০৪. শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী

শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী

সত্যযুগে অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা ও দানবদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। বিষ্ণুর মায়ায় দানবরা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয় এবং মৃত অবস্থায় মর্ত্যভূমিতে পড়তে থাকে। দেবগণের গুরু ছিলেন বৃহস্পতি। দানবদের গুরু ছিলেন শুক্রাচার্য। বিদ্যা, বুদ্ধি, পাণ্ডিত্যে দু’জনে সমান হলেও, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন। যা বৃহস্পতির জানা ছিল না। শুক্রাচার্য মৃত দানবদের বারবার বাঁচিয়ে তুলছিলেন। দেবতারা বহু আলোচনা, বহু মন্ত্রণার পর স্থির করলেন দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র শিক্ষা করতে পাঠানো হবে। শুক্রাচার্য স্বাভিমানী ব্রাহ্মণ। তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।

শুক্রাচার্যের অত্যন্ত আদরের কন্যা রূপবতী দেবযানী। দেবতারা বিশ্বাস করেছিলেন, কচ তাঁর নম্র ব্যবহার, স্থৈর্য এবং স্থির বুদ্ধির প্রয়োগে দেবযানীর মন জয় করতে পারবেন। ঘটলও তাই। আশ্রমকন্যা হলেও দেবযানী পিতার অত্যন্ত আদরে পালিতা হওয়ায় তাঁর মধ্যে অধিকারবোধ অত্যন্ত প্রবল ছিল। তিনি পিতার ক্ষমতা জানতেন এবং সেই ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে নিজেকে বিবেচনা করতেন।

দানবরাজ বৃষপর্বা গুরুকে ঈশ্বরের মতো ভক্তি করতেন। গুরুকে না জানিয়ে কোনও গুরুতর কার্য করার কথা তিনি চিন্তাও করতে পারতেন না। বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা অতুলনীয়া রূপসি। দানবরাজ কন্যা হওয়ায় তিনি অতিমাত্রায় গর্বিতা। দৈত্যগুরুর কন্যাকে তিনি তাঁর অন্য সখীদের মতোই দেখেন। কোনও অধিক মান্যতা দেওয়ার বোধ কখনওই অনুভব করতেন না।

দানবরাজ বৃষপর্বা বিচলিত না হলেও কচের আগমনে এবং উদ্দেশ্য জেনে অন্য দানবরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তারা স্থির করল শুক্রাচার্যকে না জানিয়ে কচকে হত্যা করবে। দানবরা প্রথমবার কচকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াল, দ্বিতীয়বার কচকে টুকরো টুকরো করে কেটে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। দেবযানী তাঁর প্রীতির পাত্র কচের জন্য পিতার কাছে কান্নাকাটি করতে আরম্ভ করলেন। শুক্রাচার্য দু’বারই মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র দ্বারা কচকে জীবিত করে তুললেন। তৃতীয়বার দানবরা কচকে পিষে চূর্ণ করে ফেলল এবং শুক্রাচার্যের মদের সঙ্গে তা মিশিয়ে দিল। দেবযানী যথারীতি কচের অনুপস্থিতিতে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। শুক্রাচার্য অনুসন্ধানে জানলেন কচ তাঁর পান করা মদের সঙ্গে তাঁর উদরের মধ্যে বাস করছেন। শুক্রাচার্য সেই অবস্থায় কচকে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র দান করলেন এবং আপন উদরের পার্শ্বদেশ বিদীর্ণ করে বাইরে আসতে আজ্ঞা দিলেন। কচ বাইরে এসে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র দ্বারা গুরুকে জীবিত করে তুললেন।

মন্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। কচের স্বর্গে ফিরে যাবার সময় উপস্থিত। দেবযানী কচের প্রতি অকুণ্ঠ প্রণয় জ্ঞাপন করে তার পাণিগ্রহণের অনুরোধ জানাল। কচের কাছে এ প্রস্তাব অবিশ্বাস্য। তিনি দেবযানীকে ভগিনী ভিন্ন আর কিছু ভাবতেই পারেন না। কচ বললেন, “দেবযানী, তুমি ও আমি উভয়েই গুরু শুক্রাচার্যের উদরনিঃসৃত। সুতরাং আমাদের অন্য কোনও সম্পর্কই হতে পারে না। যখন দেবযানী দেখলেন যে কচ কিছুতেই তাঁকে গ্রহণ করবেন না, দেবযানী কচকে অভিসম্পাত দিলেন, “যে মন্ত্রশিক্ষার অহংকারে তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে, তা শেখাতে পারবে কিন্তু প্রয়োগ করতে পারবে না।” কচ ক্ষুব্ধ হলেন, যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি হাজার বছর তপস্যা করেছেন, দেবসমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এক নারীর লালসায় তা ব্যর্থ হয়ে যাবে? দেবযানীকে বললেন, ‘তাই হবে, আমি প্রয়োগ করতে পারব না, কিন্তু আমি যাকে শেখাব, সে নিশ্চয়ই এর প্রয়োগ করতে পারবে। গুরুদেব শুক্রাচার্য তোমাকে গ্রহণ বিষয়ে আমাকে কোনও আদেশ দেননি। তা সত্ত্বেও তুমি আমাকে অভিশপ্ত করলে। আমিও অভিসম্পাত করছি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ শুক্রাচার্যের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও কোনও ব্রাহ্মণ অথবা ঋষিকুমার তোমার পাণিগ্রহণ করবেন না।

কচ স্বর্গে ফিরে গেলেন। দেবতারা কচকে ফিরে আসতে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন ও ইন্দ্রকে শত্রু বিজয়ের যাত্রায় অগ্রসর হবার অনুরোধ জানালেন।

‘তাই হোক’ বলে ইন্দ্র শত্রুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এক উদ্যানের মধ্যে সরোবরে কয়েকজন যুবতীকে জলকেলি করতে দেখলেন। সরোবরের তীরে যুবতীদের বস্ত্রগুলি পড়ে ছিল। ইন্দ্র বায়ুর রূপ ধরে সেই বস্তুগুলিকে পরস্পর মিশিয়ে দিলেন। জলকেলি সমাপ্ত করে যুবতীরা জল থেকে উঠে আপন আপন বস্ত্র নিতে গেলেন। তাঁদের মধ্যে দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা বুঝতে না পেরে দেবযানীর বস্ত্রখানি পরিধান করলেন। সেই বস্ত্র নিয়ে তখনই শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর মধ্যে বিবাদ বেঁধে গেল।

দেবযানী বললেন, “অসুরের মেয়ে! তুই আমার শিষ্য হয়ে আমারই কাপড় নিয়েছিস কেন? তোর সদাচার নেই। সুতরাং তোর ভাল হবে না।”

শর্মিষ্ঠা বললেন, “দেবযানী। তোর পিতা নীচে থেকে স্তুতিপাঠকের মতো বিনীতভাবে কি বসার সময়ে, কি শয়ন করার সময়ে সর্বদাই আমার পিতার স্তব করে থাকেন। যে স্তব করে এবং প্রার্থনা করে এবং প্রতিগ্রহণ করে, তুই তার কন্যা; আর যার স্তব করা হয় এবং যিনি দান করেন ও প্রতিগ্রহ করেন না, আমি তাঁর কন্যা। সুতরাং ভিখারিনি, তুই কপাল কুটে কিংবা মাটিতে পড়ে সন্তাপ কর কিংবা অপকারের চেষ্টা কর, অথবা ক্রোধ করতে থাক, তাতে আমার কী হবে। তুই নিবস্ত্রা ও দরিদ্রা। আর আমি সশস্ত্রা ও রাজকন্যা। তথাপি তুই আমার উপর ক্রোধ দেখাচ্ছিস; তুই ঠিক প্রতিযোদ্ধা পাবি; আমি তোকে গ্রাহ্যই করি না।

দেবযানী যুক্তি দেখিয়ে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন এবং শর্মিষ্ঠার পরা কাপড়খানি ধরে টানতে লাগলেন। ক্রোধে শর্মিষ্ঠা একটি ধাক্কা দিয়ে দেবযানীকে একটি কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে নিজের গৃহে চলে গেলেন। ক্রোধে অধীরা এবং দেবযানীর হত্যায় কৃতনিশ্চয় শর্মিষ্ঠা ‘দেবযানী মরে গেছে’ এই মনে করে তার দিকে আর দৃষ্টিপাত না করেই আপন ভবনে চলে গেলেন।

এদিকে রাজা যযাতি মৃগয়ায় ক্লান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে জলের সন্ধানে সেই কূপের কাছে উপস্থিত হলেন। জলশূন্য কূপের ভিতরে তাকিয়ে যযাতি অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বলাকৃতি একটি কন্যাকে দেখতে পেলেন। দেখেই তিনি আশ্বস্ত করে দেবকন্যার মতো সেই কন্যাটিকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে? তোমার নখগুলি তাম্রবর্ণ, শরীরের বর্ণ তপ্ত কাঞ্চনের মতো, মণিময় কুণ্ডল দুটি পরিমার্জিত। তুমি কোন গুরুতর বিষয় চিন্তা করছ আর পীড়িতের মতো ক্রন্দন করছ কেন? লতা ও তৃণে পরিপূর্ণ এই কূপের মধ্যে তুমি পড়ে গেলে কেমন করে?”

দেবযানী বললেন, “যিনি সঞ্জীবনী বিদ্যার বলে দেবগণ-নিহত, দৈত্যগণকে বাঁচিয়ে তোলেন, আমি সেই শুক্রাচার্যের কন্যা; তিনি নিশ্চয়ই আমাকে কূপে পতিত বলে জানতে পারেননি।”

জানামি ত্বামহং শান্তং বীর্যবন্তং মনস্বিনম।

তস্মাৎ মাম্ পতিতামস্মাৎ কূপাং উর্দ্ধুতম অহর্সি ॥ আদি : ৬৬ : ২১ ॥

“আমি অনুমান করি, আপনি শান্ত, বলবান ও মনস্বীই হবেন। সুতরাং আপনিই আমাকে এই কূপ থেকে তোলার যোগ্য। রাজা, এই আমার রক্তবর্ণ হস্ত। আপনি আমার হাতখানি ধরে উপরে তুলুন। আমার মনে হচ্ছে, আপনি নিশ্চয় সকুল উৎপন্ন হবেন।”

তারপর যযাতি ব্রাহ্মণকন্যা জেনে দেবযানীর দক্ষিণ হস্ত ধরে তাঁকে কূপের উপরে উত্তোলন করলেন। বলপূর্বক সুন্দর নিতম্ব দেবযানীকে উদ্ধার করে তাঁর অনুমতি নিয়ে রাজা আপন রাজধানীতে চলে গেলেন।

এদিকে ঘূর্ণিকা নামের এক দাসী দেবযানীর অন্বেষণে সেখানে এসে উপস্থিত হল। দেবযানী তাঁকে বললেন, “ঘূর্ণিকা, সত্বর যাও। পিতৃদেবকে আমার সমস্ত অবস্থা জানাও। আমি এখন কিছুতেই বৃষপর্বার গৃহে প্রবেশ করব না।”

ঘূর্ণিকা দ্রুত অসুররাজের গৃহে গিয়ে শুক্রাচার্যকে সমস্ত সংবাদ জানাল। ঘূর্ণিকা বলল যে, অসুররাজ-কন্যা শর্মিষ্ঠা উদ্যানের ভিতরে দেবযানীকে আহত করেছে। শুক্রাচার্য তখনই বিচলিত হয়ে উদ্যানে গিয়ে দেবযানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। দেবযানীর আহত অবস্থা দেখে শুক্রাচার্য দুই বাহুতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সকল লোকেই নিজের দোষ ও গুণে দুঃখ ও সুখ অনুভব করে। আমি মনে করি, তোমার কোনও দোষ ছিল, যার এই প্রায়শ্চিত্ত শর্মিষ্ঠা করিয়ে দিয়েছে।” দেবযানী বললেন, “আমার প্রায়শ্চিত্ত হোক বা না হোক, শর্মিষ্ঠা আমাকে যা বলেছে, আপনি মনোযোগ দিয়ে তা শুনুন। তার একথা কি সত্য যে আপনি দৈত্যদের স্তুতিপাঠক? বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ক্রোধে অধীর হয়ে আমাকে এ কথা বলেছে। সে বলেছে, “যে লোক সর্বদা স্তব করে, প্রার্থনা করে এবং প্রতিগ্রহ করে, তুই তার কন্যা। আর যাঁর স্তব করা হয়, যিনি দান করেন এবং প্রতিগ্রহ করেন না, আমি তাঁর কন্যা। পিতা, যদি শর্মিষ্ঠার কথা সত্য হয় তবে অনুনয় করে আমি তাঁকে প্রসন্ন করব, তাঁর সখীকে আমি এ-কথা বলে দিয়েছি। এই নিদারুণ অপমান করে শর্মিষ্ঠা আমাকে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে গিয়েছে।”

শুক্রাচার্য বললেন, “দেবযানী, তুমি স্তাবক, যাচক কিংবা প্রতিগ্রহ উপযোগীর কন্যা নও। কিন্তু যিনি কারও স্তব করেন না এবং সকলেই যাকে স্তব করে, তুমি তাঁরই কন্যা। অসুররাজ বৃষপর্বা, দেবরাজ ইন্দ্র এবং মনুষ্য যযাতি জানেন যে অচিন্তনীয়, অদ্বিতীয় এবং জগদীশ্বর ব্রহ্মই আমার বল। বিশেষত, আমিই কেবল জগতে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র জানি। এই মন্ত্রের দ্বারা মৃত প্রাণী পুনরায় জীবিত হয়। আত্মপ্রশংসা দোষের, আমার আত্মপ্রশংসা করা উচিত নয়। চলো, আমরা ক্ষমা করে নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। কারণ ক্ষমাই সাধুলোকের প্রধান শক্তি। মর্ত্যলোকে অথবা স্বর্গলোকে সর্বত্র যে কিছু পদার্থ আছে, আমিই তার ঈশ্বর, আমার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা আমাকে এই আশীর্বাদ করেছিলেন।”

শুক্রাচার্য এইভাবে মধুর ও কোমল বাক্যে বিষণ্ণা ও দুঃখার্তা দেবযানীকে আশ্বস্ত করলেন। শুক্রাচার্য আরও বললেন, “দেবযানী, তুমি আরও জেনো যে তোক ক্ষমাগুণে ক্রোধকে দূর করেছেন, সেই লোকই জগৎ জয় করতে পারেন। যে লোক অশ্বের তুল্য উদ্ৰিক্ত ক্রোধকে দমন করতে পারে, সাধু লোকেরা তাকেই সারথি বলে থাকেন। শুধু লাগাম ধরে থাকেন যিনি তিনি সারথি হতে পারেন না। সাপ যেমন খোলস ছেড়ে ফেলেন, তেমনই সাধু ব্যক্তি ক্রোধকে ত্যাগ করেন। যে লোক ক্রোধ নিরুদ্ধ রাখেন, অপরের তিরস্কার সহ্য করেন, অন্যের দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে অন্যকে উৎপীড়ন করেন না— তাঁরাই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যে লোক শত বৎসর ধরে পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধ করে না অথচ কারও উপরে ক্রোধ প্রকাশ করে না— এ দুয়ের মধ্যে ক্রোধহীন লোকই শ্রেষ্ঠ।

ক্রোধহীন মানুষ শ্রেষ্ঠ। কাম ও ক্রোধ অত্যন্ত নিন্দিত। ক্রুদ্ধ ও কামুক লোকের যজ্ঞ, দান ও তপস্যা নিষ্ফল হয়ে যায়। ক্রোধের বশবর্তী লোক জিতেন্দ্রিয়, তপস্বী, যাজ্ঞিক অথবা অন্য প্রকার ধার্মিক হতে পারেন না। ক্রোধী লোকের পুত্র, ভ্রাতা, ভৃত্য, সুহৃদ, ভার্যা, ধর্ম ও সত্যপরায়ণতা— এ সবই নিষ্ফল হয়ে যায়।

বুদ্ধিহীন বালক-বালিকারা পরস্পর যে বিবাদ করে, বুদ্ধিমান লোক তার অনুসরণ করেন না। কেন-না, বালক প্রভৃতি বিরোধের দোষগুণ বোঝে না।” দেবযানী বললেন, “পিতা আমি বালিকা হলেও ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব জানি এবং ক্ষমা ও ক্রোধের দোষ-গুণও জানি। যে শিষ্য হয়েও শিষ্যের ব্যবহার করে না, ধর্ম বিসর্জন করে, সে শিষ্যকে ক্ষমা করা উচিত নয়। যে ভৃত্য ও শিষ্য, আপন কর্তব্য ও প্রভুসেবা করে না, গুরুসেবা করে না— সেই মিশ্রবৃত্তি শিষ্যের মধ্যে আমার বাস করতে ইচ্ছা করে না। যে সকল লোক ব্যবসায় এবং বংশের মর্যাদা জানে, সেই সাধু-প্রকৃতির লোকের মধ্যেই বাস করবে। চণ্ডাল ও ধনী লোক সর্বদাই অন্যের উৎপীড়ন করে। কোনও সৎকর্ম করে না, ধনের বলে বড় হতে চায় এবং দুর্বৃত্ত ও পাপাচারী হয়ে থাকে। কেবল জাতি দ্বারাই চণ্ডাল হয় না, যারা আপন কর্তব্য না করে, সর্বদা ধন, বংশ ও বিদ্যাতে আসক্ত থাকে, তারাও ন্যায় অনুসারে চণ্ডাল। পাপিষ্ঠ প্রতিবেশী বিনা কারণে সজ্জনের বিদ্বেষ ও অপবাদ করে, সেই পাপিষ্ঠদের সঙ্গে সজ্জনের বাস করা উচিত নয়, কারণ তাতে সজ্জন ক্রমে পাপী হয়ে ওঠে। পুণ্যবান ও পাপীর সঙ্গে যে লোক বাস করে, সে ক্রমশ পুণ্য বা পাপে অনুবাসী হতে থাকে। তাই কখনও পাপীদের সঙ্গে বাস করবে না। শর্মিষ্ঠার দারুণ কটুবাক্য আমার হৃদয় মন্থন করছে। কিছু লাভের আশায় আমি বিদ্বেষী ধনীর উপাসনা করব না, কারণ নীচ লোকের সঙ্গে বাস করতে থাকলে ক্রমাগত অপমানিত হতে হয়। দুর্জনের মুখনিঃসৃত কটুবাক্য সর্বদাই সজ্জনের মর্মকে তাড়িত করতে থাকে। অস্ত্রে ছিন্ন কিংবা অগ্নিতে দগ্ধ অঙ্গ পুনরায় উৎপন্ন হয় কিন্তু বাক্‌ক্ষত অঙ্গ আর উৎপন্ন হয় না। কটুবাক্যে বিকলীকৃত চিত্ত আর সুস্থ হয় না।”

দেবযানীর এই বিলাপ শুনে শুক্রাচার্য সিংহাসন আরূঢ় বৃষপর্বার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, “মহারাজ, গোরু যেমন সদ্য প্রসব করে না, পাপও তেমনই সদ্য ফল দেয় না। আর বারবার পাপ করলে পাপ কর্তাবই মূলোচ্ছেদ করে। পাপকারী যদিও আপনার উপরে পাপের কোনও ফল দেখতে পায় না; তবুও মুখদ্বারা ভুক্ত গুরুপাক দ্রব্য যেমন উদরে গিয়ে ফল জন্মায়, তেমন সেই পাপও পুত্রে বা পৌত্রে গিয়ে নিশ্চয়ই ফল জন্মাবে।

সচ্চরিত্র, ধার্মিক, গুরুশুশ্রূষাপরায়ণ এবং আমারই গৃহে অবস্থিত অঙ্গিরার পৌত্র ব্রাহ্মণ কচকে তুমি হত্যা করিয়েছিলে। আবার তোমার কন্যা শর্মিষ্ঠা, আমার কন্যা শুদ্ধচিত্তা দেবযানীকে প্রথমে অনেক নিষ্ঠুর কথা বলেছে, পরে ক্রোধবশত প্রতারণা করে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই কারণে দেবযানী তোমার রাজত্বে বাস করবে না। বৃষপর্বা, বধের অযোগ্য কচকে বধ করায়, আবার আমার কন্যা দেবযানীকে বধ করার চেষ্টা করায়, আমি তোমার রাজত্বে আর বাস করব না, বন্ধুদের সঙ্গে তোমাকে ত্যাগ করব। রাজা! আমি দেবযানীকে ছাড়া তোমার রাজত্বে বাস করব না। তুমি আমার জন্য শোক কোরো না, অথবা আমার উপরে কোনও ক্রোধ কোরো না।”

বৃষপর্বা বললেন, “ভৃগুনন্দন, আপনার মধ্যে অধর্ম বা মিথ্যাবাদিতা আছে বলে আমি মনে করি না। ধর্ম ও সত্য আছে বলে মনে করি, অতএব আপনি আমার উপরে প্রসন্ন হোন। আপনি যদি আমাদের পরিত্যাগ করে এ স্থান ত্যাগ করে চলে যান, তবে আমরা সমুদ্রে গিয়ে প্রবেশ করব। কারণ সমুদ্র ছাড়া আমাদের অন্য কোনও আশ্রয় থাকবে না।”

শুক্রাচার্য বললেন, “অসুরগণ, তোমরা সমুদ্রেই প্রবেশ করো অথবা দিক্‌প্রান্তে চলে যাও, আমি দেবযানীর দুঃখ সহ্য করতে পারব না। তবে তোমরা দেবযানীকে প্রসন্ন করতে চেষ্টা করতে পারো, কারণ তার উপরেই আমার জীবনের ভার রয়েছে।” বৃষপর্বা বললেন “ভৃগুনন্দন, অসুরদের যা কিছু সম্পদ আছে কিংবা হাতি, গোরু, ঘোড়া আছে, সেগুলির এবং আমাদের সকলের প্রভু আপনি।”

শুক্রাচার্য বললেন, “অসুররাজ, দৈত্যগণের সকল সম্পত্তির যদি আমি প্রভু হই, তা হলে তোমরা দেবযানীকে প্রসন্ন করো।” বৃষপর্বা বললেন, “তাই হবে।” শুক্রাচার্য দেবযানীর কাছে গিয়ে সে কথা জানালে, দেবযানী বললেন, “আমি অসুররাজের মুখেই সে কথা শুনব।” শুক্রাচার্যের মুখে সে কথা শুনে বৃষপর্ব পাত্রমিত্র সকলকে নিয়ে দেবযানীর কাছে গেলেন এবং “প্রসন্ন হও” এই কথা বলে তার চরণযুগলে পতিত হলেন। বৃষপর্বা আরও বললেন, “দেবযানী, তুমি যা চাইবে, তাই দেব।— তা যদি দুর্লভ হয়, তা হলেও তোমাকে তা দেব।” দেবযানী বললেন, “এক হাজার কন্যার সঙ্গে শর্মিষ্ঠাকে আমি দাসী রাখতে চাই। পিতা আমাকে যে পাত্রের হাতে দান করবেন, শর্মিষ্ঠা আমার পিছনে পিছনে সেখানে যাবে।” বৃষপর্বা তৎক্ষণাৎ ধাত্রীকে আদেশ করলেন, “শীঘ্র যাও, শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে এসো, দেবযানী যা-যা চাইছেন শর্মিষ্ঠা তা সবই করুক।” ধাত্রী গিয়ে শর্মিষ্ঠাকে বলল, “ওঠো, চলো জ্ঞাতিবর্গের আনন্দ সম্পাদন করো। দেবযানীর উত্তেজনায় শুক্রাচার্য শিষ্যগণকে ত্যাগ করছেন, অতএব দেবযানী যা চাইবে, তোমাকে তাই করতে হবে।”

শর্মিষ্ঠা বললেন, “দেবযানী যা চাইবে, আমি আজ থেকে তাই করব এবং শুক্রাচার্যের আদেশেও দেবযানীর জন্য সব করব। তবুও আমার দোষে শুক্রাচার্য যেন দেবযানীকে নিয়ে চলে না যান।” পিতার আদেশে শর্মিষ্ঠা তখনই সহস্র দাসী নিয়ে শিবিকায় উঠে রাজবাটী থেকে নির্গত হলেন। শর্মিষ্ঠা দেবযানীর কাছে গিয়ে বললেন, “দেবযানী, সহস্র দাসীর সঙ্গে আমি তোমার পরিচর্যাকারিণী দাসী হলাম। তোমার পিতা তোমাকে যে স্থানে দান করবেন, আমি সেই স্থানে তোমার পিছনে পিছনে যাব।” দেবযানী বললেন, “শর্মিষ্ঠা তোমার মতে আমি স্তাবক, যাচক ও প্রতিগ্ৰহ উপজীবীর কন্যা। আর তুমি, স্তৃয়মানের কন্যা। সুতরাং তুমি আমার দাসী হবে কীভাবে?” শর্মিষ্ঠা বললেন, “যে-কোনও কাজ করেই বিপন্ন জ্ঞাতিবর্গের বিপদের প্রতিকার করব।”

শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাস্যবৃত্তি স্বীকার করে নিলে দেবযানী শুক্রাচার্যকে বললেন, “পিতা! আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। সুতরাং এখন নগরে প্রবেশ করব। আপনার জ্ঞান অব্যর্থ, সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবও অব্যর্থ।” দেবযানীর কথা শুনে দানবগণ শুক্রাচার্যের বিশেষ সম্মান করলেন, তখন তিনি নগরে প্রবেশ করলেন।

দীর্ঘকাল অতিবাহিত হলে কোনও সময় বরবর্ণিনী দেবযানী বিহার করার জন্য সেই বনেই উপস্থিত হলেন। দেবযানীর পিছনে পিছনে শর্মিষ্ঠাও সহস্র দাসী নিয়ে অনুগমন করলেন। দেবযানী সেই সখীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশেষ আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। সখীরা কেউ পুষ্পমধু পান করতে লাগল, কেউ গান গাইতে আরম্ভ করল। কেউ কেউ নানাবিধ খাদ্য খেতে লাগল, কেউ কেউ ফল চর্বণ করতে লাগল।

এই সময়ে মৃগয়াবিহারী রাজা যযাতি পিপাসার্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে ঈশ্বরেচ্ছানুসারে পুনরায় সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দিব্য অলংকারে অলংকৃত সেই ক্রীড়ারত রমণীদের দেখলেন। আরও দেখলেন যে, দেবযানী রত্নখচিত একটি আসনের উপরে সহাস্যমুখে উপবেশন করে আছেন। আর রূপে অতুলনীয়া সেই রমণীদের মধ্যে প্রধানা, স্বর্ণালংকারে অলংকৃতা এবং মধুরহাসিনী আরও একটি কন্যা সেই আসনের থেকে নিকৃষ্ট আসনে উপবেশন করে দেবযানীর পাদ-সংবাহন করছে। আনন্দিত, ক্রীড়ারত, নৃত্যরত, সেই রমণীরা অপূর্ব রূপবান যযাতিকে দেখে লজ্জায় অবনত হয়ে পড়ল।

যযাতি বললেন, “দুই হাজার কন্যা দুটি কন্যাকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। কল্যাণী! আমি আপনাদের দু’জনের নাম ও পরিচয় জানতে চাই।”

দেবযানী বললেন, “মহারাজ, আমি বলছি, আপনি শ্রবণ করুন। আমি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী, আর ইনি দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। ইনি আমার সখীও বটেন, দাসীও বটেন। তাই আমি যেখানে যাই, ইনিও সেইখানে যান।” যযাতি বললেন, “অসুররাজ-তনয়া পরমসুন্দরী এই কন্যাটি কী করে আপনার সখী ও দাসী হলেন, তা শোনার জন্য আমি অত্যন্ত কৌতূহল বোধ করছি। এমন সুন্দরী দেবী নয়, গন্ধর্বী নয়, যক্ষী অথবা কিন্নরীও নয়। এইরকম সুন্দরী নারী আমি পৃথিবীতে বেশি দেখিনি। এই অসুররাজ কন্যার নয়ন লক্ষ্মীদেবীর নয়নের মতো দীর্ঘ। এর সমস্ত লক্ষণই মনোহর এবং ইনি সকল অলংকারে অলংকৃত। এই সুন্দরী নিজের ভাগ্যদোষে অথবা আপনার তপোবলে দাসী হয়েছেন। না হলে, এইরকম সর্বাঙ্গসুন্দরী কখনও অন্যের দাসী হতে পারেন না। আপনার রূপও এই নারীর রূপের তুল্য নয়; অতএব নিশ্চয়ই ইনি পূর্বজন্মের পাপের ফলে আপনার দাসী হয়েছেন।”

দেবযানী বললেন, “মহারাজ, সকল লোকই দেবকৃত ফলের অনুসরণে বাধ্য হয়। এর দাস্যবৃত্তিও এইরকম কোনও দৈবকৃত ফল বলেই মনে করুন। আপনার আকৃতি ও বেশ রাজার ন্যায় দেখা যাচ্ছে এবং আপনি বেদও জানেন বলে মনে হচ্ছে। অতএব আপনি আমাকে বলুন আপনি কে? আপনি কার পুত্র? আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” যযাতি বললেন, “ব্রহ্মচর্য করবার সময়ে সমস্ত বেদই আমার কর্ণগোচর হয়েছিল; আর আমি যযাতি নামের রাজা এবং রাজারই পুত্র।’ দেবযানী বললেন, “মহারাজ, আপনি কীসের জন্য এখানে এসেছেন? এই সরোবর থেকে লীলাপদ্ম নেওয়ার জন্য? না, এই বনে মৃগয়া করার জন্য?” যযাতি বললেন, “ভদ্রে, আমি মৃগয়া করতে এসে জলের জন্য এখানে এসেছি। সে যা-ই হোক। আপনি অনেক কথাই জিজ্ঞাসা করেছেন, এবার আমাকে যাবার অনুমতি করুন।” দেবযানী বললেন, “দুই সহস্র কন্যার এবং দাসী শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আমি আপনার অধীনা হলাম। আপনার মঙ্গল হোক। আপনি আমার সখা ও স্বামী হোন।”

যযাতি বললেন, “দেবযানী, আপনার মঙ্গল হোক। আমি আপনাকে বিবাহ করতে পারি না। কারণ, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে আপনার পিতার বিবাহ-সম্বন্ধ স্থাপন করা সংগত নয়। পরস্ত্রী, ভগিনী, বর্ণশ্রেষ্ঠা, সগোত্রা, পুত্রবধূ, নিকৃষ্টবর্ণা, ভিক্ষুণী এবং রোগিণী— পণ্ডিতগণ এদের সঙ্গে রমণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন।”

দেবযানী বললেন, “ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে সংসষ্ট আছেন। আবার ব্রাহ্মণও ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে সংসৃষ্ট আছেন। বিশেষত আপনি ঋষিও বটেন, ঋষিপুত্রও বটেন। সুতরাং মহারাজ, আপনি আমাকে বিবাহ করুন।” যযাতি বললেন, “দেবযানী, চারটি বর্ণই এক শরীর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু তাদের ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন, শৌচও ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ।” দেবযানী বললেন, “মহারাজ, একবার একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করে, বিবাহবিষয়ে প্রত্যাখ্যান করা কোনও পুরুষের পক্ষেই সংগত নয়। আপনি পূর্বে আমার পাণিগ্রহণ করেছেন, আমি তাই বিবাহের প্রস্তাব করেছি। আপনি ঋষিপুত্র হয়ে এবং নিজেও ঋষি হয়ে আমার যে পাণিগ্রহণ করেছিলেন, সে পাণি অন্যে গ্রহণ করবে কী করে?” যযাতি বললেন, “ক্রুদ্ধ তীক্ষ্ণবিষ সর্প ও বিশাল অগ্নি— এই দুই অপেক্ষাই ব্রাহ্মণকে ভীষণতর বলে বুঝতে হবে।” দেবযানী বললেন, “তীক্ষ্ণ বিষ সর্প ও বিশাল অগ্নির থেকেও ব্রাহ্মণকে ভয়ংকর বললেন কেন?” যযাতি বললেন, “সর্প একজনকে নষ্ট করে, অস্ত্রও একজনকেই বধ করে। কিন্তু ক্রুদ্ধ ব্রাহ্মণ রাজ্যের সঙ্গে নগর ধ্বংস করে দেন, সেই কারণেই আমি অগ্নি ও সর্পের থেকে ব্রাহ্মণকে ভীষণতর বলে মনে করি। অতএব আপনার পিতা আপনাকে দান না করলে, আমি বিবাহ করতে পারি না।”

দেবযানী বললেন, “মহারাজ, তা হলে আমি আপনাকে বরণ করলাম। পিতাই আমাকে আপনার কাছে দান করবেন। এ অবস্থায় আপনি আমাকে বিবাহ করতে পারেন। কেন-না, আপনি প্রার্থনা করেননি, অথচ দত্তাকেই গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আপনার কোনও ভয় থাকতে পারে না। আপনি কিছুকাল অপেক্ষা করুন, আমি পিতার কাছে দূতী পাঠাচ্ছি। ধাত্রী! তুমি সত্বর যাও, ব্রহ্মার তুল্য পিতৃদেবকে এখানে আনয়ন করো। আমি নিজেই মহারাজকে বরণ করেছি, একথাও পিতৃদেবকে সত্বর জানাও।”

ধাত্রী সত্বর গিয়ে দেবযানীর অভিমত সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথভাবে শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে জানাল। শুক্রাচার্যও শোনামাত্র এসে রাজাকে দর্শন দান করলেন। রাজাও শুক্রাচার্যকে উপস্থিত দেখে নমস্কার করলেন এবং কৃতাঞ্জলি হয়ে অবনতভাবে অবস্থান করতে লাগলেন। তখন দেবযানী বললেন, “পিতঃ, এই যযাতিরাজই পাণিগ্রহণ করে কূপের ভিতর থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন; আপনাকে নমস্কার করি; আপনি এর হাতেই আমাকে সমর্পণ করুন, জগতে আমি অন্য পুরুষকে পতিত্বে বরণ করব না।”

শুক্রাচার্য বললেন, “দেবযানী, ধর্ম এক, প্রণয়ের পাত্র আর-এক। তাই তুমি আমার অনুমতির পূর্বেই যযাতিকে পতিত্বে বরণ করেছ। বিশেষত, কচের অভিসম্পাতে তোমার তো কোনও ঋষিপুত্রের পাণিগ্রহণ হতেই পারে না। যযাতি, আমার পরম স্নেহের পাত্রী এই কন্যাটি তোমাকে পতিত্বে বরণ করেছে; আমিও একে দান করলাম। সুতরাং তুমি একে মহিষীরূপে গ্রহণ করো।”

যযাতি বললেন, “মহর্ষি, এই পাণিগ্রহণে বর্ণসংকরজনক গুরুতর পাপ আমাকে স্পর্শ না করে, এই জন্য আমি আপনার শরণাপন্ন হলাম।” শুক্রাচার্য বললেন, “তুমি এই বিবাহে বিষন্ন হোয়ো না, আমি তোমাকে পাপ থেকে মুক্ত করব। আমার অভীষ্ট বর শোনো, আমিই তোমার পাপ নষ্ট করে দেব। তুমি ধর্মানুসারে এই সুন্দরী দেবযানীকে বিবাহ করো এবং এর সঙ্গে অতুলনীয় আনন্দ ভোগ করতে থাকো।”

ইয়ঞ্চাপি কুমারী তে শর্মিষ্ঠা বার্ষপর্বনী।

সম্পূজ্যা সততং রাজন্! মা চৈনাং শয়নে হবয়েঃ ॥ আদি: ৬৯ : ৪৪।

“যযাতি! বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে তুমি সর্বদাই পূজনীয়ভাবে পালন করবে। কিন্তু কখনও শয্যাতে তাকে ডাকবে না।”

শুক্রাচার্য একথা বললে, যযাতি রাজা শুক্রাচার্যকে প্রদক্ষিণ করে শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে দেবযানীকে বিবাহ করলেন। তারপর রাজশ্রেষ্ঠ যযাতি দুই সহস্র কন্যা এবং শর্মিষ্ঠার সঙ্গে সুন্দরী দেবযানীকে ও শুক্রাচার্যের কাছ থেকে প্রচুর ধন যৌতুক লাভ করে আনন্দের সঙ্গে শুক্রাচার্যের অনুমতি অনুসারে আপন রাজধানীতে চলে গেলেন।

যযাতি রাজধানীতে আপন অন্তঃপুরে দেবযানীকে স্থাপন করলেন। আর দেবযানীর অনুমতি অনুসারে উদ্যানের অশোকবনের কাছে নূতন একটি বাটী নির্মাণ করে, সেখানে অসুররাজ শর্মিষ্ঠাকে আপন সহস্র অনুচরীর সঙ্গে স্থাপন করলেন এবং তাঁদের যথাযোগ্য অন্ন, পানীয় ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিলেন।

দেবযানীর সঙ্গে বহু বৎসর বিবাহের পর, দেবযানী গর্ভবতী হলেন ও একটি পুত্র প্রসব করলেন।

বহুকাল অতীত হলে, যৌবনান্বিতা বৃষপর্ব-দুহিতা শর্মিষ্ঠা ঋতুমতী হয়ে চিন্তা করলে লাগলেন, “আমার ঋতুকালও উপস্থিত হল; অথচ আমার পতিও নেই; এখন আমি যে যন্ত্রণায় পতিত হলাম, তাঁর উপশম হবে কী উপায়ে? দেবযানী তো পুত্রবতী হয়েছে, কিন্তু আমার যৌবন নিষ্ফল এসেছে। সে যা-ই হোক, দেবযানী যেমন নিজেই পতিবরণ করেছে, আমিও তেমনই নিজে পতিবরণ করব। রাজা আমাকে অবশ্য পুত্র দান করবেন। এই আমার বদ্ধমূল ধারণা। সুতরাং এই নির্জন স্থানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে কী করে?”

কিছুক্ষণ পর রাজা যযাতি আপন ভবন থেকে বেরিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছায় সেই অশোক বনের কাছে শর্মিষ্ঠাকে দেখতে পেলেন। মধুরহাসিনী শর্মিষ্ঠা সেই নির্জন স্থানে রাজাকে একাকী দেখে, কাছে গিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁকে বললেন, “মহারাজ, বিষ্ণু, ইন্দ্র, চন্দ্র, যম, বরুণও আপনার গৃহে স্ত্রীলোকদের দেখতে পারেন না, অন্য পুরুষ কোন ছাড়? মহারাজ, কুলশীল ও রূপের সঙ্গে আমার সম্পর্কে সবকিছুই আপনি জানেন। অতএব আমি অনুনয় করছি যে আপনি আমার ঋতু রক্ষা করুন।” যযাতি বললেন, “শর্মিষ্ঠা, তোমার স্বভাব ও কুলও জানি এবং তোমার সূচ্যগ্র পরিমাণ রূপও যে নিন্দিত নয়, তাও দেখছি।”

শর্মিষ্ঠা বললেন,

ন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি ন স্ত্রীষু রাজন্‌! ন বিবাহকালে।

প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে পঞ্চানৃতান্যাহুর পাতকানি ॥ আদি : ৭০: ১৬।

“মহারাজ, পরিহাসের সময়, স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জনের সময়, বিবাহের সময়, প্রাণ যাবার সময় এবং সর্বস্ব অপহরণের সময়— এই পাঁচটি সময় মিথ্যা বললে পাপ হয় না। কিন্তু সাক্ষ্য দেবার সময় বিচারক জিজ্ঞাসা করলে, যে লোক মিথ্যা বলে, তারই মিথ্যা বলার জন্য পাপ হয়। আর কোনও একটি বিষয় নিয়ে দুজনে বিবাদ আরম্ভ করে, তাঁদের মধ্যে যদি কেউ মিথ্যা বলে তারও পাপ হয়।”

যযাতি বললেন, “রাজাই প্রজাদের দৃষ্টান্ত স্থল; তিনি যদি মিথ্যা বলে সেই পাপে বিনষ্ট হন, প্রজারাও তাঁর দৃষ্টান্তে মিথ্যা বলে সেই পাপেই বিনষ্ট হতে থাকে। সুতরাং আমি বিপন্ন হয়েও মিথ্যা বলতে বা করতে প্রস্তুত নই।”

“মহারাজ!” শর্মিষ্ঠা বললেন, “যিনি নিজের পতি এবং যিনি সখী পতি— এঁরা দুজনাই সমান এবং দুই সখীর বিবাহও সমান; সুতরাং সখী দেবযানী আপনাকে বিবাহ করায় আপনি আমারও পতি হয়েছেন।”

যযাতি বললেন, “আমার ব্রত আছে, প্রার্থনাকারীকে প্রার্থিত বস্তু দেব। তুমি প্রার্থনা করছ; অতএব আমার কী করা উচিত, তা তুমিই বলো।”

শর্মিষ্ঠা বললেন, “মহারাজ, আমাকে পাপ থেকে রক্ষা করুন এবং ধর্ম উৎপাদন করুন। আমি আপনার কাছ থেকে পুত্রবতী হয়ে জগতে উৎকৃষ্ট ধর্ম আচরণ করতে চাই। ভার্যা, দাস ও পুত্র— এই তিনজনেই আপন আপন অর্জিত ধনে অস্বতন্ত্র। তারা যা উপার্জন করে, তাতে প্রভুরই স্বাতন্ত্র থাকে। আমি দেবযানীর দাসী সে দেবযানী আবার আপনার অধীনা। সুতরাং মহারাজ, আমাদের এই দুজনকেই আপনার ভজনা করা উচিত। অতএব আমাকেও ভজন করুন।”

শর্মিষ্ঠা এই কথা বললে, রাজা তাঁর কথা সত্য বলেই মনে করলেন এবং সেই জন্যই তাকে সম্মানিত করলেন। পরে শর্মিষ্ঠার প্রার্থনা পূরণ করে ধর্মরক্ষা করলেন। রাজা শর্মিষ্ঠাকে সন্তুষ্ট করে নিজেও যথেষ্ট সুখ পেলেন। পরে তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সম্মান করে যথাস্থানে চলে গেলেন। যযাতির সঙ্গে সম্মেলনে মধুরহাসিনী শর্মিষ্ঠা সেই রাজা থেকেই প্রথম গর্ভ ধারণ করলেন। তারপর পদ্মনয়না শর্মিষ্ঠা যথাসময়ে দেববালক সদৃশ একটি বালক প্রসব করলেন।

দেবযানী শর্মিষ্ঠার পুত্র জন্মেছে শুনে গভীর দুঃখে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “সুন্দরী, তুমি কামে অধীর হয়ে এ কী পাপ করে ফেলেছ।”

শর্মিষ্ঠা বললেন, “ধার্মিক ও বেদপারদর্শী কোনও ঋষি এসেছিলেন, তিনি বরদান করতেও সমর্থ ছিলেন। আমি ধর্মসংগতভাবেই তাঁর কাছে কাম প্রার্থনা করেছিলাম। আমি অন্যায়ভাবে কামাচরণ করিনি; সেই ঋষি থেকেই আমার এই পুত্র জন্মেছে। আমি তোমাকে সত্য কথাই বলছি।”

দেবযানী বললেন, “তুমি যা বলছ, তাই যদি ঘটে থাকে, তবে ভালই হয়েছে। তুমি কি সেই ব্রাহ্মণকে চেনো? আমি তাঁর নাম বংশ ও গোত্র জানতে ইচ্ছা করি।” শর্মিষ্ঠা বললেন, “দেবযানী, তিনি তপস্যার তেজে সূর্যের ন্যায় দীপ্তি পাচ্ছিলেন; তাই তাঁকে দেখে ওসব বিষয় তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই আমার সামর্থ্য হয়নি।” দেবযানী বললেন, “শর্মিষ্ঠা, যদি এমনই হয়, যে বর্ণশ্রেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ থেকে তুমি সন্তান লাভ করে থাকো, তবে তোমার প্রতি আমার ক্রোধ নেই।”

দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা পরস্পর হাস্যপরিহাসে কিছু সময় অতিবাহিত করলেন। দেবযানী শর্মিষ্ঠার কথা সত্য ভেবে আপন ভবনে চলে গেলেন। যযাতি দেবযানীর গর্ভে দ্বিতীয় ইন্দ্র ও বিষ্ণুর ন্যায় যদু ও তুর্বসু নামে দুটি পুত্র জন্ম দিলেন। আর, বৃষপর্বানন্দিনী শর্মিষ্ঠা যযাতি থেকে দ্ৰহ্য, অনু ও পুরু নামে তিনটি পুত্র লাভ করলেন।

তারপর, কোনও এক সময়ে দেবযানী যযাতির সঙ্গে নির্জন উদ্যানে গমন করলেন। তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন দেবতার ন্যায় রূপবান তিনটি বালক আপন মনে খেলা করছে। দেবযানী বিস্ময়ের সঙ্গে যযাতিকে বললেন, “মহারাজ, দেববালকের ন্যায় সুলক্ষণসম্পন্ন এই বালক কটি কার? এরা রূপে ও তেজে আপনার সদৃশ বলেই আমার মনে হচ্ছে।” রাজাকে এই প্রশ্ন করে দেবযানী বালকদের জিজ্ঞাসা করলেন, “পুত্রগণ!” তোমাদের নাম কী? তোমরা কোন বংশে জন্মেছ? তোমাদের পিতা কে? সব আমার কাছে বলল। আমি তোমাদের বংশ ও পিতার বিষয় জানতে ইচ্ছা করি।”

সেই বালক তিনটি তর্জনী অঙ্গুলি দ্বারা রাজা যযাতিকে এবং দূরস্থিত মাতা শর্মিষ্ঠাকে দেখিয়ে দিল এবং মুখেও তাই বলল। দেবযানীকে এই উত্তর দিয়ে বালক তিনটি মিলিত হয়ে রাজা যযাতিকে আলিঙ্গন করতে গেল। কিন্তু দেবযানী উপস্থিত থাকায় রাজা তাদের আদর করলেন না। বালকগণ তখন রোদন করতে করতে শর্মিষ্ঠার কাছে গেল। সেই বালকদের রোদনে রাজা লজ্জিত হলেন। দেবযানী, রাজার প্রতি সেই বালকদের প্রণয় দেখে প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারলেন এবং শর্মিষ্ঠাকে বললেন, “তুমি আমারই অধীন হয়ে আমার অপ্রিয় কার্য করেছ। তুমি এখনও সেই অসুরের স্বভাবেই আছ এবং আমাকে এতটুকুও ভয় করো না।” শর্মিষ্ঠা বললেন, “দেবযানী! আমি যে ঋষি বলেছিলাম তা-তো সত্যই। আর আমি ন্যায় ও সত্য অনুসারেই চলেছি। সুতরাং তোমাকে ভয় করি না। তারপর তুমি যখন এঁকে পতিত্বে বরণ করেছিলে, আমিও তখন এঁকে পতিত্বে বরণ করেছিলাম। কারণ, ধর্ম অনুসারে সখীর পতি নিজের পতি হয়। তুমি বয়োজ্যেষ্ঠা এবং ব্রাহ্মণকন্যা। সুতরাং আমার পূজনীয়া এবং মাননীয়া। কিন্তু তোমার অপেক্ষা রাজর্ষি আমার বিশেষ পূজনীয়।”

দেবযানী শর্মিষ্ঠার কথা শুনে বললেন, “মহারাজ, আপনি আমার অপ্রিয় কার্য করেছেন। সুতরাং আমি আর এখানে থাকব না।”

দেবযানী এই কথা বলে, ক্রন্দন করতে করতে মলিন মুখে শুক্রাচার্যের নিকট উপস্থিত হলেন। যযাতি তাঁকে অনুসরণ করলেন। শুক্রাচার্যকে দেখে নমস্কার করে দেবযানী বললেন, “অধর্ম ধর্মকে জয় করেছে এবং নীচ উপরে উঠেছে। বৃষপর্বার দুহিতা শর্মিষ্ঠা আমাকে অতিক্রম করেছে। এই রাজা যযাতি শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিনটি পুত্র উৎপাদন করেছেন, আর আমি দুর্ভাগা বলে আমার গর্ভে দুটি পুত্র জন্মিয়েছেন। ইনি ধর্মজ্ঞ বলে বিখ্যাত হলেও আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করেছেন।”

শুক্রাচার্য বললেন, “মহারাজ, তুমি ধর্মজ্ঞ হয়ে যখন আপন প্রিয় বলে অধর্ম করেছ, তখন অচিরকালের মধ্যে দুর্জয় জরা তোমাকে আক্রমণ করবে।” যযাতি বললেন, “এই দানবরাজদুহিতা শর্মিষ্ঠা তাঁর ঋতুর সফলতা চেয়েছিল। তাই আমি ধর্মসংগত কাজই করেছি। অন্য কোনও অভিপ্রায়ে নয়। মহর্ষি, যে পুরুষ ঋতুসাফল্যপ্রার্থিনী রমণীর ঋতু রক্ষা না করে, তাঁকে বেদবাদী ঋষিরা ভ্রূণহত্যাকারী বলে থাকেন। যে পুরুষ নির্জনে রমণের জন্য প্রার্থিত হয়েও গমনের যোগ্য অত্যন্ত কামুকী স্ত্রীর সঙ্গে উপগত না হয়, পণ্ডিতগণ তাকেও ভ্রূণহত্যাকারী বলে থাকেন। আর আমার নিজস্ব ব্রত হল, আমার কাছে যে যা চাইবে, তাকে তাই দেব। বিশেষত আপনি শর্মিষ্ঠাকেও তো আমার হাতেই দিয়েছিলেন। তাই সে অন্য পুরুষকে পতি করতে চায়নি। ভৃগুনন্দন, আমি সেই সমস্ত কারণ পর্যালোচনা করেই শর্মিষ্ঠার সঙ্গে সংসর্গ করেছি।”

শুক্রাচার্য বললেন, “রাজা, তোমার আমার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কেন-না, তুমি তো আমার অধীন। যযাতি, ধর্ম বিষয়ে মিথ্যা ব্যবহার করলে চৌর্যের তুল্য পাপ হয়।” শুক্রাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে অভিসম্পাত করলে, যযাতি তৎক্ষণাৎ যৌবন বয়স পরিত্যাগ, বৃদ্ধ বয়স প্রাপ্ত হলেন। যযাতি বললেন, “ভৃগুনন্দন, আমি আপনার দেবযানীর সঙ্গে যৌবন সম্ভোগ করে আজও তৃপ্তি লাভ করতে পারিনি; অতএব আপনি অনুগ্রহ করুন, আমার শরীরে যেন বার্ধক্য উপস্থিত না হয়।” শুক্রাচার্য বললেন, “রাজা, আমি মিথ্যা বলিনি। তোমার শরীরে জরা উপস্থিত হয়েছে। তবে তুমি ইচ্ছা করলে এ জরা অন্যের শরীরে দিতে পারবে।” রাজা শুক্রাচার্যের কাছে অনুমতি চাইলেন যে, তাঁর জরাগ্রহণকারী পুত্ৰই রাজ্যাধিকারী হবে। শুক্রাচার্য অনুমতি দিলেন।

এই পর্যন্তই শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর কাহিনি। যযাতির কাহিনি আরও কিছু বিস্তৃত। রাজা প্রথমে দেবযানীর পুত্রদের তাঁর জরা গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাঁরা উভয়েই অস্বীকার করলেন। রাজা এরপর শর্মিষ্ঠার প্রথম দুই পুত্রকে একই অনুরোধ করলেন। তাঁরাও অস্বীকার করল। এদের প্রত্যেকের অস্বীকারের প্রাথমিক কারণ ছিল, জরা গ্রহণ করলে তারা নারীভোগ করতে পারবে না।।

শর্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু রাজার অনুরোধ শ্রবণমাত্র রাজার জরা আপন দেহে গ্রহণ করলেন। যযাতিও পুরুর যৌবন গ্রহণ করে হাজার বছর সকল ভোগ্যবস্তু গ্রহণ করলেন। এই ভোগ করতে করতেই তিনি অনুভব করলেন, কাম্য বস্তুর উপভোগে কাম কখনও নিবৃত্তি পায় না। ঘৃত দ্বারা অগ্নি যেমন বৃদ্ধি পায়, কামও তেমনি কাম্যবস্তুর উপভোগে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অতএব তৃষ্ণাকে পরিত্যাগ করতে হবে।

এই চিন্তা করে, হাজার বছর ভোগ সম্পন্ন করে, যযাতি পুত্র পুরুকে তাঁর যৌবন ফিরিয়ে দিলেন। পুরু রাজা হলেন। তাঁর বংশের নাম পুরুবংশ। এই বংশেরই পরবর্তী বংশধরেরা হলেন পাণ্ডব-কৌরব।

***

পুরু বংশ ও যদু বংশের দুই আদি মাতার সঙ্গে পাঠকের পরিচিতি ঘটল। মহাভারত পাঠকেরা দেবযানীর সঙ্গে পূর্বেই পরিচিত হয়েছেন। বৃহস্পতির পুত্র কচ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কচের বিনম্র আচরণ, সর্বদা তৎপর থেকে দেবযানীর সকল ইচ্ছাপূরণ দেবযানীর মনে কচ সম্পর্কে অনুরাগ জন্মায়। দৈত্যরা তিনবার কচকে বিনষ্ট করতে চাইলে দেবযানীর ইচ্ছায় শুক্রাচার্য কচকে জীবিত করেন ও অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে তাকে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিক্ষা দেন। বিদ্যা শিক্ষা শেষ করে কচ স্বর্গে ফিরে যেতে চাইলে দেবযানী কচকে আপন প্রণয় জ্ঞাপন করে বিবাহ করতে অনুরোধ করেন। কচ এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। দেবযানী, এই প্রত্যাখ্যানে কচকে অভিসম্পাত করেন। বলেন, “লব্ধ বিদ্যা শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।” কচও দেবযানীকে এই অভিশাপের উত্তরে অভিশাপ দেন, “শুক্রাচার্যের কন্যা হলেও দেবযানীকে কোনো ঋষি বা ব্রাহ্মণ বিবাহ করবেন না।”

দানবরাজ বৃষপর্বা শর্মিষ্ঠার পিতা। তাঁর গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী। শর্মিষ্ঠাকে জলকেলির সময় দেখা যায় অত্যন্ত দাম্ভিক, উদ্ধত আপন শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে শুধু বাক্যে নয়— সে দেবযানীকে আঘাত করে কূপে ফেলে রেখে চলে যায়। রাজা যযাতি দৈবক্রমে দেবযানীকে কূপ থেকে উদ্ধার করেন। দেবযানী পিতার অত্যন্ত আদরের কন্যা। আপন দুঃখের বর্ণনা দিয়ে সে পিতাকে নিয়ে বৃষপর্বার রাজ্য ত্যাগ করে চলে যেতে চায়। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে বৃষপর্ব শুক্রাচার্যের শরণাপন্ন হন এবং সহস্র দাসীর সঙ্গে আপন কন্যা শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর দাসীত্বে নিযুক্ত করেন। এই প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি দেবযানীর সত্তায় মিশে গিয়েছিল। যাতির ক্ষেত্রে তার অধিকারবোধ ছিল সমগ্র। সে জানত যে রূপে গুণে শর্মিষ্ঠা শ্রেষ্ঠতরা। কিন্তু শুক্রাচার্যের কন্যা হিসাবে সংসারে সকল বস্তুর সে অধিকারিণী। তার অনুমতি ব্যতীত শর্মিষ্ঠার জীবনে সে কোনও কিছুই ঘটতে দিতে রাজি ছিল না। সে আত্মসর্বস্ব।

শর্মিষ্ঠা প্রথম আবির্ভাবে ঔদ্ধত্য ও কোপ দেখালেও, শুক্রাচার্যের রাজত্যাগের সিদ্ধান্তে তার সংবিৎ ফিরে আসে। দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা হয়েও সে দানবদের কল্যাণে মুহূর্তমধ্যে দেবযানীর প্রভুত্ব স্বীকার করে নিয়ে তার দাসীত্ব গ্রহণ করে। সে সাধারণভাবে দেবযানীর অনভিপ্রেত অথবা অননুমোদিত কার্যে আগ্রহ দেখাত না।

কিন্তু আকস্মিক যৌবনের আবির্ভাবে, তীব্র কামদহনে, দেবযানীর সুখী দাম্পত্য জীবনে ও গর্ভবতী হওয়ায় শর্মিষ্ঠা মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পেরেছিল, পিতা বর্তমান থাকলেও তাকে কোনও সাহায্যই করতে পারবেন না। অতএব নিজের সমস্যা সমাধানে সে নিজেই অগ্রসর হয়। রূপবান, গুণবান রাজা যযাতি আগেই তার চিত্তহরণ করেছিলেন। উদ্যানে যযাতিকে একান্তে পেয়ে সে আপন প্রণয় জ্ঞাপন করল। শর্মিষ্ঠা বেদবিদ, ধর্মশাস্ত্র তার আয়ত্ত ছিল, সে ক্রমশ তর্কজালে যযাতিকে আবদ্ধ করল। শেষ পর্যন্ত যযাতি তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে বাধ্য হলেন। শর্মিষ্ঠা অসাধারণ রূপবতী, গুণবতী ছিলেন। তার আকর্ষণ যযাতির পক্ষে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। গুরু শুক্রাচার্যের নিষেধ অস্বীকার করে যযাতি তাকে তিনটি সন্তানের জননী করলেন।

মহাভারতের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দু’বার করে পাওয়া যায়। ঠিক এই ঘটনাই অর্জুন-উলূপী মিলনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। ব্রহ্মচারী অর্জুনকে বাক্যজালে ও তীক্ষ্ণ যুক্তির বাঁধনে বেঁধে, তীব্র যৌবনের আকর্ষণে উলূপী অর্জুনের ব্রহ্মচর্য ভঙ্গ করে তার সঙ্গে সঙ্গম করতে বাধ্য করেছিলেন।

দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা মহাভারতের দুই উল্লেখযোগ্য নারী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *