সূর্যকন্যা তপতী
জতুগৃহ দাহের পর ভীমসেন অমানুষিক বলের পরিচয় দিয়ে চার ভ্রাতা ও মাতা কুন্তীকে একচক্রাপুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। এইখানে এক ব্রাহ্মণের গৃহে তাঁরা কিছুকাল বাস করেছিলেন। ব্রাহ্মণের গৃহে বিপদ দেখে কুন্তীর আদেশে ভীমসেন পুনরায় অসাধারণ শক্তির পরিচয় দিয়ে বকরাক্ষসকে বধ করলেন। ব্রাহ্মণের বিপন্মুক্তি ঘটল। কিছুকাল পরে ব্যাসদেব এসে পাণ্ডবদের পাঞ্চাল নগরে যাত্রা করবার আদেশ দিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ ও শত্রুদমনকারী পাণ্ডবগণ হৃষ্টচিত্তে ব্রাহ্মণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাতা কুন্তীকে সম্মুখে রেখে উত্তরমুখে যাত্রা করলেন এবং হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘অলকানন্দা’ নদীতীরে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবরা যখন সেখানে উপস্থিত হলেন, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। বিশ্রামের প্রয়োজনে পাণ্ডবগণ সমুদ্রের সেই অংশে অবগাহনের আয়োজন করলে, গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ এসে তাঁদের নিষেধ করলেন। সেই নিষেধ অগ্রাহ্য করায় অর্জুন এবং অঙ্গারপর্ণের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ হল। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অঙ্গারপর্ণ নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘চিত্ররথ’ নাম প্রদান করলেন। তিনি অর্জুনের চিরসখিত্ব প্রার্থনা করে তাকে ‘চাক্ষুষী’ নামক মোহিনী মায়াবিদ্যা দান করলেন। পরবর্তীকালে এই চিত্ররথ অর্জুনের ঘনিষ্ঠ সখা রূপে বাস করতে থাকেন, ইনি পাণ্ডবদের বৈভব দেখাবার ছল করে পত্নীদের নিয়ে যাত্রাকালে কর্ণসহ দুর্যোধনকে পরাজিত করেন ও দুর্যোধনকে বন্দি করে নিয়ে যান। অর্জুনকে তিনি দেবলোকে নৃত্যশিক্ষা দান করেন, যে বিদ্যা বৃহন্নলারূপে অর্জুনের অত্যন্ত প্রয়োজনে লেগেছিল। অলকানন্দা তীরে পরাজিত অঙ্গারপর্ণ অর্জুনকে ‘তাপত্য’ এই বিশেষণে সম্বোধিত করেন এবং অর্জুন এই বিশেষণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিম্নোক্ত কাহিনির বর্ণনা দেন।
যিনি এই আকাশে থেকে অগ্নিময় তেজ দ্বারা সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করেন, তাঁরই কন্যার নাম ছিল ‘তপতী’। এই সূর্যদেবের কন্যা সাবিত্রীর কনিষ্ঠা এবং তিনি ত্রিভুবন বিখ্যাত তপস্বিনী ছিলেন। দেবী, অসুরী, যক্ষী, রাক্ষসী, অপ্সরা কিংবা গন্ধর্বী—কোনও রমণীই সৌন্দর্যে তপতীর তুল্যা ছিলেন না। তাঁর সকল অঙ্গই সুগঠিত ও অনিন্দিত এবং নয়নযুগল দীর্ঘ এবং কৃষ্ণবর্ণ ছিল। তিনি সদাচারসম্পন্না, সচ্চরিত্রা, সুবেশা ও হাবভাবযুক্তা ছিলেন। রূপ, গুণ, স্বভাব ও শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা ত্রিভুবনের মধ্যে কোনও পুরুষকেই সূর্যদেব তপতীর অনুরূপ বর মনে করতে পারছিলেন না। সেই সময়ে ঋক্ষবংশীয় অজমীরের পুত্র এবং কুরুবংশের মধ্যে প্রধান বলবান রাজা সম্বরণ সূর্যের আরাধনায় প্রবৃত্ত হলেন। তিনি প্রত্যহ পবিত্র হয়ে, অহংকার ত্যাগ করে এবং শুশ্রূষায় প্রবৃত্ত থেকে অর্ঘ্য, মালা ও গন্ধ প্রভৃতি উপহার, ব্রত, উপবাস ও নানাপ্রকার তপস্যা দ্বারা ভক্তি সহকার উদয়কালে সূর্যের পূজা করতে লাগলেন।
তপতীর যৌবন উপস্থিত হওয়ায় তাঁকে দান করা আবশ্যক হয়ে পড়ল। কিন্তু তাঁর বরের বিষয়ে চিন্তা করে সূর্যদেব শান্তি পাচ্ছিলেন না। তখন কৃতজ্ঞ, ধার্মিক এবং জগতে অতুলনীয় রূপবান সম্বরণকেই তপতীর অনুরূপ বর বলে সূর্যদেব স্থির করলেন এবং তাঁকে কন্যাটি দান করবার ইচ্ছা করলেন। কারণ, সূর্য যেমন আপন তেজে আকাশে আলোক বিস্তার করেন, সম্বরণ রাজাও তেমনই আপন তেজে পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ব্ৰহ্মজ্ঞেরা যেমন উদয়কালীন সূর্যের অর্চনা করেন, তেমনই ক্ষত্রিয় প্রভৃতি প্রজারা সম্বরণরাজার অর্চনা করত। মনোহর মূর্তি সম্বরণ রাজা কমনীয়তাগুণে বন্ধুবর্গের পক্ষে সূর্যকেও অতিক্রম করেছিলেন। সম্বরণ রাজার এই সকল গুণ ও আচার লক্ষণ ছিল বলে স্বয়ং সূর্যদেবই তাঁর হাতে তপতীকে দান করার ইচ্ছা করেছিলেন।
তারপর মনোহর মূর্তি ও অসাধারণ বিক্রমশালী সম্বরণ রাজা কোনও সময়ে পর্বতের নিকটবর্তী কোনও বনে বিচরণ করছিলেন। তিনি মৃগয়া করছিলেন, এমন সময়ে তাঁর নিরুপম অশ্বটি ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে সেই পর্বতেই প্রাণত্যাগ করল। তখন রাজা পদব্রজেই সেই পর্বতে বিচরণ করতে থেকে জগতে অতুলনীয়া দীর্ঘনয়না একটি কন্যাকে দেখতে পেলেন। শত্রুসৈন্য বিজয়ী একাকী সম্বরণ রাজা সেই কন্যাটিকে দেখে নির্নিমেষ নয়নে অবস্থান করতে থাকলেন এবং তাঁর রূপ দেখে, তাঁকে সাক্ষাৎ লক্ষ্মীদেবী বলে এবং সূর্যমণ্ডল থেকে বিচ্যুতা স্ত্রীমূর্তিধারিণী সূর্যপ্রভার ন্যায় মনে করতে লাগলেন। আবার তাঁর উজ্জ্বল তেজ ও আকৃতি দেখে অগ্নিশিখার মতো এবং নির্মলতা ও মনোহরতা দেখে তাঁকে চন্দ্রকলার মতো ধারণা করতে লাগলেন। সেই অসাধারণ নয়না কন্যাটি পর্বতের উপরে থেকে স্বর্ণময়ী প্রতিমার মতো শোভা পাচ্ছিল। তাঁর রূপের ও পরিচ্ছদের কিরণে সেই পর্বতের উচ্চ বৃক্ষ, ক্ষুদ্র বৃক্ষ এবং সকল লতা যেন সমান হয়ে গিয়েছিল এবং পর্বতটাই যেন স্বর্ণময় হয়ে ছিল।
সম্বরণ রাজা সেই কন্যাটিকে দেখে ত্রিভুবনের সকল রমণীকেই যেন অবজ্ঞা করতে লাগলেন এবং নিজের চোখের সাফল্য লাভ করেছেন বলে মনে করতে লাগলেন। তখন সেই কন্যাটি নিজের গুণরূপ রজ্জু দ্বারা রাজার মন ও চক্ষু বন্ধন করে ফেলল বলে তিনি সেখান থেকে যেতে বা অন্য কিছু জানতে পারলেন না। বিধাতা নিশ্চয়ই দেবলোক, অসুরলোক এবং মনুষ্যলোক মন্থন করে এই বিশালনয়নার এই মনোহর রূপ সৃষ্টি করেছিলেন। সম্বরণ রাজা এই ধারণা করলেন এবং তাঁর রূপরাশি দেখে তাঁকে জগতে অতুলনীয়া বলে মনে করলেন। সেই সুন্দরীকে দেখেই সদ্বংশজাত সম্বরণ রাজা কামবাণে পীড়িত হয়ে মনে মনে অনেক বিষয় চিন্তা করলেন। সেই সরলা সুন্দরীকে বললেন, “সুন্দরী! তুমি কে? তুমি কার কন্যা বা ভার্যা? কীজন্য এখানে অবস্থান করছ? একাকিনীই বা কেন নির্জন বনে বিচরণ করছ? তোমার সকল অঙ্গই সুন্দর, সুতরাং তুমি সকল অলংকারে অলংকৃত হয়ে এই অলংকারগুলির যেন অভীষ্ট বিশেষ অলংকার হয়েছ। তোমার তুল্য রূপবতী কোনও দেবী, অসুরী, যক্ষী, রাক্ষসী, নাগী, গন্ধর্বী বা মানুষী আছে বলে আমি মনে করি না। হে যৌবনমত্তে! আমি যত সুন্দরী রমণী দেখেছি বা শুনেছি তোমাকে তাদের তুল্য বলে মনে করতে পারি না। চারুবদনে পদ্মদলতুল্য-নয়নযুক্ত তোমার মুখখানিকে চন্দ্র অপেক্ষাও সুন্দর দেখেই কামদেব যেন আমাকে মন্থন করছেন।”
সম্বরণ রাজা তাকে এই কথা বললেও তখন সেই রমণী সেই নির্জন বনমধ্যে তাঁর কথার কোনও প্রত্যুত্তরই করল না। তবুও রাজা বারবারই সেই কথা বলতে থাকলে, বিদ্যুৎ যেমন মেঘের ভিতর অন্তর্হিত হয়, তেমনই সেই দীর্ঘনয়না সেইখানেই অন্তর্হিত হল। তখন রাজা সেই পদ্মনয়না রমণীকে অন্বেষণ করবার জন্য উন্মত্তের ন্যায় ভ্রমণ করতে থেকে সমস্ত বন বিচরণ করতে থাকলেন। কিন্তু তাকে না পেয়ে আবার সেইখানে এসে বহু বিলাপ করে রাজশ্রেষ্ঠ সম্বরণ নিশ্চেষ্ট হয়ে কিছুকাল দাঁড়িয়ে রইলেন।
সেই কন্যাটি অদৃশ্য হলে শত্ৰুবিজয়ী সম্বরণ রাজা কামপীড়নে মোহিত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। তখন মধুরহাসিনী ও সুনিতম্বা সেই কন্যাটি এসে পুনরায় রাজাকে দেখা দিল এবং মৃদু হাস্য করতে করতে কুরুবংশরক্ষক কামার্ত রাজাকে বলল:
উত্তিষ্ঠোতিষ্ঠ ভদ্রং তে ন ত্বমর্হস্যরিন্দম।
মোহ নৃপতিশার্দূল! গন্তুমাবিষ্কৃতঃ ক্ষিতৌ ॥ আদি : ১৬৫ : ৪ ॥
“হে শত্রুবিজয়ী রাজশ্রেষ্ঠ! আপনি উঠুন উঠুন, আপনার মঙ্গল হোক, বিধাতা আপনাকে রাজা করে ভূতলে পাঠিয়েছেন, সুতরাং আপনি অল্প কারণে মূৰ্ছিত হতে পারেন না।” রাজা মধুর বাক্যে এভাবে অভিহিত হয়ে তখনই সম্মুখস্থিতা সেই বিশালনিতম্বা কন্যাটিকে দেখতে পেলেন।
তারপর কামাকুলহৃদয় সম্বরণ রাজা অস্পষ্ট বাক্যে সেই সুলোচনা কন্যাটিকে বলতে লাগলেন, “ভাল, হে সুলোচনে! হে যৌবনমত্তে! আমি কামার্ত হয়ে তোমাতে আসক্ত হয়েছি, তুমি আমাতে আসক্ত হও, তা না হলে প্রাণ আমাকে পরিত্যাগ করবে। হে, বিশালনয়নে! হে পদ্মকোষবর্ণে! তোমার জন্যই কাম আমাকে নিশিত শর দ্বারা বিদ্ধ করতে থেকে কিছুতেই নিবৃত্তি পাচ্ছে না। ভদ্রে, কামরূপ মহাসর্প আমাকে দংশন করেছে, কিন্তু সুন্দরা, তুমি আমার প্রতি আশ্বাসবাক্যও বলছ না, সত্বর এসে আমাকে রক্ষা করো। হে অনিন্দ্যসুন্দরী! তোমার কণ্ঠস্বর কিন্নরের উৎকৃষ্ট গানের মতো এবং তোমার মুখখানি পদ্ম ও চন্দ্রের তুল্য; সুতরাং আমার প্রাণ তোমারই অধীন হয়েছে। সুন্দরী! তোমাকে ছেড়ে আমি জীবিত থাকতে পারব না। কারণ, কাম আমাকে অনবরত বিদ্ধ করছে। অতএব বিশাল নয়নে! তুমি আমার প্রতি দয়া করো। আমি তোমার ভক্ত। সুতরাং তুমি আমাকে পরিত্যাগ করতে পারবে না। সুন্দরী! তুমি প্রীতিপূর্বক সংযোগ ঘটিয়ে আমাকে রক্ষা করো। তোমাকে দেখার পর আমার মনে অনুরাগ জন্মেছে, তাই সে মন অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছে। কল্যাণী! তোমাকে দেখে আর অন্য রমণীকে দেখবারও ইচ্ছা আমার হচ্ছে না, তুমি প্রসন্ন হও, আমি তোমার অধীন এবং ভক্ত, অতএব আমাকে ভজন করো। সুন্দরী! তোমাকে দেখার পর কামদেব বাণ দ্বারা আমার হৃদয়কে অত্যন্ত বিদ্ধ করছেন। কমলনয়নে! কামানল থেকে আমার যে দাহ উপস্থিত হয়েছে, তা তুমি নিজের প্রণয়সংযোগরূপ জল দ্বারা নিবারিত করো। কল্যাণী! তোমার দর্শনমাত্রেই আমার হৃদয়ে কাম জন্মেছে। সেই দুর্ধর্ষ কাম বিশাল বাণ ও ধনু ধারণ করে দুঃসহ বাণদ্বারা আমাকে বিদ্ধ করছে; অতএব সুন্দরী, তুমি আত্মসমর্পণ করে তাকে শান্ত করো। সুন্দরী! তুমি গান্ধর্ব বিবাহ অনুসারে আমার সঙ্গে মিলিত হও। রম্ভোরু! বিবাহের মধ্যে গান্ধর্ব বিবাহ একটি শ্রেষ্ঠ বিবাহ।”
তপতী বললেন, “রাজা, আমার দেহের উপর আমার আধিপত্য নেই। কারণ আমার পিতা আছেন, সুতরাং আপনার যদি আমার উপর প্রণয় জন্মে থাকে, তবে আমাকে পিতার নিকট প্রার্থনা করুন। রাজা, আমি যেমন দর্শনমাত্রই আপনার প্রাণ হরণ করেছি, আপনিও তেমন আমার অপেক্ষা অধিক পরিমাণে আমার প্রাণ হরণ করেছেন। কিন্তু আমি আমার দেহের প্রভু নই, তাই আপনার কাছে যেতে পারছি না। কারণ স্ত্রীজাতি স্বাধীন নয়। ত্রিভুবনের মধ্যে কোন কন্যা বিখ্যাত বংশোদ্ভূত এবং ভক্তবৎসল রাজাকে প্রতিপালক ও পতিরূপে লাভ করতে ইচ্ছা না করে? অতএব আপনি এই সময়ে প্রণিপাত, তপস্যা ও ব্ৰতদ্বারা আমার পিতা সূর্যদেবের কাছে আমাকে প্রার্থনা করুন। মহারাজ, তিনি যদি আমাকে আপনার হাতে দিতে ইচ্ছা করেন, তবে আমি চিরকালের জন্য আপনার বশবর্তিনী হব। হে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ, জগতের প্রদীপ এই সূর্যদেবের কন্যা সাবিত্রী, আমি তাঁরই কনিষ্ঠা ভগিনী, আমার নাম ‘তপতী।”
সর্বাঙ্গসুন্দরী তপতী এই কথা বলে উপরের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু সম্বরণ রাজা পুনরায় সেইখানে ভূতলে পতিত হলেন। তারপরে, সৈন্যগণ ও অনুচরগণের সঙ্গে মন্ত্রী অন্বেষণ করতে করতে সেই মহাবনে এসে সেই অবস্থায় রাজাকে দেখতে পেলেন। যথাসময়ে উত্তোলিত আবার ভূতলে পতিত ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় মহাধনুর্ধর রাজাকে অশ্ববিহীন অবস্থায় ভূতলে পতিত দেখে সেই মন্ত্রী সন্তাপানলে জ্বলে উঠলেন এবং সত্বর গিয়ে স্নেহের বশে ব্যস্ত হয়ে পিতা যেমন পুত্রকে উত্তোলন করেন, তেমনই কামমোহিত ভূতলে পতিত রাজাকে ভূতল থেকে উত্তোলন করলেন। এবং তিনি মঙ্গলময় মধুর বাক্যে সম্মুখস্থিত রাজাকে বললেন, “রাজশ্রেষ্ঠ, আপনি ভীত হবেন না, আপনার মঙ্গল হোক।” মন্ত্রী মনে করলেন, যুদ্ধে শত্ৰুনিপাতকারী, রাজা ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়েই ভূতলে পতিত হয়েছিলেন।
তারপর তিনি পদ্মসৌরভযুক্ত শীতল জল দ্বারা রাজার মস্তক সিক্ত করলেন। তাতে ময়লা দূর হওয়ায় রাজার মুকুটখানি আরও উজ্জ্বল হল। রাজা চৈতন্যলাভ করে কেবল সেই মন্ত্রী ব্যতীত সমস্ত সৈন্যকেই বিদায় করলেন। রাজার আদেশে সেই বিশাল সৈন্য রাজধানীর দিকে প্রস্থান করল। কিন্তু রাজা সেই পর্বতের সমতল ভূমিতেই পুনরায় উপবেশন করলেন। তিনি সূর্যদেবের আরাধনা করার ইচ্ছায় সেই পর্বতেই পবিত্র ও কৃতাঞ্জলি ঊর্ধ্বমুখে ভূতলে অবস্থান করতে লাগলেন এবং মনে মনে পুরোহিত বশিষ্ঠকে স্মরণ করতে লাগলেন। রাজা এইভাবে সেই স্থানে দিবারাত্র অবস্থান করতে লাগলে, বারো দিনের দিন ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ সেখানে আগমন করলেন। জ্ঞানী ও ধার্মিক বশিষ্ঠ তপতীই যে সম্বরণ রাজার চিত্ত অপহরণ করেছেন তা ধ্যানে জেনে, তাঁরই উদ্দেশ্য সাধন করার ইচ্ছায় তাঁর সঙ্গে কিছু আলাপ করলেন। পরে রাজা দেখছিলেন, এই অবস্থায় সূর্যের তুল্য ভগবান বশিষ্ঠ সূর্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য উপরের দিকে চলে গেলেন। তারপর বশিষ্ঠ কৃতাঞ্জলি হয়ে সূর্যের কাছে উপস্থিত হলেন এবং ‘আমি বশিষ্ঠ’ প্রণয়পূর্বক এই আত্মপরিচয় দিলেন। তখন সূর্যদেব মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠকে বললেন, “মহর্ষি! আপনার উপযুক্ত অভ্যর্থনা করছি, আপনি অভীষ্ট বিষয় বলুন। মহাত্মন, আপনি আমার কাছে যা ইচ্ছা করছেন, তা অতি দুষ্কর হলেও আমি আপনাকে দেব।” সূর্যদেব এই কথা বললে, বশিষ্ঠ প্রণাম করে তাঁকে বললেন, “সূর্যদেব, সাবিত্রীর কনিষ্ঠা তপতী নামে আপনার যে একটি কন্যা আছে, সেটিকে সম্বরণ রাজার জন্য আপনার কাছে আমি প্রার্থনা করছি। সম্বরণ রাজা অত্যন্ত যশস্বী, ধর্মার্থজ্ঞ এবং উদারচেতা, সুতরাং তিনিই আপনার কন্যার উপযুক্ত বর।”
সূর্যদেব পূর্বেই সম্বরণ রাজাকে কন্যা দান করবেন স্থির করে রেখেছিলেন। সুতরাং বশিষ্ঠের প্রস্তাব শুনে, তাঁকে আদর করে বললেন, “মহর্ষি, সম্বরণ রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তপতীও নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা, অতএব সম্বরণের হাতে তপতীকে দান করা ভিন্ন আর কী করব।” তারপর, সূর্যদেব নিজেই সম্বরণ রাজার জন্য সর্বাঙ্গসুন্দরী তপতীকে মহাত্মা বশিষ্ঠের কাছে সমর্পণ করলেন, মহর্ষি বশিষ্ঠও তখন তপতী নাম্নী সেই কন্যাটিকে গ্রহণ করলেন এবং সূর্যদেবের কাছে বিদায় গ্রহণ করে পুনরায় চলে এলেন।
বিখ্যাতকীর্তি কুরুশ্রেষ্ঠ সম্বরণ রাজা তপতীকে ভাবতে থেকেই কামাবিষ্ট হয়ে সেখানে বাস করছিলেন। রাজা, চারুহাসিনী দেবকন্যা তপতীকে বশিষ্ঠের সঙ্গে আসতে দেখে, অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বিশেষ শোভা পেতে লাগলেন। সুন্দরী তপতীও মেঘবিচ্যুত বিদ্যুতের ন্যায় আপন কান্তি দ্বারা সমস্ত দিক আলোকিত করে আকাশ থেকে আসতে থেকে অত্যন্ত শোভা পেতে লাগলেন। তখন রাজা কষ্টসাধ্য সূর্যোপাসনায় দ্বাদশ দিন অতিবাহিত করলে, শুদ্ধচিত্ত বশিষ্ঠকে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পেলেন। সম্বরণ রাজা তপস্যা দ্বারা বরদাতা জগদীশ্বর সূর্যদেবের আরাধনা করে এবং বশিষ্ঠের প্রভাবে তপতীকে ভার্যারূপে লাভ করলেন। তারপর দেবগণ ও গন্ধর্বগণ সেবিত সেই পর্বতে থেকেই ভার্যা তপতীর সঙ্গে বিহার করতে ইচ্ছা করলেন।
সম্বরণ রাজা রাজধানী, রাজ্য, বন, উপবন প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ করবার জন্য সেই মন্ত্রীকেই আদেশ করলেন। তখন বশিষ্ঠও রাজাকে সেইরূপ অনুমতি দিয়ে চলে গেলেন। রাজাও সেই পর্বতে থেকেই দেবতার মতো বিহার করতে লাগলেন। রাজা আরও বারো বছর সেই পর্বতে থেকেই বনে ও উপবনে ভার্যার সঙ্গে রমণ করলেন।
সেই বারো বৎসরের মধ্যে সেই রাজার রাজ্যে ও রাজধানীতে ইন্দ্র বর্ষণ করলেন না। অনাবৃষ্টি চলতে থাকলে স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রজাই ক্ষয় পেতে লাগল। সেই ভয়ংকর সময়ে ভূতলে হিমবিন্দুও পড়েনি। পৃথিবীতে কোনও শস্য জন্মেনি। লোক সকল ক্ষুধায় পীড়িত হয়ে, গৃহ পরিত্যাগ করে পরস্পর কর্তব্যহীন হয়ে পড়ল। ক্ষুধার্ত অথচ উপবাসী মৃতপ্রায় লোকে পরিপূর্ণ সেই রাজধানীটা পরিপূর্ণ যমালয়ের মতো হয়ে পড়ল।
তারপর রাজধানীর সেই অবস্থা দেখে, ধর্মাত্মা মুনিশ্রেষ্ঠ সেই বশিষ্ঠ সেখানে উপস্থিত হলেন এবং তিনি বারো বৎসর অতীত হলে, তপতীর সঙ্গে সম্বরণ রাজাকে সেই রাজধানীতে নিয়ে এলেন। তখন দেবরাজ পূর্বের ন্যায় বর্ষণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। সম্বরণ রাজা রাজধানীতে প্রবেশ করলে, দেবরাজ শস্য জন্মাবেন বলে বর্ষণ করলেন। নির্মল হৃদয় সম্বরণ রাজা ভাগ্য ফিরিয়ে আনলে রাজার সঙ্গে সেই রাজধানী অত্যন্ত আনন্দ লাভ করল। তারপর, শচীদেবীর সঙ্গে মিলিত দেবরাজের মতো সম্বরণ রাজা তপতীর সঙ্গে মিলিত হয়ে, আবার বারো বৎসর যজ্ঞ করলেন।
অঙ্গারপর্ণ চিত্ররথ অর্জুনের কাছে এই কাহিনি প্রকাশ করে বলল, “অৰ্জুন, তোমাদের পূর্বোৎপন্না সূর্যকন্যা তপতী এমনই ভাগ্যবতী ছিলেন, সেই সম্বরণ রাজা তপতীর গর্ভে ‘কুরু’ নামে একটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। সেই তপতীর গর্ভে জন্মেছ বলে তোমরা সকলেই ‘তাপত্য’। তাই আমি তোমাকে ‘তাপত্য’ বলে সম্বোধন করেছি।”