১০. হুমায়ূন আহমেদ রোগমুক্ত

হুমায়ূন আহমেদ রোগমুক্ত

২০১২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের শনিবার। ব্রেকফাস্ট টেবিলে ১৪ বছরের একটি ছেলে বলল, আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখেছি। গ্রেট রাইটারের অসুখ ভালো হয়ে গেছে। তার মা বলল, কীভাবে? ছেলেটি বলল, আমি গত রাতে ড্রিম দেখেছি, রাইটার চেরি ব্লসম দেখে নিউইয়র্কে এসে ডক্টর দেখাতে গেল। আর ডক্টর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো রাইটারের কোনো অসুখই নেই। ডক্টর অবাক। রাইটার অবাক। কীভাবে এমন হলো? পরে দেখলো চেরি ব্লসম দেখার ফলেই রোগমুক্ত হয়ে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। ছেলেটির মা’র আর তর সইছিলো না। ফোনেও বলবে না। এসব কথা কি ফোনে বলা যায়? মা ঐদিনই সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওনকে কথাটা বললেন। হুমায়ূন আহমেদ ১ বছর বয়স থেকেই ছেলেটিকে চেনে। ওর নাম বিজিত সাহা। হুমায়ূন আহমেদ ও শাওন শুনে যে কী খুশি হলেন সেদিন- দৃশ্যটি ফ্রেমে ধরে রাখার মতো। এরপর থেকেই চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার জন্য হুমায়ূন আহমেদ মনে মনে তৈরি হচ্ছিলেন। ২০১২ সালের ২০ মার্চ তারিখ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে সেই ফেস্টিভ্যাল। তাছাড়া সেবছরই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো টোকিও থেকে ওয়াশিংটনে চেরি ব্লসম ট্রি গিফটের ১০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। ইন্টারনেটে খবর নেওয়া হলো। পরপর দুবার দেশে যাওয়ার কারণে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমি না যাওয়াতে রুমাও আর যেতে পারলো না। বইমেলা নিয়ে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো মিটিং থাকছে। ৬ এপ্রিল ২০১২ হুমায়ূন আহমেদ চেরি ব্লসম দেখতে গেলেন। সঙ্গে মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত আর ফানসু মন্ডল। মুনিয়া মাহমুদ, নূর উদ্দীন এবং তাঁদের দুই সন্তান গিয়েছিল। তাঁরা উঠলেন শেরাটন হোটেলে। হুমায়ূন আহমদের ভক্ত কাজল ও নজরুল ইসলাম সেখানে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেই বাড়িতেই শাওনের গান ও হুমায়ূন আহমেদের কথাগুলো ইউটিউবে প্রচার হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া ও গল্প হয় নজরুল ইসলামের বাড়িতে। ওয়াশিংটন থেকে তাঁরা দেখতে গেলেন ব্যুরে ক্যাভার্ন গুহা এবং চেরি ব্লসম। সে সময় মুনিয়া মাহমুদসহ অনেকেই ছিলেন না। তাঁরা চলে এলেন কোনো জরুরি কাজে নিউইয়র্কে।

মেরিল্যান্ড

ওয়াশিংটনে ঘোরাঘুরি শেষ করে তাঁরা গেলেন মেরিল্যান্ডে বসবাসকারী লেখকের ছোটবেলার বন্ধু ড. মোহাম্মদ মাসুমের বাসায়। সেখানে তিন বন্ধু একত্র হলেন। আটলান্টিক সিটির পর একমাত্র শহর মেরিল্যান্ড যেখানে হুমায়ূন আহমেদ দুবার গেলেন। বন্ধুর বাড়িটি লেখক খুব পছন্দ করতেন। পার্কভিন এলাকায় গাছগাছালি ভরা। বাড়ির সাথে লাগোয়া বাড়িটি লেখক কিনতে চেয়েছিলেন। হোটেল থেকে বন্ধুকে দেখার জন্য লেখক ছুটে গেলেন বিকেলে। রাতে খাওয়া-দাওয়া করলেন সবাই মিলে।

বছরের শুরুতেও লেখক গিয়েছিলেন বাল্টিমোরে ড. মোহাম্মদ মাসুমের বাসায়। তখন তাঁর সাথে ছিলেন শাওন, দুই সন্তান, মাজহারুল, স্ত্রী স্বর্ণা ইসলাম ও তাদের সন্তানরা। সেবছর গানের অনুষ্ঠান হয়েছিলো। গান গেয়েছিলেন ড. জুলফিকার হোসেন এবং শাওন। হুমায়ূন আহমেদের অনুরোধে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন ড. মোহাম্মদ মাসুম। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়েছিলো। সে আড্ডায়, আশরাফ আহমেদ এবং গোলাম কিবরিয়া সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ পছন্দ করেছিলেন সিসিলি ভাবির খাবার। যাওয়ার সময় গরুর ভুনা নিয়ে গেলেন হোটেলে। গাজরের হালুয়াও পছন্দ করেছিলেন। তারপর বাসে করে তারা নিউইয়র্কে ফিরে আসেন। হুমায়ূন আহমেকে দেখতে নিউইয়র্কে এসেছিলেন ড. মোহাম্মদ মাসুম পরিবার। যখনি একসাথে হতেন তখনি ঢাকা কলেজের সাউথ হস্টেলের আর দিনগুলোতে তারা ফিরে যেতেন। স্মৃতিরোমন্থন করতেন বগুড়া জেলা

স্কুলে যখন দুজন পড়তেন। ক্যান্সার চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে লেখক দুবার গিয়েছিলেন বাল্টিমোরে।

ইউটিউবের ভিডিও

ইউটিউবে পরিবেশিত যে গানগুলো সবাই শুনেছেন দেখেছেন, সেগুলো নিউইয়র্ক বইমেলার জন্যই তৈরি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওন। যদিও ইউটিউবে লেখা আছে নিউইয়র্কে তোলা, আসলে এটি ধারণ করা হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদ যখন প্রথমবার মেরিল্যান্ড যান সেবছর। হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত এবং ছোটবেলার বন্ধুরাও ছিলেন সেখানে। ইউটিউবে ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি বলছেন, আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত গান শুনেছি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে কী অসাধারণ গান করতে পারেন তার একটা ঘটনার কথা বলছি। তিনি আরো বলেন, একদিন আমার কাছে গিয়াসউদ্দীন নামে একজন গীতিকার এসে বললেন, স্যার আমি গত ২০ বছর ধরে গান করি। অথচ এখনো বাংলাদেশ টেলিভিশন বা রেডিওর নিবন্ধনকৃত শিল্পী হতে পারলাম না। আমি কয়েকটি গান শুনলাম, তারপর তখনকার টেলিভিশনের মহাপরিচালক নওয়াজেশ আলী খানের কাছে একটা কাগজ লিখে পাঠালাম। তিনি বললেন, এবার আমরা তার একটা গান শুনি। শাওন গাইলেন, ‘মরিলে কাঁদিস না, আমার যাদুধন’…। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী গানটি শুনে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। এক সময় চশমা খুলে হুমায়ূন আহমেদ চোখ মুছলেন। এরপর আমেরিকায় তাঁর চিকিৎসার কথা বলেন। চিকিৎসার জন্য ১ কোটি টাকা জমা দিতে হয় বলে জানান। শাওন সংশোধন করে দেন- ১ কোটি নয় ১ লক্ষ ২৫ হাজার ডলার। এত নগদ টাকা সাথে আনা যায়নি, তাও বললেন। বললেন, মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। যখন সময় হবে সে চলে যাবে। স্যার সূরা বনি ইসরাইলের একটি সূরার কথা উল্লেখ করে বললেন, আমি তোমাদের প্রত্যেকের ভাগ্য গলায় হারের মতো ঝুলিয়ে দিয়েছি ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।

ডেনভার

 হুমায়ূন আহমেদ ডেনভারে গিয়েছিলেন মেহের আফরোজ শাওন, নিষাদ, নিনিত, শাশুড়ি মিসেস তহুরা আলী এবং শাওনের ছোট বোনকে সাথে নিয়ে লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসুর বাড়িতে। সেখানে তারা কয়েকদিন ছিলেন। অনেক আনন্দ করেছেন। বেড়াতে গেছেন রকি মাউন্টেন হিলে। খেতে গেছেন রেস্তোরাঁয়। এ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন তাঁর পায়ের তলায় খড়ম’ গ্রন্থের এক পরিচ্ছেদ: মিশিগান।

০১১ সালের জুন মাসে বেড়াতে গেলেন মিশিগানে আরেক বন্ধু আহসান হাবীবের বাড়িতে। লস এঞ্জেলেস, লাস ভেগাস থেকে মিশিগান হয়ে ট্রেনে করে নিউইয়র্কে এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে একসময় ঢাকায় খুব যোগাযোগ ছিলো। তারপর অনেকদিন যোগাযোগ নেই। এ রকমই একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আহসান হাবীবের সাথে আবার যোগাযোগ হলো ২০০৬ সালে নিউইয়র্কের বইমেলায়। সেখানে মিস্টি হিল’ দেখেই দেশে গিয়ে নুহাশ পল্লীতে বানিয়েছিলেন মিস্টি হিল। বিভিন্ন নার্সারিতে গাছ খোজা, লেক ইরিতে বেড়াতে যাওয়া এবং সন্ধ্যায় বাঙালিদের সাথে আড্ডা দিয়ে তিনি কাটিয়েছিলেন মিশিগানে কয়েকটি দিন।

যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ

হুমায়ূন আহমেদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একে অন্যকে খুব পছন্দ করতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনীর নাম পায়ের তলায় সর্ষে আর হুমায়ূন আহমেদের ভ্রমণ কাহিনীর নাম পায়ের তলায় খড়ম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘সেই সময়’। হুমায়ূন আহমেদেরও একটি গ্রন্থ ‘সেই সময়’। আমেরিকায় তারা একসাথে হয়েছেন চারবারেরও বেশি। দুবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। দুজনেই ঘুরতে ভালোবাসতেন। মরণব্যাধি ক্যান্সার নিয়ে ১৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ২০১১ সালের জুন মাসে এসেছিলেন একবার বেড়াতে। বইমেলায় যোগ দেওয়ার কথা ছিলো, আসতে পারেননি। সেময় তিনি লস এঞ্জেলেস, লাস ভেগাস ও মিশিগান হয়ে যাওয়ার আগে আসেন নিউইয়র্কে। সেবছরই প্রথম নিনিতকে নিয়ে এলেন যুক্তরাষ্ট্রে।

জুন, ২০১১
লস এঞ্জেলেস

২০১১ সালের জুন মাসে হুমায়ূন আহমেদ বেড়াতে এসে প্রথমেই লস এঞ্জেলেসে নামলেন। এই প্রথম তিনি নিউইয়র্কে না এসে লস এঞ্জেলেস হয়ে পরে নিউইয়র্ক হয়ে দেশে ফেরেন। ১২ জুন লস এঞ্জেলেসের উইলশায়ার প্লাজা হোটেলের বলরুমে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এক আনন্দ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। সাইফুর রহমান, ওসমানী জিতু ও মনোয়ার হোসেন। উপস্থাপিত এই অনুষ্ঠানে লস এঞ্জেলেসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মাননা দেওয়া হয়। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জেসমিন খান ও মমিনুল হক বাচ্চু। খালি গলায় বৃষ্টির গান গেয়ে শোনান মেহের আফরোজ শাওন। কবিতা আবৃত্তি করেন এজাজ আহমেদ। প্রবাসের গল্পকার হিসেবে বুলবুল। সিনহা, সাংবাদিকতায় তপন দেবনাথ ও সমাজ সেবক হিসেবে শংকু আইচকে সম্মাননা দেওয়া হয়। শংকু আইচ হুমায়ূন আহমেদের হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন। সেটিই ছিলো হুমায়ূন আহমেদের লস এঞ্জেলেসে শেষ অনুষ্ঠান।

লাসভেগাস

আটলান্টিক সিটির মতো লাস ভেগাসও হুমায়ূন আহমেদের খুব পছন্দের ক্যাসিনো। এখানে থাকার কথা ছিলো একদিন। পরবর্তীতে শাওনের ভালো লাগায় তিন দিন ছিলেন। প্লেনের টিকেট পরিবর্তন করতে সহযোগিতা করেছিলেন একজন বাঙালি চিকিৎসক। লেখক ক্যাসিনোর বিভিন্ন ম্যাজিক শো দেখেছিলেন। লাস ভেগাসের খোকন তালুকদারের বাড়িতে খেয়েছিলেন বাঙালি খাবার। এরপরই হুমায়ূন আহমেদ ৪ গ্রন্থটি খোকনকে উৎসর্গ করেছেন। একজন খোকন হলেন লাস ভেগাসের খোকন।

.

পাদটীকা

বেড়াতে ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। তাই সময় পেলেই বেরিয়ে পড়তেন পরিব্রাজকের মতো। নিজের বেড়ানোর কথা নিয়ে লিখেছেন একাধিক গ্রন্থে। বলেছিলেন, ১২ জুন সার্জারির পর ভালো হয়ে ফিরলে সবাই মিলে বের হবো ক্যারাভ্যান (বাসের মতো খাওয়া দাওয়া,বাথরুমসহ একটি যান) নিয়ে পুরো আমেরিকা সফরে। কয়েকটি পরিবার একসাথে থাকবে। নিউইয়র্ক থেকে গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন স্টেট দেখতে দেখতে লস এঞ্জেলেস। তা আর হলো না। কিন্তু লেখকের সেই আকাঙ্ক্ষার কথাগুলো তো রয়েই গেলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *