০১. হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো

০১. হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো

হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে আসছেন। না, বেড়াতে কিংবা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠান বা মেলায় আসছেন না। আসছেন চিকিৎসার জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বাংলা ভাষার কিংবদন্তি লেখক এলেন কুয়েত এয়ারওয়েজে উড়ে। নিউইয়র্কে তখন সত্যিই খুব চমৎকার আবহাওয়া, নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ।…

গাড়ি পার্ক করে আমি আর আমার স্ত্রী রুমা সাহা নির্দিষ্ট সময়ে জেএফকে এয়ারপোর্টের (JFK Airport) ৪ নম্বর টার্মিনালে (Terminal-4) পৌঁছে গেছি। এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি জলি ও জামাল আবেদীন। জলি নুহাশের মায়ের মামাতো বোন। গত ২০ বছর ধরে হুমায়ূন আহমেদের সাথে এই পরিবারের। সম্পর্ক। আরও দেখি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাব্বির আহমেদ চৌধুরী, কনস্যুলেটের কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ। তাঁরাও এসেছেন। হুমায়ূন আহমেদকে অভ্যর্থনা জানাতে।…

সিঙ্গাপুর থেকে হুমায়ূন আহমেদ রওয়ানা হবেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। এর আগেই মাউন্ট এলিজাবেথ সেন্টারের (Mount Elizabeth Hospital) চিকিৎসকরা চূড়ান্ত করলেন তাঁর শরীরে কোলন ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। এর পরপরই হুমায়ূন আহমেদ স্যার আমেরিকায় আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তারিখটা সম্ভবত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১১। ঢাকা থেকে অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ফোনে হুমায়ূন আহমেদের আমেরিকায় চিকিৎসা এবং সেখানে মেমোরিয়াল স্রোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করার কথা জানালেন। ১১ তারিখ, ই-মেইলে পাঠালেন সিঙ্গাপুরের চিকিৎসার কাগজপত্র। কাগজপত্র হাতে পেয়ে আমি আর দেরি করিনি। গেলাম মেমোরিয়াল হাসপাতালের ১১ তলার আন্তর্জাতিক ইউনিটে। একটা ফরম পূরণ করে কাগজপত্র রেখে এলাম। এর মধ্যে ১০ তারিখ থেকে নিউজার্সিতে বসবাসরত বিজ্ঞানী ও কাউন্সিলম্যান ড. নূরননবী এবং লস এঞ্জেলেস থেকে শংকু আইচ ফোন করে বললেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাকে খুঁজছেন, আমি যেন জরুরি যোগাযোগ করি। আমি সাথে সাথেই নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় (ঢাকার সময় সকাল) ফোন করি। কথা হলো হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সাথে। বললেন, তোমাদের ওখানে আসছি, অনেকদিন থাকতে হবে। এয়ারপোর্টে থেকো। সব ব্যবস্থা করো। এরপর মেহের আফরোজ শাওন ও মাজহারুল ইসলামের সাথেও কথা হলো, প্লেনে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে। এদিকে স্যার প্লেনে ওঠার পরপরই ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ফোন করে জানালেন বিশ্বজিত, হুমায়ূন আসছে, তুমি জানো বোধহয়? বললাম, হ্যাঁ। আমার সাথে কথা হয়েছে। জ্যোতিদা বললেন, হুমায়ূনের চিকিৎসার ব্যাপারে আলমগীর আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আলমগীর রহমান হলেন অবসর প্রকাশনার প্রধান প্রকাশক। ড. পূরবী বসু মেমোরিয়াল হাসপাতালে একটা এপয়েন্টমেন্ট করেছেন ১৫ তারিখে। আমি ড, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে বললাম, মোমোরিয়ল হাসপাতালে আমি গিয়েছিলাম। ড. নূরননবীও যোগাযোগ করেছেন হাসপাতালে। নবী সাহেব বলেছেন, তাঁদের বন্ধু ড. মোসলেহউদ্দীন আহমেদের স্ত্রী ডোরিন চিকিৎসা নিয়েছিলেন মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালে। ড. জাফর ইকবাল তাঁকে ফোন করার পরপরই তিনি মেমোরিয়াল হাসপাতালে যোগাযোগ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ জেএফকে এয়ারপোর্টে কুয়েত এয়ারওয়েজ থেকে নামলেন। একে একে হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত ও মাজহারুল ইসলাম সবাই পার হয়ে এলেন ইমিগ্রেশন। আমরা ফুল দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে অভ্যর্থনা জানালাম। হুমায়ূন আহমেদ সবার সাথেই সৌজন্যমূলক কথা বললেন। কনসাল জেনারেলকে ধন্যবাদ জানালেন। আমরা তার ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে পার্কিং-এ চলে এলাম। হুমায়ূন আহমেদ তখন মনের সুখে সিগারেট ধরিয়েছেন। গাড়িতে ব্যাগ ওঠানো শেষ। হুমায়ূন আহমেদ এবার কার গাড়িতে উঠবেন? বিষয়টি নিয়ে পরে ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ কলামে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিখেছিলেন, নিউইয়র্কে পৌঁছালাম বিকেলে। অ্যাম্বেসি থেকে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে দেখে চমকালাম। অ্যাম্বেসি মণিহার আমার নাহি সাজে। মুক্তধারার বিশ্বজিত গাড়ি নিয়ে এসেছে। নুহাশের মা’র মামাতো। বোন (জলি) থাকেন নিউইয়র্কে। তিনিও গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমি পড়লাম মহাবিপদে। কোন গাড়িতে চড়ব? অ্যাম্বেসি, বিশ্বজিত না জলি?’

হুমায়ূন আহমেদ কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর ছেলে নিনিতকে কোলে নিয়ে আমাদের গাড়িতেই উঠে বসলেন।

এরকম আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ ৭ পর্বের নাটকটি বাংলাদেশে দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে। হুমায়ূন আহমেদের ৩ পর্ব নাটক চলার পর নিউইয়র্কে এসেছেন। বেড়াতে। আসার আগেই আমাকে জানানো হয় এয়ারপোর্টে থাকতে। নির্ধারিত সময়ে আমি আর মুক্তধারা এস্টোরিয়া শাখার কর্মাধ্যক্ষ রফিকুল আলম গেলাম এয়ারপোর্টে। তখন আমাদের ‘হোন্ডা অডিসি’ (Honda Odyssey) ভ্যানটি ছিলো না। ১৯৯৬ মডেলের ‘মাজদা’ (Mazda) চালাতো রুমা। সেটি নিয়েই আমরা গেলাম হুমায়ূন আহমেদকে রিসিভ করতে। তখন নিউইয়র্কে অবসর নামে একটি অডিও ভিডিও প্রতিষ্ঠান ছিলো। ‘অবসর’-এর মালিক শানু খানের সাথে আসাদুজ্জামান নূরের সম্পর্ক ছিলো। তারা একই এলাকার। হুমায়ূন আহমেদ আসছেন জেনে বিরাট একটি লিমোজিন (Limousine) নিয়ে তারা এয়ারপোর্টে হাজির। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ সেদিনও সেই লিমোতে ওঠেননি। আমাদের পুরনো গাড়িতে করেই এসেছিলেন।…

দীর্ঘ বিমান ভ্রমণেও তেমন কোনো ক্লান্তি দেখলাম না হুমায়ূন আহমেদের চোখে মুখে। আমি নিনিতকে কোলে নিতে চাইলাম। নিনিত আমার কোলে এলো না। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার নিনিতকে দেখলাম। বাবার কোলেই পরম স্নেহে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পুত্রের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের স্নেহের ঘটনা এই নতুন নয়। নুহাশ জন্মের পর নুহাশ ও আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ’ নামে বই লিখে প্রথম পুত্র সন্তান হওয়ার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিলেন পাঠকদের সাথে। ১৯৯৪ সালে নুহাশকে কোলে নিয়ে নিউজার্সির হিলটন হোটেলে (Hilton Hotel) মুক্তধারার স্টলে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। আগেরবার নিষাদকে নিয়ে ২০০৯ সালে নিউইয়র্কের বইমেলায় এসেছিলেন। তখন নিষাদকে কোলে নিয়ে রীতিমতো মঞ্চে উঠে অনুষ্ঠান করেছিলেন। আর এবার কনিষ্ঠ পুত্র, বাবার কাঁধে থাকাটাই স্বাভাবিক। মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ আর মাজহারুল ইসলাম উঠেছেন জলি ও জামাল আবেদীনের গাড়িতে। এরমধ্যে বাংলাদেশে ফোন করলেন শাওন। হুমায়ূন আহমেদের মা এবং শাওন তার নিজের মাকে আমেরিকা পৌঁছানোর সংবাদ জানালেন। মাজহারুল ইসলাম যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন সাউন্ডভিউ কর্পোরেশনের পরিচালক সৈয়দ এম হোসেনের সাথে। তারও বোধহয় এয়ারপোর্টে থাকার কথা ছিলো কিন্তু কোনো অসুবিধার জন্য থাকতে পারেননি। তখন ম্যাকডোনাল্ডের ড্রাইভ থ্র থেকে কফি এবং খাবার নিয়ে আমরা যাচ্ছি এস্টোরিয়ার সাউন্ডভিউ গেস্ট হাউসে। এস্টোরিয়া গেস্ট হাউসের সামনে পৌঁছালাম। জানতে পারলাম, ‘দেশ’ টেলিভিশনের পরিচালক ও আসাদুজ্জামান নূর হুমায়ূন আহমেদের জন্য সাউন্ডভিউ গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। নিউইয়র্কে বাসা না নেওয়া পর্যন্ত তারা ঐ গেস্ট হাউসেই থাকবেন। সেখানে গেটে অনানুষ্ঠানিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে অভ্যর্থনা জানালেন সাউন্ডভিউ ব্রডকাস্টিং-এর পক্ষে সৈয়দ এম হোসেন, আবীর আলমগীর, জামান খোন্দকার, রিফাত ই ফারুক, চয়ন রহমান ও তাওহীদুল ইসলাম। সাউন্ডভিউ ব্রডকাস্টিং-এর বিশাল ভবন। এর আগেও দু’একবার গেলাম দোতলায় এবং তৃতীয়তলায়। সেখানে শিল্পীরা এবং দেশ থেকে সাংবাদিকরা এলে থাকতেন জানতাম। কিন্তু সেখানে যে এমন সুন্দর এবং সাজানো গোছানো গেস্ট হাউস রয়েছে জানতাম না। দুটো রুম দেওয়া হলো হুমায়ূন। আহমেদকে। এলিভেটর দিয়ে উপরে উঠে বাম দিকে গিয়ে আবার বামে দুটো রুম পার হয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যখন ঢুকছিলাম তখনই দেখলাম খুব সুন্দর সোফাসমেত লিভিংরুম। সামনে ডাইনিংটেবিল সমৃদ্ধ গেস্ট হাউজের রুমগুলো এক এক করে লাইন ধরে সাজানো। বাম পাশের কর্নারের রুমটি হুমায়ূন আহমেদ পছন্দ করলেন। হাতে একটা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সামনের সোফায় বসলেন। ওখান থেকেই ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং ড. পূরবী বসুকে জানালাম হুমায়ূন আহমেদের পৌঁছার কথা। ড. নূরননবীও ফোন করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ ভালোভাবে পৌঁছেছেন কিনা জানলেন। এর মধ্যে সব ব্যাগ চলে এলো উপরে।

১৫ সেপ্টেম্বর, মেমোরিয়াল হাসপাতালে যাওয়ার বন্দোবস্ত। দুপুর ১টায় বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালে প্রথম চিকিৎসার জন্য হুমায়ূন আহমেদ যাবেন। রাতের খাবারের ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছেন জলি আবেদীন। সকালের নাশতা আনার দায়িত্ব আমাদের। এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ রুমে গেলেন, গোসল করলেন, বিশ্রাম নিলেন।

সন্ধ্যার দিকে গেস্ট হাউসে পৌঁছালেন শিল্পী এস আই টুটুল আর তার এক বন্ধু ইমরুল আহসান হাবীব কচি। তিনি জ্যামাইকা থাকেন, ‘রসনা’ নামে রেস্তোরাঁর মালিক। কিছুক্ষণ পরে এলেন নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের। হুমায়ূন আহমেদ রুম থেকে বের হয়ে এলেন। বললেন, সিগারেট খাবেন। বিশাল ঝামেলা। গেস্ট হাউজের ভেতরে সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই। বিরাট অস্বস্তিতে পড়লেন হুমায়ূন আহমেদ। তারপরও সিগারেট খেলেন। গল্প হলো, সকলে মিলে। রাত ৭টার দিকে আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার স্ত্রী রুমা সাহা থেকে গেলো।

১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় আমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির। এর আগেই হুমায়ূন। আহমেদ উঠে গেছেন। পরোটা, আলু ভাজি, ডিম অমলেট আর বার্গার কিং থেকে হ্যাঁশ ব্রাউন। সাথে অরেঞ্জ জুস। সকলের ব্রেকফাস্ট শেষ। এবার হুমায়ূন স্যার আমাকে হাসপাতালের ফরম পূরণ করার কথা বললেন। ফরমের সব কিছু পূরণ করে শুধু ঠিকানা, ফোন নম্বর আর সন্তানের ঘরগুলো বাকি রাখলাম। হুমায়ূন আহমেদ মেমোরিয়াল হাসপাতালে ঠিকানা ব্যবহারের ব্যাপারে কথা বললেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম, জলি আবেদীন, জামাল আবেদীন, রুমা আর আমার সাথে। ঠিক করলেন জামাল আবেদীনের ঠিকানা ব্যবহার করা হবে। দুটো ফোন নম্বরের একটিতে জামাল আবেদীন, আর একটিতে আমার নম্বর বসিয়ে দিলেন। সন্তানের সংখ্যার ঘরে লিখলেন ছয়। ব্যস, হাসপাতালে যাওয়ার প্রাথমিক কাজ শেষ।

সিঙ্গাপুরে রোগ নির্ণয়

হুমায়ূন আহমেদ মলাশয়ে রক্তপাত দেখতে পেয়ে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ সেন্টারে পরীক্ষা করাতে গিয়েছিলেন। পরীক্ষায় মলাশয়ে ১৪-১৮ সেমি. আকারের টিউমার ধরা পড়ে। ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা করা হয় এবং তার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুরে থাকতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা করাবেন আমেরিকায়। লস এঞ্জেলেস, হিউস্টন এবং নিউইয়র্কের বিখ্যাত হাসপাতালগুলো ছিলো তাদের পছন্দের তালিকায়। এরপর ঢাকায় ফিরেই ৩দিনের মধ্যে রওয়ানা হন নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। স্থির করেন ভর্তি হবেন মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালে।

উৎকণ্ঠিত

হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে চিকিৎসা নিতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীর বাঙালিরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া থেকে শুরু করে লেখকের শুভাকাঙ্ক্ষীরা সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য মুক্তধারায় ফোন করে। অসংখ্য ফোনের খবর হুমায়ূন আহমেদকে জানাবার জন্য মুক্তধারা থেকে একটি রেকর্ড বুক মেন্টেইন করা হয়। প্রতি দু’তিন সপ্তাহ পরপর সেটি হুমায়ূন আহমেদকে জানানো হতো।

মেমোরিয়াল হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট

এই হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট করা নিয়ে ড. পূরবী বসু ‘নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের ক্যানসার চিকিৎসা’ লেখায় উল্লেখ করেন, হুমায়ুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকাশক ও প্রতিবেশী আলমগীর রহমানের কাছে কাকতলীয়ভাবে সংবাদটা জানতে পেরে আমি হুমায়ুনের জন্য তাঁর নিউইয়র্কে পৌঁছার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেমোরিয়াল সোয়েন-কেটারিং (MSKCC)-এ ডাক্তার দেখানোর জন্য একটা এপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করি। এই ব্যাপারে আমার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর রিভলিন আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন। এছাড়া আশি আর নব্বইয়ের দশকে প্রায় এক যুগ ধরে আমি স্লোয়েন-কেটারিংয়ে গবেষণার কাজ করেছি বলে সেখানে একটু আধটু জানাশোনা অবশিষ্ট ছিলো। ডক্টর রিভলিন আমাকে গ্যাস্ট্রোরেন্টেলজি (Gastroenterology) প্রফেসর ও স্লোয়েন-কেটারিংয়ের প্রধান মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডাক্তার ডেভিড কেলসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে বললেন। ডাক্তার কেলসনই তখন বিভাগীয় দায়িত্বে ছিলেন এবং ডাক্তার রিভলিন তাঁকে জানতেন।

হাসপাতালে প্রথম দিন

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১। আমরা দুপুর ১২টায় এস্টোরিয়ার সাউন্ডভিউ গেস্ট হাউসের উপরের তলা থেকে নিচে নামছি। নেমেই সিগারেট ধরালেন হুমায়ূন আহমেদ। সিগারেট শেষ হলো। এবার গাড়িতে উঠবেন। সামনে দুটো গাড়ি। একটি রুমা ড্রাইভ করছে, আর একটি গাড়ি নিয়ে আবেদীন। হুমায়ূন আহমেদ এবারও আমাদের গাড়িতেই উঠলেন। মেহের আফরোজ শাওনও উঠলেন। জামাল আবেদীন মনক্ষুণ্ণ হলেন। মাজহারুল ইসলাম গেলেন আবেদীনের গাড়িতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন মাজহারুল ইসলাম আমাদের গাড়িতে। বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল হাসপাতালে প্রথমদিন যাচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসা করাতে। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, যেন ভালো সংবাদ আসে। গাড়িতে ওঠাকে কেন্দ্র করে এই অনভিপ্রেত ঘটনা নিয়ে কোনো আলোচনাই হলো না। কারণ হুমায়ূন আহমেদ যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন আর কারও কিছু বলার থাকে না। এরই মাঝে গাড়ি থেকে ড. পূরবী বসুর সাথে কথা হলো। বললেন, সব ঠিক আছে। কোনো চিন্তা করবেননা। হুমায়ূন আহমেদ এ বিষয়ে তার নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ কলামে লিখেছেন, আশ্চর্যের ব্যাপার নিউইয়র্কে যেদিন পৌঁছলাম তার পরদিনই ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। ব্যবস্থা করলেন ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের স্ত্রী পূরবী বসু। তিনি নিজেও গল্পকার, এক সময় এই ক্যান্সার সেন্টারের গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। কেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতালে আমার মতো অভাজনের চিকিৎসা হওয়া উচিত তা তিনি লিখে জানালেন। পূরবী বসু এতটা মমতা আমার জন্য লুকিয়ে রেখেছিলেন তা আমার জানা ছিলো না। অকৃতি অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি। এরিখ আনিসুজ্জামান নামে একজন আমেরিকানও ১০ সেপ্টেম্বর ২০১১ সকাল ৯টা ৫৩ মিনিটে চিঠি দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। রোজ কোজেন্স নামে মেমোরিয়াল হাসপাতালের কর্মকর্তাকে হুমায়ূন আহমেদকে চিকিৎসা করাবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তিনি চিঠিটি লিখেন। হুমায়ূন আহমেদ জানলে নিশ্চয়ই এরিখের কথাও তাঁর ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’-এ লিখতেন। ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন এবং বৃহত্তম প্রাইভেট হাসপাতাল এটি। শুরু করেন জন এ এস্টর এবং তার স্ত্রী শার্লোট। ১৮৮৪ সালে নিউইয়র্ক ক্যান্সার হসপিটাল নামে শুরু হয়। ১৮৯৯ সালে ম্যানহাটানের পশ্চিম। আপার সাইডে নাম পরিবর্তন করে হয় জেনারেল মেমোরিয়াল হসপিটাল। ১৯৩৬ সালে হাসপাতালটির স্থান পরিবর্তন করে নতুন ভবন তৈরি শুরু হয় ইয়র্ক এভিনিউতে। জায়গাটি দান করেন জন ড, রকফেলোর জুনিয়র। ১৯৩৯ সালে হাসপাতালটি চালু হয়। ১৯৪০ সালে দুই অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মোটরস এক্সিকিউটিভ আলফ্রেড পি. সোলন এবং চার্লস এফ কেটারিং যোগ দিয়ে এই হাসপাতালটিকে আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বায়ো মেডিকেল রিসার্চ ইন্সটিটিউশন হিসেবে রূপান্তর করেন। এবং ১৯৪৮ সালে তাদের নামকে ডেডিকেট করা হয়। ১৯৬০ সালে মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) ক্যান্সার সেন্টার নামে নতুন কর্পোরেশন করা হয়। ১৯৮০ সালে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে একসঙ্গে হাসপাতালটির কার্যক্রম চলছে। হাসপাতালটির কথা ভাবছি। পৃথিবীর সকল মানুষ এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ছুটে আসেন। আমাদের প্রিয় লেখকও এসেছেন। জন এ এস্টর, তার স্ত্রী শার্লোট, জন ড, রকফেলার জুনিয়র, আলফ্রেড পি.সোলন এবং চার্লস এফ কেটারিং যেন দেবতুল্য মানুষ এঁরা। বিভিন্ন সময়ে বরেণ্য ব্যক্তি পৃথিবীর মানুষের সেবা করার জন্য কী মেমোরিয়াল স্রেয়েন-কেটারিং হাসপাতালের ১১ কীর্তি রেখে গেছেন!

রুমার গাড়ি পার্ক করলো মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালের সামনে। ৩০০ ইস্ট ৬৬ স্ট্রিট, নিউইয়র্ক (300 East 66 St, NY)। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। ১১তলায় বিদেশি রোগীদের চিকিৎসা বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার। তখন দুপুর ১২টা ১৫। ১টায় এপয়েন্টমেন্ট। উলেজ নামে সামনের ডেস্কে কর্মরত ব্যক্তিকে ফরমটি দেওয়া হলো। আমরা অপেক্ষা করছি, বিভিন্ন নিয়ম কানুন শেষ করার জন্য। মেমোরিয়াল শ্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতাল ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের গেস্ট সার্ভিস কো-অর্ডিনেটর করি না মার্মোলেজস একজন অ্যারাবিয়ান ভদ্রমহিলা ভেতর থেকে বের হয়ে ‘আহমেদ’ বলে ডাকলেন। হাতে একটি ফাইল। মেহের আফরোজ শাওন ও আমি ভেতরে গেলাম। চিকিৎসা শুরুর আগেই ১৫০০ ইউএস ডলার জমা দিতে বললেন। জমা দেওয়া হলো নগদ। এরপর আমরা ঐ কক্ষ থেকে বের হয়ে রোগীদের অপেক্ষার স্থানে ফিরে এলাম। টাকা জমা দেওয়া হলো। কঠোর প্রকৃতির ভদ্রমহিলা জানালেন, অন্যান্য চিকিৎসা শুরুর আগেই অগ্রিম বিল পরিশোধ করতে হবে। মেহের আফরোজ শাওন বললেন, তাই হবে। তুমি পরবর্তী ব্যবস্থা করো। আমরা তৈরি আছি। ডা. ভিচের সহকারি এসে আমাকে বললেন, আহমেদ তুমি অপেক্ষা করো, সময় হলে ডা. ভিচ তোমাকে ডাকবেন। হুমায়ূন আহমেদের তাৎক্ষণিক রসিকতা শুরু হয়ে গেছে তখন। এদিকে হাসপাতালে পৌঁছালেন সঙ্গীতশিল্পী এসআই টুটুল। আমেরিকায় গ্রীষ্মকালে গান করতে আসেন। হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটক-চলচ্চিত্রের সুরকার ও প্লেব্যাক সিঙ্গার। টুটুলকে হুমায়ূন স্যার বললেন, ডাক্তার তো কিছুক্ষণ আগে বিশ্বজিতকে নিয়ে যাচ্ছিলো কেমো দেওয়ার জন্য। কেমো দেওয়া রোগীদের চুল পড়ে যায়। বিশ্বজিতের মাথায় তো চুল নেই। তাই ডাক্তার বুঝেছে, সেই আহমেদ। আমরা কোনোভাবে ডাক্তারকে আটকালাম। অনেক বলে-কয়ে ডাক্তারকে বিরত করলাম, ও হুমায়ূন আহমেদ নয়। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার স্টিফেন আর ভিচ এবার সত্যি সত্যিই হুমায়ূন

আহমেদকে ডাকলেন। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম ডা. স্টিফেন ভিচের কাছে গেলেন। ডাক্তার সিঙ্গাপুর থেকে আনা সব কাগজপত্র দেখলেন। সিঙ্গাপুরে করা ক্যাট স্ক্যান রিপোর্ট দেখলেন। কাগজপত্র দেখে সিঙ্গাপুরের ডাক্তারদের মতো ডা. ভিচও নিশ্চিত হলেন হুমায়ূন আহমেদের কোলন ক্যান্সার চতুর্থ স্টেজে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে ছয়টি কেমো দেওয়া হবে। তাঁর কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে না। তবে তিনি তখন সিঙ্গাপুর থেকে ক্যাট স্ক্যান এর প্লেটটি আনাতে বললেন। ড. ভিচের সহযোগী সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল থেকে আনা কাগজপত্রগুলো ফটোকপি করে রেখে দিলেন। সিঙ্গাপুরের ল্যাব এবং স্থানীয় যোগাযোগের নম্বর নিলেন ডা. ভিচের সহযোগী। এদিন ডাক্তার ভিচের নির্দেশে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যথাক্রমে: Electrocardiogram, Venipuncture, Comprehensive Metabolic Pan, Carcinoembryonic Antigen (C, Hepatitis Bc Antibody, Hepatitis Bs Antigen, Cbc W/ Automated Different, Partial Thromboplastin Time, Prothrombin T হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সহজাত ভঙ্গিতে হাস্যোজ্জ্বল। মেহের আফরোজ শাওন ও মাজহারুল ইসলাম কিছুটা গম্ভীর। ড. স্টিফেন ভিচ হলেন। মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালের আন্তর্জাতিক ইউনিটের প্রধান। স্টিফেন আর ভিচ সম্পর্কে হাসপাতালের ওয়েবসাইটে তিনি নিজেই বলছেন, আমি সিনিয়র মেডিকেল অনকোলজিস্ট এবং লাং ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং ক্যান্সারের অজানা দিকগুলো উন্মোচন করায় বিশেষ পারদর্শী। এছাড়া তিনি ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসার পদ্ধতি বা ধাপগুলো নির্ধারণ করতে সহায়তা করেন। এই স্টিফেন ভিচের কাছেই হুমায়ূন আহমেদ তাঁর চিকিৎসা করাতে এসেছেন।

এবার চিকিৎসক কী বললেন এবং সে সময় হুমায়ূন আহমেদের অনুভূতির কথা তাঁর নিজের মুখেই শুনুন।

আমার ডাক্তারের নাম স্টিফেন আর ভিচ। দীর্ঘদেহী সুস্বাস্থ্যের বয়স্ক একজন মানুষ। খানিকটা গম্ভীর। ভুরু কুঁচকানো। তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সব কাগজপত্র পরীক্ষা করলেন। ওই হাসপাতাল থেকে মূল স্লাইড তলব করলেন। আমি একসময় বললাম, আমার ক্যান্সার কোন পর্যায়ের? ডাক্তার বললেন, চতুর্থ পর্যায়ের। ক্যান্সার যখন মূল কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে তখন আমরা তাকে বলি চতুর্থ পর্যায়ের ক্যান্সার।

ভীত গলায় বললাম, ডাক্তার, আমি কি মারা যাচ্ছি?

ডাক্তার ভিচ নির্বিকার গলায় বললেন, হ্যাঁ।

শাওনের দিকে তাকিয়ে দেখি সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। আমি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ডা. ভিচ হঠাৎ আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, তুমি একা তো মারা যাচ্ছ না। আমরা সবাই মারা যাচ্ছি। এই কারণে বললাম তুমি মারা যাচ্ছ। তবে খুব দ্রুত যে মারা যাবে সে রকম মনে হচ্ছে না। রোগের বাইরে ডাক্তারের সঙ্গে অনেক কথা হলো। ডাক্তার বললেন, তুমি পেশা কেন বদলেছ? ছিলে কেমিস্ট, হয়েছ লেখক। আমি বললাম, পৃথিবীতে অনেক কেমিস্ট আছে, সে তুলনায় লেখক কম বলেই পেশা বদলেছি। আমার ছেলেও কেমিস্ট। তার কেমিস্ট্রিতে তোমার মতো পিএচডি ডিগ্রি আছে। লেখালেখির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার কি কোনো বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে? আমি বললাম, হয়েছে। তবে তোমার জন্য আমি আমার নিজের ভাষা বাংলায় লেখা বই নিয়ে এসেছি। এই বইয়ে কী লেখা তুমি কিছুই বুঝবে না। তুমি যদি বইটা তোমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখো, তাহলে আমার ভালো লাগবে। বইটার দিকে চোখ পড়লেই তোমার মনে হবে, অতি দূর দেশের বাংলা ভাষার এক লেখককে তুমি চিকিৎসা দিয়েছিলে।

ডাক্তার ভিচের হাতে বাদশাহ নামদার উপন্যাস তুলে দিলাম। তিনি বই হাতে নিয়ে বললেন, এই বই আমি আনন্দের সাথে আমার লাইব্রেরিতে রেখে দেব। শাওন একটু পরপর কেঁদে উঠছিল। ডাক্তার একসময় শাওনের পিঠে হাত রাখলেন। ভরসার এই স্পর্শ শাওনের জন্যে প্রয়োজন ছিলো। প্রথমদিন ড. ভিচের কাছে দেখানোর পর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখা ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ কলামে এই কথাগুলো লিখেছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর, হুমায়ূন আহমেদ সাউন্ডভিউ গেস্ট হাউস থেকে জ্যামাইকায় ভাড়া করা বাসায় উঠলেন।

এরমধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর মেহের আফরোজ শাওন ও মাজহারুল ইসলামকে গিয়ে ৪,৫১০ ইউএস ডলার নগদ জমা দিয়ে আসতে হয়। কেননা ২১ সেপ্টেম্বর এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করার আগেই তাদের টাকা জমা দিতে হয়। তারপর আরও বলে দেওয়া হয়, ৬টি কেমোথেরাপির টাকা অগ্রিম জমা দেওয়ার জন্য। এরপর ড. পূরবী বসু যোগাযোগ করে কিস্তিতে টাকা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মেমোরিয়াল শ্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে ১ম কেমোথেরাপি দেওয়া হবে। ২১ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়-হুঁমায়ূন আহমেদ থেরাপি দেওয়ার মতো অবস্থায় আছেন কিনা। তাছাড়া এদিন হুমায়ূন আহমেদকে কেমো দেওয়ার জন্য মেডিপোর্ট (Port/Reserv/Venous Access D) বসানো হয়। প্রথমে হুমায়ূন আহমেদ কিছুটা নার্ভাস ছিলেন। বুকের চামড়ার ভেতরে এই পোর্টটি বসানো হয়। যাতে করে যতবারই কেমো দেওয়া হয় তাঁকে আর নতুন করে সুই কুঁড়তে হয়নি। এই মেডিপোর্ট-এর মধ্য দিয়ে তাঁর শরীরে ক্যান্সার নিরোধক ওষুধ প্রবেশ করে। এছাড়া কেমো দেওয়ার বিষয়ে সবকিছু হুমায়ূন আহমেদকে জানানো হয়। এদিন হুমায়ূন আহমেদের সাথে মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম, জামাল আবেদীন আর আমি ছিলাম। Midazolam Injection 2 mg, Fentanyl Injection 100 mc, Fluor Guid Cuad Plc/Rep/Rem, US Guide for Vasc Access, Electrocardiogram, PACU SDH up to 2 hrs, Ins Cn Tun Cvacc W/S Pt> 5y, Glucose Check via Meter, ব্লাড প্রেশারসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা করার জন্য হুমায়ূন আহমেদকে মেমোরিয়াল হাসপাতালে আসতে হয়। জামাল আবেদীনের গাড়ি পার্ক করাই ছিলো। সকলে গাড়িতে চলে যায় সাউন্ড ভিউ গেস্ট হাউসে। আমি চলে যাই সাবওয়েতে জ্যাকসন হাইটসে (Jacson Heights)। এর আগে হাসপাতালে জমা দিতে হয় ১৩,০০০ ইউএস ডলার নগদ এবং ১০,৮০০ ডলার মাস্টার কার্ডে। এদিন ইলেকট্রনিক্স ট্রান্সফার করে পেমেন্ট করা হয় আরো ৬,৫৪৭ ডলার। মোট ৩০,৩৪৭ ডলার।

২২ সেপ্টেম্বর হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম এবং আমি রুমার গাড়িতে করে মেমোরিয়াল হাসপাতালে পৌঁছি সকাল ৯টায়। এর মধ্যে জামাল আবেদীনও এসে পৌঁছেছেন। আজ হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কেমোথেরাপি। যে যার মতো প্রার্থনা করছে। সব যেন মঙ্গলমতো হয়। ব্লাডপ্রেশার, ওজন মেপে আগের দিনের রিপোর্ট দেখে হুমায়ূন আহমেদকে অপেক্ষা করতে বললেন নার্স। সব কিছু ঠিকঠাক থাকার পর ফার্মেসিতে কেমো দেওয়ার জন্য মেডিসিন তৈরি হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে নিয়ে গেলো হুমায়ূন আহমেদকে। শাওন সাথে গেলেন। এদিন তাকে যেসব ওষুধ এবং কেমো দেওয়া হয় তাহলো Dexametha Tablet 4 mg Quantity 48, Palonosetron 250.000 mc, Pump Dosi-Fuser, Fluorouracil 400 mg, Fluorouracil 650 mg, Leucovorin Ca 650 mg, Oxaliplatin 140 mg, Chemo, Intra, Push EA Addt Dr, Chm IV Inf, <1 hr, Sngl or Int, IV Inf, Th/Pr/Dx Cncrnt Inf, Chm IV Inf, EA Addl Hr, Ref & Maintance of Portable P, Thr, Prp, Dx Inj, Add Sq IV Pu.

আমরা অপেক্ষা করছি। প্রায় ১৫ মিনিট পর মেহের আফরোজ শাওন বেরিয়ে এলেন। সবকিছুই ভালোভাবে চলছে। আমরা এক এক করে হুমায়ূন আহমেদকে দেখে এলাম। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর হুমায়ূন আহমেদকে তৈরি করা হয় বাসায় পাঠানোর জন্য। কেননা আগামী দুদিন এই ওষুধটি হুমায়ূন আহমেদের শরীরে যাবে। তাই একটি বোতলের মতো পাত্রে (ক্যানিস্টার) ঢুকিয়ে হুমায়ূন আহমেদের পেটের উপর একটা ব্যাগে বেঁধে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হলো, কোনো অসুবিধা হলে হাসপাতালের জরুরি নম্বরে ফোন করতে। নতুবা সরাসরি নিউইয়র্ক এভিনিউর জরুরি বিভাগে চলে আসতে হবে। প্রথম কেমোথেরাপি শেষ হলে ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক এভিনিউর মূল শাখায় গিয়ে খালি হয়ে যাওয়া ক্যানিস্টারটা খোলা হলো। হুমায়ূন আহমেদ অনেক স্বস্তিবোধ করা শুরু করলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ দুপুরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখতে যান হুমায়ূন আহমেদকে তার জ্যামাইকার বাসায়। এ সময় শেখ হাসিনা তাকে এক গুচ্ছ ফুল উপহার দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের আশির্বাদ ও শুভেচ্ছা বহন করে এনেছি আপনার রোগ মুক্তির জন্যে। শেখ হাসিনা হুমায়ূন আহমেদকে চিকিৎসার যাবতীয় সহায়তা প্রদানের অঙ্গিকার করে ১০ হাজার ডলারের একটি চেক প্রদান করতে চান। হুমায়ূন আহমেদ তা নিতে অপারগতা। প্রকাশ করলে তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও আশির্বাদের প্রতীক এটি, তাই গ্রহণ করা উচিত। আমরা সেটি সানন্দে গ্রহণ করলাম। শেখ হাসিনা জানতে চান তার শারীরিক অবস্থা। জবাবে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আপনার উপস্থিতিতে আমার রোগের অনেকটা উপসম অনুভব করছি। আমি স্বস্তি পাচ্ছি। জনগণের যে আশির্বাদ আপনি বয়ে এনেছেন, তা থেরাপির চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর বলে মনে হচ্ছে। শেখ হাসিনার সাথে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ এফ এম রুহুল হক এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে এ মোমেন। ২৪ সেপ্টেম্বরই ঠিক হয় প্রধানমন্ত্রী হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের পক্ষ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হলে তখন আমি বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিই। তখন মেহের আফরোজ শাওন এবং মাজহারুল ইসলামের ফোন নম্বর দিয়ে দিই। হুমায়ূন আহমেদকে বিষয়টি ফোনে জানাই। কিন্তু তখনো বলা হয়নি প্রধানমন্ত্রী দেখতে যাবেন হুমায়ূন আহমেদকে। তাদের ধারণা ছিলো ম্যানহাটানের কোনো হাসপাতালে হুমায়ূন। আহমেদ চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

১ম কেমোথেরাপি দেওয়ার পর ২৬ সেপ্টেম্বর ড. স্টিফেন ভিচ আবার দেখেন হুমায়ূন আহমেদকে। এদিন Colon Malignancy ও বায়োপসি করা হয়। a yt Qltative Mass Spectrometry, Mut Id Enzym Ola/Sbce OR As, Mol Dx Lysis Prior Nuc Extr, Mol Dx Amp Nuc Aci Ini 2 Nu, Extract Nucleic Acid পরীক্ষা করা হয়। ৬ অক্টোবর চূড়ান্ত করা হলো দ্বিতীয় কেমোথেরাপির তারিখ।

২৭ সেপ্টেম্বর হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আমার ই-মেইলে জাপানের নাগাসাকি স্কুলের প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আরিফা নাজনিন এমবিবিএস-এর পাঠানো দোয়া সেন্ড করেন। জাপান থেকে মেইলটি ড. আরিফা ড. জাফর ইকবালকে পাঠান। ড. জাফর ইকবাল আমাকে পাঠালে আমি সেটা হুমায়ূন আহমেদকে সাথে সাথে পৌঁছে দিই। হুমায়ূন আহমেদ এই দোয়া পড়তেন। হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে নাট্যশিল্পী জামাল উদ্দীন হোসেনসহ অনেকেই এই দোয়াটি নিয়েছেন। আমি হুমায়ূন আহমেদকে তিনবার এই দোয়ার প্রিন্ট দিয়েছি।

হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে চিকিৎসা করানোর আগে থেকে ড. জাফর ইকবাল ড. নূরননবীসহ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করেছেন তাঁর ভর্তির ব্যাপারে। বিভিন্ন কেমোথেরাপির পর তাঁর সাথে আমার ই-মেইলে যোগাযোগ ছিলো। এবং তা হুমায়ূন আহমেদকে আপডেট করতাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে দাদাভাইকে (হুমায়ূন আহমেদ) দেখার সংবাদ বাংলাদেশে প্রকাশিত হওয়ার পরও ড. জাফর ইকবাল ই-মেইলে জানান, প্রধানমন্ত্রী সুন্দর মনের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ খবরও জানতে চান। অক্টোবরের ১০ তারিখ। ৪,৯৪৫.৫৬ ডলার ট্রান্সফার করে পেমেন্ট করা হয়। ৬ অক্টোবর হুমায়ূন আহমেদকে ২য় কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এদিন কেমোথেরাপির সময় রোগীর সামান্য কোষ্ঠকাঠিন্য লক্ষ করা গেছে। তবে ওষুধ গ্রহণসহ সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলে। রোগীর লিভার রোগের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং Fluorouracil 400 mg, Fluorouracil 650 mg, Leucovorin Ca 650 mg, Oxaliplatin 140 mg, Thr, Prp, Dx Inj, Add Sq IV Pu, Outpt Visit-Est Pt-Lvl 1, Venipuncture, Comprehensive Metabolic Pan, Carcinoembryonic Antigen (C), Cbc W/ Automated Differenti, Chemo, Intra, Push Ea Addt Dr, Chem IV Inf > 8hrs Rqrng Pu, Chm IV Inf, <1hr, Sngl OR Int, IV Inf, Th/Pr/Dx Cncrnt Inf, Chm IV Inf; Ea Addl Hr, Dexametha 4 mg Tablet Quantity 48, Palonosetron 250 mc, Pump Dosi-Fuser 0. কেমো নেওয়ার পর যথারীতি তাকে ক্যানস্টারসহ বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ৮ অক্টোবর তা আবার খোলা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দুসপ্তাহ পর রোগীর তৃতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিন হুমায়ূন আহমেদ, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে জ্যামাইকা থেকে মুক্তধারার কর্মী শাহীন আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে আসে। এদিন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম প্রকাশক খান ব্রাদার্স-এর পুত্র আমেরিকায় বসবাসকারী চিকিৎসক তার সাথে হাসপাতালে দেখা করেন। অক্টোবরের ১২ তারিখ Molecular Pathology Report দেওয়া হয়। অক্টোবরের ১৮ তারিখে জমা দেওয়া হয় ২৮,৩৬৯ ইউএস ডলার হাসপাতালে ট্রান্সফার করে জমা দেওয়া হয়।

২১ অক্টোবর। ৩য় কেমোথেরাপির আগে হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা Folfox আজ শুরু হবে। রোগী মলাশয়ে কোনো সমস্যা অনুভব করছেন না এবং রক্তপাতের কোনো সমস্যা হয়নি। সেদিন মেমোরিয়াল হাসপাতালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। লেখকের লেখালেখি অব্যাহত রয়েছে। এদিন হুমায়ূন আহমেদকে দেখা সংক্রান্ত ড. ভিচ তাঁর পরিকল্পনায় উল্লেখ করেন, প্রফেসর আহমেদ প্রথম দুটো Cycle সহ্য করতে পেরেছেন। তাঁর টিউমার মার্কার সংকীর্ণ হয়ে আসছে এবং তার মলাশয়ে নতুন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাতে চিকিৎসক তার তৃতীয় থেরাপি শেষে ৪র্থ থেরাপির বিষয়টিও চূড়ান্ত করেন। তবে পরবর্তী কেমোথেরাপির আগে রোগীর সহ্য ক্ষমতা যাচাই করা হবে। সেদিন হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ, শাওন, রুমা, মাজহারুল, জামাল ও আমি উপস্থিত ছিলাম।

৫ নভেম্বর, ২০১১ ছিলো ঈদের দিন। সেদিন তার ইচ্ছে ছিলো মসজিদে গিয়ে ঈদের নামজ পড়বেন। সকালেই পিতা ও দুই পুত্র একইরকম নীল পাঞ্জাবি পরে বাসায় ঈদ ঈদ ভাব নিয়ে এসেছেন। বাসায় রান্না হয় বিরিয়ানী, গরুর ভুনা, চিকেন ও নানাবিধ হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের খাবার। এদিনই হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে আসেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। ড. ইউনুসের সাথে ৪০ মিনিট সময় অতিবাহিত করেন হুমায়ূন আহমেদ এবং তাকে তার কয়েকটি বই উপহার দেন। তাঁর সাথে ছিলেন ড. আবুল কাসেম, ড. শওকত আলী ওহাইও (Ohio) থেকে আগত ড. মোহাম্মদ আলী দম্পতি এবং কাজী আশরাফ হোসেন। ড. শওকত আলী ও কাজী আশরাফ হোসেন ড. ইউনুসের পক্ষ থেকে মুক্তধারায় যোগাযোগ করলে হুমায়ূন আহমেদের বাসার ঠিকানা ও মেহের আফরোজ শাওনের ফোন নম্বর দেওয়া হয়।

৭ নভেম্বর, ৪র্থ থেরাপি দেওয়ার আগে চিকিৎসক জানান, তিনি আগের Cycle সহ্য করার পাশাপাশি তা কার্যকর হচ্ছে। ডায়েবেটিকের কারণে রোগীর ব্লাড সুগার এলিভেটেড। ৪র্থ থেরাপির পর পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয় ৪র্থ থেরাপির পর পুনরায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিন নির্ধারিত সময় থেকে এক ঘণ্টার মতো সময় বেশি লাগে। আমি বেলভ্যু হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পরও আরো ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় হুমায়ূন আহমেদকে বাড়ি পাঠানোর জন্য তৈরি করতে। শাওন আর আমি উপস্থিত ছিলাম কেমো নেওয়া পর্যন্ত। এরপর হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনকে রুমা জ্যামাইকার বাসায় নিয়ে যায়। ড. নাসির জমাদার, হুমায়ূন আহমেদের জাপানি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের অনুবাদক। তিনি হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে এলেন নিউইয়র্কে। ছিলেন কয়েকদিন হুমায়ূন আহমেদের বাসায়। খুবই উৎসাহ নিয়ে এলেন আবার ফিরেও গেলেন অদ্ভুতভাবে। ১৩ নভেম্বর ছিলো হুমায়ূন আহমেদের ৬৪তম জন্মদিন। ঘটা করে কিছু করা না হলেও বাসায় আগের দিন থেকে জন্মদিনের আবহ তৈরি হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আসেন অন্যপ্রকাশের অন্যতম পরিচালক মাসুম রহমান। বাড়িতে আছে। মেহের আফরোজ শাওনের বোন সেঁজুতী আর মা তহুরা আলী। নিচের তলায় লেখকের ভক্ত, শুভার্থীদের জন্য একটা মন্তব্যের খাতা রাখা হয়েছে। দুপুরে ভালো রান্নাবান্না। ১২ নভেম্বর রাত ১২-০১ মিনিটে কেক কাটা হলো। একটি কেক এলো চ্যানেল আই’র। আর একটি আনেন জামাল আবেদীন। রুমা মিষ্টান্ন নিয়ে এলো। তারপর হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সাথে স্কাইপির মাধ্যমে জন্মদিন পালন। পরের দিন ১৩ নভেম্বর মুক্তধারায় সারাদিনব্যাপী পালিত হলো লেখকের জন্মদিনের অনুষ্ঠানমালা।

২৮ নভেম্বর ২০১১। মেমোরিয়াল হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ ৫ম কেমোথেরাপি গ্রহণ করেন। এটিই ছিলো এই হাসপাতালে সর্বশেষ থেরাপি। এদিন থেরাপি নেওয়ার আগে ড. ভিচ হুমায়ূন আহমেদের সিটিস্ক্যান পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি বললেন, কেমোথেরাপি শরীরে কার্যকর হচ্ছে। এদিন হুমায়ূন আহমেদ আর মেহের আফরোজ শাওনকে জ্যামাইকা থেকে নিয়ে এলো রুমা সাহা। আমি জ্যাকসন হাইটস থেকে তাদের সাথে একত্রিত হয়ে মেমোরিয়াল হাসপাতালে গেলাম। বিকেলে মুক্তধারা কর্মী শাহীন মিয়া এসে হুমায়ূন আহমেদকে জ্যামাইকায় পৌঁছে দেয়। নভেম্বরের ২৩ তারিখ জমা দেওয়া হয় ২৩,২১৬ ইউএস ডলার।

কেমোথেরাপির পরের দিন যখন মেডিসিন খোলার জন্য আবার যেতে হতো ১২৭৫ ইয়র্ক এভিনিউতে, তখন বেশিরভাগই শাহীন মিয়া এবং রুমা সাহা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আসতো। জামাল আবেদীনও গিয়েছিলো বেশ কয়েকদিন। এসেছিলেন গাজী কাশেমও। ক্যানিস্টার খোলার দিন আমি মাত্র একবার এসেছিলাম। তাও সেদিন মাজহারুল ইসলাম ছিলেন না নিউইয়র্কে। এছাড়া দু’তিনবার রুটিন চেকআপের সময় হুমায়ূন আহমেদ এবং আমি, মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম সাবওয়েতে করেও মেমোরিয়াল হাসাপাতালে যাতায়াত করেছি। সাবওয়েতে অনেক বাঙালি হুমায়ূন আহমেকে দেখে অবাক-বিস্মিত হয়েছেন। কেউ কেউ কাছে এসে কথাও বলতে চেয়েছেন। ফলোআপ চেকআপের সময় তিনি বার্নস এন্ড নভেলে গিয়ে বই কিনতেন। পছন্দ করতেন হাসপাতালের পাশে ‘রেইন’ নামের রেস্তোরাঁর স্যুপ এবং ফ্রাইড আইসক্রিম।

কম মাত্রার ANC এবং Plt থাকার ফলে ১২ ডিসেম্বর মেমোরিয়াল হাসপাতালে ৬ষ্ঠ থেরাপিটি স্থগিত করা হয়। তবে এদিন ফলোআপ ভিজিটে ডা. ভিচের সাথে আলোচনা করা হয় ১৪ ডিসেম্বর থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে স্থানান্তরের বিষয়টি। একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি মত দেন। এ ব্যাপারে ড. পূরবী বসু ডা. ভিচের সাথে ই-মেইলে বিশদভাবে আলোচনা করেন। মেহের আফরোজ শাওন এবং হুমায়ূন আহমেদ এদিন ডা. ভিচের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করেন। ডা. ভিচকে জানানো হয় আর্থিক কারণে হাসপাতাল পরিবর্তন করতে হচ্ছে। তবে যে কোনো বিষয়ে তার পরামর্শ নেওয়া হবে। নিয়মিতভাবে চিকিৎসা বন্ধ করা হলেও ডা. ভিচের সাথে ড. পূরবী বসু যোগাযোগ রাখতেন। বেলভ্যু হাসপাতালের সিলভিয়া জেইন যখন এবাস্টেন মেডিসিনটি হুমায়ূন আহমেদকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখনও ডা, ভিচের সাথে যোগাযোগ করেন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিন ডা. জেইনের ই মেইল ও ফোন নম্বর আমি পূরবী বসুকে পাঠিয়ে দিই যাতে সহজে বেলভ্যু হাসপাতালের ডাক্তারের সাথে ড. ভিচের যোগাযোগ হয়। সেদিন হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, রুমা সাহা এবং আমি অনেকক্ষণ মেমোরিয়াল হাসপাতালে ছিলাম। পরে আমরা জাপানি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করি। সেখানে ছিলো হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ফ্রাইড আইসক্রিম। মেমোরিয়াল হাসপাতালে আসার দ্বিতীয় দিন এই হাসপাতালে প্রথম হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন ও মাজহারুল ইসলামসহ এই রেস্তোরাঁয় প্রথম খেতে এলাম। সেদিনই প্রথম আমি ফ্রাইড আইসক্রিম খাই। ডিসেম্বর মাসে পূরবী বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত নিউইয়র্কে বেড়াতে আসেন। তখন তারা একদিন থাকেন হুমায়ূন আহমেদের বাসায়। সেপ্টেম্বরে হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকায় চিকিৎসা করাতে আসার পর মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে নিত্যদিনের শুভার্থী পূরবী বসুর সাথে আমেরিকায় প্রথম দেখা হলো হুমায়ূন আহমেদের। আরও দু’দিন তারা। বেড়াতে যান হুমায়ূন আহমেদের বাসায়। ২৫ ডিসেম্বর, ক্রিসমাস ট্রি এনে দিলেন হুমায়ূন আহমেদকে জামাল আবেদীন। হুমায়ূন আহমেদের গাছপ্রীতি সকলেরই জানা। আমেরিকায় ক্রিসমাস উপলক্ষে ট্রি কিনে তা সাজালেন তারা। খুবই আনন্দ পেয়েছিলেন ক্রিসমাস ট্রি দেখে। ছবিও তুলেছিলেন সেদিন। বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা চলার পরও মাঝে মাঝে চিকিৎসার বিষয়ে ডা. ভিচের পরামর্শ নিতেন শাওন ও পূরবী বসু। এদিকে ৬ষ্ঠ কেমোথেরাপির জন্য মেমোরিয়াল হাসপাতালে অগ্রিম টাকা জমা রাখা হয়েছিলো। যদি কখনো হুমায়ূন আহমেদকে আবার চিকিৎসা করাতে মেমোরিয়াল হাসপাতালে আনার প্রয়োজন হয়, তাই টাকাটা ওঠানো হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ যখন মৃত্যুর সাথে লড়ছেন বেলভ্যু হাসপাতালে, তখনই হাসপাতাল থেকে জমা টাকাটা তুলে নেওয়া হয়। তখন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে আর মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিতে হবে না।

বেলভ্যু হাসপাতাল (Bellevue Hospital)

হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় কেমোথেরাপি হবে ২১ অক্টোবর। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলামকে জ্যামাইকা বাসা থেকে নিয়ে আমরা মেমোরিয়াল হাসপাতালে পৌঁছালাম। মুক্তধারা’র সহযোগী শাহীন মিয়া আমাদেরকে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিলো। আমরা এলিভেটরে করে তৃতীয় তলায় গেলাম। সেখানে প্রথমে ব্লাডপ্রেশার, ওজন মাপাসহ আনুষঙ্গিক রেগুলার চেকআপ করা হলো। হুমায়ূন আহমেদ এসে সোফায় বসলেন। নানা কথা হচ্ছিল। হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ তার ডানদিকের চোখের নিচ দেখিয়ে বললেন, বিশ্বজিত এদিকটা খুব কালো হয়ে যাচ্ছে। একজন ডারমাটোলজিস্ট (Dermatologist) দেখানো দরকার। এপয়েন্টমেন্ট করো। আমি বললাম, শুধু ডারমাটোলজিস্ট নয় আপনার হার্টেরও ফুল চেকআপ করা দরকার। এবার যেহেতু থাকতে হবে কিছুদিন, পুরো শরীর চেকআপ করে যাবেন। কথাটা হুমায়ূন আহমেদের ভালো লাগলো। আহমেদ’ বলে নার্স ডাকলো। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ভেতরে গেলেন শাওন। কেমোথেরাপি দেওয়া শুরু হলো। আধঘণ্টা পর আমি একবার ভেতরে গেলাম। অনেকটা স্বাভাবিক। প্রথম দুটো কেমোথেরাপি নেওয়ার পর ভয়টা কেটে যায়। যারা বাইরের পেশেন্ট, তৃতীয় তলার একটা বড় কক্ষের মধ্যে ছোট ছোট রুমে তাদের কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। ৫৩ স্ট্রিট এবং লেকজিনটন এভিনিউ (53 St, Lexington Ave) হলো স্লোয়েন-কেটারিং মেমোরিয়াল হাসপাতাল। ২৮ স্ট্রিট এন্ড ১ম এভিনিউ (28 St 1st Ave) হচ্ছে বেলভ্যু হাসপাতাল। আমি মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে নেমেই নিচে ৬ ট্রেন ধরে ২৮ স্ট্রিট চলে যাই। ডারমোটলজিস্ট এপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আগামী দুমাসের মধ্যে কোনো এপয়েন্টমেন্ট নেই। হুমায়ূন আহমেদের আগে যে মেডিকেল রেকর্ড ছিলো, তার খোঁজ নিলাম। নাম ও জন্ম তারিখ দিলাম। সাধারণত হাসপাতাল কোনো রোগীর ইনফরমেশন অন্য কাউকে দেয় না। আমাকেও দেয়নি। ১৯৯৬ সালের রেকর্ড খুঁজে বের করতে হবে। যাতে তাঁকে হাসপাতালে গিয়ে বসে না থাকতে হয়। তাই আমি আর দেরি না করে মেমোরিয়াল হাসপাতালে ফিরে যাই। আমি যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। আমি নিজে থেকে কিছু বলিনি। এলিভেটরে নামতে নামতে হুমায়ূন আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ। বেলভ্যু হাসপাতালে যাওয়ার কথা বললাম।

আগে থেকেই সামনে মুক্তধারার কর্মী শাহীন মিয়া দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ি নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ, শাওন, মাজহারুল ইসলামসহ আমরা গাড়িতে উঠলাম। ম্যানহাটান থেকে জ্যামাইকা যাওয়ার পথে গ্রান্ড সেন্ট্রালে ওঠার আগে আমি জ্যাকসন হাইটস নেমে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ যাওয়ার পথে ‘আনন্দবাজার’ গ্রোসারি থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা পদ্মার ইলিশ নিয়ে গেলেন। হুমায়ূন আহমেদের পুরনো ফাইল খুঁজে বের করলাম মেডিকেল নম্বর। পরদিন আবার গেলাম বেলভ্যু হাসপাতালে। রুমারও একটা এপয়েন্টমেন্ট ছিলো। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো, আগের মেডিকেল একাউন্টটি ইন-এ্যাকটিভ হয়ে গেছে। কোনো তথ্য হাসপাতালে নেই। সেদিন হাসপাতাল থেকে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেছে। বিষয়টা রুমার সাথে আলাপ করলাম। রুমা বলল, ওর মা বীণা চৌধুরীর একজন পরিচিত লোক আছেন বেলভ্যুতে কাজ করেন। কোন বিভাগে বা কোন ফ্লোরে কাজ করেন রুমা জানে না। রুমার মা’কে ফোন করা হলো। তাঁর কাছে ফোন নম্বর নেই। বললেন, রুমার বাবা জানেন। আমরা বাসায় চলে এলাম। ২১ অক্টোবর হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় কেমোথেরাপির দিন আমি সরাসরি চলে গেলাম মেমোরিয়াল হাসপাতালে। উপরে না উঠে আমি হাসপাতালের গেটেই অপেক্ষা করছি। গাজী কাশেম গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিলেন হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনকে। একটু বরফ পড়েছিলো। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। হুমায়ূন আহমেদ হ্যাট, জ্যাকেট পরে গাড়ি থেকে নামলেন। তৃতীয় তলায় কেমো নেওয়ার সেকশন। পেমেন্ট আগেই করা ছিলো। যথারীতি প্রথমে নার্স প্রেশার এবং ওজন পরীক্ষা করলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিয়ে গেলেন কেমো দেওয়ার রুমে। ২১ অক্টোবর, ৩য় কেমোথেরাপি নেওয়ার সময় কেমোর খরচের বিষয়টি প্রথম আলোচিত হয়। ক্যাট স্ক্যান (বাংলাদেশে CT Scan নামে পরিচিত) করাতে খরচ হয় মেমোরিয়াল হাসপাতালে ১,৫০০ ডলারের মতো। আর বাইরে করা যায় ৩০০ ডলারে। বিষয়টি নিয়ে ডা. ভিচের সাথে কথা বললেন শাওন। তিনি বললেন, যে কোনো ক্লিনিক থেকেই করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে দোশী ডায়গনস্টিক সেন্টারে (Doshi Diagnostic Imaging) ক্যাট স্ক্যান করা হলো। সে রিপোর্ট জমা দেওয়া হলো ডা. ভিচকে। এরপর টাকা পয়সা নিয়ে মেমোরিয়াল হাসপাতালের বাড়াবাড়ি লেগেই ছিলো। ড. পূরবী বসু শত চেষ্টা করেও পারলেন না কোনো বিল মওকুফ বা হ্রাস করতে। তবে প্রথম ৪টি কেমোর টাকা অগ্রিম দেওয়া ছাড়া চিকিৎসা হবে না বলা হলে পূরবী বসু ডেনভার থেকে অনেক ই-মেইল ও ফোন করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে টাকা পরিশোধের বিষয়টি করে দিয়েছিলেন।

১৫ সেপ্টেম্বর, মেমোরিয়াল হাসপাতালে ডা. ভিচকে দেখাবার পর তিনি সিঙ্গাপুরের ক্যাট স্ক্যান-এর অরিজিনাল প্লেট দেখতে চান। সে প্লেটটি তখন সাথে ছিলো না। ডা. ভিচের রুম থেকে বেরিয়ে শাওন মাজহারুল ইসলামকে সিঙ্গাপুরে খোকনকে ফোন করতে বললেন। ফোন করা হলো, ঠিকানা দেওয়া হলো মেইল করার জন্য। এদিন মেহের আফরোজ শাওন ও মাজহারুল ইসলামসহ আমি চেষ্টা করি সোশ্যাল ওয়ার্কার-এর সাথে দেখা করতে। নিচের তলায় এসে খোঁজ করা হয়। আমেরিকায় প্রত্যেক হাসপাতালেই সাধারণত কোনো রোগীর পক্ষে পুরো খরচ বহন করা সম্ভব না হলে সোশ্যাল ওয়ার্কারের সাথে যোগাযোগ করলে তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। যার যা আয় সে হিসেবে তাকে সেভাবে বিল দেওয়া হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আগে টাকা না দিলে চিকিৎসা করানো যাবে না বা চিকিৎসা বন্ধ থাকবে। মেমোরিয়াল হাসপাতালেও আগে বিল মওকুফের ব্যাপারটা ছিলো। সেটা ড. পূরবী বসুর মুখেই শুনেছি। নিউইয়র্ক থেকে এক সময় প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রবাসী সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহর বড় ছেলের চিকিৎসা বিনে পয়সায় এই হাসপাতালে পূরবী বসু করিয়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি। একসময় পূরবী বসু এই হাসপাতালে কাজও করতেন। সময়ের সাথে সাথে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর নিয়ম পাল্টেছে। এখন আর সেরকম ব্যবস্থা নেই মেমোরিয়াল হাসপাতালে। পূরবী বসুই একদিন ফোনে। এ কথা বললেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে একদিন হুমায়ূন আহমেদের সাথে কথা বলছিলাম মেমোরিয়াল হাসপাতালের ১১ তলায়। কেমো দেওয়ার আগে রেগুলার চেকআপ ডা. ভিচ করবেন। আমরা সবাই বসে আছি সোফায়। এভাবে বসে থাকলে সবসময় নানা কথা বলে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। এই হাসপাতালে যেকোনো ফ্লোরে গেলেই আগতদের জন্য চা, কফি ও বিস্কুট-এর ব্যবস্থা রয়েছে। এর জন্য কোনো পয়সা দিতে হয় না। আমি বাইরে গিয়ে কফি বানাচ্ছি। হুমায়ূন আহমেদ এসে বললেন তার জন্যও কফি বানাতে। বানালাম। কফি হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমেরিকার বুক ফেয়ার এক অদ্ভুত ধরনের। প্রত্যেক হাসপাতালেই মাসের বিভিন্ন সময় নিয়মিত এই বুক ফেয়ার হয়। সে বইগুলো তিনি দেখছিলেন।

বিভিন্ন ধরনের বই। ম্যাগাজিন, বাচ্চাদের বই। আমি বললাম, যদি ক্যাট স্ক্যান করার জন্য ডা. ভিচ বাইরের ক্লিনিকে অনুমতি দেন তাহলে কেমোথেরাপি নিতে অসুবিধা কোথায়? কেননা কেমো আমেরিকার যে হাসপাতালেই নেওয়া হোক তা একই রকম। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে অন্যান্য হাসপাতালে এর খরচ কত খোঁজ নিতে বললেন। মেহের আফরোজ শাওনও এসে যোগ দিলেন এ সময়। এরপর ডাক্তার দেখানো শেষ হলে শাওন আমাকে প্রথম কেমোথেরাপির একটা বিল দিলেন। তাতে ওষুধের নাম ও মূল্য লেখা রয়েছে।

আমি সেদিনই মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে প্রথমে বিলিং ডিপার্টমেন্টে গেলাম। প্রথমে কাউন্টারে পরে সুপারভাইজারের কাছে। কোনো লাভ হলো না। সেখান থেকে গেলাম দ্বিতীয় তলায় একাউন্টস সেকশনে। নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। হঠাৎ করে দেখি লম্বা এক ভদ্রলোক এলিভেটর থেকে উঠে একাউন্ট সেকশনে যাচ্ছেন। বাঙালি মনে হওয়ায় আমি উঠে তার কাছে গিয়ে কথা বললাম। ভদ্রলোকের কথা শুনেই বুঝলাম তাঁর বাড়ি সিলেটে। বাংলাদেশের মানুষ জানতে পেরে নিজের পরিচয় দিলাম। চিনতে পারলেন। বললেন তিনি মুক্তধারায় মাঝে মাঝে যান। তারপর আসল কথা বললাম। বিলটি তাকে দেখালাম যেখানে কেমোর নাম ও মূল্য লেখা আছে। জানতে চাইলাম ওষুধগুলোর মূল্য বেলভ্যু হাসপাতালে কত হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদের নাম দেখেই ভদ্রলোক এমন এক মন্তব্য করলেন আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। বুঝলাম ওনাকে দিয়ে হবে না। ধন্যবাদ জানিয়ে আবার বসে থাকলাম, আমাকে ডাকের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর আর একজন পরিচিত বাঙালিকে দেখলাম একাউন্ট সেকশনের দিকে যেতে। গিয়ে ‘হ্যালো’ দিলাম। ভদ্রলোক আগে জ্যাকসন হাইটস সোনালী এক্সচেঞ্জ-এর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন। সোনালী ব্যাংক-এর জিএম আমার মাসতুতো বোন অর্চনা সাহার রেফারেন্সে তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০০ সালে। বললেন তার চাকরি শেষ হয়ে গেলে তিনি আর দেশে না গিয়ে নিউইয়র্কে থেকে গেলেন। কয়েকমাস আগে বেল্যু হাসপাতালের একাউন্ট সেকশনে চাকুরিতে যোগ দিয়েছেন। বললাম অনেকটা সাহস করে। এমনিতেই ঐ ভদ্রলোকের সাথে কথা বলায় মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এরকম অনেক প্রশ্নেরই সম্মুখীন হয়েছি বহু বছর ধরে। কিন্তু আজ আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। বাংলা ভাষার একজন লেখকের শরীরে ক্যান্সার নামের মরণব্যাধি ধরা পড়ার পর চিকিৎসা করাতে নিউইয়র্কে এসেছেন। সে সময় তাঁকে সাহায্য করা বা না করা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি, কিন্তু এ ধরনের আক্রমনাত্মক কথা শোনার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। যাহোক সোনালী এক্সচেঞ্জ-এর ভদ্রলোক আমাকে জানালেন এ ধরনের কোনো ওষুধের মূল্যমান তাদের কাছে রেকর্ডে নেই এবং সিটি হাসপাতালের মেডিসিনের মূল্য সেভাবেই ধরা হয় যার আয় যে রকম সেভাবে। আমি আমার মতো করে যা বোঝার বুঝেছি। কিন্তু কোনোভাবেই দাম জানতে পারলাম না। ওষুধ কী একই, একই কোম্পানির ওষুধ কিনা- কেননা হুমায়ূন আহমেদ সেনসেটিভ মানুষ, কোনোভাবেই পুরো বিষয়টি না জেনে গেলে তাঁকে উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করা যাবে না। আমি অপেক্ষা করলাম আমার ডাক পড়া পর্যন্ত। ঘণ্টাখানেক বসার পর আমাকে একজন এসোসিয়েট এসে আলাদা একটা রুমে নিয়ে গেলেন। তারা মনে করেছেন আমি বিল পরিশোধ বা মেডিকেইডের ব্যাপারে এসেছি। নাম লেখাবার সময়, জন্ম তারিখও দিতে হয়। আমার প্রশ্ন শুনে একাউন্টস এসোসিয়েটও হতবাক। হয়তো তার কর্মজীবনে এরকম প্রশ্ন নিয়ে কেউ আসেনি। আমাকে বসিয়ে রেখে সে তার সুপারভাইজারের কাছে গেল। মিনিট পাঁচেক পর সুপারভাইজার এক ভদ্রমহিলা এলেন। তাকে আমি বললাম, মেমোরিয়াল হাসপাতালের বিলটা দেখালাম। ভদ্রমহিলা সাথে সাথে ইন্টারকমে কারো সাথে কথা বললেন। বললেন, একই মেডিসিন, একই কোম্পানির ওষুধ বেলভ্যু হাসপাতালসহ সকল সিটি হাসপাতাল ব্যবহার করে। তবে তিনি কত দাম বলতে পারেননি। সোনালী এক্সচেঞ্জের ভদ্রলোক যে উত্তর দিয়েছেন তাই দিলেন তিনি।

আমি ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসি।

অফিসে এসে ২১ নভেম্বরে ফিলাডেলফিয়া বসবাসরত চিকিৎসক ডা. জিয়াউদ্দিনকে ফোন করি। জিয়াউদ্দিন আহমেদ অন্যরকম মানুষ। দীর্ঘদিন তার সাথে আমাদের সম্পর্ক। ভালো মানুষ হিসেবে জিয়াউদ্দিন আহমেদ সুবিদিত। তিনি স্ক্যান করে ওষুধের নামগুলো পাঠাতে বললেন। পাঠালাম, বললেন এই ওষুধগুলো তিনি চেষ্টা করবেন কোম্পানি থেকে কমপ্লিমেন্টারি নিতে।

কথা বললাম ফার্মাসিস্ট এবং হুমায়ূন আহমেদের ঢাকা কলেজের সহপাঠী আমিনুর রশীদ পিন্টুর সাথে। তিনি বলতে থাকলেন, তাঁর ক্যান্সার সারভাইবের গল্প। নানা কথা। তার ইচ্ছে একদিন হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা করার। এসে তিনি কীভাবে নিজে ক্যান্সার থেকে ভালো হয়ে দৈনন্দিন জীবন যাপন করছেন সেটা শোনাবেন। তাছাড়া একসাথের সহপাঠীর একটু হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অভিমানও ঝরে পড়লো। কিন্তু কোনোভাবেই বাইরে খোলাবাজোরে মেডিসিনগুলোর মূল্য বলতে পারলেন না। ডা. জিয়াউদ্দিন পরের দিন ফোন করে জানালেন অর্ধেকেরও কম মূল্যে ঐ ওষুধগুলো কেনা সম্ভব। আর তিনি চেষ্টা করে দেখবেন কোনোভাবে এগুলো ডাক্তারদের জন্য কোম্পানি থেকে কমপ্লিমেন্টারি আনা সম্ভব কি না?

এরমধ্যে মুক্তধারায় একদিন ফোন করলেন ডা. মামুনের স্ত্রী। তিনিও ডাক্তার। অত্যন্ত সুন্দর করে বললেন তারা যদি হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের কোনো সাহায্যে আসেন, তাহলে খুশি হবেন। আমি তার সাথেও বিষয়টি আলাপ করলাম। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেই নিজেকে আপডেট করার চেষ্টা করছি। গত ২১ বছরের প্রবাস জীবনে নানা রকমের রোগী নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। কিন্তু ক্যান্সারের রোগীর চিকিৎসা নিয়ে আমি নিজে কখনো সরাসরি সম্পৃক্ত হইনি। কিন্তু এর কষ্টের বিষয়টি আমি প্রথম জানতে পারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গলায় ক্যান্সারের আক্রান্ত হওয়ার পর। প্রতি সপ্তাহে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকা প্রকাশের আগের দিন সর্বশেষ খবর নেওয়া ছিলো আমার এ্যাসাইনমেন্ট। শেষদিকে কীভাবে শহীদ জননীর কথা বলা কষ্ট হওয়া থেকে একসময় কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতি সপ্তাহেই টের পেতে থাকি। তারপর কথা বলতাম শহীদ জননী জাহারা ইমামের ছেলে জামির সাথে। মিসেস মামুনের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে কথা বললাম ডা. মামুনের সাথে। তিনি জ্যামাইকা হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি বললেন, একই মেডিসিন এবং একই চিকিৎসা পদ্ধতি সব হাসপাতালে। তবে এক এক চিকিৎসক এক এক রোগীকে একেক রকম চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। মিসেস মামুনকে আমি বললাম আপনারা হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের জন্য যে কিছু করার কথা ভাবছেন সে কথাগুলো আমাকে একটা ই-মেইলে জানান, আমি হুমায়ূন আহমেদেকে পাঠিয়ে মেইলটা ফরোয়ার্ড করে দেবো। ঐদিন সন্ধ্যায় আমি জ্যামাইকা গেলে হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওনকে ডা. মামুন দম্পতির কথা বললাম। মিসেস মামুনের একটা কথা আমার খুবই ভালো লেগেছিলো, ওনার ক্লিনিক জ্যামাইকার হিলসাইডে। তাঁদের সবচেয়ে কাছে তারা থাকেন, যেকোনো বিপদে আপদে সবার আগে পৌঁছাতে পারবেন।

আমার খুব ভালো লাগলো, মিসেস মামুনের সাথে কথা বলে। আর হুমায়ূন আহমেদ নিজেও অসুস্থ। তার ওপর দুটি শিশু সন্তান নিয়ে মেহের আফরোজ শাওন বিদেশ বিভূঁইয়ে। যদিও তখন জামাল আবেদীন, জলি আবেদীন ও মাজহারুল ইসলাম ছাড়াও সাহায্যকারী মহিলা থাকতেন তাদের সাহায্য করার জন্য। তারপরেও একটি ডাক্তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাই আমি মিসেস মামুনের নম্বরটা মেহের আফরোজ শাওনকে দিয়ে আসি।

এরমধ্যে একদিন নিনিত অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাকে ফোন করলেন শাওন। আমি রওয়ানা হওয়ার আগে মিসেস মামুনকে ফোন করে ঘটনাটি বলি। জ্যাকসন হাইটস থেকে জ্যামাইকা যেতে ২০ মিনিট লাগে। আমি পৌঁছার আগেই নিনিতকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যান ডা. মামুন ও তাঁর স্ত্রী। এরপর ডাক্তার মামুন ও মিসেস মামুন হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন অতি অল্প সময়ে। হুমায়ূন আহমেদের প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য মিসেস মামুন তার ঢাকার জমি পুরোটাই দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চূড়ান্ত হলো মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং হাসপাতাল থেকে নিউইয়র্ক সিটি হাসপাতালে কেমো নেওয়ার বিষয়টি। ৬ষ্ঠ সাইকেল নেওয়ার আগেই ডা. মামুন বলেছেন জ্যামাইকা হাসপাতালে কেমো নেওয়া শুরু করতে এবং তার জন্য কোনো খরচ হবে না। সিটি হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসা চলবে। হুমায়ূন আহমেদ কখনোই বিনে পয়সায় চিকিৎসা করাতে চাননি। এরমধ্যে মাজহারুল ইসলাম দেশে চলে যান। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের পরও আমাকে অনেক ঘন ঘন তার জ্যামাইকার বাসায় যেতে হতো। প্রয়োজন ছাড়াই যেতে বলতেন। সন্ধ্যার পর তখন প্রায় প্রতিদিন যেতাম। মেহের আফরোজ শাওনও বিভিন্ন খোঁজখবর নিলেন। ডা. ভিচের সাথে আলাপ করলেন। ড. পূরবী বসুর সাথেও একদিন শাওন আমাদের গাড়ি থেকে ফোনে কথা বললেন। সেদিনই হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, তিনি জ্যামাইকা হাসপাতালে নয় বেলভ্যু হাসপাতালেই দেখাতে চান। সবকিছু আমাকে ব্যবস্থা করতে হবে। বেলভ্যু হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগ এবং আরও নানা বিষয়ে মেহের আফরোজ শাওন গুগলস থেকে খোঁজ নিচ্ছেন, ডা. মামুনের সাথে কথা বলেছেন, ডা. ভিচের সাথে কথা বলেছেন।

২৮ নভেম্বর, মেমোরিয়াল হাসপাতালে ৫ম কেমোথেরাপি নেওয়ার পর যখন ২৯। ডিসেম্বর ক্যানিস্টার খোলার জন্য হাসপাতালে যাওয়া হলো, সেদিন আসার

সময়ই সিদ্ধান্ত হলো, হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। অক্টোবর মাসে ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু আসেন ডেনভার থেকে নিউইয়র্কে। আপস্টেটে তাঁদের বাড়ি। তখনই পূরবী বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত দুদিন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের জ্যামাইকার বাসায়। পূরবী বসু তখন চেষ্টা করেছিলেন হ্রাসকৃত মূল্যে বিল পরিশোধ করার বিষয়টি। যদিও তিনি বিষয়টি এর আগে ড. ভিচের সাথে ডেনভার থেকে মেইলে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু ড. ভিচ তাঁর সীমাবদ্ধতা ও অপরাগতার কথা জানিয়েছিলেন ই-মেইলে। ১ ডিসেম্বর, বেলভ্যু হাসপাতাল থেকে আনা সব কাগজপত্র ডেনভারে বেড়াতে যাওয়ার আগের দিন ২ ডিসেম্বর হুমায়ূন আহমেদ আমাকে স্বাক্ষর করে দেন। এক, হাসপাতালের কার্ড করার আবেদন, দুই. এখানে তাঁর যেহেতু কোনো জব নেই তিনি কার সাথে থাকেন, তিন. তার লোকাল গার্ডিয়ানের প্রত্যয়নপত্র, চার. হুমায়ূন আহমেদের যে কোনো বিল বা হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সবকিছুর জন্য আমার অঙ্গীকারনামা এবং পাঁচ-টেম্পরারি মেডিকেল কার্ডের জন্য মুক্তধারা থেকে আমার স্বাক্ষরিত চিঠি। আমি ৪ ডিসেম্বর বেলভ্যু হাসপাতালে যাই। রনি বড়ুয়ার সহযোগিতায় হমায়ুন আহমেদের অনুপস্থিতিতে মেডিকেল কার্ড করতে সক্ষম হই। খবরটি হুমায়ূন আহমেদকে জানাবার জন্য আমি শাওনের ফোনে ডেনভারে ফোন করি। দুবার করলাম। ফোন ভয়েস মেইলে চলে যায়। তখন আমি একটা ই-মেইল পাঠাই হুমায়ূন আহমেদের কাছে। একটি মেহের আফরোজ শাওনের মেইলে আর সিসি করি পূরবী বসুর কাছে। যেহেতু সেসময় হুমায়ূন আহমেদ পূরবী বসুদের বাসায়।

ডিসেম্বর ৫, ২০১১ তারিখে ই-মেইলে প্রেরিত হুমায়ূন আহমেদকে লেখা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

স্যার,

আদাব জানবেন। আশাকরি ভালো আছেন। ওখানে যাওয়ার পরে আপনাদের ফোন করেছিলাম। সংযোগ পাইনি।

যা হোক, সেদিন সকাল ৯টায় বেলভ্যু হাসপাতালে গেলাম। প্রথমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে এরপর হাসপাতালের বিজনেস সেকশনে বিল যাতে হ্রাসকৃত মূল্যে ধরা হয় সে মিটিং হলো। সব কাগজপত্র জমা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দুপুরে আপনার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও হাসপাতালের কার্ড পাওয়া গেল। সম্ভব হলো বেলভ্যুতে কর্মরত রনি বড়ুয়ার লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে।

বেলভ্যুতে অনকোলজি বিভাগে তারিখ নেওয়া হয়েছে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ সকাল ১০-২০ মিনিট। এছাড়া আপনার চোখের পাশে যে কালো দাগ পড়েছে তার জন্য এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে ১২ জানুয়ারি দুপুর ১-৩০ মিনিট। এই এপয়েন্টমেন্ট ডেটগুলো ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নেওয়া। রেগুলার এপয়েন্টমেন্ট পেতে সময় লাগতো কমপক্ষে দু’তিন মাস।

হার্টের এপয়েন্টমেন্ট ১৪ ডিসেম্বর অনকোলজির ডাক্তারকে কাগজপত্র দেখিয়ে তাড়াতাড়ি নেওয়া যাবে। এমনিতে আগামী ৩ মাসে কোনো এপয়েন্টমেন্ট নেই। ১৪ তারিখে ডাক্তার না দেখানো পর্যন্ত কেমোথেরাপি বেলভ্যুতে নেওয়া যাবে কিনা তা আজও ফাইনাল হয়নি।

১২ ডিসেম্বরের কেমোথেরাপি মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেবেন না কুইন্স। হাসপাতালে নেবেন, সেটা সিদ্ধান্ত নেবেন। আজ এনওয়াইইউর একজন মেডিসিনের ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি এ বিষয়ে। তার বক্তব্য কেমোথেরাপি যেকোনো জায়গা থেকেই নেওয়া যায়। এ ব্যাপারে ডাক্তারকে মিসেস মামুনও ফোন করেছিলেন।

যাহোক এখন থেকে বেল্যুতে সবরকম চিকিৎসা করানো যাবে। ১৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে যাওয়ার আগে যে কোনো ডাক্তার থেকে একটা রেফারেল নিয়ে যেতে হবে। সাথে মেডিকেল কার্ড ও হাসপাতালের এপয়েন্টমেন্টের ডকুমেন্ট স্ক্যান করে পাঠালাম।

দুপুর ৩টায় বাংলাদেশ মিশনে আপনার খামটা দেওয়া হয়েছে।

শ্ৰদ্ধান্তে,

বিশ্বজিত সাহা

এই চিঠির উত্তরে মেহের আফরোজ শাওন কিছু না জানালেও ড. পূরবী বসু অভিনন্দন জানিয়েছেন। চিঠিটি পাঠানোর পরদিন পূরবী বসুর ই-মেইলটি তুলে দেওয়া হলো:

12.06.2011

Dear Bishwajit, You did a lot. It sounds like you accomplished mission impossible. I am very glad. Congratulations.

Purabi Basu

হুমায়ূন আহমেদ ফিরলেন ১০ ডিসেম্বর ডেনভার থেকে লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসুর বাড়ি থেকে। সারা রাত প্লেনে কাটিয়ে ভোরে এসে পৌঁছালেন নিউইয়র্কে। আসার আগে অবশ্য একদিন ডেনভারে ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং হুমায়ূন আহমেদের সাথে কথা হয়েছিলো। ডেনভার থেকে পৌঁছানোর পর আমি আর রুমা গেলাম ঐদিনই জ্যামাইকার বাসায়। মেহের আফরোজ শাওনের মা, ছোটবোন সেঁজুতীসহ গল্প করছিলেন সামনের ঘরের সোফায়। আমরা ঘরে ঢোকার পর সেঁজুতী উঠে গেলেন। একটু লাজুক। কথা কম বলেন। হুমায়ূন আহমেদ বেডরুম থেকে উঠে এলেন। আমি বেলভুর মেডিকেল কার্ড এবং এপয়েন্টমেন্ট স্লিপটা হাতে দিলাম। কী যে খুশি হলেন বলার মতো নয়। এখনও সেই হাসি মুখটা চোখে ভাসছে। গল্প শুরু হলো ডেনভারের, রকি মাউন্টেনের। পূরবী বসুর, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের, তাঁদের ছেলের এবং পোষা কুকুরের। ১৪ ডিসেম্বর বেলভ্যুতে যাওয়ার আগে ঠিক হলো মেমোরিয়াল হাসপাতালে ডা. ভিচের কাছে যাওয়ার। ডেনভারে থাকা অবস্থায় পূরবী বসু ডা. ভিচের সাথে অ্যাপয়েনটমেন্ট করে রেখেছেন ১২ ডিসেম্বর ২০১১। আমরা ১২ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় পৌঁছে গেলাম মেমোরিয়াল হাসপাতালে। মুক্তধারার শাহীন মিয়া আমাদের মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে এলো। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন ও আমি। এদিন ড. ভিচের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো হুমায়ূন আহমেদ বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর হবেন। তবে ষষ্ঠ সাইকেল কেমোথেরাপিটি এখান থেকে গ্রহণ করবেন। ৬ষ্ঠ কেমোথেরাপি নেওয়া Low Anc Ges Low Palt এর কারণে স্থগিত রাখা হয়। হুমায়ূন আহমেদ রকি মাউন্টেন-এ যাওয়ার গল্প করলেন, পূরবী বসুর বাড়ির বর্ণনা, কোন ঘরে কে থাকে, ঐ বাড়ির সবচেয়ে আদরণীয় হলেন কুকুরটি, তাও বললেন রসিকতা করে। পরে হুমায়ূন তাঁর পায়ের তলার খড়ম’ গ্রন্থে ঐ কুকুরের ছবিটি লেখার সাথে প্রকাশ করেন। হুমায়ূন আহমেদের খাবারপ্রীতি জগদ্বিখ্যাত। ডেনভারের খাবারের বর্ণনা করলেন। বাংলাদেশের খাবার আর নিউইয়র্কের খাবারের কথা বললেন। নিউইয়র্কের খাবারের সাথে ডেনভারের খাবারের তুলনা করলেন। নিউইয়র্কের ফ্রেশ খাবার আর তিনি যে পুরনো খাবার খেতে পছন্দ করেন না, তা বললেন বিশেষভাবে।

বেলভ্যু হাসপাতালে প্রথম দিন

১৪ ডিসেম্বর ২০১১ সকাল ৮টায় মেহের আফরোজ শাওনের ফোনে ঘুম। ভাঙলো। বললেন তাঁরা তৈরি হচ্ছেন। আমরা যেন ৯টার মধ্যে পৌঁছে যাই। মনে পড়লো ১৫ সেপ্টেম্বরের কথা। সেদিনও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। মেমোরিয়াল হাসপাতালে প্রথমদিন রুমার গাড়িতে গিয়েছিলেন। আজও রুমা যাবে আমাদেরকে নিয়ে। রুমা ঘুম থেকে উঠে তৈরি হতে হতে আমি আরো ১৫ মিনিট শুয়ে থাকলাম। আমরা চলোম আমাদের এলমহাস্ট বাসা থেকে জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে। নর্দান ব্যুলেভার্ড (Northern Boulevard) বার্গার কিংয়ের ড্রাইভ থু (Drive Thru) থেকে ব্রেকফাস্ট নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বাসায় পৌঁছালাম। সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে জ্যামাইকা থেকে রওয়ানা হলেই হবে। আমরা গাড়ি পার্ক করে উপরে গিয়ে বসলাম। চা খেলাম। হুমায়ূন আহমেদকে বললাম মেডিকেল কার্ডটা এবং এপয়েন্টমেন্ট স্লিপ নেওয়ার জন্য। শাওন সেটা নিয়ে নিলেন। তৎক্ষণাৎ হুমায়ূন আহমেদ শাওনের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন মেডিকেল কার্ডটি। একটু অবাক হলাম। গত তিন মাস চিকিৎসার জন্য এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। কখনো পকেটে মানি ব্যাগ। রাখতেও দেখিনি। কিছু লাগলে শাওনের কাছ থেকে নিয়ে খরচ করেন। অন্য কারও থেকে কিছু নিলেও ভুলনোর আগে সেটা ফেরত দেওয়ার যে তাড়া ছিলো হুমায়ূন আহমেদের তা শিক্ষণীয়। সেই মানুষটি হাসপাতাল কার্ড চেয়ে নিলেন। শাওনের কাছ থেকে। শাওন কিঞ্চিৎ অবাক হলেন। লাল রংয়ের কার্ডটি হুমায়ূন আহমেদের পর সব সময়ই হাসপাতালে যেতে তার পকেটেই রাখতেন।

বেলভ্যু হাসপাতালে আমরা দীর্ঘদিন আসা যাওয়া করি। ১৯৯৬ সালে আমার বড় ভাই রনজিত সাহার হার্টের বাইপাস সার্জারি। ১৯৯৭ সালে আমাদের পুত্র বিজিত সাহার জন্ম। এরপর থেকে আমাদের পরিবারের সকলের হাসপাতাল বেলভ্যু। ১৯৯৮ সালে হুমায়ূন আহমেদকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি এবং এক রাত যাপন- সব মিলিয়ে বেলভ্যুর প্রতিটি বিল্ডিং পরিচিত। হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দিল রুমা। একটু একটু বরফ পড়ছে। ২৯ স্ট্রিট এবং ১ম ও ২য় এভিনিউর কর্নারে গাড়ি পার্কিং করতে গেলো রুমা। আমি আগেই এসে ঘুরে গেছি গত সপ্তাহে। অনকোলজি (Oncology) বিভাগ, কোথায় যেতে হবে সব আগে থেকেই জানা ছিলো। হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে এলিভেটরে উঠে সরাসরি মেজানিন (Mezzanine) ফ্লোরে। হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে হাসপাতালের কার্ড নিয়ে রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে দিলাম। চেয়ারে বসতে না বসতেই এলেন বেল্যুতে কর্মরত রনি বড়ুয়া। আসার আগেই রনি বড়ুয়াকে আমি ফোনে জানিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদকেও আগেই জানিয়েছি রনি বড়ুয়া সম্পর্কে। দেখা করে তিনি চলে গেলেন। মিনিট পনেরো পর হুমায়ূন আহমেদকে ডাকা হলো। আমরা তাঁকে নিয়ে ভেতরে গেলাম।

নার্স ওজন এবং উচ্চতা মাপলেন। এরপর আমরা আবার ফিরে আসি পূর্বের জায়গায়। যেখানে রোগীরা অপেক্ষা করে থাকেন।

বিকেল প্রায় ৩ টা বেজে গেছে। এখনো ঠিক হয়নি অনকোলজি বিভাগের কোন ডাক্তার হুমায়ূন আহমেদকে দেখবেন। একসময় ডাক পড়লো। ছোট খাট একজন ডাক্তার ‘আহমেদ’ বলে ডাকলেন। আমরা উঠে গেলাম ডাক্তারের পেছনে পেছনে। একসময় জানতে পারলাম ভারতীয় বংশোদ্ভূত সে তরুণী ডাক্তারটির নাম ড. সিলভিয়া জেইন। তাঁর পূর্বপুরুষরা চট্টগ্রামে থাকতেন। হুমায়ূন আহমেদ যে আমাদের দেশের প্রখ্যাত লেখক সে কথা আমি ডাক্তারকে বললাম। নানা কথার মধ্যেও সিঙ্গাপুর এবং মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে আনা রিপোর্টের ওপর থেকে ডাক্তারের তীক্ষ্ণ নজর এড়ালো না। বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন রোগীকে। শাওন ব্যাগ থেকে সকল ওষুধ বের করে ডাক্তারকে দেখালেন। অধিকাংশ ওষুধের নামই তাঁর মুখস্থ ছিলো। ডাক্তার তার সহকারিকে ডাকলেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর। চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন ডা. জেইনকে। ডা. বললেন তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মেমোরিয়াল হাসপাতালের ডা. ভিচের সাথে কথা বলে নেবেন। এ কথা শুনে হুমায়ূন আহমেদ, শাওন এবং আমরা খুবই আশান্বিত হলাম। সঙ্গে সঙ্গে ডা. জেইনকে মেমোরিয়াল হাসপাতালের ড. স্টিফেন ভিচের নম্বরটি দেওয়া হলো। ডাক্তার জেইন তাঁর এন্টনি নামে একজন সহকারিকে সমস্ত রিপোর্ট কম্পিউটারে আপডেট করতে বললেন। এবং কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করবেন তার একটা পরিকল্পনা ও নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করলেন ডা. জেইন। ১২ ডিসেম্বরের কেমোথেরাপি নেওয়া সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ডা. জেইন বলেছেন, ৩ সপ্তাহ পরপর যে কেমোথেরাপি নেওয়া হয় সেটা ৫ সপ্তাহের। মধ্যে নিলেই হয়। এরমধ্যে কোনো অসুবিধা হয় না। ড. সিলভিয়া জেইন একটি কাগজে কী কী জমা দিতে হবে তা নিজের হাতে লিখে আমাকে তালিকাটি দিলেন। আমরা ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে এলে এলেক্স নামে একজন পেশেন্ট নেভেগিয়েটরকে ডেকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। এরিখ আমার ফোন নম্বর রাখলো। আমি এরিখের নম্বর রাখলাম। এরিখের কাছে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে আনা স্লাইডগুলো এবং সিটিস্ক্যান রিপোর্ট, মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেওয়া ৫টি কেমোথেরাপির বিবরণ জমা দেওয়ার জন্য ডা. বললেন। ডা. জেইন তার সেল ফোন নম্বর দিলেন আমাদেরকে। যে। কোনো জরুরি মুহূর্তে ফোন করতে বললেন। ব্লাড জমা দিয়ে আমরা রেজিস্ট্রেশনে গেলাম। পরবর্তী তারিখ দেওয়া হলো ২১ ডিসেম্বর। বেলভ্যু। হাসপাতাল থেকে স্যুপ খেয়ে আমরা জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

১৮ তারিখের জন্য অপেক্ষা না করে আমি ১৫ ডিসেম্বর এরিখের কাছে স্লাইডগুলো a Sinaporen Records বেলভ্যু হাসপাতালে জমা দিয়ে এসেছি। ১৫ ডিসেম্বর আবার যেতে হয়। মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সেখান থেকে রিপোর্টগুলো তুলি আবার বিকেলে এরিখ যাওয়ার আগেই তাকে দেওয়ার জন্য যাই। তার একটি সেট আমরা সেদিনই জমা দিলাম এরিখের কাছে। সে ৩ দিন পর ফোন করতে বললাম। ১৮ তারিখ সোমবার ফোন করলাম। বলল, এখনো ঠিক হয়নি। পরের দিন ফোন করতে বললেন। সকাল সাড়ে ১১টায় পেলাম এরিখকে। পরবর্তী এপয়েন্টমেন্ট ২১ ডিসেম্বর এবং সেদিনই ৬ষ্ঠ কেমো আর বেলভ্যুতে প্রথম কেমোর তারিখ নির্ধারণ করা হবে।

যথারীতি ২১ তারিখ আমরা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যাই আবার বেলভ্যু হাসপাতালে। ড. সিলভিয়া জেইন দীর্ঘক্ষণ ধরে জমা দেওয়া সব কাগজপত্র দেখলেন। ২২ ডিসেম্বর বেলভ্যু হাসপাতালে ৬ষ্ঠ কেমোথেরাপির তারিখ দেওয়া হলো। ডা. প্রত্যেকটি বিষয় ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। কোন পদ্ধতিতে কেমো নেওয়া হবে। আউট পেশেন্ট হিসেবে হাসপাতালের কোথায় এসে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সেখানে একটা মেডিসিন নেওয়ার পর আবার ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। আমরা হাসপাতালে ভর্তির অগ্রিম কাগজটিও ডাক্তার থেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শাহীন মিয়া হাসপাতালের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম নিশ্চিন্ত মনে। ১ম কেমোথেরাপির আগেই আমি আর একদিন বেলভ্যু হাসপাতালে এলাম। রনি বড়ুয়ার সাথে তাঁর ফ্লোরে গিয়ে দেখা করে সব বিষয়ে আলোচনা করলাম। কোন ওয়ার্ডে হুমায়ূন আহমেদ কেমো নেবেন এবং কোথায় ভর্তি হওয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দিতে হবে সব খোঁজ নিলাম। কেননা আমাদেরকে পৌঁছাতে হবে সকাল ৯টার মধ্যে। যাতে হাসপাতালের আউট পেশেন্ট বিভাগে নেওয়ার পর যাতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে না হয়। সবকিছু দেখে ১৬ ওয়েস্ট যেখানে হুমায়ূন আহমেদ কেমো নেবেন, সেই ফ্লোরেও গেলাম। নার্সদের সাথে হাই-হ্যালো দিয়ে এলাম।

৬ষ্ঠ ও বেলভ্যুতে প্রথম কেমোথেরাপি

২২ ডিসেম্বর সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে উঠেই আমি আর রুমা তৈরি হচ্ছিলাম জ্যামাইকা যাওয়ার জন্য। বেরুবার আগে একবার ফোন করলাম শাওনকে। জ্যাকসন হাইটস থেকে জ্যামাইকা যেতে লাগে ২০/২৫ মিনিট। ট্রাফিক না থাকলে সেখান থেকে বেলভ্যুতে যেতে লাগে ৪৫ মিনিট। কখনো ১ ঘণ্টার ওপরে লেগে যেতো। তাই আমরা কেমোথেরাপি এবং ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্টগুলোর দিন আগেই বেরিয়ে পড়তাম। কোর্ট হাউজের সামনে গিয়ে আবার ফোন করে জানালাম পৌঁছে গেছি। তখনও হুমায়ূন আহমেদ বাসা থেকে বের হননি। রুমা নিচে গাড়িতেই রইল। আমি উপরে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদসহ তার ব্যাগ নিয়ে নিচে নামছি, শাওনও একসাথে নামলেন। আমরা বেলভ্যুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রুমার পাশে আমি সামনের সিটে। হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন মাঝখানের দুসিটে। মাজহারুল ইসলাম পেছনের সিটে। আজ হুমায়ূন আহমেদ বেলভ্যুতে প্রথম কেমো নেবেন। দুরাত থাকতে হবে সেখানে। বেলভ্যু হাসপাতালের অনকোলজিস্ট ড. জেইন আগেই আমাদের বলে দিয়েছেন কেমো নেওয়ার সময় সিটি হাসপাতালগুলো কোনো রিস্ক নেয় না। নিয়ম হলো সার্বক্ষণিক চিকিৎসক এবং নার্সদের তত্ত্বাবধানে কেমো শেষ না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয়। এমনিতেই হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতালে যেতে পছন্দ করেন না। তার ওপরে দুদিন থাকতে হবে। সঙ্গে টুথ পেস্ট, ব্রাশ, গেঞ্জি, জামা ও কতগুলো বই আনা হয়েছে ব্যাগে করে। আরও ছিলো লেখার জন্য কলম, কাগজ। তখন তিনি নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ প্রথম আলোতে লিখছেন। যথারীতি রুমা আমাদের হাসপাতালের গেটে নামিয়ে গাড়ি পার্ক করতে গেলো। আমরা সরাসরি ডা. জেইনের দেওয়া ভর্তির স্লিপটি নিয়ে এডমিশন সেকশনে জমা দিয়ে অপেক্ষা করছি। প্রথমদিন বেলভ্যুতে আউট পেশেন্ট হিসেবে ভর্তি। নানান জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। পেমেন্টে-এর বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলাম আমি। ওরা আমাকেই রোগী ভেবে বসেছিলো। তারপর সর্বশেষ হুমায়ূন আহমেদকে দেখিয়ে বললাম, ইনি হলেন হুমায়ূন আহমেদ। কাগজপত্র এনে হুমায়ূন আহমেদকে স্বাক্ষর করতে। দেওয়া হলো। প্রায় ৪৫ মিনিট লেগে গেলো সেখানে। ১৬ ওয়েস্ট-ভর্তি সেকশন থেকে যোগাযোগ করে বেড রেডি করতে বলা হয়। এরপর একজন এটেনডেন্ট এসে হুমায়ূন। আহমেদকে নিয়ে যায়। যেহেতু আগের দিন এসে আমি দেখে গেছি, তাই যাওয়া মাত্র বসে না থেকে এটেনডেন্ট নার্স পাঠানো, কেমো রেডি করার দ্রুত অর্ডার দেওয়া ফার্মেসিতে এ কাজগুলো দ্রুত করা। সম্ভব হলো। পুরো ওয়ার্ড ভর্তি রোগী। আরও একজনের সাথে হুমায়ূন আহমেদকে রাখা হলো। কেমো দেওয়ার আগে মেডিপোর্টে স্যালাইন দেওয়ার জন্য একজন নার্স এলো। হুমায়ূন আহমেদ শরীরে সুচ ঢোকানোর সময় ব্যথা পেলেন। নার্সটি আবার চেষ্টা করলেন, আবারও ব্যথা পেলেন। হুমায়ূন আহমেদের কষ্ট দেখে সাথে সাথে আমি নার্সকে সুচ না ঢোকানোর জন্য অনুরোধ করলাম। নার্স স্টেশনে গিয়ে প্রধান নার্সকে বললাম হুমায়ূন আহমেদের কষ্টের কথা। তিনি এসে মেডিপোর্টটার স্থান ভালো করে দেখে একবারেই সুচ ঢোকালেন। তখন আর তেমন ব্যথা অনুভব করেননি। হুমায়ূন আহমেদ হেসে নার্সকে ধন্যবাদ জানান। আগেই আমি ১৬ ওয়েস্ট সেকশনের কর্তব্যরত প্রধান নার্সকে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে জানিয়ে গিয়েছিলাম। এ্যাশলি জোন্স নামে নার্সকে গতকালই হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’র ইংরেজি অনুবাদ ও Blissful Hell বইটি উপহার দিয়েছি। এই হাসপাতালটি যেহেতু এনআইইউ’র আওতায়। তাই শিক্ষানবীশ অনেক ডাক্তার আসেন প্রধান চিকিৎসকের সাথে। কিন্তু পুরো বিষয়টি থাকে ইউনিট প্রধান নার্সের কাছে। দুজন নার্স দুশিফটে সার্বক্ষণিক রোগীদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো। দেখভাল করেন। হুমায়ূন আহমেদ যেহেতু নিয়মিত কেমো নেবেন এই ইউনিটে তাই আগে থেকেই এই ইউনিটে কর্মরত স্টাফরা ধারণা পেয়ে গেলো একজন সেলিব্রিটি চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারপরে তারা আরও জানলো নর্থ ডেকোটা থেকে পেশেন্ট পিএইচডি করে চলে গেছেন নিজের দেশে। পুরো বিষয়টি ওদের কাছে নতুন। এরপর ভর্তি হওয়া হাসপাতালের পোশাক নিয়ে কর্মরত অবস্থায় রনি বড়য়া এসে যখন হুমায়ূন আহমেদের খোঁজখবর নিলেন, তখন পুরো ইউনিট সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলো।

বিকেল প্রায় সাড়ে ৩টা। ফার্মেসি থেকে কেমো তৈরি হয়ে এলো। কেমো শুরু হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, এবার তুমি যাও। আমি দীর্ঘক্ষণ থাকলে তিনি মনে করতেন আমার অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। তাই আমার দায়িত্ব শেষ মনে হতেই সব সময়ের মতো আজও তাড়া দিলেন। রুমা থেকে গেলো আমি সাবওয়েতে জ্যাকসন হাইটসে ফিরলাম। প্রতি দুঘণ্টা পরপর ইউনিটে ফোনে যোগাযোগ করতাম। পরদিন রাতে আবার গেলাম। এর পরের দিন ছাড়া পাবেন। আগেই পৌঁছে গেলাম আমি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি। হুমায়ূন আহমেদ আর মেহের আফরোজ শাওনকে জ্যামাইকার বাসায় পৌঁছে দিতে যাওয়ার আগে মুক্তধারার শাহীন মিয়া আমাকে জ্যাকসন হাইটসে নামিয়ে দিলো। যেহেতু হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাবেন, তাই যাতে তিনি কখনো সিটি হাসপাতালে বোরিং ফিল না করেন সেই ব্যবস্থা করার জন্যই আমি রনি বড়ুয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি। আমার শাশুড়ি মায়ের পরিচয়ে রনি বড়ুয়াকে আমি বেলভ্যু হাসপাতালে খুঁজে পাই। অত্যন্ত নিরহঙ্কারী এবং সহজ সরল মানুষটির সাথে প্রথম পরিচয়েই আপাদমস্তক ভদ্রলোক মনে হয়েছে। নভেম্বর মাস থেকে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিরলসভাবে

সহযোগিতা করেছেন নীরবে নিভৃতে। বেলভ্যু হাসপাতালে প্রথম কেমোথেরাপির দিন যখন আরও একজনের সাথে একটি রুমে হুমায়ূন আহমেদকে থাকতে দেওয়া হলো, তখনই আমি পৃথক একটা রুমের ব্যবস্থা করার কথা বলি রনি বড়য়াকে। তিনি বললেন চেষ্টা করবেন। পরেরবার ৭ম থেরাপির দিনই ব্যবস্থা হয়ে গেল পৃথক রুমের। প্রথমে নেওয়া হয় দুজনের রুমে। অনেক রোগী ছিলো সেদিন। পরে রনি বড়ুয়াসহ ম্যানলি লামার এর সাথে দেখা করে হুমায়ূন আহমেদের বিষয়টি বলি। বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের সংখ্যা শুনে লামার রীতিমতো বিস্মিত। রনি বড়য়ার মাধ্যমে লামা’র সাথেও একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লামারকে। আমরা দুজনেই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বলি। হাসপাতালের স্টাফদের সাথে লাঞ্চ টাইম ছাড়া কথা বলাও মুশকিল। ম্যানলি বললেন, যতই আগে থেকে ঠিক করা থাক রোগীর ভিড় বেড়ে গেলে তখন কারও কিছু করার থাকে না। তারপরেও হুমায়ূন আহমেদ যেদিন কেমোথেরাপি নিতে আসবেন তার দুদিন আগেই আমি রনি বড়য়ার সাথে কথা বলে নিতাম। আর রনি ম্যানলির সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করতেন। তাই পরবর্তীতে প্রায় সময়ই হুমায়ূন আহমেদ পাবলিক হাসপাতালেও প্রাইভেট হাসপাতালের মতো ট্রিটমেন্ট পেতেন সিঙ্গেল রুমে। এছাড়া আরো কত কী যে সাহায্য। কখনো আমারা ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গেছি, রনি বড়ুয়াকে ফোন করেছি আগেই এসে রেজিস্ট্রেশন করে রেখেছেন নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে। এমন কোনো দিন ছিলো না যখনই হাসপাতালে আসতেন হুমায়ূন আহমেদকে একবার না একবার দেখে যেতেন। তবে হুমায়ূন আহমেদ রনি বড়ুয়াকে খুব পছন্দ করতেন। একদিন তার জন্য আনা বাসার খাবার রনি বড়য়াকে খাওয়াতেও চেয়েছিলেন। ১৪ এপ্রিল ছিলো হুমায়ূন আহমেদের ১২ নম্বর কেমোথেরাপির ডিসচার্জের দিন। ১লা বৈশাখ উপলক্ষে রনি বড়ুয়া হুমায়ূন আহমেদকে ‘শুভ নববর্ষ’ বললেন। হুমায়ূন আহমেদ ভুলেই গেছিলেন, বাংলা নববর্ষের কথা। বেলভ্যুতে প্রথম কেমো নেওয়ার পর ৪ জানুয়ারি ছিলো ড. সিলভিয়া জেইনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণের এপয়েন্টমেন্ট। ২ মাসের কম সময়ের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের মলাশয়ে রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। নতুন কোনো উপসর্গ নেই। এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে হুমায়ূন আহমেদকে পরবর্তী কেমোর জন্য এভাস্টিন নামে একটি ওষুধ যোগ করেন। এই ওষুধটি দেওয়ার আগে ডা. জেইন আমাদের বলেন, গত ৬টি কেমো নেওয়ার ফলে হুমায়ূন আহমেদের কোলনের ক্যান্সার পর্যায়ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। তাই WIESTO GP GameTMCO GUTI Oxaliplatin, Levo Covenin, 5Fu foart ওষুধের সাথে যোগ করেন এভাস্টিন (Avastin) পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণের আগে হুমায়ূন আহমেদকে পরিষ্কার করে পুরো বিষয়টি সেদিন বুঝিয়ে দেন। ড. ভিচ যখন হুমায়ূন আহমেদকে দেখতেন তখন সরাসরি এভাবে বলতেন না। শাওন অথবা পূরবী বসু কোনো জটিল প্রশ্ন থাকলে আলাদাভাবে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। বেলভ্যুতে চিকিৎসার প্রথম দিন থেকেই প্রত্যেকটি বিষয়ে সরাসরি রোগীর মতামত নেওয়া এবং রোগীকে জানানো শুরু করেন ড. জেইন। অত্যন্ত স্পষ্টভাষী এবং কনসেপ্ট ক্লিয়ার অনকোলজিস্ট ড. জেইন আমাদের অনুরোধে ড. ভিচের সাথেও যোগাযোগ করেন। ড. ভিচও ড. জেইনের সাথে এভাস্টিন যোগ করার বিষয়ে একমত হন। অবশ্য এর আগে বেলভ্যুতে প্রথম দিন ড. জেইনকে দেখানোর পর যাতে মেমোরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসক ড. ভিচের মতামত নিতে পারেন তাই ড. পূরবী বসুকে ড. জেইনের ই মেইল, ফোন নম্বর এলেক্স’র ই-মেইল দিয়েছিলাম। ড. জেইন আমাকে পরবর্তীতে জানিয়েছেন, তাঁর সাথে ড. ভিচের কথা হয়েছে। ৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হলো বেলভ্যুতে ৭ম কেমোথেরাপি। এভাস্টিন যুক্ত হওয়ায় হুমায়ূন আহমেদকে নতুন বিল্ডিংয়ের দোতলায় প্রথমে ক্যান্সার সেন্টারে নিয়ে যেতে হয়। এক এক ডোজ এভাস্টেন’র মূল্য প্রায় ৬ হাজার ইউএস ডলার। ১ বছর যদি কোনো রোগী ১৭টি এভাস্টেন নিয়ে থাকেন তাহলে ১ লক্ষ। ইউএস ডলার পর্যন্ত খরচ হয়। আমেরিকার সিটি হাসপাতালগুলোর ডাক্তারদের রোগীর অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। এদের সাথে হাসপাতালের বিলের বা ওষুধের মূল্যের কোনো সম্পর্ক নেই। এখানকার চিকিৎসকরা অনেক স্বাধীন। তাই বেলভ্যু হাসপাতালের ডাক্তারকে এ বিষয়ে তেমন ভাবতে হয়নি। ড. জেইন প্রথম দিন এভাস্টিন দেওয়ার সকল বন্দোবস্ত ৪ জানুয়ারিই করে রেখেছিলেন। এদিন আমি হুমায়ূন আহমেদকে একা নিয়ে আসি। শাওনের সাথে কথা হয় তিনি খাবার নিয়ে দুপুরে আসবেন। তিনি আসার পর আমি যাবো হাসপাতাল থেকে যাব। প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগলো এভাস্টেন দিতে। এরপর হাসপাতালে ভর্তির স্লিপ নিয়ে আমরা অপেক্ষা করি ভর্তির ফরমগুলো পূর্ণ করা পর্যন্ত। বেল্যুতে ইনপেশেন্ট ভর্তির রুমের পাশেই হলো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কেমো শেষে নিয়মিত এই স্টোর থেকে হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্ডি অথবা কোনো উপহার নিয়ে যেতেন নিষাদ ও নিনিতের জন্য। বসে না থেকে তিনি এই স্টোরটিতে ঘুরতেন। বা পায়চারী করতেন, সামনের করিডোরে। এরপর এটেনডেন্ট আসার পর আমরা ১৬ ওয়েস্ট চলে যাই। যেদিন আগে থেকেই হুমায়ূন আহমেদের জন্য পৃথক রুম বরাদ্দ ছিলো। আগের দিন বিকেলেই রনি বড়ুয়ার সাথে কথা হয় পৃথক রুমের ব্যাপারে। পৃথক রুমে একটি শয্যা, পাশে একটা সুন্দর ফোল্ডিং চেয়ার। ছোট টেবিল। ব্যাগ থেকে হুমায়ূন আহমেদের আনা কাপড়-চোপড়গুলো বের করে ওয়ারড্রবে রাখলাম। বইগুলো সাজিয়ে দিলাম টেবিলে। খাবার এলো হাসপাতাল থেকে। এরমধ্যে আমি গিয়ে নার্সকে তাড়া দিয়ে আসি কেমোর প্রিপারেশন নেওয়ার জন্য ফার্মেসিতে ফোন করতে। নার্স সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করলেন। খুব ব্যস্ত থাকতে হয় ওয়ার্ডগুলোর প্রধান নার্সকে। কিছুক্ষণ পরই শাওন এলেন হুমায়ূন আহদের জন্য বাসা থেকে খাবার নিয়ে। রনি বড়য়া এলেন। তারপর আমি চলে এলাম সাবওয়েতে বাসার উদ্দেশ্যে।

অষ্টম কেমোথেরাপিও ভালোভাবে নেওয়া হলো ২১ জানুয়ারি। সেদিনও সকালে আমি জ্যামাইকা থেকে নিয়ে আসি হুমায়ূন আহমেদকে। শাওন বললেন গতবারের মতো দুপুরের খাবার নিয়ে একেবারে আসবেন। রাত ৯টা পর্যন্ত থাকবেন। তারপর রাতে থাকবেন মাজহারুল ইসলাম। সেদিনও এভাস্টেন নেওয়ার জন্য প্রথমে মেইন বিল্ডিংয়ে ২ ঘণ্টার মতো থাকতে হয়। এরপর ১৬ ওয়েস্টের কক্ষে। সেবারো কোনো অসুবিধা ছাড়াই অষ্টম কেমোথেরাপি নেওয়া সম্পন্ন হলো। দুদিন থাকার পর তৃতীয় দিন ডিসচার্জ করিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে বাড়িতে পৌঁছে দিই। আরকানসাস থেকে এমাসে আসলো বাবাকে দেখতে হুমায়ূন আহমেদের কণিষ্ঠা কন্যা বিপাশা আহমেদ তাঁর স্বামীকে নিয়ে। এয়ারপোর্ট থেকে জামাল আবেদীন সরাসরি নিয়ে গেলেন বিপাশা ও তাঁর বরকে জ্যামাইকার বাসায় রাত সাড়ে ১১টায়। পিতা পুত্রী একে অপরকে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। একসময় তারা দুজন পৃথকভাবে একান্তে কথা বলেন। পরদিন ম্যানহাটানে হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, বিপাশা ও তার বর এবং জামাল আবেদীন ও জলি আবেদীন একসাথে ম্যানহাটানের রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করেন। পিয়ার ১৭ ছিলো হুমায়ূন আহমেদের খুব পছন্দের জায়গা। সেখানে অনেকবার হুমায়ূন আহমেদকে জামাল আবেদীন নিয়ে গেলেন।

ফেব্রুয়ারি ১৮ তারিখ ছিলো হুমায়ূন আহমেদের নবম কেমোথেরাপি। ২৪ জানুয়ারি দেশে চলে যাওয়ার ফলে ১৮ তারিখে উপস্থিত ছিলাম না। সেদিন হুমায়ূন আহমেদ ও শাওনকে আমার স্ত্রী রুমা হাসপাতালে নিয়ে যায়। ভর্তি করানো থেকে শুরু করে নির্ধারিত কক্ষে যাওয়ার পর কেমো শুরু পর্যন্ত রুমা হাসপাতালেই ছিলো। ১৯ ফেব্রুয়ারি আমি এসেই সরাসরি হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গিয়ে অবসর প্রকাশনার আলমগীর রহমান এবং অন্যপ্রকাশ’র দেওয়া বিভিন্ন মাছ, মাংস ও হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের খাবার বাসায় রেখে আসি। বিকেলে যাই হাসপাতালে। সালাম দিলাম। বললাম আমার অনুপস্থিতিতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা? বললেন, রুমা একেবারেই বুঝতে দেয়নি। সেখানেই অন্যপ্রকাশের প্রকাশিত বই ‘এ্যাঙ্গা ব্যাঙ্গা চ্যাঙ্গা’ বইয়ের প্যাকেটটি হুমায়ূন আহমেদের হাতে দিলাম। আরও দিলাম অনন্যা প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী মনিরুল ইসলামের দেওয়া ডলারের প্যাকেট। কাকলী প্রকাশনার সেলিম ভাইও হুমায়ূন আহমেদের সম্মানী দিতে চেয়েছিলেন জানালাম। তখনি ঢুকলেন হাসপাতালে রনি বড়ুয়া। কাজ শেষে করে বাড়ি যাওয়ার আগে একবার দেখতে আসছেন হুমায়ূন আহমেদকে। কথা হলো আমার অনুপস্থিতিতে কোনো অসুবিধা হলো কিনা। রনি বড়ুয়াও বললেন রুমা বুঝতেও দেয়নি আমার অনুপস্থিতি। পরের দিন আবার কানাডা থেকে কবি ইকবাল হাসান ও স্থপতি শিখা আহমাদকে নিয়ে গেল রুমা বেলভ্যু হাসপাতালে। সেখানে অনেক হাসাহাসি, জোকস করেন হুমায়ূন আহমেদ। হাসপাতালের বিছানায় বসেই হুমায়ূন আহমেদ তাদের শোনালেন, একবার একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি, আমার পাশে জাতীয় স্মৃতি সৌধের ডিজাইনার মইনুল হোসেন। অনুষ্ঠান শুরু হলো। হঠাৎ মইনুল বললেন, আপনি আমার চেয়ারটায় বসুন। প্লিজ। আমি কারণ জানতে চাইলাম না- চেয়ার বদল করলাম আমরা। একটু পর মইনুল আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে যা বললেন, শুনে আমি বিস্মিত। বললেন, দরোজার দিকে তাকিয়ে দেখুন কারা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকালাম-কিছু নেই। বললাম, কিছুইতো দেখছি না। মইনুল বললেন, ভালো করে দেখেন- তিনটা জ্বিন কেমন পথ আগলে দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। দরোজা দিয়ে আমি কীভাবে বেরুবো? বললাম, মইনুল আপনি আমার পিছন পিছন বেরুবেন। জ্বিনরা আমাকে ভয় পায়। আপনার কিচ্ছু হবে না।

শিল্পী সুলতান সব সময় পকেটে বিড়াল নিয়ে হাঁটতেন। আর মাঝে মধ্যেই নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলতেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন জিজ্ঞেস করলে বলতেন, কার সঙ্গে আবার-তেনাদের সঙ্গে। একবার বললেন, হুমায়ূন, জ্বিনদের অত্যাচারে অস্থির হয়ে আছি। সারাক্ষণ কানের কাছে খালি বিড়বিড় করে। কী যে বলে কিছুই বুঝি না। তো একবার, শিল্পী সুলতান গেলেন নিউমার্কেট। পকেটে দুটো বিড়াল ছানা। পকেটমার পিছু নিল তাঁর-যদি কিছু পাওয়া যায়! হঠাৎ দেখা গেল, পকেটমার চিৎকার করে দৌড়-মানিব্যাগ হাত কামড়ে দিয়েছে। এভাবে একেরপর এক জোকস বলে গেলেন তিনি।

হুমায়ূন আহমেদের এই জোকসগুলো নিয়ে ইকবাল হাসান বাংলাদেশের সমকাল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটা লেখা লিখে সে সময় আলোড়ন তোলেন। ইকবাল হাসান ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গিয়েও তাদের সাথে সময় কাটান।

পরের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি, জাতিসংঘের সামনে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান নিয়ে খুব ব্যস্ত। রুমা দেখলাম সময় পেলেই হাসপাতালে যাচ্ছে, জ্যামাইকার বাসায় যাচ্ছে। বিভিন্ন ফ্রেমিংয়ের স্টোরে যাচ্ছে। আমার অনুপস্থিতিতে দেখলাম রুমার সাথে মেহের আফরোজ শাওনের একটা হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে। আগে গাড়িতে উঠলে আমি আর রুমা সামনে বসতাম। অভ্যাসবশত আমি সেভাবেই উঠছিলাম। রুমা বললো তুমি মাঝখানে বসো, শাওন বসুক সামনে। রুমা শাওনকে নাম ধরেই বলে শুরু থেকে। আমি সম্বোধন করতাম ম্যাডাম। ফেব্রুয়ারি মাসে মাজহারুল ইসলামের স্ত্রী স্বর্ণা ইসলাম এবং তাঁদের সন্তান অমিয় এলে জ্যামাইকার বাড়িতে আনন্দের ফল্প বয়ে যায়। বিশেষ করে নিষাদ পায় তার খেলার সাথী। আবার শাওন ক্লান্ত অবসন্ন হৃদয় থেকে কিছুটা রিলিফ পান। এছাড়া মাজহার তনয়কেও হুমায়ূন আহমেদ খুব ভালোবাসতেন। কেমোথেরাপির দিন সকাল থেকে আউট পেশেন্টের এভাস্টিন নেওয়া ও ভর্তি হওয়ার পর আমি চলে আসতাম। এরমধ্যে কখনো মাজহারুল ইসলাম কখনো শাওন হুমায়ূন আহমেদের জন্য খাবার নিয়ে হাসপাতালে চলে আসতেন। আউট পেশেন্ট বিভাগ থেকে এভাস্টিন দেওয়ার পর ভর্তির কাজ শেষ করে হুমায়ূন আহমেদকে রুমে আনার পর প্রতিদিনই আমাকে বলতেন, এবার। তুমি চলে যাও। তোমার কাজ শেষ।

দুপুরের খাবার এলে আমি চলে যেতাম। মাজহারুল ইসলামের সাথে অমিয় আসতো। অমিয়কে দেখে হুমায়ূন আহমেদ খুব খুশি হতেন। অমিয়’র জন্য তাঁকে দেওয়া খাবারগুলো রাখা হতো। আমাকে বলতো, অমিয় খুব ভালোবাসে এধরনের খাবার। হাসপাতালে অমিয় এলে তার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ খুঁজে পেতেন নিষাদ-নিনিতের ছায়া। আমার যতদূর মনে পড়ে সেবছর স্বর্ণা ইসলামদের দেশে ফেরার তারিখ দুবার পরিবর্তন করা হয়। ২০১২ সালের ৪, ৩১ মার্চে ও এপ্রিলের ১৩ তারিখে বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ ১০, ১১ ও ১২তম কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। মার্চের ৪ তারিখে আমার অনুপস্থিতিতে রুমা নিয়ে যায় হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে ১০ম কেমো দিতে। ১৮ মার্চ পরের দুটো কেমোথেরাপির সময়

আমি যথারীতি সাথে ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন রনি বড়ুয়া, দেশে যাওয়ার পর আমার স্ত্রী রুমা সাহা হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতালে আনা নেওয়া থেকে শুরু করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, এপয়েন্টমেন্ট করার বিষয়গুলো দেখতো। এমনি একদিন কেমো নেওয়ার আগে ব্লাড টেস্ট করার কথা। ডাক্তার অর্ডার করেছেন। কোনো না কোনো কারণে তা কম্পিউটারে আপডেট হয়নি। রনি বড়য়া তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করেন রুমার সাথে। রুমা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যায় বেল্যুতে। কিন্তু সেদিন প্রচণ্ড রোগীর ভিড়। নার্সরা রক্ত নিতে দেরি করছিলো। স্যার যাতে বিরক্ত না হন তাই রনি বড়ুয়া নার্সদের সাথে কথা বলে নিজেই স্যারের রক্ত নিলেন। হুমায়ূন আহমেদ রনি বড়ুয়ার হাতে রক্ত দেওয়ার পর বলেছেন, সেদিন তার কোনো ব্যথাই লাগেনি। এই কথাগুলো রনি বড়ুয়া এখনও ভোলেননি। তার বিভিন্ন স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের সাথে। বেলভ্যু হাসপাতালের মেডিকেইড ডিপার্টমেন্টের কারমান গঞ্জালেস’র কথা কখনোই আমি ভুলবো না। কতভাবে যে তিনি সাহায্য করেছেন, তা ভোলার নয়। এবং তা সম্ভব হয়েছে হুমায়ূন আহমেদ একজন লেখক বলে। হাসপাতালের বিল নিয়ে প্রতি কেমোথেরাপি এবং ভিজিটের পরপরই যেতে হতো একাউন্ট সেকশনে। প্রথম থেকেই আবেদন করা হয় সবচেয়ে কম মূল্যে যাতে চিকিৎসা করানো যায়। সেভাবেই কাগজপত্র দিয়ে মেডিকেল কার্ড করা হয়। প্রথম কেমোথেরাপির পর দুদিন হাসপাতালে থাকাসহ মোট বিল আসে ৮,৫০০ ইউএস ডলার। বিল পাওয়ার পর আমি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সাথে কথা বলি। বললাম, আপনি বললে আমি মুক্তধারা থেকে স্পন্সর করে টেম্পরারি মেডিকেল কার্ডের জন্য চেষ্টা করতে পারি। স্যার আপত্তি করেননি। পরের দিনই আমি কাগজপত্র নিয়ে তার জন্য টেম্পরারি মেডিকেল কার্ডের আবেদন করলাম। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ডাক পড়লো মেডিকেইড ডিপার্টমেন্টে। আমি জানি, স্যার সেখানে যেতে বিব্রত বোধ করবেন। তাই তার পক্ষে আমি একাই গিয়ে দেখা করলাম। কাগজপত্র দিলাম, স্পন্সর হিসেবে আমি এবং মুক্তধারার নাম দিয়ে ট্যাক্সের কাগজপত্রও জমা দিলাম। ৭ দিন পর দ্বিতীয় কেমোথেরাপির আগেই গায়েনিজ সুপারভাইজার কারমান গঞ্জালেস ইমার্জেন্সি মেডিকেইড বিল পরিশোধের ফরম দিলেন। প্রতিবার চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তারের কাছ থেকে ফরম নিয়ে তা পূরণ করে জমা না দিলে বিল জমে যেতো। দুসপ্তাহের জন্য আমি দেশে যাওয়ার পর এসে দেখি হাসপাতাল থেকে আমার ঠিকানায় কেমোথেরাপির বিল পাঠানো হয়েছে। ডাক্তারের কাছ থেকে কাগজে স্বাক্ষর করে এনে সে বিল ৩ সপ্তাহ পর এডজাস্ট করলাম। নভেম্বর থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এভাবে বিল আসতে থাকে, পরে মেডিকেইড অফিসে তা এডজাস্ট করাতে হতো। কারমানকেও আমি হুমায়ূন আহমেদের ইংরেজি বই উপহার দিয়ে এসেছি মৃত্যুর পর। এ সময় কেমোথেরাপির দিন প্রতিদিন সকালেই আমি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে চলে যেতাম। আমার স্ত্রী রুমাই তার গাড়িতে আমাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। ছেলেমেয়েদের একান্ত জরুরি কোনো প্রয়োজন থাকলে মুক্তধারার শাহীন পৌঁছে দিতো। কোনো দিন এমনও হয়েছে, শাহীন ঠিক সময়ে না আসায় আমি স্যারকে সাবওয়েতে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। ট্রেনে ৫৯ স্ট্রিটে নেমে সেখান থেকে ইয়েলো ক্যাব ধরে ২৮ স্ট্রিট এবং প্রথম এভিনিউর বেলভ্যু হাসপাতাল। এছাড়া মুহাম্মদ সরোয়ারও একদিন হাসপাতাল থেকে হুমায়ূন আহমেদকে বাড়িতে পৌঁছে দেন। সেদিন সরোয়ার হুমায়ূন আহমেদকে বলেন, আপনি সহসাই দেশে যাবেন। এতে হুমায়ূন আহমেদ খুব আনন্দ পান। পরবর্তীতে সত্যি সত্যি যখন দেশে যাওয়া ফাইনাল হলো, তখন সরোয়ারের কথা আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন। সরোয়ার হলেন নির্মাণ ব্যবসায়ী এবং সৌখিন জ্যোতিষ। মোট ১২টি কেমোথেরাপির মধ্যে দুটির ভর্তির দিন আমি ছিলাম না। জানুয়ারির ২১ তারিখ অষ্টম থেরাপির দিন রুমা নিয়ে গেলে হুমায়ূন আহমেদকে। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ ছিলো নবম থেরাপির দিন। সেদিন আমিও ছিলাম। ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। রুমা আগে থেকেই জ্যোতিদাকে বলে রেখেছিলো। জ্যোতিদা লাগ্লাডিয়া কলেজে বাংলা শেখাতে নিউইয়র্কে আসতেন। কখনো তিনি তাঁর নিজের আপস্টেটের বাড়িতে থাকতেন। আবার কখনো হুমায়ূন আহমেদের বাসায় কিংবা আমাদের বাসায় থাকতেন। কোনো দিন কেমো শেষ হলে গাজী কাশেম, নূরউদ্দীন এবং রুবেলও স্যারকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যেতেন। ১২টি কেমোথেরাপির পর হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী চিকিৎসা নির্ধারণের জন্য ড, সিলভিয়া জেইন ২৫ এপ্রিল এপয়েন্টমেন্ট দেন। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, রুমা এবং আমার উপস্থিতিতে ড. জেইন বললেন। তিনি ক্যাট স্ক্যান, কোলনের এক্সরেসহ আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৩০ এপ্রিল ডা. জেইন আবারও এপয়েন্টমেন্ট দেন। ড. জেইন বললেন রিপোর্ট নিয়ে তিনি সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলবেন। এরমধ্যে অবশ্য হুমায়ূন আহমেদকে এক্সরে এবং ক্যাট স্ক্যান করার জন্য দুদিন হাসপাতালে যেতে হয়।

৩০ এপ্রিল। হুমায়ূন স্যার, শাওন, রুমা আর আমি তখন ডা. জেইনের কক্ষে। colonoscopy-i result দেখে ড. জেইন বললেন কোলনে ৬ থেকে ৮ মি.মি. আকারের কিছু ছোট আকৃতির sessile polyps দেখা গেছে। ডা. জেইন সার্জারি বিভাগে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন। এরমধ্যে চশমা পরা মধ্যবয়স্ক একজন ডাক্তার আর তার পেছনে আরো একজন তরুণ ডাক্তার ডা. জেইনের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পরিচয় দিলেন ‘আ অ্যাম ড. মিলার, সার্জেন্ট। পরিচয় করিয়ে দিলেন সহকর্মীর। বললেন, তারা মনে করছেন ১২টি কেমোথেরাপির ফলে হুমায়ূন আহমেদের বৃহদান্ত্রের যে অংশে ক্যান্সার রয়েছে সেটা কেটে ফেলে দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেবেন। আর লিভারের যে অংশে sessile_polyps রয়েছে। সেগুলো local embolization technique-এর মাধ্যমে দূর করা হবে। তবে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৭ মে টিউমার বোর্ড গঠন করা হলো। এপ্রিলের ৭ তারিখ ছিলো হুমায়ূন আহমেদের জীবনের বিশেষ দিন। এ দিন ডা. মিলারের নেতৃত্বে সার্জারি বোর্ড তাঁর সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনকোলজিস্ট সিলভিয়া জেইনও ছিলেন সেই বোর্ড মিটিং-এ। দুপুর দুটোয় এপয়েন্টমেন্ট। হুমায়ূন আহমেদ স্যার, মেহের আফরোজ শাওন, ফানসু মন্ডল আর আমি। এ দিন ফানসু মন্ডল জ্যামাইকা থেকে স্যারকে বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমি আগেই পৌঁছে যাই হাসপাতালে। ড. জেইন স্যারের সাথে সার্জারি বিষয় নিয়ে কিছু কথা বললেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে নানা প্রশ্ন করলেন। মেহের আফরোজ শাওন প্রশ্ন করলেন। আমিও প্রশ্ন করলাম। হুমায়ূন আহমেদ ডা. জেইনকে বললেন সার্জারি হলে তার আগে তিনি ২ সপ্তাহের জন্য দেশে যেতে চান। ডা. জেইন বললেন, কোনো অসুবিধা নেই। সেভাবেই তারিখ নির্ধারণ করা হবে যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশ থেকে ফিরে আসা যায়। তবে দেশে যাওয়ার আগে সার্জারির আগে যা যা প্রয়োজন সব যেন করা হয়, সে বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হলো। কিছুক্ষণের জন্য ডা. জেইন আমাদের বসিয়ে রেখে বাইরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন ডা. মিলার, তাঁর সহযোগী আর মেডিকেল বোর্ড-এর সদস্যদের সাথে নিয়ে। স্বভাসুলভ হাসি দিয়ে ড. মিলার আলোচনা শুরু করলেন। জানালানে কীভাবে সার্জারি করা হবে, তার পদ্ধতিগুলো কী হবে এইসব। হুমায়ূন স্যার ডা. মিলারকে এধরনের সার্জারির ফলাফল সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। ডা. মিলার তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, তিনি সার্জারি করলে শতভাগ সাকসেসফুল হবেন। হুমায়ূন আহমেদেরপর এক মিনিটও চিন্তা করেননি সার্জারি নিয়ে। মেহের আফরোজ শাওনসহ আমরাও আনন্দে আত্মহারা। স্যার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ক্যান্সারমুক্ত হবেন। ড. মিলারের সহযোগী ভারতীয় জ্যোতি নারাং এসে হুমায়ূন আহমেদের সকল রেকর্ড অনকোলজি বিভাগ থেকে সার্জারি বিভাগে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ক্যান্সার বিভাগের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টিমটি সার্জারির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। সার্জিকাল অনকোলজি বিভাগের ডাক্তার জর্জ মিলার সব রিপোর্ট দেখে এ দিন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময় হওয়া সম্ভব বলেও জানালেন। ১২ জুন অস্ত্রোপচারের তারিখ নির্ধারণ করা হলো। আমরা ডা. জেইনের রুম থেকে চলে গেলাম তৃতীয় তলায় জ্যোতি নারাংয়ের রুমে। সেখানে বিভিন্ন সেকশনে দ্রুত এপয়েন্টমেন্টগুলো নেওয়া হলো। সাধারণ সিটি হাসপাতালে ১ মাসের যেসব এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না সেগুলো জ্যোতি সারাং নিজস্ব উদ্যোগে ডা. মিলারের কথা বলে ১০দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করলেন। প্রায় দিনই হাসপাতাল, আজ এ পরীক্ষা, কাল সে পরীক্ষা। হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু একটুও বিরক্ত হচ্ছেন না। দেশে যাওয়ার আনন্দে তিনি আত্মহারা। কখনো ফানসু মন্ডলের গাড়িতে, কখনো আমাদের গাড়িতে স্যার বেলভ্যু হাসপাতালে আসা যাওয়া করছেন।

দেশে যাওয়া

৯ মে ২০১২, রাত ৯টায় কুয়েত এয়ারওয়েজ-এ বাংলাদেশে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। সাথে স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন আর দুই সন্তান নিষাদ, নিনিত। বন্ধু-বান্ধব পরিবেষ্টিত হাস্যোজ্জ্বল হুমায়ূন আহমেদকে এয়ারপোর্টে বাঙালিরা ঘিরে ধরেন। সকলেই এই বরেণ্য লেখকের শারীরিক অবস্থার খবর নেন, ছবি তোলার জন্য ভিড় করেন। এয়ারপোর্ট তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্যার বলেন, মা, মাতৃভূমি আর বন্ধুবান্ধবদের দেখতে এবং নুহাশ পল্লীর বৃক্ষদের সাথে সময় কাটাতে দেশে যাচ্ছেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকায় ফিরে আসবেন। তিনি আরও জানান, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে যাবেন। সেখানে তার মা অপেক্ষা করছেন। এয়ারপোর্টে লেখককে বিদায় জানাতে যান নাসির আলী মামুন, নূরুজ্জামান, ফানসু মন্ডল, মাসুদুল হক রুবেল ও তাঁর স্ত্রী, গাজী কাশেম, আমি আর আমার স্ত্রী রুমা সাহা। উপস্থিত ছিলেন বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহের, সাংবাদিক শিহাবউদ্দীন কিসলু। ব্যক্তিগত কাজে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখা হলো ‘পরিচয়’র সম্পাদক নাজমুল আহসানের সাথে।

নিউইয়র্কে ফিরে আসা

হুমায়ূন আহমেদ আটলান্টিকের উপর দিয়ে উড়ে এসে নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে নামলেন। বললেন, আমি ভালো আছি। দেশে ভালো ছিলাম। নুহাশ পল্লীতে অনেক ভালো ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে ২ তারিখ রওয়ানা হয়ে প্রায় ১০ ঘণ্টা যাত্রাবিরতি দিল্লিতে এবং আড়াই ঘণ্টা ব্রাসেলসে। নিউইয়র্ক সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় জেট এয়ারওয়েজ-এ জেএফকে বিমানবন্দরে (GFK Airport) এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে লেখককে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, ফানসু মন্ডল, সুফিনাজ মন্ডল স্বপ্ন, গাজী কাশেম, মুনিয়া মাহমুদ, নূরুদ্দীন আহমেদ, মাসুদুল হক রুবেল আমি আর রুমা। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক ঠিকানার সভাপতি সাঈদুর রব ও এনা সম্পাদক লাবলু আনসারও ছিলেন। হাস্যোজ্জ্বল হুমায়ূন আহমেদের সাথে দুই পুত্র নিষাদ, নিনিত এবং স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ছাড়াও অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম ইমিগ্রেশন এবং ব্যাগেজ নিয়ে বাইরে পৌঁছালেন দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে। নির্ধারিত সময়ে প্লেন এসে নামে কিন্তু নিনিতের স্ট্রলার না আসায় এয়ারপোর্টে কিছুক্ষণ দেরি হয়। সবসময়ের মতো এবারও হুমায়ূন আহমেদ সরকারি বা অন্য কারও গাড়িতে না উঠে আমাদের গাড়িতেই বাসায় পৌঁছালেন। এরপর ওজোনপার্কের বাসায় এসে গোসল করে বললেন, নিউইয়র্কের বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েও একধরনের ভালো লাগছে। প্রিয় সন্তান নিষাদকে বললেন, বাবা আমরা কোথায় এসেছি? এটা আমাদের আর একটা বাসা।

৪ জুন সকাল থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তৃতীয় পর্বের চিকিৎসা শুরু হয়। ৫ জুন এনেসথেসিয়া বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১২ জুন সার্জারি বিভাগ অস্ত্রোপচারের ক্লিয়ারেন্স দেয়।

আমাদের বাসায় হুমায়ূন আহমেদ

 ৯ জুন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলো স্যার জ্যাকসন হাইটসে আমাদের বাসায় আসবেন। তখন আমরা বইমেলার আয়োজন নিয়ে খুব ব্যস্ত। প্রতি সপ্তাহেই হয়তো মুক্তধারায় নতুবা আমাদের বাড়ির পেছনে বইমেলার প্রস্তুতিসভা চলছে। এরমধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ইচ্ছে অনুযায়ী বাইরের কাউকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে শুধু সীমিত সংখ্যক বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। স্যারের পছন্দের খাবার ইলিশ মাছ, দেশি কই, পাবদা, খাসির মাংস ও কয়েক রকমের ভর্তা রান্না করেছে রুমা। রুমার এক বান্ধবী রান্না করে এনেছে হুমায়ূন আহমেদের আর এক পছন্দের খাবার গরুর মাংস। হুমায়ূন আহমেদ এলেন অনেক দেরিতে। রাত প্রায় ৯টা বাজে। তেমন কিছুই মুখে দেননি তিনি। কেমন যেন নিষ্প্রভ দেখায় তাকে। তবে এর মধ্যেও মাজহারুল ইসলাম এবং মুনীয়া মাহমুদকে নিয়ে হাসিঠাট্টা কম হয়নি। রাত ১২টা পর্যন্ত সেদিন আড্ডা চলে। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মিসেস তহুরা আলী, নাসিমুন নাহার নিনি, মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম, মুনীয়া মাহমুদ, নূরউদ্দীন, রুবেল, ফানসু মন্ডল, সেমন্তী ওয়াহেদসহ আরও কয়েকজন পারিবারিক বন্ধু সেদিন উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্তকে ১২ জুন সকাল ৫টায় গাড়ি নিয়ে তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।

সফল অস্ত্রোপচার

১২ জুন নিউইয়র্ক সময় ভোর সাড়ে ৫ টায় ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গাড়িতে হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, পূরবী বসু বেলভ্যু হাসপাতালে আসেন। আরেকটি গাড়িতে আসেন মাজহারুল ইসলাম, ফানসু মন্ডল, রুবেল। ৬ টার মধ্যে আমি পৌঁছে যাই বেলভ্যু হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন বিভাগে। ভোর সাড়ে ৬ টায় রেজিস্ট্রেশন শেষ হলেও সকাল ৮টা ২২ মিনিটে অস্ত্রোপচার শুরু হয়। শেষ হয় দুপুর ৩টা ৩০ মিনিটে। বেলভ্যু হাসপাতালের ১১ তলায় ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অস্ত্রোপচার শেষে অনকোলজি বিভাগের সার্জন ড্যানিয়েল কুজনিন মেহের আফরোজ শাওনও আমাদের জানান, কোলনে সফল অস্ত্রোপচার ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের লিভারে যে তিনটি টিউমার ছিলো তাও লেজারের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। লোকালাইজড এ্যাম্বুলাইজেশন নামে অত্যাধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে কাটা-ছেঁড়া ছাড়াই লিভারের ভিতরে থাকা ক্যান্সার সেলগুলো ধ্বংস করা হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে আইসিসিউই’তে আনা হলো স্যারকে। সকাল থেকে আমরা সকলে পার্শ্ববর্তী কক্ষে অপেক্ষা করছিলাম। স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছিল রোগীদের অস্ত্রোপচারের আপডেট। আমি কিছুক্ষণ পরপরই গিয়ে খবর নিচ্ছিলাম। ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এলেন। তাঁর গাড়ি পার্ক করে রেখেছিলেন মিটারে। তাই তিনিই আগে গেলেন সার্জারি থেকে আসার পর হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে। এসময় দেখে এলেন বেলভ্যুর কর্মী রনি বড়ুয়া। এরপর মেহের আফরোজ শাওন। চোখ খোলার পরই হুমায়ূন আহমেদ ‘কুসুম’ ‘কুসুম’ বলে ডাকেন। এ সময় তিনি পানিও খেতে চান। এরপর এক এক করে আমি, মাজহারুল ইসলাম, পূরবী বসু, ফানসু এবং রুবেল তাঁকে দেখে আসি। নিউইয়র্ক থেকে একসময় প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রবাসী সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহও তাঁকে দেখতে যান।

১৩ জুন এবং ১৪ জুন বেলভ্যুর ১০ম তলায় স্যার পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে ছিলেন। হাসপাতালের তরল খাবার খাচ্ছিলেন, তার শরীর ছিলো ব্যথায় জর্জরিত। চিকিৎসকদের নির্দেশ অনুযায়ী ১১ জুন সকাল থেকেই তরল জাতীয় খাবার দেওয়া শুরু হয়। দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নির্ধারিত ওষুধও গ্রহণ করেন। লেখক তখন একটু দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তবে সার্জারির আগে অনেক রোগীকে স্ট্রেচারে নেওয়া হলেও স্যার হেঁটে এবং এলিভেটরে করে ১৫ তলা থেকে ১১ তলায় যান।

অনকোলজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সার্জন জর্জ মিলার-এর তত্ত্বাবধানে ড্যানিয়েল কুজনিন ছাড়াও সার্জন উইলিয়াম এবং আরও দুজন সহকারি সার্জারিতে অংশ নেন। ড্যানিয়েল কুজনিন জানান, অস্ত্রোপচার শতভাগ সফল, তেমনি লিভারে থাকা তিনটি টিউমারও বিলুপ্ত করা হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদের লিভার মেটাস্টাসিসের মাইক্রোওয়েব এ্যাবলাশন এবং লো এ্যান্টেরিয়র রিসেকশন নামক অপারেশনের এ্যাটেন্ডিং সার্জন ছিলেন জর্জ মিলার। অপারেটিং সার্জনের দায়িত্ব পালন করেন ডা. ব্রিটনি উইলিয়ামস। প্রথম সহকারি ডা. ড্যানিয়েল কুজন। অপারেশনে আনুমানিক রক্তক্ষরণ: ৫০০ সিসি। মুত্র নিষ্কাশন ১৭৫ সিসি। সার্জারির পর স্যারের কোনো ড্রেইন ও জটিলতা ছিলো না। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হুমায়ূন আহমেদকে ১২ জুন বিকেল সাড়ে ৩ টায় টিউবমুক্ত, বল (স্থিতিশীল) বহাল করা হয়েছে অ্যানেসথেসিয়া আগের/পরের কেয়ার ইউনিট। অপারেশনের যৌক্তিকতা/কারণ (Indication), রোগী ৬২ বৎসর বয়স্ক পুরুষ যাকে স্টেজ-৪ সিগময়েড এ্যাডেনোকারসিনোমা (ক্যান্সার)-এর জন্য নিওঅ্যাডজুট্যান্ট Folox দেওয়া হয়েছে। ২০১১-এর সেপ্টেম্বরে রোগ নির্ণয়ের সময়েই লিভার মেটাস্টাসিস (ছড়িয়ে পড়া) পাওয়া গিয়েছিলো। রোগের পুরনো ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। করোনারি আর্টারি ডিজিজ যার কারণে ২০০২ সালে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাস্ট (ওপেন হার্ট) হয়েছে এবং ইনস্যুলিননির্ভর ডায়াবেটিস ‘মলিটাস’। রোগ অতঃপর একটা সিটিস্ক্যান ও পেটের এমআরআই করেছে (ক্যান্সার) পুনঃস্টেজিং করার জন্য। উল্লেখ্য তিনটা লিভার লেশন ছিলো সেগমেন্ট ৩,৬ এবং ৭ এ। তা ছিলো ছড়িয়ে পড়া রোগের সামঞ্জস্যপূর্ণ যা পূর্বের তুলনায় ছোট ছিলো এবং কোলনে (অন্ত্রে) কোনো Mass পরিলক্ষিত হয়নি। তাকে পুনরায় কোলনোস্কপি করা হলে প্রবেশ দ্বারের থেকে ১৮ সে.মি. দূরে একটা পরিপূর্ণ অবরোধ না করা Mass দেখা যায়। বায়োপসির ফলাফল ছিলো অ্যাডনেনা কারসিনোমার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই মাস Mass-কে চিহ্নিত করা হয়। রোগীকে শল্য ক্যান্সরবিদ দ্বারা দেখানো এবং ফলে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এ সময়। অপারেশন শেষে রোগীকে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া থেকে কোনো ঘটনা ছাড়াই জাগানো হয় এবং টিউবমুক্ত করা হয় কোনো ঘটনা/সমস্যা ছাড়াই। তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় পোস্ট অ্যানেসথেসিয়া কেয়ার ইউনিটে সুস্থ অবস্থায়। ১২ থেকে ১৯ জুন ৮দিন হাসপাতালে সমস্যাবিহীন থাকার পর ১৯ জুন সকালে তাঁকে রিলিজ করা হয়।

১৯ জুন সকাল ৮টায় হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতাল থেকে ছাড়ার আগে রেজিস্টার্ড ফিজিসিয়ান এ্যাসিস্ট্যান্ট (আরপিএ) জ্যোতি নারাং সূত্রে জানা যায়, ৬২ বৎসর বয়স্ক পুরুষ পুরনো মেডিক্যাল হিস্টরি করোনারি আর্টারি ডিজিজ এবং করোনারি আর্টারি বাইপাস প্লাস্ট উত্তর/পরবর্তী ইসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ, ৬০ ঊর্ধ্ব বয়সের ধূমপান ইতিহাস, লিভার মেটাস্টাসিস-এর কারণে প্রাথমিক উপস্থিতি রোগীর ইসিজি হয়েছিল মে, ২০১১ সালে এবং সেপ্টেম্বর ২০১১-তে সিঙ্গাপুরে মোটামুটি অগ্রগতি/ বিভাজিত সিগময়েড কোলন এর এ্যাডেনোকার্সিনোমা নির্ণিত হয়। টিউমারটি ছিলো ১৪-১৮ সে.মি. এবং প্রায় গোলাকার। সেটিতে লিভার মেটস ( ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার) দেখা যায়। রোগী MSKCC-60 (Memorial Sloan Katring Cancer Center) for sconti 57915 উপস্থিত হয়। MSKCC-তে চিকিৎসা পূর্ব CEA ছিলো ৯১.৭। রোগীকে ১ সাইকেল (CYCLE) FOLFOX ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে শুরু করা হয় AVASTIN ছাড়া। কারণ তখন তার মলদ্বারে রক্তপাত হচ্ছিল। চার চক্র (CYCLE) চিকিৎসার পর CT স্ক্যান কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হলেও সার্জারির উপযুক্ত হয়নি। পাঁচ চক্রে (CYCLE) কেমো দেবার পর রোগী বেলভ্যতে উপস্থিত হন ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ তে। AVASTIN সহকারে আরও ৭ চক্র কেমো চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং সর্বমোট ১২ চক্র শেষ হয় ১৪ এপ্রিল ২০১২ তে। ১৩ এপ্রিল ২০১২ রোগীকে ১ মার্চ ২০১২ গ্যাস্ট্রোরেন্টেলজি (Gastroenterology) বোর্ডে উপস্থাপিত করা হয়। লিভারের চার দিকে (ক্যান্সার) ছড়িয়ে পড়ার কারণে রোগীকে সার্জারির ক্যান্ডিডেট মনে করা হয় না। ১২ চক্র চিকিৎসার পর ১৪ এপ্রিল ২০১২ তে একটা সিটিস্ক্যান করার পর লিভার মেটস ক্ষুদ্র দেখা যায় এবং বক্ষে ও কোলনে নতুন রোগ দেখা যায়নি। ১৩ এপ্রিল ২০১২ এমআরআই-তে লিভারে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেটস যা রোগ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সংগতিপূর্ণ লক্ষ করা যায়। ১ মে ২০১২-তে কোলনোস্কপিতে TRANSVERSE COLON-এ কিছু SESSILE POLYP পাওয়া যায় যা ব্যবচ্ছেদ করে ফেলা হয়। একটা ১৪ মি.মি. ঝুলন্ত পলিপ সিগময়েডে দেখা যায় যা কেটে ফেলা হয়। একটা ক্যান্সারস্বরূপ STENOSIS (সংকোচন) অসম্পূর্ণ অবরুদ্ধকারী প্রবেশদ্বারের প্রায় ১৮ সে.মি. দূরে পরিলক্ষিত হয় যা বায়োপসি করা এবং চিহ্নিত (Tattoed)। করা হয়। রোগীকে আবার ৬.১ কনফারেন্সে উত্থাপিত করা হয় এবং মনে করা হয় যে লিভারে RFA (Radio Freqeuncey Ablation) এবং অপারেশনের উপযুক্ত। ল্যাব ১২ এপ্রিল ২০১২ : CEA 6.2 (Carcino Embryonic Antisom) ১২ জুন ২০১২-তে রোগীকে উক্ত অপারেশনগুলো করা হয়। অপারেশন উত্তর কালে রোগীর বমি ভাব এবং বমি হয়েছিলো। অপারেশন এর পরদিন (POD#1) রোগীকে ক্লিয়ার লিকুইড খেতে দেওয়া হয়। প্লাভিক্স, এএসএ ৪১ মিলিগ্রাম। কখনো কখনো নিচের চাপ ৯০/৪০ হার্ট রেট-৮০, অক্সিজেন সিচুয়েশন ৯০-এর কোঠায়। রোগীর ইপিডুরাল Adjust করা হয়। অপারেশনের পরের দ্বিতীয় দিনে থোলি খুলে ফেলা হয়। রোগী মূত্র ত্যাগে সক্ষম হন এবং তাকে সাধারণ খাবার দেওয়া হয়। ৬২ বছর বয়স্ক রোগী ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিঙ্গাপুরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। সেখানে তার সিগময়েড কোলন সনাক্ত হয়। টিউমারটি ১৪ থেকে ১৮ সে.মি. বিস্তৃত হয়েছিলো। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে রোগীকে চিকিৎসার জন্য মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং হাসপাতালে আনা হয়। রোগীর মলাশয়ে রক্তপাতের দরুণ ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখ থেকে তার ১ম কেমোথেরাপি (Cycle 1 of FOLFOX) শুরু করা হয়। ৪ রাউন্ড কেমোথেরাপি ও সিটিস্ক্যান আশানুরূপ ছিলো না। ৫ম রাউন্ড কেমোথেরাপির পর ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে রোগীকে বেলভ্যুতে আনা হয়। ৬ষ্ঠ রাউন্ড কেমোথেরাপির পর অতিরিক্ত ৭ম রাউন্ড থেকে Avastin যোগ করা হয় এবং মোট ১২টি রাউন্ড ১৪ এপ্রিল ২০১২ তারিখে শেষ হয়।

১৯শে জুন রোগীকে ডিসচার্জ করে বাড়ি পাঠানো হয়। পরবর্তী ফলো আপ তারিখ দেওয়া হয় আগস্টের ১৫ তারিখে সার্জিক্যাল Oncology বিভাগে। ১৯ জুন সকালেই আমি বেলভ্যু হাসপাতালে যাই। সকালেই হুমায়ূন আহমেদকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়। মাজহারুল ইসলামকে দেখতে পেলাম হুমায়ূন আহমেদের পাশে। দেখি স্যার অনেকটা তৈরি বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। চোখে-মুখে আনন্দ। ৮দিন পর দেখা হবে নিষাদ-নিনিতের সাথে। আজ তো মহা আনন্দ। কেমো দেওয়া শেষে দুরাত পর বাড়িতে গেলেই যে আয়োজন হতো, আজ তো যাচ্ছেন ৮ দিন। বললেন সন্ধ্যায় রুমাকে নিয়ে তার বাসায় খেতে। স্যারের ওষুধের কয়েকটা প্রেসক্রিপশন দিলেন মাজহারুল আমার হাতে। নার্সের সাথে কথা বলে আমি ওষুধ আনতে ফার্মেসিতে গেলাম। কয়েক রকম ওষুধ নিতে সময় লেগে যায়। নিচে থেকে উপরে উঠছি, জ্যামাইকা থেকে শাওন এলেন ফানসু মন্ডলের গাড়িতে করে। আপস্টেট থেকে এলেন ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং পূরবী বসু। এরমধ্যেই হুমায়ূন আহমেদ ১২ তলা থেকে হেঁটে গাড়িতে উঠে রওয়ানা হলেন জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠার পর শাওন ফোন করলেন। বললেন, তারা রওয়ানা হয়েছেন। স্যার আবারও আমাদেরকে বাসায় যেতে বললেন। আমি বিনয়ের সাথে বললাম, আজ যাওয়া হবে না। আর একদিন আসবো। আসলে এ দিন সন্ধ্যায় ছিলো বইমেলার মিটিং। তাছাড়া একইদিনের পুরো অংশ আমার পক্ষে সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমি আগেই মাজহারুলকে অনুরোধ জানিয়েছি ওষুধগুলো নেওয়ার জন্য। এরমধ্যে দুজায়গায় ওষুধ তৈরি হতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গাড়ি আমাকে জ্যাকসন হাইটস নামিয়ে দিয়ে গেল। হুমায়ূন আহমেদের সফল সার্জারি এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজের খবরে বাঙালিপাড়া জ্যাকসন হাইটস-এ যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সেখানে ১৯ জুন সন্ধ্যায় তাই আমাদের আর যাওয়া হলো না। তবে হুমায়ূন আহমেদের সেই নিমন্ত্রণে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ যারা নিয়মিত যান তাদের কয়েকজন সেদিন উপস্থিত ছিলেন। ১৯ তারিখ রাতে আর আমার সাথে স্যারের আর কথা হয়নি। সেদিন আমিও খুব ব্যস্ত ছিলাম। ২০ জুন বিকেল ৬টা নাগাদ মুক্তধারায় মেহের আফরোজ শাওন ফোন করলেন। জানতে চাইলেন ডা. মিলারের নম্বর। আমি ডাক্তারের সহযোগি জ্যোতি নারাং-এর মোবাইল নম্বর দিলাম। নম্বরটা নিয়ে শাওন আর কিছু বললেন না। আমি কিছু প্রশ্ন করার আগেই তিনি ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিলেন।

আর ফেরেননি তিনি

২১ জুন ২০১২। সকাল ১১টা ৫ মিনিটে মাজহারুল ইসলাম ফোন করলেন। বললেন, ফানসু মন্ডল এবং তিনি হুমায়ূন আহমেদকে সকালে বেলভ্য হাসপাতালে নেওয়ার পথে স্যার ব্যথা সহ্য করতে পারেননি। ফলে ওজোনপার্ক এলাকা থেকেই ৯১১ কল করা হয়। ৯১১ হলো আমেরিকায় মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্স অথবা পুলিশসহ যেকোনো অতি জরুরি প্রয়োজনে। সাহায্যকারী ফোন নম্বর। নিউইয়র্ক সিটির এ্যাম্বুলেন্স এসে হুমায়ূন আহমেদকে জ্যামাইকা হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারা ইমার্জেন্সিতে আছেন। আমাকে জরুরি সেখানে যেতে বললেন। আমি তখন জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারা অফিসে। গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করে সাবওয়েতে E-train-এ জ্যামাইকা হাসপাতাল। মেডিকেল সেন্টারে সাড়ে ১১টা নাগাদ পৌঁছালাম। পৌঁছেই সরাসরি জরুরি বিভাগে গেলাম। স্যারের মুখে তখন অক্সিজেন মাস্ক। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন। স্যার আমাকে দেখতে পেলেন। ১৯ তারিখে বেলভ্য হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর আমার সাথে তাঁর আর দেখা হয়নি।

২১ জুন সকালে জ্যামাইকা হাসপাতালের ঘটনা। হুমায়ূন আহমেদের পাশেই দাঁড়ানো মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল। কর্তব্যরত চিকিৎসক হাসনাইন শাহেদ-এর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তাকে অক্সিজেন দেওয়া ছাড়া গত ২ ঘণ্টায় আর কিছুই করা হয়নি। বাঙালি ডাক্তার হাসনাইন, হুমায়ূন আহমেদকে ইমার্জেন্সিতে দেখেই যত দ্রুত রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে যা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তাই করেছেন। আমাকে দেখে চিনতে পারলেন, কথা হলো। অনেক রোগীর ভিড় ইমার্জেন্সিতে। ড, হাসনাইন বললেন, হুমায়ূন আহমেদের পেট ফুলে গেছে। তারা বাথরুম করবার জন্য চেষ্টা করছেন। এরমধ্যে মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডলের সাথে কথা হলো। আমি বুঝতে পারলাম না, স্যারকে হাসপাতালে আনার দেড় ঘণ্টা পর কেন আমাকে জানানো হলো? আবার গেলাম ডা. হাসনাইনের কাছে। একজন চাইনিজ সার্জেন্ট হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে দেখতে এলেন। বললেন সিটিস্ক্যান করাতে হবে। ডা. হাসনাইনও তখন ছিলেন সার্জেন্ট-এর সাথে। নার্সকে বললেন দ্রুত ব্যবস্থা করতে।

জ্যামাইকা হাসপাতাল (Jamaica Hospital)

সকাল ৯-৩২ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদেকে হাসপাতালে নেয়া হলেও আমি জানতে পারি সকাল ১১টায় মাজহারুর ইসলামের ফোনে। ১১টা ৩৫ মিনিটে আমি পৌঁছে যাই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে। সেখানে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে স্ট্রেচারে শায়িত অবস্থায় দেখতে পাই। এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি চিকিৎসক সৈয়দ হাসনাইনের সাথে কথা বলি জানতে পারি, হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার সম্ভাব্য যা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেন। হুমায়ূন আহমেদকে ২১ জুন ২০১২ সকাল ৯টা ৩২ মিনিটে জ্যামাইকা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। ৯টা ৩৭ মিনিটে হাসপাতালে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। ৯টা ৫৫ মিনিটে হাসনাইন শাহেদ নামে একজন বাংলাদেশী চিকিৎসক হুমায়ূন আহমেদকে এটেন্ড করেন এবং তাঁর চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। হুমায়ূন আহমেদকে সকাল ১০:১১ মিনিটে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তিনি বলেন, আমি বমি ও তীব্র ব্যথায় জর্জরিত হয়ে হাসপাতালে এসেছি। রোগীর ইতিহাসে বলা হয় তার করোনারী আর্টারি ডিজিজ, অন্ত্রের ক্যান্সার স্টেজ-৪ S/P_Embolizatoin, কেমো-উত্তর/পরবর্তী দুসপ্তাহ পূর্বে অন্ত্রের সার্জারি হয় বেলভ্যু হাসপাতালে। দুদিন আগে Discharge কৃত রোগীর জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, কনস্টিপেশন, ডায়রিয়া, গ্যাস নির্গত হচ্ছে। সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে রোগীকে গ্রহণ করা হয় AEO X 3 পেটের সার্জারি উত্তর-অভিযোগ পেটে ব্যাথা, বমি ভাব এবং বমি। শ্বাস স্বাভাবিক এবং ক্লেশমুক্ত। ফুসফুস পরিষ্কার। ডা. হাসনাইন পরীক্ষা করেছেন, ওষুধ অর্ডার হয়েছে। রোগীকে নিরীক্ষণ করা হবে। এটেন্ডেট ছিলেন তখন Yanina Levaridva RN.

রোগীকে পরীক্ষা করা হয়েছে ১১টা ১৫ মিনিটে। সার্জারির স্থলে সংযোজন বা বিচ্যুতি হয়েছে বলে চিকিৎসকের ধারণা। রোগীকে ফুইড দেওয়া হচ্ছে এবং ফলি সংযোজন সিটিস্ক্যানের অপেক্ষায়। এ সময় ডাক্তারকে জানানো হয় যে, ফ্যামেলি স্টেইটস দ্যাট, পেশেন্ট হ্যাড এ ফল ফ্রম চেয়ার ইয়েস্টারডে’ গতকাল রোগী চেয়ার থেকে পড়ে যান। ড. হাসনাইনকে রোগীর সমস্যার কথা বর্ণনা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল। সকাল ১১টা ৪২ মিনিটে একটা স্ট্রেচারে বসা অবস্থায় রোগীকে গ্রহণ করা হয়। Alert/Oriented X 3 রোগী কথা বলেছেন, কোন ব্যথা অস্বীকার করেছেন, হার্ট মনিটর সংযুক্ত ও হার্ট রেট-১৪০। রক্তচাপ ১৬১/৭৭ Intravenous Normal saline চলে। প্রাথমিক কেয়ার ডাক্তার রক্তচাপ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিলেন। তখন রোগীকে সার্জারি দল পরীক্ষা করেছেন। এ সময় এটেন্ডেট ছিলেন Dr. Zoeth Stone Edwards. বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে জ্যামাইকা হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন: X Ray-তে দেখা যায় যে পেটের অভ্যন্তরে নিউমো-বাতাস/বায়ু পেরিটেনিয়াম রয়েছে। এ্যাবডমেনের সিটি’তে দেখা যায়, বৃহৎ নিউমোপেরিটেনিয়াম বা পেটের অভ্যন্তরে অনেক বাতাস, হালকা শ্বাস রুদ্ধ, স্টেপল লাইন ভাঙ্গার নিশ্চিত চিহ্ন অনুপস্থিত। এছাড়া এসময় জ্যামাইকা হাসপাতাল থেকে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তাব রাখা হয়, ICU তে ভর্তি এবং জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা শুরু করার। নাকে নল দিয়ে পেটের চাপ কমানো। রোগীর সার্জারির প্রয়োজন পড়ার সম্ভাবনা নিয়েও ডা. অং-এর সাথে আলোচনা হয়।

বিকেল ৪টা ৩৯ মিনিটে রোগীর শয্যাপাশে দেখে সার্জন আলেক্সেডো অং বলেন, ৬১ বৎসরের ভদ্রলোকের Anterior colon Resecution [সামনের অন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে ৯ দিন আগে বেল্যু হাসপাতালে। বর্তমানে তার পেট ফেঁপে গেছে এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। রোগী সম্পূর্ণ জাগ্রত, দ্রুত শ্বাস চলছে, নাকে অক্সিজেন। পেট যথেষ্ট ফাপা কিন্তু বেদনাহীন। STAPLE Line অক্ষুণ্ণ, কাটা জায়গা পরিষ্কার এবং শুষ্ক, শ্বেত কনিকা ৫.১ হাজার, হিমোগ্লোবিন ১০.২ পেটের সিটি দেখাচ্ছে মুক্ত তরল পদার্থ এবং বাতাস লিভারের পার্শ্ববর্তী স্থানে। সংযোজিত স্থানে কোনো উৎসরণ বা লিক দৃশ্যমান নয়, ছবির মূল্যায়ন অনুযায়ী। আলোচনা করেন E.D’র ডাক্তার এবং ডা. ইসলামের সাথে (মেডিক্যাল এ্যাটেন্ডিং) যে, রোগীকে ভর্তি করে

অপারেশন করতে হবে। রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং আরো ইমেজিং পরীক্ষার প্রয়োজন, কোনো লিক বা ফুসফুসে Embolism অপ্রমাণিত করার জন্য। বিকেল ৫টা ২৩ মিনিটে রোগী এবং তার স্ত্রীর সাথে আলাপ হয়। তার স্ত্রী এবং শয্যাপাশে বন্ধুরা বহুবার CT’র ফলাফল জানতে চাচ্ছে। জ্যামাইকা হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের উপদেশ হলো হাসপাতালে ভর্তির কিন্তু রোগী এবং পরিবারবর্গ বেলভ্যুতে যেতে ইচ্ছুক। তাদের অনুরোধ অনুযায়ী বেলভ্যুতে আলাপ করে Surgical Intensive Care Unit-এ একটা শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে ইতিমধ্যে। বেলভ্যু পর্যন্ত যাত্রাপথে ঘটতে পারা রিস্কের কথা হাসপাতাল থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। রোগী AMA [Against Medical Advise] স্বাক্ষর করেন। সন্ধ্যা ৬টা ৩২ মিনিটে বলা হয়, পূর্বে রোগীর রক্তমিশ্রণ ছিল। রোগী এবং তাঁর স্ত্রীর সাথে, সার্জারি এ্যটেন্ডিং কথা বলেন এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। বর্তমানে রোগীর প্রাইভেট এম্বুলেন্স ইমার্জেন্সিতে অপেক্ষমান। এ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন, হার্ট মনিটরিং এবং নরমাল স্যালাইনের ২০০ মি/ঘণ্টা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদ-এর নিয়োজিত নার্সকে তুলে ফেলা হয়। সন্ধ্যা ৬টা ৪৮ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদকে ডিসচার্জ করে JH BLS নামে প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্সে করে বেলভ্যু হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স যাত্রা শুরু করার কথা বেলভ্যু হাসপাতালের রনি বড়ুয়াকে অবহিত করি। তিনি বললেন, আমাকে একটু অপেক্ষা করতে, অন্য একটি ফোন এসেছে। কিছুক্ষণ পর বললেন, মেহের আফরোজ শাওন ফোন করেছেন। তারা রওয়ানা হবার কথা জানিয়েছেন। এরমধ্যে রনি বড়ুয়া জানালেন সবকিছু প্রস্তুত। এম্বুলেন্স আসার সঙ্গে সঙ্গেই হুমায়ূন আহমেদকে ইমার্জেন্সিতে না রেখে আইসিউতে নিয়ে যাওয়া হবে। ডা. জ্যোতি নারাংয়ের সাথে দেখা করে ইতিমধ্যে রনি বড়য়া হুমায়ূন আহমেদ-এর জন্য আইসিউতে খোলামেলা একটা ঘর। ঠিক করে রেখেছেন।

তখন রনি বড়য়া বলেন, ২১ জুন সকাল ৯টায় তিনি হাসপাতালে এসেছেন। কেননা ২০ তারিখ রাতে মাজহারুল ইসলাম রনি বড়ুয়াকে ফোন করেছেন। সকাল ৯টার মধ্যে যেন রনি বড়য়া চলে আসেন বেলভ্যু হাসপাতালে। তিনি সেভাবেই চলে এসেছেন। মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল ওজোনপার্কের বাসা থেকে সকাল ৯টার দিকে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বেলক্ট হাসপাতালের উদ্দেশ্যেই যাত্রা করেন। ইতিমধ্যে তার চেয়ার থেকে পড়ে যাবার ১৫ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদ-এর লিকেজ থেকে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে। পেট ফুলে, ব্যথায় তিনি কাতর হয়ে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ১৮ ডিসেম্বর, ২০১১-এ মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে স্থানান্তর হওয়ার পর এই প্রথম হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতালে যাবেন তা আমি জানতে পারলাম না। রনি বড়ুয়াকেও বলা হয়নি হুমায়ূন আহমেদ যে চেয়ার থেকে পড়ে গেছেন। তেমনি বলা হয়নি বেলভ্যু হাসপাতালেও হুমায়ূন আহমেদ-এর চেয়ার থেকে পড়ে যাবার কথা। হুমায়ূন আহমেদকে ২১ জুন সকালে জ্যামাইকা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর হুমায়ূন আহমেদ-এর কিছুটা কথা বলার ক্ষমতা ছিল, ফলে তিনি নিজে তার অসুবিধার কথা কিছুটা চিকিৎসকদের অবহিত করেন। তখনি জ্যামাইকা হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাছে বলা হলো আগের দিন চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। বাড়ির কাজের সাহায্যকারী মহিলা শোভার কাছ থেকে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে। গেলেও পরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ গোপন করা হয়। যদি সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে ডাক্তারের কাছে বলা না হতো বিষয়টি কেউই কখনো জানতে পারতেন না। আজ যারা চেয়ার ডেবে যাওয়া, কাত হয়ে যাওয়া, পড়ে যাওয়ার সময় ধরে ফেলাসহ বিভিন্ন ঘটনা লিখছেন বা বলছেন তাদেরকে সেটা আর কষ্ট করে বলতে ও লিখতে হতো না। আর একটি বিষয়ও এখন স্পষ্ট, ২০ জুন হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে যাবার পর বিষয়টি আমার কাছেও গোপন রাখা হয়। তারা বোধহয় আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এই ঘটনাকে আমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারবো। তাই তারা পরদিন সকাল ৯টায় যে হাসপাতালে যাবেন, সেকথা আমাকে এই প্রথম আমাকে জানানো হলো না। অথচ এর আগে যতবারই হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে নেওয়া হয়, আমি অথবা আমার স্ত্রীই নিয়ে গেছি। হাসপাতালের রুম সংক্রান্ত বা অন্য কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানালে আমি সেটা রনি বড়ুয়া বা বেল্যুর অন্যান্য স্টাফকে দিয়ে করাবার চেষ্টা করেছি। মাজহারুল ইসলাম রনি বড় য়াকে সরাসরি ফোন করে ২১ জুন সকালে বেলভ্যু হাসপাতালে থাকতে বলেন। কেননা মাজহারুল ইসলাম এর আগে কখনো হুমায়ূন আহমেদকে ভর্তি বা বিল সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে যুক্ত ছিলেন না। আবার ২১ জুন সকাল ৯টায় এ্যাম্বুলেন্স কল করা হলেও, আমাকে জানানো হয় সকাল ১১টায়। তখন হুমায়ূন আহমেদ জ্যামাইকা হাসপাতালে। হুমায়ূন আহমেদ-এর মেডিকেলু বিল। সংক্রান্ত বিষয়ে যদি আমার যোগসূত্র না থাকতো হয়তো মাজহার আমাকে বিষয়টি জানাতেই না। ২০ জুন মেহের আফরোজ শাওন যখন ফোন করেও হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসকের ফোন নম্বর নেন তখনো আমাকে হুমায়ূন আহমেদের চেয়ার থেকে পড়ে যাবার ঘটনাটি আমাকে জানানো হয়নি। অথচ আমাকে জানানো হলে সে। সময়েই তাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতো। একজন। সার্জারি হওয়া রোগীকে চেয়ার থেকে পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে ৯১১ কল করাই ছিল প্রথম কাজ। অথচ সে কাজটিই করা হয়নি।

আমরা সবাই অপেক্ষা করছি। এমন সময় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু এলেন। একসাথে ইমার্জেন্সিতে এত লোক এলাউ করে না। মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল বাইরে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করছেন। এরমধ্যে শাওনের সাথেও কথা হলো একবার ফোনে। তিনি তখন ওজোন পার্কের বাসায়। ক্যাট স্ক্যানের রিপোর্ট না এলেও একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে হুমায়ূন আহমেদের সেলাই ছিঁড়ে গেছে অথবা কোথাও লিকেজ হয়েছে। ডা. হাসনাইন আমাকে এ কথা জানাবার পর চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তখনও আমি জানি না হুমায়ূন। আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে গেছেন। আমাকে(মাজহারুল ইসলাম বা ফানসু মন্ডল কেউ বলেননি। প্রথম থেকেই স্যারকে বেল হাসপাতালে স্থানান্তর করার বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলি। আমি প্রথমে ডা. হাসনাইনকে দিয়ে জ্যামাইকা হাসপাতাল থেকে চেষ্টা করলাম এ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করতে। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী যে স্থানে রোগী অসুস্থ হবে সে স্থান থেকে ১৫ মিনিটের পরিধির মধ্যে যে হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ট্রমা সেন্টার আছে, রোগীকে সেখানেই এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাবে। তাই এ্যাম্বুলেন্স আসার পর মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল চেষ্টা করা সত্ত্বেও হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে নিতে পারেননি। একটু আগে খাবার খেতে গেলে জ্যামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সির পিছনে কয়েকটি এ্যাম্বুলেন্স চোখে পড়েছিলো। আমি গেলাম তার খোঁজ নিতে, পেলাম না। এ্যাম্বুলেন্স চলে গেছে। জ্যামাইকা হাসাপাতালের কেয়ার ইউনিট থেকেও চেষ্টা করলাম এ্যাম্বুলেন্সের। বললাম প্রয়োজনে আমরা পেমেন্ট করে দেব। সোজাসুজি উত্তর, নিয়ম নেই। এরমধ্যে বেলভ্যু হাসপাতালে রনি বড়ুয়ার সাথে কথা হলো বেশ কয়েকবার। তিনিও চেষ্টা করছেন এ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে কিন্তু একই জটিলতা। জ্যামাইকা হাসপাতালের কেয়ার ইউনিট থেকে প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্সের নাম্বার নিয়ে চেষ্টা করতেই পেয়ে গেলাম। বলল, ৩ ঘণ্টা পর আসবে। ১,০০০ ডলার চাইল জ্যামাইকা হাসপাতাল থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে যেতে। রনি বড়ুয়ার কাছ থেকে আর একটি প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স কোম্পানির নম্বর পেলেন মাজহারুল। তিনিও ফোন করলেন। চেষ্টা চলছে বিভিন্নভাবে। শেষপর্যন্ত আর একটি নম্বরে ফোন করে পেয়ে গেলাম ৭৫০ ডলারে। এ্যাম্বুলেন্সটি ২ ঘণ্টার মধ্যে আসবে। সে কোম্পানির সাথে জ্যামাইকা হাসপাতালের কেয়ার ইউনিটে কর্তব্যরত মহিলাকে কথা বলিয়ে দিলাম। ডাক্তার হাসনাইনও কথা বললেন যেসব সুযোগ সুবিধা থাকা দরকার তা যেন থাকে এ্যাম্বুলেন্সে। এদিকে হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর করতে হলে স্ত্রী অথবা অভিভাবকের সম্মতি-স্বাক্ষর লাগবে। মেহের আফরোজ শাওনকে ফোন করা হলো আসার জন্য। তিনি গাড়ি পাঠাতে বললেন। ফানসু মন্ডল হাসপাতাল থেকে গিয়ে তাকে নিয়ে এলেন। বিকেল ৫টা ২৩ মিনিটে মেহের আফরোজ শাওনের স্বাক্ষরের পর হুমায়ূন আহমেদকে বেল্যুতে নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলো। এ্যাম্বুলেন্স যখন পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন আমাকে বলা হয়েছিলো, এয়ার বাস অথবা হেলিকপ্টার দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে জ্যামাইকা থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে নেওয়া যায় কিনা। আমার জানা ছিলো না। হাসপাতালের কেয়ার বিভাগে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের কাছেও সেরকম তথ্য নেই। আমি ফোন করলাম বেলভ্যুতে রনি বড়ুয়ার কাছে। তিনি বললেন, মেহের আফরোজ শাওনও তার কাছে জানতে চেয়েছেন, তার জানা নেই। আমি আবার গেলাম ডা. হাসনাইনের কাছে। ডা. হাসনাইন বললেন, প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স কোম্পানির ব্যাপারটাও তিনি আগে জানতেন না। মেহের আফরোজ শাওন, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, মাজহারুল ইসলাম, ফানসু মন্ডলসহ আমরা সকলে মিলে বিষয়টি নিয়ে ওয়েটিংরুমে আলোচনা করি। শেষপর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিলো না। দুজন দুজন করে ইমার্জেন্সিতে যাওয়া আসা করছি। আর ক্রমশই স্যারের শরীর খারাপ হয়ে পড়ছে। দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত কাগজপত্র তৈরি। হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্সের সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করা হলো। রাস্তার সামনে গিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে হুমায়ূন আহমেদকে স্ট্রেচারসমেত ওঠানো হলো। আমরা সবাই পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে এলাম। স্যারকে এ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর পাশের সিটে শাওন ও মাজহারুল ইসলাম উঠলেন। দরজা বন্ধ হলো। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু চলে গেলেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে তাঁদের গাড়িতে (ফানসু) মন্ডল গেলেন হুমায়ূন আহমেদের ওজোন পার্কের বাসায় শাওনের মোবাইল ফোনের চার্জার আনতে। তিনি আমাকে নামিয়ে দিলেন সাবওয়ে স্টেশনে। আমি নেমেই রনি বড়ুয়াকে বিষয়টা জানালাম। তিনি একটু অপেক্ষা করতে বললেন, অন্য একটি ফোন এসেছে। কিছুক্ষণ পর বললেন, মেহের আফরোজ শাওন ফোন করেছিলেন। তারা রওয়ানা হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

বেলভ্যুতে শেষ আসা

২১ জুন রাত ৯টা ২০ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদকে এ্যাম্বুলেন্স থেকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হলো বেলভ্যু হাসপাতালের ভেতর দিয়ে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের পথ দিয়ে আইসিইউতে। ভাড়া করা এ্যাম্বুলেন্সে স্ট্রেচার থেকে হাসপাতালের স্ট্রেচারে স্থানান্তর করার সময়টুকুও নষ্ট না করে হুমায়ূন আহমেদকে দ্রুত নেওয়ার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখেন রনি বড়ুয়া। তার জন্য ব্যবস্থা করা হয় খোলামেলা কর্নারের রুম। হুমায়ূন আহমেদ এ ধরনের রুমই পছন্দ করতেন। তাঁর একটি লেখাতেও তিনি লিখেছিলেন আইসিউ হবে, খোলামেলা, আলো-বাতাসে ভরপুর যাতে রোগী আসলেই তার মন ভালো হয়ে যায়। আমরা সব সময় এরকম রুমই হুমায়ূন আহমেদের জন্য বরাদ্দের চেষ্টা করা হতো। এদিনও হুমায়ূন আহমেদের এ্যাম্বুলেন্স পৌঁছার আগে সব ব্যবস্থা করা থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে কর্তব্যরত ডাক্তার হুমায়ূন আহমেদকে এটেন্ড করেন। হুমায়ূন আহমেদকে ভর্তি করার সময় এদিন রাত ৯টা ২৮ মিনিটে রোগীর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন জানিয়েছেন, রোগী রাতে ঘুমাতে পারেননি। তার শরীরের তাপমাত্রা ছিলো ১। তাৎক্ষণিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে দেখলেন কর্তব্যরত ডাক্তার ০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। রোগীর স্ত্রী আরও জানিয়েছেন, রোগীর তলপেটে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় তাকে জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো। জ্যামাইকা হাসপাতালের চিকিৎসকের সাথে আলোচনায় জানা যায়, রোগী পানিশূন্যতায় ভুগছেন। জ্যামাইকায় রোগীর সিটিস্ক্যান করা হয়। এরপর রোগীকে বেলভ্যুতে আনা হয়। জ্যামাইকা হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের বন্ধুদের কথা উল্লেখ থাকলেও বেলভ্যু হাসপাতালে মেহের আফরোজ শাওন ছাড়া আর কারও কথা উল্লেখ নেই। উল্লেখ করা হয়নি হুমায়ূন আহমেদ যে চেয়ার থেকে পড়ে যান সে কথাটিও।

কতর্ব্যরত চিকিৎসক সূত্রে জানা যায়, কোলনের অপারেশনস্থলের কাছে ফুটো হয়ে যাওয়া (এনাস্টমিক লিক) সংক্রান্ত জটিলতাই ছিলো এর কারণ। এর ফলে ছিদ্র স্থান দিয়ে মল নিঃসরণ হচ্ছিলো। এজন্য এটা বন্ধের চেষ্টায় তার। অপারেশন স্থল খুলে আরেকটি অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাতে। সেদিন ভোর ৫টায় আমাকে ফোন করেছিলো বেলভ্যু হাসপাতাল থেকে। হুমায়ূন আহমেদের সার্জারি করার জন্য আরো কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা বাকি ছিলো। সেগুলোতে স্বাক্ষর করার জন্য হাসপাতাল রোগীর অভিভাবককে খুঁজছে। আমার স্ত্রী রুমা ফোনটা রিসিভ করেছিলো। রুমা সঙ্গে সঙ্গে মেহের আফরোজ শাওনকে ফোনে জানিয়ে দেয় দ্রুত আইসিউতে যাওয়ার জন্য। ডিসেম্বরে ১৪ তারিখ বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর ২২ জুন সকাল পর্যন্ত বেলভ্যু হাসপাতাল রেকর্ডে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে আমার নম্বরটাই ছিলো প্রথম প্রেফারেন্স। দ্বিতীয়টি ছিলো মেহের আফরোজ শাওনের। আর মেডিকেল বিল সংক্রান্ত বিষয়ে আমার ফোন নম্বরটি ছিলো প্রথম আর রুমা সাহারটা ছিলো দ্বিতীয়। হাসপাতালের বিলিং ডিপার্টমেন্ট এবং ফার্মেসি মনে করতো আমরা দুজন হুমায়ূন আহমেদের ছেলে ও মেয়ে। আমরাও কিছু বলতাম না। মুক্তধারা থেকে স্পন্সর, পরিবারের সদস্য এবং আমাদের ঠিকানা ছিলো লেখকের থাকা ও বিলিং এর ঠিকানা সেখানে অন্য কিছু ভাবারও ব্যাপার নয় অন্য কারও।

২২ জুন, ২০১২
দ্বিতীয় সার্জারি

২২ জুন ভোর ৪টা ১২ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদকে অনির্ধারিত অস্ত্রেপাচারের পর সন্দেহ করা হয় তার পাকস্থলি বা উদরের আবরণের মধ্যে পচন ধরেছে এবং সেখানে ফুটো হয়েছে। তার উদর প্রণালী খতিয়ে দেখা যায় বৃহদান্ত্র থেকে পয়ঃপ্রণালীতে ফুটো হয়েছে। উদরের আবরণের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ৩০০০ সিসির ক্রিস্টাল স্যালাইন এদিন তাঁকে দেওয়া হয়। চিকিৎসক ছিলেন তেজাশ শাহ।

এরপর অবস্থার অবনতি হলে প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা পর ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে তাকে সার্জারি করা হয়। সার্জারির পরে পাকস্থলীর চারদিকে ফুটোর ব্যাপারে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন। তখন সার্জারির তত্ত্বাবধানে ছিলেন ডা. হার্ভে জি মুর। এরপর তাকে আইসিউতে রাখাও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। সকালে এই অস্ত্রোপচারের সময় তাকে এনেসথেসিয়া সহ সবকিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু পেটের সেলাই খোলার পরই সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসে মলসহ বিভিন্ন বর্জ্য যা নিঃসরণ হচ্ছিল সার্জারির জোড়ার পাশ দিয়ে। এ সময় তার সেলাইয়ের জায়গায় একটি বড় আকারের গর্তও ধরা পড়ে যার দুই পাশ দিয়েই বেরিয়ে আসছিলো ময়লা। অপারেশনের পর পর রোগীর রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিকভাবে। এই অবস্থায় তাকে স্থানান্তর করা হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে।

২৪ জুন ২০১২

চেয়ারে বসা অবস্থায় ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তখন সকাল ১০টা। রনি বড়ুয়া গিয়েছিলেন দেখতে হুমায়ূন আহমেদকে। যথারীতি প্রশ্ন করেন, কেমন আছেন স্যার। প্রচুর কষ্টের মধ্যেও মুখে হাসি এনে হুমায়ূন আহমেদ বললেন ভালো আছি।

২৫ জুন ২০১২

বিছানায় শোয়া অবস্থায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হুমায়ূন আহমেদ। একটু বসার চেষ্টা করছিলেন।

২৬ জুন ২০১২

হুমায়ূন আহমেদ ক্লান্ত অবসন্নভাবে ছিলেন প্রায় সারাদিন। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন তারপরেও ঘুমুতে পারছিলেন না। রাত সাড়ে ১০টায় আমি এবং রুমা গিয়েছিলাম বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে। বইমেলার গেস্টরা আসতে শুরু করেছেন। কখনো আমরা সকাল ৯ টার আগেই হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে যাই। আবার কখনো রাত ১০টার পরে। ঐদিন প্রায় ১১টা বেজে গিয়েছিলো আমরা যখন হুমায়ূন আহমেদের রুমের সামনে যাই। রুমের সামনের গ্লাসের সামনে থেকে চলে আসবো। তখনই তিনি হাত দিয়ে ডাকলেন। আমি আর রুমা ভেতরে গেলাম। বলার চেষ্টা করছেন প্রচণ্ড ব্যথা শরীরে। ভালো করে শুনা যাচ্ছিল না। গোঙানির শব্দে, আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় বললেন শরীর টিপে দিতে। কোনোভাবেই আসতে দিচ্ছিলেন না হুমায়ূন আহমেদ আমাদের। বললাম সারাদিন আসতে পারিনি বইমেলার জন্য। রুমা হুমায়ূন আহমেদের কখনো কপাল কখনো ডান হাত টিপে দিচ্ছিলেন। আমি বাম হাত ও পা টিপে দিচ্ছিলাম। ব্যথায়-যন্ত্রণায় হুমায়ূন আহমেদ ক্ষত-বিক্ষত। আর পারছেন না তিনি সহ্য করতে। বারবার হাতের কাছে থাকা বোতাম টিপতে বললেন আমাকে যাতে করে ব্যথার ওষুধ বাড়ানো হয়। এর আগেও প্রথম সার্জারির পর হুমায়ূন আহমেদ যখন ৭ দিন হাসপাতালে ছিলেন ব্যথায় জর্জরিত থাকতেন তখন কপাল-হাত-পা আমরা টিপে দিতাম। মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম ও আমি। এরপর একদিন দেখলাম পূরবী বসুও আমার সামনে হুমায়ূন আহমেদের হাত পা টিপে দিচ্ছিলেন। দ্বিতীয়বার সার্জারির পরতো আমরা ছাড়াও রাতের বেলায় যে ছেলেটি এবং বাংলাদেশ মিশনের ড্রাইভার থাকতেন, তারাও হুমায়ূন আহমেদের হাত-পা কপাল টিপে দিতেন। তাতে তিনি কিছুটা ভালো অনুভব করতেন।

আসলে হুমায়ূন আহমেদ সবসময় কিছু কিছু না জিজ্ঞেস করতেন। কিছু না কিছু বলতেন। বারবার বলতে চাচ্ছিলেন কিছু, কথা বলার শক্তি ছিলো না তাঁর। জড়িয়ে আসছিল কথা। শুধু শুনলাম, ব্যথা, যন্ত্রণা।

আমি হুমায়ূন আহমেদকে বললাম, বইমেলা শুরু হচ্ছে ২৯ জুন। হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে। অথচ তিনি যেতে পারবেন না। হয়তো ভাবছেন ২৯ জুন, নিষাদ তাঁর জীবনের প্রথম চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন। ৩০ তারিখ তাঁকে দেওয়া হবে আজীবন সম্মাননা। ১ জুলাই মেহের আফরোজ শাওনের সাথে শতবর্ষের বাংলা গানের অনুষ্ঠান। সবই এখন স্বপ্ন। প্রথম দুটি ঘটলেও, মিরাকেল কিছু না ঘটলে, তৃতীয়টি ঘটছে না। জানতেন এর পরের সপ্তাহে আমরা লাস ভেগাস যাচ্ছি বঙ্গ সম্মেলনে। বঙ্গ সম্মেলন নিয়েও কত কথা। শেষবার ২০০৯ সালে সানফ্রান্সিসকোতে আমরা হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গ সম্মেলনে। তাঁরা এসেছিলেন নিউইয়র্কের বইমেলায় যোগ দিতে। মেহের আফরোজ শাওনও এসেছিলেন সেবার। বইমেলার পরের সপ্তাহেই থাকবো না এক সপ্তাহ নিউইয়র্কে। ১১ জুলাই ফিরবো বিকেলে। কথা শুনছেন, খুবই কষ্ট হচ্ছে। বলতে চাচ্ছেন, বলতে পারছেন না। ছেলেটি বাইরে থেকে ফিরে এলো। আর পারছিলেন না সহ্য করতে। আমাদের কোনোভাবে এ অবস্থায় তাকে ফেলে আসতে মন সায় দিচ্ছে না। হঠাৎ করে রুমের পেছনে চেয়ারে বসা ছেলেটি উঠে গেল বাইরে। তখনি রুমা আমাকে বলল, স্যারকে এতো অস্থির তো কখনো আমরা দেখিনি। সেই ১২ জুনের সার্জারি বা ২২ জুনের সার্জারির পরের সময়েও। আমি বাইরে গিয়ে নার্সকে ডেকে হুমায়ূন আহমেদের কষ্টের কথা বললাম। নার্স বলল, ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রোগী তো ঘুমুতে পারছেন না। ডোজ বাড়িয়ে দেবেন, আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়বেন। আমরা থাকলে হুমায়ূন আহমেদকে যতই ওষুধ দেওয়া হোক তিনি ঘুমুবেন না সেটা আমি জানি। তাই আমি বললাম আমরা এবার যাচ্ছি, কাল আসবো। স্যার আমাদের দিকে যে দৃষ্টিতে তাকালেন, আবার একটু দাঁড়ালাম। ইচ্ছে করছিলো না ওভাবে চলে আসতে। আমি আর রুমা এলিভেটর দিয়ে নিচে নামলাম। পরপরই ফোন এলো মেহের আফরোজ শাওনের। এক সময় কথা শেষ হলো। ২৯, ৩০ জুন ও ১ জুলাই ছিলো নিউইয়র্কে বইমেলা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছেন কবি, লেখক সাহিত্যিক, সাংবাদিক। এত অতিথি সামলানো। তার উপর অনেক প্রকাশকও এসেছেন দেশ থেকে। রাত ১টা বেজে যায় প্রতিদিন অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে। এত রাতে কি হাসপাতালে যাওয়া যায়? যে কটা দিন তিনি ছিলেন, যতবারই গেছি শুধু দেখে এসেছি, তিনি আমাদেরকে দেখেছেন কিনা তা আমরা বুঝতে পারিনি।

২৯ জুন, ২০১২

সার্জারির পর ২৯ জুন ২০১২ ডাক্তার তার উদরের আঘাত থেকে একটি ড্রেন সনাক্ত করেন। তার সাথে রয়েছে উদর প্রণালীতে ফুটো। তাঁকে সেজন্য শিরায় একটা ওষুধ ইনজেক্ট দেওয়া হয়। তার লিভার ফাংশন কমে যায়। বিলিয়ারি ট্রি, গল ব্লাডার, কিডনি ও এড্রেনাল গ্লান্ড ভালোই কাজ করছিলো। কিন্তু প্রস্টেট বেড়ে যায়। এরপর তার উদরে আবার সিটিস্ক্যান করার নির্দেশ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। উদর প্রণালীতে ফুটোর সাথে দেখা দেয় পাকস্থলীর আবরণে ফোড়া যা ছিলো ডাক্তারদের উদ্বেগের বিষয়। উদর থেকে নিঃসরণ, উদর আস্তর পুরো করার পর কমেছে বলে ডাক্তাররা ধারণা করেন। উদরে ইতঃপূর্বে যে আঘাত পেয়েছেন তাতে বাতাস জমে গেলে তা পুনরায় খোলার প্রয়োজন মনে করেন। লিভারের চিকিৎসার পর কিছুটা পরিবর্তন আসে। এদিন হুমায়ূন আহমেদ সকাল থেকেই খুব অস্থিরতায় ভুগছিলেন। মুখে। লাগানো নল খোলার জন্য গতকাল থেকেই বলছিলেন। মুখে তো বলতে পারছেন না। কাগজে লিখে জানতে চাচ্ছেন। এ সময় বেলভ্যু হাসপাতালের ইন্টার্নি ডাক্তারদের শিফট বদলি হয়ে নতুন শিফটের ডাক্তার এলেন। নতুন ডাক্তার। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। হুমায়ূন আহমেদ তখন মেহের আফরোজ শাওনকে লিখে প্রশ্ন করেন কখন খোলা হবে তার মুখের নলটি। ডাক্তার বলছেন, আমরা জানি না কখন খোলা হবে। তারপরই তিনি মুখে, নাকে লাগানো সব নল খুলে ফেলার চেষ্টা করেন। এদিন কর্তব্যরত চিকিৎসক মনে করেন, তাঁর ফুসফুসে ধমনীরোধক রক্তপিণ্ডের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ফুসফুসে অসংখ্য অস্বচ্ছতা লক্ষণীয়। পেটের উপরের অংশ পর্যবেক্ষণে খুবই সীমিতভাবে দেখা গেছে সেখানে প্রলেপ রয়েছে। পেটের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতাও রয়েছে। এদিন তার বুক ও পেটের ক্যাট স্ক্যান করা হয়।

৩০ জুন, ২০১২

একদিকে বইমেলা শুরু হচ্ছে নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। আর একদিকে জ্যামাইকায় বসবাসরত লেখক হুমায়ূন আহমেদ বেলভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।

১ জুলাই ২০১২

শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায়। আজ সকালে হুমায়ূন আহমেদের প্রচুর বমি হয়। একইসাথে তার শ্বাসপ্রশ্বাসেরও অবনতি হয়। এদিন দুপুরে বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদের গুজব ছড়ায়। গুজব ছড়াবার চেষ্টা পরে ব্যর্থ হয়। কারণ তখন হাসপাতালে ছিলেন মেহের আফরোজ শাওন ও পূরবী বসু। এদিন মেহের আফরোজ শাওন, মাজহারুল ইসলাম, ফানসু মন্ডল ও ড. পূরবী বসু ছিলেন হাসপাতালে। সকালে ড. আব্দুল মোমেনও হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে হাসপাতালে যান। হুমায়ূন আহমেদের হৃদকম্পনের মাত্রা আবারও অস্বাভাবিক হতে থাকে। এই অবস্থায় আশঙ্কার কারণে তার শ্বাসনালীতে দেওয়া হয় অক্সিজেন টিউব। এর আগে ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ার কারণে পিজটেইল ক্যাথেটার দিয়ে বুকের ডানদিক থেকে বের করে আনা হয় ফুসফুসের পানি। এদিন হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন ইকবাল হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে বাংলাদেশ থেকে আসেন।

তাঁরা ব্রুকলিনে একটি বাসা ভাড়া নেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা হুমায়ূন আহমেদের পাশে সময় কাটান। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের সাথে হুমায়ূন আহমেদের কোনো কথা হয়নি। ১ তারিখ থেকেই হুমায়ূন আহমেদকে ১০০% ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। এদিন সকালে ড. পূরবী বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত নিউইয়র্ক থেকে ডেনভারের উদ্দেশ্যে চলে যান।

০৩ জুলাই ২০১২

এদিন মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার জন্য জমাকৃত ২০,৪৫২.৬৯ ডলার মেহের আফরোজ শাওন কর্তৃক উত্তোলন করা হয় হয়। এই হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় ৪০,১৬৯.৪৫ ইউএস ডলার।

৪ জুলাই ২০১২

হুমায়ূন আহমেদের শরীরে নতুন উপসর্গ দেখা দেয়। এসময় তার প্রস্রাবের মাত্রা একেবারেই কমতে থাকে। প্রতি ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০ সিসির জায়গায় তখন এর মাত্রা ছিলো ১.৭ ফোঁটা মাত্র। এছাড়া মলদ্বারের পেছনেও এক ধরনের সংক্রমণ দেখা যায়। এই অবস্থায় কিডনি ডায়ালিসিস করা হয়।

এদিন হুমায়ূন আহমেদের কন্যা বিপাশা আহমেদ তার স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সাথে জামাল আবেদীন, জলি আবেদীন।

৬ জুলাই ২০১২
তৃতীয় সার্জারি

অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। এ দিন কোলনের সেলাই খুলে যায়। এই স্থান দিয়ে বেরিয়ে আসে বর্জ। হুমায়ূন আহমেদের উদরের প্রণালী ফেটে পাকস্থলীর দ্রব্যাদি বেরিয়ে আসে। এই অবস্থায় এটাকে অস্ত্রোপচার করে পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়। এ দিন সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে তার সার্জারি শুরু হয়। শেষ হয় রাত ৯টা ১৫ মিনিটে। ডাক্তার জোশেফ জে কার্টার সার্জারি করেন। এরপর তাকে আইসিসিউতে নিয়ে যাওয়া হয়।

৭ জুলাই ২০১২

এদিন হুমায়ূন আহমেদকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তাঁর আরো জটিলতা দেখা দেয় বলে চিকিৎসকরা উপস্থিত আত্মীয়স্বজনদের জানায়। তার ফুটোর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। পাকস্থলীর অভ্যন্তরে ফাঙ্গাস হয়ে যাওয়ার ফলে ক্রমান্বয়ে তাঁর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেন। সার্জারি করার বিষয়ে ড. জুডি চ্যাং-এর সাথে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আগামী ৯ জুলাই কোলন জোড়া লাগানো হবে। উপস্থিত আত্মীয়স্বজনকেও তারা এ কথা জানান।

৯ জুলাই, ২০১২
চতুর্থ সার্জারি

দুপুর ২টা ৪২ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদের চতুর্থ সার্জারি হয়। ডা. স্পিরস ফ্রাংগোস সেদিন সার্জারি করেন। সেদিন পেটের সেলাই খুলে ময়লা পরিষ্কার করা হয়। এরপর আবার জোড়া লাগিয়ে আইসিসিউতে ফেরত আনা হয়।

১০ জুলাই

কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রথম সার্জারি পরবর্তী ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেন। ১১ জুলাই, ২০১২ রাত ১১-৩০মিনিটে নিউইয়র্ক পৌঁছেই যাই বেলভ্যু হাসপাতালে। দেখে এলাম গ্লাসের বাইরে থেকে। দূতাবাসের লোকটিকে দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের কক্ষে চেয়ারে শুয়ে আছেন। ১৩ জুলাই, ২০১২
পঞ্চম সার্জারি

হুমায়ূন আহমেদের শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার জন্য মুখে নল ব্যবহার করা হতো। দুসপ্তাহ পর্যন্ত এভাবে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নেন। ১৩ জুলাই সকাল ৮টা ২৬ মিনিটে ট্রাকিওস্টোমি করা হয়। শ্বাসনালীতে ছিদ্র করে পাইপ লাগিয়ে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এটা হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম সার্জারি। ড. ডেভিড হিরাস এই অস্ত্রোপচার করেন। হাসপাতালে অবস্থানকালে হুমায়ূন আহমেদকে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন করতে হয়। এ সময় রক্তচাপ এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহকে সচল রাখতে সর্বোচ্চ মাত্রায় একাধিক এন্টিবায়োটিক যেমন ভ্যানকোমাইচিন, ফ্লাজিল, ইমিপিনেম,ক্যাপসোফিউজিন,ফ্লোকোনাজল ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় ওষুধের কার্যকারিতা ঠিকমতো হচ্ছিল না।

১৫ জুলাই, ২০১২

এদিন হুমায়ূন আহমেদের বুকের এক্সরে করা হয়। অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

১৬ জুলাই, ২০১২

বুক, পেট এবং তলপেটের ক্যাট স্ক্যান করা হয়। এটি গত ২৯ জুন ২০১২ তারিখে পেট ও শ্রেণি সংক্রান্ত সিটিস্ক্যান-এর তুলনামূলক একটি সমীক্ষা। ফুসফুস সংক্রান্ত মূল্যায়নের জন্য একই সময়ে এই পরীক্ষার বক্ষবিষয়ক সিটিস্ক্যান রিপোর্টটি বিবেচ্য হয়। হৃদযন্ত্র কিছুটা সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে হৃদযন্ত্রে কোনো ঝিল্লি দেখা যায়নি। ঐদিন সকাল ১০টায় আমি আর রুমা যাই স্যারকে দেখতে বেলভ্যু হাসপাতালে। গত কয়েকদিন ধরেই আমার আর ভালো লাগছিলো না। সবকিছু কেমন হয়ে গেল। গেটে পাশ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম ১০ জন ব্যক্তির নাম দেওয়া ছিলো, তাতে রুমার নাম নেই। আমি ভেতরে ইতস্তত বোধ করলাম। রনি বড়ুয়াকে ফোন করে নিয়ে গেলাম একসাথে দেখতে হুমায়ূন আহমেদকে। দেখে এলাম। হুমায়ূন আহমেদের পাশে সেদিন আর কাউকে দেখিনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর এটেন্ডিং নার্স-এর সাথে কথা বলে চলে এলাম। বলল, রোগী সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। তাঁর স্ত্রী বলতে নিষেধ করেছেন। ভাবলাম, হয়তো রোগীর স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। এই নার্সটির সাথে আগে অনেক কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে। চলে এলাম। আবার তাকালাম। গ্লাসের ভিতরের হুমায়ূন আহমেদকে এটিই যে আমার শেষ দেখা হবে, তা কিন্তু ভাবিনি।

১৭ জুলাই, ২০১২

অবস্থা অপরিবর্তিত।

বুকের এক্সরে করা হয়। গতকালের সমীক্ষার সাথে তুলনা করে আজকের সমীক্ষা এখনও প্রক্রিয়াধীন। ফুসফুসের পরীক্ষায় তেমন কোনো পরিবর্তন আছে বলে ডাক্তার মনে করেননি বলে জানান। হৃদযন্ত্রের উপরের অংশ স্বাভাবিক আছে। ১৮ জুলাই বুকের এক্সরে করা হয়। কোনো উন্নতি নেই তাঁর অবস্থার।

১৯ জুলাই

ভোর ৩.৪৫ মিনিটে বুকের এক্সরে করা হয়। গতকালের তুলনায় আজ অবস্থার কিছুটা অবনতি হয়েছে। সকালে রোগীর প্রচুর বমি হয়। একইসাথে তার শ্বাস-প্রশ্বাসেরও অবনতি হয়। ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখ ০১:২২ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। ইতঃপূর্বে তাকে সর্বোচ্চ শ্বাস প্রশ্বাসের সহায়তা দেওয়া হয়। তাকে ১০০% অক্সিজেনসহ সর্বোচ্চ মাত্রার অন্যান্য সহায়তাও দেওয়া হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে অকার্যকর হওয়ায় রোগীকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তীব্র ধূমপানজনিত ক্ষত মৃত্যুর প্রাথমিক তাৎক্ষণিক কারণ। রোগীর পাশে এসময় উপস্থিত ছিলেন মেহের আফরোজ শাওন, তার মা মিসেস তহুরা আলী, ড. জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন ইকবাল, মাজহারুল ইসলাম, ফানসু মন্ডল ও ড. আব্দুল মোমেন। ডেথ রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন বিশিষ্ট অনকোলজিস্ট ডা. জি লরেন বাউরেল জর্জ মিলার। রিপোর্টে বলা হয়েছে, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের। তার উপর কোলন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছিলো লিভারে। বেলভ্যু হাসপাতালে ১২ জুন কোলন সার্জারির পর ১৯ জুন সকালে তাঁকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয়। ২১ জুন আবার তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কোলনের সার্জারিস্থলের কাছে ফুটো হয়ে যাওয়া (এনাস্টমিক লিক) সংক্রান্ত জটিলতাই ছিলো এর কারণ। এর ফলে ছিদ্রস্থান দিয়ে নিঃসরণ হচ্ছিল মল। এজন্য এটা বন্ধের চেষ্টায় তার সার্জারি স্থল খুলে আরেকটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। এই অস্ত্রোপচারের সময় তাকে এনেসথেসিয়া সহ সবকিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু পেটের সেলাই খোলার পরই সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসে মলসহ বিভিন্ন বর্জ্য যা নিঃসরণ হচ্ছিল সার্জারির জোড়ার পাশ দিয়ে। এ সময় তার সেলাইয়ের জায়গায় একটি বড় আকারের গর্তও ধরা পড়ে যার দুই পাশ দিয়েই বেরিয়ে আসছিলো ময়লা। অপারেশনের পর পর রোগীর রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিকভাবে। এই অবস্থায় তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। এ সময় তাকে সংযুক্ত করা হয় কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের সাথে। জুলাই মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও রক্তের শ্বেতকণিকা কমতে থাকে। অল্প হলেও যন্ত্র ছাড়াই তিনি কিছুটা শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছিলেন। কিন্তু এদিন সকালে হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক বমি শুরু হয়। এটা ছিলো পিত্তবমি। বমির প্রচণ্ডতায় এর কিছুটা চলে যায় তার ফুসফুসে। এই অবস্থায় অবনতি শুরু হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের। সংক্রমণ ও শারীরিক অবস্থাকে গতিশীল রাখতে এই অবস্থায়ও তাকে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন এন্টিবায়েটিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল। ফুসফুসের সংক্রমণ কমাতে ও প্রস্রাব বৃদ্ধির বিশেষ ওষুধ দেওয়ার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়।

১৯ জুলাই। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটের দিকে মুত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন হুমায়ূন আহমেদ। ১.২২ মিনিটে তিনি প্রকৃতই মুত্যর কোলে ঢলে পড়েন। এ সময় তার শরীরের কোনো অংশই আর কাজ করছিলো না। হৃদযন্ত্র, ব্লাডপ্রেসার সচল রাখতে সর্বোচ্চ মাত্রার ওষুধ এর সাথে ১০০% অক্সিজেন দেওয়ার পরও সেটা নিতে সক্ষম ছিলেন না তিনি। এই অবস্থায় শেষ হয়ে যায় প্রচেষ্টা। ঘোষণা করা হয় তিনি আর নেই। ডেথ রিপোর্টে মুত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সেপসিস ব্যাকটেরিয়া যা শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছিলো। রিপোর্টে বলা হয়, দ্বিতীয় অপারেশনের আগে রোগীকে সব ধরনের ঝুঁকির কথা অবহিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছিলো অপারেশনের কারণে রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ, মুত্যু এমনকি স্থায়ী নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হতে পারে। এসব জেনেও তখন হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসায় সম্মতি দিয়েছিলেন। ১৯ জুন সকাল ৯টায় যথারীতি প্রথমে হুমায়ূন আহমেদের ওয়ার্ডে ফোন করলাম। বললেন, আগের মতো। ১০টায় ফোন করলাম রনি বড়ুয়াকে। বললেন, তিনি দেখে এসেছেন। বিছানায় শুয়ে আছেন। নড়াচড়া নেই। দুপুর ১২টায় ঢাকা থেকে ফোন। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে সবাই খবর জানতে চান। দুপুর ১টায় নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিক ‘সাপ্তাহিক বাঙালী’র সম্পাদক কৌশিক আহমেদ ফোন করে জানান, বিশ্বজিত আপনি কি হাসপাতালে?

আমি বললাম না, আমি মুক্তধারায়। বললেন, আপনি জানেন না সবাই তো এখন হাসপাতালে। হুমায়ূন আহমেদ আর নেই।

আমি আর একটি কথাও বলিনি, মুক্তধারা থেকে নেমে বেলভ্যুতে চলে গেলাম। ফোনে রুমাকে বললাম, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, তুমি চলে এসো। গেট পাশ নিতে গিয়ে দেখলাম বাঙালি কর্মী মুজিবুর রহমানকে। পাশ নিয়ে ১২ তলায় উঠতেই মুখোমুখি হলাম ড. জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন ইকবালের সাথে। দেখলাম মাজহারুল ইসলামকে। যে ছেলেটি রাতে থাকতো দেখা হলো তার সাথে। হুমায়ূন আহমেদকে কিছুক্ষণ আগেই মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তার ছোট ভাই জাফর ইকবাল তাঁকে শেভ করে মুখের দাড়ি পরিষ্কার করে দেন। সাদা ধবধবে কাপড়ের বিছানায় শুয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। ২৬ জুন-এর পর মেহের আফরোজ শাওনের সাথে আমার আর কথা হয়নি। সর্বশেষ ২৮ জুন কথা হয় মাজহারুল ইসলামের সাথে। পেশেন্ট ওয়ার্ডের নার্সদের থেকে খবর নিতাম হুমায়ূন আহমেদের। এছাড়া রনি বড়ুয়া যখন দেখতে যেতেন সেসময় তার সাথে কথা হতো। কথা হতো জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বা কোনো কোনো সময় জ্যোতি নারাং-এর সাথে।

মে মাসের শেষ দিকে জানতে পারি হুমায়ূন আহমেদের অনকোলজিস্ট সিলভিয়া জেইন বেলভ্যু হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন অন্যত্র। ১২ জুন সার্জারির আগে অনকোলজিস্ট ডা. জেইনের কাছ থেকে যেদিন ফাইল চলে গেল সার্জেন্ট মিলারের কাছে, তারপর ডা. জেইন আর হুমায়ূন আহমেদকে দেখেননি। জ্যোতি নারাং-এর মতো হেল্পফুল খুব কম স্টাফ আছেন যারা তাদের সেবাটা রোগীকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। জ্যোতি নারাং হুমায়ূন আহমেদের জন্য তাই করেছিলেন।

এরপর দ্রুত ঘটে গেল সবকিছু। পরিবার চায়নি তাই হলো না হুমায়ূন আহমেদের ময়না তদন্ত। মরদেহ নেওয়া হলো ওজোন পার্কের ফিউনারেল হোমে। পরদিন ২০ জুলাই জ্যামাইকা সেন্টারে প্রথম জানাজা। ২১ জুলাই দেশের পথে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নিয়ে যাত্রা। সরাদেশে শোকের মাতম। বিমানবন্দরে মরদেহ দাফন নিয়ে দুপরিবারের দুরকম কথা। শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। ২৪ জুলাই নুহাশ পল্লীতে দাফন। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল, ১৮ জুলাই বেলভ্যু হাসপাতালের ১২তলা থেকে হেঁটে নেমে গাড়িতে ওঠা মানুষটি মাত্র দুদিনের ব্যবধানে আবার হাসপাতালে এলেন মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে। মাত্র দুটো দিন তাঁর জীবনের সব ওলট পালট করে দিল। ১৮ জুলাই সন্ধ্যার সেলিব্রেশনটিও ইতিহাসবিদদের লেখায় নেই যেখানে আমাদেরও আমন্ত্রণ ছিলো আমরা সবিনয়ে জানিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে যেতে পারবো না। ইতিহাসে থাকেনি চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি। যদি হাসপাতালে ঘটনাটি লিপিবদ্ধ না থাকতো, তাহলে

এটিও ইতিহাস থেকে বাদ পড়তো। কিন্তু এটিই সত্যি, ২০ জুন চেয়ার থেকে পড়ে হুমায়ূন আহমেদের কোলনের সেলাই খুলে যে লিক হয় সেটিই তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এই লিক থেকেই শরীরে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়েছে। ব্যাকটেরিয়ামুক্ত হতে হুমায়ূন আহমেদকে ২২ জুন থেকে অতিরিক্ত ৪টি সার্জারি করতে হয়েছে। প্রচণ্ড কাটা ছেঁড়া আর কষ্ট যন্ত্রণায় হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন পৃথিবী থেকে। অথচ বাঁচার জন্য তাঁর ছিলো শত চেষ্টা। ১২টি কেমোথেরাপিও যাকে কাবু করতে পারেনি, চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে সদ্য অস্ত্রোপচারের স্থানে ছিদ্র হয়ে সে মানুষটি চিরতরে চলে গেলেন সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে।

শেষকথার শেষে

শেষ করেও অনেক কথা শেষ করা যায় না। আজ খুব মনে পড়ছে, সেইসব দিনগুলোর কথা।

সাউন্ডভিউ গেস্ট হাউজ থেকে জ্যামাইকা

সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ এস্টোরিয়ার সাউন্ড ভিউ স্টুডিও গেস্ট হাউসে। আসার দুদিন পর থেকেই বাসা নেওয়ার জন্য মেহের আফরোজ শাওন পত্রিকা দেখে দেখে ফোন করছেন বিভিন্ন স্থানে। মাজহারুল ইসলাম ও মেহের আফরোজ শাওন, জামাল আবেদীনসহ বিভিন্ন বাসা দেখেছেন। উডসাইড ও সানি সাইডেও বাসা দেখা হলো। কিন্তু একক বাসা না পাওয়াতে কোনোটাই পছন্দ হচ্ছিলো না। খোলামেলা এবং প্রচুর আলো বাতাস থাকতে হবে এটাই ছিলো হুমায়ূন আহমেদের প্রথম শর্ত। তাছাড়া মেহের আফরোজ শাওন চাচ্ছিলেন এ্যাটাচ না হয়ে ডিটাচড একটি বাড়ি। এরই মাঝে চ্যানেল আই-এর আশরাফুল আলম খোকনের মাধ্যমে মেহের আফরোজ শাওনের পরিচয় হলো রিয়েল এস্টেট ব্রোকার শরাফ সরকার-এর সাথে। তাঁর সাথে গাজী কাশেমেরও পরিচয় ছিলো। গাজী কাশেম একসময় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। বাসা দেখা হলো। হুমায়ূন আহমেদ বাড়ি নেবেন শুনে গাজী কাশেম বাড়ির যা ভাড়া তার চেয়ে কমিয়ে ১,৫০০ ইউএস ডলার নেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। বাড়িটি মূলত শাহজাহান কবির নামে একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর। তিনিও ওজোন পার্কে থাকেন। গাজী কাশেম বিভিন্ন সময় তার সাথে ব্যবসায় করেন। এই পরিচয়ের মাধ্যমেই গাজী কাশেম-এর সাথে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের সাথে। সম্পর্ক স্থাপন হয়। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অনুরাগ থাকাতেই পরে তাঁর পরিবারের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন।

জ্যামাইকার বাড়ি

যে রকম বাড়ি দেখছিলেন হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওন। সেরকমই পেয়ে গেলেন শাটফিন বুবার্ড-এর বাড়িটি। ১৪৮-০১, ৯০ এভিনিউ, জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক ১১৪২৩’তে অবস্থিত দোতলা কর্নার বাড়ি। উপরে এটিক। নিচে কাজ চলছে। কোনো ভাড়াটে নেই। একেবারে যেমনটি চেয়েছিলেন তারা তেমনটিই পেয়ে গেলেন। বাড়ির ডানদিকে ও পেছনে প্রচুর গাছপালা। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর পরিবার জ্যামাইকাতে ভাড়া নেওয়া নতুন বাড়িতে ওঠেন। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই প্রথমে রান্নাঘর। বাম পাশে লিভিংরুম। এরপরের রুম হুমায়ূন আহমেদের শোবার ঘর। সাথে একটা বাথরুম। লিভিংরুমে কয়েকটি চেয়ার। একটি টেলিভিশন। ডান দিকে বাথরুম। এরপর দুপাশে দুটি রুম। নতুন বাড়ি। কত কিছুর প্রয়োজন। কিছু কিছু জিনিস আনা হলো জামাল আবেদীনদের বাসা। থেকে। কিছু এলো আমাদের বাসা থেকে। কিছু দিয়ে গেলেন গাজী কাশেম তার বাসা থেকে। এভাবেই শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের নিউইয়র্কের সংসার। এক রুমে হুমায়ূন আহমেদ ও তার পরিবার। আর এক রুমে জলি ও জামাল আবেদীন। অন্য রুমে থাকেন মাজহারুল ইসলাম। হুমায়ূন আহমেদ এয়ারপোর্টে নামার সময় রিসিভ করা থেকে জানুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত গুলতেকিন আহমেদের খালাতো বোন জলি আবেদীন হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি ছিলেন। জামাল আবেদীন জ্যামাইকার বাসা থেকেই কাজ-কর্ম করতেন। জ্যাকসন হাইটসে বাসা থাকলেও হুমায়ূন আহমেদের অনুরোধে জলি ও জামাল আবেদীন ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের জ্যামাইকায় বাসায় থাকতেন। এছাড়া মাজহারুল ইসলাম, শাওনের মা ও কখনো ছোটবোন সেঁজুতিও থাকতেন। মাঝে এসেছিলেন জাপান থেকে হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু। নভেম্বর ২০১১ সালে এসেছিলেন অন্যপ্রকাশের অন্যতম পরিচালক মাসুম রহমান। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের সময় পরিচয় হয় মুনিয়া মাহমুদ-এর সাথে। অনেক বাঙালিই সেদিন দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর মধ্যে মুনিয়া মাহমুদও ছিলেন। পরে মুনিয়া মাহমুদ ও তাঁর স্বামী নূরুদ্দীন-এর সাথে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতালে গেলে নিষাদ ও নিনিতকে মুনিয়া মাহমুদ দেখাশুনা করতেন। সময়ে-অসময়েও অন্যান্য সাহায্য করতেন। এ বাড়িতে থাকা অবস্থায় নিষাদকে পাবলিক স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ সময় হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু ফানসু মন্ডলের সাথে যোগাযোগ হয়। ফানসু মন্ডল তখন নিষাদকে স্কুলে ড্রপ করতেন। পরবর্তীতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী হুমায়ূন আহমেদের বগুড়া স্কুলের সহপাঠী ফানসু মন্ডলের সাথে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিশেষ করে দেশে যাওয়ার আগে মে মাস থেকে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। তিনি হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে। বিভিন্ন জনের জিনিসপত্রও তিনি সকলকে বুঝিয়ে দেন। এছাড়া মাজহারুল ইসলামের বন্ধু রুবেল হোসেনও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিভিন্ন সময় রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে সহযোগিতা করতেন।

ওজোন পার্কের বাড়ি

ওজোনপার্কের বাড়ির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের হাতে লাগানো সবজি গাছ–ছবি: ইব্রাহীম চৌধুরী খোকনফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলানো হয় বাড়ি বিক্রির। এর মাঝে বাড়ির মালিক শাহজাহান কবিরের সাথেও একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। বাড়িটি কেনার কথাও ভাবা শুরু করলেন এক সময় হুমায়ূন আহমেদ। দীর্ঘদিন থাকতে হবে চিকিৎসার জন্য তাই তিনি স্থায়ীভাবে থাকার জন্য একটা বাড়ির কথা অনেকবার বলেছেন। লং আইল্যান্ড এলাকাটিও পছন্দ হয়েছে তাদের। নিউজার্সির এডিসন এলাকায় বাড়ি দেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। জ্যামাইকার বাড়িটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার আগেই শাওন অন্য বাড়ি দেখতে থাকেন। জ্যামাইকা, ওজোনপার্ক এবং ইউনিয়ন টানপাইক এলাকায় কয়েকটি বাড়ি দেখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু। কোনো বাড়িই পছন্দ হচ্ছিল না। হুমায়ূন আহমেদকে ওজোনপার্কে আর একটি বাড়ি দেখানো হলো। সাবওয়ে থেকে দূর হলেও এই বাড়িটি শাওন ও হুমায়ূন আহমেদ পছন্দ করলেন। বাড়িটি আবার ফানসু মন্ডল এবং শাহজাহান কবিরের বাড়ির কাছাকাছি। বাড়িটি ছিলো ডুপ্লেক্স হাউস। প্রথমে ঢুকতেই লিভিংরুম উইথ কিচেন। হাতের বাম দিকে ছোট্ট একটা রুম। উপরে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই হাতের ডানদিকে হুমায়ূন আহমেদের বেডরুম। তারপর বাথরুম। এরপর পরপর আরো দুটো বেডরুম। মাঝখানের রুমে থাকতেন মাজহারল ইসলাম। বিভিন্ন কার্ডবোর্ডের বাক্স দিয়ে চমৎকার একটি অফিস টেবিল তৈরি করেছিলেন। তিনি। এরপরের রুমে থাকতেন শাওনের মা সংসদ সদস্য তহুরা আলী এবং তার কন্যা সেঁজুতী। ঐ রুমেই হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ছেলে নিষাদকে নিয়ে ছবি আঁকতেন। এ বাড়ির ভাড়াও ছিলো বিদ্যুৎ-গ্যাস সমেত ১,৫০০ ইউএস ডলার। দেশ থেকে আসার পর হুমায়ূন আহমেদ ১১ দিন ছিলেন ওজোন পার্কের বাড়িতে। আগে ছিলেন ৯ দিন। দেশে যাওয়ার আগে স্যার বাড়ির পেছনে কয়েকটি সবজি গাছ লাগিয়েছিলেন। সেগুলো এখন বেশ বড় হয়েছে।

ফিউনারেল হোম

ওজোন পার্কে যে বাড়িতে হুমায়ূন আহমেদ বসবাস করতেন সেই বাড়ির খুব কাছের ইসলামিক বিউরিয়াল এন্ড শিপিং সার্ভিস ইঙ্ক ফিউনারেল হোমে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ আনা হয় ১৯ জুলাই বিকেলে। ২০ জুলাই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে। ২১ জুলাই ফিউনারেল হোম থেকে জেএফকে বিমানবন্দরের ৪নং টার্মিনালে। এ দিন এমিরেটস (Emirates Airlines) এর ইকে ০২০২ (EK-0202) বিমানে আবুধাবি এবং সেখান থেকে ইকে ০৫৮২ (EK 0582) বিমানে ২৩ জুলাই সকাল ৯টায় ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার মরদেহ পৌঁছে। ২০ জুলাই সকালে ফিউনারেল হোমে তাকে গোসল করানো। হয়। তাকে গোসল করান গুলতেকিন আহমেদের খালাতো বোনের স্বামী জামাল আবেদীন, বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহের ও প্রথম আলো নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন।

এর আগে সকালে ফিউনারেল হোমে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেখতে আসেন। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, শাশুড়ি তহুরা আলী, মাজহারুল ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় কফিনের পাশে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শাওন। তার আর্তনাদ আহাজারীতে সেখানে শোকবিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শাওন বারবার বলতে থাকেন, “তোমাকে রাখতে পারলাম না আমাকে রেখে চলে গেলে। আমি আজীবন তোমার সাথে থাকবো। কেন আমাকে ফেলে গেলে? এ সময় দুই শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, এই দেখো ওরা তোমার পাশে/ কথা বলো/কথা বলো। শাওনের আর্তচিৎকারে তখন উপস্থিত অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত। পাশে দাঁড়ানো প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলছিলেন, স্যার আপনাকে যেতে দেওয়া যায় না। আপনি আছেন, আপনি থাকবেন।

জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে শোকার্ত মানুষের ঢল

গত ২০ জুলাই শুক্রবার নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে হাজার মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা আবেগ শোকের মধ্যে নিউইয়র্কে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। ২০ জুলাই বাদ জুম্মা নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে অবস্থিত জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম মাওলানা জাফর বেগ। সর্বস্তরের প্রবাসীরা ছাড়াও তার জানাজায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাঁদের, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আব্দুল মোমেনসহ কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ। জানাজায় বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি উভয়েই। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে জানাজায়। অংশ নেয় হাজারো নারী পুরুষ। জানাজা শেষে মরদেহ দেখা নিয়ে হুলস্থলের কারণে সৃষ্টি হয় বিশৃংখল পরিবেশ। জানাজায় পরিবারের পক্ষে ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী। নিউইয়র্কের সর্বস্তরের মানুষ এদিন শেষবারের মতো হুমায়ূন আহমেদএর মরদেহ দেখতে আসেন জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে। মসজিদ ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের জন্য হলেও নিউইয়র্কে বসবাসরত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান সম্প্রদায়ের লোকও লেখককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে উপস্থিত হন। এই অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি সরাসরি সম্প্রচার করে। ২১ জুলাই রাতেই আমিরাত এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ঢাকা রওয়ানা হয়ে যান। ২৩ জুলাই রোববার সকালে তারা ঢাকা পৌঁছেন। এয়ারপোর্টে তারা সাংবাদিকদের হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ সংবাদ অবহিত করেন।

ডেথ সার্টিফিকেট

কোটি মানুষের হৃদয়ের মানুষ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দাফন নিয়ে মেহের আফরোজ শাওনের বক্তব্য এবং ডেথ সার্টিফিকেটের তথ্যে কোনো মিল নেই। নুহাশ পল্লীতে দাফন করার কথা উল্লেখ করেছেন শাওন। অথচ ডেথ সার্টিফিকেটে দাফনের স্থান উল্লেখ করা হয়েছে গুলশানে, নিজস্ব প্লটে। হুমায়ূন আহমেদের ডেথ সার্টিফিকেটে দেওয়া এমন তথ্য জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্ক। গত ১৯ জুলাই নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ ইস্যু করেছে এই সার্টিফিকেট। ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটের নম্বর ১৫৬-১২-০২৮০১৪। সার্টিফিকেটে মৃত ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য ছাড়াও নিচে একটি কলাম রয়েছে। যেখানে ‘প্লেস অব ডিসপোজিশন’ বা কোথায় দাফন করা হবে তা উল্লেখ করতে হয়। ডেথ সার্টিফিকের সেই কলামে উল্লেখ করা হয়েছে ‘গুলশান বাংলাদেশ। স্থান হিসেবে উল্লেখ আছে ফ্যামেলি প্লটের কথা। অর্থাৎ গুলশানে পারিবারিক প্লটে দাফন করার কথা। এব্যাপারে দাফন বিষয়ে অভিজ্ঞ নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের প্রথম মসজিদ মদিনা মসজিদের সভাপতি এডভোকেট নাসির আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক হাফিজ জুলকিফল চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হলে, তারা বলেন, ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করে নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড মেন্টাল হাইজিন বিভাগ। যে ফিউনারেল হোমে লাশ রাখা হয়, সেখান থেকে লাশ দাফনের তথ্য সরবরাহ করা হয়। ফিউনারেল হোম লাশের উত্তরাধিকারের কাছে জানতে চায় কোথায় দাফন হবে। সে তথ্যই সার্টিফিকেট ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করে। তারা যা দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে বাইরের কারও কথা শুনবে না ফিউনারেল হোম কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, ডেথ সার্টিফিকেটে উত্তরাধিকার বা অভিভাবক হিসেবে যার নাম থাকে তাকেই বলতে হবে, কোথায় দাফন হবে লাশ। সেটাই উল্লেখ করা হয় সার্টিফিকেটে। হুমায়ূন আহমেদের ডেথ সার্টিফিকেট সার্টিফিকেটে উত্তরাধিকার বা অভিভাবক হিসেবে যার নাম তিনিই দাফনের স্থান উল্লেখ করবেন। ডেথ সার্টিফিকেটে হুমায়ূন আহমেদের উত্তরাধিকার হিসেবে একমাত্র নাম রয়েছে। মেহের আফরোজ শাওনের। ফলে এখানে অন্য কেউ কিছু বললে সেটা অস্বাভাবিক হবে বলে মন্তব্য করেন মদিনা মসজিদ কর্মকর্তাদ্বয়। উল্লেখ্য, ২৩ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের লাশ পৌঁছার পর মেহের আফরোজ শাওন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, নুহাশ পল্লীতে লাশ দাফনের কথা বলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ নিজে। এ নিয়ে সেখানে চরম জটিলতা সৃষ্টি হলে সরকারি হস্তক্ষেপে অচলাবস্থার অবসান হয়। মেহের আফরোজ শাওন এর আগে জেএফকে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের। জবাবে বলেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

প্রথম শ্রেণির টিকেট

হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম সিদ্ধান্ত নিলে বিমানের প্রথম শ্রেণির টিকেট না পাওয়া পর্যন্ত দেশে যাবেন না। তাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে মরহুমের কফিন দেশে পৌঁছে একদিন পর। এদিকে বাঙালি জাতি, সারা দেশবাসী যখন এক নজর তাদের প্রিয় লেখককে দেখতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছেন, পরিবার যখন শোকাহত, অনুরাগীরা শোক সাগরে ভাসছে, সেই রকম একটি স্পর্শকাতর মুহূর্তে মেহের আফরোজ শাওনের প্রথম শ্রেণির টিকেট ব্যতীত দেশে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে সকলে হতবাক হয়ে যান। যেখানে আগের দিন হুমায়ূন আহমেদ-এর ভাই জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী এমিরাটস এয়ারলাইন্সেই দেশে চলে যান, সেখানে প্রথম শ্রেণির টিকেটের জন্য একদিন বিলম্বিত হয়। প্রবাসী বাঙালী এই ঘটনায় শুধু হতবাকই হননি এমন সিদ্ধান্তকে অনেকেই চরম অমানবিক বলে মন্তব্য করেন। যেদিন হুমায়ূন আহমেদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় জ্যামাইকা মসজিদে সেখানে প্রথম শ্রেণির টিকেটের জন্য দেনদরবার করেন প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম মসজিদের পাশে বাংলাদেশ’ পত্রিকা অফিসে। এ ঘটনাটিও নিউইয়র্কে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের ক্ষোভের সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, প্রথম শ্রেণীর টিকেট বাবদ এবং হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ ফিউনারেল হোমে রাখা বাবদ ২৫ হাজার ইউএস ডলারের মতো নিইউইয়র্ক কনস্যুলেট অফিস থেকে বাংলাদেশ সরকার খরচ করেছে।

শোকাহত সারাদেশ

১৯ জুলাই গভীর রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী পেশা-শ্রেণির মানুষের মধ্যে গভীর শোক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। নাট্য, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ গভীর রাতে ঢাকায় পৌঁছুলে মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বিশেষ করে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর গভীর রাতের প্রতিটি টকশো এবং আলোচনার বিষয়বস্তুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে হুমায়ূন আহমেদের বর্ণাঢ্য জীবন ও অসাধারণ সৃজনশীলতার কথা। তাঁর মৃত্যু যে কী বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে তা গণমাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং সংবাদে।

২৩ জুলাই

হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে আনার পর বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় ঈদগাহ ময়দান, বারডেম হাসপাতাল এবং দাফন পর্যন্ত সর্বত্র সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। যেখানেই হুমায়ূন আহমেদের পদচারণা ছিলো, সেখানেই সৃষ্টি হয়েছে গভীর শূন্যতা। হুমায়ূন আহমেদের মতো এমন অসাধারণ জননন্দিত ছোট গল্পকার, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকারের শূন্যতা কোনো কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। বহু জনপ্রিয় গানেরও স্রষ্টা তিনি। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েও জীবন সায়াহ্নে তিনি লিখছিলেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়ে একটি নতুন উপন্যাস ‘দেয়াল’। তথ্য সংশোধনজনিত উচ্চ আদালতের পরামর্শের কারণে তাঁর একটি খণ্ড পত্রিকায় ছাপার পর সেটির মুদ্রণ বন্ধ রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্যামলছায়া, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, একাত্তর প্রভৃতি। আগুনের পরশমণি ও শ্যামলছায়া এসব চলচ্চিত্র বপুল জনপ্রিয়তা পায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনসহ বিভিন্ন বাউল সাধকদের সঙ্গীত ছিল হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত প্রিয়। যে কারণে অনেক চলচ্চিত্রেই তিনি এসব বাউল ফকিরদের গান ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যে এমন কিছু চরিত্র তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, এসব কালজয়ী চরিত্রের জন্য তাঁকে বহুঁকাল মনে রাখবেন পাঠক। বিশেষ করে হিমু, মিসির আলীর মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্যে প্রায় বিরল। বিচিত্র সৃজনশীলতায় তিনি এমন অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেখানে মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিলেও তিনি চির অমর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো বিপুল জনপ্রিয় আর তরুণ মনের ঢেউ জাগানো কোনো লেখকের জন্ম হয়নি। তিনিই মধ্যবিত্ত বাঙালির ধমনির ধ্বনি যথার্থ শুনতে পেয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে কেবল সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখকই ছিলেন না, ছিলেন টিভি ও চলচ্চিত্রের জগতে সমান জনপ্রিয়। চলচ্চিত্রের কাহিনি নির্মাণ ও নাট্যকার পরিচালক হিসেবে ছিলেন জননন্দিত। তার অসামান্য রচনাকৌশল, অনায়াস সংলাপ রচনা, তুলনারহিত রসবোধ এবং প্রাঞ্জল গদ্যশৈলী তাঁকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য এক উজ্জ্বল ভুবন। তাঁর সৃষ্টিকর্মের চরিত্ররা অনন্য, তাদেরকে সৃষ্টির নিপুণশৈলী মুহূর্তেই পাঠককে এক গম্ভীর মুগ্ধতার জগতে নিয়ে যায়। তাঁর দুই শতাধিক গ্রন্থের অধিকাংশ এ দেশের মানুষের জীবন ও ভাবনার নিপুণ রেখাচিত্র। হুমায়ূন আহমেদ প্রায় একক হাতেই এ দেশে সাহিত্যকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। এক সময় পশ্চিমবঙ্গের একচ্ছত্র সাহিত্যবাজার বাংলাদেশকে একাই রক্ষা করেছেন। ঘরে ঘরে সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের বইয়ের পাঠক।

দেশের মাটিতে হুমায়ূন

২১ জুলাই নিউইয়র্ক সময় রাত ১১টা ৪১ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহবাহী ফ্লাইটটি জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট (JFK Airport) থেকে দুবাইয়ে যাত্রাবিরতির পর বিমানটি ২৩ জুলাই সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। জননন্দিত কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ প্রথমে ২২ জুলাই রোববার আসার কথা বলা হলেও একদিন পিছিয়ে যায় বলে জানান জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এ মোমেন। একই বিমানে ফিরেছেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, দুই শিশু সন্তান নিষাদ, নিনিত, শাশুড়ি তহুরা আলী, শ্যালিকা সেঁজুতি ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। কফিন গ্রহণ করার জন্য বিমানবন্দরে ছিলেন লেখকের দু-ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, ছেলে নুহাশ, মেয়ে শীলা ও নোভা, পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস এবং অন্য স্বজনরা। লেখকের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য ফুল দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয় এ্যাম্বুলেন্স। সার্বিক পরিস্থিতি তদারক করতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিল এবং প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুজ্জামান শিখর। সকাল থেকে হুমায়ূনের ভক্ত-অনুরাগীরা ভিড় করে বিমানবন্দরে। গণমাধ্যমকর্মীরাও হাজির ছিলেন সংবাদ সংগ্রহ করতে। কয়েকটি টিভি চ্যানেল বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সম্প্রচার করেছে কফিন গ্রহণের দৃশ্যটি।

বিমানবন্দরে হৃদয়বিদারক দৃশ্য

রাত শেষে ভোর। আর ভোরের আলো ফুটতেই গোটা দেশ ও জাতির অপেক্ষার প্রহর গোনা দ্রুতলয়ে চলতে থাকে। প্রিয় মানুষ আসছেন কফিনবদ্ধ হয়ে। বুক ফাটা আর্তনাদ কুড়ে কুড়ে নিঃশেষ করে ফেলে তার অগণিত ভক্তহৃদয়। অবশেষে ২৩ জুলাই সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে প্রহর শেষ হলো। প্রিয় মাতৃভূমির মাটি স্পর্শ করলো নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে বহনকারী এমিরেটাস এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৭৭৩০০ ফ্লাইটটি। শুরু হয়। হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। সে সময় বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সরকারের তরফ থেকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিল এবং প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুজ্জামান শিখর। দেশে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দর থেকে লেখকের কফিন সরাসরি ধানমন্ডিতে তার বাড়ি দখিন হাওয়ার নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনা। হয়। বিমানবন্দর থেকে জেবিএফএইচ’র মরদেহবাহী গাড়িটি রওনা হয় হাজারো ভক্তের মিছিলে, শহীদে মিনারের দিকে। সে সময় লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন অশ্রুভেজা কণ্ঠে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, আমি শুধু একটা কথাই জানি। নুহাশ পল্লীকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। প্রতিটি গাছ তার নিজের হাতে লাগানো। এসব গাছের সঙ্গে কথা বলত সে। তিনি বলেন, আমাকে সে বলেছে, যদি আমার কিছু হয় সবাই আমাকে নিয়ে টানাটানি করবে। তুমি আমাকে নিয়ে টানাটানি করতে দিও না। তুমি আমাকে নুহাশ পল্লীতে নিয়ে যেও। ওই গাছগুলোর কাছে আমাকে দিয়ে এসো। মৃত্যুর আগে হুমায়ূন আহমেদ তার কোনো অচেনা জায়গায় তাঁকে দাফন করতে নিষেধ করেছিলেন বলেও উল্লেখ করেন শাওন। নিউইয়র্কে অস্ত্রোপচারের আগের রাতেই নাকি হুমায়ূন আহমেদ তাকে নুহাশ পল্লীতেই দাফনের কথা বলেছিলেন। তাই তিনি বলেন, তাঁর সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। উনি নুহাশ পল্লীতেই শুয়ে থাকতে চেয়েছে। ওনার শেষ ইচ্ছা ছিল নুহাশ পল্লী। ওনাকে আর কষ্ট দিয়েন না। নুহাশ পল্লীতেই ব্যবস্থা করেন।…

শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা

বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এই বরেণ্য কথা সাহিত্যিকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে জনতার ঢল নামে। ইতঃমধ্যে শহীদ মিনারের পূর্বপাশের গেটে উপচেপড়া ভক্তকূল অপেক্ষমান। ২৩ জুলাই সকাল ১০টা ২১ মিনিটে তার লাশ শহীদ মিনারে এসে পৌঁছে। সে সময় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ সৈয়দ শামসুল হক, সালেহ চৌধুরী, আফজাল হোসেন, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ মঞ্চে নিয়ে আসেন। শবদেহের পেছনে ছিলেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছোট ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব, মেয়ে শিলা, নোভা, ছেলে নুহাশসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সে সময় উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, চাষী নজরুল ইসলাম, লিয়াকত আলী লাকী, ফকির আলমগীর, তারানা হালিম, ড. ইনামুল হক, কুদুস বয়াতী, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ, আসাদুজ্জমান নূর, আলী যাকের, মামুনুর রশীদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, অরুণ চৌধুরী, চয়নিকা চৌধুরী, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আমজাদ হোসেন, মাহফুজ আহমেদ, বারী সিদ্দিকী, সেলিম চৌধুরী, খুরশীদ আলম এবং আরো অনেকে। পূর্বপাশের গেট দিয়ে ঢুকে পশ্চিম পাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় মোতায়েন রয়েছে র‍্যাব ও পুলিশের। বিপুলসংখ্যক সদস্য। এদিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের নিরাপত্তা এবং সে এলাকায় যানজট নিরসনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চার দিকের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। পুরো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি চ্যানেল।

ছেলের কফিনে মাথা রাখলেন মা

ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁই ছুঁই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এলেন রত্নগর্ভা মা আয়েশা ফয়েজ। সদ্যপ্রয়াত ছেলেকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা অগণিত মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন কফিনের কাছে। এই ছেলেই তো হর-হামেশা আশ্রয় খুঁজতো তার। বুকে। বড় হয়েও কত অবলীলায় মাকে জড়িয়ে ধরতো ছেলেটা। সেই সন্তানের মরদেহ স্পর্শ করা মায়ের জন্য যে কতটা কষ্টের, তা ছিল হৃদয় বিদারক।

হুমায়ূন আহমেদের গ্রামে শোকের মাতম

বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদে তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নের কুতুবপুরে চলেছে শোকের মাতম। তার মৃত্যুতে জেলার সর্বত্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভক্ত, অনুরক্ত ও শুভানুধ্যায়ীরা শোকাহত হয়ে পড়েছেন।

২০ জুলাই ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে অগণিত মানুষ হুমায়ূন আহমেদের কুতুবপুর গ্রামের বাড়িতে ভিড় জমানো শুরু করেন। তার এই আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে তার স্বজনদের সমাবেদনা জানাতে গিয়ে শোকাহত অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কুতুবপুর গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীরা সেদিন কালো ব্যাচ ধারাণ করে। তারা অনেকে শোকাহত। সকালে প্রিয় লেখকের একমাত্র জীবিত চাচা আলতাবুর রহমান (৮১) ও চাচি মুক্তাদিরা বেগমসহ (৭০) অন্যান্য স্বজনদের সমবেদনা জানাতে আসে প্রত্যন্ত এলাকার লোকজন। সে সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এক সময় চাচা আলতাবুর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা।

দাফন নিয়ে টানাপোড়েন

মঙ্গলবার দাফনের বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও লেখককে কোথায় সমাহিত করা হবে তা নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মতবিরোধ চলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন নুহাশ পল্লীতেই স্বামীর কবর চাইলেও সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের সন্তানরা তাদের বাবাকে ঢাকায় দাফনের পক্ষে মতো দেন। এই নিয়ে সোমবার দিনভর টানাপোড়েন চলে। পরিবারের মধ্যে মতদ্বৈততা অবসানে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা কয়েক দফা দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর রাত আড়াইটার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় নানকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, নুহাশ পল্লীতেই দাফনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের সন্তানরা চাচ্ছিল তাদের বাবার দাফন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে হোক। কারণ সেখানে সবাই সহজে যেতে পারবে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে রাজি করানো যায়নি।

আবার সন্তানরা চাচ্ছে না, তাদের বাবার লাশ বারডেমের হিমঘরে পড়ে থাকুক। এ কারণেই তারা নুহাশ পল্লীতে দাফনের বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের ৩ সন্তান নোভা, শীলা ও নুহাশের সঙ্গে সোয়া এক ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক তাঁর বাসভবনে। এর আগে নানক বৈঠক করেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে। হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাসভবন দখিনা। হাওয়ায় ওই বৈঠক চলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

উল্লেখ্য, এর আগে হুমায়ূন আহমেদের দাফন নিয়ে নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে মেহের আফরোজ শাওনের দেওয়া বক্তব্য এবং ঢাকা এয়ারপোর্টে দেওয়া বক্তব্যে নুহাশ পল্লীতে দাফনের কথা বলায়, বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাদের নিউইয়র্ক প্রবাসী ঘনিষ্ট কয়েকজন। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আব্দুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, শনিবার হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে জেএফকে এয়ারপোর্টে প্রকাশ্যে মেহের আফরোজ শাওন লাশ দাফনের ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ কিছু বলে যাননি বলে জানান। সেলিনা মোমেন বলেন, শাওনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সেখানে আমিসহ অনেক বাঙালিই উপস্থিত ছিলেন। তবে শাওনের কথা রেকর্ড করতে গেলে শাওনের মা তহুরা আলী বাধা দেন বলেও উপস্থিত থাকা প্রবাসী বাঙালিরা উল্লেখ করেন।

বেদনাবিধূর নুহাশ পল্লী

টিপ টিপ বৃষ্টি। বৃষ্টি ভীষণ পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। বৃষ্টির প্রতি দুর্বলতার কারণেই নিজের হাতে গড়া নুহাশ পল্লীতে বৃষ্টি বিলাস নামে একটি রেস্ট হাউজ গড়েছিলেন। টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শোনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। বৃষ্টির প্রতি ভালবাসার কারণে বৃষ্টিস্নাত হয়েই শেষ বিদায় নিলেন বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট এবং সাম্প্রতিক কালের তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। নুহাশ পল্লীতে শোকার্ত মানুষের ভিড়। প্রিয় মানুষকে বিদায় জানাতে আত্মীয়- স্বজন এবং শুভাকাক্ষিদের ভিড়। সবার চোখেই জলের স্রোত।

নুহাশ পল্লীর লিচু বাগানে ত্রিপলের অস্থায়ী ছাউনি টানানো হয়। তার তলায় সদ্য খোঁড়া হয় কবর। সেই কবরেই বৃষ্টির মধ্যে হাজারো ভক্ত-পাঠক, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, বুদ্ধিজীবী এবং স্থানীয় মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মমতায়ঘেরা নুহাশ পল্লীর কাক্ষিত এবং পছন্দের লিচুতলাতেই চিরন্দ্রিায় শয়িত হলেন হুমায়ূন আহমেদ। যিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন তিনি নিজেই চলে গেলেন স্বপ্ন জগতে। দাফনের স্থান নিয়ে টানাপোড়েনের পর যে স্থানটি ছিলো তার প্রিয় সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। জানাজা শেষে বিপুল সংখ্যক মানুষ শ্রদ্ধা জানান বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভাধরকে। এ সময় উপস্থিতিদের মধ্যে এক বেদনাবিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। সকালে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে হুমায়ূন আহমেদের। লাশ নিয়ে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হয় একটি এ্যাম্বুলেন্স। সেই এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গেই বেলা ১২টা ৫ মিনিটে নুহাশ পল্লীতে পৌঁছান শাওন ও তার দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত। তার কিছুক্ষণ আগেই নুহাশ, শীলা ও নোভাকে নিয়ে পৌঁছান জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। সেসময় উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক আখতারুজ্জামান, জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সবুজ, গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন প্রমুখ। যারা কফিনটি কবরে নামান তাদের একেবারে সামনে ছিলেন লেখকের বড় ছেলে নুহাশ। তার পরনের নীল পাঞ্জাবিও বৃষ্টিতে সিক্ত হয়। হুমায়ূনের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের মেয়ে শীলা ও নোভা, দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং তাদের দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত, লেখকের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব এবং তাদের দুই বোন, আ ক ম মোজাম্মেল হক। এমপি, টঙ্গী পৌর মেয়র আজমত উল্লাহ, অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম, অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলামসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। কবরস্থ করার আগে শেষবারের মতো হুমায়ূন আহমেদের লাশ দেখার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছেলে নুহাশ, মেয়ে শীলাসহ নুহাশ পল্লীর কর্মচারীদের। সেসময় অঝোরে কাঁদতে থাকেন মেহের আফরোজ শাওন। প্রিয় মানুষটির চিরশয্যার সময় সবাই ছিল অশ্রুসিক্ত। বাঁশ ও চাটাই দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় কবরের উপরের অংশ। হুমায়ূন আহমেদের তিন ছেলে নুহাশ, নিষাদ ও নিনিত বাবার কবরে দিয়েছেন মুঠো মুঠো মাটি। কবরের ওপর মুঠো ভরে মাটি ছড়িয়ে দিয়েছেন অন্য স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তরা। ধীরে ধীরে কবর ঢেকে যায় মাটিতে। মোনাজাত শেষে কবরের উপর ফুল দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি জানানো হয় পরম ভালোবাসা। প্রকৃতিপ্রেমী। হুমায়ূন আহমেদ নিজের অপরিসীম দরদ দিয়ে গাজীপুর সদরের মির্জাপুর ইউনিয়নের পিরুজালী গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন তার স্বপ্নের নুহাশ পল্লী। চল্লিশ বিঘা জমির উপর ১৯৯৭ সাল থেকে তিলতিল করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন। অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ নুহাশ পল্লী। এখানে রয়েছে প্রায় ২৫০ প্রজাতির গাছপালা। এছাড়াও দিঘি, বিভিন্ন প্রকার মুরাল, বৃষ্টি বিলাস বাংলো। অবসর পেলেই এখানে ছুটে আসতেন হুমায়ূন আহমেদ। এখানকার নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে খুবই পছন্দ করতেন তিনি। জীবদ্দশায় তিনি একাধিকবার তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন নুহাশ পল্লীর লিচু বাগানেই তাকে যেন দাফন করা হয়। তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই অবশেষে ২৪ জুলাই তার লাশ নুহাশ পল্লীর লিচু গাছের তলায় দাফন করা হয়। নুহাশ পল্লীর ভাস্কর আসাদুজ্জামান খান জানান, সোমবার গভীর রাতে ঢাকায় পরিবারের সদস্যরা লেখকের দাফনের স্থান চূড়ান্ত করার পরপরই তারা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সকালে কবর খোঁড়া শুরু হয়। হুমায়ূন আহমেদের দাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে স্থানীয় প্রশাসনও ছিল তৎপর। ঢাকা থেকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নির্বিঘ্ন করতে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। তাঁর মরদেহ বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স ছাড়াও প্রায় শ’খানেক গাড়ির বহরে ছিল পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা। রাজধানীর উত্তরা থেকে শুরু করে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষকে হুমায়ূন আহমেদের শেষযাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ হাত নেড়ে শেষ বিদায় জানিয়েছেন প্রিয় লেখককে, কেউ ফুল ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রিয় মানুষটির উদ্দেশ্যে। দাফনের পর সংক্ষিপ্ত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে হুমায়ূনের ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি পছন্দ করতেন। সেই বৃষ্টির মাঝেই তার জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নিউইয়র্কে তার জানাজার সময়ও বৃষ্টি হয়েছিলো। এখানেও দাফন ও জানাজার সময় বৃষ্টি হয়েছিলো। বৃষ্টির প্রতি হুমায়ূন আহমেদের দুর্বলতার কথা বলতে গিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, নুহাশ পল্লীতে বৃষ্টি বিলাস নামে একটি রেস্ট হাউজ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সুষ্ঠুভাবে দাফন সম্পন্ন হওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে তিনি ধন্যবাদ জানান।

সাফল্যের ফুলে মোড়ানো জীবন

জীবনবাদী হুমায়ূন আহমেদের জীবনের আলো মাত্র ৬৪ বছরে নিভে এলেও তার এই নাতিদীর্ঘ জীবন পুরোটাই ছিল সাফল্যের ফুলে মোড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায়ই প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ রচনা করে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন। আত্মপ্রকাশ লগ্নেই তিনি চমকে দেন পাঠকদের তার অসামান্য স্মিতবাক আর চুম্বক রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে। নন্দিত নরকের ভূমিকায় অধ্যাপক ড. আহমেদ শরীফ লেখেন, ‘হুমায়ূন বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবনরসিক’। জীবনরসিক হুমায়ূন আহমেদ এরপর কেবল সাফল্যের সিঁড়ি ভেঙেছেন। ‘নন্দিত নরকে’র অনতিবিলম্বে তিনি রচনা করেন উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারগার’, ‘অচিনপুর’, ‘নির্বাসন’। ১৯৭৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় যান এবং দেশে ফেরেন ১৯৮২ সালে। এর পরের বছর থেকে উপন্যাসের পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন টিভি নাটক। প্রথম নাটক ‘প্রথম প্রহর’ দর্শকচিত্ত জয় করে। এরপর লেখেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের অসামান্য জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’।

মধ্যবিত্তের জীবনবাস্তবতা ও মানসিকতার নিখুঁত রূপায়ণের মাধ্যমে তিনি দেশের ঘরে ঘরে মানুষের প্রিয় কথাকারে পরিণত হন। এরপর ধারাবাহিক বহুব্রীহি’ (১৯৮৭), ‘অয়োময়’ (১৯৮৯) ও ‘কোথাও কেউ নেই’ (১৯৯১) তার জনপ্রিয়তাকে প্রবাদে পরিণত করে। বিশেষ করে কোথাও কেউ নেই’র ফাঁসির আসামি বাকের ভাই চরিত্রটি দেশের আপামর জনসাধারণকে উদ্বেল করে তোলে। তারা বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ বাতিলের দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করতে শুরু করে। কোনো টিভি নাটকের একটি চরিত্র নিয়ে এ রকম আবেগ এদেশ কেন, সারাবিশ্বেই এক বিরল ঘটনা। টিভি নাটক নির্মাণ ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি অনন্য কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ বেশ কটি শাখায় পুরস্কার অর্জন করে। তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিনও একইরকম সাড়া জাগায়। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি একে একে তৈরি করেন ‘চন্দ্রকথা’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘তের নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘শ্যামল ছায়া’সহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র। তাঁর সর্বশেষ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।

এতকিছুর পরও হুমায়ূন আহমেদ নিষ্ঠ ছিলেন সাহিত্যেই প্রবলভাবে। জীবনের শেষ দশ বছরে লিখেছেন বিপুলাকৃতির বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। ‘মধ্যাহ্ন’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘বাদশা নামদার’ এবং সর্বশেষ তার অসমাপ্ত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘দেয়াল’। গত প্রায় এক বছর ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে অবস্থানকালেও প্রায় শেষ পর্যন্ত তার কলম ছিল সক্রিয়। সেই দফায় নিউইয়র্কে অবস্থানরত অবস্থায় তার রচনা সংকলন ‘নিউইয়র্কের নীলাকেশে ঝকঝকে রোদ’। গত মে মাসের ৯ তারিখে হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসার বিরতিতে তিন সপ্তাহের জন্য মা ও মাটির টানে দেশে ফেরেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্কে দ্বিতীয় দফা চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে জীবনের প্রতি তার তীব্র টান ও আগ্রহের কথা অকপটে জানিয়ে গেলেন। জানিয়েছিলেন, সাহিত্য নিয়ে তার নতুন ভাবনার কথা, নতুন পরিকল্পনার কথা। প্রখর রসবোধ, জীবনকে নানাভাবে ও আঙ্গিকে দেখার ক্ষমতা হুমায়ূনকে বরাবরই চিরতরুণ করে রেখেছে। একুশের বইমেলা, পত্র-পত্রিকার ঈদ সংখ্যা আর টিভি নাটকের প্রাণপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া এসব ক’টি প্রাঙ্গণই আগামীতে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে উঠবে। তার স্মিত হাসির প্রখর কলমের শূন্যতা বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের অঙ্গনকে চিরস্থায়ী এক নিঃস্বতার মধ্যে ফেলে দিল। তারপরও জীবনের নিয়মই এই, বিদায় নিতেই হয়। তাই প্রখর প্রাণবাদী, জীবনরসিক হুমায়ূন আহমেদকেও বিদায় নিতে হলো তাঁর অগণিত অনুরাগীদের কাছ থেকে।

এবং অবশেষে

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর ১২ দিন পর এলো পারমানেন্ট মেডিকেইড বেনিফিট কার্ড। খামটি খুলে আমি চেয়ে থাকি। যেমন চেয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদের ডেথ সার্টিফিকেট দেখে। এখনও বিল আসছে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর আগে যে ১২ জুনসহ সর্বমোট ৫টি সার্জারি হয়ে গেলো তার বিল। ১২ বিশাল অঙ্কের বিল। ভাগ্য ভালো যে, মুক্তধারা থেকে লেখকের জন্য মেডিকেইড কার্ড করা হয়েছিলো। দেখানো হয়েছিলো তিনি আমাদেরই পরিবারের একজন সদস্য। তিনি একজন লেখক। এখানে তিনি কোনো চাকরি করেন না। গ্রিনকার্ড অথবা নাগরিকত্ব যাদের আছে তারাই মেডিকেইড পান। এটা পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার। সেখানে একজন ট্যুরিস্টের মেডিকেইড পাওয়া একটি বিশেষ ঘটনা। হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন ভাগ্যবান মানুষ তাঁর বেলায় সবকিছুই সম্ভব। এটিই বোধ হয় অদ্ভুতভাবে ঘটে গেল তাঁর জীবনে। এভাস্টিনসহ বেলভ্যুতে ৭টি কেমোথেরাপি ও ১৪দিন হাসপাতালে থাকার বিল আগেই এডজাস্ট করা হয়েছে।

অন্তত ৩০০ হাজার ডলার খরচ থেকে বেঁচে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ পরিবার। হাজার হাজার ডলারের ওষুধ কেনা হতো এক একবার ২/৩ ডলার করে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর মেহের আফরোজ শাওন ই-মেইলে আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ধন্যবাদ মেহের আফরোজ শাওনকে। ২৫ জুনের পর থেকে আমার সাথে প্রায় কথাই বন্ধ তাঁর সাথে। যেদিন হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নিয়ে তারা দেশে ফিরছেন সেদিনই প্রথম কথা হলো। প্লেনে উঠার পূর্ব মুহূর্তে শাওন বলেছিলেন তাঁর ছেলেদের জন্য দোয়া করতে, যেন বাবার মতো হয় তারা। আমি বলেছিলাম, অবশ্যই থাকবে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে আপনার উপর। কেননা, এখন মা ও বাবার দুটো বিশাল দায়িত্ব তার কাঁধে।

তাঁর চিঠিটি ইংরেজি হরফে লেখা বাংলায় ইমেইল

মেহের আফরোজ চিঠিতে লিখেন: বিশ্বজিতদা। কেমন আছেন এই প্রশ্ন করব না। জানি ভালো নেই, ভালো থাকা সম্ভব নয়। যে স্নেহ হুমায়ূন আহমেদ আপনাকে করতেন তার অনুপস্থিতিতে আপনার কেমন থাকা যায় তা বুঝতে পারি। পুত্র নিষাদের সাথে হুমায়ূন আহমেদের কাটানো চমৎকার সব সময় দেখে বাবা হিসাবে আপনার কন্যা বহতার সাথে কাটানো সময়গুলো উপলব্ধির যে বহিঃপ্রকাশ মেমোরিয়াল হাসপাতালে কেমোথেরাপি চলাকালীন সময়ে আপনি দেখিয়েছিলেন তা আমার চোখে প্রায় ভাসে। জীবনযুদ্ধের ব্যস্ততায় বহতার বড় হওয়ার সময়ে আপনার সময় কম দিতে পারার কথা বলতে গিয়ে আপনার কান্না। ভেজা চোখ বহুদিন আমার আর হুমায়ূন সাহেবের নিজস্ব গল্পে স্থান পেয়েছিলো।

টিঠিতে মেহের আফরোজ শাওন আরো লিখেন: জামাল আবেদীন একবার আপনাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করায় অপমানিত হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদের। কাছে। তখন আপনার পক্ষ নেওয়ার কারণে জামাল আবেদীনের কাছে গালি শুনেছিলাম আমিসহ উপস্থিত আরো একজন।

হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন: মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারের প্রথমদিন ভিজিট (সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১১) থেকে শুরু করে মেডি পোর্ট প্লেসমেন্ট… একে একে ৫ টি কেমোথেরাপি WBC (White Blood Cell) কেমোতে যাওয়ার পর বোনে ম্যারো থেকে WDC প্রডিউস করার ইনজেকশন … আর্থিকভাবে কতটা অসহায় ছিলাম আমরা তা আপনি মাজহার ভাই, পূরবীদি, আমার মা-বাবা আর আমি ছাড়া কে জানে?

বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ডেনভারে। পূরবীদির বাড়িতে বসে আমরা যখন শুনলাম আপনি অনেক দৌড়াদৌড়ি করে। বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের পেশেন্ট কার্ডের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন (যা আপনার একার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল) তখন হুমায়ূন আহমেদ স্বস্তি পেলেন এই ভেবে যে, খরচ কিছুটা কমলো। আমি স্বস্তির পাশাপাশি একটু কনফিউশনে পড়ে গেলাম কারণ ঢাকা থেকে ফোন করে আমার বাবা বারবার বলছিলেন উনি। বেঁচে থাকতে আমরা যেন খরচ নিয়ে টেনশন না করি। কিন্তু যখন বেলভ্যু হাসপাতালে ইয়ং তুখোড় ডা. সিলভিয়া জেইন এর সাথে মিট করলাম এবং মেমোরিয়াল স্লোয়ান কোটারিং ক্যান্সার সেন্টরের সাথে তার ট্রিটমেন্ট প্লানিং-এ অসাধারণ সামঞ্জস্য পেলাম তখন আর কোনো কনফিউশনই রইল না।

চিকিৎসা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ভাবনা প্রসঙ্গে চিঠিতে মেহের আফরোজ শাওন লিখেন, আমি জানি ধন্যবাদ পাওয়ার আশায় আপনি কিছু করেন না। কিন্তু আপনার এই একটি কাজের জন্য আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপনাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ দিয়েই যাবো। কারণ অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাওয়ার চিন্তাটাই যে হুমায়ূন আহমেদের কাছে কতটা কষ্টের ছিলো তা কাছের কিছু মানুষের একজন হিসাবে আপনি বেশ ভালই জানতেন। বারটা কেমো পার হলো এরপর এলো এপ্রিল ৩০… এর বেস্ট সার্জন ডা. জর্জ মিলার দেখলেন হুমায়ূন আহমেদের রিপোর্ট। ওর সাথে প্রতিদিনের মতো আমি এবং আপনি সাথে। আরও ছিলেন ফাংসু ভাই। আমি নিশ্চিত আপনার মনে আছে। যখন ডা. মিলার সার্জারির সম্ভাবনার কথা বললেন তখনকার সেই মুহূর্তটির কথা। সেদিন ভেবেছিলাম যুদ্ধে জিতেই গেছি (কী বোকা আমি)…।

১২ জুন সার্জারি প্রসঙ্গে শাওন চিঠিতে লিখেন: মে ৭, ডা. মিলার নিশ্চিত করলেন সার্জারি হবে। ১২ জুন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যে কত তাড়াতাড়ি সাইন করলো হুমায়ূন আহমেদ। তার সেই হাসিটা…(আহারে কী সুন্দরই না ছিলো সেদিনটা)। বাসায় ফেরার পথে কত জল্পনা-কল্পনা.. পূরবীদি সাথে সাথেই অনলাইনে ডেনভার টু নিউইয়র্ক এর টিকিট করে ফেললেন।

নিউইয়র্কের বইমেলা প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে শাওন চিঠিতে উল্লেখ করেন, আপনি হুমায়ূন আহমেদের কাছে জানতে চাইলেন মুক্তধারা থেকে দেওয়া আজীবন সম্মাননা তিনি কার হাত থেকে নিতে চান…। তিনি জবাব দিলেন অবশ্যই পূরবীদির হাত থেকে আর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী যে জনৈক বিশিষ্ট চিত্র সমালোচক (!!!) নিষাদ হুমায়ূন’ উদ্বোধন করবেন এই সব আলোচনা হলো। ইশ!…ঠিক সেই মুহূর্তটুকুন যদি স্থির হয়ে থাকতো আমাদের জীবনে…

স্মৃতিচারণ করে মেহের আফরোজ শাওন চিঠিতে লিখেন, বিয়ের পর হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার নিউইয়র্ক ভ্রমণ ২০০৫-এ, জেএফকে এয়ারপোর্ট (JFK Airport)-এ ইমিগ্রেশন ক্রস করার পর দেখেছিলাম একটা ফুলের বাকেট হাতে হাস্যেজ্জ্বল বিশ্বজিত সাহাকে। এরপর যতবার দেখেছি সেই একই চিত্র। এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে আসলেও বিশ্বজিতদাকে হাসিমুখে দেখতাম আর আবার কবে নিউইয়র্ক যাব সেই প্রশ্ন শুনে হাসতাম। এবার বিদায় দিতে এসে বিশ্বজিতদা কেন পালিয়ে বেড়ালেন, তাকাতেই পারছিলেন না আমার দিকে। আর আমার বৌদি যিনি বন্ধুর মতন ধরেছিলেন আমার হাত গত দশ মাসের বিভিন্ন সময়ে। আমাকে বিদায় দিয়ে বললেন যোগাযোগ রেখো…

বেদনার কথা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ভালো নেই আমি… ভালো নেই হুমায়ূন আহমেদের নিজের থেকে প্রিয় নিষাদ-নিনিত… তবুও তো বেঁচে আছি…

হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবিগুলো প্রসঙ্গে মেহের আফরোজ শাওন চিঠিতে লিখেন: আপনার দায়িত্বে থাকা নিষাদ-নিনিত এর বাবার আঁকা ছবিগুলো যদি কারো মাধ্যমে আমার হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো। চিঠিতে সর্বশেষে লিখেন, ভালো থাকার চেষ্টা করবেন। বৌদিকে প্রীতি অনেক ভালোবাসা। মেহের আফরোজ শাওন। ঢাকা।

ধন্যবাদ
মেহের আফরোজ শাওন।

সেই ২৬ জুন রাতের পর তো আপনার সাথে আর তেমন কথাই হয়নি। ২১ জুলাই স্যারকে যখন শেষবারের মত বিদায় দিতে গেলাম জেএফকে এয়ারপোর্টে তখনই ভাবি আমার জীবনের ২৫ বছরের একটি সম্পর্কের অবসান। কীভাবে তাকাবো আপনার দিকে। নিষাদকে নিয়ে যখন এয়ারপোর্টে ম্যাকডোনাল্ডে নিয়ে গেলাম, ছোট শিশুটির মধ্যে ছিলো না কোনো প্রতিক্রিয়া। ছোট্ট শিশুটি হয়তো বুঝতেই পারেনি, তাদের বাবা নেই। আর নিনিত যে সারাক্ষণ থাকতো বাবার গায়ে গায়ে। এই দুটো পিতৃহারা শিশুর দিকে তাকাবার পর, আর কারো দিকে তাকাবার মতো আমার মানসিক অবস্থা ছিলো না। অথচ গতবার যখন ৩ সপ্তাহের জন্য স্যার দেশে গেলেন কতবার বললেন আমাকে সঙ্গে যেতে। পরে আবার নিজেই বললেন, তোমার তো বইমেলা। তুমি যেতে পারবে না। গেলে খুব আনন্দে করতে বিশ্বজিত। দেশে যাওয়া ঠিক হওয়ার পর অন্তত ৫ বার বলেছেন। দেশ থেকে আসার পর আর একটি কথাও কয়েকবার বলেছেন, আপনার সামনেও দু’তিনবার বলেছেন। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন তিনি দেশে গিয়ে বলবেন। তাঁর তো আর বলা হলো না সে কথা। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে অনেক কিছু দিতে চেয়েছেন। আমি নিইনি। আমি যেন পাই, তিনি চেয়েছিলেন নিজে থেকে। তার চেয়ে বড় পুরস্কার আমার জীবনের আর কী? আপনি তো জানেনই আমি কেমন মানুষ। আমি যা করি ভালোবেসেই করি। আর যদি কোনো কিছু পছন্দ না হয়, তাহলে আস্তে করে সরে যাই। আর যদি মনে হয় সরার জায়গা নেই, সরলে ভুল হবে তখনি আমি তার প্রতিবাদ করি। তবে সেটা কোনোভাবেই কারো অমঙ্গলের জন্য নয়। মঙ্গলের জন্য। আমরাও কোনোদিন আমাদের স্মৃতি থেকে হুমায়ূন আহমেদকে মুছতে পারবো। না। পিরবো না নিষাদ, নিনিতকে ভুলতে। আমাদের পারিবারিক জীবনের সাথে এই হুমায়ূন আহমেদের শেষ ১০টি মাস ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো। ৩ সপ্তাহের জন্য আপনারা যখন দেশে গিয়েছিলেন আমাদের সন্তানরা জিজ্ঞেস করে, বাবা তুমি হাসপাতালে যাচ্ছ না কেন? স্কুল থেকে এসে ছেলে মেয়েরা তাদের মাকে প্রশ্ন করেছে, মা তুমি বাসায় কেন? গত ১০ মাসে হাসপাতাল আর আমাদের জীবন কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এখনও আমি মাঝে মাঝে মনের অজান্তে তৈরি হই হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

অনেক কথা, অনেক স্মৃতির কথা মেহের আফরোজ শাওন আপনি উল্লেখ করেছেন। সত্যিই এটা আপনার মহত্ত্ব। তবে হুমায়ূন আহমেদের হাসপাতালের বিল কোনো অবস্থায় আছে তা একবারও উল্লেখ করেননি। ১৪ ডিসেম্বর বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার কোনো খরচ করতে হয়নি তাই হয়তো মনে করেছেন ওভাবেই বোধহয় সব শেষ হয়ে গেছে। না হয়নি। ২১ জুন থেকে ১৮ জুলাই। মৃত্যুর আগে বেলভ্যুতে শায়িত ২৮ দিন এবং শেষ ৪টি সার্জারির বেলভ্যু হাসপাতালের নতুন বিল এসেছে। সাথে যোগ হয়েছে জ্যামাইকা হাসপাতালের বিলও।

বেলভ্যু হাসপাতাল এবং জ্যামাইকা হাসপাতালের বিভিন্ন বিল মৃত্যুর ৬মাস পরেও আসছে। কয়েকটি আমি দেশে যাওয়ার আগে এডজাস্ট করে এসেছি। তিনি মারা গেছেন এই মর্মে চিঠি ও ডেথ সার্টিফিকেটও দিয়ে এসেছি। তারপরেও বিল আসছে। প্রতিটা বিল আলাদা আলাদা এডজাস্ট করতে হয়। এটাই হাসপাতালের নিয়ম। আপনার তো মনে আছে ২১ জুন-এর পর আর কোনো বিল এডজাস্ট করানো হয়নি। এখন সেগুলো করতে হচ্ছে। তবে কোনো পেমেন্ট আপনাদের করতে হবে না। সব কিছু মিটিয়ে ফেলতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। ভাববেন না, বিল এডজাস্ট করে আমি স্যারের ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করছি। স্যারের ভালোবাসার ঋণ কখনো শোধ করা যায় না, যাবেও না। নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে স্যারের জন্য ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ আমি আর কোনোদিন পাবো না। কিন্তু আমি জানি, আমার মনের ভিতর যে ভালোবাসার একটা বিরাট ফুলবাগান আছে, সেখানে তাঁর নিত্য আসা-যাওয়া। স্যার, আপনার জন্য বিশ্বজিতের সশ্রদ্ধ আদাব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *