সুখী, সুশ্রী, উজ্জ্বল একটি দিন। গ্রীষ্মের ধোঁয়ামুখে মেঘের ধোঁয়া, মেঘের ধোঁয়ারং কালো, আকাশ ভরা কালো, আকাশভাঙা বৃষ্টি, তারপর বৃষ্টি পড়ে পড়ে তাপ জুড়োল, মেঘ লুকোল, আকাশ ফেটে নীল বেরোল। সত্যি নীল… নরম অথচ জ্বলজ্বলে ঘন নীল, যে নীল—যদিও নীলের জন্যই তার খ্যাতি-বাংলার আকাশে দেখা দেয় বছরে আট কি দশ দিনের বেশি না। বাইরে রোদ্রটা নিশ্চয়ই গরম, কিন্তু ঘরে আলো, হলদে-সবুজ-বেগুনি মেশানো আভা, যেন গাছপালার ভিজেসবুজ নিজের গায়ে মেখে নিয়েছে এই আলো। ভিজে ভাবটা হাওয়াতেও, ঝিরঝির বইছে ঠান্ডা, যখন বইছে না তখনো ঠান্ডা, এমনকি ইলেকট্রিক পাখাটাকে যদিও এখন দুপুর, একটু ছুটি দিলেও চলে। স্বাতীর অন্তত থেমে থাকা পাখাটার দিকে লক্ষই নেই। পরনে ঘাস রঙের শাড়ি, নিচু করা মাথার মাঝখান দিয়ে আলোর সুতোর মতো সিঁথি, আলোর দিনটির সমস্ত সুখ তার মুখে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি চিঠি পড়ছে সে। আর তার পিছনে তার বাঁকানো ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চেয়ে লম্বা একজন, ঢোলা মালকেঁচা দিয়ে ধুতি পরা, গায়ে শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল, হাতে দু-খানা বই আর একটি খাতা। তার দাঁড়িয়ে থাকার ভাবটা এমন যেন সে স্বাতীর মুখের কোনো একটা কথা শুনবে বলে অপেক্ষা করছে, আর সেই কথার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে তার। একটা চিঠি পড়ে উঠতে যেটুকু সময়, তার মতে লাগতে পারে, সেটুকু দেরি করল সে, তারপর কথা বলল–
কী লিখেছেন মা?
ভালোই আছে সব—মুখ না তুলেই জবাব দিল স্বাতী।
আমার কথা?
আমার উপরেই তোর ভার দিয়েছেন বড়দি, স্বাতী মুখ ফেরাল, তাকালো… হাসল।
আমি কি এখানেই থাকব, না হস্টেলে যাব?
ওঃ বড়ো যে হস্টেলের শখ! সেখানে বাবু সেজে ঘুরে বেড়াবেন আর কলেজ ফাঁকি দেবেন রোজ! ও সব হবে না—কেমন আমি তোমাকে কড়া শাসনে রাখি দ্যাখো না!
মা বলেছিলেন আমি এখানেই থাকব। কিন্তু বাবা বলেছিলেন—না, না, ওদের অসুবিধে হবে। আর কী বলেছিলেন তোমার বাবা?
বাবা কিন্তু আনতেই চেয়েছিলেন আমাকে সেই পুজোর সময় সবাই যখন এল। তখন মাই বললেন না, সামনে পরীক্ষা!–এমন তখন রাগ হয়েছিলো মার উপর।
খুব রাগ? স্বাতী ভুরু বাঁকাল।
হবে না? ছ-মাস দেরি তখনো পরীক্ষার!আর ঐ এক মাস আমি কি পড়েছিলাম নাকি?
মিছিমিছি আমার আসা হল না!
তা বেশ তো, বেড়াতে না এসে একেবারে থাকতেই এলি।
তাও কি তুমি ভেবেছ সহজে? মা কি কম প্যানপ্যান করেছেন–কেন, এখানকার কলেজেই তোছেলেমানুষ, একা-একা কলকাতায় যত হ্যানো-ত্যাননা জানেন মা! আচ্ছা, তুমিই বলল, ওখানকার কলেজকে কি কলেজ বলে, না পুরো যোলো বছর বয়সকে ছেলেমানুষ বলে? বড়দি যে তোকে ছেড়ে দিলেন শেষ পর্যন্ত, সেটাই তো আশ্চর্য। যা ভালো তিনি বাসেন তাদের! নিজের ছেলেমেয়েকে সব মা-ই ভালোবাসেন, ওতে আর নতুন কী আছে?
বাঃ, এক মাস হয়নি কলকাতায় এসেছিস, এরই মধ্যে বুলি কপচাতে শিখেছিস তত বেশ!
নাঃ, তুমিও আমাকে ছেলেমানুষ ভাবো!
তাতে আর দুঃখ কী–লম্বা তো হয়েছিস খুব! চিনতেই পারিনি প্রথম দিন দেখে—এই ডালিম?
আমাদের ডালিম? ঠাশ করে এত বড়ো হয়ে গেল কবে?
তুমিও অনেক বড়ো হয়েছ, ছোটোমাসি। এ কথার উত্তরে স্বাতী কিছু বলল না, কয়েক-পা হেঁটে গিয়ে একটি চেয়ারে বসল। চেয়ারগুলি, আগে ছিল ঘরের মাঝখানে যেমন থাকা উচিত, এখন আছে একপাশে একটু ঘেঁষে ঘেঁষে, কেননা বসবার ঘরের অর্ধেকটা এখন ডালিমের, সরু একটা তক্তাপোশ, ছোটো টেবিল–শাশ্বতীর পুরোনো দিনের পড়ার টেবিল, এতদিন যেটা রাজেনবাবুর ঘরে জায়গা জুড়ে পড়ে ছিল—সেই সঙ্গে বেখাপ্পারকম নতুন একটা চেয়ার মামার উপহার ভাগ্নেকে-টেবিলে বই, গোল টাইমপিস, দেয়ালে দৃশ্য-আঁকা ক্যালেন্ডার, কিন্তু ছবির অংশ অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে একই পেরেকে ঝোলানো মালিকের নিজের কেনা চকচকে নতুন চৌকো আয়নাটিতে। এত জিনিসে নিশ্চয়ই একটু আঁটো হয়েছে ঘরটি, কিন্তু এখন—এই আলোর দিনে, এই সুখী, সুশ্রী, সুন্দর দিনটিতে বেশ হালকা, খোলা, ছিপছিপে লাগছিলো ঘরটিকে। যদিও একতলা, তবু জানলা বেশি বলে, আর জানলার পরদাগুলি দুপুরবেলার নিরিবিলির সুযোগে আর আজকের আশ্চর্য আলো-হাওয়ার খাতিরে স্বাতী সরিয়ে দিয়েছিল বলে, আকাশের নীল সোনার সচ্ছলতা পৌঁছতে পেরেছিল ঐ ঘরটি পর্যন্ত।
ডালিম বসল না, এগোলও না, যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল—আচ্ছা, ছোটোমাসি, আমি কি খুব বেশি লম্বা?
লম্বাই তো ভাল।
ভাল, কিন্তু বড়ো বেশি হওয়া ভাল কি? আমি আবার রোগাও কিনা—কী করা উচিত আমার বলো তো? এক্সারসাইজ করব? কিন্তু এক্সারসাইজ একবার ধরলে তারপর ছেড়ে দিলেই নাকি মোটা হয়ে যায়?
রোগাও থাকবি না, মোটাও হবি না—মুশকিল হল তো তোকে নিয়ে।
কেন, রোগা-মোটার মাঝামাঝি কিছু নেই বুঝি? ডালিম তার ছোটোমাসির দিকে তাকাল, একটু থেমে থাকল, তারপর বলল—তুমি ব্যাকব্রাশ করতে বলেছিলে–ঠিক হয়েছে?
দেখি?
লম্বা ডালিম মাথা নিচু করল। বাপের মতোই শক্ত, কোঁকড়া চুল তার, ছেলেবেলার সিঁথিস্মৃতি নিশ্চিহ্ন করে ঠেলে তুলে দিয়েছে উপর দিকে। স্বাতী বলল-বড়ো তেল দিয়েছিস, অত দিবি না। আর ঐ নীল শার্টটা কি নিজে পছন্দ করে কিনলি?
ডালিম মুখ তুলল—ভালো না?
রংটা বেশ-পরদা হলে মানাত। আর তুই বুঝি কোঁচাবিরোধী?
ডালিমের মাথা আবার নিচু হল। বিচ্ছিরি—এখন তা-ই লাগল—বিচ্ছিরি মালকোচার ফুলে ওঠা ভাঁজের দিকে একবার তাকাল, বিচ্ছিরি নীল রঙের শার্টটার দিকে একবার, তারপর মাথা নিচু রেখেই ভুরু কুঁচকে চোখ তুলল, স্বাতীর পিছন দিকের দেয়ালটা দেখতে দেখতে বলল— আমি যা-ই করি আর না করি, আমি তো আমিই থেকে যাব।
তোর বুঝি অন্য কেউ হতে ইচ্ছে করে? স্বাতী মুখ টিপে হাসল, নিজের তেরো-চোদ্দ বছরের জ্বালা-যন্ত্রণার কথা মনে করে।
ইচ্ছেতে আর কী হয় বলো? এরপরে, সেই দেয়ালে চোখ রেখেই, ডালিম আবার বললইচ্ছে করলেই কি আমি সত্যেনবাবু হতে পারি? স্বাতী জোরে হেসে উঠে বলল–এত লোক থাকতে ওঁকেই পছন্দ করলি?
বাঃ, সত্যেনবাবু খুব সুন্দর যে!
সুন্দর? আর এক দমক হাসল স্বাতী–এ-কথা পৃথিবীতে তোর আগে কেউ উচ্চারণ করেনি। আহা—লোক তো ফর্সা রং আর মাপজোক মতো নাক-চোখ হলেই সুন্দর বলে। কিন্তু আমরা বলি— না, লাবণ্যই আসল।
আমরা মানে কে কে?
ডালিম হেসে ফেলল তার একটু ফাঁক-ফাঁক দাঁত দেখিয়ে। চোখ সরিয়ে, ঠিক স্বাতীর মুখের উপর এনে বলল–তুমিই বলো ছোটোমাসি, সত্যেনবাবু সুন্দর না? একথার উত্তরে ছোটোমাসি ঠাট্টা করলেন—এ রকম বুঝি কোনোদিন কেউ দ্যাখেনি?
ডালিম গম্ভীরভাবে বলল—কাউকে দিয়ে আমি কী করব? আমি আমার চোখ দিয়েই দেখি। ওরেবাবা! স্বাতীর হাসিতে দিনটির সমস্ত আলো সুর হয়ে বেজে উঠল—এদিকে ওঁকে দেখলেই তো পালিয়ে যাস।
আমি আর কী কথা বলব ওঁর সঙ্গে? একটু চুপ করে থেকে স্বাতী হঠাৎ বলল—তোর বোধহয় অসুবিধে হয় এ ঘরে?
অসুবিধে? কেন?
বসবার ঘর তো–কখনো কেউ এলে—
ওঃ, আমি কি আর তেমন ছেলে যে সবসময় শুধু পড়ব বসে বসে! আর আসেই বা কে… মাঝে মাঝে সত্যেনবাবু হঠাৎ–থামল ডালিম, তক্ষুনি আবার বলল-তোমাদের হয় না তো অসুবিধে? স্বাতী বলল-বড্ডো। বাবার তো রাত্তিরে ঘুম হয় না এ কথা ভেবে যে তুই বুঝি একা ঘরে ভয়-টয় পেলি।
সে কী! গোঁফের ছায়া-পড়া ঠোঁট এমন করে বাঁকাল ডালিম যে দেখতে মিষ্টি হল—আমি ভয় পাব কেন?
আমিও তো তা-ই বলি। কিন্তু বাবা রাত্তিরে উঠে একবার দেখেই যাবেন কী জানি, বলা তো যায় না, তোকে যদি ভূতেই ধরে কি রাক্ষসেই খেয়ে ফ্যালে।
কী অন্যায়!
বাবার ইচ্ছে তুই তাঁর ঘরেই থাকিস। বলেন—এখানে তো অনেক জায়গা, আর আমি তো থাকিই না সারাদিন—
দাদু বড্ডো–
হ্যাঁ, বাবা বড্ডো। তা তুই কী বলিস? তার টেবিল, তার তক্তাপোশ, তার আয়না, তার ছিমছাম গুছোনো ছোট্টো রাজত্বটির উপর একবার চোখ ঘুরিয়ে এনে ডালিম বললো—আমি আমি… এখানেই থাকি.. কেমন, কেমন ছোটোমাসি? তারপর ইচ্ছার স্বপক্ষে একটু যুক্তিও উদ্ভাবন করে ফেলল—তোমাদেরও সুবিধে—কেউ এলে-টেলে তক্ষুনি খবর দিতে পারি।
মস্ত সুবিধে! স্বাতী হাসল, তারপর কড়া চোখে তাকিয়ে বলল—গল্প করেই কাটাবি দিনটা, না কি কলেজ আছে-টাছে? টেবিলের টাইমপিসটার দিকে একবার চোখ ছুঁড়ে ডালিম উত্তর দিল—এখনো দেরি আছে একটু। তোমাদের বেশ সকালে কলেজ—সারাটা দিন ছুটি পাও।–আমার ভালো লাগে না। ডালিম তক্ষুনি বলল—আমারও না! কোন ভোরে উঠতে হয়—! আচ্ছা ছোটোমাসি, সত্যেনবাবু তোমাদের কী পড়ান?
তুই যা একেবারেই পড়িস না, উনি তা-ই পড়ান। ডালিম চোখ দিয়ে হাসল।—বাঃ, আমি বুঝি কবিতা পড়ি না? দেখছ না আমার টেবিলে সঞ্চয়িতা?… নিশ্চয়ই খুব ভালো পড়ান উনি? আগে জানলে ওখানেই ভরতি হতাম, কিন্তু বাবা বলে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির কথা–বাবাও সেখানেই পড়েছিলেন—আর তার কথামতো সায়ান্সও নিয়েছি কিন্তু একটুও ভাল লাগছে না, ছোটোমাসি! ছোটোমাসি ধমক দিলেন—ভাগ, পালা এখন, আর আড্ডা নয়! দেরি হচ্ছে না কলেজের? ডালিম বই-খাতা হাতে কয়েকটি অনিচ্ছুক পা ফেলে দরজা পর্যন্ত এল। আবার দাঁড়িয়ে বলল—আজ কলেজ হবে কি না কে জানে?
কেন?
রবীন্দ্রনাথের যে রকম…
যাঃ! ও কথা মুখে আনতে নেই।
না, না, কাল সবাই বলছিল কিনা আর আজকেও তো কাগজে… আচ্ছা, যাই।—ডালিম যেন নিজেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল রাস্তায়।
******
স্বাতী একভাবেই বসে থাকল। আরাম লাগছিল তার, শরীরের আরাম, ঝিরঝিরে দুপুরের আরাম, খেয়ে উঠে একটু গল্প-টল্পের পর পরিপাকের মসৃণতার আরাম। বসে বসে ঝিমুনি এল-ঘুমই আসছিল, সত্যি বলতে-হঠাৎ ঘরের মধ্যে হালকা আওয়াজ শুনে চোখ বুজেই বলল—কী-রে, ফেলে গিয়েছিলি কিছু? উত্তর না পেয়ে স্বাতী চোখ খুলল, চোখ খুলেই ছিটকে উঠে দাঁড়াল–কী? কী হয়েছে? শুকনো মুখ, উশকো চুল, চাপা ঠোঁট আর না-কামানো গাল–এতদিনের মধ্যে কখনো স্বাতী দ্যাখেনি সত্যেন রায়ের এ রকম চেহারা। আর কথা যখন বললেন, আওয়াজটাও অন্যরকম শোনাল—শোনোনি এখনো?
কী?
সত্যেন চোখ তুলল স্বাতীর মুখে, চোখ নামাল মেঝেতে, বলল—রবীন্দ্রনাথ…। আর বলতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে স্বাতীর মাথাও নীচু হল, আর হাত দুটি এক হল বুকের কাছে। খানিক আগে যখন বড়দির চিঠি পড়ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ভঙ্গিটা সেই রকমই হল অনেকটা আর তার ঘাড়ের, কাঁধের, পিঠের গড়নে যেখানে তখন সুখের সুষমা প্রায় কথা বলছিল—সেই সব রেখাই দুঃখ আঁকল সেখানে, স্তব্ধ আনতি, দুঃখের আরও গভীর সুষমা। দুজনে দাঁড়িয়ে থাকল মুখোমুখি। কিন্তু মুখোমুখি না, কেননা দুজনেই নিচু-মাথা, আর দুজনেই চুপ। একটু পরে সত্যেন চোখ তুলল, স্বাতী তা দেখল না, কিন্তু সেও চোখ তুলল তখনই। প্রশ্নহীন শান্ততায় তাদের চোখাচোখি হল। সত্যেন রায় বললেন—চলো।
যাব? কোথায়?
যাবে না একবার দেখবে না?
নিশ্চয়ই। বলেই স্বাতীর মনে হল–কিন্তু বাবাকে না বলে?
চল তা হলে।
কিন্তু আপনি—এখন কোত্থেকে?
আমি ওখানেই—এখন আসতাম না—তোমার জন্য এলাম। তুমি তো দ্যাখোনি কখনো— দেখলে না—তবু যদি শেষ একটু…
সত্যেন রায়ের দাড়ি-গজানো শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাতী বলল—কিন্তু আপনার স্নানখাওয়া বোধহয়–
ও-সব এখন না— ঈষৎ ভঙ্গি হল সত্যেনের কাঁধে, ঈষৎ অসহিষ্ণুতার। আর দেরি না। চলো!
আপনি একটু কিছু খেয়ে নিন। কিছু খাননি সকাল থেকে?
না, না! একটু জোরেই বলে উঠল সত্যেন। মনে-মনে একটু খারাপ লাগল তার—যেন আঘাত লাগল—আজকের দিনে, এ-রকম সময়ে এসব তুচ্ছ খাওয়া-টাওয়া নিয়ে স্বাতীর এই ব্যস্ততায়। সকালে প্রথম পেয়ালা চায়ের পরে এ পর্যন্ত কিছুই খায়নি, তা সত্যি। কিন্তু তখন তার ক্ষুধাবোধ একটুও ছিল না, ক্লান্তিও না, আর কোনো চেতনাই তার ছিল না দুঃখের চেতনা ছাড়া। মহৎ, মহামূল্য, তুলনাহীন দুঃখ-কল্পনায় চেনা, সম্ভাবনায় পুরোনো, তবু বাস্তবে আশ্চর্য, আকস্মিকের মতো নতুন, অবিশ্বাসের মতো অসহ্য। সকালে গিয়ে যেই বুঝল যে আজই শেষ, তখনই স্থির করল শেষ পর্যন্ত থাকবে তারপর কেমন করে কাটল ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ভিড় বাড়ল, জোড়াসাঁকোর বড়ো বড়ো ঘর আর বারান্দা ভরে গেল, উঠোনে আরো। টেলিফোনে বসে গেঞ্জি গায়ে কে একজন ঘামতে ঘামতে খবর জানাচ্ছে চেঁচিয়ে—তাছাড়া চুপ, তাত লোকের মধ্যে কারো মুখেই কথা নেই, চেনাশোনারা পরস্পরকে দেখতে পেয়ে কিছু বলছে না, নতুন যারা আসছে তারা কিছু জিগেস না করেই বুঝে নিচ্ছে। অপেক্ষা, বোবা অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা কীসের? একবার, অনেকক্ষণ পর, একটু বসেছিল সে, বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা শব্দ শুনল—পাশের ঘর থেকে অনেকক্ষণ চেপে রাখার পর বুকফাটা ঝাপটা দিয়েই থেমে যাবার মতো, আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই তাকাল হাতের, দেয়ালের ঘড়ির দিকে, বারোটা বেজে কত মিনিট… কী যেন ফিশফিশানি উঠল। খানিক পরে যখন একবার করে ঘরে যাবার অনুমতি দিল সবাইকে—সেও গেল। মাথাটি মনে হল আগের চেয়েও বড়ড়া, প্রকাণ্ড কিন্তু শরীরটি একটু যেন ছোটো হয়ে গেছে, যদিও তেমনি চওড়া কব্জির হাড়, তেমনি জোরালো প্রকান্ড আঙুল। শেষবার সে চোখ রাখলো তার কতকালের চেনা সেই মুখের, মাথার, কপালের দিকে, মহিমার দিকে, একবার হাত রাখল হিমঠান্ডা পায়ে। আর সেই মুহূর্তটি যেই মনে পড়ল সত্যেনের, যেই দেখতে পেল মনের চোখে আবার সেই প্রকাণ্ড মাথার ক্লান্ত নুয়ে পড়া, অমনি তার বুক ঠেলে একটা গরম শিরশিরানি উঠল, মুখ ফিরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। মুহূর্তের চেষ্টায় আত্মস্থ হয়ে নিয়ে আবছা একটু হাসির ধরনে বলল—আচ্ছা, জল দাও এক গ্লাশ।
শুধু জল? স্বাতী তাড়াতাড়ি জল এনে দিল ডালিমের কুঁজো থেকে। জল খেয়ে সত্যেন বলল— আর দেরি না, চলো। তখন স্বাতী বলল, কিন্তু–আমি ভাবছি—
তোমার বাবার কথা ভাবছ? সত্যেন ঠিক আন্দাজ করল-অর্ধেকটা ঠিক—তিনি এসে পড়বেন এখনই। আপিশ সব ছুটি। স্বাতীর মুখ উজ্জ্বল হল—তাহলে, একটু দেরি করলে হয় না? বাবাকে বলে যেতে চাও? সত্যেন এবার ধরল পুরো কথাটা, আর আবার একটা ধাক্কা লাগল তার মনে। আজকের দিনেও নড়চড় হতে পারবে না কোনো নিয়মের? দৈনন্দিন বাধ্যতাকে একটু ভোলা যাবে না কোথাও? ভাবতে হবে অন্য সব দিনের মতোই অন্য সব কথা? কিন্তু সে তো আর কিছু ভাবেনি… ভিড়ের মধ্যে বেঁকে বেঁকে বেরিয়েই দৌড়ে বাস ধরে ছুটে এসেছে জোড়াসাঁকো থেকে টালিগঞ্জ, তক্ষুনি আবার টালিগঞ্জ থেকে জোড়াসাঁকো ছুটবে বলে। কিন্তু কেন? প্রশ্নটা সত্যেনের মনে উঠেই মিলিয়ে গেল, নিজের সঙ্গে সওয়াল-জবাবের অবস্থা তার নেই এখন, সময়ও না। বলল—তোমার বাবা কিছু বলবেন না, আমি জানি।
আমিও জানি।
তবে? স্বাতী জবাব দিলো না। সত্যেন বলল–তাহলে তুমি বরং থাকো। কিন্তু আমি আর থাকতে পারছি না। স্বাতী তক্ষুনি বলল—না, আমিও যাবে। ছুটে ভিতরে গেল, দু-লাইন চিঠি লিখে বামের মার হাতে দিল বাবার জন্যে, বদলে নিল জামা আর জুতো, হাতে নিল ব্যাগ, আর সত্যেন রায়ের সঙ্গে রাস্তায় নেমে প্রথমেই লক্ষ করল যে দিনটি এখনো তেমনি সুখী আর সুশ্রী আর উজ্জ্বল।
কালিঘাটের আগেই ভরতি হয়ে গেল বাস। তবু উঠছে… কলেজের ছেলে, মেয়ে, স্কুলের ছেলে, দোকানদার, বেকার, আড্ডা দিয়ে দিন কাটানো ছোকরা। দম আটকে আসে, এমন ভিড়। কিন্তু স্বাতীর লেডিজ সিট নিরাপদ আর সে বসেছে জানলাধারে, একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে। রাস্তায় বিকেলের মতো লোক, দলে দলে চলেছে স্কুলছেলেরা, হল্লা নেই। বুড়োমতো অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন কিছুই করবার নেই.. যে দোকানেই রেডিও চলছে তার সামনেই ভিড়। আর মোড়ে মোড়ে ছোটো ছোটো ভিড় কোনো একটা বাস-ট্রামে উঠতে পারার আশায়। সিনেমার দেয়াল-ছবি কালো কাগজে কাটা পড়েছে, দরজা বন্ধ। মেয়েরা, খোলা চুলে, বাচ্চা কোলে, দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, জানলায়, দেখে নিচ্ছে যতটা সম্ভব রাস্তাটাকে। রাস্তাতেই আজ সকলের চোখ, সকলের মন।
মেঘলা হয়ে এল দিন, চৌরঙ্গিতে আসতে আসতে বৃষ্টি নামল। কিন্তু এসপ্লানেডে এসে বাস দাঁড়াল যখন, আবার জ্বলজ্বলে রোদ আর সেই ভিজেনরম আলোয় স্বাতী দেখল ভিড়ের এক আশ্চর্য আলোড়ন, এসপ্লানেডের পক্ষেও আশ্চর্য। স্যুটপরা আপিশচাকুরে, কালোকোর্তা উকিল, ছাতাহাতে আধবুড়ো বাবুরা, ছিপছিপে ছোকরাকেরানি, ইংরেজ, চিনে, মান্দ্রাজি, পাদ্রি, পার্শি চৌরঙ্গি, ধরমতলা, কার্জন পার্ক, কর্পোরেশন স্ট্রীট-সব দিক থেকে আসা যাওয়া করছে সকলে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ঠিক যেন জানে না, একটু যেন দিশেহারা। আপিশ ছুটি হলেই সোজা বাড়ি ফিরতে হবে, এই মুখস্থ কথাটা অনেকেই যেন ভুলে গেছে। দেখতে যতই ছিন্নভিন্ন হোক, কলকাতার ভিড় কখনই লক্ষ্যহীন নয়, প্রত্যেকে জানে কোথায় যাচ্ছে আর কেন যাচ্ছে। কিন্তু সেই লক্ষ্য, লক্ষ্যের নিশ্চয়তা আজ হারিয়ে ফেলেছে সবাই—আর সেইজন্যই আশ্চর্য, অদ্ভুত এই ভিড়। সোজা দাঁড়িয়ে সোজা তাকিয়ে আছে কেউ, কেউ মিছিমিছি হাঁটছে, কেউ হঠাৎ যেন মনস্থির করে বারকয়েক পা ফেলেই থেমে যাচ্ছে আবার, কেউ কাগজ পড়ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আর তার ঘাড়ের উপর দিয়ে গলা বাড়িয়েছে আরো দু-তিনজন। এইমাত্র পৌঁছল কাগজের স্পেশল–হাতে হাতে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
সত্যেন, স্বাতীর পিছনে বসে, হাত বাড়িয়ে কাগজ কিনল। একবার তাকিয়েই স্বাতীকে দিল। স্বাতী একবার তাকিয়েই রেখে দিল কোলের উপর। তার পাশে বসেছিল যে বছর পনেরোর মেয়েটি, অনুমতি না নিয়ে সেটা হাতে নিল, তার চোখ নড়তে লাগল উপর থেকে নিচে, আর সেই চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল কালো-কথা-ছাপানো কাগজটার উপর, ছাপাখানার কাচা-কালি মুছে মুছে দিয়ে। জোড়াসাঁকোয় প্রায় খালি হয়ে গেল বাস। সকলে ছুটল দ্বারকানাথের গলির দিকে, কিন্তু সত্যেন রাস্তা পেরোতে গিয়ে থমকাল। দেখে গেল মানুষের জাঙাল—হল কী? কেউ নেই যে? —এর মধ্যে নিয়ে গেল? তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল কথাটা। হ্যাঁ, নিয়ে গেছে… দেখতে চান তো কলেজ স্ট্রীটে-বলতে বলতে চলে গেল একজন।
স্বাতী আগে কখনো আসেনি চিৎপুরে, অবাক হয়ে দেখছিল গলির মতো রাস্তায় ট্রাম-বাস-এর ঠেলাঠেলি। আবার ওরই মধ্যে আরো গলি, প্যাঁচালো, অন্ধকার, উঁচু-উঁচু বাড়ির আকাশটাকা ঘেঁষাঘেঁষি; ফুটপাতে অদ্ভুত ভিড় আর অদ্ভুত সব জিনিসের দোকান। প্রায় ভুলেই গিয়েছিল কেন এসেছে, মনে পড়ল সত্যেনের কথায় নিয়ে গেছে, চলো কলেজ স্ট্রীট। হাঁটতে পারবে না তাড়াতাড়ি? নামমাত্র ফুটপাতে গায়ে গায়ে ধাক্কা বাঁচিয়ে দ্রুতনিঃশব্দ হাঁটতে লাগল দুজন। ক-মিনিট পরে বেঁকল বাঁয়ে, ঢুকল মুক্তারামবাবু স্ট্রীটে। কলকাতার এসব পাড়া-স্বাতীর মনে হল—যেন অন্য দেশ, অন্য জগৎ। এর আলো, হাওয়া, এর গন্ধ পর্যন্ত অন্যরকম। এদিক ওদিক তাকাতে চাইল, কিন্তু ভাল করে দেখতে পারল না—এত তাড়াতাড়ি হাঁটছিলেন সত্যেনবাবু। লম্বা, বাঁকা, অন্ধকার মুক্তারামবাবু স্ট্রীট কর্নওআলিস স্ট্রীটে শেষ হল, আর একটু পরেই দেখা গেল কলেজ স্ট্রীট-হ্যারিসন রোডের মোড়। কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের ছাতে-ঢাকা ফুটপাতে সত্যেন দাঁড়াল, একটা জুতো-দোকানের সিঁড়িতে উঠল। আরো অনেকে দাঁড়িয়েছে সেখানে, বেশির ভাগ কলেজের ছাত্র। মুখে মুখে শোনা গেল, এক্ষুনি এসে পড়বে।
সত্যেন বলল—কষ্ট হল তোমার হাঁটতে?
ন্না।
মনে হচ্ছে কি, না এলেই পারতে?
না। কথা ফুরোল ওখানেই, আবার দুজন চুপ। উল্টোদিকে একটা একতলা দোকানঘরের কার্নিশছাড়া বিপজ্জনক ছাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরা তাক করে। পাশের দোতলার বারান্দায় মেয়েদের, বাচ্চাদের ভিড়, আশেপাশে একটা জানলা নেই, যেখানে তিন-চারটি করে মুখ না বেরিয়ে আছে, আর রাস্তায় কেউ চলছে না, সকলেই দাঁড়িয়ে। সত্যেন আবার অনুভব করল মনের উপর সেই অপেক্ষার, সেই বোবা অপেক্ষার চাপ।…আসছে…আসছে… গুনগুন রব উঠল ভিড়ের মধ্যে।
স্বাতী মনে মনে ভাবছিল লম্বা, গম্ভীর, আনত, আচ্ছন্ন, স্তব্ধ, মন্থর মিছিল, কিন্তু মাত্রই কয়েকজন যেন অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এল কাঁধে করে—নিয়ে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণে—পিছনে এলোমেলো অল্প লোক বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল স্বাতীর চোখের সামনে দিয়ে—বরাদুরে ঝিলিক দিল লম্বা সাদা চুল আর মস্ত সাদা শান্ত, তন্ময় কপাল! ঐটুকু দেখল স্বাতী, আর দেখতে পেল না। সত্যেন দেখল, স্বাতী দাঁড়িয়ে আছে শক্ত সোজা হয়ে, হাত মুঠো করে, ঠোঁটে ঠোঁট চাপা, দেখল তার কণ্ঠের কাঁপুনি, ঠোঁটের কাপুনি, গালের ঘন রঙ… দেখল তার তরল কালো উজ্জ্বল চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল হল, ঝকঝকে দুটি আয়না হয়ে উঠল, তারপর ভাঙল আয়না, আবার তরল হল, উপচোল, মাথা নিচু হল। আর তাই দেখে সত্যেনেরও নতুন করে গলা আটকাল, চোখ ঝাপসাল, আর সেজন্য লজ্জা করল নিজের কাছেই। এ মৃত্যু তো কান্না চায় না। এই দুঃখ, এই মহান, মহামূল্য দুঃখ, আশি বছরের পরম পরিশ্রমের এই সবশেষের রত্ন—এ কি চোখের জলে বাজে খরচ করবার?
চলো এখন— সত্যেন কথা বলল। সে যে কাঁদছিল তা লুকোবার চেষ্টা করল না স্বাতী, আঁচলে চোখ মুছল, কাশল একবার, একটু ভাঙা গলায় বলল-চলুন।
কিন্তু ট্রাম-বাস আকণ্ঠ। নানা রাস্তা দিয়ে, নানা রাস্তা ঘুরে সবাই ছুটেছে নিমতলার দিকে। অসহায় দাঁড়িয়ে রইল দুজনে, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে এল। স্বাতী বলল—হাঁটলে হয় না? একটু এগিয়ে গেলে হয়ত–
একটু এগোলে কিছু হবে না। এক যদি এসপ্লানেড পর্যন্ত—
এসপ্লানেড কি খুব দূর? স্বাতী, এ-অঞ্চলের ভূগোল-বিষয়ে অনিশ্চিত, জিগেস করল।
তেমন আর দূর কী— সোৎসাহে বলল সত্যেন-চিত্তরঞ্জন এভিনিউ দিয়ে… হাঁটবে তাহলে?
বেশ তো।
কলুটোলা পার হয়ে চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে পৌঁছতেই আকাশ কালো করে আবার বৃষ্টি নামল একেবারে হঠাৎ একটা পোর্টিকোর তলায় আশ্রয় নিল তারা। ঘোর বৃষ্টি, জোর নামল, ঝমঝম, আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চলে গেল একদল শান্ত নিঃশব্দ, গম্ভীর মন্থর চীনে। প্রত্যেকের মাথা নিচু, প্রত্যেকের হাতে ফুল, প্রত্যেকের খালি পা। যতক্ষণ দেখা গেল স্বাতী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তাদের। তারপর বলল—কী সুন্দর এরা! সত্যেন মাথা নেড়ে সায় দিল।
যাচ্ছে কোথায়?
নিমতলায়…নিশ্চয়ই।
নিমতলার নাম শুনেছিল স্বাতী, তাই বুঝল।—আপনি যাবেন না?
যেতাম–কিন্তু…
আমি বুঝি যেতে পারি না সেখানে?
তুমি যেতে পার, কিন্তু আমি নিয়ে যেতে পারি না।
কেন?
ভাবতে পার না কী ভিড়! স্বাতীর ভাল লাগল না কথাটা। মনে হল আজকের দিনেও সত্যেনবাবু বড়ো সাবধানী, ধরাবাঁধা, বড়ো নিয়ম মেনে চলা। এদিকে বৃষ্টি থামে না। আর একটি দল এল—সাহেব পাদ্রি, দাড়িওলা বুড়ো বুড়ো, লম্বা সাদা আলখাল্লা পরনে, হাতে ফুল, মুখে শান্তি, চোখে প্রার্থনা। ভিজতে ভিজতে চলে গেল। বৃষ্টি কমল, বৃষ্টি থামল, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে আবার রওনা হল তারা, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি… হাতে, ঠোঁটে, মাথায়। রোদ ফুটল, ভিজে কালো রাস্তায় চিকচিকোল বিকেলবাঁকা হলদে রোদ, ভিজে নরম হাওয়ায় ঝলমলাল।
সত্যেন বলল—ক্লান্ত লাগে তো বল, এখানে বাসে ওঠা যেতে পারে মনে হচ্ছে। স্বাতী বলল–বেশ তো লাগছে হাঁটতে। কথাটা বলেই অনুতাপ হল, অপরাধী লাগল, আজকের দিনে এরকম সময়ে কারও কি কিছু বেশ লাগতে পারে? না কি লাগলেই কেউ মুখে বলে? ভীরু আড়চোখে স্বাতী তাকাল সত্যেন রায়ের মুখের দিকে, কিন্তু বেশ-লাগার বিসদৃশতা শোকাচ্ছন্ন অধ্যাপক যেন লক্ষই করলেন না, বরং খুশি গলায় বললেন—তাহলে আর কথা কী! আবার চুপচাপ হাঁটল দুজনে, কিন্তু জোড়াসাঁকোয় বিফল হয়ে মুক্তারামবাবু স্ট্রীট দিয়ে যেমন চুপচাপ হেঁটেছিল, সে রকম না। তখন গতি ছিল দ্রুত, গলি ছিল সরু, মন উৎকণ্ঠ, আর এখন চোখের সামনে চিত্তরঞ্জন এভিনিউর উদার ঋজুতা-মস্ত চওড়া দিলখোলা রাস্তা, নিরিবিলি, ট্রাম নেই, মোটরগুলো যেন আলগোছে ভেসে যাচ্ছে চুপচাপ, দুধারে মস্ত উঁচু উঁচু বাড়ি, কিন্তু আরো মস্ত, আরো অনেক উঁচু এখানে আকাশ, আর রাস্তা এত ছড়ানো যে বাড়িগুলিকে হালকা লাগে—দুধারের বাড়ি যেন দু-পাড়ার-আর সমস্ত রাস্তাটির উপর কঁপছে, দুলছে, জ্বলছে বৃষ্টিধোয়া হলদে-সবুজ বিকেলের স্বচ্ছ, সূক্ষ্ম আভার একটি পরদা। আস্তে চলছে তারা, এখন আর তাড়া নেই… কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের জুতোদোকানের বারান্দায় পরমক্ষণ কেটে গেছে, কানে কানে টানা মনের ছিলা এখন ঢিলে। এখন সময় আছে তাকিয়ে দেখার—বিকেলের দিকে, আলোর দিকে, সুন্দর, উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার। অস্পষ্ট একটা সুখ মনের মধ্যে অনুভব করল স্বাতী। একটু পরে তার অপরাধবোধও থাকল না, কিন্তু মনের এই হাওয়াবদলের খবর নিজেই জানল না যেন, ভাবল না কিছু, বিশেষ কিছু ভাবল না, আস্তে ড়ুবে গেল নতুন সুখচেতনায়। আর সত্যেন-কবিতা-পাগল মানুষ, আবাল্য রবীন্দ্রপূজক, সেও অনুভব করল অস্পষ্ট একটা সুখ। রবীন্দ্ররহিত বাংলাদেশে শোকোচ্ছাসী কলকাতার উপরে যেমন এই মুহূর্তে আকাশের বিকারহীন তোরণে নীলিমার নিশান উড়ল, তেমনি এখন তার মনেও ঐতিহাসিক শশাকের গভীর কালো কবরটাকে ঢেকে দিল বর্তমানের, উপস্থিতের, জীবন্ত মুহুর্তের সবুজ—আর এতই সহজে যে সে নিজেই তা বুঝল না। এই আবছা-চেতন ভাললাগাটা দুজনেই মেনে নিল নিঃশব্দে—নিজেরটা… আর অন্যজনেরটাও। এর আগে তারা কথা বলেনি বলবার কিছু নেই বলে, আর এখন বলল না, যেহেতু দরকার নেই।
******
এসপ্লানেডে এসে আবার চাকার চিৎকার, জনতার আবর্ত, ছুটোছুটির ধাক্কা। অনেক থেমে থেমে রাস্তা পার হল। চৌরঙ্গিতে এসে সত্যেন বলল-চা খাবে?
আপনি তো কিছু খাননি সারাদিন—স্বাতীর মনে পড়ল।
তোমার দেরি হয়ে যাবে যদি মনে কর—
কত আর দেরি হবে?
তার মানে—ভীষণ দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই?
একথায় স্বাতীর মনে পড়ল যে বাড়ির কথা, বাড়ি ফেরার কথা, বাবার কথা এতক্ষণের মধ্যে একবার তার মনে পড়েনি। বাবা কী ভাবছেন? কতক্ষণ বেরিয়েছে? বেজেছে ক-টা? হোয়ইটওয়ে লেডর ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে—যাকগে। বলল–কোনটাতে যাবেন?
সারি-সারি ছোটো-ছোটো রেস্তোর, প্রত্যেকটা বোঝাই। মাঝখানে বড় একটা ইংরেজ হোটেল, রাস্তার দিকটা ঘষা কাচে আব্রু করা, রবর-মোড়া সিঁড়ি–সেইটিতে ঢুকে পড়ল স্বাতীকে নিয়ে সত্যেন। রাস্তার আলোভিড়গোলমালের উথালপাতাল থেকে হঠাৎ চলে এল মসৃণ, শব্দহীন, প্রশস্ত, গম্ভীর অন্ধকারে। আবার একটা নতুন গন্ধ পেল স্বাতী, কেমন একটা বিলেতি গন্ধ, শুকনো হালকা, গরম করা গন্ধ অচেনা, কিন্তু ভালো…ভালো। ফাঁকা ফাঁকা টেবিলের ধার দিয়ে দিয়ে একটা কোণ-টেবিলের দিকে যাচ্ছিল তারা, হঠাৎ এই যে আওয়াজ দিল একটা টেবিলে একলা বসা একজন। সত্যেন দাঁড়াল, হাত তুলল নমস্কারে। কিন্তু কোনো প্রত্যভিবাদন না করে ভদ্রলোক বললেন–কোত্থেকে? নিমতলা?
না, ও-পর্যন্ত আর–স্বাতী, চিনতে পারছো এঁকে—
স্বাতী চিনেছিল। কালো, অপ্রসন্ন, উশকোখুশকো ধ্রুব দত্ত বসে আছেন চেয়ারের মধ্যে ছড়িয়ে, আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট, সামনে গেলাশে ফিকে ব্রাউন পানীয়, যে রকম—হঠাৎ ঝলসাল স্বাতীর মনে যে রকম সে দেখেছিল চাং-আন রেস্তোরয় বুড়োমতো ফিরিঙ্গির সামনে। সত্যেনবাবুর নমস্কারের ব্যর্থতা লক্ষ্য করে সে আর অনুরূপ কোনো চেষ্টা করল না, শুধু মুখের নম্র ভাব দিয়েই বোঝাতে চাইল যে এই যশস্বীর সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য একবার তার হয়েছিল। কিন্তু সেটুকুরও দরকার ছিল না, ধ্রুব দত্ত লক্ষ্যই করলেন না তার উপস্থিতি। সত্যেনের দিকে তাকিয়ে বললেন–কেমন দেখলেন হায়-হায় কাণ্ড, হৈ-হৈ ব্যাপার? সত্যেন তখনই কোনো জবাব খুঁজে পেল না এ-কথার, আর ধ্রুব দত্ত তখনই আবার আরম্ভ করলেন—রবীন্দ্রনাথের জন্য দুঃখ হচ্ছে আমার। এত চেষ্টা করলেন ইওরোপে মরতে, এতবার বললেন, লিখলেন সে-কথা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত… আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি! তেতো, ছোট্টো হাসলেন ধ্রুব দত্ত, আর সেই মস্ত ফঁকা রেস্তোরয় আবছা আলোর চুপচাপের মধ্যে বড়ো চড়া আর কর্কশ শশানাল তার কণ্ঠ। সত্যেন কিছু বলতে যাচ্ছিল বোধহয়, কিন্তু পলকে বুঝে নিল যে ইনি কিছু শুনতে চান না, নিজের মনের জমানো কথাগুলো উগরোতে চান শুধু–সিগারেটে টান দিয়ে, কিন্তু পানীয়টাকে তেমনি ফেলে রেখে, একটু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতে লাগলেন কবি–আমি বেরিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ ঘুরলাম রাস্তায়-রাস্তায়, তারপর টিকতে না পেরে ঢুকে পড়লাম এখানে। ওঃ, কী একটা সুযোগ! যারা কথা ও কাহিনী ছাড়া কিছু রবীন্দ্রনাথ পড়েনি, পড়লেও বোঝেনি, বুঝলেও মানেনি, আর যে সব ধূর্ত, নির্বোধ, ধুরন্ধর তেলতেলে ঠোঁটে গুরুদেব আওড়ায়, অথচ যাদের সমস্ত অস্তিত্বটাই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধতা আর সেইসব অসংখ্য হুজুগনাচুনিরা, যারা সারা জীবনে কখনো জানবে না, জানতে চাইবে না, রবীন্দ্রনাথ কী, কেন, কেমন… সেই দেশসুদ্ধ সক্কলের কী একটা সুযোগ আজ! দশটা আই. এফ. এ. ফাইন্যালের সমান, একশোটা কানন-সাইগল একসঙ্গে! কাগজওলাদের পৌষমাস, মিটিংওলাদের মরশুম, ব্যবসাদারি বড়কর্তাদের নাম-ফাপানো হল্লা! কী উৎসাহ, কী হুটোপুটি, কী ফুর্তি! রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকা বা না-থাকায় কিছুই যাদের এসে যায় না, এই শোকের হোলিতে চরম মেতেছে তারাই! হাঃ! থেমে থেমে, প্রত্যেকটি কথা ভেবেচিন্তে, চড়া, কড়া, কর্কশ গলায় পূর্বসুরীর অন্ত্যেষ্টিভাষণ উচ্চারণ করলেন উত্তরসাধক, শেষ কণ্ঠধ্বনির পরে ঠিক জায়গায় থামলেন, সামনে ঝুঁকে হাত বাড়ালেন, অন্তঃস্থ করলেন কিঞ্চিৎ পানীয়, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এ বিষয়ে আর কিছু তার বলবার নেই।
সত্যেন কথাগুলি শুনছিল চুপ করে, শুনতে-শুনতে গম্ভীর হল তার মুখ, তারপর বিষণ্ণ, এমনকি একটু ব্যথিত হল। একটু পরে বলল–আচ্ছা, তাহলে হাত তুলল বিদায় জানিয়ে। আপনারা— ধ্রুব দত্ত হঠাৎ তাকালেন স্বাতীর দিকে, যেন এইমাত্র দেখতে পেলেন—এখানেই বসুন না। অস্বস্তি হল স্বাতীর, এর আগে সত্যেনবাবুর ঘরে এঁকে দেখে যেমন হয়েছিল তার চেয়েও বেশি, মুখ ফেরাল তখনই, তবু অনুভব করল মুখের উপর তীক্ষ্ম জুলজুলে চোখ আর তার ভয় হল যে সত্যেনবাবু না ও-টেবিলেই বসে পড়েন, তাই নিজেই এগিয়ে গেল কয়েক পা। আমরা একটু ওদিকে—বলে সত্যেনও এগোল। অনেকটা দূরে কোণঘেঁষা টেবিলে দুজনে বসল যখন, নিপুণভাবে চা ঢেলে, নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে, বাঁ হাতে একটি স্যাণ্ডউইচ খুলে স্বাতী বলল—তার পক্ষে একটু বেশিই গরম সুরে বলল—কবি হতে পারেন, বিখ্যাত হতে পারেন, কিন্তু মানুষ ভাল না। সত্যেন তখন পর্যন্ত ধ্রুব দত্তের কথাই ভাবছিল, একটু হেসে বলল-ভালমানুষ? মনের কথা যে মুখে বলতে পারে না, অন্যায়ের প্রতিবাদ পারে না, যার চক্ষুলজ্জা বেশি, সৎসাহস কম, আর সেইজন্য অন্যেরা যাকে যেমন-তেমন ব্যবহার করে সেই তো ভালমানুষ? বলতে বলতে নিজের কথাই মনে পড়ল সত্যেনের, ধ্রুব দত্তর কথার উত্তরে কিছু তার বলবার ছিল, বলা উচিতও ছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি আর এ রকম নিত্যই ঘটে তার জীবনে, মনে-মনে অনেক কষ্ট পায় সে জন্য। না, তা কেন—স্বাতী প্রতিবাদ করল। নিজে কষ্ট পেলেও অন্যকে যে আঘাত করে না, সে-ই ভালমানুষ। বলেই মনে পড়ল নিজের বাবাকে কিংবা বাবাকে ভেবেই কথাটা বলল।
সত্যেন তাকাল স্বাতীর দিকে, একটু তাকিয়ে থাকল। আবেগের উষ্ণতার রং লেগেছে তার মুখে, এতক্ষণের হাঁটাচলায় ঈষৎ বিস্ত চুল, চোখে আত্মবিশ্বাসের ঋজুতা। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম এত স্বাধীনভাবে কথা বলল সে। এই সেদিনও একটা বাধো বাধো ভীরুভাব ছিল প্রোফেসরের সামনে। এবার শিলং থেকে এসে অবধি বদল দেখছে সত্যেন—শিক্ষকের প্রাপ্য সমীহ মুছে গেছে মন থেকে-যদিও সপ্তাহে একদিন কলেজের অনার্স-ক্লাশে রীতিমতো দেখা মুচ্ছে আজকাল। সত্যেন চেষ্টা করেছে সেটা লক্ষ্য না করতে—অন্তত স্বীকার না করতে–কিন্তু এই মুহূর্তে স্বাতীর এই স্বচ্ছন্দ, প্রাণবন্ত প্রতিবাদে সেটা স্পষ্ট, মূর্ত, সংজ্ঞেয় হয়ে উঠল, সংজ্ঞাত হল সত্যেনের মনে—চোখ সরিয়ে নিল সে, চোখ নামাল চায়ের পেয়ালায়। আমি আমিই কি বজায় রেখেছি শিক্ষকের মাত্রা-মাপা সৌজন্য? এই দূরত্বলোপে, এই অন্তরালমোচনে আমিও কি সহকর্মী নই, আমিই কি দায়ী নই, উদ্যোক্তা নই? কী করছি আমি, কোথায় চলেছি? কেন ছুটেছিলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে জোড়াসাঁকো থেকে টালিগঞ্জে, অম্লত, অভুক্ত, শোকাচ্ছন্ন দুপুরবেলায়? রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু!—সে কি আমার পক্ষে এমন একটা ঘটনা নয়, যা আমাকে তখনকার মতো ভুলিয়ে দেবে অন্য সব, সব চেষ্টা, ইচ্ছা, উৎসাহ? তবু তো শেষ নিশ্বাস যখন পড়ল, শেষ প্রণাম করে যেই বেরিয়ে এলাম, তক্ষুনি আমার মনে পড়ল—ওকে। মনে হল আজকের এই মহান অভিজ্ঞতার অংশ ওকে দিতেই হবে, আর সেটা আমার কর্তব্য, আমারই দায়িত্ব…কিন্তু কেন?… কিন্তু কেন?–কেমন একটা লজ্জায়, বিক্ষোভে, আত্মপীড়নে মাথা নুয়ে পড়ল সত্যেনের, আর সেই ভাবটা লুকোবার জন্য চায়ে চুমুক দিতে লাগল ঘন-ঘন।
সত্যেনের এই অনুচিন্তনের সমস্তটুকুতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগল না। স্বাতী তাই, তার সঙ্গীর কোনো ভাবান্তর না বুঝে পরের কথাটি তেমনি স্বচ্ছন্দে বলল–নিজের দেশে বুঝি কিছুই ভাল দেখতে পান না উনি? সত্যেন হঠাৎ বুঝল যে ধ্রুব দত্ত নিছক সত্য বলছেন, তার শোক অনেক বেশি পবিত্র, তাঁর রবীন্দ্রভক্তি অনেক বেশি নিষ্কাম আর কথাগুলি শুনতে তার—সত্যেনের—যে খারাপ লাগছিল তার কারণ তার সাময়িক ভাবালুতা, তার কারণ তার মনেও আজকের গণােন্মাদের সংক্রমণ। মুখ তুলে বলল-ভাল না থাকলেও ভাল দেখতে হবে? কিন্তু… স্বাতী তর্ক তুলল–দেশের দোষ তিনি যেমন বোঝেন নিজের দোষও কি তেমনি? নিশ্চয়ই! মৃদু হাসল সত্যেন। পর-পর তার চারখানা কবিতার বই-ই তো তার প্রমাণ। নিজের প্রতিটি দোষ কাটিয়ে ওঠার, নিজেকে প্রত্যেকবার ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টায় কখনো তার ক্লান্তি নেই। আর বোঝে তো, প্রায় মাস্টারি সুর লাগল শেষ কথাটায়, নিজের দোষ নিজে দেখতে পাওয়া কত শক্ত, আর কত কষ্টের।
লেখার কথা জানি না, কিন্তু তার নিজের দোষ যে কত তা কি তিনি বোঝেন?
নিজের দোষ মানে? আর তার কথা তুমি জানই বা কী? এবার প্রায় কঠোর হল সত্যেন।
স্বাতী হঠাৎ জিগেস করল-উনি যেটা খাচ্ছেন সেটা কী?
উনি ওসব…ওসব ব্যবহার করেন বোধহয়— সত্যেন গম্ভীর জবাব দিল।
স্বাতী থামল একটু। সে যা ভেবেছিল, কিন্তু ভাবতে চায়নি, তা-ই তাহলে সত্যি! কবি ধ্রুব দত্ত বসে-বসে তাই খাচ্ছেন, সোজা বাংলায় যাকে বলে মদ? মাঝারি ঘরের সব বাঙালি মেয়েরই মতো স্বাতী ছেলেবেলা থেকেই ঐ বস্তুটাকে বিভীষিকা বলে জেনেছে–আর যদিও সম্প্রতি বিদেশী বইয়ে এর একটা অন্যরকম ছবিও সে পেয়েছে, তবু সেটা যেন অন্য জগতের, ইংরেজিতেই ভালো শোনায়, বাংলায় কথাটা শুনলেই তার গা শিউরে ওঠে। শুনেছে অনেক, শরৎচন্দ্রেও পড়েছে, ফিল্মেও দেখেছে, কিন্তু জলজ্যান্ত একজন মানুষকে বসে-বসে মদ খেতে চাক্ষুষ দেখল বলতে গেলে এই প্রথম। আর সে মানুষ কে? একজন কবি। আর সময়টা কখন? যখন কয়েক ঘন্টা আগে কবিতার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে, আর সমস্ত দেশ আত্মহারা… চমৎকার সময় এ-সবের! মনের কথাটা সে মুখে বলে ফেলল। আমরাও তো চা খাচ্ছি বসে বসে, সত্যেন মৃদুস্বরে বলল—ওতে কী আছে? স্বাতীর ভাল লাগল না সত্যেনবাবুর মুখে ধ্রুব দত্তর এই সমর্থন। উনি নিজেও কি ঐ দলে? উনিও কি মাঝে মাঝে ব্যবহার করেন ও-সব? কবিতা ভালো, কবিতা খুব ভালো, কিন্তু বোকারা যা রটায়, তারও কি কোনো ভিত্তি আছে তাহলে কবিতা যারা বানায়, কবিতা নিয়ে দিন কাটায়, তারা কি সকলেই একটু …একটু?
তাছাড়া– সত্যেন আবার বলল—কাউকেই কিছু বলবার থাকলে সামনেই বলতে হয়, আমরা এখন যা করছি তাকেই ইংরেজিতে বলে ব্যাকবাইটিং, আক্ষরিক অর্থেই তা-ই—বলে তাকাল অনেকগুলি কঁকা টেবিল পেরিয়ে ধ্রুব দত্তর পাঞ্জাবি-ঢাকা পিঠের দিকে। স্বাতী অনুসরণ করল সত্যেনের দৃষ্টি। সে যেখানে বসেছিল, সেখান থেকে মুখেরও একটুখানি দেখা যাচ্ছিল, আর পেঁচিয়ে-ওঠা সিগারেটের ধোঁয়া, আর মাত্র ওটুকু থেকেই স্বাতী বুঝে নিল যে ভদ্রলোকের সমস্ত মন এখন একান্তনিবিষ্ট সামনে রাখা ঐ গেলাশটার উপর। যেন ধাক্কা খেয়ে সরে এল তার চোখ, পড়ল সত্যেনের অন্যমনস্ক মুখে, দেখল সে মুখে সরলতা, সতো, শান্তি… দেখল বিশ্বাসের আশ্রয়, শ্চয়তার আশ্বাস—আর একটু আগে কবিভাবের মানুষদের বিষয়ে যা ভেবেছিল তার জন্য অনুশোচনায় মেঘলা হল চোখ, আর সেটা মিথ্যা জেনে চোখের মেঘ কেটে গেল। সত্যেন, যেন তার দিকে স্বাতীর চোখের নিবিড়তা বুঝতে পেরেই ফিরে তাকাল, আর স্বাতী চোখে চোখ পড়তেই হেসে ফেলল—আকস্মিক, অবান্তর, এমন কি একটু অসংগত হাসি।
সত্যেন ভুরু কুঁচকে বলল–কী?
কিছু না। আপনার সব কথাই ঠিক, কিন্তু একটা কথা আমি বলবই-ভদ্রলোকের চোখের তাকানোটা ভালো না, বলে আর একবার তাকাল ধ্রুব দত্তর পিঠের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে ধ্রুব দত্ত উঠলেন কোনো দিকে না তাকিয়ে, লম্বা শরীরে একটু কুঁজো হয়ে; দ্রুত বেরিয়ে গেলেন কেমন এলোমেলো, অস্থির, লক্ষ্যহীনভাবে। সত্যেন তাকিয়ে থাকল ঐ চলে যাওয়ার দিকে, তারপর বলল—এটা একেবারেই ভুল বললে। ওঁর চোখেই তো ওঁর প্রতিভা কিন্তু এ কথা আর না, অন্য কিছু বললা। কিন্তু স্বাতী তখন ধ্রুব দত্তর অভদ্র চোখের কথাই ভাবছিল।
সত্যেনই অন্য কথা পাড়ল—ডালিমকে দেখেছিলে তখন?
ডালিমকে? কখন?
যখন কলেজ স্ট্রীটে দাঁড়িয়েছিলাম। একটা বাসে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছিল। আমাদের দ্যাখেনি, বেশ ছেলে ডালিম। শেষের কথাটা খামকা শশানাল—মানে, যথেষ্ট শোনাল না স্বাতীর কানে। জিগেস করল—কেন? বেশ কেন? সত্যেন একটু দেরি করে জবাব দিল—কোনো কারণে নয়, এমনি। ধ্রুব দত্ত সেখান থেকে চলে যাওয়াতে স্বাতীর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ সম্পূর্ণ হয়েছিল, চেয়ারে হেলান দিয়ে আরামে বসে বলল—কাউকে বরবাদ করার যে-কটা উপায় আছে তার মধ্যে একটা হল ঐ বেশ কথাটা।
সত্যেন হেসে বলল—অন্যের মুখে বেশ শুনতেও ভাল লাগে না—না?
তার মানে?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সত্যেন বলল-আর, তোমার বড়দি, তিনি কেমন আছেন?
বড়দির কথা আপনি মাঝে-মাঝেই জিগেস করেন, কেন বলুন তো?
মাঝে-মাঝেই মনে পড়ে বলে।
কিন্তু কতটুকুই বা দেখেছেন আপনি ওঁকে!
সেইজন্যই বোধহয়।
বেশি দেখা হলে মনে পড়ে বুঝি কম? স্বাতী খুব যুক্তিসংগত প্রশ্ন করল একটা।
যেটা নেই, সেটাই আমাদের মনে পড়ে। যেটা আছে, সেটা তো আছেই।
স্বাতী বলল–তাহলে তো নেই-টাই ভাল।
কেন? মনে পড়াটাই ভালো বুঝি? স্বাতী একটু ভাবল। তার তরুণ জীবনে একটুখানি যে স্মৃতির চর পড়েছে, সেই নতুন নরম মাটির গন্ধ নিল মনে মনে। বলল—ভালো না? খুব ভাল। আর এটা?
কোনটা?
যেটা আছে… হচ্ছে।
কী জানি! স্বাতী, ঈষৎ লাল, হাসল।
এই তত অসুবিধে আমাদের–সত্যেন হেলান দিল চেয়ারে—যে সব সময়ই আমাদের চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। যেটা আছে, হচ্ছে, সেটা আমাদের কাছে কিছুই না; আমাদের সুখের সময়গুলিকে আমরা বুঝতে পারি, তখন-তখন না, পরে—অনেক পরে; আর তাই সব সময় মনে হয় যা হয়ে গেছে তার মতো আর হল না, হবে না—এটা অবশ্য একটু হেসে জুড়ে দিল—আমার নিজের কথা না, নতুনও না, কিন্তু পুরোনোকেই নতুন লাগে যখন সেটা জীবন দিয়ে বুঝি। সত্যেন কথা শেষ করে পিঠ সোজা করল, পেয়ালা হাতে নিল, পেয়ালা খালি করে রুমালে ঠোঁট মুছল। সারাদিনের উপবাসভঙ্গের প্রভাবে, চায়ের তাপে, স্বাতীর চোখের উষ্ণতায় সত্যেনের খুব বেশি জীবন্ত লাগছিল নিজেকে, ভাল লাগছিল বসে থাকতে, দেখতে, শুনতে, বলতে। আর তার কথা শুনে স্বাতী ভাবল এটাই আমার সুখের সময়ের একটা নয় তো? এখন বুঝি না, পরে বুঝব? কিন্তু এখনই বুঝতে চাইল স্বাতী, চেষ্টা করল হাতে হাতে চোর ধরতে—আর তখনই ধিক্কার দিল নিজেকে যে সমস্ত দেশের এত বড়ো একটা শশাকের সময়কে নিজের একটি সুখের সময় বলে কল্পনা করতে পেরেছিল। কিন্তু সত্যেনবাবুরও মুখে-চোখে দুঃখের কোনো চিহ্ন তো আর নেই।
বাসন সরাল, বিল শোধ হল, সে থাকার আর কোনো কারণ থাকল না, তবু সত্যেন দেরি করল। এতক্ষণে তার চোখে পড়ল যে রেস্তোরয় ভিড় বর্ধিষ্ণু, আলো উজ্জ্বলিত, আর ঢুকেই যে কজনকে দেখেছিল তার সকলেই প্রস্থিত। চারদিক ভ্রমণ করে ফিরে এল তার চোখ, খুব সহজে, হালকাসুরে যেন আগের কথার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ আছে, এমনিভাবে বলল—
একটু যেন ব্যস্ত হয়েছিলে তখন?
ব্যস্ত, কখন? কীসের?
শিলঙে তোমার শেষ চিঠি যেটা পেয়েছিলাম–
এই প্রথম সে চিঠির কোনো উল্লেখ করল সত্যেন। এর আগে একবারও করেনি—আর সে জন্য স্বাতী কৃতজ্ঞ ছিল মনে মনে। চিঠিটা পাঠিয়েই লজ্জা করছিল তার, আর তার ঠিক চারদিন পরে সত্যেনবাবু যখন এলেন, আর এসেই দেখা করলেন তার সঙ্গে, তখন আরো বেশি লজ্জা করছিল—কিন্তু সত্যেনবাবুরও কোনো কথায় কি ব্যবহারে যখন বোঝাই গেল না যে সে চিঠি তিনি পেয়েছিলেন, তখন স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো তার; এমনকি—যদিও মনের কোনো গভীর অংশে নিশ্চয়ই জেনেছিল যে তার চিঠি ভ্রষ্ট হয়নি, ব্যর্থ হয়নি, কেননা ছুটির বাকি ক-দিনও উনি কাটিয়ে আসতেন তাহলে—তবু নিজের কাছে এরকম একটা ভাণও সে করছিল যে সেচিঠি পৌঁছয়নি, বাঁচা গেছে, আপদ চুকেছে! আর এখনও যদিও তার মুখের তপ্ত-লালিমা তার মাথাটাকে নুইয়ে দিচ্ছিল বুকের কাছে, চোখের পাতা টেনে দিচ্ছিল চোখের উপর, তবুও সেই ছলনাই তাকে আত্মরক্ষার শক্তি দিল, স্পষ্টই প্রশ্ন করল কোন চিঠি?
যেটাতে লিখেছিলে আমাকে–চলে আসতে।
আপনি সেটা পেয়েছিলেন?
তুমি কি ভেবেছিলে পাইনি?– সত্যেন, সরল পুরুষ, শক্তি বাড়িয়ে দিল ছলনায়।
কী জানি! স্বাতী আত্মস্থতা ফিরে পেল, উদাস চোখে তাকাল, একটা নিশ্বাস ছাড়ল গোপনে, খুব গোপনে..বড্ড ভয় পেয়েছিল তখন, দম আটকে আসছিল। যাক… মজুমদার, আর যাই হোক, এটুকু ভদ্রতা অন্তত করেছে যে তারপর আর আসে না, দাদার কাছেও না, আর দাদা….দাদা এখন খুব গম্ভীর, এর মধ্যে আটটা-দশটা কথাও বোধহয় বলেনি তাকে … তা, তা-ই ভালো, রাগই লক্ষ্মী। কী ভীষণ চেহারা নিয়েছিল তখন, অথচ কত সহজেই মিলিয়ে গেল। ছোট্টো হাসি ফুটল স্বাতীর ঠোঁটে, মুখ নিচু করল লুকোতে।
এদিকে সত্যেন ভাবছিল সেই চিঠিটার কথা, চোখে দেখছিল কাগজটার নীল রং, নিশ্বাসে পাচ্ছিল তার ঝাপসামতো গন্ধ, পাঠ নেই, কয়েকটি… মাত্র কয়েকটি কথা, আর তলায় সেই নাম, সুন্দর নাম, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নাম। ফেরার পথে সমস্ত রাত ঐ চিঠির কথাগুলি ট্রেন-চাকার তালে তালে তার মাথায় ঘুরেছে, কেমন একটা অস্বাভাবিক সুখের স্রোত হয়ে চলতি ট্রেনের আবছাঘুমের ফাঁকে-ফাঁকে বয়ে গেছে আর সেই স্রোত, সেই গৃঢ় গোপন সুখ. সেই অতিসূক্ষ্ম অস্বাভাবিক কম্পন—যদিও বাইরে কিছু বোঝা যায় না, আর তার দিনরাত্রি তেমনি নির্দিষ্ট নিয়মেই কাটছে–এখনো তার মনের তলায় থেমে যায়নি… আর এখন, এই মুহূর্তে সেটা যেন উপরদিকে উঠে এল, কোনো একটা কথা হয়ে ফুটতে চাইল সত্যেনের মুখে, কিন্তু কথাটা ভাষায় তৈরি হতে যে সময়টুকু লাগল, সেই ফাঁকে স্বাতী বলে উঠল—এখন উঠলে হয় না?
হ্যাঁ, চলল। বাইরে প্রায় সন্ধ্যা, আবার মেঘলা, বৃষ্টি টিপটিপ, ট্রামে ভিড়। স্বাতী বসতে পেল লেডিজ সিটে, আর সত্যেন দাঁড়াল যদিও তার ঠিক পিছনেই, তবু কথাবার্তা অসম্ভাব্য জেনে–কিংবা ইচ্ছে করে–সে রকম চেষ্টা করল না একজনও। স্বাতী বসে বসে ভাবল যে দু-মাস আগেও সে যেন ছেলেমানুষ ছিল, বোকা ছিল, এখন সে ঠিক-ঠিক নিজেকে পেয়েছে, খুঁজে পেয়েছে সেই নিজেকে, যার মতো হতে সবচেয়ে বেশি তার ইচ্ছা। আর এক-একবার বাইরের স্রিয়মাণ সন্ধ্যার দিকে, এক-একবার স্বাতীর আলগা হওয়া, কাঁটা বেরিয়ে-পড়া মস্ত খোঁপার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সত্যেন ভাবল যে স্বাতীকে ঐ চিঠির বিষয়ে যে কথা সে জিগেস করেছিল, তার কোনো উত্তর পায়নি।
******
স্বাতী স্তম্ভিত হল বাড়ি ফিরে বাবাকে দেখে। বাবাকে এত অভিভূত করেছেন রবীন্দ্রনাথ! বাবার মুখ কালো, ঠোঁট শুকননা, চোখ যেন গর্তে বসা। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বলল—রামের-মা চিঠিটা দিয়েছিল তোমাকে? রাজেনবাবু মাথা নাড়লেন।
দেরি হল আমার-না? এবারেও বাবা যখন কথা বললেন না, কিছু জিগেস করলেন না, কী রকম একটা সন্দেহ হল স্বাতীর-বাবা, তুমি…তোমাকে..বাবা, কী হয়েছে?
একটা টেলিগ্রাম এসেছে।
টেলিগ্রাম? কই দেখি বলতে-বলতেই স্বাতীর চোখে পড়ল বাবার হাতের কাছে পড়ে থাকা ফ্যাকাশে রঙের খামটা। তুলে নিয়ে এক পলক পড়ল, তারপর বাবার দিকে তাকাল। বাবা কিছু বললেন না। স্বাতী জিগেস করল—স্ট্রোক কাকে বলে, বাবা?
অসুখ— স্বাতী যা বুঝেছিল রাজেনবাবু তার বেশি বললেন না।
খারাপ অসুখ?
ভাল না–মেয়ের দিকে তাকালেন না বাবা।
ডালিম—? স্বাতী এদিকে ওদিকে তাকাল।
ফেরেনি এখনও।
ওর তো আজই যাওয়া চাই। কিন্তু গাড়ির কি সময় আছে?
সময় বদলেছে, নটায় আজকাল। ও যদি আটটার মধ্যে না ফেরে—
আসবে-এক্ষুনি আসবে—সকলেই তো আজ…কিন্তু আটটার মধ্যে ঠিক এসেই পড়বে।
তাহলে আমিই চলে যাব— রাজেনবাবু তার কথা শেষ করলেন।
তুমি–তুমি কেন–না, না যাবে বইকি, তোমাকে দেখলে কত ভালো লাগবে বড়দির-অসুখটা কি খুবই খারাপ?
রাজেনবাবু উত্তর দিলেন না।
খারাপ—খুব খারাপ—কত আর খারাপ–ঘরের মধ্যে ছটফট করে হাঁটতে-হাঁটতে স্বাতী বলতে লাগল—মানুষের কি শক্ত অসুখ করে না…করেও, সেরেও যায়–তুমি অত ভাবছ কেন, ওখানকার ডাক্তাররা যদি না পারে এখানে চলে আসুক-হাঁ, তা-ই তো ভাল, কলকাতায় কত বড়ো-বড়ো ডাক্তার—সব অসুখ সারাতে পারেন তাঁরা… হঠাৎ থেমে গেল স্বাতীর কথা, ছুরির খোঁচার মতো মনে পড়ল যে কলকাতার ডাক্তাররা যদি সব সারাতে পারত তাহলে মা…আর রবীন্দ্রনাথ…। অথচ চুপ করে থাকতে পারছিল না কিছু না-বলা চুপচাপটা যেন অসহ্য, তাই আবার বলল—কখন এসেছে টেলিগ্রাম?
এই—দুটো।
তুমি কখন ফিরেছ?
তার একটু আগে।
দুটো! চার-পাঁচ ঘণ্টা! এতক্ষণ বসে আছেন বাবা এই দুশ্চিন্তার ভার নিয়ে একলা! আর আমি… ছোড়দিকে খবর দিয়েছ?
হরিকে পাঠিয়েছিলাম–বাড়ি ছিল না। আজ তো সবাই—
এখন আবার পাঠাও।
থাক, এখন আর ওকে ব্যস্ত করে কী হবে? এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে ফিরবে!—রাজেনবাবু তাকালেন পুরনো হলদে হওয়া দেয়ালঘড়ির দিকে।
দাদা?
রাজেনবাবু কথা না বলে হাত ওল্টালেন।
দাদা এলেও তা—দুটোর সময় এসেছে টেলিগ্রাম, না?—তা–তুমি চা খেয়েছ? হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল স্বাতীর।
দিয়েছিল।
এ থেকে ঠিক বোঝা গেল না বাবা খেয়েছিলেন কি খাননি; কিন্তু ও বিষয়ে আর কিছু বলা, কি আবার চা দিতে বলা—অর্থহীন লাগল, সব কথাই অর্থহীন লাগল। স্বাতী আর একবার টেলিগ্রামটা পড়ল, উল্টে-পাল্টে দেখল, তারপর যেন বাইরের ঘরে শব্দ পেয়ে ছুটে গেল ডালিমকে কিংবা দাদাকে আশা করে—কিন্তু না—কেউ না। রাজেনবাবু উঠলেন, হোল্ডলে ডালিমের বিছানা বাঁধালেন হরিকে দিয়ে, আর শতরঞ্চিতে জড়িয়ে নিলেন সুজনি, বালিশ আর নিজের দু-একটা জামাকাপড়।
স্বাতী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, তারপর বলল— তুমি যাবে, বাবা?
দেখি।
হ্যাঁ, বাবা, তুমি যাও—আমার জন্য ভেব না—আমি থাকতে পারব।
তুই না হয় শাশ্বতীর ওখানে—
কেন? হরি আছে, রামের-মা আছে—কী হবে আমার? আর তুমি তো চলেই আসবে, আর জামাইবাবুও সেরে উঠবেন— বলতে বলতে বাধা বিছানা দুটোর দিকে তাকিয়ে ভীষণ ফাঁকাফাঁকা লাগল স্বাতীর, কেমন একটা দমবন্ধ-করা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল সারা বাড়িতে। সব তৈরি করে রাজেনবাবু আবার বসলেন চুপ করে, আর স্বাতীরও সব কথা ফুরিয়ে গেল, নিজেকে তার মনে হল একটা নিংড়োনো ভিজে গামছার মতো, আর ঘরের মধ্যে টিকটিক করতে লাগল হলদে বুড়ো-ঘড়িটা।
ডালিম ফিরল আটটার আগেই। জামাকাপড় কাদায় মাখামাখি, মুখে বিজয়ীর নম্র হাসি। ছাড়েনি সে, নিমতলা গিয়েছিল, ঢুকেছিল, মানুষের চাপে মরে যেতে যেতেও হেরে যায়নি, আর ফিরতে ফিরতে ভেবেছে কী রকম করে বলবে সব ছোটোমাসিকে, আর ছোটোমাসি কী-রকম অবাক হতে-হতে শুনবে। ছোটোমাসি-ডাকতে ডাকতে সে ঘরে এল, আর ঢুকেই থমকে দাঁড়াল দরজার কাছে। ছোটোমাসি এলিয়ে আছে খাটে, আর দাদুর মুখ যেন কেমন, আর মেঝেতে দুটো বিছানা বাঁধা—কেন?
ডালিমের তৈরি হতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগল না। কোনোরকমে স্নান-গায়ের কাঁদাও উঠল না–আর খাবার সামনে একবার বসল আরকি। তার যে ভীষণ একটা উদ্বেগ হচ্ছিল তা নয়, কিন্তু বাবার অসুখের জন্য এখুনি তাকে যেতে হচ্ছে, হঠাৎ এত বড় একটা দায়িত্ব পেয়ে তার আত্মমর্যাদা বেড়েছিল অনেকখানি, আর তারই ফলে চরমে উঠল তার ক্ষিপ্রতা, আর তাকে দেখতেও হল গম্ভীর, খুব গম্ভীর। বুদ্ধি করে বলল—কিছু ফল-টল নিয়ে যাব শেয়ালদা থেকে? একথার উত্তরে রাজেনবাবু বললেন–ট্যাক্সি এসেছে। চলো–বলে নিজেই এগোলেন।
আপনি—আপনি কেন?
তোমাকে তুলে দিয়ে আসি–
না–না—কিচ্ছু লাগবে না—আমি বুঝি– বাঃ! ডালিম প্রায় হাত দিয়ে ঠেলে দিল দাদুকে, তারপরেই নিচু হয়ে প্রণাম করল আর তার ছোটোমাসির দিকে একবার তাকিয়েই লাফিয়ে উঠে বসল ট্যাক্সিতে। এতক্ষণে স্বাতী জিগেস করল—বাবা, তুমি গেলে না? গেলাম না তো। দেখি–কাল-এতক্ষণে রাজেনবাবু মেয়ের দিকে ভাল করে তাকালেন।