হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু ও নিউইয়র্কের সংবাদ মাধ্যম
হুমায়ূন আহমেদ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ আমেরিকায় চিকিৎসা নিতে আসার পর থেকেই তাঁর ভক্তবৃন্দ এবং দেশবাসী ছিলো উদ্বিগ্ন। ১৫ সেপ্টেম্বর মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং (MSKCC) হাসপাতালে চিকিৎসার প্রথমদিন থেকেই নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিকগুলো হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার খবর গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। কেমোথেরাপি শেষ হওয়ার পর এবং হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা ছাড়াও তাঁর লেখালেখি, জন্মদিন এবং ব্যক্তিগত ভ্রমণও গুরুত্বের সাথে নিউইয়র্কের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা, বাঙালি, বাংলা পত্রিকা, পরিচয়, এখন সময়, আজকাল, দেশবাংলা, বাংলা টাইমস, বাংলাদেশ, জন্মভূমি, বর্ণমালা, শ্যামল বাংলা, বিজয়সহ বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করে।
এছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলোর প্রতিনিধি ছাড়াও সংবাদ সংস্থা নিউজ ওয়ার্ল্ড, এনা, বাংলা নিউজ ২৪ ডটকমসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমই ছিলো বাংলাদেশও বহির্বিশ্বে হুমায়ূন আহমেদের খবর জানার উৎস। এসব খবর বিভিন্ন জনের বরাত দিয়ে প্রকাশ হতো।
প্রথম থেকেই পারিবারিকভাবে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা হতো না বা স্পষ্ট ছিলো না। তাছাড়া মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ভয়েস অব আমেরিকার সাথে সাক্ষাৎকারে মেহের আফরোজ শাওন বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ আগের চেয়ে ভালো আছেন এবং একটু ভালো হলেই বাসায় ফিরবেন। আবার সকাল সাড়ে ৯টায় মাজহারুল ইসলামের বরাত দিয়ে চ্যানেল আই সংবাদ প্রচার করে হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে উঠছেন। এ ঘটনার ২ ঘণ্টার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়। এরকম নানা ঘটনা ঘটে হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকায় চিকিৎসা নিতে আসার পর থেকে। তবে ২০ জুন তাঁর চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার পর ২১ জুন সকালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে সকল সংবাদ মাধ্যমের সাথে পরিবারের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হয়। এমন কী হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর ফিউনারেল হোম ও ওজোনপার্কের বাসায় কর্তব্যরত সাংবাদিকদের সাথে পরিবারের সদস্যদের বাদানুবাদও হয়। অবশ্য এর আগেই দৈনিক ইত্তেফাঁক-এর বিশেষ সংবাদদাতা শহীদুল ইসলাম এবং সাপ্তাহিক ঠিকানায় হুমায়ূন আহমেদ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অথচ হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার খবরটি যদি কয়েক সপ্তাহ পরপর বা শেষদিনগুলোতে ২ দিন পরপর পারিবারিকভাবে সাংবাদিকদের জানানো হতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন পরিস্থিতি হতো না।
চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে ক্ষতস্থানে লিকেজ
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাঙালি পত্রিকায় গত ২৮ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: জনপ্রিয় কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদ মরণব্যাধি ক্যান্সার থেকে বাঁচতে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে এসেছিলেন। কিন্তু শেষমেষ ক্যান্সারে নয়, তিনি মারা গেলেন ব্লাড ইনফেকশনে। মৃত্যু সনদে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ তথ্যই উল্লেখ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাই জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরে গণমাধ্যমকেও বলেছেন যে ক্যান্সারে নয়, তার ভাই মারা গেছেন ভাইরাল সংক্রমণে।
এদিকে নিউইয়র্কের বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাঙালী’ পরবর্তী শনিবারের সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংক্রান্ত কারণ উল্লেখ করে এক্সকুসিভ প্রতিবেদন ছেপেছে। সেখানে বেলভ্যু হাসপাতালের চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, প্রথম দফা কোলনে সার্জারি এবং লোকালাইজড অ্যাম্বুলাইজেশনের মাধ্যমে লিভারের মধ্যে থাকা ক্যান্সারের সেলগুলো ধ্বংস করার পর হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সার থেকে নিরাময় লাভ করেন। কিন্তু ২০ জুন চেয়ার থেকে পড়ে গেলে তার সার্জারির ক্ষতস্থান ব্লাড লিকেজ হয় এবং তা লাংগ ও লিভারে ছড়িয়ে পড়ে। এরসঙ্গে কলোসটমির বর্জ্যও নির্গত করে। ফলে ইনফেকশন প্রকট হয়ে ওঠে। ইনফেকটেড ব্লাডের ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠলে হুমায়ূন আহমেদকে সিডেটিভ (ঘুমের ওষুধ) দেওয়া হয়। এছাড়া ইনফেকশন কমানোর জন্য ক্রমাগত অ্যান্টিবায়োটিকস পরিবর্তন করে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। এই অবস্থায় তার ব্লাড প্রেশার নেমে আসে। ব্লাড প্রেশারকে কার্যকর অবস্থায় রাখার জন্যও মেডিকেশন দেওয়া হয়। অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় ভেন্টিলেটর লাগিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কৃত্রিম পদ্ধতিতে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে হার্ট রেট, ব্লাড প্রেশার, অক্সিজেন লেভেল ও রেসপিরেটরি রেট ব্যালেন্স করার চেষ্টা চালানো হয়। পাশাপাশি চেষ্টা চালানো হয় লাঙ্গস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড রিমুভ করার। অনেক ক্ষেত্রে এর ফলে রোগী স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। ক্যান্সার চিকিৎসায় তিনি আরোগ্য লাভ করলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে তার চিকিৎসা হয় ইনফেকশন রোগের। যেসব রোগীর ব্লাডের মাধ্যমে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে তাদের লো প্রেশার দেখা দেয় এবং ব্লাড সার্কুলেশন। বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকলে ব্লাড ইনফেকশন হওয়ার প্রচণ্ড আশঙ্কা থাকে। হুমায়ূন আহমেদেরই শিকার হয়েছেন। পত্রিকাটি আরো উল্লেখ করেছে, ২৯ জুন থেকে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় হুমায়ূন আহমেদকে। বেশীদিন এ অবস্থায় রাখলে কোমায় চলে যেতেন তিনি। কিন্তু তার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিসমতুল্য এই লেখক।
হুমায়ূন আহমেদের মুত্যু রহস্য উদঘাটন
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় গত ৬ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বহুল আলোচিত মুত্যু নিয়ে রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। কোটি মানুষের প্রিয় এই লেখকের অকাল মৃত্যু কেন?
কী সমস্যা হয়েছিলো। এসব নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল ও বিতর্কের প্রেক্ষিতে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার পক্ষ থেকে ব্যাপক অনুসন্ধানের পর প্রাপ্ত গত ৩ আগস্ট জর্জ মিলার স্বাক্ষরিত ডেথ রিপোর্ট নিয়ে বাংলা পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। যাতে বেরিয়ে এসেছে অজানা সব তথ্য। রিপোর্টে বলা হয়, কোলন অপারেশনের সংযোগস্থলের জোড়ায় ছিদ্র, সেখান থেকে বর্জ্য কনিকা নিঃস্বরণ এবং সংক্রমণই হুমায়ূন আহমেদের শোকবহ মুত্যুর কারণ। তবে এই ছিদ্র হওয়ার কারণ সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট কিছু বলতে পারেনি। এ বিষয়ে নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকডেল ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. মুজিব উর রহমান মজুমদারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেলভু হাসপাতালে অপারেশন সফল হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। সেখানে ৭দিন। অবস্থান করেছেন ড. হুমায়ূন আহমেদ। এরপর তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন নিজেই হেঁটে। কিন্তু বাড়িতে আসার একদিনের মাথায় এত জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন সেটা আমাদের জানা নেই। এটা ড. হুমায়ূন আহমেদের সহচর বা পরিজনরাই বলতে পারবে। ৭ দিন হাসপাতালে পর্যবেক্ষনে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু বাড়িতে আসার পর তার ইনফেকশন বা সংক্রমণ কিছুটা অস্বাভাবিক। উল্লেখ্য এলমহার্স্ট হাসপাতালের এনেসথেসিয়োলজিস্ট ডা. মাসুদুর রহমান ডেথ রিপোর্টটি সম্পর্কে বাংলা পত্রিকাকে বিশেষ সহযোগিতা করেন। হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ ধীরে ধীরে কীভাবে মুত্যুর দিকে এগিয়ে গেলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে রিপোর্টে। ডেথ রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন, বিশিষ্ট অনকোলজিস্ট ডা. জি লরেন বাউরেল জর্জ মিলার। রিপোর্টে বলা হয়েছে, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের। তার ওপর তার কোলন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছিলো লিভারে। বেলভ্যু হাসপাতালে ১২ জুন কোলন অপারেশনের পর ১৯ জুন সকালে তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয়। ২১ জুন আবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কোলনের অপারেশনস্থলের কাছে ফুটো হয়ে যাওয়া (এনাস্টমিক লিক) সংক্রান্ত জটিলতাই ছিলো এর কারণ। এর ফলে ছিদ্রস্থান দিয়ে নিঃসরণ হচ্ছিল মল। এজন্য এটা বন্ধের চেষ্টায় তার। অপারেশন স্থল খুলে আরেকটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। এই অস্ত্রোপচারের সময় তাকে এনেসথেশিয়া সহ সবকিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু পেটের সেলাই খোলার পরই সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসে মল সহ বিভিন্ন বর্জ। যা নিঃসরণ হচ্ছিল অপারেশনের জোড়ার পাশ দিয়ে। এ সময় তার সেলাইয়ের জায়গায় একটি বড় আকারের গর্তও ধরা পড়ে। যার দুই পাশ দিয়েই বেরিয়ে আসছিলো ময়লা। অপারেশনের পরপর রোগীর রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিকভাবে। এই অবস্থায় তাকে স্থানান্তর করা হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। এ সময় তাকে সংযুক্ত করা হয় কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রের সাথে। জুলাই মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও রক্তের শ্বেত কনিকা কমতে থাকে। অল্প হলেও যন্ত্র ছাড়াই তিনি কিছুটা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছিলেন।
কিন্তু এদিন সকালে হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক বমি শুরু হয় ড. হুমায়ূনের। এটা ছিলো পিত্তবমি। বমির প্রচণ্ডতায় এর কিছুটা চলে যায় তাঁর ফুসফুসে। এই অবস্থায় অবনতি শুরু হয় শ্বাসপ্রশ্বাসের। সংক্রমণ ও শারীরিক অবস্থাকে গতিশীল রাখতে এই অবস্থায়ও তাকে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন এন্টিবায়েটিক সহ বিভিন্ন ধরনের ঔষধ দেওয়া হচ্ছিল। ফুসফুসের সংক্রমন কমাতে ও প্রস্রাব বৃদ্ধির বিশেষ ঔষধ দেওয়ার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়। ৩ জুলাই। ড. হুমায়ূন আহমেদের হৃদকম্পনের মাত্রা আবারো অস্বভাবিক হতে থাকে। এই অবস্থায় আশংকার কারণে তার শ্বাসনালীতে দেওয়া হয় অক্সিজেন টিউব। এর আগে ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ার কারণে পিজটেইল ক্যাথেটার দিয়ে বুকের ডানদিক থেকে বের করে আনা হয় ফুসফুসের পানি। ৪ জুলাই ড. হুমায়ূন আহমেদের শরীরে নতুন উপসর্গ দেখা দেয়। এসময় তার প্রস্রাবের মাত্রা একেবারেই কমতে থাকে। প্রতি ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০ সিসির জায়গায় তখন এর মাত্রা ছিলো মাত্র ১.৭ ফোঁটা মাত্র। এছাড়া মলদ্বারের পেছনেও এক ধরনের সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যায়। এই অবস্থায় কিডনি ডায়ালিসিস করা হয় তার। ৬ জুলাই। অবস্থার আরো অবনতি হয়। এদিন কলোনের সেলাই খুলে যায়। এস্থান দিয়ে বেরিয়ে আসে বজ্য। এই অবস্থায় এটাকে ধৌত করে পরিছন্ন করার উদ্যেগ নেওয়া হয়। ৯ জুলাই তার আহত অপারেশনস্থলকে জোড়া লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৩ জুলাই মুখের পাইপ খুলে গলা দিয়ে অস্কিজেন নল ঢুকানো হয়। হাসপাতালে অবস্থানকালে ড. হুমায়ন আহমেদকে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন, ক্যাথেটার্স করতে হয়। এ সময় রক্ত চাপ এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহকে সচল রাখতে সর্বোচ্চ মাত্রায় একাধিক এন্টিবায়োটিক যেমন ভ্যানকোমাইচিন, ফ্লাজিল, পিপ্রোফ্লোক্সাসিন, পলিমিক্সিন বি, ইমিপিনেম, ক্যাপসো ফিউজিন, ফ্লোকোনাজল ধরনের ঔষধ দেওয়া হয়। ১৯ জুলাই। দুপুল ১টা ১৫ মিনিটের দিকে মুত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন হুমায়ূন আহমেদ। ১.২২ মিনিটে তিনি প্রকৃতই মুত্যর কোলে ঢলে পড়েন। এ সময় তার শরীরের কোন অংশই আর কাজ করছিলো না। হৃদযন্ত্র, ব্লাডপ্রেশার সচল রাখতে সর্বোচ্চ মাত্রার ওষুধ এর সাথে ১০০% অক্সিজেন দেওয়ার পরও সেটা নিতে সক্ষম ছিলেন না তিনি। এই অবস্থায় শেষ হয়ে যায় প্রচেষ্টা। ঘোষণা করা হয় তিনি আর নেই। ডেথ রিপোর্টে মুত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সেপসিস ব্যাকটেরিয়া। যা শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছিলো। রিপোর্টে বলা হয়, দ্বিত্বীয় অপারেশনের আগে আমরা রোগীকে সব ধরনের ঝুঁকির কথা অবহিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছিলো অপারেশনের কারণে রক্তক্ষরন, সংক্রমণ, মুত্যু এমনকি স্থায়ী নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হতে পারে। এসব জেনেও তখন ড. হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসায় সম্মতি দান করেন। রিপোর্টে এর আগে জ্যামাইকা হাসপাতালে ভর্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ২১ জুন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী জানান যে,পায়খানা বন্ধ, অনিদ্রা এবং ১০০ ডিগ্রির উপর জ্বরের কারণে হুমায়ূন আহমেদ সারারাত ঘুমুতে পারেননি। এর কারণ জানতেই ইমার্জেন্সিতে এসেছেন তারা। উল্লেখ্য যে, ১২ জুন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম অস্ত্রোপচার হয় নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে। ১৯ জুন তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে সব পরীক্ষা নিরীক্ষাতেই কোনো সমস্যা নেই বলে চিকিৎসকরা অভিমত দেন। তার অপারেশনকে সফল বলেও মন্তব্য করেছিলেন চিকিৎসক জর্জ মিলার। উল্লেখ্য, ২০জুন তিনি বাড়িতে চেয়ার থেকে পড়ে যান বলে জানা যায়। কীভাবে বা কী কারণে তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন সেটা এখনো অস্পষ্ট। এর পরই শুরু হয় সব ধরনের জটিলতা। ২১ জুন হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু ফানসু মন্ডলের গাড়িতে করে তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে নেওয়ার পথে পেটের ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠে। অবস্থার অবনতি হলে এ্যাম্বুলেন্স ডেকে নেওয়া হয় স্থানীয় জ্যামাইকা হাসপাতালে। এ সময় তার সাথে ছিলেন, অন্য প্রকাশ এর প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম। খবর শুনেই সেখানে উপস্থিত হন, নিউইয়র্ক মুক্তধারার প্রধান বিশ্বজিত সাহা, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু। বিকেল ৫.৩০ মিনিট পর্যন্ত সিটিস্ক্যান ছাড়া সেখানে কিছুই করা হয়নি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বিকেলে ড. হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন আসেন সেখানে। এরপরই তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য তিনি নিউইয়র্ক আসেন। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বিখ্যাত শ্লোন ক্যাটারিংয়ে ডা. ভিচের মাধ্যমে শুরু হয় তার চিকিৎসা। ১৪ ডিসেম্বর বেলভ্যু হাসপাতালের ডা. জেইনের মাধ্যমে শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের কেমোথেরাপি। মোট ১২টি কিমো নেওয়ার পর ডা. মিলারের নেতৃত্বে গঠিত একটি টীম তাকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১২জুন প্রথম কোন অপারেশনের পর ১৯ জুন তিনি ছাড়া পান হাসপাতাল থেকে।
চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার তথ্য জ্যামাইকা হাসপাতালে থাকলেও বেল্যুতে বলা হয়নি
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকার ১৩ আগস্ট ২০১২ সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘হারিয়ে যাওয়া নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মুত্যু নিয়ে লুকোচুরির আরো অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। হুমায়ূন আহমেদের পড়ে যাওয়া নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্যের অসঙ্গতি পুরো বিষয়টিকে বিভ্রান্তিকর করে তুলছে। হুমায়ূন আহমেদের পড়ে যাওয়ার বিষয়টি বেমালুম উপেক্ষা করেছেন, তার সাথে ঘনিষ্ঠজনেরা। বক্তব্য বিবৃতিতে তারা বলেছেন, তিনি পড়ে যাননি। চেয়ার হেলে গিয়েছিলো ইত্যাদি। কিন্তু হাসপাতালের দেওয়া রেকর্ডে এখন বেরিয়ে এসেছে আসল তথ্য। যেখানে তারা নিজেরাই পড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকাতে অবস্থিত কুইন্স হাসপাতালের দেওয়া রেকর্ডে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের সাথী মাজহারুল ইসলামের দেওয়া তথ্যে তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। জ্যামাইকা হাসাপাতালের চিকিৎসক আলফ্রেডো অং স্বাক্ষরিত রেকর্ডে বলা হয়েছে, ২১ জুলাই সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য আনা হয় হুমায়ূন আহমেদকে। এ সময় পরিবার থেকে জানানো হয় যে, ফ্যামেলি স্টেইটস দ্যাট, প্যাসেন্ট হ্যাড এ ফল ফ্রম চেয়ার ইয়েস্টারডে’ গতকাল রোগী চেয়ার থেকে পড়ে যান। বিশ্বস্থ সূত্রের মতে, ২০ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে যান। এ সময় পড়ে যাওয়ার ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠেন তিনি। এরপর থেকে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এদিন বিকেল ৫টার দিকে মেহের আফরোজ মুক্তধারার প্রধান বিশ্বজিত সাহার কাছে ফোন করে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসকের ফোন নম্বর জানতে চান। অর্থাৎ তার কাছে চিকিৎসকের জরুরি নম্বরটিও ছিলো না। শাওন বিশ্বজিত সাহার কাছে নম্বর চাইলেও পড়ে যাওয়ার ঘটনা চেপে যান। পরদিন পৌনে ৯টার দিকে অবস্থা বেগতিক দেখে একটি প্রাইভেট কারে করে। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দেন মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল। পথিমধ্যে প্রচণ্ড বমি এবং অবস্থার আরো অবনতি হলে ডাকা হয় এ্যাম্বুলেন্স। জ্যামাইকা হাসপাতালের রেকর্ড অনুয়ায়ী ২১ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জ্যামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয় অসুস্থ হুমায়ূন আহমেদকে। এ সময় সেখানে মাজহারুল ইসলাম ও ফানসু মন্ডল ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। বিকেল ৪ টার দিকে শাওন হাসপাতালে যান। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে নিতে মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা ৭০০ ডলারে একটি প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। বেলভ্যু হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ী রাত ৯/২৮ মিনিটে ড. হুমায়ূন আহমেদ ভর্তি হন। বেলভ্যু হাসপাতালে নেওয়ার পথে এ্যাম্বুলেন্সে হুমায়ূন আহমেদের সাথে মাজহারুল ইসলাম ও শাওন ছাড়া অন্য কেউ ছিলেন না। কারণ এ্যাম্বুলেন্সে ২ জনের বেশি নেওয়া যায় না। বেলভ্যু হাসপাতালের রিপোর্টে দেখা যায় সেখানে রোগীর অবস্থা বর্ণনা করেছেন শাওন নিজে। যেখানে তিনি বলেছেন, প্রচণ্ড পেট ব্যথার কারণে রোগীকে জ্যামাইকা হাসাপতালে নেওয়া হয়। এছাড়াও রোগীর দাহ্য বন্ধ, সারারাত ঘুমাতে না পারা এবং ১০০ ডিগ্রি জ্বরের কারণও তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মেহের আফরোজ শাওন সেখানে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন নাই অথচ জ্যামাইকা হাসপাতালে প্রথম নিয়ে যাওয়ার পর চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার। বিষয়টি অবহিত করেন মাজহারুল ইসলাম। বাংলাদেশেও তারা এবিষয়টি খোলাসা করে বলেননি কাউকে। হুমায়ূন আহমেদের পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি এ পর্যন্ত মেহের আফরোজ শাওনের শুভাকাঙ্ক্ষীদের লেখাতেও গোপন করার বিষয়টি দৃশ্যমান। অতি সম্প্রতি একজন লেখিকা তার লেখাতে সব কিছু বিস্তারিত উল্লেখ করলেও সুচতুরভাবে হুমায়ূন আহমেদের পড়ে যাওয়ার বিষয়টি অজ্ঞাত রেখেছেন। পরবর্তীতে চেয়ার কাত হয়ে যাওয়া, পড়ে যাওয়ার সময় ধরে ফেলা বা বেলভ্যুতে নিজে ডাক্তারের কাছে বলা জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের মুত্যু নিয়ে যখন দেশে বিদেশে হাজার কৌতূহল তখন ঘনিষ্ঠজনদের অসঙ্গত বক্তব্য বিবৃতি দিনে দিনে সন্দেহ সংশয়ের ডালাপালাকে আরো বিস্তৃত করছে।
অবহেলায় মৃত্যু–দায়ী কারা!
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানার ২৭ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশ, নিউইয়র্কসহ উত্তর আমেরিকায় নানা প্রশ্নে জন্ম দিয়েছে। এই সব প্রশ্নের জন্মই দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে হুমায়ূন আহমেদ কী শুধু অর্থাভাবের কারণে মেমোরিয়াল স্লোয়েন ক্যাটারিং এ ভর্তি করা হয়নি?
কেন তাঁকে বেল্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিশ্ববিখ্যাত হাসপাতাল কার নিদের্শে ত্যাগ করা হলো? সেখানে কেমোথোরপি নেওয়া হলো সেখানে কেন অপারেশন করা হলো না? অর্থ সংকটের কথা কেন আগে জানানো হলো না। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু এবং অন্যান্য খরচ নিয়ে শাওন এবং মাজহারুল ইসলাম কেন মিথ্যার আশ্রয় নিলেন? কী তাদের স্বার্থ? সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসার পর হুমায়ূন আহমেদকে কেন প্লাস্টিকের চেয়ারে বসানো হলেছিলো? সেই চেয়ার থেকে তিনি কীভাবে পড়ে গেলেন, প্রচণ্ড আঘাত ফেলেন, সেলাই খুলে গেল এবং ইনফেকশন হলো? কার অবহেলা, উদাসীনতা ছিলো? চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার একদিন পর কেন তাকে জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়া হলো? চেয়ার থেকে পড়ার সাথে সাথেই তো প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন? কেন তাকে সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া হলো না? তিনি চেয়োর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন ২০ জুলাই কিন্তু তাকে জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়া হয় ২১ জুলাই। কিন্তু কেন? জ্যামাইকা হাসপাতালেই বা শাওন গেলেন না কেন? কী কারণে? মাজহার কেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গেলেন? অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যুতে নেওয়া হয়। হুমায়ূন আহমেদের চেয়ার থেকে পড়ার বিষয়টিও শাওন-মাজহার কেন লুকানোর চেষ্টা করেছেন? মিডিয়ায় যেভাবে ঘটনাকে লুকিয়েছেন শাওন ও মাজহারুল ঠিক একই স্ট্যাইলে বাসায় চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার কথাও ডাক্তারের কাছে লুকানো হয়েছে। ডাক্তার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ক্যান্সারে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়নি। তাহলে কীভাবে মৃত্যু হলো হুমায়ূন। আহমেদের? চারিদিকে এ সব প্রশ্ন মানুষের মুখেমুখে কিন্তু কোনো উত্তর নেই। অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন হুমায়ূনের মৃত্যু রহস্য বের করতে হলে এ সব প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করতে হবে। এদিকে ৭ জুলাই, মঙ্গলবার। ১৮ জুলাই ঠিকানা প্রকাশিত হবে। অফিসে পাঠকদের ফোন আসছিলো। তারা জানতে চাচ্ছিলো বাংলা সহিত্যের কিংবদন্তী, নন্দিত কথাসাহিত্যিক এবং জনপ্রিয় নাট্যকার, দুই বাংলার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা কী? ঠিকানা অফিস থেকে বার বার ফোন করা হচ্ছিলো হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। তিনি ফোনের কোন উত্তর দেননি। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর নিয়ে ঠিকানা রিপোর্ট প্রকাশ করে হুমায়ূন আহমেদকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হুমায়ূন আহমেদ। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর টনক লড়ে হুমায়ূন আহমেদের শয্যাপাশে যারা ছিলেন তাদের দুই জন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রীর মেহের আফরোজ শাওন এবং প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। ঠিকানার এ রিপোর্টকে ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর সংবাদ বলে ঢাকার শীর্ষ সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় তারা বিবৃতি প্রদান করেন। সেই বিবৃতিতে তারা বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে, তবে সংকট এখনো কাটেনি। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে যে তাকে রাখা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল। ঠিকানার রিপোর্টই সত্যি হলো।
১৮ জুলাই ঠিকানা প্রকাশিত হলো ১৯ জুলাই নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১টা ২২ মিনিটে বরেণ্য সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ম্যানহাটানের বেলভ্যু হাসপাতালের ১০তলার ৪৩ নম্বর বেডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কুতুবপুরে তার জন্ম হলেও ২০১২ সালের ১৯ জুলাই আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার শয্যা পাশে ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছোট ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, তার স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক, হুমায়ূন আহমেদের শাশুড়ি তহুরা আলী এমপি, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. এ কে মোমেন, সেলিনা মোমেন, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদের বাল্যবন্ধু ফানসু মন্ডল। ড. মোমেন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছি তখন নিউইয়র্ক টাইম দুপুর ১২টা ১০ মিনিট। ভেন্টিলেশনে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ব্যথায় প্রচণ্ড কোঁকাচ্ছিলেন। ডা. মিলার ব্যথা কমানোর জন্য কড়া ডোজের ওষুধ দিয়েছেন কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। ডাক্তারকে খুব চিন্তিত দেখা গেল। বার বার দেহের রক্তচাপ পরীক্ষা করছিলেন। চোখ রাখছিলেন মনিটরের উপর। ডাক্তার বললেন, রক্তচাপ ১২০/৭০ এর উপরে রাখাই হলো আসল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি রক্তচাপ দ্রুত নেমে যাচ্ছে। ৬০ থেকে ৫০, ৫০ থেকে ৪০, ৪০ থেকে ৩০ এক সময় দেখলাম মনিটরের রক্তচাপের রেখাঁটি লম্বা একটানা রেখায় পরিণত হলো। আমরা বুঝলাম সব শেষ, আমাদের প্রিয় লেখক দেশের গর্ব আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ড. মিলার বললেন, সরি। ডাক্তার মৃত্যুর সময় লিখেছিলেন ১টা ২২ মিনিট। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মেহের আফরোজ শাওন। বলতে লাগলেন, “তুমি যেও না। দুটো ছেলেকে তুমি কার কাছে রেখে যাচ্ছ। কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ। মানুষকে স্বপ্ন দেখানো মানুষ নিজেই চলে গেলেন স্বপ্নের জগতে। যেখান থেকে আর কোনো দিন ফিরে আসার কথা নয়। রকওয়ের যে বাসায় হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সেই বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেল হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই ড. জাফর ইকবালকে। বিষণ্ণ মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঠিকানার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওনার একটি হাত আমার হাতের মধ্যে ছিলো। তিনি ঘুমের মধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, কোনো কষ্ট করতে হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিনি পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন করে গেছেন। সারাজীবন দেশের মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। মানুষের জন্যই লিখেছেন। তিনি দেশবাসীসহ সকল প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে তার ভাই’র রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া চেয়েছেন। বাসার নম্বর ১১৫১১। ১১৫-১১৬ স্ট্রিটের মাঝখানে, ১১১ এভিনিউর উপর। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে জাফর ইকবাল, তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক, বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী এসআই টুটুল, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম, মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা, তার স্ত্রী রুমা সাহা, নাট্য অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেন, রওশন আরা হোসেনসহ আরো অনেকেই। ড. জাফর ইকবালকে ধরে অঝোরধারায় ছোট বাচ্চার মতো কান্নকাটি শুরু করে দিলেন শিল্পী এসআই টুটুল। বলতে লাগলেন- আমাদের দেখার আর কেউ রইলো না, আমরা এতিম হয়ে গেলাম। টুটুলের চোখের পাখি দেখে জাফর ইকবাল নিজেই কেঁদে উঠলেন কী সান্ত্বনা দিবেন টুটুলকে। অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলেন আর দোয়া করতে বললেন। বাসার লিভিংরুমে অনেকেই বসা। উপর থেকে বন্ধ দরজা ভেদ করে শাওনের কান্না এবং বিলাপের শব্দ আসছে। উপস্থিত সবাই তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। কান্নার মধ্যে সে বলতে লাগলো আমি এখন কী করবো? দেশের কোটি কোটি মানুষ দোয়া করলেন, কিন্তু কিছুই কাজে আসলো না? মা তহুরা আলী এমপি মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। প্রকাশক মাজহারুল ইসলামকে দেখা গেল ড. জাফর ইকবালকে ধরে অশ্রুহীন কান্না করতে। মুখ দিয়ে শব্দ হচ্ছে চোখে কোনো পানি নেই। তাও আবার কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী।
হুমায়ূন আহমেদের দুই শিশু পুত্র নিষাদ এবং নিনিত। বাবার লাশ বাড়ি থেকে কয়েক ব্লক দূরে একটি ইসলামিক ফিউনারেলে, মা উপরে কাঁদছে, বাসায় শোকার্ত মানুষ। নিষাদ এবং নিনিত অন্য মানুষের কোলে থাকলেও তাদের চোখ যেন প্রিয় কাউকে খুঁজছে, যখনই সুযোগ পাচ্ছে তখনই এক রুম থেকে। অন্য রুমে ছুটে যাচ্ছে। চোখ কাউকে খুঁজলেও বুঝতে পারেছে না তারা কী হারিয়েছে। নিষাদ জানে বাবা হাসপাতালে কিন্তু নিনিত! সে তো জানে না। ফ্যালফ্যাল করে মানুষের দিকে তাকাচ্ছে। একজনের কোল থেকে আরেক জনের কোলে যাচ্ছে নিষাদ এবং নিনিত ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস আসল কোলটিই যে তারা হারালো সে কথাটি তারা জানে না। নিষাদ হয়তো দেশে গিয়ে জানবে তার বাবার মৃত্যুর খবর কিন্তু নিনিত কী কখনো বাবার স্মৃতিকে মনে রাখতে পারবে? মানুষের পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ গাছ এবং প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসতেন। নিজ হাতে নুহাশ পল্লীতে যেভাবে গাছ লাগিয়েছেন রকওয়ের অস্থায়ী বাড়ির আঙ্গিনাতেও নিজ হাতে লাউ এবং শিমের গাছ লাগিয়েছিলেন। গাছগুলো এখন অনেক বড় হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত ফল দেবে কিন্তু খেয়ে যেত পারলেন না হুমায়ূন আহমেদ। মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ার পর সবার প্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে আমেরিকায় এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। প্রথমে তার চিকিৎসা দেওয়া হয় ক্যান্সারে নিউইয়র্কের বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিংয়ে। দুই পর্বে সেই হাসপাতালে মোট ৫টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। ভালো ছিলেন মোটামুটি। ১১ মে দেশে গিয়ে ২০ দিন সবার সাথে দেখা করে এবং নুহাশ পল্লীতে সময় কাটিয়ে এসেছেন। শ্লোয়েন কেটারিং হলো ক্যান্সারের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। পরবর্তীতে তাকে ভর্তি করানো হয় বেলভ্যু হাসপাতালে। তাঁর পরিবারের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও এর কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। একজন জানালেন, অর্থ সাশ্রয়ের জন্য নাকি তাকে স্লোয়েন ক্যাটারিংয়ে না ভর্তি করিয়ে বেলভ্যুতে ভর্তি করা হয়েছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা বললেন, আমি জানি না, নিশ্চয় পরিবারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমি জানি ক্যান্সারের জন্য শ্লোয়েন কেটারিংই বিখ্যাত। কেন হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যুতে ভর্তি করা হয়েছে। এমন প্রশ্ন অনেকের। কে বা কারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হুমায়ূন আহমদের কী এতই অর্থকষ্ট ছিলো? আর থাকলে সেই কথাটি মানুষ কেন জানতে পারলো না? কারা এর জন্য দায়ী? হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা নিয়ে এত বড় অবহেলাই বা কেন হলো– এমন প্রশ্নও অনেকের? মানুষ জানলে হয়তো তাদের প্রিয় মানুষের জন্য হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেন। অবহেলার শিকার হতে হতো না হুমায়ূন আহমেদকে। অনেকের অভিযোগ অবহেলাই হুমায়ূন আহমেদকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে। ১২ জুন বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের সফল অস্ত্রোপচার হলো। তিনি সুস্থ হয়ে ১৯ জুন তার বাসায় ফিরে গেলেন। সবাই আনন্দিত। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী ছিলো না। দুই দিনের মাথায় তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, বাসায় আসার পর হুমায়ূন আহমেদকে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসানো হয়েছিলো। সেই চেয়ার থেকেই তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন। যার কারণেই ইনফেকশনের জন্ম। কিন্তু কীভাবে পড়লেন তা নিয়ে এখনো নানা জনের নানা প্রশ্ন। তাকে কি কেউ দেখার ছিলেন না? এখানেও কি তিনি চরম অবহেলার শিকার হয়েছেন? এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে। ২০ জুলাই পড়ে যাওয়ার পর রাতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হলে তাকে এ্যাম্বুলেন্স যোগে জ্যামাইকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১২ ঘণ্টা থাকার পর তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর তার শরীরে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করা হয়। সেখান থেকেই তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন, তার শরীরের নার্ভগুলো কয়েকদিন থেকেই কাজ করছিলো না, তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। ডা. মিলার তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা, হৃদযন্ত্রের বৈকল্য এবং কিডনির ক্রমব্যর্থতার কারণে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। ক্যান্সারে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়নি। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশের ন্যায় প্রবাসেও শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই ছুটে যান বেলভ্যু হাসপাতালে কিন্তু নাম থাকায় ঢুকতে পারেননি। হাসপাতালে লিস্টে ১০ জনের নাম দেওয়া হয়েছে। এ ১০ জন ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারেননি। যারা গিয়েছেন তারা। হাসপাতালের সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ফিরে গিয়েছেন। কেউ কেউ আবার হুমায়ূন আহমেদের বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন। তবে তাদের প্রিয় লেখককে শেষবারের মতো দেখার জন্য সবাই জ্যামাইকা বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টারে ছুটে গিয়েছিলেন। কারণ হুমায়ূন আহমেদের নামাজে জানাজা গত ২০ জুলাই জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। রকওয়ের মুসলিম ফিউনারেল থেকে দুপুর সাড়ে ১১টায় হুমায়ূন আহমেদের লাশ নিয়ে আসা হয়েছিলো জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে। জুম্মার নামাজ শেষে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম মীর্জা আবু জাফর বেগ জানাজা পড়ান। জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাজায় অংশগ্রহণ করেন ওয়োশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাঁদের, স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে মোমেন, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কস্যুলেটের কন্সাল জেনারেল সাব্বির আহমেদ চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদের ভাই ড. জাফর ইকবাল, তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক, হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, তার মা তহুরা আলী এমপি, ঠিকানার প্রেসিডেন্ট ও সিওও সাঈদ- উর- রব, লেখক গাজী কাশেম।
জানাজায় অংশ না নিলেও, সার্বক্ষণিক মরদেহের পাশে ছিলেন মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিত সাহা, তার স্ত্রী রুমা সাহা। মরদেহ দেখতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন বিশ্বজিত সাহা। জানাজা শেষে এক নজর দেখার জন্য হুমায়ূন আহমেদের কফিন খুলে দেওয়া হলে হাজার হাজার মানুষ লাশ দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সেই সময় দেখা যায় চরম বিশৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে অনেকে লাশ না দেখেই চলে যান। আবার অনেক অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ধাক্কা খেয়ে লাশ দেখেছেন। এর মধ্যে অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টি। কিন্তু প্রিয় লেখককে শেষবারের মতো এক নজর দেখার জন্য বৃষ্টির মধ্যে ভিজেছেন। কয়েকঘণ্টা লাশ জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে ছিলো। সেখান থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় রকওয়ের সেই মুসলিম ফিউনারেলে।
হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে ইউটিউবে শাওনের তথ্য
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাঙালী’র ২৮ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় আসল পরিচয় গোপন রেখে স্বল্প আয়ের একজন অভিবাসী হসাবে নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। এর আগে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ক্যান্সার রোগ নরাময়ের বিশেষায়িত হাসপাতাল মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং সেন্টার ছেড়ে সরকারি বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসা বাবদ ওই হাসপাতালে অর্ধ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয় হলেও সরকারি চিকিৎসা (মেডিকেইড) সুবিধা নেওয়ায় লেখকের পরিবারকে একটি ডলারও পরিশোধ করতে হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ এসব তথ্য জানতেন কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ তথ্য গোপন করে চিকিৎসা সুবিধা নেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন এই লেখক এবং নিউইয়র্কে বসে একটি লেখায় তিনি তা প্রকাশও করেছিলেন। এমনকী জীবদ্দশায় তিনি জেনে গেছেন স্লোয়েন-কেটারিং সেন্টারে তার চিকিৎসায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার খরচ হয়েছে। অথচ বেলভ্যু হাসপাতালের হিসাব বিভাগে হুমায়ূন আহমেদের মেডিকেইড সুবিধা নেওয়ার তথ্য এখনো সংরক্ষিত আছে।
ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখায় বাংলাদেশিদের বিনামূল্যের চিকিৎসা সুবিধা নেওয়া কঠোর সমালোচনা করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছিলেন, বাঙালি ব্যবস্থায় আমি চিকিৎসা নেব, এই প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এই লেখক নিজের সমালোচনাকে পেছনে ফেলে বিনা খরচের চিকিৎসা নিয়েছেন নিউইয়র্কে।
যদিও অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম চিকিৎসার সব ব্যয় বহন করবেন। এমন আশ্বাস দিয়ে হুমায়ূন আহমেকে বলেছিলেন, চিকিৎসার অর্থ কীভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে তা দেখার দায়িত্ব আপনার নয়। টাকা কীভাবে জোগাড় হবে হুমায়ূন আহমেদ জানতে চাইলে মাজহারুল ইসলাম তাঁকে কথা দিয়েছিলেন যে কারও কাছ থেকে এক ডলার সাহায্য নেবেন না এবং এই মুহূর্তে তার হাতে ৫০ হাজার ডলার আছে।
এদিকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত নিউইয়র্কের বহুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বাঙালী তাদের শনিবারের সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি ‘এক্সকুসিভ’ প্রতিবেদন ছেপেছে। ওই প্রতিবেদনে বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন। আহমেদের চিকিৎসার রেকর্ড পর্যালোচনা করে নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। পরিচয় গোপন রাখার কারণেই হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য গোপন রাখা হতো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সাপ্তাহিক বাঙালী’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত প্রায় ১০ মাসের চিকিৎসায় মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে হুমায়ূন আহমেদকে মাত্র ৫টি কেমো দেওয়া হয়েছিলো। বাকি ৭টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয় বেলভ্যু হাসপাতালে। এখানেই গত ১২ জুন প্রথম অস্ত্রোপচার হয় হুমায়ূন আহমেদের। সফল অস্ত্রোপচার শেষে বাসায় ফিরে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে ভেতরে রক্তক্ষরণ হওয়ার প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর আবার বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আরো চারটি অস্ত্রোপচার এবং পরবর্তীতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। জনপ্রিয় এই লেখকের। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর আগে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার আগেই জমা দিতে হবে। এই অর্থ জমা না দিলে তার চিকিৎসা শুরু সম্ভব হবে না। হুমায়ূন আহমেদ তার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছেন, যা ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন। চ্যানেল আই’র কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর তাকে চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার ডলার দিতে চেয়েছিলেন, তাও সময়মত পাননি বলে উল্লেখ করেন তিনি। শেষপর্যন্ত লেখক পূরবী বসুর অঙ্গীকারে শ্লোয়েন-কেটারিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ হুমায়ূন আহমেদের শরীরে ৫টি কেমো দেন, যাতে প্রায় ৪০ হাজার ডলার ব্যয় হয়। অর্থের সংস্থান না হওয়ায় পরবর্তীতে বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় হুমায়ূন আহমেদকে। এমনকি গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামাইকার বাসায় হুমায়ূন আহমেদকে গিয়ে ১০ হাজার ডলার অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন। প্রয়োজনে আরো দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদই তখন বলেছিলেন যে তিনি নিজেই ২ কোটি টাকা খরচ করতে পারবেন। এর বেশি লাগলে তিনি জানাবেন।
এদিকে প্রথম সার্জারির পর ধারণ করা ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, মেহের আফরোজ শাওন বলছেন যে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার খরচ হয়েছে। বেলভ্যু হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে হুমায়ূন আহমেদকে রেখে ডাক্তারদের ওই পরিমাণ অর্থ দাবি করা এবং শাওন এজন্য কান্নাকাটি করেছেন বলেও ভিডিওতে দেখা গেছে। কিন্তু বেলভ্য হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী হুমায়ূন আহমেদ মেডিকেইড সুবিধার অনুকূলে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে উল্লেখ আছে। ইউটিউবে প্রচারিত ওই ভিডিওচিত্রে। শাওনের দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্নের উদ্রেগ রয়েছে। যদিও হুমায়ূন আহমেদ দুটি হাসপাতালেই অর্থ লেনদেনের কোনো অংশেই দৃশ্যমান ছিলেন না। কারণ দুটি হাসপাতালেই তখন তিনি ছিলেন অপারেশন থিয়েটারে। আর হুমায়ূন আহমেদ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করেছেন স্লোয়েনকেটারিং সেন্টারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার পর। ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার পরিশোধ করা হয়েছে সে তথ্য দুটি হাসপাতালের কোথাও সংরক্ষিত নেই। শ্লোয়েন-কেটারিং-এ ১ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হলে সেখানেই কেমো সম্পন্ন হতো হুমায়ূন আহমেদের।
‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ লেখায় হুমায়ূন আহমেদ যে তথ্য উল্লেখ করেছেন তাতে মেমোরিয়াল শ্লোয়েন-কেটারিং হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তিন লাখ টাকা, শরীরে কেমো দেওয়ার জন্য মেডিপোর্ট বসাতে ৮ লাখ টাকা এবং আটটি কেমোর জন্য ১ কোটি টাকা দেওয়ার কথা। পরবর্তীতে লেখক পূরবী বসুর মধ্যস্থতায় দুটি কেমোর খরচসহ হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসায় স্লোয়েন-কেটারিং কর্তৃপক্ষকে ৪০ হাজার ডলারের কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এরপরই হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নাকি কোনো মহল তাকে ব্যয় সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দেয়নি তা নিয়ে এখন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ হুমায়ূন আহমেদ নিজেই উল্লেখ করেছেন যে স্লোয়েন-কেটারিং সেন্টারে তার জন্য ১ কোটির বেশি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের দাবি
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাঙালি প্রতিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: জনপ্রিয় কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের মুত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবী উঠেছে। স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকালে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যালিফোর্ণিয়ার সাংবাদিক মনোয়ার হোসেইন পিয়াল এই দাবী জানিয়েছেন। তদন্ত কমিটি গঠনের দাবীতে প্রবাসীদের সোচ্চার করতে মনোয়ার হোসেইন পিয়াল লস এঞ্জেলেস থেকে নিউইয়র্ক আসেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার অপারেশন সম্পূর্ন সফল হয়েছিলো বলে দাবী করেছিলেন তার স্ত্রী শাওন ও প্রকাশক মাজহার। তারপর তাকে বাড়িতে নেওয়া হলো তড়িঘড়ি করে। একদিন পরেই তিনি চেয়ার উল্টে পড়ে যান। এখান থেকেই তার অবস্থার অবনতি ঘটে। আমরা জানতে চাই এ ধরনের একটি জটিল অপারেশনের রোগী যখন চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন তখন সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেলভূ হাসপাতালে না নিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর অবস্থার অবনতি হলে জ্যামাইকা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো কেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে প্রাইভেট কারে হুমায়ূন আহমেদের মত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নিলো কারা। এরপর গাড়ীতে অবস্থা খারাপ হলে তার জন্য ডাকা হলো এম্বুলেন্স। অথচ তিনি পড়ে যাওয়ার পরপরই এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিলে হয়তো সংক্রমণকে এড়ানো যেতো। কারণ ক্যান্সারে নয়, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়েছে সংক্রমণে। সাংবাদিক সম্মেলনে মনোয়ার হোসেইন পিয়াল বলেন, আমাদের অবস্থান কারো বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু সঠিক তথ্য জানার অধিকার সবার আছে। হুমায়ূন আহমেদ এমনিতেই মারা গেলেন, না কারো অবহেলা বা দুর্ঘটনার কারণে এক করুণ পরিণতিতে তাকে নিপতিত হতে হলো এ বিষয়েটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া ফিউনারেল হোমে কেন পড়েছিলো হুমায়ূন আহমেদের লাশ। তার লাশ দেখার মতো কি কেউ ছিলো না। এ বিষয়গুলোর সঠিক জবাবের স্বার্থে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিক সম্মেলনে আয়োজকদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের এবং সাপ্তাহিক আজকালের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক জাকারিয়া মাসুদ জিকো। বিজনেস ক্লাস টিকেটের জন্য একদিন পর হুমায়ুনের মরদেহ দেশে গেল সাপ্তাহিক ঠিকানার ২৭ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়: কথা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের লাশ সেই দিনই নিয়ে যাওয়া হবে কিন্তু প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ও মেহের আফরোজ শাওনের কারণে ২০ জুলাই লাশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি ছয়টি টিকেট চেয়েছেন বিজনেস ক্লাস। রাষ্ট্রদূত এবং স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোমেন তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা ৪টির বেশি টিকেট দিতে পারবো না। তিনি বলেন, প্রতিটি টিকেটের দাম পড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ডলার। মাজহারুল ইসলাম নিজেকে বলেছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের লোক। সুতারং তিনি যা বলবেন তাই হবে। ড. মোমেন বলেন, বিজনেস ক্লাসের টিকেট চাওয়ার কারণে ২০ জুলাই লাশ প্রেরণ করা গেল না, সিট পাওয়া যায়নি। ২১ জুলাই এমিরাটসের রাতের ফ্লাইটের টিকেট পাওয়া গেল। সেই অনুযায়ী ২১ জুলাই রাত ১১টা ২০ মিনিটে তারা লাশ নিয়ে চলে গেলেন। অন্য একজন বললেন, যেখানে তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে লাশ নিয়ে যাওয়া উচিত এবং দাফন করা উচিত, সেখানে মাজহারদের কাছে বড় হলো বিজনেস ক্লাসের টিকেট। মাজহারদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের লাশ বড় কথা নয় কীভাবে আরামে বাংলাদেশে যাওয়া যায় সেটাই বড় কথা। লাশের সাথে গিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের শাওন, দুই সন্তান নিষাদ হুমায়ূন, নিনিত হুমায়ূন, তহুরা আলী এমপি, সেঁজুতি এম আফরোজ ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম।
শাওন–মাজহার জানতেন হুমায়ূন মারা যাচ্ছেন!
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সপ্তাহিক ঠিকানার ৩ আগস্ট ২০১২ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়: ‘নন্দিত কথা সাহিত্যিক, বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট এবং কোটি পাঠকের হৃদয় জয় করা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য বেড়েই চলেছে। ১৯ জুলাই দুপুরে মারা যাওয়ার পর ৩১ জুলাই পর্যন্ত তার মৃত্যুর রহস্যের জট খোলেনি রবং তা আরো জটিল হয়ে উঠেছে। মৃত্যুকে নিয়ে নতুন করে আরো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বরেণ্য কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। এই দুজন একের পর এক মনগড়া তথ্য পরিবেশন করে জনমনে বিভ্রান্তি এবং ধুম্রজাল সৃষ্টি করছেন। এই দুজনের রহস্যজনক ভূমিকা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো। হুমায়ূন আহমেদ যখন ম্যানহাটানের বেলভ্যু হাসপাতালের ১০ তলার ৪৩ নম্বর বেডে (সাউথ) মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, ডাক্তারা বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, কৃত্রিমভাবে লেখককে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, ৯টি মেশিন দিয়ে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই সময় থেকেই মেহের আফরোজ শাওন এবং প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম একের পর এক মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে বিভ্রান্তির জন্ম দিয়ে গেছেন। তারা তখন থেকেই কেন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন তা নিয়েও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারা আসলে কোন স্বার্থে রক্ষা করার জন্য মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করছেন? তাদের আসল উদ্দেশ্য কী- তা নিয়ে দেশে-প্রবাসে নানা গুঞ্জন এবং ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শাওন এবং মাজরুল ইসলাম তা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ আর বাঁচবেন না, তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে, লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তাকে রাখা হয়েছে- এই সংবাদ ১৮ জুলাই ঠিকানায় প্রকাশিত হওয়ার পর ঐ দিনই ঠিকানার রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে মেহের আফরোজ শাওন এবং মাজহারুল ইসলামের স্টেটমেন্ট ঢাকার টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। যাতে তারা বলেন, যে হুমায়ূন আহমেদ। ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করছেন। অথচ সেই সময় সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছেন তার পরিণতি সম্পর্কে। ঠিকানার রিপোর্টকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করে নিজেরাই মিথুকে পরিণত হয়েছেন। এমন কি ১৯ জুলাই দুপুর ১টা ২২ মিনিটে যখন হুমায়ূন আহমেদ মারা যান ঐ দিন দুপুর ১২টার সময় ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষতকারে মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্ক বলেছেন, তিনি ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করছেন। হুমায়ূন আহমেদকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়টিও শাওন অস্বীকার করেন। যতদিন পর্যন্ত শাওন এবং মাজহারুল ইসলাম নিউইয়র্কে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত তারা মিডিয়াকে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেছেন এবং সঠিক তথ্য সব সময় আড়াল করে গেছেন। শাওন তো প্রবাসে মিডিয়াকে বলা যায় একেবারেই এড়িয়ে গেছেন। দেশে গিয়েও শাওন এবং মাজহারুল ইসলামের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন অব্যাহত রেখেছেন।
এখনো তারা সত্য বলছেন না এমন অভিযোগ লেখকের বাসায় বা সাথে যারা। ছিলেন তারা করছেন। তারা চাচ্ছেন শাওন এবং মাজহারুল ইসলামই সত্য বলুক এবং হুমায়ূন আহমেদের অবহেলা বা গাফিলতিতে মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করুক। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে ২৭ জুলাই ঠিকানা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলো ‘শাওন- মাজহারকে নিয়ে রহস্য, নুহাশ পল্লীতে হুমায়ুনের শেষ শয্যা, অবহেলায় মৃত্যু দায়ী কারা? এ রিপোর্টটি ঠিকানার পাশাপাশি একই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকেও গুরুত্বের সাথে পরিবেশিত হয়। এ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর সারা বাংলাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়, নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দেয়, মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়। এমন কি শাওন এবং মাজহারের ভূমিকা নিয়েও রহস্যময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মিডিয়ায় প্রশ্নের সম্মুখীন হন শাওন এবং মাজহারুল ইসলাম। ঠিকানায় প্রকাশিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেশে এবং প্রবাসে হুমায়ূন ভক্তরা জানতে পারে, সর্বোপরি সারা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে। তাদের প্রিয় লেখকের মৃত্যুতে কিছু রহস্য আছে। ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে বিষয়টি। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই শাওন এবং মাজহারুল ইসলাম মিডিয়ায় জবাবদিহি করতে বাধ্য হন। তবে তারা হুমায়ূনের মৃত্যু নিয়ে আগের মতোই সেখানে একই কৌশল মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। রিপোর্টে উল্লেখ ছিলো হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে পায়ে হেঁটে ১৯ জুন বাসায় আসার পর পারিবারিক পার্টিও দেওয়া হয়েছিলো। অবহেলার কারণে হুমায়ূন আহমেদ ২০ জুন একটি প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েই তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। সারা রাত ব্যাথায় এবং যন্ত্রণায় ছটফট করলেও হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। অবস্থা বেগতিক হলে তাঁকে ২১ জুন জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ তার অপারেশন করা হয়েছিলো বেলভ্যু হাসপাতালে। জ্যামাইকা হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের সাথে তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন যাননি। হুমায়ূনকে নিয়ে গিয়েছেন প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। ঠিকানার বরাত দিয়ে ঢাকায় এ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর মাজহারুল ইসলাম এবং শাওন প্রথমে চেয়ার থেকে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। পরে অবশ্য মাহজারুল ইসলাম বলেছিলেন চেয়ারের খুঁটি দেবে গিয়েছিলো। এখানেও মাজহারুল ইসলাম মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদকে যে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসানো হয়েছিলো সেই প্লাস্টিকের চেয়ার ছিলো তাদের বেড রুমে।
আমেরিকায় এমন কোনো মাটির বাসা নেই যেখানে চেয়ার দেবে যেতে পারে! আমেরিকার বাসাগুলোতে মাটির কোনো ফ্লোর নেই। হয় কাঠের ফ্লোর না হয় টাইলস দিয়ে বানানো। এই সব ফ্লোরে চেয়ার দাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কেন মিথ্যার আশ্রয় নিলেন মাজহারুল সেটা তিনিই ভাল বলতে পারেন বা কী লুকানোর চেষ্টা করছেন সেটাও তিনি জানেন। হাসপাতাল পরিবর্তনের ব্যাপারে মাজহারুল ইসলাম বলেছেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না, হাসপাতাল পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি ছিলো লেখকের পরিবারের। চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি শাওন অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, শাওন চেয়ার থেকে কখনো পড়ে যাননি বরং চেয়ার থেকে পিছলে যান। তিনি যখন পিছলে যান তখন আমি তার হাত মালিশ করছিলাম।
চিকিৎসকরাও অপারেশনের পর বলেছিলেন, তিনি যদি পড়ে যান তাতে কোনো ক্ষতি হবে না। একটি টিভি চ্যানেলকে এই হাস্যকর সাক্ষাৎকার দেন। মেহের আফরোজ শাওন। হুমায়ূন আহমেদ যে পড়ে যান এ কথা সত্যি। তার পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি দেখেছিলো কাজের মেয়ে। তিনি তার বাসার দ্বিতীয় তলায় দুটো খাটের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় লিভিং রুমে ছিলেন শাওন, সেঁজুতি, বাথরুমে ছিলেন মাহজারুল ইসলাম, কাজের মেয়ে শোভা ছিলো কিচেনে। হুমায়ূন আহমেদ পড়ে যাওয়ার শব্দে তারা সবাই দৌড়ে তার রুমে যান। তাকে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে যাওয়ার পর তাঁর শরীরের অবস্থা ছিলো ইংরেজি শব্দ ‘এল’-এর মতো। অপনারেশনের কারণে তিনি সোজা হতে পারছিলেন না। যে চেয়ার থেকে হুমায়ূন আহমেদ পড়ে গিয়েছিলেন সেই চেয়ারটি এখনো সযতনে একজন হুমায়ূন ভক্ত রেখে দিয়েছেন। যে মানুষটি অবহেলা, অযত্ন এবং গাফিলতির কারণে প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গেলেন, সেই ঘটনাকেই অস্বীকার করছেন শাওন। কিন্তু কেন? এর রহস্য কী? চেয়ার থেকে যদি পড়েই না যান তাহলে হুমায়ূন আহমেদকে তাড়াহুড়া করে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হলো কেন? সত্য লুকানোর জন্য হুমায়ূন আহমেদকে কি জ্যামাইকা হাসাপাতালে নেওয়া হলো? হুমায়ূন আহমেদের অপারেশন হয়েছিলো ম্যানহাটানের বেলভু হাসপাতালে। তার কোন অসুবিধা হলে তাকে বেলভ্যু হাসপাতালেই নেওয়ার কথা। তা না। করে জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়ার রহস্য কী? আরো হাস্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন শাওন। ডাক্তারের বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘চেয়ার থেকে যদি তিনি (হুমায়ূন) পড়েও যান তাতে কোনো ক্ষতি হবে না। যে মানুষটি এত বড় অপারেশন করে আসলেন কয়েক দিন হলো তিনি যদি চেয়ার থেকে পড়ে যান তার ক্ষতি হবে না এমন কথা মনে হয় বেয়াকুফ বা আহাম্মকও বিশ্বাস করবে না। হুমায়ূন আহমেদ যদি চেয়ার থেকে না পড়েন তবে এ প্রসঙ্গটিই বা আনবেন কেন শাওন? শাওনের মিথ্যাচার এখানেই শেষ নয়, তিনি বলেছেন, হার্ট এ্যাটাকে মারা গিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। বিষয়টি পূরবী বসুকে উদ্ধৃত করে। ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন শাওন। কারণ পূরবী বসূ ডাক্তার নন, তিনি কখনো ডাক্তার ছিলেন না। তিনি হচ্ছেন পুষ্টিবিদ। তাই তিনি কারো মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে পারেন না। তিনি যে ডাক্তার নন সে কথা তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ঠিকানাকে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে পূরবী বসু অবশ্য কোনো কথা বলতে চাননি। আর পূরবী বসু যে সত্যি সত্যি শাওনকে বলেছেন তা নিয়েও প্রবাসীদের সন্দেহ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০ জুন সকাল ১১টায় চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার পর প্রচণ্ড ব্যাথা পেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সারাদিন সারা রাত ব্যাথায় ভোগায় অবস্থা বেগতিক দেখে পরদিন সকালে ফানসু মন্ডলের গাড়িতে করে তাকে জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সকালে জ্যামাইকা হাসপাতালে নেওয়ার পূর্বে হুমায়ূন আহমেদ রাতে কয়েকবার বমি করেছিলেন। সেই বমিও পরিষ্কার করেছিলো কাজের মেয়ে শোভা। একজন। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। ফানসু মন্ডলের গাড়িতে করে হাসপাতালে নেওয়ার মাঝপথে এ্যাম্বুলেন্স কল করা হয়। বার বার বমি এবং পড়ার কারণে সেলাই খুলে যেতে পারে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। জ্যামাইকা হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হুমায়ূন আহমেদকে নেওয়া হয় বেলভ্যু হাসপাতালে। ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, হুমায়ূন আহমেদের ইনফেকশন হয়েছে। সেখানে দ্বিতীয় বারের মতো তাকে অপারেশন করা হয়। দ্বিতীয়বার অপারেশেনের পর থেকেই তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। একটি বিশ্বাস্ত সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় বার যখন হুমায়ূন আহমেদকে সার্জারি করা হয়, সেই স্থানটি অপেন রাখা হয়েছিলো। যাতে করে ভিতর থেকে পানি এবং পুঁজ বের করতে পারে। অবশেষে ডাক্তারদের সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে হুমায়ূন আহমেদ গত ১৯ জুলাই দুপুর ১টা ২২ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুকে ঘিরে সৃষ্ট নানা রহস্য নিয়ে প্রবাসে এখনো তুমুল আলোচনা চলছে শোব প্রকাশের পাশাপাশি। মেহের আফরোজ শাওন জানিয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদ হার্ট এ্যাটাকে মারা গিয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই ড. জাফর ইকবাল জানিয়েছেন, ক্যান্সারে নয় ইনফেকশনে মারা গিয়েছেন তার ভাই। ডাক্তার মিলার জানিয়েছেন, শ্বাস প্রশ্বাসে জটিলতা, হৃদযন্ত্রের বৈকল্য এবং কিডনির ক্রম ব্যর্থতার কারণে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। তিনজন তিন ধরনের কথা উল্লেখ করেছেন। এখন কার কথা সত্যি? তবে সব কথাই সত্য হলো তাদের কারো কথার সঙ্গেই শাওন বা মাজহারের স্টেটমেন্টের কোনো মিল নেই। এ নিয়েও কম্যুনিটিতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, হুমায়ূনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তা প্রমাণের জন্য হাসপাতালের রিপোর্টটি প্রকাশ করা উচিত। তাহলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় এসেছিলেন ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। প্রথমে তার চিকিৎসা দেওয়া হয় ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত হাসপাতাল শ্লোয়েন ক্যাটারিংয়ে। সেখানে তার ৫টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ম্যানহাটানের বেলভ্যু হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর বাকি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। ১২টি কেমোথেরাপি শেষে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তবে বড় প্রশ্ন ছিলো কেন শ্লোয়েন কেটারিং বাদ দিয়ে তাকে বেলভ্যুতে নেওয়া হয়? মাজহার বলেছেন, এটা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে মোমেনও বলেছেন, স্লোয়েন-কেটারিং ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত হাসপাতাল কিন্তু তাকে কেন বেল্যুতে নেওয়া হয়েছে তা তার পরিবারের সদস্যরাই জানেন। হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন এমন ২ জন বলেছেন অর্থ সংক্রান্ত কারণেই হুমায়ূন আহমেদকে বেলভ্যু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্লোয়েন-কেটারিং এ প্রতি রাতের জন্য ৫ হাজার ডলার চার্জ করা হতো। এই অর্থ দেওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও এই বিষয়টি শাওন বা মাজহার কেউ মিডিয়াকে জানাননি। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তাহলে কী অর্থাভাবেই হুমায়ূন আহমেদের সুচিকিৎসা হয়নি? অর্থের কারণে বিখ্যাত ক্যান্সার হাসপাতাল ত্যাগ করে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়েছে। হাসপাতাল পরিবর্তনের সিদ্ধান্তই বা কে নিয়েছেন? শাওন না অন্য কেউ? স্লোয়েন ক্যাটারিং হাসপাতাল ত্যাগের পূর্বে বা কয়েকটি কেমোথেরাপি দেওয়ার পর স্টিফেন আর ভিচ একটি রিপোর্ট দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে। সেই রিপোর্টেই ভিচ উল্লেখ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ কত দিন বাঁচবেন, তাঁর শরীরের অবস্থা কী। সূত্র জানায়, হুমায়ূন আহমেদকে যখন স্লোয়েন ক্যাটারিং এ নিয়ে আসা হয় সেই সময় চতুর্থ ধাপে ছিলো তার ক্যান্সার। এই ধরনের ক্যান্সার রোগীরা কতদিন বাঁচতে পারেন তা ডাক্তাররা বলে দেন। ডাক্তার ভিচও হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি ৩ থেকে ৪ বছর বাঁচতে পারেন। অপারেশন করে সমস্ত কিছু সরানো সম্ভব হলে আরো কয়েক বছর বেশি বাঁচতে পারেন। এ রিপোর্টটি সম্পর্কে জানতেন পূরবী বসু, প্রকাশক মাজহারসহ আরো কয়েকজন। পূরবী বসু এবং মাহজার এ ঘটনাটি প্রথমে হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওনকে জানাননি। তারা জানতে পেরেছিলেন মার্চ মাসের দিকে। মোটামুটি সবাই জানতেন হুমায়ূন আহমেদ কতদিন বাঁচবেন। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, চেয়ার থেকে না পড়লে এবং পড়ার সাথে সাথে যদি বেলভু হাসপাতালে নেওয়া হতো তাহলে তিনি মারা। নাও যেতে পারতেন। ডাক্তার ভিচের দেওয়া সময়ের আগেই হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন অবহেলার কারণে। হুমায়ূন আহমেদেকে যারা প্রথম থেকেই বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছিলেন, শেষ দিকে তাদেরকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা, রুমা সাহা, জামাল আবেদীনসহ অন্যান্য যারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। আর এ কাজটি করেছেন প্রকাশ মাজহারুল ইসলাম কৌশলে। তাকে সহযোগিতা করেছেন শাওন। এক সময় যারা নিয়মিত হাসপাতালে যেতেন তাদের যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেন শাওন ও মাজহার। এমন কী বাসায় পড়ে যাওয়ার খবরটিও এসব লোকদের প্রথমে। দেওয়া হয়নি। জ্যামাইকা হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর তাদের জানানো হয়। মাজহার কয়েকজনকে টেক্সে ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। মাজহার হুমায়ূনের কাছের লোকদের সরিয়ে তার আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিত জনদের হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শেষদিকে হাসপাতালে ১০ জন লোকের লিস্ট দেওয়া হয়। এই ১০ জন ছাড়া অন্য কারো যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। এই ১০ জন হচ্ছেন মেহের আফরোজ শাওন, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম, তহুরা আলী এমপি, ড. জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমীন হক, ফানসু মন্ডল, আসাদুজ্জামান নূর, রুবেল, পূরবী বসু এবং উদ্দিন। আরো যোগ করা হয় পারভেজ ও মুনিয়া মাহমুদকে। বাদ দেওয়া হয় বিশ্বজিত সাহা, রুমা সাহা, গাজী কাশেম, জামাল আবেদীন, জলি আবেদীন। এর মধ্যে রুবেল, উদ্দিন এবং পারভেজ মাজহারের আত্মীয় বা পরিচিত। এর মধ্যে একজন মাজহারের ভাগিনা পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের ফটো তুলতে বাধা দিয়েছিলেন। ড. জাফর ইকবাল, ইয়াসমীন হক, বিশ্বজিত সাহা, গাজী কাশেম সবাই সহযোগিতা করছেন আর মাজহারের ভাগিনা সাংবাদিকদের ফটো তুলতে বাধা দিচ্ছে। ভাড়াটিয়া সিকিউরিটির মতো আচরণ করা মাজহারের ভাগিনার কাজ ছিলো শাওনকে সাংবাদিকদের কাছ থেকে গার্ড দিয়ে দূরে রাখা এবং ছবি তুলতে বারণ করা ও বাধা দেওয়া।
মেহের আফরোজ শাওনের ভূমিকা নিয়ে আরো প্রশ্ন উঠেছে। হুমায়ূন আহমেদ যে বাসায় ছিলেন সেখানে রান্না-বান্নার জন্য রাখা হয়েছিলো কাজের লোক। এমন কী শেষ দিকে হাসপাতালেও রাতের বেলায় শাওন যেতেন না, স্বামীর শয্যাপাশে থাকতেন না। সেখানে বাংলাদেশ মিশনের লোকদের বাই রোটেশনে রাখা হতো। এই তথ্য জানিয়েছেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে মোমেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. মোমেন বলেন, ‘ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আমার কাছে অনুরোধ এসেছে আমি যেন হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে মিডিয়ায় কিছু না বলি। আমরা আর এর মধ্যে যেতে চাই না। মেহের আফরোজ শাওনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা মিথ্যাচারের এখানেই শেষ নয়। হুমায়ূন আহমেদের দাফন নিয়ে তিনি বাংলাদেশে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন নুহাশ পল্লীতে কবর দেওয়ার কথা হুমায়ূন বলেছিলেন। অথচ নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের যে ডেথ সার্টিফিকেট রয়েছে সেখানে হুমায়ূন আহমেদের কবর দেওয়ার কথা রয়েছে গুলশান বাংলাদেশ, নুহাশ পল্লীতে নয়। গত ১৯ জুলাই নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা এই সাটিফিকেটের নম্বর হচ্ছে ১৫৬-১২-০২০১৪।
ফিউনারেল হোমে লাশ ছিলো একা
গোসল দেওয়ার লোকও ছিলো না
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার ২৭ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: ড. হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে মারা যাননি। রক্তের সংক্রমণই তার অকাল মৃত্যুর কারণ। বাসায় ফেরার একদিন পর তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক হাসপাতালে না নিয়ে জননন্দিত এই ব্যক্তিত্বকে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় একদিন পর নেওয়া হয়। জ্যামাইকার কুইন্স মেডিকেল সেন্টারে। এরপরই যত জটিলতা। যার প্রেক্ষিতে কোটি মানুষের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে পাড়ি দিতে হলো পরপারে। লেখক হুমায়ূন আহমেদের লাশ গোসল করানোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে লাশের গোসল নিয়ে তার ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তিকে হেস্তনেস্ত হতে হয়েছে। অন্যের সাহায্য নিতে হয়েছে গোসল করানোর কাজে। ফিউনারেল হোমে হুমায়ূন আহমেদের লাশ পড়েছিলো একা। অনাদরে অবহেলায়। মাতমে অস্থির কাউকে তখন দেখা যায়নি প্রিয় ব্যক্তির কফিনের পাশে। আত্মীয় জামাল আবেদীন ও আনিসুর রহমান ছাড়া কেউ নেই। সাধারণত কেউ মারা গেলে লাশের পাশে সার্বক্ষণিক কাউকে রাখা হয়। দোয়া কালাম পড়া হয় আত্মার শান্তি কামনা করে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের পাশে কেউ না থাকায় গোসলের পর মাত্র চার ব্যক্তিকে প্রথম মোনাজাত করতে হলো। এসব নিয়ে এখন হাজারো প্রশ্ন সাধারণের মনে। কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মণি হুমায়ূন আহমেদ কেন এমন উপেক্ষার শিকার হলেন এর জবাব চান তার ভক্তরা। এ বিষয়ে জানতে গিয়ে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
একটি বিশ্বস্ত সূত্রমতে, গত ১২ই জুন বেলভ্যু হাসপাতালে অপারেশন হয় হুমায়ূন আহমেদের। অপারেশনের পর সবাই খুশি। চিকিৎসকরা বললেন, এটা ১০০% সফল অস্ত্রোপচার। মাত্র ৮ দিনের মাথায় ২০ জুন হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হলে তিনি নিজেই পায়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে চড়ে ওজোনপার্কের ভাড়া বাড়িতে ফিরে আসেন। সূত্রমতে, বাড়ি ফেরার দিনই একটি পার্টি করা হয় হুমায়ূন আহমেদের বাড়িতে। সেখানে সব ধরনের গোশতসহ পানীয় ছিলো। ক্যান্সার অপারেশনের একজন রোগীকে এসব খাবার দেওয়া সঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে অনেকের প্রশ্ন। ২১ জুন বিকেলে হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে যান। এটাই হয়েছিল তার জন্য বড় কাল। চেয়ার থেকে কীভাবে তিনি পড়লেন এটা কেউ জানেন না। পড়ে যাওয়ার কারণে অপারেশনস্থল আঘাতপ্রাপ্ত হয় মারাত্মকভাবে। এ নিয়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গীরা কোনো ব্যবস্থা নেননি তাৎক্ষণিকভাবে। একদিন পর ব্যথায় কুঁকরে ওঠেন হুমায়ূন আহমেদ। এ সময় মুক্তধারার প্রধান বিশ্বজিত সাহাকে ফোন করেন শাওন। জানতে চান ডাক্তারের ফোন নম্বর। বিস্ময়কর বিষয় হলো, শাওন ও মাজহারুল ইসলামের কাছে জরুরি প্রয়োজনের জন্য
ফোন নম্বরটিও ছিলো না ড. হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসকের। পরদিন অর্থাৎ ২২ জুন বিকালে যখন ব্যথা চরম আকার ধারণ করে তখন একটি প্রাইভেট কারে করে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তারা রওনা হন হাসপাতালের দিকে। গাড়িতেই তিনি সংজ্ঞা হারান। এক পর্যায়ে এ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলে সংজ্ঞাহীন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যাওয়া হয় জ্যামাইকায় অবস্থিত কুইন্স মেডিকেল সেন্টারের ইমার্জেন্সি রুমে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন আরেকটি এম্বুলেন্স ডেকে রাতে লেখককে নিয়ে যাওয়া হয় বেলভ্যুতে। সেখানে যাওয়ার পর পরই অবস্থার ভয়াবহতা দেখে চিকিৎসকরা তাকে আবার অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন ২৩ জুন। এরই মধ্যে ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
সূত্র জানায় হুমায়ূন আহমেদ মারাত্মক ইনফেকশনে আক্রান্ত হলেও সব সময়ই এটাকে ঢেকে রাখার একটি প্রবণতা ছিলো। এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই রয়েছে হাজার প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠেছে, ১২ই জুন যখন বেলভ্যুতে হুমায়ূন আহমেদের অপারেশন হচ্ছিল তখন তার স্ত্রী শাওন ও মাজহারের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে। ড. হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘ অপারেশনের সময় সেখানে উপস্থিত ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বিশ্বজিত সাহা, পূরবী বসু, ফানসু মন্ডলসহ আরও অনেকে ছিলেন উদ্বিগ্ন। বসে বসে তারা মনিটরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন লেখকের সর্বশেষ অবস্থার খবর। কিন্তু শাওন ও মাজহার বেরিয়ে যান। তারা ফিরে আসেন প্রায় দুই ঘণ্টা পর। উপস্থিত শুভানুধ্যায়ীরা বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করেননি।
একটি সূত্রমতে, ড. হুমায়ূন আহমেদ বাসায় পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু একদিন পরে প্রায় মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় রক্তে সংক্রমণ। যা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে তার মৃত্যুর কারণ। এই গাফিলতির দায়ভার কে নেবে এটাই এখন প্রশ্ন। বাংলা সাহিত্যের স্রোতধারায় পরিবর্তনের নায়ক হুমায়ূন আহমেদ। নন্দিত এ ভালোবাসার মহানায়ক মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। বিশ্বের সর্বাধুনিক। চিকিৎসার জন্য খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রে এলেন আরোগ্য হওয়ার প্রত্যাশায়। নিউইয়র্ক আগেও আসা-যাওয়া করেছেন পাঠক নন্দিত এ লেখক। পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সদাচঞ্চল রাখা হুমায়ূন আহমেদ লাশ হয়ে ফিরে গেলেন। নিউইয়র্ক থেকে গত শনিবার রাতে হুমায়ূন আহমেদের কফিন নিয়ে ফ্লাইট উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে গেল। নিউইয়র্কের কোনো
বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ আর আসবেন না। প্রবাসী কোনো ভক্ত-পাঠক আর কখনো অটোগ্রাফ চেয়ে আবদার জানাবেন না। জীবনের সব হিসাব চুকিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে এসে প্রায় ১০ মাস ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। দশ মাস নিউইয়র্কে অনেকটা নীরবেই কেটেছে তার। ক্যান্সারের স্পর্শকাতর চিকিৎসার কারণেই নিয়ন্ত্রিত ছিলো তার চলাচল। বাংলাদেশি অধ্যুষিত নিউইয়র্কের কুইন্সে ঘর ভাড়া করে চিকিৎসা চলছিলো। নির্বিঘ্ন চিকিৎসা অব্যাহত রাখার জন্যই প্রবাসীদের পক্ষ থেকে অহেতুক বিব্রত করা হয়নি প্রয়াত লেখককে। প্রবাসীদের সব আড্ডা সমাবেশে হুমায়ূন আহমেদের প্রসঙ্গ এসেছে। সবাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছেন প্রিয় লেখক যেন সেরে ওঠেন। যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। সব শুভকামনা ধুলায় মিশে যায়। ১৯শে জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হুমায়ূন আহমেদ। পাঠকের মনোজগৎ নিয়ে বহু রহস্য সৃষ্টি করে গেছেন ক্ষণজন্মা এ শব্দের কারিগর। মৃত্যুর আগে ও পরে নিউইয়র্কেও তাকে নিয়ে বেশ কিছু রহস্য, বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বদল: বিখ্যাত ক্লোন ক্যাটারিং মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদের। শারীরিক অবস্থার উন্নতিও ঘটেছিলো। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ক্লোন ক্যাটারিং মেমোরিয়াল হাসপাতাল। হঠাৎ করেই জানা গেল বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। বেলভ্যুর কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে পরিচিতি নেই। এখানেই তার অস্ত্রোপচার হলো। অস্ত্রোপচারের আট দিনের মাথায় বাড়ি ফিরলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাড়িতে শরীরের অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটে। জ্যামাইকা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ হয়ে আবার বেলভ্যু হাসপাতালে গেলেন এবং টানা প্রায় চার সপ্তাহ ওখানে থেকেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। অনেকেরই জিজ্ঞাসা, হাসপাতাল পরিবর্তন করা হলো কেন? লোকজন জানতে চেয়েছেন, কারণটা কি ছিলো অর্থনৈতিক? বলা হচ্ছে ক্যান্সারের আক্রমণে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু ঘটেনি। ঘটেছে। অজানা ভাইরাসের আক্রমণে। এ আক্রমণটা ঘটলো কোথায়? হাসপাতালে না। নিজের ঘরে? ক্যান্সার চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর জন্য প্রযোজ্য দেখাশোনায় হুমায়ূন আহমেদের বেলায় কোথাও কোনো অবহেলা হয়েছে কি? নিউইয়র্কে কে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের অভিভাবক? হুমায়ূন আহমেদ কোনো সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর জানার জন্য উদ্বিগ্ন থেকেছে বাংলাদেশের লক্ষ্য কোটি মানুষ। চিকিৎসার জন্য লেখকের সঙ্গে আসা প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ছিলেন সার্বক্ষণিক। নিউইয়র্কে অবস্থানকালীন চিকিৎসা থেকে নানা বিষয়ে দৌড়ঝাপ করেছেন মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা। লেখকের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য এ দুজনের ওপরই সংবাদকর্মীদের নির্ভর করতে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দুজনের দেওয়া ভাষ্যে ফারাক ছিলো বিস্তর। প্রিয় লেখকের সঙ্কটজনক শারীরিক অবস্থা নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে হিমশিম খেতে হয়েছে সংবাদকর্মীদের। অনেকেই বলেছেন, ১৯ জুলাই সকাল পর্যন্ত মাজহারুল ইসলাম লেখকের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেননি। অনেকেরই জিজ্ঞাসা, কোথাও কি কিছু আড়াল করার চেষ্টা ছিলো? আমাদের ব্যর্থতা: নিউইয়র্কের বাংলা সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন ঢাকা থেকে। সংবাদ প্রচার হওয়ার পরও দ্রুত নিউইয়র্কের বাংলা সংবাদপত্রের কর্মীরা হাসপাতালে উপস্থিত হতে পারেননি। হাসপাতালের ভেতর থেকে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন এবং মাজহারুল ইসলাম নিউইয়র্কের সংবাদ কর্মীদের নয়, ঢাকায় ফোন করে সংবাদ দিচ্ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পাঁচ ঘণ্টা পর ফিউনারেল হোমে পাঠানো হয়। এ পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সংবাদকর্মীরা ছাড়া মাত্র তিনজন সাধারণ প্রবাসীকে হাসপাতালের গেটে ভিড় করতে দেখা গেছে। জ্যামাইকার রকওয়ে বুলেভারের ইসলামিক ফিউনারেল হোমে রাখা হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম রোজার প্রস্তুতি এবং তার জানাজা নামাজের ব্যস্ততা ছিলো, ফিউনারেল হোমের মূল ফটকসহ কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিলো। রাত ১২টা পর্যন্ত ফিউনারেল হোমে কোনো প্রবাসীকে ছুটে আসতে দেখা যায়নি। জ্যামাইকার রকওয়ে বুলেভার এবং ১১৬ স্ট্রিটের ঘরে হুমায়ূন আহমেদের পরিবার ছিলেন। সেখানে মধ্যরাত পর্যন্ত মাত্র জনবিশেক মানুষের আগমন ঘটেছে।
শুক্রবার সকালে ফিউনারেল হোমে মরদেহ দেখার ব্যবস্থা থাকলেও কোনো প্রবাসী বাংলাদেশিকে সেখানে দেখা যায়নি। শুক্রবার জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের নামাজে জানাজায় লোকসমাগম নিয়েও কথা উঠেছে। রমজানের প্রথম জুমার নামাজে একই ধরনের লোকসমাগম হয়ে থাকে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। জানাজার পর মরহুমের কফিন দর্শনার্থীদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো শৃঙ্খলা ছিলো না। জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে নামাজে জানাজার পর কোনো শুভেচ্ছার আয়োজন দেখা যায়নি। যেসব সংগঠন, সমিতির নেতারা অহরহ বিবৃতি দিয়ে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা জানান, তাদেরও দেখা যায়নি। বহু ফুল ফোঁটানোর মহানায়ক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ শনিবার দুপুর পর্যন্ত ছিলো ফিউনারেল হোমে। প্রবাসী বাংলাদেশি কোনো সংগঠন, নেতা পাতি নেতাদের সেখানে ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। যেসব বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, লেখকের আত্মার আত্মীয় বলে পরিচয় ছিলো তাদেরও দেখা মিলেনি। শনিবার রাতে জনাবিশেক লোক ছিলেন জেএফকে বিমানবন্দরে। যারা এখন শোকসভার ডাক দেবেন, ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা লিখবেন, তাদের টিকিটিও চোখে পড়েনি হাসপাতাল থেকে ফিউনারেল হোম পর্যন্ত। ফিউনারেল হোম থেকে অস্থায়ী বাড়ি, জানাজা এবং শেষ বিদায়ে জেএফকে’তে।
বিমানবন্দরে কমিউনিটির উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া ছিলো লজ্জাজনক। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, প্রিয় লেখককে কেন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিলো? নানা কারণে সভা-সমিতি করে যারা নিজেদের মোড়লত্ব জাহির করেন তারাইবা কেন এগিয়ে গেলেন না? যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, কুঁজো হয়ে হাঁটেন তারাইবা কোথায় ছিলেন? নিয়ন্ত্রণহীন অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকেই শেষ দেখা দেখতে পারেননি প্রিয় লেখকের প্রিয়মুখ। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সমন্বয় ছিলো না। নামাজে জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেছেন ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাঁদের, জাতিসংঘস্থ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন। অব্যবস্থাপনা ছিলো ফিউনারেল হোমেও : শুক্রবার সকাল ৯টায় ইসলামিক ফিউনারেল হোমে গিয়ে মরহুম লেখকের কোনো স্বজনকে পাওয়া যায়নি। ফিউনারেল হোমের পরিচালক ব্রুস বেইটস জানান, মরদেহ গোসল করানোর জন্য স্বজনদের অপেক্ষা করছেন। সকাল সোয়া ১০টার দিকে জামাল আবেদীন ও আনিসুর রহমান ফিউনারেল হোমে উপস্থিত হন। দুজনই মরহুম লেখকের একান্ত স্বজন, প্রথম পক্ষের স্ত্রী গুলতেকিনের নিকট আত্মীয়। অন্য কারও জন্য অপেক্ষা না করে মরদেহ গোসল এবং ধর্মীয়ভাবে প্রস্তুত করা হয়। ধর্মীয় নিয়ম-কানুন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলেও প্রিয় লেখকের এ অন্তিম পর্বে আমিও যোগ দেই। নিয়ম অনুযায়ী সাদা কাফনের শেষ পরিচ্ছদে মুড়িয়ে দেওয়া হয় মরহুমের দেহ। ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া: মরদেহ গোসল করানোর আমার কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিলো না। ফিউনারেল হোমের উন্মুক্ত টেবিলে চিরচেনা লেখকের নিথর দেহ দেখে মুষড়ে পড়ার অবস্থা। আমার থরথর কাপ এবং অঝোর কান্না দেখে জামাল আবেদীন আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন। আমরা তিনজন তখন দোয়া দরুদ পড়ছিলাম। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই মরদেহ কফিনে রেখে দেওয়া হয়। ফিউনারেল হোমে পারিবারিক দর্শনার্থী: ফিউনারেল হোমে পারিবারিক দর্শনার্থীদের জন্য কফিনে রাখা হলেও বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কোনো স্বজন বা পরিবারের লোকজন আসেননি। এখানে একটি প্রার্থনা কক্ষ থাকলেও ধর্মীয় কোনো আয়োজনও ছিলো না ফিউনারেল হোমে। মরহুম লেখকের জন্য ছিলো না কোনো দোয়া কালামের ব্যবস্থা। হলরুমে কফিনের মধ্যে একটা লাশ পড়ে আছে। কেউ নেই কিছু বলার। আমরা মাত্র চার জন বসে আছি। এরই মধ্যে ফিউনারেল হোমে পৌঁছে। গেলেন বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের। নীরব নিথর হুমায়ূন আহমেদের কফিন পড়ে আছে সেখানে। আমরা চার জন পাশে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম দোয়া দরুদ করার। তারপর তার আত্মার মাগফেরাত কামনায় প্রথম মোনাজাত করি আমরাই। শেষ পর্যন্ত বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহেরকে অনুরোধ করা হয় মোনাজাত পরিচালনার জন্য। মাত্র চার জন মিলে আমরা মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করি। বেলা সাড়ে ১১টার কিছু পর হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন তার মা তহুরা আলী, দুই পুত্র নিনিত ও নিশাদকে নিয়ে ফিউনারেল হোমে পৌঁছেন। শাওন মরহুম হুমায়ূন আহমেদের কফিন ধরে বিলাপ করতে থাকেন ‘জিম জিম-তুমি চলে গেলে/তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো কীভাবে’। হুমায়ূন আহমেদকে সম্ভবত জিম’ নামেই ডাকেন তার স্ত্রী শাওন। শাওন বলছিলেন, ‘জিম তুমি বলতে কুসুম আমার চোখ বুলিয়ে দাও (শাওনকে হুমায়ূন আহমেদ ‘কুসুম’ বলেই ডাকতেন)। শাওন বলেন, “দেখো জিম, আমি তোমার চোখ বুলিয়ে দিচ্ছি।’ শাওন বিলাপ করতে থাকেন, ‘জিম আমি রাখতে পারলাম না। এ সময় শাওনের মা তহুরা আলী মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘দু’সন্তানের জন্যই তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। মন শান্ত করো মা। নিশাদ ও নিনিত দু’সন্তান শেষ দেখা দেখেছে ওদের বাবা কোটি জনতার প্রিয় মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে। ফিউনারেল হোমে মা ও নানীর সঙ্গে নিয়ে এলে তারা শুধু দেখছিলো। বাবাকে ‘বাই বলো, বাবার কাছ থেকে বিদায় নাও’ বলছিলেন মা মেহের আফরোজ শাওন। পলকহীন অবুঝ দুই শিশুপুত্র তখন কেবল এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। ছবি উঠানো বারণ: হুমায়ূন আহমেদের কফিনে বিলাপরত তার স্ত্রী ও স্বজনদের ছবি গ্রহণের উদ্যোগ নেই। ফিউনারেল হোমের পরিচালকের কাছ থেকে প্রথম জেনে নেই ছবি তুলতে কোনো বাধা আছে কিনা। ক্যামেরায় ছবি ধারণ করতেই ক্ষুব্ধ মেহের আফরোজ শাওন ছুটে এসে আমার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেন। তার মা তহুরা আলী উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদ নিষেধ করে গেছেন কোনো ছবি যেন ওঠানো না হয়।
প্রয়াত লেখকের নিষেধের কথা আমার জানা নেই বলে তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করা হয়। ধারণ করা সব ছবি মুছে ফেলে আমার ক্যামেরা ফেরত দেওয়া হয়। অসুস্থ অবস্থায় প্রয়াত লেখকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকা অনেকেই বলেছেন ছবি ওঠানোর ব্যাপারে নিষেধের কথা হুমায়ূন আহমেদ বলে যাননি। মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে থেকেই তো তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না। মরদেহ ফিউনারেল হোমে রেখে অপ্রীতিকর আচরণ: মাত্র সাতজন পারিবারিক দর্শনার্থীদের সুশৃঙ্খল থাকার জন্য বলছিলেন সকাল থেকে ফিউনারেল হোমে উপস্থিত জামাল আবেদীন। তার দিকে হঠাৎ তেড়ে আসেন প্রয়াত লেখকের বন্ধু বলে পরিচিত ফানসু মন্ডল। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে আসা ফানসু মন্ডল এবং জামাল আবেদীনের মধ্যে ‘তুমি কে, তা আমি দেখে নেবো’ ইত্যাদি বাক্যবিনিময় শুরু হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফিউনারেল হোম কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়।
মরদেহ দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা
জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে নামাজে জানাজা শেষ হওয়ার পরও মরহুমের কফিন দেশে ফেরার সময় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সংশিষ্টদের জিজ্ঞাসা করা হলে সবাই বলছিলেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চলছে, শুক্রবার রাতেই যেন ফ্লাইট ধরানো যায়। সমন্বয়ের সঙ্গে সংশিষ্ট মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা জানান, কার্যত সব টিকিট একসাথে না পাওয়ায় বিলম্ব হচ্ছিল। বাংলাদেশ মিশনের একটি সূত্র জানায় মরদেহের সঙ্গে যারা ঢাকা যাবেন তারা নাকি প্রথম শ্রেণি ছাড়া ভ্রমণ করবেন না। অথচ হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইকোনমি ক্লাসে ওইদিন ঢাকার উদ্দেশে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন। জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ তখন ফিউনারেল হোমের হিমাগারে। জীবদ্দশায় তার ভ্রমণে প্রথম শ্রেণির চাহিদা সবসময় ছিলো কিনা জানি না। তবে লাখো জনতার অপেক্ষা ও উৎকণ্ঠায় স্বদেশ তখন প্রিয় লেখকের কফিনের অপেক্ষায়।