গাড়ির দরজা খোলার একটুখানি আওয়াজে আলো জ্বলে উঠল ভিতরের ঘরে, বাইরের ঘরে। আর দরজা খুলে রাজেনবাবু যেই দাড়ালেন, ঠিক তক্ষুনি গলির মোড়ে মিলিয়ে গেল গাড়ির পিছনের জ্বলজ্বলে লাল পাথর-চোখ। বিজু চলে গেল ভিতরে। স্বাতী বসে পড়ল বাইরের ঘরেই, পাখাটা খুলে দিল বসবার আগে। ঘরটা গরম আর বড়ো ছোটো না?
মেয়ের মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখলেন রাজেনবাবু। তারপর বললেন–যেতে তো চাসনি, বেশ ভালই লাগল তো? স্বাতী কথা বলল না। তার চামড়ায় তখনো বয়ে যাচ্ছিল লেকপাড়ের গাড়িচলার বেশিরাতের হাওয়া। রাজেনবাবু আবার বললেন–শাশ্বতী এল না?
কই, না তো! চলে তো গেল।
ভালই করেছে।
এলেই আরো দেরি হত, এগারোটা বেজে গেছে এমনিতেই–।
এত বেজেছে? রাজেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন—যা এখন, শুয়ে পড়। বলতে বলতে একটা হাই তুললেন নিজে। তাই তো, এখন শুয়ে পড়া ছাড়া আর কী করবার আছে? কিছু নেই, কিছুই নেই। রোজ রাত্রে একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুয়ে পড়তেই হবে, ঘুমোতেই হবে প্রতি রাত্রে প্রত্যেক মানুষকে। বিশ্ববিধাতার এই ব্যবস্থার উপর একটু রাগ করেই মাথা ঝেকে উঠে দাঁড়াল স্বাতী, আর দাঁড়িয়েই দেখতে পেল বাবাকে। শুধু-যে বাড়ি ফেরার পর এই প্রথম দেখতে পেল তা নয়, যেন অনেকদিন পর চোখে দেখল। যেন অনেকদিনের মধ্যেও বাবা এমন করে তার চোখে পড়েননি। সাদা, ছাইরঙা আর কালোয় মেশানো অল্প চুল মাথার, চোখের কোলে ছোটো-ছোটো আর নাকের পাশে মোটা-মোটা রেখা, গলার চামড়া ঢিলে, খোলা গায়ে থলথলে একটু খুঁড়ি। কোঁচাটা উল্টিয়ে কোমরে গোঁজা বলে সত্যিকার চাইতে বড় দেখাচ্ছে, ধুতি পরার কালো দাগের আভাস দেখা যাচ্ছে কোমরে। একজন বুড়োমানুষকে দেখল স্বাতী–বুড়ো, ক্লান্ত, সঙ্গীহীন, আপাতত ঘুম-পাওয়া। চমক লাগল, অবাক হল, যেন বিশ্বাস হল না। কেননা এর আগে কোনোদিন স্বাতীর চোখ বাবাকে বুড়ো দ্যাখেনি। কেমন লাগে বুড়ো হতে? কেমন লাগে বুড়ো হয়েও বেঁচে থাকতে? অন্য যত বুড়ো, আধ-বুড়ো মানুষ, রাস্তায় বেরোলেই যাদের দেখা যায়—তাদের কি মানুষের মধ্যে গণ্য করে স্বাতী, কি তার বয়সের অন্য কেউ? না—নিজের ঘরে আসতে-আসতে কথাটা ভেবে দেখল মনে-মনে-মানুষের মধ্যেই গণ্য করে না তাদের, মনে হয় ওরা আছে কেন? না-থাকলে কী এসে যায়! মনে হয় পৃথিবীটা তাদেরই, তাদেরই জন্য, যারা বয়সে তার সমান কিম্বা কাছাকাছি বয়সের। সকলেরই তা-ই মনে হয়। অন্য সব বিষয়ে যত ঘোরতর অমিলই থাক মতের আর মনের, এই একটি বিষয়ে তারা সকলেই একমত একমন, যাদের বয়স পনেরো-ষােলো থেকে আরম্ভ করে চব্বিশ-পঁচিশ। এমন একমন যে এ বিষয়ে তারা কথা বলে না কখনো, এ-ওর চোখে তাকিয়েই বুঝে নেয়। তাদের সমস্ত হাসি, ঠাট্টা, ফুর্তি, আড্ডা আর সমস্ত ঝগড়াঝাটি, কান্নাকাটির মস্ত মোটা বইটার প্রথম পাতাতেই এই কথা ছাপানো আছে নিচে-লাইন-টানা মোটা-মোটা অক্ষরে। পঁচিশের পরেই একটু ঝাপসা-হারীতদাকেই মনে হয় আলাদা জাত, আর ঐ প্রকাণ্ড মজুমদারকে তো নিশ্চয়ই। তবু সত্যি বলতে, হারীতদার সাতাশে, এমনকি মজুমদারের বত্রিশেও আজ কি তার ভিরমি লাগল? ঘরে এসে আলো জ্বালল! শাড়ি না-ছেড়েই বসে পড়ল চেয়ারে। ভাবতে চেষ্টা করল কতবছর বয়সে মানুষ বুড়ো হয়, কিংবা কত বছর পর্যন্ত হয় না। চল্লিশ? চল্লিশ সে কাকে চেনে? ঠিক? বড়ো জামাইবাবু। কত বয়স? তা চল্লিশ-টল্লিশ হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু বুড়ো? বাবার মতো?…হঠাৎ মেন-একটা কষ্ট হল, বাবাকে মনে-মনেও বুড়ো ভাবল বলে। পৃথিবীর সেই-সব বুড়ো, প্রায়বুড়ো মানুষ, পৃথিবীর যারা কেউ না, যারা বেঁচে আছে শুধু ট্রামের ভিড় বাড়াতে, বাবাও কি তাদেরই একজন? তার বাবা!
বুড়ো, ক্লান্ত, সঙ্গীহীন, ঘুম-পাওয়া, ঘুমোতে-না-পারা। বাবা ওঠেন খুব ভোরে—শীতে, গ্রীষ্মে সূর্য ওঠার আগে-ঘুমিয়েও পড়েন দশটার মধ্যে অঘোরে। আজ ঘুমোত পারেননি তার জন্যই। টেবিলের টাইমপিসে—বাবা এটা এনে দিয়েছিলেন ম্যাট্রিক পাশের পরে—এগারোটা বেজে দশ, প্রায় ছ-ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরল। এতক্ষণ বাড়ির বাইরে কবে থেকেছে? শিগগির তো মনে পড়ে না। কলেজেও এতক্ষণ কাটে না—আর কলেজ তো দিনের বেলা, সকলেরই কাজ থাকে তখন, কিন্তু রাত্তিরে? জামাইবাবুর সঙ্গে দল বেঁধে গিয়েছে সবাই শ্যামবাজারে থিয়েটারে—সবাই। বাবা ছাড়া কেন? যাঃ, বাবা আবার থিয়েটারে যাবেন কী—আর তাই বড়দিও প্রায়ই যাননি। যত উৎসাহে অন্যেরা গিয়েছে, তত উৎসাহেই বড়দি বাড়ি থেকেছেন। কেননা নিরিবিলিতে দুটো কথা বলা যাবে বাবার সঙ্গে। আর সে? বাঃ, সে কি যেতে চেয়েছিল নাকি আজ? বাবাই তো বললেন, আর ছোড়দি এমন জোর করল। কিন্তু যেতে চায়নি, তা কি বাবার জন্য?… না। নিজের কাছে জবাব দেবার আগে একটু থামল স্বাতী, যেতে চায়নি প্রবীরচন্দ্র মজুমদারের জন্য। মজুমদারের জন্য যেতে না চাইবার কারণ? ভাল লাগে না লোকটাকে—লাগে না? খুব খারাপ কাটল এই ছ-ঘণ্টা সময়?
স্বাতী নিজেকে দেখতে পেল মেট্রো সিনেমার মখমল কুশনে, কার্পেটমোড়া ঝলমলে সিঁড়িতে, চাং-আন-এর জমাট কামরায়, লেকপাড়ের হাওয়াগাড়িতে। আর ততক্ষণ বাবা? একলা বাড়িতে আলো-না-জ্বালা বারান্দার পাটিতে, একটা-দুটো পান, চুপচাপ-বাড়িতে চুপচাপ। বইপড়ারও অভ্যেস নেই বাবার—কী ভাবেন? তারপর কোনওরকমে–টা বাজিয়ে একলা বসে খেয়ে নিয়ে আবার দুটো পান। আর তারপর শুয়ে পড়লেই ঘুম, কিন্তু তাও আজ হল না, একা— অন্ধকারে চুপচাপ জেগে থাকলেন তার জন্য, সাড়ে দশটা, এগারোটা পর্যন্ত। হয়তো দেরি দেখে দুশ্চিন্তাও হল, কিন্তু সে কথা বলবার কেউ নেই। তাকেও কিছু বলবেন না, কোনো কথা বলবার কেউ নেই। তার সঙ্গে, সত্যি বলতে, কতটুকুই বা কথা আছে বাবার, আর তারই বা কী কথা বাবার সঙ্গে? বড়দি, তার পনেরো বছরের বড়ো, বাবার কাছে বসলে ঘর-সংসারের কথা তাঁর ফুরোয় না। কিন্তু তার মনের মধ্যে যত কথার আকুলিবিকুলি ছটফটানি, তার কতটুকু বলা যায় বাবাকে? এই তো এখন, সিনেমা দেখে চীনে রেস্তোরয় খেয়ে, কাউফমানের কফি পান করে, লেক-চক্কর দিয়ে, তারপর কি ইচ্ছে করে বাড়ি এসেই শুয়ে পড়তে, ঘুমোতে— ইচ্ছে কি করে না বাড়ি এসেও খানিকক্ষণ কথা বলতে, গল্প করতে, হাসতে? কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়তে, ঘুম-ঘুম গলায় কথা বলতে?…কিন্তু বাবা ঘুমোতে পারলে বাঁচেন, দাদাও এতক্ষণে বিছানায়। শুধু সেতার যেন ঘুম নেই, তৃপ্তি নেই। কেন?
ঘরের চারিদিকে তাকাল স্বাতী। ঠিক-ঠিক গোছানো, ফিটফাট। বেতের চেয়ার, নিচু মোড়া, নিচু আলনায় স্কুচোনো শাড়ি পেঁচিয়ে রাখা। ছোটো শেলফে বই, মশারি-ফেলা তৈরি বিছানা, টেবিলে রেকাবি-ঢাকা জল ভরা গ্লাশ, ঠিক যেখানকারটি যেখানে, ঠিক যেমনটি চাই। আর একটু ভাল করে তাকাল, ধোবারবাড়ির টাটকা পরদা জানলায়, টেবিলের ছড়ানো বইগুলি গায়ে-গায়ে দাঁড় করানো, দেয়ালে মার ঝাপসা হয়ে আসা ছবিটা একটু কম ঝাপসা। নতুন কিছু নয়, রোজই এ রকম। সে যেমন খুশি থাকে, চলে, ছড়ায়–আর রামের মা দু-বেলা গুছোয়, আর বাবা বলে দেন। বেশ তো আছে সে, খুব আরামে, একলা একটা ঘরে তার দিদিরা কেউ থাকেনি, তার কলেজ-বন্ধুরাও বোধহয় থাকে না, ভাবতে গেলে সারা দেশে কজন মানুষের কপালে জোটে একলা একটা ঘর! তার কপালেও জুটেছে নেহাতই দৈবাৎ, নেহাতই সে বাবার সবছোটো মেয়ে বলে। তা কারণ যা-ই হোক, আছে তো ভাল, নিরিবিলি, স্বাধীন, আপনমনে। তবে কেন ঘুম নেই, সুখ নেই, কী যেন নেই… কী? কী?
স্বাতী হাত বাড়াল জলের গ্লাশে। আর গ্লাশটা হাতে তুলতেই চোখে পড়ল—একটা চিঠি। নাখেয়েই নামিয়ে রাখল গ্লাশ, তুলে নিল শক্ত সাদা খামটা। কিন্তু তক্ষুনি খুলল না। একটু তাকাল খামের উপর নামের দিকে—তারই নাম, কুচকুচে কালিতে ঢেউ-বাঁকা অক্ষরে লেখা, কখন এসেছে… কখন থেকে অপেক্ষা করছে তার জন্য? যদি সে এসেই শুয়ে পড়ত তাহলে আজ হয়তো চোখেই পড়ত না। কী অন্যায়! কিন্তু কার অন্যায়? এতক্ষণ কোথায় ছিল সত্যেন রায়? আজকের বিকেল থেকে আরম্ভ করে এই মুহূর্তের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত একবারও তার মনে পড়েনি সত্যেন রায়কে, যেমন বাড়ি ফেরার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত একবারও মনে পড়েনি বাবাকে। বাড়িতে পা দিয়েই বাবাকে যেমন অন্যরকম লেগেছিল, তেমনি এই চিঠিটা—
স্বাতীর নিশ্বাস ভারি হল। কপালের চুল সরিয়ে আস্তে খুলল খাম, ভিতরে ভাঁজ করা কড়কড়ে সাদা কাগজটা আস্তে খুলল চোখের সামনে। ঢেউ বয়ে গেল তার মনের উপর দিয়ে, কালোকালো অক্ষরের কথা বলা ঢেউ। হাওয়া বয়ে গেল তার মনের উপর দিয়ে, পাহাড়ি হাওয়া, ঠান্ডা হাওয়া, শান্তির, অশান্তির হাওয়া। মনে পড়ল, আর সেই একটি মুহূর্তেই যেন মনেমনে পড়ল অন্য সব চিঠি; যত চিঠি সে পেয়েছে, যত চিঠি সে লিখেছে, সেই শান্তিনিকেতনের প্রথম চিঠি থেকে ফিরে এল তারা, উড়ে এল এক ঝাঁক পাখির মতো। কেউ-কেউ সাদা, অন্যেরা হালকা-নীল, কিন্তু সাদারা আর নীলেরা উড়ে চলেছে একই দিকে… দূর দূরের দিকে, তারপর আর বোঝা যায় না কে সাদা কে নীল।
চিঠি পড়া শেষ করে স্বাতী হাতে নিল গ্লাশ। একটু-একটু করে খেয়ে নিল সমস্তটা জল। নামল জল স্রোতের মতো তার ভিতরে, নামল তার মনে পাহাড়ি ঝরনা, ঠান্ডা, কত দূর থেকে ঠান্ডা, যত নামছে তত অশান্ত, নামছে সাদা আর নীল দুটি রেখার ঝরনা, নামছে অশান্তি দূর…দুরের সমুদ্রের দিকে। তারপর আর বোঝা যায় না কোনটা সাদাআর কোনটা নীল। চিঠিখানায় একটি হাত রেখে স্বাতী মাথা হেলিয়ে চোখ বুজল।
******
স্বাতী!
ডাক শুনে এমন চমকাল যে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। সামলে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে প্রথম কথা মনে হল কোনো-একটা বই-টই দিয়ে চিঠিটা চাপা দেয়। কিন্তু না—লুকোবে কেন, লুকোবার কী আছে? একটু তাকিয়ে, একটু হেসে বলল—তুমি ঘুমোওনি, বাবা?
তুই এখনো ঘুমোসনি যে?
ঘুম পায়নি।
ঘুম পায়নি বলেই বসে-বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলি?
ঘুমোচ্ছিলাম না, স্বাতী বলল—ভাবছিলাম।
ও আমার রাতজাগুনি ভাবুনি রে! রাজেনবাবু গলা ছেড়েই হাসলেন মেয়ের গম্ভীর কথা শুনে আর আরো গম্ভীর মুখ দেখে-শুয়ে পড় এক্ষুনি, আর এক মিনিট দেরি না।
হ্যাঁ বাবা, শুই। মেয়ের মুখে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে বাবা বললেন—কিছু চাই? রামেরমাকে ডেকে দেব?
না–না—তুমি শুয়ে পড়ো, বাবা—আমি এক্ষুনি— বলতে-বলতে স্বাতী টেবিলে পড়ে থাকা চিঠিটা দু-আঙুলে নাড়ল একটু। তারপর আস্তে-আস্তে খামে ঢুকিয়ে রাখল, যাতে বাবার চোখে পড়ে। রাজেনবাবু এক পলক তাকিয়ে বললেন—কী লিখেছে সত্যেন?
কী করে বুঝলে, কার চিঠি?
এত সুন্দর হাতের লেখা আমাদের জানাশোনার মধ্যে আর কার?
স্বাতী বলল—লেখেনও খুব সুন্দর। তামুপাহাড়ের কথা এমন করে লিখেছেন-একটু পড়ব, বাবা, শুনবে?
দুষ্ট! খালি ছুতো করে-করে জেগে থাকার চেষ্টা! আর কথা না—ঘুম!
রাজেনবাবু ফিরে এলেন নিজের ঘরে, শুয়ে পড়লেন অন্ধকারে। আর, একটু পরে দু-ঘরের মাঝখানকার পরদা-ঢাকা দরজাটাও অন্ধকারে মিশে গেল। আর, আরো একটু পরে রাজেনবাবুর কানে ভেসে এল নরম, খুব নরম গলার গুনগুনানি। প্রথমে বড্ডো লাজুক, একটু কঁপা, ভিতু গুনগুন। একটু চড়া, আরো, কিন্তু গুনগুন, তারপর আবার নামল মৃদু, মোছা-মোছা, গুনগুন। আহা—পাগল করা বেহাগ—গানটা ছেড়ে দিল স্বাতী! রাখলে তো ভালই হত—ভাল করে। শিখলই না, সেই যতীন দাস রোডে থাকতে একটু-একটু। আজকাল আর হাঁ-ও করে না বুঝি.. কতকাল পরে গানকে আজ মনে পড়ল ওর, কতকাল পরে মনের মধ্যে গানকে ফিরে পেলেন রাজেনবাবু। কান পেতে শুনলেন, মন ভরে শুনলেন—দুটো-একটা কথাও কানে এল, বোধহয়। রবিবাবুর কোনো-তাই এত মিষ্টি! তক্ষুনি কথা ড়ুবে গেল, শুধু গুনগুন। আহা—থামে না যেন! থামল না… সেই রাত্রে, চুপচাপ অন্ধকারে, ঘুম-জড়ানো বিছানায় শুয়ে-শুয়ে রাজেনবাবু আস্তে-আস্তে ভেসে গেলেন সেই দুঃখে, যে দুঃখ তিনি কখনো পাননি, আর সেই সুখে, যে সুখ শুধু কল্পনা। সমস্ত জীবনের ক্লান্তি মুছে গেল, সমস্ত পৃথিবী শান্তিতে ছেয়ে গেল আর তবু, রাজেনবাবু ঘুমিয়ে পড়ার পরেও আরো চলল গুনগুন, নরম, আরো নরম, আবছা-মোছা গলায়… একটু থেমে-থেমে… গুনগুন মনের গুনগুনকথা, ব্যাকুলতা, ভয়, প্রার্থনা, প্রশ্ন।
******
সেই যে ছেলেবেলায় একবার ছোড়দি তার হাতে বই পাঠিয়েছিল শুভ্রকে, আর সেই বই খুলেই নীল খামের ঝিলিক দেখে কেমন-একরকম হেসেছিল শুভ্র, তারপর থেকে চিঠির নীল রং দেখলেই একটা যেন ব্রাস হত স্বাতীর। মানে একথা ভাবতেই ত্ৰাস হত পাছে কোনোদিন তাকেও কেউ লেখে ও-রকম। কিন্তু সত্যেন রায়ের ঘরে গিয়ে দেখেছিল টেবিলের ঘন-নীল প্যাডের ফাঁকে ফাউন্টেন পেন গোঁজা, আর সেই কাগজেই প্রথম চিঠি এল শান্তিনিকেতন থেকে। ভয় ভাঙল, এমনকি ভাল লাগল, খুব ভাল লাগল ঐ ঘন-নীল বেগুনিমতো রংটা। কদিন পরে সে-ও কিনেছিল নীল রঙের কাগজ-খাম। অত ভাল রং পাড়ার দোকানে মিলল না, অমন খসখসে কাপড়-মতো কাগজও না। সবচেয়ে ভালো যা পেল, তা-ই এনেছিল, আর তারপর বসে-বসে ভেবেছিল কাকে চিঠি লেখা যায় তার এই নতুন নীল কাগজে।
কিন্তু চিঠি লেখার কোনো লোকই নেই স্বাতীর। বাবার হয়ে মাঝে-মাঝে মৈমনসিং-এ বড়দিকে, রেজুনে মেজদিকে আর দিল্লিতে সেজদিকে চিঠি লিখতে হয় তার–তাতা হামের পর কেমন আছে, ইরু এবার কোন ক্লাসে উঠল, দীপুর একটা ছবি পাঠিও, আমি ভালো আছি, বাবা ভালো আছেন, তোমরা কেমন। ছোটো ছোটো খবর-চিঠি, মোটামুটি একই খবর, একই রকম, টুকরো-টুকরো শুকনো হাড়—একে কি আর চিঠি বলে? ওরই মধ্যে একটু রক্তমাংস লাগিয়ে ফেলে সে। বড়দিকে জানায়—এক-একদিন সকালবেলা আমার এমন ইচ্ছে করে আলুসেদ্ধ খেতে—কিন্তু আলু সেদ্ধ হলেই তো হল না—লিখতে-লিখতে একটা পাতাই ভরে যায়। মেজদিকে জিজ্ঞেস করে—মেমিও গিয়েছিলে বেড়াতে, সে-কথা কেন কিছু লেখোনি?–কী সুন্দর নাম মেমিও—আচ্ছা, তোমরা স্টিমারে করে ভামো গিয়েছ কখনো সেদিন একটা বইয়ে পড়েছিলাম… মনে-মনে ভামোতে চলে যায়; ভামো, মেমিও, ম্যান্ডালে, ম আওয়াজটাই মিষ্টি; সমস্ত বর্মাটা যেন মস্ত একটা ভ্রমর! আর সেজদিকে খবর দেয় যে সেদিন পুরোনো একটা ট্রাঙ্ক থেকে তোমার নাম লেখা একখানা বই বেরোল হঠাৎ কী-বই বলল তো? তোমার আর কী করে মনে থাকবে–সত্যেন্দ্র দত্তের বেলাশেষের গান-সেজদি, তুমি কবিতা পড়তে তখন?–বইখানা কিন্তু আমার হয়ে গেল—আর তোমার হাতের লেখা কিন্তু একরকমই আছে— শেষের কটা পাতা নেই, কাগজও হলদে হয়ে গেছে—আরো বেশি ভালো লাগল সেই জন্য… এমনি চলল ড্যাশ দিয়ে-দিয়ে খানিকক্ষণ। কিন্তু অনেক দেরি করে করে এসব চিঠির জবাব যেই আসে, তক্ষুনি স্বাতী বুঝতে পারে তার ভুল। মেজদির সর্বদাই এত শরীর খারাপ যে চিঠিপত্র কয়েক লাইনের বেশি এগোয় না। সেজদির প্রত্যেক চিঠিতেই দারুণ তাড়াহুডোের লক্ষণ—ভুল কথা, কথা ফেলে যাওয়া, এক কথা দু-বার—শেষ করে একবার পড়ারও সময় নেই। আর বড়দি তো নিজের হাতে চিঠি লেখা ছেড়েই দিয়েছেন, নয়তো আর মেয়ে বড়ো হয় কেন মায়েদের! তিন দিদি বাইরে, তবু চিঠি লেখার কেউ নেই! অথচ লেখার ইচ্ছে ভীষণ লোকে যাকে দুঃখ বলে, এ-দুঃখ কি তার কোনোটার চেয়ে কম? একবার চেষ্টা করেছিল কলেজের অনুপমার সঙ্গে চিঠি জাতে, অনুপমা যেবার বেড়াতে গিয়েছিল তার কাকার কাছে বরিশালে। চিরাচরিত নিয়ম উল্টিয়ে স্বাতীই লিখেছিল আগে। জবাবও এসেছিল চটপট; উৎসাহ পেয়ে দুই নম্বর চিঠিতে অনেক কথাই বিনিয়েছিল, কিন্তু অনুপমার দুই নম্বর আর এলই না। কলেজ খুলতে স্বাতী যখন জিজ্ঞেস করল–আমার চিঠির জবাব দিসনি যে? অনুপমা দিব্যি হেসে বলল—কী আবার লিখব, আর সময়ই-বা কোথায়? বলে কী! সময় নেই! সময় তবে আছে কীসের জন্য? কথা নেই লেখার? মনের মধ্যে দিনরাত তবে তাতা-থৈ কীসের?
******
ছোড়দি, আমাকে চিঠি লিখবে তুমি? ভয়ে-ভয়ে, আড়চোখে, আধোগলায় শাশ্বতীর কাছেই প্রস্তাব করেছিল একদিন। চিঠি?
প্রশ্নচিহ্নটা সুতীক্ষ্ম হল শাশ্বতীর গলায়।
আমি লিখব আর তুমি জবাব দেবে।
সে কী রে! শাশ্বতী হাসল।–হাসছ কেন? স্বাতী দেখাতে চাইল দমেনি। শাশ্বতী জবাব দিল না, চোখের দিকে তাকিয়ে আরো হাসল।
চিঠি লিখতে ভাল লাগে না তোমার?
তোর বয়সে লাগত, কিন্তু–কথা শেষ না করে শাশ্বতী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দুই কানের মুক্তোদুল ঝিলমিলিয়ে।
এর পর একদিন দুপুরবেলা বসে-বসে স্বাতী নিজেই নিজেকে লম্বা লিপি চিত্রাল, আর তারপর নিজেই দু-জন সেজে আরো লম্বা জবাব বুনল পরের দিন। আর তারপর অবশ্য দুটোই ছিঁড়ে ফেলে দিল, কেন এ-খেলা, আর ভাল লাগল না, আর গোর্কির সেই টেরেসা গল্প মনে পড়ে আরো বেশি খারাপ লাগল। অতএব নীল কাগজের প্যাডটি খুব বেশী রোগা হয়ে যায়নি এই ছ-মাসে। কিংবা পাঁচ মাসে যেটুকু রোগা হয়েছিল, আবার প্রায় ততটাই হল তার পরের এক মাসে, সত্যেন রায় শিলং যাবার পর। স্বাতী আশা করেনি চিঠি-কিংবা করেছিল, আশা মানুষ কী না করে? কিন্তু সত্যি ভাবেনি… কিন্তু চিঠির ধরনটা এমন, যেন এ আগে থেকেই জানা, যেন এ-বাড়ি থেকেই গেছেন আর পাহাড়-বেড়ানোর চিঠি-পাঠানোর আর লোক নেই স্বাতী ছাড়া। স্বাতীর চিঠি পাবার, চিঠি লেখার কল্পনা এতদিনে একটা শরীর পেল। বিনা কাজের লম্বা ছুটি, লম্বা মে মাস, ভরা গ্রীষ্মের বড়ো-বক্সে দিনগুলির অনেকখানি নীল-সাদা লেখার আঁকে উড়িয়ে দিতে দিতে জ্বলজ্বলে জুন এসে দরজায় দাঁড়াল।
কিন্তু হঠাৎ কেন শক্ত হয়ে গেল চিঠি লেখা? যে-কোনো সময়ে মন থেকে কলমে আর কলম থেকে কাগজে ঝরঝর করে যার কথা ঝরে পড়ে, সে কেন আজ কলম হাতে নিয়ে চুপ? ভরেছিল চার পৃষ্ঠায় এক-কাহন, কিন্তু শেষ করে পড়ল যখন সমস্তটা–ছি-ছি, কী বাজে, ছেলেমানুষি, কী লিখেছে এসব! একটানে লম্বা করে দিল মাঝখান দিয়ে, কুচি-কুচি ছড়িয়ে দিল টেবিলতলায়, আবার আরম্ভ করল নতুন করে, কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে ভাল করে আরম্ভই করতে পারল না। কথা নেই বলে মুশকিল নয়, মুশকিল এই যে এত কথা আছে যে তার মধ্যে কোনটা লিখবে আর কোনটা লিখবে না, সেই হল মুশকিল। যেটা মনে আসে সেটাই মনে হয়—বাজে! অথচ এইরকমই সব পাঠিয়েছে আগে–এই সেদিনও—কেন পাঠিয়েছে? কেন? একটা সহজ, অত্যন্ত সহজ, কিন্তু অদ্ভুত, অত্যন্ত অদ্ভুত প্রশ্ন দেখতে-দেখতে স্বাতীর মনে গজিয়ে উঠল, ভেলকিওয়ালার গাছের মতো ছোট্টো চারা থেকে মস্ত বাঁকা-বাঁকা ডালপালা পর্যন্ত কেন সত্যেন রায় চিঠি লেখেন তাকে, আর সে-ই বা কেন পাওয়া মাত্র জবাব দেয়? কতটুকুই বা চেনা, আর চেনাই বা কী রকম, চিঠির কোনো কথাই ওঠে না সত্যি বলতে, অথচ এই সহজ কথাটা এতদিনে একবারও মনে হয়নি, কেন হয়নি? দিনটা, সিনেমা-সন্ধ্যার পরের সেই রবিবারটা বৃথাই কাটল স্বাতীর, জবাব লেখা হলই না। পরের দিন দুপুরবেলা সে যখন প্রায় শেষ করে এনেছে চিঠি, যেন একটা ভার নামাতে পেরে মনটা বেশ ভাল লাগছে, রামের-মা এসে খবর দিল বাইরের ঘরে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। ধক্ করে উঠল বুকের মধ্যে। সত্যেন রায়? ফিরে এলেন হঠাৎ? কিন্তু চিঠিতে তো–থাক তাহলে চিঠি। উঠে দাঁড়িয়ে, আঁচলে একবার মুখ মুছে জিজ্ঞেস করল-বসতে বলেছ?
বসেছেন।
পাখা খুলে দিয়েছ?
না তো!–
রাগ হল রামের মা-র উপর–এতদিনেও বোঝানো গেল না যে কেউ এলেই পাখাটা—রাগ বাড়ল বসবার ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকেই। কী বোকা রামের-মা, সত্যি! বলে দিলেই হত দাদাবাবু বাড়ি নেই।
কুচোনো কেঁচা মেঝেতে লুটিয়ে মজুমদার উঠে দাঁড়াল। ঝিরিঝিরি গিলের ঝিরঝিরানি তুলে দুহাত জোড় করল, চোখে চিকচিকোলে, ঠোঁটে হাসল, একটু পরে বসল, তারপর বলল – বিজন বোধহয় বাড়ি নেই?
না। এ-সময়ে তো থাকে না কখনো।
আমিও তাই ভেবেছিলাম বলে মজুমদার আরো একটু আরাম করে হেলান দিল চেয়ারে। কোনো কথা ছিল? এলে কিছু বলতে হবে?
না, বলতে হবে না কিছু। আর, দিনের মধ্যে দেখা হবেই একবার। একটু চুপ করে থেকে স্বাতী বলল—আজ আপনার আপিশ নেই বুঝি?
আপিশ? আপিশ আমার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘোরে। যারা চাকরি করে তারা বেশ আছে, দশটা-পাঁচটা কাজ, বাকি সময় নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার এমন একটা অবস্থা হচ্ছে দিন-দিন, এমন জড়িয়ে যাচ্ছি পঞ্চাশ ব্যাপারে… সবাই যেন আমাকে খুঁজে খুঁজে বের করছে, ইচ্ছে করলেও আর রেহাই নেই। এ-রকম কদ্দিন চলবে, আর কোথায় এর শেষ হবে হঠাৎ থেমে, একটু হেসে বলল-কিন্তু আপনাকে এ-সব কথা বলছি কেন? স্বাতী কথা বলল না, যেন মেনেই নিল মজুমদারের শেষ কথাটা। একটু পরে মজুমদার নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিল তা বললামই না হয়… শুনতে আপনার ভালো লাগছে না, কিন্তু বলতে তো আমার ভাল লাগছে! তার প্রায়-শেষ-করা, শেষ-না-করা চিঠির কথা ভেবে স্বাত এবারেও কিছু বলতে পারল না। মজুমদার বলল—আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন আমি এরকম অসময়ে হঠাৎ এসেছি বলে?
না-না–কী আশ্চর্য—আমি কেন—
কেমন অন্যমনস্ক দেখছি আপনাকে?
ই!
কী করছিলেন?
কী আর—
ঘুমোচ্ছিলেন?
ঘুমোবো কেন?… ইনি আমাকে দুপুর-ঘুমোনি ভাবলেন।
আমি বুঝেছি আপনার অবস্থাটা— মজুমদার গম্ভীরমুখে বলল—আমি উঠলে বাঁচেন, কিন্তু ভদ্রতা করে বসে থাকতে হচ্ছে, তাই না? স্বাতী লজ্জা পেল। এই তার দোষ, আর এই তার মস্ত অসুবিধে যে মনের ভাব লুকোতে সে জানে না.. তা বলে এরকম করে বলাটাও সত্যি! সে চোখ তুলল, চোখ নামাল, আবছা হাসল, কিছু বলতে গেল, আর এই প্রস্তুত অপ্রতিভ থেকে মজুমদারই তাকে উদ্ধার করল মুখে ভালোমানুষি হাসি আর কথায় ভালোমানুষি ঠাট্টা-সুর টেনে-কিন্তু ভয় নেই আপনার—আমি এক্ষুনি উঠব সারাদিন তো চরকিঘোরা আছেই বেশ লাগছে এই ঘরটিতে বসতে।
একটু ছলছলে হল স্বাতীর মন। মনে পড়ল এমনি এক দুপুরবেলার কথা, যেদিন সত্যেন রায় এসেছিলেন কমিনিটের জন্য নবজাতক বইখানা দিতে। কী-কষ্ট সত্যি পুরুষদের—না কষ্ট কী, কেমন স্বাধীন, যখন যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে, এই তো কেমন বেড়াচ্ছে শিলং পাহাড়েচিঠিটা পারবে তো আজ ডাকে পাঠাতে?…মনকে ফিরিয়ে আনল চিঠি থেকে। সহজ হয়ে বলল-বাঃ! আপনি বসুন না যতক্ষণ ইচ্ছে।
ইচ্ছে! যদিও ছুটির দিনেও সে দুপুরবেলা বাড়ি থাকে না—ভাবতেই হাঁপ ধরে—তবু স্থানকাল-পাত্রী বুঝে কথা সাজাল কার না ইচ্ছে করে বলুন, জানলা-ভেজানো ঘরে পাখার তলায় বসে দুপুরবেলাটা গল্প করে কাটাতে? কিন্তু–একটু আগে পুরুষের যে সুবিধের কথা স্বাতী ভাবছিল, তার ঠিক উল্টোটা এবার শুনল—যা ইচ্ছা করে তা-ই কি আর করা যায়? তাহলে আর কাজ বলে বস্তুটা জন্মাবে কেন জগতে?
তা কাজে তো আপনার অনিচ্ছা নেই! কিছু একটা বলতে পেরে স্বাতী যেন হাপ ছাড়ল। কথাটা শুনে স্পষ্ট খুশি হল মজুমদার, কেননা তার ভাষায় সবচেয়ে বড়ো প্রশংসাই এইটা। যারা তার চাকরি করে, আর যারা কোনওরকম সুবিধের জন্য তার কাছে হাত পাতে, তাদের সকলের কাছে যে কথাটি সে জাকিয়ে বলে, সে-কথাই এখানে একটু নরম করে বলল–কিন্তু সে অনিচ্ছা অন্যদের এত বেশি যে আমাকে মিছিমিছি চারগুণ খাটতে হয়। বেকারের এত কান্নাকাটি তো শোনেন, কিন্তু আমি তো দেখি পৃথিবী ভরে কাজ আছে বিস্তর, কিন্তু কাজের লোক নেই। সে চেষ্টা করল কিছু না বলে মুখে-চোখে সমর্থন জানাতে, কেননা সেটাই ভদ্রতা। তাতেই উৎসাহিত হয়ে মজুমদার আরো বলল—এই তো এক্ষুনি ছুটতে হবে বারো মাইল দূরে ফ্যাক্টরিতে। দু-বেলা নিজে না-দেখলে চলে না, ছোটোখাটো ব্যাপারও আটকে যায়—যদিও মাইনে দিয়ে লোক পুষছি অনেকগুলো। ভাষাটা ভালো লাগল না স্বাতীর, মনের মধ্যে কামড় দিল নিজের দাদার কথা। একটু হঠাৎ করেই বলল—আচ্ছা, একটা কথা। দাদা সত্যি-সত্যি কী করছে আপনি কি জানেন?
কেন, আপনারা জানেন না?
আমাদের কাছে কিছু বলে-টলে না।
তক্ষুনি মজুমদারের মুখে নামল আপিশ-বস-এর গাম্ভীর্য। নিচু গলায় থেমে থেমে বলল–বিজন ভালই করছে…ভালই করবে…ওর পার্টস আছে মনে হয়।
পার্টস? প্রশ্ন ফুটল স্বাতীর চোখে। কাজের লোক–সংক্ষেপে রায় দিলেন কাজের কর্তা। যে দাদাকে ছেলেবেলা থেকে বাড়িসুদ্ধ সবাই জেনেছে অকর্মণ্যের চরম নমুনা বলে, তার সম্বন্ধে এমন কথা তারই মুখ থেকে যে কিনা সারা রাজ্যে কাজের লোক দেখতে পায় না! স্বাতী যেন বুঝতে পারল না বিশ্বাস করবে কি করবে না। তার এর পরের কথাটাও তাই প্রশ্নের সুরেই বেরোল–তাহলে ভালই?
মনে তো হয়… হওয়া তো উচিত— বস-গম্ভীর মজুমদার বিচক্ষণ জবাব দিল। তারপরেই সহজ করল ভঙ্গি বড়ো দুশ্চিন্তা বুঝি ওকে নিয়ে আপনার বাবার?
দাদা এঁকে কী বলেছে আর কতখানি বলেছে, মজুমদারের মুখের চেহারা থেকে তা বুঝে নেবার, চেষ্টা করতে করতে স্বাতী বলল—হওয়া কি অন্যায়?
নিশ্চয়ই না—আর ম্যাট্রিকটাও যখন পাশ করতে পারেনি—কিন্তু আমিও তো– মজুমদার বড়ো বড়ো দাঁত দেখিয়ে হাসল–মাত্ৰই ম্যাট্রিক পাশ। তার দাদা আর একজন মজুমদার হলে তার কেমন লাগবে, স্বাতী মনে-মনে তা চিন্তা করল।
স্কুল-কলেজের পাশ-ফেল আর জীবনযুদ্ধের পাশ-ফেল এক জিনিস নয় মজুমদার তার অভিজ্ঞতার অংশ দিল স্বাতীকে, আর সেই সঙ্গে আশ্বাসও–আপনার বাবাকে বলবেন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমি ওকে সাব-কনট্র্যাক্ট দিতেই থাকব নিয়মিত। আর অমনি করে-করে নিজেই দাঁড়িয়ে যাবে একদিন। এখন যুদ্ধটা কয়েক বছর টিকলেই হয়।
মজুমদার তাহলে কনট্রাক্টর? আর দাদাও সেই কাজে ঢুকেছে? মনটা খারাপ হয়ে গেল স্বাতীর। আস্তে আস্তে বলল—কিন্তু বাড়ি বানাবার কাজে দাদা কী করবে? মজুমদারের মোটা গালে ভাজে-ভঁজে হাসি ছড়াল, আবার মনে-মনে উপভোগও করল মেয়েটির এই প্রায় পাড়াগেঁয়ে অজ্ঞতা। প্রায় সস্নেহ সুরে বলল—বাড়ি বানাবার কনট্র্যাক্ট নয়, যুদ্ধের সাপ্লাইয়ের কনট্রাক্ট। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল যে স্বাতী বুঝল না কথাটা। কিন্তু আর বোঝাবার চেষ্টা না করে বলল—বিজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল নিশ্চয়ই কোনো শুভক্ষণে।
কেন? সরল প্রশ্ন স্বাতীর।
সেইজন্যই তো আপনা— মুখে এসেছিল আপনার, কিন্তু ঠিক সময়ে কথাটা বদলে নিল–আপনাদের সঙ্গে তো আর আলাপ হত না তা না হলে। আপনার ছোড়দি চমৎকার মানুষ, হারীতবাবুও। কবে আবার আসবেন ওঁরা এখানে?
ঠিক কী?–
আগে একটা খবর পেলে চেষ্টা করতে পারি হাজির হতে–অবশ্য আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে। স্বাতী চেষ্টা করল এমন করে হাসতে, যাতে বোঝা যায় আপত্তির কোনো কথাই ওঠে না। হঠাৎ কব্জিঘড়িতে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল মজুমদার। চলতে-চলতে বিদায় নিল, এবারও পিছনে না-তাকিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। কিন্তু হঠাৎ নয়, আগে থেকেই আড়চোখে ঘড়ি দেখছিল, আর ঠিক সময়মতোই উঠেছে। যে জন্যে এসেছিল তা হয়েছে তার। সোমবারের দামি সময় থেকে খানিকটা খাবলে নিয়ে যে জন্য সে এসেছিল হালকা-হাওয়ায় খামা-চলার উজান বেয়ে ক্যানিং স্ট্রীট থেকে টালিগঞ্জে, তা হয়েছে। ভালমতোই হয়েছে, বেশ খুশি লাগছে নিজের উপর। সে এসেছিল তার মনোনীতাকে একা পেতে ততটা নয়—তাতে আর তেমন লাভ কী, আর সেটা তো একটু বেশি পরিমাণেই সহ্য করতে হবে পরে—যতটা বাড়িতে, অসময়ে, অতর্কিতে দেখতে, যতটা সম্ভব অপ্রস্তুত অবস্থায়। কিন্তু বাস্তব তার আশাকে ছাড়িয়ে গেছে, কেননা সে ভাবতেই পারেনি যে সত্যি দেখতে পাবে এমন করেই, এতটাই অসাজা, অমাজা, যেমন-তেমন। একবার একটি নাচিয়ে মেয়ের সঙ্গে আলাপের একটু সূত্রপাত হয়েছিল তার, পার্টি আলো করে আছে ফুটফুটে পরীটি। কিন্তু সেই মেয়েকেই একদিন সকালবেলা বাড়িতে দেখে প্রায় চিনতে পারেনি, মনে হয়েছিল অন্য মানুষ। শুধু যে গায়ের রং কালো তা নয়, নাক-চোখ পর্যন্ত আলাদা যেন। আবার, আরো একটু উঁচু-ঘরের এমন মহিলাও সে দেখেছে, যাদের বাইরের চেহারা আর বাড়ির চেহারা প্রায় একই রকম। সত্যি তারা দেখতে কেমন—যদি সত্যি বলে কিছু থাকে-তা বোধহয় ঈশ্বর ছাড়া যদি ঈশ্বর বলে কিছু থাকে—কেউ জানে না। মজুমদার অবশ্য আগেই জেনেছিল যে বিজনের বোন এই দু-দলের কোনো দলেই পড়ে না। কিন্তু এটা জানত না, এটা সে ধারণাও করতে পারেনি যে আজকালকার কোনো ভদ্রমহিলা একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবার আগে চুলে একবার চিরুনিও চালায় না, মুখে একবার পাউডারও বুলোয় না, যেমন ছিল তেমনি বেরিয়ে আসে কুঁচকোনো আধ-ময়লা শাড়িতে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ভাল করে তাকিয়ে দেখছিল ছোটো-ছোটো কোঁকড়া চুল পাখার হাওয়ায় উড়ে-উড়ে পড়ছে কপালে, মুখখানা একটু লালচেকালো, ঘামলে যেৱকম হয়। ভিতরের ঘরে পাখা নেই নাকি? আঙুলে কালির দাগ—লিখছিল? ফাউন্টেন পেন নেই? শাড়িটা নেহাত বেচারা গোছের, আর ব্লাউজটা আঁচল-ঢাকা হলেও কড়া চোখে ধরা পড়ল, ব্লাউজটা সস্তা—পপলিনের, তাও ফিট করেনি ঠিক, বোধহয় স্বহস্তেই প্রস্তুত। সাধারণ, একেবারেই সাধারণ। এ-রকম দু-চার লক্ষ পাওয়া যাবে এই মুহূর্তে এক কলকাতাতেই তা-ই কি? কপালে-তা কোঁকড়া ছোটো চুল, মুখ, চোখ, হাসি-অনিচ্ছার ঐ আবছা একটু হাসি-আর খালি, সাদা, পাতলা পা-দুটি বেশ-তো মানিয়েছিল মেঝের উপর। ঐ বাজে মেঝেতেই ও রকম, আর সাদা আর ছাইরঙ মার্বেল-মেঝে হলে? বড্ডো ঘরোয়া আজকালকার হিসেবে, এক-এক সময় ছেলেমানুষ, কোনো খবর রাখেনা পৃথিবীর বাইরের ব্যাপারে কিছুই বোঝে না তা ভালোই তো। মজুমদারের এতক্ষণে সন্দেহ হল যে আবছা-আলোর ঐ ঘরটিতে এই ঘোরদুপুরের সময়টুকু তার ভালই কেটেছে, ভাল লেগেছে তার, যেমন ভাল লাগছে এই আগুনতাতা দুপুর-গাড়ি থেকে অল-সবুজ কোঁকড়া পুকুরটাকে পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে। এই ভাল লাগাটা ভাল লাগল না মজুমদারের। নিজের সম্বন্ধে তার ধারণার সঙ্গে মেলে না এটা, একটু যেন শ্রদ্ধা কমে গেল নিজের উপর। তবু, কমলা আলো সবুজ হবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ো রোড ধরে ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে এগোতে এগোতে আবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মেঝেতে পাতা পাতলা সাদা পা-দুটি। আর ঠিক তখনই সেই পা-দুটি ঢুকল স্যান্ডেলে, বেরোল রাস্তায়, চলল তাড়াতাড়ি, পেরোল গলি, থামল গলিমোড়ের চিঠিবাক্সের সামনে লাজুক কথা অন্ধকারে লুকোল, আকাশে উড়ল ছোট্ট লাজুক হালকা-নীল পাখি।
সে চিঠি যখন পৌঁছল, সত্যেন রায় ব্যস্ত ছিলেন হিলভিউ হোটেলের আফটরনুন টি-র প্রতি যথাসাধ্য সুবিচারের চেষ্টায়। চেষ্টায়? তবে কি পাহাড়-পাড়ার নামডাক মিথ্যে, না কি সত্যেন রায়েরই স্বাস্থ্য তেমন ভাল যাচ্ছে না? না। সে-বছরের সেই গ্রীষ্মে, বর্ষা নামার আগের মাসটিতে, পৃথিবীর মধ্যেই স্বাস্থ্যকরতার একটা প্রাইজ নিতে পারত শিলং; আর সত্যেন রায়, যৌবনের চুড়ায়, শান্ত, সমতল, উচ্চাশাহীন জীবনের স্বাধীনতায়, শিলঙের গুণপনাকে এমন করেই আত্মসাৎ করতে পেরেছিলেন, যেমন বোধহয় আর একজনও পারেনি সে-বছরের হাজার দেড়েক গ্রীষ্ম-প্রবাসীর মধ্যে। জীবনে কখনও এর চেয়ে ভাল ছিলেন না তিনি। এতই ভাল যে, হিলভিউ হোটেলের আফটরনুন টি-টাও প্রায় পুরো পাওনাই আদায় করে নিচ্ছিল তার কাছে। আর নেবেই-বা না কেন, টি যখন, চা নিশ্চয়ই আছে, আর তৈরি পেয়ালার বদলে টি-পটের সুবিধেটাও তিনি জুটিয়েছিলেন। অবশ্য বিনামূল্যে নয়—আর যদিও রান্নাঘর থেকে তার ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে টি পটসুদু তাপ হারাত, আর যদিও দেশটাই চায়ের কিংবা সেইজন্য চা-পাতাটাও ঠিক পয়লানম্বরি নয়–তবু চা তো। আর নাম যখন বিকেল-চা, শুধু চা-ই নয়— সঙ্গে লুচি, আলুভাজা আর ফল-টল। লুচি অবশ্য চামড়ামাতো, আলুভাজা ন্যাতার মতো, আর ফল মানে হচ্ছে শনিপূজোর সিন্নির মতো কুচি-কুচি কলা আর শশা, কি বড় জোর চাকচাক টক-টক বুনোনা আপেল। তা যা-ই হোক, এ নিয়ে খুব বেশি নালিশ ছিল না সত্যেন রায়ের। নালিশের বাধা ছিল তাঁর স্বভাবে, আর প্রতিকার ছিল যকৃতের সক্রিয়তায়। ঐ টি-পটটার জন্যই তিনি কৃতজ্ঞ, আরো কৃতজ্ঞ একটা ঘর পেয়েছেন বলৈ। ঘর মানে অবশ্য—তা এর বেশি লাগবেই বা কীসে, তার প্রায় সারাদিন তো বাইরে-বাইরেই—উঠতে হয় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, একমাত্র জানলাটিকে বন্ধ করলে ফাপর আর খুলে রাখলে বরফ। হোটেলের আসল বাড়ি থেকে আলাদা বলে ইলেকট্রিক আলোও নেই। কিন্তু এর কোনোটাই তেমন অসুবিধে লাগে না তার এখনকার বাসিন্দার, সুবিধেই বরং, আর অসুবিধেও যদি লাগত, যে-কোনো অসুবিধেই কি সুবিধে নয় তিন-চারজন জবড়জঙের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটানোর তুলনায়? বেশ প্রীত-চিত্তেই অনতিতপ্ত চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন সত্যেন রায়। তার এখনকার অবস্থাটাকেই কল্পনা করে নিচ্ছিলেন কুইন্স হোটেলের উচ্চচূড়-চা বলে (হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়েছিল একদিন)। আর সত্যি-তো কুইন্স হোটেল হলেও সুখ কি আর বেশি হত এর চেয়ে? একা আছি, আরামে আছি, মন খেলাবার ভাল-ভাল ভাবনার অভাব নেই, আর কী চাই?
আর কিছু চাই না। কিন্তু আরো কিছু হলে আরো বেশি সুখী যে হওয়া যায়, সেটা প্রমাণ হল একটু পরেই। খাসিয়া চাকর চিঠি এনে তার সামনে রাখল, রেখেই চলে গেল। আর ওটুকু সময়ের মধ্যেই একমাত্র তাকিয়ে স্পষ্ট জানাল যে বার-বার কাঠসিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে এই খুচরো অথচ বিশেষ কাগজগুলোর সঙ্গে সমান মাপেই যেন বখশিস ওঠে বাবুর হাতে, এখান থেকে চলে যাবার সময়।
******
টাটকা-গরম তোস-রুটি বলল, ভাঁজ-না-ভাঙা খবর-কাগজ বলল,নতুন-কেনা পাতা-না-কাটা বই বলল, চায়ের সঙ্গে চিঠির মতো কিছু না। হোক সকালে, হোক বিকেলে, হোক যে-কোনোরকম চা আর যে-কোনো লোকের চিঠি-বই-দোকানের বিল হলেও আপত্তি নেই—শুধু পোস্টকার্ড না হলেই হল। আর যদি হয় এমন কারো চিঠি, যাকে ভাল লাগে, এমন-কোনো চিঠি, যা ভাবতেই ভালো লাগে…চা-পেয়ালা নামিয়ে চিঠিটা হাতে নিলেন সত্যেন রায়। একবার উল্টিয়ে দেখলেন, আর একবার আলোর দিকে তুলে দেখলেন, যেন নেড়েচেড়েই ভিতরটাকে চেখে নেবেন একটু। তারপর খাম খুলে এক নিশ্বাসে পড়ে নিয়ে চিঠিটা হাতে রেখেই আর এক পেয়ালা তুলে একটু লম্বা মাপেই চুমুক দিলেন চায়ে। আর সঙ্গে সঙ্গেই মুখ-চোখ বিকৃত হল—ছি! একদম জল! জল-চায়ের টোকটাকে খুক করে গিলে ফেলে মন থেকে চা-চিন্তা সরিয়ে দিলেন তখনকার মতো। আবার আস্তে আস্তে থেমে থেমে পড়লেন চিঠি, চিঠি শেষের নামের উপর চোখ রাখলেন একটুক্ষণস্বাতী..স্বাতী মিত্র। নামটি ঝংকার দিল প্রোফেসরের মনের মধ্যে, সেই হলদে-লাল সূর্যাস্তে প্রথম যেমন শুনেছিলেন। সুন্দর নাম। ছোটো-ছোটো দুটি কথা, সমান ওজনের, নরম একটু অনুপ্রাস। সবসুন্ধু হালকা, আবার সেই সঙ্গে গম্ভীরও। লিখলে ভাল দেখায়, বললে ভাল শোনায়…তাই-তো, তবে কি আমি এই নাম নিয়ে এতই ভেবেছি? এই বিষয়টাকে যত রকম করে ভাবা যায়, কিছুই তো বাকী রাখিনি মনে হচ্ছে…কিন্তু হঠাৎ যেন একটু ঝাঁকুনি লাগল শরীরে—অবাক লাগল যে এত ভেবেও এই আসল কথাটাই এখনও ভাবেননি যে এ-নামটা কাচা… অস্থায়ী… বলতে গেলে মিথ্যে। ঐ ছন্দে বসানো ছিপছিপে মিত্রকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কেউ কায়েম হবে একদিন–একদিন কেন, শিগগিরই-খুব যে তার দেরি নেই সেটা নিশ্চিতই।
******
এই নাম বদলের ব্যাপারটা সত্যেন রায় ঠিক পছন্দ করলেন না। চিঠিটা খামে, আর খামটা পকেটে ঢুকিয়ে একটু ক্ষিপ্রভাবেই উঠে পড়লেন। চায়ের বাসনগুলো সরিয়ে রাখলেন তক্তাপোশের তলায়। সেই তলা থেকে টেনে আনলেন স্যুটকেস, তালা খুলে বের করলেন একটা পরিষ্কার রুমাল, বন্ধ করে আবার ঠেলে দিলেন ভিতরে। উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ারের পিঠ থেকে তুলে কালো রঙের আলোয়ানটি গায়ে জড়ালেন, হঠাৎ একটু থেমে মনিব্যাগের ভিতরটাতেও উঁকি দিয়ে নিলেন একবার। এই কাজগুলির প্রত্যেকটিতেই প্রকাশ পেল তার পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস, জীবনযাপনের ধীর লয়ের সমতা। কিন্তু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার নিজেরই মনে হল যেন একটু তাড়াহুড়ো করছেন, বিরক্ত হলে মানুষ যেমন করে, কিংবা যেন কারো সঙ্গে দেখা হবে কিন্তু কারো সঙ্গেই তো না। বেশি দূর হাঁটলেন না। প্রথম যে জায়গাটা মনে হল সহনীয় রকম নিরিবিলি, সেখানেই পাইনতলায় বসে পড়লেন। সুন্দর… যে কোনো জায়গাই সুন্দর এখানে। কিন্তু এই প্রথম, বোধহয় জীবনেই প্রথম-প্রকৃতির লীলাখেলা তেমন-যেন রুচল না। পার্বত্য-দৃশ্য ছাড়াও অন্যরকম লীলাখেলা আছে প্রকৃতির, সেইটা কেড়ে নিল মন। সেদিন বসে বসে জীবনের কোনো তত্ত্ব ভাবলেন না, জীবনটাকেই ভাবলেন। নিজের জীবন-যেটা, তারই বিবেচনায়, নিতান্তই অযোগ্য বিষয়। কেননা নিজের কথা বড়ো বেশি ভাবে তারাই, যাদের মন অন্য কোথাও পৌঁছতে পারে না। অর্থাৎ যারা বোকা, মূখ, কিংবা অসুখী। প্রথম দুই শ্রেণীর কোনো একটির অন্তর্গত বলে নিজেকে ভাবতে চাইল না সত্যেন, মন দিল তৃতীয়টিতে।
কিন্তু নিজেকে অসুখী বলে কখনোই তো সে ভাবেনি এ পর্যন্ত। বরং উল্টো, জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর এ ধারণাই তাকে উপহার দিয়েছে যে ভাগ্যের বিশেষ একটু পক্ষপাত আছে তার উপর। মা যখন মরেছিলেন—জীবনের এই পরিচ্ছেদটায় ছাত্রীর সঙ্গে বেশ মিল আছে তার—তখন সে এতটা বড়ো যাতে মা না-থাকলেও বেঁচে থাকতে খুব বেশি অসুবিধে হয় না, আর এতটা ছোটো যাতে আঘাতটা আস্তেই লাগে। বাবা আর বিয়ে করলেন না, উল্লেখযোগ্য অন্য কিছুও করলেন না জীবন ভরে। কম খরচে, কম রোজগারে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালেন ছেলেকে নিয়ে। তারপর শান্তিনিকেতনে দিলেন, আর ছেলে যখন ম্যাট্রিকুলেশনে স্কলারশিপ পেয়ে কলকাতায় পড়তে এল, তখন থেকে বাসা নিলেন ধলেশ্বরীর ধারে দেশের বাড়িতে। প্রচুর পরিশ্রম করে গ্রামে এক লাইব্রেরি বসালেন, তারপর সেই লাইব্রেরিতে রোজ দু-খানা খবর-কাগজ পড়ে আর যে-কোনো ইচ্ছুক কিংবা অনিচ্ছুক শ্রোতার কাছে বিবিধ রাষ্ট্রিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিক সমস্যার উত্তর বিশ্লেষণ করে দিন কাটাতে লাগলেন। মোটের উপর মন্দ কী! সবচেয়ে ইচ্ছুক, সবচেয়ে সসাত্তর শ্রোতা অবশ্য তাঁর ছেলেই। আর আস্তে আস্তে নিতান্তই শ্রোতার পর্যায়ে সে আর রইল না, নিজেরও দু-একটা কথা বলবার হল। বাবা তাই ব্যগ্রভাবেই তাকাতেলাগলেন ছেলের ছুটি-হওয়া বাড়ি-আসার দিকে। খুব ইচ্ছা করেছিলেন ছেলে হবে ইতিহাসের পণ্ডিত, কিন্তু সত্যেন পছন্দ করল ইংরেজি-সাহিত্য। তবুতার ইচ্ছাটাকেও সম্মান জানাল তার অনার্সের একশো টাকার প্রাইজ থেকে কয়েকটি বাছা-বাছা মোগল ইতিহাসের বই বাবাকে পাঠিয়ে, যেহেতু মোগল আমলটাতেই তার আগ্রহ বেশি। এই যে প্রথম সে বাড়িতে কিছু পাঠাল তাও নয়। আই. এ. পড়তে পড়তেই সে ট্রশনি ধরেছে, স্কলারশিপ তো আগাগোড়াই আছে, এমন দিনের নাগাল পেতে তাই খুব দেরি তার হল না, যখন কলকাতায় নিজের খরচ নিজে চালিয়ে বাবাকে ছোটোখাটো মনিঅর্ডারও সে পাঠাতে পারল। সংক্ষেপে থাকতে শিখেছিল বাবার কাছে, কলকাতায় ছাত্রজীবনে যে-সব অভ্যাস সংগ্রহ করে অনেকেই উপস্থিত সুখের অনুপাতে ভবিষ্যতের দুঃখ জমায়, তার একটাও টানতে পারল না তাকে, সিগারেট পর্যন্ত ধরল না। আর সেইজন্য সহপাঠী আর সমবয়সী অনেকেরই তুলনায় গরিব হয়েও অর্থাভাবের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটল অনেকেরই তুলনায় নামমাত্র। একমাত্র বাজে খরচ ছিল বই কেনা। বাজে নয় অবশ্য, খুব বেশি রকমই কাজের। কিন্তু কোনো একটা বই নিজে কিনতে না পারলেও খুব দুঃখ নেই, কলেজের লাইব্রেরিতে, কিংবা অন্য কোথাও পাওয়া যাবেই-আর জীবনের অধিকাংশ বই তো ধার করেই পড়তে হয় মানুষকে। না, টাকার কষ্ট সে পায়নি। এমন একটা দিনের কথা, সত্যি বলতে, সে মনে করতে পারে না, যেদিন টাকা নেই বলে এমন কোনো অসুবিধে ভোগ করেছে যেটা সহ্য করা তার পক্ষে সহজ হয়নি।
বাবা মারা গেলেন এম. এ. পরীক্ষার ক-মাস আগে। একটু হঠাৎ-ই। তবু পৌঁছতে পেরেছিল ঠিক সময়ে, মানে, শেষ সময়ের একটুখানি আগে। বড়ো ফাঁকা লেগেছিল প্রথমটায়, আর একটু অন্যায়ও। কী-ই বা বয়স বাবার—এইতো সেদিন চল্লিশ পেরোলেন। আর, বলতে গেলে, এই দুজনই তো আমরা ছিলাম। কিন্তু বেঁচে থাকার আপাতচিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে বাবাদেরই তো ছুটি হয় আগে। মানে, সেটাই উচিত, আর উচিতটাই ভাল। আমার এখন যে রকম লাগছে, এর চাইতে অনেক, অনেকগুণ খারাপ লাগত বাবার, যদি আজ আমি মরে যেতাম আর তিনি থাকতেন। যদি ধরো, মৃত্যুর কোনো দূত এসে আমাকে বলত—এক্ষুনি চল আমার সঙ্গে, নয়। তোমার বাবাকে ধরে নিয়ে যাব, আমি তাহলে কী বলতাম? বলতাম কি—আমি যাচ্ছি, বাবাকে ছেড়ে দাও? না, সেটা বোকামি হত, বিশ্রী নিষ্ঠুর হত বড়ো। অবশ্য আরো দশ, কুড়ি, তিরিশ বছরও বেঁচে থাকতে পারতেন কিন্তু তারই বা অর্থ হত কী, কী ছিল তার জীবনে? কী ছিল তার জীবন? বাবার জীবনে খুব একটা উজ্জ্বলতা সত্যেন দেখতে পায়নি কখনোই। কেননা নিজের মনে মার জন্য কোনো অভাববোধ যদিও সে বহুকাল ভুলে গেছে, তবু সবসময় বাবার জন্য কষ্ট পেয়েছে মা নেই বলে। মনে মনে এটা সে পরিষ্কার বুঝেছিল যে মাতৃহীন যুবকের প্রায় কোনো দুঃখই নেই, প্রায় সব দুঃখই আছে বিপত্নীক প্রৌঢ়ের। এসব চিন্তা দিয়ে চোখের জলকে ঠেকিয়ে রাখল সত্যেন, তা থেকে একটু তেলো-মতো সান্ত্বনাও নিংড়ে বের করল। আর তারপরের দিনগুলিতে তার মুখ ভরে খোঁচা-খোঁচা দাড়ির মতোই আরো অনেক চিন্তা গজিয়ে উঠল মনের মধ্যে। অদূরবর্তী পরীক্ষাটা তাকে শক্তি দিল। মনখারাপের সময় কই—এম. এ.-টা ভাল না হলে কিছুই হল না। কেননা নিজের সম্বন্ধে দুটি, আর দুটিই মাত্র, স্পষ্ট সিদ্ধান্তে সে অনেক আগেই পৌঁছেছিল–প্রথমত, জীবিকার জন্য প্রোফেসরি ছাড়া আর কিছুই তার করবার নেই। আর দ্বিতীয়ত, থাকবারও তার আর কোনো জায়গা নেই কলকাতা ছাড়া। ছাত্রজীবনের ক-বছরেই সে বুঝেছিল যে কলকাতায় প্রতিযোগিতা তীব্র, শক্তিশালীরা নির্বিবেক, আর কর্তৃপক্ষ সাধারণতই স্বজনবৎসল। রোগা ডিগ্রি নিয়ে কলেজঘাটে ভিড়তে পারে শুধু তারাই, জন্মটা যাদের জোরালো। কিন্তু তার পরিচয় যেহেতু মাত্র তার নিজের নামটুকুতে শেষ, আর আরও সেইখানেই, সেইজন্য সেটুকুতে কোনোরকম খুঁত থাকলে তার চলবেই না। আরো ভাবতে-ভাবতে আরো দেখতে পেল যে বাবা থাকতে তার জীবনের যে গড়ন ছিল এখনো তা-ই আছে। আর বাবা থাকলে তার জীবনের যে গতি হত, এখনও তাই হবে, বাবা না থেকে বলবার মতো কোনো বদল তো ঘটালেন না। মা-ছাড়া বাড়িতে, উদাসীন বাবার সংসর্গে আবাল্য সে স্বাবলম্বী, আর অন্য অর্থেও স্বাবলম্বী হতে পেরেছিল প্রায় সতেরোর পর থেকেই। তার জীবনটা, বলতে গেলে, এখন পর্যন্ত কেটেছে বিবিধ হোস্টেলে আর বাবার এই বাড়িতে ভাগাভাগি করে। আর এ বাড়িও তো অন্য একরকম হোস্টেলই। তার জীবনটা যে-রকম চলছিল, চলবে, চলতে পারে, তার কোনও নড়চড় হল না। শুধু এটুকুতফাৎহল যে বছরে তিনবার করে এই গ্রামে আর আসতে হবে না তাকে। আর এটা অবশ্য সুবিধে বলেই লাগল তার মনে, মস্ত সুবিধে, কেননা সত্যেন পল্লীপ্রেমিক নয়, দেশপ্রেমিকও না। সে নিশ্চিত জানল যে এই বাড়িতে, গ্রামে আর কোনোদিন সে ফিরবে না, আর জানতে পেরে যেন গুমোটভাঙা হাওয়া দিল মনে। এতদিন সে শুধু স্বাবলম্বী ছিল, এতদিনে স্বাধীন হল। বেড়াতে পারবে টাকায় যতটা কুলোয়, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবে প্রত্যেক ছুটিতে, আর কোনো বাধা নেই, ভাবনা নেই। শেষের কথাটা ভাবতে দীর্ঘশ্বাস পড়ল, কিন্তু শ্রাদ্ধ চুকিয়ে, সেই মোগল ইতিহাসের বই ক খানা, আর অন্য যা খান পাঁচ-সাত বই ছিল বাবার, সব তার হোল্ডলে ঢুকিয়ে, বাবার বিয়েতে পাওয়া এখন ফুটোওলা শাখানা সুটকেসের সব-তলায় বিছিয়ে, গোছগাছ শেষ করে সে যখন তার মাথাটার মতই ন্যাড়া একটা তক্তপোশে চুপ করে বসল, তখন দীর্ঘশ্বাস ফিরে এল না। জ্ঞাতিসম্পর্কের জ্যাঠামশাই এসে বললেন—কী হে, আজই যাচ্ছ?
আজই যাচ্ছি।
সত্যি—কী একটা কাণ্ডই হল! নরেন যে এরকম হঠাৎ..তা গলা নামিয়ে, যদিও এই সতর্কতা সেখানে একেবারেই অনর্থকতা, কিছু রেখে-টেখে গেছে তো?
আমাকেই রেখে গেছেন—জবাব দিল সত্যেন।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি-কথায় হার মানলেন না জ্যাঠামশাই, কিন্তু তোমার জন্য রেখে গেল কী? সত্যেনের মুখে এল—সমস্ত পৃথিবীটা। কিন্তু সামলে নিল, পাছে ওঁর কানে ফাজলেমি শোনায়; আর কোনো জবাবও মনে এল না। অভ্যেসমত চুলে হাত বুলোতে গিয়ে ন্যাড়া মাথার খসখসে ছোঁওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে বলে ফেলল—আমার তো দরকার নেই কোনো।
শোনো কথা। দরকারের জন্যই কি সব, আর দরকারের তুমি কতটুকু জানো হে এখনও! তা তোমার এই বাড়ি, আর জমিজমা– সত্যেনের ঠোঁট-বাঁকানো অবজ্ঞা লক্ষ্য করে আরো বেশি অবজ্ঞা জানিয়ে হাসলেন একটু—এমন মন্দই বা কী, শ-তিনেক টাকা আয় হবে বছরে। এসবেও কি কোনো দরকার নেই তোমার?
আমি তো সত্যি ভেবে পাই না—সত্যেন একটু ভেবেই বলল—এসব আমার কোন কাজে লাগবে।
তাহলে এক কাজ করোজ্যাঠামশাই গম্ভীর হলেন—বেচে দাও। আমি কিনে নিতে পারি বলো তো।
কিনে আবার নেবেন কী–সত্যেন একটু চপলভাবেই হেসে উঠল—আপনার কোনো কাজে লাগে তো লাগবে। জ্যাঠামশাই ভুল বুঝলেন কথাটা। মনে মনে ভাবলেন ছেলেটার বিষয়বুদ্ধি যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। তাতে অখুশি হলেন না। বেশ একটু নরম সুরেই বললেন–বুঝেছ তত…মেয়েটা বিধবা হয়ে এল, অতগুলো কাচ্চাবাচ্চা, তাই ভাবছিলাম ওর মাথার উপর একটা চাল অন্তত—
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এখানে যদি ওঁর সুবিধে হয়—
অসুবিধে তো তোমার, আসবে তো মাঝে মাঝে? মোলায়েম হাসিমুখে সত্যেন জানাল—আমি আর আসব না।
না, না, আসবে না কেন, আসবে বইকি! আরে আমরা তো আছি। আর তুমি হলে এ গ্রামের গৌরব। অবশ্য ভেবো না যে বড়ো বড়ো স্কলার আর হয়নি এখানে–তমালপুরের মৃত ও জীবিত কীর্তিমান রায়চৌধুরীদের উপাধি ও বৃত্তির বিবরণ সোৎসাহে আবৃত্তি করলেন তমালপুরের অন্যতম অনতিকৃতী রায়চৌধুরী। সত্যেন শুনল যে তার জ্ঞাতিবর্গের মধ্যে আছেন কিংবা ছিলেন দুজন প্রিন্সিপাল (একজন তাদের গটিনজেনের ডক্টর), একজন ডেপুটিপোস্টমাস্টার-জেনারেল, একজন এক্সিকিউটিভ এঞ্জিনিয়র, লাহোরের ডেইলি নিউজ-এর এডিটর একজন, ভাইসরয়ের বাগানবাড়ির হর্টিকালচরিস্ট একজন, আর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট একগণ্ডা। কোনোটাই যেন নতুন লাগল না, যেন আগেও শুনেছে বারকয়েক, তবু মুখে-চোখে সচেষ্ট মনোেযোগ জইয়ে রাখল। তোমার কাছেও তমালপুর অনেক আশা করে হে!—বলে জ্যাঠামশাই কথা শেষ করলেন। আমাকে না হলেও বোধহয় তমালপুরের চলবে—সত্যেন মনেমনে বলল—আর আমিও বোধহয় তাতেই ভাল থাকব।
শিলঙের হালকা হাওয়ায় বিকেল-ছায়ায় বসে-বসে চার বছর আগেকার সেই দিনটিকে যেন জ্যান্ত করে অনুভব করল সত্যেন। হেঁটে-হেঁটে স্টিমারঘাটে আসার সময় ঘাড়ের উপর গরম রোদুর আর স্টিমারের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একটা ভিজে ভিজে ধোঁয়ার গন্ধ। ভাল লাগছিল তার। মাত্র কদিন আগে যে-ছেলের বাপ মরেছে তার পক্ষে হয়তো একটু অন্যায়রকমই ভাল। সত্যি স্বাধীন লাগছিল তমালপুর ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গে, সত্যি সুখী লাগছিল তমালপুরে আর ফিরতে হবে না বলে। জায়গাটা কোনোদিনই সে পছন্দ করেনি, এমনকি, বাবা-যে পছন্দ করেছিলেন সেটাও পছন্দ করতে পারেনি। ওখানকার সকলেরই, তার বাবারও, মনের সেই ভাবটাতে খোঁচা খেয়েছে ছেলেবেলা থেকেই, মনে মনে যার নাম সে দিয়েছিল তমালপুরাত্মবোধ কিংবা রায়চৌধুরীচেতনা। প্রতিবাদ জানিয়েছে কলেজে ভর্তি হবার সঙ্গে সঙ্গে নামের চৌধুরীটাকে তালাক দিয়ে, ওখানে গিয়ে যথাসম্ভব কম মেলামেশা করে, আর প্রতিশোধ নিয়েছে কেউ দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করলে ঝাপসা জবাব দিয়ে। দেশ! দেশ মানে কী? সেযে ওখানকার, ওটা যে তার দেশ, এতো তার মনের হাজার মাইলের মধ্যে নেই। এখানে বিশ্রী লাগে তার, ওটা তার প্রতিকূল, বাবাকে ছাড়া একটুও আপন লাগেনি আর একজনকেও। পৃথিবীতে এত ভাল-ভাল জায়গা থাকতে ঐ দম-আটকানো তমালপুরটাই তার দেশ? কী আশ্চর্য কথা! কান পেতে স্টিমারের ঝকাঝক শুনল একটু, শুনল দূরত্বের আশা; চোখ তুলে তাকাল জলভরা দূরত্বের দিকে, দেখল দিগন্তের আশ্বাস।
বাবা মরবার পরেই খানিকটা অসুখী লাগতে পারত। কিন্তু তাও যখন তেমন লাগল না, সত্যেন প্রায় ধরেই নিল যে অসুখী অবস্থার সঙ্গে চেনাশোনা তার হবেই না। আর তার জীবনও তার এ-ধারণার খোরাক যোগাল। যেমন সে ভেবে নিয়েছিল ঠিক-ঠিক তাই হল পর-পর, তার এম. এ. পরীক্ষায় পূর্ব-ইতিহাসের বাঞ্ছিত পুনরাবৃত্তিই ঘটল, চাকরি জোটাতেও হিমশিম হল না। দেশ বেড়ানোর শখ মেটাতে লাগল, বিশেষ বিশেষ বই পড়ার বাধ্যতার দায়টাকে জীবনের মতো চুকিয়ে দিয়ে সাহিত্যের স্বরাজ পেল। শুধু একটু কষ্ট হয়েছিল হস্টেল ছেড়ে সাধারণ মেস-এ উঠতে, কিন্তু তাও তো শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচিয়ে দিল টালিগঞ্জের গলির মধ্যে একতলার ঘর দুটো। নিশ্চয়ই মানতে হয় যে ভাগ্য তাকে নেকনজরে দেখেছে, সে যা চেয়েছে-সত্যিসত্যি যা চেয়েছে তা সবই পেয়েছে এ পর্যন্ত, আর যা সে পায়নি তা সত্যি-সত্যি সে চায়ওনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের যিনি শিরোধার্য, তার কাছে গিয়েছিল চাকরির সুপারিশ আনতে। কলেজের নাম শুনে ঈষৎ নাক কুঁচকে তিনি বললেন ওখানে কেন? বি. ই. এসএর চেষ্টা করো, পেয়ে যাবে।
আপাতত—
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কিন্তু এখন থেকেই উঠে পড়ে লেগে যাও—শিগগির একটা খালিও হচ্ছে কেস্টনগরে। ডি. পি. আই-এর কাছে একটা পার্সনাল চিঠি দেব তোমাকে? কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল সত্যেন। ঢোক গিলে, রুমালে মুখ মুছে, কোনোরকমে আওয়াজ বের করল—আমি কলকাতাতেই থাকতে চাই।
আহা, এখন যাও-তো, সময়মতো ধরাধরি করে প্রেসিডেন্সিতে চলে আসতে কতক্ষণ! আর নয়তো-যুবকের লজ্জা-লাল মুখের উপর একবার চোখ ফেললেন প্রৌঢ়—একটা রিসার্চফেলোশিপ নাও আমার কাছে। টাকা ঐ কলেজের চাইতে কম হবে না, বেশিই সম্ভব। একটু থামলেন, শ্রোতার মুখে ইচ্ছার ঝিলিমিলি দেখে নিয়ে আরো একটু গম্ভীর গলায় বললেন–এইটিন্থ সেঞ্চুরির শেষ দিকটাকে ধরো। পিরিয়ডটা নিয়ে বেশি কিছু ওয়র্ক বিলেতেও হয়নি, খানিকটা তৈরি করে পি. আর. এস.-এর জন্য দাও—দ্দিনে লেকচারারশিপ হয়ে যাবে। তারপর ঘোষ-ফেলোশিপ নিয়ে লন্ডনের পি. এইচ. ডি. আর তারপর বিশ্ববিদ্যার প্রধান পুরুষ নিজের অতীতের ম্যাপটাকেই মেলে ধরলেন চাকরি-চাওয়া ছোকরা-নবিশের ভবিষ্যতের সামনে—তারপর আর কী! তারপর যে আর কিছুই ভাবনার থাকে না, সেইটা বোঝাবার জন্য হেলান দিলেন ইংরেজি চেয়ারের চামড়া-পিঠে। সহৃদয়, সদয় একটু চোখ টিপে আবার বললেন–কিছু ভেব না, আমি ঠিক চালিয়ে নিয়ে যাব তোমাকে-ক্র্যাব-এর উপর কিছু নোট আছে আমার কথা শেষ করলেন না, আর তাতেই বুঝিয়ে দিলেন নোটগুলির মূল্য, আর শিষ্যের প্রতি তার গুরুদাক্ষিণ্যের গুরুত্ব। আশাতীত পাবার পর যেমন হয় ঠিক তেমনি নীরব, নতমুখ, অভিভূত দেখলেন প্রার্থীকে। আর তার এই তৃতীয় দৃষ্টিপাতে, যদিও সত্যেন দেখল না, প্রায় পুত্রস্নেহ প্রকাশ পেল। নিজের গুরুত্ব প্রায় ভুলে গিয়ে প্রায় মিত্রবৎ প্রশ্ন করলেন–ক্র্যাবকে তোমার কেমন লাগে?
ক্র্যাব। ইংরেজিতে এত-এত কবি থাকতে জর্জ ক্র্যাব! সত্যেনের বলতে ইচ্ছে করল, ক্র্যাব কে? প্রোফেসরের চোখে চোখ রেখে, শান্ত মুখে, গভীর গলায় বলতে ইচ্ছে করল কথাটা, ভীষণ ইচ্ছে করল, মনের মধ্যে একটা ব্রাস উঠল যে আর একটুক্ষণ বসে থাকলে সত্যি না বলে আর পারবে না, তাই উঠে পড়ল হঠাৎ। বোকার মতো হাসল, বেচারার মতো হাত ঘষল, বান্দার মতো পিছে হাঁটল, আর অধ্যাপক তৃপ্ত হলেন তার সর্বশরীরে কৃতাৰ্থতার সর্বলক্ষণ লক্ষ্য করে। সত্যি তো, অবস্থা তাকে দয়া করেছে দরাজ হাতে। সবচেয়ে সুবিধে এইটা পেয়েছে যে সাংসারিক অর্থে সে একেবারেই একা। যেহেতু কলকাতায় এসেই সে বুঝেছিল যে তার পড়াশুনোর খরচ বাবার পক্ষে একটু বেশি হয়ে পড়ছে, আর সেইজন্য প্রথম সুযোগেই দশটাকাবারোটাকা মজুরিতে ছেলে পড়ানোর বৌনি করেছিল। তাই বাবার আনুষঙ্গিক অন্য কিছু, যেমন, মা, ভাইবোন, আর বিবিধ আত্মীয় এসব তার মনের উপর আশ্রয়ের ছায়া ফেলতে পারেনি। ঠিক উল্টো, তার কাছে পারিবারিক সম্বন্ধ মানেই বন্ধন, ভার, স্বাচ্ছন্দ্যনাশ, কেননা এটা তো অবধারিত যে কাছাকাছি অন্য কোনো মানুষ থাকলে সে কিংবা তারা নিশ্চয়ই নির্ভর করত তারই উপর। যদি, ধরো, তার ছোটো ভাইবোন থাকত কয়েকজন তাহলে? তাহলে তো তাকে ঐ করতে হত—বি. ই. এস.-এর সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে ঘুরতে হত কেষ্টনগর-রাজসাহী-চট্টগ্রাম, নয়তো জর্জ ক্র্যাবকে নিয়ে রিসার্চ করে ইউনিভার্সিটির কৃপা কুড়োতে হত। করতেই হত এসব, হয়তো আরো অনেক কিছু যা ক্র্যাব কিংবা কেষ্টনগরের চেয়েও মারাত্মক। কোথায় থাকত তার স্বাধীন জীবন, কোথায় থাকত সাহিত্যস্বরাজ। তার সঙ্গে বি. এ.-তে সেকেন্ড হয়েছিল অসিত ঘোষ। এম. এ. বাদ দিয়ে আই. সি. এস. দিল—হল। এখন কোথায় যেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট। এম. এ.-তে সেকেন্ড হয়েছিল প্রাণতোষ বাগচী, সে কৃষ্ণনগরকে কৃচ্ছনগর মনে করল না—সেদিন বদলি হল ঢাকায়। আর অল্পের জন্য ফার্স্টক্লাসের ফাড়া কাটাল যে ধীরাজ গুপ্ত, সে চলে গেছে দিল্লিতে রেডিওর প্রপাগান্ডার পাণ্ডা হয়ে। পুরোেনো সহপাঠীদের কারো কারো সঙ্গে এখনও তার দেখা হয় মাঝে-মাঝে। তারা প্রত্যেকেই তাকে বলে-করছ কী হে, ঐ একটা রদ্দি কলেজেই পচবে নাকি? উত্তরে সত্যেন শুধু বলে বেশ আছি। কথাটা ভান নয়, স্তোক নয়, সত্যি সে যা বিশ্বাস করে তা-ই সে বলে। কত ভাল আছে, কত সুখে আছে, তা কি এরা বোঝে না? কলকাতায় আছে, অল্প কাজ, লম্বা ছুটি, নিজের ছাড়া আর কারো ভার নেই, বলতে গেলে কোনও ভারই নেই, কেননা তার নিজের খুব অল্পেই চলে যায়। কলেজে পায় একশো কুড়ি টাকা, একটি (একটিই মাত্র) টুশনি করে সেই সঙ্গে। সবসুন্ধু যা পায় তাতে ভেসে যায় তার। বই কেনা, দেশ দেখা সবসুন্ধু। এর বেশি আয় হলে তা নিয়ে কী করবে তা প্রায় ভেবে পাওয়াই মুশকিল। আর, আয় বাড়াবার কথাও অবশ্য ওঠে না, যদি না সে রাজী হয় অবসর বেচতে, স্বাধীনতা বিকোতে। আর তার কাছে যা আসল, সবচেয়ে যা মূল্যবান, তা-ই যদি না থাক তাহলে অন্য কোনো কিছুই কোনো কাজে লাগবে না তো! ঐ তো হিলভিউ হোটেলেই আর একজন আছেন কলকাতার প্রোফেসর, প্রবীণ, পরার্থপর। কেননা শিলঙের এই সোনার মতো সকালবেলার প্রত্যেকটিকে তিনি জবাই করেছেন, বি. এ. পরীক্ষার খাতায় লাল পেন্সিলের খোঁচা দিয়ে-দিয়ে। ভাগ্য তার, ম্যাট্রিকুলেশনের পরীক্ষক তাকে করেনি এখনও। দরখাস্ত দিয়ে যাচ্ছে নিয়মমাফিক, নয়তো কলেজে ভালো দেখায় না। আর দিয়েই মনে মনে বলছে-না যেন হয়। আর যেহেতু আরেদনপত্রে নাম সই ছাড়া এ পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কিছুই সে করেনি, তাই তার এই অনুক্ত প্রার্থনা নির্ভুলভাবে মঞ্জুর হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। যেটা না -হলে অন্যদের বাঁচা শক্ত, সেটা না হলেই সে বাঁচে। না, আশেপাশে এমন একজনকেও সে দেখতে পায় না, যার সঙ্গে জায়গা বদলাবার ইচ্ছা মুহূর্তের জন্যও তার হতে পারে। এক হিসেবে একটু হয়তো স্বার্থপরতা, অন্য হিসেবে স্বার্থবোধের সাংঘাতিক অভাব—মানে সাংসারিক মূঢ়তা—দুটোই দেখতে পেল সত্যেন তার মনের এই ভঙ্গিতে। কিন্তু তাই বা কেন? ভাইবোন, অন্যান্য আত্মীয়, যারা আদৌ ছিল না, কিংবা নামমাত্র ছিল, তারা নেই বলে যদি তার ফাঁকা না লাগে, বরং হাল্কা লাগে, সেটা কি স্বার্থপরতা? পাচটা-সাতটা ভাইবোন কি পাতিয়ে নিতে হবে, যাতে সে অধমতম গরিব হতে পারে? আর মূঢ়তা—কীসের? যদি কোনো বিপদে পড়ে? যেমন, শক্ত কোনো অসুখ হতে পারে, চাকরি যেতে পারে হঠাৎ, আরো কত কিছু হতে পারে—হয় তো অনেকের… কিন্তু সত্যেন যতই ভাবল, কিছুতেই নিজের কোনো বিপদেপড়া অবস্থা কল্পনা করতে পারল না। কিংবা যতদূর ভাবতে পারল, কোনো বিপদই বিপদ লাগল না তার কাছে। ভয় কী—পইন-হাওয়ার ঝিরঝিরানি তার কানে-কানে বলল–ভয় কী! পাতার ফাঁকে-ফাঁকে আকাশের নীল চোখও তাই বলল। কিছুতেই ভাবতে পারল না যে তার এই একলা অবস্থা মানেই অসহায় অবস্থা। ভাল আছে, বেশ আছে, খুব ভাল—এ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারল না। একা বলেই ভাল। সেটাই—এইমাত্রই তার মনে হল কথাটা–তার সবচেয়ে মূল্যবান, তার জীবনের আসল, আর এটাকেই সে নানা দিক থেকে আঁকড়ে থাকে, অবসর, স্বাচ্ছন্দ্য কি স্বাধীনতার নাম দিয়ে। কলকাতার এই ন-বছরে অনেক অনেক লোকের সঙ্গেই তার আলাপ হয়েছে—তাকে পছন্দ করেছে অনেকেই, সে-ও উপভোগ করেছে অনেকের সঙ্গ, কেউ-কেউ কখনও কখনও খুব কাছেও এসেছে, বন্ধু হয়ে উঠেছে প্রায়… প্রায়, ঠিক বন্ধু কেউ হয়নি। একজনও না; ঠিক জায়গায় ঠেকিয়ে দিয়েছে, কিংবা নিজেই ঠেকে গেছে। কিন্তু সেটাই সে চেয়েছে, এর বেশি হলে কী যেন সে হারাত, নিজেরই খানিকটা খোওয়া যেত যেন। পকেটের মধ্যে চিঠিটার উপর একবার হাত রাখল সত্যেন। তার চিঠি? কে? ছাত্রী? ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষকের এ কী-রকম পত্রবিনিময়? বন্ধু? পঁচিশ বছরের পুরুষের সঙ্গে আঠার বছরের মেয়ের বন্ধুত্ব? এ বন্ধুত্বের পরিণাম সে কি প্রত্যক্ষ করেনি গল্পে-উপন্যাসে হাজার বার? বিদ্বান, সুসংস্কৃত, বানিপুণ, এমন কি সত্যিকার জ্ঞানী কিংবা গুণীও দু-একজন, যত পুরুষের সঙ্গে সে মিশেছে, তাদের একজনকেও ঠিক বন্ধু বানাতে পারল না। পারল না মানে চাইল না। আর বন্ধু হল কিনা এই কাচা, হাল্কা, কাঁপা-কাঁপা, প্রায় চোখ-না-তোলা, কথা-না-বলা একটুখানি মেয়ে? শুধু মেয়ে বলেই? বাড়ি তার স্ত্রীলোকবর্জিত, কিংবা বাড়ি বলেই কিছু নেই। তা-বলে দেখাশোনা যে একেবারেই হয়নি তাও নয়। সহপাঠিনী ছিলেন কয়েকজন, বাছা বাছা সহপাঠির মা, বোন, বৌদি, ছাত্রাবস্থার শেষের দিকে কোনো কোনো অধ্যাপকের স্ত্রী, এমন কি ডিগ্রির জোরে জ্বলজ্যান্ত যুবতীকেও বি. এ. পরীক্ষায় তরিয়ে দিতে পেরেছে নিজের বিপজ্জনক বয়সটা সত্ত্বেও কিন্তু বিপদ সে কিছু ঘটায়নি, সে-রকম কোনো সম্ভাবনার প্রথমতম উঁকিঝুঁকিও দেখতে পায়নি নিজের মনে। ইচ্ছে করলেই ভাব জমাতে পারত কোনো কোনো তরুণীর সঙ্গে, চেষ্টা করলে (হয়তো খুব কঠোর চেষ্টাও না) এগোতে পারত আরো—কেন করেনি? যৌবনের মধুর ভীষণ জৈব-ষড়যন্ত্র থেকে সে কি মুক্ত? তা কি হতে পারে! কখনও কি আকৃষ্ট হয়নি, লুব্ধ হয়নি? তাও হয়েছিল একবার। কিন্তু আরও প্রবল ছিল তার নিজের নির্জনতার টান। তাই হারেনি। তাহলে স্বাতী মিত্র আলাদা হল কীসে? অন্যদের থেকে অন্যরকম হল কেমন করে? স্পষ্ট মনে পড়ল কোলরিজ-পড়ানো কলেজ-ক্লাসের সেই সকালবেলা, প্রথম যেদিন চোখ রেখেছিল তার মুখে। সেদিন ভাল লেগেছিল—সেটা না-লেগেই পারে না—অনেকগুলি বিরুদ্ধ, পাশ-প্রতিজ্ঞ ফাঁকামুখের মধ্যে হঠাৎ এক জায়গায় প্রাণের অনুকম্পন অনুভব করে। তারপর…হ্যাঁ, কলেজের লাইব্রেরিতে আশ্চর্য এই আবিষ্কার সেদিন করেছিল যে সাহিত্যের স্বাদ যাদের দিতে গিয়ে প্রতিদিন সে গভীর আত্মিক যন্ত্রণা ভোগ করে, তাদের মধ্যে এমন একজন অন্তত আছে যার কবিতার খিদে পেয়েছে। আরো আশ্চর্য এই কারণে, কেননা সত্যেন দেখেছে—অল্প যে-কজন কবিতা পড়ে তারা সকলেই পুরুষ, মেয়েরা গল্পটল্পেরই মক্কেল–যে সে একজন মেয়ে। মেয়েটিকে একটুখানি মনে রাখার মতো মনে হল সেদিন। কেননা তার নিজের উপর যাদের আগ্রহ, তাদের উপর তার আগ্রহ বরং কম, কিন্তু তার যে-সব বিষয়ে আগ্রহ, অন্য কারো সে-সবে আগ্রহ দেখলে সেই মানুষের দিকে আগ্রহ তার দৌড়ে ছোটে। কিন্তু তাতে কী? সাহিত্য ভালোবাসে এমন মানুষ সে তো এই প্রথম দেখল না, তার মেলামেশার সমস্ত জগৎটাতেই একটু-না-একটু সাহিত্যের হাওয়া বয়। কী তবে, নিজেকে প্রশ্ন করল সত্যেন, কী তোমাকে টেনে আনল স্বাতী মিত্রের এতটাই কাছে যে আজ তা নিয়ে এত ভাবনাই ভাবতে হচ্ছে? তার রূপ? তার বয়স? তার ভীরু, নরম, উষ্ণ, বিস্মিত নারীত্ব? না কি তার উৎসাহ, উৎসুকতা, আনুগত্য, তার মনের মতো চমৎকার অচষা খেত, যেখানে তুমি মনের সুখে চালাচ্ছ পৃথিবীর বড়ো-বড়ো লেখকদের লাঙল? আর তো কারো মন-তৈরির ভার এমন করে পাওনি। আর এমন মন, যা তৈরি হবার যোগ্য, আর যার তৈরি হবারই সময়। আর তাই থেকেই কি কোনো একদিন একথা ভাবতেও শুরু করেছ যে এমন আর দ্যাখনি, এমন মানুষ, এমন মেয়ে? সত্যেনের চোখ বুজে এল, দু-আঙুলে কপালের চামড়া টেনে ধরল একবার। দৈবক্রমে প্রতিবেশীও হয়ে পড়ল। আরো দেখা হল, আরো ভাল লাগল। প্রথম দেখাতেই ভাল লাগল তার বাবাকে, আর যদিও সে নিজেকে এটুকু অন্তত অক্ষত রাখতে পেরেছে যে দেখাশোনাটা ঘন ঘন হতে দেয়নি, তবু সমস্ত বাড়িটাকেই যেন সঙ্গী করে নিয়েছিল তার চলাফেরার। বাড়ি! কথাটার অর্থ বুঝেছিল বড়দির নিমন্ত্রণের দিন। আর সেইদিনই জেনেছিল পারিবারিক জীবনের আনন্দ। শুধু যে বড়দি তাকে মুগ্ধ করল তাও নয়। সমস্তটা মিলিয়ে একটা সুষমা স্পর্শ করল তাকে, সব যেন ছন্দে বাঁধা, কোনো এক-হয়ে-ওঠা সম্পূর্ণতার গড়ে তোলা অংশ। এমন কি হারীতবাবুকেও বেসুরো ঠেকল না শেষ পর্যন্ত। আর সবচেয়ে বড়ো কথা নিজেকে একবারও বাইরের লোক মনে হল না সেই আত্মীয়মণ্ডলে। কলকাতার শহরে কোনো-কোনো বাড়িতে সে নিমন্ত্রিত হয়েছে কয়েকবার, অনাদর পায়নি কোথাও, সৌজন্য পেয়েছে সর্বত্র। এমন আরাম, এমন একান্ত আরাম পায়নি আর কখনো কোনোখানেই। পরের দিন সকাল থেকেই আবার যাবার ইচ্ছা প্রবলভাবে চেতিয়ে উঠল মনের মধ্যে, আর সেইজন্যেই কিছুতেই গেল না।
সেটা ভালই করেছিল। কিন্তু ভুল, মস্ত ভুল ঘটিয়ে রেখেছিল আগেই। কেন সেই চিঠি লিখেছিল শান্তিনিকেতন থেকে? কী সেই ইচ্ছা, চিন্তা, জল্পনা বা কল্পনা, যা তাকে তখনকার মতো দখল করে সেই প্রথম চিঠি লিখিয়েছিল। তারপর এবারও আবার! আর এই চিঠি লেখা—এটা তার একটা বাসনা ছাড়া আর কী? সাহিত্য ভালবাসে, কিন্তু নিজে লিখতে পারে না, তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটায় মাঝে মাঝে একে ওকে লম্বা চিঠি লিখে। কিন্তু সেবারে শান্তিনিকেতনে বসে আর কারো কথাই কি মনে পড়ল না, অল্প-চেনা ছিপছিপে ছাত্রীটিকে ছাড়া? ঐ বাধোবাধো আধোবলার মেয়েটির কাছেই কি ভাবোচ্ছাসটি পাঠাতে হল? আর এবার–লিখবে, যেন জানা কথাই, যেন না লেখার কথাই ওঠে না। ভুল করেছে… ভুল করেছে?
পকেটে রাখা চিঠিটার অন্তঃসার মনে মনে আউড়িয়ে গেল আরো একবার। আর তো ভিতুভিতু নয়, আধো-বাধো নয়… বেড়েছে, জোর বেড়েছে, সাহস পেয়েছে, দ্বিধা ভুলে যাচ্ছে, বাধা ঠেলে দিচ্ছে, কেউ যেখানে আসেনি, সেখানেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে নাকি এই মেয়ে, পার হবে নাকি সীমান্ত? এক লাফে উঠে দাঁড়াল সত্যেন, প্রায় আওয়াজ করে বলে উঠল—না, আর না। এ চিঠির জবাব দেবে না, আর লিখবে না কোনোদিন। শুধু দেখাশোনার ফলে যা হতে পারত না, সেই অভাব্য, অবিশ্বাস্য, অসম্ভবকেই সে কি ডেকে আনবে চিঠির পর চিঠিতে। সত্যেনের ত্ৰাস লাগল, শীত করল হাওয়ায়, পা ফেলল দ্রুত। রাত্রে ঘুমোবার আগে লণ্ঠনের আলোয় আবার চিঠি পড়ল। অনেকক্ষণ ঘুম হল না, কিন্তু ঘুম ভাঙল খুব ভোরেই। চায়ের আগেই বেরিয়ে পড়ে কয়েক মাইল হেঁটে এল আর হোটেলে ফিরে চা খেয়েই চিঠির উত্তর লিখতে বসে গেল—কী সুন্দর দিনটি আজ!…