! একটু পরে আতা আবার বলল—তাতে কী? তাতা বলল—ট্রেনের শব্দ তো রোজ শুনি আমরা! আতা বলল-রাস্তায় বেরোলে দেখাও যায় কত সময়। টালিগঞ্জের ব্রিজটা কী মজার-নিচে ট্রাম, উপরে রেলগাড়ি! একদিন রেল-লাইনে উঠবে, ছোটোমাসি? স্বাতী কথা বলল না, নড়, না, নড়তে সে পারে না–তার তা-ই মনে হল—যতক্ষণ না শব্দটা মিছি  যায়। হাতের মুঠো শক্ত হল তার। ভাবল, ফুলগুলো নষ্ট হচ্ছে। শব্দের একটা প্যাঁচানো সুতে। লম্বা হয়ে খুলতে খুলতে ফুরিয়ে গেল। স্বাতী বুঝল তার চোখে জল আসছে। আসতে দিল, অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে।

চলল ছোটোমাসি! স্বাতী আবার হাঁটল, তাড়াতাড়ি এবার, কিন্তু বাড়ির…সেই বাড়ির আরো কাছে এসে মৃদু, আরো মৃদু হল তার চলা। দরজা বন্ধ, ঘর অন্ধকার। উপরতলায় আলো জ্বলছে। একতলাটা বন্ধ, অন্ধকার।

উঃ! তাতা চেঁচিয়ে উঠল দিদি আমার পা মাড়িয়ে দিল।

তুই অমন পায়ে-পায়ে হাঁটিস কেন?

শোনো ছোটোমাসি— তা আখুটে গলায় আরম্ভ করল, কিন্তু মাসির মুখ দেখে থেমে গেল। একটু পরে একেবারে অন্য সুরে বলল—একটা কথা শোনো, ছোটোমাসি। মাসি তাকালো তার দিকে। তাতা ফিশফিশ করে বলল—এইটে তোমার সত্যেনবাবুর বাড়ি না? স্বাতী মাথা নাড়ল। আছেন এখন বাড়িতে?

আতা হেসে উঠল—কেন? তুই যাবি নাকি? দিদির এই একটা কথা তাতা বিনা-জবাবে ছেড়ে দিল, উপরের দিকে তাকিয়ে তেমনি ফিশফিশ গলায় বলল—আছেন বোধহয়। আতা বলল— দূর বোকা! উপরে তো অন্যেরা থাকে; আর ফিশফিশ করছিস কেন ও রকম? যেন কী একটা ভীষণ গোপন কথা! আতা আবার হাসল। তুমি চুপ করো তো দিদি!–তাতা বেশ গলা চড়াল এবার। চল এখন! আতা তাড়া দিল বোনকে রাস্তার মধ্যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না! বাকি পথটুকু তর্ক করতে করতে এল দু-বোন। স্বাতী তাদের গলা শুনল, একটা কথাও বুঝল না। হঠাৎ মনে পড়ল, ফুলগুলো? আছে হাতে। বন্ধ, অন্ধকার। ট্রেন কখন? হাতটা ঘামছে। ফুলগুলি বাঁ হাতে নেব?

আতা-তাতার গলা থেমে গেল হঠাৎ স্বাতীর কাপড়ে টান পড়ল। কী? আগের চেয়েও ফিশফিশ গলায় আতা বলল-ছোটোমাসি। স্বাতী তাকিয়ে দেখল, সামনেই বাড়ি। আর সিঁড়ির ধাপে দরজার ধারে সত্যেন। দরজায় আঙুলের টোকা পড়ল তিনবার। আতা নিচু গলায় বলল–কী রে, কেউ শুনতে পায় না? আমি যাই ওদিক দিয়ে। আমিও তাতা ছুটল আতার পিছনে। সত্যেন ফিরে তাকাল। স্বাতী তিনটি সিঁড়ি উঠল। সত্যেন বলল—আবার এলাম। স্বাতী কিছু বলল না। সত্যেন বলল—এলাম মানে… আসতেই হল। স্বাতী কিছু বলল না। একটু চুপ করে থেকে সত্যেন আবার বলল–আসতেই হল, না এসে পারলাম না। তা… আমার বোধহয় সময় হল এদিকে… আচ্ছা–. স্বাতী বলল—না। হাত থেকে কয়েকটা শিউলি তার পায়ের কাছে পড়ল। আবার বলল-না, যেয়ো না। ভিতর থেকে দরজা খুলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *