২.১ করুণ রঙিন পথ

দ্বিতীয় পর্ব
করুণ রঙিন পথ

কীভাবে স্বাতী? বৃষ্টিবিকেলে জানলাধারে বসে, ফিকে নীল শাড়িতে, পিঠে চুল ছড়িয়ে, ঠোঁটে মুখে জলছিটে নিতে নিতে কী ভাবে সতেরো বছরের স্বাতী? কী?…কী আর ভাববে, সব ভাবনা ভেবে রেখেছে অন্যেরা। যেসব ভাবনা ভাবা যায় বলেও সে ভাবেনি কোনোদিন। প্রথমে বাবো-বাবো ঝাপসা… তারপর যখন খুলে গেল—কিন্তু কোথায় চলেছে পথ, কী-ভীষণ ভয়ের অন্ধকারে, কোন কোননা, হাসিমুখের, সব-তলের পাতালে!…এ-রকম গল্পও আছে পৃথিবীতে! ছেলেবেলা থেকে গল্প তো সে কম পড়েনি। মাসিকপত্রের রাশি-রাশি গল্প, শরৎচন্দ্রের সব, রবীন্দ্রনাথের কত, কিন্তু এ-রকম! পড়তে পাগল-পাগল করে আর লিখতে গিয়ে মানুষ পাগল হয়ে যায় না? হয় কি আর না! ঐতো মোপাসা বলে একজন, বইতেই লেখা আছে, সত্যি নাকি পাগল হয়ে গিয়ে নিজের গলা কেটে মরেছিল। আর সেরকম যারা মরেনি, তারাও তা-ই। তবে অনেকেই সেটা লুকোতে পারে বোধহয়, কেউ-কেউ পারেই না।…লুকোবে? আর যেটা দপদপ করে জ্বলছে এই সাদা-কালো পাতাগুলিতে, বইয়ের কাগজ যে পুড়ে যায় না, সেটাই যেন আশ্চর্য লাগে। আশ্চর্য, কী ভীষণ, নির্লজ্জ, নিষ্ঠুর—আর কী —কী সত্য কথা সব! এরা কী সব জানে, কী করে জানে মানুষের মনের সব কথা, এসব তো মুখ ফুটে কেউ বলে না কখনও। বলবে কি, এসব কথা যে তারই মনের কথা। তাই তো জানে না কোনো মানুষ, জানতে পারে না…যতক্ষণ না এ-সব বই পড়ে। আমি-যে আমি, আমারও মনের কত কথা লিখে গেছে এরা কত কেন, সব কথাই তো, যার কথাই লিখেছে সেই মানুষই যেন আমি। পড়তে লজ্জাই করে এক-এক সময়। কিন্তু সব মানুষই যদি আমি, তবে আর লজ্জা কার কাছে—আর লজ্জাই তো নয় শুধু, তার উল্টোটাও আছে—সেই উল্টোটাও তেমনি আশ্চর্য। আর, শুনতে যেটাই যেমন হোক না, ঠিক, ঠিকই তো, এইরকমই ততা। এতই ঠিক ঠিক এইরকম যে আমার কথাই আমি জানব না এদের মুখে না-শুনলে। আমিযে কী, আমি-যে কেমন, আমি যে কত মন্দ আর কত ভাল, তা নাকি কোনো জন্মে লিখে রেখেছে কোন দূর-দূর দেশের পাগলরা! আশ্চর্য! কত আশ্চর্য সেটাও কুলিয়ে ওঠে না সতেরো বহরের স্বাতীর মেঘলা-ঘন ভাবায়। সব ভাবনা মুছে যায় ফিকে, ভিজে, আকাশজোড়া ঘোরবিকেলে।

এমনি এক বিকেলে স্বাতী নিচু হয়ে পড়ছিল টলস্টয়ের নীতি-ক, রাজেনবাবু আপিশ থেকে ফিরে ডাকলেন–স্বাতী। স্বাতী শুনতে পেল না। রাজেনবাবু কাছে এসে বললেন–এই বিকেলবেলায় আর বই কেন? স্বাতী চমকে তাকাল, বাবাকে দেখে হাসল, উঠে দাঁড়াল বইয়ের মধ্যে আঙুল দিয়ে। আজকাল তোকে যখনই দেখি তখনই পড়ছিস। এত পড়া কি ভাল? ভাল না বুঝি?

এসব বই—স্বাতীর টেবিলটার দিকে একবার তাকালেন রাজেনবাবু-বুঝিস তুই?

কেন বুঝব না—? একটু লজ্জা-লজ্জা ধরনে স্বাতী জবাব দিল। সব সময় পড়া কিন্তু ভাল না। রাজেনবাবু আবার বললেন।

আর-কী করব, বলো তো?

কেন?–রাজেনবাবুর মুখ-চোখ উজ্জ্বল হল, যেন একেবারে নতুন একটা আবিষ্কার করলেন এক্ষুনি। সংসারের কাজ-টাজ করতে পারিস মাঝে-মাঝে।

ঠিক! ডান হাতের তর্জনী তুলে স্বাতী দাঁড়াল একটু, তারপরে সে-ও যেন মস্ত একটা আবিষ্কার করে ফেলল হঠাৎ—বাবা, ভিজেছ!

কই তেমন—

কী-যে তুমি, রোজ-রোজ তোমার ভেজাই চাই! নেচে উঠল পিঠের উপর চুল। এক ছুটে নিয়ে এল শুকনো জামাকাপড়। চা আনছি এক্ষুনি—বলে দৌড় দিল আবার। কিন্তু চা খেতে-খেতেও হাতে রাখল বই।

একে-একে চারখানাই শেষ হল। ফেরৎ দিতে হবে, নতুন বইও চাই, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করে না। আবার কাউকে দিয়ে পাঠানো ভাল দেখাবে কি? এই দ্বিধা থেকে তাকে উদ্ধার করলেন সত্যেনবাবু নিজেই। হঠাৎ একদিন বেলা তিনটের সময় তিনি টোকা দিলেন রাজেনবাবুর দরজায়। দরজা খুলে দিয়ে স্বাতী যেন তাকাতে পারল না মুহূর্তের জন্য। বৃষ্টির পরে দারুণ রোদ সেদিন। টুটুকে লাল মুখে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন সত্যেনবাবু। হাতে এক পাজা বই অবশ্য আছেই। আপনি!—স্বাতীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তোমার জন্য বই আনলাম দুখানা–।

আসুন! ঘরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই স্বাতীর হাতে দু-খানা বই দিলেন সত্যেনবাবু। স্বাতী একবার তাকিয়ে আস্তে-আস্তে বল— শানাই, নবজাতক। নতুন বই? বলতে চেয়েছিল যে নতুন কেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু সত্যেনবাবু জবাব দিলেন–রবীন্দ্রনাথের নতুন বই। কত ভাগ্য আমাদের, এখনো রবীন্দ্রনাথের নতুন বই পাচ্ছি। কিন্তু যে-রকম শুনছি তার শরীরের অবস্থা–।

অসুখ?

সেবারের পর আর সামলে ওঠেননি ঠিক। কবে-যে রবীন্দ্রনাথের কী অসুখ করেছিল স্বাতী তা জানত না, তাই একটু চুপ করে থেকে বলল-বসুন! হাতের বইগুলি পাশে রেখে সত্যেনবাবু এমন একটি শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলেন যেন ওখানেই কাটাবেন বাকি জীবন। জিজ্ঞেস করলেন-ও-বইগুলো পড়লে? আবছা হাসল স্বাতী। আবছা মাথা নাড়ল।

হয়নি এখনো?

স্বাতী তাড়াতাড়ি বলল, আপনার কিআমার কোনো দরকার নেই এক্ষুনি, কিন্তু তোমাকে তো আরো পড়তে হবে। এই তো সময়। স্বাতী মাথা নিচু করে আঁচলের প্রান্তটা জড়াতে লাগল হাতের কব্জিতে।

কেমন লাগল তোমার? স্বাতী চোখ তুলল একবার, বলল না কিছুই। ভাল লাগল? সত্যেনবাবু আবার জিগেস করলেন। এ-প্রশ্নের কি কোনো উত্তর আছে? তার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যেনবাবু বললেন—আচ্ছা, আরো দেব তোমাকে, বলেই দাঁড়ালেন।

যাচ্ছেন?

যাই—

এক্ষুনি?

বাড়ি গিয়ে একটু পরেই বেরোতে হবে আবার। জানালার দিকে তাকিয়ে স্বাতী বলল—কী রোদ!

—ঘরে বসে যতটা মনে হয় বেরিয়ে পড়লে আর ততটা লাগে না…আচ্ছা।

সত্যেনবাবু চলে যাবার পর স্বাতী বাইরের ঘরেই বসে রইল। একটু চা খেতে বলল না, একটু জল পর্যন্ত না! এই রোদুরে কত যেন ক্লান্ত হয়ে এসেছিলেন। তা আর কী হবে–ওরকম হঠাৎ চলে গেলে মানুষের কি আর মনে থাকে কিছু! তবু নিজের এই ত্রুটিটা স্বাতীর মনে খোঁচা দিতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। সেটা ভুলে যাবার জন্য নবজাতক খুলে বসল, এখানে ওখানে চোখ বুলিয়ে এলোমেলো পাতা ওল্টাল কয়েকবার। তারপর হঠাৎ অন্য কথা ভুলে গিয়ে পড়তে লাগল কবিতা। একটির পর একটি, শান্তি নামল মনে। যেসব গল্প একদিন ধরে সে পড়ছিল, তার আশ্চর্য পাগলামির পরে এ যেন এক আরো আশ্চর্য শান্তি, ঝড় অন্ধকার আর অসহ্য বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে সে যেন চলে এল এমন এক দেশে যেখানে সব আলো, সব ভাল, সব সুন্দর। মনের আরামে চোখ বুজে এল তার, নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে মধুর একটি ঘুম মায়ের মতো তাকে কোলে তুলে নিল।

বই ফেরৎ দিতে স্বাতী নিজেই গেল দু দিন পরে এক আঙুলে আস্তে টোকা দিতেই দরজা খুলে তার মুখোমুখি দাঁড়ালেন সত্যেন রায়। একটু তাকিয়ে থেকে বললেন—এসো। ঘরে ঢুকে স্বাতী থমকে দাঁড়াল। বেতের টেবিলে পা তুলে দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে বসে আছেন একজন। দু-আঙুলে সিগারেট ধরা একটি হাত চেয়ারের বাইরে ঝুলে পড়েছে, চোখ যেন আদ্ধেক বোজা। আরে! এঁকে তো চিনি, দেখেছি তো আগে! কে… কোথায়?—এস! সত্যেন রায় আবার অভ্যর্থনা জানালেন।

এগিয়ে এসে স্বাতী দেখল, টিপয়ে দু-পেয়ালা আদ্ধেক-খাওয়া চা আর মেঝেতে সিগারেটের টুকরো। এঁরা বেশ গল্প-টল্প করছিলেন, এর মধ্যে আমি… আগে জানলে কি আসতুম এসময়ে। অন্য ভদ্রলোকটি যেন এতক্ষণে জানলেন যে ঘরে আর-একজন এসেছে। কেমন ঝিমোনো অনিচ্ছুক চোখে একটু তাকিয়েই হঠাৎ সমস্তটা চোখ খুলে ফেললেন। যেন একটা ধাক্কা খেয়ে স্বাতী কাছের চেয়ারটায় বসে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল যে ইনি তো সেই বিখ্যাত ধ্রুব দত্ত, যার নাম শুনেছিল দাদার মুখে, আর দাদার নাটক দেখতে গিয়ে যাকে দেখে হতাশ হয়েছিল।

স্বাতী মিত্র, আমাদের কলেজের ছাত্রী। আর ইনি ধ্রুব দত্ত, কবি—বলে সত্যেন রায় ছাত্রীর নাকের কাছে ভোলা মস্ত দুখানা পায়ের দিকে তাকালেন। ধ্রুব দত্ত পা নামিয়ে নিলেন। কিন্তু ও-রকম এলিয়েই বসে রইলেন চেয়ারে। স্বাতীর নরম নমস্কারের উত্তরে মাথাটা অস্পষ্টভাবে একটুখানি নেড়ে হাত বাড়িয়ে পেয়ালার চা-টুকু শেষ করলেন এক চুমুকে। তোমাকে একটু চা দিতে বলি? —ধ্রুব দত্তর অবহেলার ভঙ্গিটা সত্যেনবাবু ঢেকে দিতে চাইলেন ছাত্রীর দিকে একটু বেশি মন দিয়ে।

না, আমি এক্ষুনি…আমি শুধু এই বইগুলো—

একটু বোসো। একটা কবিতা শোনো ধ্রুববাবুর। টেবিল থেকে রোগা চেহারার একটি পত্রিকা তুলে নিলেন সত্যেন রায়। কবির দিকে তাকিয়ে বলেন—আপনি পড়ুন।

না, না, আমি পড়তে-উড়তে পারি নামোটা গলায় জবাব দিলেন কবি।

পড়ুন না! এই মেয়েটি… ইনিও খুব কবিতা ভালবাসেন।

নাকি?–পুরো চোখ খুলে ধ্রুব দত্ত আবার তাকালেন স্বাতীর দিকে। স্বাতী তাকিয়ে দেখল, ভদ্রলোকের মুখের চেহারায় একটুও সুখ নেই, মোলায়েম কালো রঙের তলায় একটা অশান্তি যেন ছটফট করছে সবসময়। সেই নাটকের রাত্তিরে ভাল করে দেখতে পারেনি, আজ দেখল, দেখে আরো খারাপ হয়ে গেল মন। এই একজন কবি? কী জানি!

কবিতাটা পড়ুন না—আবার অনুরোধ করলেন সত্যেন রায়। কিন্তু সিগারেট মুখে তুলতে তুলতে হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিলেন ধ্রুব দত্ত। তাহলে আমিই পড়ি একবার কবির দিকে, একবার ছাত্রীর দিকে তাকিয়ে, আর দেরি না করে সত্যেন রায় পরিষ্কার গলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে সেই পত্রিকার কবিতাটি পড়লেন। পড়ার শেষে জ্বলজ্বলে মুখে বললেন—খুব ভাল হয়েছে, সত্যি! ধ্রুব দত্ত ঠোঁট বাঁকালেন একটু, কিন্তু ওতেই বোঝা গেল যে তিনি খুশি হয়েছেন। তোমার কেমন লাগল? পোফেসর ফিরলেন ছাত্রীর দিকে।—ভাল। পড়াটা খুব ভাল লেগেছিল স্বাতীর। কিন্তু কবিতাটার ভাল-মন্দ কিছু বোঝেনি, সেইজন্য কথাটায় খুব বেশি উৎসাহ আনতে পারল না। হঠাৎ ধ্রুব দত্ত সারা মুখ ভরে হেসে ফেললেন। কেমন একটু মজার ধরনে নাক কুঁচকে বললেন নিজের লেখা সম্বন্ধে ঐ ভাল কথাটা শুনলেই আমার যেন পায়ের তলায় শুড়শুড়ি লাগে.. চলি। লম্বা শরীরটাকে কয়েকটা ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে সোজা করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বিদায়ের একেবারেই কোনো ঘটা না করে বেঁকে-বেঁকে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন দরজা দিয়ে। ঘরে হঠাৎ যেন একটা শান্তি নামল। অনেকক্ষণ চলবার পর রেডিও বন্ধ হলে যেমন লাগে, ঠিক সেইরকম। স্বাতীর অপ্রস্তুত লাগল। চটে গেলেন ধ্রুব দত্ত? আমি কি খুবই বোকার মতো বলেছিলাম ভাল-টা? সত্যি, আমি একটা মানুষ, আমার আবার একটা ভাললাগা! কিন্তু আমার কী দোষ, সত্যেনবাবুই তো—

প্রথম দেখলে–সত্যেন রায় এতক্ষণে রোগা চেহারার পত্রিকাটিকে হাত থেকে নামালেন–ধ্রুববাবুকে একটু কেমন-কেমন লাগে, কিন্তু সত্যিকার কবি। স্বাতী আর কথা বলার উৎসাহ পেল না।

হঠাৎ উঠে দুম করে চলে গেলেন? যেন আপন মনেই সত্যেন রায় বললেন আবার আমার সঙ্গেও আলাপ আজই প্রথম।

আজই প্রথম! স্বাতী অবাক হয়ে তাকাল। যে-রকম করে বসেছিলেন–মনের কথাটা আর লুকোতে পারল না সে-আমি ভেবেছিলুম আপনার কতকালের বন্ধু! বসবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে সত্যেন রায় বললেন—তবে কি ভাবছিলে আমার বন্ধু বলেই প্রশংসা করছিলাম? অবশ্য বন্ধু হলেও প্রশংসা আমাকে করতেই হত, এমনকি শত্রু হলেও। একটু চুপ করে থেকে স্বাতী আবার বলল—যারা ভাল লেখেন তাদের সকলের সঙ্গেই বুঝি আপনার আলাপ?

সকলের সঙ্গে আর কোথায়—সত্যেন রায় একটু-যেন লজ্জিত হলেন স্বাতীর প্রশ্নে। তবে এর এর বইয়ের একটা সমালোচনা লিখেছিলাম আমি, সেইটে পড়ে—

নিজের প্রশংসা পড়ে আর টিকতে পারলেন না? ছাত্রীর সরল হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে অধ্যাপকের নিজেরও হাসি পেল। কিন্তু গম্ভীর হয়ে বললেন—প্রশংসা শুনতে যে ভাল লাগে, সেটাই ওঁর ভাল লাগে না। ঠিক শিল্পীর স্বভাব।

যারা বই লেখে তাদের চাইতে যারা বই পড়ে তারাই কিন্তু ভাল—স্বাতী হেসে ফেলল কথাটা বলে।

লেখকের চাইতে লেখকের বই অনেক সময় ভাল হয় বটে—সত্যেন রায় একটু ভেবে বললেন। কিন্তু ধ্রুব দত্তর চোখ-মুখ কী অসাধারণ।

নাকি? মনে-মনে বর্ণনার সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করতে-করতে স্বাতী বলল— কিন্তু উনি তো বুড়ো! সত্যেন রায় হেসে বললেন–তোমার বয়সে অনেককেই বুড়ো লাগে, আমার বয়সে অনেককেই লাগে না। স্বাতীর মুখে এল—আহা, আপনার আবার বয়স! কিন্তু এ রকম সুরে কি প্রোফেসরের সঙ্গে কথা বলা যায়? তাই সে বলল—আপনার থেকে তো অনেক বড় উনি!

তাই বলে বুড়ো নাকি! একটু পরে আবার বললেন–কবিদের বুড়ো হওয়া বুঝি ভাল লাগে তোমার?

কারোরই লাগে না—স্বাতী স্বীকার করল।

রবীন্দ্রনাথকে দেখে তোমার কী মনে হয়?

দেখিনি কখনো।

রবীন্দ্রনাথকে দ্যাখোনি! কলকাতায় আছ, এত বড়ো হয়েছ, রবীন্দ্রনাথকে দ্যাখোনি।

স্বাতী মাথা নিচু করে অপরাধ মেনে নিল। সতেন রায় হঠাৎ হেসে বললেন—এমন করে বলছি যেন তোমার দোষ। সকলের কি আর সুযোগ হয়? আর মেয়েদের অসুবিধে কত! মাকে বলে শান্তিনিকেতনে যাও না একবার। স্বাতী বলল—আমার মা নেই। মুখের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে সত্যেনবাবু বললেন–মা নেই…তা বাবা তো আছেন। আর এমন চমৎকার বাবা! মনে-মনে একটু চিন্তা করে, অনেকটা সাহস করে স্বাতী এতক্ষণে একটা ঘরোয়া প্রশ্ন করল—আপনার মা-বাবা এখানে থাকেন না?

আমার মা-ও নেই, বাবাও নেই—ক্ষীণ একটু হাসলেন সত্যেনবাবু। স্বাতী অবাক হল কথা শুনে। কিন্তু অবাক কী, এরকম কত লোকই তো আছে পৃথিবীতে। কিন্তু বাৱাও নেই! তার বাবাও কি থাকবেন না একদিন? মুহূর্তের জন্য স্বাতী যেন নিশ্বাস নিতে পারল না। একটু নড়ে-চড়ে একটু সোজা হয়ে যেন নিজের মধ্যে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল–ভাই-বোন? সত্যেনবাবু মাথা নাড়লেন।

তাও নেই…একজনও না… আশ্চর্য!

আশ্চর্য বুঝি?

স্বাতী কথা বলল না। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। এ বাড়িতে যদি একজন মা থাকত এখন, কত ভাল লাগত। নিজের রুগ্ন মার স্মৃতিকে মনে-মনে সাজিয়ে দাঁড় করাল এই ঘরে, দেখল তার হাসি, শুনল তার কথা আর ছায়াভরা ঘরে চুপচাপ বসে-বসে তার যেন মনে হতে লাগল যে-মার কথা সে ভাবছে, সে-মা আর কেউ নয়, সে নিজেই।

উঠে ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন সত্যেনবাবু—এবারে কী-কী বই নেবে বলো। উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বেছে-বেছে নামালেন কয়েকখানা ইংরেজি বই। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে বললেন–ধ্রুব দত্তর কবিতা পড়বে নাকি? নিজের অজান্তেই একটু কুঁচকে গেল স্বাতীর কপাল। ঐ এক পেয়ে বসেছেন! সত্যেনবাবুর মুখে একটু যা চেখেছিল, তাতে ধ্রুব দত্তর কবিতা সম্বন্ধে খুব একটা খিদে চেতিয়ে ওঠেনি তার। তাই কোনো জবাব দিল না। প্রথমেই ভাল লাগবে হয়তো–সত্যেনবাবু মুখ দেখে মনের কথাটা বুঝে নিলেন—তাই বলে যদি ছেড়ে দাও তাহলে কিন্তু ঠকবে। দ্যাখো পড়ে! স্বাতী উঠে দাঁড়িয়ে বই ক-খানা হাতে নিল—আমি তাহলে যাই?

খুব ভাল লাগল আজ বিকেলবেলাটা—স্বাতীর সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে সত্যেনবাবু বললেন। স্বাতী ভেবেছিল তিনি রাস্তা পর্যন্ত আসবেন। কিন্তু দরজার কাছে থামলেন, একটু দাঁড়িয়ে থেকেই চলে গেলেন ভিতরে। খুব ভাল লাগল বিকেলবেলাটা, স্বাতীর মনের মধ্যে বাজতে লাগল। কেন? বোধহয় ধ্রুব দত্তর জন্য। রান্নাঘরের দিক দিয়ে বাড়ি ঢুকল স্বাতী। ঢুকেই দাদার সঙ্গে দেখা। খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছে বিজন, আর সেই সঙ্গে প্রকাণ্ড একটা অমলেট। দাদা! তুই এ-সময়ে বাড়িতে?

কেন, থাকতে নেই একদিনও? টেবিলের উপর বইয়ের বোঝা নামিয়ে স্বাতী বসল দাদার মুখোমুখি। হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে বলল-সে-কথা আমরাই জিজ্ঞেস কতে পারি তোকে। চামচে দিয়ে অমলেট কেটে নিয়ে মুখে দিল বিজন। আর বাঁ হাতে কামড়ে ছিড়ে নিল খানিকটা কাচা রুটি। চিবোতে চিবোতে ফোলা ফোলা গালে একটু হেসে বলল–বাড়ির কী খবর-কবর বল।

তুই আজকাল কী করছিস বল তো সত্যি করে! স্বাতী ভুরু কুঁচকে তাকাল দাদার দিকে। একেবারে সত্যি কথাটাই শুনবি? বিজন গলা ভিজিয়ে নিল চায়ের পেয়ালায় তোর প্রোফেসর কেমন আছেন?

প্রোফেসর? তখনকার মতো স্বাতী যেন ভুলেই গিয়েছিল যে সত্যেন রায় তার প্রোফেসর। ঐ যে, বাবা যাকে আমার টেবিলফ্যানটা পাঠিয়ে দিলেন।

তোর ঘরে তো সীলিং-ফ্যানই আছে আজকাল।

তবু পাখাটা আমার জন্যই এসেছিল, অন্য কাউকে দেবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস অন্তত করা উচিত ছিল একবার। একটা কড়া জবাব এসেছিল স্বাতীর মুখে, কিন্তু সেটা বলতে গেলেই ঝগড়া হবে। আর ঝগড়া হলে দাদার আর কী, বেরিয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত, তারই মন-খারাপ হয়ে থাকবে দু দিন ধরে। তাই একটু চুপ করে থেকে স্বাতী অন্য কথা পাড়ল তোর ধ্রুব দত্তর সঙ্গে দেখা হল এইমাত্র—লেখক ধ্রুব দত্ত? ওর নামও আর মুখে আনিস না আমার কাছে।

সে কী! স্বাতীর চোখ কপালে। —এই না তুই ধ্রুব দত্ত বলতে পাগল!

তা পাগল প্রায় হয়েইছিলাম ওর পাল্লায় পড়ে। বিজন হা-হা করে হাসল।–আমাকে বলল থিয়েটারের পাশ দেবে, বাড়ি যেতে বলল। তা যেদিনই বাড়ি যাই সেদিনই বাড়ি নেই। বাড়িতে কখনো না-ই যদি থাকবে, তাহলে বাড়ি একটা রাখা মে বাপু! অদ্র! ধ্রুব দর টেবিনে তোলা পা দুটোর কথা মনে করে দাদার শেষ মন্তব্যে সায় দিতে লোভ হল স্বাতীর, কিন্তু পাছে এতে দাদার বড়ো আশকারা হয়, তাই একটু হেসে বলল-ধ্রুব দন্ত্র চেয়ে তোর বুদ্ধি এক বেশি, দাদা। বাড়িতে কাউকে আসতেই বলিস না কখনো। বিজন কথা না বলে মুখ নিচু করে রুটি-অমলেট শেষ করল। ট্রেন-বদলের আগে লোকেরা যেমন খিদের মুখে রিফ্রেশমেন্ট রুমে খেয়ে নেয়, সেই রকম করে খেল সে, দ্রুতবেগে, আদ্ধেক চিবিয়ে, কোনোদিকে না তাকিয়ে। শূন্য প্লেটটা ঠেলে দিয়ে চায়ের পেয়ালা কাছে এনে মুখ মুছল কুমালে, তারপর স্বাতীর কথার জবাব দিলো—আমার সঙ্গে নাকি ধ্রুব দত্তর তুলনা! আমি হলাম দু-বার ম্যাট্রিক-ফেল-করা ভ্যাগাবন্ড, আর উনি একজন বিখ্যাত মানুষ। বিবাহিত ভদ্রলোক, ছেলেপুলে চারটে-পাঁচটা। ওঁর কথার একটা ওজন থাকা চাই তো! বাজে, বাজে সব!

সত্যেন রায় তো বলেন, উনি কবিতা লেখেন খুব ভাল।

তা যত খুশি লিখতে পারেন, তাতে আমার কিছু না।

তোরই বা পাশ চাইতে যাবার কী হয়েছিল?

বাঃ, উনিই তো উৎসাহ করে…যাক, যাক, তুই তোর প্রোফেসর আর সাহিত্যিকদের নিয়ে থাক, স্বাতী। আমি ওসবের মধ্যে নেই। বিদ্যের পিপে তো সব! কিন্তু টাকার মুখ দ্যাখে কখনো! ও-রকম বিদ্যে দিয়ে লাভ কী বল আজকালকার দিনে? পিঠ খাড়া করে বসে টেবিলের উপর দু-কনুই রাখল স্বাতী। আঙুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলল—তোর থিয়েটার আবার কবে? জানিস না বুঝি? ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বিজন একবার চোরা হাসি হাসল। ছেড়ে দিয়েছি ওসব। এত বড় একটা খবরে একটুও চঞ্চল না হয়ে দু-হাতের জড়ানো আঙুলের মাঝখানটায় থুতনি রেখে স্বাতী বলল—এখন তাহলে? ফিল্ম?

ফিল্মে তো ঢুকতে পারি ইচ্ছে করলেই, কিন্তু—

আর কিন্তু কেন? নিচু-করা চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বিজন বলল হেসে নে, হেসে নে, বেশিদিন হাসবি না।

তা বেশ তো, ফিল্মেই ঢুকে পড়–স্বাতী হাসির রেখা মুছে ফেলল মুখ থেকে।

নাঃ, আমি বিজনেস করব।

কী করবি?

বিজনেস।–গম্ভীর সশ্রদ্ধভাবে বিজন উচ্চারণ করল কথাটা।–বিজন্স বিজনেস? স্বাতী আর পারল না, হাত ছড়িয়ে দিয়ে হেসে উঠল খিলখিল করে। বিজনও হাসল সঙ্গে সঙ্গে, একেবারেই অপ্রত্যাশিত সেটা–সব ঠিক করে ফেলেছি। বি-জন নাম হবে কোম্পানির। ইংরিজি B.John, বুঝলি না? কেমন ভেবেছি, বল তো?

আর কদ্দূর ভেবেছিস?

দেখবি! শোন স্বাতী, হঠাৎ বোনের দিকে গলা বাড়িয়ে বিজন নিচু গলায় বলল–বাবাকে বল না আমাকে হাজার দু-তিন টাকা দিতে। তাহলেই লেগে যেতে পারি এক্ষুনি।

তোরই বলা উচিত না?

নিশ্চয়ই! কিন্তু উচিতটা কি সব সময় হয় রে? সংসারে বাবাদের যে-রকম হওয়া উচিত…

—দাদা! স্বাতীর কণ্ঠে যুদ্ধ ঘোষণা।

থাক, থাক। বিজন বীরদর্পে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। তোর বক্তৃতা শোনার সময় নেই আমার। তোকে বলতে হবে না, যা করবার আমিই করব। দরজার ধার থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার বলল—কিন্তু দুঃখের বিষয়, তোদের বাবা তার একমাত্র পুত্রকে মানুষের মধ্যেই গণ্য করেন না। তা তোরা না দিস, যে করে হোক যোগাড় করে নেব। টাকা আমার চাই। শেষের কথাটা চীৎকার করে, বেগে বেরিয়ে গেল বিজন। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা দুলে উঠল ধাক্কা লেগে।

***

একে একে ক্যালেন্ডার থেকে খসে পড়ল জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরের পাতা। বেরিয়ে পড়ল লাল তারিখে ভরা অক্টোবর। ছুটি! কিন্তু তাতে আলাদা করে আনন্দ করবার কী আছে? আনন্দে ভরে গেছে স্বাতীর দিন-রাত্রি, তার ঘুমের স্বপ্ন, প্রতিটি জেগে থাকা মুহূর্ত। নতুন একটা জগৎ পেয়েছে সে। সাহিত্যের জগৎ—দেশ, দৃশ্য, মানুষ। কত হাসির হাওয়া, কান্নার কাঁপন—কত মধুর, নিষ্ঠুর, ভীষণ, সুন্দর বর্ণনা! লজ্জা করে, ভয় করে, বিশ্রী লাগে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনন্দ, শুধু আনন্দ। জীবনে এত আছে? কী ভাগ্য সত্যেন রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, নয়তো কোথায় পেত এসব, এ-আনন্দ জানত কী করে? এত আনন্দ কি একা একা সহ্য হয়? আর-একজন না হলে চলে? একদিন ছোড়দি এসে তার টেবিলের বইগুলি নেড়েচেড়ে দেখছিল, সুযোগ পেয়ে স্বাতী জিজ্ঞেস করল–ছোড়দি তুমি গোগোল পড়েছ?

গোগোল! শাশ্বতী হেসে উঠল মজার নাম শুনে।—গোগোল কেন, গোল-গোল হলেই পারত। মলাট খুলে বলল-কে রে এই সত্যেন রায়? অনেক বই এনেছিস।

চেনো না তুমি? আমাদের কলেজেরই তো প্রোফেসর।

সত্যেন রায়? শাশ্বতী ভুরু বাঁকাল। কী জানি–আমাদের সময়ে তো ছিল না, নতুন বোধহয়। অনেক বই বুঝি তার?

অনেক। আর কী ভাল-ভাল সব বই! ছোড়দি তুমি যদি এটা পড়ে দ্যাখো, এই ওভারকোটের গল্পটা—উঃ! পাতা উল্টিয়ে লম্বা-লম্বা ব্যঞ্জনবহুল নাম দেখেই শাশ্বতী বই বন্ধ করল। নেবে, ছোড়দি? মিনতি করল স্বাতী। কী-যে অদ্ভুত–শাশ্বতী মাথা নাড়ল-বাংলা বই নেই। ভদ্রলোকের?

কত চাও! কবিতার বই সমস্ত—

কবিতা আবার কে পড়ে! গল্পের বই নেই? নভেল? তোর হারীতদা আবার বাংলা বই পড়েন না, আর ইংরেজি যা পড়েন—

তা কিনে নিলেই পারো বাংলা বই।

হ্যাঁঃ, বই কিনে পয়সা নষ্ট করি আর কি! দামি শাড়ি ঝলমলিয়ে শাশ্বতী চলে গেল ঘর থেকে।

******

এর পর স্বাতী একদিন চেষ্টা করল হারীতদাকে। সেদিন সে শেষ করেছে অস্কার ওয়াইন্ডের উপন্যাস। লক্ষ টাকা দামের মণিমুক্তার মতো কথাগুলি সাজানো। যেন রঙের ঝিলিক লাগে চোখে, যেন এক-একটি কথাকে বইয়ের পাতা থেকে তুলে এনে হাতে ধরা যায়। তীব্র একটা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সে। খুব নিচু গলায়, যেন অত্যন্ত গোপন কিছু বলছে, এইরকম সুরে বলল—হারীতদা, আপনি পিকচার অব ডরিয়ান গ্রে পড়েছেন?

ওয়াইন্ড? হা-হা করে হেসে উঠল হারীত। এস্কেপিস্টের বাদশা! রোমান্টিসিজম-এর পচা মাল! ওয়াইল্ড পড়ছ! এদিকে সর্বনাশ যে ঘনিয়ে এল! স্বাতী অবাক হল, আঘাত পেল, তাকিয়ে রইল। তবে কি এসব ভাল লাগা উচিত না? কিন্তু ভাল লাগার আবার উচিত-অনুচিত আছে নাকি? কী জানি! অগত্যা দাদার পিছনেই ঘোরাঘুরি করল স্বাতী। বিজন মাঝে-মাঝে দুপুরবেলাটা বাড়িতে কাটায়, খেয়ে-দেয়ে লম্বা ঘুম দিয়ে বেরিয়ে যায় বাবা আপিস থেকে ফেরবার ঠিক আগেই-বই পড়বি দাদা, গল্পের বই?

কী বই রে?

খুব, খুব ভাল বই, দ্যাখ! সেই ডরিয়ান গ্রে-র গল্পটাই দাদার হাতে দিল স্বাতী। নিজেকে বড়ো স্বার্থপর লাগে এক-এক সময়… আহা, দাদাও পড়ক। বইটার দিকে তাকিয়ে বিজন বলল–থাক, পরে পড়ব। সিগারেট ধরিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়, বালিশের তলা থেকে বের করল একটা রঙচঙে বই। মলাটে কালো মুখোশ-পরা দুশমনের দিকে পিস্তল উচিয়ে আছে বুক-খোলা জামায় শ্বেতাঙ্গিনী। এ-সব বাজে বই পড়িস কেন দাদা?

বাজে! হুঁ! ঠোঁট গোল করে সিগারেটের ধোয়া বের করল বিজন। জানিস না তো, স্পোকেন ইংলিশ শিখছি। ওঃ, চোস্ত! কথায়-কথায় ড্যাম। একটু পরে আবার বলল—বিজনেস করতে হলে ইংরেজিটা বলতে পারা চাই, বুঝলি না? স্বাতী বুঝল, আস্তে উঠে গেল তার ভাললাগার ভার একলা বহন করে।

দোলের দিনে ছোটো ছেলে যেমন আর-কাউকে বাগাতে না পেরে ঘরে এসে মা-র পিঠেই রঙের শিশি খালি করে, স্বাতীও সেইরকম বাবাকেই ধরে পড়ল একদিন। জান বাবা, সত্যেনবাবু যেসব বই পড়তে দেন না আমাকে, কী-যে ভাল-ভাল বই!

হবেই! যেমন মানুষ, তেমন তত পছন্দ।

তুমি তো বল আমি দিন-রাত কেবল বই পড়ি। কিন্তু তুমি আরম্ভ করলেও আর ছাড়তে পারবে না।

তাহলে আমার তো আরম্ভ না করাই ভাল। আপিস-টাপিস আছে তো আবার! স্বাতী হেসে বলল—আচ্ছা, আমি তোমাকে গল্পগুলো বলব। শুনবে, বাবা?

বেশ! রাজেনবাবু তৎক্ষণাৎ রাজি।

এখন শুনবে?

এখন? রাত্তিরে খেয়ে-দেয়েই তো ভাল। আচ্ছা স্বাতী, সত্যেন তো এত বই দেয়। তোমারও তো ওকে কিছু দেওয়া উচিত।

ও মা, আমি আবার কী দেব!

নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে পারো মাঝে-মাঝে। ভাল রান্না-টান্না হলে পাঠিয়েও দিতে পারো। আমি ও-সব পারব-টারব না।

পারব না বললেই তো আর হল না। এখন বড় হয়েছ, সবই করতে হবে। স্বাতী মুখ তুলে শুধু মাথা নাড়ল উত্তরে। আচ্ছা, পুজোর সময় আমিই বলে আসব একদিন। শ্বেতাও এসে পড়বে তদ্দিনে। খুশির আভা লাগল রাজেনবাবুর মুখে।

বড়দি সত্যি আসবে?

লিখেছে তো-রাজেনবাবুর মুখ খুশিতে জ্বলজ্বলে হল। কিন্তু ছুটি হবার সঙ্গে-সঙ্গে সত্যেনবাবু চলে গেলেন কোথায় যেন বাইরে আর পুজোর কটা দিন দেশের বাড়িতে কাটিয়ে দশমীর দুদিন পরে শ্বেতা এসে পৌঁছল স্বামী, চারটি ছেলে-মেয়ে, একটি চাকর আর বিস্তর মালপত্র নিয়ে। এসেই হোল্ডলে বাঁধা মস্ত বিছানা নিজেই টেনে-টুনে খুলে ফেলল, বের করে দিল এক বান্ডিল পুজোর কাপড়, আর বিস্কুটের টিনে-টিনে ভরা ক্ষীরের আর নারকোলের রকমারি খাবার। এক প্লেট ভরতি করে সাজিয়ে স্বাতীর সামনে ধরে বলল-খা।

ও মা! এত!

এত কী রে? আমার ওরা তো এরকম চার পালা… বাব্বা, বিছানার মধ্যে যা করে লুকিয়ে এনেছি, রাক্ষসরা টের পেলে কি আর রক্ষে ছিল? পথেই সাবাড় করে দিত। আরো দু-প্লেট সাজাতে-সাজাতে বলল—আয় বিজু। বাবা? রাজেনবাবু হেসে বললেন—তুই হচ্ছিস কী রে দিন-দিন? এই তো বাড়িতে পা দিলি!

নষ্ট হয়নি তো আবার? উদ্বেগ ফুটল শ্বেতার কঠে। একটা তুলে নাকের কাছে ধরে দু-তিনবার নিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিন্ত হল—না, ঠিক আছে। কী? নিজের বাচ্চাদের সে তাড়া করল এবার

এখানে ঘুরঘুর কেন? আচ্ছা, নে একটা-একটা। আর কিন্তু না, ভাগ! স্বাতী খাচ্ছিস না?

—চা হোক।

আচ্ছা আচ্ছা, চায়ের সঙ্গে আবার খাবি, এখন এইটে–। বেছে-বেছে একটা মৎস্যাকৃতি মিষ্টি তুলে শ্বেতা গুঁজে দিলে স্বাতীর মুখে।

আঃ, বড়দি।

কেমন, ভাল না? সমস্ত মুখে এলাচগন্ধী নরম নারকোলের ছড়িয়ে-পড়া অনুভব করতে-করতে স্বাতী হেসে ফেলল।

এই ক্ষীরেরটা…বিজু, তুই আর, এই যে-স্বামীকে দেখতে পেয়ে শ্বেতা আঁচল তুলে দিল মাথায় তুমিও একটা খাবে নাকি?

তোর পাল্লায় পড়লে কি আর রক্ষে আছে? রাজেনবাবু হাসলেন।

আর বলেন কেন? গালের চর্বির ভাজে-ভাজে হাসি ফুটিয়ে প্রমথেশ বলল—ব্লাড-প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে, তার উপর আপনার মেয়ে…

আহা–স্বামীর আর বাবার মাঝামাঝি তাকিয়ে শ্বেতা বলল—ইচ্ছে না-থাকলে কেউ যেন জোর করে খাওয়াতে পারে। রাজেনবাবু বললেন—সক্কলে তো খেল, তুই? শ্বেতা যেন শিউরে উঠে বলল—রক্ষে করো! এসব খেতে-খেতে পচে গেছে মুখ! আমার জন্য ডিম-সন্দেশ এনো। আর শোনপাপড়ি, আর কলে-ঠান্ডা দই।

বেশ।–রাজেনবাবু উঠে পড়লেন। বাবা, চা…

চা আর খাব না এখন। আর দেরি না করে রাজেনবাবু চললেন ট্রামে করে জগুবাবুর বাজারে। একটু পরেই শাশ্বতী আর হারীত এসে পৌঁছল, নতুন করে বোল উঠল আনন্দের। চা হতেহতে শ্বেতা এল। হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার একটি শাড়ি পরে, কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুর, আঁচলে চাবির গোছা। যদিও পাঁচটি সন্তানের মা, একটু ভাঙেনি তার শরীর। একটু মোটা হয়নি, ঈষৎ স্নান রঙের মুখখানা যেন লাবণ্য দিয়ে বানানো। স্বাতী দেখে মুগ্ধ।

বসন্তের সকালে পাখি যেমন নেচে-নেচে বেড়ায়, চায়ের টেবিলে শ্বেতার ভাবটা যেন তেমনি। একবার শাশ্বতীকে জড়িয়ে ধরে। একবার হাত রাখে বিজুর টেড়ি-কাটা মাথায়। একবার কোনো একটা সেকেলে চিরকেলে ঠাট্টা করে হারীতকে। জনে-জনে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে দিতে স্বাতীর কাছে এসে হঠাৎ একটু থেমে বলল—স্বাতী! তুই বড়ো সুন্দর হয়েছিস রে?

আর তুমি! লাজুক হেসে স্বাতী জবাব দিল—তুমি-যে দিন-দিন আরো সুন্দর হচ্ছো।

শোনো কথা! স্বাতীর প্রকাণ্ড খোঁপাটার উপর দিয়ে শ্বেতার হাত ঘুরে এল একবার—এ-রকম চুলই তো আজকাল দেখি না কোনো মেয়ের। নিজের ছোটোখাটো খোঁপাটা আস্তে একটু চাপড়ে শাশ্বতী বলল—জান বড়দি, লম্বা চুল আজকাল আর ফ্যাশনেবল নয়।

নাকি রে? তাহলে আমার আর দুঃখ কী। আমারও ছিল তো মন্দ না, কিন্তু যেতে-যেতে এখন…এই দ্যাখ, শেয়ালের ল্যাজ। তার কথা শুনে, তার হাসি দেখে, সকলেই হেসে উঠল একসঙ্গে।

মেয়েদের চুল আর ক-দিন! হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে উঠল বিজন—যদ্দিন না বিয়ে হয়। বিয়ের পরে একটি-দুটি ছেলেপুলে হলেই ব্যস! কথাটা সে শুনেছিল অনেকদিন আগে ধ্রুব দত্তর মুখে। বাড়ির এতগুলি লোকের সামনে এমন লাগসই জায়গায় বলতে পেরে কী-যে খুশি লাগল! ধ্রুব দত্ত যখন বলেছিলেন, শ্রোতারা অনেকেই হেসেছিল, কিন্তু বিজনের শ্রোতারা একটু যেন গম্ভীরই হয়ে গেল, শুধু প্রমথেশ বলে উঠল—ঠিক…ঠিক বলেছ বিজু, একেবারে খাঁটি কথা। শাশ্বতী নড়েচড়ে বলল–ছেলেমানুষের মুখে বুড়ো কথা কী বিশ্রী!

আর কতকাল ছেলেমানুষ করে রাখবি তোরা? মস্ত বাবু হল না? তো একটু হাসল ভাইয়ের দিকে। বিজু, আর চা? বয়স্ক মোটা গলায় বিজন জবাব দিল—না, আর না। তোমরা বোসো বড়দি। আর কারো দিকে না তাকিয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি। তথাকথিত গুরুজনদের মধ্যে বসে থাকা আর সম্ভবও ছিল না তার পক্ষে। সিগারেটের জন্য আইঢাই করছিল প্রাণ।

হারীত, তোমাকে আর?

দিন আর-একটু–হারীত তার পেয়ালাটি ঠেলে দিল শ্বেতার দিকে। স্বাতী বলল—তুমি এবার বোসো তো বড়দি, খাও।

এই বসি-হারীতের পেয়ালা দ্বিতীয়বার ভরে দিয়ে শ্বেতা বসল বিজুর পরিত্যক্ত চেয়ারে। শাশ্বতীর আর হারীতের মাঝখানে দে তো শাশ্বতী, আমাকে একটু চা দে। চিনি বেশি কিন্তু। ক চামচে? খুব পরিচ্ছন্ন, নিপুণ, নিখুঁত ভঙ্গিতে চিনির বাটিতে চামচে ড়ুবিয়ে শাশ্বতী চোখ তুলল।

তিন। একটু হেসে শ্বেতা জুড়ে দিল—চারেও আপত্তি নেই… এ কী রে!

হঠাৎ শাশ্বতীর চামচে-ধরা ডান হাতের কব্জিটা দু-আঙ্গুলে চেপে ধরল শ্বেতা।–শাঁখা কই?

শাশ্বতী জবাব দিল না। নিচু মুখে চা ঢেলে দিয়ে বসে পড়ল।

বিয়ের শাখা ভেঙে গেছে বুঝি? তা পরতে হয় তো আবার! ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ম একটু হাসি ফুটিয়ে হারীত বলল–ও সব দাসীত্বের চিহ্ন ধারণ করে আর কী হবে!

দাসীত্ব? আহা রে শ্বেতা কনুই দিয়ে ঠেলা দিল শাশ্বতীকে। কী রে? দাসীত্ব নাকি? কিন্তু শাশ্বতী হাসল না, মুখ তুলল না। এই শাখা নিয়ে একটু দুঃখের খোঁচা আছে তার মনে। শাখার বিরুদ্ধে হারীতের জেহাদ বিয়ের প্রথম থেকেই। অসভ্য, বর্বর, মিডিয়াভল…এ-সব বিশেষণ শেষ করে হারীত বলল –ঐ শাখা-সিঁদুর-পরা মূর্তি নিয়ে বেরোতে লজ্জা করে আমার।

শাশ্বতীও রাগ করে জবাব দিল বেশ তো, বেরিয়ো না!

কী? একেবারে সতীলক্ষ্মী হয়ে অন্তঃপুরে লুকোবে?

আমি যাই করি না, তোমার তাতে কী?

–নিশ্চয়ই আমার, কেননা তুমি আমার স্ত্রী। আর এ-যুগে আমরা তো শুধু স্ত্রী চাই না, সঙ্গিনীও চাই।

—সঙ্গিনীর অভাব কী তোমার! এই শেষ মন্তব্যটার একটু ইতিহাস ছিল। কদিন আগে একটা পার্টিতে গিয়েছিল তারা। কোনো এক দুঃখী দেশের সাহায্যে চাঁদা তোলা হচ্ছিল শাশ্বতীর ঠিক মনে নেই সেটা চীন না স্পেন না চেকোশ্লোভাকিয়া। সেখানে একটি ঠোঁটে-রং-মাখা পাজামাপরা পাঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে হারীত একটু বেশিক্ষণই কথা বলেছিল। বাড়ি ফেরার পথে শাশ্বতী একটু গম্ভীর হয়েছিল সেদিন। কিন্তু হারীত স্পেন, চীন কিংবা চেকোশ্লোভাকিয়ার দুর্দশার বর্ণনায় এত মগ্ন ছিল যে স্ত্রীর মুখ দেখে কিছুই তার মনে হয়নি তখন। কিন্তু যেই শাশ্বতী ওকথা বলল, অমনি ঐ পাঞ্জাবি মেয়েটির কথাই মনে পড়ল তার। সে খুব শ্রদ্ধা করে এমন একজন মানুষের বোন। একটু তাকিয়ে থেকে স্ত্রীকে বলল—তুমি দেখছি একেবারেই অশিক্ষিত। এই রকম কথা-কাটাকাটি হতে-হতে বিয়ের ছমাস পরে একদিন শাশ্বতীর হাত চেপে ধরে মটমট করে দুটো শাখা ভেঙে দিল হারীত। রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে খুব কাঁদল শাশ্বতী-দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম কান্না—কিন্তু শাঁখা পরার কথা আর মনেও আনল না, আর আস্তে-আস্তে তার মনে হতে লাগল যে এ-ই ভালো হল, হারীতের বন্ধুদের স্ত্রীরা কেউই শাঁখা পরে না, একটু বেখাপ্পাই লাগে নিজেকে।

শাশ্বতীর কাছে কোনো জবাব না-পেয়ে শেতা ফিরল হারীতের দিকে-তা দাসীত্ব যদি হয় সে তো তোমারই দোষ বাপু, শাখার উপর রাগ কেন? মুহুর্তের জন্য একটু-যেন অস্বস্তি বোধ করল হারীত, তারপর বলল-ও-সব চিহ্ন দূর হলে দাসীত্বও যাবে।

কেন, চিহ্ন ছাড়া দাসীত্ব থাকতে পারে না?

এটা কিন্তু তোমার দিদি ঠিক বলছেন, হারীত। এই ধরো না আমরা, আমরা তো এঁদের দাসত্বই করি। কিন্তু চিহ্ন-টিহ্ন কিছু তো নেই-বলতে-বলতে প্রমথেশের গালে চর্বির ভাজে-ভাঁজে যেন হাসির ছোটো-ছোটো ঢল নামল। সেদিকে তাকিয়ে হারীত মনে-মনে বলল-হাফ-উইট! কিন্তু মনের কথা যেহেতু কানে শোনা যায় না, তাই প্রমথেশ আবারও একটা রসিকতার চেষ্টা করল—বিয়ের পরে পুরুষেরও যাতে একটা চিহ্ন থাকে, তুমি বরং তাই নিয়ে একটা আন্দোলন আরম্ভ করতে পার, হারীত।

-তা অনেক পুরুষের থাকে বইকি। হিরের আংটি, সিল্কের পাঞ্জাবি, সোনার বোতাম, আর হাতে একটা চকচকে নতুন ছাতা। হারীত ঘোঁৎ করে হেসে উঠল, কী রকম শুকনো নিরানন্দ হাসি। কারো কারো কয়েক মাস, কারো কারো আজীবন। ছাতাটা বাদ দিয়ে বর্ণনাটা মিলে গিয়েছিল প্রমথেশের সঙ্গে, কিন্তু প্রমথেশ সেটা বুঝলই না। মাথা নেড়ে নেড়ে তারিফ করে বলতে লাগল—ঠিক বলেছ ভাই, ঠিক!

ঠিক? যা বলেছ, হারীত! শ্বেতা হেসে উঠে একটা চাপড় বসিয়ে দিল হারীতের পিঠে-হারীত ভেবে পেল না, এত আনন্দ কীসের—একটা কথার মতো কথা বলেছ! ওঁর সেই বিয়ের আংটি আর বোম উনি কিছুতেই ছাড়বেন না তো। দ্যাখো তো—শ্বেতা স্বামীর দিকে ফিরল কী চমৎকার দেখাচ্ছে হারীতকে হাত-কাটা চেনটানা গেঞ্জি-শার্টে। ভাবিসনে শাশ্বতী, ঐ চেন ধরেই টেনে নিয়ে বেড়াতে পারবি। শ্বেতা গড়িয়ে পড়ল শাশ্বতীর কাঁধে।

মুখে একটা উঁচু দরের হাসির ভাব রেখে হারীত উঠে দাঁড়াল ভাঁজ-করা খবর-কাগজটা রাজদণ্ডের মতো হাতে ধরে—ঘুরে আসি একটু।

আরে, বসো, বসো-আরো অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে—বলল শ্বেতা।

পরে হবে। একটা-দুটোর আগে তো খাওয়া হবে না। কাজ সেরে আসি।

পুজোর মধ্যেও কাজ? প্রমথেশ চমৎকৃত।

ছুটিতে আপিশের, আমার ছুটি নেই।–দাঁতের ফাঁকে পাইপ চেপে ধরে লম্বা-লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল কর্মবীর। গোল-গোল চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে প্রমথেশ মন্তব্য করল— হারীত আমাদের তুখোড় ছেলে।

তুইও যেমন! শাশ্বতীর মাথায় একটা টোকা দিয়ে তো বলল—পুরুষমানুষের কত সময় কত খেয়ালই হয়, তা নিয়ে আবার ভাবিস! আজই চল, তোকে শাঁখা কিনে দেব কালিঘাটে।

স্বাতী দেখল, হারীতদা চলে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে ছোড়দির সমস্ত ভাবটাই বদলে গেল যেন। সহজ হল, মুখে পরিষ্কার ফুটে উঠল আরাম। শুধু আজই নয়, হঠাৎ স্বাতীর মনে হল, সবসময়ই এরকম হয় ছোড়দির। হারীতদা যতক্ষণ কাছে থাকেন, তার চলা, বলা, হাসি, সমস্তই যেন আধো-আধো বাধো-বাবধা। আর তাকে এ-বাড়িতে রেখে যেই হারীতদা কিছুক্ষণের জন্যও অন্য কোথাও গেলেন, অমনি সে অন্য মানুষ। এ-রকম মনে হওয়া অন্যায়, হয়তো এটা আমারই ভুল; কিন্তু যতই যে তাকাতে লাগল ছোড়দির দিকে, যতই শুনতে লাগল বড়দির সঙ্গে তার বকরবকর, স্বাতী ততই অবাক হল এ-কথা ভেবে যে এতদিনের মধ্যে আজই প্রথম তার এটা মনে হল। সত্যি, ছোড়দির হয়েছে কী? মোটাসোটা হয়েছে, শাড়ি-গয়না পরে দেখায়ও জমকালো; কিন্তু…কিন্তু মুখে লাবণ্য কই, চোখের তারা নাচে না কেন, তাজা একটা ফুল যেন রোদুর লেগে শুকিয়ে গেল। হয় নাকি এ-রকম? এ-রকমও হয় নাকি? ছোড়দির মুখের পাশেই বড়দির ছলছলে মুখের দিকে তাকিয়ে কী রকম একটা কষ্ট হল স্বাতীর মনের মধ্যে।

******

বাবা বাজারসুদ্ধ কিনে নিয়ে এলেন। কোমরে আঁচল জড়িয়ে বড়দি ঢুকল রান্নাঘরে। কতবার ডাকলেন রাজেনবাবু, কিন্তু শোনে কে!—ঈশ! কী চমৎকার তেলওলা আড়মাছটা, এ আমি নিজের হাতে না বেঁধে পারবই না। আর মাথাটা দিয়ে মুড়িঘণ্ট… ও মা, বাঁধাকপি! আশ্বিন মাসেই বাঁধাকপি! আর কাকড়া কী বড়ো বড়ো! সত্যি, কলকাতা শহর! এরকম হলে তবে না বেঁধে সুখ!

মেয়েটা যে কী! বিড়বিড় করলেন রাজেনবাবু। আহা—প্রমথেশ বলে উঠল—যে যেটা ভালবাসে, তাকে সেটা করতে দেওয়াই তো ভাল।

আসল কথা—স্বাতী হাসল—বড়দির রান্না ছাড়া রোচে না আর কি আপনার মুখে।

ঠিক বললে না। শালীদের রান্না আরো বেশি রুচবে, কিন্তু তারা তো আর… হা-হা হাসি দিয়ে কথা শেষ করল প্রমথেশ। স্বাতী আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। গনগন করে জুলছে দুটো উনুন, ছ্যাকছাক করছে কড়াই, বুড়বুড় করছে ডেকচি। কাছে এসেই গন্ধে হেঁচে ফেলল স্বাতী।

স্বাতী, কী রে?

কী আবার, এমনি!

খাবি কিছু? মাছ ভেজে দেব? না একটা আলুসেদ্ধ?

ও-মা, এইমাত্র তো অতগুলো মিষ্টি খেলাম। এক্ষুনি আবার খেতে পারে নাকি মানুষ?

আমার সব কটা আলুসেদ্ধর যম। যত রান্নাই হোক আলুসেদ্ধ চাই-ই। বলতে-বলতে ডালের টগবগে ডেকচিটা হাতা দিয়ে ঘুটে একবারেই তিনটে আলু তুলে আনল শ্বেতা। এক আঙুলে একটু ছুঁয়ে-ছুঁয়ে পরীক্ষা করল, তারপর হাতটা নাচিয়ে-নাচিয়ে দুটোকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিল জ্বলন্ত জলে। আর অন্যটিকে নির্ভুলভাবে ফেলল একটা বাটির গর্তে। বাঁ হাতে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়ে আঙুলে সইয়ে-সইয়ে খোসা ছাড়িয়ে ফেলল নিমেষে। তারপর সুগোল, হলদে, ধোঁয়া-ওঠা, সুগন্ধি একটি আলু চায়ের প্লেটে নুন-গোলমরিচ সুদ্ধ সাজিয়ে সামনে রেখে বলল–এই নে। সমস্ত কাণ্ডটি শেষ হতে বোধহয় মিনিটখানেকের বেশি লাগল না। দেখেদেখে স্বাতীর মনে পড়ে গেল জাপানিদের টেনিস খেলার কথা। ছেলেবেলায় দেখেছিল একবার অরুণদার সঙ্গে, সাউথ ক্লাবে।

বোস না, বসে খাশ্বেতা ঠেলে দিল ছোটো একটা জল-চৌকি। কই, রামের মা, বাঁধাকপি কোটা হল তোমার? স্বাতী বসে-বসে কামড়ে কামড়ে আলুটা খেতে লাগল, আর মনে হল যে আলুসেদ্ধর মতো সুখাদ্য পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু আলুটা যতই ছোটো হয়ে এল, ততই খাওয়ার সুখ কমিয়ে দিতে লাগল রান্নাঘরের গরম। কাকড়ায় মশলা মাখাতে-মাখাতে শ্বেতা একবার তাকিয়ে বলল—যা এবার এখান থেকে। পালা! আলুটা শেষ করে স্বাতী উঠল। চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থেকে বলল—বড়দি, কী করে পায়রা উনুনের ধারে এতক্ষণ বসে থাকতে? আঁচলে একবার মুখ মুছে শ্বেতা একটু হাসল বোনের দিকে তাকিয়ে তুইও পারবি। পারবে? সেও পারবে? সকালের বাকি সময়টুকু কেমন ঘুরে-ঘুরে উন্মনা হয়ে কাটাল স্বাতী। দুপুরে খাওয়া হতে-হতে দুটো বাজল, আর তারপরে স্থাশ করে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নামল একেবারে। দিন কি এতই ছোটো হয়ে গেল হঠাৎ? চা খেয়েই হারীত বলল—আমরা চলি এবার।

ও মা, এখনই? সঙ্গে-সঙ্গে শ্বেতার প্রতিবাদ। রাত্তিরে খেয়ে-দেয়ে…

একবেলাতেই দু-বেলার মতো হয়ে গেছে। একটু বেশিও। শাশ্বতী, তৈরি হয়ে নাও।

এত তাড়া কীসের?

আমার এক বন্ধু আসবেন সাড়ে সাতটায়—হারীত তার হাত-ঘড়ির দিকে তাকাল।

বন্ধু-বান্ধব তো রোজই আছে তোমার–শ্বেতা নরম সুরে বলল—একদিন না হয়…

তা হয় না। অ্যাপয়ন্টমেন্ট করেছি।

তাহলে তো যেতেই হয়, সত্যি–প্রমথেশ মাথা নাড়ল।

তা, শাশ্বতী থাক না—শেষ চেষ্টা শ্বেতার। বেশ, বেশ!—সঙ্গে-সঙ্গে প্রমথেশ উৎসাহিত। শাশ্বতী থাক, খেয়ে-দেয়ে যাবে রাত্তিরে, কেমন? বিজু পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবেখন। আর বিজু না যায়, আমি তো আছি হে, ভাবনা কী?

বন্ধুটি সস্ত্রীক আসবেন, শাশ্বতীর তাই যাওয়া দরকার—বলতে বলতে হারীতের ঠোঁটের কোণ বেঁকল একটুতা, ও যেতে না চায়, থাক। রাত্তিরটাই থাক না এখানে। একটু গা মোড়ামুড়ি দিয়ে শাশ্বতী ক্ষীণস্বরে বলল—না বড়দি, আমি চলেই যাই। একবার শাশ্বতীর, একবার হারীতের মুখ-চোখের দিকে পলক ফেলে শ্বেতা বাংল–আচ্ছা, আচ্ছা, তা-ই ভাল। সত্যি তো, বাড়িতে লোকজন আসবে, গৃহকত্রী না-থাকলে চলে! আবার আসিস। রোজই আসিস, কেমন? আয় তোর চুলটা বেঁধে দিই—বলে হাত রাখল শাশ্বতীর মাথায়। চুল বেঁধে শাড়ি পরতে-পরতে দেরি হয়ে গেল একটু। সাড়ে সাতটার আগে পৌঁছবার জন্য ট্যাক্সি নিতে হল হারীতকে, আর খামকা এই খরচটা হল বলে মন-মেজাজ আরো বিগড়ে গেল তার। শাশ্বতী ধার ঘেঁষে বসেছিল মুখ ফিরিয়ে। খানিকটা চুপচাপ চলবার পর হঠাৎ হারীত বলল—কী, কাদছ নাকি? শাশ্বতী কথাও বলল না, মুখও ফেরাল না।

এতই যদি তোমার বাপের বাড়ির টান, তাহলে বিয়ে না করাই তোমার উচিত ছিল। এবারেও কোনো জবাব পেল না হারীত। Fool! এই জোরালো ইংরেজি মনোসিলেবল একবার উচ্চারণ করেই হারীত যেন ট্যাক্সি-ভাড়াটা উশুল করে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *