কোথাও যাব না, তোমার কাছেই থাকব। কিন্তু যেতেই হয়। শাশ্বতীর পালা এল।
কয়েকমাস আগে রাজেনবাবু এসেছেন নিজের বাড়িতে। টালিগঞ্জে। ব্রিজের কাছাকাছি, রসা রোড থেকে একটু পশ্চিমে ঢুকে, ছোটো একটু জমি শস্তায় কিনেছিলেন অনেকদিন আগে কোনো এক ফাঁকে। হঠাৎ স্থির করলেন বাড়ি করবেন। একেবারে হঠাৎ নয়, ছমাস আগে থেকে মাস্টারের নিয়মিত আনাগোনা সত্ত্বেও রাজেনবাবু মনে মনে যা ভয় করেছিলেন তা-ই হল, বিজু ফেল করল ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায়। ফেল করে কয়েকদিন খুব মন খারাপ করে থাকল; তারপরই মেতে গেল গরচা ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন-এর সীতা নাটকের ধুমধামে। সোজা কথা নাকি, তাকে সাজাতে হবে তুঙ্গভদ্রা! এ-ছেলের হাতে, রাজেনবাবু ভাবলেন, কাচা টাকা না পড়াই ভাল। অবশ্য টাকা যে তার বলবার মতো কিছু আছে তা নয়। সরকারি সিঁড়ির ধাপে-ধাপে উঠে এতদিনে সাতশো টাকার একটি আসনে বসেছেন বটে, কিন্তু জীবন ভরে অনেক দেনা করতে, অনেক দেনা শুধতে হয়েছে। দশ বছর ধরে স্ত্রীর অসুখ, তিনটি মেয়ের বিয়ে, আর ছেলেমেয়ের সুখের জন্যে হিসেবহীন খরছ কী আর থাকে! তবু, প্রভিডেন্ট ফান্ডটা অনেকবার অনেক মার খেয়েও টায়ে-টুয়ে টিকে আছে, ইনশিওরেন্সের পলিসি দুটোও পেকে এল। বাংলাদেশের অধিকাংশ চাকুরে ভদ্রলোকের টাকা জমাবার উপায় যে দুটি মাত্র, তারই প্রথমটিকে প্রায় নিঃশেষ করে রাজেনবাবু বাড়িটি তুললেন।
বড়ো বাড়ি হল না। একতলা, থাকবার ঘর খানচারেক। চেহারাটাও জাহাজ কি এরোপ্লেন কি লেবং-এর রেসকোর্সের মতো না-নেহাতই সাদাসিধে বাড়ি একটি, যেখানে মানুষ থাকে, খায়, ঘুমোয়। শাশ্বতী সুখী হল না মোটেও। আবার রাস্তার নাম বিধু ঘোষ লেন, সেটাও অপছন্দ। বাড়িটা এখানে কেন করলে, বাবা? একদিন সে না বলে পারল না। এখানে ভাল লাগে না তোর, না রে?
পাড়াটা বড়ো—শাশ্বতী বলতে যাচ্ছিল গরিব। কিন্তু হারীতবাবুর কথাবার্তা শুনে সে গরিবদের শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। সত্যি, তারাই তো সংসার চালাচ্ছে, তারাই সব। একটু থেমে সে কথা শেষ করল—বড়ো পাতিবুর্জোয়া। বি. এ. পড়নি মেয়ের কথা শুনে রাজেনবাবু অবাক, পাতি–? কী বলল? পাতিবজরা? পাতিবিজোড়? পাতিবাছুর? বড্ডো–কী?
এই আর কী! বাবার অজ্ঞতা সহাস্যে ক্ষমা করল শাশ্বতী—দেখছ না, কী রকম ঘেঁষাঘেঁষি। আর বাচ্চাগুলো কী রকম নোংরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়! জানলার তাকে পা ঝুলিয়ে বসে স্বাতী একটা কাচা পেয়ারা চিবিয়ে খাচ্ছিল। হঠাৎ কথাটা কানে যেতেই বলে উঠল-ঘেঁষাঘেঁষি! বলো কী ছোড়দি! এদিকটা কী রকম খোলা মাঠ, গাছপালা, আর কতখানি আকাশ! বাব্বাঃ! যতীন দাস রোডের কথা ভাবতে হাঁপ ধরে এখন! শাশ্বতী হেসে উঠল তার ভঙ্গি দেখে। বলল— দোতলা করলে না কেন, বাবা?
সবটাই আমি করে ফেলব? বিজুর জন্য কিছু বাকি থাক!
দোতলা দিয়ে হবেই বা কী? এই বেশ। ঠিক যেটুকু দরকার সেটুকু। বেশি-বেশি আমার ভাল লাগে না!-একহাতে জানালার শিক ধরে স্বাতী পা দোলাতে লাগল। তক্ষুনি আবার জুড়ে দিল—একতলাই সবচেয়ে ভালো লাগে আমার। বাইরেটা খুব কাছে হয় একতলা হলে। কেমন সুন্দর বাগান করি দ্যাখো না! ছোটো একতলা বাড়ির মতো সুন্দর নাকি আর কিছু? প্রতিপক্ষকে আর কিছু বলবার সুযোগই দিল না স্বাতী। নিজেই জজ হয়ে নিজের পক্ষে রায় দিল, আর নিশ্চিন্ত হয়ে পেয়ারায় কামড় বসাল তারপর।
কিন্তু প্রতিপক্ষ ছাড়ল না, পরে নিরিবিলি ঘরে আবার তর্ক তুলল—আচ্ছা স্বাতী, তুই কেন ভাবিস যে তোর যা ভাল লাগে, সকলেরই তা-ই?
বা-রে! তাই বলে আমার ভাল লাগাটা বলতেও পারব না আমি?
তোর ভাবখানা এইরকম যেন তোর ইচ্ছেমতোই চলবে জগৎ-সংসার।
জগৎ-সংসার তো না, শুধু দু-একজন—
দুই আর কেন, শাশ্বতী বাধা দিল কথায়—ওরকম মানুষ একজনের বেশি তো হতে পারে না, আর হলেও বিপদ।
মানে?
ন্যাকা! এদিকে নভেল পড়ে পেকে ঢোল!
স্বাতী সত্যিই বোঝেনি কথাটা, বুঝল ছোড়দির ঠোঁটের বাঁকা হাসি দেখে। হাসির উত্তরে একটু বেশি গম্ভীর হয়ে বলল—তা এই বাড়ির কথা নিয়ে ঝগড়া কর কেন, এ বাড়িতে তুমি তো আর থাকবে না বেশিদিন!
তুই-ই যেন থাকবি!
নিশ্চয়ই! কথাটা ঠেলে উঠল ভিতর থেকে, কিন্তু আসতে-আসতে যেন জোর কমে গেল, শেষ পর্যন্ত পৌঁছলই না। একটু চুপ করে থেকে কী একটা অন্য কথা বলতে গেল ছোড়দি, শোনো–।
চুপ কর এখন—বলে শাশ্বতী টেবিল থেকে একখানা বই তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শোনো না—স্বাতীর স্বর ব্যাকুল। না!—শাশ্বতী বই খুলল চোখের সামনে। শোনো একটু। প্রায় কান্নার সুরে স্বাতী প্রার্থনা জানাল-মারকস-এর বই এক্ষুনি না পড়লে চলবে না তোমার? মারকস না রে, মার্ক্স শাশ্বতী হেসে শুধরে দিল—দেখি একটু পাতা-টাতা উল্টিয়ে, হারীতবাবু আবার তো আসবেন সন্ধেবেলা। অবাক হল স্বাতী। যে কথাটা বলবার জন্য ছটফট করছিল, সেটা ভুলে গেল। তাতে কী?—খুবই ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন তার।
হারীতবাবুই দিয়েছেন কিনা বইটা।
আজই বুঝি ফেরত দিতে হবে? তা আর-কদিন রাখতে দেবে না বললে?
এ-সব তো আর সত্যি পড়বার বই নয়! শাশ্বতী মুখ টিপে হাসল।—দেখে রাখি একটু এলে বলতে হবে তো দু-একটা কথা।
এমন একটা তাজ্জব কথা স্বাতী তার পনেরো বছরের জীবনে শশানেনি। না-পড়েও ভান করতে হবে অন্যের কাছে? কেন? ভাল না লাগে না-পড়লেই হয়, মুশকিল আর কী! চোখ-ভরা প্রশ্ন নিয়ে ছোড়দির দিকে সে তাকাল, কিন্তু ছোড়দির মুখ আড়াল করেছে দুখানা হলদের উপর কালোতে ছাপা মলাট। শাশ্বতী উঠল খানিক পরেই। টেবিলে সারে দাঁড়ানো পাঠ্যবইয়ের মাথায় অপাঠ্য বইখানাকে সযত্নে শুইয়ে রেখে চলে গেল গা ধুতে। ছোড়দির ব্যস্ত ভাব দেখে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল স্বাতীর। টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে বইখানা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে পাতা ওল্টাতে লাগল। কেমন ভয় হল তার, বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল, কখন কোন পাতার ফাঁক থেকে আবার ঝিলিক দেয় নীল রঙের খাম। কতক্ষণে সব পাতা ওল্টাবে… বইখানা উপুড় করে জোর কঁকানি দিল কয়েকবার। না কিছু নেই। ঠিক জায়গায় আবার শুইয়ে রাখল মার্ক্সকে, কী ভালমানুষের মতোই শুয়ে আছে বইখানা, কিন্তু, কিন্তু…কিন্তু কী?
মাথায় তোয়ালে চেপে ঘরে আসতে-আসতে শাশ্বতী বলল—তুই যা এবার।
পরে যাব।
এই তোর এক বদভ্যাস, স্বাতী। তোয়ালে নামিয়ে শাশ্বতী চিরুনি হাতে নিল—অন্তত বিকেলে তো একটু ফিটফাট হতে হয়?
আমি সারাদিনই ফিটফাট-স্বাতী ধুপ করে শুয়ে পড়ল খাটে।
শুলি যে?
শুই না!
যত অসময়ে!–কালো চুলে সাদা-সাদা আঙুল দ্রুত ওঠাপড়া করতে লাগল শাশ্বতীর। আচ্ছা ছোড়দি, দু-আঙুলে কপালের চামড়া একটু টেনে ধরে স্বাতী বলল—শুভ্রবাবুর খবর কী?
কী অদ্ভুত! আমি কী করে জানব?
আমাদের এ বাড়িতে একদিনও আসেননি-না?
ও বাড়িতেও আর আসত কই শিগগির। খেটে-খেটেই ফুরসৎ নেই? ঐ ফিতেটা দে তো। বড়ো যে দরদ দেখছি তার জন্য। দু-চক্ষে দেখতে পারতিস না তো!
আমার ইচ্ছায় তো জগৎ চলে না—স্বাতী পাশ ফিরে একটি হাত রাখল শালের তলায়। আমি দেখতে না পারলেই তো মন্দ হয়ে যায় না মানুষ। জবাব না দিয়ে শাশ্বতী হেজেলিন-স্নোর মুখ খুলল। হলদে আর কালো মলাটের সেই শশাওয়ানো বইটার উপর আবার চোখ পড়ল স্বাতীর।
ছোড়দি, মার্ক্স কী?
মার্ক্স—মার্ক্স একজন মানুষ।
তার লেখা বই?
তার—তার বিষয়ে।
বিষয়ে মানে?
মানে-–শাশ্বতীর পাউডার-প্যাডটা থেমে গেল মুখের উপর, এই আর কী। ইনক্সা আনন-রেণু মুখে বুলোতে-বুলোতে সে কথা শেষ করল—জানতে চাস তো হারীতবাবুকে জিজ্ঞেস করিস। তিনি জানেন বুঝি এ-সব?
জানেন না! কত বড়ো বিদ্বান! লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের পাশ করা! শাশ্বতী সরে এসে একখানা শাড়ি পরতে লাগল যার রং ঠিক কালোজামের ভিতরটার মতো। ওঁর কাছে ইকনমিক্স পড়ো বুঝি তুমি?
যাঃ!
যাঃ কেন? পড়লেই পার, প্রায়ই তোত আসেন।
কী অদ্ভুত! প্রায়ই আসেন কখন? শাশ্বতী কোঁচার মতো করে কোমরে গুঁজল শাড়ি। তারপর পিঠের উপর দিয়ে আঁচলটা ঘুরিয়ে আনতে-আনতে বলল–কী ওঁদের সভা-টভা সব হয়— তারই খবর দিয়ে যান মাঝে-মাঝে। তোকে বলি না কতবার যেতে। যাস না তো কখনো? কী হয় সভায়?
কত রকম হয়! গান, বক্তৃতা, তর্কাতর্কি—
বাজে! স্বাতী ঠোঁট বাঁকাল।
বাজে কী রে? হারীতবাবু চমৎকার বলেন—কত শিক্ষা হয় ওঁর কথা শুনলে। শাড়িটাকে এখানে কুঁচকে, ওখানে একটু টান করে দিতে-দিতে শাশ্বতী আর একবার আয়নার সামনে দাঁড়াল। স্বাতী তার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বলল—দিদি, তোমার ঐ চৌকো বাক্সের পাউডারটা কিন্তু বিশ্রী।
বিশ্রী? শাশ্বতী হেসে উঠল।
বড্ডো কটকটে।
ফেস-পাউডার কিনা। স্বাতীর কথা উড়িয়ে দিল শাশ্বতী। কিন্তু আয়নায় সূক্ষ্ম চোখে একটু তাকিয়েও দেখল। খুব কি উগ্র হয়েছে? না, ঠিকই। তবু আর একবার পাউডার-প্যাড হাতে নিয়ে বলল, কে একজন লেখক না তার ফ্যাশনেবল নায়িকার মুখে কিউটিকুরা পাউডার মাখিয়েছিলেন? কী বুদ্ধি!
কেন? আর একবার তাজ্জব বনল স্বাতী।
কিউটিকুরা বুঝি মুখে মাখে?
মাখে না? প্রতিবাদের বেগে স্বাতী উঠে বসল একেবারে—আমি তো মাখি। তুমিও তো মেখেছ কত। কথাটা যেন শুনতেই পায়নি, এমনিভাবে শাশ্বতী বলল—সেদিন ঐ লেখককে নিয়ে কী ঠাট্টা অগ্রণী সংঘে! সবশেষে হারীতবাবু তুললেন ঐ পাউডারের কথাটা—
তাঁর কাছে অনেক রকম শিক্ষাই তো হয় তাহলে—স্বাতী যেন অভিভূত হয়ে পড়ল হারীতবাবুর জ্ঞানের পরিধিতে। বোনকে নরম হতে দেখে শাশ্বতী সুখী হয়ে বলল–তুই দেখিস এটা মেখে। কত ভালল, তুলনা হয় না।
তা তুমি যা-ই বল, কিউটিকুরার মতো গন্ধ নয় আর কিছুরই–বলতে বলতে স্বাতী উঠে দাঁড়াল।
হারীত যখন এল, তার একটু আগে রাজেনবাবু ফিরেছেন আপিশ থেকে। আর স্বাতী ছোটো পটে করে তার চা নিয়ে এসেছে বসবার ঘরে। বাবার চা ঢেলে দিয়ে স্বাতী হেসে বলল–আমি একটু চা খাই, বাবা?
রোজ-বোজ আর অনুমতি চাওয়া কেন?
তবে রোজ খাব, কেমন বাবা? এখন তো বড়োই হয়েছি—না? বাবার গলা একটুখানি জড়িয়ে ধরেই স্বাতী সরে এল চায়ের কাছে। তুমি একটু খাবে, ছোড়দি? একটু দূরে জানলার কাছে ইজিচেয়ারে শাশ্বতী সেজে-গুজে বসে ছিল সেই হলদে-কালো মলাটের বইটা চোখের সামনে খুলে। সংক্ষেপে জবাব দিল–না। চামচে দিয়ে চা খেতে-খেতে স্বাতী বলল–ঈশ কী ভালো হয়েছে চা-টা, চমৎকার!
স্বাতী, তোর চামচে দিয়ে চা খাওয়াটা ছাড় তো! ছুটে এল সুশিক্ষিত শাশ্বতীর মন্তব্য।
কেন, কী হয়?
কেউ খায় না।
খায় না আবার! অনেককে আমি দেখেছি—
তারা সব ক্যাবলা।
চামচে দিয়ে যারা খায় না, তারা বুঝি কেউ ক্যাবলা না? মুখে ও-কথা বলে স্বাতী চামচে রেখে দু-আঙুলে পেয়ালা তুলল বয়স্ক ধরনে। তারপরেই—নাঃ, চামচে দিয়েই ভাল! বলে তাকাল ছোড়দির দিকে। কিন্তু শাশ্বতী হঠাৎ মেন-একটু চঞ্চল হয়ে উঠে গম্ভীরভাবে চোখ ডোবাল বইয়ে। বাইরে জুতোর শব্দ হল, আর মৃদু কিন্তু স্পষ্ট তিনটি বিলিতি টোকা পড়ল দরজায়। রাজেনবাবু বললেন–দ্যাখ-তো কে। কিন্তু স্বাতী বসে-বসেই বলল–আসুন। পরদা ঠেলে হারীত ঘরে এল। ঢিলেঢালা রকমের একটা পাতলুন পরা, আর গলা-খোলা শার্ট। ঢুকেই রাজেনবাবুকে দেখে দু-হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে বলল—এই যে, ভাল? স্বাতী, চা-রাজেনবাবুর ব্যস্ত ভাব।
না না, আমি চা না, এইমাত্রহারীত একটু ঝুঁকে স্বাতীর দিকে তাকাল—এসে অসুবিধে করলুম কি? ভাবখানা এইরকম যেন ঘরের তিনজনের মধ্যে স্বাতীই প্রধান। স্বাতী হেসে ফেলল। কীরকম জোর দিয়ে-দিয়ে কথা বলেন ভদ্রলোক, চা-কে বলেন চ্চা, এসে, কে এশ-শে। অসুবিধে কী, একটু থামল স্বাতী, আবার বলল—বসুন। স্বাতীর অনুরোধ উপেক্ষা করল না হারীত। কয়েক পা হেঁটে গিয়ে শাশ্বতীর পাশের চেয়ারটিতে বসলকী, পড়লেন?
সবটা হয়নি—চোখ আনত শাশ্বতীর, কণ্ঠ ক্ষীণ।
হাঁটুতে হাঁটু তুলে টিপে টিপে পাইপে তামাক ভরতে-ভরতে হারীত বলল—বিষয়টা শক্ত। তবে এ ছাড়া তো আর বিষয় নেই আজকাল। আমরা অবশ্য দিব্যি খেয়ে-দেয়ে চাদের বিষয়ে পদ্য লিখে দিন কাটাচ্ছি। এদিকে একটা বডোরকমের লড়াই—পাইপ মুখে তুলে সে কথাটা শেষ করল—বাধল বলে। সেজন্য এখন থেকেই দেশলাই জ্বালতে গিয়ে হঠাৎ থেমে, পাইপটা মুখ থেকে হাতে নামিয়ে গেঞ্জি-পরা বাবাটির দিকে তাকিয়ে বলল-I am sorry.
না, না, তাতে কী! আমি বরং—রাজেনবাবু উঠতে গেলেন।
আপনি বসুন—দেবতার বরদানের মতো হাতটি উঁচু করল হারীত—এতে অবশ্য কিছু নেই, তবে আমাদের দেশে একটা নিয়ম যখন আছে, আমি বরং বাইরে একটু পাইচারি…। স্বদেশের প্রথাকে প্রতি পদক্ষেপ সম্মানিত করে হারীত পাইপ হাতে বেরিয়ে গেল।
******
একটু পরে চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে রাজেনবাবু আস্তে-আস্তে উঠে ভিতরে এলেন। শাশ্বতী বসে বসে কয়েকটা আঁকাবাঁকা ভঙ্গি করল শরীরের, আর বসেই রইল। স্বাতী এল বাবার সঙ্গে-সঙ্গে-একটু বেড়াতে যাবে, বাবা?
চল। রাজেনবাবু তক্ষুনি রাজী।
চলো, ঐ মাঠটায় হাঁটি একটু।
বেশ। দু-মিনিটে তৈরি হয়ে এল স্বাতী—বাবা। শুয়ে পড়লে? যাবে না—হঠাৎ থেমে বাবার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে স্বাতী বলল—থাক বাবা, না গেলাম।
কেন রে? চল আমি এমনিই শুয়েছিলাম একটু—
স্বাতী শিয়রে বসে বলল—না বাবা, তুমি শোও, আমি তোমার পাকা চুল বাছি।
আর কি বাছবার সময় আছে?
ইশ, কটাই বা চুল পেকেছে তোমার, তাই নিয়ে এত জাক? হাত দিয়ে চুল সরাতে-সরাতে তক্ষুনি আবার বলল–উঃ! কত! সঙ্গে সঙ্গে—পট্।
লাগে!–রাজেনবাবু নড়ে উঠলেন।
কী ছেলেমানুষের মতো কর! চুপ করে শোও না! বাবার মাথাটি স্বাতী ঘুরিয়ে নিল নিজের ইচ্ছেমতো। চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলল—সুন্দর চুল তোমার, বাবা!
হবেই! স্বাতীর বাবা তো আমি–আবছা শশানাল বাবার গলা। বাবার যখন একটা চুলও পাকেনি, কেমন ছিলেন দেখতে? সে যেন বাবাকে একরকমই দেখেছে বরাবর, মনে হয় এ-রকম ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না কখনো। কিন্তু সত্যি-ততা আর তা-ই নয়। পুরোনো দু-একটা ছবি আছে বাবার। এতই অন্যরকম যে, দেখলে হাসি পায়। কিন্তু যখনকার ছবি তখন তোঠিকই ছিল। বাবা—স্বাতী ডাকল—ও বাবা! ভারি নিশ্বাসের শব্দ শুনল উত্তরে। ও মা! ঘুমিয়ে পড়লে কেমন অবাক লাগল স্বাতীর, বাবাকে এই সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তে দেখে। নড়ল না, চুপ করে বসে রইল সেখানেই, আলো কমে-কমে রাত নামল ঘরে…বাইরে থেকে হঠাৎ ভেসে এল হাসির শব্দ, সরু মোটা গলায় মেশানো।
******
সন্ধ্যের পর স্কুলের পড়া নিয়ে বসে স্বাতী বলে উঠল—ছোড়দি, হারীতবাবুর বইটা। বইটা কী?
ফিরিয়ে দিলেই পারতে, পড়বে-তো আর না—
তোর তাতে কী! ঝামটা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে শাশ্বতী ভাবতে লাগল, হারীত যে বলে গেল রোববার বিকেলে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটুটে যেতে, সেটা কেমন করে সম্ভব হবে।
পরের দিনও এই কথাই ভাবছিল সে। দুপুরবেলা বই হাতে পাড়ার দুটি সহপাঠিনীর সঙ্গে কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। অগ্রণী সঙ্রে যে কটি সভায় সে গিয়েছে, সবই রাসবিহারী এভিনিউর এক বডোলোকের বাড়িতে। একা যাওয়া-আসা করা গেছে সহজেই। কিন্তু কলেজ স্কোয়্যার! এদিকে হারীতের কাছে প্রকাশ করেনি তার এই অসুবিধের কথাটা। কী ভাববে সে! কত মেয়ে আজকাল একলা টহল দেয় সারা শহর, আর সে বুঝি–। উঠে পড়ুন–ছোটো ছাইরঙের একটি গাড়ি এসে থামল ঠিক তার সামনে। উঠে পড়ুন– হাত নেড়ে আবার ডাকল হারীত।
আপনি!
আসুন, হারীত হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিল। শাশ্বতীর চেহারাটা হল মূর্তিমতী দ্বিধা। আমতা-আমতা করে বলল—না, আমি ট্রামেই। পাশের মেয়েটি কানে-কানে বলল-কে রে?
হারীত গলা বাড়িয়ে বলল—ও, বন্ধুদের জন্যে বুঝি? তা সকলকে তুলে নিতে পারলে আমি তো সুখী হতাম খুব। কিন্তু দেখছেন তো একজনের বেশি…অতএব আপনারা অনুমতি করলে–একটু হেসে সে অন্য মেয়ে দুটির দিকে তাকাল। যা–পাশের মেয়েটি আস্তে একটু ঠেলে দিল শাশ্বতীকে দয়া-মায়াও নেই তোর?
ঐ যে ট্রাম-বলে এগিয়ে গেল অন্য মেয়েটি। ট্রাম চলে গেল বন্ধু দুজনকে নিয়ে। কেমন একটা ট্রেন-ফেল-করা চেহারা করে শাশ্বতী দাঁড়িয়ে রইল সাড়ে দশটা বেলার বড়ো রাস্তার ব্যস্ততার মধ্যে। হারীত বলল—আর ভাবছেন কী? শাশ্বতী গম্ভীর হয়ে বলল—অনেক ধন্যবাদ মিস্টার নন্দী, কিন্তু।
ওহ! ডোন্ট বি সিলি! এমন একটা অসহিষ্ণু অথচ সকৌতুক মুখভঙ্গি হল হারীতের, যে শাশ্বতী আর দেরি না করে গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ি বেঁকল ডান দিকে হাজরা রোড ধরে। এ কী! শাশ্বতী দরজা ধরে চেঁচিয়ে উঠল—এদিকে না! হারীত কোনো জবাব না দিয়ে গাড়িটিকে আস্তে দাঁড় করাল একটি পেট্রলপাম্পে। স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল শাশ্বতীর, মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—ও!
পকেট থেকে পাইপ বের করল হারীত। গাড়ির গায়ে ঠুকে ঠুকে পোড়া তামাক ফেলে ল্লি। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল—আপনি ভেবেছিলেন আমি আপনাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি? আগুনের রঙ ছড়িয়ে পড়ল শাশ্বতীর কুমারী মুখে। দৃশ্যটা উপভোগ করতে-করতে হারীত আবার বলল–আর সে রকম কোনো দুরভিসন্ধি যদি আমার থাকেই, আপনি ভয় পাবেন কেন? নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না? শাশ্বতী মুখ ফিরিয়ে দেখতে লাগল কাচের স্তম্ভে ফিকে-সোনালি পেট্রলের বুড়বুড়ি-তোলা নেমে আসা। একটু পরে গাড়ি চলল রসা রোড ধরে বরাবর দক্ষিণে। জ্বলজ্বলে রোদ, ট্রাম-বাস ভরতি, প্রত্যেকটি বাড়িফেরা ট্রামে তার কলেজের মেয়েরা। কী অস্বস্তি! মনে হচ্ছে অপরাধ করলাম চিবিয়ে চিবিয়ে হারীত বলল। গাড়িটা বেশ তো—এতক্ষণে শাশ্বতী কিছু বলবার কথা খুঁজে পেল।
আমার এক বন্ধুর গাড়ি, আমি ব্যবহার করি। বড্ডো ছোটো, অসুবিধে হচ্ছে?
হলেই বা কী করা!
বইগুলো অন্তত কোল থেকে নামাতে পারেন।
থাক। রাসবিহারী এভিনিউর মোড় পার হতে হতে হারীত বললনাঃ, আপনাকে কষ্ট দিলাম, কিন্তু আমি তো আর আপনার সুখের জন্য আপনাকে আসতে বলিনি।
তবে?
আমার সুখের জন্য—নিশ্চয়ই!
শাশ্বতী মুখ নিচু করল।
রোববার আসছেন তো?
দেখি।
দেখি আবার কেন?
এত দূর—
দূর? দূর আবার কী! আসতেই হবে আপনাকে। শাশ্বতী এক হাতে কপালের চুল সরাল। তার ঈষৎ নোওয়ানো আধখানা মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা নতুন কথা ঝিলিক দিল হারীতের মনে—আচ্ছা ভাববেন না, আমি যাবার সময় তুলে নেব আপনাকে।
না, না!
এতে আঁৎকাবার কী আছে?
মিছিমিছি অসুবিধে—
অন্তত ট্রাম-বাস-এর চেয়ে বেশি অসুবিধে না—
সে কথা না—
তবে আবার কী! ছটায় তৈরি থাকবেন, আমাকে যেতে হবে একটু আগেই।
না, সত্যি দেখুন—
সত্যি দেখুন! মুখে-মুখে ঠাট্টা করে উঠল হারীত। শাশ্বতী হেসে ফেলল।
বড়ো রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে শাশ্বতী গলিটুকু হেঁটে এল। কেন, বাড়ি পর্যন্ত গাড়িতে এলে কী হত? সত্যি, কী বিশ্রী আমার মনের এই—! বাজে সব! মানে হয় না কোননা, রোববার যাব হারীতের সঙ্গে গাড়িতে নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!
******
কিন্তু হল না। রাজেনবাবু বললেন—তুই একা ওর সঙ্গে যাবি কী রে?
গেলে কী হয়?
হবে আবার কী—এ রকম যায় না। তুই ওকে না বলে আয়।
না! যে-বাবার মুখে কোনোদিন কোনো না শোনেনি সে-বাবার মুখে না! যেখানে গেলে নানা বিষয়ে শিক্ষা হয়, সেখানেও নিজের ইচ্ছেমত যেতে পারবে না, এত পরাধীন সে! আর এতদিন ধরে সে ভেবে এসেছে তার বাবা অন্য বাবাদের মতো নয়! মাথা ঝেকে বলে উঠল–আমি পারব না কিছু বলতে।
আমিই বলে আসি তবে।
না, না! কিন্তু ততক্ষণে রাজেনবাবু অন্তর্হিত। একটু পরে ঢাকাই জামদানি পরা শাশ্বতী শুনল ছছাটো গাড়িটির চলে যাওয়ার শব্দ। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে রাজেনবাবু বললেন—কী রে, তোর মন খারাপ হল নাকি খুব? কী
বললে তুমি হারীতবাবুকে?
বললাম, শাশ্বতী আজ যাবে না।
এই বললে তুমি! শাশ্বতী আর্ত ভঙ্গিতে হাত তুলল।
কী বলব তবে?
বলতে পারলে না অসুখ করেছে?
কেন, অসুখ করেছে নাকি তোর? রাগে শাশ্বতীর ইচ্ছে করল গায়ের জামা-কাপড় টেনে ছিড়তে। ছি ছি, এর পরে কী করে মুখ দেখাবে সে? আর বাবা কী-রকম মানুষ, দিব্যি বলে এলেন সে যাবে না! অপমান করলেন একজন উঁচু দরের মানুষকে! আর কি সে আসবে? না, আসবে তো না-ই, তার উপর কী ভেবে গেল তাকে! কী বিশ্রী, কী-রকম একটা জড়ভরত ভূত! যদি কোনোরকমে আজকের সভাটায় সে যেতে পারত, তাহলে..তাহলে অন্তত বুঝিয়ে বলতে পারত—
তা এতই যদি তোর যাবার ইচ্ছে—ঠিক তার মনের কথাটাই বাবার মুখে শুনতে পেল শাশ্বতী— বিজুকে নিয়ে বাস-এ চলে যা। কিন্তু বিজু রাজি হল না। শার্টের কলারটা উঁচু করে তুলে দিয়ে সে তখন বেরোচ্ছে আড্ডা দিতে।-বক্তৃতা নাকি? সর্বনাশ! আমি ওর মধ্যে নেই। একদিন না-হয় গেলি একটু ছোড়দিকে নিয়ে—রাজেনবাবু অনুরোধ জানালেন!–আমি না!—ত্বরিতে নিষ্ক্রান্ত হল বিজু। তখন রাজেনবাবু বললেন—তাহলে চল আমিই। বাবার সঙ্গে? তা হোক, তবু তো যাওয়া হবে। শাশ্বতী উঠল তার বিপর্যস্ত প্রসাধনের মেরামত করতে। রাজেনবাবু ডাকলেন–স্বাতী, যাবি নাকি?
কোথায়, বাবা? স্বাতী ছুটে এল পাশের ঘর থেকে।
তোর ছোড়দিকে নিয়ে মিটিং-এ যাচ্ছি—
তুমি কেন?
যাই। একটু বেড়ানোও হবে আমার।
না, তুমি যাবে না।… হাসছ কী? একটাই রোববার। এখন আবার বাস-এর ঝাঁকানি খেতে খেতে কলেজ স্কোয়্যার-পাগল?
রোববারটা এমনিই বসে-বসে—
বসে-বসে না আরো-কিছু! কেন, দাদা যেতে পারে না?
তার সময় হয় না।
যত সময় বুঝি তোমার? এমন রাগ হয় সত্যি–!
ঘরে এল ব্যাগধারিণী শাশ্বতী।
ছোড়দি, বাবা কিন্তু যাবেন না। তাকে দেখামাত্র স্বাতীর ঘোষণা। শাশ্বতী থমকে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে।
—যাই না! রাজেনবাবু দেখলেন শাশ্বতীর মুখে মেঘ আর স্বাতীর চোখে বিদ্যুৎ। অসহায়ভাবে বললেন–যাই কেমন? তুইও চল।
ছোড়দি, তুমি কেমন? স্বাতী দাঁড়াল কোনের মুখোমুখি বাবাকে আবার টেনে নিয়ে যাচ্ছ—
আহা, ও-তো কিছু বলেনি–
স্বাতী!–শাশ্বতী গর্জন করে উঠল—তুই এ বাড়ির কর্তা হলি কবে থেকে?
ককখনো না!–স্বাতীও গলা চড়াল-ককখনো তুমি যাবে না বাবা—আমি বারণ করছি! চাইনে, চাইনে যেতে—এ বাড়িতেই আর থাকব না আমি! শাশ্বতী ছুটে গিয়ে জানালার শিক ধরে ফোঁপাতে লাগল।
******
মিথ্যে হল না মুখের কথা, একটি মাসও কাটল না এরপর, হারীত বিয়ের প্রস্তাব জানাল। সেদিনও রবিবার। বাজার নিয়ে এসে রাজেনবাবু বাইরের ঘরে বসে কাগজ পড়ছেন, হারীত ঢুকল গটগট করে।সেদ্দিন তার পোশাকটা—বোধহয় আইনত শীতঋতু আরম্ভ হয়েছে বলেই একটু আঁটোসাঁটো। পালুনে কড়া ইস্ত্রি, নেকটাইটি পরিষ্কার। শরীরের একটা কুণ্ঠিত ভঙ্গি দিয়ে রাজেনবাবু অভ্যর্থনা জানালেন। বসুন। বলে কাগজের পাতাগুলি গুছিয়ে নিয়ে তিনি উঠতে যাচ্ছিলেন, হারীত বলল-আপনি উঠবেন না, আপনার সঙ্গেই আমার কথা। রাজেনবাবু শান্ত চোখে যুবকের মুখের দিকে তাকালেন।—কথাটা হচ্ছে-হারীত চেয়ারে পিঠ খাড়া করে হাতলে দুটো টোকা দিল—আমি শাশ্বতীকে বিয়ে করতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে শাশ্বতীরও এ-ই ইচ্ছে, এখন আপনার মত হলেই হয়ে যায়।
শাশ্বতী—নামটা হারীতের মুখে একটুও মধুর শুনলেন না রাজেনবাবু। কেন-যে এই ছেলেটিকে ভালো লাগে না! খারাপ তো কিছু নয়—ভালো ছেলে! শিক্ষিত, বিলেত-ফেরৎও, উৎসাহী, বুদ্ধিমান। তবু-ওর চাল-চলন, হাব-ভাব, কথা বলার ধরন—সব যেন…। অন্য তিন জামাই এসে দাঁড়াল চোখের সামনে…দিলখোলা ফুর্তিবাজ জামাই প্রমথেশ, একটু রাগী হেমাঙ্গ… কিন্তু চাপা ঠোঁটের কম কথায় বেশি বুদ্ধির মানুষ, উশকোখুশকো চুলে দিশেহারা অরুণ; তাদের পাশে এই—এই—কী? কী জানি! আজকালকার ভালো-ভালো ছেলেরা বুঝি এইরকমই, আমি পুরোনো লোক আমার চোখের দোষ। কন্যাপক্ষকে নীরব দেখে পাণিপ্রার্থী আরো বলল— আমার সম্বন্ধে কিছু খবর আপনাকে জানাবার আছে, চাকরি করি ইনশিওরেন্স আপিশে। এখন পাচ্ছি তিনশো, প্রসপেক্ট আছে। বাবা উকিল—আইনের বই-টই লেখেন, থাকেন ভবানীপুরে ঠাকুরদার আমলের বাড়িতে, দুই কাকাও সেখানে—আমি সম্প্রতি আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছি রাসবিহারী এভিনিউয়ে।
—কেন? একটুও দেরি না করে আপনার মেয়েরই সুখের জন্য—জবাব দিল হারীত। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল—তাহলে আপনি কী বলেন?
-তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলবো।
–নিশ্চয়ই, ও-সব ফর্মালিটি তো আছেই। তবে এবিষয়ে বাবার যখন আলাদা কোনো মত নেই, আপনি আমার সঙ্গেহারীত উত্তরের জন্য রাজেনবাবুর মুখের দিকে তাকাল, উত্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়াল। আচ্ছা, চলি। কাল আবার আসবো এই সময়ে। দরজার দিকে যেতে যেতে একটু থামলো রাজেনবাবুর সামনে, গলা নিচু করে চোখে কেমন একটা উদাস ভাব এনে বলল একটা কথা বলি, এ বিয়ে হবেই, আশা করি মিছিমিছি একটা গোযোগ…! দেখি।
হারীত চলে যাবার পর রাজেনবাবু তেমনি বসে রইলেন চেয়ারটিতে। কী দোষ? হারীতের কী দোষ? কেন মনে হচ্ছে না চমৎকার, কেন সুখী হতে পারছেন না—কেন তার মুখে দেখতে পাচ্ছেন না প্রমথেশের ভালোমানুষি, হেমাঙ্গর ধার, অরুণের লাবণ্য? কেন ওদের পাশে বসাতে গিয়েই মন কুঁকড়ে ফিরে আসছে? কিন্তু মেয়ে তাকে পছন্দ করেছে, মেয়ে সুখী হবে, আমি কে? কিছুই কি নই? আমার না ওরা? না। ফল কি গাছের? মুকুল গাছের, ফুল গাছের, ফল পৃথিবীর। যে মুহূর্তে পাকলো সেই মুহূর্তে দিতে হবে পৃথিবীকে, না দিলে ফল পচবে, গাছ মরবে।…যদি পড়ে পোড়া জমিতে, জোলো জমিতে, মরুভূমিতে?… কে জানে, কেউ কি বলতে পারে? কাকে জিগেস করবেন? কার সঙ্গে কথা বলবেন আজ? বিছানায় শুয়ে, অত কষ্ট পেয়ে, রোগে ধুকতে-পুঁকতে, তবু-ততা সে ছিল! গেল কোথায়?…তবে কি সত্যি চলে গেল, আর দেখবো না, তার মেয়ের বিয়েতেও দেখতে পাবো না একবার?
বাবা!—এইমাত্র স্নান করেছে স্বাতী, পরেছে লাল পাড়ের সাদা একটি শাড়ি, ভিজে চুল মেলে দিয়েছে পিঠে। তাকিয়ে রাজেনবাবু কথা বলতে পারলেন না। বলবার কিছু নেই, বললেও কেউ শুনবে না। দিতে হবে, আমাকেও দিতে হবে, আমার কাছেও পৃথিবীর পাওনা ছিল তিনটি, চারটি, পাঁচটি কন্যা।
—বাবা, তুমি যেন বড়ো চিন্তিত?
–শোন স্বাতী, তোকে একটা কথা বলি—
—কী, বাবা?
–আচ্ছা, হারীতের সঙ্গে তোর ছোড়দির বিয়ে হলে কেমন হয় রে?
—ভালো-তো!
–ভালো? তোর ভালো লাগে হারীতকে?
—আমার? স্বাতী আর-কিছু বলল না। রাজেনবাবু জিগেস করলেন-শাশ্বতী বেশ সুখী হবে, তোর মনে হয়?
-কেন হবে না? বলে স্বাতী ঘুরে দাঁড়ালো, একটু-যেন লাজুক ধরনে। চোখে লাগল লাল পাড়ের ঝলকানি। এরকম তো হয়েছিল। আগে একবার… হঠাৎ মনে হল রাজেনবাবুর, ঠিক এরকম, এমনি এক অঘ্রানের সকালে…ঠিক এই মুহূর্তটি, এই ঘর-আলোকরা লাল পাড়, ভিজে চুলের গন্ধ, ঘুরে দাঁড়ানোর চমক—কবে? কবে? সে কি এ জন্মে, সে কি আর-এক জন্মে? সে কি এই জগতে? না আর-এক জগতে? সে কি আমি? সে কি সত্যি আমি? সে আরএকটি পনেরো বছরের মেয়ে, তাকে মনে পড়ে না? আমাকে আর মনে পড়ে না? আমাকে আর মনে পড়ে না তোমার?—ছোড়দিকে ডাকব, বাবা? স্বাতী নিচু হয়ে থুতনি রাখলো বাবার কাঁধে। মাথা সরিয়ে নিলেন রাজেনবাবু, দুই চোখ ভরে দেখতে লাগলেন, যেন স্বাতীকে আগে দ্যাখেননি। সেই কোঁকড়া-কালো মাথাটা, যত মুখ জীবনে দেখেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মুখ। সে-মুখ তো নেই আর! যে-মুখে শুধু আনন্দ ছিল, শুধু অমৃত, সে-মুখে কেন আশঙ্কা, কেন অশান্তি? কী-যেন লুকোনো আছে, সেই লুকোনোকে তার ভয়। চোখ এমন বড়ো-বড়ো ছিল না তার, এমন বাঁকাও ছিল না। কখনো এমন আশ্চর্য লাগেনি তার মুখ, এত আশ্চর্য যে অচেনা…যদিও চারটি মেয়েকে এর আগে বড়ো হতে দেখেছেন, তবু রাজেনবাবু যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না যে এ তারই কন্যা।
–কিছু বলছে না যে? আবার প্রশ্ন স্বাতীর–আচ্ছা, বলে রাজেনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, আর সেদিন থেকেই লেগে গেলেন টাকা যোগাড়ের চেষ্টায়। তারিখ পড়ল অঘ্রানেরই শেষে। দেখতে দেখতে পাড়ায় ছড়াল বিয়েবাড়ির শোর।
******
যাকে বলে বিয়েবাড়ি! ভিড়, হৈ-চৈ, অফুরন্ত রান্না আর খাওয়া। এক বছরে যদিও তিন মেয়েই যাওয়া-আসা করেছে দু-একবার, আর পুজোর সময় একবার তো আর সরস্বতী একসঙ্গেও এসেছিল কিছুদিন—তবু চেষ্টা করেও তিন মেয়েকে একত্র করতে পারেননি রাজেনবাবু। খুব আশা ছিল যে শাশ্বতীর বিয়ের সময়…কিন্তু হলো না। হেমাঙ্গ রেনাল-কলিকে ভুগছে, তাকে নিয়ে আসা অসম্ভব, তাকে রেখে আসাও তা-ই। লম্বা একটি চিঠিতে মহাশ্বেতা কদল বাবার কাছে পাঠাল সেই খামেই পাঁচশো টাকার ড্রাফট, আর পার্সেলে বর্মি স্যাকরার শিল্পকলার কয়েকটি নমুনা। নতুন বাড়িতে মেয়ে-জামাইরা এই প্রথম এল। সবচেয়ে বড়ো পুব-দক্ষিণ-খোলা ঘরটি, শাশ্বতী আর স্বাতী যেটাতে থাকে—মানে থাকতো সেটি রাজেনবাবু দিলেন শ্বেতাকে—সে বড়ো বলে নয়, তার ছেলেপুলে বেশি বলে। তার ঘর হল সরস্বতীর, আর বিজুর ছোটো ঘরে ছোটো দুই মেয়েকে দিয়ে তিনি এলেন বাইরের ঘরে—এলেন মানে আর কী, রাত্তিরের শোওয়াটা নিয়েই তো কথা।
-আমি? আমি কোথায় পোব? বিজু গনগন করল। রাজেনবাবু বললেন—কেন? বাইরের ঘরে তো কত জায়গা।
—মেঝেতে?
রাজেনবাবু তক্তাপোশ আনালেন। স্বাতী বললো–তুমি বুঝি মেঝেতে শশাবে বাবা, আর দাদা তাপপাশে?
–মেঝেতেই আরাম।
—আমি পড়ব কোথায়? আমার পরীক্ষা না?
—পরীক্ষা তো স্বাতীরও, রাজেনবাবু মাথা চুলকোলেন—তা একটা দিন–।
–ঈশ! এমনিই পড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছিস! স্বাতী ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো-খুব সুবিধেই হলো তোর, চমৎকার ছুততা হলো একটা। বিজু রাগ করে দু-তিন খানা বই আর একটি বালিশ নিয়ে চলে গেল তার এক বন্ধুর বাড়িতে। শ্বেতা থেমে-থেমে বলল—সত্যি, ওকে কেন—আমরা নাহয়–ওর পরীক্ষা–।
—ভালো-তো! রাজেনবাবু বললেন–যদি রাগ করেও একটু পড়ে-উড়ে, তবে-তো ভালোই।
–তা-ওকে ডেকে আনবে না?
-আসবেই।
সারাদিন বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যের একটু আগে বাড়ি এসে বিজু হাঁক দিলো–স্বাতী আমার মশারি দে। শ্বেতা তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল বেশ ছেলে! কোথায় ছিলি রে সারাদিন? আয়কী খাবি? বিজু মোট গলায় বললো—আমি চলে যাবো এক্ষুনি।
—যা, ঘরে যা। তোর ঘর ঠিক করে দিয়েছি।
ঘরে এসে বিজু অবাক। পরিষ্কার গুছোনো টেবিল, নতুন সুজনি দিয়ে ঢাকা বিছানা, আর বোন দুটোর চিহ্নমাত্র নেই। হাত-পা ছড়িয়ে তক্ষুনি শুয়ে পড়ল লম্বা হয়েউঃ বড়ো ঘোরাঘুরি হয়েছে সারাদিন। সন্ধ্যের পর শ্বেতা বলল–বাবা, আমি বাইরের ঘরেই বিছানা করতে বললাম, এখানে এক খাটে শাশ্বতী আর স্বাতী, আর-এক খাটে তুমি–
—কেন?
—বিজুকে তার ঘরেই দিয়েছি।
—আর তুই বুঝি ছেলেপুলে নিয়ে এই ঠাণ্ডায়–
–ঠাণ্ডা কোথায় কলকাতায় আবার শীত! মস্ত বিছানা হবে মেঝেতে, ছেলেপুলে নিয়ে বেশ ছড়িয়ে শোব।
-হ্যাঁ, তাই বেশ। যা গড়ায় ওর এক-একজন! বলে প্রমথেশ এমনভাবে হেসে উঠল যেন এই গড়ানোটা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার।
–বিজুকে এ-রকম প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না—বললো সরস্বতী।
—প্ৰশ্ৰয় কী রে? শ্বেতা জবাব দিলো—সকলেরই সুবিধে, আর ওর বুঝি অসুবিধে হবে?
–অসুবিধে আবার কী-বোনেদের জন্য একটু কষ্ট করতে পারে না? দুদিনেরই তো ব্যাপার।
—আহ—ছেলেমানুষ—ওর আবার।–
–আমি-তো দেখছি ওর ছেলেমানুষি ঘুচবে না কখনোই। তোমাকে বললাম, বাবা, ওকে দিল্লিতে আমার কাছে রাখো, ঠিক মানুষ হয়ে যেতো ওখানে।
—সত্যি নাকি রে? তবে আমার ডালিমটাকে রাখি তোর কাছে—এক্কেবারে পড়তে চায় না হনুমান! ছাইরঙের গরম স্যুট পরে অরুণ এসে দাঁড়াল—শোনো, একটা রুমাল দিতে পারো?
–স্যুটকেসেই আছে দ্যাখো না, স্বামীর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল সরস্বতী।
–খুঁজে পাচ্ছি না তো—
–তুমি আবার কবে কী খুঁজে পাও। যা তো গীতি, বাবার একখানা রুমাল বের করে দে। গীতিও সেজেছিলো বাবার সঙ্গে বেরোবে বলে; পুতুলের মতো মাথা নেড়ে বললো–আমি পারবে না।
—পারবি না! কিছুই পারবি না তোরা! সবই যদি আমাকেই করতে হবে, তা হলে আর ছেলেমেয়ে হয়ে আমার লাভ কী হলো!
—আহা, দে না খুঁজে, রাজেনবাবু নিচু গলায় বললেন। মেয়ের গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে মাথায় কাপড় টেনে সরস্বতী উঠে দাঁড়ালো। শ্বেতা বলে উঠলো—তোর শাড়িটা দিসরে আমাকে পাড় লাগিয়ে দেব।
—এটা? সরস্বতী একটু যেন অবাক হল।—এগুলো তো পাড় ছাড়াই পরে।
–নাকি? পাড়-ছাড়া শাড়ির ফ্যাশন হয়েছে আজকাল? মা-গো, মা-গো! শ্বেতার যেন চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না।
—মনে নেই তোমার, সেই মিসেস দে—জজ-সাহেবের স্ত্রী—ঘর ভরে গেলো প্রমথেশের উচ্চহাসিতে।
******
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শাশ্বতী বললো স্বাতীকে—বড়দিটা কীরকম হয়ে গেছে রে!
—কী হয়েছে?
—কেমন বাঙাল-বাঙাল! স্বাতী একটু ভেবে বলল—আমার কিন্তু অন্যরকম লাগে।
—কীরকম? লেপের তলায় বোনের আরো একটু গা ঘেঁষে স্বাতী চুপি-চুপি বলল–ঠিক মা-র মতো।
–কী গরম রে? শাশ্বতী লেপ সরিয়ে দিল পায়ের উপর থেকে।
–ছোড়দি, মাকে তোমার মনে পড়ে?
–বাঃ, পড়ে না?
—আমার কিন্তু মনে হয় ভুলেই গেছি। বড়দি যেদিন এলেন না—আমি কীরকম চমকেছিলাম প্রথম দেখে—ঠিক যেন.. দূর!
মা বুঝি ও-রকম ছিলেন। ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখিস।
কী জানি, আমি-ততা বড়দিকে বেশি দেখিনি, তাই বোধহয়—
জামাইবাবুটা ক্যাবলা, একটু পরে শাশ্বতী মন্তব্য করলো—সেইজন্যেই বড়দি ওরকম হয়ে গেছে।
যাঃ, জামাইবাবু খুব ভাললা—চমৎকার।
ভালো সত্যি অরুণদা। কিন্তু কী-রকম বুড়োটে হয়ে গেছে রে এর মধ্যে! তোর সঙ্গে আজকাল বেশি ভাব দেখি না তার?
দেখাই হয় না।
তোর মনে আছে, স্বাতী–শাশ্বতী নড়ে-চড়ে বোনের মুখের কাছে মুখ আনল—সেই যে কেঁদেছিলি অরুণদাকে বিয়ে করবো বলে?
যাঃ!
কেঁদে একেবারে গঙ্গা-যমুনা! আর কী মেরেছিলি আমাকে–মনে নেই?
যাঃ!
কাণ্ডই করেছিলি, সত্যি…দিদিরা হেসে খুন! কথাটা মনে করে সেইরকমই হাসল শাশ্বতী, যেরকম দিদিরা হেসেছিল কথাটা শুনে দশ বছর আগে। কিন্তু ঠিক কি সে-রকম? একটু চুপ করে থেকে স্বাতী যেন আপন মনে বলল–আজ এক শুক্কুরবার গেল, আবার শুক্কুরবারেই তো—
নে, ঘুমো এখন।
ছোড়দি, একটা কথা বলবে?
কী? একটু লজ্জা শাশ্বতীর মুখে।
কেমন লাগছে?
কেমন আবার! শাশ্বতী এক ঝটকায় পাশ ফিরল।
******
দুপুরবেলায় সিনেমা দেখে বিকেলের রোদুরে বেরিয়ে আসতে যেমন লাগে, তেমনি লাগল হারীতের পরের শুক্রবারের রাত-শেষে শনিবারের সকালবেলায়। লোকজন, চলাফেরা, হাসি, কথা, ব্যস্ততা, রোদুরে মাখা শীতের সকাল, আর সে ঘুম থেকে উঠল একটা অচেনা বাড়ির অচেনা ঘরের মেঝেতে। পাশে আলপনা, হাতে হলদে সুতো, পরনে গরল। যেন সিনেমা শেষ, সকলে মিশে গেছে রাস্তার ভিড়ে, সে পড়ে আছে সিঁড়িতে একলা। নাঃ, এক পেয়ালা চা খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। গায়ের আড়মোড়া ভেঙে হারীত উঠে দাঁড়াল। বাথরুমে হাত-মুখ ধুয়ে, গরদ ছেড়ে সাধারণ কাপড় পরে ঘরে এসে দ্যাখে রীতিমতো ভিড়। মেঝেতে মস্ত রুপোর ট্রেতে চা-শুধু কি চা! রুটি-মাখন, ডিমের পোচ, সোনারঙের মোটা-মোটা মর্তমান কলা, আবার ফুলো-ফুলো লুচি, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, সন্দেশ, পান্তুয়া, সরভাজা… হারীতের ভির্মি লাগল।
সরস্বতী বলল—কী নন্দী-সাহেব, রাত্তিরে একটু ঘুমিয়েছিলে কি?
খুব ঘুমিয়েছিলাম—হারীত গম্ভীরভাবে বসল এসে মেঝের বিছানাতেই, যেহেতু ঘরে চেয়ারটেয়ার কিছু নেই।
ও মা, বিয়ের কাপড় ছেড়ে ফেললে! শেতা ব্যস্ত হয়ে উঠল–বাসি-বিয়ে হবে না?
আরো গভীরভাবে হারীত বললো—আমি একটু বেরোবো।
এখন! এখন কোথায় যাবে! আঁৎকে উঠল শ্বেতা। কতকিছু আছে এখন—
আ–হা। মোটাসোটা প্রমথেশ খাটে এসে জুড়ে বসল-তোমাদের ওসব নিয়ম-টিয়ম ছাড়ো তো একটু! আজকালকার ছেলেদের কি ভালো লাগে ওসব! দাও, চা দাও ওকে।
স্বাতী, যা তো তোর ছোড়দিকে ডেকে নিয়ে আয়।–এটা বোধহয় আজকালকার ছেলেটির ভালো লাগবে। সরস্বতী কটাক্ষ হানলো হারীতকে।
মিছিমিছি লজ্জায় ফেলা বেচারাকে—মাথার কাপড়টি আরো একটু টেনে দিয়ে শ্বেতা বললো। কিন্তু না! বেনারসি আর গয়না-পরা শাশ্বতী বেশ হাসিমুখেই ঘরে এসে বড়োজামাইবাবুর কাছে বসল খাটে ঠেসান দিয়ে। এই ভুল করলে! ওখানে ওর পাশে গিয়েই বোসো না, একটু দেখি আমরা! বলে প্রমথেশ অনুমোদনের জন্য আর সকলের দিকে তাকাতে লাগল।
আর জ্বালিয়ো না তো বাপু! শ্বেতা উব-হাঁটু হয়ে ট্রের কাছে বসে খাবার-সাজানো-সাজানো থালা এগিয়ে দিতে লাগল হারীতের দিকে।
এ-সব দিয়ে কী হবে?
খাও একটু?
একটু?
কাল-তো উপোশ করেছিলে–
না। উপোশ কেন করব? শ্বেতা হেসে ফেলল—আচ্ছা, কাল না-হয় উপোশ করনি। তাই বলে আজ করবে নাকি?
—একটু চা দিন। সরস্বতী এগিয়ে এলো চা ঢালতে। হারীত বলল, আপনারা? হাত নেড়ে জবাব দিল প্রমথেশ—আমাদের হয়ে গেছে অনেক আগে। বুঝছ না, মফস্বলের অভ্যেস, ঘুম ভেঙেই খিদে।
—আপনি? প্রশ্নের লক্ষ সরস্বতী। মুখ টিপে হেসে সরস্বতী বললো—আগে বললে না—বসে থাকতুম তোমার জন্যে। ঢিলেঢালা ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা অরুণ ঘরে ঢুকে সোজা বসে পড়ল মেঝের উপর, কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলল—আমাকে একটু চা। সরস্বতী চা ঢেলে প্রথমে দিলো জামাইকে, তারপর স্বামীকে।
খাটের দিকে তাকিয়ে হারীত বললো—শাশ্বতী, তুমি?
প্রমথেশ হা-হা করে হেসে উঠল, শ্বেতা হাসি লুকোল আঁচলে, আর সরস্বতী সহজভাবে বললচা খাবি, শাশ্বতী? শ্বেতা মুখ তুলে হারীতের দিকে তাকাল—ওর জন্য ভাবতে হবে না তোমাকে-তুমি খাও-তো এবার!
একটি ডিম খেল হারীত, তারপর চায়ে চুমুক দিতে লাগল।
তা হবে না, সব খেতে হবে। লুচির থালা এগিয়ে দিল শ্বেতা। হারীত শিউরে সরে এল। খাও!
না।
খা–ও!
দেখুন, সকালে কিছু খাই না—
রোজ-রোজ কি বিয়ে করো যে রোজকার মতো খেতে হবে? চালাকি, না? খাও শিগগির! অনেকটা আলু-ভাজা একখানা লুচিতে মুড়ে শ্বেতা গুঁজে দিল হারীতের হাতের মধ্যে। হারীত কাতরভাবে লুচিখানা খেয়ে উঠল।–আর কী খাবে? আসরে নামল সরস্বতী।
আর না।
ও, বড়দির হাতই পছন্দ তোমার? দাও বড়দি, আরো কিছু দাও নন্দীর হাতে। উনি আবার নিজে হাতে নিয়ে খেতে জানেন না।
কিন্তু সন্দেশের বিরুদ্ধে একেবারে উপুড় হয়ে পড়ল হারীত। রীতিমতো সত্যাগ্রহ। শালিরাও ছাড়ল না, হত্যা দিল দু-দিক থেকে দু-জনে। শাশ্বতী বলে উঠল খাট থেকে এ কী একগুঁয়েমি! এত করে বলছে, খাও না!
ও মা! এর মধ্যে এত? শ্বেতা হেসে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে, আর সরস্বতী একটু-যেন শুকনো গলায় বলল—আমরা তো ফেল হলুম রে, এবার তুই আয়, দ্যাখ পারিস যদি! দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রাজেনবাবু বললেন—খাওয়া নিয়ে জবরদস্তি কী বিশ্রী! যে যে-রকম ভালোবাসে সে রকম দিলেই হয়। মৃদুস্বরে বললেন, কিন্তু শুনতে পেলো সকলেই।
তা—তা—ইচ্ছে করলে আর—থাকগে! মুখ ভার হল সরস্বতীর।–সকলের অভ্যেস তো একরকম না–বলে রাজেনবাবু অন্য দিকে চলে গেলেন।
শ্বশুরকে দেখে হাতের সিগারেট নামিয়ে রেখেছিলো অরুণ, ত্বরিতে তুলে নিয়ে বলল–স্ত্রী যদি এক মাইল দূরে খাটে বসে থাকে, তাহলে কি আর খেতে ভালো লাগে কারো! শাশ্বতী এসো না এখানে? জমিদারি ধরনে পায়ের পাতায় হাত বুলোতে-বুলোতে একটু দুলে-দুলে প্রমথেশ বললো–তুমি তো বেশ লোক হে! বসেছ তো গিয়ে নিজের স্ত্রীটির মুখোমুখি, তার উপর আবার—
বাঃ, তাই বলে অন্যের স্ত্রীর দিকে নজর দেব না একটুও!—কিছু মনে করো না, হারীত। সভাস্থল থেকে একটু দূরে জানালার ধারে বসেছিল স্বাতী, অরুণের কথাটা শুনে চোখ তুলে তাকাল। শালির বিয়েতে খুব-যে রস! উশকোখুশকো চুলের হাসিমুখ মানুষটিকে তীর ছুঁড়ল সরস্বতী। কিছুতেই খেলে না তো!—বলে শ্বেতা আঁচলে মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু দমল না; দুপুরবেলা নতুন জামাইকে সাজিয়ে দিল মস্ত রুপোর থালায় বাটি-চেপে-গোলকরা ফুলের মতো ভাত, আর থালাটি ঘিরে হারের লহরের মতো ঝকঝকে কাঁসার ছছাটো-বড়ো বাটিযেন সাতাশবৌ নিয়ে চাদ। হারীত এসে বসতেই শ্বেতা বললো–খেতে হবে না, শুধু দেখবার জন্য দিয়েছি। দেখবার যোগ্যই—হারীতকে স্বীকার করতে হল। বলে দিন সবচেয়ে ভালো রান্না কোন কোনটা। শেতা খুশি হয়ে বলল—সবটাই চেখে দ্যাখো একটু-একটু।
চেখে দেখব? বাকিটা ফেলা যাবে তো?
সে তোমাকে ভাবতে হবে না!
কী অপব্যয়! কত খাবার নষ্ট! সারি-সারি বাটির উপর চোখ বুলিয়ে হারীত স্বগতোক্তি করল। তা না-হলে আর বিয়ে কী!—শুক্তোটাকে উপেক্ষা করে ছোলার ডালের হেঁচকি দিয়ে খাওয়া আরম্ভ করলো প্রমথেশ–সেই সি. আর, দাশের গল্প জানো না-মেয়ের বিয়ের সময় খাজাঞ্চি এস্টিমেট দিল একলাখ টাকার। হেসে বললেন দাশসাহেব—আরে একলাখ টাকা তো চুরিই হবে, লাগবে কত বললা! বলে প্রমথেশ মাথা উঁচু করে হেসে উঠল।
এই করে-করেই তো এই অবস্থা হয়েছে আমাদের। হারীত মাছের চপের কোনা ভেঙে মুখে দিল।–তা দেরি নেই আর, আসছে দিন! এ যাত্রাও কোনোরকমে ঠেকিয়ে রাখল চেম্বারলেন, কিন্তু যুদ্ধ হবেই, তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে এসব!
মানুষের আনন্দ-উৎসব বন্ধ হবে ভেবে তুমি যেন বেশ উৎসাহিত?—চুমুক দিয়ে শুক্তোর ঝোল খেয়ে নিল অরুণ-ডাক্তার। রাজেনবাবু নেবু নিংড়ে নিচ্ছিলেন ডালে, চোখ না তুলেই আস্তে বললেন—তা সত্যিই তো, অপব্যয়টা আমাদের বড়ো বেশি।
অপব্যয় যখন হয়েই গেছে, সদ্ব্যবহার করা যাক! প্রমথেশ পাতে নিল উচ্ছে দিয়ে বাঁধা মৌরলা মাছ। সহজে কি শিক্ষা হবে আমাদের? রাস্তায় না খেয়ে মরবে মানুষ, তবে তো–হারীত বেছে বেছে হাত দিল সর্ষে-নারকোলের চিংড়িতে।
মানুষের যারা উপকার করে তাদের কী মুশকিল! সাদা-সাদা লাউয়ের তরকারি দিয়ে একটু ভাত মেখে নিয়ে অরুণ বলল—মানুষ ভালো থাকলে ভালোই লাগে না তাদের।
হঠাৎ বাবার কাঁধে মাথা হেলিয়ে জলের মতো ছলছল শব্দে হেসে উঠল স্বাতী! হারীত চট করে চোখ তুলে তাকাল একবার, তারপর খেতে লাগল নিঃশব্দে, গম্ভীরভাবে। স্বাতী, তুমি যে বসলে না?-প্রমথেশ কথা বদলাল।
আমি দিদিদের সঙ্গে খাবো।
কেন, ওকে আর বিজুকে বসিয়ে দিলেই হতো নতুন জামাইয়ের সঙ্গে।
বিজু তো সেই কখন খেয়ে বেরিয়ে গেছে–জবাব দিলো শ্বেতা—আর স্বাতী—
না, না—অরুণ বলে উঠল—ও-সব একসঙ্গে খাওয়া-টাওয়া হাইজিনিক নয়।
তোমার মুখে এ কথা? সরস্বতী হাসল।—স্বাতী সঙ্গে না বসলে তোমার তো খাওয়াই হতো না।
তার অবশ্য আলাদা কারণ আছে। কী স্বাতী, মনে নেই? অরুণ এক ঝলক তাকাল স্বাতীর দিকে।
তোমাদের এসব সেকেলে ঠাট্টা নন্দীর ভালো লাগছে না, রাশ টানল সরস্বতী।–তা একেলে ঠাট্টা শুনি না দু-একটা! যাকে লক্ষ করে শ্বেতার টিপ্পনি, সে একটু লাল হল, কিন্তু থালা থেকে চোখ তুলল না। স্বাতী উঠে এল সেখান থেকে। আবছা মনে পড়ে, অরুণদাকে তার কী-ভালো লাগত ছেলেবেলায়; অত ভালো কাউকেই যেন আর লাগল না। শুভ্র, শুভ্রর বন্ধুরা, হারীতবাবু কেউ কি সেই অরুণদার মতো?…কিন্তু সে রকম আর নেই কেন, সে অরুণদার কী হল?..বড়ো হতে হতে ছেলেবেলার ভালোলাগা আর থাকে না বুঝি? ভাগ্যিস সে বড়ো হয়েছে—এখন থেকে ভালোলাগা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত, আর তো বদল হবে না-না কি হবে? সর্বনাশ!—স্বাতীর যেন দম বন্ধ হল মুহূর্তের জন্য। তা-ই যদি হয়, তাহলে ভালোলাগায় বিশ্বাস কী! শাশ্বতীর কাছে গিয়ে সে বলল—আচ্ছা ছোড়দি, একবার যাকে আমাদের ভালোলাগে, তাকেই কি ভালোলাগে বরাবর?
কী বোকার মতো কথা! ছোড়দির সিঁদুর-ভরা মাথার দিকে স্বাতী একটু তাকিয়ে রইল চুপ করে। হঠাৎ বলল–ছোড়দি, আজ চলে যাবে?
বিজুটা কই রে?
জানি না তো!
কখন থেকে দেখছি না ওকে?
দাদা তো বাইরে বাইরেই—
দেখে আয় তো, ফিরেছে নাকি। স্বাতী ঘুরে এসে বলল–না ছোড়দি, দাদা বাড়ি নেই। ট্যাক্সিতে ওঠবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত শাশ্বতী বিজুর খোঁজ করল, কিন্তু বিজু ফিরল রোদেপোড়া চেহারা আর স্যান্ডেল-পরা ধুলো-মাখা পা নিয়ে সন্ধেবেলা। ঢুকেই বাড়ির থমথমে চুপচাপ ভাবটা তার ভালো লাগল না। এ-ঘরে ও-ঘরে কয়েকবার উঁকি-ঝুকি দিয়ে স্বাতীকে জিজ্ঞেস করল ছোড়দি কই? স্বাতী ভারি গলায় বলল—চলে গেছে। কথাটা যেন ধাক্কা দিল বিজুকে। সামলে নিয়ে বলল, কখন গেলো?
বিকেলে।
আমাকে আগে বলতে পারিস না? বিজুর গলা চড়ল। আলাদা করে আবার বলতে হবে নাকি?
কেন বলবি না আমাকে?
চ্যাঁচাসনে, দাদা!
কত খোঁজ করলে তোর। শ্বেতা নিশ্বাস ছেড়ে বলল।
তা এক কাজ কর না-হাত-পা ধুয়ে একবার ঘুরে আয় ওখান থেকে—কত খুশি হবে! বয়ে গেছে আমার।
ওকে কিছু বোলো না, বড়দি—স্বাতী বললো। ও কি এ-বাড়ির লোক যে ওর কিছু এসে যায়?
নই-ই তো! এ বাড়ির লোক তো নই-ই আমি! গলা ছেড়ে চীৎকার করল বিজু। আমি এবাড়ির লোক হলে কি আর এটাও জানতে পেতাম না যে ছোড়দি কখন যাবে!
তবে-তো বুঝিসই, জবাব দিল স্বাতী।
বুঝি না? বিজু যেন চোখ দিয়ে পুড়িয়ে ফেলল স্বাতীকে—সবই বুঝি। এ-বাড়ি তোর, এ-বাড়িতে তুই-ই সব, তোর কথায় সবাই ওঠে বসে—আমার কোনো জায়গা নেই এখানে। এতদিন ছোড়দির জন্য তোর জ্বলুনি-তো কম ছিল না, এবার সেও বিদায় হল? কেমন! আহ্লাদে নাচ এবার! মুখ লাল করে গলার রগ ফুলিয়ে, ঠোঁটে ফেনা তুলে, বাড়ির বিমর্ষ অবসন্ন প্রত্যেকটি মানুষের কানে বিজু তার মনের কথা সেঁধিয়ে দিল। একটি কন্যার সদ্যবিচ্ছেদে যা হয়নি, সেই রকম একটা আঘাত হঠাৎ যেন আকাশ থেকে নামল। কিন্তু কেন জানিস? আবার শোনা। গেল বিজুর গলা—কেন আমি এ-বাড়ির লোক নই, জানিস? তোর জন্য! শুনে রাখ, স্বাতী, আমি-যে বাড়ি থাকি না, আমি-যে ঘুরে-ঘুরে বেড়াই, আমার-যে পড়াশুনা হলো না—সব তোর জন্য! তোর রাজত্বে আমিও থাকব ভেবেছিস! আমি আর না–! এই আমি চললাম! বুকে চাপড় মেরে একহাত লাফিয়ে উঠে, পায়ের কাছে ঢনাৎ করে একটা কেটলি উল্টিয়ে বিজু বেরিয়ে গেল বন্দুকের গুলির মতো।
কী অসভ্য ছেলে! পাশের ঘরে রাজেনবাবু বললেন চাপা গলায়। আর সবাই যেন স্তম্ভিত হয়ে রইল কয়েক মিনিট। তারপর প্রমথেশ ফিশফিশ করে বলল-দ্যাখোনা, সত্যি চলে গেলে নাকি?
কেন-যে যেখানে সেখানে রাখে সব! শ্বেতা কেটলিটি তুলে রেখে বাবার কাছে এলো-বাবা, তুমিও তো ওকে একটু ডাকলে-টাকলে পারো মাঝে-মাঝে! বড়োসড়ো হয়েছে এখন ওয়াইল্ড! এই একটি ইংরিজি শব্দ ছাড়া আর কোনো কথা সরস্বতীর মনে এল না।—একেবারে ওয়াইল্ড!
মা তো নেই, শেতা তাড়াতাড়ি বললো—আর এ-বয়সে সব ছেলেই একটু না একটু বিগড়োয়। বাবা যদি একটু ওর সঙ্গে…
না—সরস্বতী বাধা দিলো, ওসব কিছু না—শাসন চাই, কড়া শাসন। বাবা অমন অসম্ভব ভালোমানুষ বলেই তো মাথায় চড়েছে। কোনো মেয়ের কথার উত্তরেই রাজেনবাবু কিছু বললেন না। হঠাৎ আবার শোনা গেল দুমদাম পায়ের শব্দ; যেন রাস্তায় মার খেয়েছে এই রকম একটা চেহারা করে বিজু ঘরের মধ্যে এসে সকলের দিকে তাকিয়ে বললো—বলতে পারলে না? আমাকে বলতে পারলে না তোমরা? কেউ বলতে পারলে না? বলেই ছিটকে শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে শাশ্বতীর খাটে, মুখে বালিশ চেপে বিশ্রী বীভৎস আওয়াজ করে ডেকে উঠলোছোড়দি—ঈ। ও-ও ছোড়দি! একেবারেই অসভ্যের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। বারান্দার একটি থামে হেলান দিয়ে স্বাতী যেন শীতের ছাইরঙা-সন্ধ্যার মধ্যে মিশেছিল এতক্ষণ, চমকে উঠল দাদার অন্যরকম চীৎকার শুনে। বিজু সহজে থামল না, আর শুনতে শুনতে স্বাতীর গলা আটকে এল, ঠোঁট কেঁপে উঠল, তার মুখ তাকে অমান্য করে বিকৃত হল নানা রকম রেখায়, আর ফোঁটা ফোঁটা গরম শরীর-নিংড়োনো জল গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখ বেয়ে গালে।