বিরাট-মহিষী সুদেষ্ণা
বনবাসের দ্বাদশ বৎসর অতিক্রান্ত হলে, শর্তানুযায়ী পাণ্ডবেরা এক বৎসরকাল অজ্ঞাতবাসে থাকার জন্য প্রস্তুত হলেন। বনবাসের শেষ দিনে পিতা ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করে জানিয়েছিলেন, তোমরা যদি নিজ বেশেই থাক, তবু এই অজ্ঞাতবাস বৎসরে তোমাদের কেউ চিনতে পারবে না। পাণ্ডবেরা অনেক আলোচনা করে, ঈষৎ ছদ্মবেশ ধারণ করে বিরাটরাজার মৎস্যদেশে অজ্ঞাতবাস অতিবাহিত করবেন স্থির করলেন।
মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোকে ব্যাসদেব বর্ণনা যত দিয়েছেন, অনুক্তও ততই রেখেছেন। সত্যবতীর জন্ম-পরিচয় দিতে গিয়ে ব্যাস বলেছেন যে, মৎস্যরূপিণী অদ্রিকার গর্ভে দুটি ডিম্ব প্রসূত হয়। তার মধ্য থেকে একটি নারী ও একটি পুরুষ সন্তানের জন্ম হয়। পিতা রাজা উপরিচয় বসু দাসরাজাকে সন্তান দুটি দান করেন। এই পুরুষ সন্তানটিই পরবর্তীকালে মৎস্যদেশের রাজা হয়। অনুমান করা অসংগত নয় যে এই পুরুষটিই পরবর্তীকালে বিরাটরাজা বলে পরিচিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ইনি সত্যবতীর যমজ ভ্রাতা ছিলেন। উভয়ের বয়সের সাদৃশ্য দেখলে, এ অনুমান আরও গভীরতর হয়।
যুধিষ্ঠির ‘কঙ্ক’ নাম নিয়ে বিরাটরাজার সভায় গৃহীত হলেন, তিনি বিরাট রাজার দ্যূতক্রীড়ার অক্ষসঙ্গী হলেন, ভীমসেন ‘বল্লব’ নামধারন করে বিরাট রাজার পাচকভৃত্যের কার্যে নিযুক্ত হলেন। তখন নীলনয়না দ্রৌপদী, সুন্দর, কোমল ও কুঞ্চিতা কেশগুলিকে তুলে মস্তকের দক্ষিণপার্শ্বে বস্ত্রদ্বারা আবৃত করে নির্মল, কৃষ্ণবর্ণ, বৃহৎ একখানি বস্ত্র পরিধান করে সৈরিন্ধ্রীর বেশ ধারণ করে রাজপথে বিচরণ করতে লাগলেন। পথচারীরা তাঁকে প্রশ্ন করতে লাগল— “তুমি কে? কী বা করতে ইচ্ছা করছ?” তখন দ্রৌপদী তাদের বললেন, “আমি একজন সৈরিন্ধ্রী এসেছি। যিনি অনুমাত্র দান করে আমাকে পোষণ করতে ইচ্ছা করেন, আমি তারই কার্য করব।” তাঁর রূপ, বেশ ও কোমল বাক্য শুনে তাঁকে তারা অন্নের জন্য উপস্থিত একটি কামিনী বলে বিশ্বাস করতে পারল না।
বিরাটরাজার প্রিয়তমা ভার্যা কেকয়রাজনন্দিনী সুদেষ্ণা অট্টালিকা থেকে সকল দিক দেখতে থেকে দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। তিনি তখন অনাথা ও একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে দেখে ডেকে এনে প্রশ্ন করলেন, “ভদ্রে, তুমি কে? কী করতে ইচ্ছা করছ?” তখন দ্রৌপদী সুদেষ্ণাকে বললেন, “রাজ্ঞী, এই আমি সৈরিন্ধ্রী এসেছি। যিনি আমাকে পোষণ করতে ইচ্ছা করেন, আমি তাঁরই কাজ করব।” সুদেষ্ণা বললেন, “তোমার মতো নারীরা নানাবিধ বহুতর দাসদাসীকে পোষণ করে থাকেন, কিন্তু তুমি যা বললে, সেইরূপ নিজেরা পোষিত হন না। তোমার শরীরের গ্রন্থিগুলি গুপ্ত; ঊরুযুগল পরস্পর সন্নিহিত, নাভি, স্বভাব ও কণ্ঠস্বর নিম্ন, স্তনযুগল, নিতম্বযুগল, নাসিকা ও মন উন্নত। সুন্দর চরণতল যুগল, করতলযুগল ও অধরদেশ রক্তবর্ণ এবং বাক্য হংসের ন্যায় মধুর। তোমার কেশ ও স্তনযুগল সুন্দর, বর্ণ শ্যাম ও নিতম্ব দুটি ও স্তন দুটি স্থূল; সুতরাং তুমি আপন রূপে কাশ্মীরদেশীয় ঘোটকীর ন্যায় শোভা পাচ্ছ। আর তোমার নয়নের লোমগুলি বক্র, ওষ্ঠযুগল বিম্বফলের ন্যায় রক্তবর্ণ, কটিদেশ কৃশ, গ্রীবাটি শঙ্খের ন্যায় ত্রিরেখাঙ্কিত, শিরাগুলি গূঢ় এবং মুখখানি চন্দ্রের ন্যায় সুন্দর। অতএব ভদ্রে, তুমি কোনও প্রকারেই দাসী নও; সুতরাং বলো তুমি কে? কোনও যক্ষী? না দেবী? না গন্ধর্বী কি? না অপ্সরা? কিংবা তুমি কি অলম্বুষা, মিশ্রকেশী, পুণ্ডরীকা বা মালিনী? অথবা তুমি কি ইন্দ্র, বরুণ, ত্বুষ্টা, ধাতা বা প্রজাপতির পত্নী?
দ্রৌপদী বললেন, “আমি দেবী, গন্ধর্বী, যক্ষী বা রাক্ষসী নই কিন্তু সৈরিন্ধ্রীরূপা নারী; এ-কথা আপনার কাছে সত্য বলছি। আমি কেশসংস্কার করতে জানি। সুন্দর বিলেপন ঘষতে পারি এবং নানাবিধ পরমসুন্দর ফুলের মালা গাঁথতে পারি। আমি পূর্বে কৃষ্ণের প্রিয়তমা মহিষী সত্যভামাদেবীর কাছে এবং কুরুবংশীয় পাণ্ডবমহিষী দ্রৌপদীদেবীর সেবা করতাম। আমি সেই সেই স্থানে ভাল ভাল খাদ্য পেতাম। একাকিনী চলতাম এবং যে ক’খানি কাপড় পেতাম তাতেই সুখী হতাম। সত্যভামাদেবী নিজেই আমার নামকরণ করেছিলেন— “মালিনী!” দেবী সুদেষ্ণা, সেই আমি আপনার বাড়িতে থাকবার জন্য এসেছি।” সুদেষ্ণা বললেন, “মালিনী, এখানে রাজা যদি সমস্তটুকু মন দিয়ে তোমাতে অনুরক্ত না হন, তবে আমি তোমাকে মাথায় করেই রাখব; এ-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। মালিনী, এই রাজবংশে যে সকল স্ত্রীলোক আছে এবং আমার ঘরে যে সকল স্ত্রীলোক পরিচারিকারূপে রয়েছে, তারা সকলেই আসক্ত হয়ে তোমাকে দেখছে; সুতরাং তুমি কোন পুরুষকেই মোহিত না করবে? আমার বাড়িতে যে সকল গাছ আছে; সেগুলির দিকে তাকিয়ে দেখো; সেগুলিও যেন তোমাকে নমস্কার করছে; অতএব তুমি কোন পুরুষকে মোহিত না করবে? সুনিতম্বে! উত্তমরমণী! বিরাটরাজা তোমার এই অলৌকিক মুখখানি দেখে, নিশ্চয় আমাকে পরিত্যাগ করে সমস্ত মন দিয়ে তোমাতে আসক্ত হবেন। অনিন্দ্যসুন্দরী! আয়তনয়নে! তুমি অনুরাগের সঙ্গে যে পুরুষকে দেখবে, সেই পুরুষই কামের বশবর্তী হবে। চারুহাসিনী সর্বাঙ্গসুন্দরী! আবার যে পুরুষ সর্বদা তোমাকে দেখবে, সেই পুরুষই কামের বশীভূত হবে। অতএব শুভ্রহাসিনী! স্ত্রীজাতীয়া কাঁকড়া যেমন নিজের মৃত্যুর কারণ গর্ভে ধারণ করে, আমি তোমাকে রাখা তেমনই মনে করি।”
দ্রৌপদী বললেন, “প্রশস্ত স্বভাবে! বিরাটরাজা বা অন্য কোনও পুরুষ কখনও আমাকে লাভ করতে পারবেন না। কারণ আমার পাঁচটি গন্ধর্বযুবক পতি আছেন। তাঁরা কোনও মহাবল গন্ধর্বরাজের পুত্র, তাঁরা আমাকে সর্বদাই রক্ষা করে আছেন। তবুও আমি, ব্রত বলেই এই দুঃখকর আচার পালন করছি। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দেন না, কিংবা আমার দ্বারা পাদপ্রক্ষালন করান না, আমি সেভাবে বাস করতে পারলেই স্বামীরা সন্তুষ্ট হন। তারপর, যে পুরুষ অন্য সামান্য স্ত্রীলোকের ন্যায় আমাকে লাভ করার চেষ্টা করেন, সে পুরুষ সেই রাত্রিতে আমার পতিগণ কর্তৃক নিহত হন। এবং শুভ্রহাসিনী! শ্রেষ্ঠ মহিলে! কোনও পুরুষই আমাকে প্রলোভন দেখিয়ে বিচলিত করতে পারে না। আর আমার সেই গন্ধর্ব পতিগণ বলবান ও দুঃখ সহনক্ষম, তাই তাঁরা সর্বদাই গুপ্ত থেকে আমাকে রক্ষা করেন।” সুদেষ্ণা বললেন, “নন্দিনী, এমন হলে, তুমি যেমন ইচ্ছা করছ, তেমনভাবেই আমি তোমাকে রাখব; তুমি কোনও প্রকারেই কারও চরণ বা উচ্ছিষ্ট স্পর্শ করবে না।” বিরাট মহিষী সুদেষ্ণা সেইভাবে আশ্বস্ত করলে, দ্রৌপদী পতিব্রতা থেকেই সেই রাজধানীতে বাস করতে লাগলেন; কিন্তু অন্য কোনও লোকই তাঁকে দ্রৌপদী বলে জানতে পারেনি। ওদিকে দ্রৌপদীর প্রবেশের দিনেই ভীমসেন ‘বল্লব’ নাম নিয়ে বিরাটরাজার রন্ধনশালার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, স্বর্গপুরীতে উর্বশীর অভিশাপগ্রস্ত অর্জুন ‘বৃহন্নলা’ নামে নপুংসক রূপে বহু পরীক্ষাদানের পর বিরাটকন্যা উত্তরার নৃত্যশিল্পী রূপে বৃত হলেন। দেবতাকুল তুল্যাকৃতি নকুল ‘গ্রন্থিক’ নামে বিরাটরাজের অশ্বকার্যে নিযুক্ত হলেন এবং পাণ্ডুনন্দন সহদেব ‘তন্তিপাল’ নাম ধারণ করে বিরাটরাজার গো-সমূহের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। এইভাবে পঞ্চপাণ্ডব বিরাটরাজার আশ্রয়ে তাঁদের অজ্ঞাতবাস বৎসরটি অতিবাহিত করেছিলেন।
বিরাটরাজার সভায় মাঝেমধ্যেই বীর মল্লদের মধ্যে পারস্পরিক মল্লযুদ্ধ হত। কখনও কখনও সিংহ ব্যাঘ্র ইত্যাদির সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ ঘটত। সকল যুদ্ধেই ভীমসেন জয়লাভ করতেন এবং তিনি মল্লশ্রেষ্ঠ রূপে বিরাট-রাজ্যে স্বীকৃতি লাভ করলেন। যুধিষ্ঠিরের অক্ষক্রীড়া জ্ঞান বিরাটরাজাকে মুগ্ধ করত। অর্জুনের নৃত্যসৌন্দর্যের রাজকুমারী উত্তরা সপ্রশংস উল্লেখ করতেন। নকুল ও সহদেব আপন আপন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতেন। কেবল স্বামীরা রাজসেবায় দিন অতিবাহিত করছেন দেখে দ্রৌপদী বিশেষ সন্তুষ্ট হতেন না। অজ্ঞাতবাসের দশমাস কাল অতিবাহিত হলে বিরাটরাজের সেনাপতি, সুদেষ্ণার ভ্রাতা কীচক পদ্মমুখী দ্রৌপদীকে সুদেষ্ণার ভবনে পরিচারিকা রূপে দেখলেন। কীচক দেবকন্যার ন্যায় রূপবতী দ্রৌপদীকে দেবনারীর ন্যায় বিচরণ করতে দেখে কামবাণে প্রপীড়িত হয়ে তাঁকেই কামনা করল।
স তু কামাগ্নিসন্তপং সুদেষ্ণামভিগম্য বৈ।।
প্রহসন্নিব সেনানীরিদং বচনমব্রবীৎ॥ বিরাট : ২৩: ৫ ॥
তখন কামাগ্নি সন্তপ্ত সেনাপতি কীচক দ্রৌপদীকে সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে হাসতে হাসতেই যেন এই কথা বলল।।
“এই বিরাটরাজার বাড়িতে এই সুলক্ষণা রমণীকে আমি পূর্বে কখনও দেখিনি। সুপক সুরা যেমন গন্ধ দ্বারা উন্মত্ত করে, সেইরূপ এই সুন্দর অঙ্গশালিনী রমণী রূপদ্বারা আমাকে যেন অত্যন্ত উন্মত্ত করছে। দেবতার তুল্য রূপবতী, শুভলক্ষণা ও চিত্তাকর্ষিণী এই সুন্দরীটি কে? কারই বা স্ত্রী? কোথা থেকেই বা এসেছে? এ আমার চিত্তমথিত করে আমাকে বশীভূত করেছে, এর সঙ্গম ব্যতীত আমার স্বাস্থ্যলাভে অন্য ঔষধ নেই বলেই আমার ধারণা হচ্ছে। সুদেষ্ণা! তোমার এই সুন্দরী পরিচারিকাটি নূতন এসেছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। সে যাই হোক, তোমার গৃহে যে কার্য করছে, তা এর পক্ষে সংগত নয়। সুতরাং আমি বা আমার যা কিছু বস্তু আছে, সে সমস্তের উপরে এ গিয়ে আধিপত্য করুক। আমার বাড়িখানি বিশাল, মনোহর ও সমৃদ্ধিযুক্ত; তাতে আবার বহুতর হস্তী, অশ্ব, পাত্র, রথ, খাদ্য, পেয় ও আশ্চর্য স্বর্ণভূষণ সব রয়েছে; এ গিয়ে সেই বাড়িখানি শোভিত করুক।”
তারপর কীচক গোপনে সুদেষ্ণার কাছে কথাগুলি বলে, বনের ভিতর শৃগাল যেমন সিংহের কন্যার কাছে যায়, সেইমতো রাজনন্দিনী দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করতে থেকে এই কথা বলল, “ভাবিনী, তোমার এই সৌন্দর্য এবং এই প্রথম বয়স কেবল ব্যর্থই যাচ্ছে। কারণ, সুন্দরী কোনও পুরুষ ধারণ না-করায় উত্তমা ও সুলক্ষণা মালার মতো তুমি সুন্দরী হয়েও শোভা পাচ্ছ না। চারুহাসিনী! আমি পূর্বের স্ত্রীদের ত্যাগ করব, তারা তোমার দাসী হবে; আর বরাননে, আমিও তোমার দাসের ন্যায় বশবর্তী হয়ে থাকব।”।
দ্রৌপদী বললেন, “সূতপুত্র, আমি হীনবর্ণা কেশসংস্কারকারিণী নিন্দিতা সৈরিন্ধ্রী; সুতরাং আপনার অপ্রার্থনীয়া; তবুও আপনি আমাকে প্রার্থনীয়া বলে মনে করছেন। বিশেষত আমি পরের ভার্যা; ভর্তা আবার প্রাণীদের প্রিয়তম; সুতরাং আমাকে এরকম বলাই আপনার উচিত নয়। আপনি ধর্মের বিষয়ে চিন্তা করুন, আপনার মঙ্গল হবে। পরস্ত্রীকে ইচ্ছা করা অনুচিত, অকার্য পরিত্যাগই সৎপুরুষদের নিয়ম। আর মুগ্ধ পাপাত্মা লোক অযথা অভিলাষ করে ভয়ংকর নিন্দা কিংবা ভয় পেয়ে থাকে। সূতপুত্র, আমি বীরগণ কর্তৃক সর্বতোভাবে রক্ষিত; সুতরাং আপনার অলভ্যা। তথাপি আমাকে লভ্যা বলে মনে করে ভ্রমে পতিত হবেন না। তা হলেই আপনি জীবনত্যাগ করবেন না। আমি আপনার বা অন্য কোনও ব্যক্তিই লভ্য নই। সুতরাং আপনি সে-চেষ্টা করলে আমার সেই গন্ধর্ব স্বামীরা আপনাকে বধ করবেন। অতএব আপনি সে-চেষ্টা করে নিজেই নিজেকে বিনষ্ট করবেন না। মানুষ যে পথে যেতে পারে না, আপনি সেই পথে যাবার ইচ্ছা করছেন এবং নির্বোধ বালক যেমন নদীর এক পারে থেকে অপর পারে যেতে ইচ্ছা করে, আপনিও সেই অল্পবুদ্ধি বালকের মতো অপ্রাপ্যকে পেতে ইচ্ছা করছেন। কীচক! তুমি যদি ভূগর্ভে প্রবেশ করো কিংবা ঊর্ধ্বে আরোহন করো, অথবা সমুদ্রপারে যাও, তথাপি আমার স্বামীগণের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ, আমার স্বামীরা দেবতার পুত্র এবং সর্বপ্রকারে শত্রুদমনকারী। কীচক! কোনও রোগ যেমন মৃত্যুরজনীর প্রার্থনা করে, তুমি কি তেমনই আজ আমাকে তীব্রভাবে প্রার্থনা করছ? আর শিশু যেমন মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে চন্দ্রকে পেতে ইচ্ছা করে, তুমি কি সেইরূপ আমাকে পেতে চাইছ?”
অসীম ও ভয়ংকর কামে সমাক্রান্ত কীচক দ্রৌপদী কর্তৃক সেইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুদেষ্ণাকে গিয়ে বলল, “কেকয়রাজনন্দিনী! সৈরিন্ধ্রী যাতে আমার কাছে যায়, তুমি তার ব্যবস্থা করো। অর্থাৎ সুদেষ্ণে গজগামিনী সৈরিন্ধ্রী যে উপায়ে আমাকে ভজন করে, তুমি সেই উপায় উদ্ভাবন করো; তা হলে আমি আর প্রাণত্যাগ করব না।” সুদেষ্ণা বললেন, “কীচক তুমি কোনও উৎসব উপলক্ষে আমাকে ভোজন করানোর জন্য নিজের বাড়িতে সুরা ও অন্ন প্রস্তুত করাও। তারপর আমি সৈরিন্ধ্রীকে সুরা আনার জন্য তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। সেখানে আমি তাকে পাঠিয়ে দিলে, তুমি কোনও বাধাবিহীন নির্জন স্থানে ওকে ইচ্ছানুসারে এমন তোষামোদ করবে যাতে সে তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়।”
সুদেষ্ণা এই কথা বললে, কীচক ভগিনী সুদেষ্ণার গৃহ থেকে বার হয়ে গিয়ে রাজার পানের যোগ্য অতিপরিষ্কৃত সুরা প্রস্তুত করাল। এবং পাকনিপুণ লোক দ্বারা ছাগ, শূকর ও অন্য পশুর মাংস এবং নানাবিধ সুখাদ্য মৃগমাংস আর সুশোভন অন্ন ও পানীয় দ্রব্য প্রস্তুত করাল। সেই সমস্ত প্রস্তুত হলে, কীচক রাজমহিষীকে নিমন্ত্রণ করে পাঠাল। তখন সুদেষ্ণা সৈরিন্ধ্রী দ্রৌপদীকে কীচকের বাড়িতে পাঠানোর ইচ্ছা করলেন। সুদেষ্ণা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, ওঠো, কীচকের বাড়ি যাও। আমার জন্য মদ্য আনয়ন করো। কারণ, তার পিপাসা আমাকে বড় পীড়া দিচ্ছে।” দ্রৌপদী বললেন, “রাজ্ঞী! আমি সে কীচকের বাড়ি যাব না; কারণ সে যেরূপ নির্লজ্জ তা তো আপনিও জানেন। অনিন্দ্যসুন্দরী! প্রশস্তস্বভাবে! আমি আপনার বাড়ি এসে পতিদের কাছে ব্যভিচারিণী হয়ে কামব্যাপারে প্রবৃত্ত হব না। দেবী! প্রশস্ত স্বভাবে! পূর্বে আপনার বাড়িতে প্রবেশ করবার সময়ে আমি যে নিয়ম করেছিলাম তা আপনিও জানেন। সুকেশী, মূঢ় ও মদনদর্পিত সেই কীচক আমাকে দেখেই অপমানিত করবে; অতএব শোভনে! আমি সেখানে যাব না, রাজনন্দিনী! আপনার বহু দাসী আছে; সুতরাং অন্য কাউকে সেখানে প্রেরণ করুন। কেন-না, কীচক আমাকে অপমানিত করবে। আপনার মঙ্গল হোক।”
সুদেষ্ণা বললেন, “আমি এখান থেকে তোমাকে পাঠালে সে কখনও তোমাকে অপমানিত করবে না। এই কথা বলেই সুদেষ্ণা দ্রৌপদীর হাতে আবরণের (ঢাকনির) সঙ্গে পানপাত্র প্রদান করলেন। দ্রৌপদী আশঙ্কাবশত রোদন করতে থেকে সূর্যদেবের শরণাপন্ন হয়ে সুরা নিয়ে আসার জন্য কীচকের ভবনে গমন করলেন। দ্রৌপদী বললেন, “আমি পাণ্ডব ব্যতীত অন্য কোনও পুরুষকে যে জানি না, সেই সত্যধর্মবশত কীচক যেন আমাকে বশীভূত করতে না পারে।” অবলা দ্রৌপদী কিছুকাল সূর্যের উপাসনা করলেন; তখন সূর্যও তাঁর সেই চিন্তার সমস্ত বিষয় বুঝলেন। তারপর সূর্যদেব দ্রৌপদীকে রক্ষা করার জন্য একটি অদৃশ্য রাক্ষসকে আদেশ করলেন; সেই সময় থেকে সমস্ত অবস্থাতেই রাক্ষস অনিন্দিতা দ্রৌপদীকে ত্যাগ করল না।
পারের নৌকা পেয়ে পারগামী লোক যেমন আনন্দে গাত্রোত্থান করে, সেই রকম কীচক হরিণীর ন্যায় ত্রস্তভাবে দ্রৌপদীকে নিকটে আসতে দেখে আনন্দে গাত্রোত্থান করল। কীচক বলল, “সুকেশী! তোমার সুখে আগমন হয়েছে তো, তুমি আমার সর্বস্বের অধিকারী। সুতরাং তুমি যখন এসেছ, তখন আমার রাত্রি সুপ্রভাত হয়েছে। এখন তুমি আমার প্রিয়কার্য করো। সোনার মালা, শাঁখা, দুটি কুণ্ডল, নানারত্নখচিত নির্মল দুটি কেয়ূর, সুন্দর মণি ও রত্ন এবং নানাবিধ পট্টবস্ত্র তোমার জন্য ভৃত্যেরা আনয়ন করুক। তোমার জন্যই কল্পিত আমার দিব্য শয্যা রয়েছে। তুমি সেইখানে চলো, আমার সঙ্গে মিলে পুষ্পমদ্য পান করো।”
দ্রৌপদী বললেন, “সুদেষ্ণাদেবী সুরা নিয়ে যাবার জন্য আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, আমার গুরুতর পিপাসা হয়েছে, সুতরাং সত্বর সুরা নিয়ে এসো।” কীচক বলল, “ভদ্রে, অন্য দাসীরা সুদেষ্ণার জন্য সুরা প্রভৃতি নিয়ে যাবে।” এই বলে কীচক দ্রৌপদীর দক্ষিণ হস্ত ধারণ করল এবং বিশালনয়না দ্রৌপদীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাঁকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছা করল। তখন দ্রৌপদী তিরস্কার করে উঠলেন, পরে কীচক মহাবেগে এসে দ্রৌপদীকে ধরল। তখন সুলক্ষণা দ্রৌপদী বার বার নিশ্বাস ত্যাগ করলেন এবং সেই ধারণ সহ্য করতে না পেরে অতিক্রোধে কাঁপতে থেকে সেই কীচককে তীব্র ধাক্কা মারলেন। তাতে পাপাত্মা কীচক ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় পতিত হল। এইভাবে কীচককে ভূতলে নিক্ষিপ্ত করে দ্রৌপদী দ্রুতবেগে রাজসভার শরণাপন্ন হতে চললেন। সে-রাজসভায় যুধিষ্ঠির ও ভীমসেন তখন উপস্থিত ছিলেন। দ্রৌপদী দ্রুত যাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় কীচক গিয়ে তাঁর কেশাকর্ষণ করল এবং বিরাটরাজার উপস্থিতিতেই তাঁকে ভূতলে নিপাতিত করে পদাঘাত করল। তখন সূর্যদেব নিযুক্ত রাক্ষসটি বায়ুবেগে কীচককে এক ধাক্কা মারল। কীচক রাক্ষস কর্তৃক সবলে আহত হয়ে নিশ্চেষ্টভাবে ঘুরতে থেকে ছিন্নমূল বৃক্ষের মতো ভূতলে পতিত হল।
ভীমসেন দ্রৌপদীর উপর কীচকের পদাঘাত সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ কীচককে বধ করতে উদ্যত হলেন কিন্তু অজ্ঞাতবাস প্রকাশিত হয়ে পড়বার সম্ভাবনায় যুধিষ্ঠির চরণাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ভীমের চরণাঙ্গুষ্ঠ মর্দন করে ভীমকে নিষেধ করলেন। দ্রৌপদী রাজার কাছে অভিযোগ জানালেন। সে অভিযোগের মধ্যে রাজমর্যাদা ও অভিমান ছিল সংগুপ্ত। ওদিকে সভাসদেরা দ্রৌপদীর রূপের প্রশংসা আরম্ভ করেছেন। যুধিষ্ঠিরের অসহ্যবোধ হল। তিনি দ্রৌপদীকে ভর্ৎসনা করে রাজমহিষী সুদেষ্ণার কাছে যেতে বললেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তাঁর স্বামীরা যথাসময়ে কীচকের আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। দ্রৌপদী বললেন, “যাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্যূতক্রীড়াসক্ত, সেই মহাদয়ালুদের জন্যই আমি ভোগের সময়েও ধর্মচারিণী হয়েছি। না হলে সেই দুর্জনেরা তখনই তাঁদের বধ্য হত।” সুনিতম্বা দ্রৌপদী ক্রোধে আরক্তনয়ন হয়ে এই কথা বলে কেশকলাপ মুক্ত রেখেই বেগে সুদেষ্ণার ভবনে চলে গেলেন।
তখন সুদেষ্ণা বললেন, “বরবৰ্ণিনী! কে তোমাকে প্রহার করল? তুমি কেন কাঁদছ? কার আজ সুখের অবসান হল? কে তোমার অপ্রিয় কার্য করল?” দ্রৌপদী বললেন, “রাজ্ঞী, আমি আপনার জন্য সুরা আনয়ন করতে সেখানে গিয়েছিলাম; তারপরে নির্জনে যেমন প্রহার করে, সেই রকমই রাজসভায় রাজার সামনেই কীচক আজ আমাকে প্রহার করেছে। সুদেষ্ণা বললেন, “সুকেশী, তুমি আমার আদেশেই কীচকের বাড়ি গিয়েছিলে; এই অবস্থাতেই কীচক তোমার অপ্রিয় কার্য করেছে, যদি তুমি ইচ্ছা করো, আমি সে কীচকের প্রাণদণ্ডই করাব।” দ্রৌপদী বললেন, “রাজ্ঞী, কীচক যাঁদের কাছে অপরাধ করেছে, আমি মনে করি— তাঁরাই তাকে বধ করবেন এবং এও মনে করি যে, সে নিশ্চয়ই আজই পরলোকগমন করবে।” ক্রোধে জ্বলতে জ্বলতে দ্রৌপদী আপন কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং দেহ বেশভূষা সংস্কার করে ভীমের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তখন রাত্রিকাল। তখন নির্মলহাসিনী দ্রৌপদী পাকস্থানে ভীমসেনকে পেয়ে ধেনু যেমন মহাবৃষের কাছে গমন করে, তেমনই ভীমসেনের কাছে গমন করলেন। তারপরে দুর্গম বনে সিংহী যেমন নিদ্রিত সিংহকে আলিঙ্গন করে, সেইরূপ দ্রৌপদী নিদ্রিত পাণ্ডুনন্দন ভীমকে আলিঙ্গন করলেন। পরে হস্তিনী যেমন মহাহস্তীকে আলিঙ্গন করে সেইরূপ অনিন্দিতা দ্রৌপদী ভীমসেনকে আলিঙ্গন করে বলতে লাগলেন, “মধ্যমপাণ্ডব! উঠুন উঠুন; মৃতব্যক্তির মতো কেন শয়ন করে আছেন। কারণ পাপিষ্ঠ লোক জীবিত ব্যক্তির ভার্যাকে স্পর্শ করে কখনও জীবিত থাকে না। আমার শত্রু সেই পাপিষ্ঠ সেনাপতি কীচক অদ্যই আমার উপরে সেই পাদপ্রহার করে এখনও জীবিত রয়েছে, এ-অবস্থায় আপনি নিদ্রা যাচ্ছেন কেমন করে?”
ভীমসেনের আশ্বাসবাণী পেয়ে দ্রৌপদী আপন দুরবস্থার বর্ণনা দিলেন, রাজাধিরাজ যুধিষ্ঠির বিরাটরাজার অক্ষক্রীড়ার সদস্যরূপে নিযুক্ত হয়েছেন। ভুবনবিখ্যাত বলশালী স্বামী ভীমসেন রাজার পাচকের কার্যে রত আছেন। ত্রিভূবনে অতলবীর অর্জুন রাজকন্যার নৃত্যশিক্ষকের কার্য করছেন, নকুল অশ্বদের পরিচর্যা করছেন আর সহদেব গোশালায় গোরক্ষকের কাজ করছেন, স্বয়ং তিনি, পাণ্ডবদের পট্টমহিষী, রানি সুদেষ্ণার কেশসংস্কার করতে করতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে গেছে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতীর মতো রানি সুদেষ্ণার মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী ভীমের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ভীমসেনকে বলেন যে, বিরাটরাজার সন্তুষ্টিবিধানের জন্য ভীমসেন যখন হস্তীগণের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন অথবা পশুশালার ভিতরে ব্যাঘ্র, মহিষ ও সিংহগণের সঙ্গে যখন যুদ্ধ করেন, তখন ভীমসেনের বিপদের আশঙ্কায় দ্রৌপদীর মোহ উপস্থিত হয়। তখন অনিন্দ্যসুন্দরী সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে উদ্বেগে মূৰ্ছিতপ্রায় দেখে যুদ্ধদর্শনের জন্য চত্বরে আগত এবং গৃহস্থিত নারীদের বলেন, “এই নির্মল সৈরিন্ধ্রী একত্র বাসজাত স্নেহবশতই মহাবল ব্যাঘ্র প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময়ে এই বল্লবের বিষয়ে শোক করতে থাকে, এই আমি মনে করি। আবার সৈরিন্ধ্রীও সুন্দরী, বল্লবও অতি সুন্দর; কিন্তু স্ত্রীলোকদের মন বোঝ দুষ্কর। তবে আমার ধারণা এই যে এদের রূপ পরস্পরের যোগ্য। এবং একত্রে প্রিয়বাস বশত সৈরিন্ধ্রী সর্বদাই বল্লবের বিষয়ে সদয় বাক্য বলে থাকে। আর-এক কথা— এরা দু’জনেই এক সময়ে এসে ওই রাজবাড়িতে বাস করছে।” সুদেষ্ণা এই ধরনের কথা বলতে থেকে সর্বদাই দ্রৌপদীকে খিন্ন করেন এবং তখন তাঁকে ক্রদ্ধ হতে দেখে ভীমসেনের প্রতি দ্রৌপদীকে অনুরাগিণী বলেই আশঙ্কা করেন। সুদেষ্ণার কথা শুনে দ্রৌপদীর গুরুতর দুঃখ হয়। যুধিষ্ঠিরকৃত শোকসাগরে মগ্ন তিনি আর জীবন ধারণ করতে চান না। ভীমসেন সাধারণত যুধিষ্ঠিরের দয়া এবং ধর্ম ব্যাপারে অত্যন্ত ব্যঙ্গপ্রবণ। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতার পক্ষ অবলম্বন করলেন। বললেন যে, যুধিষ্ঠির ধর্মপাশ আবদ্ধ, অজ্ঞাতবাসের মাত্র একপক্ষকাল অবশিষ্ট আছে। এ সময় পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়লে আরও বারো বৎসর বনবাস যাপন করতে হবে। আরও বললেন যে, দ্রৌপদীর এই সব অভিযোগ শুনলে যুধিষ্ঠির দুঃখে জীবনত্যাগ করবেন। দ্রৌপদীর সংবিৎ ফিরল। তিনিও ভীমসেনকে অজ্ঞাতবাস ভঙ্গ হয় এমন কিছু না-করে কীচককে বধ করতে অনুরোধ করলেন। চূড়ান্ত আলোচনার পর ভীমসেন দ্রৌপদীকে পরদিন সন্ধ্যায় রাজকুমারীর নৃত্যশালায় আমন্ত্রণ জানাতে বললেন।
পরের দিন প্রভাতে কীচক গিয়ে দ্রৌপদীর সম্মুখে আস্ফালন করতে থাকলেন। ভীমসেনের নির্দেশ অনুসারে দ্রৌপদী কীচককে নির্জনে রাত্রে নৃত্যশালায় যেতে আমন্ত্রণ জানালেন। লোলুপ কীচক কোনওমতে দিবস অতিবাহিত করে সন্ধ্যাকালে নৃত্যশালায় উপস্থিত হল। পালঙ্কোপরি শায়িত ভীমসেনকে দ্রৌপদী ভ্রমে আলিঙ্গন করতে গিয়ে কীচক ভীমসেনের বাহুতে আবদ্ধ হল। তুমুল দ্বৈরথের পর কীচকের ভয়ংকর মৃত্যু ঘটল। ভীমসেন কীচকের হাত-পা সব পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে কচ্ছপের মতো ফেলে রেখে গেলেন। দ্রৌপদী ডেকে নৃত্যশালার প্রহরীদের মৃত কীচকের দেহের অবস্থা দেখালেন। প্রহরীরা ভীত হল। কিন্তু কীচকের একশো পাঁচ ভ্রাতা ভয়ে কুপিতও হল বেশি। তারা স্থির করল যে, সৈরিন্ধ্রীর জন্যই কীচকের অলৌকিক মৃত্যু ঘটেছে। অতএব তারা কীচকের সঙ্গেই সৈরিন্ধ্রীকে দগ্ধ করার সিদ্ধান্ত করল ও বেঁধে শ্মশানে নিয়ে চলল। দ্রৌপদী উচ্চৈঃকণ্ঠে স্বামীদের গুপ্ত নামে ডাকতে লাগলেন, “জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়সেন ও জয়দ্বল নামে— যাঁরা আছেন, তাঁরা আমার বাক্য শ্রবণ করুন— উপকীচকেরা আমাকে দগ্ধ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।” দ্রৌপদীর সেই আহ্বান ভীমসেনের কর্ণে পোঁছেলে এবং মুহূর্তমধ্যে অদ্বার দিয়ে লাফিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং মুহূর্তমধ্যে কীচকের একশত পাঁচ ভাইকে নির্বিচারে হত্যা করলেন। এইভাবে কীচককে ধরে মোট একশো ছয় জনকে ভীম হত্যা করলেন।
প্রভাতে নরনারীগণ কীচকদের নিহত দেখে রাজার কাছে গিয়ে জানাল যে, “মহারাজ গন্ধর্বের সকল কীচককে বধ করেছে। বজ্র দ্বারা বিদীর্ণ পর্বতের বিশাল মস্তক যেমন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দেখা যায়, সেইরকম কীচকদেরও বিদীর্ণ এবং ভূতলে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দেখা যাচ্ছে। আর সৈরিন্ধ্রীও মুক্ত হয়ে পুনরায় নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। অতএব মহারাজ, আপনার সমগ্র রাজধানীই সংশয়াপন্ন হয়ে পড়েছে। কারণ, সৈরিন্ধ্রীও যেমন সুন্দরী, গন্ধর্বও মহাবলশালী। আবার সেইরকম ভোগ্যবস্তুর মৈথুনও পুরুষগণের অভীষ্ট। অতএব মহারাজ, আপনার এই রাজধানীটা যাতে সৈরিন্ধ্রীর দোষে বিনষ্ট হয়, সত্বর সেইরূপ নীতি বিধান করুন।” রাজা বিরাট ভীত হয়ে মহিষী সুদেষ্ণাকে বললেন, “মহিষী! সৈরিন্ধ্রী আসলে, তুমি আমার আদেশ অনুসারে তাঁকে বোলো— সৈরিন্ধ্রী, তুমি নগর থেকে চলে যাও এবং ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যত্র বিচরণ করো; তোমার মঙ্গল হোক। কারণ রাজা তোমার স্বামী গন্ধর্বদের কাছে পরাভবের ভয় করছেন। রাজা গন্ধর্বদের ভয়ে নিজে তোমাকে এ কথা বলতে পারছেন না। তবে স্ত্রীলোকের এ কথা বলায় কোনও দোষ নেই; অতএব আমিই তোমাকে বলছি।
কিছু পরে নৃত্যশালার কন্যাদের সঙ্গে দ্রৌপদী রাজভবনে মহিষী সুদেষ্ণার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তখন বিরাটরাজার উপদেশ অনুসারে সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, তুমি যেখানে যেতে ইচ্ছা করো, সত্বর সেখানে চলে যাও। কারণ, রাজা গন্ধর্বগণের নিকট পরাভবের আশঙ্কা করছেন। কেন-না, তুমি যুবতী এবং রূপে অতুলনীয়া! তোমার মঙ্গল। হোক।”
দ্রৌপদী বললেন, “রাজ্ঞী, রাজা আর তেরোটি দিন মাত্র আমাকে ক্ষমা করুন। তাতেই সেই গন্ধর্বেরা কৃতকার্য হবেন। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁরা আমাকে নিয়ে যাবেন, আপনার প্রিয়কার্য করবেন এবং রাজারও মঙ্গল করবেন।
সুদেষ্ণা— সাধারণ আলোচনা
সুদেষ্ণার মূল কাহিনি এখানেই শেষ। এর পরে যোলো দিনের মাথায় পাণ্ডবেরা আত্মপ্রকাশ করলেন এবং সুদেষ্ণা অবাক বিস্ময় দেখলেন যে, তাঁর কেশ পরিচর্যাকারিণী সৈরিন্ধ্রী আসলে যজ্ঞবেদিসম্ভূতা দ্রুপদকন্যা ও পঞ্চপাণ্ডবের প্রিয়তমা ভার্যা দ্রৌপদী। অভিমন্যু ও উত্তরার বিবাহ সম্পর্কে দ্রৌপদী তাঁর বৈবাহিকা হলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় সুদেষ্ণা দ্রৌপদীর সঙ্গেই উপপ্লব্য নগরে বাস করছিলেন। যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের হাতে বিরাটরাজার মৃত্যু হয়। সুদেষ্ণা মৎস্যদেশে ফিরে গিয়ে তাঁর বৈধব্যের অবশিষ্ট দিনগুলি যাপন করেন।
মহাভারতের অন্য নারীদের তুলনায় সুদেষ্ণা সাধারণী কন্যা। তিনি রাজকন্যা এবং রূপবতীও। দ্রৌপদীর রূপ যে তাঁর থেকে অনেক বেশি নিয়োগের দিন থেকে সে-বিষয়ে সচেতন ছিলেন। “রাজা যদি তোমার প্রতি আসক্ত না হন, তা হলে তোমাকে মাথায় করে রাখব।” সাধারণ গৃহিণীর কর্তব্যবোধ তাঁর ছিল, কিন্তু তা ভ্রাতৃস্নেহকে অতিক্রম করতে পারেনি। দ্রৌপদীর প্রতি ভ্রাতা কীচকের দুর্নিবার আকর্ষণ তিনি বুঝেছিলেন, কিন্তু ভ্রাতাকে শাসন অথবা নিবারণের সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি ব্যাঘ্ররূপ ভ্রাতার মুখেই দ্রৌপদীকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সাধারণ নারীর মতো তিনি ভীমসেনের প্রতি দ্রৌপদীর আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন এবং পরিহাস ছলে তা ব্যক্তও করেছেন। রাজার সৈরিন্ধ্রীকে চলে যেতে বলার মধ্যে অন্যায় আছে জেনেও তিনি স্বামীর আদেশ পালন করেছেন। তবুও নিয়তির অমোঘ বিধানে তিনি দ্রৌপদীর অজ্ঞাতবাস বৎসরে, তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন। এ বিষয়ের কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রাপ্য। তাঁর স্বামীর রাজত্বেই যে মহাভারত যুদ্ধের প্রাক্-ভূমিকায় ভীমসেন কীচক সহ একশত পাঁচজন উপকীচককে বধ করেন, এ-ঘটনাও লক্ষণীয়।