০৫. হুমায়ূন মেলা

হুমায়ূন মেলা

বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের উপস্থিতিতেই মুক্তধারার আয়োজনে ২০০২ সালের ১৫ ও ১৬ জুন নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় ‘হুমায়ূন মেলা’। সে এক অন্যরকম আয়োজন। আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে প্রথমবারের মতো আমরা উত্তর আমেরিকায় এই মেলার আয়োজন করেছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশকেরা পরে অবশ্য তাঁর জন্মদিন। উপলক্ষে বাংলাদেশে আয়োজন করে হুমায়ূন আহমেদের একক বইমেলা। তাঁর মৃত্যুর পর এবার জন্মদিনে চ্যানেল আই-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় হুমায়ূন মেলা’।…

২০০২ সালের হুমায়ূন মেলা

গত ২১ জুন, ২০০২ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়: নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির ৩০ নুহাশ পল্লীর সুইমিং পুলে হুমায়ূন আহমেদ, নুহাশ, বহতা ও বিজিত বছর পূর্তি উপলক্ষে নিউইয়র্কে গত ১৫ ও ১৬ জুন ২০০২ দুদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় ‘হুমায়ূন মেলা’। জ্যাকশন হাইটসে একটি স্কুল মিলনায়তনে মুক্তধারা আয়োজিত এই মেলায় হুমায়ূন আহমেদের লেখা ১৭৬ টি গ্রন্থের প্রদর্শনী ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের গান, নাটক, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ছাড়াও চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যে লালিত বিভিন্ন খাদ্য ও পণ্যের বিপুল সমাবেশ ঘটেছিল। চমৎকার আবহাওয়ায় অনুষ্ঠিত এই হুমায়ূন মেলায় আগত বিপুলসংখ্যক প্রবাসীও তাদের প্রিয় লেখকের সান্নিধ্যে দিবস দুটি বেশ আনন্দেই কাটিয়েছিলেন। মেলা উপলক্ষে হুমায়ূন আহমেদের নতুন একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। নিউইয়র্কে লেখা এই বইয়ের নাম হচ্ছে ‘আসমানীরা দুই বোন। এর ফলে বিগত ৩০ বছরে তার লেখা গ্রন্থের সংখ্যা উপনীত হলো ১৭৭-এ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে উপমহাদেশের কোনো লেখক কিংবা সাহিত্যিকের জীবদ্দশায় এমন মেলা এটাই প্রথম এবং তাও সুদূর এই প্রবাসে অনুষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা সাহিত্যে নবধারার সংযোজন ঘটলো বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। লেখক নিজেও এ কথা স্বীকার করেছেন। উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, মৃত্যুর পর হয়তো আমার নামে এমন মেলা অথবা অনুষ্ঠান হবে। আমার জীবদ্দশায়ই দেখে গেলাম এটাও আমার জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। প্রধান বক্তা ছিলেন বিটিভি’র সাবেক প্রযোজক বেলাল বেগ। এছাড়া নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল রাষ্ট্রদূত রফিক আহমেদ খান এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি মুন্সি ফয়েজ আহমেদ ছিলেন বিশেষ অতিথি। সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান মঞ্চে সম্মানিত অতিথি ছিলেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন শামীম চৌধুরী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। তাঁর তথা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে সমুন্নত রাখতে আমরা সদা সচেষ্ট রয়েছি। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের মতো কিংবদন্তীর লেখক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্দেশকের মতো গুণীজনের জন্য অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে একটি সম্মানের আসন পাবে। সেই লক্ষ্যে আমরা জাতিসংঘে একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছি। কনসাল জেনারেল রফিক আহমেদ খান বলেন, বহুজাতিক এই দেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের সুকুমার বৃত্তি এবং সংস্কৃতি চর্চা ও ধারাবহিকভাবে গুণীজনদের সম্মান জানানোর মুক্তধারার উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তীতুল্য লেখক হলেও কিন্তু আমাদের মতোই তিনিও একজন সাধারণ মানুষ। এ কারণে পেশাগত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সবচেয়ে বেশি যার বই পড়ি তিনি হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। টিভি ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, তিনি এমন একজন রাজা যার মাথায় কোনো মুকুট নেই। আমাদের সবার হৃদয়ে তিনি চিরদিন জাগরুক থাকবেন। অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা বেলাল বেগ হুমায়ূন আহমেদের লেখক সত্তা এবং ব্যক্তি জীবনের ওপরে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, লেখকের জীবদ্দশায় এমন আয়োজনে আমি আনন্দিত এবং মোহাবিষ্ট হয়েছি। তবে এই আয়োজনই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সরকারি উদ্যোগে হলে লেখকের ভক্ত অনুরক্তা আরও খুশি হতেন। বেলাল বেগ আরও বলেন, বর্তমান সময়ের জাতীয় গৌরবকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করায় মুক্তধারাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, হুমায়ূন হচ্ছেন বাংলাদেশ টিভি নাটকের গতিশীলতার জনক। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে তার যে অবদান সেজন্যে তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনিই প্রথম বিটিভিতে টিয়াপাখির মুখ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ শব্দটি প্রচার করে সারা বাংলাদেশে একটা জাগরণ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আমার মুখ দিয়ে বের হওয়া বোস কথাগুলোকেই পত্রিকাওয়ালা অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তিনি প্রবাসীদের দেশাত্মবোধের প্রশংসা করে বলেন, চিল যেমন আকাশে উড়লেও দৃষ্টি থাকে। মাটিতে তেমনি সাড়ে ১৩ হাজার দূর আটলান্টিক মহাসাগরের এপাড়ে থাকলেও বাঙালিদের হৃদয় সদা বাংলাদেশেই পড়ে থাকে। স্বদেশের প্রতি প্রবাসীদের এই যে আকুলতা তা আমাকে আপুত করে। সভাপতির বক্তব্যের আগে হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই এবং ডকুমেন্টারির মোড়ক উন্মোচন করেন ড. ইফতেখার আহমেদ, রফিক আহমেদ খান এবং সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ। হুমায়ূন মেলায় আসা প্রায় সকলেই তাঁর বই কিনেছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে। দাঁড়িয়ে তারা লেখকের অটোগ্রাফ নিয়েছেন। এ উপলক্ষে উদীচী, বিসিএ। এবং বিপার শিল্পীদের পরিবেশনাও ছিলো চমৎকার। সবশেষে অভিনেত্রী রেখা আহমেদ হুমায়ূন আহমেদের ‘প্যাকেজ নাটক’-এর অংশবিশেষ মঞ্চস্থ করেন।

.

পাদটীকা

মাত্র দুসপ্তাহের প্রস্তুতিতে মুক্তধারা নিউইয়র্ক ২০০২ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির ৩০ বছর উপলক্ষে হুমায়ূন মেলার আয়োজন করে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, ওয়াশিংটন, বস্টোন, আটলান্টিক সিটিসহ বিভিন্ন স্টেট থেকে হুমায়ূন মেলা’য় যোগ দিয়েছিলেন প্রবাসী বাঙালিরা। স্বল্প সময়ের অনুরোধে বিশেষ করে বিশিষ্ট শিল্পী শহীদ হাসান, দুলাল ভৌমিক, তাজুল ইমাম, সেলিমা আশরাফ, রূপা খান যেভাবে হুমায়ূন আহমেদের গান পরিবেশন করেছেন তা কখনো ভোলার নয়। ধন্যবাদ অভিনেত্রী রেখা আহমেদকেও। ধন্যবাদ। সাপ্তাহিক ঠিকানা পরিবারকে। এই সংবাদটির কোনো সংগ্রহই ছিলো না আমাদের কাছে। দুদিনের নোটিশে ঠিকানা পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক মিজানুর রহমান দুঃসাধ্য কাজটি করে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। ২০০২ সালের হুমায়ূন মেলা’ নামের এই বিশেষ ঘটনাটি শুধুমাত্র মুক্তধারা বা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালিদেরও নয়, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবনেরও একটি বিরাট ঘটনা। তিনি নিজেই বলেছেন সেই অনুষ্ঠানে, মৃত্যুর পর হয়তো আমার নামে এমন মেলা অথবা অনুষ্ঠান হবে। আমার জীবদ্দশায়ই দেখে গেলাম এটাও আমার জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *