তাঁকে স্মরণ
একটি অনন্য সন্ধ্যা তাঁর স্মরণে। গানে, লেখায়, কবিতায়, স্মৃতিচারণে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের কানায় কানায় পরিপূর্ণ জুইশ সেন্টারে মিলনায়তন হয়ে ওঠে এক অনন্য, অসাধারণ বিমূর্ত সন্ধ্যার প্রতিমূর্তি। ২৯ জুন ২০১২ সন্ধ্যায় কাবেরী দাসের রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে শুরু এবং নাট্যজন। জামালউদ্দীন হোসেনের মূল বক্তব্য দিয়ে শুরু করা অনুষ্ঠানটির স্মৃতিচারণ করেন জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. আব্দুল মোমেন, নিউজার্সির কাউন্সিলম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরননবী, লেখক বেলাল বেগ, মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিত সাহা, সাংবাদিক মঞ্জুর আহমেদ প্রমুখ। সঞ্চালন করেন বিশিষ্ট লেখক কলামিস্ট হাসান ফেরদৌস। রাত ৯টা থেকে ১২টা কখন যে তিনটি ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল তা হুমায়ূন আহমেদের লেখা চাঁদনী পসর রাতে গানটির মাধ্যমে শেষ হওয়ার পরও মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঠায় বসেছিলেন মিলনায়তনে। হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালনের পরপরই নাট্যজন জামালউদ্দীন হোসেনের মূল বক্তৃতা। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ, লেখক হুমায়ূন আহমেদ, মানুষ হুমায়ূন আহমেদসহ জামাল উদ্দীন হোসেনের হুমায়ূন আহমেদের শেষ ধারাবাহিক নাটক ‘কবি’তে অভিনয়ের স্মৃতিচারণ এবং আমেরিকায় আসার আগে তাঁর চরিত্রটির কীভাবে মৃত্যু হয় তার বিবরণ দেন নাট্যব্যক্তিত্ব জামাল উদ্দীন হোসেন। ২৯ জুন সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালি সমাজের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় প্রায় সকল বক্তা হুমায়ূন আহমেদের শেষ ইচ্ছা বাংলাদেশে ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনে নিজ নিজ সহযোগিতার অঙ্গীকার। ব্যক্ত করেন। পাঠকরা হয় সুদূর ডেনভার থেকে পাঠানো ছোট গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে লেখা বক্তব্য।
বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ এক বিপুল বিস্ময়। তিনি তরুণ শ্রেণির মধ্যে বিপুল পাঠক তৈরি করে গেছেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও তিনি নতুনের হাওয়া নিয়ে এসেছেন। তার রচিত টিভি নাটক দর্শকের জন্য ছিল একন নতুন চমক। ভাষার কারুকাজ ও কাহিনীর নতুনত্বে তিনি দর্শককে চুম্বকের মতো ধরে রাখতেন। বক্তারা বলেন, আমাদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে আমরা হুমায়ূন। আহমেদের মতো অসাধারণ প্রতিভাবান সৃজনশীল একজন মানুষকে হারালাম। তিনি যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন হয়তো আমাদের আরো কিছু দিতেন। তবু তার এই নাতিদীর্ঘ সৃজনতালে তিনি আমাদের কম দেননি। আমাদের সাহিত্যে-সাংস্কৃতিতে তিনি যা দিয়েছেন তা বাঙালিদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। এছাড়া সভায় স্মৃতিচারণ করেন ড. প্রদীপ রঞ্জন কর, আব্দুল মুসাব্বির, অভিনেত্রী রেখা আহমেদ, সাংবাদিক মনজুর আহমেদ, আবু তাহের, জাকারিয়া মাসুদ জিকো, আশরাফুল আলম খোকন, মোহাম্মদ সাঈদ, রুমা সাহা, ফাহিম রেজা নূর, গোলাম সারওয়ার হারুন, আবীর আলমগীর, তৈয়বুর রহমান টনি, রানু ফেরদৌস, সেলিনা মোমেন, ম. ই. শাহীন প্রমুখ।
স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, সাহিত্যের মান বিচারে হুমায়ূন আহমেদের রচনা কতখানি শিল্পমণ্ডিত বা কালজয়ী তা বিচার করার সময় এখনো আসেনি। হয়তো ৫০ বা ১০০ বছর পরে তার প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের রচনার ব্যাপারে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তারা বলেন, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বন্ধুবাৎসল্য। সবসময় হাসি-ঠাট্টার মধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। আড্ডার মেজাজের মানুষ ছিলেন। তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন। বক্তারা বলেন, হুমায়ূন আহমেদ প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। তবে সংঘবদ্ধ কোনো আন্দোলনের সঙ্গে তিনি কখনো যুক্ত হননি। কিন্তু সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নামকরণ নিয়ে জামাত-শিবিরের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি প্রতিবাদ করতেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, তার নিজের মতো করে। বক্তারা বলেন, হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়া তার সন্তানদের জন্য বড়ই কষ্টের। তার প্রথম পক্ষের চার সন্তান দ্বিতীয়বার তাদের পিতাকে হারিয়েছে।
স্মরণসভায় বক্তারা তাদের প্রিয় লেখককে স্মরণীয় করে রাখতে হুমায়ূন আহমেদের নামে নিউইয়র্কে সড়কের নামকরণ এবং বাংলাদেশে ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরিতে সহায়তাসহ নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অভিনেত্রী রেখা আহমেদের প্যাকেজ সংবাদ নাটকের অংশ বিশেষের অভিনয়, সেমন্তী ওয়াহেদের নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ গ্রন্থ থেকে তিন কন্যা নিয়ে লেখা অংশ পাঠ, হারুণ আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকে অভিনয়ের স্মৃতিচারণ, তাজুল ইমামের হুমায়ূন আহমেদের আমার গায়ে যত দুঃখ গান পরিবেশন, স্বপ্ন কাওসারের লালনের ওপর গান পরিবেশন, শিল্পী রথীন্দ্র নাথ রায়ের স্মৃতিচারণ ও হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় একটি গান পরিবেশন, হুমায়ূন আহমেদের ওপর লেখা নিজ কবিতা পাঠ, বিভিন্ন প্রস্তাবনা, সব মিলিয়ে হুমায়ূনের ক্যান্সার হাসপাতালের নির্মাণে সহযোগিতার অঙ্গীকার নিয়ে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ২৯ জুনের হুমায়ূন স্মরণ অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘটে। কোনো নাম উচ্চারণ ছাড়া হাসান ফেরদৌসের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত প্রথম পর্বের অনুষ্ঠানটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। একের পর এক বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলছে। অথচ সঞ্চালক কাউকে ডাকছে না। অনুষ্ঠান চলছে অনুষ্ঠানের মতো। রাত ১২টা হয়ে গেছে, পরের দিন রয়েছে অফিসে, কিন্তু মানুষ আসছে রাতের মতো। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের কবি, লেখক, সাংবাদিক সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানায় তাদের প্রিয় লেখককে। সভায় নিউইয়র্ক মুক্তধারাকে ধন্যবাদ জানানো হয় গত বছর লেখকের জন্ম বার্ষিকীর অনুষ্ঠান করার জন্য। এছাড়াও ২০০২ সালে মুক্তধারা নিউইয়র্ক হুমায়ূন মেলার যে প্রবর্তন করেন তার জন্যও মুক্তধারাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। বক্তারা আগামী বছর থেকে নিউইয়র্ক থেকে শুরু হওয়া হুমায়ূন মেলা বাংলাদেশে পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকপত্র দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া নিউইয়র্কে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেছে নিউইয়র্কের সাহিত্য পরিষদ। রবিবার বিকালে জ্যামাইকার হিলসাইডে অনুষ্ঠিত এক স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, হুমায়ূন আহমেদ তার লেখা, নাটক ও সিনেমায় সমাজের অনেক অসঙ্গতি তুলে ধরতেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।