ব্যাসদেব প্রদত্ত কুরু-পাণ্ডব বংশের কুলপঞ্জিকা
বৈশম্পায়ন রাজা জনমেজয়ের কাছে বিচিত্রবীর্যের দুই বিধবা পত্নীর গর্ভে বেদব্যাস কখন এবং কীভাবে ধৃতরাষ্ট্রের এবং পাণ্ডুর জন্ম দিলেন এবং শূদ্রা দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম দিলেন, বলতে শুরু করেন, তখন অধৈর্য ও অসহিষ্ণ জনমেজয় তাঁকে অনুরোধ করেন যে, সৃষ্টির প্রথম থেকেই তাঁর বংশের কুলপঞ্জিকা আগে সংক্ষেপে তাঁর কাছে বর্ণনা করে তারপর বৈশম্পায়ন বিশদভাবে বর্ণনা দিন। রাজাদেশ শিরোধার্য করে বৈশম্পায়ন বলতে আরম্ভ করলেন, “যিনি প্রলয় পর্যন্ত থাকেন, যাঁকে নিত্য বলা হয়, যার শারীরিক ক্ষয় হয় না এবং যিনি স্বয়ং নারায়ণ থেকে উৎপন্ন, সেই ব্রহ্মা থেকে মরীচি ও দক্ষ জন্মগ্রহণ করেন। ব্রহ্মা নিজের অঙ্গুষ্ঠ থেকে দক্ষকে এবং দুই নয়ন থেকে মরীচিকে সৃষ্টি করেন; সেই মরীচির পুত্র কশ্যপ এবং দক্ষের কন্যা অদিতি বিশ্বের প্রথম স্বামী-স্ত্রী।
কশ্যপ থেকে অদিতির গর্ভে সূর্য, সূর্য থেকে মনু, মনু থেকে ইলা, ইলা থেকে পুরুরবা, পুরুরবা থেকে আয়ু, আয়ু থেকে নহুষ, নহুষ থেকে যযাতি জন্মেছিলেন।
যাতির দুই ভার্যা ছিল; একজন শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী, অপরজন অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্বসু, এবং শমিষ্ঠার গর্ভে দ্রুহ্য, অনু ও পুরু জন্মেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে যদু থেকে যাদব বংশ এবং পুরু থেকে পৌরববংশ সৃষ্টি হয়েছে। পুরুর ভার্যা ছিলেন কৌশল্যা; তাঁর গর্ভে পুরুর ঔরসে জনমেজয় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন এবং একটি বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করে তপোবন গমন করেন। জনমেজয় অনন্তা নাম্নী মগধরাজ কন্যাকে বিবাহ করেন। সেই অনন্তার গর্ভে জনমেজয়ের প্রাচীণ্বান নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অপর সর্যোদয়ের পূর্বে পূর্বদিক জয় করেছিলেন এবং সেইজন্যেই তার নাম হয়েছিল ‘প্রাচীণ্বান’।
প্রাচীণ্বান অস্মকী নাম্নী যদুবংশীয় একটি কন্যাকে বিবাহ করেন; তাঁর গর্ভে, প্রাচীণ্বানের সংযাতি নামে পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। সংযাতি দৃশদ্বান রাজার কন্যাকে বিবাহ করেন; সেই কন্যার নাম ছিল বরাঙ্গী। বরাঙ্গীর গর্ভে সংবাতির ঔরসে ‘অহংযাতির’ জন্ম হয়। অহংযাতির ‘সার্বভৌম’ নামক পুত্র জন্মে।
সার্বভৌম যুদ্ধ জয় করে কেকয়দেশের রাজকন্যা সুনন্দাকে অপহরণ করেন ও তাঁকে বিবাহ করেন। সেই সুনন্দার গর্ভে সার্বভৌমের পুত্র ‘জয়সেন’ জন্মলাভ করেন।
জয়ৎসেন বিদর্ভ-রাজকন্যা সুশ্রবাকে বিবাহ করেন; তাঁর গর্ভে জয়ৎসেনের ঔরসে ‘অর্বাচীন’-এর জন্ম হয়। অর্বাচীনও বিদর্ভরাজের ‘মর্যাদা’ নাম্নী অপর কন্যাকে বিবাহ করেন। সেই মর্যাদার গর্ভে অর্বাচীনের পুত্র ‘অরিহ’-এর জন্ম হয়।
অরিহ অঙ্গদেশীয় রাজকন্যার অঙ্গীর পাণিগ্রহণ করেন। তাঁর গর্ভে ‘মহাভৌম’ নামে অরিহের পত্র উৎপন্ন হয়। মহাভৌম প্রসেনজিৎ রাজার কন্যা ‘সুযজ্ঞা’কে বিবাহ করেন; তাঁর গর্ভে মহাভৌমের যে পত্র হয়, তাঁর নাম ছিল ‘অযুতনারী’। যিনি অযুত পরুষমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। সেই জন্যই তাঁর নাম হয়েছিল ‘অযুতনারী’। অযুতনারী পৃথুশ্রবা রাজার কন্যা কামার পাণিগ্রহণ করেন। কামার গর্ভে অযুতনারীর অক্রোধন নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। অক্ৰোধন কলিঙ্গ রাজকন্যা করম্ভাকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভে ‘দেবাতিথি’ নামে পুত্র জন্মগ্রহণ করে।
দেবাতিথি মর্যাদা নাম্নী বিদেহ রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তাঁর গর্ভে দেবাতিথির একটি পুত্র হয়। তাঁর নাম হয়েছিল (দ্বিতীয়) অরিহ। অরিহ অঙ্গরাজকন্যা সুদেবাকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভে ‘ঋক্ষ’ নামে এক পুত্র উৎপাদন করেন।
ঋক্ষ তক্ষক রাজার কন্যা জিক্ষলার পাণিগ্রহণ করেন এবং তাঁর গর্ভে ‘মতিনার’ নামক পুত্র উৎপাদন করেন। মতিনার সরস্বতী নদীর তীরে সর্বাঙ্গসম্পন্ন দ্বাদশ বর্ষ ব্যাপক একটি যজ্ঞ করেন; সেই যজ্ঞ সমাপ্ত হলে, সরস্বতী এসে মতিনারকে পতিরূপে বরণ করেন। মতিনার তাঁর গর্ভে ‘তংসু’ নামে একটি পুত্র উৎপাদন করেন। সেই তংসু আবার ভার্যা কালিন্দীর গর্ভে ‘ঈলিন’ নামক একটি পুত্র উৎপাদন করেন (কালিন্দীর অন্য নাম জালিঙ্গী)।
ঈলিন ভার্যা রথন্তরীর গর্ভে দুষ্মন্ত প্রভৃতি পাঁচ পুত্র উৎপাদন করেন। দুষ্মন্ত বিশ্বামিত্র মুনির কন্যা শকুন্তলাকে বিবাহ করেন। সেই শকুন্তলার গর্ভে ভরতের জন্ম হয়। দুষ্মন্ত কর্তৃক ভরতের গ্রহণ বিষয়ে দুটি দৈববাণী হয়। “মাতা তো চর্মকোষের মতো; কিন্তু পুত্র পিতারই বটে। যেহেতু পিতাই পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। অতএব দুষ্মন্ত! পুত্রটির ভরণপোষণ করো; শকুন্তলার অবমাননা কোরো না।” “মহারাজ। বংশরক্ষক পুত্র পিতৃলোককে নরক থেকে উদ্ধার করে। বিশেষত তুমিই এই বালকটির জনক; সুতরাং শকুন্তলা সত্যই বলেছে।” এই দৈববাণীর কারণেই শকুন্তলার পুত্রের নাম হয়েছিল ‘ভরত’।
ভরত কাশীরাজ সর্বসেনের কন্যা সুনন্দাকে বিবাহ করেন; সেই সুনন্দার গর্ভে ‘ভূমন্য’ নামে ভরতের একটি পুত্র জন্মে। ভূমন্য যথাসময়ে যদুবংশজাত বিজয়া নাম্নী একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করেন এবং তাঁর গর্ভে ‘সুহোত্র’ নামের এক পুত্রের জন্ম হয়। সুহোত্র ইক্ষ্বকুবংশীয় সুবর্ণা নাম্নী একটি কন্যাকে বিবাহ করেন। সেই সুহোত্রের গর্ভে হস্তীর ‘বিকুণ্ঠন’ নামে এক পত্ৰ জন্মায়।
‘বিকুণ্ঠন’ যদুবংশীয় সুদেবাকে বিবাহ করেন, তাঁর গর্ভে বিকুণ্ঠনের যে পুত্র জন্মায় তার নাম ছিল ‘অজমীর’। অজমীরের চার স্ত্রী ছিল। তাঁদের নাম— কৈকেয়ী, গান্ধারী, বিশালা ও ঋক্ষা। এই চার স্ত্রীর গর্ভে অজমীরের একশো চব্বিশজন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। সেই পুত্রগণ যথাসময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের রাজা হয়ে ভিন্ন ভিন্ন বংশ স্থাপন করে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সংবরণ রাজা পাণ্ডবদের বংশ স্থাপন করে গিয়েছেন।
সংবরণ বিবস্বানের কন্যা তপতীকে বিবাহ করেন; সেই তপতীর গর্ভে সংবরণের যে পুত্র জন্মে, তাঁর নাম ছিল ‘কুরু’। ‘কুরু’ যদুবংশজাত সুভাঙ্গী নাম্নী একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তাঁর গর্ভে ‘বিদূরথ’ নামে কুরুর একটি পুত্র হয়। বিদূরথ মধুবংশীয়া সম্প্রিয়া নাম্নী একটি কন্যাকে বিবাহ করেন। সেই সম্প্রিয়ার গর্ভে বিদূরথের যে পুত্র জন্মেছিল, তাঁর নাম ছিল ‘অনশ্বা’। অনশ্বা মগধবংশীয়া অমৃতা নাম্নী কোনও কন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তাঁর গর্ভে অনশ্বার ‘পরিক্ষিৎ’ নামে পুত্র জন্মে। পরিক্ষিৎ বাহুদরাজার কন্যা সুযশাকে বিবাহ করেন, সেই সুযশার গর্ভে পরিক্ষিতের যে পুত্র জন্মায়, তাঁর নাম ছিল ভীমসেন। ভীমসেন কেকয় রাজকন্যা কুমারীর পাণিগ্রহণ করেন। তাদের পুত্রের নাম হয় ‘প্রতিশ্রবা’।
প্রতিশ্রবার পুত্র প্রতীপ। প্রতীপ শিবি রাজার কন্যা সুনন্দাকে বিবাহ করেন। পুত্রদের নাম ছিল দেবাপি, শান্তনু ও বাহ্লীক। তাঁদের মধ্যে দেবাপি বাল্যকালেই তপোবন গমন করেন আর শান্তনু রাজা হন। শান্তনুর বিষয়ে প্রসিদ্ধি আছে যে তিনি হস্তযুগল দ্বারা যে-যে বৃদ্ধ ব্যক্তিকে স্পর্শ করতেন সেই সেই বৃদ্ধ ব্যক্তিই অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করতেন এবং পুনর্বার যুবক হয়ে যেতেন। এই জন্যই লোকে তাঁকে শান্তনু বলে জানত।
শান্তনু গঙ্গাদেবীকে বিবাহ করেন এবং গঙ্গার গর্ভে তাঁর ‘দেবব্রত’ নামে একটি পুত্র হয়। তাঁকে সকলে ভীষ্ম বলত। ভীষ্ম পিতা শান্তনুকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছায় ব্যাসজননী সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিয়েছিলেন। সে সত্যবতীকে সকলে ‘গন্ধকালী’ বলত। কুমারী অবস্থায় সেই সত্যবতীর গর্ভে প্রথমে পরাশর থেকে বেদব্যাসের জন্ম হয়।
তারপরে আবার সেই সত্যবতীর গর্ভেই শান্তনুর আর দুটি পুত্র জন্মে। তাঁদের নাম ছিল ‘চিত্রাঙ্গদ’ও ‘বিচিত্রবীর্য’। তাঁদের মধ্যে চিত্রাঙ্গদ যৌবন সীমায় উপস্থিত হতে না হতে গন্ধর্ব কর্তৃক নিহত হন, আর বিচিত্রবীর্য রাজা হন। বিচিত্রবীর্য কোশল দেশাধিপতি কাশী রাজার কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিবাহ করেন। কিন্তু তিনি নিঃসন্তান অবস্থাতেই মৃত্যুমুখে পতিত হন।
তখন সত্যবতী চিন্তা করলেন, দুষ্মন্তের বংশ লোপ না পায়। তিনি মনে মনে বেদব্যাসের চিন্তা করলেন। তাতে বেদব্যাস তাঁর সম্মুখে দাড়িয়ে বললেন, “মা, আমাকে কী করতে হবে?” তখন সত্যবতী বেদব্যাসকে বললেন, “তোমার ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান অবস্থাতেই পরলোক গমন করেছেন; সুতরাং তুমি তাঁর উৎকৃষ্ট সন্তান উৎপাদন করো।”
“তাই হোক”, এই কথা বলে বেদব্যাস তিনটি পুত্র উৎপাদন করলেন। তাঁদের নাম ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘পাণ্ডু’ ও ‘বিদুর’। তাঁদের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র রাজা হলেন এবং বেদব্যাসের বরে গান্ধারীর গর্ভে তাঁর একশত পুত্র হল। ধৃতরাষ্ট্রের সেই একশত পুত্রের মধ্যে দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ ও চিত্রসেন প্রধান ছিলেন।
পাণ্ডুর দুই স্ত্রী ছিল; প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল ‘কুন্তী’ এবং ‘পৃথা’ আর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল ‘মাদ্রী’। তাঁরা দু’জনেই স্ত্রীরত্ন ছিলেন। পাণ্ডু কোনও এক সময়ে মৃগয়া করার জন্য বনে গিয়ে দেখলেন একটি হরিণ একটি হরিণীর সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হয়েছে। সে হরিণ তখনও কামসুখ পাচ্ছিল না, কিংবা তাতে তৃপ্তিলাভ করছিল না; অথচ পাণ্ডু সেই অবস্থায় সেই অদ্ভুত হরিণকে বাণদ্বারা আঘাত করলেন। তখন সেই মৃগরূপধারী মুনি বাণবিদ্ধ হয়ে পাণ্ডুকে বললেন, “রাজা! কামসুখ না পাওয়া অবস্থায় আমাকে বধ করলে অথচ তুমি নিজেও কামরসে অভিজ্ঞ। তুমিও মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়ে কামসুখ না পাওয়া অবস্থাতেই মৃত্যুলাভ করবে।”
পাণ্ডু এর ফলে অত্যন্ত বিষণ্ণ থাকতেন, শাপের বিষয়ে মৈথুন পরিত্যাগ করার জন্য ভার্যাদের কাছে যেতেনই না। সেই অবস্থায় একদিন বললেন, “কুন্তী, আমি নিজের অবিমৃশ্যকারিতা দোষে এই দুঃখভোগ করছি। অথচ শুনে থাকি যে, নিঃসন্তান লোকের গতি হয় না; অতএব তুমি আমার জন্য পুত্র উৎপাদন করো।” পাণ্ডু একথা বললে কুন্তী তিনটি পুত্র উৎপাদন করলেন— ধর্ম থেকে যুধিষ্ঠির, বায়ু থেকে ভীমসেন এবং ইন্দ্র থেকে অর্জুনকে।
তাতে পাণ্ডু সন্তুষ্ট হয়ে কুন্তীকে বললেন, “তোমার সপত্নী এই মাদ্রীরও সন্তান হয়নি; সুতরাং এর গর্ভেও পুত্র উৎপাদন করাও।” “তাই হোক” এই বলে কুন্তী মন্ত্রটি মাদ্রীকে দিলেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয় এসে মাদ্রীর গর্ভে নকুল ও সহদেবকে উৎপাদন করলেন।
কিছুদিন পরে মাদ্রীকে অলংকৃত দেখে পাণ্ডু রমণের ইচ্ছা করে তাঁকে স্পর্শ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। মাদ্রী কুন্তীর নিকট নকুল সহদেবকে সমর্পণ করে পাণ্ডুর চিতাগ্নিতে সহমরণে গেলেন।
তপস্বীগণ কুন্তী এবং পাণ্ডুর পাঁচ পুত্রকে নিয়ে হস্তিনাপুর গেলেন। দুর্যোধন বাল্যকাল থেকেই পাণ্ডবগণের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করত। সে পাণ্ডবদের বিনাশের ব্যবস্থা করছিল। পিতাকে দিয়ে দুর্যোধন পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়ে অগ্নিতে ভস্মীভূত করার ব্যবস্থা করল। বিদুরের পরামর্শে পাণ্ডবগণ রক্ষা পান। পাঞ্চাল রাজধানীতে গমন করে তাঁরা দ্রৌপদীকে ভার্যা লাভ করেন। দ্রৌপদীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের প্রতিবিন্ধ্য; ভীম সূতসোম, অর্জুন শ্রুতকীর্তি, নকুল শতানীক এবং সহদেব শ্রুতকর্মাকে পুত্ররূপে উৎপাদন করেন।
যুধিষ্ঠির শিবির বংশীয় গোবাসন রাজার কন্যা দেবিকাকে স্বয়ংবরে লাভ করেন। দেবিকার গর্ভে যুধিষ্ঠিরের যৌধেয় নামের পুত্র জন্মে। ভীম কাশীরাজের কন্যা বলধরাকে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। তাঁদের পুত্রের নাম হয় ‘সর্বগ’। অর্জুন দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী মধুরভাষিণী সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করেন। তাঁদের পুত্রে নাম হয় ‘অভিমন্যু’। অভিমন্যু শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। নকুল চেদিরাজের কন্যা করেণুমতীকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের ‘নিরমিত্র’ নামের পুত্র জন্মে। সহদেব মদ্ররাজ দ্যুতিমানের কন্যা বিজয়াকে স্বয়ংবরে লাভ করেন, তাঁদের পুত্রের নাম ছিল সুহোত্র।
আর, ভীমসেন পূর্বেই রাক্ষসী হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচ নামে একটি রাক্ষসপুত্র উৎপাদন করেছিলেন। পাণ্ডবদের এগারোটি পুত্র হয়েছিল, তাঁর মধ্যে কেবলমাত্র অভিমন্যুর বংশধর জীবিত ছিলেন। অভিমন্যু বিরাটরাজার কন্যা উত্তরাকে বিবাহ করেছিলেন। অভিমন্যুর ঔরসে সেই উত্তরার যে গর্ভ হয় সে ছয় মাসে মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়। কৃষ্ণ কুন্তীদেবীকে মৃত বালকটিকে কোলে নিতে বলেন এবং মৃত সন্তানটিকে জীবিত করেন। কুরুকুল ক্ষয় হয়ে গেলে পুত্রটির জন্ম হয়েছিল বলে কৃষ্ণ তাঁর নাম রাখেন ‘পরিক্ষিৎ’। পরিক্ষিৎ মাদ্রবতীকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের পুত্রের নাম ‘জনমেজয়’। জনমেজয়ের ভার্যা বপুষ্টমার গর্ভে জাত পুত্র দুটির নাম ‘শতানীক’ ও ‘শঙ্কু’।
আপন ভার্যা বিদেহনন্দিনীর গর্ভে শতানীকের একটি পুত্র জন্মেছে, তাঁর নাম অশ্বমেধদত্ত। এই হল পুরুর বংশ ও পাণ্ডব বংশের ক্রমিক বিবরণ।
পুরুষের নাম | স্ত্রীর নাম | পুরুষের নাম | স্ত্রীর নাম |
১. নারায়ণ | ২৮. তৎসু | জালিঙ্গী | |
২. ব্রহ্মা | ২৯. ঈলিন | রথন্তরী | |
৩. মরীচি | ৩০. দুষ্মন্ত | শকুন্তলা | |
৪. কশ্যপ | অদিতি | ৩১. ভরত | সুনন্দা |
৫. বিবস্বান | ৩২. ভূমন্যু | বিজয়া | |
৬. মনু | ৩৩. সুহোত্র | সুবর্ণা | |
৭. ইলা | ৩৪. হস্তী | যশোধরা | |
৮. পুরুরবা | উর্বশী | ৩৫. বিকুণ্ঠন | সুদেবা |
৯. আয়ু | ৩৬. অজমীর | কৈকেয়ী | |
১০. নহুষ | ৩৭. সংবরণ | তপতী | |
১১. যযাতি | শর্মিষ্ঠা | ৩৮. কুরু | শুভাঙ্গী |
১২. পুরু | কৌশল্যা | ৩৯. বিদূরথ | সম্প্রিয়া |
১৩. জনমেজয় | অনন্তা | ৪০. অনশ্বা | অমৃতা |
১৪. প্রাচীণ্বান | অশ্মকী | ৪১. পরিক্ষিৎ | সুযশা |
১৫, সংযাতি | বরাঙ্গী | ৪২. ভীমসেন | কুমারী |
১৬. অহংযাতি | ভানুমতী | ৪৩. প্রতিশ্রবা | — |
১৭. সার্বভৌম | সুনন্দা | ৪৪. প্রতীপ | সুনন্দা |
১৮. জয়ৎসেন | সুশ্রবা | ৪৫. শান্তনু | সত্যবতী |
১৯. অর্বাচীন | মর্যাদা | ৪৬. বিচিত্রবীর্য | অম্বালিকা |
২০. অরিহ | অঙ্গী | ৪৭. পাণ্ডু | কুন্তী |
২১. মহাভৌম | সুযজ্ঞা | ৪৮. অর্জুন | সুভদ্রা |
২২. অযুতনারী | কামা | ৪৯. অভিমন্যু | উত্তরা |
২৩. অক্রোধন | করম্ভা | ৫০. পরিক্ষিৎ | মাদ্রবতী |
২৪. দেবাতিথি | মর্যাদা | ৫১. জনমেজয় | বপুষ্টমা |
২৫, অরিহ | সুদেবা | ৫২. শতানীক | বৈদেহী |
২৬. ঋক্ষ | জিক্ষলা | ৫৩. অশ্বমেধদত্ত | (বালক) |
২৭. মতিনার | সরস্বতী |
তালিকাটি এক নজরে দেখলেই দেখা যাবে যে বিশিষ্ট নারীচরিত্র এই তালিকায় নেই। যেমন গঙ্গা, অম্বিকা, অম্বা, মাদ্রী, দ্রৌপদী, গান্ধারী, চিত্রাঙ্গদা, উলূপী, হিড়িম্বা, জরা, দুঃশলা, দেবিকা, কালী ইত্যাদির নাম।
এই কুলপঞ্জিকায় কেবলমাত্র সেইসব নারীর উল্লেখ আছে, যারা সম্রাট কিংবা রাজার বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন এবং যাদের গর্ভজাত পুত্র অথবা বংশধর এই বংশের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন।
আমরা যেমন এই তালিকার অন্তর্গত নারীদের সম্পর্কে মহাভারতের বিবরণ অবশ্যই উল্লেখ করব, কিন্তু যাঁদের নাম উল্লিখিত নেই, তাঁদের সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা করব।
দেবী সরস্বতী আমাদের সহায় হোন।।
তালিকায় উল্লিখিত সকল নারী সম্পর্কেও সবিশেষ আলোচনা মহাভারতে নেই। কেবলমাত্র সেই নারীদের উল্লেখ আছে যাঁরা আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। যাঁদের প্রভাব কেবলমাত্র প্রজাপুঞ্জের উপরে নয়— ভাবীকালের উপরেও পড়েছে। প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার সকলেই পাণ্ডব বংশের অন্তর্গতা নন, কাজেই সকলের নাম অনুসন্ধান করা সমীচীন হবে না। অহল্যা, তারা, মন্দোদরী বাল্মীকির রামায়ণের শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্র। আমাদের আলোচ্য মহাভারতের নারী চরিত্র। কেউ কেউ সাবিত্রীকে মহাভারতের চরিত্র হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সত্যবানের স্ত্রী সাবিত্রী মহাভারতের চরিত্র নন। দ্রৌপদীর দুর্দশার বর্ণনা প্রসঙ্গে মার্কণ্ডেয় মুনি যুধিষ্ঠিরকে সাবিত্রীর কথা বলেছেন। সাবিত্রী সমান্তরাল কাহিনি। যেমন যুধিষ্ঠিরের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে নল-দময়ন্তীর কথা বলা হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের বনবাসের কাহিনি বর্ণনা প্রসঙ্গে রাম-সীতার কাহিনি এসেছে, হরিশ্চন্দ্র ও শৈব্যার কাহিনি এসেছে। সেইরকম সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনিও সমান্তরাল কাহিনি। মহাভারতে আর-এক তারার উল্লেখ আছে। এই তারা বৃহস্পতির স্ত্রী, বৃহস্পতি শিষ্য সোমের ঔরসে ইনি বুধের জন্ম দেন। ইনিও চরিত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যায় কোন তারার কথা বলা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই।