১৬. নাগকন্যা উলূপী

নাগকন্যা উলূপী

নারদের উপদেশ অনুসারে পাণ্ডবরা দ্রৌপদী সম্পর্কে দাম্পত্য নিয়ম বন্ধন করলেন। দ্রৌপদী এক-এক ভ্রাতার কাছে এক বছর কাল থাকবেন, সেই সময়ে অন্য কোনও ভ্রাতা সেই গৃহে প্রবেশ করতে পারবেন না। যিনি এই নিয়ম লঙঘন করবেন, তাঁকে বারো বছরের জন্য বনবাস যেতে হবে।

এই নিয়ম অনুযায়ী দ্রৌপদী তখন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে অস্ত্রাগারে বাস করছিলেন। একদিন এক ব্রাহ্মণ রাজদ্বারে এসে উচ্চৈঃকষ্ঠে সহায়তা প্রার্থনা করলেন। দস্যুরা তার গৃহে প্রবেশ করে গোধন হরণ করছেন। অর্জুন এই সকাতর প্রার্থনা শুনলেন। কিন্তু শূন্য হাতে দস্যুদের মুখোমুখি হওয়া যাবে না, এই চিন্তা করে, অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে অস্ত্র সংগ্রহ করে দস্যুদের পশ্চাদৃধাবন করলেন। দস্যুদের পরাজিত করে ব্রাহ্মণের ধন প্রত্যর্পণ করে, যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বনবাসের প্রার্থনা করলেন। যুধিষ্ঠির তাকে এই বলে আটকানোর চেষ্টা করলেন যে, কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের ঘরে প্রবেশ করলে নিয়ম লঙঘন হয় না। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের ঘরে প্রবেশ করলে নিয়ম লঙ্ঘিত হয়। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আপনার মুখেই শুনেছি যে ছল করে ধর্ম আচরণ করবে না।” অর্জুন বনবাসে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

কুরুবংশের যশোবৃদ্ধিকারী মহাবীর অর্জুন প্রস্থান করলে, বেদপারদর্শী মহাত্মা ব্রাহ্মণরা তার অনুগমন করলেন। বেদবিৎ, বেদাঙ্গবিৎ, ব্রহ্মজ্ঞ, ভিক্ষুক, বৈষ্ণব, স্তুতিপাঠক, পৌরাণিক, কথক, জিতেন্দ্রিয়, বনবাসী এবং অলৌকিক উপাখ্যানপাঠক এই সমস্ত সাধুলোক ও মধুরভাষী অন্যান্য বহুতর সহচরকর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে, অর্জুন দেবগণে পরিবেষ্টিত দেবরাজের ন্যায় গমন করতে লাগলেন। তিনি যাত্রাপথে মনোহর ও বিচিত্র বন, সরোবর, নদী, সাগর, দেশ ও পবিত্র তীর্থ সকল দর্শন করলেন, পরে গঙ্গাদ্বারে গিয়ে আশ্রম নির্মাণ করলেন। অর্জুন ও ব্রাহ্মণগণ সেই আশ্রমে বাস করতে থাকলে, সেই ব্রাহ্মণরা ক্রমশ বহুতর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান আরম্ভ করলেন। মন্ত্রপাঠপূর্বক আগুন জ্বালা হতে লাগল, আগুন জ্বলতে থাকল, হোম হতে লাগল, অগ্নিকুণ্ডে পুষ্প নিক্ষেপ চলতে থাকল, অগ্নির আলোক অপর তীর পর্যন্ত যেতে লাগল। সুতরাং স্নাত, তপোনিষ্ঠ ও সৎপথস্থিত সেই জ্ঞানী মহাত্মাদের দ্বারা সেই গঙ্গাদ্বারটি অত্যন্ত শোভা পেতে লাগল। সেই আশ্রমটি সাধুলোকে ব্যাপ্ত হলে, একদিন অর্জুন স্নান করবার জন্য গঙ্গায় গিয়ে নামলেন। তিনি সেখানে স্নান ও পিতৃলোকের তর্পণ করে হোম করবার ইচ্ছায় জল থেকে ওঠবার ইচ্ছা করলেন। এই সময়ে কামার্তা উলূপী নাম্নী নাগকন্যা এসে অর্জুনকে জলে আকর্ষণ করে নিয়ে গেল। অর্জুন পরিকৃত ও পরিচ্ছন্ন কৌরব্য নাগভবনে গিয়ে সমাহিতভাবে অগ্নিহোত্রের অগ্নি দর্শন করলেন। তখন তিনি সেই অগ্নিতেই হোম করলেন। তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে হোম করায় অগ্নিদের সন্তুষ্ট হলেন।

অর্জুন হোম করে হাসতে হাসতেই যেন উলূপীেক বললেন, “সুন্দরী! তুমি এই সাহসের কাজ করলে কেন? এই সুন্দর দেশটার নাম কী? এবং তুমি কে? কারই বা কন্যা?” উলূপী বলল, “ঐরাবতবংশীয় কৌরব্য নামে এক নাগ আছেন। আমি তাঁর কন্যা, আমার নাম ‘উলূপী’। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি স্নান করার জন্য গঙ্গায় নেমেছিলেন। তখন আমি আপনাকে দেখেই কামে পীড়িত হয়েছি। হে কুরুনন্দন, আপনাকে লক্ষ্য করেই কামদেব আমাকে যাতনা দিচ্ছেন, অন্য কেউ আমার পতিও হননি। সুতরাং আপনি এই নির্জন স্থানে আত্মসমর্পণ করে আমাকে আনন্দিত করুন।”

অর্জুন বললেন, “ভদ্রে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বারো বৎসর যাবৎ আমার এই ব্রহ্মচর্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং আমি তো স্বাধীন নই। অথচ আমি তোমার প্রীতিজনক কার্য করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু পূর্বে আমি কখনও কোনও মিথ্যা কথা বলিনি। নাগকন্যে, কী প্রকারে আমাদের সেই নিয়ম করাটা মিথ্যা না হয়, অথচ তোমার প্রিয় কার্য করা হয়, তেমন-একটা উপদেশ দাও দেখি।” উলূপী বললেন, “পাণ্ডুনন্দন, আপনি যে-কারণে পৃথিবী বিচরণ করছেন এবং যে-কারণে আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা আপনার উপরে এই ব্রহ্মচর্যের আদেশ দিয়েছেন, সে সমস্তই আমি জানি। আপনাদের মধ্যে যে-কোনও ব্যক্তি দ্রৌপদীর সঙ্গে এক ঘরে থাকবার সময়ে আপনাদের মধ্যে যে-কোনও ব্যক্তি মোহবশত সেই ঘরে প্রবেশ করবেন, তিনি বারো বৎসর পর্যন্ত বনে থেকে ব্রহ্মচর্য করবেন, এই আপনাদের নিয়ম। সুতরাং ব্রহ্মচারী থেকে পরস্পরের বনবাস করার এই নিয়মটা আপনারা ধর্মের জন্য দ্রৌপদীর বিষয়েই করেছেন। সুতরাং আমার সঙ্গে রমণ করলে আপনার ধর্ম কলুষিত হবে না। তারপর পীড়িতের পরিত্রাণ করাও তো কর্তব্য। আমার সঙ্গে রমণ করায় যদিও এই ধর্মের অনুমাত্র ব্যতিক্রম হয়, তথাপি আমাকে রক্ষা করায় আপনার ধর্ম নষ্ট হবে না অর্জুন! আমার প্রাণরক্ষা করলে, সেটা আপনার ধর্মই হবে। আর-এক কথা, আমি আপনার ভক্ত, সুতরাং আপনিও আমাকে ভজন করুন। এই সাধুদের মত। পক্ষান্তরে আপনি আমার প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ না করলে আমি জীবিত থাকব না। সুতরাং আপনি আমার প্রাণ রক্ষা করে প্রধান ধর্ম অর্জুন করুন। আমি শরণাগত হয়েছি, দুঃখিত হয়ে বারবার বলছি এবং অত্যন্ত কামাতুর হয়ে আপনাকে প্রার্থনা করছি। অতএব আপনি আমার প্রিয় কার্য করুন, আত্মসমর্পণ করে আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন।”

উলূপী এই কথা বললে অর্জুন ধর্ম পালনের জন্যই তাঁর সঙ্গে সর্বপ্রকার রমণ করলেন। অর্জুন নাগরাজের বাড়িতে থেকেই সে রাত্রি অতিবাহিত করে সূর্যোদয় হলে গাত্রোত্থান করে, উলূপীর সঙ্গে পুনরায় গঙ্গাদ্বারে আগমন করলেন। তখন উলূপী অর্জুনকে এই বর দিল যে, “হে ভরতশ্রেষ্ঠ! আপনি সমস্ত জলেই অজেয় হবেন এবং জলজন্তুই আপনার বশীভূত হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।” উলূপী এই বর দিয়ে অর্জুনকে মুনিগণের মধ্যে রেখে আপন ভবনে চলে গেল।

এই পর্যন্তই উলূপী-অর্জুনের প্রাথমিক পরিচয়। পরবর্তীকালে উলূপী-অর্জুনের পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছিল এবং উলূপীও দীর্ঘকাল অর্জুনের সঙ্গে বাস করেছিলেন। কিন্তু তার পূর্বে অর্জুন-উলূপীর পুত্র ইরাবানের জন্মমৃত্যু প্রভৃতি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।

উলূপীর পূর্বপতি গরুড় কর্তৃক নিহত হন। তারপর ঐরাবত তাঁর শোকাতুরা অনপত্যা কন্যাকে অর্জুনের কাছে সমর্পণ করেন। কর্তব্যবোধে অর্জুন সেই কামার্তা পরপত্নীর গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র ইরাবানকে উৎপাদন করেন। ইরাবান নাগলোকে জননী কর্তৃক পালিত হন। অর্জুনের প্রতি বিদ্বেষবশত ইরাবানের পিতৃব্য দুরাত্মা অশ্বসেন তাঁকে ত্যাগ করেন। অর্জুন যখন সুরলোকে অস্ত্রশিক্ষা করছিলেন তখন ইরাবান তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। অর্জুন তাঁকে বলেছিলেন, যুদ্ধকালে আমাদের সাহায্য করো।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ইরাবান পিতৃপক্ষ সমর্থনে যোগ দিয়েছিলেন। গজ গবাক্ষ বৃষক চর্মবান আর্জক ও শুক— শকুনির এই ছয় ভ্রাতার সঙ্গে ইরাবানের যুদ্ধ হয়। ইরাবানের অনুগামী যোদ্ধারা গান্ধারসৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন। শকুনির ছয় ভ্রাতাকেই ইরাবান বধ করলেন। তখন দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে অলম্বুষ রাক্ষসকে বললেন, অর্জুনের এই মায়াবী পুত্র আমার ঘোর ক্ষতি করছে, তুমি ওকে বধ করো! বহু যোদ্ধায় পরিবেষ্টিত হয়ে অলম্বুষ ইরাবানকে আক্রমণ করল। দু’জনের মায়াযুদ্ধ হতে লাগল। ইরাবান অনন্তনাগের ন্যায় বিশাল মূর্তি ধারণ করলেন, তাঁর মাতৃবংশীয় বহু নাগ তাঁকে ঘিরে রইল। অলম্বুষ গরুড়ের রূপ ধারণ করে সেই নাগেদের খেয়ে ফেলল। তখন ইরাবান মোহগ্রস্ত হলেন। অলম্বুষ খড়গাঘাতে তাকে বধ করল।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হলে যুধিষ্ঠির সিংহাসন আরোহণ করলেন। কিছুকাল পরে মহর্ষি বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরের নিকট আগমন করলেন এবং তাঁকে অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে নির্দেশ দিলেন। যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করার ক্ষেত্রে তাঁর অর্থ অসামর্থ্যের কথা জানালে মহর্ষি ব্যাস তাকে মরুত্ত রাজার সংগৃহীত অর্থ আনয়ন করার জন্য আদেশ করলেন। চৈত্রী পূর্ণিমাতে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার দিন স্থিরীকৃত হল। যজ্ঞীয় অশ্বটিকে নিয়ে অর্জুন বার হলেন। বহু রাজ্য অতিক্রম করে, রাজা ও রাজপুত্রকে পরাজিত করে ক্রমে অর্জুন মণিপুর রাজ্যে প্রবেশ করলেন। অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা বিবাহজাত পুত্র বভ্রুবাহন পিতার আগমন সংবাদে অতিশয় আনন্দিত হয়ে অর্জুনকে অভ্যর্থনা করার জন্য রাজধানী থেকে নির্গত হলেন। কিন্তু পুত্রের এই অক্ষত্রিয়োচিত আচরণে অর্জুন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন এবং তাকে ক্রুদ্ধ ভৎসনা করতে থাকলেন। ভর্তা অৰ্জুন পুত্র বভ্রুবাহনকে ভৎসনা করছেন জানতে পেরে এবং তা সহ্য করতে না পেরে নাগদুহিতা উলূপী ভূমি ভেদ করে সেইস্থানে উপস্থিত হলেন।

তারপর উলূপী দেখলেন যুদ্ধার্থী অর্জুন বারবার তিরস্কার করছেন, আর সপত্নীর পুত্র বভ্রুবাহন বিবেচনা করতে থেকে মাথা নিচু করে আছেন। তখন সর্বাঙ্গসুন্দরী নাগদুহিতা উলূপী কাছে গিয়ে ধর্মবিশারদ পুত্র বভ্রুবাহনকে ধর্মসংগত বাক্যে বললেন, “পুত্র, আমি নাগদুহিতা উলূপী, তুমি আমাকে তোমার বিমাতা বলে অবগত হও। তুমি পিতার ধর্ম পালন করো, তাই তোমার শ্রেষ্ঠ ধর্ম হবে। পুত্র, তুমি এই কুরুশ্রেষ্ঠ যুদ্ধদুর্ধর্ষ পিতার সঙ্গে যুদ্ধ করো, তা করলেই ইনি তোমার উপর সন্তুষ্ট হবেন, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’ মাতা উলূপী এইভাবে উৎসাহিত করলে সেই মহাতেজা রাজা বভ্রুবাহন যুদ্ধের জন্যই মনোনিবেশ করলেন এবং কাছে গিয়ে অশ্ববিদ্যা বিশারদ পুরুষগণ দ্বারা অৰ্জুন-রক্ষিত সেই যজ্ঞীয় অশ্ব ধারণ করলেন। তখন ভূতলাস্থিত অর্জুন অশ্বটি ধৃত হয়েছে দেখে সন্তুষ্টচিত্ত হয়ে রথস্থিত পুত্র বভ্রুবাহনকে যুদ্ধে পরাজিত করতে প্রবৃত্ত হলেন। ক্রমে পিতা পুত্রের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল। উলূপী ক্রমাগত বভ্রুবাহনকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। তখন বভ্রুবাহন হাস্য করতে থেকে নতপর্ব একটি বাণ দ্বারা নরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের স্কন্ধদেশের এক পার্শ্বে বিদ্ধ করলেন। তখন অত্যন্ত বেদনাপূর্ণ হয়ে উত্তম ধেনু ধারণ করে অর্জুন চৈতন্যমাত্র অবলম্বন করে মৃতের ন্যায় পড়ে রইলেন। চেতনা লাভ করে অর্জুন প্রশংসাপূর্বক পুত্র বভ্রুবাহনকে বললেন, “মহাবাহু বৎস চিত্রাঙ্গদানন্দন পুত্র, সাধু সাধু! তোমার উপযুক্ত কার্য দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। পুত্র! যুদ্ধে স্থির থাকো। এই আমি তোমার উপরে বহুতর বাণক্ষেপ করছি।” বভ্রুবাহনের উপরে অনেক নারাচ নিক্ষেপ করলেন। তখন রাজা বভ্রুবাহন ভল্ল দ্বারা বজের ন্যায় দৃঢ় ও বিদ্যুতের ন্যায় উজ্জ্বল গাণ্ডিব নিক্ষিপ্ত সে সমস্ত নারাচকেই দুইভাগে তিনভাগে ছেদন করলেন। তখন বভ্রুবাহন বালচাঞ্চল্যবশত সুধার ও সুপুঙ্খ একটি বাণ দ্বারা অর্জুনের হৃদয় গুরুতর বিদ্ধ করলেন। কৌরবনন্দন অর্জুন পুত্র কর্তৃক সেই বাণ দ্বারা অত্যন্ত বিদ্ধ ও মূৰ্ছিত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। কৌরবধুরন্ধর বীর অর্জুন ভূতলে পতিত হলে, বভ্রুবাহন মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। তখন ভর্তাকে নিহত এবং পুত্রকে ভূতলে পতিত দেখে পরিতপ্তা হয়ে চিত্রাঙ্গদা রণাঙ্গনে প্রবেশ করলেন। ক্রমে বভ্রুবাহন মাতা চিত্রাঙ্গদা শোকে সন্তপ্তহৃদয়া হয়ে রোদন করতে থেকে অত্যন্ত কম্পিত কলেবরে নিহত পতিকে দর্শন করলেন। তারপর পদ্মনয়না চিত্রাঙ্গদা দুঃখে সন্তপ্ত হয়ে বহুতর বিলাপ করে মূৰ্ছিত ও ভূতলে পতিত হলেন। পরে অলৌকিক সুন্দরী চিত্রাঙ্গদা চৈতন্যলাভ করে নাগদুহিতা উলূপীকে দেখে বলল, “উলূপী, দেখো তোমার জন্যই আমার পুত্র কর্তৃক বাণদ্বারা নিহত যুদ্ধবিজয়ী ভর্তা রণস্থলে শায়িত আছেন। উলূপী! তুমি আর্যধর্ম জানো এবং পতিব্রতাও বটে। যেহেতু তোমার জন্যই তোমার পতি নিহত হয়ে রণস্থলে পতিত রয়েছেন, সেইহেতু এঁর জীবনের উপায় তোমার করা উচিত। কিন্তু মূঢ়ে! যদিও তোমার এই পতি তোমার কাছে অপরাধী হয়ে থাকেন, তথাপি তুমি ক্ষমা করো। আমি প্রার্থনা করছি, তুমি একে জীবিত করো। আর্যে শুভাননে! তুমি ত্রিভুবন বিদিত হয়েও ধর্ম জানো না। যেহেতু পুত্র দ্বারা ভর্তাকে নিহত করিয়ে তুমি শোক করছ না। নাগনন্দিনী! আমি নিহত পুত্রের জন্য শোক করি না কিন্তু যাঁর আতিথ্য করলাম, সেই পতির জন্য শোক করি।” নাগতনয়া উলূপীদেবীকে এই কথা বলে যশস্বিনী চিত্রাঙ্গদা তখন ভর্তার কাছে গিয়ে বললেন, “কৌরবপ্রধান ধর্মরাজের প্রিয়জনের শ্রেষ্ঠ এবং আমার প্রিয় মহাবাহু! উঠন, আমি আপনার অশ্ব এই মুক্ত করলাম। প্রভু! আপনি ধর্মরাজের যজ্ঞীয় অশ্বের অনুসরণ করবেন, সেই আপনি কী জন্য ভূতলে শয়ন করে আছেন? কৌরবনন্দন! আমার ও কৌরবগণের প্রাণ আপনার অধীন। অন্যের প্রাণদাতা সেই আপনি কেন প্রাণত্যাগ করবেন? উলূপী! তুমি দেখো, এই পতি ভূতলে পতিত হয়ে আছেন। তুমি এই পুত্রকে উৎসাহিত করে, এর দ্বারা পতিকে বধ করিয়ে শোক করছ না। এই বালক মৃত-অবস্থায় ভূতলে শায়িত থাকুক। রক্তনয়ন অর্জুনের জীবিত হওয়ার পরিবর্তে তা বরং আমার কাছে বাঞ্ছনীয় বোধ হবে।

নাপরাধোহস্তি সুভগে। নরানাং বহুভার্যতা।

প্রমদানাং ভবতোষ বা তেহভূদবুদ্ধিরাদৃশী ॥ আশ্বমেধিক : ১০২ : ২৪ ॥

“সুভগে! পুরুষগণের বহুভার্যিত দোষ নয়, কিন্তু স্ত্রীগণের বহুপতিকতা দোষই বটে, তোমার এইরূপ বুদ্ধি যেন না হয়। কারণ স্বয়ং বিধাতাই চিরকালীনভাবে ও অনশ্বররূপে এই নিজের অভীষ্ট নিয়ম করেছেন। সেইজন্যেই অর্জুনের বহুভাৰ্যাত্ব বিধাতার অভীষ্ট বলেই অবগত হও। সে যাই হোক, পতির সঙ্গে তোমার সম্মেলন সত্য হোক। উলূপী! তুমি পুত্র দ্বারা এই পতিকে বিনাশ করিয়ে আবার যদি আমাকে জীবিত অবস্থায় তাকে না দেখাও, তা হলে আজই আমি জীবন পরিত্যাগ করব। দেবী! আমি পতিপুত্রবিহীনা হয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছি। অতএব তোমার সামনেই আমি প্রায়োপবেশন করব, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” চিত্ৰবাহন তনয়া সপত্নী চিত্রাঙ্গদা উলূপীকে এই কথা বলে সেই স্থানে প্রায়োপবেশন করে নীরব হলেন। চিত্রাঙ্গদা অবিরল অশ্রুমুখী হয়ে অর্জুনের চরণযুগল ধারণ করে নিশ্বাস ত্যাগের সঙ্গে পুত্রকে দর্শন করতে থেকে শোকার্ত অবস্থায় উপবিষ্ট রইলেন।

তখন বভ্রুবাহন পুনরায় চৈতন্যলাভ করে রণাঙ্গনে মাতাকে দেখে বলতে লাগলেন, “এ অপেক্ষা গুরুতর দুঃখ আর কী আছে? সুখে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আমার মাতা ভূতলে নিপতিত মৃত বীর পতিকে ধারণ করে আছেন। ইনি যুদ্ধে শত্রুহন্তা সর্বাস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ, সমরে আমার দ্বারা নিহত, অসম্ভাব্য মৃত্যু স্বামীকে দর্শন করছেন। হায়! এই দেবীর হৃদয় অত্যন্ত দৃঢ়, যেহেতু বিশালবক্ষা ও মহাবাহু নিহত স্বামীকে দর্শন করতে থেকেও এঁর হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে না। আমি মনে করি কাল উপস্থিত। না হলে মানুষের মৃত্যুলাভ করা দুষ্কর। যেহেতু আমি ও আমার মাতা এখনও জীবিত আছি। হায় হায়! আমি পুত্র হয়ে দেখতে দেখতে পিতা অর্জুনকে বধ করেছি এবং তার স্বর্ণময় কিরীট বিদ্ধ করায় তা ভূতলে পড়ে আছে। হে ব্রাহ্মণগণ! আপনারা দর্শন করুন, আমি পুত্র হয়ে পিতাকে বধ করেছি, সেই বীর পিতা ভূতলে বীরশয্যায় শায়িত আছেন। অশ্বানুগামী যে-সকল ব্রাহ্মণ আমার প্রহার থেকে মুক্তি পেয়েছে তাঁরা এই বিশ্বশ্রেষ্ঠের কী শান্তি করছেন, যে বীরশ্রেষ্ঠকে আমি বধ করেছি! ব্রাহ্মণগণ! আমি যুদ্ধে পিতৃহত্যা করেছি বলে অত্যন্ত নৃশংস ও পাপাত্মা; সুতরাং আমার কী প্রায়শ্চিত্ত হবে, তা আপনারা বিশেষভাবে আদেশ করুন। আমি আজ পিতৃহত্যা করায় অত্যন্ত নৃশংসই হয়েছি, সুতরাং এই পিতারই চর্মদ্বারা দেহ অলংকৃত করে আমার এখন দুষ্কর দ্বাদশবার্ষিক মহাব্রত করা উচিত। এই পিতার মস্তকের দুই দিকের দুই অংশ ধারণ করে আমার আজ এই প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। পিতৃহত্যা করায় আমার অন্য প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে না।

“নাগতনয়ে! দেখুন আমি আপনার ভর্তাকে বধ করেছি। আমি আজ যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করে আপনার প্রিয় কার্য করেছি। কল্যাণী! আজ আমি পিতার অবলম্বিত পথে গমন করব। কারণ আমি নিজে নিজেকে ধারণ করতে সমর্থ হচ্ছি না। মা! দেবী! আমি সত্য করে হৃদয়। স্পর্শ করছি এবং বলছি, আমি ও গাণ্ডিবধম্বা মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় আপনি সন্তুষ্ট হবেন।” এই কথা বলে তারপর রাজা বভ্রুবাহন দুঃখে ও শোকে আহত হয়ে আচমন করে দুঃখবশতই এই কথা বললেন, “স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রাণী শ্রবণ করুক, মা নাগশ্রেষ্ঠে! আপনিও শ্রবণ করুন, আমি সত্য বলছি যে, যদি আমার পিতা নৱশ্রেষ্ঠ অর্জুন গাত্রোত্থান না করেন, তাহলে আমি এই রণস্থলেই অনাহারে দেহ শুষ্ক করব। কারণ, পিতৃহত্যা করে আমার কোথাও সেই পাপ থেকে নিষ্কৃতি হবে না। পিতৃহত্যা পাপে লিপ্ত হয়ে আমি নিশ্চয়ই নরকে যাব। মানুষ বিনাযুদ্ধে বীর ক্ষত্রিয়কে বধ করে শত গোদান করলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হয়, কিন্তু পিতৃহত্যা করায় আমার নিষ্কৃতি লাভ করা দুষ্কর। একক এই পাণ্ডুপুত্রই মহাতেজা ধনঞ্জয়, ধর্মাত্মা ও আমার পিতা। তাঁকে বধ করে আমার কী প্রকারে নিষ্কৃতি হতে পারে?” এই বলে অর্জুনের পুত্র মহামতি বভ্রুবাহন পুনরায় আচমন করে প্রায়োপবিষ্ট হয়ে নীরব হলেন।

শত্রুতাপক মণিপুরাধিপতি বভ্রুবাহন তখন পিতৃশোকার্ত হয়ে মাতা চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে প্রায়োপবেশন করলে তখন উলূপী সঞ্জীবন মণির স্মরণ করলেন। নাগগণের পরমাশ্রয় সেই মণিও তখনই সেই স্থানে উপস্থিত হল। তারপর উলূপী সেই মণি গ্রহণ করে সৈন্যগণের মনের আনন্দজনক বাক্য বললেন, “পুত্র! ওঠো, শোকার্ত হয়ে তুমি এই জিষ্ণুকে জয় করোনি। কারণ ইনি মনুষ্যগণের এবং ইন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত দেবগণেরও অজেয়। কিন্তু আমি আজ পুরুষশ্রেষ্ঠ ও যশস্বী তোমার পিতার প্রীতির জন্য এই “মোহনী” নাম্নী মায়া প্রয়োগ করেছি। কারণ, রাজা কৌরবনন্দন, তুমি রণস্থলে যুদ্ধ করতে লাগলে, তোমার বল পরীক্ষা করবার জন্যই এই বিপক্ষ বীরহন্তা এসেছেন। অতএব পুত্র! আমি তোমাকে যুদ্ধের জন্য প্রণোদিত করেছি, সুতরাং পুত্র! রাজা! তোমার কোনও অনিষ্ট করবার ইচ্ছায় আমি এই কার্য করেছি বলে তুমি আশঙ্কা কোরো না। পুত্র! ইনি প্রাচীন, নিত্য, অচল ও নরঋষি। স্বয়ং ইন্দ্রও যুদ্ধে একে জয় করতে সমর্থ হন না। নরনাথ! এই অলৌকিক মণি আমি আনয়ন করেছি, যে মণি সর্বদা মৃত নাগগণকে সঞ্জীবিত করে থাকে। তুমি এই মণিটিকে তোমার পিতার বক্ষে স্থাপন করো। তা হলেই তুমি দেখতে পাবে এই পৃথানন্দন সঞ্জীবিত হয়েছেন। উলূপী এই কথা বললে, অমিততেজা ও অপাপকারী বভ্রুবাহন গভীর শ্রদ্ধা সহকারে পিতা অর্জুনের বক্ষঃস্থলে মণিটি স্থাপন করলেন। সেই মণিটি বক্ষে স্থাপন করলে বীর ও প্রভাবশালী অর্জুন পুনরায় জীবিত হলেন এবং দীর্ঘকাল নিদ্রিতের ন্যায় গাত্রোত্থান করলেন। পরে হস্তযুগল দ্বারা রক্তবর্ণ নয়নযুগল মার্জনা করতে লাগলেন।

মহাত্মা ও মনস্বী পিতা অর্জুন চৈতন্য লাভ করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন দেখে বভ্রুবাহন তাঁকে অভিবাদন করলেন। নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন গাত্রোত্থান করলে এবং পূর্বের ন্যায় কান্তিসম্পন্ন হলে ইন্দ্র স্বর্গীয় পবিত্র পুষ্প বর্ষণ করলেন। মেঘের ন্যায় গম্ভীর ধ্বনিকারী, দুন্দুভি সকল আহত না হয়েও শব্দ করতে লাগল এবং আকাশে সাধু সাধু’ এইরূপ গুরুতর ধ্বনি হতে থাকল। মহাবাহু অর্জুন সর্বপ্রকারে আশ্বস্ত হয়ে গাত্রোত্থান করে বভ্রুবাহনকে আলিঙ্গনপূর্বক তার মস্তক আঘ্রাণ করলেন। এবং অর্জুন দেখলেন, বভ্রুবাহনের কিছুদূরে উলূপীর সঙ্গে শোকাকুলা চিত্রাঙ্গদা রয়েছেন। তখন অর্জুন বভ্রুবাহনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “শত্রুহন্তা! এই সমস্ত রণস্থলকে শোক, বিস্ময় ও আনন্দযুক্ত দেখছি কেন? তুমি যদি জানো, তবে আমাকে তা বলো। কী জন্যই বা তোমার জননী রণস্থলে এসেছেন এবং নাগরাজ-তনয়া এই উলূপীই বা কেন এখানে এসেছেন? আমি জানি যে তুমি আমার আদেশেই যুদ্ধ করতে এসেছ। তাতে স্ত্রীলোকদের এই স্থানে আগমনের হেতু আমি জানতে চাইছি।” অর্জুন সেই প্রশ্ন করলে আচারাভিজ্ঞ বভ্রুবাহন তখন মাথা নিচু করে অর্জুনকে বললেন, “এই উলূপীকে জিজ্ঞাসা করুন।”

অর্জুন বললেন, “কুরুকুলানন্দকারিণী! নাগনন্দিনী! তোমার ও মণিপুরপতির মাতার এই রণাঙ্গনে আসার প্রয়োজন কী ছিল? নাগতনয়ে! তুমি এই রাজার মঙ্গলাভিলাষিণী আছ তো? কিংবা চঞ্চলনয়নে! তুমি আমার মঙ্গল কামনা করো তো? বিশাল নিতম্বে! প্রিয়দর্শনে! আমি বা এই বভ্রুবাহন তোমার কোনও অপ্রিয় আচরণ করিনি তো? চিত্ৰবাহনতনয়া, উত্তমঙ্গনা ও তোমার সপত্নী চিত্রাঙ্গদা তোমার নিকট কোনও অপরাধ করেনি তো!”।

তখন উনূপী হাস্য করতে থেকেই যেন অর্জুনকে বললেন, “আপনি বা বভ্রুবাহন আমার কাছে কোনও অপরাধ করেননি। কিংবা আমার সপত্নী এই চিত্রাঙ্গদাও আমার কাছে কোনও অপরাধ করেননি, প্রত্যুত আমার কাছে দাসীর মতোই আছেন; কিন্তু যে-কারণে আমি এই সকল কার্য করেছি, তা শুনুন। আমি মস্তক অবনত করে আপনাকে প্রসন্ন করছি, আপনি আমার উপর ক্রোধ করবেন না। প্রভু কৌরবনন্দন, আপনার প্রীতির জন্যই আমি এ-সব করেছি। মহাবাহু ধনঞ্জয়, আমি যা করেছি, আপনি সর্বপ্রকারে তা শ্রবণ করুন।

“পৃথানন্দন, আপনি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে অধর্মপূর্বক ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে যে বধ করেছেন, সেই পাপের এই প্রায়শ্চিত্ত করলেন। কারণ, বীর, আপনি যুধ্যমান অবস্থায় ভীষ্মকে নিপাতিত করেননি, কিন্তু আপনি শিখণ্ডীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তাকে অবলম্বন করেই আপনি ভীষ্মকে বধ করেছিলেন। আপনি যদি সেই পাপের শাস্তি না করে জীবন ত্যাগ করতেন, তা হলে সেই পাপকর্মের ফলে নিশ্চয়ই নরকে পতিত হতেন। এখন পুত্র বভ্রুবাহনের হাতে যে অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, এ হল সেই পাপের শাস্তি। মহামতি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ! পূর্বেই গঙ্গা এবং বসুগণ আপনার এই পাপ কার্য শুনেছিলেন এবং বসুগণ ও আমি সেই ব্যাপার গঙ্গার কাছে বলেছিলাম। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ, ভীষ্ম নিহত হলে বসুদেবগণ গঙ্গাতীরে এসে, স্নান করে মিলিত হয়ে গঙ্গার মত অনুসারেই সেই ভয়ংকর বাক্য সেই মহানদীকে বলেছিলেন, ‘উত্তমাঙ্গনে! এই শান্তনুনন্দন ভীষ্ম রণস্থলে যুদ্ধ করছিলেন না, সেই অবস্থায় অর্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে ভীষ্মকে বধ করেছে। অতএব আমরা আজ এই কারণেই অর্জুনকে অভিসম্পাত করব’। তখন গঙ্গাও বললেন, ‘তাই হোক।’

“আমি পিতার গৃহে প্রবেশ করে পিতার কাছে সেই বৃত্তান্ত জানিয়ে দুঃখিত চিত্ত হয়ে রইলাম। আমার পিতাও সেই বৃত্তান্ত শুনে অত্যন্ত বিষাদপ্রাপ্ত হলেন। তারপরে আমার পিতা বসুগণের কাছে গিয়ে তাদের বারবার প্রসন্ন করে আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলেন। তখন বসুগণ আমার পিতাকে বললেন, ‘সেই অর্জুনের পুত্র মণিপুরাধিপতি যুবক বক্ৰবাহন রণস্থলে থেকে বাণ দ্বারা অর্জুনকে ভূতলে পতিত করবেন। বভ্রুবাহন এইরূপ করলে, অর্জুন আমাদের শাপ থেকে মুক্তি পাবেন। এখন আপনি যেতে পারেন’—বসুগণের এই নির্দেশ আমার পিতা আমাকে জানিয়েছিলেন। আমি সেই কারণে এই অভিশাপ থেকে আপনাকে মুক্ত করছি। না হলে, স্বয়ং দেবরাজও আপনাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারেন না। স্মৃতিশাস্ত্র পুত্রকে পিতৃস্বরূপ বলেছে, সেইজন্যেই আপনাকে পুত্র বভ্রুবাহন যুদ্ধে পরাজিত করতে পেরেছে। আমার মতে পুত্র কর্তৃক পরাজয় দোষের নয়। প্রভু আপনিই বা কী মনে করেন?”

উলূপী এই কথা বললে অর্জুন প্রসন্নচিত্ত হয়ে বললেন, “দেবী! তুমি যা করেছ, সেই সমস্তই আমার অত্যন্ত প্রীতিজনক হয়েছে।” এই বলে অর্জুন চিত্ৰবাহনদুহিতা চিত্রাঙ্গদার সমক্ষে মণিপুরাধিপতি পুত্র বভ্রুবাহনকে বললেন, “রাজা, পরবর্তিনী চৈত্রপূর্ণিমাতে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ হবে। তুমি দুই মাতার সঙ্গে ও মন্ত্রিবর্গের সঙ্গে সেই যজ্ঞে যাবে।” অর্জুনের আমন্ত্রণ শুনে বভ্রুবাহন অর্জুনকে বললেন, “ধর্মজ্ঞ, আমি আপনার আদেশে সেই মহাযজ্ঞ অশ্বমেধে যাব এবং দ্বিজাতিগণের পরিবেশক হব। আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আপনার দুই ভার্যার সঙ্গে এই নিজ পুরীতে প্রবেশ করুন। এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না। প্রভু! বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ! আপনি এই পুরীতে নিজগৃহে সুখে এক রাত্রি বাস করে পুনরায় অশ্বের অনুগমন করবেন।” অর্জুন বললেন, “বিশাল নয়ন মহাবাহু! এই বিষয়ে তোমার যে গুরুতর আগ্রহ জন্মেছে, তা আমি বুঝলাম, কিন্তু যেহেতু আমি কেবল অশ্বানুসরণব্রত গ্রহণ করেছি, সেইজন্য তোমার পুরীতে প্রবেশ করব না। নরশ্রেষ্ঠ, এই যজ্ঞীয় অশ্ব ইচ্ছানুসারে বিচরণ করে থাকে। সে যা হোক, তোমার মঙ্গল হোক। আমি যাই, আমার এ যাত্রায় অবস্থান সম্ভবপর নয়।” তখন বভ্রুবাহন যথাবিধানে পূজা করলে, ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন ভার্যাদ্বয়ের অনুমতি নিয়ে প্রস্থান করলেন।

উলূপী—সাধারণ আলোচনা

নির্দিষ্ট সময়ে অশ্বমেধযজ্ঞ আরম্ভ হল। ধীমান রাজা বভ্রুবাহন, মাতা উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে মিলিত হয়ে কৌরবগণের কাছে উপস্থিত হলেন। মহাবাহু বভ্রুবাহন পাণ্ডবভবনে প্রবেশ করে অতিসুন্দর ও কোমল বাক্য বলে পিতামহী কুন্তীদেবীকে নমস্কার করলেন। তারপর চিত্রাঙ্গদা ও উলূপী মিলিত হয়ে কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা এবং অন্যান্য কৌরব স্ত্রীদের সবিনয়ে এবং যথানিয়মে নমস্কার করলেন। তখন কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা এবং অন্যান্য কৌরব স্ত্রীগণ উলূপী ও চিত্রাঙ্গদাকে নানাবিধ রত্ন দান করলেন। স্বয়ং কুন্তীদেবী অর্জুনের হিতকামনায় উলূপী ও চিত্রাঙ্গদাকে বিশেষ আদর করতে লাগলেন। সেই অবস্থায় তারা মহামূল্য শয্যা ও আসনে অবস্থান করতে লাগলেন।

এরপরে উলূপী দীর্ঘকাল কৌরবপুরীতে ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তী আশ্রমে বাস করতে থাকলে উলূপী অন্যান্য কুরুবধুদের সঙ্গে আশ্রমে গিয়েছিলেন। সেখানে সঞ্জয় গান্ধারীর কাছে “অসামান্য সুন্দরী গৌরবর্ণা রমণীরূপে” উলূপীর বর্ণনা দিয়েছিলেন।

পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী মহাপ্রস্থান যাত্রা করলে উলূপী কৌরবভবন ত্যাগ করে জলমধ্যে। নাগলোকে প্রস্থান করেন। উলূপী অত্যন্ত তেজস্বিনী নারী ছিলেন। নিজের কাম নিবেদনকালে তিনি ছিলেন যেমন অকুণ্ঠিতা, অর্জুনের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষেত্রেও তেমনই অকুতোভয়। কোনও কোনও পণ্ডিত ব্যক্তি অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা সম্মিলনকে ভারতবর্ষের প্রথম বিধবাবিবাহ বলে পরিগণিত করতে চেয়েছেন। বিধবাবিবাহের পর ক্ষেত্রটি আর পরের, থাকে না—স্বামীর হয়ে যায়। অর্জুন পরক্ষেত্রে ইরাবানকে উৎপন্ন করেছিলেন। সেটি তার স্বক্ষেত্র ছিল না। কাজেই এটি বিধবাবিবাহ নয়।

প্রিয়-পুরুষ অর্জুনকে চিত্রাঙ্গদা অকৃপণ ভালবাসা দিয়েছিলেন। অর্জুনের আদেশেই তিনি পুত্র ইরাবানকে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। অর্জুনের অন্য কোনও পত্নী সম্পর্কে তাঁর কোনও ঈর্ষা, বিদ্বেষ ছিল না। ধর্মানুযায়ী তিনি পাণ্ডবপক্ষে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং চূড়ান্ত ক্ষতি থেকে অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন। নাগজাতির সঙ্গে পাণ্ডবদের সম্পর্ক ছিল। ঐরাবতও কেবলমাত্র ভীমসেনকে রক্ষাই করেননি, তাঁকে রসায়ন কুণ্ড পান করার জন্য দিয়েছিলেন। নহুষ সর্প অবস্থায় ভীমসেনকে বলদান করেছিলেন। খাণ্ডবদাহন করার জন্য, মাতৃবধের জন্য অশ্বসেন সর্পরূপ ধারণ করে অর্জুনকে বধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উলূপী বভ্রুবাহনের হস্তে নিহত অর্জুনের প্রাণদান করে অর্জুনের জীবনে চিরঋণী হয়ে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *