শকুন্তলা
মহাত্মা পুরুর বংশে জন্মগ্রহণকারী ঈলিন বিশ্ববিজয়ী সম্রাট ছিলেন। ঈলিন রথন্তরী নাম্নী এক রমণীকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেছিলেন। সেই রথন্তরীর গর্ভে ঈলিনের জ্যেষ্ঠপুত্র দুষ্মন্তের জন্ম হয়। দুষ্মন্ত যুদ্ধে দুর্জয় রাজশ্রেষ্ঠ হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। দুষ্মন্তের ঔরসে লক্ষণার গর্ভে জনমেজয় নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। আর দুষ্মন্ত থেকেই শকুন্তলার গর্ভে ভরত নামে অন্য একটি পুত্রের জন্ম হয়। সেই ভরত থেকেই ভরতবংশের বিশাল যশোরাশি বিস্তীর্ণ হয়েছে এবং ভরতের রাজধানী ভারতবর্ষ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
পুরুর বংশরক্ষক বলবান দুষ্মন্ত রাজা চতুঃসমুদ্রবেষ্টিত পৃথিবীর রাজা ছিলেন। যুদ্ধ-বিজয়ী রাজা দুষ্মন্ত পৃথিবীর পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ— এই চারটি অংশ সমস্তই ভোগ করতেন এবং সমুদ্র সন্নিহিত দেশগুলিও শাসন করতেন। দুষ্মন্ত রাজার রাজত্বকালে কোনও লোকই বর্ণসংকর জন্মাত না। কৃষিক্ষেত্রকর্ম ও খনি আবিষ্কার করত না কিংবা কোনও পাপকার্য করত না। তারা ধর্মানুষ্ঠান করত এবং তার দ্বারা ধর্ম ও অর্থ লাভ করত। দুষ্মন্ত রাজা হলে, চোরের ভয় থাকত না, রোগ হত না। কোনও বিপদ না দেখা দেওয়ায় মানুষের শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করার প্রয়োজন হত না। মানুষ আপন আপন বর্ণ অনুযায়ী কাজ করত। ধর্মপালন করত। দুষ্মন্তের শাসনে প্রজারা পরম সুখে বাস করত। যথাসময়ে বর্ষণ হত। শস্য সকল সুস্বাদু ছিল। পৃথিবী রত্নে পরিপূর্ণ ছিল, গোরু প্রভৃতি পশু যথেষ্ট পরিমাণে ছিল; ব্রাহ্মণগণ আপন আপন কার্যে নিরত ছিলেন; মিথ্যা ব্যবহার করতেন না। প্রজারা দুষ্মন্তের রাজ্যে নির্ভয়ে বাস করত।
অদ্ভুত বলবান ও বজ্রতুল্য দৃঢ়শরীর যুবক দুষ্মন্ত দুই হাতে জল ও বন প্রভৃতির সঙ্গে মন্দর পর্বত তুলে নিয়ে বহন করতে পারতেন। তিনি গদাযুদ্ধ, সর্বপ্রকার অস্ত্র সঞ্চালন, হাতির পিঠে ও ঘোড়ার পিঠে চড়ার ব্যাপারে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন, বলে তিনি ছিলেন বিষ্ণুর সমান, তেজে সূর্যের সমান, ধৈর্যে সমুদ্রের সমান এবং সহিষ্ণুতায় পৃথিবীর সমান। তিনি সকলের প্রিয় ছিলেন। নগরবাসী ও দেশবাসী লোক তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল। ধর্মসংগত ব্যবহারে সকল লোককে সন্তুষ্ট রেখে তিনি দেশ শাসন করতেন।
মহাবীর দুষ্মন্ত কোনও এক সময়ে প্রচুর সৈন্য ও বাহন নিয়ে, হস্তী ও অশ্বসমূহে পরিবেষ্টিত হয়ে, মৃগয়া করার জন্য গভীর বনে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সময়ে অতি সুন্দর হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিক—চতুরঙ্গ সৈন্য সঙ্গে নিয়ে এবং তরবারি, শক্তি, গদা, মুষল, কুন্ত ও তোমরধারী যোদ্ধাগণে পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি যাত্রা করলেন। তখন যোদ্ধাদের সিংহনাদ, শঙ্খ ও দুন্দুভিধ্বনি, হস্তীর বৃংহিত শব্দ, রথচক্রের শব্দ, নানা বেশধারী ও নানাবিধ অস্ত্রধারী বীরগণের কণ্ঠধ্বনি, অশ্বের হ্রেষারব ও বীরগণের সিংহনাদ ও বাহু চাপড়ানোর শব্দে ভয়ংকর কোলাহল হতে লাগল।
পুরস্ত্রীরা অট্টালিকার উপরে উঠে, অপূর্ব শোভাধারী দুষ্মন্তকে দেখতে লাগল। শত্রুহন্তা ও ইন্দ্ৰতুল্য সেই রাজাকে দেখে তাদের সাক্ষাৎ ইন্দ্র বলেই মনে হতে লাগল। রাজার বহু প্রশংসা করে স্ত্রীলোকেরা তাঁর মাথায় পুষ্পবর্ষণ করতে লাগল। ব্রাহ্মণরা এসে তাঁর স্তব করতে লাগলেন। আনন্দিত রাজা মৃগয়া করার জন্য বনের দিকে যেতে লাগলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণ বহুদূর পর্যন্ত রাজার পিছনে পিছনে গেলেন। তারপর রাজার অনুমতি নিয়ে তাঁরা ফিরে গেলেন। তারপরে রাজা গরুড়তুল্য উজ্জ্বল রথে আরোহণ করে, তার শব্দে ভূমণ্ডল ও গগনমণ্ডল পরিপূর্ণ করে যেতে যেতে নন্দনকাননের মতো একটি বন দেখতে পেলেন। সে বনে বেল, আকন্দ, খদির, কয়েতবেল ও ধব প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল; পর্বত থেকে পাথর পড়ে প্রায় সকল জায়গাই উঁচু ও নিচু হয়েছিল। সেখানে মানুষ ছিল না; আর সে বন সিংহ, হরিণ ও অন্যান্য ভয়ংকর জন্তুগণে ব্যাপ্ত ছিল এবং বহুযোজন বিস্তৃত ছিল। নরশ্রেষ্ঠ রাজা দুষ্মন্ত ভৃত্য, সৈন্য ও বাহনদের সঙ্গে থেকে নানাবিধ পশু বধ করে, সেই বনটাকে তোলপাড় করে তুলেছিলেন। তীক্ষ্ণ বাণে তিনি বহুতর ব্যাঘ্রকে নিপাতিত করতে লাগলেন। তিনি দূরের পশুদের তীক্ষ্ণ শরে বধ করতে লাগলেন, আর কাছের পশুদের তরবারি দ্বারা ছেদন করতে লাগলেন। মহাশক্তিশালী অসাধারণ বিক্রমী, গদা ক্ষেপণে অভিজ্ঞ রাজা দুষ্মন্ত বন্য পশুদের বধ করতে করতে সমস্ত বনটিতেই তোলপাড় সৃষ্টি করতে লাগলেন। সেই বনে যূথপতিকে বধ করায় হরিণযূথ পালাতে লাগল। হরিণযূথ ভয়বশত ইতস্তত আর্তনাদ করতে লাগল। কতগুলি হরিণ পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে, জলপিপাসায় শুষ্ক নদীতে গিয়ে, জল না পেয়ে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। কতগুলি পরিশ্রান্ত হরিণ ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে যে মুহূর্তে ভূতলে পড়ল, অমনি ক্ষুধার্ত নররূপী ব্যাঘ্রগণ সেগুলি ভক্ষণ করতে লাগল। কতগুলি সৈন্য হাড় থেকে হরিণের মাংস বার করে নিয়ে আগুনে ঝলসে নিয়ে তা ভক্ষণ করতে লাগল। অস্ত্রের আঘাতে বিশাল বন্যহস্তীরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে শুঁড় গুটিয়ে বেগে পলায়ন করতে লাগল। তাদের দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে রক্ত ঝরতে লাগল। এই অবস্থায় তারা বিষ্ঠা ও মূত্রত্যাগ করতে করতে বহুতর মানুষকে নিষ্পেষিত করে ছুটে চলল। রাজা সিংহগুলিকে মেরে ফেললেন; এই অবস্থায় সে বনটা নিহত পশুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে, তৃষ্ণার্ত অবস্থায় একাকী সেই বনের প্রান্তে গিয়ে এক বিশাল প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। সে প্রান্তরও দ্রুত অতিক্রম করে রাজা অন্য এক বনে উপস্থিত হলেন। সে বনটির ভিতরে মুনিদের আশ্রম ছিল। শীতল বাতাস বইছিল, ঝিঁঝি ডাকছিল, নানাবিধ পাখি মধুর রব করছিল, কোকিলের কুহুধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, গাছগুলি ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। ভ্রমরগণ ফুলে ফুলে মধু পান করছিল—বহুতর বিশাল গাছের ছায়ায় বনভূমি মনোরম হয়ে ছিল, সবুজ ঘাসে বনভূমি পরিপূর্ণ ছিল। সে বনে এমন কোনও গাছ ছিল না, যাতে ফুল ধরেনি। এমন কোনও গাছ ছিল না যাতে ফল ধরেনি এবং কোনও গাছেই কাঁটা ছিল না। সকল ঋতুতেই গাছগুলিতে ফুল ধরত। সেই ফুল যেন বনভূমিকে গয়না পরিয়ে দিয়েছিল। রাজা ধনুর্ধারণ করেই সে মনোরম বনে প্রবেশ করলেন। বাতাসে ফুলে ভরা গাছের শাখাগুলি বারবার আন্দোলিত হয়ে রাজার মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগল। পাখিরা আনন্দে মুখর হয়ে রব করতে লাগল। গাছগুলি ফলের ভারে অবনত হয়ে পড়েছিল কিন্তু ফুলগুলি আবার আকাশের দিকে উঁচু হয়ে আপন যৌবনের স্পর্ধা ঘোষণা করছিল, আর মধুলোভী ভ্রমরগণ সে ফুলের চারপাশে গুনগুন রব করে ঘুরছিল। সে বনে বহু স্থানে লতামণ্ডপ ছিল। সে লতামণ্ডপগুলিতেও রাশি রাশি ফুল ফুটেছিল। আনন্দময় সেই স্থান দেখে রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। কতকগুলি বৃক্ষ ছিল ইন্দ্ৰধ্বজের মতো দীর্ঘ। তার শাখাগুলি পরস্পর সংযুক্ত ছিল এবং সেই শাখাগুলিও পুষ্পে পরিপূর্ণ ছিল। সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, বানর, কিন্নর ইত্যাদি সকল সময়ে সেই বনে বিচরণ করত। সুখস্পর্শ, শীতল ও সুগন্ধি পুষ্পরেণুবাহী বাতাস ইতস্তত বিচরণ করে যেন রমণেচ্ছায় সেই বৃক্ষের তলায় উপস্থিত হত।
রাজা দুষ্মন্ত এমন সুন্দর, নদীতীরজাত, স্বভাব সুকোমল অথচ ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় উচ্চ বনটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বনের মধ্যে একটি অতি মনোহর আশ্রম দেখতে পেলেন। সে আশ্ৰম পাখির কূজনে মুখরিত ছিল। অজস্র বৃক্ষের মাঝখানে ছিল আশ্রমটি। হোমাগ্নি জ্বলছিল। ইন্দ্রিয়জয়ী বালখিল্যগণ ও অন্যান্য মুনিরা বিচরণ করছিলেন। অনেকগুলি হোমগৃহ ছিল, সেগুলিতে ফুলের আস্তরণ ছিল। আশ্রমটি পবিত্র ও নির্মল মালিনী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। তপস্বীরা স্নান করতে সেখানে যাতায়াত করছিলেন এবং ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র জন্তুরাও শান্ত স্বভাবের ছিল। দেখে রাজা দুষ্মন্ত অশেষ আনন্দ লাভ করলেন। রাজা দুষ্মন্ত দেখলেন পুণ্যসলিলা মালিনী নদী জননীর মতো সেই আশ্রমকে রক্ষা করছে। চক্রবাক পক্ষীযূথ নদীতীরে বিচরণ করছে। স্রোতের উপর ফুলের মতো ফেনা ভাসছে, তীরে কোথাও কিন্নরগণ বাস করছে, কোথাও বানর ও ভল্লুকেরা বাস করছে। কোথাও মত্ত হস্তী ভয়ংকর ব্যাঘ্র এবং ভীষণ সর্প একত্রে বাস করছে। চারপাশে পবিত্র বেদপাঠের শব্দ ভেসে আসছে।
সেই মালিনী নদীর তীরে মহর্ষি কণ্বমুনির মনোহর আশ্রম। সেখানে অন্য মহর্ষিরা অবস্থান করছেন। মালিনী নদী পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, আশ্রমের প্রান্তদেশগুলিও সুন্দর। এই সমস্ত দেখে রাজা সেই আশ্রমে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করলেন। রাজা কুবেরের উদ্যানের মতো সেই মনোহর উদ্যানে প্রবেশ করলেন। সেখানে ময়ূরেরা পাখনা তুলে নাচছিল। মহর্ষি কথকে দেখার জন্য রাজা সমস্ত সৈন্যবাহিনী চতুরঙ্গ-অনুচর সকলকে তপোবনের দ্বারদেশে রেখে বললেন, “কামক্রোধাদিশূন্য মহর্ষি কণ্বকে দর্শন করার জন্য আমি সেখানে যাব, তোমরা এইখানেই আমার ফিরে আসার প্রতীক্ষা করো।” তপোবনে প্রবেশ করতেই রাজার ক্ষুধা ও পিপাসা দূর হল। রাজা রাজচিহ্ন-ছত্র, মুকুট পরিত্যাগ করে, পুরোহিত ও মন্ত্রীদের সঙ্গে সেই সুন্দর আশ্রমে প্রবেশ করলেন। রাজা দীর্ঘজীবী ও মূর্তিমান তপঃপুঞ্জের ন্যায় বিরাজমান মহর্ষি কণ্বকে দেখতে চাইলেন। আনন্দিত রাজা উৎফুল্ল নয়নে ব্রহ্মলোকের মতো সেই আশ্রমটিকে দেখতে লাগলেন। ঋগ্বেদী ব্রাহ্মণরা পদ ও ক্রম অনুসারে ঋগ্বেদ পাঠ করছিলেন। যজ্ঞবিদ্যায় পারদর্শী ও অন্যশাস্ত্রাভিজ্ঞ যজুর্বেদী ব্রাহ্মণগণ ও মধুর সামগানকারী ব্রাহ্মণগণ সেই সভা আলোকিত করে রেখেছিলেন। ভারুণ্ড নামক সামবেদের অংশ এবং অথর্ব বেদের শেষাংশ পাঠ করবার সময়ে ব্রতনিষ্ঠ মুনিগণের সেই স্বরে আশ্রমটি তখনও মুখরিত ছিল। ব্রাহ্মণদের উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণে আশ্রমটি দ্বিতীয় ব্রহ্মলোকের মতো বোধ হচ্ছিল।
যজ্ঞবিধান, যজ্ঞাঙ্গের পরিপাটি, শিক্ষাশাস্ত্র, ন্যায়দর্শন, উপনিষদ এবং বেদশাস্ত্রে পারদর্শী, আত্মা-সম্পর্কিত বিধানে পারদর্শী ধ্যানাদিকার্যাভিজ্ঞ, মুক্তিসাধক কর্মনিরত ব্রাহ্মণগণ পঞ্চাঙ্গ অধিকরণে বিশেষাভিজ্ঞ, ব্যাকরণ, ছন্দ ও নিরুক্ত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ, রসায়নভিজ্ঞ, আয়ুর্বেদবিদ, পশুপক্ষীর রবে অর্থজ্ঞ এবং বিশাল বিশাল পুস্তকধারী ব্রাহ্মণগণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রে সুনিপুণ ব্রাহ্মণগণ যে সকল আলোচনা করছিলেন এবং তাদের সঙ্গে মিলে প্রধান প্রধান নাস্তিকগণ যে আলাপ করছিলেন, রাজা সে সমস্ত শুনলেন। শক্ৰহন্তা দুষ্মন্ত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দেখতে পেলেন যে কেউ কেউ ধ্যান, কেউ কেউ জপ ও কেউ কেউ হোম করছেন।
নানাপ্রকার সুন্দর সুন্দর আসন যত্নপূর্বক পেতে রাখা হয়েছে। দেখে রাজা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। ব্রাহ্মণরা দেবতার ঘরগুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছেন। রাজার মনে হল তিনি ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হয়েছেন। মহর্ষি কম্বের তপস্যায় সুরক্ষিত, মঙ্গলজনক সেই আশ্রমটি দেখে রাজার যেন আশ মিটছিল না। রাজা, মন্ত্রী ও পুরোহিতের সঙ্গে মিলে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে প্রবেশ করলেন। সেখানে মহাব্রতী ও মহাতপস্বী ঋষিরা অবস্থান করছিলেন। ফলে স্থানটি পবিত্র, মনোহর ও অত্যন্ত মঙ্গলজনক মনে হচ্ছিল। তখন রাজা সেই পুরোহিত ও মন্ত্রীদের পরিত্যাগ করে একাকী আশ্রম মধ্যে প্রবেশ করলেন কিন্তু কোথাও মহর্ষি কণ্বকে দেখতে পেলেন না। মহর্ষিকে দেখতে না পেয়ে এবং আশ্রম শূন্য দেখে রাজা উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, “এখানে কেউ আছ কি?” রাজার সেই কণ্ঠস্বর শুনে, মূর্তিমতী লক্ষ্মীর মতো একটি কন্যা আশ্রম থেকে বেরিয়ে এল। নীলোৎপলের মতো কৃষ্ণবর্ণা সেই কন্যাটি রাজা দুষ্মন্তকে দেখেই সম্মান করে সত্বর বলল, “আপনার আসার পথ সুগম হয়েছে তো?” সেই কন্যাটি রাজা দুষ্মন্তকে আসন, পাদ্য ও অর্ঘ্য দান করে প্রশ্ন করল, “আপনি সুস্থ আছেন তো? রাজ্যের মঙ্গল তো?” যথাবিধানে সম্মান করে এবং আরোগ্যের বিষয় জিজ্ঞাসা করে কন্যাটি মৃদু হাস্য করতে করতেই যেন প্রশ্ন করল, “আমি কী করতে পারি, বলুন।”
যথাবিধানে সম্মানিত হয়ে রাজা মধুরভাষিণী ও সর্বাঙ্গসুন্দরী সেই কন্যাটিকে দেখে বললেন, “ভদ্রে, আমি মহাত্মা কথের সেবা করার জন্য এসেছি। সুন্দরী, মহর্ষি কোথায় গিয়েছেন আমাকে বলুন।” শকুন্তলা বললেন, “আমার পিতা ফল আহরণ করার জন্য গিয়েছেন; আপনি একটুকাল অপেক্ষা করুন; তিনি আসলেই তাঁকে দেখতে পাবেন।” রাজা তখন কন্বমুনির দেখা পেলেন না, এদিকে শকুন্তলাও তাঁকে প্রতীক্ষা করতে বলছেন। সুতরাং রাজা অপলকে শকুন্তলাকে দেখতে লাগলেন—
অপশ্যমানস্তমৃষিং তথা চোক্তস্তয়া চ সঃ।
তাং দৃষ্ট্বা চ বরারোহাং শ্রীমতীং চারুহাসিনীম্ ॥
বিভ্রাজমানাং বপুষা তপসা চ দমেন চ।
রূপযৌবনসম্পন্নামিত্যুবাচ মহীপতিঃ ॥ আদি: ৮৫ : ১০-১১ ॥
“শকুন্তলার নিতম্ব দুটি পরম সুন্দর, শরীরের কান্তিও মনোহর; হাস্য সুমধুর, রূপ আছে, যৌবনও এসেছে এবং শরীরের গুণে বিশেষ শোভা পাচ্ছেন।” অথচ তপস্যায় থাকায় ইন্দ্রিয় সংযম এসেছে ইত্যাদি দেখে রাজা বললেন, “সুনিতম্বে, আপনি কে? কার কন্যা? কেনই বা বনে এসেছেন? সুন্দরী, আপনি এত রূপবতী ও গুণবতী হয়ে কোথা থেকে এখানে এলেন? আপনি দেখা দিয়েই আমার মন অপহরণ করেছেন। সুতরাং আমি আপনার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতে চাই; আপনি তা বলুন।”
রাজার কথা শুনে কন্যাটি ঈষৎ হেসে মধুর স্বরে তাঁকে বলল, “মহারাজ, তপস্বী, ধৈর্যশীল, ধার্মিক, উদারচেতা এবং মাহাত্ম্যশালী কণ্বের কন্যা আমি, লোকেরা তাই বলে থাকে।” দুষ্মন্ত বললেন, “ভদ্রে, জগতের সম্মানিত ভগবান কন্বমুনি ঊর্ধরেতা। স্বয়ং ধর্মও আপন কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হতে পারেন; কিন্তু চিরব্রহ্মচারী কখনও কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হতে পারেন না। সুতরাং আপনি কী করে তাঁর কন্যা হলেন? এই বিষয়ে আমার গুরুতর সন্দেহ জন্মেছে; আপনি আমার সেই সন্দেহ দূর করুন।”
শকুন্তলা বললেন, “মহারাজ এই বৃত্তান্ত যেভাবে আমার কর্ণগোচর হয়েছিল, যেভাবে আমার জন্ম হয়েছিল এবং যেভাবে আমি কন্বমুনির কন্যা হয়েছি, তা আপনি বিশদভাবে শুনুন। কোনও সময়ে এক ঋষি আশ্রমে এসে আমার জন্মের বিষয় প্রশ্ন করলে মহর্ষি কণ্ব তাঁকে যা বলেছিলেন, তা আপনাকে আমি জানাচ্ছি।” কণ্ব বলেছিলেন—
পূর্বকালে মহর্ষি বিশ্বামিত্র গুরুতর তপস্যা করছিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র তাতে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হন। তপস্যার প্রভাবে বলবান বিশ্বামিত্র তাকে ইন্দ্ৰত্বপদ থেকে বিচ্যুত করতে পারেন, এই ভেবে ভীত হয়ে দেবরাজ স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠ মেনকাকে ডেকে বলেন, “মেনকা তুমি নিজের অলৌকিক গুণে স্বর্গের অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং কল্যাণী, তোমাকে যা বলব, আমার কল্যাণের জন্য তা করো। সূর্যের তুল্য তপস্বী বিশ্বামিত্রকে ভয়ংকর তপস্যা করতে দেখে আমার মন উদ্বিগ্ন হয়েছে। তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছি। তিনি যাতে আমাকে ইন্দ্ৰত্বপদ থেকে বিচ্যুত করতে না পারেন, তুমি গিয়ে তাঁকে প্রলুব্ধ করো। তাঁর তপস্যার বিঘ্ন ঘটিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করো। তুমি অনুপম সুন্দরী। রূপ ও যৌবনের অনুরূপ কোমল অঙ্গভঙ্গি, মন্দ হাস্য এবং মধুর বাক্য দ্বারা তাঁকে লুব্ধ করে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করো।”
মেনকা বলল, “মহাত্মা বিশ্বামিত্র যে মহাতেজস্বী এবং অত্যন্ত কোপনস্বভাব, তা আপনার অজানা নয়। যে মহাত্মার তেজ, তপস্যা ও কোপের প্রভাবে আপনি নিজে উদ্বিগ্ন, তাঁর প্রভাবে আমি অধিকতর উদ্বিগ্ন হব না কেন? যিনি মহাত্মা বশিষ্ঠের প্রিয়তম পুত্রদের বিনষ্ট করেছেন। এবং যিনি প্রথমে ক্ষত্রিয় বংশে জন্মের পরে বলপূর্বক ব্রাহ্মণ হয়েছেন, যিনি স্নানাদি করার জন্য আশ্রমের কাছে অগাধজলসম্পন্ন দুর্গম এক নদী নির্মাণ করেছেন, যে পবিত্র নদীকে লোকে ‘কৌশিকী’ নামে জানে। পূর্বকালে দুর্ভিক্ষের সময় ধার্মিক রাজা ব্যাধ হয়েও যে মহাত্মার ভার্যাবর্গকে ভরণপোষণ করেছিলন। দুর্ভিক্ষ অতীত হলে পুনরায় আশ্রমে এসে যিনি সেই কৌশিকী নদীর নাম করেছিলেন—‘পারা।’ যিনি সন্তুষ্ট হয়ে নিজেই ত্রিশঙ্কুর যাজন করেছিলেন এবং দেবরাজ আপনি স্বয়ং যাঁর ভয়ে আত্মস্থ হবার জন্য সোমরস পান করেছিলেন। যিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রবণা প্রভৃতি নূতন নক্ষত্র সৃষ্টি করে, তার দ্বারা আর-একটি নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করেছিলেন। শাপগ্রস্ত রাজা ত্রিশঙ্কু যখন চিন্তা করছিলেন, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র আমাকে কীভাবে ব্ৰহ্মর্ষি বশিষ্ঠের শাপ থেকে রক্ষা করবেন, তখন বিশ্বামিত্র কিন্তু তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। দেবতারা অবজ্ঞা করে যজ্ঞাঙ্গ বিনষ্ট করলেন, কিন্তু সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়ের বিধানে সমর্থ তেজস্বী বিশ্বামিত্র অন্য যজ্ঞাঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন। বশিষ্ঠকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কু রাজাকে স্বর্গে প্রেরণ করেছিলেন।
“দেবরাজ, এতগুলি অদ্ভুত কার্য যিনি করেছিলেন, সেই বিশ্বামিত্র ক্রুদ্ধ হয়ে যাতে আমাকে দগ্ধ না করেন, আপনি তার ব্যবস্থা করুন। যিনি আপন তেজে ত্রিজগৎ দগ্ধ করতে পারেন, পদাঘাতে পৃথিবীকে বিচলিত করতে পারেন, মহামেরু পর্বতকে ক্ষুদ্র পর্বত করে দিতে পারেন এবং দিক সকলকেও হঠাৎ পরিবর্তিত করে দিতে পারেন। মহাতপস্বী, প্রজ্বলিত অগ্নির মতো অবস্থিত এবং জিতেন্দ্রিয় সেই তপস্বীকে আমার মতো অতি তুচ্ছ রমণী কী করে স্পর্শ করবে? দোজ, যাঁর মুখে অগ্নি রয়েছেন, নয়নের তারা দুটি সূর্য ও চন্দ্রের মতো এবং যাঁর জিহ্বা যমের মতো অবস্থিত, তপস্যায় প্রজ্বলিত সেই বিশ্বামিত্রকে আমার মতো রমণীই বা কীভাবে স্পর্শ করবে? যম, চন্দ্র, মহর্ষিগণ, সাধ্যগণ, বিশ্বদেবগণ এবং বালখিল্য ঋষিগণ—এঁরাও যার প্রভাবের ভয়ে ভীত—আমার মতো তুচ্ছ নারী তাঁকে ভয় পাবে না কেন? দেবরাজ আপনি আদেশ করলে আমাকে বিশ্বামিত্রের কাছে যেতেই হবে। অতএব আপনি আমার রক্ষার বিষয় স্থির করুন। যাতে আমি রক্ষিত অবস্থায় আপনার কার্যসম্পাদন করতে সমর্থ হই। আমি যখন বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে নৃত্যরত অবস্থায় খেলা করব, তখন যেন বায়ু আমার অঙ্গ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বস্ত্র সরিয়ে দেন এবং আপনার আদেশে কামদেব আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। আর, আমি যখন মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে প্রলুব্ধ করতে থাকব, তখন বন থেকে যেন যথেষ্ট পরিমাণে সুগন্ধ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে।” মেনকার কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র বায়ু ও কামদেবকে মেনকার সহচর হওয়ার আদেশ দিলেন। তখন মেনকা বায়ুর সঙ্গে বিশ্বামিত্রের আশ্রম উদ্দেশে যাত্রা করল। সুন্দর নিতম্বা মেনকা বিশ্বামিত্রের আশ্রমে উপস্থিত হয়ে ভয়চকিত চিত্তে দেখল—তপস্যার পূর্বেই সব পাপ নষ্ট হয়ে গেলেও বিশ্বামিত্র সেই তপস্যাই করছেন।
তারপর মেনকা বিশ্বামিত্রকে নমস্কার করে তাঁর চারপাশে নৃত্য করতে আরম্ভ করল। তার বস্ত্রখানি চন্দ্রকিরণের মতো সূক্ষ্ম ও শুভ্রবর্ণ ছিল। বায়ু তা অপহরণ করলেন। তখন সে লজ্জাবশত বায়ুকে যেন নিন্দা করতে থাকল; এদিকে বিশ্বামিত্র তাকে ভাল করে দেখতে লাগলেন; তবুও সে বস্ত্রখানি গ্রহণের জন্য বিশ্বামিত্রের আরও কাছে এগিয়ে গেল। তখন বিশ্বামিত্র দেখলেন, মেনকা একেবারে উলঙ্গ, তার সমস্ত অঙ্গ দেখা যাচ্ছে তার রূপযৌবনের কোনও নিরূপণ করা যাচ্ছে না। সে অপরূপা সুন্দরী, তার দেহের কোনও অঙ্গের নিন্দা করা যায় না এবং সে যেন সেই বস্ত্রখানি নেওয়ার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। বিশ্বামিত্র সেই অসাধারণ রূপ দেখে, কামাতুর হয়ে, তখন তার সঙ্গে রমণ করার ইচ্ছা করলেন। তিনি সেই সম্পূর্ণা উলঙ্গা মেনকাকে আহ্বান করলেন, মেনকাও সোৎসাহে তাঁর নিকটে এসে বাহুবন্ধনে ধরা দিলেন। তাঁরা দু’জনে দীর্ঘকাল সেখানে রমণ করতে থাকলেন এবং সেই দীর্ঘ বৎসরটি একটি দিনের ন্যায় অতি দ্রুত অতিবাহিত হল। বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ হল। কিন্তু বিশ্বামিত্র মেনকা ভিন্ন অন্য কোনও চিন্তাও করতে পারলেন না। তারপর একদিন বিশ্বামিত্র মালিনী নদীর কাছে হিমালয়ের মনোহর সমতলভূমিতে মেনকার গর্ভে শকুন্তলাকে উৎপাদন করলেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গে কৃতকাম হয়ে মালিনী নদীর কাছে জন্মমাত্র সেই কন্যাটিকে পরিত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রের সভায় চলে গেল। বিশ্বামিত্রও সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন।
সিংহ-ব্যাঘ্র পরিপূর্ণ নির্জন বনমধ্যে সেই সদ্য জাতিকাকে শায়িত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, পক্ষীগণ এসে তাঁকে সকলদিকে পরিবেষ্টন করে রইল। মাংসলোভী জন্তুরা বনের ভিতরে সেই বালিকাটিকে পাছে ভক্ষণ করে ফেলে, এই কারণেই সেই পক্ষীগণ এসে, কন্যাটিকে রক্ষা করছিল। সেই সময় মহর্ষি কণ্ব স্নান করতে নদীতে যাচ্ছিলেন—তিনি দেখলেন মনোহর নির্জন বনের ভিতরে সেই কন্যাটি শুয়ে আছে। আর পক্ষীগণ তাকে বেষ্টন করে অবস্থান করছে। মহর্ষি কন্যাটিকে তুলে আশ্রমে এনে আপন কন্যার মতো লালনপালন করতে লাগলেন। যেহেতু নির্জন বনের মধ্যে পক্ষীগণ একে রক্ষা করেছিল, তাই মহর্ষি কন্যাটির নাম দিলেন ‘শকুন্তলা’। শরীরোৎপাদক, প্রাণরক্ষক ও যাঁর অন্ন ভোজন করে—ধর্মশাস্ত্রে এই তিনজনকে ক্রমিক পিতা বলা হয়।
আশ্রমে আগত ঋষির কাছে মহর্ষি কণ্ব এইভাবে শকুন্তলার কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “ব্রাহ্মণ, এইজন্যই আপনি শকুন্তলাকে আমার কন্যা বলে মনে করুন। অনিন্দ্যসুন্দরী শকুন্তলাও আমাকে এই জন্যই পিতা বলে মনে করে।” শকুন্তলা বললেন, “সেই ঋষির প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি কণ্ব আমার এই জন্মবৃত্তান্ত বলেছিলেন। মহারাজ আপনিও এইভাবেই আমাকে মহর্ষি কণ্বের কন্যা বলে জানবেন। আমি নিজের পিতাকে জানি না বলেই কণ্বকে পিতা বলে মনে করি। আমি আমার জন্মবৃত্তান্ত যেমন শুনেছিলাম, আপনার কাছে তেমনই বললাম।
দুষ্মন্ত বললেন, “কল্যাণী, তুমি যে কাহিনি বললে, তাতে সুস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, তুমি ক্ষত্রিয়ের কন্যা। অতএব তুমি আমার ভার্যা হও; বলো আমি তোমার জন্য কী করব। সুন্দরী, সোনার হার, নানাবিধ বস্ত্র, সুবর্ণনির্মিত দুটি কুণ্ডল, নানাদেশীয় নির্দোষ ও সুন্দর মণি ও রত্ন বক্ষের ভূষণ এবং নানাবিধ মৃগচর্ম—এগুলি এখনই তোমার জন্য এনে দিচ্ছি। আর আজ হতে আমার সমস্ত রাজ্য তোমার হোক; তুমি আমার ভার্যা হও। সুন্দরী, তুমি গান্ধর্ব বিবাহ অনুসারে আমার ভার্যা হও। কেন-না, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব বিবাহই আট প্রকার বিবাহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
শকুন্তলা বললেন, “মহারাজ আমার পিতা ফল নিয়ে আসার জন্য একটু আশ্রমের বাইরে গেছেন; সুতরাং আপনি একটুক্ষণ অপেক্ষা করুন। তিনি এসেই আমাকে আপনার হাতে দান করবেন। আমার পিতা সর্বদাই আমার নিয়ন্তা এবং পরম দেবতা; সুতরাং তিনি আমাকে যাঁর হাতে দেবেন, তিনিই আমার ভর্তা হবেন। বিবাহের পূর্বে পিতা রক্ষা করেন, যৌবনকালে ভর্তা রক্ষা করেন এবং বৃদ্ধকালে পুত্র রক্ষা করে; সুতরাং স্ত্রীলোক কোনও সময়েই স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করতে পারে না। ধার্মিক মহারাজ, আমার তপস্বী পিতাকে অগ্রাহ্য করে অধর্মের অনুসরণপূর্বক কী করে পতি নির্বাচন করি?”
দুষ্মন্ত বললেন, “না না কল্যাণী, তুমি একথা বোলো না। তোমার পিতা মহাতপস্বী এবং ইন্দ্রিয়দমনশীল।” শকুন্তলা বললেন, “ব্রাহ্মণের ক্রোধই অস্ত্র; তাঁরা অন্য অস্ত্র ধারণ করেন না। ইন্দ্র যেমন বজ্ৰদ্বারা অসুর বধ করে থাকেন, ব্রাহ্মণরা তেমন ক্রোধ দ্বারা শত্রু বধ করে থাকেন। অগ্নি তেজ দ্বারা দগ্ধ করেন, সূর্য রশ্মি দ্বারা দগ্ধ করেন। রাজা দণ্ড দ্বারা দগ্ধ করেন আর ব্রাহ্মণ ক্রোধ দ্বারা দগ্ধ করে থাকেন। ইন্দ্র বজ্র দ্বারা অসুর বধ করেন, ব্রাহ্মণ ক্রোধ দ্বারা শত্রু বধ করেন।” দুষ্মন্ত বললেন, “সুন্দরী আমার ইচ্ছা এই যে, তুমি আমাকে ভজন করো। কেন-না, আমি তোমার জন্য এখানে রয়েছি এবং আমার মন তোমার জন্য অত্যন্ত আকুল হয়েছে। দেখো—মানুষ নিজেই নিজের বন্ধু এবং নিজেই নিজের গতি। সুতরাং তুমি ধর্ম অনুসারেই নিজেকে দান করতে পারো। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে বিবাহ আট প্রকার হতে পারে। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। স্বায়ম্ভুব মনু যথাক্রমে এই বিবাহগুলির লক্ষণ বলে গেছেন। সুন্দরী, ব্রাহ্মণের পক্ষে প্রথম চারটি এবং ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রথম ছ’টি বিবাহ প্রশস্ত। আর বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে আসুরবিবাহও অধর্মজনক নয়। কিন্তু প্রথম পাঁচটি বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব ও প্রাজাপত্য—এই তিনটি বিবাহ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট; আর অপর দুটি, আর্য ও আসুর উক্ত তিনটি থেকে নিকৃষ্ট। ব্রাহ্মণ কখনও আসুর বিবাহ করবেন না। আর ব্রাহ্মণাদি সকল বর্ণই কখনও পৈশাচ বিবাহ করবেন না। এই বিধান অনুসারে সকলে বিবাহ করবেন, কেন-না, এই ধর্মের পদ্ধতি। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে খাঁটি গান্ধর্ব বিবাহ বা খাঁটি রাক্ষস বিবাহ অথবা গান্ধর্ব-রাক্ষস উভয় লক্ষণ মিশ্রিত বিবাহ ধর্মসংগত বলে কর্তব্য। সুতরাং এ বিষয়ে তুমি কোনও আশঙ্কা কোরো না; কেন-না, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তোমার প্রতি আমার অনুরাগ জন্মেছে; তুমিও আমার প্রতি অনুরক্ত হয়েছ। সুতরাং তুমি গান্ধর্ব বিবাহ অনুসারে আমার ভার্যা হতে পারো।”
শকুন্তলা বললেন, “পৌরবশ্রেষ্ঠ, যদি আপনার বক্তব্য ধর্মসংগত হয় এবং যদি আমি নিজেকে দান করতে সমর্থ হই, তবে আমার প্রার্থনা শুনুন। আমি এই নির্জন স্থানে যা বলব, আপনি সে বিষয়ে আমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করুন; আমার গর্ভে আপনার যে পুত্র হবে, সে আপনি জীবিত থাকতেই যুবরাজ হবে এবং আপনার পরে মহারাজ হবে। মহারাজ, আপনি যদি আমার এ বক্তব্য স্বীকার করেন, তবে আমিও আপনাকে সত্য বলছি যে, আপনার সঙ্গে আমার সঙ্গম হোক।”
রাজা তখন কোনও বিবেচনা না করেই প্রত্যুত্তর করলেন যে, “তাই হবে এবং আমি তোমাকে আপন রাজধানীতেই নিয়ে যাব। কারণ তুমি রাজধানীতেই বাস করার যোগ্যা; নিতম্বিনী, আমি তোমাকে একথা সত্য বলছি।” এই কথা বলে রাজা গান্ধর্ব বিধানে শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করলেন এবং তাঁর সঙ্গে সহবাস করলেন। তারপর বিদায় নেওয়ার কালে শকুন্তলার বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য বারবার বললেন, “সুন্দরী তোমার জন্য চতুরঙ্গিণী সেনা প্রেরণ করব এবং তাঁরা তোমাকে রাজভবনে নিয়ে যাবে।”
রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে মনে মনে কণ্বমুনির প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে প্রস্থান করলেন। মহাতপস্বী কন্বমুনি ফিরে এসে তাঁর এই গান্ধর্ববিবাহ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, ভাবতে ভাবতে আপন রাজধানীতে ফিরে গেলেন। কিছুকাল পরে মহর্ষি কণ্ব আশ্রমে ফিরলে। শকুন্তলা লজ্জায় তাঁর কাছে গেলেন না। মহাতপস্বী ও দিব্যজ্ঞানী কণ্ব দিব্যচক্ষুতে সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। শকুন্তলার বিষয় বুঝতে পেরে, সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কল্যাণী, তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আজ নির্জনে যে পুরুষসংসর্গ করেছ, তা তোমার ধর্মনাশক হয়নি। কেন-না, কামী পুরুষ নির্জনে বিনা মন্ত্রে কামার্ত রমণীর যে পাণিগ্রহণ করে, তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সেই বিবাহই শ্রেষ্ঠ। শকুন্তলা, তুমি যে অনুরক্ত পুরুষকে পতি বলে স্বীকার করেছ তিনি ধার্মিক, উদারচেতা ও পুরুষশ্রেষ্ঠ দুষ্মন্ত। জগতে সর্বাপেক্ষা বলবান ও উদারচেতা তোমার একটি পুত্র জন্মাবে, সে এই সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর হবে। তোমার সেই সম্রাট পুত্র শত্রুকে আক্রমণ করতে গেলে, তার সৈন্যদের কেউ প্রতিহত করতে পারবে না।”
তারপর শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের কাঁধ থেকে সমিধ, কুশ ও ফল নামিয়ে রেখে তাঁর চরণ ধুইয়ে দিলেন। মহর্ষি বিশ্রাম গ্রহণ করলে, শকুন্তলা তাঁকে বললেন, “আমি স্বেচ্ছায় পুরুষশ্রেষ্ঠ দুষ্মন্ত রাজাকে পতিত্বে বরণ করেছি। অতএব পিতা আপনি মন্ত্রিবর্গ সমেত রাজা দুষ্মন্তের প্রতি অনুগ্রহ করুন।” কণ্ব বললেন, “শকুন্তলা আমি তোমার দুষ্মন্তের প্রতি প্রসন্নই আছি। অতএব কল্যাণী, তুমি আমার কাছ থেকে অভীষ্ট বরগ্রহণ করো।” শকুন্তলা দুষ্মন্তের হিত কামনা করে, পুরুবংশের ধার্মিকতা ও চিরস্থায়ী রাজত্ব বর হিসাবে চাইলেন।
দুষ্মন্ত শকুন্তলার কাছে প্রতিজ্ঞা করে রাজধানীতে ফিরে গেলেন। সেইদিন থেকে পুরো তিন বৎসর কেটে গেলে, শকুন্তলা পরম সুন্দর একটি পুত্র প্রসব করলেন। সেই দুষ্মন্তনন্দনের কান্তি অগ্নির মতো উজ্জ্বল ছিল এবং তাঁর শরীরের তেজও অসাধারণ ছিল। ধার্মিক শ্রেষ্ঠ কণ্ব যথাবিধানে সেই ক্রমাগত বড় হয়ে ওঠা বালকটির জাতকর্মাদি সংস্কার করলেন। ক্রমে সেই বালকটির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শুভ্রবর্ণ দন্ত জন্মাল। শরীর সিংহের মতো দৃঢ় হয়ে উঠল, আকৃতি দীর্ঘ হতে লাগল, হাতের মধ্যে চক্রচিহ্ন দেখা দিল, কান্তি মনোহর হয়ে উঠল, মাথাটি অপেক্ষাকৃত বড় হল এবং শরীর বলবান হয়ে লাগল। এইভাবে বালকটি কণ্বের আশ্রমেই বড় হতে লাগল। বালকটির বয়স যখন ছয়, তখনই সে অসাধারণ বলবান হয়ে উঠল। সে তখন সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ, মহিষ ও হস্তী প্রভৃতি ধরে এনে আশ্রমের নিকটবর্তী বৃক্ষে বেঁধে রাখতে আরম্ভ করল। আবার কখনও সে বৃক্ষে বা পর্বতে আরোহণ করত, কখনও সিংহ প্রভৃতি জন্তুকে ধরে এনে নির্যাতন করত, কখনও বা ব্যাঘ্র প্রভৃতি জন্তুর সঙ্গে খেলা করতে করতে দৌড়োত। সকল জন্তুকে ইচ্ছামতো দমন করত বলে আশ্রমবাসীরা তাঁর নাম রাখল ‘সর্বদমন’।
সেই বালক ক্রমে তেজস্বী ও শক্তিশালী হয়ে উঠল। তাঁর অবস্থা, শক্তি ও অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে মহর্ষি কণ্ব শকুন্তলাকে বললেন, “এর যুবরাজ হওয়ার সময় এসেছে।” তারপর শিষ্যগণকে বললেন, “শিষ্যগণ, তোমরা সর্বপ্রকারে প্রশংসনীয়া এই শকুন্তলাকে পুত্রের সঙ্গে তপোবন থেকে দুষ্মন্তের গৃহে রেখে এসো। কেন-না, স্ত্রীলোক দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে তার চরিত্র, ধর্ম ও যশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বন্ধুজনের তা কখনোই অভিপ্রেত হতে পারে না। অতএব, তোমরা বিলম্ব কোরো না। অবিলম্বে একে নিয়ে যাও।”
“তাই হোক, এই কথা বলে তেজস্বী শিষ্যগণ, শকুন্তলাকে পুত্রসহ নিয়ে হস্তিনানগরের দিকে যাত্রা করল। দুষ্মন্তগতস্বভাবা শকুন্তলা পদ্মনয়ন ও দেববালকের তুল্য পুত্রটিকে নিয়ে হস্তিনানগরে উপস্থিত হলেন। দ্বাররক্ষকেরা রাজার কাছে গিয়ে শকুন্তলার আগমন সংবাদ জানাল এবং রাজার অনুমতি পেয়ে নবোদিত সূর্যের মতো সেই বালকটি ও শকুন্তলাকে রাজার কাছে নিয়ে গেল। কণ্ব-শিষ্যরা শকুন্তলাকে জানিয়ে আশ্রমের দিকে ফিরে চললেন। শকুন্তলা রাজার কাছে উপস্থিত হয়ে, যথানিয়মে তাঁকে অভিবাদন করে বললেন, “মহারাজ আপনি আমার পুত্রটিকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করুন। আপনি দেবতুল্য এই পুত্রটিকে আমার গর্ভে উৎপাদন করেছিলেন। সুতরাং পূর্বকৃত শপথ অনুযায়ী এই পুত্রের সঙ্গে ব্যবহার করুন। পূর্বে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে আমার সঙ্গে সঙ্গমের সময়ে আপনি যে শপথ করেছিলেন, তা এখন স্মরণ করুন।”
রাজা শকুন্তলার বক্তব্য শুনে, সমস্ত বৃত্তান্ত স্মরণ করেও বললেন, “আমার তো এ জাতীয় কোনও ঘটনা স্মরণ হচ্ছে না! দুষ্ট তপস্বিনী! তুমি কার লোক? পত্নী বলে তোমার সঙ্গে কখনও ধর্ম, অর্থ বা কামের কোনও ঘটনা ঘটেছিল, তা আমার মনে পড়ছে না।
রাজা এই কথা বললে দীনা শকুন্তলা অত্যন্ত লজ্জায় মাটিতে যেন মিশে গেলেন এবং দুঃখে তাঁর চৈতন্য যেন লোপ পেল। তিনি একটি স্তম্ভের মতো স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ক্রোধ ও অধীরতাবশত তাঁর দুটি চোখ তাম্রবর্ণ হল, ওষ্ঠযুগল কাঁপতে লাগল এবং কটাক্ষ দ্বারা তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন। এই অবস্থায় তিনি রাজার প্রতি বক্রদৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। ক্রোধ বর্জন করে তপোবনে যে তেজ অর্জন করেছিলেন, যে তেজের ফলে তার ক্রোধ উপস্থিত হয়েছিল, সেই তেজ তিনি সংবরণ করলেন। তারপর তিনি একটু কাল চিন্তা করে দুঃখিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে রাজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মহারাজ মনে থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃত লোকের মতো আপনি বলছেন যে, আমার স্মরণ হচ্ছে না। আমি সত্য না মিথ্যা বলছি, আপনার হৃদয়ই তা জানে। সুতরাং সাধু সাক্ষীর মতো সত্যকথা বলুন, মিথ্যা বলে আত্মাকে অবজ্ঞার পাত্র করবেন না। যে লোক নিজে অন্যরূপ আর আত্মাকে অন্যরূপ বলে মনে করে সে তো আত্মাপহারী চোর। সুতরাং সে লোক কোন পাপ না করেছে? মহারাজ, আপনি নিজেকে প্রচণ্ড জ্ঞানী মনে করেন; অথচ আপনারই হৃদয়ে যে অনাদি জীবাত্মা রয়েছেন, তা আপনি জানেন না। কারণ যে জীবাত্মা পাপকার্যের সংবাদ জানতে পারেন, তাঁর কাছেই আপনি পাপ করছেন। মানুষ নির্জনে পাপ করে ভাবে যে, আমার পাপ কেউ জানতে পারছে না; কিন্তু তার জীবাত্মা ও দেবগণ তা জানতে পারেন। আর সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, পৃথিবী, জল, মন, যম, দিন, রাত্রি, প্রাতঃসন্ধ্যা, সায়ংসন্ধ্যা এবং ধর্ম— এরা মানুষের সব বৃত্তান্ত জানতে পারছেন। কর্মের সাক্ষী ও হৃদয়বর্তী জীবাত্মা যে ব্যক্তির সৎকর্ম দ্বারা সন্তুষ্ট থাকেন, স্বয়ং যমই তার পাপ দূর করে দিয়ে থাকেন। আর, সেই জীবাত্মাই দুষ্কর্ম দ্বারা যে দুরাত্মার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন, যমই সেই পাপাত্মাকে দারুণ যাতনা দিয়ে থাকেন।
“যে লোক আপনিই আপনাকে অবজ্ঞা করে মুখে অন্যরূপ বুঝিয়ে দেয়, দেবতারা তার মঙ্গল করেন না। কেন-না, তার আত্মাই তো তার কাছে প্রমাণ নয়। আমি পতিব্রতা, সুতরাং, আমি নিজে উপস্থিত হয়েছি বলে আমার প্রতি অবজ্ঞা করবেন না। কারণ, ভার্যা পতির কাছে নিজে উপস্থিত হলেও আদরের যোগ্য। তবুও আপনি যে আদরের সঙ্গে আমাকে গ্রহণ করছেন না, তা অত্যন্ত অনুচিত হচ্ছে। আপনি সভার মধ্যে নীচ নারীর মতো আমাকে উপেক্ষা করছেন কেন? মনে হচ্ছে, আমি শূন্যে রোদন করছি, কারণ, আপনি আমার কথা শুনছেন না। আমি আপনার কাছে থাকব বলেই প্রার্থনা করছি। এ অবস্থায় আপনি যদি আমার প্রার্থনা পূরণ না করেন, আপনার মস্তক শতধাবিদীর্ণ হয়ে যাবে। পতি ভার্যার ভিতরে প্রবেশ করে, পুনরায় পুত্রাদিরূপে জন্মগ্রহণ করেন, সেই জন্যই ভার্যার নাম হয়েছে ‘জায়া’, এ কথাই প্রাচীন পণ্ডিতরা বলে থাকেন। বৈদিক সংস্কারসম্পন্ন পুরুষের যে তেজ আছে, তাই সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করে এবং সেই সন্তানই আবার সন্তানের জন্ম দিয়ে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করে। ‘পুত’ নামক নরক থেকে পিতাকে রক্ষা করে বলে স্বয়ং ব্রহ্মাই তনয়ের নাম রেখেছেন ‘পুত্র’। তিনিই ভার্যা, যিনি গৃহকার্যে নিপুণ; তিনি ভার্যা, যাঁর পুত্র জন্মেছে; তিনি ভার্যা, যিনি পতিকে প্রাণের মতো ভালবাসেন এবং তিনি ভার্যা, যিনি পতিব্রতা হন। ভার্যা পুরুষের শরীরের অর্ধাংশ, ভার্যা সর্বপ্রধান সখা! ভার্যা ধর্ম, অর্থ ও কামের প্রধান কারণ এবং ভার্যাই পুরুষের উদ্ধারের প্রধান হেতু। যাদের ভার্যা আছে, তাঁরা যজ্ঞাদিক্রিয়ার অধিকারী, তারাই গৃহস্থ, তারাই আমোদ করতে পারে এবং তারাই সর্বত্র শোভা পেয়ে থাকে। প্রিয়ভাষিণী ভার্যা নির্জনে বন্ধুস্বরূপ, ধর্মকার্যে পিতৃস্বরূপ এবং রোগপীড়ায় মাতৃস্বরূপ। যে লোক সংসাররূপ দুর্গম পথের পথিক, তাঁর পক্ষে ভার্যা পরম বিশ্রাম স্থান এবং যার ভার্যা আছে সেই বিশ্বাসের পাত্র; সুতরাং সংসারক্ষেত্রে ভার্যাই প্রধান অবলম্বন। পতি মৃত্যুর পর যখন একাকী ভয়ংকর দুর্গম পথ দিয়ে পরলোকগমন করতে থাকেন, তখন পতিব্রতা ভার্যাই তাঁর অনুসরণ করেন। ভার্যা পূর্বে মৃত্যুমুখে পতিত হলে তিনি পরলোকে গিয়ে পতির জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকেন; আর, পতি পূর্বে মৃত হলে সাধ্বী ভার্যা তাঁর অনুগমন করেন।
“মহারাজ ভর্তা ইহলোকেও ভার্যাকে পান, পরলোকেও ভার্যাকে পেয়ে থাকেন; এই কারণেই মানুষ বিয়ে করে। জ্ঞানীগণ বলে থাকেন—ভর্তা, ভার্যার গর্ভে আপনাকে আপনিই পুত্ররূপে উৎপাদন করে থাকেন; সুতরাং তিনি পুত্রবতী ভার্যাকে মাতার মতো দেখবেন। দর্পণে যেমন নিজ মুখের প্রতিবিম্ব পড়ে, ভার্যাতেও তেমন পতি নিজেই নিজেকে পুত্ররূপে উৎপাদন করে থাকেন। সুতরাং, ধার্মিক লোক যেমন স্বর্গলাভ করে আনন্দ লাভ করেন, তেমনই পিতাও পুত্ৰমুখ দেখে আনন্দ লাভ করেন। ঘর্মাক্ত লোক যেমন জলে স্নান করে আনন্দ অনুভব করে, তেমনই দুঃখিত ও পীড়িত লোক পত্নীর সহিত মিলিত হয়ে আনন্দ লাভ করেন। রতি, প্রীতি ও ধর্ম— এ সমস্তই পত্নীর অধীন বুঝে মানুষ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেও স্ত্রীলোকের অপ্রিয় কার্য করবে না। স্ত্রীলোকই নিজের পবিত্র ও চিরন্তন উৎপত্তি স্থান। স্ত্রীলোক ব্যতীত ঋষিদেরও সন্তান সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। যখন ধূলিধূসরিত পুত্রটি গিয়ে পিতার অঙ্গ আলিঙ্গন করে, তখন তার থেকে অধিক সুখ জগতে আর কী থাকে? এই পুত্রটি নিজে উপস্থিত হয়েছে, আপনার কোলে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা করছে, করুণ নয়নে আপনার দিকে চাইছে, এই অবস্থায় আপনি কেন একে অবজ্ঞা করছেন? অতি ক্ষুদ্র প্রাণী পিপীলিকারাও আপন ডিমগুলিকে প্রতিপালন করে, পরিত্যাগ করে না— আপনি ধর্মজ্ঞ অথচ পুত্রকে প্রতিপালন করবেন না?
“সূক্ষ্ম বস্ত্র, সুন্দরী স্ত্রী এবং শীতল জলের স্পর্শও শিশুপুত্রের আলিঙ্গনের সুখ দিতে পারে না। দ্বিপদ প্রাণীর মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, চতুষ্পদ প্রাণীর মধ্যে গোরু শ্রেষ্ঠ, গুরুজনের মধ্যে পিতা শ্রেষ্ঠ আর সুখস্পর্শ বস্তুর মধ্যে পুত্ৰই শ্রেষ্ঠ। এই প্রিয়দর্শন পুত্রটি গিয়ে আলিঙ্গন করে আপনাকে স্পর্শ করুক। পুত্ৰম্পৰ্শ অপেক্ষা অধিক সুখস্পর্শ জগতে নেই। মহারাজ, গর্ভধারণের পর থেকে তিন বৎসর পূর্ণ হলে, আমি এই পুত্রটিকে প্রসব করেছিলাম এবং এই পুত্রের প্রসবের পর আমি আপনার বিরহের কষ্ট কিছু পরিমাণে বিস্মৃত হয়েছিলাম। নরনাথ, এই পুত্র প্রসবের পরে আমার প্রতি এই দৈববাণী হয়েছিল, ‘এই পুরুবংশীয় বালকটি ভবিষ্যতে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে।’ মহারাজ আমি মনে করি—মানুষ স্থানান্তরে যাবার সময়ে স্নেহবশত পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে তার মস্তকাঘ্রাণ করে অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করে। মহারাজ আপনার জানা আছে জাতকর্ম করার সময়ে ব্রাহ্মণেরা এই বেদমন্ত্র পাঠ করে থাকেন, ‘পুত্র! তুমি আমার প্রত্যেক অঙ্গ থেকে, বিশেষত হৃদয় থেকে জন্মেছ; সুতরাং তুমি এখন আমার আত্মা পুত্র নাম ধারণ করেছ, একশত বছর বেঁচে থাকো। বৃদ্ধকালে আমার ভরণপোষণ করা তোমার অধীন হবে এবং তোমার বংশ অক্ষয় হবে। অতএব পুত্র, তুমি অত্যন্ত সুখী হয়ে একশত বৎসর জীবিত থাকো।’ মহারাজ এই বালকটি আপনার অঙ্গ থেকেই জন্মেছে; সুতরাং, একটি পুরুষ থেকে আর একটি পুরুষ উৎপন্ন হয়েছে; অতএব সরোবরের নির্মল জলে যেমন আপন প্রতিবিম্ব দেখে, তেমন এক আত্মাই পুত্ররূপে দুই হয়েছে দেখুন।
“মহারাজ আপনি পূর্বে মৃগয়া করবার জন্য বনে গিয়েছিলেন, তখন একটি মৃগ আপনাকে আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিল, সেই অবস্থায় আপনি মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে গিয়ে কুমারী অবস্থায় আমাকে লাভ করেন। উর্বশী, পূর্বচিত্তি, সহজন্যা মেনকা, বিশ্বাচী ও ঘৃতাচী—এই ছ’জন অপ্সরাশ্রেষ্ঠা। তাদের মধ্যে আবার প্রধান অপ্সরা ব্রহ্মার কন্যা মেনকা স্বর্গ থেকে ভূমণ্ডলে এসে বিশ্বামিত্র থেকে আমাকে উৎপাদন করেন। সেই নিষ্ঠুর স্বভাবা মেনকা হিমালয়ের কোনও সমতল ভূমিতে আমাকে প্রসব করেন এবং তখনই পরের সন্তানের ন্যায় আমাকে পরিত্যাগ করে চলে যান। আমি জানি না পূর্বজন্মে আমি কী গুরুতর পাপ করেছিলাম, যার ফলে পিতামাতা আমাকে জন্মের পরেই পরিত্যাগ করেছিলেন আর এখন আপনিও আমাকে পরিত্যাগ করছেন। তবে, ইচ্ছা করলে এবং আপনি আমাকে পরিত্যাগ করলে, আমি নিজের আশ্রমে চলে যাব। কিন্তু এই বালকটি আপনারই পুত্র, সুতরাং আপনি একে পরিত্যাগ করতে পারেন না।”
দুষ্মন্ত বললেন, “শকুন্তলা তোমার গর্ভে যে আমার পুত্র জন্মেছিল, তা আমার স্মরণ হচ্ছে না। স্ত্রীলোকেরা সাধারণত মিথ্যা কথাই বলে, সুতরাং তোমার কথা কে বিশ্বাস করবে? তোমার জননী বেশ্যা মেনকা অত্যন্ত নির্দয়া; কেন-না সে তোমাকে হিমালয়ের উপরে বাসি ফুলের মতো ফেলে দিয়েছে। আর মূলত ক্ষত্রিয় অথচ ব্রাহ্মণ হবার জন্য লোভী এবং কামাতুর সেই বিশ্বামিত্রও নির্দয়। মেনকা অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং তোমার পিতা বিশ্বামিত্রও মহর্ষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; তুমি তাঁদের সন্তান হলে কী করে। তুমি বেশ্যার মতো কথা বলছ। এই অবিশ্বাস্য কথা বলতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? বিশেষত আমার কাছে। অতএব দুষ্ট তাপসী, তুমি চলে যাও। সেই কোপনস্বভাব বিশ্বামিত্রই বা কোথায় এবং সেই অপ্সরা মেনকাই বা কোথায়, আর এই দীনা ও তাপসীবেশিনী তুমিই বা কোথায়? তোমার এই বালকটি এত অল্প কালের মধ্যে বিশাল শরীর, অত্যন্ত বলবান এবং শালবৃক্ষের মতো এত দীর্ঘ হল কী করে?
“তোমার মাতা বেশ্যা বলে অত্যন্ত নিকৃষ্টা, তুমিও বেশ্যার মতোই কথা বলছ। তারপর, সেই স্বৈরিণী মেনকাও কামান্ধ হয়েই তোমার জন্ম দিয়েছিল। সুতরাং তোমার জন্মও অত্যন্ত নিকৃষ্ট। তাপসী, তুমি বিশ্বাসের অযোগ্য কথা বলছ। আমি তোমাকে চিনি না; সুতরাং তুমি চলে যাও।”
শকুন্তলা বললেন, “রাজা আপনি পরের সরষের পরিমাণে ছিদ্র দেখে নিন্দা করছেন, কিন্তু নিজের বেলফলের মতো ছিদ্রগুলি দেখেও দেখছেন না। মেনকা বেশ্যা হলেও দেবতার মধ্যে গণ্যা। এমনকী দেবতারা মেনকা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। অতএব দুষ্মন্ত, আপনার জন্ম থেকে আমার জন্ম উৎকৃষ্ট। আপনি কেবল ভূতলেই বিচরণ করতে পারন, আর আমি ভূতল ও আকাশ— দুই স্থানেই বিচরণ করতে পারি। সুতরাং সুমেরু পর্বত ও সরষের দানার মধ্যে যে প্রভেদ, আপনার ও আমার মধ্যে সেই প্রভেদ। আমি ইচ্ছানুসারে ইন্দ্র, কুবের, যম ও বরুণের গৃহে যাতায়াত করতে পারি। অতএব আপনি আমার ক্ষমতা অনুভব করুন। মহারাজ এবার আমি যা বলব, সেই সত্যগুলি আপনাকে শুনতে হবে। কথাগুলি আপনাকে জানাবার জন্য, কোনও বিদ্বেষের বশে নয়, অতএব আমাকে ক্ষমা করবেন।
“কুৎসিত লোকেরা দর্পণে যতক্ষণ আপনার মুখ দর্শন না করে, ততক্ষণই আপনাকে সুন্দর বলে মনে করে। কিন্তু যখন দর্পণে সে আপনার মুখ দেখে, তখন অন্যের ও নিজের পার্থক্য অনুভব করে। অত্যন্ত সুন্দর লোক কাউকে অবজ্ঞা করেন না, আর অধিকভাষী ও কটুভাষী লোক নিন্দা করে পরপীড়ক হয়ে থাকে। শূকর যেমন ফুল ফেলে বিষ্ঠা গ্রহণ করে, তেমনই মূর্খেরা অন্যের ভাল ও মন্দ কথার মধ্যে মন্দ কথাটিই গ্রহণ করে। আর বিজ্ঞ লোক, অন্যের ভাল-মন্দ দুই কথার মধ্যে কেবলমাত্র ভাল কথাটিই গ্রহণ করে। হংস যেমন জল মেশানো দুগ্ধ থেকে কেবলমাত্র দুগ্ধই গ্রহণ করে, ভাল লোকেরাও তাই করে। সজ্জন অন্যের নিন্দা করে দুঃখিত হন, দুর্জন অন্যের নিন্দা করে সুখী হন। পণ্ডিতেরা বৃদ্ধদের অভিবাদন করে সুখী হন, মূর্খেরা সজ্জনের প্রতি আক্রোশ করে সুখী হয়। প্রাজ্ঞ লোকেরা পরের দোষ জেনেও তার আলোচনা না করায় সেই ব্যাপারে অনভিজ্ঞের মতো থেকে সুখে জীবনযাপন করেন। আর মূর্খেরা পরের দোষ অনুসন্ধান করতে থেকে আকুল হয়ে জীবনযাপন করে এবং সজ্জনেরা যেখানে দুর্জনদের নিন্দা করেন, সেইখানে আবার দুর্জনেরাও সজ্জনের নিন্দা করেন। জগতের সর্বাপেক্ষা হাস্যকর বিষয় এই যে দুর্জন মানুষ সজ্জনের নিন্দা করে। আস্তিকেরা তো বটেই, নাস্তিক লোকেরাও ক্রুদ্ধ সর্পতুল্য সত্যভ্রষ্ট লোককে ভয় করে থাকে। যে ব্যক্তি নিজেই পুত্র উৎপাদন করে, তা অস্বীকার করে, দেবতারা তার সম্পদ নষ্ট করেন এবং সে স্বর্গলাভ করতে পারে না। পিতৃপুরুষেরা বলেন— পুত্রই বৃদ্ধকালে পিতার দেহরক্ষার, চিরদিন বংশরক্ষার এবং সমস্ত ধর্মরক্ষার প্রধান উপায়; সুতরাং পুত্রকে ত্যাগ করবে না। মনু পাঁচ প্রকার পুত্রের কথা বলেছেন— নিজের স্ত্রীর গর্ভে বা অন্যের স্ত্রীর গর্ভে নিজের উৎপাদিত, লব্ধ, ক্রীত, পালিত এবং পুত্রিকাপুত্র। পুত্র ধর্ম ও কীৰ্তিজনক, মনের আনন্দবর্ধক এবং ধর্মের ভেলা হয়ে নরক থেকে পিতৃলোকের পরিত্রাণকারক। মহারাজ আপনি আত্মা, সত্য এবং অপরাপর ধর্মের রক্ষায় প্রবৃত্ত রয়েছেন। সুতরাং আপনি পুত্রকে ত্যাগ করতে পারেন না এবং কপটতাও করতে পারেন না। শত কূপ খনন করার থেকে একটি দিঘি খনন শ্রেষ্ঠ, শত দিঘি খনন করা থেকে একটি যজ্ঞ করা শ্রেষ্ঠ, শত যজ্ঞ করার থেকে একটি পুত্র উৎপাদন করা শ্রেষ্ঠ এবং শত পুত্র উৎপাদন করা থেকে একটি সত্য পালন করা শ্রেষ্ঠ। দাঁড়িপাল্লার একদিকে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং অন্যদিকে একটি সত্য তুলে একবার পরীক্ষকেরা মেপেছিলেন; তাতে তাঁরা দেখেছিলেন সহস্র অশ্বমেধ থেকে একটি সত্যই অধিক হয়ে গিয়েছে। সমস্ত বেদ অধ্যয়ন, সমস্ত তীর্থে স্নান ও সত্য বাক্য—অন্যগুলি সব মিলিয়েও সত্য বাক্যের সমান হতে পারে না। সত্যের তুল্য ধর্ম নেই এবং সত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্তু নেই। আবার, এই পৃথিবীর সব থেকে ভয়ংকর বস্তু মিথ্যা। সত্যই পরম ব্রহ্ম এবং সত্যই পরম সদাচার। মহারাজ সত্য ত্যাগ করবেন না, আপনার হৃদয়ে চিরকাল সত্য সংলগ্ন থাকুক। পক্ষান্তরে, আপনি যদি মিথ্যাতেই আসক্ত হয়ে পড়েন এবং আমার কথায় বিশ্বাস না করেন, তবে আমি নিজেই চলে যাচ্ছি। আপনার মতো লোকের সঙ্গে আমার সম্মিলন সম্ভব হবে না। দুষ্মন্ত, তোমার সাহায্য ব্যতীতও আমার পুত্র, হিমালয়ালংকৃত চতুঃসমুদ্রবেষ্টিত এই পৃথিবী শাসন করবে।” এই বলে শকুন্তলা পুত্রের সঙ্গে সেই রাজসভা ত্যাগ করলেন।
মন্ত্রী, অমাত্য, পুরোহিত পরিবেষ্টিত সেই রাজার প্রতি তখন দৈববাণী হল, “দুষ্মন্ত! মাতা তো কেবল ভস্ত্রা (জাঁতা) স্বরূপ, পুত্র পিতারই বটে, কারণ পিতাই পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। দুষ্মন্ত এই পুত্রটিকে রেখে ভরণপোষণ করো, শকুন্তলার প্রতি অবজ্ঞা কোরো না। কারণ, নরনাথ সন্তানোৎপাদক পুত্র পিতাকেই যমালয় থেকে উদ্ধার করে। শকুন্তলা সত্যই বলেছে, তুমিই এই পুত্রটির জনক। বিধাতা পিতার শরীর দুই ভাগ করে পুত্র সৃষ্টি করেন, আর মাতা তাকে প্রসব করেন। অতএব দুষ্মন্ত! শকুন্তলার গর্ভজাত পুত্রটিকে রেখে ভরণপোষণ করো। কারণ পিতা জীবিত পুত্রকে পরিত্যাগ করে যে জীবনধারণ করেন, তা তাঁর পক্ষে অমঙ্গল। মহারাজ এই পুত্র তোমার ঔরসে শকুন্তলার গর্ভে জন্মেছে; সুতরাং এই মহাত্মাকে রেখে ভরণপোষণ করো। যখন আমাদের অনুরোধেও একে রেখে তোমার ভরণপোষণ করতে হবে, তখন এই পুত্রটির নাম ‘ভরত’ হিসাবে প্রসিদ্ধ হোক।”
রাজা দুষ্মন্ত দেবগণের সেই বাক্য শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পুরোহিত ও মন্ত্রীবর্গকে এই কথা বললেন—“আপনারা এই দেবদূতের বাক্য শ্রবণ করুন, আমি নিজেও এই বালকটিকে নিজের পুত্র বলেই জানি। কিন্তু আমি যদি কেবল শকুন্তলার কথাতেই এই বালকটিকে পুত্র বলে গ্রহণ করি, তবে লোকের আশঙ্কা হবে যে, এ রাজার ঔরস পুত্র না হতেও পারে।”
তখন দুষ্মন্ত সেই আকাশবাণী দ্বারা সেই বালকটিকে নিজের ঔরস পুত্র বলে প্রমাণ করিয়ে নিয়ে, সহাস্যমুখে এবং আনন্দিত চিত্তে তাকে পুত্র বলে গ্রহণ করলেন। তারপর রাজা আনন্দিত ও স্নেহপরায়ণ হয়ে তখনই সেই পুত্রটির উপনয়ন প্রভৃতি পিতার সমস্ত কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করলেন। তখন ব্রাহ্মণগণ প্রশংসা করতে লাগলেন এবং বন্দিগণ স্তব করতে থাকল, এই অবস্থায় রাজা সস্নেহে পুত্রটির মস্তকাঘ্রাণ.করে আলিঙ্গন করলেন। রাজা সেই পুত্রসংস্পর্শের কারণে পরম আনন্দ লাভ করলেন এবং ধর্মানুসারে শকুন্তলাকে ভার্যা বলে গ্রহণ করে বিশেষ সম্মানিত করলেন এবং রাজা অনুনয় সহকারে এই কথাগুলি শকুন্তলাকে বললেন—“দেবী, আমি লোকের অনুপস্থিতিতে ও অসাক্ষাতে তোমার সঙ্গে এই সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলাম। সেইজন্য আমি বিশেষ বিবেচনা করেই তোমার নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্য এইরূপ ব্যবহার করেছি। না হলে, লোকে মনে করত যে, স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক চপলতাবশতই তোমার সঙ্গে আমার সঙ্গম হয়েছিল। আর আমি বিশেষ বিবেচনা করে পূর্বেই স্থির করেছিলাম যে, এই পুত্রটিকে রাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে এবং প্রিয়তমে! বিশাল নয়নে! কল্যাণী! তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে আমার প্রতি যে সকল অপ্রিয় বাক্য বলেছ, আমি সে সমস্তই ক্ষমা করেছি।”
রাজর্ষি দুষ্মন্ত প্রিয়তমা মহিষী শকুন্তলাকে এই বলে, উপযুক্ত বস্ত্র, অন্ন ও পানীয় দ্বারা তাঁকে সম্মানিত করলেন।
দুষ্মন্ত ততোরাজা পুত্রং শাকুন্তলং তদা।
ভরতং নামতঃ কৃত্বা যৌবরাজ্যেইভ্যষেচয়ৎ ॥ আদি: ৮৮-১২৬ ॥
“তারপর, দুষ্মন্ত শকুন্তলার পুত্রটির ‘ভরত’ নাম করে, তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।” মহারাজ দুষ্মন্ত পূর্ণ একশত বৎসর রাজত্ব করার পর বনে গমন করেন, বনেই দেহত্যাগের পর স্বর্গলাভ করেন। ভরত দুষ্মন্তের সিংহাসনে আরূঢ় হন। তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশালী দিগ্বিজয়ী সম্রাট ছিলেন। তিনি যমুনার তীরে থেকে শত অশ্বমেধ, সরস্বতীর তীরে থেকে তিনশত অশ্বমেধ এবং গঙ্গার তীরে থেকে চারশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। শকুন্তলার গর্ভজাত দুষ্মন্তনন্দন ভরত থেকেই ভরতবংশের যশোরাশি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
*
কাহিনিটি অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে লিখতে হল। কারণ, এই কাহিনির সঙ্গে ভারতবর্ষের পাঠক সমাজ পরিচিত নন। মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ নাটক এর প্রত্যক্ষ কারণ। মহাকবি কালিদাস মহর্ষি ব্যাস রচিত কাহিনির চরিত্র ও পরিণতি অবিকৃত রেখে কাহিনি সম্পূর্ণ নতুনভাবে রচনা করেন। তাতে অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত নাটকটি নিয়ন্ত্রণ করেন কল্পিত মহর্ষি দুর্বাসার চরিত্র, সম্ভবত রাজা দুষ্মন্তের চরিত্র কলঙ্ক দূর করতেই কালিদাস দুর্বাসার অভিশাপ কল্পনা করেছিলেন। কালক্রমে কালিদাসের নাট্যকাহিনিটি ভারতবর্ষে অধিক পরিচিত হয় এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনায় কালিদাসকেই আকর গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে শকুন্তলার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন, তা কালিদাসের শকুন্তলা অবলম্বনেই। সে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র ভারতীয় গণ্ডির মধ্যেই থেমে থাকেননি। শেকসপিয়ারের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের নায়িকা মিরান্দার সঙ্গে শকুন্তলার অসাধারণ তুলনাও করেছেন। ইয়োরোপের কবিকুলগুরু, জার্মান কবিসম্রাট গ্যেটে একটি শ্লোক লিখে শকুন্তলাকে বিশ্বব্যাপ্ত করে গিয়েছেন। গ্যেটে লিখেছিলেন, “কেউ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, কেউ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখতে চায়, তবে শকুন্তলায় তা পাবে।” এ শকুন্তলা কিন্তু কালিদাসের, ব্যাসদেবের নয়।
আবার গ্যেটের সেই শ্লোকটির বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও অপরূপা করে তুলেছেন শকুন্তলাকে। ফলে মূল শকুন্তলা পাঠকের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেল। ব্যাসদেবের শকুন্তলা আশ্রম পালিতা কিন্তু অনভিজ্ঞ নন। তপোবনের দীর্ঘ তপশ্চর্যা তাঁর মধ্যে সংযমও এনে দিয়েছে। রাজা দুষ্মন্তের বিবাহপ্রস্তাব তিনি অনুমোদন করেছেন, কারণ বিবাহরীতি তাঁর অজানা নয়। আশ্রমপালিতা হলেও তিনি মূলত রাজকন্যা। কিন্তু গান্ধর্ব রীতিতে দুষ্মন্তের কাছে আত্মসমর্পণের পূর্বে তাঁর শর্তটি স্মরণীয়। এই শর্ত কালিদাসের শকুন্তলা কোনওদিনও দিতে পারতেন না। তাঁর গর্ভস্থ শিশুকে যৌবরাজ্য দিতে হবে এবং রাজার অবর্তমানে তিনিই রাজত্ব পাবেন—এই শর্তে শকুন্তলা আত্মসমর্পণ করেছেন। আবার রাজসভায় উপস্থিত হয়ে তিনি রাজাকে যে বক্তব্য বলেছেন, তা কেবলমাত্র শাস্ত্র অনুমোদিতই নয়, জীবনের অবশ্য পালনীয় ধর্ম। ভার্যা, জায়া এবং পুত্রের স্থান মানুষের জীবনে কতদূর প্রসারিত শকুন্তলা বিশদভাবে তা বুঝিয়েছেন। জীবনে সত্যপালনের প্রয়োজনীয়তা, মিথ্যায় কতদূর ক্ষতি হতে পারে তা শকুন্তলা দুষ্মন্তকে শিক্ষা দিয়েছেন।
ব্যাসদেবের শকুন্তলা অবলা নারী নন—সন্তানের সামর্থ্যের উপর তাঁর বিশ্বাস অটুট। তিনি মহারাজা দুষ্মন্তকে অনায়াসে বলতে পেরেছেন যে, দুষ্মন্তের সহায়তা ব্যতীত ভরত চতুঃসমুদ্রবেষ্টিত ধরণীর সম্রাট হবে। ব্যাসদেবের শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে দাবি জানিয়েছেন, আপন সততায়, অপাপবিদ্ধতায়।
ব্যাস-রচিত দুষ্মন্ত-শকুন্তলা কাহিনি পড়তে পড়তে মনে হয়, তিনি কেবলমাত্র ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। কোনও চরিত্রকে উজ্জ্বল ও মলিন করে আঁকার কোনও অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি ইতিহাসের বর্ণনা দিচ্ছেন। ইতিহাস নিজেই তাঁর চরিত্রের ভালত্ব মন্দত্ব স্থির করে দেবে। ভরতবংশের প্রতিষ্ঠার নিরপেক্ষ ইতিহাস বর্ণনা করছেন তিনি। ভরতবংশের প্রতিষ্ঠা মহাভারতের দুর্লভতম মুহূর্ত। এই বংশের সন্তানদের কাহিনিই মহাভারত। শকুন্তলা-পুত্র ভরতের নামকরণে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ। মহত্ত্বে ও ভারবত্তায় অদ্বিতীয়। তাই কাহিনির নাম মহাভারত।