নিউইয়র্ক বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ
পুরো মিলনায়তন অন্ধকার। মঞ্চের সামনের পর্দা উঠছে। আলো গিয়ে পড়বে বাম পার্শ্বে চেয়ারে বসা হুমায়ূন আহমেদের উপর। শতবর্ষের বাংলা গান’-শীর্ষক অনুষ্ঠানের শুরুতে ইতিহাস বলবেন তিনি। এরপর আলো পড়বে মঞ্চের ডানদিকে বসা শিল্পী মেহের আফরোজ শাওনের ওপর। তার গান শেষ হলে, আলো পড়বে পেছনে বসা যন্ত্রীদের ওপর। টপ্পা, ঠুমরি, বৈঠকি থেকে শুরু করে তার লেখা গানও অন্তর্ভুক্ত ছিলো সেই অনুষ্ঠানের জন্য। প্রতিটি গানের শুরুতে সেই গানটির ইতিহাস বলবেন আর মেহের আফরোজ শাওন গান করবেন। গত ২৯, ৩০ জুন ও ১ জুলাই নিউইয়র্কের সুসান বি এন্থনি স্কুল মিলনায়তনে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা ২০১২ এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায় অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হিসেবে এই অনুষ্ঠানটি অন্তর্ভুক্ত ছিলো। প্রোগ্রাম সূচিও ছাপা হয়ে যায়। অস্ত্রোপচারের পর ২১ জুন দ্বিতীয়বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বইমেলার দিন হুমায়ূন আহমেদ বেলভ্যু হাসপাতালে জীবন। মৃত্যুর সাথে লড়ছিলেন। তার ইচ্ছে পূরণ হলো না। |
আমেরিকায় বইমেলার এই অনুষ্ঠান নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের অনেক পরিকল্পনা ছিলো। জানুয়ারি মাসে আমি নিউইয়র্কের বইমেলা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাথে প্রথম আলোচনা করি। প্রথমে হুমায়ূন আহমেদকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রপত্র দেওয়া হয়। শিল্পী মেহের আফরোজ শাওনকে পৃথক আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয় অতিথি শিল্পী হিসেবে বইমেলায় সংগীত পরিবেশনের জন্য। তারপরই বলা হলো, এবার যেহেতু তিনি নিউইয়র্কে আছেন, এটা নিউইয়র্ক বইমেলার জন্য সৌভাগ্য। নিউইয়র্কের বইমেলা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ভাবনা বা তাঁর পরামর্শ চাইলাম। ভীষণ উৎসাহ দেখালেন হুমায়ূন আহমেদ। কথা বললেন সংগীতানুষ্ঠান নিয়ে মেহের আফরোজ শাওনের সাথে। চিত্র প্রদর্শনীর বিষয়টি এমনিতেই আগেই ঠিক হয়েছিলো। হুমায়ূন আহমেদ প্রথমেই বললেন বইমেলা কমিটিকে বিষয়টি আমি অবহিত করি। আহ্বায়ক নাসিমুন নাহার নিনি বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ দেখালেন। তখন প্রতি দুসপ্তাহ পর পর বইমেলার সভা হতো মুক্তধারার জ্যাকসন হাইটস কার্যালয়ে। ফেব্রুয়ারি ২০১২এর প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে যাই। এরমধ্যে ঢাকাতে রুমা আমাকে ফোনে জানাল হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন রিহার্সেল শুরু করেছেন। আমি তো ভীষণ খুশি। এব্যাপারে তখন আমি আর ঢাকাতে লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং পূরবী বসুর সাথে আলোচনা করিনি। তাঁদের শান্তিনগর বাসায় প্রায় ৪/৫দিন সকালে গিয়েছি জ্যোতি প্রকাশ দত্তের সাথে দেখা করতে। এরমধ্যে ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখ সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে গেল ঢাকা প্রেসক্লাবে। আমি নিউইয়র্কে ফিরে আসলাম। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ কেমো শেষ হওয়ার পর, আমি আর একদিন বইমেলা নিয়ে কথা তুলোম হুমায়ূন আহমেদের সাথে। সেটা হলো নিউইয়র্ক বইমেলা কমিটি থেকে হুমায়ূন আহমেদকে সম্মাননা জানাবার বিষয়টি। হুমায়ূন আহমেদ বিষয়টি শুনলেন। একটু চুপ করেছিলেন। পরে আমি বিষয়টি খুলে বললাম। এই সম্মাননা হঠাৎ করে দেওয়া হচ্ছে না। ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর এক একজন লেখককে বইমেলা কমিটি সম্মাননা জানিয়ে থাকেন। এরমধ্যে কবি শহীদ কাদরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, দিলারা হাশেম, ড. গোলাম মুরশিদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, তপন রায় চৌধুরীকে সম্মাননা জানানো হয়েছিলো। এবছর বইমেলা কমিটি হুমায়ূন আহমেদ ও লেখক শওকত আলীকে সম্মাননা জানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদকে আমি বললাম আপনার সম্মাননা অনুষ্ঠানটি হবে ৩০ জুন সন্ধ্যায়। ২০ মিনিটের অনুষ্ঠান। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ২টি গান, নাট্যাংশ ও লেখা পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি সাজানো হবে। এরপর সম্মাননা এবং উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হবে। আমি তখন জানতে চাইলাম কার হাত থেকে সম্মাননা নিতে আগ্রহী হুমায়ূন আহমেদ। আমি কয়েকটি নাম উল্লেখ করলাম। তিনি পূরবী বসুর কথা বললেন। ২০১২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসুকে ‘রং পেন্সিল’ বইটি উৎসর্গ করেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, এদের সাথে আরো আগে কেন পরিচয় হয়নি। তেমনি কিছুদিন আগে যখন বইমেলায় চিত্র প্রদর্শনীর কথা চূড়ান্ত হয়, তখন উদ্বোধন এবং পুরো অনুষ্ঠানটির বিষয়ও আমি হুমায়ূন আহমেদের সাথে আলোচনা করি। হুমায়ূন আহমেদের ইচ্ছে তাই চূড়ান্ত হয় নিষাদ হুমায়ূন চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবে। প্রতিটি ছবির ক্যাপশান থেকে শুরু করে প্রদর্শনীর। ক্যাটালগে কী লেখা হবে সব হুমায়ূন আহমেদ নিজে লিখে দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানসূচি এমনভাবে সাজানো হলো ২৯ জুন বিকেলে চিত্র প্রদর্শনীর সময় হুমায়ূন আহমেদ যখন আসবেন তখন বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তিনি। থাকতে পারছেন। এরপর ৩০ জুন সন্ধ্যায় সম্মাননা অনুষ্ঠান। ১ জুলাই সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওনের ‘শতবর্ষের বাংলা গান’-এর অনুষ্ঠান। মোটকথা বইমেলার তিনদিনই হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়েছে।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বইমেলার পরবর্তী সভায় আমি বিস্তারিতভাবে বিষয়গুলো কমিটিকে জানাই। সে সভায় ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, নাসিমুন নাহার নিনি, হাসান ফেরদৌস, সউদ চৌধুরী, আবুল ফজল, আদনান সৈয়দ, ওবায়দুল্লা মামুন, ফাহিম রেজা নূর, সেমন্তী ওয়াহেদসহ বইমেলা কমিটির ২১জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় অনুষ্ঠানসূচি চূড়ান্ত হয়। বইমেলা সাজানো হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সে বইমেলার দ্বিতীয় দিন বিকেলে কে বা কারা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করেন হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। বইমেলার জন্য আমি সে সপ্তাহে খুব কম। হাসপাতালে যাতায়ত করতাম। সেদিন শনিবার, রনি বড়য়া ছিলেন না হাসপাতালে। গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সাথে পূরবী বসুর হাসপাতালে যোগাযোগ ছিলো। তাই সর্বশেষ আপডেট আমরা জানতে পারতাম। হুমায়ূন। আহমেদের মৃত্যুর গুজব তাই রটানো বইমেলায় সম্ভব হয়নি। যেহেতু বেলভ্যু হাসপাতালে রনি বড়য়া কাজ করতেন, আমি উপস্থিত না থাকলেও প্রতিদিন অন্তত দুবার তার সাথে যোগাযোগ হতো। কোনো কোনোদিন তিন চারবারও রনি বড়ুয়া হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে যেতেন। বিশেষ করে ২৬ জুনের পর থেকে। যখন আমি বইমেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
মুক্তধারা নিউইয়র্ক এর সাথে হুমায়ূন আহমেদের সম্পর্ক ১৯৯৩ সাল থেকে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো হুমায়ূন আহমেদ উত্তর আমেরিকা বইমেলা উদ্বোধন করেন। স্মৃতির কোনো শেষ নেই হুমায়ূন আহমেদের সাথে মুক্তধারার। ১৯৯৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ যখন নিউজার্সিতে বেড়াতে আসেন তখন একদিনের জন্য আমাদের উডসাইডের বাসায় এসেছিলেন। আমরা তখন। উডসাইডের বাসায় শেলফ করে বই বিক্রি করতাম। এখান থেকেই শুরু হয় মুক্তধারা নিউইয়র্কের যাত্রা।
১৯৯৪ সালে নিউজার্সি বাংলাদেশ সম্মেলনে হোটেল হিলটনে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম মুক্তধারার স্টলে তাঁর ভক্তদের অটোগ্রাফ দেন। সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। সেসময় গুলতেকিন আহমেদ, নুহাশসহ নিউজার্সিতে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বাসায় উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেসময়ই প্রথম মুক্তধারার স্টলে হুমায়ূন আহমেদ উত্তর আমেরিকায় প্রথমবারের মতো পাঠকদের অটোগ্রাফ দেন। দেশে গিয়েই লেখেন হুমায়ূন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে যশোহা বৃক্ষের দেশে’ নামক গ্রন্থ। সে সম্মেলনে শিল্পী আবুল ফজল হুমায়ূন আহমেদের অনেক ছবি তোলেন। তখন নুহাশ খুব ছোট ছিলো।
নিউজার্সির সেই সম্মেলনের আগের সপ্তাহে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রবাসীর জন্য একটি সাক্ষাৎকার নিতে আগস্টের শেষ সপ্তাহে ড. জাফর ইকবালের বাসায় হুমায়ূন আহমেদের সাথে দীর্ঘসময় কাটে। বাংলা সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, অনুবাদ এবং প্রবাস বিষয়ে নানান কথা বলেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই দীর্ঘ সাক্ষাতকারে। প্রবাসী’র প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করা সেই সাক্ষাৎকারটি ট্যাবলয়েড সাইজ ৩ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিলো। এর আগেও অবশ্য ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সাপ্তাহিক ‘আনন্দপত্র থেকে সাংবাদিক এনামুল হক ইনুসহ একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ‘হুমায়ূন ও গুলতেকিন আহমেদ অন্তরঙ্গ আলোকে’ শিরোনামে। তখন আমি ঢাকায় মোস্তফা জব্বার সম্পাদিত সাপ্তাহিক আনন্দপত্রে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতাম। সেই সূত্রেই প্রথম হুমায়ূন আহমেদের সাথে পরিচয় ঘটে। ১৯৮৭ সালে প্রিয়তমেসু’ উপন্যাস আনন্দপত্রের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তারজন্য তখন ঘন ঘন হুমায়ূন আহমেদের বাসায় যেতে হতো। এরপর কত ঘটনা। ১৯৯৪ সালে বইমেলা উদ্বোধন করতে আসলেন হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে। বুকে ব্যথা অনুভব করেছেন। নিয়ে গেলাম তাকে বেলভ্যু হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। বিকেল থেকে সারারাত হাসপাতালে। চিকিৎসকরা বলেছেন হুমায়ূন আহমেদকে বাইপাস করতে। তিনি শুনেননি চিকিৎসকদের কথা। ভোরবেলা বন্ড দিয়ে বের হয়ে চলে আসলেন হাসপাতাল থেকে। বের হয়েই সিগারেট ধরালেন। একটি নয় পরপর দুটি। আমি বললাম, কাজটা ঠিক হয়নি। এ অবস্থায় আপনার হাসপাতাল থেকে বের হওয়া ঠিক হচ্ছে না। তিনি কথা শুনলেন না। বললেন, আগামিকাল বইমেলা, আর তুমি আমাকে নিয়ে এখানে পড়ে আছ। তোমাকে গতকাল থেকেই বলেছি, চলে যেতে, তুমি যাওনি। এই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর পরদিন অবলীলায় ফিতা কেটে বইমেলা উদ্বোধন করলেন। কাউকে বুঝতেও দিলেন না, ওনার হার্টের মধ্যে যে ব্লক রয়েছে। বরফ আর বরফ। নিউইয়র্ক নগরী। বরফমোড়া। তারমধ্যে এস্টোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বইমেলায় মানুষ আর মানুষ। হুমায়ূন আহমেদের দুর্নিবার আকর্ষণে বরফ আটকাতে পারেনি প্রবাসী। বাঙালিকে। ফিলাডেলফিয়া, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, ওয়াশিংটন, বোস্টন থেকে হুমায়ূন ভক্তরা ছুটে এসেছিলেন সে বইমেলায়। ১৯৯৭ সালে হুমায়ূন আহমেদ আসেন বেড়াতে প্রকৌশলী বন্ধু এফ করিমকে নিয়ে। তখন হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে। নাটকে শীলা আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন দুজন অভিনয় করেন। ভীষণ জনপ্রিয় সে নাটক। হুমায়ূন আহমেদের আজ রবিবার’ এর প্রথম ৩পর্ব নাটক নিউইয়র্কের অবসর প্রকাশনা ভিডিও ক্যাসেট নিউইয়র্কে রিলিজ করে। আসাদুজ্জামান নূর-এর সাথে যোগাযোগ করে তারা নাটকটি আমেরিকায় নিয়ে আসেন। সেসময় যতদিন নিউইয়র্কে ছিলেন খুব হৈ-হুঁল্লোড় করে কাটিয়েছিলেন। মুক্তধারা এস্টোরিয়া শাখার রফিকুল আলম এর নাম দিয়েছিলেন ডিটেকটিভ’। ১৯৯৮ সালে হুমায়ূন আহমেদ আসেন ফিলাডেলফিয়া বঙ্গ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সাহিত্যিক হিসেবে যোগ দিতে। কলকাতা থেকে আসেন সমরেশ মজুমদার। নিউইয়র্ক থেকে আমরা গেলাম স্টল দিতে। ফিলাডেলফিয়া প্রবাসী সুজশ গুহ ও তাঁর স্ত্রীর যে প্রচেষ্টা ছিলো হুমায়ূন আহমেদকে বঙ্গ সম্মেলনে আনার পেছনে তা কখনো আমি ভুলবো না। কমিটির লোকেরা কোনোভাবেই বাংলাদেশ থেকে কোনো সাহিত্যিক আনার পক্ষে ছিলো না। সুজশ রায় ও তাঁর স্ত্রী প্রতিনিয়ত আমার সাথে যোগাযোগ করে হুমায়ূন আহমেদকে এনেছিলেন। তখন সমরেশ মজুমদারের সাথে এরকম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো না হুমায়ূন আহমেদের। দুজন লেখকই মুক্তধারার স্টলে তাঁদের ভক্তদের অটোগ্রাফ দেন। ১৯৯৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ‘উদ্ভট গল্প’ বইটি তিনি আমাকে উৎসর্গ করেন। তাতে হুমায়ূন আহমেদ লেখেন: বিশ্বজিত সাহা, প্রবাসে বর্ণমালা সাজিয়ে বসে আছেন।
১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবি রিলিজ হয় বাংলাদেশ ও আমেরিকায় একই সময়ে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ডালাস, ফ্লোরিডা এবং হলিউডে আমেরিকার মূলধারার ছবির সাথে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। ২০০০ সালে হুমায়ূন আহমেদ আসেন নুহাশকে নিয়ে বেড়াতে। তখন নোভা আহমেদ এবং তাঁর স্বামী আরশাদ নিউজার্সি থাকেন। একদিন আমরা আমাদের উডসাইডের বাসায় নতুন জামাইকে নিমন্ত্রণ করলাম। বিভিন্ন রকমের মাছ, বেশ কয়েক রকমের ভাজি, মাংস, দই, মিষ্টি। বিশাল থালায় জামাইর জন্য বাড়া হলো নানান ব্যঞ্জন। তা দেখে হুমায়ূন আহমেদ বলেই ফেললেন নতুন জামাইর আদরই আলাদা। নুহাশ তখন অনেক ছোট। বাবার সাথে চুপচাপ বসে থাকে। হুমায়ূন আহমেদ একদিন নিউইয়র্কে আমাদের বাসায়, অন্যদিন নিউজার্সিতে নোভাদের বাসায়। আমি তখন ভীষণ ব্যস্ত মুক্তধারা নিয়ে। রুমা প্রায় প্রতিদিনই যাতায়াত করতো হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নিউইয়র্ক-নিউজার্সি। সেসময়ই হুমায়ূন আহমেদ, নোভা, আরশাদ, নুহাশকে, বহতা ও বিজিতকে নিয়ে রুমা গেল নায়েগ্রা দেখতে। ছিলো ওরা দুদিন নায়েগ্রায়। তারপর নায়েগ্রা থেকে ফিরে রুমা আমাদের ছেলে-মেয়েকে। নিয়ে থেকে ছিলো নোভাদের বাসায়। লং ড্রাইভ করে এসেছে তাই ওরা। সেদিন রুমাকে নিউইয়র্কে ফিরে আসতে দেয়নি। নোভা এবং আরশাদ রুমা ও আমাদের দুসন্তানের জন্য সেদিন ওদের বেডরুম ছেড়ে দিয়েছিলো। ওদের আন্তরিকতার কথা রুমা এখনো মাঝে মাঝে বলে। মুক্তধারার জ্যাকসন হাইটস শাখায় হুমায়ূন আহমেদের জন্য মুক্তধারা আয়োজন করে এক ‘অটোগ্রাফ’ অনুষ্ঠান। প্রচুর সংখ্যক পাঠক এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এ বছর মুক্তধারা প্রকাশ করে দুই বাংলায় প্রথম বাংলা ছবি হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ এর ডিভিডি। এ উপলক্ষে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে অনুষ্ঠিত হয় সকল কলাকুশলীদের নিয়ে এক মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। মেহের আফরোজ শাওনের সাথে বিয়ে হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ সেই অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন পর সাংবাদিকদের সামনে গেলেন। নুহাশকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সেই অনুষ্ঠানে। যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তধারা নিউইয়র্কের সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রথিতযশা লেখক, সাহিত্যিক ও পরিচালকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ২০০১ সাল ছিলো আমেরিকায় বইমেলার জন্য সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর। দশ বছর পূর্তি। সেসময় বাংলা ভাষার চার জনপ্রিয় লেখক একত্রিত হয়েছিলেন নিউইয়র্কে। বাংলাদেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমরেশ মজুমদার। এ চারজন লেখক আর কখনো কোনো বইমেলায় একত্রিত হননি। সেটি ঘটলো আটলান্টিকের পাড়ে। চারজন লেখককে নিয়ে বইমেলায় হাসান ফেরদৌস করেছিলেন দুঘণ্টার এক বিশেষ অনুষ্ঠান। লেখক-পাঠক মুখোমুখি চার লেখক ছিলেন কুইন্স বুবার্ডের হোটেল প্যান আমেরিকান-এ। হোটেলের একটি ঘটনা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই গল্প করতেন। এবার বইমেলার উদ্বোধন নিয়ে মহা সমস্যায়। চার বিশাল লেখক। কাকে দিয়ে উদ্বোধন করা হবে। মহা সমস্যা। হুমায়ূন আহমেদের আগেই উদ্বোধন করেছেন। তাছাড়া নিউইয়র্ক বইমেলার বিশেষ দিক হলো প্রতিবছরই একজন লেখক এই বইমেলা উদ্বোধন করেন। হুমায়ূন আহমেদকে চুপিচুপি বিষয়টা বললাম, তিনি বইমেলার আগের দিন হোটেল প্যান আমেরিকান-এ খাবার টেবিলেই সমস্যা সমাধান করে দিলেন। বললেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইমেলা উদ্বোধন করবেন, আমরা সুনীলদার সাথে থাকবো। সাথে সাথে সমরেশ মজুমদার, ইমদাদুল হক মিলন বলে উঠলেন, এটাই হবে সুনীলদার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। কত সহজে সমস্যার সমাধান করে দিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আর সেই বইমেলায় চার লেখককে একসাথে দেখার জন্য পুরো উত্তর আমেরিকা থেকে বইমেলায় ভিড় জমিয়েছিলেন ভক্ত, পাঠক ও অনুরাগীরা।
অতিরিক্ত দর্শক ধারণের কারণে পুলিশ এসে বের করে দিয়েছিলেন মিলনায়তন থেকে দর্শকদের। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালিদের মনে থাকবে সেই অনুষ্ঠানটি। সেসময়ই আসে আমেরিকায় প্রথম অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম মুক্তধারার আমন্ত্রণে। তাদের একটি স্টলও ছিলো। এসেছিলেন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনিও।
২০০২ সালের জুন মাসে হঠাৎ আসলেন নিউইয়র্কে। আমরা আয়োজন করলাম ‘হুমায়ূন মেলা’। তা আজ সকলের কাছে অমলিন। তা আজ সকলের কাছেই ইতিহাস।
২০০৩ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কন্যা বহতাকে মনোনীত করেন। চরিত্রের নাম যইতরী। ছবির জমিদার আসাদুজ্জামান নূর গুলি করে এক একটি কাক মারেন। জমিদারের নাতনি কাকগুলো কবর দেন। বহতার বয়স তখন ৮ বছর। জন্ম আমেরিকায়। দেরিতে কথা বলা শুরু করা মেয়েটি ভালো করে বাংলাও বলতে পারতো না। হুমায়ূন আহমেদ বহতাকে নির্বাচন করে আমাদের ফোনে জানাবার পর আমরা হুমায়ূন আহমেদকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, গত বছর যখন তিনি নিউইয়র্ক এসেছিলেন তখনি চলচ্চিত্রের গল্পের যইতরী চরিত্রটি বহতাই ভালো করবে এটি তার বিশ্বাস। বললেন, তিন। সপ্তাহের শুটিংয়ের মধ্য দিয়ে বহতার অভিনয় শেষ হয়ে যাবে। রুমা সেভাবে বহতা’র স্কুল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করলো। ৮ বছরের বহতা আর ৬ বছরের বিপ্রজিতকে নিয়ে রুমা গেল ঢাকায়। রিহার্সেল-এ সে কত সমস্যা। অভিনয় করলো বহতা। তাকে তার মা বাংলাকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে বুঝানো। নুহাশ পল্লীতে এবং ময়মনসিংহে শুটিং, খালি পায়ে অভিনয় সবই করে আসলো বহতা। এরই মধ্যে এক বিপত্তি। আমাদের ছেলের হলো ডেঙ্গু জ্বর। ওকে নিয়ে কঠিন অবস্থা। আর নিউইয়র্কে আমার হলো জন্ডিস। সব মিলিয়ে আমাদের পরিবারের উপর বিরাট ঝড় বয়ে যায়। ৩ সপ্তাহের পরিবর্তে শুটিং শেষ হতে লাগে ৬ সপ্তাহ। রুমা ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিউইয়র্কে ফিরলো। এর আগে অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের রেফোরেন্সেই ঢাকায় বিজিতকে ডাক্তার দেখানো হয়। বেলভ্যু হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করা আমাদের ছেলে বিজিতকে নিয়ে হাসপাতালে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ডেঙ্গু ভাইরাস আমেরিকায় একেবারে অপরিচিত। অনেকটা গবেষণা হয়ে গেল এই রোগের। নিউইয়র্ক সিটির ৫টি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বোর্ড পর্যন্ত বসে এ নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মেহের আফরোজ শাওন, ফেরদৌস, আসাদুজ্জামান। নূর, রুবেল ও বহতা অভিনীত ছবিটি আমেরিকার একটি হলে প্রদর্শিত হয়।
ডালাস, লস এঞ্জেলেস, মিশিগান ও ফ্লোরিডার মূলধারার বিভিন্ন হলে ছবিটি চলার কথা থাকলেও নকল কপি বের হওয়ায় আমরা প্রচন্ড আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হই। এ সময় হুমায়ূন আহমেদের ছবির বিনিয়োগকারীর সাথে মুক্তধারার সম্পর্কের টানাপড়েন চলে। কিন্তু পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদ বুঝতে পারেন পুরো ঘটনাটি। উল্লেখ্য, চন্দ্রকথা’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য বহতা সাহা শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী পুরস্কার পায়। ম্যানহাটান সেন্টারে অনুষ্ঠিত কলা মিউজিক অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করে বহতা। আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সুপ্রিয়া চৌধুরী, চিত্রনায়িকা ববিতা ছিলেন জুরী বোর্ডের সদস্য। ঐ ছবিতে পরবর্তীতে ভালো বাংলা বলতে না পারায় সংলাপ ডাবিং করা হয়েছিলো মেহের আফরোজ শাওনের ছোট বোন সেঁজুতীর কণ্ঠে। ২০০৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ আসেন লস এঞ্জেলসে বঙ্গ সম্মেলনে যোগ দিতে। মুক্তধারার স্টলে তিনি ভক্তদের অটোগ্রাফ দেন। সেসময় তিনি মুক্তধারা লস এঞ্জেলসে শাখা উদ্বোধন করেন। সে বছরই লস এঞ্জেলসে শংকু আইচের সাথে পরিচয় ঘটে। এবং তাঁকে ঐ বছর এই শুভ্র! এই বইটি উৎসর্গ করেন। ২০০৪ সালে নিউইয়র্কে মুক্তধারা আয়োজন করে নিউইয়র্কে দশ দিনব্যাপী বাংলা চলচ্চিত্র উৎসব। এতে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘আগুনের পরশমণি’, চাষী নজরুল ইসলামের হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’, আমজাদ হোসেনের ‘সারেং বৌ’, অপর্ণা সেনে’র ‘পারমিতার একদিন ও গৌতম ঘোষে’র ‘দেখা’। হুমায়ূন আহমেদের ছবিগুলো দর্শকপ্রিয়তা পায়।
২০০৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম আসলেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে আমেরিকায়। যথারীতি এয়ারপোর্ট-এ অভ্যর্থনা জানালাম আমি আর রফিকুল আলম। ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম। রুমা তখন কলকাতায়। আমাদের পুরো বাড়ি খালি। আসার আগেই আমি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে উঠতে। সেসময় তাঁদের সাথে এসেছিলেন মাজহারুল ইসলাম ও অন্যপ্রকাশের আর এক পরিচালক কমল। আমাদের বাসায় কয়েকদিন দিন থেকে তারপর তারা আবার হোটেলে উঠলেন। সেসময়ই মনে পড়ে মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। আর তা নিয়ে অনেক হাসাহাসির ঘটনা।
সে বছর হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই ‘আসমানীরা তিনবোন’র মোড়ক উন্মোচন। অনুষ্ঠান হয় মুক্তধারায়। সে অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদ নিজে মোড়ক উন্মোচন না করে বললেন আমার বোন জলি আবেদীন মোড়ক উন্মোচন করবেন। সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনও এদিন মুক্তধারায় আসেন। উল্লেখ্য, জলি আবেদীন হলেন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের মামাতো বোন। বইমেলায় আসার পর থেকেই এই পরিবারের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা হয়। নিউইয়র্ক এলে তিনি বেশ কয়েকবার জামাল আবেদীনদের জ্যামাইকা ও জ্যাকসন হাইটসের বাসায় অবস্থান করেন। তিনি রুমালী” বইটি জলি ও জামাল আবেদীনকে উৎসর্গ করেন। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ জলি আবেদীনকে নীল মানুষ’ নামে আরেকটি বইও উৎসর্গ করেন ২০১১ সালে। তাতে তিনি লেখেন: ‘জলি আবেদীন। আড়ালে তাঁকে আমি ডাকি সিস্টার টুয়েন্টি টু ক্যারেট। কারণ তার হৃদয় বাইশ ক্যারেট সোনায় বানানো–কোনো খাদ নেই।‘
২০০৫ সালে তিনি আবার এসেছিলেন মেহের আফরোজ শাওনসহ ঢালিউড অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিউইয়র্কে। ঢালিউড থেকে হুমায়ূন আহমেদকে সেসময়। আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি আলমগীর খান আলম ২০০২ সাল থেকে নিউইয়র্কে প্রবর্তন করেন। সেসময়ও তিনি এসেছিলেন মুক্তধারায় একটি অটোগ্রাফ অনুষ্ঠানে।
২০০৯ সালে হুমায়ূন আহমেদ আসলেন নিউইয়র্ক বইমেলায়। সাথে আসলেন। মেহের আফরোজ শাওন ও নিষাদ। এবার তিনি কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। নিষাদকে কোলে নিয়ে। এই অনুষ্ঠানেই তিনি পাঠকদের প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কার করে বলেন তার লেখা ভবিষ্যতে থাকবে কি থাকবে না। তিনি বলেন, আমি আমার আনন্দে লিখি। কোনো পাঠক যদি আনন্দসহকারে তাঁর লেখা পড়েন, তাতেই তিনি আনন্দিত। আর এটি থাকবে কি থাকবে না তা ইতিহাসবিদগণ। হিসেব রাখবেন। এই অনুষ্ঠানে মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদের অনেকগুলো লেখা গান পরিবেশন করেন।
২০১১ সালের হুমায়ূন আহমেদের বইমেলায় যোগ দেওয়ার কথা ছিলো। লাসভেগাস থেকে কথা ছিলো নিউইয়র্কের বইমেলায় আসবেন। আমরা টিকেটও পাঠিয়েছিলাম সেভাবে। পরবর্তীতে লাস ভেগাস থেকে তিনি প্লেনে। করে মিশিগানে আসলেন। মিশগান থেকে ট্রেনে আসলেন নিউইয়র্কে। বইমেলায় যোগ দেওয়া হয়নি তার। আসলেন বইমেলা শেষ হওয়ার পর নিউইয়র্কে। সেসময়ই মুক্তধারা কোনো অনুষ্ঠান করেনি হুমায়ূন আহমেদকে। নিয়ে। একদিন দেখা হলো হুমায়ূন আহমেদের সাথে জলি আবেদীন এর বাসায়। তিনি দুঃখ প্রকাশ করার জন্য আমায় ডেকেছিলেন। সেসময় তিনি। মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে আসেন আমেরিকায়। এ বছরই লাস ভেগাসের খোকনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় হয়। চার খোকনকে ‘যখন নামিবে আঁধার’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন ‘খোকন নামের সঙ্গে কীভাবে যেন আমি যুক্ত। চারজন খোকনের সাথে আমার গাঢ় পরিচয় আছে। খোকন সিঙ্গাপুর, খোকন নিউইয়র্ক, খোকন লাস ভেগাস, খোকন ঢাকা। চার খোকনের এক বই।
২০১১ সালে তিনি লাস ভেগাস থেকে গিয়েছিলেন মিশিগানে তার বন্ধু ড. আহসান হাবীব (সেলিম) এর বাসায়। তারা তিনদিন ছিলেন সেখানে। সেখান থেকে নিউইয়র্কে আসেন ট্রেনে করে। এর আগেরবার ২০০৯ সালেও গিয়েছিলেন মিশগানে। ড. আহসান হাবীব আর হুমায়ূন আহমেদ একই সাথে বগুড়া স্কুলে এবং পরবর্তীতে ঢাকা কলেজে পড়তেন। ২০০৬ সালে হুমায়ূন আহমেদ বইমেলায় আসার পর বিজ্ঞাপন দেখে মুক্তধারায় ফোন করেন বন্ধুকে খোজার জন্য। দীর্ঘদিন দুবন্ধুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়ার পর দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। হুমায়ূন আহমেদকে নিউইয়র্কে দেখতেও আসেন তিনি দুবার। যতবারই নিউইয়র্কে আসেন একবার না একবার তিনি মুক্তধারায় আসবেনই। ২০১২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ‘পায়ের তলায় খড়ম’ বইটি ড. আহসান হাবীব ও বন্ধু পত্নী হেলেনকে তিনি উৎসর্গ করেন। আমেরিকায় হুমায়ূন আহমেদের অনেক বন্ধু বান্ধব রয়েছেন বিভিন্ন স্টেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গত ২১ বছরে নিউইয়র্কে মুক্তধারার বিভিন্ন বইমেলা উপলক্ষে যখনি তিনি এসেছেন তখনি কোনো বন্ধু-বান্ধব বা ভক্তদের সাথে নতুন সম্পর্ক হয়েছে নতুবা পুরনো সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হয়েছে। আবার গত ২০ বছরে অনেকবার যুক্তরাষ্ট্রে আসলেও হুমায়ূন আহমেদেকে নিয়ে কিছু সংখ্যক লোক কখনো আগ্রহ দেখাননি। সবসময়ই এড়িয়ে চলেছেন। হুমায়ূন আহমেদের। জনপ্রিয়তায় তাঁরা ছিলেন ঈর্ষান্বিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি প্রকাশ করেছেন দেশে-বিদেশে। কখনো কখনো আমরা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নাচানাচি করি এটি বলতেও দ্বিধান্বিত হননি। স্বীকার করেননি হুমায়ূন আহমেদকে লেখক হিসেবে। জীবনে এক লাইন লেখেননি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। আজ দেশে-বিদেশে তাঁদের অনেকেই হুমায়ূনপ্রীতি দেখাচ্ছেন। ভালো লাগছে। মৃত্যুর পর অন্তত তিনি তাঁদের কাছে আদরনীয় হয়ে উঠেছেন। তাঁকে নিয়ে তাঁর লেখা নিয়ে বিভিন্ন লেখা-লিখিতে উদ্যোগি হয়েছেন। ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর মুক্তধারায় অনুষ্ঠিত তাঁর ৬৩তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেক হুমায়ূন আহমেদ ভক্তই মনে করেছিলেন তাঁদের প্রিয় লেখক মুক্তধারায় আসবেন। আমরা তাঁকে একবারের জন্য বলিনি আসতে। এমনকি আমাদের তরফ থেকে ফুল পর্যন্ত লেখকের হাতে আমরা দিইনি। কেননা তখন কিছুদিন হলো মাত্র লেখকের কেমোথেরাপি শুরু হয়েছিলো। সব কিছুতেই গন্ধ গন্ধ মনে হতো। খাবারে পর্যন্ত রুচি ছিলো না। কোনো ভাইরাস বা অন্য কোনো সংক্রমণ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে ভক্তদের। তিনি নিরাশ করেননি। স্কাইপির মাধ্যমে সকলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এদিন অনেকেই চেয়েছিলেন লেখকের অটোগ্রাফ নিতে। আমরা বলেছি লেখকের লিখতে কষ্ট হচ্ছে, অটোগ্রাফ দিতে বলা কি ঠিক হবে। এর মধ্যেও কয়েকজন নিউইয়র্ক প্রবাসী হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত বই রেখে যান তাঁদের প্রিয় লেখকের স্বাক্ষরের জন্য। অনেকদিন বলবো বলবো করেও আমি বলিনি।
জন্মদিনের সপ্তাহ থেকে ৭ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করি। দেশে যাবার আগে ৭ মে বিষয়টি আমি হুমায়ূন আহমেদকে জানাই। তিনি বললেন এক একজনের একটি করে বই আনার জন্য। সেদিন হাসপাতাল থেকে আসার পর কয়েকটি বই নিয়ে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ অটোগ্রাফ নেওয়া সৌভাগ্যবানদের মধ্যে সপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি সাঈদ উর রব, হাসি, খোকন, জুলফিকার, রাহা, মেজবাউল হকের কথা মনে। পড়ছে। এরমধ্যে একজন ছিলেন তাঁর হবু স্ত্রীর জন্য বই কিনে হুমায়ূন। আহমেদের জীবনের শেষ অটোগ্রাফ নেওয়া ভাগ্যবানদের তালিকায় রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ সেদিন তাঁর জাপানি ভাষায় প্রকাশিত বইটি অটোগ্রাফ করে আমাকে আর রুমাকে উপহার দেন।
পাদটীকা
কত রকম কত স্মৃতি। হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমেরিকায় বইমেলা বা মুক্তধারার সম্পর্ক ছিলো ওতোপ্রোত। কখনো তিনি এসেছেন মুক্তধারার আমন্ত্রণে। কখনো ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণে। সবসময় তিনি মুক্তধারার সাথে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক রেখে গেছেন। সে সম্পর্ক অটুট ছিলো আমৃত্যু পর্যন্ত। অনেক সময় মান অভিমান হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন অনেকে। কিন্তু কখনোই তার সাথে মুক্তধারার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। এটি ছিলো একধরনের অমলিন ভালোবাসার সম্পর্ক।