পতিব্রতা গান্ধারী
ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর— এই তিনটি বালকই জন্মাবধি ভীষ্মের কাছে প্রতিপালিত হতে থাকলেন। ভীষ্ম তাঁদের পুত্রের ন্যায় দেখতেন। ক্রমে বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী হতে থেকে তাঁরা যৌবন বয়সে পদার্পণ করলেন। মানুষের মধ্যে পাণ্ডুই ধর্মযুদ্ধে পারদর্শী ও পরাক্রমশালী হয়েছিলেন; আর মহামতি ধৃতরাষ্ট্র অন্য অপেক্ষা দৈহিক বলে প্রধান ছিলেন। আর ত্রিভুবনের মধ্যে বিদুরের তুল্য ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ কেউ ছিল না। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলে রাজ্যলাভ করেননি। বিদুরও শূদ্রার গর্ভজাত বলে রাজত্ব পাননি; কিন্তু পাণ্ডুই রাজা হয়েছিলেন। বিদুর অসাধারণ ধর্মপরায়ণ বলে ভীষ্ম সকল কার্যেই বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। একদিন ভীষ্ম বিদুরকে বললেন, “শুনতে পাই, যদুবংশের একটি, গান্ধাররাজ সুবলের একটি এবং মদ্ররাজের একটি— এই তিনটি কন্যা আছে। এরা আমাদের বংশের সম্পূর্ণ যোগ্য। আমি মনে করি— আমাদের বংশবৃদ্ধির জন্য এই তিনি কন্যাকেই আমাদের গ্রহণ করা উচিত। এ বিষয়ে তোমার কী মত?” বিদুর বললেন, “আপনিই আমাদের পিতা, আপনিই আমাদের মাতা এবং আপনিই আমাদের পরম গুরু; অতএব আপনি নিজে বিবেচনা করে, আমাদের বংশের যাতে মঙ্গল হয়, তা করুন।”
তখন ভীষ্ম ব্রাহ্মণগণের মুখে সুবলনন্দিনী গান্ধারীর সমস্ত বৃত্তান্ত শুনলেন; আরও শুনলেন যে, শুভলক্ষণা গান্ধারী চন্দ্রসূর্যনয়ন বরদাতা ভগবান মহাদেবের আরাধনা করে শত পুত্রলাভের বর পেয়েছেন। এই সমস্ত বৃত্তান্ত যথার্থরূপে শুনে ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কাছে দূত পাঠালেন। কিন্তু “ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ” কেবল এই একটি বিষয়ে সুবল বিবেচনা করে দেখছিলেন। তারপর, সুবল আপন বুদ্ধিতেই ধৃতরাষ্ট্রের বংশ, যশ ও ব্যবসায়ের পর্যালোচনা করে ধর্মপরায়ণা গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতেই সমর্পণ করবার অঙ্গীকার করলেন।
গান্ধারী যখন শুনলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, অথচ পিতা ও মাতা তাঁর হস্তেই তাঁকে দান করবার ইচ্ছা করেছেন, “তখন আমি পতিকে অতিক্রম করব না”। এই কথা মনে মনে নিশ্চয় পতিব্রতার্থিনী গান্ধারী একখানি পট্টবস্ত্র নিয়ে তাকে অনেক ভাঁজ করে তা দিয়ে নিজের নয়নযুগল বন্ধন করলেন। তখন গান্ধাররাজ সুবলের পুত্র শকুনি, পরমসুন্দরী ভগিনী গান্ধারীকে নিয়ে হস্তিনা রাজধানীতে গেলেন। তিনি অত্যন্ত আদরপূর্বক ভগিনীটিকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করলেন এবং ভীষ্মের অনুমতিক্রমে তাঁদের বিবাহ করালেন। উপযুক্ত পরিচ্ছদের সঙ্গে ভগিনীকে দান করে এবং ভীষ্মের নিকট বিশেষ সম্মানিত হয়ে শকুনি আপন রাজধানীতে ফিরে গেলেন। সুন্দরী গান্ধারীও স্বভাব, ব্যবহার এবং কার্যদ্বারা সমস্ত কুরুবংশীয় লোকের সন্তোষ জন্মাতে থাকলেন। পতিব্রতা গান্ধারী ব্যবহার দ্বারা সন্তুষ্ট করতে থেকেও অন্য পুরুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন না।
একদা বেদব্যাস ক্ষুধায় ও পথশ্রমে কাতর হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তখন গান্ধারী উপযুক্তভাবে তাঁর শুশ্রূষা করেন, এবং বেদব্যাস তাঁকে বর দিতে চান। গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের তুল্য বলবান ও গুণবান নিজের একশত পুত্র হবার বর গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি ধৃতরাষ্ট্র থেকে গর্ভধারণ করলেন। কিন্তু গান্ধারী দু’বছর পর্যন্ত সেই গর্ভ উদরেই ধারণ করে রইলেন, প্রসব আর হল না; তখন তাঁর মনে গভীর দুঃখ জন্মাল।
ইতিমধ্যে সংবাদ এল যে নবোদিত সূর্যের তুল্য তেজস্বী একটি পুত্রের জন্ম দিয়েছেন পাণ্ডুপত্নী কুন্তী। একথা শুনে এবং নিজের গর্ভ অচল হয়ে আছে— একথা বুঝে গান্ধারী বিশেষ চিন্তিত হলেন। তখন গান্ধারী মনোদুঃখে কর্তব্যজ্ঞান শূন্য হয়ে বিশেষ চেষ্টা করে ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতসারে সেই গর্ভপাত করলেন। তাতে লৌহপিণ্ডের ন্যায় একটি মাংসপিণ্ড জন্মাল। দু’বছর পর্যন্ত যা উদরে ধারণ করেছেন, তা একটা মাংসপিণ্ড দেখে গান্ধারী সেটিকে ফেলে দেবার উদ্যোগ করলেন।
এই সময়ে বেদব্যাস ধ্যানযোগে তা জানতে পেরে সত্বর সেখান উপস্থিত হলেন; উপস্থিত হয়ে তিনি দেখলেন, একটি মাংসপিণ্ড জন্মেছে। তখন তিনি গান্ধারীকে বললেন, তুমি একে কী করবার ইচ্ছা করেছ? গান্ধারী মহর্ষির কাছে নিজের অভিপ্রায় সত্য বললেন। গান্ধারী আরও বললেন, “কুন্তীর সূর্যের তুল্য তেজস্বী একটি পুত্র জন্মেছে; সে সকলের জ্যেষ্ঠ হল। এ-কথা শুনে আমি অত্যন্ত দুঃখে এই গর্ভপাত করেছি। আপনি পূর্বে আমাকে একশত পুত্র হবার বর দিয়েছিলেন; কিন্তু আমার সেই একশত পুত্রের স্থানে একটি মাংসপিণ্ড জন্মেছে।”
বেদব্যাস বললেন, “সুবলনন্দিনী, তুমি যা বলেছ, তা সত্য। কিন্তু আমার প্রদত্ত বর কখনও মিথ্যা হবে না; কারণ আমি পূর্বে ইচ্ছানুরূপ আলাপের সময়ও মিথ্যা বলিনি; সুতরাং আমার বর মিথ্যা হবে কেন? অতএব এখনই একশত কলসি ঘৃতে পরিপূর্ণ করো। তারপর সেগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন সুরক্ষিত স্থানে রেখে দাও। তারপর শীতল জলদ্বারা এই মাংসপিণ্ডটাকে সিক্ত করতে থাকো।” তখন সিক্ত করতে থাকলে সেই মাংসপিণ্ডটা বহুখণ্ডে বিভক্ত হল।
কিছুকাল পরে ক্রমশ সেই মাংসপিণ্ড থেকে অঙ্গুষ্ঠপর্ব প্রমাণ একশত একটি গর্ভ পৃথক পৃথক ভাবে বিশ্লিষ্ট হল; তারপর গান্ধারী তখন তখনই সেই সেই গর্ভকে সেইসব ঘৃতপূর্ণ কলসিতে নিয়ে রেখে দিলেন। রেখে দিয়ে সুরক্ষিত স্থানে সাবধানে সেগুলিকে রক্ষা করতে থাকলেন। তখন বেদব্যাস গান্ধারীকে উপদেশ দিলেন যে, “এক বৎসর পরে পুনরায় এই কলসিগুলির মুখ খুলবে।” এই কথা বলে সেগুলিকে রক্ষা করিয়ে বেদব্যাস তপস্যা করবার জন্য হিমালয় পর্বতে চলে গেলেন। ক্রমে সেগুলির মধ্যে প্রথমে রাজা দুর্যোধন জন্মালেন। সুতরাং জন্ম অনুসারে রাজা যুধিষ্ঠিরই জ্যেষ্ঠ হলেন। তারপর কোনও লোক গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের সেই জন্মবৃত্তান্ত ভীষ্ম ও বিদুরের কাছে বলল। সেই সময়ে যেদিনে দুর্ধর্ষ দুর্যোধন জন্মেছিলেন সেইদিন মহাবাহু ও অত্যন্ত বলশালী ভীমও জন্মেছিলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র জন্মগ্রহণ করা মাত্র গর্দভের ন্যায় কর্কশস্বরে রোদন ও শব্দ করেছিল। এবং সেই শব্দ লক্ষ্য করে গর্দভ, শকুন, শৃগাল ও কাকগণ শব্দ করে উঠেছিল। প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগল এবং দিকে দিকে আগুন জ্বলে উঠেছিল। তাতেই ভীত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র, বহু ব্রাহ্মণ, ভীষ্ম, বিদুর, অন্যান্য বন্ধুগণ এবং কুরুবংশীয় সকলকে এনে এই কথা বলেছিলেন, “আমাদের বংশবর্ধক জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র যুধিষ্ঠির নিজের গুণে রাজ্য তো পেয়েই গিয়েছে। সুতরাং তার বিষয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। কিন্তু আমার এই পুত্র যুধিষ্ঠিরের পরে রাজা হতে পারবে তো। এ বিষয়ে যা সত্য, তা আমাকে আপনারা যথার্থ বলুন।”
ধৃতরাষ্ট্রের এই কথা সমাপ্ত হওয়ামাত্র মাংসভোজী ভয়ংকর প্রাণীগণ এবং অমঙ্গলসূচক শৃগালগণ চিৎকার করে উঠল। সকল দিকে ভয়ংকর দুর্লক্ষণ দেখে সেই ব্রাহ্মণগণ ও বিদুর বললেন, “মহারাজ, আপনার জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্মমাত্রই যখন এই সব ভয়ংকর দুর্লক্ষণ হতে আরম্ভ করেছে, তখন নিশ্চয়ই আপনার এই পুত্র বংশনাশের কারণ হবে। অতএব এটিকে পরিত্যাগ করলে, সেই অনিষ্টের নিবারণের সম্ভাবনা দেখা দেবে। আর ওকে বাঁচিয়ে রাখলে গুরুতর অর্থ হবে। সুতরাং মহারাজ বরং আপনার একটি কম একশত পুত্র হোক। আপনি যদি বংশের মঙ্গল চান, তবে এই পুত্রটিকে ত্যাগ করুন; এক কার্যদ্বারাই বংশের ও জগতের মঙ্গল করুন। কারণ, বংশরক্ষার জন্য বংশের একজনকে ত্যাগ করা উচিত, গ্রাম রক্ষার জন্য সে বংশকেও ত্যাগ করা সংগত, আবার দেশরক্ষার জন্য সে গ্রাম ত্যাগ করাও শ্রেয়, আর আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীই ত্যাগ করা উচিত।”
বিদুর এবং সেই সকল ব্রাহ্মণ একথা বললেও পুত্রস্নেহ সমাকুল রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের মত গ্রহণ করলেন না। তারপর একমাসের মধ্যেই ধৃতরাষ্ট্রের পূর্ণ একশত পুত্র জন্মাল। আর একশতের অধিক একটি কন্যা জন্মাল। পূর্বে গর্ভ বৃদ্ধি পেতে থাকায় গান্ধারী যখন অচল হয়ে পড়েছিলেন, সেই সময়ে একটি বৈশ্যজাতীয় যুবতী মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের শুশ্রূষা করত। সেই বৈশ্য যুবতীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে সেই বৎসরেই ‘যুযুৎসু’ নামে করণজাতীয় (পিতা ক্ষত্রিয়, মাতা বৈশ্য) একটি বুদ্ধিমান পুত্র জন্মেছিল। এইভাবে ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র জন্মেছিল। তাঁরা সকলেই যথাসময়ে বীর ও মহারথ হয়েছিলেন। আর সেই একশত পুত্রের অধিক একটি কন্যাও জন্মেছিল এবং বৈশ্যার গর্ভে অত্যন্ত তেজীয়ান ও প্রতাপশালী যুযুৎসু নামক পুত্রও একশত পুত্রের অধিক হয়েছিল।
রাজা জনমেজয় বৈশম্পায়নের কাছে জানতে চাইলেন, বেদব্যাস গান্ধারীকে একশত পুত্রলাভের বর দিয়েছিলেন, তবে দুঃশলার উৎপত্তি হল কীভাবে?
বৈশম্পায়ন উত্তরে বললেন, “মহর্ষি বেদব্যাস নিজেই সেই মাংসপিণ্ডটিকে শীতল জলে সিক্ত করে ভাগে ভাগ করছিলেন। যেমন-যেমন যে-যে ভাগ করছিলেন, তেমন-তেমন সেই এক-এক ভাগকে ধাত্রী দ্বারা তখন তখনই ঘৃতকুম্ভে ফেলতে লাগলেন। এক সময়ে সাধ্বী গান্ধারীদেবী লোকের কন্যাস্নেহের বিষয় ভেবে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, “এই একশত পুত্র আমার হবে। এতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ বেদব্যাস মিথ্যা কথা বলেননি। এরপরে যদি আমার একটি কন্যাও হয়, তবে আমার অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হবে। আমার একশত পুত্রের অধিক একটি কনিষ্ঠা কন্যা হয়, তবে আমার পতি দৌহিত্যজনিত লোকাখ্য স্বর্গের বাইরে থাকবেন না। নারীদের পুত্র অপেক্ষা জামাতাকে নিয়ে অধিক আনন্দ হয়ে থাকে, অতএব আমার যদি একশত পুত্রের অতিরিক্ত কন্যা জন্মে, তবে আমি পুত্র ও দৌহিত্রবেষ্টিত হয়ে চরিতার্থ হব। সুতরাং আমি যদি সত্যরক্ষা করে থাকি, তপস্যা করে থাকি, দান করে থাকি, হোম করে থাকি এবং পরিচর্যা করে থাকি, গুরুজনকে সন্তুষ্ট করে থাকি, তা হলে আমার একটি কন্যাও হোক।”
বেদব্যাস বললেন, “কল্যাণী, এই একশত ভাগই তোমার একশত পুত্র হবে, সুতরাং আমি মিথ্যা বলিনি। কিন্তু দৈববশত একশতের উপরেও একভাগ অবশিষ্ট আছে। এই তোমার অভীপ্সিত কন্যাও হবে।” এই কথা বলে মহর্ষি আর একটি ঘূতপূর্ণ কুম্ভ আনিয়ে, তার ভিতরে সেই কন্যা ভাগটিকেও ফেলে রাখলেন। তাই যথাকালে সকল পুত্রের কনিষ্ঠা একটি কন্যাও হয়েছিল।
গান্ধারীর পঞ্চপাণ্ডবের প্রথম সাক্ষাৎ
যুধিষ্ঠিরের যখন ষোলো বছর বয়স তখন শতশৃঙ্গ পর্বতে অন্ধমুনির অভিসম্পাতবশত কামার্ত পাণ্ডুর মাদ্রীর সঙ্গে রমণকালে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটল। শতশৃঙ্গ পর্বতের তপস্বীরা আলোচনা করে মৃত পাণ্ড ও মৃতা মাদ্রীর দেহ নিয়ে বিধবা কুন্তী ও পাঁচপত্রকে হস্তিনাপুরে পাণ্ডুর নিজ রাজ্যে নিয়ে এলেন। পাণ্ডু মৃত্যুবরণ করলে মাদ্রী কুন্তীর হাতে আপন পুত্রদ্বয় নকুল ও সহদেবকে সমর্পণ করে পাণ্ডুর সহমরণ করেছিলেন।
তপস্বীরা হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলে অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, বিদুর ও অন্তঃপুরিকারা ছুটে এসে সেই স্থানে ভেঙে পড়ে অশ্রুমথিত কণ্ঠে বিলাপ করতে লাগলেন। মাতা অম্বালিকার হাহাকারে হস্তিনাপুর পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে দেবী গান্ধারীও সেই স্থানে এসেছিলেন। বড় বিস্ময় লাগে দেবী গান্ধারী কুন্তীকে কোনও সান্ত্বনা দিলেন না। সদ্য পিতৃহারা পাণ্ডবদের কোনও আশ্বাস দিলেন না। একথাগুলি এখানে বলার প্রয়োজন। সম্পূর্ণ গান্ধারী চরিত্র আলোচনা করে আমরা এই ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পারব।
ভীষ্মের ব্যবস্থাপনায় কৌরব ভ্রাতাদের সঙ্গে পাণ্ডুপুত্রদেরও বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা হল। বাহুবলে ভীম সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হলেন। বালচাপল্যবশত ভীমসেনের হাতে কৌরবভ্রাতারা কিছু পরিমাণে নিপীড়িত হতে লাগলেন। পাঁচজন কৌরবভ্রাতাকে একসঙ্গে ধরে তাদের মাথা ঠুকে দেওয়া, কৌরবভ্রাতারা গাছের উপর উঠলে ভীমসেন গাছের গোড়ায় পদাঘাত করতে লাগলেন। কৌরবভ্রাতারা পাকা ফলের মতো গাছের উপর থেকে পড়তে লাগলেন। দুর্যোধন ঠিক করলেন, ভীমকে হত্যা করবেন। অন্যথায় তাঁকে চিরকাল পাণ্ডবদের পদানত থাকতে হবে। প্রথমে দড়ি দিয়ে বেঁধে ভীমকে জলে ফেলে দেওয়া হল। ভীম বাঁধন ছিড়ে অক্ষত দেহে ফিরে এলেন। প্রমাণকোটিতে খাওয়াদাওয়ার পর ভীমকে ভয়ংকর বিষপান করিয়ে কঠিনভাবে বেঁধে দুর্যোধন কর্ণ ইত্যাদি জলে ফেলে দিলেন, আটদিন ভীমের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। কুন্তী, বিদুর উদ্বিগ্ন। পাণ্ডবভাইয়েরা গোপনে খোঁজখবর করছেন। গান্ধারী গৃহকত্রী, তাঁকে আমরা একটিবারও ভীমের খোঁজ করতে দেখিনি।
এরপর গান্ধারীকে আমরা দেখতে পাই, কুমারদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন। অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে তিনিও এসেছিলেন কুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দেখতে। এর কিছুদিনের মধ্যেই দুর্যোধনের পরামর্শে এবং ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে পাণ্ডবেরা মাতা কুন্তীকে নিয়ে বারণাবতে গেলেন। সেখানে পাণ্ডবদের ভস্মীভূত হয়ে পুড়ে মরার সংবাদ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্যের বিষয়, আমরা গান্ধারীর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না।
অনতিকাল পরে হস্তিনাপুরে সংবাদ এল যে পাণ্ডবেরা জীবিত আছেন এবং দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করায় পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হয়েছে। ভীষ্ম ও বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করে ধৃতরাষ্ট্র পঞ্চপাণ্ডব-কুন্তী ও দ্রৌপদীকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসার জন্য বিদুরকে পাঞ্চাল নগরে প্রেরণ করলেন। পাণ্ডবেরা সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। নগরবাসীর আনন্দ ও কুশল প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে গৃহে প্রবেশ করলেন।
তখন দুর্যোধনের মহিষী কাশীরাজসুতা ধৃতরাষ্ট্রের অন্য পুত্রবধূদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দ্বিতীয় লক্ষ্মীর ন্যায় দ্রৌপদীকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং আগতা শচীদেবীর ন্যায় মাননীয়া দ্রৌপদীর সম্মান করলেন। সেই সময়ে কুন্তীদেবী দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে গান্ধারীকে নমস্কার করলেন, গান্ধারীও আশীর্বাদ করে দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করলেন।
পরিষ্মজৈব গান্ধারী কৃষ্ণাং কমলোলচনাত্র
পুত্রাণং মম পাঞ্চালী মৃত্যুরেবেত্যমন্যত ।। আদি: ২০০ : ২৯ ।।
“গান্ধারী দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করেই মনে করলেন যে, এই দ্রৌপদীই আমার পুত্রগণের মৃত্যুর কারণ হবেন।”
তারপর তিনি চিন্তা করে ন্যায় অনুসরণ করে বিদুরকে বলললেন, “বিদুর আপনার যদি ইচ্ছা হয় তা হলে কারণ, লগ্ন ও নক্ষত্রের যোগ দেখে শুভজনক তিথিতে সমস্ত আসবাব ও উপকরণ নিয়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে কুন্তীকে নিয়ে সত্বর পাণ্ডুর গৃহে সংস্থাপিত করুন। সেই আপন গৃহে যাতে সুখ হয়, তেমনভাবে কুন্তী পুত্রগণের সঙ্গে অবস্থান করবেন।” “তাই হোক” বলে বিদুর আদেশ পালন করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের আদেশক্রমে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ ও পুত্রগণের সঙ্গে বাহ্লীক— পাণ্ডবদের শয়ন-ভোজনের প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে থাকলেন।
ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজধানী।
কিছুদিন পরে ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করবার জন্য গমন করলেন। ক্রমে ইন্দ্রপ্রস্থ অলকাপুরীর ন্যায় মনোহর এক নগরীতে রূপান্তরিত হল।
খাণ্ডবদাহনের পর ময়দানব অর্জুনের অনুগত এক কর্মীতে পরিণত হল। কৃষ্ণের আদেশে ময়দানব যুধিষ্ঠিরের জন্য মর্ত্যে অতুলনীয় এক সভাগৃহ রচনা করে দিল। কৃষ্ণ ভীমার্জুনকে অত্যন্ত পরাক্রমশালী মগধরাজ জরাসন্ধকে পরাজিত ও বধ করে ফিরে আসলে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন হতে থাকল। অত্যন্ত সম্মানিত ও নিমন্ত্রিত অতিথি রূপে দুর্যোধন সেই সভায় যোগদান করলেন। ময় নির্মিত এক সভাগৃহের বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে না পেরে দুর্যোধন অত্যন্ত লাঞ্ছিত হলেন। পুকুর ভ্রমে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে আছাড় খেলেন। দ্বার ভেবে অতিক্রম করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। সমতল ভেবে হাঁটতে গিয়ে জলে পড়ে গেলেন। অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পাণ্ডবদের এবং দ্রৌপদীর উপহাসের মধ্য দিয়ে দুর্যোধন হস্তিনাপুর ফিরলেন।
দুর্যোধন পাণ্ডবদের সমস্ত সম্পদ কেড়ে নিতে এবং দ্ৰৌপদীকে চূড়ান্তভাবে লাঞ্ছিত করতে মনস্থ করলেন। স্বয়ংবর সভায় প্রত্যাখ্যাত হবার পর থেকে দুর্যোধনের দ্রৌপদী সম্পর্কে ক্ষোভ জন্মেছিল। যুধিষ্ঠিরের রাজসভা দর্শনে তা চরম আকার ধারণ করল। শকুনিকে দিয়ে কপট পাশা খেলিয়ে দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে সর্বস্বান্ত করলেন। এমনকী দ্রৌপদীকে নিয়ে বাজি ধরিয়ে তাঁকে ক্রীতদাসী করার চেষ্টাও করলেন।
পৃথিবীর কোনও সম্ভ্রান্ত রমণীর এতখানি লাঞ্ছনা ঘটেনি, সেদিন রাজসভায় যা ঘটেছিল। দ্রৌপদী তখন রজস্বলা ছিলেন, একবস্ত্রা। দুঃশাসন কর্ণ দুর্যোধনের আদেশে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে কেশাকর্ষণ করে দ্রৌপদীকে রাজসভায় টানতে টানতে নিয়ে চলল। দ্রৌপদী প্রবল প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন। কৌরব-বধূরা আর্তনাদ করে প্রতিবাদ করল। স্বয়ং কুন্তী ছুটে এসে দুঃশাসনের কাছে বারংবার আবেদন করলেন। কিন্তু দুঃশাসন সেই অবস্থায় দ্রৌপদীকে টেনে রাজসভায় নিয়ে গেল। দুর্যোধন কর্ণের দীর্ঘকাল সঞ্চিত রাগ দ্রৌপদীর উপর ঝরে পড়ল। কর্ণ দ্রৌপদীকে ‘বেশ্যা’ বলে অভিহিত করলেন। যদিও কর্ণ ভুলে গেছিলেন, তা হলে তিনিও বেশ্যাপুত্রই হন। কারণ তাঁর মাতা কুন্তীদেবীও পঞ্চপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন। এরপর দুর্যোধন বাম ঊরুর বস্ত্র সরিয়ে নগ্ন উরু দেখিয়ে দ্রৌপদীকে বসার ইঙ্গিত করলেন। সমস্ত সভা ভীমের ভয়ংকর শপথে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কর্ণ দুঃশাসনকে আদেশ করলেন দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে। এইবার যুধিষ্ঠিরের পিতৃদেব ধর্ম আবির্ভূত হলেন। দুঃশাসন যত টানেন বস্ত্রের পাহাড় জমে যায়। কিন্তু দুঃশাসন কিছুতেই দ্রৌপদীকে বিবস্ত্রা করতে পারেন না।
কিন্তু পাঠকের দু’চোখ তখন গান্ধারীকে খুঁজছে। পট্টমহিষী গান্ধারী, রাজমাতা গান্ধারী, দ্রৌপদীর এতবড় অসম্মানের সময়েও তিনি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে। তিনি বাধা দিলেন না, দুঃশাসনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন না। গান্ধারী কি বিস্ময়ে-বিমূঢ় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন? কিন্তু তাও তো নয়। শৃগাল প্রভৃতির ডাকের দুর্লক্ষণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। বিদুরের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তা জানিয়েছেন। দ্বিতীয় দ্যূতক্রীড়ায় তিনি নিষেধও করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, “দুর্যোধনের জন্মের পর বিদুর প্রভৃতি ধার্মিকগণ তাকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন এই পুত্রের জন্যই বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।” ধৃতরাষ্ট্র এককথায় গান্ধারীকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। “হয়ে যাক বংশ ধ্বংস, আমি পুত্রকে থামাতে পারব না।” গান্ধারীর দুর্যোধনকে ত্যাগের আবেদনও ব্যর্থ হল।
পাণ্ডবেরা বারো বছর বনবাস ও একবছর অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন। দেবী কুন্তী বিদুরের গৃহে আশ্রয় নিলেন। এই অবস্থাটাও পাঠকের কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক বোধহয়।
দীর্ঘ তেরো বছর। তেরো বছরকাল কুন্তী বিদুরের গৃহে বাস করেছিলেন। গান্ধারীকে একটিবারও কুন্তীর সঙ্গে দেখা করতে অথবা তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায়নি। নিজে ডেকে পাঠিয়েও তিনি কুন্তীকে কোনও শুভ পরিণতির আশ্বাস দেননি। অথচ গান্ধারী সত্য সত্যই বিশ্বাস করতেন যেখানে ধর্ম, জয় সেখানেই আসবে। তিনি জানতেন পাণ্ডবেরা ধর্মপরায়ণ।
মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। পাণ্ডবপক্ষের সমস্ত দৌত্য ব্যর্থ হলে কৃষ্ণ শেষ চেষ্টা করবার জন্য দূত হিসাবে কৌরবসভায় এলেন। অতি তুচ্ছ দাবি যুধিষ্ঠিরের, মাত্র পাঁচটি গ্রাম তাঁকে দেওয়া হোক। কিন্তু দুর্যোধন তাতেও সম্মত নন। কৃষ্ণের দৌত্য ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠল। কৌরবদের ধ্বংসের অবশ্যম্ভাবী ইঙ্গিত দিলেন। এস্ত ধৃতরাষ্ট্র অন্তঃপুর থেকে গান্ধারীকে ডাকিয়ে আনলেন। গান্ধারী কৃষ্ণের উক্তিরই পুনরুক্তি করলেন। অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে গান্ধারী কৌরবদের দুর্যোধনকে বললেন যে, দুর্যোধন ভাবছেন তাঁর পক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা আছেন। তাঁর জয় নিশ্চিত। কিন্তু তা কখনওই হবে না। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ দুর্যোধনের অন্নের ঋণ পরিশোধ করার জন্য প্রাণ দেবেন। কিন্তু কখনওই যুধিষ্ঠিরকে শত্রু ভাবতে পারবেন না। কারণ যুধিষ্ঠির ধর্মচারী। গান্ধারীর সে বোঝাতেও কোনও ভুল ছিল না। ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে ডেকে তাঁর মৃত্যুর ইচ্ছা জ্ঞাপন করলেন। ইতিমধ্যে ভীষ্মের হাতে নয় দিনে অসংখ্য রথী, মহারথী নিহত হয়েছেন। দশম দিনে ভীষ্ম নিজেই পতিত হলেন। পঞ্চদশ দিবসে দুর্যোধনের অন্নঋণ শোধ করে নিহত হলেন আচার্য দ্রোণ। আর সপ্তদশ দিনে অর্জুন বধ করলেন কর্ণকে।
অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধে দ্বৈপায়ন নদীর তীরে ভীম দুর্যোধনের ভয়ংকর যুদ্ধের শেষে ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ হল। যুধিষ্ঠির সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর হলেন। যুদ্ধশেষে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় যুধিষ্ঠিরকে ভীত ও উদ্বিগ্ন দেখে কৃষ্ণ কারণ জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির বললেন, পুণ্যব্রতা গান্ধারীর অভিশাপে তাঁরা ভস্ম হয়ে যাবেন, এই চিন্তায় তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি কৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন যে কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে গিয়ে গান্ধারীর ক্রোধের উপশম ঘটান। কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।
গান্ধারীকে যুদ্ধশেষে কৃষ্ণের সান্ত্বনাদান
রথারোহী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেতে যেতে নিকটবর্তী হয়ে হস্তিনানগরে প্রবেশ করলেন। বীর কৃষ্ণ রথের শব্দে সমস্ত দিক নিনাদিত করতে থেকে হস্তিনানগরে প্রবেশ করে, উত্তম রথ থেকে অবতীর্ণ হয়ে, অকাতর চিত্তে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে পূর্বেই সমাগত বেদব্যাসকে দেখতে পেলেন। ওদিকে ধৃতরাষ্ট্রও রথের শব্দে কৃষ্ণ এসেছেন বলে জানতে পারলেন।
ক্রমে কৃষ্ণ অনাকুলভাবে বেদব্যাস, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর চরণ স্পর্শ করে, তাঁদের অভিবাদন করলেন। তারপর যদুবংশপ্রধান কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের হাত ধরে মুক্তকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। তারপর শত্রুদমনকারী কৃষ্ণ শোকজাত অশ্রুজল সংবরণ করে, জল দিয়ে দু’চোখ ধুয়ে ও আচমন করে বিস্তৃতভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে এই কথা বললেন, “ভরতনন্দন মহারাজ, অতীত ও বর্তমানকালের কোনও ঘটনাই আপনার অজানা নয়, আপনি বিশেষভাবে তা জানেন। যাতে বংশের ও ক্ষত্রিয়গণের ক্ষয় না হয়, তার জন্য আপনার চিত্তানুবর্তী পাণ্ডবেরা সকলেই যত্ন করেছিলেন। ধর্মবৎসল যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, সময়ের প্রতীক্ষা করে সমস্ত কষ্ট সহ্য করেছেন এবং নির্দোষ পাণ্ডবেরা দূত্যক্রীড়ায় শকুনির শঠতায় পরাজিত হয়ে, বনবাস স্বীকার করেছেন। তাঁরা নানাবিধ বেশ ধারণ করে, বিরাটনগরে অজ্ঞাতবাস করেছেন এবং সর্বদা অসমর্থের মতো থেকে, অন্য বহুবিধ ক্লেশও স্বীকার করেছেন।
তারপর মহাযুদ্ধের উপক্রম দেখে, আমি নিজে এসে, সমস্ত লোকের সামনে পাণ্ডবদের জন্য পাঁচটি মাত্র গ্রাম চেয়েছিলাম। আপনার অপরাধেই সমস্ত ক্ষত্রিয় ক্ষয় পেয়েছে। বুদ্ধিমান ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, সোমদত্ত ও বাহ্নীক সর্বদাই আপনার কাছে সন্ধি- শান্তির প্রার্থনা করতেন। কিন্তু আপনি তা করেননি।
“ভরতনন্দন, সমস্ত মানুষই কালের প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে থাকে। সময় উপস্থিত হলে আপনিও তাই হয়েছিলেন। কাল ছাড়া এই ক্ষয়ের অন্য কোনও কারণ নেই, অতএব এই ক্ষয়ের জন্য সেই কালই ও দৈব প্রধান কারণ। সুতরাং মহাপ্রাজ্ঞ, আপনি পাণ্ডবগণের প্রতি দোষারোপ করবেন না। এ বিষয়ে মহাত্মা পাণ্ডবগণ ধর্ম, ন্যায় ও স্নেহের অল্পমাত্রাও অতিক্রম করেননি। এ সমস্ত আপনার আত্মকৃত দোষের ফল, এ-কথা বুঝে আপনি পাণ্ডবদের প্রতি দোষারোপ করতে পারেন না।
“আপনার ও গান্ধারীদেবীর বংশগৌরব, বংশরক্ষা, পিণ্ড প্রত্যাশা ও পুত্রের যে সকল বিষয়ে প্রয়োজন আছে, সে সমস্তই এখন পাণ্ডবগণের উপর প্রতিষ্ঠিত হল। কৌরবশ্রেষ্ঠ নরনাথ! আপনি ও যশস্বিনী গান্ধারীদেবী পাণ্ডবগণের এই অপরাধ বিষয়ে শোক করবেন না। এই সমস্ত বিষয় ও নিজের দোষ স্মরণ করে মঙ্গলময় চিত্তে পাণ্ডবগণের চিন্তা করতে থাকুন। আপনার উপরে স্বভাবতই যুধিষ্ঠিরের যে ভক্তি ও শ্রদ্ধা আছে, তা আপনি জানেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অপকারী শত্রুগণের মহামারী ঘটিয়ে দিবারাত্রই অনুতাপানলে দগ্ধ হচ্ছেন, কখনওই শান্তি পাচ্ছেন না। রাজা যুধিষ্ঠির আপনার ও গান্ধারীদেবীর বিষয়ে শোক করতে থেকে কোনও সময়েই শান্তি পাচ্ছেন না। রাজা! আপনি পুত্রশোকে সর্বতোভাবে সন্তপ্ত হয়েছেন এবং আপনার ইন্দ্রিয়গুলি ও বুদ্ধি শোকে বিশেষ আকুল হয়ে গিয়েছে; তবুও অত্যন্ত লজ্জিত যুধিষ্ঠির আপনার কাছে আসতে পারছেন না।”
যদুকুলশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে এই কথা বলে, শোকাকুলা গান্ধারীকে উত্তম বাক্য বলতে লাগলেন, “সুবলনন্দিনী, সুব্রতে, আমি আপনাকে যা বলব, তা আপনি শ্রবণ করুন। কল্যাণী, বর্তমান সময়ে আপনার তুল্য নারী পৃথিবীতে নেই। আপনি জানেন যে, সেই সময়ে আপনি সভায় আমার সামনে উভয়পক্ষের হিতজনক ও ধর্মার্থযুক্ত অনেক কথা বলেছিলেন; কিন্তু আপনার পুত্রেরা আপনার সে কথায় কর্ণপাত করেননি। তখন আপনি দুর্যোধনকে অনেক নিষ্ঠুর কথা বলেছিলেন, ‘মূঢ় দুর্যোধন তুই আমার কথা শোন— যেখানে ধর্ম থাকে, সেখানেই জয়ও থাকে।’ রাজপুত্রী এখন আপনার সেই কথা সত্য বলে উপস্থিত হয়েছে। কাজেই, আপনি আর শোকের দিকে মন দেবেন না এবং পাণ্ডবদের বিনাশের দিকে বুদ্ধি করবেন না। মহাভাগে, আপনি তপস্যার প্রভাবে ক্রোধজ্বলিত নয়নদ্বারা স্থাবর ও জঙ্গমের সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীই দগ্ধ করতে পারেন।”
তখন গান্ধারী কৃষ্ণের কথা শুনে বললেন, “মহাবাহু কৃষ্ণ, তুমি যা বললে, তা সত্য, মনের বেদনায় আমার বুদ্ধি বিচলিত হয়েছিল। কিন্তু তোমার কথা শুনে আমার বুদ্ধি এখন স্থির হয়েছে। মনুষ্যশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, সম্মিলিত পাণ্ডবদের সঙ্গে তুমিই এখন অন্ধ বৃদ্ধ ও হতপুত্র রাজার একমাত্র অবলম্বন।” পুত্রশোকে সন্তপ্তা গান্ধারী এই পর্যন্ত বলে, বস্ত্রহারা মুখ আচ্ছাদন করে রোদন করতে লাগলেন।
তারপর সর্বশক্তিমান ও মহাবাহু কৃষ্ণ যুক্তি ও কারণদ্বারা বহু বাক্যে শোকাকুলা গান্ধারীকে আশ্বস্ত করলেন। তখনই সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী কৃষ্ণ অশ্বত্থামার সংকল্প বুঝতে পারলেন। তখন কৃষ্ণ উঠে দাঁড়িয়ে, বেদব্যাসের চরণে মাথা নামিয়ে প্রণাম করে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “কৌরবশ্রেষ্ঠ, আমি আপনার কাছে প্রস্থানের অনুমতি প্রার্থনা করছি। আপনি আর শোকের দিকে মন দেবেন না। অশ্বত্থামার পাপ অভিপ্রায় জন্মেছে। সেই জন্যই হঠাৎ আমাকে উঠে পড়তে হল। অশ্বত্থামা রাত্রিতে পাণ্ডবগণের গুপ্ত হত্যা বিষয়ে সংকল্প করেছেন।”
এই কথা শুনে, মহাবাহু ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সঙ্গে মিলিত হয়ে কেশি হন্তা কৃষ্ণকে বললেন, “জনার্দন তুমি সত্বর যাও, পাণ্ডবগণকে রক্ষা করো। জনার্দন আমি আবার তোমার সঙ্গে মিলিত হব।”
কৃষ্ণ দ্রুত দারুকের সঙ্গে প্রস্থান করলেন। যাত্রার পূর্বে তিনি ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর ক্রোধ সংবরণ বিষয়ে কৃতকার্য হয়ে, তাঁদের কোপ নিবৃত্তি করে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রা করলেন।
কুপিতা গান্ধারী
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সমাপ্ত হলে পাণ্ডবেরা কৃষ্ণকে সম্মুখবর্তী করে হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রথমেই ভীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন। কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায় বুঝে যে লৌহভীমের প্রতিমূর্তির উপর দুর্যোধন প্রত্যহ গদাভ্যাস করতেন, সেই লৌহ প্রতিমূর্তিটি ধৃতরাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের তীব্র আলিঙ্গনে ভীমের লৌহ প্রতিমূর্তি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ধৃতরাষ্ট্রের মুখ থেকে তখন রক্ত পড়তে আরম্ভ করেছিল। ভীমকে বধ করে গুরুতর অকার্য করেছেন ভেবে ধৃতরাষ্ট্রের অনুতাপ দেখা দিল। কৃষ্ণ তখন প্রকৃত ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন। ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণকে বললেন, “এখন আমার ক্রোধ তিরোহিত হয়েছে। ভীমের সম্পর্কে শোকসন্তাপও কেটে গিয়েছে। আমি একাগ্রচিত্তে পৌঁছেছি। অতএব আমি মধ্যম পাণ্ডবকে স্পর্শ করার ইচ্ছা করি।”
তখন ধৃতরাষ্ট্র— শোভাবাহু ভীম, অর্জুন এবং পুরুষশ্রেষ্ঠ নকুল ও সহদেবকে আলিঙ্গন করে আশ্বাস দিয়ে তাঁদের মঙ্গলপ্রশ্ন করলেন। তারপর ধৃতরাষ্ট্র অনুমতিদান করলে কৌরবশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে গান্ধারীর কাছে গমন করলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সমস্ত শত্রুকে নিহত করেছেন জেনে পুত্রশোকার্তা ও অনিন্দিতা গান্ধারী তাঁর উপরে অভিসম্পাত করার ইচ্ছা করলেন। পাণ্ডবগণের উপরে গান্ধারীর দুষ্ট অভিপ্রায় জন্মেছে জেনে বেদব্যাস পূর্বেই সে-বিষয়ে সতর্ক হলেন। মহর্ষিও মনের ন্যায় বেগগামী, গঙ্গাস্নান করে তার পবিত্রজলে পবিত্র হয়ে, সেইখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মহর্ষি বেদব্যাস দিব্যচক্ষু ও যোগপ্রভাবিত মন দ্বারা সমস্ত প্রাণীর অভিপ্রায় দেখতে পেতেন বলেই পূর্বেই সে-বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন। সুতরাং মহাতপা বেদব্যাস সেখানে উপস্থিত হয়েই অনাময় প্রশ্ন করে এবং “এটা শাপের সময় নয় ক্ষমা করবার সময়।” এই কথা বলে পুত্রবধূ গান্ধারীকে বললেন, “গান্ধারী, তুমি পাণ্ডবদের উপরে ক্রোধ কোরো না, শান্ত হও, ক্রোধের মূল এই রজোগুণকে দমন করো। আমার কথা শোনো, তোমার পুত্র দুর্যোধন জয়াভিলাষী হয়ে এই আঠারো দিন প্রত্যহ তোমার কাছে গিয়ে বলত যে, “মা, আমি শত্রুগণের সঙ্গে যুদ্ধে যাচ্ছি, আপনি আমার জয় হোক বলে আশীর্বাদ করুন।” কল্যাণী জয়াভিলাষী দুর্যোধন তোমার কাছে এই প্রার্থনা করলেও তুমিও প্রতিদিন বলতে, ‘যে পক্ষে ধর্ম আছেন, সে পক্ষেই জয় হবে।’ গান্ধারী, তুমি চিরদিন সত্যকথা বলে আসছ, সুতরাং তুমি কখনও পুর্বে মিথ্যা বলেছ, একথা আমার মনে পড়ে না। পাণ্ডবেরা রাজাদের তুমুল যুদ্ধে গুরুতর সংশয়াপন্ন হয়ে শেষে জয়লাভ করেছেন। সুতরাং নিশ্চয় বুঝতে হবে, তাঁদের দিকেই ধর্ম বেশি ছিল। প্রশস্তহৃদয়ে গান্ধারী তুমি ধর্ম ও পূর্বের কথা স্মরণ করে তোমার পুত্রস্থানীয় পাণ্ডবদের উপর ক্রোধ সংবরণ করো। তুমি পর্বে ক্ষমাশীলা হয়ে এখন ক্ষমা করছ না কেন? অতএব অধর্ম পরিত্যাগ করো। যেদিকে ধর্ম ছিল, সেদিকে তো জয় হয়েছেই।”
গান্ধারী বললেন, “ভগবন! আমি পাণ্ডবদের দোষারোপ করি না। তাঁদের বিনাশও ইচ্ছা করি না। কুন্তীপুত্রদের কুন্তীর যেমন রক্ষা করা উচিত, তেমন আমারও তাঁদের রক্ষা করা উচিত এবং আমার যেমন রক্ষা করা উচিত, তেমনই ধৃতরাষ্ট্রেরও রক্ষা করা উচিত। দুর্যোধন, সুবলনন্দন শকুনি, কর্ণ এবং দুঃশাসনের অপরাধেই এই কৌরবক্ষয় হয়েছে। কিন্তু অর্জুন, ভীমসেন, নকুল বা সহদেব কোনও অপরাধ করেননি। যুধিষ্ঠির কখনওই না। কৌরবেরা পরস্পর যুদ্ধ ও বিনাশ করতে থাকলে সম্মিলিত ভাবেই বিনষ্ট হয়েছেন। সুতরাং তাতে আমার অপ্রীতিকর কিছু হয়নি। কিন্তু প্রশস্তহৃদয় ভীমসেন গদাযুদ্ধে দুর্যোধনকে আহ্বান করে কৃষ্ণের সাক্ষাতেই একটি অকার্য করেছেন। দুর্যোধন গদাযুদ্ধ শিক্ষায় অধিক নিপুণ এবং তিনি রণস্থলে বিভিন্ন পথে বিচরণ করছিলেন। এই অবস্থায় ভীমসেন তাঁর নাভির নীচে গদাপ্রহার করেছিলেন। এই ব্যাপারটাই আমার ক্রোধবৃদ্ধি করেছে। মহাত্মা ধর্মজ্ঞেরা সকলেরই হিতের জন্য ধর্ম নির্দিষ্ট করে গিয়েছেন। কিন্তু বীরেরা প্রাণরক্ষার জন্য কী করে সে ধর্মকে কোনও প্রকার ত্যাগ করতে পারেন?”
তখন ভীমসেন গান্ধারীর সেই সকল কথা শুনে ভীত হয়ে অনুনয়ের সঙ্গে তাঁকে এই কথা বললেন, “দেবী অধর্মই হোক বা ধর্মই হোক আমি ভয়বশত আত্মরক্ষার ইচ্ছা করে সেই কার্য করেছি, অতএব আপনি আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করুন। আমি ধর্ম অনুসারে আপনার ওই মহাবল পুত্রকে নিপাতিত করিনি। আমি কেন, কোনও ব্যক্তিই ধর্ম অনুসারে তাঁকে বধ করতে পারত না, সেই জন্যই আমি অন্যায্য আচরণ করেছি। তিনিও অধর্ম অনুসারেই যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিলেন এবং সর্বদাই তিনি আমাদের প্রতারণা করতেন। সেইজন্যই আমি অন্যায় কার্য করেছি। বিপক্ষ সৈন্যের মধ্যে একমাত্র তিনিই অবশিষ্ট ছিলেন এবং গদাযুদ্ধেও তিনি বিশেষ নিপুণ ছিলেন, বিশেষত তিনি জীবিত থাকলে অপহৃত রাজ্য ত্যাগ করবেন না; সেই জন্যই আমি এই কাজ করেছি। তারপর আপনার পুত্র দুর্যোধন সেই দ্যূতসভায় একবস্ত্রা ও রজস্বলা দ্রৌপদীকে যে সমস্ত কথা বলেছিলেন, তাও আপনার জানা আছে। দুর্যোধনকে বধ না করে আমরা সসাগরা পৃথিবী ভোগ করতে পারব না, এই ভেবেই আমি সেই অকার্য করেছি। রানি আপনার পুত্র সেই অপ্রিয়গুলির মধ্যেও আমাদের সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় কার্য করেছিল যে, সভামধ্যে দ্রৌপদীকে বাম উরু দেখিয়েছিল। জননী, তখনই আপনার সেই পুত্রকে আমাদের বধ করা উচিত ছিল। কিন্তু সে সময়ে আমরা ধর্মরাজের আদেশে সে-বিষয়ে নিবৃত্ত ছিলাম। আপনার পুত্র গুরুতর বৈরানল সৃষ্টি করেছিল, যেহেতু সে সর্বদাই আমাদের বনবাসের কষ্ট ভোগ করিয়েছিল, সেইজন্যই আমি অন্যায় কার্য করেছি। আমরা যুদ্ধে দুর্যোধনকে বধ করে সকল শত্রুতার অবসান ঘটিয়েছি, যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করেছেন, আমাদেরও ক্রোধ তিরোহিত হয়েছে।” গান্ধারী বললেন, “শুধু দুর্যোধনের বধের ব্যাপার নয়, যেহেতু তুমি তাঁকে প্রশংসা করেছ, এবং তুমি যা যা বললে, তার সব ক’টি অন্যায়ই সে করেছিল।”
“কিন্তু ভরতনন্দন বৃষসেন নকুলের অশ্বগুলি বিনাশ করলে তুমি যে দুঃসাশনের বক্ষের রক্তপান করেছ, সজ্জনেরা সেই কার্যের নিন্দা করেছেন, নীচ লোকেরা তা করে থাকে, এবং তা অত্যন্ত নিষ্ঠুর কার্য, অতএব বৃকোদর, তুমি যখন তা করেছ, তখন নিশ্চয়ই তুমি অসংগত কার্য করেছ। ভীম বললেন, “অন্য মানুষের রক্তপান করা উচিত নয়, তাতে নিজের রক্তপান করা যায় কী করে। নিজেও যেমন, ভ্রাতাও তেমনই, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। সেই রক্ত আমার দন্ত ও ওষ্ঠের নীচে যায়নি, তা তৎকাল সন্নিহিত যমও জানেন। তবে আমার হাত দু’খানা দুঃশাসনের রক্তে নিষিক্ত হয়েছিল, সুতরাং জননী আপনি শোক করবেন না। বৃষসেন নকুলের অশ্বগুলিকে বধ করলে, আমার কৌরবভ্রাতারা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। সুতরাং আমি দুঃশাসনকে বধ করে তাঁদের মনে ভয় জন্মিয়েছিলাম। দুঃশাসন দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ করলে, আমি যা বলেছিলাম, যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তা আমার স্মরণে ছিল। সেই প্রতিজ্ঞায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে আমি চিরকালের জন্য ক্ষত্রিয় ধর্মচ্যুত হব। এই ভেবেই আমি দুঃশাসনের রক্ত পান করেছি।
“কল্যাণী, পূর্বে আমরা কোনওদিন কৌরবের অপকার করিনি। তথাপি আপনার পুত্রেরা আমাদের অপকার করতেই থাকত। সেই অবস্থায় আপনি তাঁদের বারণ না করে এখন আমাকে দোষী বলে মনে করতে পারেন না।” গান্ধারী বললেন, “ভীম, তুমি অপরাজিত থেকে এই বৃদ্ধের একশত পুত্র বধ করতে প্রবৃত্ত হয়ে একটিমাত্র পুত্রকে অবশিষ্ট রাখলে না কেন? যাতে তোমার অপেক্ষাকৃত কম অপরাধ হত। বৎস আমাদের রাজ্য অপহরণ করে নিয়েছ, এই অবস্থায় আমাদের বৃদ্ধযুগলের যষ্টিস্বরূপ একটি সন্তানকেও অবশিষ্ট রাখলে না কেন? একটি পুত্রও যদি অবশিষ্ট থাকত এবং তুমি যদি ধর্মাচরণ করতে তবে তুমি পুত্ৰহন্তা হলেও তোমার উপর আমাদের এত আক্ষেপ হত না।
এই বলে পুত্রপৌত্র শোকাকুলা গান্ধারী যুধিষ্ঠিরের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “সে রাজা কোথায়?” তখন রাজশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির শাপের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গান্ধারীর কাছে উপস্থিত হয়ে মধুর বাক্য বললেন, “দেবী, আমি আপনার পুত্রহস্তা ও পৃথিবীর বীরনাশের একমাত্র কারণ। সুতরাং আপনার শাপদানের যোগ্যপাত্র এই সেই নৃশংস যুধিষ্ঠির। আমাকে অভিশাপ দিন। আমি সেইরূপ সুহৃদগণের বধ করে সুহৃদদ্রোহী হয়ে মহাশাপী হয়েছি। সুতরাং আমার জীবনে, রাজ্যে বা ধনে প্রয়োজন নেই।”
যুধিষ্ঠির এই কথা বলতে বলতে ভীত অবস্থায় নিকটবর্তী হলে গান্ধারীদেবী অত্যন্ত নিশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন, কিন্তু কোনও কথাই বললেন না। ক্রমে যুধিষ্ঠির গান্ধারীদেবীর চরণযুগলে পতিত হবেন বলে দেহ অবনত করলে, দূরদর্শিনী গান্ধারী নয়নযুগলের বস্ত্র অপসারিত করে যুধিষ্ঠিরের দক্ষিণ চরণের অঙ্গুলিসমূহের অগ্রদেশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তাতে যুধিষ্ঠিরের চরণের অঙ্গুলিসমূহ দগ্ধ হয়ে গেল। যুধিষ্ঠিরের পূর্বের সুসদৃশ নখগুলি কুনখীভূত হয়ে গেল।
তারপর অর্জুন কৃষ্ণের পিছন দিকে চলে গেলেন। এইভাবে নানা প্রকারে পাণ্ডবেরা গান্ধারীর ক্রোধ নিবৃত্তির জন্য চেষ্টা করতে লাগলে, গান্ধারী ক্রোধশূন্য হয়ে জননীর ন্যায় পাণ্ডবদের আশ্বস্ত করলেন। ক্রমে গান্ধারী অনুমতি দিলে, বিশালবক্ষা পাণ্ডবেরা কুন্তীদেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। কুন্তী এতকাল পুত্রদের অভাবে মনঃকষ্টে কালযাপন করছিলেন। এখন পুত্রদের দেখে তাঁর দু’চোখ জলে ভরে উঠল। বিপক্ষগণের অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত পুত্রদের দেহ কুন্তী বারবার দেখতে লাগলেন। এই অবস্থায় কুন্তী দেখলেন, হতপুত্রা দ্রৌপদী ভূতলে পতিত হয়ে রোদন করছেন।
দ্রৌপদী বললেন, “দেবী অভিমন্যুর সঙ্গে আপনার সেই পৌত্রেরা কোথায় গেল? তারা যে বহুপূর্বে আমাকে দেখে এখনও আপনার কাছে আসল না। হায়! আমি পুত্রহীনা হয়েছি। আমার রাজ্য দিয়ে কী হবে?” তখন দীর্ঘনয়না ও শোকার্তা কুন্তীদেবী রোদন-পরায়ণা সেই দ্রৌপদীকে উঠিয়ে আশ্বস্ত করলেন। তখন গান্ধারী পুত্রবধূ দ্রৌপদীর সঙ্গে যশস্বিনী কুন্তীকে বললেন, “বৎসে! তুমি এমন কোরো না। আমি কী প্রকারে দুঃখিতা, তাও দেখো। আমি মনে করি— এই লোমহর্ষণ যুদ্ধ লোকক্ষয় কাল পরিবর্তনে ঘটেছে এবং পূর্বে এ অবশ্যম্ভাবী ছিল। এখন স্বভাবত উপস্থিত হয়েছে। এই লোকক্ষয় নিয়তিবশত অপরিহার্য ছিল। বিশেষত যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, বীরেরাও গত হয়েছেন, অতএব তাঁদের জন্য শোক করা উচিত নয়, তুমিও শোক কোরো না, তুমিও যেমন শোকার্তা আমিও তেমনই শোকার্তা, কোন ব্যক্তিই বা আমাদের আশ্বস্ত করবে, হায়! আমারই অপরাধে এই বংশটা বিনষ্ট হয়ে গেল।
গান্ধারীর মৃতদেহ দর্শন
ব্যাসদেব গান্ধারীকে দিব্যদর্শন ক্ষমতা দিয়েছিলেন। গান্ধারী সেখানে থেকেই চোখ দিয়ে দূর থেকে কৌরবদের রণস্থল দেখতে পেলেন। দিব্যদর্শন গান্ধারী দূর থেকেই অত্যন্ত কাছের বস্তুর মতো মনুষ্যবীরগণের সেই অদ্ভুত ও লোমহর্ষণ রণস্থল তাকিয়ে দেখলেন। সেই রণস্থল অস্থি ও কেশে পরিপূর্ণ, রক্তপ্রবাহ আপ্লুত ও সকল বহুসহস্র শরীরে ব্যাপ্ত, গজযোধী, অশ্বযোধী ও রথযোধী বীরগণের রক্তসিক্ত ও মস্তকশূন্য দেহে এবং দেহশূন্য মস্তকসমূহে আচ্ছাদিত, হস্তী অশ্ব ও মনুষ্যগণের প্রাণহীন দেহে আবৃত, শৃগাল, বক, দাঁড়কাক, হাড়গিলা ও কাকসেবিত, নরমাংসভোজী রাক্ষসগণের আমোদজনক, কুরুল পক্ষীগণে ব্যাপ্ত। অমঙ্গলসূচক শৃগালগণের রবে নিনাদিত এবং গৃধ্রগণে পরিব্যাপ্ত ছিল।
তারপর বেদব্যাসের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণকে অগ্রবর্তী করে রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবেরা রণস্থলে গমন করলেন। কৌরব স্ত্রীগণ তাঁদের সঙ্গে সেই রণস্থলে গেলেন। সেই বিধবা স্ত্রীরা কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে দেখলেন পতিগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ ও পিতৃগণ নিহত হয়ে পড়ে আছেন। আর মাংসভোজী জন্তু, শৃগাল, দ্রোণকাক, সাধারণ কাক, ভূত, পিশাচ, রাক্ষস ও নানাবিধ নিশাচর জন্তুরা তাদের ভক্ষণ করছে। তখন সেই স্ত্রীলোকেরা রুদ্রের নৃত্যস্থলের ন্যায় রণস্থল দর্শন করে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে করতে মহামূল্য যান থেকে অবতরণ করলেন।
ক্রমে সেই ভরতবংশীয় স্ত্রীলোকেরা অদৃষ্টপূর্ব রণস্থল দর্শন করে দুঃখার্ত হয়ে একে অপরের গায়ের উপর পতিত হলেন এবং অন্য কয়েকজন ভূতলে পতিত হলেন। অন্য কতকগুলি শোকাকুল নারীর কোনও চৈতন্য ছিল না। সেই সময়ে পাঞ্চাল ও কৌরব স্ত্রীদের অত্যন্ত দুরবস্থা হয়েছিল। সকল দিকেই দুঃখাকুল চিত্ত নারীগণের ক্রন্দন কোলাহল হতে লাগল, এহেন ভীষণ রণস্থল দেখে এবং কৌরবগণের মহাক্ষয় প্রত্যক্ষ করে ধর্মজ্ঞা গান্ধারী পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে সম্বোধন পূর্বক দুঃখের সঙ্গে বলতে লাগলেন, “কৃষ্ণ! দেখো, আমার এই বিধবা পুত্রগণের বধূরা আলুলায়িত কেশে কুবরী-পক্ষীগণের মতো উচ্চৈঃস্বরে রোদন করছে। এরা এই কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে ভরতশ্রেষ্ঠগণকে স্মরণ করে দলে দলে পুত্রগণ, ভ্রাতৃগণ, পিতৃগণ ও পতিগণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কোথাও হতপুত্রা, বীরমাতারা এবং কোনও কোনও স্থলে বিধবা বীরপত্নীরা এই রণস্থলকে আবৃত করে ফেলেছে।
প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অভিমন্যু, দ্রুপদ ও শল্য প্রভৃতি বীরগণের দেহে এই রণস্থল শোভিত আছে। উত্তম কবচ মহাত্মাদের স্বর্ণময় রত্ন, অঙ্গদ, কেয়ূর ও মালায় এই রণস্থল অলংকৃত হয়ে আছে। বীরবাহু নিক্ষিপ্ত শক্তি, পরিঘ, তরবারি, নানাবিধ তীক্ষ্ণ বাণ ও ধনু পড়ে আছে। কোনও স্থলে মাংসভোজী জন্তুগণ মিলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও স্থানে নৃত্য করছে এবং কোনও স্থানে শয়ন করে আছে। কৃষ্ণ, তুমি এই রণস্থলটা একবার দেখো, আমি এ দৃশ্য দেখতে দেখতে শোকে দগ্ধ হচ্ছি। পাঞ্চাল ও কৌরবগণের বিনাশে পঞ্চভূতেরই যেন বিনাশ হয়ে গেছে বলে আমার বোধ আছে। জয়দ্রথ, কর্ণ, ভীষ্ম, দ্রোণ এবং অভিমন্যুর বিনাশ হবে বলে কোনও ব্যক্তি মনে করতে পারে? কৃষ্ণ দেখো, এই পুরুষশ্রেষ্ঠগণ অবধ্যকল্প ছিলেন, তথাপি দৈবের প্রভাবে নিহত হয়েছেন। এঁদের প্রাণ গিয়েছে। সুতরাং চৈতন্যও লুপ্ত হয়েছে। বিধাতা এঁদের গৃধ্র, কঙ্ক, দাঁড়কাক, শ্যেন, কুকুর ও শৃগালগণের খাদ্য করেছেন, এরা দুর্যোধনের বশীভূত ও কোপনস্বভাব ছিলেন। এখন এঁরা নির্বাপিতপ্রায় অগ্নির ন্যায় নিস্তেজ হয়ে আছেন।
“এঁরা সকলেই পূর্বে কোমল ও নির্মল শয্যায় শয়ন করতে অভ্যস্ত ছিলেন, হায়, তাঁরাই এখন মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে বিবৃত ভূমিতলে শয়ন করে আছেন। স্তুতিপাঠকেরা প্রত্যহ যথাসময়ে স্তব করতে থেকে যাঁদের অভিনন্দিত করত, তাঁরাই আজ শৃগালদের ভীষণ ও অমঙ্গলসূচক রব শুনছেন। যে সকল বীর পূর্বে চন্দন ও অগুরুলিপ্ত কোমল শয্যায় শয়ন করতেন, তাঁরাই আজ ধূলির উপরে শয়ন করে আছেন। ভীষণ ও অমঙ্গলসূচক গৃধ্র, শৃগাল ও কাকগণ বার বার রব করতে থেকে তাঁদের অলংকারসকল আকর্ষণ করছে। এই যুদ্ধাভিমানী বীরেরা জীবিত থেকেই যেন প্রীতিসহকারে তীক্ষ্ণধার পীতবর্ণ তরবারি ও নির্মল গদা ধারণ করে আছেন। সুন্দর রূপ, সুন্দর বর্ণ ও বৃষের তুল্য বিশাল নয়নশালী বহুসহস্র বীর শয়ন করে আছেন, আর মাংসভোজী জন্তুগণ তাঁদের ধরে টানছে। পরিখের ন্যায় দীর্ঘবাহু অন্যান্য বীরেরা প্রিয়তমা নারীদের ন্যায় গদাগুলিকে আলিঙ্গন করে বিমুখ হয়ে শয়ন করে আছেন। কতকগুলি বীর নির্মল অস্ত্র ধারণ করে শয়ন করে আছেন। তাতে তারা জীবিত আছেন মনে করেই মাংসভোজী জন্তুগণ ভয়ে তাঁদের আক্রমণ করছে না। অন্যান্য মহাত্মারা ভূতলে পতিত হয়ে আছেন, মাংসভোজী জন্তগণ তাঁদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের স্বর্ণ নির্মিত মালাগুলি ছড়িয়ে পড়ছে। জন্তুরা সেই অলংকারগুলি ধরে টানছে।
“কৃষ্ণ! রক্তোৎপল বনের ন্যায় মনোহর ও শোকানলশুষ্ক উত্তম রমণীগণ রোদন থেকে বিরত হয়ে বিভিন্ন পথে আত্মীয়জনের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এই কৌরব নারীগণের স্বর্ণবর্ণ মুখমণ্ডলসকল ক্রোধে ও রোদনে উদয়মান সূর্যের ন্যায় আম্রবর্ণ হয়ে গেছে। অন্য নারীরা এঁদের অসম্পূর্ণ বিলাপ শুনতে থেকে অন্যান্যের রোদনের অর্থ বুঝতে পারছেন না। এই রমণীরা বারবার দীর্ঘ নিশ্বাস ও বিলাপ করে দুঃখের বেগে কাঁপতে থেকে জীবন আহূতি দিচ্ছেন। বহুতর নারী আত্মীয়স্বজনের দেহগুলি দেখে তাঁদের ডাকছেন ও বিলাপ করছেন এবং অন্য কোমলপ্রাণ রমণীরা পাণিতল দ্বারা মস্তকে আঘাত করছেন।
স্তূপীকৃত ও পরস্পর সংলগ্ন পতিত মস্তক, হস্ত ও অন্যান্য সর্বপ্রকার প্রসঙ্গে সমরভূমি আকীর্ণ হয়ে গেছে। এইরূপ অবস্থা দর্শনে অনভ্যস্ত নারীরা মস্তকশূন্য এই সকল দেহ দেখে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছেন। শোকবিহ্বলচিত্ত কতকগুলি নারী মস্তককে দেহের সঙ্গে মিলিত দেখে এ মস্তক তো এ দেহের নয় এই ভেবে এবং অপর মস্তক দেখতে না পেয়ে দুঃখে আকুল হচ্ছেন। এই নারীরা পৃথক পৃথকভাবে বাণছিন্ন অন্য বাহু অন্য উরু, যোগ করতে থেকে, তা না মেলায়, দুঃখে আকুল হয়ে বার বার মূৰ্ছিত হচ্ছেন। কতকগুলি ভরতবংশীয় নারী ছিন্ন মস্তক ও পশুপক্ষী ভক্ষিত দেহসকল দেখে সেগুলি আপন ভর্তার নয় বলে বুঝতে পারছেন। অন্য নারীরা শত্ৰু নিহত ভ্রাতা, পিতা ও পুত্র ও পতিদের দেখে মস্তকে করাঘাত করছেন। তরবারি যুক্ত বাহু ও কুণ্ডলযুক্ত মস্তক সকল পতিত থাকায় এবং রক্ত ও মাংস কর্দমতুল্য হয়ে যাওয়ায় সমরভূমি অগম্য হয়ে গিয়েছে। এই অনিন্দ্যসুন্দর রমণীরা পূর্বে দুঃখভোগে অভ্যস্ত ছিলেন না। এখন ভ্রাতৃগণ, পিতৃগণ ও পুত্রগণের শবে পরিপূর্ণ সমরভূমিতে দুঃখে স্নান করছেন শোকার্তা গান্ধারী এইভাবে বিলাপ করতে থেকে নিহত দুর্যোধনকে দেখতে পেলেন। দুর্যোধনকে দেখে গান্ধারী শোকে মূর্ছিত হয়ে বনমধ্যে ছিন্ন কদলীবৃক্ষের ন্যায় তৎকালে ভূতলে পতিত হলেন। ক্রমে তিনি চৈতন্যলাভ করে বারবার উচ্চৈঃস্বরে রোদন করে, রক্তসিক্ত দেহ ও ভূতলে শায়িত দুর্যোধনের দিকে দৃষ্টিপাত করে এবং তাঁকে আলিঙ্গন করে কাতরভাবে বিলাপ করলেন। তখন তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়ই শোকে বিকল হয়ে গেল। সেই অবস্থায় তিনি ‘হাহা পুত্র’ বলে বিলাপ করতে লাগলেন।
কৃষ্ণের স্কন্ধসন্ধি মাংসে আবৃত থাকায় তাঁর দেহটিকে বিশাল দেখা যাচ্ছিল। তাঁর বক্ষস্থলে হার ও কৌস্তুভমণি দুলছিল। সেই অবস্থায় তিনি সেই সময়ে গান্ধারীর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন গান্ধারী নয়নজলে বক্ষস্থল সিক্ত করতে থেকে কৃষ্ণকে বললেন, “প্রভাবশালী বৃষ্ণিনন্দন, এই যুদ্ধ ও জাতিক্ষয় উপস্থিত হলে, এই রাজশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন আমার কাছে এসে বলেছিলেন, ‘মা! এই জ্ঞাতিসংঘর্ষে আমার জয় হোক বলে আপনি আশীর্বাদ করুন।’ দুর্যোধন এই কথা বললেও তার যে বিপদ আসছে তা জানতে পেরে আমি বলেছিলাম, ‘যে পক্ষে ধর্ম আছেন, সেই পক্ষে জয় হবে। প্রভাবশালী পুত্র, তুমি যুদ্ধ করতে থেকে যাতে অসাবধান না হও তা করবে। তারপর তুমি দেবতার ন্যায় শস্ত্রার্জিত লোক লাভ করবে।’ আমি দুর্যোধনকে একথা বলেছিলাম সুতরাং এখন তাঁর জন্য শোক করি না; কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধুগণ নিহত হয়েছেন এবং তিনিও অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছেন, অতএব তাঁর জন্য শোক করছি। কৃষ্ণ দেখো— অসহিষ্ণুস্বভাব, যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ, সমস্ত অস্ত্রে সুশিক্ষিত ও যুদ্ধদুর্ধর্ষ আমার পুত্র দুর্যোধন বীরশয্যায় শয়ন করে আছেন। যে শত্ৰুসন্তাপক রাজা সমস্ত রাজার অগ্রে গমন করতেন, তিনিই আজ ধূলির উপর শয়ন করে আছেন। কালের পরিবর্তনটা দেখো।
“পূর্বে উত্তম রমণীরা সেবা করতে থেকে যাঁকে আনন্দিত করত, আজ অমঙ্গলসূচক শৃগালেরা বীরশয্যায় শায়িত সেই বীরকে আনন্দিত করছে। পূর্বে জ্ঞানীগণ এসে উপাসনায় প্রবৃত্ত হয়ে যাঁকে সন্তুষ্ট করতেন, আজ গৃধ্রপক্ষীরা নিহত ও ভূতলপতিত সেই বীরকে সন্তুষ্ট করছে। পূর্বে রমণীরা ময়ূরপুচ্ছের ব্যজন দ্বারা যাঁকে ব্যজন করত, আজ পক্ষীরা পক্ষব্যজনদ্বারা তাঁকে ব্যজন করছে। মহাবাহু, বলবান ও যথার্থবিক্রমশালী দুর্যোধন ভীমকর্তৃক নিপাতিত হয়ে সিংহ নিপাতিত হস্তীর ন্যায় শয়ন করে আছেন। ভরতনন্দন দুর্যোধন ভীমের হাতে নিহত হয়ে রক্তসিক্ত গাত্রে গদা আলিঙ্গন করে শায়িত আছেন। যিনি পূর্বে যুদ্ধে একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্য আনয়ন করেছিলেন, তিনি দুর্নীতিবশত নিধনপ্রাপ্ত হয়েছেন। সিংহ যেমন ব্যাঘ্রকে নিপাতিত করে, সেইরূপ ভীমসেন মহাধনুর্ধর ও মহারথ দুর্যোধনকে নিপাতিত করেছেন। মন্দভাগ্য ও মূঢ় দুর্যোধন পিতাকে ও বিদুরকে অবজ্ঞা করে অল্পবয়স্ক হয়েও বৃদ্ধের অবমাননা করায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। সমগ্র পৃথিবী নিষ্কন্টক হয়ে ত্রয়োদশ বর্ষ যাঁর অধীনে ছিল, সেই মহীপতি আমার পুত্র দুর্যোধন নিহত হয়ে ভূতলে শায়িত রয়েছেন।
“আমি পূর্বে দেখতাম, দুর্যোধন পৃথিবী শাসন করছেন। তাতে যে পৃথিবী হস্তী, অশ্ব ও গোসমূহে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, তা আমি দীর্ঘকাল দেখতে পেলাম না। আমি আজ পৃথিবীকে অন্যের শাসনে প্রবৃত্ত দেখছি। হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি পশুগুলি আর নেই। অতএব আমি কেন জীবিত আছি? কৃষ্ণ আর-একটা অধিক কষ্টদায়ক ব্যাপার দেখো, আমার পুত্র দুর্যোধনের বধ হওয়ায় এই সকল নারী রণস্থলে নিহত বীরগণের সেবা করছেন। দেখো, আলুলায়িত কুন্তলা ও সুনিতম্বা লক্ষ্মণের মাতা (দুর্যোধনের ভার্যা) পূর্বে দুর্যোধনের সুলক্ষণ সম্পন্ন ক্রোড়ে অধিষ্ঠান করে, সুন্দর বাহুদ্বারা দুর্যোধনের বাহুযুগল অবলম্বন করে আনন্দ উপভোগ করতেন। তিনি আজ সুন্দর স্বর্ণময় বেদির ন্যায় পতিত আছেন। সপুত্র দুর্যোধন নিহত দেখেও আমার হৃদয় কেন শতধা বিদীর্ণ হচ্ছে না? সুন্দর উরুযুগল সমন্বিতা অনিন্দ্যসুন্দরী দুর্যোধনভার্যা রক্তসিক্ত পুত্র লক্ষ্মণের মস্তক আঘ্রাণ করছেন এবং দুর্যোধনের গাত্রমার্জনা করছেন। ইনি ভর্তা অথবা পুত্র কার জন্য শোক করছেন বোঝা যাচ্ছে না! আবার দেখো, দুর্যোধনভার্যা করযুগল দ্বারা মস্তকে আঘাত করে বীর দুর্যোধনের বক্ষস্থলে পতিত হচ্ছেন। পদ্মকোষের ন্যায় গৌরবর্ণা ও দীনা এই নারী পদ্মকোষের তুল্য ভর্তার মুখমণ্ডল ও পুত্রের মুখমণ্ডল মার্জন করছেন। যদি ধর্মশাস্ত্র ও বেদ সত্য হয় তা হলে এই রাজা নিশ্চয় বাহুবলার্জিত স্বর্গলোক লাভ করেছেন।
“কৃষ্ণ দেখো— আমার ক্লান্তিহীন একশত পুত্রের মধ্যে অনেককেই একা ভীমসেন গদাদ্বারা নিহত করেছেন। আমার এই বালিকা ও হতপুত্ৰা পুত্রবধূরা আলুলায়িত কেশে রণক্ষেত্রে ছুটোছুটি করছেন। এই নারীরা পূর্বে নানা অলংকারে অলংকৃত চরণদ্বারা অট্টালিকার ভিতরে বিচরণ করতেন। কিন্তু এখন এঁরা বিপন্ন হয়ে যে রক্তসিক্ত রণভূমি স্পর্শ করছেন, এও আমার অধিক দুঃখের কারণ। এই শোকার্ত নারীরা ঘুরতে থেকে গৃধ্র, শৃগাল ও কাকগণকে ক্রমাগত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। এই অনিন্দ্যসুন্দরী ও কৃশকটি নারী এই ভীষণ মহামারী দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে ধাবিত হচ্ছেন। মহাবাহু কৃষ্ণ এই রাজকন্যা ও রাজপত্নী লক্ষ্মণের মাতাকে দেখে আমার মন শান্তই হচ্ছে না। সুন্দর বাহুযুক্ত এই রমণীগণের মধ্যে কেউ কেউ নিহত ভ্রাতৃগণের কেউ কেউ নিহত পুত্রগণের বাহু ধারণ করে তাঁদের উপর পতিত হচ্ছেন।
অপরাজিত কৃষ্ণ, এই ভীষণ মহামারী উপলক্ষে হতবন্ধু, মধ্যম বয়স্ক ও বৃদ্ধ নারীগণের ভীষণ ক্রন্দন কোলাহল একবার শ্রবণ করো। দেখো— শান্ত, মুগ্ধ ও শোকার্ত নারীরা রথের নীড় (সারথির বসার স্থান) এবং নিহত হস্তী, অশ্বগণের দেহ ধারণ করে বিশ্রামের জন্য কিছুকাল অবস্থান করছেন। দেখো— অপর কেহ উত্তম নাসিকা সমন্বিত কোনও আত্মীয়জনের দেহবিচ্ছিন্ন মস্তকটি নিয়ে নিরীক্ষণ করছেন। এই অনিন্দ্যসুন্দর নারীরা এবং অল্পবুদ্ধিশালিনী আমি পূর্বজন্মে যেন বহুতর পাপ করেছিলাম বলে মনে করি। বৃষ্ণিনন্দন! যুধিষ্ঠির যখন ধর্মরাজ হয়েও আমাদের এই সমগ্র সৈন্য নিহত করেছেন, তখন আমার ধারণা এই যে, ফলভোগ ব্যতীত পুণ্য ও পাপের ধ্বংস হয় না।
“কৃষ্ণ তরুণীগণকে দর্শন করো— এদের স্তন ও মুখমণ্ডল সুদৃশ্য এবং নয়নের লোম, নয়নের মণি ও কেশকল্প কৃষ্ণবর্ণ, বিশেষত এরা সৎকুলে উৎপন্ন এবং লজ্জাশীল। হংসের ন্যায় গদগদভাষিণী, দুঃখে ও শোকে মোহিতা এবং সারসপক্ষীগণের ন্যায় রোদনকারিণী এই রমণীরা ভূতলে পতিত হয়ে রয়েছেন। প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় মনোহর রমণীগণের অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডলকে সূর্য সন্তপ্ত করছেন। মত্তহস্তীর ন্যায় দর্পশালী ও ঈর্ষান্বিত আমার পুত্রগণের অন্তঃপুরস্থ নারীগণকে আজ সাধারণ লোকেরাও দেখছে।
“কৃষ্ণ দেখো, আমার পুত্রগণের এই সকল শতচন্দ্র চর্ম, সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল ধ্বজ, স্বর্ণময় বর্ম, স্বর্ণময় বক্ষোভূষণ এবং শিরস্ত্রাণ সকলই ঘৃতাহুতি অগ্নির ন্যায় ভূতলে জ্বলছে। এই দুঃশাসন শয়ন করে আছেন। শত্ৰুহন্তা ভীম তাঁকে যুদ্ধে নিপাতিত করেছে এবং সমস্ত অঙ্গ থেকে তাঁর রক্তপান করেছে। দেখো, দ্রৌপদী দ্যূতসভার ক্লেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভীমসেনকে ক্ষিপ্ততম করেছিলেন। তাতে ভীমসেন গদাদ্বারা আমার পুত্র দুঃশাসনকে নিপতিত করেছেন। জনার্দন, দুঃশাসনও কর্ণের প্রিয়কার্য করবার ইচ্ছা করে সেই দ্যূতসভায় দ্যূতনিৰ্জিত দ্রৌপদীকে বলেছিলেন, পাঞ্চালী, তুমি এখন দাসগণের ভার্যা হয়েছ। অতএব তুমি যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের সঙ্গে আমাদের গৃহের ভিতরে প্রবেশ করো।
“কৃষ্ণ, আমি তখন রাজা দুর্যোধনকে বলেছিলাম, পুত্র তুমি ক্রোধপাশে বদ্ধ শকুনিকে বর্জন করো। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার এই মাতুলটা অত্যন্ত দুর্বুদ্ধি ও কলহপ্রিয়। তুমি একে পরিত্যাগ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপন করে শান্ত হও। দুর্মতি দুর্যোধন, তুমি বুঝতে পারছ না উল্কা (মশাল) যেমন হস্তীকে আঘাত করে, তুমিও তেমনই বাক্যরূপ তীক্ষ্ণবাণ দিয়ে ভীমসেনকে আঘাত করছ। ভীমসেন সেই সকল বাকশল্য স্মরণ রেখে নির্জনে ক্রূদ্ধ হয়ে রয়েছিল, তারপর সর্প যেমন বিশাল বৃষের উপর বিষ প্রয়োগ করে, সেইরকম ভীমসেন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের উপর ক্রোধ নিক্ষেপ করেছে। সিংহ যেমন মহাহস্তীকে নিহত করে, সেইরকম ভীমসেন দুঃশাসনকে নিহত করেছে। সুতরাং দুঃশাসন বাহুযুগল প্রসারিত করে এই শয়ন করে আছে।
“মাধব আমার পুত্র, প্রাজ্ঞজনপ্রিয় বিকর্ণ ভীমকর্তৃক নিহত ও ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হয়ে ভূতলে পতিত হয়ে আছেন। শরৎকালে নীলমেঘ পরিবেষ্টিত চন্দ্রের ন্যায় ইনি নিহত হস্তীসমূহের মধ্যে শুয়ে আছেন। অবিরত ধনু সঞ্চালন করায় এর করতলে কড়া পড়েছিল এবং ওই কড়ায় চর্মের আবরণ ছিল। তাতেই গৃধ্রগণ অতিকষ্টে তা ছিঁড়ে ফেলছে। শোকার্তা ও বালিকা ওই বিকর্ণের ভার্যা মাংসলোভী এই গৃধ্রগণকে অনবরত বারণ করছেন, কিন্তু বারণ করে উঠতে পারছেন না। যুবক, সুন্দরাকৃতি, বীরমুখে অবস্থিত ও সুখভোগের যোগ্য এই বিকর্ণ আজ ধূলির উপর শয়ন করে আছেন। কর্ণী, নালিক ও নারাচের আঘাতে তার মর্মস্থান বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছে; তথাপি এখনও বীরশ্রী এই ভরতশ্রেষ্ঠকে পরিত্যাগ করছে না।
“সমরবীর ভীমসেন প্রতিজ্ঞাপালন করার জন্য শত্রুগণহস্তা দুর্মুখকে নিহত করেছে। সেই দুর্মুখ বিমুখ হয়ে পতিত রয়েছেন। হিংস্র জন্তুগণ এর মুখখানির অর্ধাংশ ভক্ষণ করেছে। তাতেও তাকে সপ্তমীর চাঁদের ন্যায় সুন্দর লাগছে। কৃষ্ণ তুমি বীর দুর্মুখের মুখখানিও একবার চেয়ে দেখো। হায়! আমার সেই বীর পুত্রও নিহত হয়ে কেন ধূলি ভক্ষণ করছে। যুদ্ধে যার সম্মুখে কেউ থাকতে পারত না, সেই দেবসৈন্য বিজয়ী দুর্মুখকে শত্রুরা কীভাবে বধ করল।
“দেখো, ধনুর্ধরগণের উপমাস্থল ধৃতরাষ্ট্র নন্দন চিত্রসেন নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করে আছেন। শোকার্তা যুবতীরা মাংসভোজী জন্তুগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিচিত্র মাল্যাভরণধারী সেই চিত্রসেনের সেবা করছেন। স্ত্রীগণের নানাপ্রকার রোদনধ্বনি এবং হিংস্র জন্তুগণের বহুবিধ গর্জন এই উভয়ে মিলিত হয়ে আমার কাছে বিচিত্র বলে বোধ হচ্ছে। মাধব, যুবক সুন্দর ও সর্বদা উত্তম স্ত্রীসেবিত বিবিংশতি নিহত হয়ে ধূলির উপরে ওই শয়ন করে আছে। বাণে বাণে তাঁর বর্ম ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, পরে তিনি নিহত হয়েছিলেন। এখন গৃধ্রগণ তাঁকে ঘিরে রেখেছে। বীর বিবিংশতি পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করে পরে সৎপুরুষোচিত বীরশয্যায় শয়ন করেছেন। বিবিংশতির মুখখানি একবার দেখো— তা এখনও মৃদুহাস্যযুক্ত সুন্দর নাসিকা ও ভ্রূযুগল সমন্বিত অত্যন্ত নির্মল এবং চন্দ্রের তুল্য। সহস্র সহস্র দেবকন্যা যেমন ক্রীড়াপ্রবৃত্ত গন্ধর্বের সেবা করে, সেই রকম উত্তম রমণীরা বহুপ্রকারে তাঁর সেবা করতেন।
দুঃসহ বীর ছিলেন, বীরশোভায় রণস্থল শোভিত করতেন। বীরসৈন্য সংহার করতে পারতেন এবং শত্রুপক্ষকে দমনে সমর্থ ছিলেন, সুতরাং কোনও ব্যক্তি দুঃসহকে সহ্য করতে পারত না। পর্বত আপন শরীরের উৎপন্ন প্রস্ফুটিত কর্ণিকার পুষ্পে যেমন শোভিত হয়। তেমনই গতাসু হয়েও স্বর্ণময়ী মালা ও উজ্জ্বল কবচদ্বারা দুঃসহ শোভিত হচ্ছেন।”
গান্ধারী বললেন, “কেশব অন্যান্য বীরগণ বল ও বীরত্ব বিষয়ে পিতা অর্জুন বা তোমার থেকে যাঁকে দেড়গুণ অধিক বলতেন, যিনি দর্পিত সিংহের ন্যায় দুর্ধর্ষ ছিলেন এবং যিনি একক আমার পুত্রের দুর্ভেদ্য সৈন্য ভেদ করে অন্যান্য বীরের মৃত্যুজনক হয়েছিলেন; পরে সেই অভিমন্যুই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। অমিততেজা, অর্জুননন্দন, নিহত হতে থাকলেও আজ পর্যন্ত তাঁর প্রভা বিনষ্ট হয়নি। বিরাট রাজার তনয়া, অর্জুনের পুত্রবধূ, অনিন্দ্যসুন্দর বালিকা উত্তরা বীর পতিকে দেখে আকুল হয়ে শোক করছেন। ভার্যা উত্তরা সেই বীরপতি অভিমন্যুকে কাছে পেয়ে হস্ত দ্বারা তার অঙ্গ মার্জনা করছেন। অনুরাগিণী, স্পৃহনীয় রূপশালিনী ও মনস্বিনী উত্তরা প্রস্ফুটিত পদ্মের তুল্য ও তার গোল কম্বুগ্রীবাযুক্ত অভিমন্যুর মুখমণ্ডলের ঘ্রাণ নিয়ে লজ্জিত হয়ে তাঁর দেহ আলিঙ্গন করে আছেন। ইনি পূর্বেও মদ্যপানে মত্ত হয়ে সম্ভবত এইভাবেই আলিঙ্গন করতেন। উত্তরা অভিমন্যুর রুধিরলিপ্ত ও স্বর্ণখচিত বর্মটি খুলে ফেলে তার দেহের দিকে দৃষ্টিপাত করছেন। অভিমন্যুকে দেখতে দেখতে উত্তরা তোমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘পুণ্ডরীকাক্ষ, আপনার চোখের মতো যাঁর চোখ ছিল, এই তিনি পড়ে আছেন। যিনি বল, বীর্য, তেজ এবং রূপে আপনার মতোই ছিলেন, তিনি নিপাতিত হয়ে ভূতলে পতিত আছেন।” অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে উত্তরা বলছেন, ‘নাথ, আপনার অঙ্গ সকল অত্যন্ত কোমল ছিল। সুতরাং আপনি শঙ্কুমৃগের চর্মে শয়ন করতেন, আপনার সেই শরীরটি আজ ভূতলে পতিত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে না কি? হায়! হস্তীহস্তের চর্মময় বর্মধারী এবং বারংবার ধনুর গুণ সঞ্চালন করে কঠিন চর্মসমন্বিত স্বর্ণকেয়ূরযুক্ত বিশাল বাহু দু’খানি ভূতলে প্রসারিত করে আপনি শয়ন করে আছেন। আপনি বহুপ্রকার যুদ্ধ ব্যায়াম করে পরিশ্রমবশতই যেন সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। সেইজন্যই আমি এত বিলাপ করলেও আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। আমি আপনার কাছে কোনও অপরাধ করেছি বলে আমার স্মরণ হয় না। তবু আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না কেন? আপনি পূর্বে দূর থেকে আমাকে দেখলেও তো অভিভাষণ করতেন। মাননীয় প্রাণনাথ, আপনি আর্যা সুভদ্রাদেবীকে, এই দেবতুল্য পিতৃগণকে এবং শোকার্ত আমাকে পরিত্যাগ করে কোথায় যাবেন?” তারপর উত্তরা হাতদ্বারা রক্তলিপ্ত অভিমন্যুর কেশগুলি ধারণ করে তাঁর মুখখানি কোলে তুলে জীবিতের ন্যায়ই তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন—
হায়! আপনি কৃষ্ণের ভাগিনেয় এবং অর্জুনের পুত্র ছিলেন, তাতে এই মহারথেরা আপনাকে বধ করলেন কীভাবে? যাঁরা আপনাকে বধ করেছেন তারা নিষ্ঠুর কার্য করেছেন। সেই দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণকে এবং জয়দ্রথকে ধিক! আপনি বালক এবং আপনি একাকী ছিলেন, সেই অবস্থায় দ্রোণ প্রভৃতি রথীশ্রেষ্ঠরা সকলে আপনাকে পরিবেষ্টন করে আমার দুঃখের জন্য প্রহার করছিলেন। তখন তাঁদের মন কেমন অবস্থায় ছিল। আপনি রক্ষকশালী হয়েও পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের সমক্ষে রক্ষকহীন অবস্থায় কী প্রকারে নিহত হয়েছিলেন। বহু মহারথ আপনাকে যুদ্ধে নিহত করেছেন। এ দেখে পাণ্ডুনন্দন, পুরুষশ্রেষ্ঠ ও বীর আপনার সেই পিতা কী করে জীবিত আছেন? পদ্মনয়ন, আপনাকে হারিয়ে বিশাল রাজ্যলাভ করেও এবং প্রবল শত্ৰুজয় করেও পাণ্ডবগণের প্রীতি সম্পাদন করবে না। নাথ, আপনি ধর্মানুসরণ করে ইন্দ্রিয় দমনের গুণে শস্ত্রজিৎ স্বর্গলাভ করেছেন। আমি সত্বরই আপনার অনুসরণ করব। আপনি কিন্তু সেখানেও আমাকে পালন করবেন। সময় উপস্থিত না হলে কেউই মরতে পারে না। যেহেতু আপনাকে নিহত দেখেও দুর্ভাগা আমি জীবিত আছি। আপনি এখন পিতৃলোক গমন করে, অল্প ও কোমলবাক্যে আমার ন্যায় অঙ্গ কোনও অন্য রমণীর সঙ্গে আলাপ করবেন। নিশ্চয় আপনি মনোহর রূপ ও মৃদু হাস্যযুক্ত বাক্য দ্বারা অপ্সরাদের মন আলোড়ন করবেন। আপনি পুণ্যার্জিত স্বর্গলোকে গমন করে অপ্সরাদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে যথাসময়ে বিহার করতে থেকে আমার সদ্য ব্যবহারগুলি স্মরণ করবেন তো? আপনি আমার সঙ্গে এই পৃথিবীতে সামান্য সময় মাত্র সহবাস করলেন, মাত্র ছ’মাস, সপ্তম মাসে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।”
উত্তরা এই কথাগুলি যখন বলছেন, তখন বিরাটরাজার কুলবধূরা এসে ব্যর্থসংকল্পা উত্তরাকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। বিরাটরাজার সেই কুলবধূরা উত্তরাকে টেনে নিয়ে যেতে গিয়ে বিরাটরাজাকে নিহত দেখে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে রোদন ও বিলাপ করছেন। বিরাটরাজা রক্তাক্ত দেহে শয়ন করে আছেন। দ্রোণের বাণে ও অন্যান্য অস্ত্রে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সকল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এই অবস্থায় গৃধ্র, শৃগাল, কাকগণ তাঁর কাছে এসে নানাবিধ রব করছে। পক্ষীরা চক্ষুদ্বারা তাঁর অঙ্গসকল ক্ষতবিক্ষত করছে। এই অবস্থায় নীলনয়না ও শোকার্তা কুলবধূরা এসে সেই পক্ষীগণকে নিবারণ করতে পারছে না। সূর্যকিরণে সন্তপ্ত ও বিবর্ণ এই নারীগণের মুখমণ্ডলগুলির আকৃতি কষ্টে ও পরিশ্রমে বিকৃত হয়ে গেছে।
গান্ধারী বললেন, “কৃষ্ণ দেখো! মহাধনুর্ধর ও মহাবল এই কর্ণ যুদ্ধে অর্জুনের তেজে প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় নিহত হয়ে শয়ন করে আছেন। বৈকর্তন কর্ণ যুদ্ধে বহুতর অতিরথকে বধ করে রক্তাক্তদেহে ভূতলে পতিত হয়ে শায়িত আছেন। হস্তীগণ যেমন যুথপতিকে অগ্রবর্তী করে যুদ্ধ করে, তেমনই আমার মহারথ পুত্রগণ পাণ্ডবগণের ভয়ে যাঁকে অগ্রবর্তী করে যুদ্ধ করেছেন। সিংহ যেমন ব্যাঘ্রকে নিহত করে, মত্তহস্তী যেমন অপর হস্তীকে নিপাতিত করে, সেইরকম অর্জুন যুদ্ধে কর্ণকে নিপাতিত করেছেন। এখন কর্ণের ভার্যারা এসে রোদন করতে করতে স্বলিতকেশ যুদ্ধে নিহত ওই বীরের সেবা করছেন। মাধব, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যাঁর ভয়ে সর্বদা আত্মরক্ষার চিন্তা করতে থেকে, এই তেরো বৎসর যাবৎ নিদ্রা যেতে পারেননি; ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধে শত্রুগণের অজেয়, প্রলয়াগ্নির ন্যায় তেজস্বী এবং হিমালয়ের ন্যায় স্থির সেই কর্ণ দুর্যোধনের রক্ষক হয়েও বায়ুভগ্ন বৃক্ষের ন্যায় নিহত অবস্থায় ভূতলে শয়ন করে আছেন। দেখো, কর্ণের পত্নী ও বৃষসেনের মাতা অনবরত বিলাপ ও রোদন করতে থেকে ভূতলে পতিত হয়ে আছেন।
“মহাবীর কর্ণ, নিশ্চয়ই তোমার গুরু পরশুরামের অভিসম্পাত তোমাকে অনুসরণ করেছিল। যেহেতু এই রণভূমি তোমার রথের চাকা গ্রাস করেছিল। সেইজন্যই অর্জুন বাণদ্বারা রণস্থলে শত্রুগণমধ্যে তোমার মস্তক অপহরণ করতে সমর্থ হয়েছিল। হায়! হায়! এই সুষেণের মাতা (কর্ণের পত্নী) স্বর্ণকবচাবৃত, মহাব্যবসায়ী ও মহাবাহু কর্ণকে নিহত দেখে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে রোদন করতে থেকে অচৈতন্য অবস্থায় ভূতলে পতিত হয়েছেন। মাংসভোজী জন্তুগণ ভক্ষণ করতে থেকে মহাত্মা কর্ণের দেহটির অল্পই অবশিষ্ট রেখেছে। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে চন্দ্রের ন্যায় ওই দেহটি আমাদের আর প্রীতি উৎপাদন করছে না। কর্ণের পত্নী পুত্রবধেও সন্তপ্ত থেকে একবার একবার ভূতলে পতিত হয়ে, আবার উঠে কর্ণের মুখমণ্ডলের ঘ্রাণ নিতে থেকে অনবরত রোদন করছেন।
“মধুসূদন দেখো, বীর অবন্তীরাজ বিন্দ শত্রুপক্ষের মধ্যে মহামারী ঘটিয়ে ভীমসেন কর্তৃক নিহত হয়েছেন। শৃগালগণ, কঙ্ক (হাড়গিলা) গণ এবং মাংসভোজী জন্তুগণ তাঁকে নানাদিকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। কৃষ্ণ দেখো মহাধনুর্ধর ও উদারচেতা প্রতিপনন্দন বহ্নিক ভল্লের আঘাতে নিহত হয়ে, ব্যাঘ্রের ন্যায় যেন শয়ন করে আছেন। ইনি নিহত হলেও পূর্ণিমাতিথিতে উদীয়মান পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় তাঁর সমুজ্জ্বল মুখবর্ণ এখনও শোভা পাচ্ছে।
পুত্রশোকে সন্তপ্ত অর্জুন আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার জন্য যুদ্ধে জয়দ্রথকে নিপাতিত করেছেন। কৃষ্ণ দেখো, দ্ৰোণ প্রভৃতি মহাত্মারা রক্ষা করছিলেন সেই অবস্থাতেই অর্জুন নিজের প্রতিজ্ঞা সত্য করবেন বলে এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্য ভেদ করে গিয়ে সেই জয়দ্রথকে বধ করেছেন। গৃধ্র ও শৃগালগণ এখন সেই সিন্ধু ও সৌবীর দেশের রাজা দর্পশালী ও মনস্বী জয়দ্রথকে ভক্ষণ করছে। জয়দ্রথের ভার্যারা তাঁর দেহটি রক্ষা করতে থাকলে, কম্বোজ ও যবনদেশীয় রমণীরা সেই দেহটির শুশ্রূষা করছে। জনার্দন যখন কেকয়গণের সঙ্গে দ্রৌপদীকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তিনি পাণ্ডবগণের বধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ, পাণ্ডবেরা তখন দুঃশলার কথা বিবেচনা করে জয়দ্রথকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তারপর এখন সেই পাণ্ডবেরা সেই জয়দ্রথকে বধ করে দ্রৌপদীর সম্মান বাড়াবেন না কেন? বালিকার ন্যায় শোকাকুলা আমার কন্যা দুঃশলা অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে আত্মহত্যার জন্য বক্ষে করাঘাত করছেন ও পাণ্ডবদের প্রতি গালি দিচ্ছেন। এর থেকে গুরুতর দুঃখ আমার আর কী হবে, যেহেতু বালিকা কন্যা ও হতস্বামিনী পুত্রবধূরা বিধবা হয়েছেন। দেখো, আমার দুঃশলা ভর্তার মস্তকটি না পেয়ে, ভয় ও শোক ত্যাগ করে ইতস্তত ছুটোছুটি করছে।
গান্ধারী বললেন, “বৎস কৃষ্ণ, নকুলের সাক্ষাৎ মাতুল শল্য যুদ্ধে ধর্মজ্ঞ ধর্মরাজের হস্তে নিহত হয়ে এই শয়ন করে আছেন। যিনি সর্বদা তোমার সঙ্গে স্পর্ধা করতেন সেই মদ্ররাজ নিহত হয়ে এই শয়ন করে আছেন। যিনি যুদ্ধে কর্ণের সারথ্যগ্রহণ করেও পাণ্ডবগণের জয়ের জন্য সেই কর্ণেরই তেজক্ষয় করেছিলেন। হায়! হায়! কৃষ্ণা, দেখো, পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন ও পদ্মপত্রের ন্যায় সুন্দর নয়ন শল্যের মুখখানিকে কাকগণ দংশন করেছে, তথাপি তা ব্রণশূন্যই রয়েছে। কৃষ্ণ স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ এই তপ্তকাঞ্চনবর্ণ জিহ্বাটি মুখ থেকে বেরিয়ে রয়েছে এবং পক্ষীরা তা ভক্ষণ করছে। কুলাঙ্গনারা রোদন করতে থেকে যুদ্ধশোভী ও মদ্রদেশের রাজা যুধিষ্ঠির নিহত শল্যকে পরিবেষ্টন করে শুশ্রূষা করছেন। অত্যন্ত সূক্ষ্ম বসনধারিণী এই ক্ষত্রিয় রমণীরা নরশ্রেষ্ঠ ও ক্ষত্রিয় প্রধান শল্যের কাছে গিয়ে তাঁর আহ্বান করতে থেকে, ঋতুমতী ধেনুগুলি যেমন কর্দমমগ্ন বৃষকে পরিবেষ্টন করে সকল দিকে অবস্থান করে, সেইরূপ নিপতিত শল্যকে পরিবেষ্টন করে তাঁর সকল দিকে অবস্থান করছেন।
“পর্বতাধিবাসী, প্রতাপশালী ও গজাঙ্কুশধারীশ্রেষ্ঠ রাজা ভগদত্ত অর্জুন কর্তৃক নিপাতিত হয়ে ভূতলে শায়িত আছেন। হিংস্র জন্তুরা তাঁকে ভক্ষণ করছে। তাঁর মস্তকে এই স্বর্ণময়ী মালা কেশগুলির শোভা উৎপাদন করতে থেকেই যেন প্রকাশ পাচ্ছে। পূর্বকালে বৃত্রাসুরের সঙ্গে ইন্দ্রের যেমন যুদ্ধ হয়েছিল, তেমনই এঁর সঙ্গে অর্জুনের অতিদারুণ ও লোমহর্ষক গুরুতর যুদ্ধ হয়েছিল। এই ভগদত্ত পৃথানন্দন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তাঁর জীবন সন্দেহাপন্ন করে, শেষে তাঁরই হাতে নিহত হয়েছেন।
“এই জগতে শৌর্যে ও বীর্যে যার তুলনা কেউ নন, যুদ্ধে ভীষণ কার্যকারী সেই ভীষ্ম আহত হয়ে শয়ন করে আছেন। প্রলয়কালে আকাশ থেকে কালনিপাতিত সূর্যের ন্যায় এই সূর্যতুল্য তেজস্বী শান্তনুনন্দন ভীষ্ম শায়িত আছেন। এই বীর্যবান নরসূর্য অস্ত্রের তাপে শত্রুগণকে সন্তপ্ত করে সূর্য যেমন অস্তাচল প্রাপ্ত হন, সেইরকম অস্তপ্রাপ্ত হয়েছেন। দেখো, ঊর্ধবরেতা ও সত্যপ্রতিজ্ঞ ভীষ্ম বীরসেবিত বীরশয্যায় পতিত হয়ে শরশয্যাতে অবস্থান করছেন। ভগবান কার্তিক যেমন শরবনে শয়ন করতেন, সেই রকম ভীষ্ম কর্ণী, নালিক ও নারাচ প্রভৃতি বাণদ্বারা শয্যা রচনা করে তাতে শয়ন করে আছেন, অর্জুন তিনটি বাণদ্বারা তাঁর উত্তম উপাধান নির্মাণ করে দিয়েছেন, সেই উপাধান তুলায় পরিপূর্ণ নয়।
“মাধব যুদ্ধে অতুলনীয় উর্ধবরেতা ও মহাযশা ভীষ্ম পিতার আদেশ পালন করতে থেকে এই শায়িত আছেন। বেদব্যাসের মত অনুসারে যিনি ধর্মাত্মা ও সর্বজ্ঞ বলে বিখ্যাত ছিলেন, এই সেই ভীষ্ম মানুষ হয়েও দেবতার ন্যায় প্রাণধারণ করে আছেন। যুদ্ধে যাঁর তুল্য নিপুণ, অভিজ্ঞ ও পরাক্রমশালী কেউ নেই, এই সেই ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিয়েছিলেন। কুরুবংশ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেই অবস্থায় যিনি বেদব্যাস দ্বারা পুনরায় তা রক্ষা করেছিলেন, সেই মহাবুদ্ধি ভীষ্ম কৌরবগণের সঙ্গে পরাভব পেয়েছেন। দেবতুল্য ও নরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম স্বর্গে গমন করলে কৌরবেরা ধর্ম বিষয়ে কার কাছে প্রশ্ন করবেন?
“যিনি অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষক, সাত্যকির গুরু ও অন্যান্য কৌরবদের শিক্ষাদাতা ছিলেন, সেই দ্ৰোণ পতিত হয়েছেন। স্বয়ং দেবরাজ কিংবা মহাবীর পরশুরাম যেমন চতুর্বিধ অস্ত্র জানেন, তেমন দ্রোণও চতুর্বিধ অস্ত্র জানতেন। পাণ্ডুনন্দন অর্জুন যাঁর অনুগ্রহে যুদ্ধে দুষ্কর কার্য করেছেন, সেই দ্রোণ নিহত হয়ে শয়ন করেছেন। কিন্তু তাঁর সকল অস্ত্র তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। কৌরবেরা যাঁকে অগ্রবর্তী করে যুদ্ধে পাণ্ডবগণকে আহ্বান করেছিলেন, সেই অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। বিপক্ষ সৈন্য দগ্ধ করতে লাগলে, যার গতি অগ্নির তুল্যই অব্যাহত হয়েছিল, সেই দ্রোণ নিহত হয়ে, তেজোবিহীন অগ্নির ন্যায় ভূতলে শায়িত রয়েছেন। মাধব, দ্রোণ নিহত হলেও জীবিতের ন্যায় তাঁর ধনুর মুষ্টি ও হস্তাবরণ অশিথিলই রয়েছে। সৃষ্টির প্রারম্ভে চারবেদ ও সমস্ত অস্ত্র যেমন ব্রহ্মাতে সংসৃষ্ট ছিল, তেমন তা বীর দ্রোণাচার্যেরও সংসৃষ্ট ছিল; সেই দ্রোণাচার্যের বন্দনযোগ্য, বন্দিগণ প্রশংসিত, সুন্দর ও শিষ্যগণ সেবিত চরণ দু’খানি শৃগালেরা আকর্ষণ করছে। মধুসূদন! দ্রোণভার্যা কৃপী দুঃখে অচেতনপ্রায় হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন নিহত দ্রোণের কাছে অবস্থান করছেন। দেখো, সেই কৃপী মুক্তকেশী, অধোমুখী ও ভূতলে পতিত হয়ে অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ নিহত দ্রোণের শুশ্রূষা করছেন। কেশব! ধৃষ্টদ্যুম্ন বাণদ্বারা দ্রোণের বর্ম বিদীর্ণ করেছিলেন। সেই অবস্থায় দ্রোণ ভূতলে পতিত রয়েছেন, ওই জটাধারী ও ব্রহ্মচারী শিষ্যেরা এসে রণস্থলে তাঁর সেবা করছেন। কোমলাঙ্গী ও যশস্বিনী কৃপী শোকার্ত হয়ে কাতরভাবে সেই নিহত স্বামীর প্রেতকার্য করবার চেষ্টা করছেন। সামবেদীয় ব্রাহ্মণের যথানিয়মে অগ্নি আনয়ন করে, চিতা প্রজ্বলন করে তাতে দ্রোণকে স্থাপন করে সকল দিকে ঘুরতে থেকে, সামবেদের প্রাথমিক তিনটি মন্ত্র পাঠ করছেন। এই জটাধারী ব্রাহ্মণেরা ধনু, শক্তি ও রথের কাষ্ঠবিশেষ দ্বারা চিতা নির্মাণ করেছেন। এই দেখো, ব্রতচারী ব্রাহ্মণেরা নানাবিধ অস্ত্রদণ্ডদ্বারা দগ্ধ করবেন বলে মহাতেজা দ্রোণকে স্পর্শ করে সামগান করছেন ও রোদন করছেন। অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা অগ্নিতে অগ্নির ন্যায় চিতাগ্নিতে দ্রোণকে নিক্ষেপ সামবেদসংহিতার অন্তিমস্থিত তিনটি মন্ত্রদ্বারা অগ্নির স্তব করছেন। তখন দ্রোণশিষ্য অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা চিতাটিকে প্রদক্ষিণ করে কৃপীকে অগ্রবর্তিনী করে গঙ্গার অভিমুখে গমন করছেন।
“কৃষ্ণ সামনে তাকিয়ে দেখো, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা সাত্যকির হস্তে নিহত হয়ে পড়ে আছেন। বহু সংখ্যক পক্ষী চঞ্চু প্রহার করে তাঁর যেন বেদনা উৎপাদন করছেন। এ দিকে নিহত মহাধনুর্ধর সোমদত্ত সর্বতোভাবে পুত্রশোকে সন্তপ্ত হয়েই যেন পুত্রহত্যাকারী সাত্যকিকে তিরস্কার করছেন। অনিন্দিতা ভূরিশ্রবার মাতা অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে পরবর্তী বাক্যদ্বারা নিহত ভর্তা সোমদত্তকে আশ্বস্ত করছেন, ‘মহারাজ, আপনি ভাগ্যবশতই এই প্রলয়ের ন্যায় দারুণ ক্ষয় ও কৌরবদের মহাযুদ্ধ দেখছেন না এবং আপনি ভাগ্যবশত অনেক সহস্র ধনদাতা, অনেক যজ্ঞকারী ও যুপধ্বজ পুত্র বীর ভূরিশ্রবাকে নিহত অবস্থায় আজ দেখছেন না। আর আপনি আজ ভাগ্যবশতই সমুদ্রে সারসীপক্ষিণীগণের ন্যায় পুত্রবধূগণের রোদন কোলাহলের মধ্যে বহুবিধ বিলাপ শুনতে পারছেন না। হতপুত্রা ও বিধবা আপনার পুত্রবধূরা একখানি মাত্র বস্ত্র পরিধান করে আলুলায়িত কেশে সকল দিকে ছুটোছুটি করছেন। আপনি ভাগ্যবশত দেখছেন না যে, প্রথমে অর্জুন ভূরিশ্রবার বাহুছেদন করেছেন, পরে সাত্যকি তাঁকে নিপাতিত করেছেন। এখন হিংস্র জন্তুগণ তাঁর দেহ ভক্ষণ করছে। বিধবা পুত্রবধূরা নিহত শল্য ও ভূরিশ্রবার উদ্দেশে শোক করছেন— এ ঘটনা আপনি ভাগ্যবশত দেখছেন না। ভূরিশ্রবার সেই স্বর্ণময় রথসুদ্ধ ছত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে আছে— এ আপনি ভাগ্যবশতই দেখতে পারছেন না। ওই কৃষ্ণনয়না ভূরিশ্রবার ভার্যারা সাত্যকি নিহত ভূরিশ্রবার দেহটি পরিবেশন করে তাঁর জন্য শোক করছেন।’
“অর্জুন এই অতিঘৃণিত কার্য কীভাবে করতে পারলেন যে, যাজ্ঞিক ও বীর ভূরিশ্রবা অসাবধান ছিলেন, সেই অবস্থায় তাঁর বাহুছেদন করেছেন। সাত্যকি তাঁর থেকেও গুরুতর পাপের কার্য করেছেন। যেহেতু, প্রশস্তহৃদয় ভূরিশ্রবা, প্রায়োপবেশনে বসেছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁর উপর প্রহার করেছে। হায়! ধার্মিক ভূরিশ্রবা। আপনি একক দু’জন কর্তৃক নিহত হয়ে শয়ন করে আছেন। ভূরিশ্রবার ভার্যারা উচ্চৈঃস্বরে বলছেন, ‘অনায়াসে কার্যকরী অর্জুন কৃষ্ণের সামনেই অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে নিরত এবং অসাবধান ভূরিশ্রবার এই বাহুখানি ছেদন করেছিলেন।’ ক্ষীণমধ্যা এক ভূরিশ্রবা ভার্যা ভর্তার ছিন্ন বাহুখানিকে ক্রোড়ে তুলে নিয়ে কাতরভাবে বিলাপ করছিলেন, “এই সেই আমার মেখলাপসারী স্থূলস্তনমর্দনকারী নাভি, উরু, জঘনষ্পর্শী এবং কটিদেশের বস্ত্ৰবন্ধনস্থলনকারী হস্ত। এই সেই শক্ৰহন্তা, মিত্রগণের অভয়দাতা, সহস্র সহস্র গোদানকর্তা এবং বিপক্ষক্ষত্রিয় হস্তা হস্ত। জনার্দন লোকসভায় কিংবা লোকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে অর্জুনের এই মহৎকর্ম বিষয়ে কী বলবেন এবং স্বয়ং অর্জুনই বা কী বলবেন?
“ভাগিনেয়, সহদেব, বলবান এবং যথার্থ বিক্রমশালী গান্ধারাধিপতি শকুনিকে নিহত করেছেন, পূর্বে রমণীরা স্বর্ণদণ্ডব্যজন দ্বারা যাঁকে বায়ুসঞ্চালন করত। এখন হিংস্র পক্ষীরা পক্ষদ্বারা তাঁকে বায়ুসঞ্চালন করছে। শকুনি মায়াবী ছিলেন, সহস্র সহস্র মায়ারূপ ধারণ করতেন, যিনি মায়ার প্রভাব দ্যূতসভায় পাণ্ডবদের রাজ্যজয় করেছিলেন, সেই শকুনি জীবনযুদ্ধে সহদেব বাণে নিহত হয়েছেন। আমার পুত্রদের বিনাশের জন্যই শকুনি ছল শিক্ষা করেছিলেন, আজ গৃধ্রেরা সকল দিকে তাঁকে বেষ্টন করেছেন। এই শকুনিই আমার পুত্রগণের এবং অনুচরবর্গের সঙ্গে নিজের বিনাশের জন্যই পাণ্ডবদের সঙ্গে আমার পুত্রদের গুরুতর শত্রুতা ঘটিয়েছিল। আমি বিচলিত হচ্ছি, অস্ত্রাঘাতে বিনষ্ট আমার পুত্রেরা যে স্বর্গে গিয়েছে, শকুনিও সেই স্বর্গপ্রাপ্তি হবে। কুটিল প্রকৃতি শকুনি সেই স্বর্গলোকেও পাণ্ডবগণের সঙ্গে সরল আমার পুত্রদের বিরোধ বাঁধাবার চেষ্টা করবে।”
এরপরে গান্ধারী কম্বোজ, কলিঙ্গ, মগধ, কোশল, কেকয় রাজাদের মৃতদেহের বর্ণনা দিয়ে কৃষ্ণকে বললেন, “মাধব, দেখো— বিশাল সিংহ যেমন বনমধ্যে বিশাল হস্তীকে নিপাতিত করে সেই রকম দ্রোণ যুদ্ধে দ্রুপদরাজকে নিপাতিত করেছিলেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের নির্মল ও শুভ্রবর্ণ ছত্রটি শরৎকালের চন্দ্রের ন্যায় শোভা পাচ্ছে। এই দ্রুপদরাজার ভার্যাগণ ও পুত্রবধূগণ পাঞ্চালদেশের রাজা ও বৃদ্ধ দ্রুতপদের দাহের ব্যবস্থা করে, অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে, আমাদের দক্ষিণ দিক দিয়ে যাচ্ছেন।” ধৃষ্টকেতু, তাঁর পুত্র, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণ— এদের মৃত্যুর বর্ণনা করে গভীর দুঃখের সঙ্গে কৃষ্ণের সমদর্শিতার অভাব উল্লেখ করে বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি যখন সন্ধি করতে না পেরে ভগ্নমনোরথ হয়ে পুনরায় উপপ্লব্য নগরে গিয়েছিলে, বলবান হলেও তখনই আমার পুত্রেরা নিহত হয়েছিল। বুদ্ধিমান ভীম ও বিদুর তখনই আমাকে বলেছিলেন যে, ‘দেবী! আপনি আপনার পুত্রদের প্রতি স্নেহ করবেন না।’ তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হতে পারে না। তাতেই আমার পুত্রেরা অচিরকালের মধ্যে বিনষ্ট হয়েছে।” এই কথা বলে গান্ধারী ধৈর্য পরিত্যাগ করে শোকে মূৰ্ছিত ও অচেতন হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। ক্রমে তিনি চৈতন্যলাভ করে পুত্রশোকে ব্যথিতচিত্ত ও আকুল এবং ক্রোধে অধীর হয়ে কৃষ্ণের অনিষ্ট করার জন্য তাঁকে বললেন, “কৃষ্ণ জনার্দন, পাণ্ডবেরা ও ধৃতরাষ্ট্ররা পরস্পর ক্রুদ্ধ হয়ে বিনষ্ট হতে উদ্যত হলে, তুমি কেন তাঁদের উপেক্ষা করলে। তুমি সমর্থ ছিলে, তোমার বহুতর ভৃত্য ছিল। তুমি আপন বিশাল সৈন্যমধ্যে অবস্থান করছিলে, উভয়পক্ষেই তোমার সমান প্রয়োজন ছিল। উভয়পক্ষই তোমার কথা শুনত। এই অবস্থায় তুমি ইচ্ছা করেই যখন কুরুকুলের ধ্বংস উপেক্ষা করেছ, তখন তুমি এই উপেক্ষার ফলভোগ করো। চক্র গদাধর কৃষ্ণ! আমি পতিত শুশ্রূষা দ্বারা যা-কিছু তপস্যা অর্জন করেছি, সেই দুর্লভ তপস্যা দ্বারা তোমাকে অভিসম্পাত করব।”
“গোবিন্দ! তুমি যখন পরস্পর বিনাশে প্রকৃত ও পরস্পর জ্ঞাতি কৌরব ও পাণ্ডবগণকে উপেক্ষা করেছ। তখন তুমিও তোমার জ্ঞাতিগণকে বিনাশ করবে। আজ থেকে ছত্রিশ বৎসর সময়ে হতপুত্র, হতজ্ঞাতি, হতমাতা এবং বনচারী অবস্থায়, কোনও কুৎসিত উপায়ে বিনষ্ট হবে। আজ ভরতবংশীয় স্ত্রীলোকেরা যেমন শোকে ভূতলে লুষ্ঠিত হচ্ছেন, তেমন তোমার স্ত্রীগণও সেই সময়ে এমনই হতপুত্র, হতজ্ঞাতি ও হতবান্ধব হয়ে শোকে সকল দিকে ভূতলে লুষ্ঠিত হবেন।”
এই কথা শুনে মহামনা কৃষ্ণ ঈষৎ মৃদুহাস্য করেই যেন গান্ধারীদেবীকে বললেন, “সুব্রতে, এ বিষয়টা আমিও জানি, অতএব অন্য দ্বারা সম্পাদিত কার্যকে আপনি শাপদ্বারা সম্পাদন করছেন। বৃষ্ণিবংশীয়রা দৈববশত বিনষ্ট হবেন, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি ভিন্ন অন্য কোনও লোকে যদুবংশ ধ্বংস করতে সমর্থ হবেন না। কেন-না তাঁরা অন্য মানুষ এমনকী দেবদানবগণেরও অবধ্য; সুতরাং এ-বিষয়ে আপনার অভিসম্পাত অনর্থক।
কৃষ্ণ বললেন, “গান্ধাররাজনন্দিনী, উঠুন, উঠুন, শোকের দিকে মন দেবেন না। আপনার অপরাধেই বহু লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। দুরাত্মা, ঈর্ষান্বিত, অত্যন্তাভিমানী, নিষ্ঠুর স্বভাব, সজ্জনের সঙ্গে শত্রুতাকারী ও বৃদ্ধলোকের উপদেশ অগ্রাহী পুত্র দুর্যোধনকে প্রশংসা করে তারই দুর্ব্যবহারকে আপনি ভাল মনে করতেন, তা আপনার বড় দোষ ছিল, এখন সেই আত্মকৃত দোষকে আমার উপর চাপাচ্ছেন কেন। যে লোক মৃত বা নিরুদ্দিষ্টরূপ অতীত বিষয় নিয়ে শোক করে, সেই লোক দুঃখের সঙ্গে নূতন দুঃখভোগ করে বলে, দুটি অনর্থই অনুভব করতে থাকে।
“পুত্র তপস্যা করবে ভেবে ব্রাহ্মণী গর্ভধারণ করেন, সন্তান ভার বহন করবে ভেবে গোরু গর্ভধারণ করে, পুত্র দৌড়োবে এই চিন্তা করে অশ্বী গর্ভধারণ করে, পুত্র ভৃত্যের কাজ করবে বলে শূদ্ৰস্ত্রী গর্ভধারণ করে, পুত্র পশুপালন করবে মনে করে বৈশ্যাস্ত্রী গর্ভধারণ করে এবং পুত্র যুদ্ধে নিহত হবে ভেবেই আপনার ন্যায় ক্ষত্রিয়রমণী গর্ভধারণ করেন।” কৃষ্ণের সেই পুনরায় অপ্রিয় কথা শুনে গান্ধারী শোকাকুল চিত্তে নীরব হয়ে রইলেন।
গান্ধারীর তপোবন গমন ও মৃত্যু
গান্ধার রাজকন্যা, সুবল-নন্দিনীর জীবনের মূল কাহিনির বর্ণনা শেষ হল। এরপরেও গান্ধারী আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন। রাজ্যাভিষেকের পর যুধিষ্ঠির অন্য সকলের গৃহবণ্টন করে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী যে গৃহে ছিলেন, নিজেও সেই গৃহেই বাস করতে থাকলেন। যুধিষ্ঠিরের কাছে যে শ্রদ্ধা সম্মান ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী পেয়েছিলেন, তা আপন পুত্রদের কাছ থেকেও কখনও পাননি। কুন্তী-বিদুর-যুযুৎসু সর্বদা তাঁদের তত্ত্বাবধান করতেন। দ্রৌপদী, অর্জুন, নকুল সহদেব তাঁদের সেবায় যত্নবান ছিলেন। শুধুমাত্র ভীম, আড়ালে থেকে অথচ ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী শুনতে পান এমন অপ্রিয় কথা বারবার বলতেন। “আমার এই হস্ত পরিখের তুল্য, এই হস্ত দ্বারা আমি ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রকে বধ করেছি।” এই অপ্রিয় বার্তায় ধৃতরাষ্ট্র আঘাত পেতেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের নম্র নত ব্যবহার তাঁর চিত্তের ক্ষোভ বিদূরিত করে দিত। ধন, বিলাসসামগ্রী, দাস- দাসী, অকাতর দানের জন্য অর্থপ্রদান, যুধিষ্ঠির কোনও কিছুরই অভাব রাখেননি।
ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের ব্যবহারে সুগভীর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। গান্ধারী ভীমের উপর ক্রুদ্ধ হলেও কুন্তীর কথা স্মরণ রেখে ভীমকে অভিসম্পাত করেননি। এইভাবে যুধিষ্ঠিরের রাজত্বের পনেরো বৎসর কেটে গেলে, ধৃতরাষ্ট্র তপোবনে গিয়ে বাকি জীবন তপস্যায় অতিবাহিত করবেন স্থির করলেন। যুধিষ্ঠির প্রথমে প্রচণ্ড আপত্তি করলেও ধৃতরাষ্ট্রের আগ্রহের আতিশয্য দেখে, মন্ত্রীমণ্ডলীর সঙ্গে আলোচনা করে সম্মতি দিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির স্তম্ভিত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, কুন্তীদেবী ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে বনবাসে যাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত বিপর্যস্তভাবে প্রশ্ন করলে কুন্তী বলেন যে, তিনিই কর্ণের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তিনি কর্ণকে প্রকাশিত না করার জন্যই তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। যুধিষ্ঠির কুন্তীর বনবাসের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে বললেন, আপনি আমাদের দিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করিয়ে এখন কী জন্যে বনে যেতে চাইছেন। কিন্তু কুন্তী কোনও পুত্রের অনুরোধে কর্ণপাত না করে যাত্রা করতে থাকলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “তোমরা ক্ষত্রিয় এবং পাণ্ডুর বংশধর। তোমাদের উপর অন্যায় করা হয়েছিল। তাই আমি তোমাদের যুদ্ধ করতে বলেছি। এখন তোমরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছ। সুতরাং আমার যেখানে কর্তব্য আমি সেইখানেই যাব।” ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর ও সঞ্জয় তপোবনে চলে গেলেন, তপোবন যাত্রার দু’বছর পর বিদুর দেহত্যাগ করলেন। একদিন শিষ্যবৃন্দকে নিয়ে ব্যাসদেব সেই তপোবন আশ্রমে এলেন। গান্ধারী দুর্যোধন ও অন্য পুত্রদের দেখতে চাইলেন। কুন্তী তাঁর কানীন পুত্র কর্ণের উৎপত্তি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা দিয়ে কর্ণকে দেখতে চাইলেন। ব্যাসদেব পরদিন সন্ধ্যায় গঙ্গাতীরে তাঁদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন জানালেন। পরদিন সায়াহ্নকালে গঙ্গাতীরে এসে সকলে উপবেশন করে পবিত্রচিত্তে সেই মৃত প্রিয়জনকে স্মরণ করতে লাগলেন। ব্যাসদেব মৃত কুরুপাণ্ডব যোদ্ধাদের আহ্বান করতে লাগলেন। তখন জলমধ্যে কুরুপাণ্ডব সৈন্যের তুমুল নিনাদ শোনা গেল। ভীষ্ম, দ্রোণ, পুত্রসহ বিরাট ও দ্রুপদ। অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ঘটোৎকচ, বৃষসেন, দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি শকুনি, জরাসন্ধ প্রভৃতি বীরগণ দিব্যদেহ ধারণ করে গঙ্গাগর্ভ থেকে সসৈন্যে উখিত হলেন। জীবদ্দশায় যাঁর যে প্রকার বেশ ও বাহন ছিল, এখনও সেই প্রকার দেখা গেল। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্যদৃষ্টি দিলেন। কুরুপাণ্ডব বীরগণ পরস্পরের উপর দ্বেষ ত্যাগ করে নিস্পাপ হয়ে একত্রে সমাগত হলে। পুত্র পিতামাতার সঙ্গে, ভার্যা পতির সঙ্গে, ভ্রাতা ভ্রাতার সঙ্গে এবং মিত্র মিত্রের সঙ্গে সহর্ষে মিলিত হলেন। সেই রাত্রে একত্রে স্বর্গবাসের মতো আনন্দে তাঁরা বাস করলেন। রাত্রি অতিক্রান্ত হলে সেই বীরগণ গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতিরা হস্তিনানগরে চলে গেলেন।
এরও পর দু’বৎসর অতিক্রান্ত হল। একদিন দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। তাঁর কাছেই যুধিষ্ঠির শুনলেন, তাঁরা চলে আসার পর ধৃতরাষ্ট্র তপস্যা আরও কঠোর করলেন। মুখে বীটা দিয়ে মৌনী ও বায়ুভুক হয়ে কঠোর তপস্যায় রত হলেন। তাঁর দেহ অস্থিচর্মসার হয়ে গেল। গান্ধারী কেবল জলপান করে, কুন্তী একমাস অন্তর এবং সঞ্জয় পাঁচ দিন অন্তর আহার করে জীবনধারণ করতে লাগলেন। তাঁদের যাজকগণ যথাবিধি অগ্নিতে আহূতি দিতে লাগলেন। ছ’মাস পরে তারা অরণ্যে গেলেন। সেই সময়ে চতুর্দিক দাবানলে ব্যাপ্ত হল। ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি অনাহারে অত্যন্ত কৃশ হয়েছিলেন। পশুপক্ষীরা পালাতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে চলে যেতে আদেশ দিলেন।
সঞ্জয় আদেশ পালন করে হিমালয়ের দিকে চলে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তী পূর্বাস্য হয়ে উপবেশন করলেন। সমাধিস্থ হওয়ায় তাঁদের দেহ কাষ্ঠের ন্যায় নিশ্চল হল। এই অবস্থায় তাঁরা দাবানলে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। নারদের মুখে এই বিবরণ শুনে পঞ্চপাণ্ডব কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
গান্ধারী— সাধারণ আলোচনা
পতিব্রতা গান্ধারী। স্বামীকে অতিক্রম করবেন না বলে যিনি সারা জীবন চক্ষু-আবৃতা রাখলেন। ধর্মপরায়ণা গান্ধারী। যিনি আঠারো দিন যুদ্ধের প্রতিদিন পুত্র দুর্যোধনকে বলেছেন, যথা ধর্ম তথা জয়। ভারতীয় মুনিঋষিরা সেই গান্ধারীকে প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার অন্তর্গত করলেন না। “অহল্যা কুন্তী তারা দ্রৌপদী মন্দোদরী” এই পঞ্চকন্যার মধ্যে গান্ধারী নেই। বিষয়টা বিশদ আলোচনা করতে হবে। কারণ, এইখানেই লুকিয়ে আছে গান্ধারী চরিত্রের ভালমন্দ।
ধৃতরাষ্ট্র কেবলমাত্র জন্মান্ধ ছিলেন না, স্নেহান্ধও ছিলেন। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে অতিক্রম না করার জন্য গান্ধারী দৃষ্টিকে আবৃত করেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্নেহান্ধতাও গান্ধারীকে স্পর্শ করেছিল। দুর্যোধন জন্মমাত্রই বিদুর তাকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র করেননি, গান্ধারীও সেই না করাকে অনুমোদন করেছিলেন। একে কুন্তীর পুত্র আগে জন্মগ্রহণ করার ঈর্ষা গান্ধারীর ছিল, তিনি নিজের গর্ভপাত পর্যন্ত করিয়েছিলেন। পুত্র দুর্যোধন কপট পাশায় যুধিষ্ঠিরের সর্বস্ব কেড়ে নিলে গান্ধারী খুব একটা দুঃখিত হননি। তিনি চেয়েছিলেন পুত্র সসাগরা ধরণীর অধিপতি হোক। রাজসভায় একবস্ত্রা রজস্বলা দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াননি— দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে কোনও চেষ্টাও করেননি। দ্রৌপদী সম্পর্কে তাঁর মনে ক্ষোভ ছিল। বধূবেশিনী দ্রৌপদীকে প্রথম স্পর্শ করেই তাঁর মনে পড়েছিল— এই নারীই তাঁর পুত্রদের মৃত্যুর কারণ হবে।
পাণ্ডবেরা বনবাস যাত্রা করলে কুন্তী বিদুরের গৃহে বাস করতে থাকলে, গান্ধারী একটি দিনও তাঁকে সান্ত্বনা দিতে যাননি। অথচ কুন্তী তাঁদের তপোবনে বাসের সময়ে স্বেচ্ছায় তাঁর ও ধৃতরাষ্ট্রের সেবার জন্য বনবাসী হন। বিধাতার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের ছিল— সেই অভিযোগ গান্ধারীরও ছিল। স্বামী দৈহিক প্রতিবন্ধকতার কারণে জ্যেষ্ঠ হয়েও সিংহাসন লাভ করেননি।
এই সমস্ত দোষের কারণে প্রাতঃস্মরণীয় ঋষিরা তাঁকে পঞ্চকন্যার অন্তর্গত করেননি, যাঁদের নাম স্মরণ করলে সব পাপ দূরীভূত হয়।