২.৬ শিলঙে সুন্দর

শিলঙে সুন্দর, কিন্তু কলকাতায় সবচেয়ে বিশ্রী-গরম গ্রীষ্মদিনের একটি। আকাশে নীল নেই। পাতলা…খুব পাতলা একটা ধোঁয়ারং ছড়ানো, হঠাৎ কখনো মেঘের মতো ছায়া-ফেলা, কিন্তু মেঘ নয়। মেঘের উল্টো কেননা বৃষ্টির আশাকেই সে দুরে সরায়, আর হাওয়া বন্ধ করে দিয়ে পৃথিবীর হাঁপ ধরায়। বাইরের দিকে তাকালে রোদ্রটা কড়া লাগে না, বরং মিনমিনেই। প্রথম গ্রীষ্মের মুড়মুড়ে ফিটফাট টাটকা-তাজা তাত—যা মনে হয়, হাতে তুলে বাক্সে ভরা যায় —তার বদলে একটা পিছল, প্যাচালো, নাছোড়, ধূর্ত তাপস্নানের জলে বোয়া যায় না, আবার উড়িয়েও তাকে নিতে পারে না ইলেকট্রিকের হাওয়া। তাকে ফাঁকি দেবার একটি মাত্র উপায় আছে কাজ… এমন কাজ, যা অন্তত মনটাকে আঁকড়ে রাখে। কিন্তু তেমন কাজ স্বাতীর কি আছে? স্নান করেছে সকালেই, বসে আছে তার বেতের চেয়ারটিকে পাখার তলায় টেনে এনে, পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা। কামড়ে-ধরা বই, তবু মন তার সরে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে, মনে হচ্ছে পাখাটায় যেন জোর নেই আজ, মনে হচ্ছে শুধু বই পড়ে আর সময় কাটে কত? বিজন ডাকল ঘরে এসে তার নাম ধরে। স্বাতী তাকাল একবার, চোখে আগ্রহ ফুটল না। এই, মজুমদার এসেছে—ব্যস্ত বিজন মস্ত খবর দিল। স্বাতীর মুখ শক্ত হল একটু, অল্প একটু। ভাইয়ের দিকে না তাকিয়ে বলল—উনি বুঝি দুপুরবেলা ছাড়া কারো বাড়ি আসবার সময় পান না?

দুপুর কী রে? মোটে তত দশটা!

দশটা? এখনো এতগুলি ঘণ্টা পড়ে আছে দিনের? কী লম্বা দিন! বোনের এই চুপ-করাটুকুর সুযোগ নিল বিজন। তাড়াতাড়ি জুড়ল–বিশেষ একটা দরকারেই এসেছে। বিশেষ জোর লাগল বিশেষ কথাটায়।

কিন্তু স্বাতী যেন শুনতেই পেল না, কিংবা শুধু শেষ শব্দটা শুনল। বই থেকে চোখ তুলে, কিন্তু এবারেও বিজনের দিকে না তাকিয়ে আস্তে-আস্তে বলল—এসেছেন তো আমি কী করব? বলেই মনে পড়ল, ঠিক এই কথাটাই আগে একদিন বলেছিল, সত্যেন রায় যখন এসেছিলেন। একই কথা কতই আলাদা করে বলি আমরা!

কী করবি? বিজন চটপট জবাব দিল–বাড়িতে বন্ধুবান্ধব এলে সবাই যা করে তাই করবি। আমার কোনো বন্ধু এলে নিশ্চয়। বিজন একটু থামল, স্বাতী বুঝল যে মুখে প্রথম যে কথা এসেছিল সেটা বদলে নিল সে, হেসে বললো—আচ্ছা, আচ্ছা, আমার বন্ধুর সঙ্গেই না হয় দয়া করে একটু দেখা করলি।

এখন ব্যস্ত আছি, স্বাতী চোখ নামাল ছেলেবেলায়। বিজনকে চটাতে চাইল, পারল না। হঠাৎ তার স্বভাবের আদিম সরলতায় ফিরে গেল বিজন। জানতে চাইল—ব্যস্ত কেন, পড়ছিস তে। স্বাতীকে বলতে হল—সেইজন্যেই ব্যস্ত। গম্ভীরভাবে, কিন্তু ঠোঁটের দূর-কোণে একটু হাসিও রেখে বিজন বলল-তাই-তো! তুই-যে এত বড়ো একজন ব্যস্ত মানুষ, মজুমদার তো আর জানে না। আর জানবেই বা কী করে সেদিন দুপুরবেলা বসে এক ঘণ্টা গল্প করলি। স্বাতী বই নামাল কোলে, বসল সোজা হয়ে, এতক্ষণ পরে বিজনের চোখে চোখ রাখল। বলল–ভুল করেছিলাম।

আশ্চর্য! তক্ষুনি জবাব দিল বিজন—তুইও ভুল করিস! স্বাতী কথা বলল না।

বিজন একটু দাঁড়াল—অন্তত দরকারি কথাটা শুনে আয়।

আমার সঙ্গে দরকার?

তোর সঙ্গেও।

তাহলে তো তুই শুনলেই চলতে পারে–স্বাতী প্রশ্নের মতো আরম্ভ করল, কিন্তু শেষ করল সিদ্ধান্তের সুরে—মানে, তোর মুখে আমার শুনলে।

তা পারে, কিন্তু তুই একবার চেহারাটাও দেখাবি না? বিজন একবার জিভটাকে ঘুরিয়ে আনল গালের মধ্যে। মুচকি হেসে রঙের টেক্কা ছাড়ল-মজুমদার আবার একা আসেনি, তার ভাগনিও এসেছে সঙ্গে।

ভাগনি?

হ্যাঁ, ভাগনি। বিজয়ী ভঙ্গি এবার বিজনের।

ভদ্রলোকের আবার ভাগনিও আছে?

থাকতে নেই? বিজন হাসল। তা হলে তুই একবার–বিজন কথা শেষ করল না; দৌত্য সমাধা করে বেরিয়ে গেল।

তাহলে না গেলেই নয়? স্বাতী দেরী করল না। অনিচ্ছার কাজে তাড়াতাড়িই ভাল। যত শিগগির আরম্ভ, তত শিগগিরই শেষ। ভেবেছিল, অন্য-একজন মেয়ের প্রতি তার মেয়েলি কর্তব্য সেরে একটু পরেই ফিরতে পারবে। কিন্তু ভুল ভেবেছিল, উর্মিলা ঘোষ সহজে উঠল না। স্বাতী ঘরে দিয়ে দাঁড়ানো মাত্র আলাপ করিয়ে দেবার সবুরটুকুও না করে মেয়েটি সম্ভাষণ জানাল—আসুন, অনেকক্ষণ বসে আছি আমরা। এই যে এখানে বসুন-বেতের সোফায় নিজের পাশের জায়গাটি দেখিয়ে দিল। একটু দূরে বসতে যাচ্ছিল স্বাতী, কিন্তু এ-আদেশ অমান্য করতে পারল না। মুখ ঘুরিয়ে ছ-কোণ কাচের ঝকঝকে চশমার ভিতর থেকে স্বাতীকে বেশ মন দিয়ে একটু দেখে নিয়ে নবাগতা আবার বলল–আপনার কথা এত শুনেছি যে আলাপ করতে না এসে পারলাম না।

আমার কথা কোথায় শুনলেন? অন্য কেউ হলে, হয়তো দিন-কয়েক আগে হলেও স্বাতী হেসে : বলত কথাটা, একটু খুশি-খুশি ঠাট্টা ধরনে। কিন্তু এখন কথাটা উচ্চারণ করল ঠিক সেই সুরে, যে সুরে রেলস্টেশনে লোকে জিজ্ঞেস করে—নৈহাটির গাড়ি আবার কখন?

কেন? মামার কাছে! আর আপনার দাদার কাছেও দুজনের দিকে ছিমছাম দুটি হাসি ঝলসাল স্বাতীর অনুরাগিণী। প্রথমোক্তকে লক্ষ্য করে স্বাতী বলল—আপনাদের আলোচনার এর চেয়ে ভাল বিষয় কি নেই আজকাল?

কীসের চেয়ে ভাল? মজুমদার হাসল। আর এই প্রশ্নের তাৎপর্য স্বাতীর অনুমানের অস্পষ্টতায় ছেড়ে দিয়ে আরো চওড়া হেসে আবার বলল-মিলুর কথা! যা বলতে ওর ভাল লাগে, তাই ও বলে..আমার ভাগনি, উর্মিলা। স্বাতী সৌজন্যসম্মত নমস্কারের ভঙ্গি আনল মাথায়। কিন্তু উদ্দিষ্টা তা লক্ষ্য না করে মামার কথার জবাব দিল–যা ভাল লাগে তাই বলি আমি? না, যাকে বলছি তার যা ভাল লাগবে, তাই বলতে চেষ্টা করি—কেমন, তা-ই ভাল না? উর্মিলা সদ্য আপিতার দিকে তাকাল অনুমোদনের জন্য। কিন্তু স্বাতী একটু হেসে বলল—এখানে কিন্তু হিসেবে আপনার ভুল হয়েছে।

ভুল কেন? আপনাকে নিয়ে অন্যেরা কথা বলছে, এ-কথা শুনতে আপনার ভাল লাগে না? একেবারেই না—স্বাতী গম্ভীর হল।

সে কী! ফেমাস হতে ভাল লাগে না আপনার?

ফেমাস! স্বাতী যেন এই প্রথম শুনল, আলগোছে আওড়াল কথাটা। কিন্তু উর্মিলা স্পষ্ট জবাব চাইল-লাগে না?

যা আমি হইনি, যা আমি হব না, তা হতে কেমন লাগবে ঠিক বুঝতে পারছি না।

উর্মিলা সশব্দে হেসে উঠে কথাটাকে রসিকতা বানিয়ে দিল। চেয়ারের মধ্যে পিঠটাকে একটু ঢিল দিয়ে সবুজ জুতো-পরা পা-দুটো বাড়িয়ে দিল মেঝেতে, একটা হাত বুলিয়ে দিল চেয়ারের বাইরে। আর সেই হাতে তার জুতোর রঙেরই ব্যাগটাকে দোলাতে দোলাতে বলল—যদি ধরেই নেন যে হবেন না, তাহলে আর কী করে হবেন? ও তো আর কিছু না, লোকে যাকে নিয়ে কথা বলে, সেই ফেমাস। ভাল বললে ভাল, মন্দ বললেও ভাল। কিন্তু কথা বলবেনা বলে পারবে না। আর সেটা চেষ্টা করলেই হয়।

চেষ্টা করলেই?

ঠাট্টা করছেন আমাকে? কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছি যে ফেমাস হব… হবই। এখন থেকেই চেষ্টা করছি সেজন্য—হব যখন, দেখবেন।

আমি তো নগণ্যই থেকে যাব। তাই দেখব না, শুনব।

কেন, ফেমাস লোকদের চোখে দেখতেও কি আপনার আপত্তি?

দেখতে চাইলেই কি দেখা যায় তাদের?

চেষ্টা করলেই যায়।

চেষ্টা করার চেষ্টাই আমার আসে না।

চড়া গলায়, পিছনে মাথা হেলিয়ে, উর্মিলা আবার হেসে উঠল। ব্যাগটা পড়ে গেল হাত থেকে। নড়েচড়ে বসল পায়ের উপর পা তুলে, ব্যাগটা স্থির করল হাঁটুর উপর, যেন হাসিঠাট্টার শেষে এবার আসল কথা পাড়ছে, এমনি একটা গাম্ভীর্য মুখে এনে বলল—যদি আমি বলি, একজন। ফেমাস মানুষের সঙ্গে আপনার দেখা করার জন্যই আমরা আজ এসেছি, তাহলে কি আপনি সুখী হন না?

এর উত্তরে স্বাতী বলল—আমি এমনিতেই সুখী। উর্মিলার ছকোণাচে চশমা-আঁটা দৃষ্টি প্রায় কঠার হল স্বাতীর মুখের উপর। পাছে আবারও ঐ ফেমাস কথাটা কানে শুনতে হয়, সেই ভয়ে এর পরের কথাটাও স্বাতীই বলে ফেলল—তাছাড়া বিখ্যাতদের বেশি ভালও লাগে না আমার। বলবার সময় ভাবেনি, কিন্তু বলেই মনে পড়ল ধ্রুব দত্তকে।

কাকে দেখেছেন? উর্মিলা জেরা করল।

দেখিনি ঠিক কাউকেই, তবে মনে হয়—

আপনার মনে হওয়াটাকে যাচাই করে দেখুন না একবার। কাল আসুন সন্ধেবেলা আমাদের ওখানে শশাঙ্ক দাসের গান শুনতে-শশাঙ্ক দাসের গান। আবার সাড়ম্বরে ঘোষণা করল উর্মিলা।–আপনাকে নিমন্ত্রণ করতেই এসেছি আমরা। উর্মিলা ধরেই নিল যে নিমন্ত্রণ করা মানেই অন্য পক্ষের গ্রহণ করা। কথা শেষ করে চোখে তাকাল পুরুষ দুজনের দিকে, হাসল, যেন নিজের উপর খুশি হয়ে, আর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে হাঁটু নাড়তে লাগল বসে বসে।

সে দুজন একটিও কথা বলেনি এতক্ষণ। স্বাতী দু-একবার তাকিয়েছিল তাদের দিকে। তারা দ্যাখেনি। আর স্বাতী দেখেছিল তারা দুজনেই উর্মিলাকে দেখছে, আর চোখাচোখি করছে পরস্পরে। উর্মিলাকে উৎসাহ দিচ্ছে তাদের চোখে, বাহবা দিচ্ছে। দু-জনে যেন পরামর্শ করে পুরো রঙ্গমঞ্চটা ছেড়ে দিয়েছে তাকে। রঙ্গমঞ্চ কথাটাই এখানে ঠিক, একটা অভিনয় তাকে দেখানো হল। ভাল অভিনয়—ভালই। কিন্তু ওখানেই যেন শেষ নয়, তাকে একটা পার্টও দিতে চাচ্ছে, নামাতে চাচ্ছে রঙ্গমঞ্চেই। ভাগনির শেষ হবার পরে ঠিক সময়ে আরম্ভ করল মজুমদার। স্বাতীকে লক্ষ্য করে বলল—শশাঙ্ক হঠাৎ এসেছে কলকাতায়, আমি খবর পেয়েই পাকড়েছি। ততক্ষণে স্বাতী তার মনের মাকড়শা-বোনা কম আলোর কোণ খুঁজে খুঁজে শশাঙ্ক দাসকে উদ্ধার করেছে, তাই বলতে পারল—সেই ফিল্মের গাইয়ে?

হ্যাঁ, ফিল্মের গাইয়ে বলেই শশাঙ্ককে লোকে চেনে আজ—স্বাতী যেন আশা করেনি মজুমদারের মুখে এই কথা, কথার এই সুর। ঈষৎ চমকাল, কিন্তু বক্তা সেটা লক্ষ্য না করে আগের কথার জের টানল-পরশু ও ফিরে যাবে, ভয়ানক ব্যস্ত। কিন্তু আমি তো ছাড়বার পাত্র নই। শেষ কথাটায় মজুমদার নিজে হাসল বড়ো-বড়ো দাত দেখিয়ে। কিন্তু স্বাতীর মনে হল না সেটা হাসির কথা।কলকাতার কেউ তো জানেই না উনি এসেছেন—যোগান দিল বিজন।

তাহলে কি আর রক্ষে ছিল, ছেকে ধরত না চারদিক থেকে?

মাত্র দু-একজনই জানে। বিজনের ভাষার ভুল শোধরাল স্বাতী–তাই অল্পেই রক্ষে পেলেন। তা নয়—স্বাতী ঠিক বুঝল না মজুমদার কোন কথার প্রতিবাদ করল-হাজার লোকের মধ্যেও আমি ঠিক ধরে আনতাম শশাঙ্ককে। তা আসবেন কাল। বেশি লোক বলিনি। বেশি বলবার মতো বাড়িও নয় আমার। আপনারা, আর অল্প কজন বন্ধুবান্ধব—বলতে বলতে মজুমদার উঠে দাঁড়াল–হ্যাঁ, আপনার বাবাকেও যদি বলেন…আমার আর সময় নেই, চলি। বিজন, তুমি মিলুকে পৌঁছিয়ে দিও ভাই শেষ কথাটা দরজার ধার থেকে ছুঁড়ে দিয়ে আচম্বিতে, অকস্মাৎ, অপ্রত্যাশিত প্রস্থান করল মজুমদার।

আমাকে কারো পৌঁছিয়ে দেবার দরকার নেই–উর্মিলা আরম্ভ করেছিল মামাকে লক্ষ্য করেই, কিন্তু মামা তার কথা শোনার জন্য দাঁড়ালেন না। অগত্যা বিজনকেই তাক করল চশমা-চোখ–তবে আপনি যদি ইচ্ছা করেন, আমার সঙ্গে যেতে পারেন। ভাগনিকে রেখে, তাকে পৌঁছিয়ে দেবার ভার দাদাকে দিয়ে, মজুমদারের হঠাৎ চলে যাওয়ায় স্বাতী একটু অবাক হল। কেননা ব্যবহারের যে-সব ধারণা তার মনে বদ্ধমূল, তার সঙ্গে এটা মেলে না। যেন বিষয়টা বুঝে নেবার জন্য বলল—নিজেদের গাড়ি থাকার একটা সুবিধে এই যে পৌঁছিয়ে দিতে লোক লাগে না।

গাড়ি না হলেই লাগে নাকি? উর্মিলার প্রতিবাদ উঠল তখনই—আপনি ভেবেছেন কি আমাকে?

তবু, আপনার মামা গাড়িটা পাঠিয়ে দেবেন নিশ্চয়ই।

কেন? গাড়ি পাঠাবেন কেন? ট্রাম-বাস আছে কী করতে?

ও! কাছেই বুঝি? স্বাতী অন্য দিকে আলোর সন্ধান করল।

আমরা কোথায় থাকি আপনি জানেন না?—উর্মিলা যেন অবাক হল। আর তার অবাক হওয়ায় অবাক হল স্বাতী, নিঃশব্দে মেনে নিল নিজের অজ্ঞতা! আমরা থাকি বেনেপুকুরে—উর্মিলা আলো ফেলল।

সেটা কোথায়?

ও মা, বেনেপুকুর জানেন না? খিলখিল করে হেসে উঠল উর্মিলা। স্বাতী লজ্জা পেল বিখ্যাত বুঝি জায়গাটা?

না, না, সে রকম কিছু নয়, পাড়াটা বাজেই—তা ঠিক সুবিধেমতো পাওয়া গেল না আর কোথাও। অনেক ঘর চাই, গ্যারেজ চাই, গ্যাস চাই, আবার ফ্ল্যাট হলেও চলবে না। উর্মিলা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক খবর উগরে দিল—এই সব হয়ে ওঠা ভাড়া-বাড়িতে তো শক্ত? এই একেবারেই সত্য কথাটায় উর্মিলা প্রশ্নের সুর লাগাল, আর এমনভাবে তাকাল যেন সে ভাবছে স্বাতী এ নিয়ে তর্ক করবে, স্বাতীকে তাই সায় দিতে হল—নিজের বাড়িতেও সহজ না। ঠিক বলেছেন, অনেকের পক্ষে তাই। তবে মামা যখন বাড়ি বানাবেন–এ-বিষয়ে এর বেশি বলা উর্মিলারও বোধহয় বাহুল্য লাগল, ফিরে এল আগের কথায়–তা এটাও মন্দ না। বড়ো বড়ো ঘর, চওড়া-চওড়া বারান্দা, আপনার ভালই লাগবে। উর্মিলা একবার চোখ ঘুরিয়ে আনল স্বাতীদের বসবার ঘরের চারটি কাছাকাছি দেয়ালে।

আর কী-কী আমার ভাল লাগবে বলুন তো, শুনি আপনার মুখে। কিন্তু স্বাতীর এই আঘাত জলের উপর পড়ল। জলের মতো সহজে উর্মিলা জবাব দিল—তা তো জানি না, তবে গান যে ভাল লাগবে, এটা নিশ্চিতই।

কিন্তু আমি তো এখনও বলিনি যে কাল যাব।

ও আবার বলবেন কী—যাবেন তো? উর্মিলা মুখে বলল এ-কথা, আর চোখে বলল–শশাঙ্ক দাসের গান শোনার সুযোগ কেউ কি পেয়েও হারায়?

স্বাতী কিছু বলল না। আপনি কি ভাবছেন যে যাবেন না? ইশ! হেসে তাকিয়ে ভুরু বাঁকিয়ে স্বাতীর একটি হাত ধরে উর্মিলা বলল—তোমাকে বড়ো ভাল লেগেছে আমার…সত্যি তারপরেই অন্য হাতে বাঁধা ছোট্টো সোনার ঘড়ির দিকে কোণ-চোখে তাকিয়ে, মুখ ঘুরিয়ে, প্রায় একই রকম মধুর সুরে বলল—আমার সঙ্গে বেরোবেন নাকি বিজনদা, আমি কিন্তু আর বেশিক্ষণ বসব না। বিজন এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল বোধহয় দুজনকেই। কথা শোনামাত্র তড়াক করে উঠল।

তার চেয়েও কমক্ষণে আমার হয়ে যাবে—বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল দ্রুত স্নানাহার সারতে। সেই কম-ক্ষণই স্বাতীর পক্ষে অনেকক্ষণ হল। কেননা, বিজন চলে যাওয়া মাত্র উর্মিলা ঘুরে বসল হাঁটুতে প্রায় হাঁটু ঠেকিয়ে। একেবারে দু-চোখভরা ঢলঢলে তাকিয়ে বলল—এস ভাই, এখন একটু মন খুলে কথা বলি দু-জনে। এর পরেও আরো মন খুলবেন ইনি? স্বাতী একটু সরে বসল, তুমি-টাকে যেন লক্ষ্য করল না। একটু বেশিই ভদ্রভাবে বলল—আপনাকে কিছু পানীয়? কথাটা উচ্চারণ করেই স্বাতী প্রায় জিভ কামড়াল। কেমন করে সে আগেই না-বুঝে পারল যে ওটা শুনে তার সঙ্গিনীর খিলখিলে-কলকলে হাসি আর উথলোবে? কিন্তু স্বাতী সবচেয়ে বেশি যা ভাবতে পারত, তার চেয়েও বেশি হল। হাসির অথৈ জলে পড়ে গেল উর্মিলা। অনেক ঠোক হাসি গিলতে গিলতে একটি একটি কথার বুদ্বুদ তুলল কোনোরকমে—পানীয়? নাভাই পানীয়-টানীয় কিছু চাই না আমার। স্বাতী অদম্যভাবে আবার বলল—কিছু না?

না।–পানীয়!—উঃ! ড়ুবতে ড়ুবতে বেঁচে গিয়ে উর্মিলা এবার দুর্বলভাবে হাসির হেঁচকি তুলতে লাগল। দাদা বোধহয় খেতে গেল, আমি একবার উর্মিলা দৃষ্টিপাত করল ভিতরের দিকে কেন, চাকর নেই? তক্ষুনি উর্মিলা উঠে এল শুকনো ডাঙার কেজো ঘাটে।

সে জন্য না—স্বাতী জরুরিভাবে উঠে দাঁড়াল।

আরে বসো, বসো-উর্মিলা হাত ধরে সাধল, বাদ সাধল—দাদার অত যত্ন না করলেও চলবে। বসো, একটু গল্প করি। স্বাতী বিবর্ণভাবে বসে পড়ল। ভিতরে যাবার দরজাটায় রইল তার চোখ… চোখের তৃষ্ণা।

তুমি বোধহয় আই. এ. পাশ করলে এবার।–উর্মিলা আরম্ভ করল মন-খোলা গল্প। স্বাৰ্তী মৌনভাবে বুঝিয়ে দিল যে অনুমানটা মিথ্যে না।

এখন কী করবে?

পড়ব।

পড়াশুনো তো শেষ হবে একদিন।

হোক তো।

তোমার শিগগিরই শেষ হবে—– উর্মিলা প্রায় দৈবজ্ঞের মতো বলল।

পড়াশুনোর কি শেষ আছে জীবনে? প্রায় আর্যভাবে উত্তর দিল স্বাতী।

তুমি তাহলে তোমার জীবনটা নিয়ে বেশি কিছু ভাবনি?

আপনি ভেবেছেন মনে হচ্ছে? স্বাতী বলতে চেয়েছিল, আমার জীবন নিয়ে আপনি ভেবেছেন, কিন্তু উর্মিলা উথলে উঠে বলল নিশ্চয়ই! আমার জীবন নিয়ে আমি যদি না ভাবি—কিন্তু ঐ আপনিটা আর কেন ভাই, মোটে ভাল শোনায় না। আর বয়সে বেশি বড়ো না আমি তোমার। এবার বি. এ. দিলাম, আর এর পরেই মুশকিল। পরীক্ষার আগে থেকেই মা চিঠি লিখছেন মামাকে-মা তো দেশে থাকেন, আর আমার বাবা নেই। কিসের জন্য বুঝতেই পারো, আর মামারও তাই মত। মনে মনে উনি বেশ সেকেলেই আছেন এখনও, আর আমাদের মতো মডার্ণ হবেনই বা কী করে মামাও কথাবার্তা এমন বলেন যেন বিয়ে ছাড়া মেয়েদের গতি নেই। আমি বলি—না, কখনো না, বিয়ে-বিয়ে করে চ্যাঁচামেচি কি এখনো শুনতে হবে, এই উনিশ-শো একচল্লিশেও? অবশ্য তোমার মতো মেয়ের কথা আলাদা, তোমাকে দেখেই বোঝা যায় তুমি বিয়ে করারই টাইপ। দ্যাখো না, কলকাতায় আছ তো জন্ম থেকেই, অথচ শহরটাই চেন না এখনও, একলা চলাফেরাও ভাবতে পার না। তাই বিয়েটাই তোমার পক্ষে ঠিক। কিন্তু সকলে তো আর লক্ষ্মী মেয়ে নয়, তোমার মতো, ইচ্ছা-অনিচ্ছাও অনেকের অন্যরকম। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করো বিয়েতে আমার মত নেই কেন? আমি কি কোনোদিনই বিয়ে করব না? মামা যদি এ কথা জিজ্ঞেস করেন আমাকে-আমি বলব, না, তা নয়, কোনো একদিন করব হয়তো। যেদিন ইচ্ছে হবে করব, আর সেদিনই করব কিন্তু তার একদিনও আগে না। এখন? এখন সে কথা ভাবতেও পারি না, এখন আমি জীবনটাকে দেখতে চাই, চাখতে চাই, সবচেয়ে বেশি চাই ফ্রিডম, পুরুষরা যেটা মনোপলি করে রেখেছে এতকাল। তাছাড়া আমার একটা প্ল্যানও ঠিক করা আছে—তখন যে বলছিলাম ফেমাস হব তারই প্ল্যান! আমি পলিটিক্স করব। পলিটিক্স ছাড়া আর কিছুতেই নাম নেই আজকাল, আর কিছুর দরকারও নেই বোধহয়। মোটামুটি একটা প্রোগ্রামও ভেবে রেখেছি। নেহাতই মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন, মেয়েদের নিয়েই হৈ-চৈটা তুলতে হবে। বাপের সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে আইনে। পুরুষ যে-কটা ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে, আর মেয়েরা নাকি কিছুতেই একবারের বেশি না। সব ঠিক করে ফেলেছি। বুঝতে পারছি না এখনও শুধু এইটুকু, যে কোন পার্টিতে যাব—প্রোগ্রেসিভ-ডেমক্র্যাট, না র্যাডিকল-লিবরল, না অ্যাডভান্স-গার্ড। সবচেয়ে জোরালোটাতেই যাওয়া উচিত নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রত্যেকেই বলে আমরাই সবচেয়ে জোরালো। আবার ভুল পার্টির জন্য না জেলেই যেতে হয় কোনো সময়। ঐ একটা শুধু অসুবিধে আমাদের দেশে পলিটিক্স করার। হাত নেড়ে, পা নেড়ে, হাঁটু নেড়ে, হাঁটু ছড়িয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, সমস্ত শরীরে কম্প তুলে, সমস্ত কথায় রঙ্গ ঢেলে, প্রত্যেকটি চীৎকার-চিহ্নকণ্ঠস্বরে পরিস্ফুট করে স্বতীর নতুন বন্ধু এই বিচিত্র বক্তৃতাটি তাকে শোনাল। মাঝে মাঝে একটু একটু থামল, যেন অন্যজনের কিছু বলবার কথা, যেন এমনকি সত্যিই অন্যজন কিছু বলেছে। আর স্বাতী অবশ্য কিছু বলল না, বলতে চাইল না, পারল না। চাইলেও পারত না, পারলেও চাইত না। শুনলও না সব, প্রায় কিছুই শুনল না। শুধু তাকিয়ে থাকল স্থির, কিন্তু খানিক পরে আর দেখলও না। শুধু তার কানের মধ্যে ঘনঘোর গোলমালের গোলাগুলি চলতে লাগল।

উর্মিলার মনের কথা এখানেই হয়তো শেষ হয়নি, হয়তো মন খুলতে আরম্ভ করেছিল মাত্র। কিন্তু গভীরতর উন্মােচনের আর সময় হল না, বিজন ফিরে এল। সময় বাঁচাবার জন্য স্নানটা বাদ দিয়েছিল সে। হোক গরম, স্নানে গরম কমে এটা কুসংস্কার ছাড়া আর কী! রাস্তায় বেরোলে একই, আর একশো ডিগ্রির উপরে তাতা রাস্তাটাই তখন তার কাছে কল্লকাতার সুখস্থান। ঘরে পা দিয়েই বলল–চলুন। উর্মিলা এমন চিরস্থায়ীভাবে চেয়ারটায় বসেছিল যে তাকে উঠতে দেখে স্বাতী অবাক হল।

আচ্ছা, আজ চলি ভাই, অনেক গল্প করলাম—হঠাৎ যেন নিজের ভাষার ভুল বুঝতে পেরে জুড়ে দিল—তুমি তো কথাই বললে না। আমাকে বোধহয় পছন্দ হল না তোমার—কী বলে? আমার কিন্তু তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। উদার, উচ্ছল, বৎসলভাবে স্বাতীর পছন্দকারিণী। হাত রাখল তার কাঁধে। তারপর ব্যাগ খুলে, স্বাতীর ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, প্রসাধনের ভাঙচুর মেরামত করে নিল। ভুরু কুঁচকে নিজেকে দেখল আয়নায়, নিজেকেই উপহার দিল মিষ্টি একটি হাসি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বিজনকে বলল—চলুন। বিজন বলল—একটা ট্যাক্সি আনানো যাক।

ট্যাক্সি কেন? বিজনের প্রস্তাবটা হাত ঘুরিয়ে উড়িয়ে দিল উর্মিলা–বাসে-ট্রামে সাত-রাজ্যি ঘুরে বেড়াই আমি!

আপনার জন্য বলি–নিক্ষিপ্র উত্তর দিল বিজন—নিজের জন্যই বলেছিলাম। সম্ভবত নিজে বুঝল না কথাটা কত গভীর। কিন্তু উর্মিলা বুঝল।ঐ তো দোষ বিজনদার। বলতে বলতে কুলকুল করে হেসে উঠল বাজে খরচের রাজা। দাদাটিকে একটু শাসন করো ভাই, বড় বয়ে যাচ্ছে।

ওকে আপনি নাম ধরে ডাকলেই পারেন, স্বাতী হঠাৎ নিজেকে বলতে শুনলও আপনার ছোটোই হবে।

না ভাই, এটা কিন্তু ভাল বললে না। এতই কি বুড়ো দেখায় আমাকে? কিন্তু এ কথার উত্তরে সৌজন্যের প্রত্যাশাও স্বাতী মেটাতে পারল না, আর কিছু বলবারই শক্তি পেল না।

তা এ কথা ঠিক—অকাতর উর্মিলা আবার বলল—যে অমুকদা-অমুকদির দিন আর নেই সকলেই এখন সমান, সকলেই সকলকে নাম ধরে ডাকবে। তা না হলে আর হল কী? কথাটা শেষ করল বিজনের দিকে জুলজুলে তাকিয়ে। আর এই আশ্চর্য স্বর্ণযুগ—তার আরো আশ্চর্য প্রমাণ—বিজনের মুখে স্বৰ্গসুখ উদ্ভাসিত করল।

******

নিজের ঘরে, একলা বাড়িতে, স্তব্ধ দুপুরে স্বাতীর আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল আস্তে-আস্তে। তার চেতনা ফিরে এল। কিন্তু অভ্যস্ত আশ্রয়গুলিতে ঠিক যেন ফিরতে পারল না। ক্লোরোফর্ম থেকে জেগে উঠে এইরকম লাগে মানুষের নিজের এই ঘর যেন অচেনা, বইগুলি অর্থহীন, দিনটা জ্বরের মতো শূন্য। খানিক আগে বসে বসে ছেলেবেলা পড়ছিল, এখন আবার সেই চেয়ারটিতেই বসেছে, ছেলেবেলাও আছে, কিন্তু বই খোলার নিয়মরক্ষাটুকুও করছে না। এর মধ্যে কী যেন একটা সাতিক ঘটে গেছে, যেন একটা দেয়াল উড়ে গেছে তার ঘরের, কিংবা হঠাৎ তার ডান হাত আর নাড়তে পারছে না। এমন একটা সাতিক কিছু যা তার জীবনটাকে এক ধাক্কায় অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে, যেন একেবারে আরম্ভে, আবার প্রথম থেকে নতুন করে সব ভাবতে হবে। মনের তলার পাগলা-ঘোলা ঘূর্ণি থেকে যে কথাটি প্রথম স্পষ্ট হয়ে উপরে ভেসে উঠল তা এই যে তার মা নেই। কথাটা ভাবতেই-আর কোনোদিন এ রকম লাগেনি—অসহায় লাগল, ভয়-ভয় করল। যেন কোনো অদ্ভুত বিদেশে, কোনো ভীষণ ভিড়ের মধ্যে সবাই তাকে ফেলে চলে গেছে, বাবাও। বাবা যে এ সময়ে আপিশে, সেটাও মনে হল তার এখনকার কান্না-পাওয়া হারিয়েযাওয়ার অংশ। আর এখন এই লম্বা-লম্বা দমবন্ধ ঘন্টাগুলি ভরে বাবার জন্য বসে থাকা ছাড়া কিছুই তারকরবার নেই। স্বাতী একবার জোরে নিশ্বাস নিল,মুখ মুছল আঁচলে। বড়ো ঘাম—কিন্তু ঘামটা যেন ঠান্ডা, গরমটা যেন ভিতরে ভিতরে শীত। খুব চুপ করে, খুব মন দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল বাবা এলে কী বলবে। কী বলবে? এখন যদি থাকতেন তাহলেই বা কী বলত? কোন ভাবনাটা তার মনে পরিষ্কার, কোন ভাষাটা তৈরি? সে তো নিজেই এখনও জানেনা তার কী আছে। নিজেই জানে না এই ভয় কেন। আরো সেটা জানতেও তার ভয়। হঠাৎ তার শরীরটাই দুর্বল লাগল–ক্লান্ত, অবসন্ন, ঘুমিয়ে পড়ার মতো।

রামের মা ঘরে এসে বলল–দিদিমণি, খাবে নি? রামের মা-র চেহারা, গলার আওয়াজ স্বাতীকে যেন সান্ত্বনা দিল। চেয়ারের মধ্যে একটুও না নড়ে বলল—তুমি বড়ো তাড়া দাও রামের মা।

—এত্ত বেলা হয়ে যায়, খাবার জন্য মন বলে না তোমার? একটু চুপ করে থেকে স্বাতী জিজ্ঞেস করল—রামের মা, তোমার নাম কী?

নাম! আমার নাম?

হ্যাঁ, নাম কী তোমার?

আমার নাম—যেন একটু চেষ্টা করে এই তথ্য মনে করতে হল—আমার নাম মনোরমা। তবে আমরা তোমাকে মনোরমা ডাকি না কেন?

কী যে বলো, দিদিমণি! এমনভাবে শরীর বেঁকিয়ে হাসল যেন একটা লজ্জার কথা।

তুমি তো আর জন্ম থেকেই রামের-মা ছিলে না। রাম জন্মাল, তবে তো হলে। এই যুক্তি অনুধাবন করতে পারল না রাম-জননী, ফাঁকা মুখে তাকিয়ে রইল। স্বাতী আবার বলল–রামের বাবা কী বলে ডাকত তোমাকে? মুখে আঁচল চেপে হাসি লুকোল রামের পিতার পুত্রের মাতা। তার শরীরে এমন একটা ভঙ্গির ঝিলিক দিল যে স্বাতী হঠাৎ বুঝল যে তার বয়স অত্যন্তই বেশি না। আধখানা মুখ ফিরিয়ে সে জবাব দিল–সে আমি বলতে পারব নি, দিদিমণি। বলো না। স্বাতী যেন জীইয়ে উঠল এই প্রাকৃত, পার্থিব কৌতুকে।

সে বড় নাজের কথা, তোমাদের কানে সইবে নি। স্বাতী একটু ভেবে বলল–তবে তো ভালই। শুনলে ভাল বলতে না, দিদিমণি—এত বড়ো একটা স্বাধীন মন্তব্য শুনতে স্বাতী আশা করেনি, একটু বেশি মন দিল কথা শোনায়-আর্ধেক শুনলে মুছে যেতে। তা আমাকে যা বলে বলত, সোয়ামি যখন, বলতেই পারে, কিন্তু মা-বাপ তুলে যখন মুখ ছাড়ত–স্বাতী ভেবেছিল কথাটা শেষ হবে না, কিন্তু তার আশাতীত আর একটা কথা বলল তার পরিচারিকা—তখন আমিও ছাড়তাম না!

স্বাতী দমে গেল। নাজের কথার সে অন্য মানে বুঝেছিল। এত বছর ধরে রোজ যাকে দেখছে, অথচ কিছুই যার জানে না, তার কথা আর একটু জানবার তার ইচ্ছে হল। জিজ্ঞেস করল— তোমার স্বামী মারা গেছে কদ্দিন?

মরেছে কবে? প্রশ্নটা যথাযথ জেনে নিল, তারপর উত্তরও দিল যথাযথ–সে অনেক কাল হবে। সেবারে খুব আম হয়েছিল না? সারা জষ্টি বিষ্টি নেই এক হিটে। ভোররাতে কলিরা হল, আর মানুষটাকে যেন হিচড়ে টেনে নে গেল যমে। একটু থেমে স্বাতী এর পরের প্রশ্নটি করল—তোমার কষ্ট হয় না?

মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রামের মা প্রশ্নটা বোঝবার চেষ্টা করল। তারপর তৃতীয়বার স্বাতীকে তাক লাগিয়ে বলল–না দিদিমণি, মিছে বলব না, কষ্ট আমাকে তেমন দিত নি, খেতে পরতে দিত। ঐ-যা এক দোষ ছিল, মুখটা আস্তাকুঁড়। তা দোষ বিনে মানুষ হয়? আর মারধোরটা ছেল না তোত, রোজগারেও কামাই দেয়নি একদিন, একদিনের তরে ব্যামো হয়নি একটা–তা মরণে ডাকলে তার উপর তো কথা নেই! চুপ করে থাকল স্বাতী। মাথার কাপড়টা কথা বলতে বলতে পড়ে গিয়েছিল। সেটা যথাস্থানে তুলে দিয়ে রামের মা যথারীতি আবার প্রস্তাব করল—দিদিমণি, এখন খাবে চলো।

চলো। স্বাতী উঠল তক্ষুনি, আর নিজেকে তার অনেক বেশি নিজের মতো লাগল খাবার পরে ঘোর দুপুরের মস্ত ঘন ঘণ্টাগুলিতে। হঠাৎ যদি কেউ চলতে চলতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, রাস্তায় ভিড়, পাড়ায় হৈ-চৈ, অ্যাম্বুলেন্সে খবর, তারপর ডাক্তার বলে কিছু না, এক্ষুনি সেরে যাবে—এ যেন সেই রকম অনেকটা। এখন স্বাতী মনে করতে পারল সব, ভাবতে পারল সমস্তটা। উর্মিলার বকরবকরের বাছাবাছা অংশগুলিকে টেনেটেনে তুলে পর-পর সাজাতে পারল—তখন যদিও শুনছে বলেই মনে হয়নি। দাদার মুখ-চোখের ভঙ্গি মনে পড়ল স্পষ্ট মজুমদারের সঙ্গে তার চোখাচোখি, উর্মিলার দিকে তার তাকানো, উর্মিলার সঙ্গে তার বেরোনো… আর তাকে, স্বাতীকে, কেমন এড়িয়ে-এড়িয়ে চলা। এক মজুমদারেই কিষ্কিন্ধ্যা, তার উপর আবার ভাগনি, আর ঐ লম্বা-হাবা লেজুড় তার দাদা! আবার, মুহূর্তের জন্য, স্বাতী যেন শিউরে উঠল। মনে মনে বলল-মেয়েদের যেন কখনও মা না মরে, আর মা যদি-বা মরে, এমন ভাই যেন কখনও কোনো মেয়ের না হয়।

কিন্তু দাদা-হঠাৎ গর্বের একটা ঢেউ উঠল স্বাতীর মনে, আর সেই সঙ্গে সাহসের হাওয়া লাগল। দাদা তার কী করতে পারে? দাদা কি একটা মানুষ? তাকে যন্ত্রণা দিতে পারে এমন সাধ্য কী দাদার? এইটাই তার ভুল হয়েছে যে সে আশ্রয় খুঁজছিল, মা-র আশ্রয়, বাবার। কিন্তু কেন? এই ব্যাপারটাকে একটা বিরক্তিকর বইয়ের মতো তাড়াতাড়ি পাতা উল্টিয়ে সে কি শেষ করে দিতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে, নিজেই পারে। সে নিজেই তার আশ্রয়—আর আবার কে? সে যদি সোজা হয়ে দাঁড়ায়, চোখ তুলে তাকায়, যদি সে শুধু একবার মনস্থির করে নেয়, তাহলে কেউ কি তার কিছু করতে পারে? সঙ্গে সঙ্গে, আর একসঙ্গে, স্বাতীর মন দটি সিদ্ধান্তে পৌঁছল। প্রথম, বাবাকে কিছুই বলবে না এসব। দ্বিতীয়, কাল যাবে গান শুনতে। গান শুনতে অবশ্য নয়, যাবে উর্মিলাকে কয়েকটা কথা বলতে। অন্য কোথাও, অন্য কোনো সময়ে হলে ভাল হত, উপলক্ষটা ঠিক উপযুক্ত নয়। কিন্তু আবার সুযোগ পাবে কবে, আর যে-কোনো জায়গায়, যে-কোনো সময়ে কথাটা যখন অস্বস্তিকর, তখন একই কথা। আর উর্মিলাকে ঠিকমত বলতে পারলে বাবাকে আর বলতে হয় না, এ-বিষয়ে জানবারই দরকার নেই তার। এক দাদাই যা জ্বালাচ্ছে বাবাকে, তার উপর আরো অশান্তি?

ছায়া লম্বা হল রাস্তায়, রোদের রং বদল হল, আর ঠিক যখন বর্ষার আগের দুরন্ত দিনগুলির আরো একটির শেষ হবার খবর ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ল, তখন স্বাতী উঠল চেয়ার ছেড়ে। জানলা খুলে দিল ঘরের, শেলফের সবগুলি বই নামিয়ে নতুন করে গোছাতে বসল। উর্মিলাকে কাল যা বলবে, তার প্রত্যেকটি কথা এতক্ষণ ধরে ভেবে-ভেবে সে ঠিক করেছে, অনেকবার আউড়েছে মনে মনে। এতক্ষণে পরীক্ষার পড়ার মতো প্রায় মুখস্তু হয়ে গেছে। উর্মিলা বারবার বাধা দেবে, বার-বার জিভ নাড়বে, চ্যাপ্টানো আমের রসের মতো চুইয়ে চুইয়ে গড়াবে তার আঠা-আঠা কথা। স্বাতী শুধু একটু দূরে সরে যাবে, হাত যাতে চিটচিটে না হয়, চোখ দিয়ে বিঁধে রাখবে উর্মিলাকে, বিধিয়ে দেবে তার কথাগুলি… সব… সমস্ত… প্রত্যেকটি। কথাগুলি বেশি না, কথাগুলি এই ও আপনার মামার বয়স হয়েছে, টাকা হয়েছে। এখন তার জীবনের একটি যোগ্যা সঙ্গিনীর সন্ধান করছেন আপনারা। তিনি নিজেও করছেন, কিংবা নিজেই করছেন। তিনি ভাবছেন–তাই আপনারাও ভাবছেন যে, এখন সেই সময় এসেছে যখন মনে করা যায় যে অনুসন্ধানের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু না, আপনাদের অনুমান ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। আর সেই ভুল অনুমানের অনুসরণ আরো যদি আপনারা করেন, সেটা শুধু পণ্ডশ্রমই হবে না অপ্রীতিকরও হবে। অনেকের পক্ষেই অপ্রীতিকর। আমি আজ এসেছি শুধু এই অপচেষ্টা থেকে আপনাদের বিরত করতে। দয়া করে আপনার মামাকে এই কথাটা বলবেন। বুঝিয়ে দেবেন, দয়া করে একটুও অস্পষ্টতা রাখবেন না। তার সঙ্গিনীর সন্ধান অন্যত্র করতে হবে। আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে আমার মন্তব্য করা অশোভনতার চরম। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকা আমার পক্ষে আর যে সম্ভব হল না, আপনারাও..আপনারাই তার কারণ। অতএব আশা করি আমার ভব্যতার এই ব্যতিক্রম মার্জনা করতে আপনারা অনিচ্ছুক হবেন না। আরো একটা কথা আপনাদের জানানো দরকার। আমার দাদা আর আমি এক বাড়িতে বাস করি, বাকি দুজনে দুই জগতে। দাদার বন্ধু আমার বন্ধু হতে পারে না কখনও। তাই আপনার মামার, কিংবা আপনার, আবার যদি অবসরের এমনই প্রসার কি প্রয়েজনের এমনই বাধ্যতা ঘটে যে আমাদের বাড়িতে আসতেই হয়, তাহলে দাদাকে লক্ষ্য করেই আসবেন, দাদাকেই… শুধু দাদাকে। এই কথাগুলি শুনতে আপনার ভাল লাগল না, বলতে আমার আরো অনেক খারাপ লাগল। কিন্তু না বললে খারাপ হত, তাই বলাই ভাল হল।–স্বাতীর মন এই ক্ষুদ্র নিবন্ধটি রচনা করে তার ভার নামাল। এখন বলতে পারলেই নিশ্চিন্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *