বর্ষার কী জাঁকজমক সেবার! যেন উড়িয়ে নেবে, যেন ভাসিয়ে দেবে। আরো কত বর্ষা তো কেটেছে স্বাতীর, আগে কখনো এমন দ্যাখেনি। সে যেন চোখে দেখতে পেল ঘাসের ঘন হওয়া, গাছপালার বেড়ে ওঠা, মাটির সুখ, শিকড়ের খুশি। লম্বা, মেঘলা-একলা দুপুর, রঙের আহ্লাদে গলে-যাওয়া বিকেল, আর রিমঝিম রাত্রি। আর মাঝে মাঝে মেঘ-ছেঁড়া ভিজে-ভিজে জোছনা। এত ভাল লাগে, ভাল লাগে বলেই একা লাগে, আবার মানুষের সঙ্গও বেশি ভাল লাগে না। এইরকম একটা আবছায়ার মধ্যে তার যেন দম আটকে এল। কলেজটা খুললে বাঁচে।
সেদিন সকালে শহর স্নান করে সেজে-গুজে ফিটফাট, যেন সে জানে আজ স্বাতীর কলেজ খুলবে। বই হাতে নিয়ে হালকা পায়ে বেরোল বাড়ি থেকে। সবুজ পৃথিবী, ঝকঝকে রোদুর, তার শরীরে সুখ আর ধরে না। রাস্তায় যদি লোক না থাকত ঘুরপাক খেয়ে নেচে নিত একবার। ট্রামে মেয়েদের সিট ছেড়ে দিয়ে সে বসল একেবারে সামনে এগিয়ে। কী হাওয়া, আর কী সুন্দর সাদার্ন এভিনিউর মোড় পর্যন্ত রাস্তাটি! কত গাছ, কত ঘাস, আর গাছের তলা দিয়ে ছাইরঙের ট্রামগুলি জলের হাঁসের মতো বেঁকে যায়। মিনিটে-মিনিটে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ দ্যাখে লো, কেউ কি দ্যাখে? ভাল লাগার জন্য কোথায়-না ছুটোছুটি করে মানুষ—সিনেমা, থিয়েটর, খেলার মাঠ। যে-কোনো জায়গায় যে-কোনো রকম একটা মেলা-টেলা কিছু হলে মেয়ে-পুরুষে থইথই, দোকানে-দোকানে ভিড় ধরে না, রেলগাড়ি চড়ে দূর-দূর দেশে চলে যায়। এদিকে কত ভাললাগা যে ছড়িয়ে আছে চোখের সামনে! নাম নেই, দাম নেই, টিকিট নেই, এত বড় শহরে আর কেউ তা জানে না? ভাল লাগার জন্য কোথাও যেতে হয় নাকি, কিছু করতে হয় নাকি! এমনি-এমনিই তো ভাল লাগার শেষ নেই, ভাল না লেগে উপায় আছে মানুষের?
প্রথম ঘণ্টায় অনাদিবাবুর ক্লাশ। অনাদিবাবুকে বেশ তো ভাল দেখাচ্ছে আজ। চশমাটা বদলেছেন? না, একরকমই তো, দেখতেই ভাল উনি! কী আশ্চর্য! আশ্চর্য কেন, অনাদিবাবুকে দেখতে ভাল হতে নেই? আর তার পড়ানোই বা এমন মন্দ কী? স্বাতী চোখের সামনে বই খুলল, কিন্তু অনাদিবাবু নাম ডাকা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে স্বভাবত সুগম্ভীর মুখে আরো গাম্ভীর্য এনে বললেন তোমাদের ক্লাশের উনিশ রোল নম্বর মেয়ে, মায়া সান্যাল, ছুটির মধ্যে মারা গেছে—
অ্যাঁ! অর্ধস্ফুট উচ্চারণে চঞ্চল হয়ে উঠল দশ-বারোটি মেয়ে, মায়া সান্যালের বন্ধুরা। আর অন্যেরা তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে।
—তার স্মৃতির সম্মানরক্ষার্থে আজ তোমাদের ক্লাশ হবে না। তোমরা বাড়ি যেতে পার।–কথা শেষ করেই অনাদিবাবু চলে গেলেন।
হাউ শকিং!
কী হয়েছিল?
কবে মরল?
তুই কিছু জানিস, অলকা? তোর বাড়ির কাছেই তো—
মাসখানেক আগেও দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে। তারপর মামাবাড়ি গেলুম—অন্যদের চেয়ে চড়া গলায় ইভা বলে উঠল–একটা কনভোলেন্স মিটিং করা উচিত আমাদের।
নিশ্চয়ই! অলকার সোৎসাহ সমর্থন।
কবে করবি?—সুপ্রীতির প্রশ্ন।
আজই! এখনই!–ইভা টগবগ করে উঠল।–একটা রেজলিউশন পাস করে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব আজই।
কিন্তু অনেকে যে চলে যাচ্ছে—
ইভা লাফিয়ে উঠল প্রোফেসরের তক্তায়। আঙুলের গাঁট দিয়ে টেবিল ঠুকে বক্তৃতার ঢঙে বলল—বন্ধুগণ, আপনারা যাবেন না। মায়া সান্যালের জন্য কনডোলেন্স মিটিং করব আমরা। আপনারা যাবেন না, আপনারা বসুন। স্থির হয়ে বসুন। তবু চলে গেল কেউ-কেউ। অনেকে যেতে-যেতে বসে পড়ল। ইভা তাকিয়ে বলল—আচ্ছা, এতেই হবে। একজন আপত্তি তুলল–সভাপতি কোথায়?
লাগবে না—দ্রুত উত্তর দেয় ইভা। এটা আমাদের নিজেদের সভা, ছাত্রীদের সভা। আর এযুগে সভাপতি একটা অ্যানাক্ৰনিজম। নতুন শেখা ইংরিজি কথাটা ঠিক জায়গায় বসাতে পেরে ইভা বেশ খুশি হল মনে-মনে…একটা মেয়েও মানে জানে না নিশ্চয়ই আপনারা কেউ কিছু বলুন, আমি রেজলিউশন ড্রাফট করি— ইভা গম্ভীরভাবে বসে পড়ল প্রোফেসরের চেয়ারে। এতই যদি সভাপতির শখ, তাকেই মনে করুক না। একটু ঠেলাঠেলির পর অলকা উঠে কিছু বলল, তারপর সুপ্রীতি, তারপর আরো দুটি মেয়ে। বলতে গিয়ে তারা ঠেকে গেল, ভুল করল, হেসে ফেলল। অন্যেরাও হাসল। মোটেও শোকসভার মতো লাগল না তখন। তারপর ইভা উঠে রেজলিউশন পড়ল, সবাই মিলে দাঁড়িয়ে গ্রহণ করল সেটি। আর সবশেষে ইভা বক্তৃতা করল জমকালো ভাষায় অনর্গল বেগে। মেয়েরা অবাক হল শুনে আর স্বাতীর মনে হতে লাগল যে মায়া মরেছে ইভাকে এই বক্তৃতার সুযোগটা দেবার জন্যই।
তার সামনের বেঞ্চিতে মায়া যেখানে বসত, সেখানে মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছিল স্বাতী। সেই মানে জানতে চাওয়া মোটাসোটা মায়া। মরে গেল! মরে যাওয়া এতই সোজা? যে-কোনো মানুষ যে-কোনো দিন মরতে পারে?…আমিও? ভাগ্যিস কথাটা লাফিয়ে উঠল স্বাতীর মনে, ভাগ্যিস আমি মরিনি! পৃথিবীর কোটি-কোটি মানুষের মধ্যে আমি না থাকলে কী হত? কিছু না, যদি আমি না-ই জন্মাতাম—তাতেই বা কী হত? কিছু না। এই-তো মায়া সান্যাল হঠাৎ হ্যাঁ থেকে না হয়ে গেল—কী হল তাতে? মা মরে গেলেন, তবু-তো আমরা বেঁচে-বর্তে আছি ভাল? হ্যাঁ, ভালই তো আছি। হঠাৎ হাতুড়ির বাড়ি পড়ল হৃদপিণ্ডে—মার জন্য যে তার আর কষ্ট হয় না, সেই কষ্টে যেন বুক ফেটে গেল। তবে কি কারো জন্যই কিছু এসে যায় না কোথাও? পৃথিবীকে না হলে এক মুহূর্ত চলে না আমার, কিন্তু আমাকে না হলে পৃথিবী তো চলবে চিরকাল। এই যে বৃষ্টি, হাওয়া, রোদুর—এ কি আমার জন্য? এরা কি আমাকে চায়? কোনওরকমে হঠাৎ জন্মে গেছি পৃথিবীতে। জানি না কেমন করে না-মরে আছি। তাই তো সব পাচ্ছিএই রোদ, বৃষ্টি, হাওয়া। মনে হয় আমারই জন্য সব। চায়, আমাকেই চায় ওরা। কিন্তু না-ই যদি চায় তাহলে আমি কেমন করেই বা হলাম! আমি না হয়ে অন্য কেউ তো হতে পারত, আমি হলাম কেন? রাস্তায় বেরিয়ে স্বাতী তাকিয়ে দেখতে লাগল আকাশের দিকে, আলোর দিকে, পাতা-কাঁপা গাছের দিকে। শোনো, তোমরা কি আমার কেউ নও? আকাশের উঠোনে ছুটোছুটি খেলছে বাচ্চা মেঘেরা। বড়ো রাস্তার চকচকে গায়ের উপর দিয়ে লম্বা ছায়া লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে এল। গাছের চুল ধরে ঝকানি দিয়ে হা-হা করে হেসে উঠল হাওয়া। আমাকে তোমরা চিনতে পারো না? উত্তর নেই, উত্তর নেই! মনে-মনে বানিয়ে নিতে হয় উত্তর, বলিয়ে নিতে হয় ওদের দিয়ে যে কথা শুনতে চায় মন।
কী ভাবছিস? পাশে চলতে-চলতে জিজ্ঞেস করল অনুপমা।
না তো!
মায়ার কথা ভাবছিস?
মায়ার কথা? না। মায়ার কথা কেন ভাবব? মায়ার কথা কে ভাবছে আর?
কিছু-না-কিছু তো ভাবছিসই–বলল সুপ্রীতি—তবে বলবি না, এই আর কি!
কেমন দেখাচ্ছে তোকে! রাস্তা পার হয়ে চিত্রা ঘুরে দাঁড়াল স্বাতীর মুখখামুখি হয়েছে কী?
কী আবার হবে।
প্রেমে পড়িসনি তো? হেসে উঠল সুপ্রীতি আর অনুপমা। আর স্বাতী বলল–হাসছিস কেন, প্রেমে পড়া কি হাসির কথা?
তাহলে সত্যি-ই!—কথাটার রেশ টেনে তিনজনে চেঁচিয়ে হেসে উঠল এবার। সত্যি না?–চাপা হাসির আভা স্বাতীর চোখে-মুখে।
বলবি কে?
আমি কি জানি যে বলব?
ফাজলামি–!
চল, ট্রাম—সুপ্রীতি ঠেলল চিত্রাকে। এমন সুখের চর্চাটায় বাধা পড়ল।—চিত্রা সুখী হল না, কিন্তু ট্রাম তো আর দাঁড়াবে না। লেডিজ সিট সব কটি ভরতি। চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রইল অ্যালুমিনিয়মের হাতল ধরে। তাদের যে খুবই খারাপ লাগছিল তা হয়তো নয়, কিন্তু পুরুষদের এখনও এটা খারাপ লাগে। তাই পিছন দিকের লম্বা সিট থেকে একজন, তারপর দুজন, তারপর অনিচ্ছায় মুখ কালো করে আরো দুজন উঠে দাঁড়িয়ে ছাত্রীদের জায়গা করে দিল। এ ওর পিঠ ধরে ঝাকানি সামলে বসে পড়ল তারা। তারপর উদাসভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, যেন এ-ব্যাপারটা তাদের কিছু না। লজ্জাই করে, সত্যি। একটি মেয়ের বসবার জন্য দুজন পুরুষ সর্বদাই উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটি হয়তো লেকে যাচ্ছে হাওয়া খেতে, আর পুরুষরা ফিরছে সারাদিন খেটে-খুটে ক্লান্ত হয়ে। কিন্তু উপায়ই বা কী! স্বাতী কপাল থেকে চুল সরাল–সত্যি-তো আমরা দুর্বল। আর তাছাড়া যতই-না দাপাদাপি করি, আমাদের অসুবিধেও! সমানসমান বলে ঠ্যাচালে কী হবে, আমাদের শরীরই মেরে রেখেছে আমাদের। ঘেঁষাঘেঁষি ভিড়ের মধ্যে বিশ্রী! অথচ আমাদের জন্য অন্যেরা দাড়িয়ে থাকে, সেটাও।
ঐ যে সত্যেন রায় অনুপমা কানে-কানে বলল।
কে?
সত্যেন রায়, প্রোফেসর–মনে আছে, ইভার সঙ্গে ঝগড়া? ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল সত্যেন রায়কে। দাঁড়িয়ে আছেন এক হাতে চামড়ার স্ট্র্যাপ ধরে। আর-এক হাতে, মোটা-মোটা দুখানা বই বেশ কসরৎ করেই সামলাচ্ছেন। নিশ্চয়ই এখানে বসে ছিলেন তিনি? আমাদের জন্যই অন্তত বই দুটো যদি নামিয়ে রাখতে পারতেন। আমার কিছু অসুবিধে নেই, কিন্তু বলি কী করে? তাকিয়ে আছেন সোজা সামনের দিকে। স্বাতী দেখতে পেল ঘাড় বেয়ে চুল নেমেছে, এবার ছাঁটা দরকার। পাঞ্জাবির একটা পকেট ছেড়া-জানেন তো? না, পয়সা-টয়সা পড়ে যায়?-আর দেখল পায়ের চাপে গোড়ালির উপরের সরু হাড়টা ফুলে-ফুলে উঠছে। কথা বলার আশাই নেই। ট্রামের মিনিট দশেক সময় স্বাতীর ভারী অস্বস্তিতে কাটল। সেই বইটার কথা বলতে পারত না এখন। মেয়ে হবার অসুবিধে কত! ছেলে হলে উঠে দাঁড়াতে পারত, কথা বলতে পারত কাছে গিয়ে। আবার কবে দেখা হবে! স্বাতী নামে সকলের আগে। বন্ধুদের কাছে চোখে-চোখে বিদায় নিয়ে উঠেই সে দেখল সত্যেনবাবুও নামছেন সেই স্টপে। কিন্তু তাতে কী, সে রাস্তায় পৌঁছতে-পৌঁছতে ভদ্রলোক হনহন করে রাস্তা পার হতে লেগেছেন আর সে ট্রাম-লাইন পার হবার আগেই ঢুকে পড়েছেন তাদেরই পাশের গলিতে। যেন জানতে পেরে ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু এখানে কোথায়? চেনাশোনা কেউ আছে বুঝি? আসেন নাকি মাঝে-মাঝে? গলির মধ্যে সাদা পাঞ্জাবির মিলিয়ে যাওয়া দেখতে-দেখতে স্বাতীর মনে কেমন একটা আশাও হল।
এর ঠিক দুদিন পরে আবার দেখতে পেল সত্যেন রায়কে। তাদেরই ট্রাম-স্টপে অপেক্ষা করছেন কাঁধে চাদর ঝুলিয়ে, একখানা কাগজ-মলাটের বই এক হাতে উল্টিয়ে চোখের সামনে খুলে। স্বাতী তাকাল, এক পা এগিয়ে এল, আবার পেছোল; চোখ নড়ল না বই থেকে। হুশ করে ট্রাম এসে দাঁড়াল। সত্যেনবাবু উঠতে গিয়ে মহিলা দেখে হাতল ছেড়ে দিলেন। স্বাতীও হাত বাড়িয়ে সরে এল প্রোফেসরকে সম্মান জানিয়ে। ইতিমধ্যে ট্রাম দিল ছেড়ে। সত্যেনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন— এই রোককো! কিন্তু কেজো ট্রাম কথা শুনল না। মজা হল—বেরিয়ে গেল স্বাতীর মুখ দিয়ে। সত্যেনবাবু এক পলক তাকালেন। মুখের ভাবে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে তার দোষেই ট্রামটা ধরা গেল না। কিন্তু ভদ্রমহিলার মুখে এই মন্তব্যটাও তিনি আশা করেননি।
আমাকে…আমাকে চিনতে পারছেন না?
আপনি-প্রোফেসরের চোখ পড়ল স্বাতীর হাতের বইয়ের উপর। থমকে গিয়ে, আপনি তুমি দুটোই এড়িয়ে, অস্পষ্টভাবে বললেন–কলেজে বুঝি?
আপনি আমাকে—স্বাতী কথাটা পাড়তে আর দেরি করল না—আমাকে একখানা বই দিয়েছিলেন অনেকদিন আগে—
নাকি?
মনেই নেই? স্বাতী একটু ব্যথিত হল। বইটা ভুলেছেন, আর সেইসঙ্গে যাকে দিয়েছিলেন
তাকেও? ক্ষীণ স্বরে বলল–কলেজের লাইব্রেরিতে একদিন—
লাইব্রেরির বই? একটু উদ্বিগ্ন প্রশ্ন সত্যেনবাবুর।
না, আপনারই। গোল্ডেন ট্রেজরি—
ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ-সত্যেনবাবুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। —পড়েছ?
চেষ্টা করেও ফেরৎ দিতে পারিনি এতদিন—
কেন, ভাল লাগল না?
স্বাতী বুঝতে না-পেরে চোখ তুলল মুখের দিকে।
সত্যেনবাবু আবার বললেন—এর মধ্যে হয়ে গেল পড়া?
সাত মাস আট মাস হল—
মাত্র সাত-আট মাসেই পড়ে ফেললে!
একটু লজ্জিত, একটু বিব্রত মুখ তুলে স্বাতী তাকাল এবারেও।
কবিতার বই আমি ধার নিই না কখনো–। স্বাতীর চোখের প্রশ্নের উত্তর দিলেন সত্যেনবাবু–দিইও না। ও তুমিই রাখো।
না, না, আমি কেন, আপনি—কী আশ্চর্য—
আশ্চর্য কিছু না—সত্যেনবাবু একটু হাসলেন। অন্য বই পড়ে শেষ করলেই শেষ হল। কবিতা তো আর শেষ হয় না কখনো, নিজের না-থাকলে চলে! স্বাতী অবাক হল কথা শুনে। বাবোবাবো ভাবটা চেষ্টা করে কাটিয়ে উঠে বলল—তাই বলে যে-কোনো লোককে যে-কোনো বই দিয়ে দেবেন?
না! কিন্তু সত্যি যারা ভালবাসে তাদের তো দিতেই হবে।
তাহলে আপনার নিজের বই আর থাকবে না।
সে-ভয় নেই। সে-রকম মানুষ খুব কমই।
আমি কি সেই খুব-কমদের একজন? স্বাতীর মনে প্রশ্ন উঠল। কী করে বুঝলেন? আমাকে তো চেনেনও না। কথাটা বলা যায় কিনা, কী-রকম করে বললে ঠিক হয়, তা ভাবতে-ভাবতে আবার ট্রাম এল। অন্য দিনের মতো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লজ্জা করল স্বাতীর, বসে পড়ল মেয়েদের সিটেই। সত্যেনবাবু যে পিছনের দিকে বসে আছেন একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে না-পেরে এই ট্রামে-যাওয়াটুকু অন্যদিনের মতো উপভোগ করতে পারল না। ঠিক কলেজের সামনেই ট্রাম দাঁড়ায়। নামবার সময় সত্যেনবাবু সরে দাঁড়ালেন স্বাতীর জন্য। তারপর একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতেই ঢুকলেন কলেজে। নানা দিক থেকে মেয়েরা আসছে তখন। কেউ একা, অনেকে ছোটো-ছোটো দলে। গেট পার হয়েই স্বাতী যেন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল তাই তো! কোনো কথাই তো হল না! …কী কথা? ভেবে কোনো কথা পায় না..কত যেন কথা আছে মনে হয়।
আবার দেখা হল একদিন। বৃষ্টির পরে ঝিলমিলিয়ে রোদ উঠেছে সন্ধের একটু আগে। পশ্চিমের মাঠে বেড়িয়ে ফিরছিল স্বাতী। এখন অবশ্য ঠিক মাঠ বলা যায় না আর। বাড়ি উঠছে, রাস্তা হচ্ছে, মোষের গাড়ি পিষে দিয়েছে ঘাস, চওড়া-চওড়া টাক পড়েছে সবুজে। তবু এখন মাঠ। ছেড়ে গলিতে ঢুকলেই মন খারাপ লাগে। কিন্তু আর কদিন পরে সবই তো গলি হয়ে যাবে। মাঠের গা ঘেঁষে পুরোনো একটি দোতলা, পশ্চিম-মুখো, সূর্যাস্তের মুখোমুখি। তারই একতলায় সরু বারান্দায় রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সত্যেন রায় দেখলেন, বেগনি রঙের শাড়ি পরা একটি কালো চুলের মেয়ে যেন হলদে আলোর নদীতে নেয়ে উঠে এল। কাছে আসতেই চিনতে পারলেন। পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ চোখ তুলে থমকে দাঁড়াল স্বাতী। আরে! উনি?—আপনি! কথাটা এমন বেগে তার গলা দিয়ে বেরল যে নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনাল, চোখ নামিয়ে নিল একটু লাল হয়ে।–কেমন? ভালো? প্রোফেসরের কুশল–প্রশ্ন।
আপনি এখানে? এবার খুব মৃদু সুর স্বাতীর। এখানেই থাকি।—তা-ও তো বটে। নয়তো ট্রামে উঠবেন কেন ঐ স্টপ থেকে? কী বোকা আমি! আগেই ভাবা উচিত ছিল, তাহলেই তো এমন অন্যায়রকম অবাক হতাম না। নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে বলল—এ-বাড়িতে অন্য কারা থাকত যেন?
তাঁরা আছেন।
আত্মীয় আপনার?
না, না, আত্মীয় হবে কেন—সত্যেনবাবু হাসলেন। তারা দোতলায় আছেন, আমি একতলাটা ভাড়া নিয়েছি। বেশ জায়গা।
আপনার ভাল লাগে?
এখান থেকে তাকালে কলকাতাই মনে হয় না।–-সত্যেন রায় একবার তাকালেন দুরের আকাশে রঙিন মেঘের দিকে, আর একবার কাছের কালো চুলে হলদে-ফিতে আলোর দিকে। যেন বুঝতে পারলেন না কোনটা দেখবেন। স্বাতী বলল—আগে আরো সুন্দর ছিল। কত গাছ কেটে ফেলেছে!
এখনই-বা কম সুন্দর কী—সত্যেনবাবু বললেন, কালো চুলের আলোর দিকে তাকিয়ে। স্বাতী একটু চুপ করে রইল, তারপর হঠাৎ তার মনে পড়ল, যতীন দাস রোডে তাদের পাশের বাড়িতে নতুন কারা এল একবার। মা রাত্তিরের খাবার পাঠালেন বাড়ি থেকে। কুঁজো ভরতি-ভরতি জল, বাচ্চাদের দুধ, সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে চার-পাঁচবার আনাগোনা বাবার।–আপনার কোনো তাড়াতাড়ি সে খবর নিল—কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? যদি কিছু দরকার হয়— দরকার হলে বলব—সত্যেনবাবু বারান্দা থেকে সিঁড়িতে নামলেন।–খুব কাছে থাকো? ঐ মোড়ে সাদা একতলাটা—স্বাতী আঙুল দিয়ে দেখাল। যদি কখনো–কথা শেষ করল না। তোমাকে আসতে বলতে পারলাম না, আমার বাড়িতে তো আর কেউ নেই–।
কবে আসবেন সব?
আর কেউ নেই। একাই থাকি।
একেবারে একা?
ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটল সত্যেন রায়ের–একেবারে একা।—এই একাই স্বর্গ! কী বিশ্রী ছিল ভবানীপুরের সেই মেসের ভিড়। যেন ট্রাম থেকে নেমে আর-একটা ট্রামে ঢুকলাম। …কপালগুণে হঠাৎ জুটে গেছে এটা। পাড়াটা জাতে নিচু আর বাড়িটা পুরোনো বলে মাত্র আঠারো টাকা ভাড়ায়। আবার তাকিয়ে দেখলেন দূরের দিকে। গোলাপি মেঘ বাদামি হল, আর নিচু-করা মাথাটির উপর ফুলে-ফুলে ওঠা চুল ছাইরঙা ছায়ায় আরো যেন কালো দেখাল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন-নাম কী তোমার?
স্বাতী মিত্র।
স্বাতী মিত্র? স্বাতী?
স্বাতী।
সুন্দর নাম।
সুন্দর! এর পরে মিনিটখানেক সত্যেনবাবু যখন আর-কিছু বললেন না, স্বাতী একটু চোখ তুলে অস্ফুট একটা আচ্ছা-বলে বিদায় নিল নিচু মাথায় অধ্যাপককে অভিবাদন জানিয়ে। বাড়ি এসে বলল-বাবা, আমাদের এক প্রোফেসর এসেছেন এখানে।
কোথায়?
ঐ-যে মাঠের ধারে বাড়িটা—
ও, রেবতীবাবুর বাড়িতে?
পাড়ার সক্কলকে তুমি চেনেনা কেমন করে, বাবা?
রাজেনবাবু হেসে বললেন–দেখাশোনা হলেই চেনাশোনা হয়। তা ভাল হল রেবতীবাবুর, প্রোফেসর ভাড়াটে পেলেন।
ভাল কেন?
ভাল না? প্রোফেসররা খুব শান্ত ভালমানুষ হয় তো।
নাকি?
বিদ্বান কি আর মিছিমিছি হয় রে।
তা তুমি যা-ই বল, তোমার মতো ভালমানুষ হতে বিদ্বানদের ঢের দেরি এখনও।
হয়েছে, হয়েছে। নিজের বাপকে সবাই ভাল বলে!
ঈশ! স্বাতী মাথা ঝাঁকাল।–বললেই হল!
রাজেনবাবু আগের কথায় ফিরে গেলেন-তা, তোর সঙ্গে দেখা হল প্রোফেসরের?
হ্যাঁ, বাবা। একা থাকেন ভদ্রলোক—
একা কেন?
আমি কী জানি!..আর একা কি কেউ থাকে না?
ঐ-তো দ্যাখ! প্রোফেসর না-হলে কি বাড়ি ভাড়া পেতেন?
পেতেন না? স্বাতী অবাক।
জানিস না বুঝি! কলকাতায় এক কোনো পুরুষমানুষকে সহজে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চায় না। স্ত্রী থাকা চাই, কি অদ্ভুত মা, বোন-টোন কিছু।
—কেন? রাজেনবাবু একটু ভেবে জবাব দিলেন—কোনো মেয়ে না-থাকলে বাড়ি তো আর বাড়ি হয় না। কথাটা হঠাৎ ধক করে উঠল স্বাতীর বুকের মধ্যে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। রাজেনবাবু বললেন—মাঝে-মাঝে খোঁজ-খবর নিস তোর প্রোফেসরের।
খোঁজ-খবর আমি আর কী নেব? তুমি যদি একদিন—।
বেশ, নিয়ে চলিস আমাকে।
পাড়ার সকলের সঙ্গে তোমার তো আলাপ থাকাই চাই, না বাবা? স্বাতী হাসল। এর পরের রবিবারের সকালে বাজার নিয়ে এসে রাজেনবাবু যথারীতি গায়ের জামা খুলে একটি পান খেলেন বসে। আর তার পরেই উঠে জামা পরলেন আবার। আবার বেরোচ্ছ? স্বাতীর কথাটা অর্ধেক প্রশ্ন, অর্ধেক প্রতিবাদ।
যাই একটু অনুকুলের বাড়িটা—
রাখো-তো তোমার! স্বাতী গলা চড়াল—রোজ-বোজ দেখতে হবে না অত। ঠিকই আছে, উড়েও যায়নি, চুরিও হয়নি।
আহা, বুঝিস না? দূরে থাকে, যদি কিছু গোলমাল হয়—
হোক গোলমাল, তোমার কী? স্বাতী মাথা ঝাঁকাল। রাগ হয়, সত্যি। এক দূর সম্পর্কের কাকা তার, দিল্লি-শিমলের চাকুরে। ঐ মাঠের একটা প্লটে বাড়ি তুলছেন, আর বাবা সময় পেলেই তার দেখাশোনা করছেন রোদূরে দাঁড়িয়ে। যতীন দাস রোডের বাড়িতে কাকাটি এসেছিলেন একবার। কী খাওয়ার ঘটা সে-কদিন, বাবা পারেন! অথচ একদিন তার একখানা ধুতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, চাকর ভুল করে বাবার কাপড়ের সঙ্গে রেখেছিল। তাই নিয়ে এমন হুলুস্থুল বাধালেন যে মা-র হার্টফেল হবার যোগাড়।
এক্ষুনি আসছি–রাজেনবাবু কাচুমাচু মুখে অনুমতি চাইলেন মেয়ের কাছে।
না, যেতে হবে না কোথাও।
তুইও চল না—
বয়ে গেছে আমার!
ফেরবার পথে তোর প্রোফেসরের বাড়িও একবার যাব না-হয়। স্বাতী একটু ভেবে বলল—
সত্যি যাবে নাকি?
বাঃ, কেমন আছে-টাছে একবার দেধ? স্বাতী হঠাৎ বলল—না বাবা, আমি যাব না।
কেন?
ন্না—স্বাতী চোখ কুঁচকে মাথা নাড়ল।
চল না, একটু বেড়ানোও তো হবে, কেমন সুন্দর সকালবেলাটা। স্বাতী চলে গেল ঘর থেকে।
দু-মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে এসে বলল—তোমার ধুতিটা বদলে নাও, বাবা।
এই রে!
তুমি যে কী! স্বাতী পাট-করা জামা-কাপড় বের করে দিল, মুখের দিকে তাকিয়ে বলল— দাড়িটাও কামিয়ে নিলে পারতে।
থাম তো! দু-দিন-পরা জামার মোলায়েম অন্তরঙ্গতা থেকে টাটকা-জামার কড়কড়ে ভব্যতায় বদলি হয়ে নিয়ে রাজেনবাবু মেয়ের সঙ্গে রাস্তায় নামলেন।
******
ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। রাস্তায় ঘাসের আর বাসি বকুলের একটা আবছা ঠান্ডা মিঠেমিঠে গন্ধ। প্রোফেসরের বাড়ি পার হয়ে মাঠে নামল তারা। স্বাতী একবার মাত্র তাকাল একতলার ঘরটার দিকে। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে বোঝাতে লাগল যে সকলের সব দায় ঘাড়ে করে নেবার এই বদভ্যাস বাবাকে ছাড়তেই হবে। আর কান দিয়ে মেয়ের কথা শুনতে শুনতে মনে-মনে রাজেনবাবু ভাবতে লাগলেন যে অনুকূলের কনট্রাক্টর নিশ্চয়ই তাকে ঠকাচ্ছে। দেখা হলে কথা বলতে হবে। নিশ্চয়ই কনট্রাক্টর আসেইনা মোটে। তার একজন ছোকরা-মতো কর্মচারী ধুতির সঙ্গে শোলা-টুপি পরে সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিল। রাজেনবাবু তাকে থামিয়ে কয়েকটা কথা বললেন। আর স্বাতী দাঁড়িয়ে রইল একটু দূরে অর্ধেক তৈরি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। একটা বাড়ি যতদিন তৈরি হতে থাকে, কী কুচ্ছিৎই দেখায়! ভাবাই যায় না যে এর মধ্যে একদিন মানুষ থাকবে। হাসবে, হাঁটবে, চা খেতে-খেতে গল্প করবে, গল্প করতে করতে ঝগড়া বাধাবে। এখন তাকিয়ে শুধু মনে হয়, দূরেদূরে ছড়ানো এই আট-দশটা ইটের টিপি মাঠের গায়ে বড়ো-বড়ো ফোড়ার মতো লাল হয়ে উঠল। স্বাতীর চোখ গেল দূরে, মাঠের ওপারে সেই পুরোনো বাড়িটিতে চুন-শুরকি ধুলোর মধ্যে রোদুরে দাড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সমস্ত পাড়াটাকেই কেমন শান্ত, ছায়াচ্ছন্ন মনে হল। ফেরবার সময় অর্ধেক মনে হল পথ।
রেবতীবাবুর একতলার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রাজেনবাবু বললেন—প্রোফেসর আছে ততা বাড়িতে? আবার কী-রকম একটা অনিচ্ছায় স্বাতীর শরীর ভারি হয়ে এল। বাবার জামায় টান দিয়ে ফিশফিশ করে বলল–থাক, চলল।
আয়-রাজেনবাবু নিশ্চিন্ত। বারান্দায় উঠে টোকা দিলেন দরজায়। দরজা খুলে দিল চাকর। বাবু আছেন?
বসুন। হলুদের হাত কাপড়ে মুছে সরে দাঁড়াল লোকটি। ঘরের মাঝখানে বেতের টেবিল ঘিরে খানচারেক চেয়ার। বোস—মেয়েকে এ-কথা বলে রাজেনবাবু বেশ ঘরোয়াভাবে বসে পড়লেন। বসুন, বাবুকে বলি—বলে লোকটি দু-কাঁধের একটা বিনীত ভঙ্গি করে নীল-পরদার ওপারে চলে গেল।
আসামাত্রই যে দেখা হল না তাতে স্বাতী যেন একটু স্বস্তি পেল। তাকিয়ে দেখল, একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দুটি শেলফ। একটি বড়ো, আর একটি ছোটো। কিন্তু দুটোই রোগামতো ন্যাড়া-চেহারার, বড়োটায় ইংরেজি বই, আর ছোটোটায় বাংলা। বইগুলি দাঁড়িয়ে, ওয়ে, কাৎ হয়ে, মাথা উলটিয়ে নানা অবস্থায় আছে। হয়তো গোছাবার সময় হয়নি এখনো, না কি বই যারা পড়ে তাদের বই এ রকমই থাকে? দুটি জানালার মাঝখানে ছোটো একটি লেখার টেবিল। নীল-প্যাডের ফাঁকে কুচকুচে কালো কলম গোঁজা—চিঠি!কাকে চিঠি? ও মা, চিঠি লেখার লোকের নাকি অভাব? এখানে একা থাকেন, বাড়ির লোকেদের তো লিখতেই হয়। কিন্তু প্যাডটার বেগুনিমতো নীল রঙটা বড়ো যেন…হঠাৎ কেমন-একটা রাগ চিড়বিড় করে উঠল, মনে হল অনেকক্ষণ বসে আছে এসে, কেন বসে আছে, কী দরকার বসে থাকবার, আর আসবারই-বা দরকার ছিল কী?… বাবা—কিন্তু আর বলা হল না, সত্যেনবাবু ঘরে এলেন। স্বাতী চকিতে দেখল, এইমাত্র স্নান করেছেন ভদ্রলোক, মাথার চুল পরিষ্কার আঁচড়াননা। গায়ে পাতলা-ঢিলে একটা পাঞ্জাবি, আর তিনি কাছে আসতে সূক্ষ্ম একটু সুগন্ধও স্বাতীকে মুহূর্তের জন্য উন্মন করল। বাইরে থেকে মনে হয় ঠিক তা নয়, বাবুগিরি আছে।
ঘরে পা দিয়েই সত্যেনবাবু একটু-যেন থমকে গেলেন অবাক হয়ে। আর তার পরেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললেন—কী আশ্চর্য! তুমি!…আপনি! আমি স্নান করছিলাম, তাই…এতক্ষণ বসেবসে…কী আশ্চর্য। স্বাতী উঠে দাঁড়িয়ে বলল–আমার বাবা।
বুঝেছি। রাজেনবাবুর দিকে তাকাতেই সত্যেন রায়ের ঠোঁটে হাসি ফুটল। রাজেনবাবুও হেসে বললেন–আমার মেয়ে, ধরে নিয়ে এল আমাকে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। মানে, আমারই যাওয়া উচিত ছিল… আপনি কষ্ট করে… তুমি বোস, দাড়িয়েই থাকবে নাকি? কষ্ট করে এই রোদুরে… আর পাখাটাও খুলে দেয়নি, কী কাণ্ড! সত্যেনবাবু ছুটে গেলেন দেয়ালের কোণে। চালিয়ে দিলেন টেবিল-ফ্যানের সুইচ। অতিথিরা দু-জনেই হাওয়া পাচ্ছে কিনা তা দেখবার জন্য তাকালেন, কিন্তু হাওয়া কই? প্লাগটা খুলে আবার লাগালেন, সুইচটা এদিক-ওদিক করলেন অনেকক্ষণ। কিন্তু পাখা চলল না। মুখ তুলে, হাতের উল্টো-পিঠটা কপালে একবার বুলিয়ে আবছা একটু হাসলেন। —এই ভাড়াটে পাখাগুলো—
থাক না—রাজেনবাবু বললেন—পাখার কী দরকার? জানালা দিয়েই হাওয়া আসছে খুব। আপনি বসুন।
কালই দিয়ে গেল এটা-করুণ চোখে পাখাটার দিকে শেষবার তাকিয়ে সত্যেনবাবু বসলেন এসে। রাজেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন-ঘোষ কোম্পানি দিয়েছে বুঝি?
কী করে জানলেন? প্রোফেসর অবাক।
ঐ একটাই তো ইলেকট্রিকের দোকান এ-পাড়ায়। আর সেজন্যই এরকম কথা শেষ না করে রাজেনবাবু বললেন—আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?
অসুবিধে? না, অসুবিধে কী।
ওদিকের ঘরটা বুঝি রেবতীবাবু রেখেছেন?
হ্যাঁ, ওঁর জিনিসপত্র আছে ওটাতে। আমার তো লাগে না, দুটো ঘরই মনে হয় বেশি। রান্নাঘর? রাজেনবাবুর পরের প্রশ্ন। একটু ভেবে সত্যেন রায় জবাব দিলেন-বোধহয় নেই। বোধহয় মানে…নিজেই একটু হেসে তাড়াতাড়ি আবার বললেন—মানে, নেই আর কি। আর রান্নাই বা কী, তার জন্য আবার!
চাকর রাঁধতে পারে?
বেঁধে তো দিচ্ছে। কিন্তু রাঁধতে পারে কিনা, আমি ঠিক বলতে পারব না।
রাজেনবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন এ কথায়। ছাত্রীর দিকে মুখ ফিরিয়ে সত্যেনবাবু বললেন—তুমি যে একেবারে চুপ? বইয়ের শেলফ থেকে চোখ সরিয়ে আনল স্বাতী। বই দেখবে? দ্যাখো না—সত্যেনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে শেলফের কাছে গেলেন-এসো এখানে। স্বাতী আস্তে উঠে প্রোফেসরের পাশে দাঁড়াল। বই কী সুন্দর! কত রকম রঙ, কত রকম বাঁধানন। আর নাম… কত নাম। আর দুটি মাত্র মলাটের মধ্যে কত কাণ্ড। দু-আঙুলে আলগোছে দুএকটি বই একটু ছুঁলো সে।
নেবে? নেবে বই?…বলো, কোনটা তোমার ইচ্ছে?ফিকে-ধূসর শোওয়ানো একটি বইয়ের উপর স্বাতী আস্তে আঙুল রাখল। আর কোনো কারণে নয়, শুধু মলাটের রঙটা আশ্চর্য সুন্দর বলে— চেখভ! খুশি গলায় বলে উঠলেন সত্যেন রায়।
চে–? না-বলা প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে প্রোফেসর আবার উচ্চারণ করলেন—চেখভ। খ-টা খুব কড়া শোনাল আর ভ-টা খুব নরম। আন্তন চেখভ, রুশ। কিন্তু অনুবাদ এত ভাল—আর গল্পগুলি হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করলেন—ইংরিজিতে গল্পের বই কী পড়েছ? স্বাতী মাথা নাড়ল।
কিচ্ছু না?
আবার মাথা নাড়ল স্বাতী। সত্যেন রায় তাকিয়ে দেখলেন তার মেঘ-রঙের চোখ দুটিতে লজ্জার সঙ্গে কৌতূহলের প্রতিযোগিতা, নম্রতার সঙ্গে উৎসাহের লুকোচুরি–কিছু পড়োনি! কত ভাল বই, আর পৃথিবীতে প্রায় সব ভাল বইয়ের চমৎকার অনুবাদ!ইংরেজ রাজত্বের নানা অসুবিধের মধ্যে এই একটা সুবিধেই তো আমরা পেয়েছি। বলতে-বলতে ফিকে ধূসর বইটি, আর বেছে বেছে আরো তিনখানা নামিয়ে দিলেন তার হাতে। বইয়ের, লজ্জার, কৃতজ্ঞতার ভারে স্বাতী যেন নুয়ে পড়ল। অস্ফুটে বলল—একসঙ্গে এতগুলো!
এতগুলো আর কী, বদলে-বদলে তো পড়তে ইচ্ছে করে। প্রথমে ছোটোগল্প দিয়ে অভ্যেস কর, পরে বড়ো উপন্যাস পড়তে পারবে। শেষের কথাটা একেবারেই মাস্টারি। স্বাতী চেষ্টা করল কিছু বলতে। যে-কোনো একটা কথা বলতে চেষ্টা করল, একটা কথাও বলতে পারল না। বাইরে এসে রাজেনবাবু বললেন–তোর খুব লাভ হয়ে গেল রে এসে। যে পাতায় বইয়ের নাম-টাম লেখা থাকে, এক-এক করে সেই পাতাগুলি দেখে নিচ্ছিল স্বাতী। চোখ তুলে বলল—সত্যি! চমৎকার মানুষ।
এর মধ্যেই বুঝে ফেললে!
কী-নরম চেহারা রে! এমন যেন আর দেখিনি।
তোমার সবটাতেই বাড়াবাড়ি! স্বাতীর হাসির শব্দটা যেন কুঁজোর জল ঢালার মতো। আর কী-রকম ছেলেমানুষি করলেন পাখাটা নিয়ে!
সত্যি! ঘটনাটা মনে করে স্বাতী আবার হেসে উঠল।
–পড়াশুনোর মানুষ, এদের দেখবার কেউ না থাকলে চলে? চুরি করে সর্বনাশ করে চাকর।
–তোমার বুঝি ইচ্ছে করছে রোজ এর বাজারটা করে দিতে? রাজেনবাবু মুখ টিপে হাসলেন। একটু পরে স্বাতী বলে উঠল—আচ্ছা বাবা, তুমি কী-রকম?
কী-রকম বল তো?
বেশ বলে দিলে আমি তোমাকে ধরে এনেছি! এমন রাগ হচ্ছিল আমার তখন!
বাঃ, তোরই প্রোফেসর—
আমার তো প্রোফেসর, কিন্তু গরজটা যেন তোমারই!
আহা, আমারও তো ইচ্ছে করে একটা ভাল লোকের সঙ্গে আলাপ করতে! বললেন রাজেনবাবু বাড়ির সিঁড়িতে পা দিয়ে। তুমি নিজে কিনা ভাল, তাই সকলকেই ভাল দ্যাখো, লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে বাবার আগেই বাড়িতে ঢুকে পড়ল স্বাতী।
নিজের ঘরে গিয়ে বই ক-খানা রাখল তার পড়ার টেবিলে। চেয়ারে বসে একখানা তুলে নিল হাতে। কিন্তু খুলতে গিয়েই থেমে গেল। চোখে ঝিলিক দিল নীল খাম…নীল প্যাডের ফাঁকে কালো কলমটি গোঁজা..বই খুললেই বিষাক্ত একটা পোকা লাফিয়ে উঠবে, কামড়ে দেবে। কী-সব ভাবছে সে বোকার মতো! কোথায় শুভ্র, আর কোথায় সত্যেনবাবু! শুভ্র তো একটা বাজে কেন, বাজে নে? শুভ্র যদি বাজে হয় ছোড়দিও তো বাজে!.. আর, কী-ই বা আছে এতে? ক্লাশের মেয়েদের যা-সব গল্প করতে শশানে… না, না.. বিশ্রী, বিশ্রী সব, সব বাজে, পৃথিবীসুষ্ঠু লোক বাজে। কিন্তু সেটা কি সত্যেনবাবুর দোষ?…স্বাতী খানিকক্ষণ বসে রইল শক্ত হয়ে। তারপর আস্তে, আস্তে, খুব মন দিয়ে চারখানা বইয়ের প্রত্যেকটির পাতা উল্টাল। পাতাগুলি খসখস করে বলল-এসো, এসো। কালো-কালো ইংরেজি অক্ষরগুলি গুনগুন করল—শোনো, শোনো। একটু আগে তার যেমনই খারাপ লাগছিল, তেমনি একটা সুখের ঢেউ ছলছল করে উঠল বুকের মধ্যে। আঃ, এ-সব বই কি কখনো তার হাতে আসত সত্যেন রায়ের সঙ্গে দেখা না-হলে?
সন্ধেবেলা সে সেজদির চিঠি পড়ে শোনাচ্ছে বাবাকে, রামের-মা এসে বলল একজন বাবু এসেছেন। বিরক্ত হয়ে স্বাতী জিজ্ঞেস করল–কে?
কে, তা ও জানবে কী করে। আমি দেখে আসছি, বলে রাজেনবাবু উঠে পড়লেন।
পাওনাদার-টার কেউ হবে আর কি! বসে থাক না খানিকক্ষণ।
পাওনাদারদের কী মুশকিল বল তো! ধারে দিতেও হয়, আবার টাকা চাইতে গেলেও লোকে রাগ করে!—যেতে-যেতে হাসলেন রাজেনবাবু। একটু পরেই ফিরে এসে বললেন—তোর প্রোফেসর। শোনামাত্র স্বাতী উঠে দাঁড়াল।
চলে গেছেন।
চলে গেলেন!
কত বললাম বসতে, বসলেন না। টুশনি আছে-টাছে বোধহয়। স্বাতী আবার বসে পড়ে একটু নির্জীব সুরে বলল—কেন এসেছিলেন? কথা না-বলে মুখ টিপে হাসলেন রাজেনবাবু।
এসেছিলেন কেন?
কিছু না এই—একটু-একটু অপরাধী ভাবে রাজেনবাবু বললেন—আমাদের সেই টেবিল-ফ্যানটা ওঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কিনা—
পাঠিয়ে দিয়েছিলে?
আমাদের তো কোনো কাজেই লাগে না ওটা। আর সারাটা দিন গরমে কষ্ট পাবেন ভদ্রলোক ভাল করিনি?
আমি তোমাকে বলেছি না বাবা, আমাকে জিজ্ঞেস না করে কখনো কিছু করবে না!
কেন, এতে দোষ কী?
ভাল করে তো চেনেনও না আমাদের। হঠাৎ এ-রকম, উনি কী মনে করলেন বল তো!
এতে আবার মনে করবার কী? কত তো ভাল-ভাল কথা বলে গেলেন। কথা শুনলে প্রাণ জুড়োয়, সত্যি!
তোমার প্রাণ বড়ো সহজেই জুড়োয়—স্বাতী গম্ভীর হল।
পড় দেখি সরস্বতীর চিঠিখানা আর-একবার—মেয়েকে খুশি করবার চেষ্টা করলেন রাজেনবাবু। স্বাতী পড়ল। কিন্তু সে একরকমের দায়সারা পড়া।…চলে গেলেন! একটু বসতে পারলেন না! আবার কবে—
কিন্তু আর দেখা হল না শিগগির। আর তাতে যেন মনে মনে আরাম পেল স্বাতী। কদিন ধরে এমন হচ্ছে যে রোজই বিকেলের দিকে বৃষ্টি, বেড়াতে যাওয়া আর হয় না। ঘরে বসে বসে সেই ইংরেজি বইগুলি পড়ে, আর মাঝে-মাঝে চোখ তুলে বাইরের দিকে তাকায়। আকাশে নীল-মেঘ কালো, ছাই রঙ ছড়াল…বৃষ্টি ঝমঝম, ঝমঝম। আলো কম, আরো কমে আসে, মরে যায়। আর পড়া যায় না, দেখা যায় না। বই খোলা, বই কোলে বসে থাকে… ভাবে… আবছা… একলা… চুপ।