কী দশা হবে? ঐ বইয়ের মতো? কিন্তু ও-বই তো বিশ্বজয়ী। ঘর ছাড়িয়ে, বারান্দা পেরিয়ে, উঠোনের সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে আটকে গেছে কীটসের কবিতা। মলাটের দুই ডানা ছড়িয়ে, মুখ থুবড়ে, শিকার-করা পাখির মতো; বিকেলের বাঁকা রোদুরে চিকচিক করছে কবির নাম, সোনালি অক্ষর… সোনালি স্বাক্ষর। স্বাতী তুলে নিল তাকে, কোলে তুলে আঁচলে মুছল, মলাট খুলে একবার দেখল যেখানটায় সত্যেন রায়ের নাম লেখা, তারপর কান-দুমড়োনো পাতাকটিতে আঙুলের চাপ দিতে দিতে ভাবল যে কখনোই, কোনো কারণেই এতখানি রাগা উচিত না, যাতে কোনো বই ছুঁড়তে গিয়ে লেখকের নাম চোখে পড়ে হাত থেমে না যায়।…দাদাটা একটা চঁড়াল। তবু ভাগ্যিশ বাবা বাড়ি ছিলেন না, জানবেনও না কিছু! পাছে বাবা এক্ষুনি এসে পড়েন, এসে তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করেন—কী রে? কী হয়েছে? আর সেও ঝোকের মুখে সব বলে ফ্যালে, স্বাতী তাড়াতাড়ি তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল, স্নানের জলে ধুয়ে ফেলবার চেষ্টা করল সব ঝাল, ঝাঁঝ, জ্বালা। নিজেকে দোষ দিল বার বার, দাদার পক্ষ নিয়ে অনেক কথা বলল মনে-মনে। সে-সব কথায় বাঁধুনি এত সুন্দর, যুক্তি এত নিখুঁত যে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তার নিজেরই বিশ্বাস জন্মাল তাতে। সে দেখতে পেল যে দাদার উপর একটা অন্যায় আছে এই বাড়ির, অবহেলার অন্যায়। ছেলেবেলা থেকে সকলের অবহেলার চিমটি খেয়ে-খেয়ে দাদা এইরকম খ্যাপা-মতো হয়ে গেছে। এখন উঠেপড়ে লেগেছে টাকায় টেক্কা দিতে—বেচারা! স্বাতী দেখল–সাপের মতো লিকলিকে আঙুল আর দেখল না, বেড়ালমতো দাঁতে-নখে ছিঁড়ে-খাওয়া রগ-ফাটা রাগ আর দেখল না—দেখল, দাদা হাত পেতেছে তার কাছে। বাড়িতে আর-কারো কাছে, বোধহয় বাইরেও কারো কাছে যে-পাত্তা সে পায় না, তারই জন্য হাত পেতেছে বাড়ির সেই একমাত্র মানুষের কাছে, যে তার বয়সে আর সম্পর্কেছোটো। গায়ে-পড়ে যেমন ঝগড়া করে, গায়ে-পড়ে কথাও বলে ওই আবার; নানা ছুতোয় এই কথাই যেন বলতে চায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাকে মানো, দাদা বলে না হোক, মানুষ বলে মানন, বয়স্ক বলে, ভদ্রলোক বলে, পুরুষ বলে মানো।
স্বাতীর অনুশোচনা হল। সত্যি-তো, দাদার উপর তারও তাচ্ছিল্যের শেষ নেই, যখন-তখন যাচ্ছেতাই বলে, কোনো কথায় আমলেই আনে না ওকে। হয়তো সে যদি ওর সঙ্গে আড়ে চলতে পারত; যদি, ধরো সে বড়দির মতো হত, ঐ রকম ঠাণ্ডানরম ঝিরিঝিরি, তাহলে দাদা হয়তো ভালই হত—মানে সুখী হত, আর বাবাও সুখী হতেন তাতে, বাড়িতে এই অশান্তিটাই থাকত না। দাদার সুখী হওয়ার–মানে, ভাল হওয়ার দায়িত্ব ছিল তারই উপর হয়তো এখনো আছে, হয়তো সময় আছে এখনো। কথাটা ভেবে, নিজেকে হঠাৎ এ রকম একটা বড়ো পার্টে জ্বলজ্বলে দেখে স্বাতী অবাক হল, মনে-মনে একটু রোমাঞ্চিতও। বাথরুম থেকে বেরোবার আগেই, ফেঁটা ফোঁটা জল গায়ের ওপর চিকচিক থাকতে-থাকতেই প্রতিজ্ঞা করল যে এবার, জীবনে এই প্রথমবার দাদার কাছে সে হার মানবে। প্রতিজ্ঞা করল, কিন্তু স্নান করে বেরিয়ে, পাট-ভাঙা ফিকে নীল শাড়ি পরে, পাউডার-কৌটো খুলে নিশ্বাস নিতে-নিতে, তবু যেন ঝগড়ার দুর্গন্ধ তার নাক থেকে গেল না, বচসার বিস্বাদ মুখে লেগে রইল। কিন্তু এই ভাল-না-লাগাকে আমল দিলে চলবে না, নিজে কষ্ট করেও দাদাকে ভাল করতে হবে-মুখে পাউডার দিতে দিতে স্বাতী তার বড়ো পার্টের জন্য তৈরি হল।
বারান্দায় পাটি পেতে বসে বিকেলের চা খেতে-খেতে স্বাতী বাবার কাছে কথাটা পাড়ল। বাবা বললেন—বেশ। স্বাতী হেসে বলল—কাউকে খাওয়ানো হবে, এর চাইতে সুখের কথা তোমার কাছে আর কী, আমি কিন্তু ভাবছিলাম এসব ব্যবসার বন্ধুদের কথা শেষ না-করে বাবার মুখের দিকে তাকাল। তা হোক, বিজুর যখন ইচ্ছে হয়েছে— বাবা এত সহজে বললেন যে স্বাতীর মনে হলো বাবার পক্ষ নিয়ে দাদার সঙ্গে তার লড়াইটা বড়ো বেশি হয়ে যায়নি তো? চোখ নামিয়ে বলল-দাদাকে আমি বলেছিলাম বাবা।
কী?
এই-যে… বাড়িতে ওসব লোকের যাওয়া-আসা পছন্দ কর না তুমি—
আমার পছন্দ-অপছন্দে ভারি-তো এসে যায় বিজনচন্দ্রের!
না বাবা, স্বাতী গম্ভীর হল—আমি ও-কথা বলাতে দাদা কেমন কিন্তু কিন্তু হয়ে গেল। মাথা চুলকে বলল–তাহলে থাক। আমি তখন বললাম—আচ্ছা বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখি। ব্যাপার কী? রাজেনবাবু হাসলেন হঠাৎ সুপুত্র! কী চায়? বাবার কথার সুরে আবার স্বাতীর খটকা লাগল। তবে কি সে ভুল বুঝেছে, ভুল ভেবেছে? দাদাকে শাসন করতে গিয়ে যেমন বেশি বেশি করেছিল তখন, তার এখনকার ভালমানুষিটাও তেমনি ছেলেমানুষি?…কিন্তু এখন তো আর পেছোনো যাবে না, দাদার কাছে ভাল হতেই হবে, দাদা তাতে ভাল হোক আর না-ই হোক।
******
পরের দিন সকাল নটা পর্যন্ত দাদাকে দেখতে না-পেয়ে স্বাতীই অগত্যা পা বাড়াল তার ঘরের দিকে। দরজার কাছে আসতেই শুনল ভিতর থেকে ঠুকঠুক শব্দ। আর ভিতরে তাকিয়ে দেখল, দাদা টাইপ করছে বসে-বসে। আর সেই টাইপ করার সাংঘাতিক চেষ্টায় তার চোখ গোল হয়েছে, ঠোঁট বেঁকে আছে, আর তিনটে মোটা-মোটা লাইন স্পষ্ট ফুটেছে কপালে। স্বাতীর হাসি পেল, কিন্তু না, হাসবে না তো! মুখে মন-খারাপের হালকা ছায়া এনে ডাকল—দাদা!
বিজন চোখ তুলল লাল-কালো ফিতে পর্যন্ত, তক্ষুনি নামালো চাবিতে। স্বাতী আবার ডাকল, আরো নরম করে–দাদা, শোন! এবার চোখ না-তুলে বিজন মোটা গলায় জবাব দিল—কী? স্বাতী এগিয়ে এল ঘরের মধ্যে। একটু দাঁড়িয়ে থেকে আনাড়ি আঙুলের অসহায় আঁকুপাঁকু লক্ষ করল, তারপর পাখির মতো গলায় বলে উঠল—কী সুন্দর ছোট্টো টাইপরাইটার! বিজন হাত সরিয়ে তার নতুন সম্পত্তির দিকে তাকাল—ঈষৎ গর্বিতভাবেই।
কিনলি?
হ্যাঁ
তা নিজেই টাইপ করিস-কত সময় নষ্ট হয়!
বিজনের চোখ কোণাকুণি একবার ঝলসাল বোনের উপর—দু-দিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে, বলেই ভুরু কুঁচকে ঝকঝকে কালো-সাদার সারির মধ্যে S অক্ষরটা খুঁজতে লাগল। তা নিশ্চয় হবে–স্বাতী আস্তে-আস্তে বলল—কি এ-সবের জন্য তো কেরানি থাকে মানুষের।
এ কথায় বিজন খুশি না-হয়ে পারল না, মানে, খুশি না-দেখিয়ে পারল না। কেননা খুশি হয়েছিল সে আগেই, হয়ে ছিল আগে থেকেই। স্বাতীর ক্ষমা-চাওয়া-চাওয়া মন-মরা চেহারার চাইতে বেশি খুশি তাকে করতে পারে, এমন কিছুই পৃথিবীতে ছিল না আজ সকালে। চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে আলগোছে বলল—আমারও থাকবে। স্বাতী একটু চুপ করে থেকে বলল-আমি পারি মাঝে-মাঝে তোর চিঠিপত্র টাইপ করে দিতে।…দেখে এক্ষুনি ইচ্ছে করছে রে।
করবি? বিজন খুবই চেষ্টা করল মনের গলে-যাওয়া ভাবটা মুখে না ফোঁটাতে, কিন্তু বৃথা। এক-পা এগিয়ে, এক-পা পেছিয়ে স্বাতী বলল-না-থাক—ভুল হবে।
ভুল তো আমারও হয়!—বিজন আর পারল না, হেসে ফেলল—এই দ্যাখ না, এসটাকে খুঁজতে খুঁজতে চোখের ডিম বেরিয়ে এল। স্বাতী হাসিতে যোগ না-দিয়ে বলল—অভ্যেস হয়ে যাবে।
এই প্রথম স্বাতীর মুখে বিজন তার নিজের মুখের কোনো কথার পুনরুক্তি শুনল, যাতে ঠাট্টা কি অবিশ্বাস নেই, উড়িয়ে দেওয়া কি এড়িয়ে যাওয়াও না। এক ঠেলায় চেয়ার সরিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণে পুরোপুরি, মুখখামুখি চোখ বোনের মুখে ফেলে বলল—এখনই একটু করে দ্যাখ না।
নাঃ! দুপুরবেলা যদি রেখে যাস আমার কাছে, একটু-একটু প্র্যাকটিস করে রাখব।হঠাৎ থেমে, টাইপরাইটারের গোল-করা ধারটিতে আঙুল রেখে বলল—কবে কিনলি রে? বলিসনি তো কিছু।
এ আর বলব কী! গালের মধ্যে জিভটাকে একবার ঘুরিয়ে এনে বলল—আমি কিনিনি, অন্য একজনের। নতুন তো!
নতুনই তো। যে কিনেছে সে-ই আমাকে দিয়েছে ব্যবহার করতে।
সে-ই দিয়েছে? লোক ভাল, বলতে হয়। সেই ঠাট্টার সুর আবার যেন লাগল স্বাতীর গলায়। কিন্তু এত ক্ষীণ যে বিজন তা বুঝল না—না কি বুঝল? আর তাই মুখের হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর হল। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-হ্যাঁ, লোক সে খুবই ভাল। দাদার ভঙ্গীর বদলটা স্বাতী যেন লক্ষই করল না। সহজভাবে বলল—তার নিজের লাগে না?
তার?…তার আপিশেই কত মেশিন চলছে সারাদিন! স্বাতী ভেবে দেখল, মজুমদারের নামটা দাদার মুখ দিয়ে বের করাই ভাল। তাই একটু হেসে বলল—তোর বন্ধুভাগ্য খুব, দাদা। তা কোনো-একটা ভাগ্য থাকা চাই তো! বিজন এমনভাবে কথাটা বলল যেন প্রতিপক্ষের কোনো একটা আক্রমণের আভাস পেয়েই সে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু তখনই যেন স্থির করল যে আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। চড়া গলায়, কড়া আওয়াজে বলল—অনেক ভাগ্যে মজুমদারের মতো বন্ধু হয়, আমি এ-কথা বলবই।
মনে-মনে নিশ্বাস ছাড়ল স্বাতী, একটু দেরি করল, দাদা যদি আরো কিছু বলে, তাকে আবোরা কম বলতে হবে। আর হলও তা-ই; একটু পরে বিজনই আবার বলল—আর এই মজুমদারকে তোরা কিনা অপমান করিস!
ও মা? এবার কথা বলার চমৎকার সুযোগ পেল স্বাতী—অপমান আবার কে করল, আর কখনই বা করল!
অপমান না! ফোস করে নিশ্বাস ফেলল বিজন। তুই এক কাজ কর, দাদা–স্বাতী মোলায়েম গলায় বলল—তোর বন্ধুকে বল একদিন চা খেতে।
নাঃ!
না কেন? বাবাকে বলেছিলাম—তার কোন আপত্তি নেই। আর বাবার আপত্তি না-থাকলে আর আমার কী?
তার মানে-বিজন ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট রেখে, যেন তারই সাহায্য নিয়ে কথাটা শেষ করল—তোর আপত্তি আছে এখনো?
থাকলে তোর কিছু এসে যায় না তো? মুখে-মুখে জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল বিজন। সিগারেট ধরিয়ে, ঠোঁটের ফাঁক থেকে আঙুলের ফাঁকে এনে বলল-কিন্তু আপত্তি কেন?
—তোর বাড়িতে তোর বন্ধুকে তুই নেমন্তন্ন করবি, আমার তাতে আপত্তি হবে কেন? আমি বললাম তো, এখন তোর যা ইচ্ছে কর।
আচ্ছা তা-ই করব—বলে বিজন সিগারেট নামিয়ে রাখল অ্যাশট্রেতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবার টাইপ করতে বসে গেল। স্বাতী দাঁড়িয়ে রইল আরো মিনিটখানেক, আর সেই এক মিনিট বিজনের কেটে গেল S-এর পর e খুঁজতে-খুঁজতেই। কিন্তু সন্ধেবেলা নিজেই এসে স্বাতীকে খবর দিল—মজুমদারকে বললাম। শনিবার সুবিধে হল না, শুক্রবারে।
বেশ তো।
তা তুই… তুই একটু ভদ্রতা অন্তত করিস—
আমি কি ভদ্রতা জানি তোর মনে হয়?
-জানলেও শিখতে হবে, বাড়িতে তুই ছাড়া কেউ নেই যখন।–কথাটা ভাল লাগল স্বাতীর, আর সেইজন্যই মুখে কিছু বলল না।
শুকুরবার হল পরশু-মনে রাখিস তাহলে, বিজন হাত নেড়ে বিদায় নিল।
শুক্রবারে ভদ্রতার পার্টে স্বাতী ফেল তো হলই না, ভালই উত্তাল। চা ঢেলে দিল, স্পষ্ট বুঝতে দিল যে নিমন্ত্রিতেরা আরো একটু চিড়েভাজা, আরো একটা সিঙাড়া খেলে তার সুখের আর সীমা থাকবে না। নিজেও খেল, কিন্তু তার খাওয়াটা যেন বোঝাই গেল না। কথা যে বেশি বলল তা নয়, কিন্তু যখনই কথাবার্তা মিইয়ে এসেছে, আস্তে ফুঁ দিয়ে জিইয়ে তুলেছে আবার। কী কথায়, কী চোখে-মুখে, নড়াচড়ায় একবারও যেন বোঝা গেল না যে সে বয়সে এত ছোটো আর অভিজ্ঞতায় এত কাঁচা—কিন্তু কাঁচাই বা কেন, এত সে পড়েছে, সেটাও একটা অভিজ্ঞতা তো?
বিজন আশাই করতে পারেনি তার শুক্রবারের এতখানি জৌলুশ। স্বাতীকে বিশ্বাস কী—নিশ্চিন্ত হবার জন্য সে বলে এসেছিল ছোড়দি-হারীতদাকেও। ভেবেছিল, হয়তো আশাই করেছিল যে হারীতদা আসতে পারবেন না। কিন্তু অনেকদিনের পাওনা এবং অনেকদিনের না-পাওয়া একটা ইনক্রিমেন্টের খবরে তার মন-মেজাজ একটু বিশেষ খোশ ছিল সেদিন। তাছাড়া শহরে তেমন উত্তেজক সভা-টভাও ছিল না, তাই শ্যালকের প্রথম পার্টিতে শ্বশুরবাড়িতেই সে এল। তা পার্টি এমন মন্দই বা কী, তিনজন ভদ্রলোক আর দুজন মহিলায় বেশ ভরা-ভরাই দেখাচ্ছিল। আর বন্ধুমহলের তুলনায় এখানকার কথাবার্তা যদিও ফ্যাকাশে, তবুনতুন একজন মানুষ পেয়ে তাকে দলে ভরতির চেষ্টা তো করা যাবে।
হারীত প্রথম গুলি ছুঁড়ল তার পুরোনো টার্গেটেই—স্বাতী, এ কী করেছ! এত খাবে কে?
স্বাতী বলল—আমরা।
কিন্তু এটা তো ঠিক হল না—চায়ের সঙ্গে চিংড়ি-কটলেট!
চায়ের সঙ্গে কটলেট খায় না বুঝি? স্বাতী লজ্জা পেল আমার কিন্তু বেশ ভালোই লাগে।
প্রবীর মজুমদার হেসে উঠল এ-কথায়।
এই এক খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কত সময় আর কত খাটুনি যে নষ্ট হয় আমাদের দেশে–হারীত বিশেষভাবে মজুমদারকেই বিঁধল চোখ দিয়ে—আর খাবার যা নষ্ট হয় তার তো কথাই নেই।
সত্যি! মজুমদার সোৎসাহে বলল—আর, সবই বাড়ির তৈরি। কখন যে এতসব করেছেন। বলে তাকাল স্বাতীর দিকে। আবার লজ্জা পেল স্বাতী। সে অবশ্য কিছুই করেনি। বাজার করে দিয়েছেন বাবা, বানিয়েছে সারা দুপুর বসে-বসে মার আমলের পুরোনো চাকর হরি, সাজিয়েও এনে দিয়েছে আলাদা-আলাদা থালায়, সে শুধু সেজেগুজে এসে হাতে-হাতে তুলে দিয়েছে–আর নাম কিনা তারই হল! অথচ ওরকম একটা ধরাবাধা ভদ্ৰবুলির উত্তরে এ-কথা কি বলা যায়–না, দেখুন, আমি কিন্তু কিছু করিনি! অথচ ও ছাড়া আর কী বলা যায় তাও ভেবে পেল না স্বাতী। একটু লাল হয়ে মাথা নিচু করল তাই, আর দেখতে তাকে ঠিক সেইরকম হল, যে রকম হত প্রশংসাটা তার পাওনা বলে মেনে নিলে। শাশ্বতী বাঁকা হেসে বলল–কোনটা তুই করেছিস বল তো স্বাতী, সেইটে খাই।
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, মিসেস নন্দী মজুমদার এবারেও কথা ভুল বুঝল—আমি ঐ কটলেটটাই রেকমেন্ড করব। কলকাতায় প্রন-কটলেট খেতে হলে চাং-আনেই যেতে হয়, এ কিন্তু তাকেও হারিয়েছে। স্বাতী মুখ তুলল এবার। আর তুলতেই ছোড়দির সঙ্গে চোখাচোখি হল। হেসে ফেলে বলল—আমি কিন্তু করিনি।
ঐ হল! মজুমদার ব্যস্ত হল কটলেটের গুণ কার্যত প্রমাণ করতে। বিজু বলল কলকাতার কোথায় কী ভাল খাবার পাওয়া যায়, সে বিষয়ে মিস্টর মজুমদার একজন বিশারদ। নাকি? ঈষৎ শ্লেষ ফুটল হারীতের ভুরু তোলায়। কোনটা পুঁটিরামের সন্দেশ আর কোনটা জলযোগের, তা ইনি চোখ বুজে চেখেই বলে দিতে পারেন। আর তাছাড়া–
আঃ, মিস্টর মিঠু! মজুমদার বা হাত তুলে নিজের গুণপনার বিজ্ঞাপনে বাধা দিল। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল—বুঝছেন না, বাড়িতে বসে বাঁধা সময়ে খাওয়া আমার কপালে তো লেখেনি, সারাদিন সাত রাজ্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি, তাই বাধ্য হয়েই কথা শেষ না করে মজুমদার হাসল ঝকঝকে বড়ো বড়ো দাঁত বের করে।
এঁর কারখানা দমদমে, আপিশ ক্যানিং স্ট্রীটে— বিজন সুযোগ পেল বন্ধুর পরিচয় বিশদ করার—আর কাজ ছড়ানো ব্যারাকপুর থেকে ডায়মণ্ড হারবর।
তার মানে আপনি একজন ক্যাপিট্যালিস্ট!—হারীত নাকের বাঁশি কুঁচকোলো।
হইনি এখনো, হবার চেষ্টায় আছি। অভিজ্ঞতা থেকে শাশ্বতী বুঝল যে হারীতের যুদ্ধের বিউগল বেজে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল কীসের কারখানা আপনার? বাজে-বাজে জিনিস সব! মজুমদার অমায়িক হাসল-পাট, নারকোলের ছিবড়ে। সত্যি নিরাশ হল শাশ্বতী। ভদ্রলোকের কারখানায় শাড়ি-টাড়ি তৈরি হলে বেশ হত, দেখতে যাওয়া যেত একদিন। আড়চোখে ছোড়দির দিকে তাকিয়ে স্বাতী বলল—বাজে আর এমন কী! নারকোলের ছিবড়ে দিয়ে কত কিছু তো তৈরি হয়। পা-পোশ–
পা-পোশ! বিজন হোঃ করে হেসে উঠল। ঠিক কথা! ঠিক বলেছেন আপনি! মজুমদার গম্ভীরভাবে স্বাতীর দিকে তাকাল। আপনারা পা মুছবেন বলেই তো আমরা খাটছি সারাদিন। তারপর একই রকম সুরে হারীতের দিকে ফিরে বলল—আপনার কী মনে হয়? যুদ্ধটা বেশ জমে উঠেছে, না কি ফেঁশে যাবে হঠাৎ?
Wage-slave-driver! হারীত মনে-মনে আওড়াল। তারপর লোকটাকে বাগে পাবার জন্য বাঁকা চোখে পাল্টা প্রশ্ন করল—আপনার কী মনে হয়?
কী জানি—যে রকম চটপট কাৎ হয়ে পড়ছে সব-প্যারিসও গেল—এখন হিটলার ইংলন্ডটিকে জলযোগ করে ফেললেই না গোলযোগ মিটে যায়। লোকটার হাসিমাখা বোকামিতে হারীতের পিত্তি জ্বলে গেল, ধৈর্য ধরে বলল—তা হলেই মিটে যায়?
আর লড়বে কে?
কেন, রাশিয়া? হারীত সিংহনাদ ছাড়ল।–রাশিয়া? মজুমদার আরো কিছু বলত বোধহয়। কিন্তু হারীতের আর তর সইল না, ঝপ করে কোপ বসাল-রাশিয়াই তো পৃথিবীর আশা। এ-কথা শুনে মজুমদার স্পষ্ট চমকাল, চায়ের পেয়ালা মুখে তুলতে গিয়ে থেমে গেল, আর তার মস্ত, লালচে, ঠোঁট-মোটা মুখের দিকে তাকিয়ে হারীত বুঝল যে আজকের দিনে পৃথিবী ভরে প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষ যা বিশ্বাস করে, সে-কথাটাই জীবনে এই প্রথম শুনল বাংলাদেশের এই গবুচন্দ্র হবু-ক্যাপিট্যালিস্ট। রাশিয়াই তো পৃথিবীর আশা। কথাটা আবার আওড়াতে খুবই ভাল লাগল তার।
ভাগ্যিশ আপনার মুখে শুনলুম কথাটা, নয়তো আর-সবার মতো আমিও ভাবতুম যে আদ্ধেক পৃথিবী যদ্দিনে ছারখার হল, তদ্দিন স্টালিন-সাহেব দিব্যি গোঁফে তা দিলেন বসে বসে–বলে চায়ে চুমুক দিল মজুমদার।
হোক ছারখার হারীত মুখ লাল করে বলল—রাশিয়া যদি বাঁচে, তবে পৃথিবী বাঁচবে।
-ও, বুঝলাম। পৃথিবী মানেই রাশিয়া, আর সেইজন্যই রাশিয়া পৃথিবীর আশা?
লাল রং কালো হল হারীতের মুখে। ইচ্ছে হল, ঐ মাংসপিণ্ডটাকে সাফ দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে এক্ষুনি উঠে পড়ে কিন্তু তক্ষুনি মনে পড়ল দলের পাণ্ডাদের উপদেশ—ধৈর্য চাই, মেজাজ যেন খারাপ না হয় কখনো… শেখাতে হবে, বোঝাতে হবে, বশ করতে হবে মানুষকে.. জায়গা বুঝে সূক্ষ্ম একটু চাটুকারিতাও চাই—দেখেওছে এক-একজনকে, ঘন্টার পর ঘন্টা তারা তর্ক করেন জাত-বুর্জোয়া, পাতি-বুর্জোয়া, পচা-বুর্জোয়ার সঙ্গে। যদি তাদের কোনো-একজনকে টানতে পারলে কিছুমাত্র সুবিধে হয় দলের! আর তাই হারীত মুখ ফিরিয়ে চুপ করে থাকল, আর অন্যমনস্কভাবে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলল সেই চিংড়ি-কটলেটেরই সমস্তটা, চায়ের সঙ্গে যার আমদানি দেখে প্রথমে সে শিউরেছিল। তার চেহারা দেখে মজুমদার অপ্রস্তুত, শাশ্বতীর মাথা নিচু, শুধু বিজন বুক চেতিয়ে চকচকে চোখে তাকিয়ে রইল। এমন যে বিদ্বান আর বাক্যবাগীশ তার হারীতদা, তার সঙ্গেও সমানে-সমানে কথা চালাতে পারে তার বন্ধু, সে কি ফ্যালনা!
সেই চুপচাপের মধ্যে ছলছল করে উঠল স্বাতীর গলা রাশিয়া আমি খুব ভালবাসি। লোকেরা কেমন সারাদিন ধরে চা খায় আর তর্ক করে, আর স্টেশন-মাস্টাররা সব সময় ঘুমায়, আর মেয়েরা রাত জেগে-জেগে—
পাও কোথায় এসব খবর? হারীত নাকের ভিতর দিয়ে আওয়াজ করে উঠল।
কেন, টুর্গেনিভের—
টুর্গেনিভ! স্বাতীর ভিতু ভিতু কথা কচ করে কেটে দিল হারীত—বাবুগিরি করে বিদেশেই তো জীবন কাটিয়েছে, রাশিয়ার সে কী জানে? কী করেছে সে তার দুঃখী দেশের জন্য? আর তাই তো রাশিয়ায় এখন টুর্গেনিভ কেউ পড়ে না।
পড়ে না!–আহা, অমন বই, অমন ভাল বই পড়ে না? রাশিয়ার লোকেদের জন্য বড়ো কষ্ট হল স্বাতীর। বলল, বলে ফেলল—তবে তো রাশিয়ার লোকেরা এখনো খুব দুঃখী!
হারীত বলবার জন্য এমন টগবগ করছিল যে স্বাতীর কথা তার কানেই গেল না, শুধু ঐ দুঃখী কথাটা শুনতে পেয়ে তক্ষুনি গর্জে উঠল—না, রাশিয়ার লোকেরা এখন আর দুঃখী। এখন আর সেখানে স্টেশন-মাস্টাররা ঘুমোয় না, মেয়েরা রাত জেগে-জেগে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এখন সেখানে একটানা পাঁচ মিনিট ধরে হারীত বর্ণনা করল ভূস্বর্গ রাশিয়ার, বলতে বলতে মোটাসোটা মাংসলো মজুমদারকে ঘাড় কাৎ করে নেতিয়ে পড়তে দেখে বুঝল যে তার কথায় কাজ হয়েছে। আর তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শাশ্বতী বলে উঠল—সত্যি, আশ্চর্য দেশ!
আশ্চর্য! মজুমদারের প্রতিধ্বনি। হারীতের কথা, সত্যি বলতে, শেষ হয়নি, শুধু দম নিতে থেমেছিল একটু। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে সকলের মুখেই এমন একটা হার-মানা ভক্তির ভাব দেখতে পেল যে খুশি হয়ে বলে ফেলল–স্বাতী, আর একটু চা।
চা শেষ হল, বাসন সরানো হল, মজুমদার তার সিগারেটের টিন হারীতের সামনে বয়ে সন্ধির প্রস্তাব করল, আসুন—
থ্যাঙ্কিউ, আমি পাইপ-বলেই হারীতের চোখে পড়ল টিনটা স্টেট-এক্সপ্রেসের। উদারভাবে একটু হেসে বলল—আচ্ছা, নিই একটা।
এর পরে মজুমদার টিন ধরল বিজনের সামনে। বিজন মুচকি হেসে চোর-চোর তাকাল হারীত্তের দিকে, শাশ্বতীর দিকেও।
অনুমতিটা দিয়ে দিন না আপনারা মজুমদার চোখ টিপল, মিছিমিছি আর—
নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! পাঁচ মিনিটে রাশিয়াকে জিতিয়ে দিয়ে হারীতের মেজাজ এখন আগের চেয়েও খোশ। দরাজ হেসে বলল—আরে বিজন, তুমি আবার এ-সব—
বাড়িতে বসে, বড়োবয়সির সামনে, প্রকাশ্যে, সসম্মানে এই প্রথম সিগারেট ধরাল বিজন। আর তাতে এতই গৌরব লাগল যে ভাল করে টানতেই পারল না। শাশ্বতী মনে-মনে বলল–কী অসভ্যতা! ঐটুকু ছেলে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না, পাছে হারীতের আবার মেজাজ বিগড়োয়। দেশলাই ধরিয়ে হারীতের মুখের কাছে এনে মজুমদার বলল—কিছু মনে করবেন না, মিস্টর নন্দী। বোকার মতো তর্ক করেছি আপনার সঙ্গে। হারীত হা-হা করে হেসে উঠল, তারপর কেশে উঠল সিগারেট ধরাতে গিয়ে। হাত নেড়ে চোখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরিয়ে বলল–
না, না, কিছু না—
আপনাদের মত মানুষের কাছে কত শেখবার আছে আমাদের। কিন্তু সময় কই?
একদিন আসুন না আমাদের মিটিঙে।
মিটিং! মজুমদার হাত জোড় করল—মিটিং জিনিসটাকে বড়ো ডরাই।
সে-রকম না—এই কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে—
পণ্ডিতের মেলায় আমি মুখ গিয়ে কী করব, বলুন তো? মজুমদারের কথাটা নিশ্চিন্তে মেনে নিয়ে হারীত বলল—গান শুনতে তো আসতে পারেন।
গান? কী গান?
গণ-সংগীত।
রণ-সংগীত?
ঠিকই বলেছেন—গণ-সংগীতই রণ-সংগীত হবে একদিন। চাষিদের মুখের গান—ওঃ সে যে কী!
কী রকম বলুন তো? মজুমদার জানতে চাইল।
শুনলেই বুঝবেন–এক ভদ্রলোক শিখে এসেছেন নানা জেলায় ঘুরে—চমৎকার গলা—
আঃ! আঘো চোখ বুজে মজুমদার যেন মনে আনল কোনও মনে পড়ার সুখ-শশাঙ্ক দাসের মতো গলা আর শুনলাম না!
কোন শশাঙ্ক দাস বুঝলে তো, ছোড়দি? বিজন নড়ে চড়ে উঠল।
যার গাড়ির নম্বর মুখস্ত ছিল তোর—সে-ই তো? শাশ্বতী ভাইকে ঠাট্টা করল। কিন্তু নিজেও সচকিত হল মনে মনে। কী ভালই লেগেছিল ভদ্রলোকের গান—সেই প্রতিশোধ ফিল্মেসেই একবারই বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন সিনেমায়–অমন যেন আর লাগল না। আর তারই কদিন পরে স্বাতীর জন্মদিনে হারীতের সঙ্গে প্রথম দেখা!… একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল শাশ্বতী। আবার যখন কথা কানে গেল, শুনল মজুমদার বলছে—দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য এই দেশের, যে শশাঙ্ক দাসকে ফিল্মের গান গাইতে হয় টাকার জন্য।
আজকাল তো ফিল্মেও শুনি না ওঁর গান? শাশ্বতী এমনভাবে কথা বলল যে দুর্ভাগ্য সম্বন্ধে মজুমদারের সঙ্গে তাকে একমত মনে হল না।
বম্বেতে আছে এখন—ফিল্ম ছাড়া যদি উপায়ই নেই, তবে টাকা যেখানে বেশি সেখানেই ভাল! কিন্তু আমি চেষ্টা করছি ওকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে।
আপনি ওঁকে চেনেন! শাশ্বতী শিহরিত।
চিনি? আমার ওল্ড ফ্রেন্ড শশাঙ্ক।
ওল্ড ফ্রেন্ড কথাটা শুনে হাসি পেল স্বাতীর–মানে, হেসেই ফেলল, আর সেই হাসির যেকোনো একটা কারণ দেখাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলল-ছোড়দি কিন্তু খুব ফিল্মের ভক্ত। আমিও! সঙ্গে-সঙ্গে বলল মজুমদার। ফিল্ম ভাল না তা তো না, তবে শশাঙ্ক যা দিতে পারে, ফিল্ম তা নিতে পারে না।
তা ভাল-ভাল লোকেরা না-এলে— বিজনের বিচক্ষণ মন্তব্য—ফিল্মই বা ভাল হবে কী করে? তাও সত্যি—
বম্বের কোন ফিল্মে উনি গেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল শাশ্বতী। ফিল্মের কথাই চলল এর পর। বলল মজুমদারই মোটামুটি, বিজন মাঝে-মাঝে মতামত না দিয়ে ছাড়ল না। আর মুখে মৃদু একটু হাসি রেখে হারীত সহিষ্ণুতার একটা রেকর্ড রাখল প্রায় দশ মিনিট ধরে, তারপর টু মারল রুশ ফিল্মের কথা উঁচিয়ে, আইজেনস্টাইনের নিশেন ওড়াল দু-একবার। কিন্তু কথা গড়িয়ে-গড়িয়ে আবার ফিরে এল দিশি ছবির সমতলেই। কথায় কথায় জানা গেল যে মজুমদার অনেক অভিনেতাকেই চেনে-শুনে শাশ্বতী মুগ্ধ। অভিনেত্রীদের কাউকে চেনে কিনা জানতে ভীষণ ইচ্ছে করল, কিন্তু থেমে গেল জিজ্ঞেস করতে গিয়ে না, সেটা সেটা ঠিক হবে না। হয়েছে কী, শাশ্বতীর ইচ্ছে যত, ফিল্ম দেখতে পায় না তার আদ্ধেকও। মাসে দুটোর বেশিতে হারীত নিয়ে যায় না, সে দুটোই আবার ইংরেজি। শ্বশুরবাড়ির জা-ননদের দলে ভিড়তে না পারলে বাংলা-ছবি দেখা হয়েই ওঠে না তার। মজুমদারের কথা শুনে শুনে সে তাই রুদ্ধ ইচ্ছা মেটাতে লাগল যতটা সম্ভব। আরো খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর হারীতের আর সহ্য হল না। কব্জি-ঘড়িতে তাকিয়ে বলল—আমি উঠি এবার।
আমাকেও যেতে হবে। কথা থামিয়ে একেবারে উঠেই দাঁড়াল মজুমদার।
আমি–আমি থাকি একটু, ঈষৎ ম্লানভাবে শাশ্বতী বলল।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি তো বাড়িও যাচ্ছি না এখন।
কোনদিকে যাবেন? শহরের দিকে হলে আমার সঙ্গেই।
চলুন।
মিস্টর মিট্র, কাল তাহলে সকাল নটায় দেখা হচ্ছে আপনার সঙ্গে?
নিশ্চয়ই।
অনেক ধন্যবাদ, মিসেস নন্দী… অনেক ধন্যবাদ, মিস মিত্র–অনেক ধন্যবাদ মজুমদার জনেজনে বিদায় নিতে লাগল—আশা করি আবার দেখা হবে আপনাদের সঙ্গে। বিজন আবার নিশ্চয়ই বলল। হ্যাঁ, একটা কথা মজুমদারের হঠাৎ যেন মনে পড়ল—পল মুনির নতুন ফিল্ম আসছে মেট্রোতে, যাবেন আপনারা কালকের পরের শনিবার? মানে— কথাটা স্পষ্ট করল তক্ষুনি-আমি খুবই সুখী হব আপনারা যদি আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
তা—গেলে হয়, সকলের আগে জবাব দিল হারীত। সে নিজেই ভাবছিল এটাতে যাবেভালই হল। এর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়ে কটাকা বাঁচল, তার একটা হিশেব চটপট খেলে গেল তার মনে।
আপনি যাবেন তো? মজুমদার দাঁড়াল স্বাতীর সামনে।
দেখি—
দেখি কেন? স্বাতীর দিকে মাথা নোয়ালো মজুমদার। স্বাতী উঠে দাঁড়িয়েছিল বিদায় দিতে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ভাল করে তাকাল একবার। মাঝখান দিয়ে সিঁথি করা চুল দুদিকে ঢেউ তোলা, ছোটো ছোটো চোখ দূরে-দূরে বসানো, মস্ত মুখ, মোটা লাল ঠোঁট, চিকচিকে সিল্কের পাঞ্জাবি প্রায় হাঁটুতে ঠেকেছে, কুঁচোনো ধুতির জরি-পাড় লুটিয়ে পড়েছে শ্যাওলা-রঙা লপেটায়। হঠাৎ যেন উল্টোদিকে ধাক্কা খেল স্বাতী। একটা বিশ্রী লাগার কাঁপুনি উঠল মনের মধ্যে তার। এতক্ষণকার ভদ্রতা, ভব্যতা, দাদার মনরক্ষার চেষ্টা, সব ভেসে গিয়ে আবার নাক-মুখ ভরে গেল সেই বিশ্রী… বিস্বাদ. বদগন্ধে।
এত দিন আপনাকে দেখেছি মজুমদারকে সে বলতে শুনল—কিন্তু দেখা পাইনি। আজ যদি দয়া করে দেখাই দিলেন, তাহলে আরো একটু দয়া কি করতে পারেন না? শাশ্বতী মনে-মনে হাসল কথাটা শুনে। আর ভাবল যে সব মেয়েরই দিন আসে জীবনে, কিন্তু সেদিন আর কদিন! ঈশ্বর যদি মেয়েদের আস্ত এক-একটি বোকা করে না বানাতেন তাহলে তারা ভুলত না কোনো কথাতেই, আবার ভুলত না কোনো কথাই। চুপ করে সব শুনত, আর উশুল করে নিত মাশুল। স্বাতীর পাশে এসে বলল–কী, স্বাতী বুঝি যেতে চাচ্ছে না? ঐ ওর স্বভাব! …তা যাবি না কেন, আমরা সবাই সাব, আর তুই যাবি না তা কি হয়?
আর মজুমদার যখন হারীতকে পাশে বসিয়ে গাড়ি রওনা করল, তখন ভিতরে এসে স্বাতীকে প্রথম কথা বলল-কী রে? ঐ মজুমদারের অবস্থা তো কাহিল।
দেখেছি তো, স্বাতী হাসল উত্তরে–ছোড়দি সাবধান।
আমার আর সাবধানের কী—
বাঃ! সাবধান হবার তো তোমারই আছে।
অসভ্য! শাশ্বতী এক কিল বসাল স্বাতীর পিঠে-একটু লালও হল।
******
একটু লাল হল স্বাতী, লাল হল বলে রাগ হল নিজের উপর, আর সেই রাগের রঙে আরো লাল হল—তবু ভাগ্যিশ ছায়া, আবছায়া, অন্ধকার। নল-ডোবানো গ্লাস হাতে নিয়ে মজুমদারকে সামনে দাঁড়ানো দেখে একটু চমকেছিল সে, কেননা তেষ্টা তার সত্যি পেয়েছিল, অথচ বলেনি। যেহেতু সিনেমায় এসে তেষ্টা পায় শুধু বাচ্চাদের আর অনভ্যস্ত মেয়েদের। ও-দুয়েরই এক দলে কি ইনি মনে-মনে ঠাওরালেন তাকে, নয়তো কী করে জানলেন…?
নিন! মজুমদার নিচু-মাথায় হাত বাড়িয়ে দিল।
আর কেউ…? ছোড়দির দিকে তাকাতে গিয়ে স্বাতী দেখল, ছোড়দি এক চেয়ার সরে গিয়েছে, গল্প করছে দাদার সঙ্গে।
সকলেরই আছে—আপনি নিন। তখম স্বাতীর চোখ পড়ল মজুমদারের পিছনে দাঁড়ানো পাগড়ি বাঁধার হাতে ধরা ট্রে—ছি, কী করে সে ভাবতে পারল তার একার জন্য, তারই তেষ্টার কথা বুঝে নিয়েছি। কিন্তু এই লজ্জাটা জানতে দেওয়া তো আরো লজ্জা, তাই সাহস করে চোখ সরিয়ে আনল জগৎবিখ্যাত ঘড়ির বিজ্ঞাপন থেকে। একটু চড়া গলায়, ইংরিজি শব্দ ব্যবহার না করার কৃতিত্বে একটু সচেতনভাবেই বলল—ঠান্ডা পানীয়?
আপনার ভাল লাগে না?
পানীয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভাল জল— যদিও একটু সাজানো ধরনে, তবু তার সত্যিকার মতটাই বলল স্বাতী। আর মজুমদারের মুখে হাসি লক্ষ করে আবার বলল—আর সিনেমার মধ্যে সবচেয়ে ভাল মেট্রো, কেননা একমাত্র এখানেই খাবার জলের ব্যবস্থা আছে।
এখন আর নেই। কাগজের গ্লাস এমন চুরি হতে লাগল—
চুরি কেন? শাশ্বতীর কানে গেল কথাটা।–ও তো আর কিনতে হত না—
সেইজন্যই তো! কথা লুফে নিল হারীত। বিনিপয়সায় কিছু পাওয়া গেলে কি আর কথা আছে এ-দেশে? মাখনের দাম নেয় না বলে বাঙালি ছেলেরা চেটেপুটে সবটুকু মাখন খেয়ে নেয় লন্ডনের রেস্তোরয়। হারীত হেসে উঠল পিছনে মাথা হেলিয়ে।
তা জল যখন নেই-ই, আপাতত এইটে—এতক্ষণে সহজ হতে পেরে স্বাতী ঠাণ্ডা গ্লাসটি হাতে নিল। আর মজুমদার এগিয়ে গেল শাশ্বতীর দিকে-না, দেখুন, আমি না। শাশ্বতী কাঁচুমাচু।
—তাহলে অন্য-কিছু…
না, কিছু না, দেখুন শাশ্বতীর আবার ঐ ঠান্ডাই-যন্ত্রটা অপছন্দ। এমনিতেই এত ঠান্ডা যে তার উপর আর কোনো ঠান্ডার কথা ভাবতেই যেন শীত-শীত করে।
কেন, খাও না! বিজনের পিঠ পেরিয়ে হারীত গলা বাড়াল স্ত্রীর দিকে। শাশ্বতীর চোখে মিনতি ফুটল, কাতর মিনতি। কিন্তু অন্ধকারে হারীতের বোধহয় তা চোখে পড়ল না, আর পড়লেই বা কী? কেনা হয়ে গেছে, তুমি না-খেলে ফেলা যাবে, এই চরম যুক্তির মায়া কাটাতে কি পারত সে?
আপনি, মিস্টর নন্দী মজুমদার হাত বাড়াল হারীতের দিকে। এমনিতে কোল্ড ড্রিঙ্কসের কথা উঠলেই হারীত পুরুষােচিত ঠাট্টা করে। কিন্তু পুরুষের পয়সা-খসানো মেয়ে-মজানো এই বস্তুটার উপর আজ তার দয়া হল—কেননা ভদ্রতার উত্তরে ভদ্রতা তো করতে হবে। গ্লাস নিয়ে নলে ঠোঁট ঠেকাল একবার, তারপর শাশ্বতীর দিকে মুখ তুলে একটু জোর দিয়েই বলল—বেশ ভাল তো!
শাশ্বতী অবাক হল কথা শুনে। স্বামীর সঙ্গে রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে কখনো তার হয়তো ইচ্ছে হয়েছে একটা ঠান্ডা কিছু খেতে, কিন্তু হারীত তক্ষুনি বলেছে—ও-সব আবার ভদ্রলোক খায়? যত বাজে! শুনতে-শুনতে শাশ্বতীর বিশ্বাস জন্মেছিল যে ওগুলো সত্যিই জাতে বড়ো নিচু। সে এখনো একেবারেই অপছন্দ করতে পারছে না বলে একটু লজ্জিতও ছিল মনে-মনে। আর আজ কি হারীতের মুখেই তারিফ! হয়তো অসাধারণ কিছু হয়তো এক-এক গ্লাস একএক টাকা দাম-না-খেলে অন্যায় হয়, সত্যি!–আচ্ছা দিন, শাশ্বতী হাত বাড়াল। মজুমদার হেসে বলল—ইচ্ছে না করলে থাক।
নষ্ট করে লাভ কী— হারীত আড়চোখে তাকাল-দাম তো দিতেই হবে।
দাম দিতে হবে বলেই খেতে হবে? মজুমদার যেন জানতে চাইল হারীতের কাছে। টাকা দেখাচ্ছে। বড়লোকি ফলাচ্ছে। হারীত মনে-মনে বলল। মুখে বলল-অপব্যয় ভালবাসি না।
স্বামীর মুখ গম্ভীর হতে দেখে শাশ্বতী আর দেরি করল না। গ্লাস আর ভিতরে-ভিতরে কেঁপেকেঁপে সেই বরফ-মতো ঠান্ডাকে ভিতরেও নিতে লাগল আস্তে আস্তে। তার ভাগ্যে ইন্টভল শেষ হল তক্ষুনি, আর আসল ছবি আরম্ভ হতে সব চোখ যখন পরদায় আঁটা, প্রায় তেমনি ভরা গ্লাসটিকে নামিয়ে রাখল চেয়ারের তলায়। ভুলেই গেল স্বাতীর পাশে সরে আসতে। অগত্যা মজুমদারকে বসে পড়তে হল দু-বোনের মাঝখানে। আর ওখানে বসে সিনেমা ছাড়াও আরো কিছু না দেখে সে পারল না। ঘাড়টি একবার ডানদিকে, একবার বাঁ দিকে হেলিয়ে, দুজনের একজনেরও চোখে না পড়ে দু-বোনের রূপের তুলনা করল সে, চুলচেরা বিচার করল। সেকেলেদের মতে, প্রসাধনের অংশ মনে মনে বাদ দিল না। সে আধুনিক মানুষ, সে জানে যে পৃথিবীর চোখ যাকে দেখবে সে এই সাজগোজ করা মানুষই, অতএব সেটাই আসল, সেটাই সব। তবু প্ৰসাধন পেরিয়েও দেখতে পেল তার বিচক্ষণ চোখ। দিদিকে যে বেশি ফর্সা দেখাচ্ছে তার কারণ এই অন্ধকার আর পাউডারের উঁচু জাত; কনুইয়ের উপর থেকে যে-অংশটুকু ব্লাউজের হাতা ঢেকে দেয়নি, সেটুকু লক্ষ করে সত্য আবিষ্কার করতে তার দেরি হল না। দিদির মুখখানা গোলগাল, নাকটি বড়ো সোজা, হাঁ বড়ো ছোটো। মজুমদারের জজিয়তি ছোটোটির পক্ষে রায় দিতে দিতে থমকাল—ছোটো হওয়াটাই ছোটোটির সুবিধে, এখন পর্যন্তও তা-ই, এখন পর্যন্ত সে-বয়স সে ছাড়ায়নি, যখন দু-চার বছরের তফাতেও চামড়া একটু চিকচিক করে বেশি..কিন্তু বিয়ের পরে স্বামীর ঘরের অবিরাম বিশ্রামে আর অফুরন্ত আরামে কয়েক বছর কাটাবার পর ঐ ডিম-ছাঁদের মুখ আর একটু-বাঁকা চোখ অত সহজে কি আর প্রাইজ পাবে? দিদির মতো মোটার দিকে বেঁকে যদি? থুতনিতে যদি ভাঁজ পড়ে?..শাশ্বতীর মধ্যে মজুমদার দেখতে চেষ্টা করল ভবিষ্যতের স্বাতীকে। আজকের টাটকা তাজা বয়সটা কোন-কোন খুত লুকিয়ে রেখেছে, তার ফর্দ বানাল সাবধানে। কিন্তু সমস্ত হিসেব শেষ করে আরো একবার যেই তাকাল, তক্ষুনি চিনতে পারল মুখের সেই গুণকে, আর কোনো বর্ণনা না পেয়ে যার আমরা নাম দিয়েছি–নুন, মানে লাবণ্য; সমস্ত হিসেব যেন ফেল পড়ল তার, মনের মধ্যে নিশ্চিত জানল যে এই নুনের গুণ ঝরে যাবে না বছরের পর বছরের আছাড়েও।
মজুমদার প্রায় মনস্থির করে ফেলল …জীবনে এখন তার সেই অবস্থা, যখন একজন স্ত্রী দরকার। দরকার মানে দেহের নয়, মনেরও নয়— সংসারের ঘরকন্নারও না। স্ত্রীকে দিয়ে ওসব দরকার তারাই মেটায়, যারা বেচারাজাতীয় জীব, কিংবা গরিব। পৃথিবীর অধিকাংশ পুরুষ যে একবারে একটিমাত্র স্ত্রীকে নিয়ে জীবন কাটাতে রাজী, তার কারণ তো এই যে স্ত্রী সবচেয়ে শস্তা, তার উপর নিঝঞ্জাট। কিন্তু সে তো শস্তা খোঁজে না, হাঙ্গামাও ডরায় না। তবে? আর কিছু না, এখন একজন স্ত্রী হলে মানায় বেশ, দেখায় ভাল, আর এ-কথা তো মানতেই হয় যে দু-একটা সুবিধে এমন আছে যা আজকালকার সভ্য সমাজে স্ত্রীর কাছেই শুধু পাওয়া সম্ভব। দেয়ালের সঙ্গে মানিয়ে যেমন ছবি, আবার ছবির সঙ্গে মানিয়ে ফ্রেম, তেমনি টাকার সঙ্গে মানিয়ে রীতিমতো স্ত্রী চাই একটি, না হলে যেন ঠিক হয় না, একটু ফাঁকা ঠেকে। টাকা খাটে ব্যবসায়, নড়ে-চড়ে ব্যাঙ্কে, আটকে থাকে মাটির টুকরোয়; তার মতো ব্যস্ত মানুষ কত আর ওড়াতে পারে! স্ত্রী হলে টাকার একটা কাজ হয় বেশ, ঝকঝকে শো-কেসটি সাজানো যায় ইচ্ছেমতো, দেখানো যায় সকলকে। টাকা-যে তার খুব হয়েছে তা নয়…আরে না! কিন্তু হবার বাধাও আর নেই। আর এর পরে যাই হোক আর না-ই হোক, প্রথম পনেরো বছরের পরিশ্রমেই সাধারণ ভদ্ররকম একটা ব্যবস্থা তো করতে পেরেছে, অন্তত গরিব হবার ভয় আর নেই তার। কথাটা নিজের মনেও নিশ্চিন্তে বলতে পেরে তার গায়ে যেন কাটা দিল। একবার ঘাড় ফেরাল পিছনে—যেন সত্যি সে ভাবছে যে পিছনে তাকালেই দারিদ্রের বিকট বীভৎস মূর্তিটার ছায়া দেখবে এখনো কিন্তু তার বদলে আবছা চোখে পড়লো সারি সারি এমনসব মানুষ, কলকাতার কত লক্ষ লোকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যারা খায়-পরে, অতএব যারা সবচেয়ে সুখী। খুব বেঁচে গেছে সে, ওঃ! কী ভয়ই সে পেয়েছে, কী ভয়ে-ভয়েই সে কাটিয়েছে…এই সেদিন পর্যন্ত। দারিদ্র তাকে দাঁত দেখিয়েছে রোজ দুবেলা ভাত-পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে পাতলা-ডালের গঙ্গাজলে, ছোটো হয়ে-হয়ে দম-আটকানো ছিটের কোটে, ঘিনঘিনে-স্যাৎসেঁতে কলতলার পচা-পচা আঁশটে দুর্গন্ধে। ছেলেবেলার সেই সিধু মিস্ত্রির গলি হঠাৎ মনে পড়ল তার-সাত শরিকের জন্য একটা মাত্র… ভোর হতেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে আপিশের বাবুরা—স্ত্রীলোকরা সেরে নেয় রাত থাকতেই—বাবা একদিন কী মারই মেরেছিলেন হাফ-প্যান্ট নষ্ট হয়েছিল বলে। সিনেমার ছবিতে জমকালো ভোজ, আশে-পাশে কলকাতার সবচেয়ে সুখীরা–একবার চোখ ঘুরিয়ে এনে যেন নিশ্চিত জেনে নিল যে সেই কুশ্রীতার কয়েদ থেকে সে পালাতে পেরেছে বাকি জন্মের মতো।
পারল কেমন করে, নিজেরই অবাক লাগে মাঝে মাঝে। এরকম কথা ছিল? সে, জন মরিসন কোম্পানির গোডাউন-ক্লার্কের চার ছেলের বড় ছেলে। পেট ফাটিয়ে ভাত-ডাল খেয়ে-খেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করবে ঘষে ঘষে, তারপর যে কোনো কাজে, যে কোনো মাইনেতে, যে কোনো রকমে একবার বেরোতে পারলে আর কথা কী! এর বেশি আর কী আছে জীবনে মালকেঁচার উপর ওপেন-ব্রেস্ট কোট লটকিয়ে বুক ফুলিয়ে ট্রাম ধরবে ন-টার সময়। হওয়া উচিত ছিল তাই, এছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারাই তার উচিত ছিল না। কিন্তু দৈব-প্রেরণা ছিল তার, বুকে স্বর্গীয় আগুন; অতৃপ্তি ছিল. ভীষণ অতৃপ্তি। ঘৃণা ছিল সেই জীবনের উপর, যে জীবন তার জন্মদোষে পাওয়া। মাসের প্রথম রবিবারে যখন একসের আলুর সঙ্গে মিশিয়ে দেড় সের পাঁঠার মাংস রান্না হত, আর ভাইয়েরা চ্যাচামেচি নাচানাচি করত সকাল থেকে, তেজপাতাটি চেটে না নিয়ে পাত থেকে ফেলত না, তার তখন ঘেন্না করত, ঘেন্নায় যেন ভাত ঠেকে যেত গলায়। টাকা… টাকা চাই, তখনই মনে-মনে আউড়েছে—সকলের আগে টাকা, সকলের উপরে টাকা… যেমন করে তোক টাকা। যেহেতু টাকা হলেই সব হয়, আর টাকা না হলে কিছুই হয় না। এ প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পেরেছে। লোকে বলবে এটা আশ্চর্য, কিন্তু সে জানে তার মনে যে এ–প্রতিজ্ঞা বাসা বেঁধেছিল, সত্যি আশ্চর্য সেইটেই। এত বড়ো আশা সে কি কখনো করতে পারত দৈবের বিশেষ দয়া তার উপর না থাকলে? ..আর এখন, এখন চাই একটি স্ত্রী। টাকার জন্য অনেক ভেবেছে, অনেক খেটেছে। এব্যাপারেও খাটতে হবে, ভাবতে হবে। ততটা না হোক, তেমনি। কেননা বেঁচে থাকতে হলে যেমন টাকা, বিয়ে করতে হলে তেমনি দরকার যে, স্ত্রী হবে সুন্দরী। সস্ত্রীক কোথাও যাবে যখন, সেটা বেশ দেখার মতো হওয়া চাই তো। এর অবশ্য চটক নেই তেমন, চমক লাগে না চোখে কিন্তু ওসব তো সাজগোজের ব্যাপার। রূপের যে অংশটা কিছুতেই কিনতে পাওয়া যায় না, সেই মুখখানা—মুহূর্তের জন্য প্রায় বিগলিত হল মজুমদার-মুখখানা সত্যিই ভাল। ঠিক মতো মেক-আপ করলে কুখু চুল কাঁপিয়ে দিলে, সকলেরই চোখে পড়ছে অথচ কাউকেই ঠিক চোখে দেখছে না, এই ভাবটি ফোঁটাতে শিখলে এও হবে সেই দেমাকওয়ালিদেরই মতো, মজুমদার যাদের দেখতে পায় রেস্তোরয়, রেসকোর্সে। যাদের সে তারিফ করে মনে মনে, মনেপ্রাণে, কিন্তু আজ পর্যন্ত যাদের চোখে পড়তে পারেনি বলে বাধ্য হয়েছে বিয়ের হিসেব থেকে তাদের বাদ দিতে। অগত্যা চোখ রেখেছে নিচুতেই—মাঝারিগগাছের বাঙালি ঘরে, আর সেই মাঝারিঘরের পক্ষে এটি অবশ্য উঁচু-দরের, এতই উঁচু যে বলনে-চলনে পাকা হলে এ-ই পরবে সেই সবচেয়ে উঁচুতে তাকে চড়িয়ে দিতে। এই হাত দুখানাই ঠেলে নিয়ে যাবে তার সৌভাগ্যের গাড়ি এমনকি লেডি গাঙ্গুলির ড্রয়িংরুম, রানি রুক্মিণীর জল-পার্টি পর্যন্ত… আর বিজনও কাজে লাগবে মন্দ না। ভাইগুলো জাত-ক্যাংলা, দু-আনার মায়া কাটাতে পারেনি, কেরানি করে রেখেছে এক-একটাকে, কেরানিই থাকবে সারা জীবন। বাবাকে করেছে ক্যাশিয়ার—বাবা যা ভালই পারবেন, তার জন্য আর বাইরের লোককে মাইনে গোনা কেন? কিন্তু এসব ছাড়া আর একজনকে সে খুঁজছিল মনে মনে, যাকে এন্টু বললেই বাকিটা বুঝতে পারে, আর একটু পেলেই যে বড্ডো খুশি হয় না। বিজনের, আর যা-ই হোক, নাকটা উঁচু, টাকা দেখলে খাবি খায় না। বড়ো বড়ো অঙ্ক বেশ সহজেই মুখে আনতে পারে।…চেয়ারে একটু নড়ে সিগারেট বের করল, ঘাড় বাড়িয়ে নিচু গলায় বলল—আপনার কি অসুবিধে হবে ধোঁয়ায়?
স্বাতীর মন ছিল ছবিতে, শুনতে পেল না। মজুমদার একটু গলা চড়িয়ে দ্বিতীয় বারে পৌঁছিয়ে দিল তার অনুরোধ।
না, না, অসুবিধে কী— পলকের জন্য তাকিয়েই স্বাতী আবার ছবি দেখতে লাগল দু-দিকের হাতলে কনুই রেখে, হাতের উল্টো পিঠ গালে ঠেকিয়ে। এতক্ষণে ভাল লাগছিল স্বাতীর। এসেছে সে অনিচ্ছায়, এসেও অস্বস্তিতে কাটিয়েছে ইন্টভল পর্যন্ত। মন তার স্থিরই ছিল, কিন্তু সকালবেলা হঠাৎ এল ছোড়দি, এসে প্রথম কথা বলল তৈরি হয়ে থাকি, আমরা তুলে নেব তোকে।
মানে?
আহা! স্বাতীর গম্ভীর ভাবটা গায়েই মাখল না শাশ্বতী।
আমি তো বলে দিয়েছি দাদাকে যে যাব না।
ওঃ! ঈ আমার বলে দেনেওয়ালি!
দাদা বুঝি গিয়েছিল আবার তোমার কাছে?
গিয়েছিল এই কথা বলতে যে প্রবীর মজুমদার সিনেমার পরে চিনে রেস্তোরীয় নেমন্তন্ন করেছে আমাদের। বেশ উৎসাহ ফুটল শাশ্বতীর গলায়। কিন্তু স্বাতী আবারও বলল–আমি যাব না। কী বোকার মতো কথা! ভদ্রলোক সব ব্যবস্থা করেছেন-আমরা রাজী হয়েছি—এখন নাযাওয়াটা মারাত্মক অভদ্রতা হবে।
তোমরা রাজী হয়েছ, আমি না।
তাহলে যাবি না? মনে-মনে রাগল শাশ্বতী।
না।
কেন? স্বাতী জবাব দিল না।
কিছু হয়েছে?
না–কী হবে।
ঝগড়া করেছে বিজু?
না তো।
তোকে কেমন বিষণ্ণ দেখছি?
নাকি?
বল না ব্যাপারটা কী?
কিছু না। স্বাতী মৃদু হাসল। শাশ্বতী আর রাগ চাপতে পারল না। ঝাঝিয়ে উঠে বলল—আমরা সবাই যেতে পারি আর তুমি পার না, না? মস্ত ইম্পর্ট্যান্ট লোক হয়েছ একজন!
হয়েছি বোধহয়, নয়তো এত করে বলছ কেন? দাম্ভিক জবাব দিল স্বাতী।
বলছি এই জন্য যে তোকে ফেলে যেতে খারাপ লাগছে আমার। না, তার জন্যও না-তোর ভাল লাগবে বলেই বলছি! বলে শাশ্বতী দুমদাম পা ফেলে বেরিয়ে গেল। স্বাতীর আশা হল যে ছোড়দি রাগ করে ওকথা আর পাড়বেই না, কিন্তু হল উল্টো। তার গলা শোনা গেল বাবার কাছে, আর একটু পরেই ফিরে এল বাবাকে নিয়ে।
বলো, বাবা, বলো ওকে! জ্বলজ্বল করল শাশ্বতীর চোখ।
রাজেনবাবুর মনে পড়ল এই দু-বোনের ছেলেবেলার ঝগড়া, ট্যাচামেচি, মারামারি… ভাগ্য এদের, এখনো তা ফুরোয়নি আর আমারও ভাগ্য, এখনো দেখছি। হেসে বললেন, কী রে? হয়েছে কী? স্বাতী মুখ খোলবার আগেই শাশ্বতী গলা চড়াল—ওকে তুমি এমন অমিশুক বানিয়েছে, বাবা! কিন্তু ভদ্র সমাজে চলতে-ফিরতে হবে তো একদিন!
আমি বানিয়েছি বুঝি?
তা ছাড়া আর কী! কোথাও যেতে দেবে না বাড়ির বাইরে—
বাবা কেন যেতে দেবেন না! স্বাতী বলে উঠল—আমারই ইচ্ছে করে না কোথাও যেতে। ঐ তো! নিজের ইচ্ছেটাকেই চরম বলে ভাবতে শিখেছে!
আচ্ছা, আচ্ছা রাজেনবাবু শালিশি করলেন। আজ ছোড়দির ইচ্ছা চরম হোক। তা আমার বুঝি নেমন্তন্ন না? শাশ্বতী স্বাধীনভাবে একটু খরচ করছে এতদিনে, মনে-মনে তিনি খুশি। বাবা— কী বলতে গিয়ে স্বাতী থেমে গেল। আর তার থেমে যাওয়াটাকে চাপা দিয়ে শাশ্বতী তাড়াতাড়ি বলে উঠল—বলিনি বুঝি তোমাকে? বিজুর সেই বন্ধু নেমন্তন্ন করেছে আমাদের। বিজুর বন্ধু?
মজুমদার–সেদিন খাওয়াল যাকে।
ও।
যদিও বিজুর বন্ধু, শাশ্বতী হাসল, ভদ্রলোক বেশ ভালই…আমরা যাচ্ছি, স্বাতীও চলুক না, বাবা। কথাটা শোনাল যেন স্বাতী যেতে চাচ্ছে না বাবার অমত হবার ভয়ে, আর তার হয়ে বাবার মত করাতে এসেছে ছোড়দি। স্বাতী তক্ষুনি বলল—না বাবা, আমি যাব না।
এ-কথাতেও রাজেনবাবু শুনলেন স্বাতীর যাবার ইচ্ছা। সত্যি তো ওর আরো বেরোনো উচিত, বেড়ানো উচিত। কত রকম ফুর্তি করে আজকাল এ-বয়সের মেয়েরা। একটু জোর দিয়ে বললেন—যাবি না কেন, নিশ্চয়ই যাবি। গেলে ভাল লাগবে।
কেমন যেন নিরুপায় হয়ে স্বাতীকে দলে ভিড়তে হল। নিজেকে অসহায় লাগল মজুমদারের গাড়িতে বসে। মনের মধ্যে গুমরে ফিরল এই সন্দেহ যে বাইরে বোঝা না গেলেও মনেমনে তার দিকেই মজুমদার মন দিচ্ছে বেশি, তারই জন্য আজকের এই আয়োজন। আবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধমক দিল-দেমাকে টাপুটুপু না হলে এ-রকম কি ভাবতে পারে কেউ? স্বাতী চেষ্টা করল সহজ হতে, অন্যদের ফুর্তির সুরে সুর মেলাতে, দাদা-ছোড়দির হাসাহাসিতে যোগ দিতে। কিন্তু গাড়ি চালাতে-চালাতে মজুমদার হারীতদাকে কি বলছে সেইটে শুনতেই তার কানের যেন আগ্রহ, তার চোখ বার-বার ঠেকে যাচ্ছে ফিকে নীল কলারের উপরে মজুমদারের টাটকা-ছাঁটা ঘাড়ে। খানিক পরে রাগই হল নিজের উপর ঐ ভদ্রলোকের কথা অত ভাবছে বলে। সিনেমায় এসেও তার অস্বস্তি গেল না, আর ঐ কোল্ড ড্রিঙ্ক নেবার সময় তো প্রায় ধরা পড়েই গিয়েছিল, প্রায় ঢাকনা খুলেই দিয়েছিল তার দেমাকের, তার বোকামির। সে ভাবছে যে মজুমদার তার কথাই ভাবছে, মজুমদার এ-কথা ভাবল তো!…নিজেকে ধরে মারতে ইচ্ছা করল তার। কিন্তু আসল ফিল্মটি আরম্ভ হবার দু-তিন মিনিটের মধ্যেই এ-সব তার মন থেকে মুছে গেল। হয়ত ছবিটি সাধারণের উপরে বলে, কিংবা সে কালে-ভদ্রে সিনেমা দ্যাখে বলে, কিংবা হয়তো তার নভেল-পড়া মনে বানানো ঘটনার সাজানো সুষমা প্রবল নাড়া দেয় বলে, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে তাকে টেনে নিল দ্রুত, জীবন্ত-উজ্জ্বল ছবিগুলি। যা দেখেছে তা তত ভালই, যেখানে বসে দেখছে তাও ভাল লাগল। মেট্রোর দোতলায় আগে আর আসেনি সে; এতক্ষণে বুঝল চেয়ারটা কত আরামের, পিঠে কত নরম, হাঁটু রাখার জায়গা কত বেশি! কার্পেট মোড়া গদি, সোনালি সিলিং, দেয়ালে ছবি-লোকে ছবি দেখবে অন্ধকারে বসে তো, তবে আর ওসব কেন—কিন্তু ওসবের জন্য, স্বাতীকে মানতেই হল, ছবিটা ভাল লাগে আরো। তখনকার মতো। অন্য সব কথা ভুলিয়ে দিতে চারদিককার এই সুন্দর ষড়যন্ত্র মুগ্ধ করল স্বাতীকে। শরীরের আরামে ড়ুবে গেল সে, মনের বিশ্রামে—কেননা সিনেমা ভাববার সময় দেয় না। তার পক্ষে নতুন এই বিলাসিতার চেতনায় পাশের চেয়ারের মজুমদার চলে গেল হাজার মাইল দূরে, তাকে ভুলতে পেরে স্বাতীর সুখ সম্পূর্ণ হল। আর সেই সুখের তাপ জুড়িয়ে গেল না ছবি শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই। সিনেমা দেখায় অভ্যস্ত অভিজ্ঞদের মতো বাইরে এসেই তার ফাঁকা-ফাঁকা লাগল না। আবার জমকালো সিঁড়ির জমকালো ভিড়ের মধ্যে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে নামতেনামতে একথা ভাবতেও তার ভালই লাগল যে এখন বাড়ি না-ফিরে আবার যাবে অন্য এক নতুন জায়গায়।
******
চাং-আন রেস্তোরয় স্বাতী যেন অন্য মানুষ। স্বচ্ছন্দে কথা বলল, আনন্দে হাসল, একটু যেন উত্তেজনাই ধরা পড়ল তার ঝলকানো চোখে আর রং-লাগা গালে। এই সে প্রথম চোখে দেখল কলকাতার চীনে পাড়া। সরু, প্যাচাননা, কম-আলোর গলি-গলির মোড়ে আর ঘরের দরজায় গুলিয়ে যায়। চ্যাপ্টা মুখের ট্যারা চোখের চীনেদের মাছ-পাতুরি-ঘেঁষাঘেঁষি পুরুষ, মেয়ে, ছেলেপুলেও; ভাত খাচ্ছে কাঠি দিয়ে, তাস খেলছে একমনে, বাচ্চা-কোলে মা দাঁড়িয়েছে রাস্তায়। ঘর থেকে পা বাড়ালেই তো রাস্তা, একটা সিঁড়িও পেরোতে হয় না–তাই সমস্ত গলিটা, মানে, সবগুলি গলির সমস্তটাই মনে হয় ওদের বাড়ি-ঘর, গাড়িটাকে বড়ো বেঢপ লাগে, একটু অভদ্র। বার দশেক মোড় নেবার পর স্বাতী অবাক হল, মজুমদার একবারও পথ ভুল করল না! ফটকওয়ালা যে দোতলার সামনে গাড়ি দাঁড়াল, সমস্ত পাড়ার মধ্যে সেটিই সবচেয়ে ভাল বাড়ি আর এতই বাড়ির মতো দেখতে যে স্বাতী প্রথমে বোঝেইনি যে এটাই চাং-আন। বাইরে ঝলমলে আলো নেই, নাম লেখা নেই। আর ভিতরেও চুপচাপ একটি টেবিলে দুজন বুড়োমতো সাহেব বসে আছে সামনে গেলাশ নিয়ে। কিন্তু তাদের দিকে তাকাবারও সময় পেল না, তারা উপরওয়ালা! ভাবছিল দুই জানালার ফাঁকে ঐ কোণের টেবিলটায় বসলে হয়। কিন্তু না— তাদের জন্য চার নম্বর কেবিন। তা মন্দ কী, এখানেও জানালা আছে–কালো অন্ধকার স্কুলে আছে মখমলের পরদার মতো, আবার একটু পরেই অন্ধকার ছাড়িয়ে আকাশ চিনতে পারল তিনটি তারার মিটমিটে চোখে…আর, এক চামচে স্যুপ মুখে দিতেই ধারাল একটি খিদে যেন চেতিয়ে উঠল তার মধ্যে। শুধু খাবার খিদে নয়, কথা বলার, হাসির, বন্ধুতার খিদে। বইয়ের বাইরে জীবন্ত মানুষের যে জগৎ সেই জগতের জন্য খিদে। সেই কথা আরম্ভ করল এই বলে—ফিল্মটা কেমন লাগল, ছোড়দি?
ভাল। শাশ্বতী কথায় যা বলল তার আওয়াজ তা বলল না। সব ফিল্মই তার প্রায় একই রকম লাগে মোটামুটি। তখন-তখন সবই ভাল লাগে, পরে আর কিছুই মনে করতে পারে না। ফিল্মটা খুবই ভালো হতে পারত—শেষটা যদি–
হলিউডের বুদ্ধি! হারীত দাঁত দেখিয়ে হাসল মজুমদারের দিকে, কেননা উপস্থিত ক-জনের মধ্যে মজুমদারই যাহোক কথা বলার যোগ্য। শেষ পর্যন্ত বোলোকও হল ছেলেটা-হাঃ! আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলবেন না— মজুমদার আরো চওড়া করে হাসল, কিন্তু শব্দ না করে—আমি ভাল করে দেখিইনি। সিনেমায় গিয়ে সিনেমাই যদি দেখলাম তবে আর যাওয়া কেন? এই পুরুষালি রসিকতায় হারীত হেসে উঠল অন্যরকম সুরে। আর স্বাতী মানে বুঝতে না পেরে অবাক হল—কেন, দ্যাখেননি কেন?
আদ্ধেকটা একেবারেই দেখিনি। মজুমদার সত্য কথা বলল।
কিন্তু কেন? স্বাতী প্রশ্ন ছাড়ল না। মুখ গম্ভীর করে মজুমদার জবাব দিল—ভাবছিলাম।
এতটাই যখন বলতে পারলেন তখন কী ভাবছিলেন সেটাও বলে ফেলুন।-হারীত দয়া করল মজুমদারকে, দোস্তালির সুর লাগল কথায়। আপনাদের নিয়ে এই সন্ধ্যাটা যে কাটাতে পারছি, আমার সেই সৌভাগ্যের কথা ভাবছিলাম—কথাটা শেষ করতে-করতে মজুমদার স্বাতীর মুখে একটু… একটুখানি চোখ রেখেই সরিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু স্বাতীর চোখ আটকে ফেলল তাকে। ফিল্মের মস্ত অসুবিধে আমার এই মনে হয়, স্বাতী বলল—যে মানুষ কী ভাবছে সেটা বলা যায় না। স্বাতীর চোখ আশায় কাঁপিয়েছিল মজুমদারকে, কথা শুনে চুপসাল। তবু চেষ্টা করল সেই কথার সুতো ধরেই তার ইচ্ছায় পৌঁছতে-মানুষ কী ভাবছে তা জানতে আপনার ইচ্ছে করে বুঝি খুব?
ও কিছু না! হারীত মত দিল তক্ষুনি-বুর্জোয়া কলচরের বিষফোড়া! আমি তো ফিকশন পড়তেই পারি না গোয়েন্দাগল্প ছাড়া।
সত্যি! এতক্ষণে বিজন একটা প্রমাণ দিল যে কথাবার্তা তার কানে যাচ্ছে। যা এক-একখানা ডিটেকটিভ নভেল—ওঃ! বলেই চোখ নামালো মিঠে-টক পর্কের থালায়। তাই হারীতের চোখের অবজ্ঞার হলকা তাকে ছুঁয়েও ছুঁলো না। মজুমদার মুখের ভাবে হারীতের কথায় সায় দিল, আর স্বাতীকে লক্ষ্য করে কথাটা জইয়ে রাখল–আপনার কীরকম বই ভাল লাগে?
যে বই সত্যি কথা বলে সে বই ভাল লাগে আমার।
বানানো গল্প আবার সত্যি হয় নাকি? শাশ্বতী হাসল।–হয় তো! বিজু খবর দিল। টু-স্টোরি ম্যাগাজিন দ্যাখোনি?
ঠিক তা নয়, আমি বলছিলাম কী–স্বাতীর একটু লজ্জা করল প্রথমে। কিন্তু বলতে-বলতে বেশ স্বচ্ছন্দেই বলে ফেলল—বলছিলাম যে মানুষ তো ভাবে মনে-মনে, আর যা ভাবে তা মুখে বলে না। মনের কথা জানা যায় শুধু পড়লে, আর গল্প পড়ার মজাই তো ঐ!
কেমন একটা চমক লাগল কথাটায়। যা ভাবে তা বলে না বুঝি কেউ?–বলে মজুমদার যতটা হাসল ততটা হাসির কথা ওটা নয়, আর হারীত থেমে গেল মাংসের টুকরো কাঁটায় কুঁড়তে গিয়ে। একটু তাকিয়ে থেকে, স্বাতীর দিকে কাটা উঁচিয়ে বলল–স্বাতী, তোমার বুদ্ধি আছে, কথা বলতে শিখেছ, কিন্তু মর্বিড় হয়ে যাচ্ছে। তোমার এখন উচিত—বলতেও যাচ্ছিল তোমার এখন উচিত বিয়ে করা। কেননা সেই মুহূর্তে স্বাতীকে তার ভাল লাগছিল বেশ, আর তার পাশে বড়ো ফ্যাকাশে লাগছিল নিজের স্ত্রীকে। কিন্তু একজন অল্প-চেনা মানুষের সামনে এই নরম মনের জানান দিতে চাইল না, ঠিক সময়ে ব্রেক কষে দিল। হারীতদার গলার আর তাকানোর উষ্ণতা স্বাতী অনুভব করল মনে-মনে, উপভোগ করল নিঃশব্দে।
শাশ্বতী বলল—কী-উচিত জেনে নিলি না, স্বাতী?
কী উচিত? হারীতদার মনঃপুত হতে হলে তোমার মতো হওয়া উচিত। স্বাতীর এ-কথায় মজুমদার আর হারীত হেসে উঠল একসঙ্গে। বিজুও হাসল-শাশ্বতীও—কিন্তু শাশ্বতীর হাসিটা কেমন জোর-করা, সুর-ছাড়া। এই তো দেখুন— ছোড়দিকে লক্ষ্য করল না স্বাতী, আলাদা করে মজুমদারের দিকে তাকাল এবার— হারীতদা কেমন বলতে-বলতে থেমে গেলেন। মনের কথা কি মুখে বলে কেউ?
আগেরবার শাশ্বতী যেমন, এবারে তেমনি জোর-করা হাসি মজুমদারের আর হারীতের। থেমেও গেল তক্ষুনি, দুজনেই একটু যেন আড়ষ্ট। এ-মুখ থেকে ও-মুখ তাকিয়ে স্বাতীর আরো সাহসী লাগল নিজেকে, আরো স্বাধীন। আবার বলল-ফিল্মের ঐ ছেলেটা মুখে ঘেন্না করছে। বড়োলোকদের, কিন্তু মনের কথা ঠিক উল্টো।
ঠিক–উৎসাহে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মজুমদার। একে তো কথাবদলের আরাম, তার উপর এমন মনের মত কথা! পাছে অত্যন্ত বেশি উৎসাহ ধরা পড়ে, গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল–এত যে রোখা-চোখা কথা চারদিকে, সে তো বড়োলোকদের সবাই হিংসে করে বলেই।–বড়োলোক হবার এই একটা সুবিধে তো আছেই যে সবাই হিংসে করছে ভেবে সুখী হওয়া যায়।
মজুমদারের মুখ অন্য-ধরনের গম্ভীর হল, আর হারীত গলা ছেড়ে হেসে বলল—তা বড়োলোকদের তোয়াজ করার চাইতে হিংসে করা ঢের ভাল, আমি তো বলি মহৎ গুণ সেটা। হিংসেটাই তো সবচেয়ে বড়ো তোয়াজ— চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে মজুমদার হেসে উঠল হো-হো করে, আর হারীতের চোখ তার দিকে তাকিয়ে হিংস্র হয়ে উঠল প্রায়। কিন্তু সেই চোখই স্বাতীর মুখে সরে নরম হল; একটু তাকিয়ে থেকে ছেলেমানুষের এই বেয়াদবি ক্ষমা করল সে।
স্বাতী দেখল যে কথাবার্তায় সেই কর্তা। দেখল, সে যা বলে তা-ই বেঁধে, নয় হাসায়; সাজগোজ করা প্রকাণ্ড মজুমদার, বিদ্বান ঠোঁটবাকা হারীতদাতার কথা উড়িয়ে দেয় না একজনও, বরং আরো শুনতেই চায়। আর দাদা আর ছোড়দি মুছেই গেছে। একা সেই কথা বলছে বয়স্ক দুজন পুরুষের সঙ্গে, সমকক্ষের মতো। শুধু সমকক্ষ? নিজের সম্বন্ধে স্বাতীর ধারণা বদলে গেল, কেননা এর আগে এমন সমানে-সমানে কখনো কথা বলেনি হারীতদার সঙ্গে, সামনেও না। নিজেকে এতদিন যেখানে বসিয়েছিল তার অনেক, অনেক উঁচুতে উঠে গেল এক লাফে। আরো কথা এল মনে, মুখে… আগে জানতও না এত কথা সে জানে। সাত রাজ্যের বই পড়ে পড়ে যত কথা তার মনের তলায় এলোমেলো পেঁচিয়ে পড়ে ছিল, সব যেন দাঁড়িয়ে গেল সার বেঁধে, পর-পর বেরিয়ে আসতে লাগল এমন ঠিক-ঠিক সময়ে যে স্বাতী নিজে তো অবাক হলই, এও বুঝল যে অন্যেরাও অবাক হচ্ছে। যত বুঝল যে আজ তার জিতের হাত, তত সে বলল, আর যত বলল তত জিতল সে। যে এক ঘণ্টা ধরে খাওয়া হল—তার, আর অন্যদের মধ্যে অন্তত দুজনের—মনে হল যেন পাঁচ মিনিট।
হারীত বসেছিল টেবিলের মাথায়, তাই বিল ধরা হল তার সামনেই। তাকিয়ে বলল-আজ আপনার অনেক খরচ হল মিস্টর মজুমদার। মন থেকেই বলল কথাটা। নিজে যে খরচ ভালবাসে
অন্যের খরচও তার খারাপ লাগে, তার ভোগে নিজের ভাগ থাকলেও। বাঁ হাতে এক তাড়া নতুন নোট বের করল মজুমদার। ডান হাতে গুনে ক-খানা দিল, বোয় বেরিয়ে যাবার আগেই বলল—রোজ পঞ্চাশ টাকা তো এমনি-এমনিই গলে যায়।
হারীত তাকাতে চাইল ঠাট্টার চোখে, কিন্তু একটু হকচকানিও ফুটল। রাজার ছেলে মকরন্দ, সেও তো কোনো পার্টি দিতে হলে সস্তা খোঁজে? কিন্তু তার-যে বাপ বেঁচে এখনো। বরাদ্দ মাসোহারায় চালাতে হয়। আর এ-লোকটার টাকা তার নিজের, নিজের রোজগার, জবাবদিহি নেই কারো কাছে। তাই বলে বাজে খরচই রোজ পঞ্চাশ টাকা? কীসের! অত পারে নাকি কেউ? কেন পারবে না? একটু বদ হলেই পারে। লোকটা হয় বদ নয় মিথ্যুক, এ-কথা ভেবে হারীত তার আত্মসম্মান ফিরে পেল। মজুমদারকে বাঁকা চোখে বিঁধে ভারি গলায় আস্তে-আস্তে বলল—প্রচুর, প্রভূত, অফুরন্ত টাকা থাকার মতো সুখ জীবনে আর কিছু নেই কী বলেন? মজুমদার বুঝল না হারীত যা ভাবছে তা-ই বলছে, তাই লজ্জা পেল। নেই-ই তো! ফশ করে বলে উঠল বিজন—সকলেরই সে-জন্য চেষ্টা করা উচিত।
কিন্তু সকলের তা হতে পারে না, অতএব কারোরই হওয়া উচিত না!—ঘোষণা করল হারীত। টাকার বেলায় না-হয় আইন করলেন, উঠে দাঁড়ানো স্বাতীর দিকে তাকিয়ে একটা উত্তর যোগাল মজুমদারের—কিন্তু মেয়েদের রূপ, পুরুষের বুদ্ধি, এ-সবের কী হবে?
মেয়েদের শুধু রূপ আর পুরুষের শুধু বুদ্ধি? স্বাতী চোখ তুলল, ভুরু বাঁকাল। মুগ্ধ হল মজুমদার। কী সুন্দর মানাবে হিরের কন্ঠি? তার চোখের প্রশংসা ঝরে পড়ল স্বাতীর গলায়, গলার তলায়, কথা বলতে ভুলে গেল। আর তার হয়ে জবাব দিল শাশ্বতী, তার মানে মজুমদারের মনের কথাই বলল, শুধু ভিন্ন সুরে–তোর মত মেয়ে তো কমই জন্মায় যার যেমন রূপ তেমনি বুদ্ধি!
অনেকক্ষণ ধরে চেপে-রাখা একটা নিশ্বাস কথাটার সঙ্গে ছাড়া পেল। মজুমদার তা লক্ষ্য করল, আর তক্ষুনি দোষ দিল নিজেকে। দুজন মহিলা যেখানে উপস্থিত সেখানে একজনকে লক্ষ্য না করার কারণ যদি এ-ও হয় যে অন্যজনের রূপও যত বুদ্ধিও তত, তবু বেয়াকুবির তো মাফ নেই। আর যে-কোনো অবস্থায় মাথা ঠিক রাখতে পারাকেই বলে বুদ্ধি। নিজের বুদ্ধি সম্বন্ধে ধারণা নেমে গেল তার। মিস্টর নন্দী যদি মিসেস নন্দীকে লক্ষ্য না করেন সেটাকে ভদ্রতা বলে চালানো যায়, কিন্তু আমার ব্যবহার আগাগোড়াই অন্যরকম হবার কথা, লক্ষ্য সামনে রেখে উপায়ের দিকে মন দিলে তবে তো লক্ষ্যভেদ! কী করে আমি ভুললাম যে ইনি আমার পক্ষ নিয়েছেন নিজে থেকেই, প্রথম থেকেই, আর কাজের সময় ইনিই দাঁড়াবেন আমার প্রধান সহায়—বিজনের চেয়েও বড়ো সহায়। কেননা এটাই-তো স্বাভাবিক যে বিয়ে-হওয়া মেয়ের কথাতেই বিপত্নীক বুড়ো বাপ কান দেবেন। কিন্তু আমি যদি এরকম ভুল করি, তাহলে আর কী করে কী হবে! মজুমদার সংশোধনের চেষ্টা করল তক্ষুনি। বেরোবার দরজার ধারে, প্রায় দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বলল আপনার কাছে আমার একটি ক্ষমা চাইবার আছে, মিসেস নন্দী। কীসের জন্য বলুন তো?
আপনি নিশ্চয়ই এখন বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত—
কেন?
বাড়ি থাকলেই ফিরতে ব্যস্ত হয় মানুষ-মজুমদার একচোখে তাকাল হারীতের দিকে, একবার নিশ্বাস ফেলল যেন দম্পতীর আনন্দকে ঈর্ষা করে, তারপর কথা শেষ করল—কিন্তু আর একটু সময় যদি দেন আমাকে, একটুখানি সময়, একটু কফি খেয়ে নেব ফিরতি পথে। চীনেদের খাবার-টাবার ভাল, কিন্তু কফির জন্যে কাউফমান। হিটলার ইহুদি খেদিয়ে আমাদের এই একটা সুবিধে করে দিয়েছে যে সত্যিকার কফি আমরা চিনতে পেরেছি এতদিনে। মজুমদারের সমস্তটা বক্তৃতা শাশ্বতীকে লক্ষ্য করল, শাশ্বতীকেই কত্রী বানাল তার গলার আওয়াজ। সে দেখতে পেল তার কথায় কাজ হচ্ছে, আর তক্ষুনি হারীতের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল–মাফ করবেন, মিস্টর নন্দী। হিটলারের কথাটা হয়তো ভুল বলেছি, কিন্তু কফির বিষয়ে বলিনি, আশা করি তা প্রমাণ করতে পারব।
তখনকার মতো শহুরে সভ্য না-হয়ে হারীত পারল না। আপনার আতিথেয়তার—
প্রতিদান দেবেন? নিশ্চয়—যেদিন আদেশ করবেন সেদিনই আমি হাজির হতে রাজী।
হারীত সে-কথা বলতে চায়নি, কোনো-একটা ভদ্রতার বাঁধা বুলি আওড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু এর পরে মজুমদারের কথাই মেনে নেবার ভাব দেখিয়ে বলতেই হল—সে-তো খুব সুখের কথা, কিন্তু আপনি যা ব্যস্ত, কোথায় ধরব আপনাকে?
আমাকে? কেন, আমাকে ধরার জন্য ভাবনা কী—বিজনের কাছে আমাকে যেতেই হয় মাঝে মাঝে—যেতেই হবে, ওখানেই তো সবচেয়ে ভাল, কী বলল ভাই বিজন? বলে দেলোয়ারি ধরনে বিজনের কাঁধে হাত রাখল মজুমদার। মিস্টর মিটুর মহিমা থেকে হঠাৎ এই ঘরোয়া ঘনিষ্ঠতায় বদলি হওয়াটা তার পক্ষে সুখের হল কিনা ঠাওরাতে না-পেরে বিজন হেঁ-হেঁ করে হাসতে লাগল। তাহলে আর দেরি না, কেননা তার প্রস্তাব পেশ করে, পাশ করিয়ে মজুমদার সরে দাঁড়াল টান হয়ে, কাটা দরজার একটি পাট হাতে ধরে—ফ্রাউ কাউফমান খদ্দের যত ভালবাসেন, তার চেয়েও খারাপ বাসেন রাত জাগতে।
কফিতেই শেষ হল না। আবার লেকে দু-চার চক্করও। অতিথিদের যার-যার দরজায় নামিয়ে দিয়ে মজুমদার একা হল এগারোটা রাত্তিরে। আর যে-মুহূর্তে একা হল, তার টগবগে ঝকঝকে ভাবটা খসে পড়ল মুখ থেকে, নাকের পাশের রেখা মোটা হল, নিচের ঠোঁট উপরেরটিকে ঢেকে দিল, থুতনি ঝুলে গলার চামড়া ঢিলে হল, বেরিয়ে এল ক্লান্ত একজন মানুষ, বড়ো ক্লান্ত, প্রায় বুড়ো। সোজা সে এল গীতালির বাড়িতে হা, ফিল্মেরই গীতালি। তার জন্য বসে থেকে-থেকে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রায়। চোখ রগড়ে বলল—এত দেরি? কোনো আগ্রহ ফুটল না কথাটায়, কৌতূহলও না, যেন এ-ই বলতে চাইল যে এত যেদিন দেরি হয় সেদিন আর না এলেই তো পারো। মজুমদার জবাব দিল না। জুতো-টুতে সুষ্ঠু এলিয়ে পড়ল তার নিজের পছন্দ করে কেনা কাউচটিতে।
খাবে নাকি?
না। মেয়েটি পরদা-ঢাকা দরজার দিকে তাকিয়ে ডাকল লক্ষ্মী। আর সেই ডাকে তার গলার আওয়াজ প্রাণ পেললক্ষ্মী, আমার খাবার দে। খাবার এলো, গীতালি একটুও দেরি করল না।
তার খাওয়া, আর-কিছু করবার নেই বলে, মজুমদার দেখল তাকিয়ে-অকিয়ে। গাল দুটো ফুলছে আর ড়ুবছে, কণ্ঠমণি কাঁপছে, মুখের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে, জিভ বার-বার চেটে নিচ্ছে ঠোঁট। একটি কথা বলছে না, একবার চোখ তুলছে না। হাতে ছিঁড়ছে… দাঁতে চিবোচ্ছে… গলায় গিলছে… খাওয়ার একটা যন্ত্র হয়ে উঠেছে তার শরীর। আমার জন্য বসেছিল এতক্ষশ, খিদে পেয়েছে চোর! এ-কথা মনে হতে পারত মজুমদারের, কিন্তু হল না। নিজের পেট ভরা বলে, আর মেয়েটির কাছে ছমাস ধরে আসছে বলে সে দেখল শুধু কুশ্রীতা। অসহ্য কুশ্রীতা। শুধু ঐ মেয়েটির নয়, সমস্ত স্ত্রীজাতির কুশ্রীতা।হঠাৎ বুঝল, সারাদিনের ক্লান্তির চেয়েও বড়ো ক্লান্তি সারাদিনের পরে কোনো-একটা স্ত্রীলোকের কাছে আসা, আর সেই ক্লান্তিকেকিলা ডাকতে হচ্ছে জীবনের মতে, সারা জীবনের মতো, আর-কোনো কারণে না, সুষ্ঠু জাক মেটাতে, তাক লাগাতে! কী যন্ত্রণা টাকার!