অভিমন্যু-পত্নী উত্তরা
উত্তরার সঙ্গে মহাভারত পাঠকের প্রথম পরিচয় পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজ্যে। ঊর্বশীর অভিশাপে অভিশপ্ত অর্জুন নপুংসক রূপে ‘বৃহন্নলারূপে’ বিরাট রাজকন্যা উত্তরার নৃত্য-গীত শিক্ষকরূপে নিযুক্ত হলেন। ইন্দ্রের আদেশে গন্ধর্ব চিত্রসেন অর্জুনকে নৃত্য-গীত-বাদ্যাদি শিক্ষা দিয়েছিলেন। অজ্ঞাতবাস পর্বে তা অর্জুনের কাজে লাগল।
বিরাটরাজার সেনাপতি, রাজমহিষীর ভ্রাতা কীচক দ্রৌপদীর প্রতি আসক্তি ও দুর্ব্যবহারের জন্য পাচক ছদ্মবেশধারী ভীমসেন কর্তৃক নিহত হল। কৌরবসভায় এই মৃত্যু সংবাদ পৌঁছোল। রাজা সুশর্মা ও বীর কর্ণ কীচকের মৃত্যুতে উৎসাহী হয়ে বিরাটরাজার গোধন হরণের সিদ্ধান্ত করলেন। সুশৰ্মা বিরাটরাজ্য আক্রমণ করলেন। বিরাটরাজা কঙ্করূপী যুধিষ্ঠির, বল্লবরূপী ভীমসেন, গ্রন্থিক নামধারী নকুল ও তন্ত্রিপাল নামধারী সহদেবকে নিয়ে যুদ্ধে চললেন। অন্যদিকে ভীষ্মের নেতৃত্বে কৌরবশ্রেষ্ঠ বীরগণ বিরাটরাজ্যের উত্তরদিক আক্রমণ করলেন। রাজ্যে তখন কেবলমাত্র রাজপুত্র উত্তর ছিলেন। প্রতিহারী তাঁকে সংবাদ দিলে রাজপুত্র উত্তর জানালেন উপযুক্ত সারথি পেলে তিনি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন। বৃহন্নলাকে সারথ্য গ্রহণের জন্য সৈরিন্ধ্রীর পরামর্শমতো উত্তরা অনুরোধ করলেন। নানান কৌতুক করে বৃহন্নলাবেশী অর্জুন সম্মত হলেন, যুদ্ধযাত্রাকালে উত্তরা বৃহন্নলাকে অনুরোধ জানালেন কৌরব পক্ষকে পরাজিত করে তাঁদের পোশাক তাঁর পুতুল খেলার জন্য নিয়ে আসতে হবে।
যুদ্ধযাত্রার পথেই রাজপুত্র উত্তর বৃহন্নলার আসল পরিচয় জানলেন। তখন তিনিই সারথ্য গ্রহণ করলেন। আর অর্জুন সমগ্র কৌরবপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ভয়ংকর যুদ্ধে অর্জুন সমগ্র কৌরবপক্ষকে পরাজিত করে গোধন উদ্ধার করলেন এবং সম্মোহন বাণে কৌরব বীরদের অচেতন করে ফেললেন। রাজপুত্র উত্তরকে তিনি নির্দেশ দিলেন ভীষ্ম ব্যতীত অন্য সকল বীরের উষ্ণীষ খুলে নিয়ে আসতে। রাজকুমারী উত্তরার অনুরোধ তাঁর স্মরণে ছিল।
এই ঘটনার পর তৃতীয় দিবসে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাস শেষ করে আত্মপ্রকাশ করলেন। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত বিরাটরাজ অর্জুনের সঙ্গে কন্যা উত্তরার বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। ধর্মজ্ঞ অর্জুন প্রস্তাব পরিবর্তিত করে পুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অনুমোদন করলেন। অভিমন্যু উত্তরার বিবাহ নির্বিঘ্নে ঘটে গেল।
অনাগতানভিপ্রেক্ষ মৎস্যে ধর্মবৃতাং বরঃ।
পূজয়ামাস বিখিরৎ সভৃত্য বলবাহনান্।
প্রীতোহভবদদুহিতরং দত্বা তামভিমন্যেব ॥ বিরাট : ৬৭ : ১৯ ॥
—“ধার্মিকশ্রেষ্ঠ বিরাটরাজা তাঁদের আগত দেখে যথাবিধানে ভৃত্য বল ও বাহনের সঙ্গে তাঁদের পূজা করলেন। তারপরে তিনি অভিমন্যুর উদ্দেশে আপন কন্যা উত্তরার বাগ্দান করে আনন্দিত হলেন।”
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে কৌরব সেনাপতি দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে ধরবার জন্য চক্রব্যূহ রচনা করলেন। সমগ্র পাণ্ডবপক্ষে একমাত্র অভিমন্যু ব্যতীত কোনও রথীই চক্রব্যূহ ভেদ করার রহস্য জানতেন না। কিন্তু চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানতেন কিন্তু এর থেকে নিষ্ক্রমণের পথ অভিমন্যুর জানা ছিল না। অনেক আলোচনার পর যুধিষ্ঠির স্থির করলেন যে, অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করে দিলে তিনি অন্য পাণ্ডববীরদের নিয়ে অভিমন্যুর পিছনে পিছনে চক্রব্যূহ প্রবেশ করবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম। অভিমন্যু অনায়াসে চক্রব্যূহ ভেদ করলেন, কিন্তু মহাদেবের বরে কৌরব সেনাপতি জয়দ্রথ অন্য সকল পাণ্ডবকে আটকে দিলেন। সমস্ত দিন প্রচণ্ড যুদ্ধ করে একাকী অভিমন্যু সায়ংকালে সপ্তরথী বেষ্টিত অবস্থায় নিহত হলেন। অভিমন্যু-পত্নী উত্তরা তখন অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর গর্ভে অভিমন্যুর ছয়মাসের সন্তান।
কৌরবপক্ষ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পরাজিত হল। মুমূর্ষ রাজা দুর্যোধনের কাছে অশ্বত্থামা প্রতিজ্ঞা করে গেলেন যে, সেই রাত্রেই তিনি পঞ্চপাণ্ডবকে বধ করবেন। ভ্রমক্রমে শিবিরে সুপ্ত দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্নকে অশ্বত্থামা বধ করলেন। পরদিন প্রভাতে সংবাদ পেয়ে দ্রৌপদী প্রায়োপোবেশনে বসলেন, তাঁর দাবি “হয় অশ্বত্থামার প্রাণ, না হয় তাঁর মাথার জন্মগত মণি।” সহদেবকে দ্রৌপদীর তত্ত্বাবধানে রেখে বাকি চারপাণ্ডব ও কৃষ্ণ চললেন অশ্বত্থামাকে ধরতে। ভীত অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের আসতে দেখেই ‘নারায়ণাস্ত্র’ প্রয়োগ করলেন। অর্জুন তার প্রতিরোধে নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করেও নারদ ইত্যাদি ঋষির কথায় তা সংবরণ করলেন। কিন্তু সংবরণের সংযম অশ্বত্থামার ছিল না। তাই তাঁর অস্ত্র গিয়ে আঘাত করল উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকে। কৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে অভিসম্পাত করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন উত্তরার গর্ভস্থ শিশু মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হলে তিনি তাকে পুনর্জীবিত করবেন।
যুদ্ধের পর গান্ধারী কৃষ্ণর সঙ্গে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে মৃত পুত্র ও অন্য আত্মীয়দের দেখতে গিয়েছিলেন। অভিমন্যুর মৃতদেহ দেখে তিনি কৃষ্ণকে বললেন, “কেশব, অন্যান্য বীরগণ বল ও বীরত্ব বিষয়ে পিতা অর্জুন বা তোমা অপেক্ষাও যাঁকে দেড়গুণ অধিক বলতেন, যিনি দর্পিত সিংহের ন্যায় দুর্ধর্ষ ছিলেন এবং যিনি আমার পুত্রের দুর্ভেদ্য সৈন্য ভেদ করে অন্যান্য বীরের মৃত্যুজনক হয়েছিলেন, পরে সেই অভিমন্যুই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। অমিততেজা, অর্জুননন্দন অভিমন্যু নিহত হয়ে থাকলেও আজ পর্যন্ত তাঁর প্রভা বিনষ্ট হয়নি। বিরাটরাজার তনয়া, অর্জুনের পুত্রবধূ, অনিন্দ্যসুন্দরী ও বালিকা উত্তরা বীরপতিকে দেখে আকুল হয়ে শোক করছেন। ভার্যা উত্তরা সেই বীরপতি অভিমন্যুকে কাছে পেয়ে হস্তদ্বারা তাঁর অঙ্গমার্জনা করছেন।
অনুরাগিণী, স্পৃহনীয় রূপশালিনী ও মনস্বিনী উত্তরা প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় গোল কম্বুগ্রীবাযুক্ত অভিমন্যুর মুখমণ্ডলের ঘ্রাণ নিয়ে লজ্জিত হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করছেন এবং ইনি পূর্বেও মদ্যপানে মত্ত হয়ে সম্ভবত এইরূপ আলিঙ্গন করতেন। উত্তরা অভিমন্যুর রুধিরলিপ্ত ও স্বর্ণখচিত বর্মটি ফেলে দিতে দিতে তাঁর দেহের দিকে দৃষ্টিপাত করছেন। কৃষ্ণ, বালিকা উত্তরা অভিমন্যুকে দেখতে থেকে, তোমাকে লক্ষ্য করে বলছেন, “পুণ্ডরীকাক্ষ! আপনার নয়নের তুল্য যাঁর নয়ন ছিল, এই তিনি নিপাতিত হয়েছেন। যিনি বল, বীর্য, তেজ এবং রূপেও আপনার অত্যন্ত সদৃশ ছিলেন, এই তিনি নিপাতিত হয়ে ভূতলে শুয়ে আছেন।”
উত্তরা অভিমন্যুর প্রতি বলছেন, “নাথ! আপনার অঙ্গসকল অত্যন্ত কোমল ছিল, সুতরাং আপনি রঙ্কুমৃগের চর্মে শয়ন করতেন। অতএব জিজ্ঞাসা করি— আপনার সেই শরীরটা আজ ভূতলে লুন্ঠিত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে না কি? হায়! হস্তীহস্তের বর্মময় ধর্মধারী এবং অধিক সময় ধনুর গুণ সঞ্চালন করে কঠিন চর্মসমন্বিত স্বর্ণকেয়ূরযুক্ত বিশাল বাহু দু’খানি ভূতলে প্রসারিত করে আপনি শয়ন করে আছেন। আপনি বহুপ্রকার যুদ্ধ-ব্যায়াম করে পরিশ্রমবশতই যেন সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। সেইজন্যই আমি বিলাপ করতে থাকলেও আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। নাথ! আমি আপনার কাছে কোনও অপরাধ করেছি বলে আমার স্মরণ হচ্ছে না, অতএব আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না কেন? আপনি পূর্বে আমার সঙ্গে দেখা হলে দূর থেকেই অভিভাষণ করতেন। মাননীয় প্রাণনাথ! আপনি আর্যা সুভদ্রাদেবীকে, এই দেবতুল্য পিতৃগণকে এবং শোকার্তা আমাকে পরিত্যাগ করে কোথায় যাবেন।”
তারপর উত্তরা হস্ত দ্বারা অভিমনুর রক্তলিপ্ত কেশগুলি ধারণ করে তাঁর মুখখানি কোলে তুলে নিয়ে জীবিতের মতোই তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, “নাথ! আপনি কৃষ্ণের ভাগিনেয় এবং অর্জুনের পুত্র ছিলেন; তাতে এই মহারথেরা আপনাকে কী করে বধ করলেন? যাঁরা আপনাকে বধ করেছেন, তাঁরা নিষ্ঠুর কার্য করেছেন। সুতরাং সেই দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ ও জয়দ্রথকে ধিক। আপনি বালক এবং তখন একাকী ছিলেন, সেই অবস্থায় দ্রোণ প্রভৃতি রথীশ্রেষ্ঠরা সকলে আপনাকে পরিবেষ্টন করে, আমার দুঃখের জন্য যখন প্রহার করছিলেন, তখন তাঁদের মনের অবস্থা কেমন ছিল? বহু মহারথ আপনাকে যুদ্ধে নিহত করেছেন দেখে পাণ্ডুনন্দন, পুরুষশ্রেষ্ঠ ও বীর, আপনার সেই পিতা কী করে জীবিত আছেন? নাথ! আপনাকে হারিয়ে বিশাল রাজ্যলাভ এবং সমস্ত শত্ৰু পরাজয়ও পাণ্ডবগণের প্রীতি সম্পাদন করবে না। আপনি ধর্মাচরণ ও ইন্দ্রিয়দমনের গুণে স্বর্গলাভ করেছেন, আমি সত্বরই আপনার অনুগমন করব। আপনি কিন্তু সেখানেও আমাকে পালন করবেন। সময় উপস্থিত না হলে, কেউই মরতে পারে না, যেহেতু আপনাকে মৃত দেখেও আমি জীবিত আছি। আপনি এখন পিতৃলোকে গমন করেছেন। অল্প ও কোমলবাক্যে আমারই মতো অন্য কোনও রমণীর সঙ্গে আলাপ করবেন। নিশ্চয়ই আপনি মনোহর রূপ ও মৃদু হাস্যযুক্ত বাক্য দ্বারা স্বর্গে অপ্সরাকেও আলোড়িত করবেন। নাথ! আপনি পুণ্যার্জিত স্বর্গলোকে গমন করে অপ্সরাদের মধ্যে থেকে আমাকে ভুলে যাবেন না তো। আপনি আমার সঙ্গে এই জগতে এতটুকু মাত্র সময় সহবাস করেছেন। মোটে ছ’মাস; সপ্তম মাসে আপনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।
উত্তরা এইরূপ কথাগুলি বললে বিরাটরাজার কুলবধূরা এসে ব্যর্থসংকল্পা উত্তরাকে আকর্ষণ করে নিয়ে চলে গেলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হবার পর যুধিষ্ঠির রাজ্য গ্রহণে সম্মতি দেননি। বিশেষত কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত জানার পর শোকে, দুঃখে তাঁর হৃদয় জর্জরিত হচ্ছিল। সেই অবস্থায় কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে গেলেন শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের কাছে। ছাপ্পান্ন দিন সেই একক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভীষ্ম বক্তা, যুধিষ্ঠির শ্রোতা। এরপরে ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম মৃত্যুবরণ করলেন। শ্রাদ্ধশান্তি সমাপ্ত করে যুধিষ্ঠির হস্তিনায় ফিরলেন, সাম্রাজ্য গ্রহণ করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে বেরোলেন অর্জুন। দিকে দিকে রাজাকে নিমন্ত্রণ করা হল। অন্য পাণ্ডবদের নিয়ে যুধিষ্ঠির স্বয়ং মহাদেবকে প্রসন্ন করে মরুত্ত রাজার ধনসংগ্রহে যাত্রা করলেন। এই অবস্থায় কৃষ্ণ সপার্ষদ নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে হস্তিনায় উপস্থিত হলেন। উত্তরা অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্রে দ্বিখণ্ডিত এবং মৃত একটি শব-পুত্র প্রসব করলেন। অন্তঃপুরে হাহাকার পড়ে গেল। কুন্তী, দ্রৌপদী প্রভৃতি কৃষ্ণকে দেখেই তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে উত্তরার মৃত পুত্র প্রসবের সংবাদ জানালেন। কৃষ্ণ সূতিকাগৃহে প্রবেশ করলেন।
তখন দ্রৌপদী সত্বর গিয়ে উত্তরাকে বললেন, “ভদ্রে, তোমার মাতুল-শ্বশুর প্রাচীন নারায়ণঋষি, অচিন্তনীয়প্রভাব ও অপরাজিত মধুসূদন তোমার কাছে আসছেন। তখন উত্তরাদেবীও দেবতার ন্যায় কৃষ্ণকে দেখতে পেয়ে বাষ্পরুদ্ধ আর্তনাদ ও অশ্রুজল নিবারণ করে শরীর বস্ত্রাবৃত করলেন এবং শোচনীয়া উত্তরা কৃষ্ণকে আসতে দেখে সন্তপ্ত হৃদয়ে করুণ বিলাপ করতে লাগলেন, “পুণ্ডরীকাক্ষ! দেখুন অভিমন্যু ও আমি—আমরা দু’জনেই পুত্রবিহীন হয়েছি। জনার্দন! বিধাতা আমাদের দুজনকেই সমানভাবে নিহত করেছেন। মধুনাশক বীর বৃষ্টিনন্দন! আমি মস্তক অবনত করে আপনাকে প্রসন্ন করছি। আপনি অশ্বত্থামার অস্ত্রে দগ্ধ আমার এই পুত্রটিকে সঞ্জীবিত করুন। পুণ্ডরীকাক্ষ! ধর্মরাজ-ভীমসেন বা আপনি যদি বলতেন, ‘এই ঈষিকা অজ্ঞাতভাবে জননীকে বধ করুক।’ প্রভু! তা হলে আমিই বধ হতাম; কিন্তু এই বালক বিনষ্ট হত না। দুর্বদ্ধি অশ্বত্থামা ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা গর্ভস্থিত এই বালকের নৃশংস হত্যা করে কী ফল পেয়েছে? শত্রুনাশক! গোবিন্দ! আমি মস্তক দ্বারা আপনাকে প্রসন্ন করি যে, এই বালক যদি না বাঁচে, তবে আমি প্রাণত্যাগ করব। কারণ, সাধু কেশব! এই বালকের উপর আমার যে বহু অভিলাষ ছিল, সে সমস্তই অশ্বত্থামা নষ্ট করে দিয়েছে, সুতরাং আমি আর বেঁচে থাকব কেন? কৃষ্ণ! জনার্দন! আমার এই অভিলাষ ছিল যে, আমি পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে আপনাকে প্রণাম করব। কিন্তু দুর্দৈব আমার সেই অভিলাষকে নিষ্ফল করে দিয়েছে। চঞ্চলনয়ন অভিমন্যুর এই পুত্র মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় আমার মনের সকল অভিলাষ নিস্ফল হয়েছে। অভিমন্যু আপনার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। আপনি এখন তাঁর এই পুত্রকে ব্রহ্মাস্ত্রে নিহত অবস্থায় দেখুন। যিনি পাণ্ডবদের আশ্রয় ছেড়ে উত্তম সম্পদ পরিত্যাগ করে যমালয়ে গিয়েছেন, সেই দ্রোণের ন্যায় অশ্বত্থামাও কৃতঘ্ন ও নৃশংস। বীর কেশব! এই প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম যে, অভিমন্যু যুদ্ধে নিহত হলে, আমি অচিরকালের মধ্যে তাঁর কাছে যাব। আমি নৃশংসা ও জীবনপ্রিয় কিনা, তাই তা করিনি; কিন্তু এখন আমি অভিমন্যুর কাছে গেলে, তিনি আমাকে কী বলবেন।”
শোচনীয়া, দীনা ও পুত্রাভিলাষিণী সেই উত্তরা এই করুণ বিলাপ করে উন্মত্তার মতো ভূতলে লুণ্ঠিতা হলেন। হতপুত্রা ও পরিচ্ছদশূন্যা উত্তরাকে ভূতলে নিপাতিতা দেখে কুন্তী ও সমস্ত ভরত স্ত্রীগণ আর্তনাদ করতে লাগলেন। তাঁদের মিলিত আর্তনাদে সেই পাণ্ডবভবন মুহূর্তকাল যেন দৃষ্টির অযোগ্য হয়ে পড়ল। মূৰ্ছাভঙ্গে উত্তরা চৈতন্যলাভ করে সেই পুত্রটিকে কোলে তুলে বললেন, “পুত্র! তুমি ধর্মজ্ঞের পুত্র হয়েও ধর্ম বুঝছ না কেন? যে তুমি বৃষ্ণিবংশ শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণকে প্রণাম করছ না কেন? বৎস! তুমি পরলোকে গিয়ে পিতা অভিমন্যুকে বলবে, ‘বীর! কাল উপস্থিত না হলে প্রাণীগণের মৃত্যু সর্বপ্রকারেই দুষ্কর। বোলো যে মাতা উত্তরা, তুমি পুত্র এবং পতি অভিমন্যু—এই উভয়বিহীনা হওয়ায় মৃত্যু উচিত হলেও মঙ্গলশূন্যা অকিঞ্চনের মতো জীবিত আছেন।’ অথবা মহাবাহু! আমি ধর্মরাজের অনুমতি নিয়ে ভয়ংকর বিষভক্ষণ করব কিংবা অগ্নিতে প্রবেশ করব। অথবা বৎস! আমার মরণ দুষ্কর। যেহেতু আমি পতিপুত্রহীনা হয়েছি; তবুও আমার হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে না। পুত্র! ওঠো, তোমার এই প্রপিতামহী কুন্তীদেবী দুঃখিতা, শোকার্তা, আকুলা, দীনা ও শোকসাগরে নিমগ্না হয়েছেন। দেখো। আর্যা দ্রৌপদী, শোচনীয়া সুভদ্রা ও বাণবিদ্ধা হরিণীর ন্যায় অতি দুঃখার্তা আমাকেও দর্শন করো। বৎস! তুমি ওঠো, পদ্মপত্রের ন্যায় নয়নযুক্ত এবং পূর্বের ন্যায় চঞ্চলনয়ন এই ধীমান জগদীশ্বর কৃষ্ণের মুখমণ্ডল দর্শন করো।”
উত্তরা এইভাবে বিলাপ করতে করতে পুনরায় ভূতলে নিপতিত হলেন। তখন সেখানকার সকল স্ত্রীলোক তাঁকে ভূতল থেকে তুলে ধরলেন। সেই অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করে উত্তরা কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন।
তখন কৃষ্ণ আসনে উপবিষ্ট হয়ে, আচমন করে শুদ্ধ হয়ে সমস্ত জগৎকে শুনিয়ে বললেন, “উত্তরা, আমি মিথ্যা বলছি না, আমার বাক্য সত্য হবে। উপস্থিত সকল প্রাণীর সম্মুখেই আমি এই মৃত বালককে সঞ্জীবিত করব। আমি পূর্বে কখনও যথেষ্টালাপের সময়ও মিথ্যা বলিনি, যুদ্ধ থেকে পলায়ন করিনি— সেই ধর্মের বলে এই বালক জীবিত হয়ে উঠুক। যেহেতু ধর্ম আমার প্রিয় এবং ব্রাহ্মণ বিশেষ প্রিয়, সেইহেতু অভিমন্যুর মৃতজাত পুত্র জীবিত হোক। আমি যখন কখনও অর্জুনের সঙ্গে বিরোধের বিষয় জানি না, সেই সত্যের বলে এই মৃত শিশু জীবিত হোক। যেহেতু সত্য ও ধর্ম সর্বদা আমাতে প্রতিষ্ঠিত আছেন, সেইহেতু অভিমন্যুর মৃতপুত্র জীবিত হোক। ধর্মানুসারে আমি কংস ও কেশীকে বধ করেছি, সেই সত্য ধর্মের বলে এই বালক পুনরায় জীবিত হোক।” কৃষ্ণ এ-কথা বললে, সেই বালক চৈতন্যসম্পন্ন হয়ে ধীরে ধীরে অঙ্গসঞ্চালন করতে লাগল। কুরুবংশ পরিক্ষীণ হলে শিশুর জন্ম হল বলে কৃষ্ণ এর নাম রাখলেন পরিক্ষিৎ। পাণ্ডবভবনে আনন্দের লহরী বইতে লাগল। উত্তরা পুত্রকে কোলে তুলে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন।
যদুবংশ ধ্বংস হলে কৃষ্ণ দেহত্যাগ করলেন। কৃষ্ণের দেহত্যাগের সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির সিংহাসন ত্যাগ করে মহাপ্রস্থানের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। যাত্রার পূর্বে যুধিষ্ঠির সব আত্মীয়স্বজন নির্ভরশীল পরিজনদের পরবর্তী জীবনযাপনের ব্যবস্থা করলেন। উত্তরা হস্তিনাপুরেই পুত্ৰ পরিক্ষিতের কাছে থেকে গেলেন। উত্তরার কাহিনি এইখানেই ব্যাসদেব শেষ করেছেন।
উত্তরা— সাধারণ আলোচনা
অংশাবতরণ পর্বে ব্যাসদেব জানিয়েছেন চন্দ্রপুত্ৰ বৰ্চা সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যুরূপে জন্মেছিলেন। মাত্র ষোলা বছরের জন্য চন্দ্রদেব বর্চাকে পৃথিবীতে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। উত্তরা অভিমন্যুর স্ত্রী, বিরাটরাজার কন্যা। কাহিনিতে তাঁর যে চিত্র পাওয়া যায়, তা একটি অত্যন্ত অল্পবয়সি নারীর চিত্র। তার তখনও পুতুল খেলার বয়স যায়নি। তাঁর যে ইচ্ছা ছিল, তাও নিতান্ত অল্পবয়সি নারীর। কৌরববাহিনী গোধন হরণ করতে আসলে তিনি বৃহন্নলারূপী অর্জুনের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, কৌরবদের পরাজিত করে তাঁদের পোশাক তাঁর পুতুল খেলার জন্য এনে দিতে হবে। অর্জুনের বলেই তাঁর প্রার্থনা পূরণ হয়েছিল। এরপরে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হলে অভিমন্যুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। স্বামীকে তিনি ভালবেসেছিলেন এবং স্বামীর ভালবাসাও পেয়েছিলেন। অশ্বত্থামার অস্ত্রে নিহত পুত্রের জীবন তিনি ফিরে পেয়েছিলেন কৃষ্ণের ঐশী শক্তির জোরে। তাঁর পরবর্তী জীবন অন্য কুরুনারীদের মতোই বৈধব্যের জীবন। সে-জীবনে কোনও বৈচিত্র্য ছিল না।