১৩তম খণ্ড — যৌন পবিত্রতা ও বিবাহের লক্ষ্য উদ্দেশ্য
কয়েকটি মাত্র নমুনা উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা হলো। নতুবা মানবেতি–হাসের এমন কোন্ দিকটি আছে, যাতে বিবাহিত জীবনের উপকারিতা ও গুরুত্ব অনুভূত হয় না? কিন্তু এরই সাথে সাথে আমাদের এ কথাও অন্তরে বদ্ধমূল করে রাখতে হবে যে, অন্যান্য উপকারিতার সাথে বিবাহ প্রথার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌন পবিত্রতা ও সতীত্ব নামক যে অমূল্য সম্পদ মানবজাতিকে দান করা হয়েছে, তার পবিত্রতা রক্ষা করা। আর এর রক্ষাকবচ হচ্ছে বিবাহ প্রথার এ আইনী পদ্ধতি, যাকে আমরা নিকাহ বা বিবাহ বলি। এখন বিষয়টির এ দিকটি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হবে।
.
বিবাহের শর্ত চারটি
পবিত্র কুরআন মজীদে যেখানে মুহাররামাতের (যে-সব নিকটাত্নীয়ের সাথে বিবাহ বন্ধন নিষিদ্ধ) বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তার পরপরই ঘোষণা করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ
أجل لكم ما وراء الكم أن تبتوا بأموالكم محصنين غير
مسافحين–
উল্লিখিত নারীগণ ব্যতীত অন্য সকলকে মহরের মাধ্যমে বিবাহ করতে চাওয়া তোমাদের জন্য হালাল করা হলো, অবৈধ যৌন সম্পর্কের জন্য নয়।–সূরা আন নিসা : ২৪
অর্থাৎ মুহাররামত ছাড়া অন্য নারীগণ চারটি শর্তে বিবাহ বৈধ।
প্রথম শর্ত, নারী-পুরুষ উভয় পক্ষ থেকে ঈজাব ও কবুল (স্বীকৃতি) থাকতে হবে। কুরআনের বাক্য–
1 3 1 দ্বারা সেকথাই বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় শর্ত, অর্থ ব্যয় করতে হবে-যাকে বিবাহের মহর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কুরআনের আয়াত :<j;L শব্দ দ্বারা সেটিই বুঝানো হয়েছে।
তৃতীয় শর্ত হল, নারীকে বৈধভাবে অধিকার করার ইচ্ছা থাকতে হবে যাতে উভয়ের মান-সম্মান ও চারিত্রিক ঐশ্বর্য লাভ হয়। ব্যভিচারের ন্যায় নিছক বীর্য নষ্ট করা উদ্দেশ্য হলে চলবে না, যেমনটি যেনার বেলায় হয়ে থাকে। মনের স্বাদ মিটে গেল ব্যস দুজন দু দিকে চলে গেল!
মোট কথা বিবাহের উদ্দেশ্য হতে হবে নারীকে বধু বানিয়ে রাখা এবং নারী তার কাছে পুণ্যশীলা হয়ে থাকবে। অর্থাৎ বৈবাহিক সম্বন্ধ সাময়িক তথা তাৎক্ষণিক ব্যাপার নয় যে, মাত্র কয়েক দিন বা কয়েক মাস রেখে অতঃপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কুরআনের ভাষ্য ১ ৯৭০ ৬. শব্দ ক’টি থেকে তাই বুঝা যায়।
চতুর্থ শর্ত হল, গোপন প্রণয় চলবে না। যেমন কেউ অবৈধ প্রেম-প্রণয়ে আবদ্ধ হল, অথচ তা লোকে জানে না। বরং বিবাহ সম্বন্ধের জন্য কম পক্ষে দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন নারী এ ব্যাপারে শরয়ী সাক্ষী থাকতে হবে। সাধারণ ঘোষণা ও ব্যাপক প্রচার হলে আরো উত্তম।
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে :–1, 314
তারা উপপত্নী গ্রহণকারী না হলে।
.
যৌন পবিত্রতা বিবাহের মাধ্যমে
পবিত্র কুরআনে যে ১L শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা ৬-৭ মূল ধাতু থেকে উৎপন্ন। . মানে কেল্লা বা দুর্গ। অর্থাৎ মানুষ বিবাহের মাধ্যমে যৌন পবিত্রতার দুর্গে প্রবেশ করে এবং দুশ্চরিত্রতা থেকে নিরাপদ হয় যা বিবাহের মৌলিক উদ্দেশ্য। নিছক মজা লণ্ঠনই এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য নয়।
কুরআনের ভাষ্য- : ১:ব্যক্যটি বলে দিচ্ছে যে, সচ্চরিত্রতা নামক অমূল্য জিনিসটি ছাড়া বিবাহ বিবাহই নয়। বিবাহ যেমন পুরুষদের জন্য যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার মাধ্যম, তেমনি নারীদের বিবাহের উদ্দেশ্যও পবিত্র কুরআনে মজীদে ঘোষিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন
فانكحوهن باذن اهلهن واتوهن أجورهن بالمعروف
محنت مير مساحات ولا متخذات اخدان–
সুতরাং তাদেরকে অর্থাৎ দাস-দাসীদের বিবাহ করবে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে এবং তারা ব্যভিচারিণী অথবা উপপতি গ্রহণকারিণী না হয়ে সচ্চরিত্রা হয়। তাহলে তাদেরকে তাদের মুহর ন্যায়সঙ্গতভাবে দেবে।–সূরা আন নিসা : ২৫
উপরিউক্ত আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় বলা দেয়া হয়েছে যে, বিবাহ দ্বারা নারীর উদ্দেশ্য কেবল যৌনপবিত্র জীবন যাপন করা, নিজ চরিত্র ও আচরণ উন্নত রাখা, নিজের যৌন চাহিদাকে স্বীয় স্বামীর মাধ্যমে পূর্ণ করা, ব্যভিচার, গোপন প্রনয় ও সতীত্বহানি না করা। সূরা আল মায়েদায়ও এই বিষয়ই বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন :
اليوم أحل لكم الطيبات وطعام الذين أوتوا الكتاب چل تكم وطعام چل هم والمحصنت من المؤمنات والمثمن من البنين أوتوا الكتاب من قبلكم إذا أتيتموه
مسافحين ولا ما
اجورهن محصنين غير
আজ তোমাদের জন্য সকল পবিত্র জিনিসগুলো হালাল করা হল, আর যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের খাদ্যদ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল ও তোমাদের খাদ্যদ্রব্য তাদের জন্য হালাল। আর বিশ্বাসী সচ্চরিত্রা রমণী ও তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের সচ্চরিত্রা রমণী তোমাদের জন্য হালাল করা হল, যদি তোমরা তাদের মহর প্রদান করো বিবাহের জন্য, প্রকাশ্য ব্যভিচার অথবা উপপত্নী গ্রহণের জন্য নয়।–সূরা আল মায়েদা : ৫
আলোচ্য আয়াতের প্রতিপাদ্য হলো, বিবাহের জন্য সতী-সাধ্বী নারীর সন্ধান করা কর্তব্য এবং বিবাহ সম্বন্ধ খোঁজ করার সময় নারীর সতীত্ব ও সচ্চরিত্রতার প্রতিই সর্ব প্রথম দৃষ্টি দেয়া উচিত।
আয়াতের শেষাংশে পুরুষদের যৌন সততা ও সচ্চরিত্রতা কামনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামের বক্তব্য হল, বিবাহের মাধ্যমে উভয় পক্ষের শ্লীলতা রক্ষা করতে হবে এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একে অপরকে উপভোগ করবে ও জৈবিক চাহিদা নিবারন করবে ঠিকই। কিন্তু শুধু কামতৃপ্তি ও যৌনবৃত্তিই যেনো লক্ষ্য না হয়। তাহলে পশু ও মনুষ্যত্বের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়?
.
সতীত্ব ও যৌন পবিত্রতার গুরুত্ব
ইসলাম চাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী বিবাহের মাধ্যমে যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির সুযোগ আল্লাহর সীমার মধ্যে থেকে লাভ করুক। কোন অবস্থায়ই আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করার অনুমতি নেই। নিঃসন্দেহে যৌন পবিত্রতা এমন এক মহৎ বিষয় যার বিনিময়ে দুনিয়ার সমগ্র বস্তু বিসর্জন দেয়া যায়। কিন্তু অন্য কোনো জিনিসের বিনিময়ে যৌন পবিত্রতা বিসর্জন দেয়া কখনো বৈধ হতে পারে না।
যৌন পবিত্রতা যদি বিপন্ন হয়ে পড়ে, এবং আল্লাহর সীমা লঙ্ঘনের আশংকা দেখা দেয় এবং বিবাহের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়, তখন প্রয়োজন বোধে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করা বৈধ। উদাহরণ স্বরূপ, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এতোই অবনতি ও বিষণ্ণ হয়ে পড়ে যে, একের প্রতি অন্যের ঘৃণা জন্মে এবং কেউ কারো হক আদায় করতে সক্ষম না হয়, তাহলে এমতাবস্থায় ইসলাম বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেয়। কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থেকে কিছুতেই যৌন পবিত্রতা নষ্ট করা সহ্য করে না। এ কারণেই এমন অবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি আছে, যাতে স্ত্রীও মুক্ত হয়ে গিয়ে অন্যের সাথে কোনো বিবাহ সম্পর্ক (বিবাহ) স্থাপন করতে পারে এবং স্বামীও স্বাধীন ভাবে প্রয়োজন বোধে অন্য নারীর সাথে বৈধ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। আর এরই ভিত্তিতে স্ত্রীকে খুলার অর্থাৎ স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো অধিকার প্রদান করা হয়েছে, যাতে সে অত্যাচারী স্বামীর কবলে আটকে গিয়ে অসহায় হয়ে না পড়ে। বরং সে যদি সুনিশ্চিত ভাবেই বুঝতে পারে যে, বর্তমান স্বামীর সংসারে সে আল্লাহর সীমা রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে স্বামীকে মুহরের কিয়দংশ বা সম্পূর্ণটা সোপর্দ করে তার নিকট থেকে তালাক চেয়ে বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
সতীত্ব ও যৌন পবিত্রতার গুরুত্বের কারণেই ইসলাম স্বামীকে চার মাসের অতিরিক্ত ঈলা অব্যাহত রেখে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম না করার কসম খাওয়ার অনুমতি দেয়নি। বরং স্বামী যদি চার মাস পর্যন্ত তার এই কসমের ওপর অবিচল থাকে। তবে এর পর স্ত্রীকে তার নিকট আটকে রাখার কোনো অধিকার স্বামীর নেই। কেননা, তাতে স্ত্রী যৌন চাহিদায় বাধ্য হয়ে শ্লীলতার ফানুস ছিন্ন করে স্বীয় সতীত্ব হারিয়ে যেন ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে! আর এই যৌন সতোর গুরুত্বের দরুন-ই ইসলাম একাধিক বিবাহকারীদের জোর নির্দেশ প্রদান করেছে যে, তোমরা এক স্ত্রীর প্রতি এরূপ ভাবে ঝুঁকে পড়ো না, যাতে অন্য জন ঝুলে থাকে।
মহান আল্লাহ এরশাদ বলেনঃ
قتلوا كل الميل فتذرؤها كالمعلقة.
তবে তোমরা কোন এক স্ত্রীর দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না অপর স্ত্রীকে ঝুলানো অবস্থায় রেখো না। -সূরা আন নিসা : ১২৯
হয়ত এ অবস্থায় ঝুলে থাকা স্ত্রীর জন্য আল্লাহর সীমা লঙ্ঘনের (ব্যভিচারের কারণ হবে এবং বিবাহের মহৎ উদেশ্য নিঃশেষ হয়ে যাবে। বিবাহ সম্পর্কিত যে-সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাতেও এ উদ্দেশ্যের সমর্থন মেলে। হাদীসের বক্তব্য হচ্ছে, কোন অবস্থায়ই যেন যৌন শালীনতা নষ্ট না হয়।
.
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা
বিবাহ বন্ধনের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, বৈবাহিক সম্বন্ধের মাধ্যমে নারী ও পুরুষ-উভয় শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক প্রেম ও ভালবাসা সৃষ্টি, বন্ধুত্ব ও সততার উদ্ভব, উভয় পক্ষের স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভ, যা সামষ্টিক জীবনে অগ্রগতি ও উন্নতির চাবিকাঠি। তাহযীব-তামাদুনের সাথে যে সব জিনিস সম্পৃক্ত সেগুলোকে পারস্পরিক যৌথ উদ্যোগে এগিয়ে নেয়া যায়। আর এ ভাবে তা দেশ ও সমগ্র জাতির জন্য প্রশংসার কারণ হয়। স্বয়ং বিবাহ নর-নারীর জীবনে সুখ-শান্তি ও আনন্দ বয়ে আনে। পবিত্র কোরআন মজীদে যে বর্ণনা-ভঙ্গি গ্রহণ করেছে, তা এরই বঞ্জনা মাত্র।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
ومن أيته أن خلق لكم من أنفسكم أزواجا لتشكوا إليها
وجعل بينكم مودة ورحمة .
আর আল্লাহর নির্দশনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন–তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদেরকে, যাতে, তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং এজন্য তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও দয়া-মায়া সৃষ্টি করেছেন।–সূরা আর রূম : ২১
আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ বিবাহের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বিবাহের মূল বিষয়সমূহ তুলে ধরেছেন। এরশাদ করেছেন : এ সম্বন্ধ দ্বারা প্রথম যে জিনিসটি হাসিল হয়, তা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরের দ্বারা মনের প্রশান্তি ও হৃদয়ের স্বস্তিলাভ হয় এবং একে অপরের বিপদে সাহায্যকারী হয়ে। আর যখনই হৃদয়ে অনুরাগ ও আসক্তি সৃষ্টি হয়, অন্তরে যৌন ও কামোত্তেজনা অনুভূত হয়, তখনই এক হালাল বিধানের মাধ্যমে এ যৌন চাহিদা নিবারণের জন্য একে অপরের সামনে উপস্থিত থাকে। উক্ত বিষয়টির প্রতিই অত্যন্ত নিপুন ভাষায় রাসূলে কারীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইঙ্গিত করেছেন :
إن المرأة ثقب في صورة شيطان وتدبر فیشورة شيطان إذا أحدكم أعجبثه المرأة وقع في قليه فليعود إلى امرأته قوا قعها فان ذلك برد مافی نفسه.
নিশ্চয় নারী শয়তানের ভুষণে আসে এবং শয়তানের ভূষণে চলে যায়। তোমাদের কারো যদি কোনো নারীর সৌন্দৰ্য্য অবাক করে এবং অন্তরে তা দাগ কাটে তবে সে স্বীয় স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে। কেননা তাতে পরনারীর আসক্তি অন্তর থেকে দূরীভূত হয়।–মুসলিম শরীফ
.
কামভাব বা যৌন উত্তেজনার চিকিৎসা
কামভাব বা যৌন উত্তেজনা যার প্রবল থাকে, স্বভাবতই নারীর প্রতি তার দৃষ্টি অধিক হয় এবং নারী তার রূপ-লাবণ্য দ্বারা পুরুষের সুপ্ত আবেগকে জাগিয়ে দেয়। ইসলাম এর থেকে বাঁচার উপায় উপকরণ বর্ণনা করেছে। তাই যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে যায় এবং কোনো নারীর দর্শন অন্তরে দাগ কাটে যৌন উত্তেজনার কারণ হয়, তবে এমন নাযুক মুহূর্তের জন্য রাসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এ নির্দেশ হলো, তোমরা তোমাদের স্ত্রীর কাছে চলে যাও এবং যে শুক্ৰবীর্য এই উত্তেজনার পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা সংকলন করে এসো। কেননা, ওই শুক্রবীর্য বের হয়ে যাওয়ার পর শয়তান তোমাদের মনে কুমন্ত্রণা দেয়ার শক্তি ও সাহস পাবে না। আর তোমাদেরকে পাপকাজে লিপ্ত করতে সক্ষম হবে না।
প্রখ্যাত দার্শনিক আল্লামা নদভী (র.) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন?
إنه يستحب لمن رای إمرأة فتحركت شهوته ان بات
فع شهوته وتسكن نفسه
ويجمع قلبه على ما هو يه .
কোন নারীকে দেখার কারণে যদি কোন পুরুষের যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তার কর্তব্য হচ্ছে স্বীয় স্ত্রীর সাথে সহবাস করা। কেননা, তাতে যৌন উত্তেজনা মিটে যায়, আশা ও মন শান্ত হয় এবং অন্তর যা আকাংখা করে, তা দূরীভূত হয়ে যায়।–শারহু মুসলিম
হাদীসে নারীর আসা-যাওয়াকে শয়তানের সুরত ও ভুষণ বলে আখ্যায়িত করার কারণ হলো, নারীর মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবেই এমন কিছু আকর্ষণ রাখা হয়েছে যে, স্বভাবতই পুরুষের মন নারীর প্রতি আক্বষ্ট হয়। তাই শয়তান পুরুষদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য নারীকে ব্যবহার করার সুযোগ খোঁজে। অতএব, নারীর বাইরে যাওয়া শয়তানের বাইরে যাওয়ারই নামান্তর। এতে বুঝা গেল, একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত নারীর ঘর থেকে বের হয়ে পুরুষের সমাজে চলাফেরা করা উচিত নয়।
উপরিউক্ত বিষয়টি অনুধাবন করার পর এটা সহজেই বুঝা যায় যে, ইসলাম বিবাহের যে-সব মৌল উদ্দেশ্য নিরূপণ করেছে এবং যে সব বিষয়গুলোর প্রতি স্থানে স্থানে ইঙ্গিত প্রদান করেছে, সেগুলো হাসিল করা ততক্ষণ সম্ভবপর নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত বিবাহের বৈধ স্বাভাবিক ও শরয়ী বিধি-বিধান ও পদ্ধতি অবলম্বন করা না হবে। বিবাহের যে সব পদ্ধতি ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী, তা দ্বারা বিবাহের উদ্দেশ্য হাসিল সম্ভব নয়।
.
প্রেম প্রণয় ও বিবাহ
সম্প্রতি পশ্চিমী দেশগুলো এক ধরনের প্রেম ঘটিত বিবাহ আবিষ্কার করেছে। কোন নিয়ম-নীতি অবলম্বন ছাড়াই নারী ও পুরুষ উভয়ে পারস্পরিক সমজোতার ভিত্তিতে মিলে যাচ্ছে এবং গোপনে বা প্রকাশ্যে স্বামী-স্ত্রীর রূপ ধারণ করছে। এসব প্রেমঘটিত বিবাহের উদ্দেশ্য উভয় পক্ষ আমোদ-ফুর্তি করা। যৌন পবিত্রতা, মানব বংশবৃদ্ধি ও অন্য কোনো উদ্দেশ্য এতে সক্রিয় থাকে না। অবশেষে কিছু দিনের মধ্যেই যখন উভয়ের স্বাদ আহ্লাদ মিটে যাচ্ছে, তখন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন জুড়ির সন্ধানে আত্মনিয়োগ করছে। এইভাবে এক চক্র আবর্তিত হচ্ছে। কোথাও কারো সাথে এই সম্পর্ক বিবাহের মাধ্যমে স্থায়ী করার কোনো প্রয়াস চালানো হয় না। মানুষ দ্রুত প্রবণ ও চঞ্চল স্বভাবের। কাজেই কোন প্রেমঘটিত বিবাহের সময়সীমা বেশী দিন দীর্ঘায়িত হয় না। আর এভাবে বিবাহের লক্ষ উদ্দেশ্য পণ্ড হয়ে যায়।
এছাড়া এই সাময়িক ও দুর্বল সম্পর্কের দরুন স্বামী ও স্ত্রী কারো মধ্যেই সন্তান লালন-পালনের যোগ্যতা সৃষ্টি হয় না। প্রত্যেকেই নিজকে স্বাধীন ভাবতে আগ্রহী। সন্তান-সন্ততির বোঝা বহন করতে কেউই চায় না। ফলে উভয়ের মধ্যে কারোই একাগ্রতা ও এককেন্দ্রিকতা হাসিল হয় না। বলা যেতে পারে, এটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কেননা, নারীরা আজকাল অপারেশনের মাধ্যমে স্বীয় জরায়ু কেটে নেয়, যাতে সেখানে পর্যন্ত বীর্য পৌঁছে সন্তান গর্ভধারণ করতে না পারে। আর এরই ফল স্বরূপ নারীরা এখন রাস্তাঘাটে স্বীয় সতীত্ব লুটিয়ে দিচ্ছে। কেননা এরপর এখন তাদের আর কোনো গর্ভধারণের আশঙ্কা অবশিষ্ট থাকে না।
.
ইসলামী শরীয়তে যৌন পবিত্রতার গুরুত্বারোপ
যৌন পবিত্রতাই ইসলাম বিবাহের মূল লক্ষ্যবস্তু নিরূপণ করেছে। এ কথা সে কোথাও ভুলে যায়নি। কোরআন পাক স্বীয় সাবলীল ভাষায় বহু স্থানে যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে এবং মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে বিবাহের উৎসাহ জুগিয়েছে। এক স্থানে যৌন পবিত্রতা ও চারিত্রিক সততা রক্ষার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন
والمحافظين فروجهن والحفظت والذاكرين الله كثيرا
والا كرات أعد الله لهم مغفرة وأجرا عظيما.
যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারিণী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারিণী নারী-এদের জন্য রয়েছে আল্লাহ নিকট ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।–সূরা আল আহযাব : ৩৫
আলোচ্য আয়াতে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যারা যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণ করেন, আমল চরিত্র নিষ্কলুষ রাখেন, আল্লাহর সীমার মধ্যে থেকে যৌন চাহিদা পূর্ণ করেন, আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন থেকে নিজেকে আত্মরক্ষা করেন, তাঁদের জন্য রয়েছে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমার ঐশ্বর্য ও মহা প্রতিদানের অক্ষয় নিয়ামত।
.
সুসংবাদ পূর্ণ সাফল্যে লাভের
মহান আল্লাহ অন্য এক আয়াতে যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য পূর্ণ সাফল্যের সুসংবাদ দান করেছে। আল্লাহ তা’আলা যে-সব মুসলমানকে পূর্ণ সাফল্যের আনন্দময় সুখবর শুনিয়েছেন তাদের মধ্যে যারা যৌনাঙ্গকে সংযত রেখেছে তাদেরকেও শামিল করেছেন।
আল্লাহর ঘোষনা করেন :
والذين هم لفروجهم حفظون . إلا على أژواجهم أوما مكث ايمانهم فإنهم ير ملومين . ومن ابتغى وراء ذالك فأولئك هم العادون .
আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে হিফাজত বা সংযত রাখে। তবে নিজেদের স্ত্রী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে অন্যথা করলে তারা নিন্দনীয় হবে না। এবং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমা লঙ্ঘনকারী।–সূরা আল মুমিনুন ও ৫-৭
যৌন চাহিদা পূরণের জন্য আল্লাহ পাক দুটি বৈধস্থান নির্ধারণ করেছেন প্রথম, বিবাহিতা স্ত্রী। দ্বিতীয়, ক্রীতদাসী। এ দুটি স্থান ছাড়া মানুষ যৌন ক্ষুধা মিটানোর যে পথ অবলম্বন করবে, তা ইসলামী বিধানে আল্লাহর সীমা লঙ্ন বলে বিবেচিত হবে।
.
যৌন পবিত্রতা নবুওত ও রিসালাতের অঙ্গ স্বরূপ
বলাবহুল্য যৌন পবিত্রতা এতোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তা নুকূওত ও রিসালাতের অঙ্গ স্বরূপ। আল্লাহ পাক নবী ও রসূলদের ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়টি বড় গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর কোন মনোনীত বান্দাহর বিরুদ্ধে অসৎ চরিত্রের অপবাদ দেয়া হলে আল্লাহ তা নিজেই খণ্ডন করে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন।
সাইয়্যেদেনা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের আলোচনা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর ওপর আজীজ মিসরের স্ত্রী যুলায়খা তার প্রেমে আসক্ত হলেন এবং হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের পবিত্র চরিত্র অপবিত্র করতে চাইলেন। কিন্তু মহান রাব্বল ইয্যত তাঁর সহায় হলেন এবং এই অতি সঙ্কটপূর্ণ সময়ে তাকে উদ্ধার করলেন। প্রথম দিকে লজ্জা নিবারণ হেতু যুলায়খা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ইউসুফ আলাইহিস সালামকেই অভিযুক্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি নিজেই হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে নির্দোষ বলে জন সম্মুখে ঘোষণা দেন।
মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে কোরআন ঘোষণা করছে।
ولقد راودته عن نفسه قاشتم
আর সত্যই আমি ইউসুফ থেকে অসৎ কর্ম কামনা করেছি। কিন্তু ইউসুফ নিজেকে পবিত্র রেখেছে।–সূরা ইউসুফ : ৩২।
মহামহিম আল্লাহ তা’আলা হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে নির্দোষ ঘোষণার পর মহাগ্রন্থ আল কুরআনেই তার কারণ উল্লেখ করে বলেছেন:
اتشرف عثه الشؤء والفحشاء إنه مث اونا المخلصين .
তাকে (ইউসুফ) মন্দকর্ম ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য। সেতো ছিল আমার সত্যিকার বান্দাহদের শামিল।–সূরা ইউসুফ : ২৪
সাইয়্যেদেন হযরত ইয়াহইয়া (আঃ)-এর প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা বলেন :
وسيدا وحضورا وبيا من المحليين .
সে হবে নেতা, জিতেন্দ্রিয় এবং পূণ্যবানদের মধ্যে নবী।–সূরা আলে-ইমরান ও ৩৯
বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যে তার কর্মশক্তিকে নিজ আয়ত্তে রাখতে পারেন এবং প্রবৃত্তির ধোঁকায় লিপ্ত না হয়।
হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাতা মরইয়াম আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে ইয়াহুদীরা অপবাদ রটালে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল ইয্যত তা খণ্ডন করে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন :
ومريم ابنت مثيران التي أحصنت فرجها.
ইমরান কন্যা মারইয়াম সে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল।–সূরা আত-তাহরীম : ১২
কুরআনের অন্য একস্থানে বলা হয়েছেঃ
والتي أحصنت فرجها فنفخنا فيها بين ژوچنا.
আর সেই নারী–যে আপন সতীত্বকে রক্ষা করেছিল, অতঃপর তার মধ্যে আমি আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম। -সূরা আল আম্বিয়া : ৯১
স্বয়ং রাসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিবারবর্গ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন :
أول موؤن مما يقولون لهم مره ور ژ گریم۔
লোকেরা তাদের সম্বন্ধে যা বলে, তারা তা হতে পাক-পবিত্র। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা। -সূরা আন নূর ও ২৬
নবী-রাসূল ও তাঁদের পরিবারবর্গের যৌন পবিত্রতার কথা আল্লাহ রব্বুল ইযযত কোরআন মজীদে কতো দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন। এতেই প্রতীয়মান হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে সচ্চরিত্রতা ও যৌন পবিত্রতা কত বড় আবশ্যকীয় গুণ, যাকে এক মুহূর্তের জন্যও উপেক্ষা করা চলে না।
.
সচ্চরিত্রের মহত্ব ও মর্যাদা
সূরা আন নূরের একস্থানে সচ্চরিত্রের মর্যাদা প্রসঙ্গে কোরআনে বলা হয়েছে :
يثيثين والخبيثون للخبيثات والطيبت
الخيي الطيبين والطيبون إلطنت .
দুশ্চরিত্রা নারী দুচ্চরিত্র পুরুষের জন্য, দুচ্চরিত্র পুরুষ দুচ্চরিত্রা নারীর জন্য, সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং পবিত্র পুরুষ পবিত্র নারীর জন্য।–সূরা আন নূর : ২৬
দুচ্চরিত্র ব্যক্তি সচ্চরিত্রের চেয়ে মর্যাদার ক্ষেত্রে হীনতর। এ দুয়ের মধ্যে মিল হয় না। দুশ্চরিত্র পুরুষ ও দুশ্চরিত্রা নারী সম শ্রেণীর এবং সচ্চরিত্র পুরুষ ও সচ্চরিত্রা নারীর মর্যাদা উচ্চ মর্যাদার।
মহান আল্লাহ রব্বুল ইযযত বান্দাদের যেখানে গুণ বর্ণনা করেছেন, সেখানে একথাও বলেছেন যে, সৎ বান্দাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, তারা ব্যভিচারী হয় না। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন :
والذين يدعون مع الله إلها أخر ولا يقتلون النفس التي
حرم الله إلا بالحق ولا يرثون–
আর (সচ্চরিত্র তারা) যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে শরীক করে না, আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাদের হত্যা করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না।–সূরা আল ফুরকান : ৬
আলোচ্য আয়াতে কারীমা থেকে জানা গেল যে, যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতা ব্যক্তির এমন একটি সদ গুণ, যা ইযযত-সম্মান ও আমল-আখলাকের প্রাণস্বরূপ। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বানালে তাওহীদের মূল ছিন্ন ও মানুষ মুশরিক হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডে মানুষের পার্থিক জীবন শেষ হয়ে যায়। আর যৌন ব্যভিচার মানুষের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করে ইযযত-সম্মান চিরতরের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
.
নারীদের নিকট থেকে সতীত্ব রক্ষার বায়’আত
মুসলিম রমণীকুলের নিকট থেকে যে সব বিষয়ের উপর বায়’আত গ্রহণের নির্দেশ ছিলো, তন্মধ্যে একটি হল তারা ব্যভিচার করবে না এবং স্বীয় সতীত্বের শ্বেতাঞ্চলকে কখনো কলঙ্কিত করবে না। যেমন পূর্বে এ আয়াতটি উল্লেখ করা হয়েছে : আল্লাহ ঘোষণা করেন
ولا يژنين ولا يقلن أولادهن ولا يأتين ببهتان يفترينه
بين ايديه وارجلهث .
এবং তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আর কারো বিরুদ্ধে মনগড়া মিথ্যা অপবাদ দেবে না।–সূরা আল মুমতাহানা : ১২
কোন কোন মুফাসসির লিখেছেন, আয়াতে সন্তান হত্যার মানে গর্ভপাত ঘটানো। সাধারণত ব্যভিচারের ফলে যে গর্ভসঞ্চার হয়, তাকেই হত্যা করা হয়।
জাহেলী যুগে অবশ্য আরবের কোনো কোন গোত্রে সন্তান হত্যারও প্রচলন ছিল। এ আয়াতের উদ্দেশ্য তারাও। আর মিথ্যা অপবাদ দেয়ার অর্থ একাধিক পুরুষের সাথে কামলীলা উপভোগ করে কাউকে যদুচ্ছ অভিযুক্ত করা যে, এটি অমুকের সন্তান। উপরে উল্লিখিত হয়েছে তৎকালীন আরবে বিবাহের একটি পদ্ধতি এটাও ছিল যে, একজন স্ত্রীলোক একাধিক পুরুষের সাথে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতো এবং সন্তান ভূমিষ্ট হলে স্ত্রীলোকটি যার সন্তান বলে মত প্রকাশ করতো, তাকেই তা মেনে নিতে হতো। জাহেলী যুগে কোন কোন স্ত্রীলোক অপরের ব্যভিচারের সন্তানকে স্বামীর ঔরসে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবী করত।–সীরাতুনন্নবী
.
যৌন পবিত্রতা সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ (ছ) এর বাণী
যৌনাঙ্গ হিফাজত সম্পর্কে হাদীস শরীফেও বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্নভাবে মানবজাতিকে যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার উপদেশ দিয়েছেন এবং যৌন পবিত্রতার এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, যা সচ্চরিত্রতা ও মান-সম্ভ্রমের প্রাণস্বরূপ।
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমানঃ
ياشباب قريش إحفظوا فروجهم لا تزنوا الا من حفظ فرجه
قله الج
হে কোরাইশের যুবকরা! তোমরা তোমাদের যৌনাঙ্গকে হিফাযত করো। ব্যভিচার করো। শোন, যে ব্যক্তি তার যৌনাঙ্গকে সংযত রাখবে, সে জান্নাত লাভ করবে।–মিফতাহুল খিতাবাহ
আলোচ্য হাদীসে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরাইশের যুবকদের যৌন পবিত্রতার সীমা না ভেঙ্গে সৎ জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ এটিই মুক্তির পথ ও পন্থা।
.
যৌন পবিত্রতা প্রচার ও প্রসার
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষা সম্পর্কে কোরাইশ সরদার আবু সুফিয়ানকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যদিও হিরাক্লিয়াস তখন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেন নি?
يامرنا پالشدة والشقق والوقافي والتركة.
তিনি আমাদের নামায পড়তে, দান-সদকা দিতে, যৌন পবিত্রতা অবলম্বন করতে এবং রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়তা ছিন্ন না করতে আদেশ দিয়ে থাকেন।–বুখারী। পরিচ্ছেদ : স্বামী থাকা অবস্থায় কোন মহিলার আপন মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা।
সতীত্ব, যৌন পবিত্রতা ও পুণ্যশীলতা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম দিন থেকেই তার প্রচার শুধু করেন। একটি মুহূর্তের জন্য তিনি তা ভুলেন নি।
.
যৌন পবিত্র ব্যক্তির ওপর আরশের ছায়া
একদা নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা সাত ব্যক্তিকে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন। যখন আরশের ছায়া ছাড়া যখন অন্য কোন ছায়া অবশিষ্ট থাকবে না, তাঁদের মধ্যে একজন সেই ব্যক্তি হবে, দুনিয়াতে যাকে সম্ভান্ত বংশের এক রূপসী নারী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) তার প্রতি আহ্বান করে, আর তিনি ব্যভিচারের সুযোগ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন : .
আমি মহান আল্লাহকে ভয় করি।–বুখারী
.
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছ) এর যৌন পবিত্রতা প্রার্থনা
এতো ছিলো সাহাবা কিরাম (রাঃ) এর অবস্থা! স্বয়ং রাসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–যিনি ছিলেন নিষ্পাপ যার পূর্বের ও পরের সব ত্রুটি ক্ষমা করা হয়েছে ও সর্বশেষ রাসূল-এক মুহূর্তের তরেও যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার কথা ভুলতেন না। তিনি অনবরত অন্যান্য বিষয়ের সাথে যৌন পবিত্রতা প্রার্থনা করতেন। কখনো প্রার্থনা করতেন?
রাসূলের ভাষায়–
اللهم اني اسئلك الهدى والتقى والعفاف والغئی ۔
প্রভু হে : আমি তোমার কাছে সৎপথ, সংযম পবিত্রতা ও অভাবমুক্তি প্রার্থনা করছি। -মুসলিম
কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রার্থনার ভাষা হতো নিম্ন রূপঃ
البيئة والبيئة والأمانة وحسن الخلق
اللهم إني است والرضا بالقدر—
প্রভু হেঃ আমি তোমার কাছে সুস্বাস্থ্য, যৌন পবিত্রতা, আমানতদারী, উত্তম চরিত্র ও তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার প্রার্থনা করছি।-মিশকাত, অনুচ্ছেদ ও আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া
সময় সময় অন্তরের অন্তহল থেকে এমন শব্দ উচ্চারিত হতো যা আরশ-ই-মুআল্লা পর্যন্ত পৌঁছে যেত।
اللهم ألهمني شوی وای
من نفسي–
প্রভু হে! আমাকে সৎপথে চলার তাওফীক দাও এবং নফসের বেখেয়ালী থেকে তোমার আশ্রয় দান করো।-তিরমিযী, মিশকাত
কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র যবানে প্রার্থনামূলক দোয়াও করতেন তা :
منكرات الاخلاق والاعمال و
اللهم إي
প্রভু হে! খারাপ স্বভাব, খারাপ কাজ ও খারাপ বাসনা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। -তিরমিযী
নিষ্পাপ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব করুণ প্রার্থনা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আল্লাহর ভয়ে তিনি কতো বেশী ভীত ছিলেন এবং যৌন পবিত্রতা ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতার প্রতি তাঁর রকম আকুতি ছিল। তিনি অন্যান্য বিষয়ের মতো নৈতিক চরিত্রের কথাও অবিরাম স্মরণ রাখতেন।
এতোসব আবেগজড়িত প্রার্থনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য কি শিক্ষাণীয় কিছুই নেই? যদি। থেকে থাকে, আর কাছে তো বটেই, তাহলে এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং যৌন পবিত্রতার গুরুত্ব অনুধাবন করা সকলেরই কর্তব্য।
.
ব্যভিচারীর ওপর আল্লাহর শাস্তি
ইসলামের আবির্ভাবই ঘটেছিল দুনিয়া থেকে, কুলষতাও ফিতনা-ফাসাদ দূর করে মানব জাতিকে নীতি-নৈতিকতা ও সচ্চরিতার শিক্ষা দিতে। যে-সব ব্যক্তি নৈতিক চরিত্র ও আমল-আখলাকের চেহারা কলঙ্কিত করছে, রব্বুল আলামীন তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে বীভৎস যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। দুনিয়ার শাস্তির কথা যথাস্থানে সবিস্তার আলোচিত হবে। এখানে আখিরাতের শাস্তির কথা কিঞ্চিৎ তুলে ধরা হল।
মেরাজের রাতে যখন রসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাপী ও গুনাহগারদের আযাব ও শাস্তির আলামাত দেখান হয়েছিল, তখন তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেনঃ
প্রজ্জলিত উনুন। তন্মধ্যে চিৎকার ও কান্নার উচ্চরোল। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লালাম উঁকি দিয়ে দেখলেন, ঘটনা কি? রাসূলুল্লাহু ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : আমি দেখে আশ্চার্যান্বিত হলাম, আগুনের ওই জ্বলন্ত উনুনে নারী-পুরুষের এক বৃহত দল। তাদের নিচের দিক থেকে অগ্নিশিখা পজ্জলিত হচ্ছে। অগ্নিশিখার আলিঙ্গনের সাথে সাথে তাদের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সবাই হাউমাউ করে ডুকরে কাঁদছে। রাসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন : আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এসব কারা? জবাবে বলা হল, এরা ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীর দল! এরা দুনিয়ায় যেনা ব্যভিচারে লিপ্ত ছিল।-রিয়াদুস সালেহীন।
.
ইসলামে যৌন পবিত্রতা ও একাধিক বিবাহ
ব্যভিচারের কঠোর আযাব থেকে মুক্তি ও যৌন পবিত্রতার পুরস্কার লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও
فانكحوا ماطاب لكم بين البناء مثنى وثلث وربع–
তবে বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের পছন্দ দুই, তিন অথবা চার। –সূরা আন নিসা : ৩
অর্থাৎ যৌন চাহিদা মিটাতে হবে বিবাহের মাধ্যমে। আর এ ক্ষেত্রে ইসলাম একই সময় এক ব্যক্তিকে এক থেকে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছেন। তবে সেজন্য শর্ত হচ্ছে সকল স্ত্রীর সাথে সর্ব ক্ষেত্রে সমান আচরণ করতে হবে। সব স্ত্রীর অধিকার সমানভাবে আদায় করতে হবে।
.
একাধিক বিবাহের অনুমতি
সুবিচারের শর্ত সাপেক্ষ
একাধিক বিবাহের অনুমতি কামপ্রবণ ব্যক্তিদের জন্য ইসলামের এক প্রতিষেধক ব্যবস্থা মাত্র। একাধিক বিবাহের অনুমতি প্রদানের অর্থ এই নয় যে, অহেতুক একাধিক নারীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অথবা ইসলাম অনর্থক তাদেরকে একাধিক বিবাহ করতে বাধ্য করেছে। আলোচ্য আয়াতের এ উদ্দেশ্য আদৌ নয়। কেননা এর পর পরেই ইসলাম কঠোর ভাষায় ঘোষণা করেছে:
মহান আল্লাহ এরশাদ বলেন
فان خفتم ألا تعدلوا فواحدة أو ما ملكت أيماگم ذيك اثنی
ألا تعولوا۔
অতপর যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে; এতেই পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর সম্ভাবনা। -সূরা আন নিসা : ৩
ইসলামের দুশমনরা যেখান থেকে সমালোচনা করে থাকে, তার স্কন্ধশিরা সেখান থেকেই। ইসলাম কেটে ফেলেছে। কেননা, এক ব্যক্তিকে একাধিক বিবাহ করার অনুমতি ইসলাম ঠিক তখনই দিয়েছে, যখন সাম্য ও সুবিচারের আঁচল হাতছাড়া হওয়ার আশংকা থাকে এবং সঠিক অর্থে তার একাধিক স্ত্রীর প্রয়োজনও রয়েছে! সাবধান বাণী উচ্চারণ করে কোরআন মজীদের এক স্থানে নির্দেশ দিচ্ছে?
فلا تميلوا محل الميل فتذروها كالمعلقة.
তবে তোমরা এক স্ত্রীর দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়বে না অপর স্ত্রীকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখবে না।–সূরা আন নিসা : ১২৯
.
ইসলামে সাম্য ও সুবিচার
আলোচ্য আয়াতে সুবিচারের অর্থ, নারীর যে ন্যায্য অধিকার ও পাওনা রয়েছে, তা স্বামীকে পুরোপুরিভাবে পালন করতে হবে। কেননা, এটি মানুষের মৌলিক অধিকার। যেমন স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, বাসস্থান ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করা ইত্যাদি। তবে আন্তরিক ভালবাসা ভাল লাগা এমন এক জিনিস যা মানুষের আয়ত্তাধীন নয়। এক্ষেত্রে শরীয়ত সমঅধিকার করার চেষ্টা করতে বলেছে। কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও যদি অন্তরের টান ও অন্তরের ঝোঁক-প্রবণতায় বেশকম হয়ে যায়, সেটা ধর্তব্য নয়।
وإن تضلوا وتتقوا فإن الله كان فوژا ژ ما۔
আর যদি তোমরা নিজেদেরকে সংশোধন ও সাবধা নও, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুনাময়।–সূরা আন নিসা : ১২৯
স্বেচ্ছামূলক সুবিচার সম্পর্কে প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা আবদুল মাজেদ দয়াবাদী বলেন :
এটা জরুরী নয় যে, প্রতিটি আচরণ সমান সমান করতে হবে। একজন আফ্রিকীয় স্ত্রীর অভিলাস ও অভিরুচি আমেরিকান স্ত্রীর চেয়ে ভিন্নতর হতে পারে। বিগতযৌবনা ও মধ্যবয়সী স্ত্রীর প্রয়োজন, সাধ আহ্লাদও একজন কিশোরী, যুবতী স্ত্রীর সমান হবে না। সবগুলো মেষকেই এক লাঠি দ্বারা তাড়ানো উদ্দেশ্য নয়। প্রত্যেককে যথা সম্ভব তার অভিলাশ অভিরুচি ও অবস্থা অনুসারে শান্তিতে রাখাই লক্ষ্য উদ্দেশ্য।
ফিকাহবিদগণ একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা সব স্ত্রীর সাথে সুবিচার ফরয বলে ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সুবিচারের (J+ c) ব্যাখ্যা করেছেন অনির্যাতন (1; 1:) বলে। অর্থাৎ কারো প্রতি অন্যায় ও অবিচার না করা। দুররুল মুখতারে লিখেছেন।
ظاهر الآية أنه فرض أن يقول أن لا يجوز .
আয়াতের জাহিরী অর্থ বহু শ্রীর মধ্যে সুবিচার করা ফরয অর্থাৎ অধিকার লঙঘন না করা। –দুররুল মুখতার
.
অবিচারের আশংকা থাকলে এক বিবাহে সন্তুষ্ট থাকা
কোরআনের আয়াত–121 33; 8 3 43এতে পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর সম্ভাবনা এবং পরবর্তী আয়াত
فان خفتم ألا تعدلوا فواحدة–
অর্থাৎ আর যদি আশংকা করো যে, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তবে একজনেই সন্তষ্ট থাক স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, এক বিবাহ প্রথাই ইসলামের নীতি। কিন্তু প্রয়োজন দেখা দিলেও দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবে না-ইসলাম এ নীতি সমর্থন করে না।
বরং সত্যিকার অর্থে যদি একাধিক স্ত্রীর প্রয়োজন দেখা দেয় এবং ব্যক্তি যদি মনে করে যে, দ্বিতীয় বিবাহ না করলে সে যেনা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে, এঅবস্থায় অনিবার্য প্রয়োজন মহূর্তে ইসলামের নীতি হচ্ছে, একাধিক বিবাহ করে কলুষতামুক্ত জীবন আঁকড়ে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করা। সন্দেহে নেই, এ ধরনের প্রয়োজন জীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে দেখা দেয়। মানব জীবনে এ জিনিস দুর্লভ নয়। অনেক সময় কোন ব্যক্তির স্ত্রী নিঃসন্তান হয় এবং সন্তানের স্বাভাবিক চাহিদা ও মায়া তাকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে বাধ্য করে। কখনো কারো স্ত্রী চির-রুগ্না হয়ে পড়ে, তখন দৈহিক প্রয়োজন শারীরিক চাহিদা ও রুগ্ন স্ত্রীর সেবা-যত্ন উভয় প্রয়োজনেই দ্বিতীয় বিবাহ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। কখনো ব্যক্তির যৌন-চাহিদা অত্যধিক তীব্র আকার ধারণ করে এবং স্ত্রী হয় অপেক্ষাক্বত দুর্বল। তাছাড়া দ্বিতীয় বিবাহের আরো অনেক কারণ ও প্রয়োজন থাকতে পারে।
.
একাধিক বিবাহ প্রথা ও বিরোধী পক্ষ
একাধিক বিবাহের বিষয়টি এতোই স্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে তর্ক-বিতর্কের কোন প্রয়োজনই অবশিষ্ট নেই। একাধিক বিবাহ বিরোধীরাও অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলামের একাধিক বিবাহ প্রথার যৌক্তিকতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কোনো অভিজ্ঞ ও দুরদশী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মাত্রই একাধিক বিবাহের বৈধতা অস্বীকার করতে পারে না। দুনিয়ার কোন ধর্মেই একাধিক বিবাহকে অস্বীকার করা হয় নি। বরং সবগুলোতেই তার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে ইসলাম যে-সব শর্তসাপেক্ষে একাধিক বিবাহের অনুমতি প্রদান করেছে, তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, প্রাশ্চত্য ইসলামের এই একাধিক বিবাহ আইনকে স্বীয় আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু বানিয়ে নিয়েছে। যে ইউরোপীয়দের কাছে নারী জাতির কোন মূল্যই অবশিষ্ট নেই, বরং নারীর সতীত্ব নিজেও লুটছে, অন্যের দ্বারাও লুটাচ্ছে। প্রকাশ্য, দিবালোকে রাজপথেই সবকিছু হচ্ছে। দুনিয়াবাসী দর্শন করছে ইউরোপে নর-নারীর অবাধ মেলামেশা এতো সীমা অতিক্রম করে গেছে যে, তা দেখে সেখানকারই চিন্তাশীল ব্যক্তি বর্গ একাধিক বিবাহের বৈধতা শুধু স্বীকার করে নেননি, বরং তার বৈধতা অত্যাবশ্যক বলে ঘোষণা করেছেন।
.
ইউরোপের সত্য স্বীকার
মিস মেরী স্মিথ নামের লন্ডনের এক জন স্কুল শিক্ষিকা তাঁর এক পুস্তকে লিখেছেন:
বৃটিশ আইনে যে এক বিবাহ প্রথার প্রচলন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। পুরুষের পক্ষে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি থাকা উচিত।
মেরী স্মিথের উক্ত গ্রন্থ সম্পর্কে সানডে ট্রিবিউন (দরবান-নেটাল) ২৪শে নবেম্বর, সংখ্যায় তার লন্ডনস্থ প্রতিবেদক লিখেনঃ
আমার একান্ত বিশ্বাস, বৃটেনের বর্তমান পঁচিশ বছরের ঊর্ধবয়স্ক পঁচিশ লাখ বিধবা এ গ্রন্থটি সাগ্রহে লুফে নেবে।
এমন সব উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করুন, ইসলাম একান্ত প্রয়োজন মুহূর্তে একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে, তা স্বাভাবিক আইনের কত অনুকূল এবং বাস্তব পরিস্থিতি মানুষকে ইসলামের এ আইনের যথার্থতার প্রতি কিরুপ আত্নবিশ্বাস এনে দিয়েছে।
স্কুল শিক্ষিকা মেরী স্মিথই তাঁর গ্রন্থের অন্য একস্থানে লিখেছেন:
যেহেতু বৃটেনে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে অধিক সেহেতু প্রত্যেক নারী স্বামী গ্রহণে সফলকাম হতে পারে না।
অতপর তিনি বলেন : এক স্ত্রী প্রথা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে আর এ প্রথাও কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক নয়।–নিদা-ই-হেরেম
ইংল্যান্ডে যৌন ভ্রষ্টতা প্রতিরোধকল্পে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে একাধিক বিবাহের প্রথা শুরু হয়। ১৬৫৮ সালে জনৈক ব্যক্তি যৌন ব্যভিচার ও নবজাত জারজ সন্তানের মৃত্যুবোধ কল্পে একাধিক বিবাহের সপক্ষে এক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। প্রায় একশ বছর পর ইংল্যান্ডের এক প্রভাবশালী ধর্মযাজক একাধিক বিবাহ বিষয়টি সমর্থন করে আরো একটি গ্রন্থ লিখেন। খ্যাতনামা যৌন বিশেষজ্ঞ জেমস হিল্টন যেনা ও ব্যভিচার নিরোধকল্পে একাধিক বিবাহ প্রথা অবলম্বন করার পক্ষে মতামত দেন।–ইসলাম আত্তর জিনসিয়াত।
প্রখ্যাত লেখক শোপেনহার তাঁর অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছিলেন :এক স্ত্রীতে সন্তুষ্ট থাকার লোক কোথায় আছেঃ আমি তাকে দেখতে চাই। আমরা প্রত্যেকেই একাধিক বিবাহের প্রবক্তা। কেননা, প্রত্যেক মানুষেরই একাধিক স্ত্রীর প্রয়োজন হয়, তাই পুরুষের ওপর এ ব্যাপারে কোন বাধ্য বাধকতা থাকা অনুচিত।
প্রখ্যাত যৌন বিজ্ঞান বিশারদ ক্লিচন তার পুস্তকে লিখেনঃ
ইংল্যান্ডে যদিও একাধিক বিবাহ নীতিই কার্যকর হয়েছে, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিধান এখন পর্যন্ত তার স্বীকৃতি দেয় নি। যারা এক স্বামী বা এক স্ত্রীতে আবদ্ধ হয়ে দুই অথবা তিন উপপত্নী বা উপপতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, সমাজ তাদের ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু যখনই কোন ব্যক্তি পুরুষের একাধিক বিবাহের পক্ষে মতামত ও আত্তয়াজ তোলে, তখনই সমাজ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।
.
একটি শিক্ষামূলক ঘটনা
মিসরের আল্লামা আবদুল আজীজ শাভীশ একটি শিক্ষামূলক ঘটনার উল্লেখ করেছেন :লন্ডনে স্পেনীয় এক লোকের সাথে আমার সাক্ষাতকারের সুযোগ হয়ে ছিলো। আমরা অনেক ইসলামী বিষয়ের ওপর মত বিনিময় করলাম। এক পর্যায়ে একাধিক বিবাহ প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি আফসোস করে বলে উঠলেন, আহ! আমিও যদি মুসলমান হতাম, তাহলে আরেকটি বিবাহ করে নিতাম। আমি এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন : আমার স্ত্রী আজ বিশ বছর যাবত উন্মাদিনী। তার ফলে বাধ্য হয়ে আমাকে উপপত্নী রাখতে হচ্ছে। কেননা, আমি দ্বিতীয় বিবাহ করার অনুমতি পাচ্ছি না। আমার যদি আর একটা বৈধ স্ত্রী থাকত, তাহলে তার গর্ভে আমার বৈধ সন্তান হতো। তারা আমার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকার হততা, আমার নয়নের মণি ও বিশস্ত সহচর হতো। আমি তাদের দ্বারা শান্তি ও নিরাপত্তা লাভে ধন্য হতাম।–ইসলাম আত্তর জিনসিয়াত
.
ইসলামী বিধানের বিপরীত হওয়ার পরিণামফল
ইঙ্গ ওমেন ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন সভানেত্রী মিসেস বাউসেল কলকঞ্জ ওয়াশিংটনে বেকেং কমিটির সামনে ভাষণে বলেন :
যে সব মেয়ের বয়স চৌদ্দ বছরের বেশী, আমেরিকায় তাদের সংখ্যা হচ্ছে এক কোটি বিশ লাখ। এরা সবাই অবিবাহিতা। পক্ষান্তরে অবিবাহিত যুবকের সংখ্যা হচ্ছে নব্বই লাখ মাত্র। উক্ত হিসাব মতে, ত্রিশ লাখ অবিবাহিতা মেয়ের পক্ষে স্বামী যোগাড় করা অসম্ভব। কেননা, যুদ্ধ বিগ্রহ নারী ও পুরুষের সংখ্যা সাম্য বহুলাংশে নস্যাৎ করে দিয়েছে। –যমযম, লাহোর
একটু চিন্তা করুন, এহেন ভয়াবহ অবস্থায় কি করণীয়। যদি একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয়া না হয়, তাহলে দুনিয়ার কোন শক্তি যৌন পবিত্রতা রক্ষা করতে পারবে? যদি রক্ষা পায়ও, তবু এ মহা পাপের বোঝা কে মাথা পেতে নেবে? আর এ ত্রিশ লাখ অবিবাহিতা নারীর যৌন চাহিদা বৈধ প্রন্থায় মেটানোর কিইবা পথ, এবং এদের কান্নার রোল ও বিলাপ-ধ্বনি কি কোন কাজই করবে না?
যিনি একথা লিখেছেন, সম্পূর্ণ সত্যই লিখেছেন:
মানুষ মনে করে একাধিক বিবাহ ও এক বিবাহের মধ্যে বিরোধ। কিন্তু এটা নিতান্তই ভুল। আসলে বিরোধ হচ্ছে সীমিত একাধিক বিবাহ ও অসীম ব্যভিচারের মধ্যে। ইসলাম অবাধ ব্যভিচারের পথ বন্ধ করতে কতকগুলো কঠিন শর্তসাপেক্ষে সীমিত একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু যারা শুধুমাত্র এক বিবাহের প্রবক্তা, তাদের নিকট অবাধ ব্যভিচার রোধ করার কোন প্রতিষেধক নেই। আর এ কারণেই তো তারা একাধিক বিবাহের বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেও এক স্ত্রীওয়ালা স্বামীকে অন্যত্র যৌন চাহিদা মিটাতে বারণ করতে পারছে না।
.
হিন্দুধর্মের অনুসারীদের সত্য স্বীকার
এ তো ছিল পাশ্চাত্যের সত্য স্বীকারোক্তি। এখন হিন্দুধর্মের অনুসারীদের কথা শুনুন।
মাদ্রাজ হিন্দু মহাসভা হিন্দু কমিটির কাছে যে স্মারকলিপি দিয়েছে তাতে প্রথম বারের মত হিন্দু সমাজের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক বিবাহের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়। অর্থাৎ হিন্দু সমাজকে কোনো কোন সময় এমন পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হয়, যখন একজন পুরুষের একাধিক নারীকে বিবাহ করার অনুমতি থাকা উচিত।–যমযম
ইসলাম যৌন পবিত্রতার জন্য যে আইন নির্মাণ করেছে, এ আইনের ওপর আমল করলেই ইযযত-আবরু ও যৌন পবিত্রতা হাসিল হতে পারে ভিন্ন কোন পথ নেই। আর সে রাজপথ হচ্ছে, স্বীয় পসন্দনীয় কোন নারীকে বিবাহ করা-একজন, প্রয়োজনবোধে দু’জন, তিনজন, এমন কি চার জন নারীকে বিবাহ করার অনুমতি আছে। অবশ্য তা সুবিচার ও সমতা বিধানের অনিবার্য শর্তসাপেক্ষে হতে হবে।
.
একাধিক বিবাহে সমতা রক্ষা
কোন কোন বিষয়ে সুবিচার ও সমঅধিকার আবশ্যক, নারীর অধিকার অনুচ্ছেদে তার কিছুটা বর্ণনা দেয়া হবে। এখানেও কিছুটা আলোকপাত করা হল। যদি ঘটনাক্রমে একাধিক স্ত্রী গ্রহণে বাধ্য করে, তাহলে তা করে ফেলতে হবে। তবু লাম্পট্য ও ব্যভিচারের ধৃষ্টতা পরিদর্শন করা কিছুতেই চলবে না। আর একাধিক বিবাহ করতে হলে সকল স্ত্রীর সাথে সুবিচার ও সমতা বিধানের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে। কিছুতেই এর বিপরীত করা চলবে না।
আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন :
فإن فتم أن لاتقولوا فواحدة—
আর তোমরা যদি আশংকা করো স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে বিবাহ করবে। -সূরা আন নিসা : ৩
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
إذا كانت عند الرجل امرأتان فلم يعدل بينهما جاء يوم
القيامة وشقه ساقط.
যখন কোন ব্যক্তির দুজন স্ত্রী থাকে এবং সে তার দুই স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার ও সাম্য বিধান করবে না, সে কিয়ামতের দিন এক অঙ্গহীন অবস্থায় উত্থিত হবে।–তিরমিযী, মিশকাত।
এর উদ্দেশ্য এই যে, একাধিক স্ত্রী থাকা অবস্থায় সকল স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার ও সমতা বিধানের প্রতি পুরাপুরি লক্ষ্য রাখতে হবে। এর বিপরীত করলে আল্লাহ্ রব্বুল ইযযত স্বামীকে কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন। আর কিয়ামতের দিন তার এই বে-ইনসাফীর নিদর্শন হবে সকল সৃষ্টিকুলের সামনে বিকালাঙ্গ অবস্থায় তার উপস্থিত হওয়া। যে ব্যক্তি তার স্ত্রীদের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ না করবে, এটা হবে তাকে দন্ডদানের একটি উপায়, মাত্র।
.
ইচ্ছাধীন ব্যাপারে সুবিচার
যে-সমস্ত বিষয় মানুষের ইচ্ছাধীন, সে-সব ক্ষেত্রেই কেবল সুবিচার ও সমতা প্রযোজ্য, যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা উপরে আলোচনা হয়েছে। তবে যেসব বিষয় মানুষের ইচ্ছা বা আয়ত্তাধীন নয়, তাতেও সুবিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। হ্যাঁ, চেষ্টার বাইরে কিছু ধর্তব্য নয়। মহান আল্লাহর নিকট সে ক্রটির জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। যেমন, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন : রাসূলল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় সহধর্মিণীদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারায় সমতা রক্ষা করতেন এবং বলতেন?
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষায়
اللهم هذا قسمي فيما أملك فلا تلمني فيما تملك ولا
اميك–
হে পরওয়ারদেগার! আমি আমার শক্তি অনুসারে পালা বন্টন করলাম। সুতরাং যাতে শুধু মাত্র তোমারই ইখতিয়ার রয়েছে, আমার ইখতিয়ার নেই, তাতে তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করো না।–তিরমিযী, মিশকাত, অনুচ্ছেদ ও স্ত্রীদের মধ্যে পালা বন্টন।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিজের ঘটনা। তিনি হযরত উরওয়াহ (রাঃ) কে বলেলেন : হে আমার বোনের নয়নমণি! রাসূলল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্যে যখন পালা নির্ধারণ করতেন, তখন তিনি কাউকে কারো উপর প্রাধান্য দিতেন না। বরং সবার প্রতি সুবিচার ও সমতা রক্ষা করা হতো। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই ঘটত যে, আমাদের প্রত্যেকের সাথে তিনি দেখা সাক্ষাত করলেও রাতে তিনি তাঁর ঘরেই অবস্থান করতেন, যে স্ত্রীর পালা পড়ত। এক স্ত্রীর পালার দিন অন্য স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করতেন না। -আহমদ ও আবূ দাউদ
.
মৃত্য-শয্যায় রাসূল (ছঃ) এর সুবিচার
মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সহধর্মিণীদের সাথে আসর নামাযের পর দেখা-সাক্ষাত করতেন।
كان يشال في مرضه الذي مات فيهأين أنا ما”–
মৃত্যু শয্যায়ও তিনি জিজ্ঞাসা করতেন যে, আগামী কাল আমার পালা কোথায়? -বুলুগুল মুরাম
.
অন্তরঙ্গ করার জন্য নববধূর প্রতি অনুগ্রহ
দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে দেখতে হবে নববধূ কুমারী (বাকেরা) না বিবাহিতা। যদি দ্বিতীয় স্ত্রী কুমারী হয়, তবে তার কাছে সাতরাত অবস্থান করতে হবে। অতঃপর নতুন করে পালা বন্টন আরম্ভ হবে। আর যদি দ্বিতীয় স্ত্রী পূর্বে বিবাহিতা হয়ে থাকে, তবে তার কাছে তিনরাত অবস্থান করতে হবে। তারপর পালা বন্টন করতে হবে। অর্থাৎ স্বামীর সাথে পরিচিত ও অন্তরঙ্গ হওয়ার লক্ষ্যে কুমারী নববধূর জন্য সাত দিন নির্ধারণ করা হয়েছে, কারণ তারা লাজুক। আর বিবাহিতার জন্য তিন দিন। এ দিনগুলো হিসাবে ধর্তব্য হবে না।
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, সুন্নাত হচ্ছে?
إذا تزوج الرجل البر على الثيب أقام عندها سبعاثم
قشم وإذا تزوج الثيب أقام عندها ثلاثا ثم قشم. متفق عليه.
কোন পুরুষ যখন ছায়্যিবা (বিবাহিতা) স্ত্রী থাকা অবস্থায় (বাকেরা) কুমারী নারীকে বিবাহ করবে, তখন কুমারীর কাছে সাত দিন অবস্থান করে অতপর পালা বন্টন করবে। আর ছায়্যিবাকে (বিবাহিতা) বিবাহ করলে তার কাছে তিন দিন অবস্থান শেষে পালা বণ্টন করবে। -বুখারী-মুসলিম
.
স্ত্রীদের সফরে নেয়ার জন্য লটারী
সফরে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে লটারী দিতে হবে। লটারীতে যার নাম উঠবে, তাকেই সঙ্গে নিতে হবে। তাহলে বেইনসাফী হবে না এবং স্বয়ং স্ত্রীগণও তাদের সাথে বেইনসাফী করা হয়েছে বলে অভিযোগ করতে পারবেন না।
হাদীসে বর্ণিত আছেঃ
كان شول الله صلى الله عليه وسلم إذا أراد سقا قرع بين
LL 685-% ….. ২রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সফরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন, স্বীয় সহধর্মিণীদের মধ্যে লটারীর ব্যবস্থা করতেন। যার নাম লটারীতে উঠত, তিনিই তাকে সাথে নিয়ে সফরে যেতেন।
সফর শেষে বাড়ী ফেরার পর সমতা বিধান কিভাবে হবে? এ সম্বন্ধে তিনটি উক্তি রয়েছে :
এক. কোন কোন আলেমের মতে, সফরকালীন সময়ের হিসাব হবে না। সফর শেষে বাড়ী াের পর নতুনভাবে সবার মধ্যে সমতার ভিত্তিতে পালা বন্টন করতে হবে। যে সফরসঙ্গী হল তার পালা থেকে সফরকালীন সময় কাটা যাবে না। চাই লটারীতে নাম ওঠার পর স্বামী সঙ্গে নিয়ে থাকুক, অথবা বিনা লটারীতে নাম ওঠার পর স্বামী সঙ্গে নিয়ে থাকুক, অথবা বিনা লটারীতে।
দুই. অন্য একদল আলেম বলেন, সফরের সময়কাল হিসাব হবে। যে স্ত্রী সঙ্গে গেল, তার অংশ থেকে সফরের সময় কাল কাটা যাবে। জাহিরপস্থীরা এই মত পোষণ করেন। স্ত্রী লটারীর মাধ্যমে স্বামীর সাথে গিয়ে থাকুক, অথবা বিনা লটারীতে।
তিন. অপর একদল আলেম বলেন, স্ত্রী যদি লটারীর মাধ্যমে স্বামীর সঙ্গী হয়ে থাকে, তাহলে উক্ত সফরকালীন সময় তার নির্ধারিত পালা থেকে কাটা যাবে না। আর স্বামী যদি বিনা লটারীতে কোনো স্ত্রীকে নিজের ইচ্ছা মাফিক সঙ্গে নিয়ে থাকেন, তাহলে সফরকালীন সময় হিসাবে ধর্তব্য হবে। এটা হচ্ছে ইমাম আহমদ (রঃ) ও ইমাম শাফিয়ী (রঃ)-এর অভিমত। -যাদুল মা’আদ
.
নিজ পালা অপরকে দান এবং সাক্ষাতের ইখতিয়ার
ইচ্ছা করলে কোন স্ত্রী তার পালা তার অন্য সতীনকে দান করতে পারে। তখন স্বামীকে উক্ত পালা দানকারিণী স্ত্রীর পালাটি যাকে দান করা হয়েছে, তার কাছে কাটাতে পারবেন। তবে কোন স্ত্রী যদি তার পালা স্বামীকে দান করে, তবে স্বামী ইচ্ছাধীন যার কাছে ইচ্ছা ওই দিনগুলো কাটাতে পারেন।
স্ত্রীদের সাথে দেখা-সাক্ষাত ও আলাপ-আলোচনার স্বাধীনতা আছে। অর্থাৎ পালা যারই হোক, স্বামী সবার সাথেই দেখা-সাক্ষাত করতে পারেন এবং সকলকে একত্র করেও আলাপ আলোচনা করতে পারেন। অবশ্য রাত যাপন যার পালা, তার সাথেই করতে হবে-অন্যের সাথে করা চলবে না।
এখন কথা হল স্ত্রীদের সাথে রতিকর্মেও কি সমতা বিধান করা আবশ্যক? যেহেতু রতিকর্ম প্রেম-ভালবাসা ও মনের টানের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু তাতে সমতা বিধান অসম্ভব না হলেও দুরূহ বটে। তার অর্থ এই নয় যে, ন্যায় বিচার ও সমতা রক্ষার চেষ্টাও করা হবে না। বরং এ ক্ষেত্রেও সমতা বিধানেরই চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা তদবীর সত্ত্বেও যদি মন আক্বষ্ট না হয় এবং কামভাব না জাগে, তাহলে অবশ্য ক্ষমার যোগ্য বিবেচিত হবে। আর মনের বাসনা ও হৃদয়ের আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও ত্যাগ করতে চাইলে তার আদৌ কোন অনুমতি নেই। কেননা এটা ইচ্ছাকৃত অধিকার লঙ্ঘন ও বেইনসাফী।–যাদুল মা’আদ
.
স্ত্রীর সন্তুষ্টি
ভরণ পোষনের ক্ষেত্রেও স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করতে হবে। স্ত্রীদের মধ্যে সবরকম সমতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদেরকে সর্বভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হবে।
ইসলাম মিথ্যাকে নিকৃষ্টতম মহাপাপ বলে অভিহিত করেছে এবং কোন এক মুহূর্তের জন্যেও তা সহ্য করে না, কিন্তু স্ত্রীদের মনস্তুষ্টি মানসে প্রয়োজনবোধে মিথ্যা বলারও অনুমতি প্রদান হয়েছে।
হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) বর্ণনা করেন।
عليه وسلم يرخص فی شیئ
الم اسمعه النبی صلی الله
مايقول الناس إلا في ثلث الحرب والإصج بين الناس
وحديث الرجل امراته والمرأة زوجها.
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি বিষয় ছাড়া আর কোথাও মিথ্যার অনুমতি দেননি। উত্ত তিনটি বিষয় হল-যুদ্ধ ক্ষেত্রে, আপোস-মীমাংসার ক্ষেত্রে এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কথাবার্তা ক্ষেত্রে।
.
সমতা রক্ষা না করার পরিণাম
অন্যায়ভাবে স্ত্রীর ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে তার মন ভেঙে দেয়া এবং তার কোমল মতি হৃদয়ে আঘাত হানা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা এমন এক শিক্ষা, যা জীবন-যাত্রায় সব সময় স্মরণ রাখা অত্যাবশ্যক। যারা একই সময় একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে ইসলামের এ মূলনীতি মান্য করে চলে না, তাদের যিন্দেগী যন্ত্রণাদায়ক আযাবে পতিত হয়।
স্ত্রীদের কারণে আবাসগৃহ অশান্তি ও ঝগড়া-বিবাদের আখড়ায় পরিণত হয়। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস নসীব হয় না। স্বামীর প্রভাব-প্রতিপত্তি নিঃশেষ করে দেয়। ইযত-সম্মানের হানি হয়। তার সামাজিক মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। তার স্ত্রীদের অবস্থাও একই রকম দাঁড়ায়। এ পরিস্থিতির এখানেই শেষ নয়। স্ত্রীরা নিজ নিজ সন্তানদের অন্য মায়ের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দেয়। খোদ পিতার পক্ষ থেকেও ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা চলতে থাকে। ফলে শেষ পর্যন্ত সুখ-শান্তি তিরোহিত হয়ে একটি পরিবার জাহান্নামের রূপ লাভ করে।
এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যদি সকল স্ত্রীর অধিকারের প্রতি সমান লক্ষ্য না রাখা হয় এবং স্বামী এক স্ত্রীর দিকে অধিকতর ঝুঁকে পড়ে দ্বিতীয় স্ত্রীকে লটকিয়ে রাখে তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রী এমন সব অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে যার নাম মুখে উচ্চারণ করাও শরমের ব্যাপার। রাজা ও নওয়াবদের বহুপত্নীর কাহিনী সুবিদিত। যৌন পবিত্রতা এমন ভাবে লুটিয়ে দেয়া হয়, যার কোনো তুলনা নেই। ইসলাম এক মুহূর্তের জন্যও তা মেনে নিতে পারে না।
.
যৌন পবিত্রতাই সকল বিধি-বিধানের মূল
এসব আলোচনার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো-মানব জাতি যৌন পবিত্রতাকে পদদলিত করবে এবং তাদের আচার-ব্যবহারের আবিলতা দুনিয়াকে দুর্গন্ধময় করবে-ইসলাম তা এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নিতে পারে না। যৌন আকর্ষণ মানুষের স্বভাব জাত প্রবৃত্তি। কিন্তু তার জন্য। আবার স্বাভাবিক পথও রচিত হয়েছে। বিবাহের বৈধ পন্থায়ই যৌন চাহিদা মিটাতে হবে। কেউ যদি একীতে সন্তুষ্ট না হয় এবং যে যুক্তিযুক্ত কারণেই হোক, সে যদি স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায় বিচার ও সমতার রক্ষার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়, তবে দু’জন স্ত্রী রাখতে পারে। দু’জনে যথেষ্ট না হলে উল্লিখিত শর্তসাপেক্ষে তিনজন। তিন জন স্ত্রীও যদি তার জীবনকে শান্তিময় না করতে পারে, তবে উল্লিখিত শর্তসাপেক্ষে চারজন স্ত্রী পর্যন্ত রাখতে পারে। অতএব কোন প্রকারেই যৌন পবিত্রতার বিধি-বিধান কলঙ্কিত করা যাবে না।
.
একই সময় চার স্ত্রীর অধিক রাখা যাবে না
একই সময় চারজন স্ত্রীর অধিক স্ত্রী রাখা যাবে না। যারা চার স্ত্রীর বেশী রাখার পক্ষে তারা প্রচলিত ধারা তথা প্রথম যুগের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে মস্তবড় যিম্মাদায়ী স্বীয় মাথায় তুলে নিচ্ছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন : গায়লান ইবনে সালমা সাকাফী যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, সে মুহূর্তে তাঁর নয়জন স্ত্রী ছিলেন। তাঁরাও ইসলাম গ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিহ ওয়া সাল্লাম বলেলেন :–
L L;এদের মধ্যে থেকে চারজনকে বেছে নাও।–ইবনে মাজা
অপর একটি রিওয়ায়েতঃ
آن ميلان بن سلمة الثقفي أشتم وله عشر نشوۃ فی الجاهلية فأشتمن معه فقال النبی صلعم أمسك آژبا وفارق ساره—
গায়লান ইবনে সালমা সাকাফী ইসলাম গ্রহণের সময় জাহিলিয়াত যুগের তার দশ স্ত্রী ছিলেন। তারা সবাই তার সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, চারজন স্ত্রী রাখো আর বাকী সকলকে পৃথক করে দাও।–আহমদ ও তিরমিযী।
হযরত কায়স ইবনে হারিস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করলাম, তখন আমার আটজন স্ত্রী ছিলো। সুতরাং আমি নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমীপে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি উত্থাপন করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
اختر منهن أربعا۔
এদের মধ্য থেকে চারজনকে গ্রহণ করো।–ইবনে মাজা।
উল্লেখিত হাদীসে ছাড়া আরো অনেক হাদীস রয়েছে। এতে বুঝা যায়, নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টত চারজনের বেশী স্ত্রী রাখার অনুমতি দেননি। জাহেলী যুগে যাদের অধীনে চারজনের অধিক স্ত্রী ছিল, ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তন্মধ্যে থেকে মাত্র চারজন রাখার অনুমতি দিয়েছেন। এছাড়া অন্যদেরকে আলাদা করে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কার্যধারা তাঁর নিজের জন্য একান্ত খাস ছিলো।
.
স্বামী স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্য
ইসলাম যেভাবে যৌন পবিত্রতা রক্ষার জন্য কতিপয় জরুরী বিধি-বিধান সাপেক্ষে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে, তবু মানব-মর্যাদার চেহারা কলঙ্কিত হতে দেয়নি; ঠিক তদ্রূপ যৌন সততা ও চরিত্র তথা আমল-আখলাকের পবিত্রতা রক্ষার জন্য মানুষকে বিবাহের ক্ষেত্রে মহামহীম আল্লাহর আইনের মধ্যে থেকে স্বীয় পছন্দসই স্বামী-স্ত্রী বাছাই করার হুকুম দিয়েছে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেঃ
فانكحوا ما طاب لكم من البناء–
তোমরা বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের পছন্দ।–সূরা আন নিসা : ৩
.
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন-অধিকার
ভালো লাগা ও পসন্দসই মেয়েকে বিবাহ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শুধু আল্লাহর বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন না করার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ সল্প সংখ্যক মেয়েকে কুরআন তথা ইসলামী শরীয়ত বিবাহ করা হারাম ঘোষণা করেছে তাদেরকে বিবাহ করা নিষেধ। এদের মধ্যে কিছু মুহরিম তথা নিকটাত্মীয় রয়েছে এবং কিছু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। এসব ব্যতীত অন্যসব নারীকে বিবাহ করা হালাল, তাদের মধ্যে নির্বাচন ও বাছাই করার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে।
পুরুষদের যেমন নারীদের মধ্য থেকে নির্বাচনের বৈধ অধিকার রয়েছে, তদ্রপ নারীদেরও ইসলাম পাত্র বাচাইয়ের বৈধ অধিকার দান করেছে। আল্লাহর আইনের মধ্যে তারা কেউই বিশেষ কোন নারী বা পুরুষকে বিবাহ করতে বাধ্য নয়। জ্ঞানী লোকমাত্রই অবগত আছেন, কয়েকটি টাকার বিনিময়ে যে জিনিসটি ক্রয় করা হয়; তাকেও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে নেয়া হয়। সুতরাং বিবাহের মত সারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি যার মাধ্যমে দুটি অজ্ঞাত ও অপরিচিত নারী-পুরুষ একটি মযবূত বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে এতে অমনোযোগী থাকা কিছুতে বুদ্ধির কাজ নয়?
ইসলাম মযলুম, নিপীড়িত মানুষের জন্য সুবিচার ও সমতার বার্তা রূপে আগমন করেছে, মযলুম ও নিরাশ্রয় মানুষের ন্যায্য অধিকার দান যার সহজাত বৃত্তি, অধিকার প্রাপ্তদের অধিকার না পাওয়া কিংবা যালেমদের যুলুমের মূলোচ্ছেদ না হওয়া কিভাবে বরদাশত করতে পারে? সুতরাং ইসলাম ও ইসলামের নবী সবরকম যুলুম-নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ ঘোষণা করেছেন। তিনি জীবনের এ ক্ষেত্রেও-যাতে দুটি অপরিচিত মানুষ মিলিত হয় সে সংস্কার সাধন করেছেন। যাতে বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে যে মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিহিত, তা সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে।
স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের নির্দেশনা ও রাসূলের হাদীস সামনে রাখলে দেখা যায়, না পুরুষ অধিকার বঞ্চিত, না নারী। যেটুকু বিধি-নিষেধ রয়েছে, তা শুধু আল্লাহর আইনের সীমার মধ্যে অবস্থান করা।
.
যুলুম-নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ
মহামহিম আল্লাহর বিধানের সীমার মধ্যে থেকে ইসলাম বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকারী নারী-পুরুষের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মতামত গ্রহণ করা সর্বদা আবশ্যক মনে করেছে। জাহেলী যুগে এক্ষেত্রে যুলুম-অত্যাচার ও অধিকার হরণ হতো। মেয়েদের ওপর তাদের অভিভাবকরা অন্যায় ভাবে চাপ প্রয়োগ করত। তাদের স্বাধীনতা হরণ করত। এমন সব পুরুষের কাছে তাদের পাত্রস্থ করতো, যাদেরকে তারা মনে-প্রাণে পছন্দ করতো না। বিশেষ ভাবে ইয়াতীম বালিকাঁদের ক্ষেত্রে জোর করে বেইনসাফী মূলক অধিকার হরণ সংঘটিত হত।
বর্বর জাহেলী যুগের ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায়, জাহেলী সমাজে নারীদের অবস্থান কত নাজুক ও নিম্নে ছিল। এদেরকে অস্থাবর সম্পত্তি মনে করা হতো। স্বামী মনে করতো, আমি মুহরের বিনিময়ে স্ত্রীকে ক্রয় করে এনেছি। তাই স্বামীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী স্ত্রীকেও নিজের মালিকানার মধ্যে অন্তরভুক্ত করত আর এভাবে আরো নানা ধরনের যুলুম-অত্যাচার চলত। ইসলাম এ যুলুম নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ করল।
.
অভিভাবকের পরামর্শ দানের অধিকার
ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বুদ্ধিমান ছেলে-মেয়ে যেরূপ দুনিয়ার অন্যান্য কাজে স্বাধীনচেতা হয়ে থাকে, তেমনি ইসলাম তাদের বিবাহের বেলায়ও আল্লাহর আইনের গণ্ডীর মধ্যে-ইখতিয়ার দান করেছে। পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটাত্ময়ীগণ জীবনের এক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সৎ পরামর্শ অবশ্যই দিতে পারেন এবং তাঁদের পরামর্শ দেয়াও একান্ত উচিত। কিন্তু তারা কোন রকম চাপ প্রয়োগ ও জবরদস্তী করতে পারেন না। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকারী দম্পতিরও উচিত স্বীয় অভিভাবকের পরামর্শ মনেপ্রাণে গ্রহণ করা। কেননা, তাদের মতামত পরিপক্ক ও স্নেহ-মমতায় আপুত ও পরিপূর্ণ। এতদ্সত্ত্বেও এ এক অনাবৃত সত্য যে, তাদের এসব পরামর্শ গ্রহণ করতে ইসলাম স্বাধীনতা দিয়েছে।
.
মহিলাদের স্বামী নির্বাচনের অধিকার প্রদান
উপমহাদেশের নারী জাতিকে যে ভাবে আমরা অসহায় ও নিরুপায়ের অভিযোগ আরোপ করি, ইসলাম তাদেরকে ততটা অসহায়ত্বের নযরে কখনো দেখেনি। প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদের মত প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদেরও এক্ষেত্রে যথাযথ অধিকারের ইখতিয়ার রয়েছে। বিবাহের ব্যাপারে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সম্মতি সর্বদা আবশ্যক গণ্য করা হয়েছে।
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন :
ثني الأم حثی تشتاژ و تثير البكر حتى تستأذن–
বিধবা নারীকে তার সম্মতি ব্যতীত বিবাহ দেয়া যাবে না, আর কুমারী নারীকে তার সম্মতি ব্যতীত বিবাহ দেয়া চলবে না।–বুখারী, অনুচ্ছেদ? পিতা এবং ওয়ালী কুমারী অথবা। বিবাহিতা মেয়েকে তাদের সম্মতি ব্যতীত বিবাহ দিতে পারেন না।
নিম্নে হাদীসটি আরো সুস্পষ্ট। নবী (ছঃ) ইরশাদ করেন :
الأيم أحق بنفسها من وليها البكر يستأذنها في نفسها
وإذا ماثها۔
বিধবা নারী তার নিজের ব্যাপারে অভিভাবক অপেক্ষা অধিক হকদার, এবং কুমারী মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় তার সম্মতি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চুপ থাকাই তার সম্মতি।–মুসলিম, অনুচ্ছেদ : বিবাহিতার সবাক অনুমতি এবং অবিবাহিতার চুপ থাকা অনুমতি।
পরবর্তী হাদীসটির ভাষা এরূপ :নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
الثيب أحق بنفسها من وليها والبر يستأذنها أبوها
বিবাহিতা নারী তার নিজের ব্যাপারে অভিভাবক অপেক্ষা অধিকতর হকদার। আর পিতা তার কুমারী মেয়ের সম্মতি নেবেন। চুপ থাকাই তার অনুমতি।–মুসলিম
উল্লেখিত এসব হাদীসে যে বাকধারা ও বাচনভঙ্গি অবলম্বন করা হয়েছে, যে সব বার্তা ও তথ্য বিবৃত হয়েছে, নিগুঢ়ভাবে চিন্তা করলেই তার তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে। রহমতের নবী নারী সমজকে বিবাহের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দান করেছেন, নাকি পরাধীনা বানিয়েছেন-উপরিউক্ত আলোচনায় তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মহান আল্লাহ রব্বুল ইস্ত যাদেরকে সামান্যতম সৎ জ্ঞান-বুদ্ধিও দান করেছেন, তারাই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ইসলাম নারী সমাজকে বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে মোটেই পরাধীন করেনি। বরং তাদের সম্মতি-সমর্থনকে অত্যাবশ্যক করেছে। নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো পুরুষের নিকট তাকে জোর করে বিবাহ দেয়া যাবে না।
.
অভিভাবকের দায়িত্ব
অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে, বালেগার সম্মতি গ্রহণ করে বিবাহের সম্পর্ক ঠিক করা। এমন কি যে পিতা তার মেয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহশীল, তাকেও তার মেয়ের সম্মতি চাইতে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর তার মেয়ের বিবাহ মেয়ের সম্মতির স্থানে হবে।
কিন্তু ইসলাম কন্যার সম্মতিকে আবশ্যক করে দিলেও তার লজ্জা শরমকে ব্যাহত হতে দেয়নি। বরং কন্যা যদি কুমারী হয়ে থাকে, তবে তার চুপ থাকাকেই সম্মতির লক্ষণ গণ্য করা হয়েছে। হ্যাঁ, যদি বিবাহিতা হয়, তবে তার স্পষ্ট অনুমতি বাঞ্ছণীয়। হুকুম চাওয়া’ ও অনুমতি প্রার্থনা’ দ্বারা সেই কথাই বুঝাননা হয়েছে। কোন কোন আলেমের মতে, কুমারী মেয়ের চুপ থাকা যে সম্মতির লক্ষণ-এ কথা মেয়েদের জানা থাকতে হবে।
.
নবী-যুগে পাত্রীর অসম্মতির কারণে বিবাহ বাতিল
মহিলা সাহাবী হযরত খাসা বিনতে হাযাম (রাঃ) এর একটি ঘটনা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হযরত খান্সার পিতা এক ব্যক্তির কাছে তাকে বিবাহ দেন। হযরত খানসার এ বিবাহ অপছন্দ হওয়ায় তিনি নবী (ছঃ) এর দরবারে নালিশ পেশ করলেন। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খান্সার আরবী মনসূর করে তাঁর পিতাপ্রদত্ত বিবাহ বাতিল করে দেন। -বুখারী
অপর ঘটনাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এক কুমারী মেয়ে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এসে বললো : আমার পিতা যার সাথে আমার বিবাহ দিয়েছেন, আমার তা মনঃপুত নয়। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে বিবাহ অটুট রাখা-না রাখার ব্যাপারে তাকে ইখতিয়ার দিলেন।–ইবনে মাজা।
.
বিবাহে পিতার জোর জবরদস্তীর অধিকার নেই
হযরত বুরাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন : এক যুবতী নারী নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে হাযির হয়ে আরজ করলো ও আমার পিতা আমাকে আমার চাচাত ভাইয়ের সাথে আমার বিবাহ দিয়েছেন, আমার তা পছন্দ নয়। নবী করীম (ছঃ) সম্পূর্ণ ঘটনা শ্রবণ করে ব্যাপারটি তার হাতে সোপর্দ করলেন এবং বললেন : ইচ্ছা করলে তুমি এ বিবাহ অটুট রাখতে পার, অথবা তা নাকচ করতে পার। স্ত্রীলোকটি এ কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল : আমার পিতা যে কাজটি করেছেন, আমি তার সম্মতি দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন প্রশ্ন করা এবং রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জওয়াব লাভের উদ্দেশ্য ছিল, সমগ্র নারী সমাজকে এ শিক্ষা দান করা যে, প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের সম্মতি ব্যতিরেকে তাকে বিবাহ দেয়ার অধিকার পিতার নেই। হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ :
ولكن أردت أن تعلم النيساء أن ليس إلى الآباء من الأمر شين
কিন্তু আমি নারী সমাজকে এই শিক্ষা পৌঁছে দিতে চাইলাম যে, বিবাহের ক্ষেত্রে বাপ-দাদার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ কন্যার সম্মতি ছাড়া বিবাহ দেয়া যাবে না। -ইবনে মাজা
হযরত আবদুর রহমান ইবনে যাঈদ ও মাজমা ইবনে যাঈদ (রাঃ) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন ও খাদ্দাম নামে পরিচিত জনৈক ব্যক্তির কাছে তাদের কন্যা বিয়ে দিলেন। কিন্তু তাদের কন্যা এ বিয়ে অপছন্দ করলো। তাই সে নবী করীম (ছঃ) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি নবী করীম (ছঃ) এর কাছে উত্থাপন করল। নবী (ছঃ) মেয়ের পিতার দেয়া বিবাহ নাকচ করে দিলেন। অতঃপর সে কন্যা আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে বিবাহ করাল।–ইবনে মাজা
প্রাপ্ত বয়স্কা নারীকে যে জোর জবরদস্তী বিয়ে দেয়া যাবে না বরং স্বামী নির্বাচনে তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে-উপরিউক্ত হাদীসসমূহ পাঠ করার পর এ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? আর এতো সব বিধি-বিধান ও ইখতিয়ারদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবাহের মূল লক্ষ্য যৌন পবিত্রতা, স্নেহ ভালোবাসা ও বংশ রক্ষার কাজটি সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হওয়া।
.
অভিভাবকের পরমার্শ দান-ক্ষমতা ও তার গুরুত্ব বিচার
অপ্রাপ্তবষ্কা মেয়েকে অবশ্য তার অনুমতি ছাড়াও অভিভাবক বিবাহ দিতে পারেন। তা পিতা হোন কিংবা অন্য কোন অভিভাবক। অবশ্য পিতার অধিকার অধিক অর্থাৎ নাবালেগা মেয়েকে পিতা বিবাহ দিলে সে প্রাপ্তবয়ষ্কা হওয়ার পর সে-বিবাহ নাকচ করতে পারবে না। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার নিজের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন : মাত্র ছয় বছর বয়সে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে আমার বিবাহ হয়।–ইবনে মাজা
যা হোক, বিবাহের ব্যাপারটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ জন্য যা কিছু করা হোক, খুব ভেবে-চিন্তে করতে হবে। ওয়ালীকেও সন্তুষ্ট হতে হবে আর যাকে বিবাহ দেবেন, তাকেও সন্তুষ্ট হতে হবে।
এখানে একটি চিন্তার ব্যাপার আছে। অতীতের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আজকের দম্পতিরা স্বীয় বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবক এমন কি মাতা-পিতার মতামত বা পরামর্শ নেয়ারও প্রয়োজনটুকু বোধ করেন না। নিঃসন্দেহে বিবাহের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ-অপছন্দের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সাথে সাথে এ কথাও ভুললে চলবে না যে, আবেগের সাথে শেরও বড় প্রয়োজন। বিবাহ যেরূপ যৌন চাহিদা মিটানোর ব্যাপার, তেমনি পরিবার, বংশ, সমাজ, দেশ ও জাতির সাথেও সম্পর্কযুক্ত। এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও প্রতিটি দুরদর্শী লোকের কর্তব্য। বিবাহের ব্যাপারে মাতা-পিতা কিংবা অভিভাবকের পরামর্শ নেয়া একান্ত কর্তব্য।
.
মতানৈক্য সৃষ্টি হলে পাত্রীর
মতামতই অগ্রাধিকার পাবে
যদি পাত্রী ও অভিভাবকের মতামতে বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে, তবে কার মতামত প্রাধান্য পাবে? এতে সন্দেহ নেই যে, এ ক্ষেত্রে পাত্রীর মতামত অগ্রাধিকার পাবে। শরীয়তের দৃষ্টিতেই পাত্রীর মতামত প্রাধান্য পাবার যোগ্য। কেননা, বিবাহ হতে যাচ্ছে পাত্রীর; যৌন পবিত্রতার সম্পর্ক এখানে পাত্রীর সাথে। অভিভাবকের বিবাহও হচ্ছে না, আর এ বিবাহ সম্পাদনের দায়-দীয়ত্বও তার নয়। সুতরাং এটা কি করে সম্ভব যে, মতানৈকের সময় ওয়ালীর মতামত প্রাধান্য পাবে, আর পাত্রীর পছন্দ-অপছন্দের কোন তোয়াক্কাই করা হবে না? তাছাড়া নবী-যুগের ফায়সালা ও ঘটনাবলীও বিদ্যমান রয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন পাত্রীর সম্মতিকে প্রাধান্য দিয়ে পিতা-প্রদত্ত বিবাহও নাকচ করে দিয়েছেন। তারপরও পাত্রীর মতের বিরুদ্ধে ফায়সালা করেন নি। একথা ইতোপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। অতঃপর কোরআন মজীদের এ আয়াতটিও সামনে রাখুন আল্লাহ বলেন
فإذا بلغن أجله فلا جناح عليكم فيما فعلن فى انفسه
بالمعروف .
যখন তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করবে, তখন স্বামী-স্ত্রী যথাবিধি নিজেদের জন্য যা করবে, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই।–সূরা আল বাকারা : ২৩৪
আলোচ্য আয়াতের মর্ম অনুযায়ী পাত্রীর তার নিজের ব্যাপারে নিজে সিদ্ধান্ত দেয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। পাত্রী-সে মানুষ, জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারিণী। যে নির্বোধ নয় যে, পিতা-মাতা বা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো কাজই করতে পারবে না।
উপরিউক্ত আলোচনা সামনে রাখলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিবাহ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হওয়ার জন্য যথাসম্ভব পাত্রী ও পিতা-মাতা বা অভিভাবকের উভয়ের ঐকমত্যের প্রয়োজন। এ সম্পর্কে হযরত আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমীরী (রঃ)-এর অভিমত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যার সারমর্ম নিম্নরূপ :
আনোয়ার শাহ কাশ্মীরীর মূলনীতি ও মীমাংসা
প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহমাতুল্লাহ আলাইহি লিখেছেনঃ
যে সব বিষয়ের সম্পর্ক সমষ্টিগতভাবে ইসলামী শরীয়ত এসব বিষয়ে উভয় পক্ষের দৃষ্টি রেখেছে এবং এরূপ ক্ষেত্রে সমুদয় হাদীস সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা একান্ত কর্তব্য। নিছক একতরফা সিদ্ধান্ত দ্বারা নবী করীম (ছঃ) এর হাদীসের উদ্দেশ্য হাসিল করা দূরহ ব্যাপার। যাকাতের মসয়ালা ধরা যাক। যাকাতের সম্পর্ক যাকাতদাতা ও যাকাত উসুলকারী–উভয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। যাকাতদাতা সম্বন্ধে হাদীস শরীফে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যাকাত উসূলকারীকে যাকাত দানকারীর খুশী করতে হবে। যা চাইবে, তা-ই দিতে হবে। ইনসাফ করলে তার সুফল সে পাবে। আর যদি যুলুম করে তার কুফলও সে ভোগ করবে। কেননা যাকাতদানের নিয়ম হচ্ছে, উসুলকারীকে খুশী করা।
এক হাদীসে উল্লেখ আছে : একবার কিছু লোক যাকাত উসুলকারীর বিরুদ্ধে রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে অভিযোগ করল। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : তাকে খুশী করো। যাকাতে যেরূপ মাল চাইবে, তাই দিয়ে দাও। জিজ্ঞাসাকারীরা জিজ্ঞেস করল, যদি যুলুম করে, তবুও? রাসূল (স.) বললেন : হ্যাঁ, তবুও। অপরদিকে উসূলকারী সম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে : রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হুশিয়ার! যাকাত আদায়ের সময় যাকাতদাতার উত্তম মালগুলো বেছে নেবে না। মযলুমের আহজারীকে ভয় করো। কেননা, মযলুমের এবং আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরাল নেই।
আলোচ্য হাদীস দুটি সামনে রাখলে বুঝা যায়, যাকাত দানকারীকে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাকে এ ব্যাপারে তার টু শব্দ করার অধিকার নেই। উসূলকারী যা চাইবে, তাই দিতে হবে। কোন রকম উচ্চবাচ্য করা চলবে না। আবার যাকাত উসুলকারী সম্পর্কে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে নির্দেশ রয়েছে তাতে দেখা যায়, তার বাড়াবাড়ি করার কোনো অধিকারই নেই। যাকাতদাতা ব্যক্তি ইনসাফ করে যা দেবে, তাই গ্রহণ করবে। নতুবা আইনগত দণ্ডনীয় হবে।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিষয়টি এখানে লক্ষ্যণীয়। এক দিকে স্ত্রীর প্রতি নির্দেশ রয়েছে যে, স্বামীকে খুশী রেখো। স্ত্রীর সামান্যতম অসদাচরণেও জাহান্নামের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। কিন্তু অপরদিকে স্বামীকে নির্দেশ করা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে পূর্ণ মু’মিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো এবং স্বীয় স্ত্রীর নিকট সেই উৎকৃষ্টতম ব্যক্তি।
অনুরূপ পাত্রী ও তার অভিভাবকের ব্যাপারটিও তেমনি। পাত্রীকে নির্দেশ করা হয়েছে, তোমার বিবাহের ব্যাপারে অভিভাবকের অধিকার রয়েছে। এতোখানি অধিকার যে, তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে বিবাহ নাজায়েয। আবার অভিভাবককে বলা হয়েছে, পাত্রী তার নিজের ব্যাপারে তোমার চেয়ে অধিক হকদার। অভিভাবকের এতে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ সম্পর্কিত সমুদয় হাদীস সামনে রাখলে প্রতীয়মান হয়, উভয়ের ওপরই দায়িত্ব রয়েছে। পাত্রী ও অভিভাবক একে অপরের সম্মতি ব্যতিরেকে বিবাহ করবে না। পাত্রীকে তার ওয়ালীর কথার যথাসম্ভব ভরসা রাখতে হবে। ওয়ালীকেও পাত্রীর সম্মতি নিতে হবে। ওয়ালী এমন বাড়াবাড়ি করবেন না যে, পাত্রী তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর পাত্রীও এতো বিপথগামী হবে না যে, ওয়ালী ও বংশের সম্মানহানি হয়।
বয়স্কা নারীর ওপর ওয়ালীর জোর জবরদস্তীর কোনো অধিকার নেই। হ্যাঁ, পরামর্শ দেয়া উত্তম। নাবালেগার ক্ষেত্রে অবশ্য জোর জবরদস্তীর ইখতিয়ার আছে। আর অভিভাবক ও পাত্রীর। মধ্যে যখন মতানৈক্য হবে, তখন প্রাপ্ত বয়স্কা পাত্রীর মত প্রাধান্য পাবে। কোরআন-হাদীস তা-ই সমর্থন করে।–ফায়যুল বারী, শরহে বুখারী
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রঃ) এর এ রায় শুধু এ এক বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রতিটি সামষ্টিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি নবীর নির্দেশের গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন এবং এ ধরনের হাদীসসমূহের বর্ণনাভঙ্গি অনুধাবন করতে পেরেছেন।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস
দেহলভী (রঃ)-এর সমর্থন
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রঃ) এ বিষয়টির যে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। যদিও বর্ণনাভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন এবং নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রঃ) যে ভাবধারা অবলম্বন করেছেন, তা সবচেয়ে সুন্দর ও সুপরিচ্ছন্ন। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রঃ) বলেন : বিবাহে এককভাবে পাত্রীর মতামত সিদ্ধ নয়। কেননা তাদের জ্ঞান অপূর্ণাঙ্গ। তাদের চিন্তা-ভাবনা অপেক্ষাক্বত অগভীর, দুর্বল। তাছাড়া, পুরুষকেই নারীর ওপর কর্তৃত্বকারী বানানো হয়েছে। যাবতীয় ব্যবস্থাপনা পুরুষেরই হতে। বিষয়টিও এমন যে, পাত্রী নিজেই উদ্যোক্তা হলে নির্লজ্জতা প্রকাশ পায়। দ্বিতীয়ত, বন্ধুত্ব ও বিবাহের মধ্যে পার্থক্যের জন্য মাঝখানে অভিভাবক থাকা আবশ্যক। যাতে বিবাহের প্রচার প্রসার হতে পারে। কাজেই পাত্রীর উচিত, অভিভাবকের মতামত মেনে নেয়া। কিন্তু অভিভাবকের এ অধিকার নেই যে, নিছক তাঁর খেয়াল-খুশী মত মেয়েকে পাত্রস্থ করে দেবেন। কারণ, বিষয়টি পাত্রীর। আর নিজের বিষয় পাত্রী নিজে যেরূপ বুঝে, পুরুষ তা ততটা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারে না। লাভ-লোকসান পাত্রীরই হবে। তাই তার অনুমতি নেয়া একান্ত জরুরী।–হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা
ইমাম নববী (রঃ) এর মত
ইমাম নববী (রঃ) বলেন : পাত্রীর মত অভিভাবকের মতের চেয়ে অগ্রগণ্য। তিনি নিম্নোক্ত ভাষায় লিখেছেন:
وحقها أوكد من حقه فإنه لوارادتژويجها كفوا وآمنت لم تجبر ولو أرادت أن تتزوج گوا فامتنع الولي أجبر قان
ضی فدل علی تاکید حقها ورجحانها.
اصرزو جها
বিবাহে পাত্রীর অধিকার অভিভাবকের অধিকার অপেক্ষা দৃঢ়তর। পিতা–মাতা ও অভিভাবক কারো কাছে তাকে বিবাহ দিতে চান, আর পাত্রী তা অস্বীকার করে তবে পাত্রীকে বাধ্য করা যাবে না। পক্ষান্তরে পাত্রী যদি কাউকে বিবাহ করতে চায়, আর যদি অভিভাবক তাতে সম্মত না হন, তবে অভিভাবককে বাধ্য করা যাবে। তবু যদি অভিভাবক অনমনীয় থাকেন, তাহলে কাযী ওই পাত্রীকে বিবাহ দিয়ে দেবেন। এতেই প্রমাণিত, পাত্রীর অধিকার অধিকতর অগ্রগণ্য। -শারহু মুসলিম লিন নববী
.
প্রাপ্ত বয়স্কা কন্যার অভিমত অগ্রগণ্য
এসব আলোচনার সারকথা হচ্ছে, নারী জাতি বিবাহের ব্যাপারে অসহায় ও নিরুপায় নয়। বরং উত্তম পথ ও পন্থা হচ্ছে, পাত্রীর মতামত নিয়ে অভিভাবক তার বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। কোনো বিশেষ পাত্রের সাথে পাত্রী যদি বিবাহ বন্ধনে রাজি না হয়, তবে তাকে জোর করে ওই পাত্রের নিকট বিবাহ দেয়া অনুচিত। কোরআন মজিদ বিবাহের মধ্যে যে শান্তি ও নিরাপত্তাকে প্রধান লক্ষ্য নিরূপণ করেছে, তা পাত্রীর অমতে সম্ভব নয়। তালাক, ভোলা প্রভৃতি বিধি-বিধান এ জন্যই তৈরী হয়েছে।
আল্লামা সারাখশীর মাবসূত’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বিবাহের সময় পাত্রীর অনুমতি নিতে হবে। কেননা, পাত্রীর আভ্যন্তরীণ কোন রোগ-ব্যাধি থাকতে পারে, যার দরুন সে সহবাসে সক্ষম নয়। কিংবা যার সাথে তার বিবাহ আলোচনা হচ্ছে, সে ছাড়া অন্য কারো প্রতি তার মন আক্বষ্ট রয়েছে। এমতাবস্থায় পাত্রীর সম্মতি চাড়া যদি তাকে জোর করে বিবাহ দেয়া হয়, তবে এ স্বামীর সাথে তার অমিল সৃষ্টি হতে পারে। তখন পাত্রী বিপথগামী হবে। কেননা, তার মন যে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত। প্রেমের চেয়ে বড় ব্যাধি কি আর হতে পারে?
.
বিবাহে পাত্রের অধিকার বা সম্মতি
পাত্রীর ব্যাপারটি মীমাংসা হওয়ার পর পাত্রের সম্মতির প্রশ্ন উত্থিত হয়। এ সম্পর্কে শুধু এতোটুকুই বলতে হয় যে, প্রাপ্ত বয়স্ক জ্ঞানী পাত্রের মতামতই নিজের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। পুরুষকে যেহেতু কখনো অসহায় বা নিরুপায় ভাবা হয়নি, তাই এ ব্যাপারে আলোচনার কোন প্রয়োজনই নেই। বরং এখানে বলা উচিত, পাত্র যখন নিজে বিবাহ করবে, তখন তার অভিভাবকের মতামত অবশ্যই বিবেচনা করবে। এ কথা বলে উড়িয়ে দেবে না যে, এরূপ ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাতা-পিতা ও অভিভাবকের নাক গলাতে দেয় কে? কেননা, বিবাহের ক্ষেত্রে অধিক অভিজ্ঞ ও মানব-বিশারদদের মতামত গুরুত্বের দাবী রাখে। আর এতো এক স্বতঃসিদ্ধ কথা যে মুরব্বী তথা পিতা-মাতা ও অভিভাবকের মধ্যে যে দূরদর্শিতা থাকে, তরুণদের মধ্যে তা কখনো থাকে । তরুণদের হুশের চাইতে আবেগই বেশী।
.
পাত্রী নির্বাচনে রাসূলের নির্দেশ
এখন পাত্রী নির্বাচনের বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে, ধার্মিকতার বিষয়টি অগ্রগণ্য। ধনী, বংশ মর্যাদা, রূপসী হোক কিংবা কোন সাধারণ রমণী হোক–বিবাহ করার সময় তার ধার্মিকতা তথা দীন-ধর্ম ও নৈতিক চরিত্র যাচাই করতে হবে এবং তাই অগ্রগণ্য।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন :
تنوع المرأة لاربع إمالها ولحسبها وجمالها ووينها
فاظفر بذات الوين تربت يداك .
কোনো মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব করার সময় চারটি বিষয় লক্ষ্য করা হয়। সম্পদশালী, বংশ-মর্যাদা, রূপ-সৌন্দর্য ও ধার্মিকতা। সুতরাং তোমার ধার্মিক মহিলাই বিবাহ করা উচিত, নচেৎ তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।–বুখারী, অনুচ্ছেদ : স্বামী-স্ত্রীর একই দীনভূক্ত হওয়া
.
অহেতুক ধন-সম্পদ-পূজা
উপরিউক্ত হাদীসের বক্তব্য হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যখন বিবাহ করে, তখন ওইসব জিনিসের ভিত্তিতে পাত্রী নির্বাচন করে থাকে। কখনো সম্পদশালী দেখে স্ত্রী নির্বাচন করে। পাত্রী অনেক সহায়-সম্পত্তির অধিকারিণী, ধন-সম্পদ ও বাড়ী গাড়ীর মালিক। তার সাথে বিবাহ হলে জীবন সুখে শান্তিতে চলবে। খাওয়া পরার চিন্তা থেকে মুক্তি মিলবে। স্বীয় দারিদ্র্য সত্ত্বেও নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি থাকবে। ধার্মিক হোক বা না হোক। কিন্তু মানুষ ক্ষিপ্রতাপ্রিয় বলে অপর দিকটি ভেবে চিন্তে দেখে না।
আসলে ধনবতী নারীকে জীবনসঙ্গিনী করলে জীবনের স্বাধীনতাও স্বাদই বিনষ্ট হয়ে যায়। আনন্দ-সূর্তি তিরোহিত হয়। মহান আল্লাহ তা’আলা দাম্পত্য জীবনের যে আধিপত্য স্বামীর হস্তে সমর্পণ করেছেন, তাতে অন্তরায় সৃষ্টি হবে। স্ত্রীর খোরপোষের ব্যবস্থা অটুট থাকবে না। আর ঘরের আসবাবপত্র ও জাক জমক দেখে যে আনন্দ লাভ হয়, ছেলেমেয়ের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে হৃদয়ে যে খুশীর ঢেউ খেলে, তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কেননা, এসবই স্ত্রীর ঐশ্বর্যের ফল। নিজের হাতের উপার্জন নয়। স্ত্রীর চোখে স্বামীর প্রভাব-প্রতিপত্তি অবশিষ্ট থাকে না। কেননা, সম্পদশালী স্ত্রীর দৃষ্টিতে দরিদ্র স্বামীর মর্যাদা একজন সাধারণ ব্যক্তির ও ব্যবস্থাপকের চাইতে বেশী কিছু নয়। আর তা’ও স্ত্রী উন্নত চরিত্রের অধিকারিণী হলে। যদি আল্লাহ না করুন, স্ত্রী বেআদব হয়, তবে প্রতিটা মূহুর্তে কট্টর ছোবল মারবে এবং পদে পদে খোঁটা দেবে। তাছাড়া, এই ধনবতী স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তান-সন্ততি হবে, তারাও পিতাকে যথোচিত সম্মান করবে না। স্ত্রীর কোনো ভুলের দরুন স্বামী কিছু বললে বা উপদেশ দান করতে চাইলে স্ত্রী তা রূঢ় ভাষায় প্রতিহত করবে। এখন চিন্তা করুন, এ পরিস্থিতিতে জীবনের স্বাদ-আস্বাদ কতটুকু বাকী থাকবে? এ সব বিষয় গুলোর প্রতি নির্দেশ করেই নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ
لاتزوجوهن لأموالهن فعسى أموالهن أن تطفيهن—
কোন নারীকে তার ধন-সম্পদ ঐশ্বর্য দেখে বিবাহ করবে না। সাধারণত তাদের ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য তাদেরকে স্বামীর অবাধ্য করে তোলে।–ইবনে মাজা
.
বংশ-পূজা
অনেক সময় পাত্রী নির্বাচন নিছক বংশ মর্যাদা দেখে করা হয়। ব্যক্তির মাহাত্ম্য ও যোগ্যতা বিচার করা হয় না। অথচ ব্যক্তির যোগ্যতা ছাড়া বংশীয় আভিজাত্য নিছক অর্থহীন। তাছাড়া, ধার্মিকতা ব্যতীত নিছক বংশীয় আভিজাত্য নারীর মধ্যে গর্ব অহংকার জন্ম দেয়। ফলে, সে স্বীয় অবস্থান থেকে সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পায়। ক্রমশ এ জিনিসটিও পুরুষের আধিপত্য ব্যাহত করে। অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে, বংশ মর্যাদা আদৌ বিবেচনাযোগ্য নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ধামিক ব্যতিরেকে নিছক বংশীয় আভিজাত্য কোন সুফল বয়ে আনে না। মনে রাখতে হবে, ইসলামে সর্বপ্রথম ধামির্কতার স্থান, অতঃপর অন্য বিষয়। দীন-ধর্মের বিপরীতে বংশ মর্যাদার কোনো গুরুত্বই নেই।
নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
যোগ্যতা ও ধাময় যে, বংশ মর্যাদা ক্রমশ এ জিনিসটি দেয়। ফলে,
ولأمة خير ماء سوداه ذات ين أفضل۔
দীনদার কালো কুৎসিত নির্বোধ ক্রীতদাসীও উকষ্ট।–ইবনে মাজা,
অন্যান্য হাদীস থেকেও উপরিউক্ত কথার সমর্থন মেলে, একবার নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ধার্মিক লোক আমার বন্ধু-সে যেখানকারই হোক এবং যে-ই হোক না কেন।
.
রূপ ও সৌন্দর্য-পূজা
আবার কেউ কেউ পাত্রী-নির্বাচনে শুধু মাত্র রূপ-লাবণ্যকেই মাপকাঠি বানিয়ে ফেলে। আক্বতি ও চেহারা-সুরত হৃদয়গ্রাহী, রূপ-লাবণ্য, আর্কষণীয়, অপরূপ অঙ্গভঙ্গি, অনিন্দ্য দেহসৌষ্ঠব, শুধু তাই নয়, আধুনিক, আলোকে সুশোভিত, মডেল, টিপটপ গঠন ও স্মার্ট এবং একেবারে আধুনিকা হতে হবে।
কিন্তু এদিকটা একবারও চিন্তা করে না যে, এটা কোনো স্থায়ী বিশেষ সৌন্দর্য নয়। যোগ্যতা ও প্রতিভা ছাড়া নিছক রূপ-লাবণ্যের কোন মূল্য নেই। কেননা, লাবণ্যের সাথে গুণের সমন্বয় না ঘটলে সে রূপ অনর্থ বিপদের সৃষ্টি করবে। স্ত্রীকে অতিমাত্রায় উগ্রতায় উদ্ধত ও প্রগলভ করবে। অপচয় ও বিলাসিতায় নিমজ্জিত করবে। রূপ-লাবণ্যে দুষ্ট লোকেরা বিপদগামিনী করার প্রচেষ্টা চালাবে। আর এই নিছক রূপ-সৌন্দর্য সম্পর্কেই নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন :
: ) ه و روجو ال :
لاء لحسنهن فعسى حسنهن يرديهن .
শুধু রূপ-লাবণ্য দেখে কোন নারীকে বিবাহ করো না। কেননা, নিছক রূপ সৌন্দর্য সাধারণত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।–ইবনে মাজা
.
ধার্মিকতা ও যোগ্যতাই মাপকাঠি
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান : বিবাহ করার সময় পাত্রী নির্বাচনে ধার্মিকতাকে মাপকাঠি বানাও। ধন-সম্পদ, রূপ-লাবণ্য ও বংশ-মর্যাদা এমন কোনো স্থায়ী জিনিস নয়, যাকে এক্ষেত্রে মাপকাঠি বানানো যেতে পারে। পাত্রী নির্বাচনে সকল মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, ব্যক্তিগত সৎ শিক্ষা, যোগ্যতা, ও উপযুক্ততাকে প্রাধান্য দেয়া। যেমন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বলেছেন : রূপ-লাবণ্য ও ধন-ঐশ্বর্যের ভিত্তিতে তোমরা বিবাহ করো না। কেননা, তাতে ফিতনার আংশংকা অধিক বিদ্যমান। তোমরা ধার্মিকতাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দান করবে। ধার্মিকতাসম্পূর্ণ কালো-কুৎসিত স্ত্রীও অধিক শ্রেয়।
নবী করীম (ছঃ) আরো ফরমান :
ولكن تزوجوه على الين–
তোমরা বিবাহ করবে পাত্রীর দীনদারী ও ধার্মিকতা দেখে।–ইবনে মাজা।
ফাতহুল কাদীর গ্রন্থ প্রণেতা তাবারানীর বরাত দিয়ে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন : নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
زها لم يزده الله الا ذلا ومن تزوجها
من تزوج امراة
لوله IT اما
ومن تزوجهالحسبها له با
1। ১১;
المالها لم يوت…
بره ويمص
دنا ومن تزوج إمرأة لم يزد بها إلا أن فرجه أويل بيمه بارك الله له فيها وبارك لها فيه.
য্যে ব্যক্তি কোন নারীর রূপ দেখে বিবাহ করে আল্লাহ তা’আলা তাকে হেয় করেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে তার ধন-সম্পদ দেখে বিবাহ করে আল্লাহ তাকে অভাবী করেন, যে ব্যক্তি নারীর বংশ দেখে বিবাহ করে, আল্লাহ তাকে অপদস্থ করেন। আর যে ব্যক্তি কোন নারীকে চক্ষু সংযত, যৌনাঙ্গ সংযত এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় করার মানসে বিবাহ করে মহান আল্লাহ সে দম্পতিকে বরকত সহায়তা দান করেন।–শামী।
একথা সত্য যে, উপযুক্ত ধার্মিক স্ত্রী স্বামীর হক সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকে। স্বামীর সন্তুষ্টি বিধান স্বীয় কর্তব্য ও কাজ বলে মনে করে। ঘরের কাজকর্ম ঠিক মতো আঞ্জাম দেয়। এরূপ স্ত্রীর মধ্যে অযথা আত্মম্ভরিতা সৃষ্টি হয় না। সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার পুরোপুরি খেয়াল থাকে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথেই ঝগড়া-বিবাদ করে না। অন্য লোকেরও ধার্মিকতা ও নেক নারীর ওপর বিশ্বাস জন্মে। পাড়া-প্রতিবেশী তাকে সমীহ করে। আর এই ভাবে স্বামী সংসার সুখের সর্গ হয়ে ওঠে।
তাই নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি চারটি বস্তু লাভ করল, সে দুনিয়া আখেরাত উভয়ের কল্যাণ সাধন করল : ১. শোকরগোযার অন্তর, ২. যিকিরকারী যবান, ৩. বিপদে দৈর্য ধারণকারী দেহ ৪. স্বামীর ধন-সম্পদ সংরক্ষণকারী নেক স্ত্রী। -মিফতাহুল খিতাবাহ
একবার নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান, পরিপূর্ণ ঈমানদার ও পরকালের সাহায্যকারিণী স্ত্রী বিবাহ করা উচিত।–ইবনে মাজা, অনুচ্ছেদ, উৎকৃষ্ট নারী
.
আখলাক-চরিত্র উপেক্ষা করার পরিণাম
মানুষের দৃষ্টিকোণ যদি সৎ আমল-আখলাকের পরিবর্তে শুধুমাত্র জাঁক-জমক ও রূপ-সৌন্দর্যে পর্যবসিত হয়, তাহলে দুনিয়ায় বিপর্যয় অবস্থা সৃষ্টি হবে? অত্যাচার দাঙ্গা-হাঙ্গামার হিড়িক পড়ে যাবে। শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ইযত সম্মান বিলুপ্ত হবে। বহু স্ত্রীলোক অবিবাহিতা থেকে যাবে। আর স্বামীহীনা মেয়েলোকের সংখ্যা যখন বেড়ে যাবে, তখন শয়তানের শয়তানী কর্মকান্ড করার পুরোদস্তুর সুযোগ মিলবে।
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إذا خطب إليكم م وضون دينه وخلقه فزوجوه إلا تفعلوا
تكن فتنة في الأرض وفساد عريض—
তোমাদের কাছে যখন এমন কোনো ব্যক্তি বিবাহের প্রস্তাব করে, যার দীনদারী ও আখলাক চরিত্র তোমরা পছন্দ করো, তখন বিবাহ দিয়ে দাও। নতুবা যমীনে ভীষণ হৈ চৈ ও ফিতনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়বে।–তিরমিযী
.
বিবাহের পাত্রী নির্বাচন ও ফকিহগন
বিবাহের পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুসলিম ফিকাহবিদদের মতে, নিম্নোক্ত মূলনীতি গ্রহণ করা ভালো :
باو يژا وما وثا
باو
يندب أن تكون أقل منه اعلى مه لقا و ادبا وورعا وجمالا۔
পাত্রী বংশ-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ধন সম্পদ ও বয়সে স্বামীর চেয়ে কম এবং আচার-ব্যবহার, রূপ-লাবণ্য ও ধার্মিকতায় স্বামীর চেয়ে অধিক হওয়া উত্তম।
সাথে সাথে বিবাহ করার সময় এ বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখা উচিত।
درون طويلة مهزولة . و
وذات الولد ولا المسنة ولا زانية.
যাকে বিবাহ করা হবে, সে যেনো দীর্ঘকায়া, কুৎচিত, দুশ্চরিত্রা, শীর্ণকায়া, খর্বকায়া, সন্তানবতী, বিগত-যৌবনা অশ্লীলভাষিণী ও ব্যভিচারিণী না হয়।
মোট কথা, হবু স্ত্রী সর্বদিক দিয়ে উপযুক্ত ও মানানসই হতে হবে। দুনিয়াবী দিক থেকেও দীনের দিক থেকেও। তাহলেই স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব অক্ষুণ্ণ থাকবে।
হাদীসের মর্মানুসারে পাত্রীর মধ্যে যে-সব গুণাবলী থাকা বাঞ্চনীয়, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো :
এক. পাত্রী ধার্মিক ও সৎস্বভাবা। নবীর নির্দেশ :
–ধার্মিকতাকে অধিকার করো।
দুই. স্ত্রী হবে আনুগত্যশীল ও সুখ-দুঃখের অংশীদার 3,
3 313/ 115স্ত্রীকে দেখলে মন জুড়ায়, কোন আদেশ করলে তা পালন করে।
তিন. বিশ্বাসিনী, সংযমশালিনী, গৃহের-তত্ত্বাবধান কারিণী, নম্র-ভদ্র, ক্বতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারিণী ও সর্বক্ষেত্রে দৈর্যশীলা।
و القه فى نفسها وماله
-নিজের জান ও স্বামীর মালে অন্যথা করে না।
চার. স্নেহবৎসলা, স্বাস্থ্যবর্তী ও সন্তান সেবিকা :
خير نساء كبن الإبل؛ صالح يشاء قريش أختاه على ولي
في صغره وارعاه على زوج فی ذات يوم”
অর্থাৎ আরবের নারীদের মধ্যে উত্তম নারী হল কুরাইশী নারী। তারা শিশু-সন্তানের প্রতি স্নেহশীলা ও স্বামীর ধন ও মালের সংরক্ষিকা।
পাঁচ. স্বামী অনুরাগিণী ও অধিক সন্তান প্রসবিনী : 1: 11:1 5 তোমরা অধিক অনুরাগিনী ও অধিক সন্তান প্রসবিনী নারী বিবাহ করবে।
ছয়. পুণ্যবতী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিতা নারী।
সাত. গুণবতী ও নিষ্কালঙ্গিনী নারী।
আট. দুনিয়াসর্বস্ব ও আখেরাত ভ্ৰষ্টা নয়।
.
সৎ পাত্র নির্বাচন ও ফকিহগণ
মেয়েরা স্বামী নির্বাচনেও নুন্যতম এই সব উল্লেখিত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। তাহলেই তার জীবন আনন্দঘন, সুখী ও শান্তিময় হয়ে উঠবে।
ফিকাহবিদগণ বলেন :
والمرأة تختار الزوج الدين الخشن والخلق المؤشر ولا
تتزوج فاسقا ۔
মেয়েরা দীনদার, সৎ চরিত্রবান ও উদার লোককে স্বামীরূপে গ্রহণ করবে, কোন অধার্মিক লোককে স্বামী বানাবে না। –রদ্দুল মুহতার
অনুরূপ পিতা যদি তার কন্যাকে বিবাহ দিতে চান, তবে তাঁকেও পাত্র নির্বাচনের পূর্বে এইসব জরুরী বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। অজ্ঞ, মূর্খ ও লোভী পিতারা যখন তাদের কন্যাদের বর নির্বাচন করে, তখন তাদের দৃষ্টি থাকে ধনসম্পদের ওপর পাত্রের বয়স, যোগ্যতা ও মান-মর্যাদার প্রতি একটুও দৃষ্টি থাকে না। এই পদ্ধতি বন্ধ ও পরিহার করা সকলের মানবিক দায়িত্ব।
ফিকাহবিদগণ লিখেছেন।
ولا يزوج ابنته الشابة شيخا كبيرا ولا رجلا دسیما۔
পিতা তাঁর যুবতী কন্যাকে কোনো বৃদ্ধ ও বয়স্ক পাত্রের কাছে বিবাহ দেবেন না। -রুদুল মুহতার
.
বয়সে সমতারক্ষা
কন্যার বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রের সমবয়সের দিকে দৃষ্টি রাখাও অভিভাবকের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। হযরত রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আদরের দুলালী হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার বিবাহে সমবয়স্কতার বিচার করেছিলেন। ইমাম নাসাঈ একটি অনুচ্ছেদই দাঁড় করেছেন–13, 410। ও কনের বিবাহ তার সমবয়স্কের সাথে হওয়া এবং এ অনুচ্ছেদে হযরত বুরাইদা (রাঃ) এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন এভাবে?
خطب أبو بكر وعمر رضي الله عنهما فاطمة فقال رسول
الله صلى الله عليه وسلم إنها صغيرة فخطبها على زوجها
مثه.
হযরত আবুবকর ও হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আহাকে বিবাহের পয়গাম পাঠালে রাসূলুল্লাহ (ছ) বললেন : তার অর্থাৎ ফাতিমার বয়স কম। অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) হযরত ফাতিমাকে বিবাহের পয়গাম পাঠালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীর কাছে ফাতিমাকে বিবাহ দেন।–নাসাঈ
মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা লিখেছেন, বিবাহে সমবয়স্কতা বিচার অতি জরুরী। আর এতে বহু উপকারিতা রয়েছে। নবী করীম (ছঃ) যদিও হযরত আয়েশাকে স্বল্পবয়স্কা অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন, কিন্তু তার মূলে ছিল এক মহত উদ্দেশ্য। সকলেই অবগত আছেন, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী পত্নী হওয়ার সুবাদে দ্বীনের কতো বিরাট অংশ প্রচারিত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে ইসলামের কতো বিরাট খিদমত তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন।
.
উত্তম গুণের সাথে রূপ-লাবণ্যতা
বিবাহে পাত্রী-বির্বাচন সম্পর্কে যা-কিছু লেখা হলো, তাতে এ ধারণা করা মোটেই ঠিক হবে না যে, কেউ সুন্দরী (নারীদের) বিয়ে করবে না–বেছে বেছে অসুন্দরী মেয়ে বিয়ে করবে। এ উদ্দেশ্য আদৌ নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে, গুনের সাথে সাথে রূপের দিকে খেয়াল রাখা। গুণের কথা ভুলে গিয়ে নিছক রূপের মোহে পাগল হওয়া অনুচিত। নতুবা রূপ কোনো খারাপ জিনিস নয়। তা আল্লাহরই এক নিয়ামত।
হাদীসে জনৈক সাহাবীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন : আমি এক আনসারী মেয়েকে বিবাহ করতে চাচ্ছি। তিনি বললেন : ভাল করে দেখে নিও। কেননা, আনসারী মেয়েদের চোখে কিছুটা ত্রুটি থাকে।
এ কথার উদ্দেশ্য এই যে, ভেবে চিন্তে, দেখে-শুনে বিয়ে করো। পরে তার কোন দোষ-ত্রুটি বেরিয়ে না পড়ে এবং সেই অজুহাতে তোমাদের দাম্পত্য জীবনে কলহ-বিবাহ দেখা দেয়।
.
কুমারী মেয়ে বিবাহ করা
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) এর ঘটনা হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে। তিনি নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করলেন, সম্প্রতি আমি বিবাহ করেছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কুমারী, না বিবাহিতা (বিধবা)? হযরত জাবের (রাঃ) বললেন : বিবাহিতা। এ কথা শুনে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
فه بگراتبها ولايك.
তুমি কেন কুমারী মেয়ে বিবাহ করলে না? সে তোমার সাথে ক্রীড়া-কৌতুক করত, আর তুমি তার সাথে ক্রীড়া-কৌতুক করতে?–বুখারী, অনুচ্ছেদ ও পরিণত বয়স্কা নারী বিবাহ করা
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এর সাথে এই শব্দ ক’টি উল্লেখ আছেঃ
تاجگلوتاجها.
সে তোমার সাথে হাসতে-খেলতো, আর তুমি তার সাথে হাসতে-খেলতে!–মুসলিম
হাদীস কুমারী উল্লেখের কারণ, তার সাথে বনিবনা ও সদ্ভাবের সম্ভাবনা বেশী। অল্পতেই সে তুষ্ট ও ক্বতজ্ঞ থাকে। কুমারী আদর যত্ন ও সোহাগ বেশী করে। কিন্তু এর দ্বারা যদি রূপ সৌন্দর্য ও কমনীয়তাও ধারণা করা হয়, তাতে দোষ কি? যখন আমোদ-ফুর্তি ও চিত্তবিনোদনে রূপ-গুণ ও কমনীয়তারও ভূমিকা রয়েছে বলে হাদীসের সমর্থন মেলে। এ সম্পর্কে আরেকটি হাদীসে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
کر فانهن اعذب افواها وانتق ارحاما وارضی
باليسير–
তোমরা কুমারী মেয়েদের বিবাহ করবে। কেননা তারা মিষ্টভাষিণী অর্থাৎ স্বামী ভক্ত, তাদের গর্ভাশয় অধিক গর্ভধারী এবং তারা অল্পতে সন্তুষ্ট থাকে।–মিশকাত, বিবাহ অধ্যায়
হাদীসে পরিষ্কার ভাষায় কুমারী মেয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যেও এমন একটি দিক রয়েছে, যাতে বুঝা যায়, বিবাহে কনের মনোহারিত্ব সৌন্দর্য ও রূপ-লাবণ্য দেখা দূষণীয় নয়।
.
কুমারী পাত্রীর বৈশিষ্ট্যসমূহ
সাহাবী আলকামা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম। পথে তাঁর সাথে হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাক্ষাত ঘটে। তাঁরা দু’জনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। (এক পর্যায়ে) হযরত উসমান (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে বললেন :
بعض ما مضى من
الأتزوجك جارية شابة لعلها
زمانك–
কেন আপনি কোনো কুমারী মেয়েকে বিবাহ করেছেন না! সে আপনার অতীত দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেবে।–মুসলিম
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রঃ) লিখেছেন:
فيه استحباب گام الشابة لاتها المحته بمقاصد التكاح فانها الاستثتان واطيب نكهة وارغب في
ش
رة واث
الإستمتاع الذي هو مقهوة التكاح واح محادث واجمل مثظرا والنمسا واثرب أن يعودها زوجها الأخلاق التي يرتضيها.
এই হাদীস মর্মানুযায়ী কুমারী মেয়ে বিবাহ করা মুস্তাহাব। কেননা, কুমারী পাত্রী বিবাহের উদ্দেশ্য সাধনে বেশী উপযোগী। উপভোগে উত্তম, সুগন্ধে সর্বোত্তমা, সংসর্গে মনোহারিণী, জীবন যাপনে উৎকৃষ্টতমা, আচার ব্যবহারে হর্ষোফুল্ল, দেখতে সুশ্রী, স্পর্শে কোমলা এবং অতি সহজে কুমারী পাত্রীকে স্বামী তার মনের মতো গড়ে তুলতে পারে।–নববী, শারহে মুসলিম
.
দ্বীন ধর্ম ও রূপ-লাবণ্যের সমন্বয়
আল্লামা হাফিয ইবনুল কাইয়ুম (রঃ) বলেন : নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় উম্মতকে ধার্মিক ও সুশ্রী নারী বিয়ে করার পরামর্শ দিতেন। তাঁর ভাষা নিম্নরূপ :
وكان لى الله عليه وتم حه أمته على الكاح
الآبار الحشان ثروات البرين–
নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় উম্মতকে কুমারী, সুশ্রী ও ধার্মিকা পাত্রী বিবাহ করার উৎসাহ প্রদান করতেন।
ওপরে যেটুকু আলোচনা হল, তাতে একথা সহজেই প্রমাণিত হয় যে, সুশ্রী নারী বিবাহ করা দূষণীয় নয়, বরং উত্তম। কিন্তু নিছক রূপ-সৌন্দর্য ও কমনীয়তা দেখলেই চলবে না, বরং সাথে সাথে আখলাক-চরিত্র ও আচার-ব্যবহারও দেখতে হবে।
.
সুশ্রী ও সৌন্দর্যের মাপকাঠি
এখানে উল্লেখ্য যে, সৌন্দর্যের অর্থ নিছক বাহ্যিক রং-রূপের সৌন্দর্য জৌলুশ নয়। বরং সাথে সাথে স্বভাব-চরিত্রও সুন্দর, আমল-আখলাকও পরিচ্ছন্ন এবং দীনদারীতেও পাকাপোক্ত হতে হবে। তাছাড়া সৌন্দর্যের মাপকাঠি রং-রূপও একেক জনের রুচিতে একেক রকম। এক জনে যাকে সুন্দরী বলে মনে করে, অপরজন তাকে অসুন্দর ভাবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অন্যের পছন্দের কোনো মূল্য নেই। নিজের পছন্দই বিবেচ্য।
অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়, সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় প্রেম ভালবাসা থেকে বাহ্যিক রূপের ল্যাবণ্যের আকর্ষণকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। আর স্বভাব-চরিত্র যদি ভালো না হয়, তখন তো সবই মিথ্যা। কাজেই বাহ্যিক রূপের জন্য বিবাহ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। হ্যাঁ, ধর্ম ও সদাচারের সাথে সাথে রূপ-সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটলে নিয়ামত মনে করতে হবে।
সার কথা, যৌন পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বক্তব্য হল, তোমরা কুমারী, মিষ্টভাষিণী ও রূপসী পাত্রী বিবাহ করবে, তবু যৌন পবিত্রতা নষ্ট করার কল্পনা মনে স্থান দেয়া যাবে না।
.
বিধবা বা বয়স্ক বিবাহ
উপরের আলোচনার অর্থ এই নয় যে, নিছক কুমারী মেয়েই বিয়ে করতে হবে বিধবা-বিবাহ সমীচীন নয়। হাদীস শরীফে কুমারী বিবাহে উৎসাহ দান করা হয়েছে, আর তার সপক্ষে যুক্তি সঙ্গত কারণও বর্তমান। তাই কোন কোন হাদীস শরীফে এর কারণও বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীসে উল্লেখ ফরয হয়েছে, কুমারী পাত্রীর সাথে মিলমিশ ও সদ্ভাব দ্রুত সৃষ্টি হয়। প্রথম স্বামীর ঘরে আসে বলে স্বামী যে ভাবে গড়তে চায়, সেভাবেই গড়ে ওঠে। অল্প জিনিসেও সন্তুষ্ট হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, স্বামী তার সাথে আন্তরিকভাবে এতোই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে যে, তার প্রেম ভালবাসা অন্তরে গেঁথে যায়। আর এভাবে স্বামী দৃষ্টি ও কল্পনার ব্যভিচার হতে মুক্তি পায়। পাত্র যদি দ্বিতীয় বিবাহ করতে চায় কিংবা বেশী বয়সী হয়, তবে অনূঢ়া পাত্রী তার জন্য অনুপযুক্ত হবে।–ফিকাহবিদদের অভিমত আপনারা জেনেছেন। তারা বয়স্ক লোকের সাথে কুমারী বিবাহ নিষেধ করেছেন। সুতরাং এরূপ বয়স্ক লোকের পক্ষে বিধবা-বিবাহই উত্তম। তাহলেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা ও সমঝোতা হবে।
.
রাসূল ও সাহাবা যুগে বিধবা বিবাহ
স্বয়ং রসূলে করীম ছল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবন প্রণালীই এর বাস্তব উদাহরণ। তিনি এক মাত্র আয়েশা (রাঃ) ব্যতীত বাকী সবাইকে বিধবা বিবাহ করেছে। স্বীয় বিধবা কন্যাদেরও তিনি পাত্রস্থ করেছেন। খোলাফা-ই-রাশেদীন ও সাহাবা-ই–কিরাম-এর জীবনচরিত পাঠ করলেই জানা যাবে, তাঁরা বিধবা বিবাহ করেছিলেন। মহিলা সাহাবীগণও তাঁদের স্বামীদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয়-তৃতীয় বিবাহ করেছেন।
এতোসব ঘটনা উল্লেখ করে আমি বলতে চাচ্ছি যে, বিধবা-বিবাহ অবাঞ্চনীয় হতো, হলে স্বয়ং নবী করীম (ছঃ) ও সাহাবা-যুগে এতোসব বিধবা-বিবাহ কি করে সংঘটিত হল? এ থেকে বুঝা গেল, বিধবা-বিবাহ অবাঞ্চিত নয়। বরং তা পুণ্যের কাজ ও শরীয়ত সিদ্ধ।
.
বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখা
ইসলামী শরীয়ত যৌন পবিত্রতা রক্ষার জন্য সম্ভব হলে অনানুষ্ঠানিকভাবে হবু পাত্রী দেখারও অনুমতি প্রদান করেছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে।
নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
إذا اخطب أحدكم المرأة فإن استطع أن ينظر إلى ما يدعوه
إلى نگاهافليفعل–رواه أبو داود—
যখন তোমরা কোন নারীকে বিবাহের প্রস্তাব করবে, তখন সম্ভব হলে বিবাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী জিনিসটি দেখে নেবে।–আবূ দাউদ, মিশকাত
আলোচ্য হাদীস থেকে জানা গেলো বিবাহের পূর্বে ভদ্রভাবে ও শরীয়ত সম্মত উপায়ে পাত্রী দেখা বৈধ, যাতে মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয় এবং বিবাহে পাত্রীর পক্ষ থেকে যাবতীয় সন্দেহ-সংশয়ের নিরসন হয়। এতে ভবিষ্যতে পাত্রী পক্ষকে অপমানকর এমন কোন কথাবার্তা বলারও অবকাশ থাকবে না। আর এভাবে বিবাহের উদ্দেশ্য সুষ্ঠু ও উত্তম রূপে বাস্তবায়িত হবে। হাদীস থেকে এ কথা ও জানা গেল যে, সবদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য পাত্রী সম্পর্কে অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয়ও জানা যেতে পারে, যেমন–ধার্মিকতা, সৌন্দর্য, বংশ, অর্থ-সম্পদ প্রভৃতি।
.
হবু পাত্রী দেখার জন্য রাসূল (ছঃ) এর পরামর্শ
মগীরা ইবনে শুবা (রাঃ) বলেন : আমি নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমীপে আমার বিবাহ প্রসঙ্গ তুলোম। তিনি বললেন, তুমি কি পাত্রী দেখেছ? আমি বললাম, না, হে আল্লাহর রাসূল! একথা শুনে তিনি বললেন :
فانظر إليها فاه أحرى أن يوم بينما۔
তুমি বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখে নাও। কারণ পাত্রী দেখা তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করবে।–তিরমিযী।
উক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখা মুস্তাহাব আবশ্যক।
ইমাম তিরমিযী লিখেছেন : কোন কোন আলেম এই হাদীসের আলোকে বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখা দুর্ষণীয় নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে এ জন্য শর্ত হচ্ছে, নারীদেহের যে অংশ দেখা কার হারাম, সে অংশ দেখা যাবে না। এবং এব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ইমাম আহমদ (রঃ) ও ইসহাক (রঃ) এই মত পোষণ করেন।
ইমাম তিরমিযী (র) বলেন :
ومعنى أن يوم بينكما قال أخرى أن تدوم المود بيگما۔
LR: ১৪–এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে স্নেহ ভালোবাসা স্থায়িত্ব লাভ করবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন : জনৈক ব্যক্তি কোন এক নারীকে বিবাহ করার ইচ্ছা পোষণ করলে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি কি পাত্রী দেখেছ? সে না সূচক জবাব দিল। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানলেন যে, সে পাত্রী না দেখেই বিবাহ করতে যাচ্ছে, তখন তিনি বললেনঃ
اذهب فانظر إليها فان في أعين الأنصار شيئا ۔
যাও, ওই নারীকে দেখে নাও। কেননা, আনসারী নারীদের চোখে কিছুটা ত্রুটি আছে। -মুসলিম
ইমাম নববী (রঃ) উক্ত হাদীসের ভাষ্যে লিখেন :
আলোচ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখা মুস্তাহাব। এটাই (ইমাম শাফিয়ীর এর) মাযহব। ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ইমাম মালেক (রঃ) সকল কুফাবাসী এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) ও সাধারণ ইমামদেরও এই মাযহাব। কাযী এক শ্রেণীর আলেম কর্তৃক পাত্রী দেখা মাকরূহ বলার যে মত উল্লেখ করেছেন, তা ঠিক নয়। তা এই হাদীসে ও মুসলিম উম্মাহর ইজমার বিপরীত। এরপর তিনি লিখেন :আমাদের এবং ইমাম মালেক (রঃ), ইমাম আহমদ (রঃ) ও সাধারণ ইমামদের অভিমত হচ্ছে, এই দেখার ক্ষেত্রে পাত্রীর সম্মতি থাকা শর্ত নয়। বরং পাত্রীর অগোচরে বা অজ্ঞাতে তার অসতর্কাবস্থায়ও দেখা যেতে পারে। পাত্রীর অনুমতি প্রার্থনাও শর্ত নয়। পাত্রীর অনুমতি ছাড়াই দেখা যেতে পারে। অনুমতি নেয়ার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। আর এরূপ ক্ষেত্রে পাত্রীর অনুমতি দানে লাজ লজ্জার বাধ সাধে। ব্যাপারটি যে ধোঁকা’বাজির কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা, অনেক সময় পাত্রী দেখার পর পছন্দ না হলে বিবাহ হয় না। সুতরাং অনুমতি নিয়ে দেখার পর বিবাহ না হলে, তা পাত্রীর দুঃখ ও লজ্জার কারণ হবে। আর পাত্রীর অগোচরে দেখার পর বিবাহ না হলে, তাতে তার দুঃখ পাবার কোন কারণ থাকবে না। কেননা, সে ব্যাপারটি সম্পর্কে আদৌ জ্ঞাতই নয়। আর এ কারণেই আমাদের সহাবাগণ বলেন, বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণের পূর্বেই পাত্রী দেখে নেয়া উচিত, যাতে পছন্দ না হলেও কারো মনোকষ্ট না আসে। পক্ষান্তরে বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার পর পাত্রী দেখে পছন্দ না হলে, তা পাত্রী পক্ষের মান-সম্মান ও মননপীড়ার কারণ হয়। শাফেয়ী সাহাবাগণ বলেন, নিজের পক্ষে দেখা সম্ভব না হলে কোন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত মহিলাকে পাঠিয়ে পাত্রী দেখা যেতে পারে। আর এটা করতে হবে বিবাহের পয়গাম পাঠানোর পূর্বেই।–মুসলিম শরীফের ভাষ্য
হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রাঃ) বলেন, নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
مرأة فلا باس ان ينظر
خطبة
আল্লাহ তা’আলা যখন কোনো ব্যক্তির অন্তরে কোনো নারীর বিবাহের বাসনা সৃষ্টি করে দেয়, তখন তার পক্ষে ওই নারীকে দেখা খারাপ কিছু নয় ইবনে মাজা।
.
বিবাহের পাত্রী দর্শনে ভদ্রতা ও সততা
এসব হাদীসের মর্মানুসারে বিবাহপূর্ব পাত্রী দেখা দূষণীয় তো নয়ই, বরং উত্তম। তা স্বচক্ষেই হোক, আর অন্য কোনো আস্থাভাজন নারীর মাধ্যমে হোক। উক্ত পদ্ধতিতে অনেকটা মানসিক সান্ত্বনা লাভ করা যায়। বিবাহের ক্ষেত্রে কোনো রকম সন্দেহ-সংশয় ও খারাপ ধারণাও সৃষ্টি হয় না। ফলে এ সংক্রান্ত প্রাথমিক হাঙ্গামাও মাথাচাড়া দিতে পারে না। অবশ্য এজন্য অনিবার্য শর্ত হল, নিষ্ঠা ভদ্রতা ও সততা এবং শরীয়ত লঙ্ন না করা। পাত্রী দেখার উদ্দেশ্য নিচক অভ্যাসে পরিণত করা চলবে না। ফিকাহবিদগণও পাত্রী দেখা বৈধ বলেন।
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রঃ) বলেন :
قالوا يجوز النظر إلى الموبقكي كينج الأمر إلى القابر وقالوا يا التي مث ابتداء النظر ثم يفوض الأمر
ফকীরা বলেন : পাত্রী দেখা জায়েয, যাতে ঘটনা হাঙ্গামার দিকে না গড়ায়। তারা আরো বলেন, পাত্রী দেখার সময় নিয়তে নিষ্ঠা ভদ্রতা ও সততা থাকতে হবে এবং বাকী কাজ আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবে।–আল-আরফুশ শাযী।
.
বিবাহপূর্ব প্রার্থী দেখা মুস্তাহাব
বিবাহপূর্ব পাত্রী দেখা কি? সাধারণ ফকীহগণ মুস্তাহাবের পক্ষে। একমাত্র মাওলানা–সানাউল্লাহ পানিপথী (রঃ) সুন্নাত বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্যই একই।
মাওলানা সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) এর ভাষা নিম্নরূপ :
للخاطب أن ينظر الى وجه المخطوبة وكفيها قبل
سن
النيكاح اجماعا۔
বিবাহপূর্ব পাত্রী দেখা সুন্নাত। পাত্রীর মুখ ও হাতের তালু দেখা সর্বসম্মতভাবে জায়েয। -তাফসীরে মাযহারী
ফিকাহের গ্রন্থসমূহে সাধারণভাবে নুদুব’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। নুদুব’ অর্থ মুস্তাহাব।
বিবাহের ঘোষণা ও বিবাহ-পূর্ব পাত্রী দেখা মুস্তাহাব।–দরুরুল মুখতাব
ب الشهوة
العقد وان
وجته قد
ويندب نظر الز
বিবাহের আকদের আগে বরের পাত্রী দর্শন মুস্তাহাব, যদিও কামভাবের আশংকা হয়।–আল কাওয়াকিবিল মাশরিকা।
উল্লেখ্য হাদীস সমূহই এ বিষয়ের ভিত্তি। সাহাবায়ে কিরামের আমলও এমনি ছিলো। তাঁরা বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখে নিতেন।
হযরত জাবির (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি বিবাহ করার উদ্দেশ্যে গোপনে এক পাত্রীকে দেখলাম। দেখার পর তার মধ্যে এমন কিছু আকর্ষণ পেলাম যাতে আমাদের বিবাহ সম্পাদিত হয়ে গেল।–জামউল ফাওয়ায়িদ, আবূ দাউদ থেকে।
মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রাঃ) বলেন, জনৈক রমনীর সাথে আমার বিবাহ ঠিক হয়। আমি গোপনে তাকে দেখার চেষ্টা করি। এভাবে একদিন তাকে তাদের বাগানে দেখে ফেললাম। আমার এই ব্যাপারে কেউ কেউ অভিযোগ করলো যে, রসূল (সঃ)-এর সাহাবী হয়ে এরূপ কাজ? উত্তরে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) বললেনঃ আমি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি বিবাহপূর্ব পাত্রী দেখা দূষণীয় নয়।–ইবনে মাজা
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর দুহিতা উম্মে কুলসুমকে বিবাহের জন্য প্রস্তাব পাঠান। এই বর্ণনার শেষ দিকে একথাও উল্লেখ আছে যে, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) পূর্বে তাঁকে দেখে ছিলেন।
.
হবু পাত্রী দেখার ইসলামী পদ্ধতি
একথা ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে হবে যে, ইসলামে পাত্রী দেখার অনুমতি অবশ্যই আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এ ক্ষেত্রে বিজাতীয় রীতিনীতিও ইসলামে বিধিসম্মত! বিজাতীয় ও ইসলাম বহির্ভূত রীতি-নীতি হচ্ছে, বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রী বেপরোয়া ভাবে অবাধ দেখা সাক্ষাত করে থাকে এবং প্রেম ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে বিবাহের মনযিলে গিয়ে পৌঁছে। এ পদ্ধতি ইসলামে আদৌ বৈধ নয়। বরং তা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। পূর্বে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) এ পাত্রী দেখার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এতেই প্রতীয়মান হয়, ইসলামে পাত্রী দেখার ধরন পদ্ধতি কি ছিলো। তাছাড়া এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ভদ্রমহিলার চেহারা, হাতের তালু তালু কিংবা বেশী তা বেশী পায়ের পাতা ব্যতীত গোটা দেহাবয়ব সতর স্বরূপ। এই তিনটি স্থান চেহারা, হাতের তালু ও পায়ের পাতা ব্যতীত শরীরের অন্য কোনো অংশ কোনো নারীর পক্ষেই পরপুরুষের সামনে খোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। বিস্তারিত সামনে আলোচিত হবে।
যা হোক, ইসলামে পাত্রী দেখার ব্যাপারে শুধু এতোটুকুই জায়েয। শরীয়তের বিধি লঙ্খন করে দেখা জায়েয নয়। পাত্রী দেখার ব্যাপারটি পাত্রীর জানা থাকাও আবশ্যক নয়। পাত্রী সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কোন রূপে জরুরী জ্ঞাতব্যগুলো পাত্র জানতে পারলেই হল। ইমাম নববী বলেন : শুধু চেহোরা ও হাতের তালু দেখা উচিত। তিনি লিখেন?
ام مايباح له التنظر إلى وجهها وتنقيها فقط هما نیشابور و ته ليتد بالوجه على الجمال وبالكيني على خصوبة البدني أو عدمها
পাত্রের পক্ষে পাত্রীর শুধুমাত্র চেহারা ও হাতের তালু দেখা বৈধ। কেননা এ দু’টি সতরের অন্তরভুক্ত নয়। তাছাড়া, চেহারা দ্বারা সৌন্দর্য জানা যায় আর হাতের তালু দ্বারা শরীরের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।–শারহু মুসলিম।
এটা সম্পূর্ণ জ্ঞাতব্য বিষয় যে, চেহারা দেখে মেয়েদের রূপ-সৌন্দর্য অনেকটাই আন্দাজ করা যায়। সৌন্দর্য-অসৌন্দর্য চেহারায়ই ধরা পড়ে। বরং মানুষ একটু তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন হলে শুধু মাত্র চেহারা দর্শন করেই তার জীবনের অনেক কিছু জেনে ফেলতে পারে। স্রষ্টা মানুষের চেহারাকে তার বাহিরাবয়বের হৃৎপিণ্ড বা আয়না স্বরূপ বানিয়েছেন। চেহারাকে অন্তরদৃষ্টি-যন্ত্র বললে ভুল হবে না।
এ বিষয়ে মাওলানা সানাউল্লাহ পানিপথী (রহঃ) এর উক্তি ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। তিনি বলেন, বিবাহের পূর্বে পাত্রীর মুখাবয়ব ও তার হাতের তালু দেখে নিতে হবে। হাদীসেও এর সমর্থন মেলে। তবে পায়ের পাতার কথা ফিকহের কোন কোন শরয়ী মূলনীতির ভিত্তিতে সংযুক্ত করেছেন।
অতপর পাত্রীর কোন অংশ এবং কতটুকু দেখা যাবে, সে সম্পর্কে ইমামদের মধ্যে মতাবিরোধ আছে। চেহারা ও হাতের তালু সম্পর্কে সবাই একমত। এতে কারো দ্বিমত নেই।
ইসলামী শরীয়তে পরনারীর ওপর দৃষ্টি পড়েলে প্রথম দৃষ্টিটুকুই শুধু বৈধ। দ্বিতীয় বার দৃষ্টিপাত করা বৈধ নয়। কোনো পুরুষের পক্ষে পরনারীর সাথে একান্ত মিলিত হওয়া এবং কথা বলা, প্রেম ভালোবাসা আদান-প্রদান ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না। বরং কঠোরভাবে নিষেধ করে। অবশ্য প্রয়োজনবশত লোকলায়ে কথা বলা যায়। এ ধরনের আরো অনেক নীতি-কথা উল্লেখ আছে। এসব কথার প্রেক্ষিতে বলতে হয়, ইসলামে পাত্রী দেখা বৈধ হলেও তা আবশ্যক পরিমাণ ও ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে। তার আগে ভাড়ার অনুমতি নেই। পাত্রীকে তার গৃহাভ্যন্তরে আটপৌররে পোশাকে দেখে নেবে মাত্র। তাও সুদৃষ্টি ও সতোর শর্ত সাপেক্ষে।
م ة ، و ۸ و
ه م
به به و ۸
و
م,
خاص النية عند ابتداء النظر ثم يفوض الامر الى
, م م
প্রথমে দেখার সময় নিয়ত ঠিক রাখবে, অতঃপর বাকী কাজ আল্লাহর হাতে সেপে দেবে। -আল-আরফুশ শাযী
এই সব বিধি-বিধান দ্বারা ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর ভবিষ্যৎ দাম্পত্য জীবনে যেন কোনো রকম তিক্ততার সৃষ্টি না হয় এবং বিবাহের উদ্দেশ্যাবলী পূর্ণ রূপে সফলকাম হয়।
ভালোবাসাঃ আল্লামা রশীদ রিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে–
মিসরীয় প্রখ্যাত গবেষক আল্লামা রশীদ রিযার একথা সম্পূর্ণ সত্য। তিনি লিখেনআমি দীর্ঘ ত্রিশ চল্লিশ বছর যাবত নারী সংক্রান্ত বিষয়াদি ও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। গবেষণা উপলক্ষে আমাকে বহু প্রাচীন ও নতুন গ্রন্থাদি, সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকা পাঠ করতে হয় এবং এ বিষয়ে স্বীয় তাফসীরুল মানার-এ অনেক কিছু লিখেছি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক নির্ভর করে তাদের বিবাহ পূর্বকালীন জানা-শোনা ও প্রেম-ভালোবাসার ওপর-প্রাচ্য-পাশ্চাত্যবাসীদের একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভ্রান্ত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আমার অভিজ্ঞতা একথা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসা ও অবাধ মেলামেশা বিবাহের পর সাধারণত সমাপ্ত হয়ে যায় এবং আরবদের একথা সম্পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণিত হয়ঃ
الزواج يفسد الممت۔
বিবাহ পূর্ব-প্রেমের ভিত্তি ধসিয়ে দেয়।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের সঠিক ভিত্তি হচ্ছে হযরত উমর (রাঃ)-এর সেই উক্তি–যা তিনি তাঁর নিকট এক মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন। উক্ত মহিলা হযরত উমর (রাঃ) এর দরবারে হাযির হয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করে বলেছিলেন যে, আমি তাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে পারছি না।
একথা শুনে হযরত উমর (রাঃ) তাকে বললেন, কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীকে নিষ্টার সাথে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে না পারে, সে কথা তার স্বামীকে অবহিত করা উচিত নয়। কেননা আন্তরিক প্রেম ভালোবাসার ওপর স্থাপিত-এমন গৃহের সংখ্যা বিরল। প্রতিটি ব্যক্তিকে পারস্পরিক মান-মর্যাদা ও ইসলামের ভিত্তিতে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে হবে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী উভয়কে পারস্পরিক ইজ্জত সম্ভ্রম বজায় রাখতে হবে এবং ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর ওপর যে যিম্মাদারী ও গুরু দায়িত্ব-কর্তব্য অর্পণ করেছে, তা পালন করার চেষ্টা করতে হবে। এভাবেই দাম্পত্য জীবন সুখী-সুন্দর ও আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে।
অতঃপর তিনি বলেন : স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব কর্তব্য হচ্ছে, অন্তরে যেটুকু ভালোবাসা আছে, তার চেয়েও অধিক মুখে প্রকাশ করা। তাহলে এইভাবে ক্রমশ অন্তর ভালোবাসা দৃঢ় হবে এবং দাম্পত্য জীবন সুখী সুন্দর ও আনন্দময় হবে।
.
প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর বিবাহের নির্দেশ ও অন্যান্য উপদেশ
মানব চারিত্রিক সতোর যে-সব অনুষঙ্গ দ্বারা যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার ভিত্তি দৃঢ় ও মযবুত হয়, সৃষ্ট হয় পুত-পবিত্রতার পরিবেশ ইসলাম তার সবগুলোকেই তার শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করেছে। সে সাথে যে কোন দিক থেকেই এমন কোন ফাঁক-ফোকর সৃষ্টির সকল সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, যেখান দিয়ে শয়তানী কুমন্ত্রণা অনুপ্রবেশ করে মানুষকে তার যৌন পবিত্রতা কলঙ্কিত করার জন্য প্ররোচনা দিতে পারে।
মূলতঃ ইসলাম বালেগ তথা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে ছেলে-মেয়ের বিবাহদান কার্য অনুমোদন করেছে এবং যৌবনের উদ্দামকাল আমগনের পূর্বেই এমন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে, যা পুরুষ নারীর কল্পনা শক্তিকে বিপথগামী হতে বাধা দেয়। আর এর ফায়দা হচ্ছে সাবালকত্বের শুরুতেই উভয়ে বৈধ ভালোবাসা ও আত্মীয়তার চেষ্টা করবে।
.
প্রাপ্তবয়স্কের পর বিবাহের তাকীদ
প্রাপ্তবয়স্কের পর ইসলামের বিধান হচ্ছে, অতি শীঘ্র বিবাহকর্ম সম্পন্ন করা। কেননা, যৌবনকাল অনুরাগ-আসক্তির সময়। কাম উত্তেজনা চাড়া দেয়ার মুহূর্ত। এ বয়সের সন্ধিক্ষণে মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ-চিন্তার যোগ্যতা হলেও তা আবেগের নীচে চাপা পড়ে থাকে। সাধারণত কম সংখ্যক লোকই এই বয়সে লাভ-লোকসানের চিন্তা করে। তাই জীবনের এই নাযুক সময়টা যদি আইনী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা না হয়, তাহলে বিপথগামী হওয়ার প্রবল আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে। এ কারণেই বিশেষত নব যৌবন প্রাপ্তদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে :
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন
يا معشر الشباب من استطع منكم الباءة فليتزوج—
হে যুব সমাজ! তোমরা যারা বিবাহ করতে সক্ষম, তারা যেন বিবাহ করো।–বুখারী
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর যৌবনকাল শুরু হয় এবং বত্রিশ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। কারো কারো মতে ত্রিশ বছর পর্যন্ত।
যামাখশরীর উক্তি
قال الق رى ان الشباب منتدي البلوغ انیشتین
وثلاثين …….. وقال الووى الأمم المختار أن الشباب من بل
بل الى ان يجاوز الأربعين ثم هو
شین تم
ولم يج
شي هكذا في فتح الباری۔
আল্লামা যারুল্লাহ যামাখশারী (রহঃ) বলেন : প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে বত্রিশ বছর পর্যন্ত যৌবনকাল। আর ইমাম নববী বলেন ও বিশুদ্ধ মত হল বালেগ হওয়ার সময় থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত যৌবনকাল। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত প্রৌঢ়ত্ব। চল্লিশের পর বার্ধক্য।–ইবনে মাজাহ
এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বালেগ হওয়ার পরই ইসলাম বিবাহের নির্দেশ প্রদান করেছে, তা প্রমাণ করা, যাতে জীবনের এই উচ্ছংখল ও নাজুক মূহূর্তে মানুষ ভ্রান্ত ও ভুলপথে চালিত হয়ে যৌন পবিত্রতার আঁচল কলঙ্কিত করতে সুযোগ না পায়।
.
সন্তানের বিবাহ সংক্রান্ত দায়িত্ব পিতার
এ বয়সে সাধারণত ছেলে-মেয়ে মাতা-পিতার অনুগত্যে থাকে। বিবাহের উপকরণ আপনা থেকে অনেকেই যোগাড় করতে পারে না। লাজ-লজ্জার ব্যাপার আছে। ফলে, বিবাহের প্রয়োজন অনুভব করলেও মাতা-পিতার কাছে লজ্জার কারণে বলার সাহস হয় না। এই নাজুক মুহূর্তে যৌন-পবিত্রতা কখনো কখনো বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এ বয়সের ছেলে-মেয়েদের বিবাহের দায়িত্ব মাতা-পিতার ওপর অর্পণ করেছেন। রাসূল (ছঃ) বলেছেন :
من ولي ولد فليحسن إسمه وان به فإذا بلغ فيزوجة فإن بلغ ولم
زوجة اصاب إثما قاما إثمه على أبيه.
সন্তান জন্মের পর তার সুন্দর নাম রাখা, সুশিক্ষা দান করা এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিবাহ দেয়া পিতার কর্তব্য। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর পিতা বিবাহ দান না করলে ছেলে-মেয়ে যে পাপ করবে, তা পিতার ওপর বর্তাবে।–বায়হাকী।
উপরোক্ত হাদীস থেকে দুটি বিষয় জানা গেলো। এক, পিতা ছেলে-মেয়েকে সুশিক্ষা দান করবেন, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনে পথ-প্রদর্শক হবে এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি লালন করবে। ফলে সে অশ্লীলও পাপকর্ম থেকে বিরত হবে। দ্বিতীয়, প্রাপ্তবয়স্ক হলেই পিতা পুত্রকে বিবাহ করাবেন। বিলম্ব ও অবহেলা করবে না। কেননা, মাতা-পিতার অবহেলার দরুন ছেলে-মেয়ের বিবাহে বিলম্ব হলে ইত্যবসরে যে পাপ সে করবে, তা থেকে মাতা-পিতার উপর বর্তাবে।
অন্য এক হাদীসে কন্যা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
قال في التوراة مكتوب من بعث ابنته اثنتي عشرة سنة وكم
يزوجها أصابت إثما قاثم ذالك عليه.
তাওরাতে লিখিত আছে, কোন মেয়ের বয়স বারো বছর পার হওয়ার পর যে ব্যক্তি তাকে পাত্রস্থ করবে না, সে মেয়ে কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হলে তা পিতার ওপর বর্তাবে। –বায়হাকী শুআবুল ঈমান
উভয় হাদীসের আলোকে, মাতা-পিতার দায়িত্ব হচ্ছে, ছেলে-মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই বিবাহের ব্যবস্থা করা। ছেলে-মেয়েরও বিবাহ কার্যে অনীহা প্রকাশ করা অনুচিত। সময় হলেই সহসা তৈরি হতে হবে। মাতা-পিতারও কর্তব্য হচ্ছে, ছেলে-মেয়েকেও সময় মত বিবাহ করিয়ে দেয়া। অবশ্য তাদের সম্মতি নিয়ে-যাতে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত ও দৃঢ় হতে পারে।
মাতা-পিতাকে তাকীদদান ও বিষয়ের গুরুত্ব প্রকাশার্থে এও বলা হয়েছে যে, যদি সময় মতো বিবাহ না দেয়ায় এবং মাতা-পিতা তাঁদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, ছেলে অথবা মেয়ের কেউ ব্যভিচার বা ব্যভিচারে প্ররোচিত করে এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়, তবে সে পাপের একাংশ মাতা-পিতার উপর বর্তাবে।
.
অমুসলিমদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ
ইসলাম বৈবাহিক সম্পর্ক যাতে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে দিকেও লক্ষ্য রেখেছে। যেন ভবিষ্যতে তাতে দুর্বলতা ও শিথিলতা সৃষ্টি হতে না পারে, উক্ত কারণে ইসলামী শরীয়ত বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর মধ্যে আকীদা-আমল, সমাজ-রীতি ও ধর্মমতে সাদৃশ্য বিধান করেছে। এই ভিত্তিতেই মুশরিক ছেলে-মেয়ের সাথে মুসলমান ছেলে-মেয়ের বিবাহ অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। মুশরিক বিবাহ নিষিদ্ধকারী কুরআনের এই আয়াত।;<: ১—-< 3-এর টীকায় শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রঃ) লিখেছেন:
যে-সমস্ত মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম, প্রেম-ভালবাসা ও তাদের সাথে মেলামেশা করা শিরকের ঘৃণা ও তার অপকারিতা মন থেকে হ্রাস করে এবং শিরকের প্রতি আকর্ষণের কারণ হয়, যার পরিণাম ফল জাহান্নাম। তাই এদের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণ বর্জন করা একান্ত কর্তব্য।–মুয়াহ-ই-ফুরকান বর হাশীয়া-ই-কুরআন
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রঃ)-এর উক্তি–
আলোচ্য আয়াতে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, মুসলমানরা যখন কাফির ও মুশরিক সম্প্রদায়ের সাথে মেলামেশা করবে এবং মুশরিক ও মুসলিমের মধ্যে সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠবে, তখন বিশেষ ভাবে তা বিবাহের সম্পর্কের আকারে আত্মপ্রকাশ করবে। এরি প্রেক্ষিতে অবশ্যম্ভাবীরূপে দ্বীনের মধ্যে গোলযোগ ও জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে অন্তরে কুফর ও নেফাঁকের প্রভাব সৃষ্টি হবে।–হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা
এ সব তো ধর্মীয় অপকারিতার দিক। পার্থিব ক্ষতি হচ্ছে, দুটি ভিন্ন ধর্মের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসা গড়ে উঠতে পারে না। প্রেম-ভালাবাসার সুবাতাস সৃষ্টি হওয়া অন্ত্যন্ত সুকঠিন। বরং দিন-দিন তিক্ততার পথ প্রশস্ত হতে থাকে। ফলে যৌন পবিত্রতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। আদৌ বিবাহের উদ্দেশ্যই সফলতা লাভ করতে পারবে না।
.
কুফূ বা সমতা রক্ষা
প্রেম-প্রীতির কারণেই খোদ মুসলমানদের মধ্যেও কোনো কোনো বিষয়ে কুফূ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। যেমন মু’মিন স্ত্রীলোকের বিবাহ মুশরিক পুরুষের সাথে কিংবা নেককার পুরুষের বিবাহ বার স্ত্রীলোকের সাথে হবে না।
কোরআন পাক এরশাদ করেছেন :
الاي لاينك إلا زانية أو مشرك والژانية ينكحها إتزان أو
مشرك وحرم ذالك على المؤمنين–
ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক রমণীকেই বিবাহ করবে এবং ব্যভিচারিণী-তাকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিবাহ করবে; মু’মিনদের পক্ষে এদের বিবাহ করা বৈধ নয়।–সূরা আন নূর : ৩
এ আয়াত থেকে বুঝা গেল, ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী নেককার পুরুষ ও নেককার স্ত্রীলোকের সমগোত্র (কুফূ) নয়। কেননা, কার্যক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। মিলমিশের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
যেমন কোরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :
افمن كان مؤمنا من كان فاسقا كيتون–
ঈমানদার ব্যক্তি কি নাফরমান ব্যক্তির মতোই? তারা কখনো সমান নয়। -সূরা আস সিজদাহ
ধন-সম্পদের ক্ষেত্রে কুফূ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একমাত্র ইমাম শাফিয়ী (রঃ) মাল-সম্পদের কুফূর প্রবক্তা। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে এটা এমন কোনো জিনিস নয়, যা প্রেম-ভালবাসায় বাধ সাধতে পারে। মূলতঃ কখনো কখনো ধন-সম্পদও গন্ডগোলের কারণ বৈ কিছু নয়।
.
বংশগত কুফূ গুরুত্ব হীন
কোনো কোনো ইমাম বংশের ক্ষেত্রেও সমগোত্রের বিধান করেছেন। হয়ত তাদের লক্ষ্য ছিলো যুক্তিগত উপযোগিতা। অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করে যে, বংশমর্যাদা সামাজিক বৈষম্যের দরুন বাস্তব জীবনে নানান জটিলতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কুফূর ধর্মীয় মর্যাদা কতোটুকু?
ইবনে হাজার আসকলানীর (রঃ)-এর মতে বংশগত কুফূর বৈধতা সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস নেই। বরং তার বিপরীত এমনসব হাদীসও রিওয়ায়েতসমূহ কিতাবে বিদ্যমান, যাতে বুঝা যায়, নবী ও সাহাবা-যুগে বংশগত কুফূর তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না।
ইমাম বুখারী (রঃ)আল-আকফা ফিদ্দীন শীর্ষক অনুচ্ছেদে দুটি ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা যায়, সেকালে বংশগত কুফূ ধর্তব্য ছিলো না। প্রথমটি বদরী সাহাবী হযরত আবু হুযাইফা (রাঃ)-এর। তিনি এক আনসারী মহিলার আযাদক্বত গোলাম হযরত সালিম (রাঃ)-এর কাছে স্বীয় ভাতিজী হিদা বিনতে ওয়ালীদ (রাঃ) কে বিবাহ দেন। এই হিন্দা (রাঃ) ছিলেন মুহাজির মহিলাদের অন্যতম।
অপর ঘটনাটি হযরত যাবা’আ বিন্তে যুবাইর (রাঃ)-এর। তাঁর বিবাহ হয়েছিল হযরত মিকদাদ (রাঃ)-এর সাথে। অথচ বংশ-গত দিক থেকে হযরত যাবা’আহ্ (রাঃ) বহু উচ্চস্থানীয় ছিলেন।
আল্লামা হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি একথা প্রমাণ করেছেন যে, বংশগত কুফূর কোনো গুরুত্ব নেই। বংশগত কুফূতে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ী করা ইসলামী সাম্য শিক্ষার পরিপন্থী। আল্লাহ্ পাক গোত্র-বা সম্প্রদায়কে দুনিয়ায় পারস্পরিক পরিচয়-সূত্র বানিয়েছেন। ইসলামে তার কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন :
إن أكرمكم عند الله أتقاكم–
তোমাদের মধ্য থেকে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক তাওবাবান অর্থাৎ আল্লাহভীরু।–সুরা হুজুরাত : ১
আরেক স্থানে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন :
إنما المؤمنون اخوة–
মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই।–সূরা হুজুরাত : ১
.
বংশগত কুফূ সম্পর্কে রসূল (ছঃ) এর বাণী ও
তাঁর সময়কার কার্যকলাপ
উক্ত আয়াত এবং এ ধরনের অন্যান্য আয়াতগুলো মুসলমানদের পারস্পরিক সমতা-নির্দেশক। নবী করীম (ছ) এ বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করেছেন। তিরমিযী শরীফের এ হাদীসটি উপরে বর্ণিত হয়েছে ও তোমাদের নিকট যদি এমন কোনো ব্যক্তি বিবাহের প্রস্তাব পাঠায়, যার চরিত্র ও দ্বীন তোমাদের পছন্দনীয়, তবে তাকে বিবাহ করে নাও। কেননা, দ্বীন ও চরিত্র ব্যতীত অন্য কোন জিনিসকে ভিত্তি স্থির করলে যমীনের বুকে ফিতনা-ফাসাদের ফোয়ারা ছুটবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন : ৪ • • • ১ ১৭।
ان أل بنى فلان ليسوا إلى با ولياء أن أوليائي المتقون حيث
كانوا و اين كانوا ۔
অমুক বংশের লোকেরা আমার বন্ধু নয়, আমার বন্ধু হচ্ছে আল্লাহভীরু লোক-তারা যেভাবের হোক এবং যেখানের হোক।
তাছাড়া, হযরত জয়নবের ঘটনা সবারই জানা যে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) যয়নব বিন্তে জাহাশকে স্বীয় আযাদক্বত গোলাম যাইদ ইবৃনে হারিসার সাথে বিবাহ দেন। ফাতেমা বিনতে কায়েস ফারিয়াকে যায়দের ছেলে হযরত উসামার সাথে বিবাহ দেন। হযরত বেলাল ইবনে রাবাহ হাবশীর (রাঃ) বিবাহ হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের সহোদরভাইয়ের সাথে হয়েছে।–যাদুল মা’আদ
এ সব ঘটনাসমূহ সামনে রাখলেই বংশগত কুফূর গুরুত্ব কতোটুকু, তা সহজে বুঝা যায়। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগোত্র বা কুফূ ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ না করা।
.
বিবাহের প্রচার ও প্রসার
ইসলামী বিধানে যৌন পবিত্রতা রক্ষায় সমস্ত ফিতনা-ফাসাদের উৎসসমূহ চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে যে-সব কারণে অবৈধ প্রণয় ও দুশ্চরিত্রতা লালিত-পালিত হতে পারে, আল্লাহর আইনের সীমার মধ্যে থেকে পাপাচারগুলো বন্ধ করার জোর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এ কারণেই ইসলামী শরীয়ত বিবাহের প্রচারণা অত্যাবশ্যক করেছে। কেননা, বিবাহের প্রচার প্রসার না হলে এই পথে ফিতনা-ফসাদ মাথাচাড়া দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রথমত একথা হৃদয়ঙ্গম করা উচিত যে, বিবাহ ও অবৈধ প্রণয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকা আবশ্যক, যাতে অস্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থবোধকতার বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে।
ইতিপূর্বে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, বিবাহ বৈধ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, কমপক্ষে দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন নারীর সাক্ষী হিসাবে বিবাহ মজলিসে উপস্থিত থাকা এবং স্বামী-স্ত্রীর ঈজাব-কবুল এমনভাবে সম্পন্ন হওয়া যাতে সাক্ষীরা তা শুনতে পায়। আর উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে বিবাহ অনুষ্ঠানে অধিক সংখ্যক লোক উপস্থিত থাকা। এজন্য আকদ মসজিদে হওয়া উত্তম।
রাসূলে করীম (ছঃ) এর ইরশাদ হচ্ছে?
اعلنوا هذا النكاح واجعلو في المساجد واضوبوا عليه بالهفوف–
বিবাহ অনুষ্ঠানের ঘোষণা করে দাও এবং বিবাহ মসজিদে বসে পড়াও, আর অধিক প্রচারের জন্য দফ বাজাও।–তিরমিযী।
মসজিদে বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি বিরাট উপকারিতা হলো প্রচার প্রসার। কেননা মসজিদে স্বাধীনভাবে সবাই আসতে পারে। কারো ব্যাপারে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। আর দফ বাজানোর উদ্দেশ্য তো প্রচার-প্রসার ছাড়া অন্য কিছু না। ইসলামে অর্থহীন খেলাধূলার অবকাশ রাখা হয়নি। একবার রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ফরমান ও
فصل ما بين الحلال والحرام الصوت و الفت في النكاح ۔
বৈধ ও অবৈধের মধ্যে পার্থক্যরেখা হচ্ছে বিবাহে প্রচার-প্রসার ও দফ বাজানো। -তিরমিযী
.
বিবাহের প্রচারের প্রয়োজনীয়তা
যদি বিবাহের প্রচার-প্রসার অপরিহার্য করা না হয়, তাহলে মানুষ চুপি চুপি ও অবৈধ প্রেমকেও বিবাহের সমপর্যায়ে এনে দাঁড় করাবে। আর এভাবে একটি অবৈধ পথ সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তা’আলা এ কারণেই কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। বলেছেন : যৌন পবিত্রতাকে বিবাহের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বানাতে হবে। শুধুমাত্র কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করলেই চলবে না। তাই পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে একটি বাক্য সংযোজন করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বিবাহ ঘোষণা সহকারে হতে হবে।
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে :
مثمنين تر مساويين و ميرى اخدان–
তারা (স্বামীরা) সচ্চরিত্র ও পুণ্যবান হবে-প্রকাশ্য ব্যভিচারী অথবা উপপত্নী গ্রহণকারী হবে না।–সূরা আল নিসা : ২৪।
পবিত্র কোরআনে আরো এরশাদ হয়েছে :
ممحونات في مسافات و مميزات أخدان–
তারা (স্ত্রীরা) সচ্চরিত্রা ও পুণ্যবতী হবে-প্রকাশ্য ব্যভিচারিণী অথবা উপপতি গ্রহণকারিণী হবে না।–সূরা আন-নিসা : ২৫
.
বিবাহের প্রচার ওলীমার মাধ্যমে
বিবাহ প্রচারের আরেকটি পথ অবলম্বন করা হয়েছে যার হৃদয়গ্রাহিতা ও পবিত্রতা সর্বজন স্বীক্বত। তা হল বাসর শয্যার পর ওলীমা তথা বৌ-ভাত খাওয়ানো মুস্তাহাব। হাদীসে ওলীমা খাওয়ানোর বিশেষ তাকীদ রয়েছে। স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামও সাহাবীদের দাওয়াত করে ওলীমা খাইয়েছেন। হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ)-এর সাথে যখন তার বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়, তখন বকরী যবাই করে তিনি সাহাবীদের ওলীমা খাইয়েছেন।
হযরত সফিয়া (রাঃ)-কে বিবাহের সময় সাহাবীদেরকে হায়স পাকিয়ে খাইয়েছেন। (হায়স এক বিশেষ ধরনের আরবী সুস্বাদু খাবার খেজুর, পনির ও ঘৃত সহকারে যা প্রস্তুত করা হয়) এমন কি কোন কোন সহধর্মিণীকে বিবাহের সময় অন্য কিছু যোগাড় করতে না পেরে দুই মুদ যবের দ্বারা দাওয়াত খাইয়েছেন।–মিশকাত ও ইবন মাজা
সাহাবীদেরকেও ওলীমা খাওয়ানোর তাকীদ দান করেছেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বর্ণনা করেন :
قال إلى النبي صلى الله عليه وسلم أولم ولو بشاة–
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন : একটি মাত্র বকরী দ্বারা হলেও ওলীমা করো।-বুখারী।
কেউ কেউ এ কারণেই ওলীমার দাওয়াতকে ওয়াজিব বলেছেন। কিন্তু সঠিক কথা হল সুন্নাত বা মুস্তাহাব। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তত কিছু লোককেও খাওয়ানো উচিত। অবশ্য তার অর্থ এ নয় যে, ঋণ করে কিংবা মুনাফার ওপর টাকা নিয়ে হলেও ওলীমা অবশ্যই খাওয়াতে হবে।
.
ওলীমার দাওয়াত কবুল করা
ভেবে দেখুন, একদিকে ওলীমার দাওয়াত করার নির্দেশ রয়েছে, আর অপরদিকে ওলীমার দাওয়াত কবুল করতে তাকীদ দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিহ ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
إذا دعى أحدكم إلى وليمة عرس قليج .
তোমাদের কেউ যদি ওলীমায় (বৌ-ভাত) আমন্ত্রিত হয়, তবে সে যেন তা কবুল করে।–ইবনে মাজা
.
ধনী-গরীব সবাইকে দাওয়াত দিতে হবে
ওলীমার দাওয়াত গরীবদের বাদ দিয়ে শুধু ধনীদের দিলে চলবে না, বরং দরিদ্রদেরও দাওয়াতে শামিল করতে হবে। নবী করীম (ছঃ) ফরমানঃ
ر
و م الوليمة يدعي الأغنياء وبترك الفقراء—
।নিকৃষ্টতম খাবার হচ্ছে সেই ওলীমার খাবার, যাতে গরীবদের বাদ দিয়ে শুধু ধনীদের দাওয়াত দেয়া হয়।–বুখারী-মুসলিম।
হাদীসেই বর্ণিত আছেঃ
من ترك القهوة فقد عصى الله و رسوله . متفق عليه ..
ওলীমার দাওয়াত পাওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তাতে শরীক হলো না, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করল।–বুখারী-মুসলিম
উপরোক্ত হাদীসগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখলেই অনুমান করা যায়, এ দাওয়াতের গুরুত্ব কতখানি। এতে আনন্দ প্রকাশের সাথে সাথে একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, বিবাহের খবর প্রসার হয় এবং কারো সন্দেহ-সংশয়ের সুযোগ না থাকে।
একটুখানি চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, এই প্রচার-প্রসারের বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে, যৌন পবিত্রতাকে পরিপূর্ণ রূপে সংরক্ষিত করা এবং কেউ যেনো এই পথে অবৈধভাবে যৌন পবিত্রতাকে কলুষিত করতে না পারে। বিবাহের নামে কোন প্রতারক যেন কোন অপকর্ম করতে সুযোগ না পায়। সেই সাথে বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে কারো মনে যেন কোন প্রকার সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।
.
বৈধ যৌন কামনায় স্বাধীনতা
বিবাহ কার্য সম্পাদনের পর ইসলাম স্বামীকে স্ত্রী থেকে এবং স্ত্রীকে স্বামী থেকে অর্থাৎ উভয়ে উভয় থেকে পুরোপুরি স্বাদ-আস্বাদনের সুযোগ দান করেছে। এক্ষেত্রে সামান্যতম প্রতিবন্ধকতার অবকাশ রাখা হয় নি। এতে অন্য কারো বাধা-বিঘ্নও সহ্য করা হয়নি। পারস্পরিক যৌন কামনায় দিন-রাতেরও কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বসন্ত-হেমন্তেরও কোন প্রশ্ন নেই। শীত-গ্রীষ্মের কোন শর্ত নেই। শরৎ-বর্ষারও কোন নিয়ম নেই। আর না কোন বেশরীয়তী হস্তক্ষেপের অবকাশ আছে।
শুধুমাত্র বৎসরের কিছু সময়ে নিষেধাজ্ঞা
বছরে মাত্র একটি সিয়াম সাধনার মাস। এ মাসে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ওপর রোযা পালন ফরয। আর রোযা পালন অবস্থায় যৌন সম্ভোগের অনুমতি নেই। তথাপি পরস্পরে অসংযত কথাবার্তা ও রসালাপ করাও নিষিদ্ধ করা হয়নি। যা হোক, নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক শুধু সেহেরী খাওয়ার পর থেকে ইফতার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ইফতারের পর এবং নির্দিষ্ট সময়গুলো ছাড়া রমযানেও স্ত্রী সহবাসের স্বাধীনতা দান করা হয়েছে। কোরআন মজীদেই ঘোষণা করা হয়েছে :
أحل لكم ليلة الام الرفث إلى يا گم هن لباس لكم وانتم باش
قم ها
রোযার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সহবাস বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।–সূরা আল বাকারা : ১৮৭
আলোচ্য আয়াতে রমযানের রাতের উল্লেখ করা হয়েছে। অপর এক আয়াতে এরশাদ করা। হয়েছে, সূর্যাস্তের পর স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয় থেকে সবরকম মজা লুটতে পারে। যেমনি ভাবে পানাহারের সাধারণ অনুমতি রয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা কোরআনে এরশাদ করেন :
فالآن باشروهن وابتؤاما كتب الله لكم ولوا واشربوا حتى يتبين
لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر–
সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে সঙ্গত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করেছেন, তা কামনা করো। অর্থাৎ স্ত্রী সহবাস। আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাত্রির কালো রেখা হতে উষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। –সূরা আল বাকারা : ২৩
পবিত্র রমযান মাস ছাড়া স্বামীর অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর কোনো নফল রোযা রাখার হুকুম–নেই।
হায়েয ও নেফাস অবস্থায়
এছাড়া আরো দুটি সময়ে মহিলারা প্রাক্বতিক অপবিত্রতায় আক্রান্ত হয়। একটি মাসিক ঋতুর সময়। গর্ভবতী ছাড়া প্রতিটি বালেগা নারীর প্রতি মাসেই এ রক্তস্রাব হয়ে থাকে। এর সময়সীমা ঊর্ধ্বপক্ষে দশদিন এবং কমপক্ষে তিনদিন।
দ্বিতীয়টি নিফাসের সময়। সন্তান প্রসবের পর উপর্যুপরি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত প্রসূতির রক্তস্রাব হয়ে থাকে। এর ঊর্ধ্ব সময়সীমা চল্লিশ দিন পর্যন্ত, আর কমের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। এ দিনগুলোতেও স্ত্রী-সহবাস বর্জন করতে বলা হয়েছে। কেননা, এটি অপবিত্রতার সময়। স্বভাবতই এরূপ সময়ে স্ত্রী-সহবাসে ঘৃণার উদ্রেক হয়। এছাড়া এ উভয় সময়ে সহবাসে মারাত্মক রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হওয়ারও আশঙ্কা বিদ্যমান।
কোরআন মজীদে এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
يشكون من المحيض قل هو اذی فاعتزلوا النساء في المحيض
ولا تقربوهن حتى يطهرن فاذا تطهژن فأتوهن من حيث أمركم الله–
(হে নবী!) লোকে আপনাকে রজঃস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বল, তা অশুচি’। তাই তোমরা রক্তস্রাবকালে স্ত্রী-সহবাস বর্জন করবে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী-সহবাস করবে না। সুতরাং তারা যখন উত্তম রূপে পরিচ্ছন্ন হবে, তখন তাদের নিকট ঠিক সেই ভাবে গমন করবে, যে ভাবে আল্লাহ্ তোমাদের আদেশ দিয়েছেন।–সূরা আল বাকারা : ২২২
হায়েয ও নেফাসের পর স্ত্রী সহবাসে আর কেনো নিষেধ নেই। এই ক’দিন স্ত্রীলোক আরাম করে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং হায়েযের পর তাদের মধ্যে গর্ভ ধারনের যোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এই সময়গুলো ছাড়া যদি কোন শরীয়তী অপকারিতা বাধ না সাধে, তাহলে যে কোন সময় স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে মিলতে পারে। লাভ করতে পারে আত্মার প্রশান্তি। এর চেয়ে অধিক স্বাধীনতা এক্ষেত্রে আর কি হতে পারে? অর্থাৎ কিছু সময় ছাড়া সারাটা বৎসর স্ত্রী-সহবাসে কোন বাধা নেই।
.
স্ত্রীসহবাসের অলঙ্কারপূর্ণ বর্ণনা
কোরআন মজীদ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্ত করার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করেছে, তা বড়ই অলঙ্কারপূর্ণ এবং উভয়ের পারস্পরিক যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য যে বাকধারা ব্যবহার করা হয়েছে, তা খুবই পরিশীলিত ও পবিত্র। যেমন আয়াতে এই কথাটি উক্ত হয়েছে :
هن إباش لكم وانتم باش لهن .
তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা (স্বামীরা) তাদের পরিচ্ছদ। -সূরা আল বাকারা : ১৮৭
উক্ত আয়াতে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে উভয়ের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ সাব্যস্ত করা হয়েছে। স্ত্রী স্বামীর যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে এবং স্বামী স্ত্রীর ইযত-আবরু হিফাযত করে। অনুরূপ ভাবে স্ত্রী স্বামীর জন্য সৌন্দর্য স্বরূপ এবং স্বামী স্ত্রীর জন্য। ব্যক্তি যখনই ইচ্ছা শরীরে পোশাক পরিচ্ছদ ধারণ করে। স্বামী-স্ত্রীর অবস্থাও তদ্রূপ। প্রত্যেকে একে অপরের সাথে যখন ইচ্ছা মিলতে পারে। এতে প্রেম ভালবাসা ও অন্তরঙ্গতার প্রতিও সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে, যা বৈবাহিক সম্পর্কের প্রাণ স্বরূপ। পোশাক’ শব্দের মধ্যে এই সমুদয় কথাই সন্নিবেশিত আছে। অপর এক আয়াতে স্ত্রীকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
نساء كم حرث لكم فأتوا حرثم الى شئتم
স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব, তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার।–সূরা আল বাকারা : ২২৩
.
পায়ুমৈথুন
স্ত্রী স্বামীর জন্য শস্যক্ষেত্র স্বরূপ। এ শস্যক্ষেত্র দ্বারা স্বামীর ফায়দা লাভ করার অধিকার রয়েছে। এ জন্য স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তান প্রসব করে তা পিতারই বলা হয়। এ আয়াতে এই কথার প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, স্ত্রী সহবাসের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কলা-কৌশলের পাবন্দী নেই। অবশ্য হারছ অর্থাৎ শস্যক্ষেত্র স্বয়ং বাতলে দিচ্ছে যে, উৎপাদনের সীমা পর্যন্ত এ নির্দেশ সীমাবদ্ধ। এ কারণেই পায়ুমৈথুন অর্থাৎ মলদ্বারে সহবাস হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেননা, এটা তো মানবীয় বীজের বিনাশ সাধন মাত্র। তার বপনক্রিয়া নয়। উপরোক্ত আয়াত থেকে কারো কারো ভুল ধারণা জন্মেছে। এই ভুল ধারণা নিরসনের জন্য হারছ শব্দটিই যথেষ্ট। এতদ্ভিন্ন সহীহ্ হাদীসেও উক্ত হয়েছে যে, স্বভাব বিরোধী ব্যবহার অর্থাৎ পায়ুমৈথুন তা স্ত্রীর সাথেই হোক না কেন, সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। কোরআন অন্যত্র পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে স্ত্রীর সম্মুখভাগ দিয়েই সহবাস করতে হবে।
م و نه
دهم فاتو هن من حيث امرکم الله—
তোমরা স্ত্রীদের নিকট ঠিক সেই স্থান দিয়ে সহবাস করো, যে স্থান দিয়ে সহবাস করতে আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন।–সূরা বাকারা : ২২২
আর নির্দেশ শুধু প্রজনন সীমিত অর্থাৎ যৌনাঙ্গ। যে স্থান দিয়ে জন্তু-জানোয়ারেও সঙ্গম করে না, সে স্থান নয়। আর যে কারণে মানুষ মানবতাকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে জন্তু-জানোয়ারেরও নিচে নেমে যায়, ইসলাম তাকে কিভাবে জায়েয রাখতে পারে? হাদীস শরীফে স্পষ্টরূপে তা বারণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
من أتى حائضا أو امرأة في دبرها أو كاهنا فقد كفر بما أثر على
-যে ব্যক্তি ঋতুবতী স্ত্রীর উপর উপগত হলো অর্থাৎ ঋতু অবস্থায় সহবাস করা কিংবা স্ত্রীর মলদ্বারে সহবাস করল অথবা কোনো গণকের দ্বারা নিজ ভাগ্য গণনা করাল, সে দ্বীন-ই-মুহাম্মদকে অস্বীকার করল।–তিরমিযী।
ينظر الله تعالى الى رجل أتى رجلا أو إمراة في البر .
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো পুরুষের সাথে সমকামে লিপ্ত হয় কিংবা কোন স্ত্রীর মলদ্বারে সহবাস করলো আল্লাহ্ তার প্রতি তাকাবেন না। -তিরমিযী
من أتي البناء في انجازه فقد كفر .
যে ব্যক্তি স্ত্রীর মলদ্বারে সহবাস করলো, সে কাফির হয়ে গেলো।
উক্ত হাদীসটি ইমাম তাবারানী আসওয়াতে রিওয়ায়েত করেছেন এবং এর বর্ণনাকারীরা সবাই নির্ভরযোগ্য।–মিফতাহুল খিতাবাহ
.
প্রেম-প্রীতি
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে কুরআন মজীদ প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার জীবন বলে আখ্যায়িত করেছে। সুখ শান্তি ও আরামের জীবন বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা’আলা তার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :
ومن أيته أن خلق لكم من أنفسكم ازواجا تشكوا إليها وجعل منكم
مودة ورحمه
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন ও তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবন সঙ্গীনিদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও মমতা সৃষ্টি করেছেন।–সূরা আর রূম : ২১
অপর একটি আয়াতে এই পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন ফরমান ও
هو الذي خلقكم من نفس واحدة وجعل منها زوجها ليشن اليها–
তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি (আদম) হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর থেকে তাঁর সঙ্গীনি সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়।–সূরা আল আরাফ : ১৮৯
আলোচ্য আয়াত এবং এই ধরনের অন্যান্য আয়াতসমূহ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ককে অতি উন্নত পদ্ধতিতে তুলে ধরেছে এবং মানবজাতিকে এ পবিত্র পদ্ধতিতে স্বীয় যৌন চাহিদা পূরণ ও মানসিক অশান্তি দূর করার আহ্বান জানাচ্ছে। মহান আল্লাহ্ তা’আলা পৃথিবীতে প্রতিটি জীব-জন্তুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, যাতে একাকীত্বের দুর্বিসহতায় একে অন্যের সহানুভূতিশীল হয় এবং এইভাবে উভয়ে মিলে নিরাপদ জীবন সংসার গড়ে তুলতে পারে।
.
স্ত্রী-সন্তানের ভালবাসা ও তার বিরুদ্ধে হুশিয়ারী
স্ত্রী-সন্তানকে মানুষ এত অধিক ভালবাসে যে, কখনো তাদের মধ্যে মত্ত হয়ে আল্লাহর বিধি-বিধানকে পর্যন্ত ভুল যায়। মায়া-মমতা, স্বাদ-আহ্লাদ ও আনন্দ-ফুর্তির সুখময় জীবনে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর এই ঐশ্বর্য-আরাম আয়েশ যে আল্লাহ্ তা’আলা দান করেছেন তার কথা একটিবারও স্মরণ করে না।
তাই আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার বান্দাদের সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ
ايها الذين آمنوا إن من أزواجكم وا بیگم عدوا لكم فاحذروهم وإن
تعفوا وتمحوا وتغفروا فان الله غفور رجيم
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থাকবে। আর তোমরা যদি তাদেরকে মাফ করো, তাদের দোষ-ক্রটিসমূহ উপেক্ষা করো এবং তাদেরকে ক্ষমা করো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ্ অতিব ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।–সূরা তাগাবুন : ১৪।
আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রঃ) লিখেছেন:
মানুষ অনেক সময় স্ত্রী-পুত্রের ভালবাসা ও চিন্তায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে আল্লাহ্ ও তাঁর বিধি-বিধান ভুলে যায়। এসব সম্পর্কের দরুন কতো অপকর্মে লিপ্ত হয় এবং কত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে, তার সীমা নেই। স্ত্রী ও পুত্রের ফরমায়েশ ও সন্তোষ-কামনা তাকে মুহূর্তের তরেও বিশ্রাম নিতে দেয় না। এদের ভালবাসার মোহে পড়ে সে আখেরাত সম্পর্কে গাফিল হয়ে যায়। যে পুত্র-পরিজন এত অনিষ্ট ও লোকসানের কারণ হয়, তাদের প্রকৃতপক্ষে বন্ধু বলা যায় না। বরং তারা নিকৃষ্টতম শত্রুতে পরিণত। যাদের শত্রুতার অনুভূতিও অনেক সময় মানুষের হয় না। তাই আল্লাহ্ তা’আলা সাবধান করে দিয়ে বলেছেন : এইসব শত্রু সম্পর্কে হুশিয়ার থাকো এবং এমন কোন রীতিনীতি অবলম্বন করো না, যার ফলে তাদের পার্থিব ভোগ-বিলাসিতা মিটাতে গিয়ে স্বীয় আখেরাত বরবাদ করা ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, দুনিয়ার সব স্ত্রী ও সব পুত্র-পরিজন এই ধরনের হয়ে থাকে। আল্লাহর অনেক নেককার বান্দী রয়েছে, যারা তাদের স্বামীদের দ্বীন-ধর্ম হিফাযত করে এবং নেক কাজে স্বামীর সহযোগিতা করে। আর এমন বহু সৌভাগ্যবান সন্তান-সন্ততিও রয়েছে, যারা স্বীয় মাতা-পিতার জন্য স্থায়ী নেক আমল ও সকা-ই-জারিয়া স্বরূপ।–তাফসীর-ই–মুয়াযযাহ-ই-ফুরকান বর হাশিয়া কোরআনে পাক তারজুমায়ে শায়খুল হিন্দ রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
.
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালাবাসা ও বৈধ যৌন-সম্ভোগ অব্যাহত থাকা এবং বিবাহ-সম্পর্কের দৃঢ়তার জন্য ইসলাম কিছু অধিকার ও বিধি-বিধান নির্দেশ করেছে এবং সেগুলো কার্যকর করার তাকীদ দিয়েছে। এটা এক সর্বজনসম্মত কথা যে, বিবাহের মাধ্যমে যে অপরিচিত দুটি ভিন্ন। নারী-পুরুষ সম্মিলিত হতে যাচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার অধিকারী। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সমাজরীতিতেও কোন না কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং প্রথম দেখা সাক্ষাতেই উভয়ের মধ্যে পূর্ণ মতৈক্য ও সমঝোতা হওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। তদুপরি নারী ও পুরুষের মস্তিষ্কের পরিমাপেও বৈপরিত্য বিদ্যমান। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের স্বভাব-প্রক্বতিতেও আল্লাহ পাক কিছু বিশেষ ব্যতিক্রম বিদ্যমান রেখেছেন। এ সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম স্বামীকে স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতিপয় জরুরী নির্দেশাবলী দান করেছে এবং কতকগুলো দায়িত্ব অর্পণ করেছে। অনুরূপভাবে স্ত্রীর প্রতিও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। প্রথমে স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
.
ধৈর্য ও সহনশীলতা
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে মনমালিন্য সৃষ্টি হওয়া কোনো আশ্চর্যের কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে শয়তানের প্ররোচনাদানেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আর এতে করে যৌন পবিত্রতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে স্ত্রী যখন কোমলমতি ও লাজুক হয়, তখন এ সমস্যা আরো বিরাট আকার ধারণ করে। তাই ইসলাম নারী জাতির প্রাক্বতিক দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষকে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করেছে, যাতে স্বামী-স্ত্রীর সুখী দাম্পত্য জীবনে অপ্রিয়তা সৃষ্টি হতে না পারে। যদি স্ত্রীর কোনো আচার ও ব্যবহারে স্বামীর মনে কষ্ট হয়, তবে এহেন মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
هتموهن فعسى ان تكرهوا شيئا
وعاشروهن بالم
ويجعل الله فيه خيرا كثيرا .
ويج
আর তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সভাবে জীবন যাপন করবে। তোমরা যদি তাদেরকে ঘৃণা করো, তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা যাকে অকল্যাণ মনে করছে, আল্লাহ তাতে প্রভূত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।–সূরা আন নিসা : ১৯
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ পাক ব্যাপক উপদেশ দান করে বলেছেন : কোনো পুরুষের যদি তার স্ত্রী অপছন্দ হয় এবং অন্তরে ভালো না লাগে, তবে তখন আবেগের পরিবর্তে জ্ঞান ধৈৰ্য্য। দ্বারা কাজ করতে হবে এবং অপছন্দনীয়তাকে সহ্য করতে হবে। কেননা, এটা বিচিত্র কিছু নয় যে, মানুষ তার অদূরদর্শিতার দরুন একটি জিনিসকে অপছন্দ করছে, অথচ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তার মধ্যে উত্তম উপকারিতা নিহিত রয়েছে, যা তার দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের ক্ষেত্রে কল্যাণজনক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সেই জিনিসটি, যেদিকে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইঙ্গিত করেছেন : তিনি বলেছেন
لا يضرك مؤمن مؤمنه إن كره منها خلقا رضی ثها أخر–
কোন মু’মিন পুরুষ কোনো মু’মিন নারীকে ঘৃণা করবে না। কেননা, তার একটি আচরণ অপছন্দ হলে অপরটি অবশ্যই পছন্দ হবে।–মুসলিম
বস্তুত খারাপের সাথে সাথে সাধারণত ভাল দিকও নারীর মধ্যে পাওয়া যায়। সুতরাং মন্দের ক্ষতিপূরণ ভালোর দ্বারা করতে হবে। আর এটাই হচ্ছে ধৰ্য্য ও সহনশীলতা
.
নবী (ছঃ) এর উপদেশ
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীর শারীরিক ও প্রাক্বতিক দুর্বলতার প্রতি নির্দেশ করে পুরুষদের উপদেশ দিয়ে বলেছেন
استوصوا بالشتاء خيرا فانهن خلقن من ضلع وانه أعوج شيئ في
الضلع أعلاه فإن ذهبت تقيمه سرته وإث تت كم يزل أو
নারীদের মঙ্গলের জন্য উপদেশ গ্রহণ করো। কেননা, তাদেরকে পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সবচেয়ে বাঁকা হচ্ছে পাঁজরের উপরের অংশ। যদি তুমি এটাকে সোজা করতে চাও, তবে তা ভেঙে যাবে। আর তাকে স্বীয় অবস্থায় ছেড়ে দিলে সব সময়। বাঁকাই থেকে যাবে। সুতরাং নারীদের সম্পর্কে উপদেশ গ্রহণ করো।–বুখারী
হাদীসের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, বক্রতা নারীর স্বভাবজাত ব্যাপার। তা কখনো দূর হবে না। হ্যাঁ, প্রয়োজনীয় সংশোধন হতে পারে। আর তাও কোমলতা ও সৌজন্যের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই এই চেষ্টা করাই অনুচিত যে, সে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে যাবে এবং প্রতি ক্ষেত্রে স্বামীর সাথে ঐক্যমত পোষণ করবে। কেননা, দু’জনার স্বভাব ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। কেউ যদি ভুল ধারণাবশত পূর্ণ মতৈক্যের চেষ্টা করে, তাহলে শান্তির পরিবর্তে অশান্তিই সৃষ্টি হবে। হ্যাঁ, স্ত্রীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেও ছেড়ে দেয়া চলবে না।
কেননা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক সুনিবিড়। পরিবারের সমুদয় ব্যবস্থাপনা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সমঝোতা ও যৌথ কর্মকাণ্ডে নিহিত। স্ত্রী জীবনসঙ্গিনী। তার থেকে এক মুহূর্তের জন্যই আমরা অমুখাপেক্ষী হতে পারি না। বাইরের সমুদয় কাজকর্ম যদি স্বামী দেখাশুনা করে, তবে গৃহাভ্যন্তরের কাজকর্ম স্ত্রীর হাতে। গৃহের কাজকর্ম, সন্তানের লালন-পালন ইত্যাকার বিষয়গুলো স্ত্রীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। কাজেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতৈক্য ও মিলমিশ থাকবে না, অথচ জীবনের গাড়ি দ্রুতবেগে ধাবিত হবে তা হয় না? তাই বলা হয়পুরুষ ও নারী জীবনের দুটি চাকা। এ দুটির হৃদ্যতা ও সহযোগিতা ছাড়া এ গাড়ি চলতে পারে না।
রাসূল (ছঃ) এর এ উক্তির প্রেক্ষিতে ফতহুল বারী প্রণেতা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর এই রেওয়ায়েতটি উদ্ধৃত করেন :হযরত হাওয়া (আঃ), হযরত আদম (আঃ)-এর বাম পাঁজর থেকে সৃষ্ট হয়েছিলেন।
.
সহৃদয়তা
আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসকলানী (রঃ) বলেন : ইমাম বুখারী এই অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ দাঁড় করেছেন
قوا أنفسكم وأهليگم ئاژا ۔
অনুচ্ছেদঃ আল্লাহর বাণী :তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারবর্গদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।
উদ্দেশ্য নারীদের বল্গাহীন ছেড়ে দেয়া অনুচিত। বরং কোমলতার সাথে ক্রমশ সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এ সংশোধনের দায়িত্ব পুরুষের। উপরোক্ত হাদীসে এ দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নারীদের সাথে কোমল ও সহৃদয় ব্যবহার অপরিহার্য, যা অন্তরে প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসা দৃঢ় করে। সাথে সাথে নারীর দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করতে হবে। তাদের দুর্ব্যবহার ধৈর্য দ্বারা বরদাশত করতে হবে।
একটা বিষয় এখানে বুঝতে হবে যে, নারী সৃষ্টিগত ভাবেই বক্র। তাই তাকে সম্পূর্ণ সোজা করা যাবে না। হ্যাঁ, ভালবাসা, স্নেহ ও কোমলতা দ্বারা তার প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যেতে পারে। তাতে কোন অসুবিধা নেই। স্নেহ ও কোমলতা দ্বারা সমাধানের অর্থ হচ্ছে, স্ত্রীকে স্বীয় পূর্ণ আস্থা দান করে বলতে হবে-তুমি তোমার মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হও। তোমার সামান্যতম ভুল-ত্রুটি বিরাট বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাতে তোমার বংশ-মর্যাদারও অসম্মান হবে এবং তোমার স্বামীর পক্ষেও ক্ষতিকর হবে। স্ত্রী যদি ধার্মিক ও আত্মমর্যাদাশীল হয়, তাহলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করবে। নারীর মন-মেজাজ সম্পর্কে সর্বদা খেয়াল রাখা জরুরী।
একদিন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের ধৈর্যের শিক্ষা দিতে গিয়ে বললেন :
المرأة كالضلع إن أقمتها كسرتها وإن إستمتعت بها وفيها عوج–
নারী পঞ্জরাস্থির মত বক্র। তাকে সোজা করতে চাইলে ভেঙে ফেলবে। আর উপকার গ্রহণ করতে চাইলে তাকে বক্র রেখেই তা করতে হবে।–বুখারী।
নবী (ছঃ) বলেন :
إن المرأة خلقت من ضلع لن تستقيم على طريقة فإن استمتعت بها
وبها يموج وذهبت تقيمها كوتها وگرها طلاقها—
নিশ্চয় নারী পাঁজর থেকে সৃষ্ট; সম্পূর্ণ সোজা কখনো হবে না। তার দ্বারা উপক্বত হতে চাইলে বাঁকা অবস্থায়ই উপক্বত হতে হবে। আর পুরোপুরি সোজা করতে চাইলে ভেঙে ফেলবে। নারীকে ভেঙে ফেলা মানে তাকে তালাক দেয়া।–মুসলিম
.
নারীরা উগ্রমতি ও জেদী
আমরা আমাদের জীবনে অসংখ্য দেখছি, সাধারণত নারীরা জেদী, বক্র, একগুঁয়ে ও উগ্রমতি হয়ে থাকে। অভিজ্ঞতার জগতে এসব হাদীসের মর্ম অনুধাবন করা মোটেই কষ্টকর ব্যাপার নয়। তাছাড়া, তাদের কোন এক অবস্থার ওপরে স্থিরতা নেই। খুশী থাকলে আপাদমস্তক ক্বতজ্ঞতাপুত। আর ক্ষিপ্ত হলে অক্বতজ্ঞতার শেষ সীমা ছাড়িয়ে যাবে। সূর্যগ্রহণ সংক্রান্ত হাদীসে নারীদের সম্পর্কে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই উক্তি নিম্নরূপ :
يكون العوير ويژن الإحسان کو احسنت إلى أحداث الدهر م
ثك يا قط.
رات مث شيئا قالت ما رأي
নারীরা স্বামীদের প্রতি অক্বতজ্ঞ এবং তাদের প্রতি যে সহৃদয়তা দেখানো হয়, তার–শোকরী ও নাফরমানী করে। তোমরা যদি সারা জীবন তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করো, কিন্তু তারা কখনো তোমার দ্বারা কোনো কষ্টদায়ক ব্যবহার দেখলে বলবে, আমি তোমার দ্বারা জীবনে কখনো ভাল ব্যবহার দেখলাম না।–বুখারী
স্বামী যদি ভুল-ত্রুটি ধর-পাকড় শুরু করে, তাহলে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। পুরুষের সহ্যশক্তি নারীর চেয়ে অপেক্ষাক্বত বেশি। তাই দাম্পত্য জীবনের নাজুক মুহূর্তে স্বামীর ওপর ধৈর্য ধারণের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।
.
নারী আধুনিক গবেষণায়
প্রখ্যাত গবেষক ফরীদ ওয়াজদী আফিন্দীআল-মারআতুল মসলিমামুসলিম নারী নামক গ্রন্থে নারীর মন মেজাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ গ্রন্থটির অনুবাদ ও সার সংক্ষেপ লিখেন। তিনি উর্দুতে বইটির নাম দিয়েছেনমুসলমান আওরত। উক্ত পুস্তকের এক স্থানে ফরীদ ওয়াজদী আফিন্দী ঊনবিংশ শতাক্দীর এনসাইক্লোপেডিয়ার বরাত দিয়ে লিখেছেন:
প্রকৃতপক্ষে নারীর শারীরিক গঠন প্রক্বতি শিশুর শারীরিক গঠনের প্রায় অনুরূপ। তাই, দেখা যায়, শিশুর ন্যায় নারীদের অনুভূতিও সকল ক্ষেত্রেই অতি শীঘ্র প্রভাবিত হয়ে পড়ে। শিশুরে যেমন-দুঃখ-কষ্টের ব্যাপার ঘটলে তৎক্ষণাৎ কাঁদতে আরম্ভ করে। আর আনন্দের কিছু দেখলে আত্মহারা হয়ে খুশিতে লাফাতে আরম্ভ করে। নারীর অবস্থাও অনেকটা ঠিক তেমনি। এই ধরনের অনুভূতিসূচক ব্যাপারে পুরুষের চেয়ে নারীরা অধিকতর প্রভাবিত হয়ে থাকে। কেননা, এইসব অনুভূতিসূচক বিষয়াদি নারীর হৃদয়ে এতো অধিক প্রভাব বিস্তার করে যে, জ্ঞান-বুদ্ধির সাথে এসবের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। এ কারণেই নারীদের মধ্যে ধৈর্য, ধীরস্থিরতার বিশেষ অভাব দেখা যায়। এ জন্যই যে-কোন কঠিন ও দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে নারী কখনো স্থির থাকতে পারে না।-মুসলমান আওরত
.
নারীর মাংসপেশীর ভিন্নতা
নারী শারীরিক শক্তির দিক দিয়েও পুরুষের সমান নয়। ধৈর্যশক্তি নারীর মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবেই স্বল্প। কেননা, সহ্যশক্তি মাংসপেশীর শক্তির ওপর নির্ভরশীল। আর নারীর মাংসপেশী পুরুষের তুলনায় অনেকটা দুর্বল।
প্রখ্যাত দার্শনিক ডক্টর দ্য ফরিনি এনসাইক্লোপেডিয়ায় লিখেন।
সমষ্টিগতভাবে পরীক্ষা করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, নারীর শরীরের মাংসপেশী পুরুষের মাংসপেশী হতে অনেকটা ভিন্ন প্রক্বতির এবং ঘনত্ব ও শক্তির দিক দিয়ে নারীরা এতোই দুর্বল যে, যদি স্বাভাবিক শক্তিকে তিন ভাগ করা হলে দু’ভাগই পুরুষের অংশে পড়বে, আর নারীর অংশে প্রমাণিত হবে মাত্র একভাগ। মাংসপেশীর দ্রুত সঞ্চালনগতি এবং সংকোচনের ব্যাপারেও ওই একই অবস্থা বিদ্যমান। নারীদের তুলনায় পুরুষের মাংসপেশী দ্রুত সঞ্চরণশীল ও অধিক কার্যক্ষম।–মুসলমান আওরত
.
নারীর গুণাগুণ
কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও নারীর মধ্যে অনেক গুণও বর্তমান, যা পুরুষের খুব মনঃপুত ও মানসিক শান্তির উৎস। তাই নারীর একটি দিকের দুর্বলতা দেখে তাকে ভর্ৎসনা করা কিছুতেই উচিত নয়।
অভিজ্ঞতার আলোকে পুরুষকে মানতেই হবে যে, নারী সাধারণত কষ্ট-সহিষ্ণু। পাঁজরের হাড় থেকে নারীর জন্মলাভ হয়ত তার সহনশীলতার প্রতিই ইঙ্গিতবহ। হয়ত একই কারণে নারী–পুরুষের চাইতে অধিক রূপসী ও সৌন্দর্যের অধিকারিণী। কেননা, পুরুষকে ছাঁচে-ঢালা পোড়া মাটির মতো শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে সৃষ্ট করা হয়েছে। আর নারী এক ফরসা চমকদার বস্তু হতে সৃষ্ট। পতিপ্রাণা, অল্পে তুষ্ট, সন্তানবৎসলা, সংসার পরিচালনে নিপুণা এবং বিশ্বাস ও আন্তরিকতার মূর্ত প্রতীক। এক কথায় বলা যেতে পারে, নারীর মধ্যে দুর্বলতার চেয়ে কল্যাণের দিকই অধিক।
নারীরা কতখানি কষ্টসহিষ্ণু হতে পারে, তার প্রমাণ মেলে, যখন একের পর এক প্রাক্বতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে স্বামী বেচারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন। আধুনিক গবেষণাও তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
ডঃ লম্বরোজার লিখেন :
গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের প্রতি লক্ষ্য করে ভেবে দেখুন, দুনিয়ায় নারী জাতি কেমন কঠিন বিপদাপদ ও কষ্ট সহ্য করতে পারে। তার অনুভবশক্তি পুরুষের ন্যায় ততটা প্রবল হলে সে কি করে এতসব কঠিন বিপদাপদ ও কষ্ট বরদাশত করতে পারতো? বস্তুত মানব জাতির পরম সৌভাগ্য যে, প্রক্বতি নারীকে প্রবল অনুভব শক্তি হতে বঞ্চিত রেখেছে। নতুবা মানব জাতির সঙ্কটপূর্ণ ও কষ্টদায়ক দায়িত্বসমূহ সম্পাদন করা খুবই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
নিঃসন্দেহে নারী অসহায় জাতি। তাদের মন নাযুক। কোমলতা তাদের স্বভাব। তারা কথায় কথায় হর্ষোৎফুল্ল হয়ে হয়ে ওঠে। আবার একটুতেই অগ্নিশর্মা হতেও দেরি নেই। তাই নারীকে তার সামগ্রিক অবস্থার নিরিখে বিচার করতে হবে। কোরআন মজীদে তালাকের কথা যেখানে আলোচিত হয়েছে, সেখানে পুরুষকে নারীর ওপর যুলুম-নির্যাতন চালাতেও নিষেধ করা হয়েছে।
.
যুলুম-নির্যাতন নিষেধ
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন :
ولا تمسوه ضرارا بتعتدوا ومن يفعل ذلك فقد ظلم نفسه ولا
تتخذوا أيات اللو هوا۔
আর অন্যায়ভাবে তাদের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে সীমা লঙ্ঘন উদ্দেশ্যে তাদেরকে তোমরা আটকে রেখো না। যে এরূপ করে, সে নিজের প্রতি যুলুম করে এবং তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে তামাশার বস্তু পরিণত করো না।–সূরা আল বাকারা : ২৩১
যদিও এ আয়াত তালাক সংক্রান্ত যুলুম-নির্যাতন নিরসনকল্পে অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু চিন্তা করে দেখলে এ বর্ণনাটি অতি ব্যাপক। আল্লাহ তা’আলা নারীর উপর করুণা করে পুরুষের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করেছেন। নবী করীম (ছঃ) নারীর অস্থিরমতিত্বের প্রতি লক্ষ্য করে বলছেন?
لا يجيد أحدكم إمرأته جلد العبي ثم يجامعها في اليوم الآخر–
তোমাদের কেউ স্বীয় স্ত্রীকে দাস-দাসীর মতো প্রহার করবে না, মারধরের কিছুক্ষণ পরেই দিনের শেষে আবার তার সাথে যৌন সংগমে লিপ্ত হবে। (এটা খুবই নিকৃষ্ট কাজ)।-বুখারী
.
নারীর স্বভাব
নারী জাতিকে প্রহারের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়নি। হ্যাঁ, তার খামখেয়ালি জেদী ও একগুঁয়ে স্বভাবের দরুন ইসলাম প্রয়োজনবশত বিশেষ অবস্থায় হালকা প্রহার করার অনুমতি দিয়েছে। আর তার স্থানও সর্বশেষে রেখেছে। তাও খুব সম্ভব জীবন-প্রণালীকে সুশৃঙ্খলাবদ্ধ ও নারীর যৌন পবিত্রতাকে সংরক্ষিত রাখার স্বার্থে। অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতীয়মান হয়, নারীর স্বভাবের মধ্যে উত্তেজনাশক্তি অধিক। নারী সহসাই দুঃখে কাতর এবং অল্প সুখে অধিক খুশি হয়ে পড়ে। আর পুরুষের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি বেশি। তাই সে ধৈর্য ধারণে সক্ষম। এনসাইক্লো–পেডিয়ায় ডঃ দ্য ফরিনি বলেন :
এই ব্যবধানটি উভয় শ্রেণীর বাহ্যিক পার্থক্যসমূহের সাথে পুরাপুরি সামঞ্জস্যশীল। পুরুষের মধ্যে বুদ্ধি-জ্ঞান ও বোধশক্তি অধিক। আর নারীর মধ্যে অনুভূতি ও উত্তেজনাশক্তি অধিক।–মুসলমান আওরত
অপর এক খ্যাতনামা লেখক ডঃ তরুসিয়া’র বক্তব্য :
নারীর স্নায়বিক দুর্বলতার পরিণাম বেশী হওয়ার কারণে দেখা যায়, তার স্বভাবে পুরুষের চেয়ে উত্তেজনা প্রবল।
.
প্রহার নিষিদ্ধ
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীকে প্রহার করতে বার বার বারণ করেছেন। তিনি বলেন :
تشرين عن ضرب أم .
স্বীয় স্ত্রীকে দাস-দাসীর মতো কখনো মারপিট করবে না।–মিশকাত
একদিন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, স্বামীর ওপর স্ত্রীদের কি কি অধিকার আছেঃ তার উত্তরে তিনি বললেন :
أن تطعيمها إذا طعمت و تكسوها إذا اكتسبت ولا تضرب الوجه ولا
تقبع ولا تهجر إلا في البيت–
তুমি যখন খাবে, তখন স্ত্রীকেও খাওয়াবে, আর তুমি যখন পরবে, তখন স্ত্রীকেও পরাবে। এবং না স্ত্রীর মুখে প্রহার করবে, না স্ত্রীকে অশ্লীল গালি-গালাজ করবে। আর না স্ত্রীর কাছ থেকে পৃথক থাকবে।–মিশকাত
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সমস্ত উক্তি, উপদেশ ও কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে ভৎর্সনা করার অনুমতি পুরুষদের দান করা হয়েছে। তাই এমনটি যেনো না হয় যে, এই অনুমতির ছদ্মাবরণে নারীদের ওপর যুলুম-অত্যাচার চালাবে, কিংবা তাদের ঘৃণার দৃষ্টিতে থাকবে এবং নারীর জীবনকে দুর্বিষহ যন্ত্রণাময় করে রাখবে।
রাসূলে মকবুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পুণ্যাত্মা স্ত্রীদের সাথে যে ব্যবহার ও সদাচার প্রদর্শন করেছেন, দুনিয়ার মানুষের জন্য তা এক শিক্ষণীয় আদর্শ। তিনি চরম নাযুক মুহূর্তেও স্ত্রীদের ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানোর কল্পনাও মনে স্থান দেন নি।
.
ভৎর্সনার অনুমতি ও তার মর্মার্থ
অথচ কোরআন পাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে দৈহিক প্রহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে :
والأترى تخافون شوزه فعظوهن واهجروهن في المضاجع
واضربوه فإن أطعتم فلا تبقوا عليه سي .
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা করো, তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন করো এবং তাদেরকে হালকা প্রহার করো। এর পর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন কুটকৌশল খোঁজ করো না। -সূরা আন নিসা : ৩৪
রহমতে আলম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তম আদর্শ শিক্ষা দিচ্ছে যে, কার্যত এই অনুমতি কেবল অগত্যার গতি হিসাবেই প্রযোজ্য। যা হোক, কোরআনী ঘোষণার মর্মার্থ হচ্ছে, জেদী, একগুয়েমি ও হঠকারিতার সময় প্রথমত স্বামী তার স্ত্রীকে মৌখিকভাবে উপদেশ, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ মৌখিক উপদেশ অকার্যকর হলে স্বীয় শয়নকক্ষে স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় শোয়া ত্যাগ করবে অর্থাৎ বিছানা পৃথক করে দেবে এবং পৃথক হওয়ার এই কার্যক্রমও যখন ব্যর্থ হবে, তখন গিয়ে স্বামী ইচ্ছা করলে তাদের প্রহার করো-এর অনুমতি প্রয়োগ করতে পারে।
কিন্তু এই প্রহারের ধরন কি হবে? রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সীমারেখা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :
واضربوهن ضربا غير مبرج–
তাদের এমনভাবে প্রহার করো, যেনো চামড়া ফেটে না যায়। যার মর্মার্থ হচ্ছে, হালকা প্রহার।
.
বিদায় হজ্জে নারীজাতি সম্পর্কে
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর ভাষণ
বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাও বলেছিলেন।
تملكون مثه
الا استوصوا بالنساء خيرا قائما هن عوان مثدكم لي شيئا مير ذالك إلا أن يأتين بفاحشة مبينة فان فعلن فاهجروهن في المضاجع واضربوه ضربا يرمبرج فان أطعنگم ف تبغوا عليهن سبيلا . ا إن لكم على اكم قا و إياكم عليك حقا قكم عليهن ان لا يوطن قژم من تكرهون ولا يأذن في بيوتكم من تكرهون إلا وحقه عليكم أن تحثوا إليه في شوته وطعامه–
জেনে রাখ! নারীজাতির কল্যাণ সাধনের বিষয়ে তোমরা আমার উপদেশ গ্রহণ কর। কেননা, তারা তোমাদের নিকট বন্দিনীস্বরূপ। এছাড়া তোমরা তাদের কোন কিছুর মালিক নও। হ্যাঁ, তারা প্রকাশ্য অবাধ্যাচরণে লিপ্ত হলে তাদের বিছানা পৃথক করে দেবে এবং এমন ভাবে প্রহার করবে, যাতে তাদের শরীরের চামড়া না ফাটে। এরপর তারা যদি অনুগত হয়, তবে আর বাড়াবাড়ির পথ ও কৌশল তালাশ করবে না। ভালভাবে জেনে রাখো! তোমাদের স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। স্ত্রীর ওপর তোমাদের অধিকার হল, তারা এমন কোনো লোককে তোমাদের বিছানায় অনুমতি দেবে না, যাদের তোমরা অপছন্দ করো এবং এমন কোনো লোককে তোমাদের গৃহে প্রবেশ করতে দিবে না যার আগমন তোমরা পছন্দ করো না। আর তোমাদের ওপর তাদের অধিকার হল, তোমরা তাদের থাকা-খাওয়ার উত্তম ব্যবস্থা করবে।–তিরমিযী
আসল কথা হল, কোরআন যে প্রহারের অনুমতি দিয়েছে, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি থেকে বুঝা যায়, প্রকাশ্য অবাধ্যচরণ পর্যন্তই তাকে সীমিত রাখতে হবে। এছাড়া বিশ্বনবীর বিদায় ভাষণের উপরোক্ত অংশের প্রতিটি বাক্যই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্ববাসী স্বীকার করে নিয়েছে।
ভেবে দেখুন! এ হাদীসে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি উপদেশ দান করেছেন। প্রথম কথা হচ্ছে, পারিবারিক জীবনের ব্যবস্থাপনায় এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টির জন্য স্বামীকে স্ত্রীর ওপর প্রাধান্য দান করা হয়েছে। কেননা, উভয়ের মর্যাদা যদি সমান হয়, তাহলে শক্তি-সাম্যের পরিণাম ফলে দাম্পত্য জীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যাবে। এক রাজ্যে দু রাজা বসবাস করতে পারে না। এরপর সে কথা অর্থাৎ প্রকাশ্য ব্যভিচারের ক্ষেত্রে উপদেশ ও বিছানা পৃথক করার পর সাধারণ মারপিটের (অর্থাৎ কানমলা ও তিরস্কার জাতীয়) অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর উভয়ের অধিকারের বর্ণনা।
এখানে স্বামীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে সমান আচরণ করো। আধিপত্য লাভের দরুন যা ইচ্ছা তা করে বসো না। বরং স্ত্রীদের স্বাভাবিক প্রয়োজন ও বাসনার প্রতিও খেয়াল রেখো। খাওয়া-দাওয়া ও পোশাক-পরিচ্ছদেও তাদের চাহিদা পূরণ করো। কেননা, এ সব ক্ষেত্রে নারীরা স্বামীদের মুখাপেক্ষী।
বলাবাহুল্য, জীবনের যে-ক্ষেত্রে একে অপরের মুখাপেক্ষী হয়, সে ক্ষেত্রে যদি তার চাহিদা পূর্ণ না হয়, তবে সে মনো-কষ্টে ভোগে। তার কোমল হৃদয়ে আঘাত লাগে।
বর্বর জাহেলী যুগে আরবের জাহিলী রীতি ছিলো, পরপুরুষ ও পর নারীর সাথে মেলামেশা ও কথা-বার্তায় মানুষ কোন রকম অন্যায় বা পাপ মনে করতো না, যেমন বর্তমানে ইউরোপের আধুনিক জাহিলিয়াতে দৃষ্ট হয়।
আলোচ্য হাদীসে : ১৭৮১। (তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের বিছানায় অন্য কাউকে স্থান দেবে না) এ বাক্য দ্বারা নারীদের পূর্ববর্তী জাহেলী যুগের অবাধ মেলামেশার রীতি-নীতি উচ্ছেদ করতে বলা হয়েছে। ১–অর্থ আসল যিনা নয়, কেননা, এটা তো সর্বদিক দিয়েই হারাম। এ ক্ষেত্রে নারীদের ওপর দ্বিতীয় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, স্বামীগৃহে মুহাররম অথবা গায়র মুহাররম যে-ই প্রবেশ করুক, তার আগমন সম্পর্কে স্বামীর মতামত জেনে নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কাউকে স্বামীগৃহে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না?
.
রাসূল (ছঃ) এর দৃষ্টিতে নারীর প্রতি সদ্ব্যবহার
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হচ্ছে, প্রতিটি মু’মিন-মুসলমানকে সচ্চরিত্রতার প্রতিমূর্তি এবং সুন্দর আচরণ ও সদ্ব্যবহারের প্রতিক্বতি হতে হবে। সর্বোত্তম মুসলমান হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের নিকট আচার-ব্যবহারে সর্বোত্তম বলে বিবেচিত। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন :
أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا وخياركم خياركم إياكم
পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি, যে সর্বোৎক্বষ্ট চরিত্রের অধিকারী। আর তোমাদের মধ্যে উৎকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর নিকট উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত।–তিরমিযী।
আলোচ্য হাদীসে পরিষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে যে, উত্তম ও উৎকৃষ্ট মুমিনের পরিচয় হচ্ছে আপন স্ত্রীর নিকট সর্বোৎক্বষ্ট সদাচারী বলে স্বীক্বত হওয়া। এ বর্ণনাভঙ্গি থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, প্রতিটি পুরুষ লোককে আপন স্ত্রীর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা প্রদর্শন করা এবং তার সকল বৈধ দাবীসমূহ পূরণ করা।
মোট কথা, যে ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীর কাছে নিজকে উস্কৃষ্ট বলে প্রমাণিত করতে পারবে, প্রকৃতপক্ষে সে-ই হচ্ছে সত্যিকার মানুষ। নচেৎ তাৎক্ষণিকভাবে ক্বত্রিম উপায়ে তো নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতম ব্যক্তিও নিজকে সর্ব উৎকৃষ্ট লোক বলে চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর সার্বক্ষণিক সাহচর্য মানুষের আসল প্রক্বতি ও স্বভাবের স্বরূপ প্রকাশ করে দেয়। আর এটাই হচ্ছে পুরুষ-প্রক্বতির প্রকৃত পরিচয়।
রাসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় দাসীদের (নারী) তোমরা প্রহার করা থেকে বিরত থাক। আরব জাহেলী সমাজে নারীদের জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে তেমন একটা বেশি গুরুত্ব ছিল না। পুরুষরা নারীদের সাথে যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করত। আর অযথা প্রহার করা তো ছিলো মামুলী ব্যাপার। কিন্তু এ আদেশ জারী হওয়ার সাথে সাথেই সমস্ত যুলুম-নির্যাতন বন্ধ হয়ে গেল। নারীদের প্রাণে সজীবতা এল।
সহস্র বছরের যুলুম-নির্যাতন থেকে অব্যাহতির প্রতিক্রিয়া যেমনটি হওয়ার কথা তেমনটিই হয়েছে, যার সন্ধান পাওয়া যায় এ ঘটনা থেকে। অর্থাৎ একদা হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! নারীরা তো তাদের স্বামীদের ওপর দৌরাত্ম আরম্ভ করে দিয়েছে। একথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে উপরোক্ত ফরমানের কঠোরতা কিছুটা শিথিলতায় রূপান্তরিত হলো। কিন্তু পুরুষরা এ শিথিলতা থেকে মনে হয় অন্যায় ফায়দা উঠাতে আরম্ভ করলো, যার অভিযোগ রাসূলের দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে লাগলো। এই সব অভিযোগ শ্রবণ করে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা ঘোষণা করলেন
أو ليك
لقد أطافي بالي بيت محقډيساء كثير شگون ژواجهن لي
অনেক স্ত্রীলোক মুহাম্মদ (ছঃ) এর পরিবারকে ঘিরে ধরেছে। তারা তাদের স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছে। অভিযুক্তরা নিশ্চয়ই ভালো লোক নয়।–আবূ দাউদ
ভাল লোক না হওয়ার ঘোষণা, আর তা’ও রাসূলের পবিত্র যবান থেকে নিজ সম্পর্কে কে বরদাশত করতে পারে? সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল।
.
রাসূল (ছঃ) তাঁর বিবিদের কাছে
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর ইন্তিকালের আট-নয় মাস পূর্বে মদীনা-মুনাওয়ারা পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকাশে নবী–সহধর্মিণীদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশ ছিল অন্যান্য বিষয়ের সাথে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুসম্পর্কের এক বাস্তব নমুনা স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই বলতেনঃ
فدعوه .
و لأهله وأنا خيركم لاهي وإذا مات صاحت
خيركم خيركم
তোমাদের মধ্যে উত্তম হলো ওই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম এবং স্বয়ং আমি স্বীয় পরিবারের নিকট উত্তম। আর তোমাদের সহধর্মিণী মারা গেলে তার জন্যে (আল্লাহর নিকট) দোয়া করবে।–তিরমিযী
যা হোক, নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং বাস্তবেও আমল করে দেখিয়ে গেছেন এবং পবিত্র মুখেও একথা উচ্চারণ করে গেছেনঃ
إن أكمل المؤمنين إيمانا أحستهم ځلقا والطفهم بأهله—
সবচেয়ে উত্তম মু’মিন ঐ ব্যক্তি, যার ব্যবহার সবচেয়ে ভালো এবং স্বীয় পরিবার-পরিজনের প্রতি সদয়।–মেশকাত
.
উম্মুল মুমিনীনদের প্রতি রাসূল (ছঃ) এর ভালবাসা
রহমতে আলম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র যবানে যা বলতেন বাস্তব জীবনেও তাই কাজে পরিণত করে দেখাতেন। রাসূলের (ছঃ) প্রথমা স্ত্রী বিবি খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সম্পর্কে হাদীস শরীফে অনেক ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে তাঁর ওফাতের পর প্রায়শ স্মরণ করতেন। শুধু তাই নয়, হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর ইন্তিকালের পর তার যেসব বান্ধবী জীবিত ছিলেন, হযরত তাদের সাথেও উত্তম ব্যবহার করতেন।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বর্ণনা করেন :
হযরত খাদীজা (রাঃ) ব্যতীত রাসূলের অন্য কোন স্ত্রীর ওপর আমার ঈর্ষা হতো না। যদিও আমি তাকে দেখি নি, কিন্তু রাসূল (ছঃ) তাঁর কথা এত অধিক স্মরণ করতেন যে, তিনি আমার কাছে অপরিচিত রইলেন না। রাসূল (ছঃ) তাঁকে এত অধিক ভালবাসতেন যে, ঘরে একটি বকরী যবাই হলেও তার কথা স্মরণ করতেন এবং গোশতের একটি অংশ তার বান্ধবীদের খোঁজ করে তাদের মধ্যে বিতরণ করতেন।–বুখারী, মুসলিম
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন : আমি প্রায়ই রাসূল (ছঃ) কে বলতাম, একমাত্র খাদীজা (রাঃ) ছাড়া কি আপনার আর কোনো স্ত্রী নেই? একথা আমি খাদিজা (রাঃ)-কে অধিক স্মরণ করতে দেখে বলতাম। আমি যখনই একথা বলতাম, তখন তিনি বলতেন, আল্লাহ তা’আলা আমাকে তার ঘরে সন্তান-সন্ততি দিয়েছিলেন। আর সত্যিকার অর্থেই খাদিজা ছিল সতী ও স্বামীভক্ত।–মেশকাত
.
স্ত্রীদের প্রতি সাহাবা কেরামের ভালবাসা
রাসূলের শিক্ষার ফলে সাহাবা-ই-কিরাম রাসূলের রং-এ রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের সহধর্মিণীদের বড় খুব বেশি ভালবাসতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) একজন সুবিখ্যাত সাহাবী। একবার তিনি জিহাদ উপলক্ষে সফরে ছিলেন। সফর থেকে ফেরার পথে তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতার খবর শুনে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং অতি দ্রুত সেখান থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। দ্রুত বাড়ি পৌঁছার জন্য তিনি মাগরিব ও ইশার নামায এক সাথে আদায় করেন।
হযরত ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আরেকটি ঘটনা। একবার কোনো কারণে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ শুনে তিনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। এক দিকে স্ত্রীর প্রতি অধিক ভালবাসা, অপরদিকে পিতার আদেশ। শেষ পর্যন্ত তিনি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পেরে স্ত্রীকে তালাক দিতে প্রায় অস্বীকার করে বসলেন। হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এই বিষয়টি রাসূলের দরবারে পেশ করলেন। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন পিতার আনুগত্যের সপক্ষে রায় দিলেন, তখন গিয়ে হযরত আবদুল্লাহ স্ত্রীকে তালাক দিলেন।–উসওয়া-ই-সাহাবা
নবী দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর কলিজার টুকরো হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) কোনো কারণবশত তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিলেন এবং স্ত্রীর সমুদয় মুহরানা তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তার স্ত্রীর কাছে যখন তালাকের খবর পৌঁছল, তখন তিনি হতচকিত হয়ে কান্না শুরু করলেন। বার্তাবাহক এসে স্ত্রীর এই কান্নার কথা হযরত হাসান (রাঃ) কে জানাল। তখন তিনিও বিচলিত হয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন : যদি তালাকে বাইন না দিতাম, তবে রজআত করে নিতাম (রজ’আত মানে পরিত্যক্তা স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা)।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দিক (রাঃ) এর এক পুত্র সম্পর্কেও এরূপ এক ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে অধিক ভালবাসতেন। অতিরিক্ত ভালবাসার হেতু স্ত্রীকে ছেড়ে জিহাদে যেতেও তার মন চাইত না। তাই কখনো কখনো তিনি জিহাদে অংশগ্রহণ থেকেও বিরত থাকতেন। সিদ্দীক-ই-আকবার যখন তাঁর পুত্রের এই পরিণতির অবস্থার কথা জানতে পারলেন, তখন তাঁকে ডেকে তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে বললেন। প্রথম দিকে তিনি এ নির্দেশ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় পিতার ক্রমাগত নির্দেশের দরুন স্ত্রীকে আলাদা করে দিলেন। বাহ্যত আলাদা করে দিলেও অন্তরের ভালবাসা বয়ে গেল। বিচ্ছেদের দরুন শোক গাথা কবিতা পড়তে আরম্ভ করলেন। হযরত সিদ্দীক-ই-আকবার (রাঃ) যখন পুত্রের এই ব্যাকুলতার কথা জানতে পারলেন, তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে ডেকে স্ত্রীকে রজ’আত করতে বললেন।
হযরত বারীরা (রাঃ) ও মুগীছ (রাঃ) এর কাহিনী হাদীসের কিতাবসমূহে যেমন সুবিদিত, তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক। হযরত বারীরা (রাঃ) প্রথম দাসী ছিলেন। তখন তাঁর বিবাহ হয়েছিলো হযরত মুগীছ (রাঃ) এর সাথে। আযাদ হওয়ার পর শরীয়ত অনুযায়ী তিনি পূর্ব স্বামীর সাথে সংসার করা না করার ব্যাপারে ইখতিয়ার লাভ করলেন। তাই বারীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, মুগীছ (রাঃ)-এর সাথে ঘর সংসার করবে না আলাদা হয়ে যাবে। হযরত মুগীছ (রাঃ) এ কথা শুনতে পেয়ে স্ত্রী-বিচ্ছেদে মদীনার অলিগলিতে কেঁদে ফিরতে লাগলেন।
ইসলামের যৌন পবিত্রতার বিধানের সাহায্যে যে নারী গতকাল পর্যন্ত দুনিয়ার দৃষ্টিতে তুচ্ছ ও হেয় প্রতিপন্ন হতো, আজ সে মান-সম্ভম গগনের চন্দ্র-সূর্য রূপে আলোকিত হতে লাগল। ইসলামের পয়গাম্বর তাদের অধিকার দানের কারণেই তারা এ সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পেরেছিল।
.
স্ত্রীর হকের গুরুত্ব
আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও আধ্যাত্মিক সাধনা কতো প্রশংসনীয় জিনিস। কিন্তু এতেও নারীর অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে তাদের বঞ্চিত রাখা ইসলাম অপছন্দ করেছে। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন-রাত ইবাদতে লিপ্ত থাকার অনুমতি দেয়নি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে একাধিক সাহাবী সারারাত ইবাদত-বন্দেগীতে পার করে দিতেন এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি তাঁদের আদৌ কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের ডেকে ঘোষণা দিলেন :
ان زوجك عليك حقا۔
তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর অবশ্যই হক (অধিকার) রয়েছে।–বুখারী
এক্ষেত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) ও হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ)-এর ঘটনা বিশদভাবে হাদীসের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
.
স্ত্রীর জন্য উত্তম চাল-চলনের ব্যবস্থা
স্বীয় স্ত্রীর কাছে নিজকে উত্তম ও উৎকৃষ্ট প্রমাণ করার কার্যকর ব্যবস্থা হিসাবে যেমন স্ত্রীর সাথে কোমল আচরণ, সানাদান ইত্যাকার কোন চেষ্টারই ত্রুটি করা উচিত নয়, তেমনি নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই নির্দেশসমূহের প্রতিও পুরুষদের বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে।
যেমন স্ত্রীর কাছে স্বামীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পারিপাটি পোশাক পরিধান করে আসা উচিত। তাহলে, তাকে দেখে স্ত্রী আনন্দিত হবে এবং এই ভাবে খুশীতে বাগবাগ হবে যে, আমার স্বামী পোশাক-পরিচ্ছদ ও চাল-চলনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। নোংরা, অভদ্র ও হাবাগোবা নয়। স্বামী যেমন তার স্ত্রীকে সদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত দেখতে আগ্রহী, তেমনি স্ত্রীও তার স্বামীকে পরিপাটি সুবেশী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বেশে পেতে ইচ্ছুক। মুসলমানকে কখনই বা নোংরা ও অশুচি থাকার অনুমতি দেয়া হয়নি।
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমগ্র জীবনই পাক-পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাট্যের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিলো। ঘরে-বাইরে সব সময় তিনি আয়না, চিরুনি, সুরমাদানী ও যাবতীয় সাজসজ্জার উপকরণ অবশ্যই সাথে রাখতেন।–মিশকাত
কেউ এলোমেলো অবিন্যস্ত ও অপরিপাটি থাকুক, রাসূলে মকবুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা আদৌ পছন্দ করতেন না। হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসে আছেন। এমন সময় জনৈক সাহাবী মসজিদে প্রবেশ করল। তার মাথার চুল ও গোঁফ-দাড়ি অবিন্যস্ত ও এলোমেলো ছিল। রাসূল (সাঃ)-এর ইঙ্গিতে তাকে তার কেশসমূহ বিন্যস্ত করতে বললেন। সে রাসূলের ইশারা পেয়ে মস্তক ও দাড়ির কেশসমূহ পরিপাটি করল। ফেরার পথে রাসূল তাঁকে সুবিন্যস্ত দেখে বললেন : এই অবস্থা কি পূর্ব-অবস্থার চেয়ে উত্তম নয়, যা শয়তানের মতো দেখা যেতো! –মিশকাত
পরিপাটির ব্যাপারে এ হাদীসটিও উল্লেখ্য :
إن الله طيب يحب الطيب نظيف يجب الظاقت ۔
আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি পবিত্রতা পছন্দ করেন। আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে ভালবাসেন।–মিশকাত
.
স্ত্রীর জন্য পরিপাটির উপকরণ
আলোচ্য সব হাদীসের প্রেক্ষিতে স্বামীকে স্ত্রীর জন্য এবং স্ত্রীকে স্বামীর জন্য পাক-পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। ফিকাহবিদগণ বলেছেন ও স্ত্রীর পরিপাটি ও পাক-পরিষ্কারের উপকরণাদি সরবরাহ করা স্বামীর অন্যতম কর্তব্য।
كالمشط والهن والسدر
ويجب عليه ما تنظف به وتزيل الو والخطى والأشنان والصابون على مادة أهل البي ……………… وا الطبيب فيجب عليه ما يقطع الشهو كغير وعليه ماتقطع الشنان–
وعليه الماء ما تغسل په ثيابها وبنها من الوسخ .
স্ত্রীর পরিপাটি লাভ ও মালিন্য দূর করার উপকরণাদি সরবরাহ করা স্বামীর ওপর একান্ত কর্তব্য, যেমন-চিরুনি, তেল, বরই পাতা, খেতমী (এক প্রকার উদ্ভিদ, যার দ্বারা শরীর পরিষ্কার করা হয়), উনান (এক প্রকার পাতা, যার দ্বারা হাত ধোয়া হয়), সাবান, সাজ-সজ্জার সামগ্রী প্রভৃতি প্রচলিত দ্রব্য-সামগ্রী। অনুরূপভাবে শরীর ও বগলের দুর্গন্ধনাশক খোশবু ও সাজ-সর মিও জোগান দিতে হবে। (যুগউপযোগী নিত্য প্রয়োজনীয় সাজ-সরাঞ্জাম ইত্যাদি। -রদ্দুল মুহতার
গোসল ও কাপড় ধোয়ার পানিরও ব্যবস্থা করতে হবে।
হাদীসে যেখানে স্বামীকে সফর থেকে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে স্ত্রীকে তার আগমন-বার্তা দিয়ে সহসা ঘরে পৌঁছতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে এর কারণ স্বরূপ একথাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, স্ত্রী ইত্যবসরে নিজকে সুবিন্যস্ত ও পরিপাটি করে নেবে। হাদীসের শব্দমালা নিম্নরূপ
يكي تشط الشعث و تتجه المغيبة .
যাতে স্ত্রী তার অগোচালো কেশসমূহ চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে সুবিন্যস্ত ও পরিপাটি করে নিতে পারে এবং ক্ষুর দ্বারা গুপ্তাঙ্গের লোমসমূহ পরিষ্কার করে নিতে পারে।–বুখারী।
.
স্ত্রীর বিপদাপদে সহমর্মিতা প্রকাশ করা
স্বামীর নৈতিক কর্তব্য যে, সে স্ত্রীর প্রতি বিপদাপদে সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হওয়া। প্রাক্বতিক দুর্যোগের দরুন অথবা রোগব্যাধিতে যদি স্ত্রী কোন আকস্মিক বিপদে পতিত হয়, তবে স্নেহ-মমতা ও দয়া প্রদর্শনে কোন রকম কার্পণ্য করবে না। বরং পূর্বাপেক্ষাও অধিক সৌজন্য ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করবে। রোগ-ব্যাধি হলে চিকিৎসা করাবে। অন্য কোন বিপদে পড়লে তাও দূর করার চেষ্টা করবে। কোন রোগের কারণে তার শরীর অথবা চেহারা বিক্বতি ঘটলে রোগগ্রস্ত সুরত দেখে কঠোর ও অসদ্ব্যবহার করবে না। বরং তাকে সান্ত্বনা ও প্রবোধ দান করবে। স্বামী যদি দয়া প্রদর্শন না করে, তবে তার মন ভেঙে যাবে। তার আনন্দ দুঃখ-বেদনায় পর্যবসিত হবে এবং স্বামীর নির্দয় ব্যবহারে অসহায় স্ত্রী মন ভেঙ্গে যাবে।
সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখার বিষয়। এই তো দিন কয়েক পূর্বে এক সুন্দরী রমণী বিবাহ করে ঘরে আনা হলো। তার মনস্তুষ্টির জন্য হাট-বাজার তন্নতন্ন করে নামী-দামী স্বর্ণ অলঙ্কার ও কাপড়-চোপড় ক্রয় করা হল। সবার অসন্তুষ্টি সহ্য হলেও জীবনসঙ্গিনীর দুঃখ-বেদনা সহ্য হয়নি। ঘটনাচক্রে সে-ই আজ অসুখে পড়ল এবং রোগব্যাধিতে তার চেহারা বদলে দিল। কিংবা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলল। আয়না দেখলে তার চোখে অশ্রুর বন্যা আরম্ভ হয়। পূর্বে কি চেহেরা ছিল এখন কি হয়ে গেলো। অন্ধ হয়ে গেলে তো সারা দুনিয়াই আঁধার। স্ত্রী এ দুঃখ সহ্য করতে না পেরে দিন-রাত কাঁদছে। তারপর আবার মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ স্বরূপ স্বামীর মনমানসিকতা বদলে গেছে। কথায় কথায় হুমকি-ধমকি চলছে। ঘর থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। কখনো কখনো বিনা দোষে প্রহারও করা হচ্ছে। এত নিবিড় প্রেম-ভালবাসা কেন বদলে গেল? এবং বসন্তকাল বিপরীত রূপ নিলো? রূপ-সৌন্দর্য উবে গেছে। আর তা-ও প্রাক্বতিক রোগে শোকে।
নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে মানব মনের দাবী এটাই। ভালবাসার এটাই পরিণতি, আরো লক্ষণীয় বিষয়, অসহায় নারীর দুঃখের বোঝা কে বহন করবেঃ তাদের চোখের উষ্ণ অশ্রু কি রং ধারণ করবেঃ কিন্তু ইসলাম এরূপ নির্দয় ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের অনুমতি দেয় না। বরং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করে
من لا يرحم لا يرحم.
যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।–আল হাদীস
.
স্ত্রীর যৌন চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখা
বলা হচ্ছিল, স্ত্রীকে সবরকম সানাদান ও তার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার প্রতি লক্ষ্য রাখাও স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্যের শামিল।
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে উল্লেখ আছে : একদা রাত্রিকালে তিনি খলীফারূপে টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক গৃহাভ্যন্তর থেকে বিরহ শোকগাথা আবৃত্তির আওয়ায় ভেসে এল। তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং কান পেতে শোকগাথা শুনতে লাগলেন। এক মহিলা এ শ্লোকটি স্বীয় বিশেষ ভঙ্গিতে আবৃত্তি করে যাচ্ছে
و اللو لؤة الله تخشى عواقبه. يخرج من هذا الشرير جوابه.
আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহর শাস্তির ভয় না হতো-তবে নির্ঘাত এই পালঙ্কের পার্শ্বদেশ নড়াচড়া করত।
খলিফাতুল মোসলেমীন হযরত উমর (রাঃ)-এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, ওই মহিলার স্বামী জিহাদ উপলক্ষে প্রবাসে রয়েছেন। মহিলার এ অক্বত্রিম প্রেমাবেগের শোক গাথা হযরত উমরের হৃদয়পটে গভীর রেখাপাত করল। তিনি তাঁর কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা (যিনি রাসূলে করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুণ্যাত্মা সহধর্মিনীদের অন্যতমা) কে জিজ্ঞেস করলেন; স্ত্রীলোক তার স্বামী সঙ্গলাভ ছাড়া কতদিন সবর করতে পারে? হযরত হাফসা (রাঃ) বললেন : চার মাস পর্যন্ত। এ কথা শুনে হযরত উমর (রাঃ) মুসলমানদের খলীফা হিসাবে সেনাপতিদের নিকট এই নির্দেশ পাঠালেনঃ
لايف المتزوج من أهيم أكثر منها ۔
কোন বিবাহিত পুরুষ তার স্ত্রীর নিকট থেকে চার মাসের অধিক সময় অনুপস্থিত থাকতে পারবে না! –রদ্দুল মুহতার।
এ ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হলো, স্ত্রীর দাবী-দাওয়া ও কামনা-বাসনা পূরণ করাও স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। যদি বেশি দিনের জন্য তার প্রবাসে থাকতেই হয়, তবে পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
মহাগ্রন্থ আল কোরআন মজীদের যে আয়াতে ঈলা’র উল্লেখ করা হয়েছে, তাতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি অনির্দিষ্টকাল বা চার মাস কিংবা চার মাসের চেয়ে অধিক কাল স্ত্রী-সহবাস না করার শপথ করে এবং তা কার্যকরী করে, তবে তখন তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। এবং সে অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে।
يثيرين يؤلون من نسائهم تربص اربعة اشهر فان قاموا قال
الله غفور رجيم . وإن عزموا الطلاق فإن الله سميع عليم .
যারা স্ত্রীর সাথে সঙ্গত না হওয়ার শপথ করে তারা চার মাস অপেক্ষা করবে। অতঃপর যদি তারা প্রত্যাগত হয়, তবে আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর যদি তারা তালাক দেয়ার সংকল্প করে, তবে আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।–সূরা আল বাকারা : ২২৬
.
স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস
স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে, স্ত্রীর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে গৃহাভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো তার নিকট ন্যাস্ত করা। এতে সে তার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং তার মান-মর্যাদা তার মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারী সমাজকে গৃহের রক্ষক বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন :
المرأة راعية على بيت زوجها—
নারী তার স্বামীগৃহের সংরক্ষক।–বুখারী।
অন্যান্য হাদীসেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে নারীদেরকে স্বামীর ধন-সম্পদের রক্ষক বলা হয়েছে। স্ত্রীর ওপর আস্থা রাখার আরেকটি উপকার হল, তার মান মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। সে নিজকে পরিবারের একটি বিভাগের অধিকত্রী বলে ভাববে। ফলে, স্বামী অধিকতর চিন্তামুক্ত থাকবে এবং সুখ শান্তির জীবন যাপন করতে পারেব।
.
স্বামী স্ত্রীর গোপনীয় কথাবার্তা প্রকাশ করবে না
স্বামীর আরেকটি কর্তব্য হলো, স্ত্রীর গোপন কথাবার্তা স্বামী অন্যের কাছে প্রকাশ করবে। বরং এ গোপন কথা গোপন পর্যায়েই রেখে দেবে। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীর গোপন কথা প্রচার করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন। তিনি বলেন
إن من أشير الناس عند الله منزلة الرجل يفضى الى امراته وتقضي
যে ব্যক্তি স্ত্রীর সাথে সহবাস করে সে গোপন কাহিনী অন্যের নিকট প্রচার করে, আল্লাহর দরবারে সে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি।–মুসলিম
জানা গেল, স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় কথাবার্তা প্রকাশ হওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। ইমাম নববী (রঃ) লিখেছেন যে, এই হাদীস থেকে এ বিষয় জানা গেল, স্বামী-স্ত্রীর মিলন-কাহিনী আলোচনা করা হারাম। যেমন একথা বলা : সহবাসের সময় পরস্পরে অমুক অমুক কথাবার্তা হয়েছে। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর গোপন বিষয়াদি বর্ণনা করা। এমন কি সহবাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনাও ত্রুটিমুক্ত নয়। তার বর্ণনার ভাষা নিম্নরূপ :
في هذا الحديث تحريم إفشاء الجل مايجري بينه وبين امراته من
تفاصيل لك ومايجري من المرأة فيه قول أو
أمور الإستمتاع و و فعل اونحوه–
এ হাদীস থেকে জানা গেল, স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় কথা-বার্তা প্রকাশ করা হারাম-যেমন যৌন মিলন ও তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করা। অনুরূপভাবে স্ত্রীর কোনো গোপন কথা, গোপন কাজ বা এ ধরনের কোন গোপন বিষয়াদি প্রকাশ করা হারাম।–শারহু মুসলিম
.
স্ত্রীর ভরণ-পোষণ
ইসলামী শরীয়ত স্বামীর ওপর স্ত্রীর যেসব দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তন্মধ্যে স্ত্রীর অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও অন্তর্ভুক্ত, যাতে সে সন্তানের লালন-পালন নির্বিঘ্নে চালাতে পারে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এরশাদ করেনঃ
يثق دوعة من سعته ومن قدر عليويژه قليثوق مما آتاه الله
يكلف الله نفسا إلا ما أتاها .
সম্পদশালী নিজ সামর্থ অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত, সে আল্লাহ যাই দান করেছেন, তা হতে ব্যয় করবে। আল্লাহ্ যাকে যা সামর্থ দিয়েছেন, তদপেক্ষা গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপান না।–সূরা আত্ তালাক : ৭
কারে ওপর স্বীয় সামর্থের বেশি বোঝা চাপানো হয় নি। বরং প্রত্যেকের ওপর তার যোগ্যতা অনুসারে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :
وعلى المولود له رزقهن وكسوتهن بالمعروف لا تكلف نفش الا
পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের (স্ত্রীদের) ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। কাউকেও তার সাধ্যাতীত কার্যভার দেয়া হয় না।–সূরা আল বাকারা : ২৩৩
বলা হয় যে, স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর অর্পণ করার কারণ হলো, শিশু জন্মদান, তার শিক্ষা ও লালন-পালনের ব্যাপারে স্ত্রী নিশ্চিন্ত রূপে সচেষ্ট হতে পারবে। যার বড় ফায়দা হচ্ছে স্বয়ং শিশুর মনস্তত্ত্বের ওপরও এর শুভ প্রভাব পড়বে এবং আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে সে মানসিক ভাবে চিন্তামুক্ত থাকবে।
ইতোপূর্বে যে হাদীসসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে আপনারা পাঠ করে এসেছেন, এও একটি স্ত্রীর অধিকার ও
أن تستوا إليه في كسوتهن وطعامه–
তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) ভরণ-পোষণের উত্তম ব্যবস্থা করবে।-তিরমিযী
.
ভরণ-পোষণের পরিমাণ
আবু সুফিয়ান (রাঃ)-এর স্ত্রী হিদা বিনতে উদ্যার ঘটনা সর্বজনবিদিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে অভিযোগ দায়ের করে বললেন : আমার স্বামী খুবই কৃপণ। সে আমার ও সন্তানের প্রয়োজন পরিমাণ খরচা দেয় না। হিনদা জানতে চাইলেনঃ
فهل على حرج أن أطعم من الذي له عيالنا ۔
আমি যদি তার মাল থেকে স্বীয় সন্তানদের জন্য কিছু গ্রহণ করি, তাতে কি কোনো ত্রুটি আছেঃ রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ
خذي مايكفيك وولدك بالمعروف .
তোমার এবং তোমার সন্তানের প্রয়োজন পরিমাণ নিও।–বুখারী
.
রাসূলুল্লাহ (ছ) এর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল পুণ্যাত্মা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে দেয়া। বরং একটি বাগানই তিনি এ জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন, যা বিক্রি করে সারা বছরের ভরণ-পোষণের খরচা তিনি একবারেই জমা করে দিতেন।
ان النبي صلى الله عليه وسلم كان يبيع نخل بني النضير ويحبش
لاهیم قوت نتهم—
নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনূ নযীর বাগানের খেজুর বিক্রি করে দিতেন এবং তার মূল্য স্বীয় পরিবার-পরিজনের সারা বছরের ভরণ-পোষণের স্বরূপ জমা করে দিতেন। -বুখারী
ফিকাহবিদগণ নফকা বা ভরণ-পোষণ আদায় করা ওয়াজিব বলেছেন। তাঁদের মতে, স্ত্রী ধনী হোক, গরীব হোক, যদি সে স্বামীর অধীনে থাকে, তবে ভরণ-পোষণ পাবে। ভরণ-পোষণের সার কথা–অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান।
اله وشرها هى الطعام والشوة
هى لغة ما ينفقه الإنسان على
নফকার আভিধানিক অর্থ : মানুষ যা তার পরিবারের জন্য ব্যয় করে। আর শরীয়তী অর্থ : অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান।–দুররুল মুখতার।
.
স্ত্রী তার মাতা-পিতার সাথে দেখা সাক্ষাৎ
স্ত্রীর অধিকারসমূহের মধ্যে আরেকটি অধিকার হচ্ছে, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর মাতা-পিতা ও ও নিকটাত্মীয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি প্রদান। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছঃ) নিয়ম ছিল, স্বীয় আদরের দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর গৃহে গিয়ে দেখা করা। হযরত আবূ বকর (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ) নিজ নিজ কন্যার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে নবী করীম (ছঃ) এর আবাসস্থলে উপস্থিত হতেন। হাদীসের কিতাবসমূহে এরূপ ঘটনা প্রচুর বিদ্যমান। তাই ফিকাহবিদগণ লিখেছেন, সপ্তাহে একদিন পিতা-মাতার সাথে দেখা করতে চাইলে স্বামীর বাধা দেয়া উচিত নয়। কিন্তু এটা তখন, যখন স্ত্রীর পিতা-মাতা কোন সঙ্গত কারণে স্বয়ং দেখা করতে সক্ষম না হন। নতুবা তারা নিজেরা এসে মেয়েকে দেখে যাবেন, এটাই হচ্ছে নিয়ম। -দুররুল মুখতার
.
স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ মীমাংশা
যদি স্ত্রীর সাথে কোনো ব্যাপারে মতপার্থক্য, এমনকি বিরোধ ঘটলেও স্বামীর পক্ষে কোন ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ ঠিক নয়। যদি স্ত্রী সংশোধন না হয়, তবে এমতাবস্থায় উভয় পক্ষ থেকে সালিস নিযুক্ত করতে হবে।
আল্লাহ তা’আলা কোরআন মজীদ ঘোষণা করছেন:
وإن خفتم شقاق بينهما فابعثوا حكما من أهله وحكما من أهلها–
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তোমরা স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিসী নিযুক্ত করবে।–সূরা আন নিসা : ৩৫
সাথে সাথে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, যাকে সালিস নিযুক্ত করা হবে, তিনি যেনো সৎ ও উত্তম ব্যক্তি হন। কেননা, তাঁর সততা ও আন্তরিকতাই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। নতুবা উপকারের পরিবর্তে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। কোরআন মজীদেও এর সমর্থনে ঘোষণা করেছে
إن يريدا إصلاحا یوقق الله بينهما إن الله كان عليما كبيرا ۔
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।–সূরা আন নিসা : ৩৫
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ) এ সম্পর্কীয় আয়াতসমূহের ব্যাখ্যামূলক তরজমায় লিখেছেন:
এবং যেসব নারী এরূপ হয় যে, তোমরা চাল-চলন ও আচার-ব্যবহার দ্বারা এদের অবাধ্যতার দৃঢ় আশঙ্কা করো, তবে তাদেরকে প্রথমত মৌখিক উপদেশ প্রদান কর। উপদেশ না মানলে তাদেরকে তাদের শয্যা পরিত্যাগ কর। অর্থাৎ তাদের নিকট শয়ন কর না। যদি এতেও সংশোধিত না হয়, তবে তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রহার কর। অনন্তর যদি স্ত্রীরা তোমাদের আনুগত্য করতে থাকে, তবে তাদের প্রতি যুলুম করার নিমিত্ত বাহানা ও সুযোগ তালাশ করো না। আর যদি আভাস দ্বারা তোমরা উপরস্থগণ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে এরূপ ঝগড়া-বিবাদের আশঙ্কা কর, যা তারা পরস্পর মিটমাট বা সমাধা করতে পারবে না। তবে তোমরা একজনকে স্বামীর পক্ষ হতে যে মীমাংসা করার যোগ্যতা রাখে, এবং আরেক জনকে-যে তদ্রূপই মীমাংসা করার যোগ্যতা রাখে, স্ত্রীর পক্ষ হতে নির্ধারণ করে এই ঝগড়া-বিবাদকে মীমাংসা করার জন্য তাদের নিকট প্রেরণ করো। তারা গিয়ে তদন্ত করবে এবং যে অন্যায় পথে থাকে অথবা উভয়েরই কিছু কিছু ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে তাদেরকে সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ দিবে। যদি এই উভয় সালিস আন্তরিকতার সাথে এ বিষয়ের সংশোধন কামনা করে, তবে আল্লাহ তা’আলা এই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে-তারা এতদুভয়ের পরামর্শ অনুযায়ী কর্ম করলে প্রীতি-ভালবাসা সৃষ্টি করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক মহাজ্ঞানী, সর্ববিষয়ের অবহিত। যে উপায়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে আপোস-রফা হতে পারে, তা জানেন। যখন আল্লাহ পাক সালিসদের সঠিক নিয়ত দেখতে পাবেন, তখন ওই উপায় তাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দেবেন।–বয়ানুল কুরআন
সারকথাঃ শালিস তথা মীমাংসাকারী সততা ও আন্তরিকতার সাথে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ ও মতানৈক্য উত্তমভাবে সমাধান করার নিরলস চেষ্টা করবে এবং উভয়কে এক জায়গায় এনে পরস্পরে মিলিয়ে দেবে। একই সাথে স্বামী-স্ত্রীরও নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, সালিসদের সহায়তা করা এবং তাঁরা আপোস ও মিশমিশের যে উপায় বের করে দেবেন, তদনুযায়ী চলার জন্য পূর্ণ আন্তরিক হওয়া।
.
ইসলামী শরীয়াতে স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলামী শরীয়াত স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে স্বামীর ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র ওপরে আলোচনা হয়েছে। এখন স্বামীর অধিকার সম্পর্কে ইসলামী শরীয়াতে স্ত্রীকে যে মূল্যবান উপদেশ দান করেছে, তারও একটা বিবরণ তুলে ধরা প্রয়োজন। যাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যাবলী সামনে রেখে বিচার করা যায়, ইসলাম যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণের জন্য কত বড় প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং উভয়ের পারস্পরিক সম্প্রীতিকে কি পরিমাণ মজবুত ও প্রাণময় করে তুলেছে।
.
আইনের পরিপূর্ণতা
যে সমস্ত আইন শুধুমাত্র এক পক্ষের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে অপর পক্ষকে সমস্ত দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়, তা যতই সুন্দর ও দৃষ্টি আকর্ষণকারী হোক না কেন, তাকে পরিপূর্ণ ও ত্রুটিমুক্তই বলা যাবে না। পরিপূর্ণ আইন কেবলমাত্র তা-ই হতে পারে, যা প্রত্যেকের ওপর অপরের দায়-দায়িত্বকে অনিবার্য করে তোলে, যদিও তার স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন হোক না কেন।
প্রকৃত পক্ষে নারী সৃষ্টিগত ভাবে, প্রকৃতিগত ভাবে ভারসাম্যহীন ও দৈহিক গঠনে দুর্বল। আর এ কারণেই স্ত্রী দয়া-মায়া ও করুণার পাত্রী। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তার ওপর কোন রকম দায়িত্বই অর্পণ করা উচিত নয়, কেননা তা হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দাম্পত্য জীবন বড় অপূর্ণ, বিস্বাদময় হয়ে উঠবে।
.
সংসারের কর্তৃত্ব
ইসলামী শরীয়ত নারীর এ সমুদয় দুর্বলতার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে, যা একান্ত ভাবেই তাকে বিধাতার পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়েছে। আর এ কারণেই দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব পুরুষের ওপর সোপর্দ হয়েছে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সামগ্রিক জীবনের প্রধান কর্মকর্তা পুরুষকেই নির্বাচিত করা হয়েছে, যাতে করে সংসারের কঠিন সমস্যাগুলো পুরুষ তার আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি-সাহস দ্বারা সমাধান করা যায়।
আল্লাহ্ তা’আলা পুরুষদের কর্তৃত্বের কথা ঘোষণা করে বলেছেন :
ت
بل و الله بعضهم على بعض وبما
أنفقوا من أموا لهم
পুরুষরা নারীর উপর কর্তৃত্বের অধিকারী। কারণ আল্লাহ তাদের একজনকে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষ তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে।–সূরা আন নিসা : ৩৪
মোদ্দাকথা এ যে, পুরুষকে যেহেতু জ্ঞান ও কর্মে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে, যেহেতু সে নারীর জন্য স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং মোহর, ভরণ-পোষণ প্রভৃতি উপায়ে সহায়তা করে, সেহেতু পুরুষকে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক জীবনের কর্তা বানানো হয়ছে।
.
পুরুষের কর্তৃত্ব দানের কারণ
প্রতিটি জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, পুরুষ তার আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতার বলেই অনেক ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে শক্তিশালী। স্বভাবগতভাবে নারীর জীবনে এমন কিছু সময় আসে, যখন সে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ে। অন্যের সাহায্য-সহায়তার মুখাপেক্ষী থাকে। এখানে গর্ভাবস্থা, শিশুকে দুগ্ধদান ও প্রতিপালন, হায়েয ও নিফাসের সময়ের কথা বলা হচ্ছে। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রহমাতুল্লাহ আলাইহি পুরুষের কর্তৃত্ব সম্পর্কে লিখেন।
পুরুষকে তার স্ত্রীর কর্তা বানানো অপরিহার্য এবং স্বভাবের দাবী হচ্ছে নারীর ওপর পুরুষের শেষ্ঠত্ব লাভ। কারণ পুরুষ জ্ঞান-বুদ্ধিতে পরিপূর্ণ, রাজনীতিতে সুদক্ষ, পৃষ্ঠপোষকতায় সুদৃঢ় এবং লজ্জা-শরম নিবারণে সক্ষম। তাছাড়া, পুরুষেরা নারীর অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে বলেও নারীর ওপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীক্বত।–হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা
.
আধুনিক জ্ঞান গবেষণায় পুরুষের মর্যাদা
আধুনিক জ্ঞান গবেষণাও একথা সমর্থন করছে যে, পুরুষের মস্তিষ্ক নারীর চেয়ে সুদক্ষ, তার ধৰ্য্যশক্তি অপেক্ষাক্বত মযবুত এবং বুদ্ধিও পরিপূর্ণ। তদুপরি পুরুষের শরীর ও মাংসপেশীও সুদৃঢ়। এ সম্পর্কিত কিছু উক্তি পূর্বে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এখানেও কয়েক জন মনীষীর গবেষণা লক্ষ্য করুন।
প্রখ্যাত সমাজবাদী দার্শনিক ডক্টর পোডন তাঁর ইবতিকারুন-নিযাম’ নামক পুস্তকে লিখেছেন:
পুরুষের তুলনায় নারীর স্মৃতিশক্তিও ঠিক তেমনই দুর্বল, যেমন তার জ্ঞানবুদ্ধি পুরুষের জ্ঞানবুদ্ধির তুলনায় দুর্বল। নারীর ধৈৰ্য্য ও চারিত্রিক শক্তিও পুরুষের সমান নয়। তাদের স্বভাবই অনেকট ভিন্ন প্রক্বতির। তাই দেখা যায়, নারীর ভাল-মন্দ বিচার পুরুষের ভাল-মন্দ বিচারের সাথে সাধারণত অসামঞ্জ্যপূর্ণ। এতেই প্রমাণিত হয় যে, নারী ও পুরুষের পার্থক্যটা শুধু বাইরের দিক দিয়ে নয়, বরং এসব প্রকৃতিগত পার্থক্যেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।–মুসলমান আওরত
এ উক্তি উদ্ধৃত করে ডক্টর ফরীদ ওয়াজদী লিখেনঃ
যে পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের ওপর মানুষের বিদ্যা, বুদ্ধিগত ও মানসিক বিকাশ নির্ভরশীল, তাতেও বিরাট পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ডক্টর নিকোলাস ও ডক্টর বেইলী প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, নারীর পঞ্চ-ইন্দ্রিয় পুরুষের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের তুলনায় অত্যন্ত হীন, দুর্বল।
অতঃপর সামনে অগ্রসর হয়ে ডঃ ওয়াজদী লিখেছেন:
মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নারী-পুরুষের মগযের আক্বতি ও প্রক্বতি উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। গড়ে পুরুষের মগযের ওজন নারীর মগযে তুলনায় এক শ’ ড্রাম অধিক।
.
পুরুষ অপেক্ষা নারীর ক্ষুদ্র মগজ
বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এটাও প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নারীর মগ পুরুষের তুলনায় ক্ষুদ্র। বুদ্ধি-জ্ঞানের ওপর যার প্রভাব অনস্বীকার্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর দেখা গেছে যে, বোকা ও নির্বোধ লোকের মস্তিষ্ক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র। এ ক্ষেত্রে ডঃ ওয়াজদী লিখেন।
মননশক্তির এ উৎসমূলের ক্ষেত্রেই নারীর তুলনায় পুরুষের পাল্লা বহুগুণ বেশি ভারী। সাধারণত পুরুষের মস্তিষ্ক বা মগযের গড়পড়তা ওযন প্রায় ৪৯২আউন্স, আর নারীর মগযের মস্তিষ্ক বা ওযন মাত্র ৪৪ আউন্স। দু’শ আটাত্তর জন পুরুষের মগ মেপে দেখা গেছে যে, সবচেয়ে বড় মগযের ওযন ৬৫ আউন্স এবং সবচেয়ে ছোট মগযটির ওযন ৩৪ আউন্স। অপরদিকে দু’শ একানব্বই জন নারীর মগ মেপে দেখা গেছে যে, সবচেয়ে ভারী মগটি ৫৪ আউন্স এবং সবচেয়ে হালকা মগযটির ওযন ৩১ আউন্স মাত্র। নারীর জ্ঞানশক্তি যে পুরুষের তুলনায় বহুগুণ দুর্বল-এই পার্থক্যই তার প্রক্বষ্ট প্রমাণ।
উল্লেখ্য যে, এই পার্থক্য সর্বত্র বিদ্যমান। এক্ষেত্রে সভ্য-অসভ্যের কোনো ভেদাভেদ নেই। কোনো কোনো অজ্ঞ ব্যক্তি এই প্রশ্ন তুলে তর্ক শুরু করে দেন। তাই বিখ্যাত গ্রন্থ এনসাইক্লোপেডিয়ার বিজ্ঞ সম্পাদক প্রফেসর দ্য ফরিনি লিখেন।
নারী ও পুরুষের শারীরিক ও মানসিক ব্যবধান যেমন প্যারিসের ন্যায় সুসভ্য শহরে দেখা যায়, তদ্রুপ আমেরিকার বর্বরতম জাতিসমূহের মধ্যেও ঠিক সে পরিমাণেই পরিলক্ষিত হয়।
সামগ্রিকভাবে, আধুনিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাও প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নারীর . তুলনায় পুরুষের যোগ্যতা বেশি এবং যোগ্যতার প্রতি ক্ষেত্রেই নারী অপেক্ষা পুরুষ অগ্রবর্তী।
.
কর্তৃত্ব পুরুষের সত্ত্বেও উভয়ের অধিকার সমান
স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে পুরুষের কর্তৃত্ব স্বীক্বত। এর অর্থ এ নয় যে, ইসলাম নারীকে পুরুষের দাসী বানিয়েছে। যারা এরূপ কদৰ্থ করতে সচেষ্ট, তারা অহেতুক হঠকারিতাবশই তা করে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে এ কথার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি কোনো ব্যাপারে মতানৈক্য ঘটা অসম্ভব নয়। তা যদি না হয় তবে উভয়ের মধ্যে মত-পার্থক্য দেখা দিলে তার সমাধান কি? ইসলামের দৃষ্টিতে তখন পুরুষের মতই প্রাধান্য পাবে এবং এমতাবস্থায় নারীর কর্তব্য হচ্ছে পুরুষের রায় মেনে নেয়া। কেননা, পুরুষ তার বিশেষ যোগ্যতার বলেই পারস্পরিক ও গার্হস্থ্য জীবনের কর্মকর্তা। নতুবা ইসলাম উভয়ের পরামর্শ ও সমঝোতার ভিত্তিতেই সমস্ত কাজকর্ম আঞ্জাম দেয়ার পক্ষপাতী। এছাড়া নার-নারীর মধ্যে পূর্ণ সমতা বিদ্যমান। প্রত্যেকের ওপরই অপরের অধিকার ও কর্তব্য রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :
ولهن مثل الذي عليهن بالمعروف والرجال عليهن درجة .
নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের ওপর পুরুষদের। কিন্তু নারীদের ওপর পুরুষদের কিছুটা মর্যাদা আছে।–সূরা আল বাকারা : ২২৮
উল্লেখিত আয়াতটি আকারে ক্ষুদ্র হলেও এর মধ্যে এক বিরাট মূলনীতি নিহিত। এক সাধারণ বিধান বিদ্যমান। তা হচ্ছে, নারী সব জিনিসেই পুরুষের সমান। সমগ্র মানবাধিকারেই পুরুষের সমতুল্য। তবে কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য নারীর চেয়ে পুরুষের কর্তৃত্ব আছে। যাকে নারীদের ওপর পুরুষদের কিছু মর্যাদা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যাকে La। le J Jপুরুষরা নারীদের কর্তা–এর অধীনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই একটি মাত্র ক্ষেত্র ছাড়া নারী সমগ্র আচার-আচরণ আখলাক-চরিত্র ও ইবাদত-বন্দেগীতে পুরুষের সমান। এমন কোন জিনিস নেই, যদ্বারা পুরুষকে বড় এবং নারীকে হেয় জ্ঞান করা যায়। একমাত্র ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদের এ সম্মান দিয়েছে।
জনৈক দার্শনিক ঠিকই বলেছেন, আল্লাহ রব্বুল আলামীন যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত জীবনের কর্তৃত্ব নারীর অধিকারে ফেলতে চাইতেন, তাহলে নারীকে পুরুষের মাথার অংশ থেকে সৃষ্টি করতেন, আর যদি নারীকে সেবিকার স্তরে রাখতে চাইতেন, তবে নারীকে পুরুষের পায়ের অংশ থেকে সৃষ্টি করতেন। আসলে এ দুটির কোনটিই উদ্দেশ্য ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল তৃতীয় একটি উন্নত ও ভিন্নতর বিষয়। তা হচ্ছে, নারী ও পুরুষ উভয়ে সাম্যের জীবনযাপন করবে। বন্ধুত্বের ব্যবহার চালু রাখবে। উভয়ে উভয়ের ই্যুত ও ভালবাসা অন্তরে পোষণ করবে। তাই রাব্বল আলামীন নারীকে পুরুষের পার্শ্বদেশ থেকে সৃষ্টি করেছেন।
.
যদিও স্বামী কর্তৃত্বের অধিকারী তবুও
স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে কাজ করবে
পুরুষকে কর্তৃত্বের অধিকারী বানানো সত্ত্বেও আল্লাহ পাকের নির্দেশ হলো, সাংসারিক যাবতীয় কর্ম স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মিলে মিশে করবে এবং উভয়ের সম্মতি ও সন্তোষের মাধ্যমে তা আঞ্জাম দেবে। কোরআন যেখানে মাকে বলেছে সন্তানকে দু’বছর স্তন্য দান করতে এবং পিতাকে বলেছে স্তন্যদানকারিণীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে, সেখানে দুধপান বন্ধ রাখার বিষয়টিও উভয়ের পরামর্শ ও সম্মতিক্রমে ঠিক করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছে।
فصالا عن تراض منهما وتشاور فلا جناح عليهما
যদি তারা পরস্পরের সম্মতি ও পরামর্শক্রমে দুধপান বন্ধ রাখতে চায়, তবে তাদের কারো কোনো দোষ নেই। -সূরা আল বাকারা : ২৩৩
এ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তা’আলার অভিপ্রায় সমুদয় কর্ম যথাসম্ভব পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে নিষ্পন্ন হওয়া। অনন্তর মু’মিনদের বৈশিষ্ট্যই বর্ণনা করা হয়েছে ও আল্লাহ বলেন
وامرهم شوری بینهم—
তারা পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।–সূরা আশ শূরা : ৪
এ সব আলোচনার সারমর্ম হল, ইসলাম নরী-পুরুষের মধ্যে বৈধ সম্পর্ক স্থাপনের পর এমন এক বিধান সৃষ্টি করে দিয়েছে, যা অনুসরণ করলে উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালবাসা বজায় থাকবে এবং উভয়ের চারিত্রিক সততা ও যৌন পবিত্রতার ওপর কোন রকম কলিমা লেপন করতে পারবে না।
.
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন
এ যুগে প্রায়ই শোনা যায়, ধনী পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য কিছু ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয়ে উভয়ে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করছেন। এই বিচ্ছেদভাব কখনো কখনো অনেক বছর পর্যন্ত গড়ায়। স্ত্রী যেমন তার জেদের ওপর অটল থাকে, স্বামীও তার মতের উপর অনড়। এই বিচ্ছেদকাল উভয়ের জন্যই বড় নাযুক সময়। কেননা, কাম-প্রবৃত্তি থেকে কেউই মুক্ত নয়। ইসলাম এ ধরনের বিচ্ছিন্ন জীবনকে অভিশপ্ত ঘোষণা করেছে। ইসলামী শরীয়াতে এ ধরনের জীবন ব্যবস্থার মধ্যে এর কোনো অবকাশ নেই।
.
সতীস্বাধ্বী নারী ও তার কর্তব্য
স্বামী-স্ত্রী যদি ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলতো, তাহলে এমন বিচ্ছিন্ন জীবন অবস্থারই সৃষ্টি হতো না। এরূপ ক্ষেত্রে পুরুষের কর্তৃত্বেই গোলযোগের এই ছিদ্রপথটি বন্ধ করে দিতো। FJ 1: 31 Jaiপুরুষ নারীর কর্তা এই ঘোষণার পরই আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন :
فا لصلحت قنتت حفظت للغيب بما حفظ الله .
সুতরাং সতীস্বাধ্বী স্ত্রীরা অনুগতা এবং যা লোক চক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হিফাযতে, তারা তার হিফাযত করে।–সূরা আন নিসা : ৬
উক্ত আয়াতে সতী নারীর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। নারীকে এভাবে পুরুষের আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যাতে উভয়ের মধ্যে কখনো মতভেদ সৃষ্টি হলেও বিচ্ছিন্ন থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়। দাম্পত্য জীবনের দৃঢ়তার জন্য রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
اما إمراة سألت زوجها طقا في يوما بأس فراهم عليها رائحة
যে নারী দুঃখ কষ্ট ব্যতীত স্বামীর নিকট তালাক চায়, তার জন্য জান্নাতের ঘ্রাণও হারাম। -মিশকাত
উক্ত হাদীসে নারীদেরকে শিক্ষাদান করা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে কখনো কোন অনভিপ্রেত মতভেদের ঘটনা ঘটে গেলে এ সামান্য ব্যাপারেই স্বামীর কাছে তালাক প্রার্থনা শুরু করে দিব না। পারিবারিক জীবনে সাধারণত এরূপ ঘটনা ঘটেই থাকে। কেননা উভয়ের স্বভাব-প্রক্বতিতেই প্রাক্বতিক বিভিন্নতা বিদ্যমান থাকে।
দাম্পত্য জীবন সুখী করতে সতী নারীর কর্তব্য হচ্ছে, পারস্পরিক সংঘবদ্ধ জীবন পদ্ধতিতে যখনই অমিল অনুভূত হয়, তখনই স্বামীর কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করা। আবেগ ও জেদ পরিহার করে যুক্তির পথ অনুসরণ করা। যৌথ ও পারিবারিক জীবনে স্বামীর কর্তৃত্বের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তার আনুগত্য মেনে নেয়া। স্বীয় কর্তার বাড়াবাড়ির আশঙ্কা হলে আইনের গন্ডীর মধ্যে থেকে তার বাড়াবাড়ি তার কাছে তুলে ধরবে। ন্যায়বিচার ও সাবধানতার দাবীকে ভদ্রভাবে তার কাছে পেশ করতে হবে।
আল্লাহ্ না করুন, নারী যদি জেদ ধরে আইনকে নিজ হাতে তুলে নেয়, তবে নিঃসন্দেহে দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি চিরদিনের জন্য তিরোহিত হবে। প্রতি কাজে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে পড়বে। স্বামী-স্ত্রী যে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের কর্তা, তা ধ্বংস ও বিনষ্ট হয়ে যাবে। তার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি স্বরূপ দুনিয়াবাসীর কাছে তারা হেয় প্রতিপন্ন হবে। গোটা জাতি জেনে ফেলবে স্বামী-স্ত্রী কারো মধ্যেই পারিবারিক রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা নেই। এরপর কেউ-ই সহসা তাদেরকে এই রাষ্ট্রের সদস্য পদ দানে সম্মত হবে না।
.
স্বামীর সন্তুষ্টি
পুরুষের ভালবাসা ও কর্তৃত্বের কারণে নারীর ওপর তার স্বামীকে সন্তুষ্ট ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করা অত্যাবশ্যক। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
توكنت أمر أحدا أن يسجدا لأحد لأمرت المرأة أن تسجد لزوجها ۔
যদি আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তবে নারীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার।–তিরমিযী, অনুচ্ছেদ : নারীর সাথে ব্যবহার
স্ত্রীর ওপর তার স্বামীর সমীহ-সম্ভম ও সন্তোষ বিধান করা অপরিহার্য-হাদীসের অর্থ এ ছাড়া আর কি হতে পারে, যে স্বামী নিজকে স্ত্রীর প্রতি ভালবায় উৎসর্গ করে দিয়েছে, স্ত্রীর সুখের জন্য স্বীয় ধন-সম্পদ উজাড় করে দিয়েছে, তাকে শ্রদ্ধা-সম্মান ও তুষ্ট করা স্ত্রীর কর্তব্য নয় কি?
শুধুমাত্র লোক-দেখানো ভক্তি-শ্রদ্ধা নয়, বরং আন্তরিকতাও একান্ত আবশ্যক, যাতে স্বামীর মনে দাগ কাটার দরুন স্ত্রীর ওপর সন্তুষ্ট হয়। স্বামীর সন্তোষ বিধান করা স্ত্রীর পক্ষে দুনিয়ার জন্যও আবশ্যক এবং পরকালের জন্যও।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন :
ائما إمرأة ماتت وزوجها عثها راښ دخلت الجنة.
যে স্ত্রী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।–তিরমিযী
.
স্বামীর আনুগত্য
নারী তার আনুগত্য ও ফরমাবরদারী দ্বারাই স্বামীর ভালবাসা ও সন্তুষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ স্ত্রী যখন তার স্বামীর প্রতিটি বৈধ নির্দেশ মেনে চলবে, তখন স্বামী তার ওপর স্বীয় মন-প্রাণ উজাড় করে দেবে। একজন ভদ্রলোকের পক্ষে যতটুকু আদর-ভালবাসা সম্ভব, তার সবটুকুই সে করবে। বস্তুত স্বামীর বৈধ আনুগত্যই নারীর ভূষণ। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা ও।
المرأة إذا صلت خمسها وصامت شهرها واحصنت فرجها وأطاعت
بعلها فلتدخل من ای ابواب الجنة شاءت ۔
নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযান মাসের রোজা পালন করে, স্বীয় যৌনাঙ্গ হিফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তবে সে জান্নাতের যে দর দিয়ে চাইবে, প্রবেশ করতে পারবে।–মিশকাত,
নামায-রোযা ও ইযযত-আবরু রক্ষার সাথে সাথে স্বামীর আনুগত্য করাও আবশ্যক বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ হাদীসে ইঙ্গিত করা হয়েছে, নারীর যেমন আল্লাহর হক আদায় করা জরুরী, তেমনি স্বামীর হক আদায় করাও তার কর্তব্য। স্বামীর হক নষ্ট করে নারী কখনো সফলকাম হতে পারে না।
নবী করীম (ছঃ) কে একবার জিজ্ঞাসা করা হল, ভালো স্ত্রী কে? তিনি উত্তরে বললেন :
بر ولا تخال
و تسره إذا نظر وتطيعه اذا اما
যে স্ত্রীর দিকে স্বামী তাকালে তার মন খুশী হয়, যে স্ত্রীকে কোনো বৈধ আদেশ দিলে তা পালন করে, যে স্ত্রী তার জান ও মাল দ্বারা স্বামীর অপছন্দনীয় কোন কাজ করে না সে-ই আদর্শ স্ত্রী।–মিশকাত
স্বামীর আনুগত্য করার তাকীদ এর চেয়ে মনোহর ভঙ্গিতে আর কি হতে পারে? বস্তুত যে নারীর মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলি অনুপস্থিত, তাকে নিশ্চিতভাবেই জেনে রাখতে হবে যে, রাসূলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট সে ভালো স্ত্রী নয়। আর যা-ই হোক, যে স্ত্রী আল্লাহর রাসূলের দৃষ্টিতে ভাল নয়, সেতো বড়ই হতভাগা।
.
শরীয়ত বিরোধী নির্দেশ মানা যাবে না
এটা স্বীক্বত সত্য যে, স্বামীর বৈধ আনুগত্যের বাইরে যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ স্বামীর যে সব কথা ও নির্দেশ আল্লাহর শরীয়ত বিরোধী, স্ত্রী তা মানবে না। হাদীসে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। এক আনসারী মহিলা একবার নবী করীম (ছঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন : আমি আমার কন্যাকে বিবাহ দিয়েছি। ঘটনাক্রমে কন্যার মাথার চুল উঠে গেছে। এখন স্বামী চাচ্ছেন তার মাথায় ক্বত্রিম চুল লাগাতে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি? তখন নবী করীম (ছঃ) বললেন :যে নারী স্বীয় মাথায় ক্বত্রিম চুল লাগাবে, তার ওপর আল্লাহ লানত।–বুখারী
.
অনুগত স্ত্রী মূল্যবান নিয়ামত
স্বামীর যেসব নির্দেশ শরীয়ত সম্মত স্ত্রী তা অবশ্যই মেনে চলবে। অনুগত স্ত্রীকে হাদীসে বড় মূল্যবান নিয়ামত হিসেবে ঘোষণা করেছে। অনুগত স্ত্রীকে ইসলাম কি সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে, এই হাদীসটি পাঠ করে তা অনুমিত হয়।
ما اشتقاد المؤمن بعد تقوى اللوخيرا له من زوجة صالحة إن أمرها أطاعته وإن نظر إليها سرته وإن أقسم عليها ابته وان اب عنها نصحته في نفسها ومالو ۔
তাকওয়ার বা আল্লাহভীতির পর মুসলমানদের জন্য যে উত্তম জিনিসটি গ্রহণযোগ্য, তা হচ্ছে সতী নারী। (আর সতী নারীর বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে।) সে স্বামীর নির্দেশ মেনে চলে, তার দিকে তাকালে স্বামীর অন্তর জুড়িয়ে যায়, তাকে ওয়াদা দিলে তা পূর্ণ করে এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্বীয় জান ও স্বামীর মাল সম্পদ হিফাযত করে।–ইবনে মাজা।
উক্ত হাদীস থেকে জানা গেল, মুমিনের আল্লাহ তা’আলার ভয়-ভীতির পর উৎকৃষ্ট সম্পদ হচ্ছে সতী ও অনুগত স্ত্রী, যে তার প্রিয় স্বামীর মন জয় করে। তাঁর প্রতিটি আদেশ পালন করে এবং (স্বামীর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে) যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে।
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : স্বামী যদি তার স্ত্রীকে এক পাহাড়ে থেকে অন্য পাহাড়ে, সেখান থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার আদেশ দেন, তবে সতী স্ত্রী তা-ই করবে।–ইবনে মাজা।
ইসলামী শরীয়ত স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্পর্ককে অধিকতর মযবুত করতে চায়। তাই এক্ষেত্রে উভয়ের মনস্তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখে স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেককে তার উপযুক্ত অধিকার দান করেছে। স্ত্রীর ওপর স্বামীর যেসব অধিকার রয়েছে, তার সবগুলোই স্ত্রী মনে-প্রাণে আদায় করতে সক্ষম।
একদিন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :স্বামীর বৈধ আদেশ পালন করা স্ত্রীর জন্য অপরিহার্য। তিনি আরো বলেন, স্ত্রী যে পর্যন্ত স্বীয় স্বামীর বৈধ অধিকারসমূহ আদায় না করবে, সে পর্যন্ত ঈমানের মিষ্টি স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে না।–মিফতাহুল খিতাবাহ।
পূর্বের হাদীসে বলা হয়েছে, স্বামী তার গোটা পরিবারের অধিকর্তা। পরিবারে স্ত্রীও অন্তর্ভুক্ত আছে। সুতরাং অধিকর্তার বৈধ আদেশ অমান্য করা কি করে বৈধ হতে পারে?
বৈধ সব নির্দেশ নারীর আনন্দ সহকারে পালন করা উচিত। কেননা, নারী তার স্বামীর অর্ধাংগিনী, জীবনসঙ্গিনী ও সুখ-দুঃখের অংশীদার। তাই এক জীবন সঙ্গীর কর্তব্য হচ্ছে অন্য জীবন সঙ্গীর জন্য প্রাণপাত করা। নারী যা-ই করবে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে করবে–নিজকে দাসী-বান্দী ও অধীনস্থা মনে করবে না।
.
স্বামীর যৌন আহ্বানে সাড়াদান
যৌন চাহিদা বাহ্যত পার্থিব ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রেও স্বামী তার স্ত্রীকে আহ্বান করলে স্ত্রীর স্বাভাবিক প্রণয়ের দাবী হচ্ছে, স্বামীর আদেশ মান্য করা। নবী করীম (ছঃ) বলেন :
إذا الرجل دعا زوجته حاجته خلت له وإن كانت على التنور–
যখন কোনো পুরষ তার স্ত্রীকে নিজের প্রয়োজনে ডাকে, তখন সে যেনো স্বামীর ডাকে সাড়া দেয় যদিও সে রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে।–মিশকাত, তিরমিযী
নিন্মের হাদীসে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, যদি এক্ষেত্রেও সাড়া প্রদান না করে, তবে গুনাহগার হবে। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
إذا دعا الرجل امرأته إلى فراشه فابث ان تجثى لعنتها الميكة حثی
কোনো ব্যক্তি যদি স্বীয় স্ত্রীকে তার সাথে এক বিছানায় শয়ন করার জন্য ডাকে, অর্থাৎ সহবাসের জন্য, আর স্ত্রী তা অস্বীকার করে, তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতা তাকে অভিশাপ দিতে থাকেন।–বুখারী, অনুচ্ছেদ ও যদি কোনো স্ত্রীলোক তার স্বামীর বিছানা বাদ দিয়ে আলাদা বিছানায় রাত যাপন করে।
একদিন তিনি শপথ করে বলেন, স্বামীর তার শয্যায় আসতে স্ত্রীকে আহ্বান জানাল আর স্ত্রী যদি স্বামীর সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, তবে স্বামী স্ত্রীর ওপর সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ রব্বুল ইযযত ও ফেরেশতাগণ তার ওপর নারাজ থাকেন।–মুসলিম
.
যৌন চাহিদা সত্ত্বেও স্ত্রীর স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা
ইমাম নববী (রঃ) বলেন : কোন শরয়ী ওযর ব্যতিরেকে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর সহবাসের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা হারাম।–শরহু মুসলিম।
তবে অবশ্যই স্বামীকেও স্ত্রীর অবস্থার প্রতি পুরাপুরি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিছক যৌন চাহিদার সুবাদে স্ত্রীর স্বাস্থ্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা মানবতা ও নৈতিকতা উভয়েরই পরিপন্থী। ফিকাহবিদগণ লিখেছেন ও স্ত্রীর স্বাস্থ্য খারাপ হলে স্বামীর সংযমী হওয়া আবশ্যক।
لوتوث من كثرة جمايو لم تجز الزيادة على قدر طاقتها ۔
অধিক সহবাসে যদি স্ত্রীর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, তবে স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর ক্ষমতার বাইরে সহবাস করা না জায়েয।–দুররুল মুখতার
যা হোক, নারী এ ক্ষেত্রেও স্বামীর হুকুমের অনুগত। তার অবাধ্যাচরণের কোন অনুমতি নেই। এ হাদীসে থেকেও তার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
الأتصوم المرأه وبعلها شاهد إلا بإذنه–
স্বামীর উপস্থিতিতে কোনো নারী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত (নফল) রোযা রাখবেন না। -বুখারী
এতসব বিধি-বিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যৌন সততা ও আমল-আখলাকের পবিত্রতা রক্ষা। সেই সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সুদৃঢ় ও পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসা অটুট রাখা।
.
নবী ও সাহাবী যুগে স্বামীর সন্তুষ্টি বিধান
এ কারণেই নবী করীম (ছঃ) এর যুগে ও সাহাবা যুগে স্ত্রীরা তাঁদের স্বামীদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করতেন। স্বামীদের সামান্যতম অসন্তুষ্টিও তাদের পক্ষে প্রাণসংহারক মনে হতো। স্বামীদের সাথে এতটুকু দুর্ব্যবহার করতেন না।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর ঘটনা। একদিন তিনি তাঁর হাতে একটি রূপার আংটি পরেছিলেন। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, আয়েশা! তোমার হাতে কি ওটি? তিনি বলেন : এটি আপনার সন্তুষ্টিলাভের মানসে পরেছি।-উসওয়া-ই-সাহাবা
একদিন হযরত খাওলা (রাঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: আমি প্রতি রাতে সাজগোছ করে নববধুরূপে স্বামীর নিকট শয়ন করি। কিন্তু তবু তিনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না। হযরত আয়েশা (রাঃ) এই ঘটনা রাসূলকে জানালেন। রসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন : তাকে বলে দাও, স্বামীর আনুগত্য করতে থাকো।–উসওয়ায়ে সাহাবা
.
রাসূল (সঃ)-এর প্রতি পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণ-এর ভালবাসা
ইসলামের এ পদ্ধতির ফলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে অপরিসীম ভালবাসা জন্মাতো। একে অন্যের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে দিতেন। স্বয়ং রসূলে করীম (ছঃ) এর পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণের জীবনের দিকে লক্ষ্য করুন। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাদের কি পরিমাণ অন্তরঙ্গ ভালবাসা ছিলো। আপনারা অবগত আছেন, হযরত খাদীজা (রাঃ) এক ধনাঢ্য মহিলা ছিলেন। রসূলে করীম (ছঃ) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর হাতে সোপর্দ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর উপর কোন বিপদ উপস্থিত হলে খাদীজা (রাঃ) অস্থির হয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দান করতেন।
নবী করীম (ছঃ) প্রতি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর ভালবাসার কথাও সুবিদিত। হযরত খাদিজা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর কাপড়-চোপড় স্বহস্তে ধৌত করতেন। তাঁকে খোশবু মেখে দিতেন, রাসূল (ছঃ) এর মিসওয়াক চিবিয়ে দিতেন, আবার তা সযত্নে উঠিয়ে রাখতেন। এমন কি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) কোরবানীর পশুর জন্য রশিও নিজ হাতে তৈরী করে দিতেন। একবার রসূলে করীম (ছঃ) কম্বল গায়ে দিয়ে মসজিদে তশরীফ নেন। সাহাবা-ই-কিরামের দৃষ্টি আকর্ষণের ফলে জানা গেল যে, কম্বলের গায়ে একটি দাগ দেখতে পেল। হযরত তৎক্ষণাৎ কম্বলটি খুলে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) তখন বরতনে পানি নিয়ে নিজ হাতে তা ধৌত করলেন। তারপর শুকিয়ে নিয়ে রাসূলের নিকট পাঠিয়ে দিলেন।–উসওয়ায়ে সাহাবা।
.
সাহাবীদের প্রতি স্ত্রীদের ভালবাসা
মহিলা সাহাবীগণও এই সৎগুনে পরিপূর্ণ ছিলেন। তারাও তাদের প্রিয় স্বামীদের সন্তোষ কামনায় জীবনপাত করতেন। হযরত যয়নব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর আদরের কন্যা। আবুল আসের সাথে যয়নবের বিবাহ হয়। আবু আস তখনো মুসলমান হননি। বদরের যুদ্ধ শুরু হলো। এই সত্য ও বাতিলের যুদ্ধে আবুল আস কাফিরদের পক্ষে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন। আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। কোরাইশদের এক বিরাট দল যুদ্ধে বন্দী হল। এই দলে আবুল আসও ছিলেন। নবী (ছঃ) মুক্তিপণ ঘোষণা করলেন। আবুল আসের স্ত্রী হযরত যয়নব বিনতে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাঁর স্বামীর মুক্তিপণ স্বরূপ স্বীয় গলার মূল্যবান হার প্রেরণ করলেন। এই হারটি হযরত যয়নবের নিকট তাঁর জননী হযরত খাদীজাতুল কুবরার স্মৃতি হিসাবে ছিল।
হামনা বিনতে জাহাশ (রাঃ)-এর স্বামী আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করার মানসে জিহাদে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত হামনা যখন জানলেন, তাঁর স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তখন নিজেকে আর সংযত করতে পারলেন না। ভালবাসার আতিশয্যে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। হযরত উমর (রাঃ)-এর স্ত্রী রোযার দিনে অধিক ভালবাসার দরুন স্বীয় প্রিয় স্বামীর মস্তক চুম্বন করতেন।
হযরত হাসান (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর তাঁর স্ত্রী তাঁর স্বামীর পক্ষ থেকে মোহরানা পেয়ে কেঁদে উঠে বললেন : হারানো বন্ধুর অর্থাৎ স্বামীর পরিবর্তে এ অর্থ অতি তুচ্ছ।
এসব ঘটনা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে অনুমান করুন, ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনকে কোন ভিত্তির ওপর দাঁড় করতে চায়। প্রেম ও আনুগত্য ব্যতীত বিবাহ সম্পর্ক প্রাণহীন দেহ ছাড়া কিছু নয়।
.
হাসিমুখে স্বামীকে স্বাগতম জানানো
উক্ত আলোচনার আলোকে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, নারীর কর্তব্য হচ্ছে, স্বামী ঘরে আগমন করলে তাকে হাসিমুখে স্বাগতম জানানো। কেননা, নারীর মুচকি হাসির মধ্যে এতবড় শক্তি নিহিত রেখেছে যে, স্বামী তার স্ত্রীর মুচকি হাসি দেখে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত দুঃখ বেদনা ভুলে যায়। পুরুষরা পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে স্ত্রীর হাসিমুখে কথাবর্তা ও সান্তনা দানে সব দুঃখ বেদনা ভুলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তার হৃত কর্মশক্তি ফিরে পায়।
যে সব নারী স্বামীর সামনে মুখ ভার করে থাকে, সে ইচ্ছাকৃতভাবেই আপন গৃহকে জাহান্নামে পরিণত করতে চায়। স্বামীর জীবনে সে অশান্তি বীজ বপন করে দেয়। নিম্নোক্ত হাদীসে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। উত্তম নারীর পরিচয় দিতে গিয়ে রাসূল (ছঃ) বলেন :
স্বামী যখন স্ত্রীর প্রতি তাকায়, তখন স্বামীকে খুশী করে দেয়।–মিশকাত।
এরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রী-স্বামীর সামনে সেজেগুজে ও পরিষ্কার পোশাক পরে আসবে। ঘর-বাড়ী, বিছানাপত্র ও অন্যান্য আসবাব পত্র স্বামীর সামনে পরিপাটি করে রাখবে।
.
নিজ হাতে স্বামী গৃহের কার্য সম্পাদন
নিজ হাতে স্বামীর সেবা করতেও ত্রুটি করবে না। রাসূলের পাক-পবিত্র স্ত্রীরা তাই করতেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর আদরের দুলালী হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আহারও এই নিয়ম ছিলো। তিনি গৃহের কাজকর্ম নিজ হাতে সম্পন্ন করতেন।
ইমাম বুখারী (রাঃ) তাঁরজামে নামক কিতাবেস্বামীর ঘরে স্ত্রীর কামকাজ করা নামে একটি আলাদা অনুচ্ছেদই দাঁড় করেছেন। ওই অনুচ্ছেদে আটা পিষতে পিষতে নবী দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর হাতে কালো দাগ পড়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।
হাদীসবিশারদগণ এ ঘটনাদৃষ্টে বলেছেন, গৃহের সাধারণ কাজকর্ম নারীদের নিজ হাতেই সম্পন্ন করা উচিত। নবী দুলালী হযরত ফাতেমা (রাঃ) যদি আটা পিষতে পারেন, তাহলে আপনি কি আটা ছানা ও রুটি তৈরির কাজও করতে পারেন না। ইমাম মালেক (রঃ) তো এ পর্যন্তই বলে ফেলেছেন যে, স্বামী যদি ধনী না হয়, তবে কাজকর্ম করা স্ত্রীর অবশ্য কর্তব্য। স্ত্রী যত বড় ধনীর ঘরের দুলালীই হোক না কোনো।-উমদাতুল কারী
তাবুকর যুদ্ধে তিনজন সাহাবী অংশগ্রহণ করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশে তাদের সব দিক দিয়ে একঘরে করা হয়। এদের মধ্যে হযরত হেলাল ইবনে উমাইয়া (রাঃ) অন্যতম। কিছু দিন পর নবী (ছঃ) আদেশ জারী করলেন : যত দিন পর্যন্ত এদের বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ফয়সালা না হবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের স্ত্রীরাও তাদের বয়কট করবে। এই আদেশ জারীর অব্যবহিত পরেই হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী নবীর দরবারে উপস্থিত হয়ে আবেদন জানালেন : হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্বামী বৃদ্ধ। তার সেবা করার মত কোন খাদিমও নেই। তাই আপনি অনুমতি দান করলে আমি তার সেবা যত্ন করতে পারি। রাসূলে করীম (ছঃ) হেলালের স্ত্রীকে তার সেবাযত্ন করার অনুমতি প্রদান করলেন। -বুখারী
আল্লামা হাফিয ইবনুল কায়্যিম (রঃ) এ অধ্যায়ে হযরত যুবাইর (আঃ) এর স্ত্রী হযরত আসমা (রাঃ) তাঁর স্বামীগৃহের কি পরিমাণ খিদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন, তা সবিস্তার বর্ণনা করেছেন। যাদুল মাআদ
.
হঠকারি ও জেদী স্বভাব বর্জন
মহিলাদের এক বড় দোষ জেদী ও হঠকারি স্বভাব। এটা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে হবে। কেননা, অনেক সময় দেখা গেছে, কোনো কথা তাদের মেজাজের বিরুদ্ধে হলেই তারা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। তাদের স্বভাব খুবই জেদী। মুখভার করে রাখে। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। স্ত্রীর ওপর থেকে স্বামীর মন উঠে যায়। স্ত্রীর উচিত কোন যুক্তিসম্মত কথা হলে, তা স্বামীকে বুঝানোর চেষ্টা করবে। মুখ ভারী, জেদী, কিংবা ঝগড়া-বিবাদ করবে না। স্বামীকে রাগান্বিত দেখলে নিজে নত হবে। নিজের রাগ প্রকাশ করা যদি একান্ত প্রয়োজনই হয়, তবে এমনভাবে তা প্রকাশ করবে, যাতে পারস্পরিক সম্পর্কে কোন ধরনের ফাটল সৃষ্টি না হয়।
বদমেযাজী ও অত্যাচারী স্বামীর পাল্লায় পড়লে জ্ঞান-বুদ্ধি খরচ করে কাজ করবে। বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাবে না। কিছুটা নত হয়ে হলেও আপোস-রফা করে ফেলবে। তাতে স্ত্রীরই কল্যাণ হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন
وإن امرأة خافت من بعلها شوز؛ أو إمراا فلا جناح عليهما ان
يصلحا بينهما صلحا واللح خير—
যদি কোন স্ত্রী স্বামীর দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আশংকা করে, তবে তারা আপোস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাদের কোনো অপরাধ নেই এবং আপোস-নিষ্পত্তিই উত্তম। -সূরা আন নিসা : ১৯
.
যৌন পবিত্রতা রক্ষায় কতিপয়
জরুরী বিধি-বিধান
পূর্বোক্ত আলোচনাগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে আপনাদের নিকট একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইসলাম তার আইন ও বিধি-বিধানের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের মধ্যকার ভালবাসা ও ত্যাগী মনোবৃত্তির প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে, যাতে করে বিবাহের উদ্দেশ্যসমূহ জনসমক্ষে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মানুষ শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে বিবেদ ও ভুলবুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়ে যৌন পবিত্রতা ও সতীত্ব হানি হতে না পারে।
এসব কারণেই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে প্রত্যেকের অধিকার পরস্পরের ওপর এমনভাবে বর্তানো হয়েছে যে, উভয়ে যদি নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে চলে, তবে কখনো পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের অবকাশই থাকবে না।
.
স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসায় প্রতিবন্ধক হওয়া নিষিদ্ধ
যে-সব কাজকর্ম স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়, ইসলাম তার থেকে দূরে থাকার জন্য মানব জাতিকেও কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। কোরআন মজীদে জাদু প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে তার সবচেয়ে বড় ক্ষতিকরও অপকারিতা নির্দেশ করা হয়েছে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করা।
فيتعلمون منهما ما يفرقون به بين المرء وزوجه .
তারা তাদের নিকট থেকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে যা বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে, তা শিক্ষা করত।–সূরা আল বাকারা : ১০২।
অতঃপর বিচ্ছেদের পরিণামফল উল্লেখ করে কোরআনেই ঘোষণা করা হয়েছে :
ولقد علموا لمن اشتره ماله في الآخرة مث خلاق–
আর তারা নিশ্চিতভাবে জানতো যে, যে–কেউ তা ক্রয় করবে, আখেরাতে তার কোন অংশ নেই।–সূরা আল বাকারা : ১০২
.
শয়তান স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে অধিক খুশী হয়
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো মহা পাপ। এরূপ ব্যক্তি আখেরাতের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে। সায়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছঃ) একবার ইবলীস ও তার চেলা চামুন্ডাদের শয়তানী কর্মকাণ্ডের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন : ইবলীস তার সিংহাসন বিছিয়ে দরবার খুলে বসে এবং মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তার দল প্রেরণ করে। শয়তানী দল যার যার কাজে রওয়ানা হয়ে যায়। যে শয়তান সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, ইবলীস তাকে অধিক পুরস্কৃত করে। শয়তানী ফৌজ যখন তাদের কাজ সেরে ফিরে আসে, তখন তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ সরদারের সামনে উপস্থিত হয়ে উক্ত দিনের রিপোর্ট পেশ করে ও আমি এ করেছি, আমি সেই করেছি, আমি এত বড় ফিতনা সৃষ্টি করে দিয়েছি ইত্যাদি। এক পর্যায়ে এক শয়তান সামনে অগ্রসর হয়ে স্বীয় সরদারের সামনে দাঁড়িয়ে তার বিবরণ পেশ করে :আমি আমার কাজ অতি দ্রুত সম্পন্ন করেছি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক না ঘটিয়ে বিশ্রাম নেইনি।
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ইবলীস সরদার এই রিপোর্ট শ্রবণ করে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সাবাস দিয়ে বলে, আজ তুমি বেশ করেছ, তুমিই বাজিমাত করেছ!–মিশকাত, অনুচ্ছেদ : শয়তানী ওয়াসওয়াসা,
প্রখ্যাত মুফাসসির মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন : স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায় শয়তানের অধিকতর খুশী হওয়ার কারণ হল, শয়তান যেনার আধিক্য পছন্দ করে। সে চায় জারজ সন্তানের বিস্তার ঘটুক। যমীনের বুকে ফেৎনা-ফাসাদ বৃদ্ধি হোক।–মিরকাত
.
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট করার তিরস্কার
কোনো জ্ঞানী লোকের পক্ষে এ কথা অজানা নয় যে, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিবাদ-বিচ্ছেদের ফলে অপকারিতার সৃষ্টি হয়। তাই যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট করার অপচিন্তা ও চেষ্টায় লিপ্ত থাকে এবং স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রতি ও স্বামীর মধ্যে স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্ধেষ জন্মাতে সচেষ্ট হয়, তার নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নেই। সে মানুষ নয়, মানবতার শত্রু। মানুষরূপ শয়তান এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন :
ليس منا من خبب المرأة على زوجها .
যে ব্যক্তি কোনো নারীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে প্ররোচনা বা উস্কিয়ে দেয়, সে আমাদরে দলভুক্ত নয়।–আবূ দাউদ, মিশকাত
যে দীন ভাঙ্গাকে গড়ার জন্য এবং বিশৃংখল মানুষকে সুশৃংখলাবদ্ধ করতে এসেছে, সেই পবিত্র দ্বীনের অনুসারী যদি মানুষের মধ্যে বিভেদ বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টা পায়, তবে তার মানে তার মধ্যে স্বীয় দ্বীনের কোন ধরনের সদাচার প্রবেশ করেনি।
বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করা, যার ফলে একটি নির্মিত গৃহ ভেঙ্গে যায়, যৌন পবিত্রতা বিপন্ন হয়, আমল-আখলাক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়–কোন মুসলমানের পক্ষে এমন কাজ শোভনীয় নয়।
.
ইসলামে বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুমতি
বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্য ছিল, নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে যৌন পবিত্র জীবন নির্বাহ করবে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বন্ধন অটুট ও স্থায়ী রাখবে। কিন্তু কখনো মানব জীবনের এমন ঘটনার সৃষ্টি হয়, যেখানে এই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করাই কল্যাণজনক হয়ে পড়ে। পূর্বে বিবাহ বন্ধনের আলোচনায় ইঙ্গিত করে এসেছি যে, বিবাহ করার পূর্বে পাত্র-পাত্রীর মধ্যে প্রত্যেকে অপরের অবস্থা জেনে নেবে। যথাসম্ভব দেখে নেবে। তারপর বর ও কনের উভয় পক্ষ যখন সব দিক দিয়ে সন্তুষ্ট হবে, তখন বিবাহ-সম্পর্ক স্থাপন করবে। যাতে করে এ বন্ধন অধিকতর দৃঢ় ও মযবুত প্রমাণিত হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি অটুট থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কখনো কখনো এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়, যার ফলে বিবাহের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না। (বরং বিপরীত হয়) এ সমস্যা-সংকটের ক্ষেত্রে ইসলাম এমন কিছু ভারসাম্যপূর্ণ বিধি-বিধান প্রবর্তন করেছে, যা অনুসরণ করলে যৌন পবিত্রতার ওপর যে বিপদের কালোমেঘমালা জমতে শুরু হয়, তা দূরে সরে যায়। স্বামী-স্ত্রী শান্তির জীবন-নির্বাহের পথ খুজে পায়।
.
হঠাৎ দুর্ঘটনা
স্বাভাবিক মনে হয় দাম্পত্য জীবনের বাগডোর স্বামীরই হাতে। আর স্ত্রী হচ্ছে একেবারে লাচার ও নিরুপায়। কিন্তু আসলে তা নয়। নারীর জন্য কাযীর দরবার ইখতিয়ারপূর্ণ। স্ত্রী যদি কোন আকষ্মিক দুর্ঘটনায় পতিত হয়, কিংবা স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তবে কাযী তার স্বামীর কবল থেকে তাকে উদ্ধার এবং দুর্ঘটনার মিটমাট করতে পারেন।
.
স্বামীর পুরুষত্বহীনতা
দাম্পত্য জীবনে এমন ঘটনাও ঘটে যে, কখনো কখনো স্বামী স্ত্রী যৌন চাহিদা মিটাতে সক্ষম হয় না। স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা স্বামী পূরণ করতে পারে না। এমতাবস্থায় কোন নারী যদি তার অক্ষম স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় আর স্বামী তাতে রাযী না হয়, তবে ইসলাম তার জন্য আদালতকে ইখতিয়ার দান করেছে। স্ত্রী আদালতে তার মুকাদ্দমা পেশ করবে। বিচারক তার স্বামীকে নোটিশ দিয়ে ঘটনা তদন্ত করবেন। স্বামী পুরুষত্বহীনতা প্রমাণিত হলে, তবে বিচারক তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথম এক বছর সময় দেবেন। উক্ত সময়ের মধ্যে যদি তার পুরুষত্ব ফিরে আসে অর্থাৎ স্ত্রীর যৌন চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়, তবে তো ভাল। নতুবা বিচারক তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ করে দেবেন। সাহাবী হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (রাঃ) এর বর্ণনা :
من تزوج امرأة فلم يستطع أن يمسها فانه يضرب اجل سنة فان
مشها وإلا فرق بينهما ۔
কোনো ব্যক্তি বিবাহ করল অথচ স্ত্রী-সহবাস করতে সক্ষম হল না, তাকে এক বছর সময় দেয়া হবে। এরপর যদি সে সহবাসে সক্ষম হয়, তবে ভাল। নতুবা উভয়ের মধ্যে আলাদা করে দেয়া হবে।–মুয়াত্তা ইমাম মালিক
ইমাম মালিক (র.) ইবনে শিহাব (র.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, নপুংসক স্বামীকে চিকিৎসার জন্য যে এক বছরের সময় দেয়া হবে, তা কখন থেকে? বাসর রাত থেকে, না বিচারকের কাছে মামলা দায়েরের সময় থেকে? ইবন শিহাব (র.) বলেন,
بل من يوم ترافعه إلى الشلطان–
সরকারের কাছে মামলা দায়েরের দিন থেকে।–মুয়াত্তা
যা হোক, এ ভাবে নারী তার নপুংসক স্বামী থেকে পৃথক হতে পারে এবং শরীয়ত অনুযায়ী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারে।
.
স্বামীর লিঙ্গকাটা হাওয়া
তেমনিভাবে কোনো নারীর স্বামীর জননেন্দ্রিয় কেটে যায় এবং সে তার স্ত্রীর যৌন চাহিদা মিটাতে অক্ষম তবে স্ত্রী তার এরূপ স্বামী থেকে উপরোক্ত পদ্ধতির সাহায্যে সহজেই পৃথক হয়ে যেতে পারে। বরঞ্চ এ ক্ষেত্রে এতোটুকু সুবিধা আছে যে, তাকে এক বছরের সময় ক্ষেপন করতেও হবে না। অভিযোগ পেয়েই বিচারক ঘটনা তদন্ত করবেন এবং অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে তৎক্ষণাৎ নারীকে তার স্বামী থেকে পৃথক করে দেবেন। কুদূরী গ্রন্থের লেখক নপুংসক প্রভৃতির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন :
فإن كان عنينا اجله الحاكم حولا فان وصل إليها والا فرق بينهما إن ليت المراة ذلك ….. وان كان مجبوبا فرق القاضي بينهما في الحال
কোনো নারীর স্বামী যদি নপুংসক হয়, তবে বিচারক তাকে চিকিৎসার জন্য এক বছরের সময় দেবেন। যদি সে নারীর যৌন চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়, তবে ভালো, অন্যথায় নারী চাইলে উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দেবে। আর যদি স্বামী লিঙ্গকাটা হয়, তবে বিচারক তাকে সময় না দিয়ে তৎক্ষণাৎ পৃথক করে দেবেন।–কুদুরী।
.
অন্ডকোষ কর্তনকারী স্বামীর সমাচার
অন্ডকোষ কর্তনকারী স্বামীর অবস্থাও নপুংসক স্বামীর ন্যায়। অর্থাৎ পুরুষ তার অন্ডকোষ কর্তন করে খাসী হওয়ার দরুন যদি যৌন তাগিদ অনুভব না করে এবং স্ত্রী চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়, তবে স্ত্রী বিচারকের কাছে অভিযোগ পেশ করবে। বিচারক তৎক্ষণাৎ ঘটনা তদন্ত করবেন এবং চিকিৎসার জন্য এক বছরের সময় দেবেন। এরপরও যদি সে সক্ষম না হয়, তবে বিচারক নারীকে ওই পুরুষ থেকে পৃথক করে দেবেন।
والخصی يوجل كما يوجل العنين—
অন্ডকোষ কর্তনকারী স্বামীকে নপুংসক স্বামীর মতই এক বছর সময় দিতে হবে।–কুদুরী
যেসব সমস্যার দরুন নারীর যৌন পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে, ইসলাম তার সবগুলো সমস্যারই সমাধান করে দিয়েছে। নারী নিরুপায় হয়ে পাপকর্মে লিপ্ত হতে পা বাড়াবে, এমন কোনো পথই সে খোলা রাখেনি।
.
আল্লামা হাফিয ইবনুল কায়্যিম (রঃ) এর রায়
আল্লামা হাফিয ইবনুল কায়্যিম (রঃ) এ আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেন :
و عيب ينفر الزوج الاخر ولا يحصل به مقصود
والقياس ان
النيكاح من الرحمة والمؤثر يوجب الخيار–
যুক্তির দাবী হচ্ছে, যেসব ত্রুটির কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্প্রীতি অব্যাহত থাকে না এবং বিবাহের লক্ষ্য যে প্রেম-ভালোবাসা, তা তিরোহিত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বজায় হওয়ার ইখতিয়ার দান জরুরী হয়ে পড়ে।–যাদুল মা’আদ।
কিছু কিছু ছোটখাটো বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এ এক সর্বসম্মত সত্য যে, পুরুষ ও নারীর মধ্য থেকে কেউ নিজকে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে বাধ্য ভাববে, এমন কোন অবস্থার আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি ইসলাম।
.
খুলা তালাক ব্যবস্থা
এমন নাযুক মুহূর্তের জন্য ইসলাম ঝগড়া-বিবাদের শেষ পর্যায়ে গিয়ে খুলা তালাকের অনুমতি প্রদান করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সে আগেভাগেই অবৈধ ফায়দা হাসিলকারীদের কঠোরভাবে খুলা হাসিল করতে নিষেধ করে দিয়েছে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ
ايما امرأة سألت زوجها طلاقا في غيرما باس فحرام عليه رائحة
যে স্ত্রী দুঃখ কষ্ট ব্যতীত স্বীয় স্বামীর কাছে তালাক প্রার্থনা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ ও বর্ণনা করেন।–মিশকাত
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
المنتزعات والمختلعاتهن المنافقات–
যে সব স্ত্রীরা অহেতুক স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং খুলা প্রার্থনা করে, তারা মুনাফিক।–মিশকাত
আলোচ্য হাদীসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্ত্রীরা অনর্থক স্বীয় স্বামীদের নিকট থেকে পৃথক হওয়ার বাসনা করবে না। স্বাদ গ্রহণের জন্য এরূপ কাজ করা ইসলামের এক মহান বিধানকে ছেলেখেলায় পরিণত করার অন্তর্ভুক্ত।
বলা বাহুল্য নারী যদি বাস্তবিকই ইসলামের বিধানের মর্মাবাণী অনুভব করে যে, খুলা ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে আল্লাহ রব্বুল ইযযতের সীমারেখা রক্ষিত হবে না এবং তার প্রবল বিশ্বাস যে, তাদের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর, তবে এরূপ নাযুক অবস্থায় সে ইসলামের খুলা তালাকের ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে পারে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন :
فإن خفتم الآيقيما حدود الله قد جناح عليهم فيما افتدت به .
স্বামী-স্ত্রী যদি আশংকা করেন যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না, তবে স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে নিষ্কৃতি পেতে চাইলে তাতে তাদের কারো কোন দোষ নেই। -সূরা আল বাকারা : ২৯
.
রাসূল (ছঃ) যুগে খুলা ব্যবস্থা
যদিও আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা রক্ষিত না হওয়ার শর্তসাপেক্ষে ইসলাম খুলা তালাকের অনুমতি প্রদান করেছে তার পূর্বে আদৌ অনুমতি নেই–তথাপি খুলা তালাকের দৃষ্টান্ত রাসূল (সা.)-এর যুগেও পরিদৃষ্ট হয়। হাদীসের কিতাবসমূহে এ ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত রয়েছে।
হযরত হাবীবা বিনতে সাহাল আনসারী (রাঃ) হযরত ছাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস (রাঃ) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এক ঊষালগ্নে নবী করীম (ছঃ) ফজরের নামাযের জন্য হুজরা থেকে বের হয়েছেন। দরযায় পৌঁছতেই তিনি লক্ষ্য করলেন, এক মহিলা জড়সড় হয়ে কাপড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো রাতের অন্ধকার দূর হয়নি। নবী (ছঃ) বললেন : আপনি কে? জবাব এল : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি সাহালের কন্যা হাবীবা। নবী (ছঃ) বললেন : কি অভিপ্রায়? হযরত হাবীবা (রাঃ) বললেন : আমিও ছাবিত ইবনে কায়েসের সাথে নই এবং ছাবিতও আমার সাথে নয়। অর্থাৎ আমাদের দুই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঐক্য ও বনিবনার কোন সম্ভাবনা নেই। নবী করীম (ছঃ) এ ঘটনা শুনে নামায পড়তে গেলেন। হযরত ছাবিত ইবনে কায়েস (রাঃ) যখন নবীর দরবারে হাযির হন, তখন নবী (ছঃ) বললেন : এ হচ্ছে হাবীবা বিনতে সাহাল আনসারী! আল্লাহ তা’আলার যা অভিপ্রায় ছিলো, সে এখানে এসে তাই বর্ণনা করেছে। হযরত হাবীবা বিনতে সাহল (রাঃ) মোহর ফেরতদানেরও আগ্রহ জ্ঞাপন করলেন এবং স্বামীর দেয়া মোহরানা সেখানে উপস্থিত করলেন। রাসূলে কারীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাবিত (রাঃ)-কে বললেন, তুমি তোমার দেয়া মোহরানা ফেরৎ নাও। একথা শুনে হযরত ছাবিত (রাঃ) তার মোহরানা ফেরৎ নিলেন। এ ভাবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ সংঘটিত হল।–মুয়াত্তা ইমাম মালিক
বুখারীতে উল্লেখ আছে, হযরত ছাবিত (রাঃ)-এর স্ত্রী রাসূলের (ছঃ) দরবারে এসে হাযির হয়ে বললেন :
یارسول الله ثابت بن قيس ما أعيب عليه في خلق ولا ديني ولكني
اكره الكفر في الإسلام–
হে আল্লাহর রাসূল। আমি ছাবিত ইবন কায়েসের আখলাক-চরিত্র ও দ্বীনদারী সম্পর্কে দোষারোপ করছি না, কিন্তু কথা হচ্ছে, আমি ইসলামের মধ্যে কুফরকে পসন্দ করি না। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি তার বাগান ফেরৎ দিতে প্রস্তুত? ছাবিতের স্ত্রী হা-সূচক উত্তর দিলেন। এরপর তিনি (ছঃ) হযরত ছাবিতকে বললেন:
اقبلي الحديقة وطلقها تطليقة واحدة—
তোমার বাগান নিয়ে নাও এবং তাকে এক তালাক দাও।–যাদুল মাআদ
ইমাম বুখারী (রঃ) যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন, এ ঘটনা হযরত ছাবিতের কী হলেও হাবীবার নয়। বরং এ ঘটনা ছাবিতের দ্বিতীয় স্ত্রী জামীলা বিনতে আবী সালুলের। ইবনে মাজায় এই ঘটনাই জামীলার নাম সহকারে উল্লিখিত হয়েছে।–ইবনে মাজা
প্রকাশ থাকে যে, হযরত ছাবিত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস (রা.) কালো, কুশ্রী খর্বকায়, ও বদমেযাজী ছিলেন। এজন্য কোন নারীর দৃষ্টিতে তিনি পছন্দনীয় ছিলেন না। কোন কোন রিওয়ায়তে তাঁর সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী কঠোর মন্তব্যও রয়েছে।–যাদুল মাআদ
.
পর্দার হুকুম
এখানে বলা আবশ্যক যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে পর্দার হুকুম নাযিল হয়নি। বরং হিজরী পঞ্চম বছরে এই হুকুম নাযিল হয়। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর আন্তরিক বাসনা ছিলো পর্দার হুকুম নাযিল হোক। বিভিন্ন সময়ে তিনি তাঁর এই আন্তরিক বাসনা প্রকাশ করেন। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর যে সব আন্তরিক বাসনা আল্লাহ রব্বুল আলামীন কবুলের মর্যাদা দান করেন, তন্মধ্যে পর্দার বিধান অন্যতম।
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকট আরজ করলামঃ
یا رسول الله إن نساءك يدخل عليه البر و الفاجر فلو جبتهن
فانول الله تعالى أية الحجاب–
হে আল্লাহর রাসূল। আপনার পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণের কাছে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণীর লোকেরা যাতায়াত করছে। আপনি যদি তাঁদের পর্দার ব্যবস্থা করতেন। এরপর মহান আল্লাহ তা’আলা পর্দা সম্পর্কিত এ আয়াত নাযিল করেন এবং তাঁর ওই আবেদনের পরই এ আয়াত নাযিল হয়ঃ
به رم ۸ر رم ۸—
ش له
و و ه,
/۸ و و آمنوا لا تدخلوا بيوت النو
হে ঈমানদারগণ। তোমরা অনুমতি ছাড়া নবী-গৃহে প্রবেশ করো না। -সূরা আল আহযাব : ৫৩
.
পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে
এ ঘটনাটি ঘটে হযরত যয়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ)-এর বিবাহ উপলক্ষে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যখন তার বিবাহ হয়, তখন লোকজনকে ওলিমার দাওয়াত দেয়া হয়। আহার শেষে সবার চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তিন ব্যক্তি আলাপে রত অবস্থায় থেকে গেলে। তাতে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্তি বোধ করলেও লজ্জার খাতিরে তাদের কিছু বলতে পারলেন না। ইত্যবসরে আল্লাহ তা’আলা পর্দা সম্পর্কিত হুকুম নাযিল করলেন। নারীর যুক্তিসঙ্গত ও পবিত্রতম পথ খোলা রেখেছে। এরশাদ হয়েছে :
و ۸
هم ه م ۸
وإذا سالتموهن متاعا فاسئلوهن من وراء حجاب ذلكم اطهر
إقلوبکم وقلوبهن.
তোমরা তাঁর পত্নীদের কাছে থেকে কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল হতে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র।–সূরা আল আহযাব : ৫৩
উল্লিখিত আয়াতগুলো শানে নুযুলের ক্ষেত্রে বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হলেও তাৎপর্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক। প্রতিটি মুসলমানের জন্যই এই নির্দেশ। নারীদের নিকট থেকে কিছু নিতে হলে পর্দার সাথে নেবে। সরাসরি সামনা-সামনি হবে না। তাতে নিজেরাও বেঁচে থাকতে পারবে এবং অন্যদেরও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে না।
.
অবাধ মেলামেশা সমাজ অনিষ্টকারক
এতে সন্দেহ নেই নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার দরুন মানব-প্রবৃত্তি প্ররোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। অন্যদের ভুল বুঝাবুঝির মধ্যে নিক্ষেপ করার মোক্ষম উপায় শয়তানের হস্তগত হয়। আমরা একথা বলি না যে, নারীদের ওপর আমাদের আস্থা নেই এবং পুরুষদেরকে আমরা প্ররোচনা দানকারী মনে করি। বরং আমরা নারী ও পুরুষ উভয়কেই আস্থাবান ও বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান করি। কিন্তু সাথে সাথে আমরা এ কথাও বলছি যে, আল্লাহ মানব-প্রক্বতিতে কামভাব নিহিত রেখেছেন। তাতে পুরুষ-নারীর কোন ভেদাভেদ নেই। ইতিহাসের আলোকে আমরা জানি, দুশ্চরিত্র লোকেরা সচ্চরিত্র নারী ও পুরুষদের অপবাদ দিয়েছে এবং অদ্ভূত ফিত্না-ফাসাদ সম্পর্কেও আমরা অবগত আছি। তাই যুক্তির আলোকেও এমন কিছু উপায় অবলম্বন করা একান্ত জরুরী যাতে ওই অশ্লীলতা ও ফিত্না-ফাসাদের সকল উৎসমূল বন্ধ হয়ে যায়।
ইউরোপের চারিত্রিক (অশ্লীলতার) ইতিহাস নর-নারীর পারস্পরিক মেলামেশার যে ফলাফল আমাদের সামনে পেশ করেছে এবং খোদ আমাদের দেশের কলেজ-ইউনির্ভাসিটির পর্দাবিহীন সহশিক্ষা ব্যবস্থা যে অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে, তাকে সামনে রাখলে যৌক্তিকভাবেও ইসলামের পর্দা প্রথা যে রহমত স্বরূপ বিবেচিত হবে।
.
যৌন পবিত্রতা ধ্বংসে সহশিক্ষার প্রভাব
একজন ভদ্র নারী নিম্নরূপ ভাষায় তাঁর অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন :সহশিক্ষায় শিক্ষিতা মেয়েদের নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে আমার বক্তব্য হচ্ছে, সহশিক্ষার প্রভাবে তাদের স্বাভাবিক শালীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে অধিকতর পুরুষালী ভাব সৃষ্টি হয়ে অধিকতর খারাপ করে দেয়। ফলে তারা সংসার জীবনের হাল সামলানোর উপযুক্ত থাকে না। বর্তমান বিদ্যালয়সমূহের পশ্চিমা সহশিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের মেয়েদের জন্য অনর্থক ও অবশ্যক নয়।–যমযম, লাহোর
যে সমস্ত দেশে সহশিক্ষা প্রচলিত, তাদের ঘটনা প্রত্যক্ষ করুন। আমেরিকা সম্পর্কে সেখানকার জর্জ লিন্ডসের বর্ণনা :
হাইস্কুলের অল্পবয়স্ক চার শ’ পঁচানব্বই জন মেয়ে স্বয়ং আমার কাছে স্বীকার করেছে যে, তারা তাদের ছেলে বন্ধুদের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। –মওলানা মওদুদীকৃত পর্দা
জর্জ লিন্ডসে আরো বলেন: হাইস্কুলের কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ মেয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করার পূর্বেই নষ্ট হয়ে যায়।-পর্দা
জনৈক পশ্চিমী মহিলা মিসেস ডোন র্থীহাল তাঁরনারীদের শিক্ষা সংকট শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেন :
পরিশেষে লক্ষ্যণীয় যে, সহশিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যতই বাগাড়ম্বর করা হোক না কোন, যুব শ্ৰেণীর যৌনানুভূতির সূচনা থেকে যে আবেগী সংকট সৃষ্টি হয়, এবং কোন কোন ছাত্রের লেখা-পড়ায় সহশিক্ষা বাস্তব অন্তরায় সৃষ্টি করে, তা দূরীভূত হয় না। এ সংকট চৌদ্দ থেকে আঠারো বছরের মধ্যবর্তী সময়ে সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। প্রতিদিন মেলামেশার ফলশ্রুতি স্বরূপ শুধু তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই যৌন সম্পর্কের সৃষ্টি হয় না, অধিকন্তু লেখা-পড়া ও জীবন যাত্রার পক্ষে আরো ধ্বংসাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, কখনো কখনো ছাত্রী ও শিক্ষকদের মধ্যেও যৌন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে পড়ে।–নিদা-ই-হেরম
উপরে যে-সব উদ্ধৃতি পেশ করা হল, তা মোল্লা মাওলবীদের ভাষ্য নয়, সবই আধুনিক কলেজ ভার্সিটিতে শিক্ষিত ব্যক্তিদের বর্ণনা। আর তাও তাদের অভিজ্ঞতাসম্পূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিত শ্রেণীরই যখন এ লজ্জাজনক অবস্থা তখন সাধারণ মানুষ সম্পর্কে আপনি কি ভাবতে পারেন?
ইসলামী শিক্ষা বড় দূরদর্শিতামূলক ও মানব-মনস্তত্ত্বের সম্পূর্ণ রূপ। তাই ইসলামী শিক্ষা প্রচার-প্রসার এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার বাস্তবায়নই হচ্ছে যৌন পবিত্রতা রক্ষার একমাত্র উপায় ও উপকরণ।
.
পূতচরিত্রা নারীদের স্বাতন্ত্র্য জরুরী
বিভিন্ন প্রকারের লোক সব যুগেই দেখা যায়–একথা কোন জ্ঞানী লোকই অস্বীকার করতে পারেন না। যেখানে ভাল লোকের বসতি, যেখানে কিছু মন্দ লোকও বাস করে। তারা সব সময় সুযোগ খোঁজে বেড়ায় এবং তাদের দৃষ্টি থাকে বেপরোয়া। নারী-পুরুষ উভয়ই এ দলের অন্তরভুক্ত। কিন্তু এ ধরনের লোককে তাদের চাল-চলন ও জীবনযাত্রার মান দেখেই বেশ চেনা যায়। দুশ্চরিত্র লোকেরা যে-সব নারীদেরকে কোন বিশেষ সাজ-সজ্জা দেখে অন্য ধরনের মনে করে, তাদেরকে অহেতুক উত্ত্যক্ত করার প্রয়াস পায়। তাই যখন ইসলাম শুভাগমন করল এবং
এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হতে লাগল, তখন আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করলেন?
النبي قل لأزواجك وبناتك ونساء المؤمنين يدنين
عليه من جيبه لك أدنى أن يعرفن فيؤذين وكان الله فورا
হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মু’মিনদের নারীদেরকে বল, তারা যেনো তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের মুখাবয়বের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অসীম ক্ষমাশীল, অতিব দয়ালু। -সূরা আল-আহযাব : ৫৯
উক্ত আয়াতের নির্দেশ হল, সচ্চরিত্রা ও মু’মিন স্ত্রীলোকের যথারীতি চাদর ব্যবহার করবে, যাতে করে স্পষ্টরূপে চেনা যায় যে, এঁরা দ্ৰ শ্ৰেণীর মহিলা। ব্যভিচারিণী ও দুশ্চরিত্রা নয়। চরিত্রহীন ও লম্পট লোকেরা যাতে তাদের চিনতে পেরে কোনোরূপ উত্ত্যক্ত করার দুঃসাহস না করে।
যেসব নারী বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করে কিংবা বিশেষ ধরনের সাজ-গোজ করে বাইরে বের হয়, স্বীয় রূপ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে বেড়ায়, তাদের সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন শ্রেণীর মানুষই ভাল ধারণা পোষণ করে না। বরং চরিত্রহীন লোকেরা সুযোগ পেলেই তাদের সাথে অশ্লীল প্রেম নিবেদনের চেষ্টা চালায়। পক্ষান্তরে যেসব মহিলা ইযযত-সম্ভ্রম মেনে চলে সতী-সাধ্বী ও দীনদার হয়, তাদের চাল-চলন ও আচার-আচরণেই তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। অহেতুক কেউ তাদের প্রতি খারাপ দৃষ্টিতে তাকায় না। প্রখ্যাত মুফাঁসির মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
অর্থাৎ শরীর ঢেকে রাখার সাথে সাথে চাদরের কিয়দংশ মাথার নিচে মুখাবয়বের ওপর ঝুলিয়ে দেবে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর মুসলিম রমণীগণ শরীর ও চেহারা ঢেকে এমনভাবে বের হতেন, যাতে একটি মাত্র চোখ পথ দেখার জন্য ভোলা থাকত। এতে প্রমাণিত হয় যে, ফেৎনার সময় স্বাধীন নারীদেরও চেহারাও ঢেকে রাখা উচিত।
.
স্বয়ং নবীযুগে স্বতন্ত্র পোশাক পরার নির্দেশ
স্বয়ং নবীযুগেও কিছু লম্পটই ইয়াহুদী ও মুনাফিক শ্রেণীর লোক নারীদেরকে উত্ত্যক্ত করত এবং দুশ্চরিত্রা নারীদের সাথে কোনো কোনো সচ্চরিত্র ভদ্র নারীরাও তাদের দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পেতেন না। তাই দোপাট্টা ও চাদর বাড়িয়ে তিনি পোশাকে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেন। এই স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করার পর খোদ আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন।
لن لم ينته المنافقون و الذين في قلوبهم مرض والمرجفون في
الميريئة لفريك بهم ثم لا يجاورون فيها إلا قلي.
মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা নগরে গুজব রটনা করে, তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করব। অতঃপর তারা এই নগরীতে তোমার প্রতিবেশীরূপে অল্পদিনই থাকতে পারবে।–সূরা আল আহযাব : ৬০
এ স্বতন্ত্র মর্যাদার পরও যদি কোনো দুবৃত্ত লম্পট কোনো সতী সাধ্বী নারীকে উত্ত্যক্ত করে, তবে তাকে ক্ষমা করা হবে না। আর নবীযুগে এমনটিই হয়েছে ইয়াহুদীরা দেশান্তরিত হয়েছে।
প্রথমত কুরআনের দাবী হচ্ছে, নারী নিষ্প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হবে না। যেমন, নারী সম্পর্কিত কোরআনের প্রথমত আয়াত–(< 1 313)তোমরা তোমাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে–এ ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। এবং এ সম্পর্কে কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশই বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন :
إن المرأة عورة فإذا أخرجت استشرفها الشيطان واقرب ما
تكون بروح ربها وهي في قعر بيتها۔
নারী গুপ্তাঙ্গসদৃশ। নারী যখন রাস্তায় বের হয়, তখন শয়তান তার প্রতি উঁকি উঁকি মারে। গৃহে অবস্থান করাই নারীর পক্ষে নিরাপদ।–ইবনে কাছীর।
.
বাহিরে বের হবার শরীয়তী নিয়ম
কুরআনের দ্বিতীয়ত নির্দেশ হলো, প্রয়োজনবশত যদি নারীকে ঘরের বের হতেই হয়, তবে সে দৃষ্টি সংযত রাখবে। কামভাবের স্থানসমূহ থেকে আত্মরক্ষা করে চলবে। যেমন, নর-নারীর যৌথ ক্লাব, সোসাইটি, মেলা, সিনেমা, পার্ক, থিয়েটার প্রভৃতি স্থান থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকবে।
قل للمؤمنات يغضضن من أبصاره الخ۔
মু’মিন নারীদেরকে বলো, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে আয়াতে তার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর বাইরে বের হলে শরীর ঢেকে বের হবে। স্বাধীন নারীর সর্বাঙ্গই সতর, হাতের তালু ও মুখাবয়ব ব্যতীত।
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন
يبدين زينتهن إلا ما ظهر منها–
সাধারণত যা প্রকাশ থাকে, তা ছাড়া তারা যেনো তাদের আবরণ প্রকাশ না করে –আল কুরআন
তৃতীয় নির্দেশ হল বাইরে বের হলে কিংবা কারো সামনে এলে ভালভাবে চাদর মুড়ি দিয়ে আসবে। শরীরের শোভা-সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। যেমন একটু আগেই ১১ 4.তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের মুখাবয়বের ওপর টেনে দেয়। কুরআন পাক অন্যত্র ঘোষণা করেছে।
وليضربن بخمرهن على جيوبهن .
তাদের গ্রীবা ও সিনা যেন মাথার ওড়না দ্বারা আবৃত করে।-সূরা আল নূর : ৩১
.
ওড়না পরার পদ্ধতি
খিমার বলা হয় এমন চাদরকে, যা মহিলারা মাথায় পরিধান করেন। সালফে-সালিহীন বলেন, ওড়না পরার নিয়ম হচ্ছে, মাথার ওপর থেকে বুকের ওপর এমন ভাবে টেনে দেবে, যাতে করে দেহের ফুটে ওঠা এবং সৌন্দর্যস্থলগুলোর কোন অংশ কারো দৃষ্টিগোচর না হয়। ওড়নার আচল পিঠের দিকে ফেলে দিলে বুকের প্রস্ফুটিত অংশ গোপন থাকে না, বরং তাতে আরো সৌন্দর্য প্রদর্শন হয়। বর্বর জাহেলি যুগে এমনটিই প্রচলিত ছিলো এবং ইসলাম এটিকেই চিরতরে মিটাতে এসেছিল। তাই এখানে নির্দেশ হচ্ছে, কামীসের ওপর ওড়না এমনভাবে পরতে হবে, যাতে বুকও সৌন্দর্যস্থানগুলো পুরাপুরি ঢেকে যায়।
সর্ব যুগের কবি-সাহিত্যকদের কাছে যৌবনের প্রস্ফুটন যে স্থান দখল করে আছে, তা কারো অজানা নয়। এমনিতেই কবি-সাহিত্যিকদের সজীব করা অনুভূতি অনেক সময় মানুষকে এই প্রস্ফুটনের প্রতি প্রলুব্ধ করে তোলে। তাই এ যুগে তার পূর্ণ পর্দা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন :
يرحم الله نساء المهاجرات الأولي ما أنزل الله (وليضربن الخ)
شققن مروطهن فاختمون بها—
প্রথম হিজরতকারী নারীদের ওপর আল্লাহ রহম করুন। যখন পর্দার আয়াত নাযিল হল তখন তারা স্বীয় চাদর ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওড়না বানিয়ে নিল।
.
দৃষ্টি আকর্ষণ ও সৌন্দর্য প্রকাশ নিষেধ
কোরআনের চতুর্থ নির্দেশ হল, ঘরের বাইরে বেরুলে এমন কোন আচরণ করবে না, যাতে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে কিংবা অন্যের দৃষ্টি তার ওপর আক্বষ্ট হয়, চাই তা প্রত্যক্ষ ভাবে, অথবা পরোক্ষভাবে। বরং সব রকম ভিতর ও বাইর পবিত্র থাকবে। ভিতরে পবিত্রতা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার ইরশাদ হচ্ছে?
يعلم خائنة الأعين وما تخفي الصدور
তিনি (আল্লাহ) চক্ষুর অপব্যবহার ও অন্তরে যা গোপন আছে, সে সম্বন্ধে অবহিত। -সূরা মু’মিন : ১৯
এবং বাইরের পবিত্রতা সম্পর্কে বলেছেনঃ
يعلم ما يخفين من زينتهن وتوبوا إلى اللو
ولا يضربن بارجيه جميعا اليه المؤمنون لعلكم تفلحون—
নারীরা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য্য বা আবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে মাটিতে সজোরে পদচারণা না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।–সূরা আন নূর : ৩১
সাধারণত নারীরা পায়ে বিভিন্ন রকম অলঙ্কারাদি পরিধান করে থাকে। কোন কোন অলঙ্কার এমনভাবে তৈরী করা হয় যে, তা পরিধান করে চলার সময় অনেক শব্দের সৃষ্টি হয়। যেমন নুপুর। এ ধরনের অলঙ্কার পরিধান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শরীয়তে এর অনুমতি নেই। আবার কোন কোন অলঙ্কার নিজে শব্দ না করলেও অন্য অলঙ্কারের সাথে ঢোকর লেগে শব্দ করে। যেমন ছড়া, কড়া, স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরী পায়ের দুটি অলঙ্কার নুপুর বিশেষ। এ ধরনের অলঙ্কার পরিধান করা জায়েয হলেও সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে, যাতে একটি অপরটির সাথে টক্কর লেগে শব্দের সৃষ্টি না করে। তাছাড়া, সেগুলো পরিধান করে হাঁটা-চলার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তাদের চাকচিক্য যেন অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, কেননা শব্দ হোক কিংবা চাকচিক্য, অনেক সময় এটাও ফেত্রায় পরিণত হয়।
এ সব আলোচনা থেকে একথাও সহজেই বুঝা যায় যে, যখন অলঙ্কারাদি পরতে এতসব সতর্কতার কথা বলা হয়েছে এবং তার আওয়ায সম্পর্কে সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তখন যে অঙ্গসমূহে এই সব অলঙ্কারাদি পরিধান করা হয়, সে অঙ্গগুলো তো আরো বেশী করে সতর্কতা অবলম্বন বা লুকানো দরকার। আর এ কারণেই ইসলামী শরীয়তে এই সব অঙ্গ আবৃত করার অধিক তাকীদ রয়েছে। অতএব বুঝা গেল, অলঙ্কার ও তার অঙ্গসমূহ সবগুলোরই ঢেকে রাখা কতই জরুরী।
তারা যেন সজোরে পদক্ষেপ না করে আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বায়যাবী (রহঃ) বলেন, এটা নিষেধ করার কারণ হচ্ছে, এই আওয়ায় পুরুষের অন্তরের মধ্যে নারীর আকাংখা সৃষ্টি করে। তিনি আরো বলেন, এ বর্ণনা সৌন্দর্য প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা বা উচ্চ আওয়াজ থেকে বারণ করা অপেক্ষা অধিক অলঙ্কারপূর্ণ।
বিশ্বখ্যাত তাফসীর তাফসীরে কাবীরে উল্লেখ আছে, মানব প্রক্বতি হল, নারীর চরণালঙ্কার ধ্বনি শ্রবণ মাত্রই পুরুষের যৌন আকাঙ্খায় ঢেউ খেলা আরম্ভ হয় এবং নারী সানিদ্ধের কামনা বাসনা প্রবল হয়।
মিশকাত শরীফে উল্লেখ আছে, জনৈক মুক্তি প্রাপ্তা ক্রীতদাসী হযরত যুবায়র (রাঃ) এর কন্যাকে হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট নিয়ে গেলেন। উক্ত বালিকার পায়ে নুপুর পরা ছিল। হযরত উমর (রাঃ) সেটি কেটে ফেললেন, এবং বললেন, আমি রসূলুল্লাহ (ছঃ) কে বলতে শুনেছি, ১৮ ০১: 03 প্রত্যেক বাদ্যযন্ত্রে শয়তান আছে। –আবূ দাউদ।
একবার হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট এক মহিলা ঘুঙ্গুর পরে গমন করেছিল। তিনি তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ওসব খুলে এস। কেননা, রাসূলে আকরাম (ছঃ) বলেছেন :
لا تدخل المبيتا فيو جا۔
যে গৃহে বাদ্যযন্ত্র থাকে, সেখানে ফেরেশতা প্রবেশ করেন না।
.
সুগন্ধি দ্রব্য মেখে বাইরে বের হওয়া নিষেধ
উপরোক্ত আয়াতে যে সব কারণ বর্ণনা হয়েছে, তাতে বুঝা যায় যে, এমন কোন কাজ করা যাবে না, যা অন্যের কাছে নারীর গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিংবা তাকে নারীর প্রতি আক্বষ্ট করতে পারে। অতএব, খোশবু, আতর, সেন্ট জাতীয় সুগন্ধি দ্রব্য মেখে ঘরের বাইরে যাবে না। হাদীসে নারীর মসজিদে গমন বৈধ। কিন্তু সেখানেও যদিও সে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য আল্লাহর ঘরে হাযির হচ্ছে–খোশবু জাতীয় মেখে বের হওয়ার অনুমতি নেই। বরং কাপড়-চোপড়েও আঁকজমক করতে নিষেধ করা হয়েছে। সাধারণ কাপড় পরে মসজিদে আসতে বলেছে।
এতে অনুমতি হয়, প্রয়োজন বশত নারীকে বাইরে বেরুতে হলে এমনভাবে বেরুবে, যাতে সে অন্যের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় হয়ে না ওঠে। হাদীসে উল্লেখ আছেঃ
گل عين را به المرأة إذا اشتعطرت فمرت بالمجلس فهى كذا
وكذا يعنى اية
প্রত্যেক চোখ ব্যভিচারী। আর যে নারী সুগন্ধি লাগিয়ে অনুষ্ঠানাদিতে গমন করে, সেও ব্যভিচাররিণী।–ইবনে কাছীর
একদা এক মহিলার সাথে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তার শরীর থেকে সুগন্ধি বেরুচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন :মসজিদে থেকে এসেছো? মহিলা জওয়াব দিল, হ্যাঁ। সুগন্ধি মেখেছ? সে বললো, হ্যাঁ। বললেন : আমি আমার প্রিয় সরকার-ই-দো জাহান মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে নারী সুগন্ধি মেখে মসজিদে গমন করে, তার নামায আল্লাহ তা’আলা কবুল করেন না। অতএব, সে ফিরে গিয়ে স্বীয় কাপড়-চোপড় খুব ভাল করে ধৌত করল।–ইবনে কাসীর
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
ألترافية في الزينة في غير أهلها مثل ظلمت يوم
القيامة نور تها۔
মুহাররম ব্যতীত অন্য লোকের মধ্যে সাজ-সজ্জা করে গমন করা কিয়ামত দিবসের নিচ্ছিদ অন্ধকার সমতুল্য।–তিরমিযী
.
রাজপথ দিয়ে চলাচল করবে না
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথাও ইঙ্গিতে জানা গেল যে, ফিত্না থেকে মুক্তির জন্য পুরুষগামী রাজপথ দিয়ে নারীরা চলাচল করবে না, বরং জনপদের এক পাশ দিয়ে চলাচল করবে। তাদের যেখানে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানেও তাদের পিছনের সর্বশেষ সারিতে থাকতে বলা হয়েছে। হাদীসে উল্লেখ আছেঃ
خیر مقؤف التساء أرها وشها اولها.
নারীদের জন্য উত্তম সারি হচ্ছে পিছনের সারি। আর তাদের সামনের সারি হচ্ছে নিকৃষ্টতম।–মুসলিম
আর পুরুষদের জন্য আলোচ্য হাদীসেই বর্ণিত আছে, তাদের জন্য উত্তম সারি হচ্ছে প্রথম সারি, আর নিকৃষ্ট সারি হচ্ছে শেষ সারি। অনুরূপভাবে মসজিদ থেকে বাড়ী ফেরার সময় নারীদের আগে এবং পুরুষদের শেষে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর পুরুষদের সাথে একত্রে চললে রাস্তার পাশ দিয়ে যাবে। একবার এরকম হয়ে গেলে তিনি বললেন :
استارن فإنه ليس لك أن تخت الطريق عليكن با
فات الطريق—
রমনীরা পিছনে চলবে। নারীদের রাস্তার পাশ দিয়ে চলা আবশ্যক।।
এ আদেশের পর নারীরা সেই ভাবেই চলত। পথচলার সময় তাদের পরিধেয় প্রাচীরের গা ঘেঁষে যেত।
.
ইসলাম ধর্মে সতীত্বের মর্যাদা
পৃথিবীর সামান্যতম অভিজ্ঞতাও লাভ করেছেন, এমন কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে এইসব নীতি-আদর্শের তাৎপর্য অস্বীকার করা কিছুতেই সম্ভব নয়। যে জাতি ও গোত্র এসব পথ-নির্দেশ মেনে চলে না, তাদের যৌন পবিত্রতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। প্রতিদিনই আমরা এসব ঘটনা খবরের কাগজে পড়ে থাকি।
এ কথা সত্য যে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুব সমাজ কু দৃষ্টির শিকার হয়ে পড়ে? মনের আদান-প্রদানে আসক্ত হয়ে জান বাজি রেখে বসে। ইসলাম ঘটনার ডাল-পালা ছেড়ে মূল শিকড়ের প্রতি নজর দিয়েছে এবং যে-সব রাস্তা দিয়ে ফিত্না-ফাসাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, . তার ওপর সুদৃঢ় লৌহ প্রাচীর দাঁড় করে দিয়েছে। আর এমনিভাবেই সে যৌন পবিত্রতার আচঁলকে কলঙ্কের হাত থেকে মুক্ত করেছে।
.
কোমল (মিষ্টি) কণ্ঠে কথা বলা নিষেধ
ইসলাম এ নির্দেশও দিয়েছে যে, নারীকে যদি স্বীয় স্বামী ভিন্ন পরপুরুষের সাথে অপারগতাবশত কোন কথা বলতেই হয়, যদিও তা পর্দার আড়াল থেকেই হোক না কেন, তবে সে কথায় যেন কোমল ও মিষ্ট কণ্ঠ প্রকাশ না পায়। কেননা, তাতে দুশ্চরিত্র লোকের অন্তরের মধ্যে নষ্টামির খাহেশ জন্মাতে পারে।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন ঃ
فلا تخضعن بالقول فيطمع الذي في قلبه مرض وقلن قولا معروفا ۔
(হে মু’মিন নারী) পরপুরুষের সাথে কোমলকণ্ঠে এমনভাবে কথা বলবে না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা সদালাপ করবে।–সূরা আল আহযাব : ৪
কোমলকণ্ঠে কথা বলার যে রীতি তা শুধু স্বামীর সাথেই সীমিত। অপরের সাথে সে কোমলতা অবলম্বন করা যেতে পারে না। অপরের সাথে আলাপ করার সময় স্বচ্ছ ও সদালাপ করবে। কোমলকণ্ঠে ছলা-কলার সাথে কখনো কথা বলবে না। আলাপনে কণ্ঠস্বর কর্কষ রাখতে হবে। যে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় পুরুষের শয়তানী মন প্রেমের বাহানার পথ পায় তা সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে।
ফিকীহগণ বলেছেন, নারীর আলাপ সতর’ নয়। প্রয়োজনবশত সে পুরুষের সাথে কথা বলতে পারে। হ্যাঁ, আবার কারো কারো মতে, নারীর বাক্যালাপও সতর’। তার অর্থ, পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে বাক্যালাপ নারীর পক্ষে জায়েয নয়। প্রয়োজন ছাড়াই বাক্যালাপ করার অনুমতি নেই।
রদ্দুল মুখতার গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা মান্দাসীর বরাত দিয়ে লিখেছেনঃকেউ যেন নারীর বাক্যালাপ সতর’। এর অর্থ এই মনে না করে যে, নারীর বাক্যালাপকে আমরা না জায়েজ বলছি। বরং আমরা তো প্রয়োজনবশত নারীর সাথে পরপুরুষের কথা বলাও বৈধ মনে করি। হ্যাঁ, নারীর যে তীক্ষ্ণ কোমল কণ্ঠে মধুর বাক্যালাপ পুরুষের মন আক্বষ্ট করে এবং পুরুষের কামভাব জাগ্রত হয়, তাকে আমরা বৈধ মনে করি না। আর এজন্যই ইসলাম স্ত্রীলোকরে আযান দেয়ার পক্ষপাতী নয়। কারণ তাতে সাধারণত কোমল সুর ধ্বনিত হয়।–রদ্দুল মুহতার
.
মুহাররামের কথা ভিন্ন
ইসলাম সৌন্দর্য প্রকাশ, উলঙ্গপনা, কোমল কণ্ঠে কথোপকথন ও এ ধরনের অন্যান্য বিষয়াদিকে কঠোরভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য মুহাররমের প্রতি নারীরা স্বভাবজাত ভাবেই কল্যাণাকাংখী হয়ে থাকে, তাদের সামনে আসার অনুমতি দান করেছে। যেমন–পিতা, আপন ভ্রাতা, আপন পুত্র ও আপন ভ্রাতুস্পুত্র ইত্যাদি।
কোরআন মজীদে আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন :
ولا يثيرين زينتهن إلا لبعولتهن أو آباء هن أو آباء بعولتهن او ابناءه او ابناء بعولته أو إخوانه او بن إخوانهن أو بنى إخواتهن أو ياء هن اوما ملكت أيمانيهن او التابعين تمير أولى الربة من الرجال أو الطفل الذين لم يظهروا على عورات
তারা (নারীরা) যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, সেবিকা যারা তাদের অধিকারভুক্ত অনুগত, যৌন কামনারহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অংগ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত–সূরা আন নূর : ৩১
উক্ত আয়াতে বর্ণিত ভাই অর্থ নিছক আপন সহোদর, বিমাতা ও বৈপিত্রেয় ভাই বুঝানো হয়েছে। চাচাত ভাই, মামাত ভাই, খালাত ভাই, ফুফাত ভাই এবং এই ধরনের অন্য যে সব ভাইয়ের সাথে বিবাহ বৈধ হতে পারে, তারা অন্তর্ভুক্ত নয়। অন্যান্য পরপুরুষের মতোই এইসব ভাইদের থেকেও কঠোর পর্দা করতে হবে।
মুহাররাম বলা হয় ঐ সব লোকদের যাদের সাথে কখনো বিবাহ বৈধ নয় এবং সৌন্দর্য প্রকাশ শুধু তাদের সামনেই হতে পারে। উপমহাদেশ ও অন্যান্য দেশে, চাচাত ভাই ও মামাত অই, বেয়াই প্রভৃতির সাথে যে বেপর্দা প্রচলিত আছে, তা শরীয়তের বিপরীত। ভ্রাতুস্পুত্র বলতে আয়াতে আপন সহোদর বিমাতা ও বৈপিত্রেয় ভ্রাতাদের ছেলেদের বুঝায়। অন্যান্য ভ্রাতাদের ছেলেদের বুঝায় না। অনুরূপভাবে ভাগিনাদের মধ্যে কেবল সহোদরা, বিমাতা ও বৈপিত্রেয় ভগ্ননীর পুত্রগণই অন্তরভুক্ত। অন্যরা নয়। আপন সেবিকা দ্বারা আয়াতে স্বীয় দীনী বোনকে বুঝায়। বেদীন সেবিকার সাথেও পর্দা করা আবশ্যক। কেননা, সে পুরুষের সমতুল্য। তবে হ্যাঁ, বেদীন বান্দীর সাথে পর্দা করার প্রয়োজন নেই। গোলামও পরপুরুষের মধ্যেই শামিল। সে বালেগ হলে তার সাথেও পর্দা করতে হবে।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা কম বুদ্ধির দরুন যার নরী-পুরুষের পার্থক্য-জ্ঞান নেই এবং নারীর প্রতি যার আকর্ষণ বোধ নেই তার সাথে পর্দা জরুরী নয়। এ ছাড়া অন্য সব বালেগ পুরুষের সাথে। পর্দা করা প্রত্যেক নারীর কর্তব্য। যদিও সে বৃদ্ধ, হিজড়া ও ছিন্নশিশু হোক না কেন।
মুহাররামের সাথে পর্দার প্রয়োজন নেই। তার মানে এই নয় যে, অনর্থক তাদের সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে থাকবে। হ্যাঁ, কোন কারণে তাদের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়লে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা দোষণীয় নয়। কিন্তু যে অংশগুলো প্রকাশ করা জায়েয, তা হচ্ছে হাতের তালু ও মুখাবয়ব। কোরআনের আলোচ্য আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে। বেশী তো বেশী যে সব অঙ্গে অলংকার পরিধান করা হয়, মুহাররামের সামনে সে সব অঙ্গও প্রয়োজনবশত খোলা যেতে পারে। অর্থাৎ কান, বাহু, গলা প্রভৃতির কথা বলছি। হ্যাঁ, স্বামীর কাছে কোন অংঙ্গ ঢেকে রাখার প্রয়োজন নেই। অবশ্যই একে অপরের লজ্জাস্থান দেখা উচিত নয়।
.
নপুংসক নারীমহলে প্রবেশ করবে না
নপুংসকদেরও নারীমহলে প্রবেশের অনুমতি নেই। এটা প্রথম দিকে অনুমতি ছিল। জনৈক নপুংসক (হিজড়া) রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর হুজরায় যাতায়াত করত। সবার ধারণা ছিল, নারীদেহের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতায় জানা গেল নারীর রূপ-সৌন্দর্যের সাথে তারও সম্পর্ক আছে। একদিন সে বসে বসে কোন এক নারীর চিত্র অংকন করছিল। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এ খবর জানতে পেরে বললেন
الا أرى هذا يعلم ما ههنا لا يذن عليكم.
এ ব্যক্তি নপুংসক এখানকার খবরাখবর সম্বন্ধে অবহিত। তাই এখন থেকে সে আর তোমাদের নিকট প্রবেশ করতে পারবে না।–ইবনে কাছীর
.
কিশোর মুরাহিকদের প্রতি নির্দেশ
ইসলামী শরীয়ত যৌবনোনুখ কিশোরদেরও নারীমহলে যাতায়াতের অনুমতি দেয়নি। না নারীদেরও তাদের সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি দিয়েছে। যৌবনের কাছাকাছি কিশোর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
إياكم والدول على الياء .
খবরদার, তোমরা নারীদের অন্দরমহলে যাতায়াত করবে না।–মিশকাত
.
স্বামীর আত্মীয়-স্বজন তথা দেবর
হতে দূরে থাকবে
আমাদের দেশে স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সামনে এসে হাসি-মস্করা করার যে প্রথা প্রচলিত আছে, তাও ইসলামী শরীয়তের শিক্ষার পরিপন্থী। সে দেবর হোক কিংবা অন্য কোন আত্মীয়। মুহাররামের মধ্যে কেবল স্বামীর পিতা শামিল–অন্য কেউ নয়। একদা রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট স্বামীর আত্মীয়-স্বজন (যেমন দেবর প্রভৃতি) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : ৩;]।;স্বামীর আত্মীয়-স্বজন (দেবর) মৃত্যু সমতুল্য। কেননা, তাদের থেকে তো আরো বেশী দূরে থাকা উচিত। গায়র মুহাররাম সাত্মীয়ের সামনেও যাতায়াত করা অনুচিত। কারণ এতে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আশংকা অত্যধিক। কেননা, তারা তো গৃহে অবাধে বিচরণ করবে।–তিরমিযী শরীফ
.
নারী কোন পুরুষের সাথে নির্জনে
একান্তে সাক্ষাৎ করবে না
যে-সব কার্যক্রমের কারণে যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার ওপর কলঙ্ক আরোপ হতে পারে, ইসলাম তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। পুরুষের নারীর সাথে একান্তে মেলামেশা করা কতখানি ভয়ংকর পাপের আশংকার কারণ হতে পারে, তা সুস্পষ্ট। অধিকন্তু তাতে অহেতুক যে অপবাদ রটতে পারে, তাও গোপন কিছু নয়। তাই রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ কর্ম থেকে নিষেধ করেছেন।
তিনি বলেছেন,
لا يخلون رجل بامرأة إلا كان ثالثهما الشطان–
কোন পুরুষ যখন কোনো নারীর সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন সেখানে তাদের তৃতীয় জন হয় শয়তান।–মিশকাত
একান্ত অবস্থায় শয়তান উভয়ের অন্তরে কামভাব জাগ্রত করার প্রয়াস পায়। পুরুষ ও নারী উভয়ের মনে অপকর্মের প্ররোচনা দেয়। এ কাজে সুযোগ না হলে কোন তৃতীয় পক্ষকে এদের সম্পর্কে অপবাদ রটাতে উদ্বুদ্ধ করে। আর এভাবে সে অক্বত পাপে কলঙ্ক লেপন করতে চায়।
আজকাল সভ্য যুগে অনেক অশ্লীল অপকর্ম এভাবেই সংঘটিত হচ্ছে যে, নারী অবাধে পরপুরুষের সাথে একান্তে মেলামেশা করছে এবং প্রেমালোপের ফুল-ঝুরিতে পুরুষ নারীর ওপর স্বীয় প্রেমের অসার প্রভাব জমাচ্ছে।
যে নারীর স্বামী অনুপস্থিতে তার ঘরে যাবে না হাদীসে উল্লেখ আছে, যে মহিলার স্বামী গৃহে উপস্থিত নেই, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর এ নিষেধাজ্ঞার কারণ এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, শয়তান রক্তের মত মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা চলাচল করতে থাকে। তাই সে কামভাব জাগ্রত করে দিতে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ফরমান ও
فإن الشيطان يجرى من أحكم مجرى الدم—
কেননা, শয়তান তোমাদের মধ্যে রক্ত প্রবাহের ন্যায় চলাচল করতে থাকে।–মিশকাত
উক্ত হাদীসে আরো বর্ণিত আছে, বর্ণনাকারী স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, শয়তান আমাকেও প্ররোচনা দিত। কিন্তু মহান আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহে শয়তানের ওপর আমি বিজয় লাভ করেছি। এখন আমি তার সব রকম প্ররোচনা থেকে মুক্ত। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
ويرى و لكن الله أعانني عليه قاشتم.
এবং আমারও এই অবস্থা ছিলো। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা আমাকে তার ওপর বিজয় দান করেছেন। এখন শয়তান আমার অনুগত।–মিশকাত
আলোচ্য হাদীসের আলোকে পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক আকর্ষণ সম্বন্ধে অনুমান করা যায়। বর্তমান যুগে যে-সব ফিত্না ও অপকর্মের সৃষ্টি হয়ে চলছে, তাতেও এর পূর্ণ সমর্থন মেলে। তাই প্রতিটি জ্ঞানবান ব্যক্তিই হাদীসের এই দৃষ্টিকোণ স্বীকার করতে বাধ্য।
নবী পত্মী হযরত সফিয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ইতিকাফে ছিলেন। একদিন রাতে আমি তাকে দেখতে গেলাম। আলাপ সেরে চলে আসার সময় আমাকে গৃহে পৌঁছে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আমার সাথে সাথে আগমন করলেন। আমরা উভয়ে এক সাথে চলছি, ইত্যবসরে দু’জন আনসারী সাহাবী সেখান দিয়ে গমন করেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) দেখেই দ্রুত ছুটে চললেন। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাদেরকে বললেন : ধীরে-সুস্থে যাও। আমার সাথে এ হচ্ছে সফিয়া বিনতে হাই। তারা বললেন : সুবহানাল্লাহ, হে আল্লাহর রাসূল। অর্থাৎ আপনার সম্পর্কেও কি কুধারণা হতে পারে? রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন :
إن الشيطان يجرى من إبن آدم مجرى الدم واني خشيت أن يقذف
في قلوبگما شرا أو قال شيئا . متفق علمه .
শয়তান মানুষের দেহে রক্তের মত চলাচল করতে থাকে। আমি আশঙ্কা করছি, হয়ত শয়তান তোমাদের উভয়ের মনে কোন কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করতে পারে।–রিয়াদুস সালেহীন
.
আধুনিক বিজ্ঞান ও গবেষণা আমাদের সমর্থনে
এ পর্যন্ত পর্দা সম্পর্কে কোরআন, হাদীসঃ যুক্তি বিজ্ঞানের আলোকে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কিছু ব্যক্তি ইউরোপবাসীদের অভিমত না জানা পর্যন্ত সান্ত্বনা পায় না। এই প্রগতিশীল শ্ৰেণীটির জন্য এনসাইক্লোপেডিয়া প্রভৃতি হতে কিছু উক্তি তুলে ধরছি। এতে আমাদের মূল উদ্দেশ্য আরো সুদৃঢ় হবে।
রোমান এম্পায়ার সমগ্র ইউরোপের মাতৃস্থানীয়। এক সময় এ সাম্রাজ্যেও তার চরমোন্নতির যুগে নারীদের পর্দায় রাখা হত। গৃহের বাইরের কাজের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। উনবিংশ শতাক্দীর এনসাইক্লোপেডিয়ায় লিখিত আছেঃ
রোমান নারীরাও পুরুষের মত কাজ কর্ম করা পছন্দ করত। তারা তাদের গৃহাভ্যন্তরে কর্মরত থাকত। তাদের স্বামী ও পরিবারের অন্যান্যরা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করত। গৃহস্থালী কাজকর্ম শেষ করার পর নারীদের প্রধান কাজ ছিল সূতাকাটা এবং পশম বুনে কাপড় তৈরী করা। রোমান নারীরা কঠোর পর্দা প্রথা অবলম্বন করত। এমন কি তাদের মধ্যে যে সব নারী ধাত্রীর কাজ করত, তারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভারী ওড়না দ্বারা স্বীয় চেহারা ঢেকে নিত এবং তার ওপর এক মোটা চাদর পরিধান করত–যা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলে থাকত। সেই চাদরের ওপর আবার এক আবা (জামা বিশেষ) পরিধান করত, যার দরুন তাদের শরীরের আকার-আক্বতি দৃষ্টিগোচর হওয়া তো দূরের কথা, দেহ-কাঠামোর ও পাত্তা পাওয়া মুশকিল হতো।–মুসলমান আওরত
.
নারীদের বেপর্দার পরিণাম
সে সময় রোমান রাষ্ট্র ও জাতির উন্নতির সূর্য ছিল মধ্যাহ্নে অবস্থিত। কিন্তু ঠিক এ সময়ই তাদের মধ্যে ভোগ-বিলাস ও আমোদ-ফুর্তির আকাংখা জন্ম নিল। পুরুষরা তাদের আনন্দ-ক্লাবে নারীদেরকেও শরীক করতে চাইল। নারী ছাড়া তাদের মেলা, ক্লাব, সভা-সমিতি নি-প্রাণ ও অনুজ্জ্বল মনে হচ্ছিল। ফলে নারীদেরকে পর্দা প্রথার সীমানা থেকে টেনে আনল। তাদের সতীত্বাঞ্চল কলঙ্কিত করার প্রয়াস পেল। এর কিছু দিনের মধ্যেই তাদের নারীরা সভা-সমাবেশ পার্ক, বিনোদন-ক্লাবগুলোয় যাতায়াত শুরু করল। তারপর রোমান সাম্রাজ্যের কি দশা ঘটলো? বিপর্যয় শুরু হল। সকল শৌর্য-বীর্যের ইমারত ভেঙ্গে ধূলিসাৎ হল। নিঃসন্দেহে এই বিপর্যয়ের বড় একটা কারণ ছিল নারী-স্বাধীনতা।
ইতিহাসের আলোকে আল্লামা ফরীদ ওয়াজদী লিখেছেন:
কিন্তু কথা হচ্ছে যখন তাদের বেপর্দা বানানো হল, তখন স্বাভাবিক ভাবেই পুরুষরা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এবং এ জন্য পরস্পরে হানাহানি মারামারি, কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলো। এটা এমন এক রাজনৈতিক সত্য, যা কোন ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারেন না। -মুসলমান আওরত
আল্লামা লয়েস পেরোল রিভিউ অফ রিভিউস একদাশ খণ্ডে রাজনৈতিক বিপর্যয়’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেন। তাতে তিনি লিখেন যে, উন্নত চরিত্রের ভিত্তি ধ্বংসের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাই সর্বাধিক।
এরপর সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি আরো লিখছেন।
রোমান গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের পূর্ব যুগে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ সুন্দরী কোমলমতি প্রমোদ বালাদের সান্নিন্ধ্য লাভে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর এ ধরনের প্রমোদবালা তখন প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যেতো।
.
নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার পরিণাম ফল –
অতঃপর নারীদের বেপর্দা হওয়া ও নারী স্বাধীনতা লাভের পর দেশের অবস্থা কি হল? ইতিহাস পর্যালোচনা করুন, নারী স্বাধীনতার দরুন দেশের ব্যয়ভার অত্যাধিক বেড়ে গেল। ফিত্না-ফাসাদের প্রস্রবণ প্রবাহিত হল। তাদের আমল-আখলাক দুর্গন্ধের সৃষ্টি করল। তারপর শেষ পরিণাম কি হল?
নারী-পুরুষের এই অবাধ মেলামেশার ফলে রোমানদের মধ্যে যে দুশ্চরিত্রতা ও ব্যভিচার জন্মলাভ করেছিলো, আমার কলম তা লিপিবদ্ধ করতে লজ্জাবোধ করছে। তারা অশ্লীলতা, হীনবল, হীনমনা ও নীচতায় নিমজ্জিত হলো। পরস্পরে কোন্দল, রক্তারক্তি, হানাহানি ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলো। আর এ বিপর্যয় এতোই প্রকট আকার ধারণ করলো যে, মানবতা ও নৈতিকতার তাতে নাম-নিশানা রইল না।-মুসলমান আওরত
এসব ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা, যা আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে, নারীদের পর্দা সম্পর্কে মহান আল্লাহর যে বিধি-বিধান রয়েছে, অভিজ্ঞতার আলোকে ইউরোপের বড় বড় পণ্ডিত, জ্ঞানীরাও তার যৌক্তিতা মেনে নিয়েছেন।
* ৭-এর প্রতিষ্ঠাতা অগাস্ট কোন্ট তাঁর বিখ্যাত রচনা Le 1 L। ২ .100–তে লিখেছেন:
বর্তমান যুগে যেমন নারীদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে চৈন্তিক ভ্রষ্টতা সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সমাজ বিবর্তনের সর্ব যুগেই সৃষ্টি হতে থাকে। কিন্তু যে প্রাক্বতিক ব্যবস্থা নারী জাতিকে ঘরোয়া জীবনের ব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট রেখেছে, তাতে কখনো কোন বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয় নি। এ ঐশী বিধানটি এতটা নির্ভুল ও সপ্রমাণিত যে, এর বিরুদ্ধাচরণে সহস্র অলীক কল্পনা ঠাই পেলেও কোনো রদবদল ও পরিবর্তন ছাড়াই তা সবার ওপরে বিজয়ী থাকবে। পুরুষদের কাজে নারীদের অবাধ যাতায়াত যে ভয়াবহ পরিণাম ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে, দুনিয়ায় পুরুষের ওপর নারীর যে বৈষয়িক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে, তার সীমা নির্ধারণ করে দেয়াই হচ্ছে এর একমাত্র প্রতিষেধক। পুরুষের কর্তব্য হচ্ছে নারীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যোগানো। আল্লাহর এ স্বাভাবিক বিধানই নারী জাতির প্রকৃত জীবনকে গার্হস্থ্য গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই বিধি-বিধান সহ-অবস্থানের ভয়ানক ও বিপজ্জনক অবস্থাকে সুষ্ঠ ও সুন্দর করে তোলে। এই বিধি-বিধানই নারীকে তার স্বাভাবিক প্রেরণায় মানব জাতির উৎকর্ষের মত সম্মানিত দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে।
পদার্থ বিজ্ঞানী ঝোল সায়মন তার এক নিবন্ধে লিখেছেন:
নারীকে নারীর মত থাকা উচিত। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে নারীকে নারীই থাকা উচিত। তাতেই তার জন্য মঙ্গল। আর এই গুণটিই তাকে সৌভাগ্যের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। প্রক্বতির এটিই বিধান আর প্রক্বতির এটিই নির্দেশ। সুতরাং নারী যতখানি তার নিকটবর্তী হবে, তার প্রকৃত মর্যাদা ততখানি বৃদ্ধি পাবে। আর যতখানি এর থেকে দূরে সরে যাবে, তার বিপদাপদ ততখানি বেড়ে যাবে। কোন কোন দার্শনিক মানব জীবনকে পবিত্রতামুক্ত মনে করেন। কিন্তু আমি বলছি, মানব জীবন মনমোহন, পুত-পবিত্র ও নিরতিশয় পবিত্র–যদি প্রতিটি পুরুষ ও নারী তার প্রক্বতিদত্ত মান-মর্যাদা সম্পর্কে সজাগ হয়ে প্রক্বতি-অর্পিত নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে চলে।–মুসলমান আওরত
শুধু তাই নয় বরং ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গকে একথা মানতে বাধ্য করেছে যে, যে নারী তার শ্ৰেণীকৰ্তব্য সাধন করে দেয় না, সে নারী নয়।
এই ঝোল সায়মনই এক স্থানে লিখেছেন:
যে নারী তার গৃহের বাইরের কাজে অংশ গ্রহণ করে, নিঃসন্দেহে, সে এক নিরেট কর্মীর কর্তব্য পালন করছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হয়, সে আর নারী থাকে না।
.
সমাজের দায়িত্ব কর্তব্য
আজকাল অনেক নামধারী মুসলমান পর্দার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন। তারা পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রভাবান্বিত হয়ে স্বীয় ধর্মের নির্দেশ অমান্য করছেন। কিন্তু চিন্তা ভাবনা করে দেখুন, স্বয়ং ইউরোপীয় জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবি মহল এ সম্পর্কে কি অভিমত পোষণ করছেন।
অগাস্ট কোন্ট তাঁর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুস্তকে লিখেছন
স্বামী অথবা কোন নিকটাত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে সমাজের কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের ধন-সম্পদ দ্বারা ওই নারীর প্রয়োজন পূর্ণ করা, যাতে জীবিকার প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে তাকে গৃহের বাইরে যেতে না হয়। কেননা, যথাসম্ভব নারী জীবনকে গৃহ-সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নারীকে বহির্জীবনের দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুছিবত থেকে রক্ষা করা, যাতে মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে যে বিধি-বিধানের আওতার মধ্যে অবদ্ধ করেছেন, তার বাইরে সে যেতে বাধ্য না হয়।
লক্ষ্য করুন, ইসলাম নারীদের জন্য যে আইন-কানুন শুরুতে রচনা করেছিল, আজকের দুনিয়া দ্রুত সেদিকেই ধবিত হচ্ছে। ইসলাম নারীর দায়িত্ব মুসলমানদের বায়তুল মালের ওপর অর্পন করেছিল। কিছুদিন পূর্বেও মানুষ এদেরকে দেশের জন্য অবাঞ্ছিত বোঝা মনে করত। কিন্তু এখন স্বয়ং ইউরোপের পণ্ডিতবগহই নারীদের দায়িত্ব সমাজকে গ্রহণের সুপারিশ করছেন।
.
নারী স্বাধীনতার নামে প্রতারণা
কে না জানে, নারীর অবাধ স্বাধীনতা দেশকে ফিত্নার মধ্যে নিপতিত করে। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলে। এবং স্বয়ং নারী উৰ্গতা সমাজকে জান্নাত থেকে নরকে পৌঁছে দেয়। নারীরা এই বিংশ শতাব্দীতে এ জন্য আনন্দিত যে, তারা তাদের অধিকার লাভ করছে। প্রতি বিভাগে তারা চাকুরী পাচ্ছে। কিন্তু তার এ খবর নেই যে, পুরুষরা তাদেরকে গরু-গাড়ীর মত ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে। মুহূর্তের জন্যও তাদের কোন প্রকার অবসর নেই। নিজের স্বাভাবিক কর্তব্য থেকে সে দিন দিনই দূরে সরে যাচ্ছে। পুরুষদের নিছক আনন্দ দানের জন্য নারীদের অশ্লীল সিনেমার পর্দায় আসতে হয়েছে। পুরুষদের মনতুষ্টির জন্য থিয়েটারের নরক জীবন যাপন করতে হয়েছে। পুরুষদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য তাদের ক্লাবে নৃত্য অনুষ্ঠানগুলোয় নাচতে হচ্ছে। এমনকি, নিছক পুরুষদের যৌনক্ষুধা মিটানোর জন্য নারীদের নগ্ন-ক্লাব বানাতে হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত নারী এটাই মনে করছে যে, তারা পুরুষদের গোলামী থেকে নাজাত পেয়েছে।
.
নারী-স্বাধীনতা পুরুষদের পক্ষে
পুরুষরা চিন্তা করে না নারী-স্বাধীনতার ফলে তার কি অপুরন্ত ক্ষতি হচ্ছে। কতো-ভদ্র ঘরের মেয়েরা সিনেমা ও থিয়েটার প্রভৃতির প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে, কতো ভদ্র লোকের স্ত্রী ও মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়ে গেছে এবং কত সচ্চরিত্র রমণীর সতীত্বহানি ঘটছে। কলেজ, ইউনিভার্সটি ও ক্লাবসমূহে যা-কিছু ঘটছে, তা কারো অজানা নয়। শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই তা অবহিত।
ইসলাম নারীদেরকে পদে পদে সতীত্বের দিক নির্দেশ করেছে, যাতে সামাজিক ব্যবস্থা বহাল থাকে এবং নর-নারী উভয়েই নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সুষ্ঠরূপে সমাধা দিতে পারে। যেখানে শরীয়ত-নির্দেশিত পথের বিপরীত নর-নারীর সমাবেশ ঘটে, সেখানে অনিবার্য ভাবেই শীঘ্র অথবা বিলম্বে ফিনা-ফাসাদ ও ধ্বংসের সৃষ্টি হয় এবং উভয়েই নিজ নিজ কর্তব্য আঞ্জাম দানে অক্ষম ও অপারগ সাব্যস্ত হয়।
.
নারী কোথা থেকে কোন গন্তব্যে পৌঁছে—
আমরা জনাব মাহেরুল কাঁদেরীর এ মতের সাথে সম্পূর্ণ একমত যে, পর্দাহীনতার আকাংখা শুধুমাত্র চেহারার ঘোমটাহীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, প্রথমে মুখাবয়বের ঘোমটা উঠে যায়। তারপর নিন্মদৃষ্টিপাত ক্রমশ ওপরে ওঠে। অতঃপর পোশাক পরিচ্ছেদ খাটো হওয়া শুরু হয়। অনন্তর সাজ-সজ্জার মধ্যে লোক-দেখানো মনোভাব সৃষ্টি হয়। লোভ-লালসা, অমিতাচার ও উলঙ্গপনা ও নষ্টামিপনার এই শাখা-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে থাকে। এমন কি যে নারী প্রথম বার চেহারাকে উন্মুক্ত করতে গিয়ে লজ্জা-শরমে গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিল, পরবর্তীতে সে ক্লাবঘরে গিয়ে পরপুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে এবং কাঁধে হাত রেখে নগ্ন নৃত্যে শরীক হয়।–ফারান
.
পর্দা প্রথায় স্নায়ু দুর্বলতার অভিযোগ অসত্য
যারা পর্দার ক্ষতিসমূহের মধ্যে স্নায়ু-দুর্বলতা, কামোত্তেজনা ও শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বঞ্চনার কথা বলছেন, তারা সম্পূর্ণভাবেই ভ্রান্ত ও ভুল বলছেন। আত্মহত্যার সংখ্যা প্রমাণ করেছে, স্নায়ু কার দুর্বল হয়। ইন্দ্রিয়পরায়ণতার বিষয়টিও পূর্ব-পশ্চিমের অশ্লীলতা-ব্যভিচার স্পষ্ট করে দিয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে আমরা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিতা মহিলাদের ইতিহাস পাঠ করতে বলব। যারা পর্দার মধ্যে অনুষ্ঠিত বিবাহে তালাকের সংখ্যা অধিক বলে মন্তব্য করেন, তাদেরকে আমরা ইউরোপ-এশিয়া কিংবা পর্দা ও পর্দাহীন দেশের বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা গুণে দেখতে বলব।
আমরা তো কেবল এ সত্য কথাই বলতে চাই যে, যৌন পবিত্রতার সংরক্ষণ ইসলামী শরীয়ত প্রদত্ত পর্দা প্রথার মধ্যেই নিহিত। ইসলাম, এ কথাই বলছে, যার স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে, ইউরোপের অধিকাংশ দেশে নারীর পর্দা সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়ে গেছে। জার্মানীতেনারীরা ঘরে ফিরে যাও আন্দোলন শুরু করেছে। আমেরিকায় প্রতি বছর লক্ষাধিক নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তন্মধ্যে সতের হাজার সফল হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই অধিক। এ হচ্ছে ব্যর্থ প্রেমের ফলস্বরূপ।
.
অপর নারীর কথা স্বামীর নিকট বলবে না
যে সমস্ত পথ ও পন্থা অদৃশ্যভাবে যৌন পবিত্রতার পক্ষে বিপজ্জনক, ইসলাম তাদের ওপরও পাহারা বসিয়ে দিয়েছে। যেমন, নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এক নারী অন্য নারীর সাথে মেলামেশা করে স্বীয় স্বামীর নিকট তার অবস্থা বর্ণনা করবে না। কেননা, তাতে তার স্বামীর মনে উক্ত নারীর রূপ-সৌন্দর্য স্বামীর রেখাপাত করার দরুন কামভাব জাগ্রত হতে পারে এবং সে তার পিছনে লাগতে পারে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ
تباشر المرأة المرأة قتنعتها لزوجها كاه ينظر إليها—
এক নারী অন্য নারীর সাথে এমন ভাবে মেলামেশা করবে না, যাতে করে সে তার স্বামীর নিকট গিয়ে তার কথা এমনভাবে বর্ণনা করতে পারে, যেন স্বামী ঐ নারীকে দেখতে পাচ্ছে। –বুখারী
এভাবে কামভাব ফুটে ওঠার নিশ্চিত আশঙ্কা রয়েছে এবং সেই সাথে ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হওয়ার।
.
স্বামী স্বীয় স্ত্রীর গোপনীয় কথা
অন্যের কাছে প্রকাশ করবে না
অনুরূপভাবে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষকেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গোপন কথা অন্য পুরুষের কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন।
হাদিসে বর্ণিত আছেঃ
إن من أشير الكاس عث اللهمثزلة الرجل يفضى إلى إمراتيه
وفي اليوم ينشر سوها۔
আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম ওই ব্যক্তি, যে স্ত্রী-সহবাসের গোপনীয় কথা অন্যের কাছে বর্ণনা করে।–মুসলিম, অনুচ্ছেদ ও স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
নারীকে যেমন অন্য স্ত্রীলোকের দৈহিক সৌন্দয্য প্রভৃতি বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি এখানে পুরুষকেও তার স্ত্রীর গোপন দিক কারো কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এখানেও অন্যান্য বিষয়ের সাথে একটি কথা হচ্ছে, অন্যের যৌনাবেগকে উস্কে দেয়া অনুচিত। কেননা, মানবীয় কামভাবের অবস্থা হল, যেখানেই এ ধরনের কোন আলোচনা হয়, স্বভাবতই তাতে উত্তেজনার ভাব সৃষ্টি হয় এবং কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানবীয় চিন্তা-কল্পনা এদিক-সেদিক খেয়াল করতে থাকে। তাই জ্ঞান-বুদ্ধির দাবী অনুসারে এ ধরনের অনর্থক আলাপ বর্জন করতে হবে। কামোত্তেজক আলোচনা থেকে পুরাপুরি দূরে থাকতে হবে।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, বিনা প্রয়োজনে স্ত্রী-সহবাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনাও খুবই দূষণীয়। হ্যাঁ, প্রয়োজনের কথা দূষণীয় নয়। যেমন, কেউ মনে করে, স্ত্রীসহবাসে সে অক্ষম। স্ত্রীর রোগের কথা, এমতাবস্থায় অবশ্য স্ত্রী-সহবাসের আলোচনা দূষণীয় নয়। আর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা তো সর্বাবস্থায়ই নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ।–শরহে মুসলিম, নববী
.
যৌন উত্তেজনা বিষয় বর্জন
ইসলামী শরীয়ত এ কারণেই যে-সব আচার-আচরণ মানবীয় শক্তিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এবং যার কারণে কোন ফিত্না-ফাসাদ কিংবা পাপ কর্মের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে, সেগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র কামনা-বাসনার ওপরই প্রহরা বসিয়েছেন–যে কোনো সাধ-অভিলাষই বুদ্ধি-বিবেচনায় পাপের উপকরণ হতে পারে–তাকে বাস্তব রূপ দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন
ينظر الرجل إلى عورة الرجل و المرأة إلى عورة المراة–
কোনো পুরুষ অন্য পরুষের সতর দেখবে না এবং কোন নারীও অন্য নারীর সতর দেখবে।–মুসলিম, মিশকাত
মানব-প্রক্বতি হচ্ছে, সতর বা গুপ্তাঙ্গ দেখলে কামভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুরুষে পুরুষের সতর দেখুক কিংবা নারী নারীর। অথবা বিপরীত পুরুষে নারীর সতর দেখুক এবং নারী পুরুষের। আর কামভাবে যখন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তখন বিপদাশংকা চরমে পৌঁছে। মানব-প্রক্বতি অস্থির হয়ে ওঠে। অতঃপর এক অশুভ যৌনাবেগ অন্তরে বাসা বাঁধে। কখনো পুরুষের সাথে পুরুষের ভালবাসা হয়ে যায় এবং স্বভাবে মালিনতা থাকলে সুযোগ পেয়ে পায়মৈথুনে লিপ্ত হয়। কখনো তার কামোত্তেজনা তাকে কোন পরনারীর প্রতি অবৈধভাবে আক্বষ্ট করে। আর কমবেশী একই অবস্থা নারীর বেলায়ও। কখনো তারা নিজেদের মধ্যে ভালবাসা মহব্বতের কাণ্ড ঘটায়। আবার কখনো কোনো পরপুরুষের প্রতি অবৈধ প্রেম-প্রণয়ের আকুতি জানায়। এ উভয় পদ্ধতিই ব্যভিচার তথা পাপাচারে লিপ্ত করে। তাছাড়া, এমনিতেই সতর ঢেকে রাখা ইসলামে একটি জরুরী নির্দেশ। তাই সতর দেখা তার পরিপন্থী। পরন্তু রসম-রেওয়াজেও সতর ঢাকা আবশ্যক মনে করা হয়। আর তার বিরুদ্ধোচরণ বা বিপরীত করা অপমানকর ব্যাপার।
.
দু’জন পুরুষ কিংবা দু’জন নারী একত্রে শয়ন করা নিষেধ
মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও তার কামশক্তির কারণেই ইসলাম একই বিছানায় দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারীকে শয়ন করতে নিষেধ করছে। উপরোক্ত হাদীসের শেষাংশ হচ্ছে? ..
ويفضى الرجل إلى الرجل في ثوب واحد ولا تفضى المراة
في ثوب واحد–
কোন পুরুষ অপর পুরুষের সাথে একই বিছানায় শয়ন করবে না। আর কোনো নারীও অপর নারীর সাথে একই বিছানায় শয়ন করবে না।–মুসলিম
একই বিছানায় দুজন পুরুষ কিংবা নারীর শয়ন করা মনস্তত্ত্বও ক্ষতিকর প্রমাণিত করেছে। কেননা, তার পরিণাম শুভ হয় না। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলবী (রঃ) সত্যই বলেছেন, দুজন এক বিছানায় শয়ন করা কামোত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হয়। যাতে কখনো কখনো মনে সমমৈথুন ও সমকামিতার বাসনা জাগে যা খুবই গর্হিত কাজ।
.
সতর আবৃত রাখা
পুরুষ লোকের সতর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। দেহের এ অংশটি আবৃত রাখা পুরুষের কর্তব্য। স্বীয় স্ত্রী ব্যতীত অন্য কারো সামনে উন্মুক্ত করা যাবে না। আর স্বাধীন স্ত্রীলোকের সতর মুখমণ্ডল ও হাতের তালু ব্যতীত সমগ্র শরীর। কিন্তু স্ত্রীলোকের সতর স্ত্রীলোকের জন্যও নাভি থেকে নিয়ে হাঁটু পর্যন্ত। নারীদেহের এ অংশটুকু অন্য নারীরাও দেখতে পারবে না।
মানব প্রক্বতি স্বভাবই এমন যে, নিজ লজ্জাস্থান দেখলেও তার কামভাব চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই ইসলাম মানুষকে তার একাকীত্বেও উলঙ্গ হতে নিষেধ করেছে। তাছাড়া, এটা মনুষ্যত্বেরও পরিপন্থী। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
إياكم و الثقژی قا معكم من لايفارقكم الأثد ماطو
چين يفضي الرجل إلى أهيم قاشتحبوهم واكرموهم.
সাবধান! তোমরা উলঙ্গ হবে না। কেননা, তোমাদের সাথে এমন কতক সত্তা রয়েছেন, যারা পায়খানা পেশাব ও স্ত্রী সহবাসের সময় ছাড়া কখনো আলাদা হয় না। কাজেই তাদের লজ্জা করো ও সম্মান করো।–হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা
অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক সাহাবীকে বললেন:
حفظ عورتك إلا من زوجتك أو ما ملكت يمينك ققال
و احق ان يستحيا منه
ان الرجل خالد
افرايت ا
স্বীয় সতর হিফাযত কর। তবে নিজ স্ত্রী কিংবা বান্দীর নিকট থাকলে আলাদা কথা। সে জিজ্ঞাসা করল, যদি কেউ একাকী হয়, তবে? তিনি বললেন, তখন আল্লাহকে লজ্জা করা একান্ত উচিত।
শালীনতা ও আদব-আখলাকের দাবী তো নিঃসন্দেহে এটাই যে, একাকী অবস্থায় কিরামান কাতিবীন ফেরেশতা ও স্বয়ং রব্বুল আলামীন আল্লাহ তা’আলার উপস্থিতির কল্পনাই প্রবল হবে এবং লজ্জা-শরমের খেয়ালই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু তারপরও সম্পূর্ণ উলঙ্গ হওয়াতে কাম-প্রবৃত্তিতেও উত্তেজনাবস্থা কখনো-কখনো সৃষ্টি হয়ে যায়। যা হোক, আদব ও হিকমতের দাবী হচ্ছে একান্ত বাধ্য না হলে বিবস্ত্র হবে না। আর এ ভাবে বেহায়াপনার পথ খুলে দেবে না।
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
ألا يبيت رجل يد إمراة ثيب إلا أن يكون تاحا أو ذا مرم.
কোনো বিবাহিতা নারীর কাছে বিবাহকারী অর্থাৎ স্বামী কিংবা মুহাররাম ছাড়া কোন গরপুরুষ রাত কাটাবে না।–মিশকাত
এসব হচ্ছে পর্ব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। সন্দেহ নেই, সবগুলোই বিপজ্জনক স্থান। সুতরাং সর্বদা সতর্ক থাকা জরুরী। এসব ক্ষেত্রে যৌন পবিত্রতা নষ্ট ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে।
.
কোন নারী একাকী সফর করবে না
ইসলামী শরীয়ত যৌন পবিত্রতাকে কোথাও অবলম্বনহীন রাখেনি। সর্বত্র সাধ্য অনুসারে তাকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছে। নারীর জীবনে যদি কখনো সফর করার প্রয়োজন পড়ে, তবে ইসলাম সফরেও নারীর সতীত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করে। আল্লাহর বিধান হল, নারী কোন মুহাররাম ছাড়া সফরে বের হবে না। হজ্জের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ইসলামের একটি বুনিয়াদী রুকনও কোন মুহাররাম ছাড়া নারী একাকী আদায় করতে পারে না। বাহ্যিক সতর্কতাও ইসলাম এ ক্ষেত্রে ভুলে যায়নি।
নবী করীম (ছ) বলেছেনঃ
لا يحل لامراة تؤمن بالله واليوم الأخير تسافر مسيرة يوم
وليلة إلا مع ذي محرم عليها۔
কোন মু’মিন নারীর পক্ষে মুহাররাম ব্যতীত এক দিন ও এক রাত দূরের পথে একাকিনী সফর করা হারাম।–বুখারী, মুসলিম
যার সাথে কোন নারীর কখনো বিবাহ সিদ্ধ নয়, তাকে ঐ নারীর মুহাররাম বলা হয়। যেমন আপন ভাই, পিতা, স্বামী, আপন মামা প্রভৃতি। মুহাররাম ব্যতীত নারীর একাকী সফর করা বৈধ নয়। মুহাররাম ব্যতীত কোন গায়ব মুহাররাম সঙ্গে থাকলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা গ্রহণযোগ্য নয়। স্বভাবত ঘর ছেড়ে নারী যখন বাইরে যায়, তখন তাকে অনেক বিপদ ডিঙ্গিয়ে যেতে হয়। রাস্তায় ভালো-মন্দ সব ধরনের মানুষকেই অতিক্রম করতে হয়। সৃষ্টিগত ভাবেই নারী দুর্বল ও আবেগপ্রবণ। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিও যথোপযুক্ত পরিপক্ক নয়। তাই এমন নাজুক সময় কোন বিশেষ ব্যক্তিরই যেমন স্বামী, পিতা, নারীর আপন ভাই প্রমুখ সাথে থাকা আবশ্যক, যিনি তাকে সব সময় উপযুক্ত সাহায্য করতে পারেন। আর কখনো সফর-সঙ্গীর সাহায্য-সহায়তায় প্রভাবান্বিত হয়ে কোনো অসৎ পথে চালিত না হয়। একদা রাসূল (ছঃ) বলেন
لا يخلون رجل بامراة إلا ومعها ذو محرم ولا تسافر المراة
إلا ذي محرم فقال رجل يا رسول الله إن إمراي خرجت حاجه واني كتبت في زوة كذا وكذا قال قال إنطلق إحج مع إمرأتك .
কোন পুরুষের এমন কোন নারীর সাথে সাক্ষাৎ বৈধ হবে না, যার সাথে তার কোন মুহাররাম আত্মীয় নাই। আর কোন নারী বিনা মুহাররাম সফর করবে না। এক সাহাবী বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্ত্রী হজ্জে গমন করছে, আর আমি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছি। তিনি বললেন : তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জে গমন কর।–বুখারী-মুসলিম।
উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন, তাতেই নারী সম্পর্কে আল্লাহর বিধানের অনুমান করা যায় যে, তাদের যৌন পবিত্রতা ও অন্যান্য প্রয়োজনের প্রতি ইসলাম কত লক্ষ্য ও দৃষ্টি রেখেছে। আল্লাহর পথে জিহাদের পরিবর্তে স্ত্রীর হজ্জযাত্রার সঙ্গী হওয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নারী মুহাররাম ব্যতীত সফর করবে না। তাই জিহাদে অংশগ্রহণ থেকেও তখন স্বামীর স্ত্রীর হজ্জযাত্রার সঙ্গী হওয়াকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে।
.
সফরে যাওয়ার পূর্বে গৃহের হিফাযত
সফরে হোক কিংবা গৃহে পুরুষ স্ত্রীলোকদের ভুলে যেতে পারে না। নিজের এবং স্ত্রীর উভয়ের যৌন পবিত্রতা ও অন্যান্য প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। সফরের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার সুন্নত তরীকা হলো এমন দোয়া পাঠ করবে, যাতে নিজের এবং নিজ পরিবার পরিজনের রক্ষা ও আরামের প্রার্থনা থাকে। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সফরে বের হতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন।
اللهم انت الشاب في السفر والخليقة في الأهلي اللهم
إني أعوذبك من وعثاء السفر وکابة المنظر وسوء المنقلب في المال الاهلي—
হে আল্লাহ! তুমি সফরে আমার সাথী এবং পরিবার পরিজনের প্রতিনিধি। হে আল্লাহ! আমি সফরের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ঘটনা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর আশ্রয় প্রার্থনা করছি ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজনে অপ্রিয়-দেখা থেকে।–রিয়াদুস সালেহীন
আর মুসলিম বিশ্বের প্রতিও নির্দেশ হচ্ছে যে, সফরে গমনকালে এই দোয়া পড়বে এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করবে যে, রব্বুল আলামীন তুমি অন্যান্য জিনিসের সাথে আমার সন্তান-সন্তুতি ও স্ত্রীকেও নিরাপদ রাখো। হে আল্লাহ! সফর হতে ফিরে এসে ধন-সম্পদ ও পুত্র-পরিজনের মধ্যে অপ্রিয় কিছু দেখা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। বান্দা যেনো এই ভাবে স্বীয় সন্তান-সন্তুতিকে আল্লাহ তা’আলার বিশেষ তত্ত্বাবধানে রেখে দেন–যদিও আল্লাহ তা’আলা সর্বক্ষণই বান্দার হিফাযতকারী।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ হচ্ছে, সফরের প্রয়োজন মিটে গেলেই যথাসম্ভব দ্রুত পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে আসবে। তিনি বলেন :
الشفر قطعة من العذاب يمتع أحدكم طعامه وشرابه
ونومة فإذا قضى هبته من سفره فليجعل إلى أهله—
সফর কষ্টের একটি অংশ বিশেষ। তোমাদের খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। সুতরাং যখনই সফরের প্রয়োজন শেষ হবে, পরিবার পরিজনদের দ্রুত ফিরে আসবে। -বুখারী-মুসলিম
.
যুদ্ধেরত পরিবারের স্ত্রীদের সতীত্ব রক্ষা
যেসব মুসলিম নারীর তাদের স্বামীদের জিহাদে যাওয়ার দরুন নিজ গৃহে একাকিনী অবস্থান করতে থাকেন, তাদের মান-মর্যাদা সাধারণ মুসলমানের স্ত্রীদের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে মায়ের মর্যাদা দান করা হয়েছে এবং প্রতিটি মুসলমানের ওপর তাদের সতীত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন :
حرمة بناء المجاهدين على القايدين كهژمو أمهاتهم ما من رجل من القايدين يخلي رجلا من المجاهين في أهيم
قوته فيهم إلا وقف له يوم القياموفا من حسناه ما
شاء حتى يرضي—
মুসলিম মুজাহিদদের স্ত্রীগণের মর্যাদা গৃহে অবস্থানকারীদের নিকট তাদের মায়ের সমতুল্য। কোন গৃহে অবস্থানকারী কোন মুজাহিদ-পরিবারের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হলে কিয়ামতের দিন উক্ত মুজাহিদকে অপকর্ম কারীর নিকট উপস্থিত করা হবে এবং তিনি তার ইচ্ছা অনুযায়ী ওই অপকর্মকারীর নেক আমল গ্রহণ করবেন।–রিয়াদুস সালেহীন
.
গৃহে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি প্রার্থনার রীতি
ইসলামী শরীয়ত যেখানে ছোট-বড় সব বিষয়ের বিধি-নিষেধ রচনা করেছে, সেখানে গৃহে প্রবেশের নিয়ম-রীতি না বানানো কি করে সম্ভব? তাই ইসলাম যৌন পবিত্রতা রক্ষা ও অন্যান্য গূঢ় কারণে আইন প্রবর্তন করেছে যে, কেউ কারো গৃহাভ্যন্তরে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করবে না। অতঃপর ইসলাম এই অনুমতি লাভের জন্যও পথ জানিয়ে দিয়েছে যা অনুকরণ-অনুসরণের মাধ্যমে অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়।
গৃহে প্রবেশের অনুমতি
যে ঘর বসবাসের জন্য নয় কিংবা বসবাসের জন্য হলেও কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়–যেমন খানকা–যে অংশ আম-খাস’ সর্বসাধারণের জন্যই খোলা। মাদ্রাসা–যেখানে কারো যেতে বাধা নেই, সরাইখানা–যা সবার জন্যই সমান। সর্বসাধারণের জন্য নির্মিত দরযা অথবা যে গৃহে কেউ বসবাস করে না, বরং তাতে মালামাল রয়েছে, এ ধরনের গৃহে তো নিঃসন্দেহে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করা যায়। কেননা, এগুলো তৈরীই হয়েছে সর্ব সাধারণের জন্য। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন
ليس عليكم جناح أن تدلوا بيوتا مير مشگوئة فيها متاع
لكم و الله يعلم ما تبدون وما تكتمون—
ن و
س م م
যে ঘরে কেউ বসবাস করে না, তাতে তোমাদের মালামাল থাকলে সেখানে তোমাদের প্রবেশে কোনো দোষ নেই এবং আল্লাহ জানেন, যা তোমারা প্রকাশ করো এবং যা তোমারা গোপন করো।–সূরা আন নূর ও ২৯
হ্যাঁ, যে-সব লোককে এরূপ সাধারণ গৃহে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তাদের কথা স্বতন্ত্র।
বাসা-বাড়িতে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ
এছাড়া অন্যান্য গৃহ যেখানে মানুষ বাস করে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন
ايها الذين آمنوا لا تدخلوا بيوتاير بيوتكم حتی
م خیرلکم لعل
تستانسوا و تسلموا
হে মু’মিনগণগণ! তোমরা নিজদের গৃহ ব্যতীত অন্য কারো গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে ও তাদের সালাম না করে প্রবেশ করবে না। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করতে পার।–সূরা আন নূর : ২৭
কারো গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে শরীয়তী বিধানে অনুমতি নিতে হবে। চাই সে গৃহ তার নিজস্ব হোক, কিংবা ভাড়াটে। সে গৃহে মুহাররাম বাস করুক কিংবা গায়র মুহাররাম। পুরুষ বাস করুক কিংবা নারী–সবাস্থায়ই গৃহবাসীর অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ব্যতীত গত্যন্তর নেই। স্বয়ং গৃহকর্তা অনুমতি দিক অথবা তিনি যাকে অনুমতিদানের অধিকার দিয়েছেন, তার অনুমতি সপক্ষে।
অনুমতি প্রার্থনার ইসলামী পদ্ধতি
গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার সুন্নত পদ্ধতি হলো, সেখানে পৌঁছে সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইবে। অনুমতি পেলে ভিতরে প্রবেশ করবে। অনুমতি না দেয় তাহলে এমতাবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসবে। অনুমতির জন্য পীড়াপীড়ি বাড়াবাড়ি করবে না।
জোর জবরদস্তিও করবে না। আর অনুমতি প্রার্থনা করে সাড়া না পেলে তিন বার অনুমতির জন্য ইসলামী (সুন্নাত) পদ্ধতি অবলম্বন করবে। তৃতীয় বারও কোন উত্তর না পেলে ফিরে আসবে। এমন কি যে ঘরে কোন লোকজন আছে কিনা, সে সম্বন্ধে পরিষ্কার কোনো ধারণা না থাকবে, সে গৃহেও বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করছেন:
م م ۸, وا فيها احدا فلا تدخلوها حتی پوذن لكم وان
جدوا
فان
قيل لكم ارجوا فارجعوا هو أزكى لكم والله بماتعملون
তোমরা যদি গৃহে কাউকে না পাও, তাহলে তোমাদেরকে যতক্ষণ না অনুমতি দেয়া হবে ততক্ষণ গৃহে প্রবেশ করবে না। যদি তোমাদেরকে বলা হয় ফিরে যাও, তবে তোমরা ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম পন্থা এবং তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।–সূরা আন নূর ও ২৮
প্রশ্ন হচ্ছে, যে গৃহে কোনো লোকজনই নেই, সে গৃহে যাওয়ার তোমার কি অধিকার থাকতে পারে, যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ? আর গৃহবাসী যখন স্পষ্টভাবেই ফিরে যাও, বলে দিয়েছেন তখন তো গৃহে প্রবেশের কোন অবকাশই অবশিষ্ট থাকে না। তারপরও জোরপূর্বক
সেখানে গমন করা মানুষকে কষ্ট দেয়ার শামিল। আর মানুষকে কষ্ট দেয়া মারাত্মক অপরাধ।
দ্বিতীয়ত, এতে নিজেরও অপমান। অহেতুক কারো দ্বারস্থ হওয়া। এ কারণে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মত হল, যখন ফিরে যেতে বলা হয়েছে, তখন আর অনুমতি লাভের জন্য পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। পর্দা প্রথায় শৈথিল্য দেখাবে না এবং কারো দরজায় দাঁড়িয়েও অপেক্ষা করবে না। কেননা, এর কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। তাছাড়া এটা ভদ্রতারও পরিপন্থী। বরং ফিরে চলে যাবে। দরজা পিটানোর অনুমতি নেই। কাশশাফ প্রণেতা উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তা বিশদ ভাবে তুলে ধরেছেন।– কাশশাফ
গৃহে প্রবেশে অনুমতি প্রার্থনার গূঢ় রহস্য
গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার বিরাট তাৎপর্য ও বহু উপকারিতা রয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে অনুমতি প্রার্থনা, যাকে হাদীসের পরিভাষায় ইস্তীযান (অনুমতি প্রার্থনা) বলা হয়, ওয়াজিব এবং ওয়াজিবের ওপর আমল করা জরুরী।
দ্বিতীয়ত, হঠাৎ ভিতরে প্রবেশ করা স্বয়ং প্রবেশকারীর জন্য ক্ষতিকর অথবা গৃহকর্তার? আর এ উভয় অবস্থা থেকেই বেঁচে থাকা প্রতিটি মুসলিমের আবশ্যকর্তব্য।
তৃতীয়ত, অকস্মাৎ গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলে এমন কোনো স্থানে দৃষ্টি পড়ে যেতে পারে, যা দর্শন করা নিত্যন্ত অরুচিকর। স্বয়ং প্রবেশকারীর পক্ষেও এবং গৃহবাসী উভয়ের পক্ষে। কখনো এমনও হয় যে, অকস্মাৎ কোনো অপসন্দ কিংবা অবৈধ জিনিসের উপর দৃষ্টি পড়লে গোটা জীবনই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এ কারণে বিবেক ও বুদ্ধির দাবী হচ্ছে, কারো গৃহাভ্যন্তরে তার বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা অপরাধ।
যৌথ পরিবার–যেখানে একই পিতার একাধিক সন্তান সস্ত্রীক বসবাসরত–নীতিগতভাবে সেখানেও অনুমতি লাভ করা প্রয়োজন। কেননা, সেখানে গায়র মহাররাম নারীরা বাস করে। কিংবা নুন্যতম এমন কোনো পন্থা অবলম্বন করা উচিত, যাতে করে গৃহে প্রবেশ করার পূর্বে সেখানকার স্ত্রীলোকরা তা অবগত হয়ে নিজেদেরকে সামলে নিতে পারে। আর এরূপ পদ্ধতি প্রতিটি নারী মহলেই প্রবেশ করার সময় অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরী।
.
রাসূল (ছঃ) এর সাহাবাদের মধ্যে অনুমতি প্রার্থনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদেরকে হাতে-কলমে অনুমতি প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছেন। তাই হাদীসের গ্রন্থসমূহে এ সংক্রান্ত বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। অনুমতি প্রার্থনার অধ্যায়ে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
ك فان ابين لك والا فارجع
الإستيان
অনুমতি প্রার্থনা তিন বার। অতঃপর অনুমতি পাওয়া গেলে তো উত্তম। নতুবা ফিরে যাবে।–বুখারী-মুসলিম।
বনু আমের গোত্রের জনৈক ব্যক্তি বর্ণনা করেন, তিনি একদা নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন গৃহের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। দরজার নিকট পৌঁছে জিজ্ঞেস করলেন : ভিতরে আসার অনুমতি আছেঃ নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আওয়ায শ্রবণ করে তার খাদিমকে বললেন : আগন্তুক ব্যক্তির কাছে গিয়ে তাকে অনুমতি প্রার্থনার শরীয়তী পদ্ধতি বলে দাও। তাকে বলবে যে, তুমি এই ভাবে বলো, –আস্সালাম আলাইকুম, আমি কি ভিতরে আসতে পারি? আগত ব্যক্তি দরজায় দাঁড়িয়ে খাদিমের সাথে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরএই কথোপকথন শুনতে পেলেন এবং এবার বললেন :আস্সালামু আলাইকুম, ভিতরে আসতে পারি?নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে অনুমতি প্রার্থনা শ্রবণ করলেন, তখন তাকে অনুমতি দিলন। আগন্তুক ভিতরে প্রবেশ করলেন।–রিয়াদুস সালেহীন
সাহাবী কালিদা ইবনুল হাম্বল (রাঃ) বলেন, আমি একবার নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে বিনা সালামে উপস্থিত হলাম। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমকে বললেন, ফিরে যাও। অতঃপর বল, আস্সালামু আলাইকুম, ভিতরে আসতে পারি কি?
.
সাহাবায়ে কেরামের আমল-আখলাক
উপরোল্লিখিত হাদীস থেকে জানা গেলো যে, অনুমতি নিতে হলে প্রথমে সালাম জানিয়ে গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। সালাম ছাড়া অনুমতি প্রার্থনা করা সুন্নত বিরোধী পদ্ধতি। উপরোক্ত হাদীস থেকে আরো জানা গেলো যে, অনুমতি তিন বার চাইতে হবে। তৃতীয় বারও যদি অনুমতি না পাওয়া যায়, তবে ফিরে আসতে হবে।
হাদীসে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-এর ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি একবার হযরত উমর (রাঃ) নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলামী পন্থায় তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করেও কোনো সাড়া না পেয়ে ফিরে আসেন। হযরত উমর (রাঃ) তখন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কাজ শেষে আবূ মূসা (রাঃ) কে ডেকে পাঠালেন। খাদেম তাকে ডাকার জন্য বাইরে এসে দেখলো যে, তিনি চলে গেছেন। হযরত উমর (রাঃ) কে এ খবর জানানো হল। অতঃপর দ্বিতীয় বার কোনো এক কাজে হযরত আবু মূসা (রাঃ) এর আগমন করলে হযরত উমর (রাঃ) তাঁকে তাঁর চলে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, তিন বার আমি অনুমতি চেয়েছি, কিন্তু অনুমতি না পেয়ে চলে গিয়েছি। কেননা, আমি নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
إن استأذن أحدكم ثلاثا فلم يؤذن له فلينصرف
তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তিন বার অনুমতি প্রার্থনার পরও অনুমতি না পায়, তবে তাকে ফিরে আসতে হবে।–ইবনে কাছীর
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের ঘটনা। তিনি হযরত সাআদ ইবনে উবাদাহ (রাঃ) এর গৃহে তাশরীফ নিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিন বার সালাম সহকারে অনুমতি চাইলেন। কিন্তু তৃতীয় বারও কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ফিরে যেতেই হযরত সাআদ (রাঃ) দৌড়ে এসে রাসূল (ছঃ) কে ফিরিয়ে নিলেন।–ইবনে কাছীর
.
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারা নিষেধ
কারো গৃহে প্রবেশে অনুমতির প্রয়োজন এজন্য যাতে গৃহবাসীদের ওপর দৃষ্টি পড়ে না। যায়। স্বয়ং নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘটনা। তিনি একদা স্বীয় হুজরার মধ্যে বসে একটি লাঠি রা মাথা চুলকাচ্ছিলেন। ইত্যবসরে কেউ একজন দরজায় এসে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগল। রাসূল (ছঃ) একথা জানতে পেরে রাগান্বিত হলেন। বললেন, আমি যদি তখন জানতে পারতাম, তবে তার চোখ ফুড়ে দিতাম। সে কি অবগত নয় যে :
إثما جعل الإستيان من أجل البصر
সহসা দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার কারণেই অনুমতি প্রার্থনার বিধান করা হয়েছে।–বুখারী।
উক্ত কারণেই নীতিগতভাবে অনুমতি প্রার্থনাকারীকে দরজা থেকে দূরে সরে দাঁড়াতে হবে। ডান-বাম যেদিক ইচ্ছা দণ্ডায়মান হবে। দরজার সোজাসুজি সামনে দাঁড়াবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুশর (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন বাড়ীতে আগমন করতেন, তখন দরজার সামনে দাঁড়াতেন না। বরং দরজার ডান দিকে অথবা বাম দিকে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, আস্সালামু আলাইকুম, আসসালা-মু আলাইকুম। নীতিগত ভাবে দরজার সোজা সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি প্রার্থনা করা অনুচিত। কেননা, পর্দা উঠিয়ে কেউ ভিতর থেকে বাইরে বের হলে, তখন সামনে থেকে ঘরের ভিতরে নযরে পড়ে যায়।
অন্য এক হাদীসে উল্লেখ আছে, এক ব্যক্তি নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুজরার দরজায় এসে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইল। সে দরজার সোজা সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি ইঙ্গিতে বললেন, এদিকে (অর্থাৎ ডান দিকে) কিংবা এদিকে (বাম দিকে) দাঁড়াবে এবং তার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, অনুমতি প্রার্থনা দৃষ্টিপাতের কারণেই করতে হয়। -ইবনে কাছীর
গৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারা উচিত নয়। এই উঁকি-ঝুঁকি দরজার ফাঁক দিয়ে হোক কিংবা জানালা ইত্যাদি দিয়ে। কেননা, তাতে অনুমতির উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়ে যাবে। তাছাড়া পূর্বে জানা গেল যে, দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যই এই পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঁকি দেয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
لو أن إمرة اطلع عليك بغير إثني قذفته بجاق قفقات
به ما كان عليك من جناح۔
যদি কেউ অনুমতি ব্যতীত তোমার প্রতি উঁকি দেয় এবং তুমি তাকে পাথর তুলে মারার দরুন তার চক্ষু নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাতে তোমার কোন গুনাহ হবে না।-ইবনে কাছীর
রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতেই যে অপরাধের শাস্তি এতো কঠোর, অপরাধ হিসাবে তা যে কতো বিরাট, তা সহজেই বুঝা যায়।
.
অনুমতি প্রার্থনার সময় স্বীয় ব্যক্তির নাম বলবে
অনুমতি প্রার্থনার জন্য সালামের পর আওয়ায দিলে ঘর থেকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, কে তুমি? তাহলে অনুমতি প্রার্থনাকারী তার পরিচিত নাম বলবে–জওয়াবে একথা বলবে না যে, ৪৮১ LIআমি। কারণ তাতে আগমনকারীর সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না এবং তাতে গৃহবাসীদের পক্ষে অনুমতি দানও কঠিন হয়। রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্পষ্ট জওয়াবকে অপছন্দ করেছেন। এক বার হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) নবী (ছঃ) এর দরবারে আগমন করলেন। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গৃহাভ্যন্তর থেকে জিজ্ঞাসা করলেন কে’? হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) জওয়াবে বললেন, –/’ আমি’। নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ জওয়াব শুনে অসন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন–এই আমি আমি’ কি?–বুখারী, মুসলিম
উক্ত অনুমতি প্রার্থনা পদ্ধতি পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরামও শিক্ষাদান করেছেন। নিজেরাও স্বীয় জীবনে আমল করেছেন, আর অন্যদেরও আমল করার শিক্ষা দিয়েছেন।
.
মুহাররাম ব্যক্তিরাও অনুমতি চাইবে
এই অনুমতি মুহাররাম ব্যক্তিদের কাছ থেকেও নিতে হবে। অর্থাৎ নিজের মা, বোন প্রভৃতির কাছ থেকেও অনুমতি নিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। বরং এটা অতি প্রয়োজনীয়। অনুমতি প্রার্থনামূলক আয়াতের শানে নকূলে বলা হয়েছে যে, জনৈক আনসারী মহিলা রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আগমন করে অভিযোগ করলেন যে, কখনো কখনো আমি এমন অবস্থায় থাকি যে, তখন অন্য কেউ অবস্থার সাথে সাক্ষাৎ করুক, তা আমি পছন্দ করি না–সে আমার পিতা হোক, কিংবা পুত্র। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ঘটনা-চক্র তেমনটিই ঘটে থাকে। আমার অবিন্যস্ত অবস্থায় গৃহের লোকজন অবাধে আমার গৃহে যাতায়াত করে থাকে। তখন এই আয়াত নাযিল হলো-৭] :31:12 51 তোমরা গৃহে প্রবেশ কর না ..। হাদীসের বিভিন্ন ঘটনা দৃষ্টে বুঝা যায় যে, মুহাররাম ব্যক্তিকেও গৃহে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। নারী-পুরুষ কি জানি, গৃহের স্ত্রীলোকগণ কোন অবস্থায় আছে। সাধারণত উভয় পক্ষের কেউই স্ত্রীলোকদের অবিন্যস্ত অবস্থায় দেখতে চায় না। সবার জন্য উচিত ঘরে যদি শুধু নিজের স্ত্রীও থাকে, তবু তাকে অবস্থিত করে গৃহে যাওয়া উচিত। কেননা, স্বভাবত মানুষ নিজ স্ত্রীকেও বিবস্ত্র অবস্থায় দেখা পছন্দ করে না এবং স্ত্রীও তা চায় না।
.
পুত্রের জন্য মায়ের কাছেও অনুমতি প্রার্থনা
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপন মায়ের কাছ থেকেও অনুমতি নিতে হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই অনুমতি মায়ের নিকট থেকেও নিতে হবে। সে বলল, আমি তো তার সাথে ঘরে থাকি। তার এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মা তো আমার থেকে পর্দা করবেন না, তবু কি অনুমতির প্রয়োজন? রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাঁর নিকট থেকেও অনুমতি নিতে হবে। ওই ব্যক্তি বলল, আমি তার সেবা-যত্ন করি অর্থাৎ তাঁর কাছে অহরহ যাতায়াত করতে হয়, এরপরও যদি তাঁর কাছে যেতে প্রতিবার অনুমতি নিতে হয়, তাহলে জটিলতা বেড়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাকে বুঝিয়ে বললেন, নিজের মায়ের কাছে যেতে হলেও অনুমতি নিতে হবে। তুমি কি তোমার মাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পছন্দ করবেঃ সে বলল, না’ তিনি বললেন, এ জন্যই তো বলছি যে, অনুমতি নিয়ে তাঁর কাছে যাও।’–মুয়াত্তা ইমাম মালিক
.
পূর্বসূরীদের রীতি
হযরত যয়নব (রাঃ) বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) যখন কোনো প্রয়োজনে গৃহের ভিতরে আসতেন, তখন প্রথমে দরজায় এসে থমকে দাঁড়াতেন। কাশি দিতেন, থুক ফেলতেন, তারপর ভিতরে প্রবেশ করতেন। হঠাৎ না জানিয়ে আসা অপছন্দ করতেন। আর হযরত যয়নব হচ্ছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর মুহতারামা স্ত্রী।–ইবনে কাছীর
হযরত আবু উবায়দা (রাঃ) বলেন, হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) যখনই ঘরে আসতেন, তখন অনুমতি নিয়ে আসতেন। গৃহের দরজায় এসে জোরে আওয়ায় দিতেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেন, কোনো ব্যক্তি যখন স্বীয় গৃহে প্রবেশ করবে, তখন প্রথমে দরজায় এসে জোরে কাশি দেবে কিংবা স্বীয় জুতা দ্বারা জোরে আঘাত করবে, যাতে করে তার আগমন সম্পর্কে গৃহের ভিতর খবর হয়ে যায়।
অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে তিন সালামের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রথম গৃহবাসীর ওয়াকিফহাল হওয়া, দ্বিতীয় সালামে নিজেকে সামলে নেয়া এবং তৃতীয় সালামে অনুমতি কিংবা নিষেধ করা।
আল্লামা ইবনুল আরাবী (রঃ) লিখেছেন ও অন্যের ঘরে অনুমতি লাভ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু নিজ ঘরে অনুমতির প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ ঘরে যদি মা-বোন কেউ থাকেন, তখন আওয়াজ বা কাশি দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করবে কিংবা দরজায় এসে মাটিতে পা দ্বারা আঘাত করবে, যাতে করে গৃহের ভিতর মহলে তার আগমন টের পাওয়া যায়। কেননা, কখনো-কখনো মা-বোনও এমন অবস্থায় থাকেন, যে অবস্থায় আমরা তাদের দেখা পছন্দ করি না।–আহকামুল কুরআন
হযরত ইমাম মালিক (রঃ) বলেন, স্বীয় মা ও বোনের কাছে যেতে হলেও অনুমতি প্রার্থনা করবে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) সমীপে অনেকে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করেছেন : নিজের মা-বোন যে গৃহে থাকেন, সেখানে যেতে হলেও কি অনুমতির প্রয়োজন হবে? তারা উত্তর দিয়েছেন : হ্যাঁ, অবশ্যই নিতে হবে। পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করলে বুঝিয়ে বলেছেন : কোনো ব্যক্তিই স্বীয় মা-বোনকে বেপর্দায় দেখা পসন্দ করে না। তবু তোমরা অহেতুক বারবার পীড়াপীড়ি করছো কেন?–আহকামুল কুরআন
.
ইসলামে সতীত্বের গুরুত্ব
উপরোক্ত আলোচনা থেকে গভীর ভাবে চিন্তা করলেই দেখা যাবে, ইসলাম তার বিধি-বিধানের মধ্যে অন্যান্য রহস্য ও উপযোগিতার সাথে সাথে সতীত্ব ও যৌন পবিত্রতাকেও কত উত্তম ভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে এবং ওই সব মৌলিক বিষয়াদিতেও সতীত্ব ও যৌন পবিত্রতার প্রতি কত গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
.
বর্তমান যুগে পরিত্যক্ত
শত আফসোস! গৃহে প্রবেশের এই সব রীতি-নীতি-যা ইসলাম নির্ধারণ করেছে, কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে, হাদীস শরীফে তাকীদ দান করা হয়েছে, রাসূলে মকবুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমল করেছেন, সাহাবা কিরামকে শিক্ষা দিয়েছেন, সাহাবা কিরাম গোটা জীবন আনুগত্য করেছেন কিন্তু আফসোসের বিষয় আজ মুসলিম সমাজে এ সুন্দর পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয়েছে। মুসলিম পরিবারে তা অনুসৃত হয় না। আজকের প্রয়োজন হচ্ছে, এই সব বিষয়াদি ও আদব-আখলাক বাস্তবেও রূপদান করা। সত্য কথা হচ্ছে, যৌন পবিত্রতার যে সব উপাদান মহামহীম আল্লাহর বিধানে বিদ্যমান, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে যে বিধি-ব্যবস্থা বিধৃত হয়েছে, তা হল : বালেগ ও কিশোরের বিধান বর্ণনার পর মহা গ্রন্থ আল কোরআন ওইসব নাবালেগ ও কিশোরের বিধানও বর্ণনা করেছে, যারা চিন্তা-জ্ঞানের উপযুক্ত। গায়রে মুহররাম অর্থাৎ যাদের সাথে বিবাহ বৈধ তাদের থেকে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করতে হবে, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। শুধু প্রয়োজনবশত মুখমন্ডল ও দুই হাতের তালু খোলা যাবে। আর তাও যখন ফের আশঙ্কা না থাকে। যদি ফিন্যার ভয় থাকে তখন তাও ভোলা যাবে না। মুহাররামের বিধানও বর্ণিত হয়েছে। তাদের থেকেও দেহের সমুদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনিবার্যরূপে ঢেকে রাখতে হবে। শুধুমাত্র ওইসব স্থান ছাড়া-যা সাধারণত খোলা থাকে বা খোলা রাখা যায়। যেমন-মুখাবরব, হাতের তালু, বাহু, মাথা ও পায়ের পাতা প্রভৃতি। কিন্তু ভোলা রাখার অর্থ এই নয় যে, অহেতুক এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খোলা রাখবে। গোলাম স্ত্রীলোকের পক্ষে গায়র মুহাররাম সমতুল্য। তার থেকে পূর্ণ পর্দা করা আবশ্যক। অমুসলিম দাসীও মুহাররামের মত।
.
বিশেষ সময়ে সবার জন্য অনুমতি
এখানে আমি বলতে চাচ্ছি, যেসব নাবালেগ ছেলে ও দাসী মুহাররাম সমতুল্য, বিশেষ বিশেষ সময়ে তাদেরও পর্দা করার নির্দেশ রয়েছে। এই বিশেষ সময়গুলোতে ঐ সব নাবালেগ ছেলে ও দাসীদেরও অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে হবে। কেননা, এই সময়গুলোয় সাধারণত মানুষ খোলামেলা অবস্থায় থাকে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেনঃ
ايها الذين آمنوا ليستاذنكم الذين ملكت ايمانكم والذين لم يبلغوا الحلم منكم ثلث مرات من قبل صلوۃ الفجر وحين تضعون ثيابكم من الظهيرة ومن بعير صلوة العشاء ثلث عورات تكم ليس عليكم و عليهم جنا بعده طوافون عليگم بعضكم على بعض كذلك يبين الله لكم الايب والله عليم حكيم.
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীগণ এবং তোমাদের মধ্যে যারা না বালেগ তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে। ফজরের নামাযের পূর্বে, দ্বিপ্রহরে যখন তোমরা বিশ্রামের উদ্দেশ্যে বস্ত্র শিথিল কর তখন এবং এশার নামাযের পর। এ তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তা অবলম্বনের সময়। এ তিন সময় ছাড়া অন্য সময়ে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে তোমাদের জন্য এবং তাদের জন্য কোনো দোষ নেই। তোমাদের একজনের তো অপর জনের নিকট যাতায়াত করতেই হয়। এ ভাবে আল্লাহ তোমাদের নিকট তাঁর নির্দেশ সুস্পষ্ট ভাবে বিবৃত করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। -সূরা আননূর ঃ ৫৮
উক্ত আয়াতে তিনটি বিশেষ সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে ও এক, ফজর নামাযের পূর্বমুহূর্তে। এ সময়টি প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রিয় ও নিদ্রাভঙ্গের মুহূর্ত। রাতের অচেতনে সাধারণত এই সময় সতর’ খোলা থাকে। গভীর নিদ্রা হেতু সতর ঢাকার উদ্যোগ আয়োজন থাকে না। দ্বিতীয় সময়টি দ্বিপ্রহরের। এ সময় মানুষ দুপুরের খাবার খেয়ে কায়লুলা বিশ্রাম করে। দুপুরের খানা খেয়ে শয্যায় আরাম করাকে শরীয়তে কায়লুলা বলা হয়। এটা সুন্নত। কিছুক্ষণ খোলামেলা ভাবে বিশ্রাম নেয়। গ্রীষ্মকালে সাধারণত মানুষ এ সময় স্বীয় কক্ষে নিদ্রামগ্ন থাকে। কোন কোন লোক শীত-গ্রীষ্ম উভয় সময়ই দুপুরে ঘুমায়। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষ নিদ্রা ও গাফলতীতে বেখবরই অধিকতর হয়। তৃতীয় সময় এশা নামাযের পর। এটিও প্রধানত নিদ্রার সময়। মানুষ সারা দিনের শ্রান্তি নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। এ সময় সবাই বিশ্রাম করে বলে সেও বেপর্দায় শয়ন করে। কাপড় এলোমেলো থাকা স্বভাবিক।
উপরন্তু এই তিন সময়ই বিবাহিত লোক কমবেশি তার স্ত্রীর সাথে খেল-তামাশা করে। সুতরাং শিশু ও দাসদাসীরাও আওয়াজ দিয়ে ও অনুমতি নিয়ে ভিতরে যাবে। না জানিয়ে কখনো যাবে না। কেননা, লজ্জা শরমের ব্যাপার হলে মানুষ লজ্জায় প্রিয়মান হয়ে পড়ে। অন্তরে ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করে। দাসী ও পরিচারিকা যেহেতু বালেগা হয়ে থাকে, সেহেতু স্বয়ং তারাও লজ্জা পায়। এই সময়গুলো ব্যতীত যেহেতু এই সব অবস্থা সাধারণত হয় না, তাই বিশেষ কোন যাতায়াতে কঠোরতা নেই। তাছাড়া, শিশুদের বিরত রাখাও মুশকিল। তারা সারাক্ষণ আসা-যাওয়া করতেই অভ্যস্ত। একই অবস্থা ক্রীতদাসীও পরিচারিকাঁদেরও। তারাও কাজের জন্য আসা-যাওয়া করতে বাধ্য।
কোনো কোনো মুফাসসির লিখেছেন : প্রথমোক্ত আয়াতসমূহে অপরিচিত লোকদের অনুমতির কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াতে বলা হয়েছে নিকট আত্মীয়-স্বজনদের অনুমতির কথা। অর্থাৎ যারা মুহাররামের অন্তর্ভুক্ত। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ লিখেছেন : প্রথমোক্ত আয়াতে অনুমতির নির্দেশ ছিল সাধারণ ভাবে সাধারণ লোকদের জন্য সব সময়ের জন্য। আর এ আয়াতে নির্দেশ হচ্ছে বিশেষ বিশেষ লোকদের জন্য বিশেষ বিশেষ সময়ে এবং এটিই অধিক সহীহ।
এ আয়াতে এ<L, L-এর অর্থ নিছক দাসী। কেননা, দাস গায়র মুহাররামের অন্তর্ভুক্ত এরা পুরুষদের মধ্যে যাতায়াত করতে পারবে, কিন্তু নারী মহলে যাওয়ার অনুমতি নেই। বিশেষ সময়গুলোতে তাদের ওপরও পর্দার বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাদের যাতায়াতে কোন ক্ষতি নেই। এটা হচ্ছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন। এটা যুক্তি-বুদ্ধির দিক থেকেও খুব উপযোগী।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহ আলাইহি উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যামূলক তরজমায় লিখেছেন:
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ক্রীতদাসগণের পক্ষে এবং তোমাদের মধ্যে যারা পূর্ণ বয়সে পৌঁছেনি, তাদের পক্ষে তোমাদের নিকট যাতায়াতের জন্য তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করা উচিত। প্রথমত, ফজরের নামাযের পূর্বে এবং দ্বিতীয়ত যখন বিশ্রামের উদ্দেশ্যে দ্বিপ্রহরে স্বীয় পোশাক যখন খুলে রাখে এবং তৃতীয়ত ইশার নামাযের পর। এই তিনটি সময় তোমাদের পর্দার সময়। অর্থাৎ স্বভাবত এবং সাধারণত এসব সময় তোমাদের একান্তে মিলন ও বিশ্রামের সময় এবং তাতে প্রায় লোকই নিঃসংশয়ে অবস্থান করে থাকে। সুতরাং তোমাদের ক্রীতদাস এবং নাবালেগ শিশুদেরকে বুঝিয়ে দাও, যেন তারা অনুমতি গ্রহণ ও সংবাদ দেয়া ছাড়া তোমাদের নিকট না আসে। কেননা, অনুমতি গ্রহণের কারণ এতে পাওয়া যাচ্ছে। আর উক্ত তিন সময় ব্যতীত অনুমতি গ্রহণ ছাড়া তাদেরকে আসতে দেয়ায় এবং নিষেধ না করায় না তোমাদের কোনো দোষ আছে এবং না বিনা অনুমতিতে চলে আসায় তাদের কোন দোষ আছে। কেননা, এরা তোমাদের নিকট প্রায়ই যাতায়াত করে থাকে।
হানাফী মাযহাবের মতে এ আয়াতের মর্ম হল, ক্রীতদাসরা তো তোমাদের পুরুষদের নিকট আসা-যাওয়া করে থাকে-স্ত্রীলোকদের নিকট নয়। কেননা, ক্রীতদাসের বিধান বেগানা পুরুষের ন্যায়। আর ক্রীতদাসী ও নাবালেগ শিশুরা তোমাদের স্ত্রী-পুরুষ সকলের নিকটই আসা যাওয়া করে থাকে। সুতরাং প্রত্যেক সময় অনুমতি গ্রহণ করা অধিক কষ্টসাধ্য। আর যেহেতু এটা পর্দার সময় নয়, তাই আবরণীয় অঙ্গগুলোকে আবৃত রাখা কিছুই কঠিন ব্যাপার নয়। অতএব, পুরুষ তো শুধু ক্রীতদাসের সমক্ষে নাভি হতে হাঁটুর নিম্ন পর্যন্ত আবৃত রাখবে এবং স্ত্রীলোকেরা বিধর্মিনী ক্রীতদাসীদের সামনে। অলঙ্কারাদি পরিধানের স্থানসমূহ ব্যতীত বাকী সকল অঙ্গই ঢেকে রাখবে এবং পুরুষদের ক্রীতদাসীর সামনে-যদি সে তার জন্য হালাল হয়-শরীরের কোন অঙ্গই ঢেকে রাখা জরুরী নয়, আর যদি হারাম হয়, তবে নাভি হতে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখবে। আর স্ত্রীলোকেরা মুসলমান দাসীদের সামনে শুধু নাভি হতে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখবে। সুতরাং এই পরিমাণে ঢেকে রাখা কোন কষ্টকর নয়। এ কারণই এমতাবস্থায় বিনানুমতিতে প্রবেশ বৈধ। আর নাবালেগ শিশুর সম্মুখে পুরুষরা শুধু হাঁটু হতে নাভি পর্যন্ত এবং স্ত্রীলোকেরা অলঙ্কারের স্থান ব্যতীত অপর সমস্ত অঙ্গই ঢেকে রাখবে-এও কষ্টকর নয়। পক্ষান্তরে তারা আসা-যাওয়া অধিক করে বলে প্রত্যেক সময় অনুমতি নেয়া বিরক্তিকর। আর উপরোক্ত তিন সময় ছাড়াও যদি কোনো প্রাসঙ্গিক কারণ বাধা স্বরূপ দাঁড়ায়, তখনও অনুমতি নেয়া ওয়াজিব হবে। তবে উপরোক্ত অবস্থাগুলো নির্দিষ্টরূপে উল্লেখ করার কারণ এই যে, স্বভাবত এরূপ অবস্থারই উদ্ভব হয়ে থাকে।
এই বিধান আল্লাহ তা’আলা যেমন সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন, অনুরূপভাবে তিনি তার সমস্ত বিধি-বিধান তোমাদের নিকট সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে থাকেন। এবং আল্লাহ তা’আলা সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। অতএব, সর্বপ্রকার কল্যাণ ও উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টি রয়েছে এবং নির্দেশ প্রদান কালে তিনি তার প্রতি লক্ষ্য রেখে থাকেন।-বয়ানুল কুরআন
.
অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর অনুমতি নেবে
যাদের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ও তার কাছাকাছি হওয়ার পূর্বে বিশেষ সময়গুলোতে বিধি-নিষেধ ছিলো, তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ইসলাম সাধারণ সময়সমূহেও অনুমতির কড়াকড়ি আরোপ করেছে। উপমহাদেশে প্রচলিত নিয়ম হল, শৈশবে যারা যাতায়াত করে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তাদের যাতায়াত অব্যাহত থাকে। স্ত্রীলোকেরা ঐ সব শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তাদের সাথে পর্দা করে না। এ প্রথাসম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও শরীয়ত বিরোধী। আমাদের পর্দানশীন পরিবারেও এ প্রথা প্রচলিত আছে। অথচ ইসলাম কঠোর ভাবে এ থেকে বারণ করেছে এবং সুস্পভাবে নির্দেশ দিয়েছে যে, শিশু যখন বালেগ হবে, তখন তাকেও অনুমতি নিতে হবে। বালেগ হওয়ার পূর্বেকার আযাদী অব্যাহত থাকবে না।
আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন :
وإذا بلغ الأطفال بينكم الحكم فيشتانيوا كما استأذن الذين من
قبلهم كذلك يبين الله أيته والله عليم حكيم.
আর তোমাদের সন্তান-সন্ততি বয়োপ্রাপ্ত হলে তারাও যেন তাদের বয়োজ্যষ্ঠদের এত অনুমতি প্রার্থনা করে। এইভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।–সূরা আন নূর ও ৫৯
বালেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ শিশুদের কেবল তিনটি বিশেষ সময়েই অনুমতি প্রার্থনার নির্দেশ ছিল, কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর এখন কোন সময়ের তরেই বিনা অনুমতিতে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করবে না। অন্যদের মতোই তাদের জন্যও অনুমতি প্রার্থনা একান্ত প্রয়োজন। কেননা, ইতিপূর্বে নাবালেগ থাকার দরুন তাদের কোন পর্দাজ্ঞান ছিল না। না খোদ তাদের জন্য নিজেদের মধ্যে কোনো আকর্ষণ ছিল, না অন্যদের জন্য তাদের মধ্যে কোন আকর্ষণ ছিল। কিন্তু এখন তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। স্বয়ং তারা নিজেদের মধ্যে একটি পরিবর্তন অনুভব করছে। অন্তর আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে। অন্যরাও তাদের দিকে আকর্ষণ বোধ করতে পারে। তাই স্বভাবতই বিধানও পরিবর্তন জরুরী।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা থানভী (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন:
আর যখন তোমাদের স্বাধীন শ্রেণীর মধ্য হতে সেই বালকগণ, যাদের বিধান ওপরে বর্ণিত হয়েছে, বালেগের সীমায় উপনীত হয়, অর্থাৎ বালেগ কিংবা বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী হয়, তখন তাদের পক্ষেও তদ্রপ অনুমতি গ্রহণ করা উচিত, যতদ্রুপ তাদের থেকে অধিক বয়স্ক ব্যক্তিরা অনুমতি নিয়ে থাকে। এরূপে মহান আল্লাহ তা’আলা তোমাদের নিকট তাঁর নির্দেশাবলী পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ তা’আলা মহাজ্ঞানী ও মহাকৌশলী। এই অংশটির দ্বিরুক্তি এই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে যে, অনুমতি গ্রহণরূপ বিধানের যৌক্তিকতা অধিক পরিষ্কার এবং তার বিধি-বিধানসমূহ খুবই লক্ষ্য করার বিষয়। অতএব, দ্বিরুক্তির দ্বারা তার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।–বয়ানুল কুরআন, ৮ম খণ্ড
.
এর তাফসীর
পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, নারীর সমস্ত দেহ সতর’ এবং তা ঢেকে রাখা আবশ্যক। মুখাবয়ব ও হাতের কবযি ব্যতীত। যেদিকে কুরআন পাক। দ্বারা ইঙ্গিত করেছে। এখানে 4EL–এর মর্মার্থ অনুধাবনে কারো ভুল ধারণা জন্মিতে পারে। কেউ তার পরিবেশ অনুসারে মনে করতে পারে যে, ওইগুলো সব সময়ের জন্য উন্মুক্ত রাখা জায়েয। তাই এখানে এসে আল্লাহ তা’আলা ku–এর মর্মার্থ সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং 4 L দ্বারা যেনো কোন প্রকার ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হতে না পারে, তা চমৎকারভাবে নিরসন করেছেন : মুখাবয়ব ও হাতের কবযি যদিও এ L-এ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দরুন সত্ত্বাগত সতর নয়, তবু তার অর্থ এই নয় যে, অযথা এসব উন্মুক্ত রাখবে। বরং তাও অপ্রয়োজনীয় সময়ে গায়রে মুহাররাম থেকে আবৃত রাখা ওয়াজিব, যাতে ফিত্না-ফাসাদের শিখা জ্বলে উঠতে না পারে। তবে থুথুড়ে বুড়ি তার ওইসব অঙ্গ 41 L খোলা রাখতে পারে, যদিও তা লুকিয়ে রাখাই উত্তম। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
والقواعد من النساء اللاتي لا يرجون نكاحا فليس عليهن جناح ان يضعن ثيابهم غير متبرجات يزينة وان يستعففن خير لهن والله سميع
যে সব বৃদ্ধ মহিলা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্য দোষ নেই যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বহির্বাস খুলে রাখে। তবে এর থেকে তাদের বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।–সূরা আন নূর ও ৬০
.
মুখাবয়ব ঢেকে রাখার নির্দেশ
যেখানে বয়স্ক নারীকে তার সৌন্দর্যের স্থানসমূহ উন্মুক্ত রাখতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে যুবতী নারীর তা অহেতুক খোলা রাখার অনুমতি কি করে বৈধ হতে পারে? মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) লিখেন?
আর একটি জানার বিষয় আছে যে মুখাবয়ব ও হাত পায়ের পাতাকে ঢেকে রাখার হুকুম হতে বাদ রাখা হয়েছে তার অর্থ শুধু এই যে, এ অঙ্গ মূলত আবরণীয় অঙ্গ নয়, প্রয়োজন বিশেষে মুক্ত রাখতে পারে। এ অর্থ এই নয় যে, স্ত্রীলোকেরা স্বাধীনভাবে পর পুরুষকে নিজ মুখাবয়ব দেখিয়ে বেড়াবে। কেননা, ফিত্নার আশঙ্কায় তাও ঢেকে রাখা ওয়াজিব। অবশ্য যেখানে ফিন্যার আশঙ্কা না থাকে, যথা, যে সকল বর্ষিয়সী বৃদ্ধা স্ত্রীলোকগণের কারো বিবাহাধীন আসার আশা নেই, অর্থাৎ যারা মূলেই আকর্ষণীয় নাই, …….. তাদের পক্ষে অবশ্য এ কথায় কোনো অপরাধ নেই যে, তারা তাদের ওই সমস্ত অতিরিক্ত কাপড় বেগানা পুরুষের সামনে খুলে রাখে, যার সাহায্যে মুখবয়ব ইত্যাদি ঢেকে রাখে। কিন্তু সাজ-সজ্জার স্থানসমূহ মুক্ত করতে পারবে না-যা বেগানা পুরুষের সামনে মুক্ত করা একেবারেই নিষিদ্ধ। অতএব শুধু মুখবয়ব ও দু’হাতের পাতা এবং মতান্তরে দু পায়ের পাতাও মুক্ত রাখা বৈধ। পক্ষান্তরে ফিত্নার আশঙ্কায় যুবতী স্ত্রীলোকদের পক্ষে মুখাবয়ব ইত্যাদিও ঢেকে রাখা আবশ্যক। কিন্তু কোন শরীয়ত সম্মত কারণে তাও মুক্ত রাখতে পারে। আর যদিও বৃদ্ধা স্ত্রীলোকগণের পক্ষে স্বীয় মখাবয়ব মুক্ত রাখার অনুমতি রয়েছে, তথাপি যদি তা হতেও সতর্কতা অবলম্বন করে, তবে তাদের পক্ষে আরো উত্তম।–বয়ানুল কুরআন, ৮ম খণ্ড
আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেন :
وإنما تم القواعد پذلك دون يره إثرافي النفوس وثه ولا يشتهوفن پالسر الكاولي ځي له من فعل المباح له من وضع
অন্যদের আলোচনা বাদ দিয়ে বিশেষ করে বৃদ্ধা নারীদের কথা বলার কারণ হচ্ছে, প্রবৃত্তি তাদের প্রতি বিমুখ থাকে। তবু যদি তারা পূর্ণ পর্দা অবলম্বন করে, তা হবে নিঃসন্দেহে উন্মুক্ত রাখার মতো মুবাহ কাজের চেয়ে উত্তম।–আহকামুল কুরআন।
ফকিহগণ লিখেছেন ও চেহেরা যদিও সতরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়, তবুও নারীদেরকে লোক সমাজে চেহারা খুলতে বিরত রাখতে হবে। যাতে কোনো ফেৎনা সৃষ্টি হতে না পারে। প্রক্বতি নারীর চেহারায় এমন কিছু আকর্ষণ রেখেছে, যা দেখে পুরুষ তার প্রতি অনায়াসে আক্বষ্ট হয়। পুরুষের অন্তরে স্বাভাবিক কামভাব জাগ্রত হয়।
আল্লামা ইবনে আবেদীন লিখেছেন :–
والمعنى تمنع من الكشفي خوف أن يرى الرجال وجهها فتقع
الفتنة إنه مع الكشف قديقع النظر إليها بشهوة—
নারীর মুখাবয়ব খুলতে বিরত রাখতে হবে, যাতে পুরুষেরা তা দেখে ফেৎনায় না জড়ায়। কেননা, মুখাবয়ব খোলা থাকলে কখনো তাতে কামভাব দৃষ্টি নিপতিত হয়।–রদ্দুল মুত্তার।
.
পাতলা কাপড় পরিধান কারীণী উলঙ্গ
পূর্বোক্ত আয়াতের 104 21: বাক্যটি দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, নারী এমন কোন পাতলা কাপড় পরিধান করবে না, যা সতর আচ্ছাদনকারী নয়, বরং তাতে সৌন্দর্য আরো অধিক প্রস্ফুটিত হয়। ইবনুল আরাবী লিখেছেন:
ومن البرج أن تلبس المرأة ثوبا رقيقا يقها–
যে মসৃণ পাতলা কাপড় নারী দেহের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে, তা পরিধান করাও সৌন্দর্য প্রকাশের অন্তর্ভুক্ত।–আহকামুল কুরআন
এ পর্যায়ে তিনি এই হাদীসটি বিবৃত করেন ও নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
كاسيات عاريات مائلات مميلات لا يدخلن الجنة ولا يجدون ريحها–
অনেক কাপড় পরিধানকারী নারী উলঙ্গ। নিজেরাও অন্যের প্রতি আক্বষ্ট হয়, অপরকেও নিজের দিকে আক্বষ্ট করে। এরা বেহেশতে প্রবেশ করবে না। বেহেশতের ঘ্রাণও পাবে না। –আহকামুল কুরআন
ইবনুল আরবী হাদীসটি উদ্ধৃত করে লিখেছেন, এই হাদীসেকাসিয়াত (কাপড় পরিধানকারিণী)-এর পরআরিয়াত (উলঙ্গ) বলার কারণ হল, এরা এমন সব পাতলা পিনপিনে কাপড় পরিধান করে, যা পরা না পরারই সমান। এরপর তিনি বলেন, যে পাতলা কাপড় দ্বারা পূর্ণ সতর ঢাকা হয় না, তা পরিধান করা হারাম।–আহকামুল কুরআন
পূর্বে আমরা এই আয়াতটি উল্লেখ করেছি?
وقرن في بيوتكن ولا تبرجن تبرج الجاهلية الأولى–
এবং তোমরা (নারীরা) গৃহে অবস্থান করবে বর্বর জাহেলি যুগের মতো নিজদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না।–সূরা আল আহযাব : ৩৩
উম্মে আলকামা (রাঃ) বর্ণনা করেন : একদা হযরত হাফসা বিনতে আবদুর রহমান (রাঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) নিকট উপস্থিত হলেন। হযরত হাফসা (রাঃ) পাতলা চিকন কাপড় পরিহিতা ছিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) জামাটি নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন এবং তার পরিবর্তে একটি মোটা কাপড়ের জামা তাঁকে পরিয়ে দিলেন।–মিশকাত
উল্লেখ্য হাফসা (রাঃ) ছিলেন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর ভাইয়ের মেয়ে।* অপর একটি রেওয়ায়েত হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন : একদা আসমা বিন্তে আবূ বকর (রাঃ) রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট তশরীফ আনল। সে পাতলা কাপড় পরিহিতা ছিলেন। রাসূল (ছ) অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন :
یا اسماء إن المرأة إذا بلغت المحيض لن يصلح أن يزي منها إلا
هذا وهذا أشار إلى وجهه وكفيه .
হে আসমা! নারী যখন প্রাপ্ত বয়স্কা হয়, তখন তার চেহারা ও হাতের তালু ছাড়া অন্য কিছু দেখা বৈধ নয়।–মিশকাত
সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
خذ عليك وبك و تمشوا راه–
নিজকে কাপড়ে ঢেকে ফেলো। উলঙ্গ (বেপর্দা) ঘুরে বেড়াবে না।–মিশকাত
উক্ত হাদীস এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীস থেকে জানা যাচ্ছে যে, নারী ও পুরুষ উভয়কেই এমন কাপড় পরিধান করা উচিত, যাদ্ধারা সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা যায় এবং ব্যক্তির রূপ-সৌন্দর্য সহজে প্রকাশ না পায়। এর ফায়দা হচ্ছে-সতীত্ব, সচ্চরিত্রতা ও নিষ্কলঙ্ক থাকবে। বাহ্যত বা বস্তুত কোনো কলঙ্কই যৌন পবিত্রতার সীমা স্পর্শ করতে পারবে না।
নারীর পর্দা সম্পর্কে যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল, চিন্তা করলে আপনারা এতে বিরাট রহস্যের সন্ধান পাবেন। প্রাচ্য ও পাশ্চত্যের বেপর্দা নারীদের দৈনন্দিন ঘটনা যদি আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তবে তো এটি অনুধাবন করা আরো সহজ ব্যাপার হবে।
.
ইসলামের দৃষ্টিতে সতীত্বের শত্রু
সতীত্ব ও সচ্চরিত্রতা, ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বীন ও দুনিয়ার বিরাট অমূল্য সম্পদ। যদিসতীত্ব ও সচ্চরিত্রতার বিধি-বিধান অনুসৃত না হয়। সন্দেহ নেই, দুনিয়া থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে-আমল-আখলাক বরবাদ হয়ে যাবে-যদি অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী না হয়।
গোটা বিশ্ব ইতিহাসেরচরিত্র অধ্যায় পাঠ করুন এবং চিন্তাভাবনা করে দেখুন, মানুষের স্বভাব-চরিত্র সবচেয়ে বেশি কোন্ জিনিসের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বনাশ হয়েছে : বরং সাথে সাথে এর পর্যালোচনা করুন যে, দেশ ও জাতির অধপতনের মূল কারণ কি ছিলো? আমার মনে হয়, এক বাক্যে সবাই একথা মানতে বাধ্য হবেন যে, যৌন পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতা সংরক্ষণের কোন বলিষ্ঠ বিধানাবলী না থাকার দরুনই এ সমস্ত চারিত্রিক অধপতন ও নৈরাজ্যের গহ্বরে পতিত হয়েছে।
.
অপবাদ আরোপ
ইসলামী শরীয়ত একারণে মানব জীবনের নীতি-আদর্শে কারো প্রতি কোনো রকম অনুগ্রহ দেখায়নি। ব্যভিচার ও ব্যভিচারী সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আপনারা এ গ্রন্থের শুরুতে পাঠ করে এসেছেন। যারা সতীত্ব ও সচ্চরিত্রতাকে কলঙ্কিত কিংবা কারো ইযযত সম্মান ও যৌন পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করতে প্রয়াসী, ইসলাম তাদের সম্পর্কে কি বিধি-বিধান দিয়েছে, এখানে তাই আলোচনা করা হবে।
যদি কোন ব্যক্তি কোন সতী-সাধ্বী নারী কিংবা সচ্চরিত্র পুরুষের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে, ইসলামের দৃষ্টিতে সে অভিশপ্ত। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন।
إن الذين يرمون المحصنات الغافلات المؤمنات تونوا في الدنيا والأخرة ولهم عذاب عظيم . يوم تشهد عليهم السنتهم وأيديهم وأرجلهم بما كانوا يعملون . يومين وفيهم الله وينهم الحق و يعلمون ان الله هو الحق المبين .
যারা সতী-সাধ্বী, পুত-পবিত্র নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের যবান, তাদের হাত ও তাদের পদযুগল, তাদের ক্বতকর্ম সম্বন্ধে। সেদিন আল্লাহ তাদেরকে তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দিবেন এবং তারা জানবে, আল্লাহ-ই সত্য স্পষ্ট প্রকাশকারী।–সূরা আন নূর : ২৩-২৫।
উক্ত আয়াত গভীরভাবে চিন্তা করলেই অনুধাবন করা যাবে, অপবাদ রটনাকারীদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ, ভীতি প্রদর্শন কতো কঠোর ঘৃণামিশ্রিত। দুনিয়াতেও এরূপ ব্যক্তিকে অভিশপ্ত বলা হয়েছে এবং আখেরাতেও।
.
অপবাদ রটানোর শাস্তি
কেউ কোন সতী-সাধ্বীকে (যার প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপিত হবে, তার মধ্যে যদি পাঁচটি শর্ত বিদ্যমান থাকে এবং অপবাদকারীর মধ্যে তিনটি শর্ত, তাহলে তাদের উপর দণ্ড ওয়াজিব। ব্যভিচারে অভিযুক্তের পাঁচটি শর্ত হচ্ছে : প্রাপ্ত বয়স্ক, সজ্ঞান, মুসলমান, স্বাধীন ও সচ্চরিত্র হওয়া এবং অভিযোগকারীর শর্ত হচ্ছে : প্রাপ্ত বয়ষ্ক, সজ্ঞান ও স্বাধীন হওয়া।) ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ করল, কিন্তু চারজন চাক্ষুষ শরয়ী সাক্ষী পেশ করতে পারল না, অপবাদ দাতাকে আশিটি বেত্রাঘাত করতে হবে এবং ভবিষ্যতে তার কোন সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেন :
والذين يرمون المحصن ثم لم يأتوا بأربعة شهداء فاجلدوهم
مين جلدة ولا تقبلوا لهم شهادة أبدا . وأولئك هم الفاسقون ۔
যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি যেনার অপবাদ আরোপ করে এবং তার সপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরাই ফাসিক।–সূরা আন নুর : ৪
বস্তুত ইসলামে সতীত্ব ও সচ্চরিত্রতার মূল্য যে কতখানি, তা এই একটি মাত্র আয়াত থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। একটি মাত্র অপরাধের দরুন ওই অপবাদকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহ কোরআন পাকে তিনটি শাস্তি প্রবর্তন করেছে। অর্থাৎ সে যদি তার দাবীর সপক্ষে চারজন সাক্ষী পেশ করতে না পারে, তাহলে (এক) তাকে আশিটি বেত্রাঘাত লাগাবে, (দুই) ভবিষ্যতে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না, সে যেন নিকৃষ্টতম মিথ্যাবাদী, (তিন) তার ওপর চিরতরে ফাঁসিকের লেবেল বা মোহর এঁটে গেল।
.
ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের ইযযত-সম্ভ্রম
কোনো নেককার মুসলমানের সম্মানহানি এমনিতেই কোন মামুলী অপরাধ নয়। একজন মুসলমানের জীবনের মূল্য যতখানি, তার মান-ই্যুতের মূল্যও কম নয় বরং অধিক। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলে মকবুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন, তন্মধ্যে ইযত-সম্ভ্রম অন্যতম। তিনি বলেন : পবিত্র মক্কা-মুকাররমার মধ্যে যিলহজ্জ মাসে আরাফাতের দিনটি যেমন পবিত্র, মুসলমানের ইযত-সমও ঠিক ততোখানি পবিত্র। –রিয়াযুস সালিহীন আল্লামা নববী রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
كل المسلم على المسلم حرام مره وماله ودمه.
এক মুসলমানের নিকট অপর মুসলমানের ইজ্জত-সম্ভ্রম, ধন-সম্পদ ও রক্ত হারাম। -রিয়াদুস সালেহীন
এবং অপবাদ আরোপকারীর এই কর্মকাণ্ড নিম্নোক্ত আয়াতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য
إن الذين يرون أن تشيع الفاحشة في الذين آمنوا لهم عذاب أليم
في الدنيا والآخرة–
যারা মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ও প্রচার কামনা করে, তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।–সূরা আন নূর ও ১৯।
যদি একথা ধরেও নেয়া যায় যে, অপবাদ দাতা সত্যবাদী, তবু যখন সে জানে যে, আমি চারজন শরয়ী সাক্ষী যোগাড় করতে সমর্থ হবে না এবং শরয়ী সাক্ষী ছাড়া দণ্ড কার্যকর হতেও পারে না, তখন এমতাবস্থায়ও তাকে অপবাদ আরোপ থেকে বিরত থাকা উচিত। কেননা, এরূপ যার নামে অপবাদ দেয়া হচ্ছে, তার যেমন অহেতুক অপমান, তেমনি নিজেরও শাস্তি ও জরিমানা। সুতরাং এ সংক্রান্ত অপবাদ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। তবে হ্যাঁ, স্বয়ং ব্যভিচারীকে সামাজিক কুফল ও আল্লাহর শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। তাতে সওয়াবও পাবে এবং অপরাধীও তার অপরাধ থেকে তওবা করতে পারে। কিন্তু সে যদি অভিযোগের প্রমাণ স্বরূপ চারজন শরয়ী সাক্ষী পেশ করে দেয় এবং শরীয়ত মুতাবিক তার ব্যভিচার প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে আর কোন শক্তি তাকে আইনের শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তার ওপর হদ বা দণ্ড কার্যকর হবে। বিবাহিত হলে প্রস্তরাঘাত, অন্যথায় আশি বেত্রাঘাত।
.
ইসলামে শাস্তির শ্রেণীবিন্যাস
এ শাস্তি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একথা জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, ইসলামে অপরাধের শাস্তি সাধারণত তার সমশ্রেণী রূপে নির্ধারিত হয়েছে। অর্থাৎ অপরাধ যে শ্রেণীর বা যতটুকু হবে, তাকে শাস্তিও সেই ততটুকু দেয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ চোরের শাস্তি হাতকাটা। কারণ এ কাজে হাতের ভূমিকা প্রধান। ডাকাতির শাস্তি শরীয়তে নির্ধারণ হয়েছে এক হাত ও এক পা কাটা। স্পষ্টতই ডাকাতির অপরাধ চোরের চেয়ে অধিক।
অতঃপর একটু চিন্তা করলে এটাও জানা যায় যে, ইসলাম তার দন্ডবিধিকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। একটি নাম হদ’ এবং অপরটি হচ্ছে তা’যীর’। আপনি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, যে সব পাপ বা অপরাধের প্রতি মনের টান থাকে, কেবল সেইসব অপরাধকেই হদ’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এবং তাতেও শাস্তির মধ্যে মনের প্রবণতা ও টান অনুপাতে হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। চুরি, ডাকাতি, মদ্যপান, অবৈধ যৌনাচার প্রভৃতি হদ’-এর অন্তর্ভুক্ত।
নিসন্দেহে ব্যভিচারের প্রতি মানুষের মন অতি তাড়াতাড়ি আক্বষ্ট হয় এবং তার প্রতি মানব মন বড় আকর্ষণ ও বাহ্যত বড় আনন্দ অনুভব করে। অতএব ইসলাম তাকে হদ’-এর মধ্যে গণ্য করেছে এবং এ অপরাধের শাস্তি বিধানে খুবই কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। নমনীয়তার কোনো নাম-নিশানা এতে নেই। আর দন্ড বা শাস্তিও বড়ই শিক্ষণীয় ও যন্ত্রনা দায়ক।
.
ব্যভিচারের শাস্তি ও অপরাধের ধরন
ইতিপূর্বে যে মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, সে অনুসারে ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারী নারীর শাস্তি হওয়া উচিত ছিলো ব্যভিচারীর লজ্জাস্থান কেটে দেয়া এবং বিশেষভাবে ব্যভিচারীর সংশ্লিষ্ট অংশকে শাস্তি দেয়া। কিন্তু ইসলাম তা করেনি। তার কারণ হল, ব্যভিচারে মৈথুন সংঘটিত হয়। আর এ এক স্বীক্বত সত্য যে, মৈথুন ও যৌন মিলনে কেবল বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পুলক অনুভব করে না, বরং তখন শরীরের প্রতিটি অঙ্গে এই আনন্দ-বিদ্যুৎ গতিতে প্রবাহিত হয়। এবং বিশেষ এক মুহূর্তে মানুষের প্রতিটি লোম পর্যন্ত স্বাদ ও পুলক অনুভব করে। তাই ইসলাম ব্যভিচারের শাস্তিও দেহের প্রতিটি লোম পর্যন্ত পৌঁছে এরূপ নির্ধারণ করেছে, যাতে কষ্টটা বাহ্যত সমস্ত শরীরে পৌঁছে যেমন অবৈধভাবে আনন্দ পৌঁছেছিল।
লজ্জাস্থান বা অঙ্গবিশেষ কর্তন করে দিলে শাস্তির উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো না। কেননা, শাস্তির মাধ্যমে কষ্টদানের সাথে সাথে অপরাধীকে হেয় প্রতিপন্ন ও ভীতিপ্রদর্শনও উদ্দেশ্য। প্রতিটি ব্যক্তি যেন দেখতে পায় যে, এই শাস্তি অমুক অপরাধের। আর সবার জানা কথা যে, ব্যভিচারের বিশেষ অঙ্গের অবস্থান গোপন স্থানে হওয়ার দরুন সেখানে কারো দৃষ্টি পড়াই সম্ভব নয়। চোরের হাত কাটা গেলে তা সবার দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্তু লজ্জাস্থানে কারও নজর পড়ে না। দৃষ্টি থেকে গোপন থাকে।
দ্বিতীয়তঃ শাস্তি অপরাধকে অতিক্রম করে যেতো। কেননা, ব্যভিচারের অঙ্গবিশেষ কর্তন করে দিলে বংশ বিস্তার বন্ধ হয়ে যেত। এছাড়া, অঙ্গ বিশেষ কর্তনে মৃত্যু অনিবার্য না হলেও মৃত্যুর আশংকা অধিক।
মোট কথা, এসব কারণে দেহের অংগ বিশেষ’ কর্তনকে ইসলাম ব্যভিচারের শাস্তি নির্ধারণ করেনি!
অতঃপর একটু চিন্তা করলে একথাও বুঝা সহজ হবে যে, চোর-ডাকাতের সাজায় যেমন প্রার্থক্য আছে, অনুরূপভাবে বিবাহিত ও অবিবাহিতের ব্যভিচারের শাস্তির মধ্যেও পার্থক্য হওয়া জরুরী। সুতরাং ইসলাম সেদিকেও পূর্ণ দৃষ্টি রেখেছে এবং এ উভয় শ্রেণীর শাস্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নিরূপণ করেছে।
.
ব্যভিচারীর শাস্তি কি
এ সব বিষয় জানার পর এখন আসুন, আমরা দেখি, ইসলাম ব্যভিচারের শাস্তি কী নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে ঘোষণা করেন :
الراية والژانی فاجلدوا كل واحد منهما مائة جلدة ولا تأخذكم بهما
رافة في دين الله إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الأخر .
ব্যভিচারি নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ উভয়কে এক শত বেত্রাঘাত করবে। আল্লার বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি কোন রকম দয়া যেননা তোমাদেরকে অভিভূত না করে যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হও।’–সূরা আন নূর ও ২
কোরআনের শব্দের অবতারণের ভাষা ভঙ্গি দেখে মনে হয়, ইসলাম যেনার শাস্তির ব্যাপারে তার সমস্ত দয়া-মায়া শিকেয় তুলে রেখেছে। তার ক্রোধের তরবারি কোষমুক্ত। অপরাধীর শাস্তি সুস্পষ্ট। শাস্তিদাতাকেও সাবধান করে দিয়ে বলা হচ্ছে যে, যেন কোন রকম দয়া ও অনুকম্পা না দেখা হয়?
যার সামনে ইসলাম তথা কুরআন হাদিস সতীত্ব ও সচ্চরিত্রতার গুরুত্ব বর্ণনা করেছে, ব্যভিচারের অপকারিতা ও তার দীনী ও দুনিয়াবী ক্ষতি তুলে ধরেছে, বৈধ উপায়ে বিবাহের মাধ্যমে যৌন ক্ষুধা নিবৃত্তির অনুমতি প্রদান করেছে এবং এতোসব সত্ত্বেও সে আল্লাহর নিধারিত। সীমা লংঘন করেছে, তার উপর কিভাবে অনুকম্পা প্রদর্শন করা যেতে পারে?
বলাবহুল্য এরূপ ক্ষেত্রে মানুষ এই ভেবে দয়ার্দ্র হয় যে, এটি মানব জাতির স্বাভাবিক যৌন চাহিদা বিধায় সে কখনো কখনো পরাভূত হয়ে পড়ে। অতপর যা-কিছু সংঘটিত হয়, উভয়ের সম্মতিতেই ঘটে। তাই এ কারণেও সম্ভবত এখানে নির্দয় হওয়ার জন্য জোর তাকীদ দান করা হয়েছে। আয়াতে এই শয়তানী ওয়াসওয়াসা কঠোরভাবে রদ করা হয়েছে।
.
ব্যভিচারীর শাস্তি প্রত্যক্ষভাবে
নির্দয়ভাবে একশত বেত্রাঘাত করা ব্যতীত এটাও কোরআনী নির্দেশ যে, ব্যভিচারী ব্যক্তি যখন তার চারিত্রিক পবিত্রতাকে কলঙ্কিত ও কুলষিত করেছে, আসমান-যমীন যখন তার শরম-লজ্জা তথা ব্যভিচারের কুফল বহন করেছে, তখন তার শাস্তি বিধান অন্তরালে কেন হবে? বরং সে শাস্তি হবে ঈমানদারদের একটি দলের উপস্থিতিতে, যাতে তা ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করে এবং অন্য লোকদের জন্যও তা শিক্ষার বিষয় হয়।
وليشه عذابهما طائفة من المؤمنين—
মু’মিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’–সূরা আন নূর ও ২
মমিন দলের উপস্থিতি দ্বারা হয়ত এটাও উদ্দেশ্য যে, তারা অবগত থাকবে যে, ওই অপরাধী ব্যভিচারের মাধ্যমে যে স্বাদ উপভোগ আত্মস্থ করেছে, তা সুযোগ পেলে তাকে আদৌ ক্ষমা করবে না, বরং দ্বিতীয় বার তাকে উক্ত অপরাধে উদ্বুদ্ধ করবে। সুতরাং তার থেকে সব সময় সাবধান থাকতে হবে।
কোরআন করীমের এই আয়াত–
الزاني لا ينكح إلا زانية أو مشركة والزانية لا يثيرها الا ان أو
ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশবিকদেরকেই বিবাহ করবে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিকরাই বিবাহ করবে।’–সূরা আন নূর ও ৩।
উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ব্যভিচারীর প্রথম দৃষ্টি ব্যভিচারের প্রতি থাকলেও উক্ত অপকর্মের দরুন তার শাস্তি স্বরূপ ব্যভিচারের নেশা তার মজ্জাগত হয়ে যায়। তাই এরূপ ব্যক্তি সম্পর্কে সাবধান থাকা খুবই জরুরী।
.
ব্যভিচারী নারীর ওপর বিধি-নিষেধ
ব্যভিচারী নারী সম্পর্কে কোরআনের উক্ত আয়াত থেকেই বুঝা যায় যে, যখন তার বেহায়াপনা প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখন সমাজে তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন সে ঘর থেকে বের হতে না পারে। কেননা, তার বহির্গমন সব দিক থেকে ইসলামের জন্য ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। হয়ত সে নিজেই অন্য কোন ব্যভিচারীমূলক কাজের সুযোগ সন্ধান করে নেবে, অথবা অন্য কোনো দুষ্ট পুরুষ তাকে অনর্থক উত্ত্যক্ত করবে–যদিও এ উত্ত্যক্ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোক না কেন। কেননা, এটা সত্য কথা যে, একবার যে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে, দ্বিতীয় বার তার দ্বারা সে কাজ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব নয় বরং সহজ। তবে সে অবিবাহিত হয়ে থাকলে বিবাহের মাধ্যমে তার সংশোধন হতে পারে। কোরআনের যে উক্তি দ্বারা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ
ت حتى يتوفهن الموت او يجعل الله
والتي ياتين الفاحشة من ساءكم فاستشهدوا عليه اربعة منكم
فان شهدوا فاسكوهن في البي لهن سيڈ ۔
তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাদের এ ব্যভিচারের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য হতে চারজন সাক্ষী তালাশ করবে। যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে তাদেরকে গৃহে অবরুদ্ধ করে রাখবে, যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় অথবা তাদের জন্য আল্লাহ অন্য কোনো ব্যবস্থা করেন।’–সূরা আন নিসা : ৩
যদিও আলেমদের এক দলের মতামত হচ্ছে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ব্যভিচারিণীর এই শাস্তিই ছিলো। কিন্তু এখন তা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু এটাও তো হতে পারে যে, এ আয়াত রহিত হয়নি, বরং ব্যভিচারের শাস্তি পূর্বোক্ত আয়াতের এক শত বেত্রাঘাতই বহাল আছে এবং এ আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে দণ্ড কার্যকর করার পর ব্যভিচারিণী যাতে ঘর থেকে বেরুতে না পারে, তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা। তাহলে তার সম্মানের ওপর কোন আঘাত আসবে না। যেমন–এ মতের সপক্ষে কাশশাফ গ্রন্থের লেখকের বক্তব্যেরও সমর্থন রয়েছে। তিনি লিখেছেন
و جوان تكون ممر مثشوخة بأن يترك ذكر الخير يكويه معلوما بالكتاب والشير ويوضی پاماليون في البيوت بعد أن يجدون صيانة لهن عن تمثل ماجرى عليه بسبب الخروج من البيوت والعرض
এমনও হতে পারে যে, এ আয়াতটি মানসুখ বা রহিত হয়নি এবং কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা নির্দিষ্ট হওয়ার দরুন এখানে দণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। আর এখানে ব্যভিচারিণীর ওপর দণ্ডবিধি কার্যকর করার পর তাকে গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ রাখার জোর তাকীদ দেয়া হয়েছে, যাতে সে গৃহ থেকে বেরিয়ে পুরুষদের কবলে পড়ে শাস্তি থেকে মুক্তি পায়।–তাফসীর-ই-কাশশাফ
যা হোক, এতোটুকু অবশ্যই হওয়া উচিত যে, ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারী নারীর সাথে এমন ব্যবহার করতে হবে, যাতে সে এ কথা বুঝতে সক্ষম হয় যে, আমি যা করেছি তা ভীষণ অন্যায় করেছি, এবং এতোই খারাপ যে, তা সমাজ ও সমাজিক বাধন বরদাশত করতে কিছুতেই বাযী নয় আর এভাবে সে তার ক্বতকর্মের ওপর অনুতপ্ত হবে। কোনো শব্দ বা বাক্য দ্বারাই যেন তার এই পাপকর্মের সপক্ষে কোন সমর্থনের দিক-নির্দেশ না হয়, যাতে সমাজ ও ব্যক্তির উপরও এর প্রভাব পড়ে।
ফিকাহবিদদের মতে, ব্যভিচারের সংজ্ঞা হচ্ছে–বুদ্ধিমান বালেগের লিঙ্গের অগ্রবাগ এরূপ কোন নারীর যোনিতে প্রবেশ করা–যে তার স্ত্রীও নয়, আর এ রমণক্রিয়া কোন প্রকার সন্দেহ সংসয় বা চাপের কারণেও হয়নি।
উপরে যে শাস্তির আলোচনা হয়েছে, তা স্বাধীন, বুদ্ধিমান, বালেগ ও অবিবাহিতার। উল্লেখিত ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় ব্যভিচার করে, তবে তার শাস্তি একশত বেত্রাঘাত। এই বেত্রাঘাত মন্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগন হবে। শুধু মুখ ও যে-সব অংঙ্গে আত লাগলে মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তা ব্যতীত।
.
ব্যভিচারী বিবাহিত হলে প্রস্তরদণ্ড আইন
আর এই বুদ্ধিমান ও বালেগ ব্যক্তি যদি স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে বিবাহিতও হয় অর্থাৎ শরয়ী বিবাহের পর স্বীয় স্ত্রীর সাথে সহবাস করে থাকে, অর্থাৎ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ব্যভিচার করে তবে তার দন্ড হচ্ছে সাঙ্গেসার। অর্থাৎ এরূপ ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে।
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, আসলাম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছঃ) এর দরবারে হাযির হয়ে সে ব্যভিচার করেছে বলে স্বীকার করল এবং নিজের বিরুদ্ধে সে ব্যভিচার করেছে একথার চার বার সাক্ষ্য দিল। এ কথা শুনে রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দিলেন। কারণ সে ছিল বিবাহিত।-বুখারী
এমন ধরনের একটি ঘটনা হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মসজিদে অবস্থান করছিলেন, ইত্যবসরে এক আগন্তুক এসে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলল : হে আল্লাহর রাসূল! আমি ব্যভিচার করেছি। একথা শুনে প্রথম তিনি মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু সে তার ওই কথা একে একে চার বার বলল। তার চার বার সাক্ষ্যদানের পর রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি পাগল? সে বললো : না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি বিবাহিত? সে বলল : হ্যাঁ। এ বার রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন–একে নিয়ে যাও এবং প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ডকার্যকর কর।–বুখারী
হযরত মায়িয আসলামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গেসারের ঘটনা হাদীসের গ্রন্থ সমূহে প্রসিদ্ধ। তিনি নিজেই রাসূলের দরবারে উপস্থিত হয়ে অপরাধ স্বীকার করেন। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) প্রথম এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু তিনি একে একে চার বার স্বীকারোক্তি করলেন। চার বার স্বীকারোক্তির পর তিনি তাকে সাজেসার করার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তাকে সাজেসার করা হয়।–বুখারী
.
রজম বা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের যথার্থতা
কোরআন মজীদে রজমের বা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ডের কথা স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে অস্বীকার করতে হবে। কারণ, সহীহ হাদীসে এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত বিদ্যমান, স্বয়ং রসূল (ছঃ) এর বাণীতেও পরিষ্কার রজমের নির্দেশ আছে।
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনৃহু অনেক পূর্বেই স্বীয় শাসনামলে এই শংকা প্রকাশ করে তা নিরসন করেছিলেন। ওমর (রা.) বলেন
ن حتى يقول قائل لانجد الرجم في
لقد خشيت ان يطول الناس زمان كتاب الله فيستوا بتربي فريضة أنزلها الله الأ وإن الرجم حق على من
ئي وقد أحصن إذا قامت البيئة أو كان الحمل أو الإعتراف
আমার আশংকা হচ্ছে, এমন এক সময় অতিক্রান্ত হবে, যখন কেউ না কেউ বলবে, আমরা আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআনে রজমের কোনো নির্দেশ দেখতে পাই না। যদি এমনটি হয়, তবে তারা এই বিধানটি ত্যাগ করার দরুন পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। একথা জেনে রাখো, যখন শরয়ী দলীল-প্রমাণ বা স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে, তখন বিবাহিত ব্যভিচারীকে রজম লাগানো স্বতঃসিদ্ধ ফায়সালা।-বুখারী
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর এই আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়েছে এবং পরবর্তী কালে কিছু কিছু ব্যক্তি তা-ই বলেছে–যা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেন। কিন্তু আল্লাহর শোকর। তাদের সে কথা তাদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে এবং মুসলিম উম্মাহ এ পাপকর্ম থেকে বেঁচে রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ উম্মাহর নিকট রজমের নির্দেশ সম্পূর্ণ সত্য ও বিধিসঙ্গত এবং মুসলিম সমাজে রজমের বিধানই প্রচলিত আছে!
যুক্তি জ্ঞানও রজমকে সমর্থন করে। কেননা, বিবাহিত ও অবিবাহিতের শাস্তির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য হতে হবে এবং তার বাহ্যরূপ এটাই।
দ্বিতীয় অবিবাহিত ব্যক্তির সঠিক পথে ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা যে, বিবাহ দ্বারা তার যৌন ক্ষুধা নিবারণের পথ খুলে যাবে। আর তার মধ্যে এ ব্যভিচার অবশিষ্ট থাকবে না। পক্ষান্তরে বিবাহিত ব্যক্তি যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে সমাজে তা সংক্রামক ব্যাধির রূপ ধারণ করার আশংকা থাকে। তাই মুসলিম জগত থেকে তার অস্তিত্ব মুছে ফেলাই উত্তম।
.
রজমের পদ্ধতি
যদি বিবাহিত পুরুষ ও নারীর ব্যভিচার প্রমাণিত হয়, তবে তাকে সাজেসার (প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ড) করা হবে। সাজেসারের নিয়ম হচ্ছে–এক উন্মুক্ত প্রান্তরে ব্যভিচারীকে নিয়ে যাবে। সেখানে বিচারক ও সাক্ষীগণ উপস্থিত থাকবেন। যদি স্বীকারোক্তি দ্বারা এই রায় হয়ে থাকে, তবে বিচারক প্রথম শুরু করবে এবং সাক্ষ্য দ্বারা ব্যভিচার প্রমাণিত হলে সাক্ষী সর্বপ্রথম আরম্ভ করবে। অর্থাৎ সর্বপ্রথম সে সাক্ষী প্রস্তর উত্তোলন করে তার ওপর নিক্ষেপ করবে অতঃপর সাধারণ জনগণ। আর এভাবে প্রস্তর আঘাতে তাকে চিরতরে নিঃশেষ করে দিতে হবে। ব্যভিচারিকে সাজেসার করতে হলে তার জন্য গর্ত খনন করতে হবে এবং তার দেহের অর্ধাঙ্গ গর্তের মধ্যে গেড়ে দিতে হবে। তাহলে নগ্ন হওয়ার ভয় থাকবে না।