স্বাতীর ঘুম ভাঙল অন্ধকারে। কিন্তু তখনই বুঝল রাত আর নেই। কানে এল কাকের কাকা, রান্নাঘরে হরির কয়লা ভাঙার ঠকাশ-ঠকাশ, বাথরুমে জলের ছলছল। শেষের শব্দটায় বুঝল বাবা উঠে পড়েছেন। নিজেও দেরি করল না। বেরোতে গিয়ে হোঁচট খেল। দরজার ঠিক বাইরে, দুটো ঘরের মাঝখানকার ফালি গলিতে, ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে রামের-মা—এ রকম করে ঘুমোয় নাকি সে, এমন অসহায়, নিঃস্ব ভঙ্গিতে? রামের-মাকে প্রায় টপকে স্বাতী এগোল, পিছনের বারান্দায় দেখা হল বাবার সঙ্গে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসছেন বাথরুম থেকে। ছাইরঙা আবছায় স্বাতী দেখল বাবার মুখ ছাইরঙা। ফ্যাকাশে অন্ধকারে রাজেনবাবু দেখলেন স্বাতীর মুখ ফ্যাকাশে। কেউ কিছু বলল না।
স্বাতী বাথরুমে ঢুকল; বেরিয়ে এসে আবার রামের-মাকে টপকে ঘরে এল। পরনের কুঁচকোনো, আধময়লা, মনমরা বেগুনিরঙের শাড়িটা ছেড়ে একখানা পাটভাঙা মিলের শাড়ি পড়ল-সাদা শাড়ি, বড়ো সাদা, চুনের মতো, চুনকাম-করা দেওয়ালের মতো সাদা আর মনমরা। শাড়ি বদল করে স্বাতী আবার এল পিছনের বারান্দায়। এটাই বাবার বসবার ঘর, আর এটাই তাদের খাবার ঘর। লম্বা সরু রেক্সিনে মোড়া খাবার টেবিল—ডাক্তারদের রোগী। দেখার টেবিলের মতো, যেন এক্ষুনি কোনো অপারেশন হবে। লম্বা দিকে ধারের চেয়ারটায় বাবা বসেছেন উঠোনের দিকে মুখ করে, স্বাতী বসল উঠোনের দিকে মুখ করে সরুদিকের একলা চেয়ারটায়। কেউ কিছু বলল না।
ঘোর কাটল, ভোর হল। ছাইরঙা আবছায়ার পর ফ্যাকাশে ছাইরঙা ভোর, ময়লা ধোঁয়াটে আলো রান্নাঘর থেকে পেঁচিয়ে বেরোনো ধোঁয়ার মধ্যে মিশল, রান্নাঘরের দেয়ালটা কালো, উঠোনে ধুলো আর কয়লাগুঁড়ো-ময়লা, মনমরা, শীত করা ভোর। স্বাতী আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিল—এর মধ্যেই শীতের ভাব। গ্রীষ্ম কেটে গেল কবে? বর্ষা ফুরলো কখন? রামের-মা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে আসছিল ঘোমটা-খোলা মাথায়। বাবাকে দেখে থমকে দাঁড়াল, কাপড় টানল, ঘোমটার তলায় দিদিমণির দিকে একবার তাকিয়ে ফিরে গেল উল্টো দিকে। দুঃখী মুখ রামের মার—স্বাতী পলকে দেখল-কালো, কুঁকড়োনো, কুঁচকোনো মুখ।
ঘোর কাটল, রোদ ফুটল। রান্নাঘরের ময়লা ছাদে রোদ পড়ল। রোগা, ছোট্ট, চৌকো, হলদে রোদ উঠোনে নামল। হরি এল রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে, চায়ের সঙ্গে রুটি-মাখন। তারও দুঃখী মুখ, শুকনো, সুখ নেই, বিষণ্ণ। ছেলেবেলা থেকে হরিকে দেখে আসছে স্বাতী, আজ প্রথম দেখল যে তার মুখ দুঃখ দিয়ে আঁকা। নিঃশব্দে চা খেল দুজনে। ঘোমটা ঢাকা রামের-মা নিঃশব্দে এল, টেবিলে রাখল চশমা আর খবর-কাগজ, নিঃশব্দে চলে গেল। রাজেনবাবু কাগজের ভাঁজ খুললেন, চশমা-চোখে পড়তে লাগলেন খুব বেশি মন দিয়ে। স্বাতী নিঃশব্দে বসে থাকল। হোট্টো, চৌকো, হলদে রোদ মিলিয়ে গেল—রোগা, সাদা, লম্বা বোদ এগিয়ে এল। স্বাতী নিঃশব্দে উঠল, নিঃশব্দে চলে এল ঘরে—রাজেনবাবু নিঃশব্দে কাগজ পড়তে লাগলেন। না—কিছু বলবার নেই, কিছু করবারও নেই। যে কথা এ-কদিন ধরে সব সময় মনে পড়ছে তার, যে কথা কাল সারা রাত ঘুমের মধ্যেও এক মুহূর্ত সে ভোলেনি, তা নিয়ে একটি কথাও বলবার নেই, একটি কথাও শোনবার নেই—এমনকি, নতুন কোনো ভাবনাও ভাবোর নেই আর, অথচ অন্য কোনো কথাও নেই, অন্য কোনো ভাবনাও নেই—যে সব কথা হাজার বার ভাবা হয়ে গেছে, ঘুরে ফিরে সে সবই ভাবতে হয় আবার। এই যেন প্রথম মৃত্যুকে চিনল স্বাতী। মা মরেছিলেন, মেন লেগেছিল? অসুখ দেখে-দেখে সয়ে গিয়েছিল, জ্ঞান হবার সময় থেকেই বুঝেছিল মা ব্যাপারটা তার পক্ষে তেমন মজবুত নয়। আর ছেলেমানুষও ছিল। কষ্ট খুব, ভীষণ কষ্ট, কিন্তু আরামও সঙ্গে সঙ্গে; যত কষ্ট তত কান্না, আর যত কেঁদেছে ততই ভুলেছে। তারপর সেই একবার ছুটির পরে কলেজে গিয়েই মায়া সান্যালের মৃত্যুর খবর। সেদিন— এখন ভাবলে বোঝে সে কথা——সেদিন সবচেয়ে বেশি তার হয়েছিল মনে-মনে একটা জিতে যাওয়ার ভাব-অন্য একজন মরল, তাকে মরতে হল না, আর সেইজন্য কলেজ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে অনেক বেশি ভালো লেগেছিল—সব। শুধু-শুধু বেঁচে থাকতেই ভালো লেগেছিল। আর এই সেদিন রবীন্দ্রনাথের—কিন্তু ও-তো কোনো মৃত্যু নয়। পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথেরা মরেন না, তাঁরা চলে যান সময় থেকে সময়ের বাইরে, শরীর ছেড়ে মানুষের মনে, তাদের শেষ নেই। কিন্তু অন্যেরা, লোকেরা, সকলেরা? তারা মরে গেলেই মরল, শরীর থেকে বেরোলেই হারিয়ে গেল, কিছু থাকল না। আর এই মরাই সকলকে মরতে হবে… স্বাতীর মনে পড়ল স্কুলে যখন আমরা সাতজন বলে সেই ইংরেজি কবিতাটা পড়েছিল। মেয়েটি বলছে—আমরা সাত ভাইবোনা, সাতজনই তো! যদিও সাতজনের দুজনই মরে গেছে। ছেলেমানুষ, মৃত্যু কাকে বলে বোঝে না। পড়ে হাসি পেয়েছিল স্বাতীর। আট বছরের মেয়ে-মৃত্যু বোঝে না। যত দূর স্মৃতি পৌঁছয়, এমন দিনের কথা মনে করতে পারেনি, যখন সে এ কবিতার মেয়েটির মতো ছিল। খুব, খুব ছেলেবেলাতেই—বোধহয় চার কি পাঁচ বছরেই—এই খবরটা সে পেয়েছিল যে সকলকেই মরতে হয়, এমনকি তাকে—তাকেও মরতে হবে। এই তো সে খেলছে, হাসছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছ, যা ইচ্ছে তাই করছে, কিন্তু সবসময়, সবসময় তাকে পিঠের দিকে তাক করে আছে এক তীরন্দাজ, কানে-কানে ধনুক টেনে, মহাভারতের ছবিতে কিরাতের মতো পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে–যে কোন মুহূর্তে ছাড়তে পারে তীর, ছাড়ছে না কেন কেউ জানে না, কিন্তু শেষপর্যন্ত ছাড়বেই। কখন কেউ জানে না, আর ছাড়লেই হয়ে গেল। ঘরে কখনো একা থাকলেই এই তীরন্দাজকে মনে পড়ত স্বাতীর, পিছন ফিরে তাকাতে ভয় করত, পিঠটা শুড়শুড় করত যেন। কিন্তু একলা তাকে তো না, সকলকেই তো একসঙ্গে তাক করে আছে ঐ এক তীরন্দাজ, এক তীর, অন্যেরা জানে না? ভাবে না? ভয় পায় না? বড়োদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্বাতী চেষ্টা করেছে তাদের মনের ভাব বুঝতে-কই, তারা তো ভয়ে ভয়ে নেই, দিব্যি! তাহলে তারও কি আর ভয় থাকবে না বড়ো হলে কবে বড় হবে? কত বড়ো হলে ও রকম নিশ্চিন্ত হওয়া যায়? ছোট্টো স্বাতী আশায়-আশায় থাকল, কিন্তু কবে যে সেই শুভক্ষণ এল আর গেল, কবে থেকে যে পিঠের শুড়শুড়ানি সারল, মহাভারতের কিরাতের মতো সেই তীরন্দাজকে ভুলল, তা আর মনে করতে পারে না এখনকার স্বাতী। এখন শুধু এইটে মনে পড়ে যে অনেক… অনেকদিন তাকে মনে পড়েনি… সেই ঝাপসা ছেলেবেলার পর আর না-মা যখন মরলেন তখন না। একটানা অনেক… অনেক বছর সে। এমনভাবেই কাটিয়েছে যেন মৃত্যু নেই।
টেলিগ্রাম!
আওয়াজটায় বুক কেঁপে উঠেছিল স্বাতীর, যদিও এর জন্যই বিকেল থেকে বসেছিল ছোড়দির আর বাবার সঙ্গে। একটু দেরি হয়েছিল উঠতে, বাবা তার আগেই উঠলেন। স্বাতী দেখল দরজায় একটা দৈত্যের ছায়া, আর একটু পরে রাস্তার অন্ধকারে রাক্ষসের একচোখের মতো সাইকেলের আলো। মুহূর্তের জন্য বাবার মুখটা যেন ভেঙ্গেচুরে অন্যরকম হয়ে গেল, তারপর ফিশফিশে আওয়াজে বললেন—আমি যাই।
স্বাতী বলল—আমিও যাব।
না।
বাবা!
না।
আগের দিনের বাধা-বিছানা বাঁধাই ছিল, আর দু-একটা জিনিস শাশ্বতী গুছিয়ে দিল চটপটআর পাঁচটা মিনিটও দেরি হল না, কোনোরকমে ট্রেন ধরবার সময়টুকুই ছিল তখন। রাজেনবাবু দুই মেয়েকে নামিয়ে দিলেন শাশ্বতীর বাড়িতে। সেই তো বাবা গেলেন, তবু আগের দিন গেলে— কিন্তু তাতেই বা কী হত! তাদের দেখে, তাদের মুখ দেখে হারীত বলল-খবর ভাল না? শাশ্বতী জবাব দিল না। তোমার বাবা চলে গেলেন আজ? হারীত তাকাল স্বাতীর দিকে। স্বাতী আস্তে মাথা নাড়ল। হারীত কপাল কুঁচকাল—অবস্থা কি খুব খারাপ?
শেষ–কথা বলল শাশ্বতী।
শুনে হারীত চুপ করে থাকল মিনিটখানেক, তারপর খুব গম্ভীর মুখে বলল—হুঁ—এত খাওয়া-যদি শেষের দিকেও খাওয়াটা কমাতেন—তাছাড়া তো আর ওষুধ নেই এর—আর স্ট্রোক একবার হয়ে পড়লে মুশকিল! মুশকিল্ল কথাটা একটু আলগা করে উচ্চারণ করল, যেন এখনও এ থেকে উদ্ধার পাবার আশা আছে। শাশ্বতী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছোড়দির দীর্ঘশ্বাস, আর হারীতদার কথা, দুটোই খুব খারাপ লাগল স্বাতীর। খারাপ লাগল ও-বাড়িতে থাকতে বাড়িতে থাকলেই হত, কিন্তু বাবা কিছুতেই দিলেন না। যে কটা দিন বাবা ফিরলেন না, কী যে খারাপ তার কেটেছিল! একবার ঘুরে আসতে পারেনি বাড়ি থেকে, কেননা সে-কদিনের মতো ছোড়দির তো কথা ওঠে না বাপের বাড়ি যাবার, আর দাদা যদিও মাঝে-মাঝে এসেছে, একবারও তাকে নিয়ে যেতে চায়নি–আবার, যদিও বাবা নেই, বলতে গেলে কেউ নেই, তবু বাড়িতেই যে তার মন পড়ে আছে এ কথা ছোড়দির কাছে লুকোনো দরকার।
অন্য বাড়িতে এই প্রথম থাকল স্বাতী। ঠিক ঠিক নিজের অভ্যেস মতো সব হয় না অন্য কোথাও, কিন্তু ঐ অসুবিধে আর কতটুকু, আর সেজন্য খারাপ লাগার মতো মনও ছিল না তার। কিন্তু যেহেতু বাড়িটা ছোড়দির, তার ছোড়দির… এ বাড়ির যা কিছু তাদের বাড়ি থেকে আলাদা, সবই একটু বিশেষ হয়ে তার চোখে পড়ল। ছোড়দির সঙ্গে তার মাখামাখি ছিল সবচেয়ে বেশি। মেজদি-সেজদির বিয়ের পর, আরো বেশি মা মরবার পর–ছোড়দিকে না হলে এক দণ্ড তার চলত না। আর এখন সেই ছোড়দির সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হলে খুব ভালো কিন্তু সারাদিন একলা কাটাতে হলে সে যে একটু হাঁপিয়ে ওঠে, এইটে বুঝতে পেরে তার বিবেকে কামড়াল। হোড়দির অনেক অভ্যেসই আলাদা, কথাবার্তা আলাদা, অনেকটাই মেলে না তার সঙ্গে। স্বাতী ধরে নিল যে ছোড়দি যা ছিল তা-ই আছে, সে নিজেই বদলেছে। তাই নিজেকে দোষ দিল মনে-মনে, আর সে দোষ ঢাকবার জন্য ছোড়দিকে খুব বেশি করে ভালবাসতে চেষ্টা করল। দুপুরবেলা পাশে শুয়ে-শুয়ে নিবিড় হতে চাইল ছেলেবেলার স্মৃতিতে, কিন্তু ঠিক সুরটি যেন লাগল না, আর ছোড়দিও তাকে রেহাই দিল খানিক পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রে খাওয়ার পর আবার——কিন্তু তখন যদি ছোড়দি একটু বেশিক্ষণ কাটিয়েছে তার সঙ্গে, হারীতদা, সে স্পষ্ট বুঝেছে, সেটা পছন্দ করেননি। আবার হারীতদা যদি কখনো তার সঙ্গে বেশি কথা বলেছেন, তাহলে ছোড়দির মুখভার হয়েছে। অন্যসময় হলে স্বাতীর হয়তো মজা লাগত, তখন শুধু খারাপই লাগল, শুধু মনে হল এখানে তার জায়গা নেই, এখানে সে আছে কেন।
কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগল মৃত্যুর প্রতি ছোড়দি-হারীতদার উদাসীনতায়। দুজনের মধ্যে হারীতদাই অবশ্য ভালো, তিনি স্পষ্টই বুঝতে দিলেন যে স্ত্রীর দিদির স্বামীর মৃত্যু তাঁর কাছে কিছুই না, তবে স্ত্রীর মন রক্ষার জন্য কয়েকটা দিন তিনি একটু চুপচাপ কাটাতে প্রস্তুত। কিন্তু ছোড়দি প্রায় সব সময় একটা শশাকের ভাব রাখল, থেকে-থেকেই বলতে লাগল জামাইবাবুর, বড়দির কথা, বলতে-বলতে নিশ্বাস ফেলল ঘন-ঘন, চোখের জল মাঝে-মাঝে। এইটে অসহ্য লাগল স্বাতীর। কেন? ছোড়দি কি কপট, না স্বাতীর দুঃখ বেশি? না, ছোড়দির দুঃখও খাঁটি তার দুঃখও বেশি না। বেশি দুঃখের কথাই বা কী, ছোড়দির চেয়ে বেশি তো আর দ্যাখেনি জামাইবাবুকে। হয়তো ভালো লেগেছিল বেশি, খুব। কিন্তু সে-মানুষ হারিয়ে গেল বলে তার কি কিছু হারাল? কিছু না। কোনো এক প্রমথেশ চৌধুরী পৃথিবীতে আর নেই, তাতে ছোড়দির যতটা এসে যায়, তারও ঠিক ততটাই— কিছু না। ছোড়দির দুঃখ বড়দির জন্য, আর সেটাই ঠিক… স্বাভাবিক, কিন্তু স্বাতী বড়দিকে তেমন ভাবল না, ডালিমদেরও না, জামাইবাবুকেই ভাবল বার বার। বার বার ভাবল তার লম্বা, ঠান্ডা, নিঃসাড় শুয়ে থাকা-মরা! কেমন দেখাচ্ছিল? সব সময় হাসি-হাসি সেই মুখে একটুও হাসির ভাব ছিল কি? না কি যন্ত্রণায় মোড়ানো মুখ? না কি কিছুই না–শূন্য? কিছু না, শুধু শূন্যতা-স্বাতী ভাবল-জামাইবাবুকে, না…মৃত্যুকেই ভাবল স্বাতী— তাহলে এই? অদৃশ্য তীরন্দাজ অব্যর্থ তীর নিয়ে ঠিক তৈরি? যেমন ছিল তার ছেলেবেলায়, তেমনি? তখন তেমনি, এখন তেমনি, সবসময় তেমনি! আমরা ভুলে যাই, আমরা ভুলে থাকি। সে কখনো ভোলে না। সে আছেই, সে আছে। তাক করে আছে পিঠের দিকে, আমার দিকে, যা কিছু আমার আর যা কিছু আমি সেই সমস্তর দিকে। যত আমার ইচ্ছা, চিন্তা, চেষ্টা, সবার ওপরে সে। আর যত আমার ভালবাসা, তার ওপরেও সে। কেমন করে এতদিন ভুলে ছিলাম! মৃত্যুকে এতদিন ভুলে ছিল বলে স্বাতীর অবাক লাগল, আরো অবাক লাগল অন্যদের এখন ভুলে থাকতে দেখে। আর চোখের উপর ছোড়দি-হারীতদাকে দেখে। মৃত্যুর সঙ্গে হারীতদার ভদ্রতার সম্পর্ক, আর ছোড়দির করুণার। যে যার সম্পর্কের পাওনাটুকু মিটিয়ে আবার বেঁচে থাকতেই ব্যস্ত। একবার মনে পড়ল না তাদের যে, মৃত্যুর আরো পাওনা আছে। মনে পড়ল না যে, জন্মের সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যুর কাছে বিক্রি হয়ে গেছে তারা নিজেরাই। সেই নিশ্চিত, নিশ্চিন্ত, ভীষণ তীরন্দাজকে কখনো তারা দ্যাখেনি, এখনো তারা দেখল না।
ছোড়দি-হারীতদার সঙ্গে মস্ত একটা বিচ্ছেদ অনুভব করল স্বাতী। শুধু ও-দুজন নয়, সকলের সঙ্গেই বিচ্ছেদ। যারা বেঁচে আছে, যাদের নিয়ে পৃথিবী, স্বাতীর মনে হল তারা তার কেউ না। এমন কিছু সে জেনেছে যা আর কেউ জানে না, সেইজন্য সকলের থেকে সে বিচ্ছিন্ন, পৃথিবীর মধ্যে সে একলা। সবাই চলেছে একদিকে নেচে, লাফিয়ে, ছুটে, ঘুরে, তাড়াতাড়ি, দেরি করে, দলে দলে চলছে বলির পাঁঠা… কেউ জানে না কোথায় যাচ্ছে, একলা সে জানে। একলা সে জানে যে জীবন্ত মানুষরাই মরশু, যারা বেঁচে আছে, তারাই দিনে দিনে মরছে, মৃত্যু নেই শুধু মৃতের। একলা সে জানে যে মৃত্যু ছাড়া সত্য নেই, যতদিন পারি আর. যেমন করে পারি মৃত্যুকে আমরা পালিয়ে বেড়াই, আর সেই পালিয়ে বেড়ানোর নামই জীবন। আর এই জীবনএতে দুঃখই সত্য, দুঃখই নিশ্চিত আর স্থির। যতক্ষণ পারি আর যেমন করে পারি আমরা তাকে এড়াই, ফাঁকি দিয়ে বেড়াই আর সেই ফাঁকির নামই… সুখ, আশা, ইচ্ছা। এও সেই জানে, একলা সে। গান আরম্ভ হবার আগে যেমন ঝমঝম তানপুরা বাজে, তেমনি একটা ঝিমোননা, গম্ভীর, একটানা সুর স্বাতীর মনের মধ্যে বাজতে লাগল সবসময়। দুঃখের সুর, সব জড়ানো দুঃখের। গম্ভীর, মন্থর, নিশ্চিত দুঃখের স্রোত বয়ে চলল একটানা। থামে না, কমে না, বাড়ে না, ছাড়ে না… সবসময় একরকম। বাবা ফিরলেন, বাড়ি ফিরল—একই রকম। দিনের পর দিন কাটতে লাগল–একই রকম।
যেদিন বাড়ি ফিরল, সেদিনই সত্যেনবাবু এলেন। তাকেও একটু দূর লাগল, পর লাগল, কিন্তু এও মনে হল যে তার এখনকার মনের ভাব কেউ যদি বোঝে তো তিনিই বুঝবেন। তাকে প্রথম দেখে হাসিমুখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আর একবার তাকাতেই হাসি মিলিয়ে গেল মুখ থেকে, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—কী হয়েছে? স্বাতী তখনই কোনো জবাব দিতে পারল না। এখানে ছিলে না তোমরা?—আমি এসেছিলাম দুদিন—বাড়ি বন্ধ ছিল— কোথায় গিয়েছিলে?—কী? কী হয়েছে? স্বাতী আরো একটু দেরি করল, মনে মনে কথাগুলি সাজিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল—আমার বড়োজামাইবাবু—মানে, বড়দির স্বামী–তিনি মারা গেছেন।
গেছেন। কথাটা শুনে সত্যেনবাবু একবার মাত্র তাকালেন—চকিত, দ্রুত, একটু ভীত দৃষ্টি। তারপরেই বসে পড়লেন, বসে থাকলেন নিচু মাথায় চুপ করে। কিছু বললেন না, জিগেস করলেন না,, কোনো বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন না। শুধু বসে থাকলেন চুপ করে খানিকক্ষণ, অনেকক্ষণ… আর স্বাতীও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, মনে পড়ল এই সেদিনের কথা, যেদিন উনি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর নিয়ে। সেদিন তক্ষুনি কিছু করবার ছিল, অনেক করবার ছিল, তারপর বলবারও ছিল অনেক.. আজ কিছু নেই, আজ শুধু চুপ। শহর ভরে, দেশ ভরে এখনও রবীন্দ্রনাথের হৈ-হৈ, কাগজে সেটাই বড়ো খবর এখনও। কত পত্রিকা, কত বক্তৃতা, ছবি, গান, কথা, কমিটি, সমিতি—এ রকম চলবে আরো কিছুদিন—আর এরই মধ্যে আরো বড়ো এক খবর এসে পৌঁছল মাত্র কয়েকজন মানুষের কাছে, সব মানুষ থেকে আলাদা হয়ে গেল সেই কজন, আরো কাছাকাছি হল পরস্পরের। যে কোনো একজনের মরে যাওয়াটা কিছুই না, রোজই মরছে। চলতে চলতে একবার আহা বললেই ফুরোল, কিন্তু যে-কজন তাতে দুঃখ পায়, তাদের দুঃখের মতো দুঃখ নেই, নিজের দুঃখ ছাড়া দুঃখ নেই… সেটাই শুধু দুঃখ, অন্যসব খবর, ঘটনা, কথা বলার বিষয়। হঠাৎ স্বাতীর মনে পড়ল রেস্তোরয় বসে ধ্রুব দত্তর সেই কথাগুলি খুব খারাপ লেগেছিল তখন, খুব রাগ হয়েছিল, কিন্তু ঠিকই তো—ঠিক কথাই তো বলেছিলেন। দুঃখ কি অমন করে শহর ভরে ছড়ায়, দুঃখ কি পৃথিবী ভরে সোর তোলে? কেমন করে হবে— দুঃখ-তো সেটাই, যা মানুষকে এক করে দেয়। সকলে মিলে, অনেকে মিলে দুঃখী হওয়া যায় না তো। আমরা যে শুধু দুঃখকে ডরাই তা নয়, দুঃখীকেও এড়াই। তাই, যতক্ষণ পারি, এমনভাবে চলি-ফিরি যেন দুঃখ বলে কিছু নেই, যেন ওটা কিছুই না। যে কথা শুনে সত্যেনবাবু অমন করে বসে পড়লেন, সেটা কি তার কাছে কিছু? তার মুখে চোখ রেখে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজল স্বাতী। কিন্তু কপালে হাত রেখে নিচুমাথায় এমন করে বলেছেন যে থুতনি ছাড়া কিছু প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। সত্যি যেন একটা আঘাত পেয়েছেন এইরকম দেখাচ্ছে ভঙ্গিটা। কিন্তু তার আঘাত পাবার কী আছে? আর আমিই বা কেন ভাবছি সে কথা—তিনি তো বলতে গেলে চেনেনই না ওঁদের। এটা তার ভদ্রতা—হারীতদার চেয়ে উঁচু জাতের ভদ্রতা—সুন্দর সৌজন্য, কিন্তু আমারও তো ভদ্রতা আছে, আমারই কথা বলা উচিত, যাতে উনি সহজ হতে পারেন। স্বাতী বসে আলাপ করল—আপনি এসেছিলেন এর মধ্যে?
সত্যেনবাবু হাত সরালেন কপাল থেকে, কথা বললেন না।
কলেজেও যাইনি একদিন—স্বাতী আলাপ চালাল–ছোড়দির ওখানে ছিলাম। বাবা তো গেলেন বড়দির কাছে। সত্যেনবাবু মুখ তুললেন, কথা বললেন না।
একেবারে হঠাৎ—আপনাকে তাই আগে জানাতে পারিনি। বলেই অপ্রস্তুত লাগল স্বাতীর–সবই ওঁকে জানাতে হবে নাকি? আর খবরটাও যেন ওঁর কাছে জরুরি?—তাই তাড়াতাড়ি আবার বলল—আপনি একদিন কী করলেন? এতক্ষণে উনি তাকালেন, এতক্ষণে কথা বললেন, আমি—আমি আর কী করব। এখন যাই বলে একবার একটু তাকালেন স্বাতীর চোখে, তারপর চলে গেলেন। সেই চোখের গভীর স্তব্ধতাকে স্বাতী অবিশ্বাস করতে পারল না। একটু অবাকই হল, একটু ভাবল মনে-মনে। উনি কি তবে বুঝেছেন আমার মনের কথাটা? উনিও কি দেখেছেন সেই ভীষণ তীরন্দাজকে? যা শুধু আমিই জানি, পৃথিবীর আর কেউ জানে না, তা কি তবে উনিও জানেন? বালতি-ন্যাতা হাতে ঘর মুছতে এল রামের-মা। তার দিকে তাকিয়ে সত্যেনকেই দেখল স্বাতী, দেখল সেদিনের সেই স্তব্ধ গভীর চোখ। তার মনের মধ্যে খেলে গেল—আমি দুঃখ পেয়েছি, সেটাই তার দুঃখ, আমি বড়দিকে ভালবাসি, তাই সে বড়দিকে প্রায় না দেখেই ভালবাসে। কথাটা এর আগেও অনেকবার উঁকি দিয়েছে তার মনে—আমল দেয়নি—এখনো আমল দিল না। কিন্তু নিজেরই অজান্তে সত্যেনের কথাই ভাবতে লাগল বসে বসে। এই দেড় মাস ধরে একটু ঘন-ঘন আসছে। এই দেড় মাসে স্বাতী সবসুদ্ধ যত কথা বলেছে তার অর্ধেকেরই বেশি সত্যেনের সঙ্গে। বাবা বড়ো চুপচাপ আজকাল আর একটু যেন ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন, চশমা চোখে বাসে চিঠি লেখেন বড়দিকে, বড়দির বড়ো দেওরকে—স্বাতী কখনো বাবাকে দ্যাখেনি নিজের হাতে এত চিঠি লিখতে। এতদিন সে-ই ছিল বাবার সেক্রেটারি কিন্তু এসব চিঠির বিষয়ে সে কিছু জানে না পর্যন্ত, মেজদি-সেজদির চিঠি এলেও বাবা তাকে দেন না। একদিন জিগেস করেছিল—কী লিখছ, বাবা, বড়দিকে?
আসতে লিখলাম এখানে।
বড়দি আসবেন! কথাটা খুশির না, উচ্ছ্বাসের না। কথাটা যেন প্রশ্ন, যেন দ্বিধাভরা প্রশ্ন। কেমন করে চোখ রাখবে বড়দির উপর আবার, কেমন করে কথা বলবে?
হ্যাঁ, আসাই ভাল। বাবাও এমন করে কথাটা বললেন যেন এর বিরুদ্ধ যুক্তিও আছে। স্বাতী বুঝল যে বড়দির পক্ষে এখানে আসা এখন আর সহজ না—আগেও সহজ ছিল না, কিন্তু তখনকার বাধা
আর এখনকার বাধা একেবারে উল্টোউল্টি তাই বলল—তুমি বললে আসবে না?
দেখি।-বাবা আবার লিখতে লাগলেন, একটু পরে চোখ তুললেন তার দিকে। চশমার পিছনে বাবার কুকড়ানো বুড়ো চোখে স্বাতী কী যেন দেখল; আর তাকাল না, আর দাঁড়াল না সেখানে। বাবার মুখ নিলিয়ে গেল, সত্যেনকে মনে পড়ল আবার। স্বভাবত সরল তার চোখ, মুখে গম্ভীরতর লাবণ্য, আস্তে কথা বলে, কিন্তু অস্পষ্ট কখনো না। আর এমন কথা বলে যে সবসময় উত্তর না দিলেও চলে, চুপ করে শুনলেও মনে হয় দু-পক্ষেরই কথাবার্তা এটা। এখন আর বইয়ের কথা না, নানা কথা। তিন বছরে সব সুষ্ঠু যে কটা কথা বলেছিল তারা, এই দেড়মাসে তার বেশি বলা হয়ে গেছে। স্বাতী ভাবতে চাইল সেই কথাগুলি, কিন্তু কী আশ্চর্য একটা কথাও মনে আনতে পারল না। কী? কী বলে সত্যেন? হঠাৎ চমকে উঠল স্বাতী, চমকে বুঝল সত্যেনবাবুকে সে মনে মনে সত্যেন ভাবছে। একা ঘরে লাল হল, যেন নিজের দিক থেকেই মুখ ফেরাল আর ঠিক তখনই ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল শরতের শীতল, উজ্জ্বল, সুন্দর একটি সকাল, যে সকালটা এতক্ষণ মরে ছিল তার কাছে। সত্যেন!—আওয়াজ না করে, কিন্তু ঠোঁট নেড়ে, নামটা উচ্চারণ করল একবার। কবে থেকে সত্যেন হল?
******
একটু শব্দ হল ঘরে, তাকিয়ে দেখল, ছোড়দি। দু-বোনে চোখাচোখি বল নিঃশব্দে, তারপর স্বাতী বলল—তুমি খুব সকালেই এসেছ!
হ্যাঁ, ঘুম থেকে উঠেই চলে এলাম, আর একটু সকাল সকালই উঠেছিলাম। বলতে বলতে শাশ্বতীর মনে পড়ল অন্যদিনের চাইতে সকালে উঠে ভোরবেলাটি কেমন ভালো লাগল, ভালো লাগল এক ট্রামে করে এই পথটুকু আসতে। বলল অন্য কথা—ভালো ঘুমোতেও পারিনি রাত্রে, কীসব আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখছিলাম। বোধহয় এক রাত্রির অল্প একটু অনিদ্রার ফলেই, শাশ্বতীর গাল একটু বেশি লালচে দেখাল, চোখ একটু বেশি ঝকঝকে। কিন্তু স্বাতী চোখে যা দেখল মুখে তা বলল না। শাশ্বতী আবার বলল—সেবারে বড়দি এলেন—ঠিক এইরকমই ছিল সকালবেলাটা। একটু থেমে খামকা জুড়ল—না রে? কথাটা স্বাতীরও মনে হয়েছিল এইমাত্র, কিন্তু সে সায় দিল না, কথা বলল না। কী ভালোই লেগেছিল! কী ফুর্তি জামাইবাবুর, আর বড়দি যেখানে, সেখানেই আনন্দ। আর সেই বড়দি-টলটল করল জলের ফোঁটা শাশ্বতীর চোখে। তার মনে হল, অমন ভালো আর কখনো লাগেনি, অমন সুখী কখনো আর হয়নি জীবনে—যদিও তখন তা বোঝেনি। তখন বরং রোজই প্রায় দুঃখই পেয়েছে তাদের পারিবারিক উৎসবে হারীতের যোগ দেবার অনিচ্ছায়, আর ও-ধরনের আমোদের প্রতি হারীতের প্রকাশ্য অবজ্ঞায়। তার মন আরো পিছনে সরল, পোঁছল তার বিয়ের সময়ে প্রথম না ঘুমোনো রাতটির পরে আলো-ভরা সকালে… আসনপিড়ি হয়ে খাটে বসে জামাইবাবুর হো-হো হাসি, আর বড়দির সেই ওকে—মাত্র সেদিন থেকেই হারীত ও হয়েছে তার কাছে জোর করে খাওয়ানো। মজার দেখাচ্ছিল ওকে, কত অন্যরকম ছিল তখন। শাশ্বতী নিশ্বাস ফেলল—বড়দির জন্য না, নিজের জন্যই নিশ্বাস ফেলল এবার। মনে পড়ে তোর—যেন অন্য কিছু বলতে বলতে সামলে নিল সে—মনে পড়ে সেই সবাই মিলে থিয়েটরে যাওয়া?
পড়ে না? সবই মনে পড়ে। বড়দি এলেন, এসেই ধরে ধরে সকলকে খাওয়াতে লাগলেন ক্ষীরনারকোলের মিষ্টি, তারপর রান্নাঘরে বসে সেই আলুসেদ্ধ আলুসেদ্ধর ধোঁয়া-ওঠা একটা গন্ধ-ও-রকম গন্ধ পৃথিবীর আর কোনো আলুসেদ্ধর হবে না। কিন্তু এ সবই ভাবা হয়ে গেছে মজার বার। শাশ্বতী বলল–জামাইবাবু কী রকম হাসতেন! হ্যাঁ, হাসতেন। আর যাবার সময় ট্যাক্সিতে উঠে অন্যরকম একটু হেসে বলেছিলেন–স্বাতী, তাহলে যাই…আবার কবে…। কিন্তু এসবও হাজার বার ভাবা হয়ে গেছে। যাতে আবারও এসব ভাবতে না হয়, স্বাতী বলল–
চা খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ–হারীত ওঠেনি তখনো নিজেই করে নিলাম এক পেয়ালা শাশ্বতীর কথার বদলে যাওয়া সুর স্বাতীকে প্রায় জানিয়ে দিল যে স্বামী ওঠার আগে স্বাধীনভাবে এ এক পেয়ালা চা বেশ উপভোগ করেছিল সে। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল—সময় হল নাকি?
এখনই? একটু কেঁপে উঠল স্বাতী।
গাড়ি কটায় পৌঁছয়?
আটটা—কত মিনিট যেন—
তাহলে দেরি আছে এখনো, শাশ্বতী তাকাল হাতের ছোট্টো সোনার ঘড়ির দিকে–তার বিয়েতে জামাইবাবুর উপহার।
বাবা স্টেশনে গিয়েছেন?
কী-জানি… বোধহয়–বাবার গতিবিধি সম্বন্ধে এই বোধহয়টা একটু বেখাপ্পা শোনাল শাশ্বতীর কানে। যাই, দেখে আসি। তখনই ফিরে এসে বলল—হ্যাঁ, গিয়েছেন। এবার বেখাপ্পা লাগল স্বাতীর। বাবা কোথাও বেরিয়ে গেলেন তাকে কিছু না বলে, তার সঙ্গে দেখা না করে—এটা তার কাছে নতুন।
বিজু? শাশ্বতী জিগেস করল।
ওঠেনি…বোধহয়।
শাশ্বতীর মনে হল স্বাতী অন্য কথা ভাবছে, যে কথার সঙ্গে বড়দির আজ আসার কোনো যোগ নেই। নিজেই গেল বিজনের ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ। টোকা দিল, বিজু, বিজু বলে ডাক। জবাব পেল না। ফিরে এসে বলল—বিজু এত বেলায় ওঠে? স্বাতী বলল—এমন আর বেলা কী। আমরা আজ ভোরে উঠেছি কিনা, তাই মনে হচ্ছে।
কারণ আছে বলেই উঠেছি, বিজুরও ওঠা উচিত। স্বাতী চুপ।
ওকে ডাকলে হয় না?
তুমি ডাকলে তো শুনলাম।
কিন্তু—ওদের আসবার সময়ও ঘুমিয়ে থাকে যদি বিজু? শাশ্বতীর চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটল–
কী বিশ্রী! কী ভাববেন বড়দিছি! আমার তো মনে হয় ধাক্কাধাক্কি করে ওকে ডেকে তোলাই উচিত— শাশ্বতী ব্যস্ত হল।
দেখো চেষ্টা করে।
তোর ভাবটা যেন তোর কিছুই না?
স্বাতী চুপ।
এখনও তোর রাগ পড়েনি বিজুর উপর?
রাগ ছিল নাকি কোনোদিন? স্বাতী পাতলা হাসল।
শাশ্বতীও হাসল—আমার উপরেও রেগেছিলি খুব।
মজুমদারের ব্যাপারটি চুকে যাবার পর এই প্রথম তার কোনো উল্লেখ হল দু-বোনের মধ্যে। স্বাতী বলল–আমি কি তোমার উপর রাগতে পারি? শাশ্বতী তাকাল স্বাতীর দিকে, ঘরের দিকে। এই ঘরেই সে থাকত, ঘুমোত—স্বাতীর সঙ্গে। একটু আবছা করে বলল—তখন যা ভাল মনে হয়েছিল করেছিলাম, মনে রাখিস না। এর পরে দুজনেই চুপ করে রইল একটুক্ষণ।
আসবার সময় সত্যেনবাবুকে দেখলাম ট্রাম-স্টপেশাশ্বতী কথা বদলাল।
কে সত্যেনবাবু?
সত্যেনবাবু—সত্যেন রায়—তোর আজ হয়েছে কী বল তো? ছোড়দির সঙ্গে একটু একটু কথা বলতে বলতে মনের গভীরে যে মানুষের কথা সারাক্ষণ সে ভাবছিল, তার সম্বন্ধে হঠাৎ ও রকম একটা দৈনন্দিন উল্লেখ শুনে স্বাতী বুঝতেই পারেনি প্রথমটায়। কিন্তু ঠিকই তো, অন্যদের কাছে সে মাত্রই একজন সত্যেনবাবু, যেকোনো একজন সত্যেন রায়। ছোড়দির সাধারণ সুরটা নকল করে বলল–কলেজে যাচ্ছেন বোধহয়।
ছুটি হয়নি এখনো?
এই হবে।
আমি তাকালাম, কিন্তু উনি দেখলেন না–নয়তো কথা বলতাম একটু। একটু পরে শাশ্বতী আবার বলল–বেশ লাগে আমার ওঁকে। স্বাতী লক্ষ্য করেছে সত্যেনাকে আজকাল একটু অন্য চোখে দেখছে ছোড়দি। কবে থেকে যেন ভাবটা স্পষ্ট বদলেছে। এখানে এসে দেখতে পেলে কেমন হাসে, এগিয়ে কথা বলে, একটু বেশিই বলে—অন্তত স্বাতীর তাই মনে হয়। দাদা ছোড়দিকে কিছু বলেছে—এ-ই সে ধরে নিয়েছিল মনে-মনে, যেহেতু তার মনেই হয়নি তাকে আর সত্যেনকে একসঙ্গে দেখতে পাওয়াই সত্যেনকে লক্ষ্য করার যথেষ্ট কারণ আজকাল। ছোড়দির মুখ দেখে বোঝবার চেষ্টা করল দাদার কথা সে কতটা বিশ্বাস করেছে, তারপর তার কাঁধের দিকে তাকিয়ে বলল—সুন্দর ব্লাউজটা। কিন্তু শাশ্বতী আগের কথাতেই ফিরে গেল—একদিন চা খেতে বলব ভাবি বাড়িতে, কিন্তু—যেটা ভাবছিল স্বামীর বিষয়ে সেটা চালিয়ে দিল স্বামীর বন্ধুদের নামে—হারীতের বন্ধুদের সঙ্গে ঠিক-তো মিলবে না সত্যেনবাবুর।
একা এঁকে বললেই পারো।
তা পারি, কিন্তু তোর হারীতদকে তো জানিস, নিজের দলের দু-তিনটি বন্ধু যেখানে নেই, সেখানে তার কিছুই ভাল লাগে না, আবার দু-চারজন না হলে জমেও না ঠিক, আর—আর সত্যেনবাবুর কি ভাল লাগবে তুই না গেলে? স্বাতী হেসে ফেলল, হেসে বলল—বেশ তো, আমাকে যদি বলো আমিও যাবো।
না, তোকে বলব না।
শাশ্বতী হাসল, বাঁকা।
খানিকটা এটা মনের কথা শাশ্বতীর। সম্প্রতি এ বাড়িতে সে যে-কদিন এসেছে-যদিও এক একদিন এক-এক সময়ে তার মধ্যে চার-পাঁচদিনই এদেখেছে স্বাতীকে ঐ প্রোফেসর ভদ্রলোকটির সঙ্গে বসে থাকতে। সে এলে স্বাতীর যেন একটু ইতি-উতি অবস্থা—একবার এঘর একবার ও-ঘর—আবার তিনজনে একসঙ্গে বসতেও উশখুশ। এ থেকে যা ভেবে নেবার তা অবশ্য ভেবেইছিল শাশ্বতী, যদিও মজুমদারের ব্যাপারটা তখন তার মনে তেতো হয়ে লেগেছিল বলে কাউকে কিছু বলেনি এ পর্যন্ত—বাবাকে না, স্বামীকেও না। মনে মনেই পুষছিল কথাটা, ভালই লাগছিল। মনে পড়ছিল নিজের নিজেদের কথা। আহা, এই একটা সময় জীবনের! তার ইচ্ছে করে সত্যেনের সঙ্গে একা একা কথা বলতে, টিপে টিপে তার মনের কথা বের করতে—কিন্তু তার স্বামীটি যে সে রকম না, এ রকমের মেলামেশা ভালোবাসে, আরো কম বাসে খরচ করতে। মজুমদার মানুষটা কিন্তু মন্দ ছিল না, যদি আসা-যাওয়াটা রাখত অন্তত—যাঃ, ওর পরে তা আর হয় নাকি সত্যি, স্বাতীকে বিয়ে করতে চেয়েই সব মাটি করে দিল মজুমদার। তখনকার মতো শাশ্বতী ভুলে গেল যে মজুমদারের এই ইচ্ছায় সে-ই যোগান দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি, আর এ-কথাও তার মনে হল না যে ঐ মানুষটাকে সে ভাবছে শুধু নিজের ইচ্ছা মেটাবার একটা উপায় হিসেবে, এই অসম্ভব আশা করছে তার কাছে যে যে-মেয়েকে সে চেয়েছিল কিন্তু পেল না, তাকেই ফুর্তিসে এগিয়ে দেবে অন্য একজনের দিকে। অনেক অসংলগ্ন, অনুচিত, পরস্পরবিরোধী ভাবনা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শাশ্বতীর মনের উপর দিয়ে ভেসে গেল। তিন বছরের চেষ্টাতেও স্বামীর দলটির মধ্যে মিশিয়ে দিতে পারল না নিজেকে, এখন চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছে। বাপের বাড়িতে বাবা বুড়ো হচ্ছেন, আর স্বাতীটা একটু অন্যরকম মানুষ তো, আর বিয়ে হয়নি বলে অসুবিধেও অনেক-শাশ্বতীর অসুবিধে। আনন্দের জায়গা বলতে এখন তার শ্বশুরবাড়িটাই। জা-দেওর-ননদ-নন্দাইতে বেশ ঝমঝমে এক-এক সময়, কিন্তু চালচলন তাদের সাবেকি। বাইরের জগতে মেয়েদের আনাগোনা এখনো পাড়ার দোকানে শাড়ি-জামা কেনা আর বাংলা ফিল্ম একটিও বাদ না-দেয়াতেই আবদ্ধ। ওখানে তার ভালো লাগে, কিন্তু হারীত যে ও-বাড়ি ছেড়েছে তাতেও সে মনে মনে খুশি। ঠিক তার মনের মতো একটা মেলামেশার জগৎ, যার স্বাদ ঐ অল্প কদিনের জন্য মজুমদার তাকে দিয়েছিল, এখন খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। সত্যেনকে দেখে, সত্যেনের সঙ্গে স্বাতীকে দেখে আবার নতুন করে আশা হল।
শাশ্বতীর এই একটা চুপ করে থাকার সুযোগ নিল স্বাতী—দাদাকে ডেকে দেখবে নাকি আরেকবার? এবার তার চেষ্টায় কাজ হল, মনের বাক্সে ডালা এঁটে শাশ্বতী তখনই উঠল— হ্যাঁ, দেখি। যেন একটা মস্ত কাজ নিয়ে যাচ্ছে, যে কাজ আর কেউ পারবে না, এমনি চেহারা করে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল মুখ লাল করে মিনিট দুই পরে–নাঃ! কত ডাকলাম, ধাক্কালাম–পাত্তাই নেই! শেষ পর্যন্ত উঃ আঃ আওয়াজও শুনলাম দু-একবার, একটু দাঁড়ালাম, কিন্তু আবার চুপ! সত্যি! ছোটোদের অবাধ্যতায় গুরুজনের মুখ যেমন গম্ভীর হয় তেমনি হল শাশ্বতীর। স্বাতী বসে বসে ওসব ডাকাডাকি শুনেছিল, তার ফলও বুঝেছিল, তাই কিছু বলল না। অত ঘুমোতে পারে নাকি কোনো মানুষ! ঘুম কি আর না ভেঙ্গেছে এতক্ষণে ইচ্ছে করে শুয়ে আছে, ইচ্ছে করে জবাব দিল না পাছে কিছু করতে হয়। তুই ঠিকই বলিস স্বাতী, বিজুটা মানুষ না।
ও-কথা আমি কবে বলেছি? স্বাতীর আপত্তি শাশ্বতী গ্রাহ্য করল না, আবার বলল—এত সড়ো একটা কাণ্ড ঘটে গেল—একটু বিকার নেই ওর মনে? দাদা যে এটাকে চুপচাপ মেনে নিয়েছে, তাতেই বরং স্বাতী স্বস্তি পেয়েছিল—যা ওর রোলারুলি স্বভাব! তাই বলল—কী আর করবে। পুরুষমানুষ—
আরে রাখ ও-সব! মনে লাগলে কেউ আবার চাপতে পারে। বিজুটা মানুষ না, ওর আত্মা নেই। কী রকম স্বার্থপরের মত থাকে দেখিস না-খায়, ঘুমোয়, তা ছাড়া আর সম্পর্ক নেই। বাড়ির সঙ্গে! বলতে বলতে শাশ্বতী বড্ডো রেগে গেল ভাইয়ের উপর, হঠাৎ তার মনে হল স্বাতীকে বিয়ে করতে চাওয়ার দুর্বুদ্ধি বিজুই দিয়েছিল মজুমদারকে।ও কি জানেও না বড়দি আসবেন?
জানে—স্বাতী সংক্ষেপে উত্তর দিল।
জানে তো জেগে-জেগে শুয়ে আছে কেমন করে—আর এত ডাকলাম। ভদ্রতা বলেও তো আছে একটা! স্বাতী বলল—সত্যি ঘুমোচ্ছে হয়তো।
কীসের! কোনো হাঙ্গামার মধ্যে থাকবে না, এই আর কী। শাশ্বতী থামল, দম নিল। তা এদিকে সব ঠিকঠাক তো?
ঠিকঠাকের আর কী!
বাঃ, এত লোক আসবে, তার একটা ব্যবস্থা আছে না! চল দেখে আসি। আবার কেজো ধরনে শাশ্বতী উঠল, ছোট্টো বাড়িটি ঘুরে এল রান্নাঘর পর্যন্ত। রান্নাঘরে হরি দুধ ফুটিয়ে রেখে, চাবাসন সাজিয়ে, এখন সিঙাড়ায় পুর ভরছে বসে বসে—আসামাত্র ভেজে দেবে গরম-গরম; আর বারান্দায় বসে রামের-মা আনারস কাটছে, টুকরোগুলো বঁটি থেকেই পড়ছে সাদা পাথরের থালায়, আর তার বাঁ দিকে একটি ঝুড়িতে পেঁপে, আপেল, কমলালেবু কত কী! কাজ খুঁজে না পেয়ে শাশ্বতী আবার ঘরের দিকেই ফিরল, চলতে চলতে বলল কেমন লাগে রে তোর ভাবতে?
কী ভাবতে?
যে বড়দি আর—তার খাওয়া-পরা কিছুই তো আর আমাদের মতো থাকল না!
বাজে নিয়ম সব!
আজকাল অনেকেই তো মানে না ওসব। কিন্তু বড়দি বোধহয়–। ভাবতেই পারি না রে। ঐ সাদা কাপড়! শাশ্বতী থামল, নিশ্বাস ছাড়ল—কী রূপ বড়দির, আর কী-বা বয়স! বড়দির সম্বন্ধে এই অত্যন্ত সংগত, স্বাভাবিক সহানুভূতির কথা শুনে হঠাৎ জামাইবাবুর জন্য ভীষণ একটা কষ্ট হল স্বাতীর। ছোড়দি যেন জামাইবাবুকে প্রায় দোষ দিচ্ছে মরে যাওয়ার জন্য। সর্বনাশ হল বড়দির, কিন্তু সে তো শুধু মুখের কথা—কথার কথা; সত্যি সর্বনাশ হল অন্যজনেরই যে মরল তারই সর্বস্ব গেল। স্বাতীর একটা ঝাপসা ধারণা হল যে শোকার্তের জন্য আমাদের যে সহানুভূতি জাগে, তাও মৃত মানুষটিকে ভুলে যাই বলেই, মৃত্যুকে ভুলে থাকি বলেই। মৃত্যু এত করেও পারল না মানুষকে দিয়ে তাকে মনে রাখাতে। দু-বোন এল বাবার ঘরে। সেখানে বাবার বড়ো খাটে আর শাশ্বতীর পুরোনো দিনের ছোটো খাটে পরিষ্কার বিছানা তৈরি, বড়োটা সুজনিতে আর ছোটোটা চিকনপাটিতে ঢাকা, সব ঠিক আছে। বাবা কিছু ভোলেন না, সময়মত সব করেন, করান, কারো জন্য ফেলে রাখেন না কিছু। রাখলে এখনকার মতো ভালো হত, কেননা ঘড়ির কাঁটা আটটার দিকে যত এগোল, ততই কমে এল দু-বোনের কথাবার্তা, আর কেমন একটা ছটফটানি শুরু হল দুজনেরই ভিতরে ভিতরে। একবার এখানে, একবার ওখানে একটু একটু করে বসে শেষ পর্যন্ত বাইরের ঘরে এল তারা। সেখানে চেয়ারগুলি তেমনি একদিক ঘেঁষে ঘেঁষে আছে, অন্য দিকে ডালিমের বিছানা তেমনি সুজনি-ঢাকা, টেবিলে বইপত্র গুছোননা। তার গোল টাইমপিসটিতেও রোজ দম দিতে ভোলেনি স্বাতী।
একটু দূরে দূরে বসল দু-বোন। শাশ্বতী বসেই বলল–দরজাটা খুলে দে, স্বাতী। স্বাতী উঠে গিয়ে রাস্তার দিকের দরজা খুলে দিয়ে আবার বসল। একটু পরে শাশ্বতী বলল—পরদাটা সরে গেল যে। টেনে দে। আচ্ছা, তুই থাকশাশ্বতী নিজেই উঠল, পরদা টেনে দিয়ে বসল অন্য একটা চেয়ারে। একটু পরে বলল–গরম—না? স্বাতী উঠে পাখা খুলে দিয়ে আবার বসল অন্য একটা চেয়ারে। একটু পরে শাশ্বতী বলল—কী জোর হাওয়া… একটু কমিয়ে–নিজেই উঠে পাখা কমিয়ে আবার বসল প্রথম যেটায় বসেছিল সেই চেয়ারে। বসেই চোখ পড়ল ডালিমের টাইমপিসটায়।-আটটা কুড়ি! শাশ্বতী যেন আঁৎকে উঠল। কুড়ি! স্বাতীরও গলা কেঁপে গেল, যেন আটটা বেজে কুড়ি মিনিট হওয়া আর কখনো সে শোনেনি।
পর-পর খানিকক্ষণ দুজনেই চেষ্টা করল গোলমুখো টেবিল-ঘড়িটার দিকে না তাকাতে, আর দু-জনেরই চোখ ঐ সাদা-কালো গোল মুখের উপরেই পড়তে লাগল বার-বার।
শাশ্বতী বলল-গাড়ি ঠিক কটায়?
ঠিক জানি না।
টাইমটেবল নেই? স্বাতী মাথা নাড়ল।
খবরকাগজ?
দেখছি। স্বাতী উঠল, খবরকাগজটা খুঁজে পেল খাবার টেবিলেই, নিয়ে এসে ছোড়দির হাতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসল। তাড়াতাড়ি, ব্যস্ত হাতে, যেন এর উপর জীবনমরণ নির্ভর করছে, শাশ্বতী কাগজ ওল্টাতে লাগল।–কই রে?… কোথায়?… কী-কাগজ এটা?… এই-যে, পেয়েছি। নাম কী গাড়ির?–তা তো জানি না।
তাও জানিস না? শাশ্বতী প্রায় খেঁকিয়ে উঠল। ঢাকা মেল-না, ঢাকা মেল কী করে হবে— মৈমনসিং থেকে তো-মৈমনসিং থেকে কোন গাড়িতে পৌঁছয় জানিস না? স্বাতী উত্তর দিল না।–কী মুশকিল! কাগজটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল শাশ্বতী। স্বাতী নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে একটা পাতা তুলে নিল, হাঁটুর উপর ছড়িয়ে চোখ নামিয়ে রাখল সেখানে।
শাশ্বতীও নিচু হল আর একটা পাতা তুলে নিল, কিন্তু সেটা চোখের সামনে না ধরে হাতের মধ্যে গোল করে পাকাতে লাগল আর খুলতে লাগল, আর কয়েকবার এ রকম করার পর হঠাৎ তার হাত থেমে গেল, একটু শান্তভাবে বলল—আমার মনে হচ্ছে ঠিক সময় হয়েছে এতক্ষণে।
নাকি? স্বাতী কাঁপল, তাকাল, উঠল–সঙ্গে সঙ্গে শাশ্বতীও উঠল। শাশ্বতী দেখল স্বাতীর মুখ ফ্যাকাশে, ঠোঁট শুকনো। স্বাতী দেখল শাশ্বতীর মুখ সাদা, ঠোঁট ফ্যাকাশে। তারপর কোনো কথা বলে দুজনেই বসে পড়ল আবার—শাশ্বতী যেটায় বসে ছিল স্বাতী বসল সেটায়, আর স্বাতী যেটায় বসে ছিল সেটাতে বসতে গিয়েও ফিরল শাশ্বতী, স্বাতীর ঠিক পাশের চেয়ারটায় বসল। কথা বলার চেষ্টাই আর করল না তারা। দুজনে বসে থাকল পাশাপাশি—দুজনেই তাকিয়ে থাকল সামনের দিকে… দরজার দিকে, পরদার ফাঁকে রাস্তার দিকে। দুজনেই শুকনো সাদা ফ্যাকাশে, আর দুজনেই ভিতরে ভিতরে কাঁপছে। পাশাপাশি, কাছাকাছি, প্রায় হাতে হাত ছুইয়ে, অথচ কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে, আর একটুও না নড়ে, এমন করে তারা বসে থাকল যে রাস্তা থেকে কারো চোখে পড়লে তার মনে হত যে বিশেষ কোনো মনোহর ভঙ্গিতে ছবি তোলাতে বসেছে দুই তরুণী। কিন্তু মেরুনরঙের ট্যাক্সিটা যখন ঝিলিক দিল জানলায়, দুজনে শান্ত উঠল, আস্তে হাঁটল—যদিও কেউ কারো দিকে তাকাল না– কয়েক পা মেঝে পার হয়ে পরদা ঠেলে বেরোল, দাঁড়াল বাইরের সিঁড়িতে, পাশাপাশি, কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে। প্রথমে লাফিয়ে নামল আতা-তাতা দুই বোন–কত বড়ো হয়ে গেছে!–তারপর ছোটন, কী কষে এঁটেছে হাফপ্যান্টের বেল্টটা!—–তারপর গান্ধিটুপি এঁটে লম্বা, গম্ভীর, দায়িত্বপূর্ণ ডালিম টুপি কেন? বাঃ, ন্যাড়া হয়েছিল না? আর ভাতে-ভাত খেয়ে মোটাও হয়েছে!—সেবারে তাকে আনা হয়নি, আর এবারে সে-ই নিয়ে এসেছে সকলকে—আর একটা ট্যাক্সিতেই সকলকে ধরে গেছে এবার। বাবা নামলেন বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে—এমন আর বাচ্চা কী এখন, আর কী রকম হাসছে সাদা সাদা দাঁত দেখিয়ে—কী মিষ্টি! অন্য সব কথা ভুলে গেল স্বাতী, সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামল, বাবার কোল থেকে নিজের কোলে নিল, বুকে চেপে ধরল, গালে চুমু খেল। আর এই নতুন মানুষটির মুখের দিকে একবার মাত্র চোখ ফেলেই সরু, ছোটো, কিন্তু বেশ জোরালো গলায় হঠাৎ কেঁদে উঠল বাচ্চাটি।
ছি-ছি, মাসির কোলে গিয়ে নাকি কাঁদে! মাসি–ছোটোমাসি— স্বাতী গলা শুনে চোখ ফেরাল। সাদা সাদা কাপড়-সাদা সিঁথি—কিন্তু বড়দি…! চোখে দেখার প্রথম মুহূর্তটিকে আবছা লাগল স্বাতীর। ওকে দে আমার কাছে—বলে শ্বেতা সুখী, দুঃখী, হাসি-হাসি, ছলছলে, ছলোছলো চোখে স্বাতীর দিকে একটুখানি তাকিয়ে একটুখানি আদর করল তার গালে। স্বাতী কেঁপে উঠল, চোখ নামাল, কয়েক ফোঁটা চোখের জল দৌড়ে নামল পর পর তার গাল বেয়ে। বাচ্চাকে নিয়ে সিঁড়ি উঠে শ্বেতা বলল—কী, শাশ্বতী? বিজু কই? বিজু–শাশ্বতী একটা মিথ্যে বানাবার চেষ্টা করল, কিন্তু দরকার হল না। ঠিক যখন শ্বেতা বাড়িতে ঢুকছে, সেই মুহূর্তটিতে ভিতর থেকে ছুটে এল বিজু, এইমাত্র ঘুমভাঙা, এলোমলো চুল, কাপড়টা লুঙ্গির মতো করে কোনোরকমে জড়ানো, গায়ে একটা বোম খোলা, বুকের চুল দেখানো ডোকাটা রঙিন বিলেতি রাতজামা। বড়দিকে দেখেই একটু থমকে দাঁড়াল সে, আর সঙ্গে-সঙ্গে তার মুখের বিশ্রী, বদ, বাঁকাচোরা একটা চেহারা হল, হঠাৎ ঘোড়ার মতো লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো বাচ্চাসুদ্ধ বড়দিকে… হাউহাউ করে লুটিয়ে কেঁদে পড়ল–ও-ও বড়দি! ও-ও জামাইবাবু! জামাইবাবু-উ!
বিজুর ধাক্কায় বাচ্চাটি প্রায় পড়ে যাচ্ছিল কোল থেকে, শ্বেতা কোনোরকমে সামলে নিল, চেষ্টা করে সরে দাঁড়াল আর বিজু যেন আশ্রয় হারিয়ে এলিয়ে পড়ে গেল তোর পায়ের কাছে মেঝেতে। ওঠার চেষ্টা করল না, মুখ ঢাকল না, কান্নার বেগে অবিশ্বাস্য সব ভঙ্গি হতে লাগল তার মুখের, আর ভাঙা, চড়া, সাংঘাতিক আওয়াজে এক একটা খাবি-খাওয়া কথা বেরোতে লাগল তার গলা দিয়ে-জামাইবাবুর মত…আর কে! কে আমাকে টাকা দিয়েছিল…কার টাকা নিয়ে আমি আজ…ও…ও জামাইবাবু… ওঃ, হো-হোঃ! দু-হাঁটু উঁচু করে, দুহাত পিছনে ছড়িয়ে, দুহাতে মেঝে আঁকড়ে, রঙিন-ডোরাকাটা বোতাম-খোলা জামার ফাঁকে বুকের কালো-কালো চুল দেখিয়ে-বসে-বসে বিকটভাবে কাঁদতে লাগল বিজন। ট্যাক্সি বিদেয় হয়নি তখনো, প্রকাণ্ড শিখ ট্যাক্সিওলা দাড়িগোঁফের ঝোঁপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাজেনবাবুও রাস্তায়,হরি মাল তুলতে তুলতে থেমে গেছে, স্বাতী আর ডালিম উঠতে-উঠতে থমকে গেছে সিঁড়িতে, রাস্তাতেও দাঁড়িয়ে গেছে দু-একজন। দরজাটা হাঁ-করা, পরদাটা সরানো, সকলেই দেখছে, শুনছে, আশেপাশের বাড়ি-কটিতেও পৌঁছচ্ছে বিজ্ঞানের এই আন্তরিক, অকৃত্রিম, মর্মস্পর্শী শোকোচ্ছাস। ঘরে শাশ্বতী দাঁড়িয়ে থাক্ল অবাক, আত-তাতা, ছোটন গোল-গোল চোখে তাকিয়ে থাকল অবাক, শ্বেতা চেষ্টা করল এক হাতে ভাইকে আরেক হাতে বাচ্চাকে সামলাতে। আর বাইরে ডালিম ঘনঘন তাকাতে লাগল ছোটোমাসির দিকে, কিন্তু ছোটোমাসি মুখ তুললেন না, নড়লেনও না, আর সেও তাই আর কিছু ভেবে না পেয়ে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে থাকল রাস্তার দিকে পিছন দিয়ে, আর দুজনের মাঝখানে সাবধানে পথ করে শেষ মালটা ঘরে তুলল হরি। রাজেনবাবু ভাড়া মেটালেন, গাড়ির ভিতরটা দেখলেন, আর ট্যাক্সির সঙ্গে-সঙ্গে প্রকাণ্ড শিখ চলে যেতেই গলিটা হাঁফ ছাড়ল। রাজেনবাবু ঘরে গেলেন না, সিঁড়িতে উঠলেন না, বিজুকে চোখে দেখেও দেখলেন, কানে শুনেও শুনলেন না। বিজুর কথা কিছুই ভাবছিলেন না তিনি, আর কিছুই ভাবছিলেন। ঘুম ভেঙে প্রথম যে-কথা আজ মনে পড়েছে, আর তার পরেও বার-বার, সে কথাই ভাবছিলেন আবার। বেলেঘাটার গরিব বাড়িতে সেই আঁতুড়ঘর, দরজায় দাঁড়িয়ে সেই প্রথম দেখা, দাইয়ের কোলে এইটুকু একটা ছোট্টো লাল শরীর আর খাটের উপর এলানো চুল, চোখবোজা সাদা মুখ, লেপের বাইরে সাদা একটি হাত। সেই সাদা দেখে শ্বেতা কথাটা মনে এল… সেই শ্বেতা।