পূর্ণাঙ্গ মোকছুদুল মোমিনিন বা বেহেশতের পথ
[১ম খণ্ড থেকে ২০তম খণ্ড একত্রে]
হযরত মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক
নয়া দিগন্ত প্রকাশন
ভূমিকা
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পারলৌকিক নাজাতের জন্য ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তাফসীর ও হাদীস এবং বিভিন্ন মূল্যবান ইসলামী গ্রন্থাবলী সামনে রেখে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল বিষয়ের যরূরী মাসয়ালা-মাসায়েলকে সন্নিবেশিত করে পূর্ণাঙ্গ মোকছুদুল মোমিনিন বা বেহেশতের পথ গ্রন্থখানা প্রণয়ন করা হয়েছে।
গ্রন্থখানা সর্বমোট বিশ খণ্ডে সমাপ্ত করা হয়েছে। প্রথম খণ্ডে, ইসলামের পরিচয় ঈমান দ্বিতীয় খণ্ডে কালেমার বর্ণনা, তাহরাত বা পবিত্রতা, চতুর্থ খণ্ডে ছলাত বা নামায, পঞ্চম খণ্ডে নামাযের নিয়্যত সমূহ ষষ্ঠ খণ্ডে, নামাযের প্রয়োজনীয় সূরাসমূহ, সপ্ত খণ্ডে ছহু সেজদা ঈদের নামাযের মাসায়েল, তাহাজ্জুদ নামায ও অন্যান্য নফল নামায, অষ্টম খণ্ডে সপ্তাহের নফল নামায, নবম খণ্ডে রোযার বিবরণ, দশম খণ্ডে হজ্জের বিবরণ, ১১তম খণ্ডে যাকাতের বিবরন, ১২তম খণ্ডে পারিবারিক জীবন, ১৩ তম খণ্ডে যৌন পবিত্রতা ও বিবাহের লক্ষ্য উদ্দেশ্য, ১৪তম খণ্ডে শিশুর যত্ন, ১৫তম খণ্ডে সামাজিক জীবন, ১৬তম খণ্ডে পরকালের বিবরণ, ১৭তম খণ্ডে কোরআনে যিকির, ১৮তম খণ্ডে পাঞ্জে সূরা, ১৯তম খণ্ডে দুরূদ শরীফ, ২০তম খণ্ডে বার মাসের নফল ইবাদতের বর্ণনা করা হয়েছে।
গ্রন্থখানা প্রণয়ণে যেসব নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য কিতাবসমূহের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে তন্মধ্যে নিম্নে কয়েক খানার নাম উল্লেখ করা হল।
কোরআন শরীফ তাফসীরে মারেফুল কোরআন, তাফসীর ইবনে কাসীর, তরজমায়ে কোরআন মজিদ, তাফহীমুল কোরআন, হাদীসগ্রন্থ : বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজা, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত। ফিকাহ ও আলমগীরী, হেদায়া, দুররুল মুখতার, প্রাগুক্ত, শামী, শরহে বেকায়া, কাযীখান, নাফেউল খালায়েক ইত্যাদি। ইসলামী গ্রন্থ : বেহেশতী জেওর, . দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ফাজায়েলে আমাল, মরণের পরে কি হবে ইত্যাদি।
আশা করি গ্রন্থখানা বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম ভাইবোনদের কিছুটা হলে প্রয়োজন পূরণ করবে। এ গ্রন্থখানা থেকে তারা যদি সামান্যও উপকৃত হন, তবে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে। সর্বশেষ সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করি তিনি যেন আমাদের পরিশ্রম কবুল করেন।
–আমিন গ্রন্থকার
পরম করুনাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা এ গ্রন্থখানা প্রকাশ করতে পেরে তাঁর লক্ষ কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। যাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গ্রন্থখানা প্রকাশ করতে পেরেছি তাঁদের নিকট আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। এ গ্রন্থ খানা নির্ভুলভাবে প্রকাশ করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এর পরেও কোন ভুল-ত্রুটি পাঠক পাঠিকার দৃষ্টিতে ধরা পড়লে আমাদেরকে অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে ইনশাআল্লাহ সংশোধন করার ওয়াদা করছি।
প্রকাশক
.
প্রথম খণ্ড– ইসলাম
ইসলামের পরিচয়
আরবি ভাষায় ইসলাম বলতে আনুগত্য ও বাধ্যতা বুঝায়। আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর বাধ্যতা স্বীকার করে নেয়া এ ধর্মের লক্ষ্য বলেই এর নাম হয়েছে ইসলাম।
ইসলাম আল্লাহ্ তাআলার মনোনীত একমাত্র দ্বীন–একমাত্র পিরপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ ব্যবস্থার আলোকে একজন মুসলমানকে জীবন যাপন করতে হয়। এতে রয়েছে সুষ্ঠু সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থ ব্যবস্থা। মানব চরিত্রের উন্নতি সাধন, ন্যায়নীতি ও সুবিচার ভিত্তিক শান্তি-শৃংখলাপূর্ণ গতিশীল ও সুন্দর সমাজ গঠন ও সংরক্ষণে ইসলামের কোন বিকল্প নেই। এতে আরো রয়েছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নীতিমালা। পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন
إن الدين عند الله الإسلام
ইসলামই আল্লাহ্ প্রদত্ত একমাত্র দ্বীন।–(সূরা আলে ইমরান : ১৯)। কালাম পাকে এরশাদ হয়েছে :
ومن يبتغ غير الإسلام دينا فلن يقبل مثه
অর্থ : কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন বা জীবন বিধান গ্রহণ করতে চায় তা কখনো গৃহীত হবে না।–(সূরা আলে ইমরান : ৮৫)
হাদীস শরীফে নিম্নলিখিতভাবে ইসলামের সংজ্ঞা ও পরিচয় দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন :
الإسلام أن تشهد ان لااله الا الله وأن محمدا رسول الله وتقيم الصلوة وتؤت الثروة وتوم رمضان وتحج البيت إن استطعت اليه
بيلا
অর্থ : ইসলাম হল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (ছঃ) আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দেয়া, নামায কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানের রোযা রাখা এবং বাইতুল্লাহ্ শরীফে হজ্জ আদায় করা যদি সমর্থ থাকে।–(বুখারী ও মুসলিম)।
ইসলাম মূলত সকল নবী-রাসূলের প্রচারিত দ্বীন। হযরত আদম (আঃ) থেকে আরম্ভ করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) পর্যন্ত এ দুনিয়া যত নবী রাসূল এসেছেন তারা সকলেই মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন এবং এর আলোকেই আপন আপন উম্মাতকে গড়ে তুলেছেন।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-ই সর্ব প্রথম নিজ ধর্মের নাম ইসলাম এবং তাঁর উম্মাতকে উম্মাতে মুসলিমা বলে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে।
ربنا واجعلنا ممشليمين لك ومن ذريتنا أمة مشيمة لك
অর্থ : হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে মুসলিম বানাও এবং আমাদের বংশধর হতেও তোমার এক অনুগত উম্মাত বানাও।–(সূরা বাকারা : ১২৮)
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর সন্তানদের বলে গেছেন :
فلا تموتن الا وانتم مسلمون
মুসলিম না হয়ে তোমরা কেউ মৃত্যুবরণ করো না।–(সূরা বাকারা : ১৩২)
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-ই সর্বাগ্রে উম্মতে মুহাম্মদীকে এ নামে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে।
ملة أبيكم إبرهيم هو سماكم المسلمين من قبل و في هذا
অর্থ : এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের জাতী। তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম এবং এ কিতাবেও।–(সূরা হজ্জ : ৭৮)।
বস্তুত নবী-রাসূলদের প্রচারিত দ্বীনে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিল না। তবে প্রত্যেকের শরীয়াত ছিল পৃথক পৃথক। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
لكل جعلنا منكم شرعة ومنهاجا
অর্থ : আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরীয়াত ও সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।–(সূরা মায়িদা : ৪৮০)
হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী-রাসূলদের যে ধারাবাহিকতা আরম্ভ হয়েছিল তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)-এর মাধ্যমে। তিনি আখেরী নবী। তার পর আর কোন নবী-রাসূল আগমণ করবেন না। তাঁর আগমণে পূর্ববর্তী সমস্ত শরীয়াত স্থগিত হয়ে গেছে। তাই এখন ইসলাম বলতে হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) কর্তৃক প্রচারিত শরীয়াতকে এবং মুসলিম বলতে উম্মতে মুহাম্মদীকেই বুঝাবে। এ হিসাবে ইসলামের সংজ্ঞা হচ্ছে নিম্নরূপ :
هو تضييق سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم في جميع ماجاء
به عن الله تعالى مما علم مجيئه ضرورة
অর্থ : আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নবী করীম (ছঃ) যে জীবন বিধান নিয়ে এসেছেন, তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করাকে বলা হয় ইসলাম।
প্রকৃতপক্ষে নবী করীম (ছঃ)-এর দেখানো পথে নিজেকে আল্লাহর নিকট সঁপে দেয়া এবং পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করার নামই হল ইসলাম। যে আত্মসমর্পণ করে তাকেই বলা হয় মুসলমান। ইসলাম গ্রহণের পর কারো ইসলাম পরিপন্থী নিজস্ব খেয়াল-খুশির অনুসরণের কোন সুযোগ থাকে না। সে তো আল্লাহর গোলাম। তার জীবন-মরণ সব কিছুই এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
وما كان مؤمن ومؤمنة إذا قضى الله و رسوله أمرا أن يكون
لا مبینا
وله فقد
امرهم ومن يعص الله
উচ্চারণ : অমা-কা-না লিমুমিনিও অলা-মুমিনাতি ইযা-ক্বাদ্বোয়াল্লা-হু অ রাছুলুহু আমরা আইয়্যাকূনা লাহুমুল খিয়ারাতু মিন্ আমরিহিম; অমাই ইয়াছিল্লা-হা অরাসূলাহ্ ফাক্বাদ দ্বেয়াল্লা দ্বলা-লাম্ মুবীনা-।
অর্থ : আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফয়সালা করে দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ফয়সালার অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। (সূরা আহযাব ৩৬)
মানুষের স্বভাব ধর্ম। মানুষের স্বভাব ধর্ম ইসলাম। আল্লাহ্ পাক মানুষকে যে সহজাত প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তা-ই হল স্বভাবজাত ধর্ম। হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে :
كل مولود يولد على الفطرة
অর্থ : প্রতিটি শিশুই ইসলামের উপর জন্মগ্রহন করে।
এ কারণেই প্রতিটি মানুষের মধ্যে উচ্চতর শক্তির সামনে আত্মসমর্পনের সহজাত প্রেরণা দেখা যায়। ভক্তি গদগদ হৃদয়ে সে নিজেকে একান্তভাবে সঁপে দিয়ে পেতে চায় আত্মিক পরম তৃপ্তি। এ সুপ্ত প্রেরণাকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে অনেক সময় মানুষ দিভ্রান্ত হয়েছে। কেউ বা আবার চন্দ্র-সূর্যকে মহাশক্তি মনে করে সেগুলোর কাছে মস্তকাবনত করেছে। আবার কেউ বা অগ্নি পুজারি হয়েছে। আবার কেউ নিজের চেয়ে অধিকতর শক্তিধর মানুষের নিকট নিজেকে সমর্পণ করেছে। কখনো তারা নিজেদের কল্পিত দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করে সেগুলোর সামনে। মাথা নত করেছে। আবার কখনো অহংকারে ফুলে ফেঁফে নিজেকেই প্রভু বলেছে। এক কথায় মানবতার ক্রমবিকাশের সকল স্তরে এ সহজাত প্রেরণা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এক মুহূর্তের জন্যও মানুষ এর থেকে মুক্ত হতে পারেনি। অপরদিকে মানুষের এ সহজাত প্রেরণার চাহিদা এটাই ছিল যে, মানুষ এমন এক মহা শক্তির সামনে নিজেকে সমর্পণ করবে যিনি সকল শক্তি, সকল ক্ষমতা ও সৌন্দর্যের উৎস; মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে যার অবস্থান, যিনি মানুষের সকল দাবী ও চাহিদা পূরণে সম্পূর্ণ সক্ষম এবং তাদের সহজাত প্রেরণা ও উচ্ছ্বাসকে তৃপ্ত করতে পারেন। আর এই পূর্ণতম সত্তাই হলেন মহান রাব্বল আলামীন। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।
قاقم وجهك لدين حنيفا فطرت الله التي فطر الناس عليها
تبديل لخلق اللي ذلك الدين القيم ولكن أكثر التالي لا يعلمون–
উচ্চারণ : ফাআকিম অজ্বহাকা লিদ্দীনি হানীফান; ফিত্বরাতাল্লা-হিল লাতী ফাত্বোয়ারান না-ছ আলাইহা-; লা-তাবদীলা লিখালকিল্লা-হি; যা-লিকাদ দীনুল কাইয়্যিমু অলা-কিন্না আকছারান না-ছি লা-ইয়ালামূন।
অর্থ : তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দ্বীনে কেন্দ্রীভূত কর। আল্লাহর সেই প্রকৃতির উপর, যার উপর আল্লাহ সর্বতোভাবে সত্য নির্ভুল মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।–(সূরা রূম : ৩০)
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) আল্লাহ্ তাআলার প্রেরিত আখেরী নবী। কোরআন তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আখেরী কিতাব। তাঁর আগমনের পর পূর্ববর্তী শরীয়াত ও কিতাব সবই রহিত হয়ে গেছে। এরপর আর কোন নবী আসবেন না এবং কোন কিতাবও নাযিল হবে না। যারা এ আকীদা পোষণ করবেন তারা মুসলিম। আর যারা পোষন করবে না, তারা অমুসলিম-কাফের।
ইসলাম একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এতে কোন খুঁত বা অপূর্ণতা নেই। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
اليوم أكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم
الإسلام دينا۔
অর্থ : আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন সম্পূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন বিধান হিসেবেমনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদাঃ ৩)
পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ হয়েছে :
ونزلنا عليك الكتاب تثيانا كل شئ
অর্থ : আর আমি আপনার প্রতি এমন কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেকটি বিষয়েরই সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী।–(সূরা নাহল : ৮৯)
এতে এ কথা প্রতিমান হয় যে, মানব জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুর নীতি-নির্ধারণী বিবরণ পবিত্র কোরআনে আছে। প্রয়োজনীয় জ্ঞানানুশীলনের মাধ্যমে নবী করীম (ছঃ)-এর পবিত্র জীবনাদর্শ অনুযায়ী সবকিছুই নির্ধারণ করতে হবে। মুজতাহিদ ইমামরা তাঁদের সম্পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেছেন এ কাজে। মানব জাতির জীবন-যাপন পদ্ধতির পরিপূর্ণ ও সুষ্ঠু সমাধান তুলে ধরেছেন তাঁরা বিস্তারিতভাবে। এই জীবন ব্যবস্থায় কোনরূপ অপূর্ণতার কথা ভাবা যায় না। মানুষের ঈমান-আকীদা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনের মূলনীতিসমূহ ইসলামে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যা পরিপূর্ণ এবং অতুলনীয়। এতে কোন কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করার আদৌ কোন অবকাশ নেই।
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এমন এক জীবন বিধান যা ভারসাম্যপূর্ণ, স্বভাবসম্মত এবং মানবিক সামর্থের উপযোগী। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।
لا يكلف الله نفسا إلا وسعها–
অর্থ : আল্লাহ্ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব অর্পন করেন না যা তার সাধ্যের বাইরে।–(সূরা বাকারা : ২৮৬)
ইসলাম চায় শান্তিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও নির্ভেজাল জীবনাদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাতে। মানব জীবনের কোন একটি বিষয় অথবা কোন একটি দিকের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া এবং স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট করাকে ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন দেয় না। এবাদত-বন্দেগী, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, আচার-আচারণ ও আমল-আখলাক অর্থাৎ জীবনের কোন স্তরে এমন কিছু করা আদৌ ইসলাম সম্মত নয় যা ঈমান ও মানবতার ক্ষতি সাধন করে।
একবার তিনজন ছাহাবী নবী করীম (ছঃ)-এর এবাদতের যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য উম্মুল মুমিনীনের নিকট আসলেন। তাঁদেরকে এ সম্পর্কে জানালে তারা একে স্বল্প মনে করে বললেন, কোথায় আমরা আর কোথায় নবী করীম (ছঃ)। আল্লাহ তাআলা তাঁর পূর্বাপর সকল ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনা করে দিয়েছেন। তারপর তাঁদের একজন বললেন, আমি রাতভর নামায আদায় করতে থাকব। দ্বিতীয় জন বললেন, আমি সর্বদাই রোযা রাখব একদিনও বাদ দেব না। তৃতীয় জন বললেন, আমি স্ত্রীসংসর্গ বর্জন করব। কখনও বিয়ে করব না। তারপর নবী করীম (ছঃ) তাদের কাছে আসলেন এবং বললেন : তোমরাই কি এ সব কথা বলেছিলে? আল্লাহর কসম, আমি রোযা রাখি আবার বাদও দিই। আমি নামায পড়ি আবার ঘুমিয়েও যাই। আমি বিয়েও করি। (মহিলাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করি না। এটাই হচ্ছে আমার নীতি ও আদর্শ।) সুতরাং যে ব্যক্তি আমার নীতি ও আদর্শ হতে বিচ্ছুত হবে সে আমার পথের অনুসারী নয়। (বুখারী)
এতে সুস্পষ্টভাবে এ কথাই প্রতিয়মান হচ্ছে যে, জীবনের সকল অবস্থাতেই ভারসাম্য রক্ষা করে চলা আবশ্যক।
.
ইসলাম সম্প্রীতি ও শান্তির ধর্ম
ইসলাম সম্প্রীতি ও শান্তির ধর্ম। ইসলাম মানুষকে নিজের, স্বজনের, সমাজের, নিজ দেশের তথা বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালনে ও ত্যাগ স্বীকারে প্রেরণা যোগায়। ফলে বিশ্ববাসীর জীবনে নেমে আসে শান্তি এবং দূরিভূত হবে অশান্তি, হিংসা, বিদ্বেষ এবং রাহানি। ইসলামের শিক্ষা হল, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষই আল্লাহর বান্দা। নবী করীম (ছ.) বলেন :
الخلق عيال الله
সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারের ন্যায়।
বস্তুত মানব জাতি একটি দেহের ন্যায়। কেননা, আমরা সকলেই আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
ايها الاس إنا خلقنكم من ذكر وأنثى وجعلنكم شعوبا وقبائل
اتقكم ط ان الله عليم خبير
التعارفوا ط ان اکرمک
উচ্চারণ : ইয়া আইয়ুহান্না–ছু ইন্না-খালানা-কুম্ মিন যাকারি ও অআছা-অজ্বাআলনা-কুম শুভবাও অকৃাবা-য়িলা লিতাআ-রাফু; ইন্না আক্রামাকুম ইদাল্লা-হি আক্কা-কুম্; ইন্নাল্লা-হা আলীমু খাবীর।
অর্থ : হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে পয়দা করেছি এক পুরুষ ও এক স্ত্রী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।–(সূরা হুজুরাত : ১৩)
মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনে প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদ আবশ্যক। তাই দুনিয়াতে শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ইসলাম শুধু মানুষের প্রতিই সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দেয়নি, অধিকন্তু প্রাণীর পরিচর্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও উদ্ভিদের যথাযথ ব্যবহারেও ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করেছে। নবী। করীম (ছঃ) বলেছেন :
الرحمون يرحمهم الرحمن إرحموا من في الأرض يرحمكم من في
الشماء
অর্থ : যারা দয়া করে, দয়াময় আল্লাহ্ ও তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা যদি জগতবাসীদের প্রতি দয়া কর তবে আকাশের অধিবাসি (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।
-(তিরমিযী ও আবু দাউদ) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা তিনি নবী করীম (ছঃ)-এর সাথে আরাফা থেকে মুযদালিফার দিকে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি (ছঃ) তাঁর পেছনে উট হাঁকানো এবং প্রহারের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে চাবুক দিয়ে ইশারা করে বললেন, হে লোকেরা! তোমরা ধীর-স্থিরভাবে চল। কেননা, উট দৌড়িয়ে নিয়ে যাওয়া কোন ছাওয়াবের কাজ নয়।-(মিশকাত)
ইসলাম কেবল বিশ্বাসভিত্তিক ধর্ম নয়। বরং তা বিশ্বাস ও কর্মের এক সুষম সমন্বয়ের বাস্তব অভিব্যক্তি। সে জন্যই বৈরাগ্যবাদকে ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন : –, অর্থ : ইসলামে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই।
হাদীসের এ বাণী প্রতিটি মানুষকে নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য, পরের জন্য, দেশের জন্য, জাতির জন্য তথা বিশ্বের জন্য কর্মে উদ্বুদ্ধ করে। কর্মই মূলত মানুষের মানবীয় পরিচয় বিকাশের এবং মনুষ্যত্ব প্রকাশের সুযোগ এনে দেয়। কাজেই প্রত্যেক মুসলমানকে তার প্রাত্যহিক চিন্তা-কর্মে এ কথা প্রমাণ করতে হবে যে সে আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল (ছঃ)-এর উম্মাত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون
অর্থ : আমি জিন ও মানব জাতিকে কেবল মাত্র আমার এবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।
–(সূরা যারিয়াত : ৫৬)
উপরোক্ত আয়াতে যে এবাদতের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে সে এবাদত শুধু নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং উপরোক্ত আমলের আগে-পরে কর্মমুখর মুহূর্তগুলোতেও আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে যেন বৈষয়িক লোভ-লালসায় নিপতিত হয়ে কেউ পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী হয়ে না পড়ে। প্রতিদিনের সব ধরণের কাজ-কর্মে আল্লাহর নির্দেশ পালন ও নবী করীম (ছঃ)-এর আদর্শের অনুসরণই হল উল্লিখিত আয়াতে এবাদতের আসল তাৎপর্য।
.
ঈমান বা বিশ্বাস
ঈমান : ঈমান অর্থ, বিশ্বাস পরিপূর্ণ মুমিন সেই যে শরীয়াতের বিষয়গুলোকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে এবং এগুলোর মৌখিক স্বীকৃতিসহ বাস্তব জীবনে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলে।
ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ পবিত্র কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত আছে। ঈমানে মুফাস্সালে সে বিষয়গুলোরই সহজ বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমনঃ
أمنت بالله وملئكته وكتبه ورسله واليوم الأخير والقدر خيره
وشره من الله تعالى والبعث بعد الموت
আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, তাকদীরের ভাল-মন্দ সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয় এর প্রতি, এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত হওয়ার প্রতি।
উল্লিখিত মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ব্যতীত কখনও ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। যিনি এগুলোতে আন্তরিক বিশ্বাস রাখবেন তাকেই মুমিন বলা হবে।
.
আমল বা কাজ
আমল : আমল বিভিন্ন ধরনের। যেমন, ১। এবাদাত, ২। মুআমালাত–লেনদেন, ৩। মুআশারাত–আচার আচরণ, ৪। সিয়াসাত–রাষ্ট্রনীতি, ৫। ইতিসাদিয়্যাত–অর্থনীতি, ৬। দাওয়াত ও জিহাদ ইত্যাদি।
(১) এবাদাত : এবাদাত চার প্রকার : যথা–নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত। দুনিয়ার লোভ-লালসার মধ্যেও মানুষ যেন স্রষ্টা আল্লাহ্ রাব্বল আলামীনের কথা ভুলে না যায় সেজন্য প্রত্যহ পাঁচবার আল্লাহর দরবারে হাযিরা দেয়ার জন্য নামায আদায় করার হুকুম দেয়া হয়েছে। নিজের মধ্যে তাক্ওয়া এবং সংযম অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রতি বছর একমাস রোযা রাখার হুকুম দেয়া হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি প্রতি বছর স্বীয় অর্থসম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ এবং উৎপন্ন শস্যের দশ ভাগের এক ভাগ অথবা অবস্থাভেদে বিশ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রদান করার নির্দেশ রয়েছে। এমনিভাবে সামর্থ্যবান হলে আল্লাহর মহব্বতে জীবনে একবার হজ্জ আদায় করার নির্দেশ রয়েছে।
(২) মুআমালাত-লেনদেন : লেনদেনের ক্ষেত্রে আমানতদারী ও সততা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাসমূহের অন্যতম। পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত, ওয়াদা পূর্ণ করে, মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতে খিয়ানত করে না, মানুষের হক আত্মসাত করে না, ওজনে কম-বেশি করে না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদঘুষসহ যাবতীয় হারাম উপার্জন থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে চলে সেই হল প্রকৃত মুসলিম। এ কারণেই লেনদেনে সততা ও আমানতদারী রক্ষা করে চলার প্রতি ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
(৩) মুআশারাত-আচার আচরণ : সামাজিক জীবনের আচার আচরণের ভেতর যাতে শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং মানুষ পরস্পর ভাই ভাই হিসাবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য ইসলাম এ বিষয়ের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পরিবারে, সমাজে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, আপন-পর, নারী-পুরুষ সকলের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করতে হবে এ ক্ষেত্রেও ইসলামের সুস্পষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। সে সব বিধিবিধানের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং অনুসরণের মাধ্যমেই একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
(৪) সিয়াসাত–রাষ্ট্রনীতি : ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, কাজেই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও ইসলাম নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ইসলামে রাষ্ট্রনীতি ধর্ম হতে পৃথক বিষয় নয়। রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ও ইসলামী বিধি বিধান প্রত্যাখ্যানকারীর শাস্তি প্রদান একান্ত আবশ্যক। তদ্রূপ দেশ ও জাতির নিরাপত্তা বিধানের জন্য সামরিক শক্তি অর্জন ও প্রয়োজনে সেনা অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামী বিধানের বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবী। আর যারা ইসলামে ইসলাম ও রাষ্ট্রনীতি ভিন্ন ভিন্ন। জিনিস বলে মনে করে তাদের ধারণা ঠিক নয়।
(৫) ইকতিসাদিয়্যাত-অর্থনীতি : অর্থ উপার্জন ও ব্যয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কিভাবে পরিচালনা করতে হবে এ ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলা জরুরী। অর্থনৈতিক জীবনে যাতে ভারসাম্য পূর্ণ হয় সেজন্য শরীয়াতের সীমা অতিক্রম করে আপন প্রবৃত্তি ও খেয়াল-খুশি মত উপার্জন ও ব্যয় করাকে ইসলাম নিষেধ করে দিয়েছে। হালাল-হারামের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। শ্রমিকের মজুরী নিশ্চিত করা হয়েছে। গরীবের যাতে অনাহার-অর্ধাহারে মৃত্যু না হয় সেজন্য যাকাত, উশ, খারাজ ইত্যাদির বিধান চালু করা হয়েছে। কেউ যেন অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়তে না পারে সেজন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনিভাবে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী সুদ প্রথাকে বাতিল করা হয়েছে। আরো বাতিল করা হয়েছে জুয়া, লটারী, কালোবাজারীসহ অবৈধ অর্থ রোজগারের যাবতীয় উপায় উপকরণ।
(৬) দাওয়াত ও জিহাদ : ইসলাম একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। এই দ্বীনকে টিকেয়ে রাখতে হলে দাওয়াতের কোন বিকল্প নেই। দাওয়াত মানে পথহারা মানুষকে আল্লাহর দিকে, সরল পথের দিকে ডাকা। বস্তুত হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (ছ.) পর্যন্ত যত নবী-রাসূল এ দুনিয়ায় এসেছেন সকলেই এ দাওয়াতের আমল করেছেন। কোরআন ও হাদীসে এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যারা অসৎ কাজে বাধা দেয় না তাদেরকে অভিশপ্ত বলা হয়েছে। এমনকি নবী করীম (ছঃ) এ জাতীয় লোকদেরকে ওহীর বরকত হতে বঞ্চিত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
জিহাদও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। সর্বক্ষেত্রে দীনের নির্দেশসমূহ যিন্দা করা এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে চলা যেমন একজন মুমিনের দায়িত্ব তদ্রূপভাবে দীনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জান-মাল কোরবান করে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়াও একান্ত কর্তব্য। কেননা, আল্লাহর বান্দাদেরকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে ইসলামের ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক জীবন বিধানের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে আসার এক মহান ও কল্যাণময় মাধ্যম হল এই জিহাদ ফী-সাবীল্লিাহ্। জিহাদ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যে ব্যক্তি জিহাদ করে না বা অন্তরে জিহাদের নিয়্যত রাখে না তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু। মুমিনের যিন্দেগী মৃত্যু পর্যন্ত জিহাদী জীবন। জিহাদ তার কর্মসূচী, শাহাদাত তার স্বপ্ন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি তার লক্ষ্য। পবিত্র কোরআন ও হাদীসে জিহাদের প্রতি জোর তাকিদ করা হয়েছে। কাজেই জিহাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
.
ইহসান
আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধন ছাড়া বান্দার কোন আমল ও এবাদতই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। এ কারণেই ইসলাম এ বিষয়টির প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ইহসানের মূল কথা হল : ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত, অপবাদ, মিথ্যা অহংকার ইত্যাদি সকল প্রকার মন্দস্বভাব হতে পাক-পবিত্র হয়ে ইখলাস, আমানতদারী, বিনয় ও নম্রতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি উত্তম চরিত্র দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলা। এ জন্য আবশ্যক নিরলস সাধনা ও মুজাহাদা। মুজাহাদার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সাথে যখন যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। তখনই সে হতে পারে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, আশরাফুল মাখলুকাত। এর জন্য আবশ্যক আত্মার সংশোধন। বস্তুত আত্মাই দেহের পরিচালক। এ কারণেই নবী করীম (ছঃ) এরশাদ করেছেন :
إن في الجسد مضغة إذا صلحت صلح الجسد كله وإذا فسدت
قد الجسد كله ألا وهي القلب
অর্থ : নিশ্চয়ই মানুষের দেহে এমন একটি গোশতের টুক্রা আছে। তা যদি বিশুদ্ধ থাকে, তবে গোটা দেহ সুস্থ থাকে। আর তা যদি বিনষ্ট হয় তবে গোটা দেহই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যায়। জেনে রাখ ঐ গোশতের টুকরাটি হল মানুষের কালব বা আত্মা।–(সহীহ বুখারী, ঈমান অধ্যায়)।
মানুষের নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষ সাধন এমন এক গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ যার পূর্ণতা। বিধানের উদ্দেশ্যে নবী করীম (ছঃ)-কে নবী হিসাবে পাঠানো হয়েছে। স্বয়ং নবী করীম (ছঃ) বলেছেন :
انما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق
অর্থ : সচ্চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।
.
আল্লাহ তাআলার পরিচয়
আল্লাহ শব্দটি ইস্মে যাত নাম। আল্লামা তাফতানীর মতেঃ
الله علم على الأصح للذات الواجب الوجود المشتجمع بجميع
الصفات الكمال
অর্থ : ছহীহ্ মতানুসারে আল্লাহ্ শব্দটি ঐ চিরন্তন সত্তার সত্তাবাচক নাম যার অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী এবং যিনি সমস্ত প্রশংসনীয় ও উত্তম গুণাবলীর অধিকারী।
আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তাই এ নামের বহুবচন হয় না। আরবী ভাষায় এর হুবহু কোন প্রতিশব্দ নেই। আর অন্য কোন ভাষায় আল্লাহ্ শব্দের কোন অনুবাদও হয় না। সুতরাং খোদা, God কিংবা ঈশ্বর কোনটাই আল্লাহ্ শব্দের যথাযথ পরিচয় বহন করতে পারে না।
শারহুল আকাইদি নাসাফিয়্যা, আল-আকীদাতুত্ তাহাভিয়্যা ইত্যাদি গ্রন্থসমূহে আল্লাহর পরিচয় এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এ মহাবিশ্বের অবশ্যই একজন অনাদি-অনন্ত স্রষ্টা; রয়েছেন। তিনি সব সময় আছেন এবং থাকবেন। তার অস্তিত্ব সন্দেহাতীত ও অবশ্যম্ভাবী। ও প্রশংসনীয় সমস্ত গুণাবলীর দ্বারা তিনি গুণান্বিত। সব ধরনের দোষত্রুটি থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। সকলই তার জ্ঞানের আওতাভুক্ত। সকল সম্ভাব্য বস্তুর উপর তিনি ক্ষমতাবান। সকল সৃষ্টি তাঁর ইচ্ছায় আবর্তিত। তিনি সর্বশ্রোতা ও সম্যক দ্রষ্টা। তার কোন উপমা নেই। নেই কোন প্রতিদ্বন্দীও। এবং নেই কোন সাহায্যকারী। তাঁর কোন বেনীর। তিনি বে-মেসাল সত্তা। তাঁর অবশম্যম্ভাবী ও নিত্য অস্তিত্বে, এবাদত বন্দেগীর অধিকারে এবং বিশ্বের শৃঙ্খলা বিধানে কেউ তাঁর শরীক নেই। তিনিই অসুস্থকে সুস্থ করেন, সকল সৃষ্টবস্তুর রিক দেন এবং সব ধরনের অসুবিধা ও কষ্ট দূর করেন তিনিই।
আল্লাহ্ তাআলা অন্য কোন সত্তায় প্রবিষ্ট ও একীভূত হওয়া থেকে পবিত্র। তিনি দেহ বিশিষ্ট নন এবং কোন দিক বা স্থানের গণ্ডিতেও আবদ্ধ নন। মুমিনগণ পরকালে তার দীদার লাভে ধন্য হবেন। তিনি যা চান তাই হয়, যা চান না তা হয় না। তিনি অমুখাপেক্ষী। তিনি
জবাবদিহি করতে হয় না। তাঁর প্রতিটি কাজই হিকমতপূর্ণ এবং প্রজ্ঞাময়। তিনি ছাড়া যথার্থ। কোন নির্দেশদাতা নেই এবং নেই কোন হাকীম।
আরশ, কুরসী, লাওহ-কলম, আসমান-যমীন, গাছ-পালা, বৃক্ষলতা এক কথায় দৃশ্যমান ও অদৃশ্য যতকিছু রয়েছে সবকিছুর স্রষ্টাই তিনি। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি স্বঅস্তিত্বে সর্বদা বিরাজমান। এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। স্বভাবগতভাবেই আমরা একথা বুঝতে পারি যে, এ বিশ্ব কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় সৃষ্টি হয় নি। বরং এর পেছনে রয়েছে এক মহাজ্ঞানীর সুনিপুণ পরিকল্পনা। তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্য সব কিছুরই অস্তিত্ব দান করেন। এ সত্ত্বেও অজ্ঞতা ও অহমিকার কারণে যুগে যুগে একদল লোক আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে ও সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেন :
آقي الله ش فاطر الموت والأرض
অর্থ : আল্লাহর ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ আছে; যিনি আসমান-যমীনের স্রষ্টা?
–(সূরা ইব্রাহীম : ১০)
সুপরিকল্পিতভাবেই আল্লাহ্ তাআলা মানবজাতিসহ সমগ্র বিশ্ব সৃজন করেছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
شتقنا الثقة علقة فخلقنا العتقة مخففتقنا المشقة عظما فكسونا العظم لحما ثم انشائه خلقا أختبرك الله احسن الخليقين
উচ্চারণ : ছুম্মা খালাক্বনান্ নুত্বফাতা আলাক্বাতান ফাখালাকৃনাল আলাক্বাতান মুদ্বগ্নতান্ ফাখালাক্বনাল মুদ্বগ্বাতান ইজোয়া-মান ফাঁকাছাওনাল ইজোয়া-মা লাহমা ছুম্মা আনশানা-হু খালক্বান আ-খারা; ফাতাবারাকাল্লা-হু আহাছানুল খালিক্বীন।
অর্থ : পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি আলাকে, তারপর আলাককে পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে অস্থিপিঞ্জরে, অস্থিপিঞ্জরকে ঢেকে দেই গোত দ্বারা, তারপর একে গড়ে তুলি অন্য সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্ কত মহান।–(সূরা মুমিনূন : ১৪)
এতে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইঙ্গিতেই আমাদের অস্তিত্ব। এ ভূ-মণ্ডল আকস্মিক কোন দুর্ঘটনার ফসল নয়। এদিকে ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে।
أم خلقوا من غير شئ أم هم الخلقون ام لقوا الموت والأرض
অর্থ : তারা কী সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা নিজেরাই আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছে?–(সূরা তূর ৩৬)।
এ মহাবিশ্বের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনিই হলেন আল্লাহ্। তার অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত। তা সত্ত্বেও যুক্তির ধোয়া তুলে এ বিষয়ে অহেতুক তর্কের অবতারণা করা হলে বলা যায়?
(ক) এ জগতে যত মানুষ বসবাস করছে তারা কেউই তাদের স্রষ্টা নয়। এমনিভাবে আমাদের সন্তানদের স্রষ্টাও আমরা নই। যে বিশাল আকাশের শামিয়ানার নিচে আমরা বসবাস। করছি তাও আমাদের সৃষ্টি নয়। যুগে যুগে যে সব দাম্ভিক ক্ষমতার দম্ভে ইলাহ্ হওয়ার দাবী করেছে তারাও এসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা হওয়ার দাবী করার দুঃসাহস দেখায়নি। জড় পদার্থও এসব কিছুর স্রষ্টা হতে পারে না। এতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, কোন কিছুই আপনা হতেই সৃষ্টি
হয়ে যায়নি বরং এক মহান স্রষ্টাই বিশ্বের সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। আর তিনিই হলেন মহান আল্লাহ্, যিনি এক ও অদ্বিতীয়।
(খ) কোন বাড়ি-ঘর, কলকারখানা দেখার সাথে সাথেই আমাদের হৃদয়পটে এ কথা ভেসে উঠে যে, কোননা কোন কারিকর এগুলো তৈরি করেছেন। কারিকর ছাড়া এগুলো হতেই পারে না। ঠিক তদ্রূপ এ মহাবিশ্ব স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়নি। তিনিই আগুন, পানি, মাটি, বাতাস সহ সব ধরণের উপাদান দিয়ে এ বিশ্ব এবং এতে যা কিছু আছে তার সবই সৃষ্টি করেছেন।
(গ) খেলার বলকে পা দিয়ে লাথি মারলে তা দ্রুত উপরের দিকে উঠে আবার কিছুক্ষণের মধ্যে নিচে নেমে আসে। উপরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে না। কিন্তু এ বিশাল পৃথিবী অবিরত ঘূর্ণায়মান। কখনো নিচে পড়ে যায় না, কখনো নির্দিষ্ট কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় না এবং এগুলোর পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। এগুলোকে কে মহাশূন্যে ধরে রেখেছে? এ সুশৃঙ্খল নিয়মের তত্ত্বাবধান কে করছে? এ সব প্রশ্নের একমাত্র জওয়াব এটাই যে, এ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা আল্লাহর কুদরতেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে।
إن الله يمسك الموت والأرض أن تزولا ولئن الا ان امسكها من
أحتين بعده إنه كان حليما فورا
উচ্চারণ : ইন্নাল্লা-হা ইয়ুমসিকুস সামাওয়া-তি অল আরদোয়া আন্ তাযূলা–অলায়ি যা-লাতা–ই আসাকাহুমা-মিন্ আহাদিম্ মি বাদিহী; ইন্নাহু কা-না হালীমান্ গাফুরা-।
অর্থ : আল্লাহ তাআলাই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে সংরক্ষণ করেন, যাতে এগুলো, স্থানচ্যুত না হয়, এগুলো স্থানচ্যুতি হলে তিনি ছাড়া কে এগুলোকে সংরক্ষণ করবে? তিনি তো অতি সহনশীল, ক্ষমাশীল।–(সূরা ফাতির : ৪১)
.
তাওহীদ
তাওহীদ অর্থ একত্ববাদ। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। সত্তাগত ও গুণাবলী উভয় দিক থেকে তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। এবাদত বন্দেগীর ব্যাপারেও তার কোন অংশিদার নেই। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
والهكم إله واحد لا إله الا هو الرحمن الرحيم
অর্থ : তোমাদের মাবুদ এক ইলাহ্, মেহেরবান ও দয়ালু ইলাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই।–(সূরা বাকারা : ১৬৩)
قل هو الله أحد الله الصمد لم يلد ولم يولد ولم يكن له كفوا
ܐܰܟ݂
অর্থ : বলুন, তিনিই আল্লাহ্ একক। আল্লাহ্ অমুখাপেক্ষী। সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দিয়েছে এবং আর না তাকে কেউ জন্ম দিয়েছে আর কেউই তার সমতুল্য নয়।
–(সূরা ইখলাস : ১-৪)
একাধিক ইলাহ থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।
وكان فيهما اله الا اللة لقتا قبحن الثورب العرش عما
يصفون
অর্থ : আসমান-যমীনে যদি আল্লাহ্ ছাড়া একাধিক ইলাহ্ থাকত, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে তা হতে আরশের অধিপতি আল্লাহ্ পবিত্র, মহান।
–(সূরা আম্বিয়া : ২২)
বহু ইলাহ্ হওয়ার ধারণা অবাস্তব। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আরো এরশাদ হয়েছেঃ
الله من ولي وما كان معه من إله إذا تذهب كل اله بما
ما ان خلق ولعلا بعضهم على بعض سبحن الله عما يصفون
অর্থ : আল্লাহ্ না কোন সন্তান গ্রহণ করেছেন আর না তাঁর সঙ্গে অন্য কোন ইলাহ্ আছে; যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ্ আপন আপন সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একজন আর একজনের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত। তারা যা বলে তা থেকে আল্লাহ্ কত পবিত্র।
–(সূরা মুমিনূন : ৯১)
এতদসত্ত্বেও অনেক মানুষ নিজেদের বিবেক বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে পাথরের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। কেউ চন্দ্র-সূর্যের, কেউ বা আগুনের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। আবার কেউ কেউ তো নিজেই ইলাহ্ হওয়ার দাবী তুলেছে, যেমন ফিরাউন ও নমরূদ। এ বিষয়ে নমরূদের সাথে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর বিতর্কের বিষয়টি আল-কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে :
و ابرهم
في ربه أن اته الله المللی ان قالام
الذي
ربي الذي يحي ويميت قال أنا شي وأمي قال ابرهيم فان الله يي الشمس من المشرق في بها من المرب فبهت الذي كفر والله
يهدي القوم الظلمين–
অর্থ : তুমি কি দেখনি ঐ ব্যক্তিকে, যে ইব্রাহীমের সঙ্গে তার রবের ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, কেননা, আল্লাহ্ তাকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন। যখন ইব্রাহীম বলল, তিনিই আমার রব যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলল, আল্লাহ্ সূর্যকে পূর্বদিক হতে উদিত করান, তুমি একে পশ্চিম দিক হতে উদিত করাও তো। তারপর যে কুফরী করছিল সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আল্লাহ্ যালিমদের সৎপথ দেখান না।–(সূরা বাকারা, ২ : ২৫৮)
খ্রীষ্টান সম্প্রদায় তাদের নবীকে ইলাহ বানানোর ফলে তারা পথভ্রষ্ট ও গুমরাহ হয়েছে। অথচ নবী-রাসূলদের সকলেই ছিলেন আল্লাহর বান্দা। হযরত ঈসা (আঃ) সম্বন্ধে আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
وامة
ما المسيح ابن مريم الا رسول قد خلت من قبلو ال يقة كانا يعلن الطعام أنظر كيف تبين لهم الأيت ثم انظر اٹی
يؤفكون
অর্থ : মারইয়াম পুত্র মাসীহ্ তো কেবল একজন রাসূল। তার পূর্বেও বহু রাসূল এসেছে এবং তার মাতা ছিল সত্যনিষ্ঠ। তারা উভয়ে খাদ্য খেত। দেখ, আমি ওদের জন্য নিদর্শন কী রূপ বিশদভাবে বর্ণনা করি, আরো দেখ, ওরা কীভাবে সত্যবিমুখ হয়।–(সূরা মায়িদা : ৭৫)
উল্লিখিত আলোচনার ভিত্তিতে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন। ইলাহ্ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোন অংশিদার নেই। কেউ যদি তাঁর সত্তা, গুণাবলী এবং এবাদতে অন্য কিছুকে অংশিদার সাব্যস্ত করে তবে সে মহাপাপী; তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
و الجنة وماوه النار وما
انه من یا
للظلمين من أنصار
অর্থ : আল্লাহর সঙ্গে কেউ শরীক সাব্যস্ত করলে আল্লাহ্ তার জন্য অবশ্যই বেহেশত হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা দোযখ আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।
–(সূরা মায়িদা : ৭২)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :
إن الشرك لظلم عظيم
অর্থ : নিশ্চয় শিরক চরম যুলম। (সূরা লুমান, ৭১ : ১৩)
আরো এরশাদ হয়েছে :
إن الله لا يغفر أن يشرك به ويغفر ما دون ذلك لمن يشاء ومن
شرك باللي فقد ضل ضل بعيدا–
অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। এতদ্ব্যহীত যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে সে তো গোমরাহীর পথে অনেক দূর অগ্রসর হল।–(সূরা নিসা ও ১১৬)।
যুগে যুগে আগত নবী-রাসূলরাও তাওহীদের শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। প্রথম নবী হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) পর্যন্ত এ পৃথিবীতে যত পয়গম্বর এসেছেন এবং তারা সকলেই বলেছেনঃ
يقوم اعبدوا الله مالكم من إله غيره
হে আমার কাওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ্ নেই।–(সূরা আরাফ ও ৭৩)।
মুসলিম মুনিষীরা এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে এ কথা প্রমাণ করছেন যে, আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তার কোন শরীক নেই।
.
আল্লাহর প্রতি ঈমান
আল্লাহ সম্পর্কে তিনি নিজেই পবিত্র কালামে এরশাদ করেছেন তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত অন্য কেউ মাবুদ (উপাস্য) নেই। তিনি জীবন্তও প্রতিষ্ঠিত, তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও যমীনের মধ্যে যা কিছু আছে, সমস্তই তার জন্য। কে এমন আছে যে, তাঁর নির্দেশ ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে? তিনি অগ্র-পশ্চাতের সমস্তকিছু জানেন। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তাঁর ইলমের সামান্যতম অংশও কেউ আয়ত্ব করতে সক্ষম নয়। তাঁর (জ্ঞানের) সিংহাসন সমস্ত আসমান-যমীন ব্যাপি পরিব্যাপ্ত। তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে তাঁর একটুও বেগ পেতে হয় না। তিনি বিরাট ও মহান।–(সূরা বাকারা আয়াত : ২৫৫)
মহান প্রতিপালক আল্লাহ তাআলা সমস্ত প্রাণী জগতের হায়াত ও মৃত্যু দানকারী ও পানাহার প্রদানকারী। তিনি আইন-কানুন ও বিধি-বিধান দাতা। জিন ও ইনসান যা কিছু করে ও বলে থাকে এবং যা কিছু অন্তরে গোপন করে রাখে, তিনি সমস্তই জানেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বি কেউ নেই। তার ইচ্ছার প্রতিবাদ বা মুকাবিলা করার সাহস বা শক্তি কারো নেই। এ সকল মহান গুণাবলীর অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের যোগ্য নেই। তিনিই সবকিছুর প্রতিপালক ও এবাদতের মালিক। তিনি চিরস্থায়ী, তার গুণাবলীও চিরস্থায়ী, অনন্তকালব্যাপী আছেন ও থাকবেন। তাঁর কোন শরীক নেই, তিনি অদ্বিতীয়। তিনি নিরাকার ও নিরাহার, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, বরং জগতবাসী তাঁর মুখাপেক্ষী।
তিনি দাতা, দয়ালু, ধৈৰ্য্যশীল ও ক্ষমাশালী। আল্লাহর কোন বান্দা অন্যায় করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেন না বরং বান্দা ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। অতএব, মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান স্থাপন করা প্রত্যক মানুষের জন্য ফরয। আল্লাহর প্রতি ঈমানের তাৎপর্য হল, আল্লাহ তাআলার জাত-সত্বা ও তাঁর সমস্ত ছেফাতী নামসমূহের এবং গুণাবলীর প্রতি জবানের স্বীকৃতিসহ অন্তরে সাথে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তাআলাই একমাত্র উপাস্য অর্থাৎ এবাদতের যোগ্য। অতঃপর তাঁর বিধানমত আমল করা।
অর্থাৎ কালেমা তাইয়্যেবা মুখে পাঠ করা, তা অন্তরের সাথে বিশ্বাস করা এবং আমলের দ্বারা কার্যে পরিণত করা। একেই আল্লাহর প্রতি ঈমান বলা হয়।
.
আসমায়ি হুস্না–আল্লাহর ৯৯ নাম
(আল্লাহ তাআলার সিফাতী নামসমূহ)
অনন্ত অসীম কুদ্রতে কামেলা আল্লাহ তাআলার কুদরতের যেমন অন্ত নেই, সেই কুত অনুযায়ী তাঁর নামেরও অন্ত নেই। এসব নাম সিফাতী বা গুণবাচক নাম বলে খ্যাত। সিফাতী নামগুলো ভিন্ন অর্থযুক্ত বলে যিনি যে নামের আমল করেন, তিনি তেমন ফলই পেয়ে থাকেন। নিম্নে আমরা আল্লাহ তাআলার কোরআনে উক্ত ৯৯টি সিফাতী নামের ও বাংলা উচ্চারণ এবং প্রত্যেকটি নামের পৃথক পৃথক অর্থ ও আমলের ফলাফল লিখে দিচ্ছি।
م، يا مؤمن، يا
يا الله يا رحمن يا رحيم، يامي يا قدوس، یا مهيمن، يا عزيز، يا جبار، یا متكبر، ياخالق، یا باری، يا مصور، یا
ع ها
۹
لا اله :-1
و
قار، يا قهار، یا رزاق، یا فتاح يا عليم يا قاپ، یا باسط، یا
ژ
، یا حکم، یا عدل،
افض، يا رافع يا معر، یا مني، يا سميع، یا ب يا لطيف، يا بير، یا حلیم، یا عظیم، یا افور، یا گور، یا علی، یا كبير، یا حفیظ، يا مقيت، یا جليل، یا گریم، یا رقيب، یا مجيب، یا واسع، يا حكيم، یا وو، يا مجيد، یا بات، یا شهيد، یا حتی اول یا قوى، يا متين، یا ولی، یا حميد، یا محيى، یا مبيرية، يا معيد يا محيي یا مميت، يا حي يا قيوم، یا واجد، یا واحد، يا أحد، يا محمد يا قاير، یا مقتر، یا مقيم، یا مؤر، یا اول، یا ایم، با ظاهر، یا باطن، يا والى، یا متعالی، یا بژ یا تواب، یا منتقم، يا رؤف، یا رب یا مقط
، یا جامع، کیا
اژ، یا تابيع، يانور، ياهادی، کیا
نی یا مغنی یا معطى، یا ما، یا بدیع، یا باقی، یا وارث، یا رشيد، یا صبور، کیا صادق، یاشار، یا ممالك الملك، يا ذالجلال والإكرام.
.
আসমাউল হুসনার বাংলা উচ্চারণ
ইয়া-আল্লা-হ, ইয়া রাহমা-নু, ইয়া-রাহীমু, ইয়া-মা-লিকু, ইয়া-কুদ্দূসু, ইয়া-সালা-মু, ইয়া-মুমিনু, ইয়া-মুহাইমিনু, ইয়া-আযীযুম ইয়া-জাব্বা-রু, ইয়া-মুতাকাব্বিরু, ইয়া-খা-লিকু, ইয়া-বা-রীউ, ইয়া-মুছাওয়িরু, ইয়া-গাফ্ফা-রু, ইয়া-কাহ্হা-রু, ইয়া-রায্যা-কু, ইয়া-ফাত্তা-হু, ইয়া-আলীমু, ইয়া-ক্বা-বিদু, ইয়া-বা-সিতু, ইয়া-খা-ফিদ্বু, ইয়া-রা-ফিউ, ইয়া-মুইয্যু, ইয়া-মুযিল্লু, ইয়া-সামীউ, ইয়া-বাছীরু, ইয়া-আদদলু, ইয়া-লাতীফু, ইয়া-খাবীরু, ইয়া-হালীমু, ইয়া-আযীমু, ইয়া-গাফূরু, ইয়া-শাকূরু, ইয়া-আলিইউ, ইয়া-কাবীরু, ইয়া-হাফীযু, ইয়া-মুক্বীতু, ইয়া-জালীলু, ইয়া-কারীমু, ইয়া-রাক্বীবু, ইয়া-মুজীবু, ইয়া-ইয়া-সিউ, ইয়া-হাকীমু, ইয়া-ওয়াদূদু, ইয়া-মাজীদু, ইয়া-বা-য়িছু, ইয়া-শাহীদু, ইয়া-হাকু, ইয়া-ওয়াকীলু, ইয়া-ক্বাওয়িয়্যু, ইয়া-মাতীনু, ইয়া-ওয়ালিল্যু, ইয়া-মুহছিয়্যু, ইয়া-মুব্দিয়্যু, ইয়া-মুঈদু, ইয়া-মুহয়ি, ইয়া-মুমীতু, ইয়া-হাইয়্যু, ইয়া-কাইয়্যূমু, ইয়া-ওয়া-জিদু, ইয়া-ওয়া-হিদু, ইয়া-আহাদু, ইয়া-ছমাদু, ইয়া-ক্বা-দিরু, ইয়া-মুক্বতাদিরু, ইয়া-মুয়াখ্খিরু, ইয়া-আউইয়ালু, ইয়া-আ-খিরু, ইয়া-যোয়াহিরু, ইয়া-বা-ত্বিনু, ইয়া-ওয়ালিয়্যু, ইয়া-মুতাআ-লী, ইয়া-বাবরু, ইয়া-তাওয়া-বু, ইয়া-মুন্তাক্বিমু, ইয়া-রাউফু, ইয়া-রাব্বু, ইয়া-মুক্বসিতু, ইয়া-জা-মিউ, ইয়া-গানিয়্যু, ইয়া-মুগনিয়্যু, ইয়া-মুতীয়ু, ইয়া-মা-নিউ, ইয়া-দ্বোয়া-ররু, ইয়া-না-ফিউ, ইয়া-নূরু, ইয়া-হা-দীয়ু, ইয়া-বাদীউ, ইয়া-বাকিয়ু, ইয়া-ওয়ারিছু, ইয়া-রাশীদু, ইয়া-ছোঁয়াকূরু, ইয়া-ছোঁয়া-দিকু, ইয়া-সাত্তা-রু, ইয়া-মা-লিকাল মুল্কি, ইয়া-যাল্জালা-লি ওয়াল্ ইক্রা-ম।
.
আসমাউল হুসনার অর্থ ও ফযীলত
بسم الله الرحمن الرحيم
পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে
–ইয়া-রাহমানু! (হে পরম দাতা)
পবিত্র কোরআনে বিসৃমিল্লাহর সাথে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর গুণ প্রকাশক রাহমান ও রাহীম নাম দুটি জগতে প্রথম প্রচারিত হয়। [ তঃ কাশশাফ ও হাক্কানী ]
পাঞ্জেগানা নামাযে ইয়া রাহমানু নামটি ১০০ বার পড়লে, দেহ ও মনের সকল প্রকার দুর্বলতা দূর হয়ে যায় এবং পাঠকারীর উপর আল্লাহ তাআলার অজস্র রহমত নেমে আসে। এছাড়া, এ নাম পাঠের তাসিরে পাঠকারীর হৃদয় আল্লাহর প্রতি আকর্ষিত হয়ে উঠে এবং যাবতীয় গুণাহর কাজে ঘৃণার ভাব জাগ্রত হয়।
–ইয়া রাহীমু! (হে পরম দয়ালু!)
(১) প্রতি ওয়াক্ত নামাযে ১০০ বার ইয়া রাহীমু পাঠ করলে, পুনরায় ভোর হওয়ার পূর্বে কোন উড়ন্ত বিপদ অর্থাৎ কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারী–যা আশেপাশে আছে বলে নিজেরও হতে পারে, তা থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
(২) সূর্যোদয়কালে প্রত্যাহ ইয়া-মা-লিকু ১০০ বার হিসেবে পড়তে থাকলে অন্য ব্যক্তি তার উপর কর্তৃত্ব করতে পারে না এবং নিজেকেও অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয় না।
–ইয়া কুদ্দূসু! (হে পবিত্রতম!)
(১) আল্লাহ পাকের এ সিফাতী নামটি ঘুমানোর সময় বালিশে মাথা রেখে ১১ বার পড়ে ঘুমালে, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হয় না। ফজর নামাযের পর ও সূর্যোদয়ের আগে ১০১ বার করে প্রতিদিন পড়লে আল্লাহ তাআলা তার বিগত জীবনের যাবতীয় পাপ মাফ করে দেন।
উচ্চারণ : সুব্বূহুন কুদ্দূসুন রব্বুনা- ওয়া রব্বুল মালা–য়িকাতি ওয়াররূহ।
অর্থ : আমাদের রব, ফেরেশতাকুল ও আত্মার রব আল্লাহ অতিশয় প্রশংসিত ও পবিত্র।
(২) ডাইনী দৃষ্টি বা বদনজর লোকের সামনে বা মজলিসের মাঝে একা একা খেতে বসলে চোখ লাগে, তাতে পেটে অসুখ হয়। কিন্তু আহার করতে বসে বরতনের চতুপার্শ্বে ডান হাতের শাহাদাৎ অঙ্গুলী একবার ঘুরিয়ে আনতে আনতে উক্ত আয়াতটি এক বার পড়ে আহার করলে কোন লোকেরই চোখ (বদনজর) লাগতে পারে না। তাছাড়া অগ্নিমান্দ্য থাকলে আহারে রুচি হবে। হজমশক্তি বৃদ্ধি পাবে।
(৩) উক্ত আয়াতটি পড়তে পড়তে বিছানায় গা ঢেকে দিয়ে নিদ্রিত হলে কখনও কুস্বপ্ন দেখবে না, স্বপ্নে কিছু খাবে না; অনিদ্রাদোষ থাকলে সুনিদ্রা হবে। [ পরীক্ষিত ]
–ইয়া সালা-মু! (হে শ্রেষ্ঠ শান্তিদাতা!)
(১) দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি উঠতে বসতে ইয়া-সালা-মু তাসবীহ করে নিলে ইনশাআল্লাহ তার সে রোগ দূর হয়ে যবে। রোগী যদি অত্যধিক হীনবল হয়ে পড়ে, তাহলে অন্য কোন পরহেজগার ব্যক্তি তার বিছানায় বসে প্রত্যহ এ নামটি অম্লাধিক সংখ্যায় পাঠ করলে (যদি হায়াত থাকে) রোগী আরোগ্য হয়ে উঠবে।
(২) বিদেশ যাত্রাকালে ঘর হতে বের হতে হতে প্রথম ইয়া-সালা-মু এবং শেষে তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ্ বলে ডান পা আগে ফেলে বেরিয়ে গেলে পথের দুর্ঘটনা হতে আল্লাহ নিরাপদ রাখেন।
–ইয়া-মুমিনু! (হে নিরাপত্তাদাতা!)
(১) ওযূ রেখে এ নামটি ২১ বার পাঠ করে ঘরের বের হয়ে গেলে অন্ধকার রাতে ভূত-প্রেত ও দুষ্ট জিন প্রভৃতি কাছে ভিড়তে পারবে না।
(২) যারা অহেতুক ভয় ও লজ্জা করে, তারা নিজের এ দুর্বলতার কথা স্মরণ হতেই ইয়া মুমিনু বলে মাবুদকে ডেকে উঠলে, ইন্শাআল্লাহ তার অন্তরে সাহস পয়দা হবে।
–ইয়া-মুহাইমিনু! (হে সত্য সাক্ষ্যদানকারী!)
যাদের সাথে অন্য কেউ অন্যায়ভাবে শত্রুতা করে, তারা এ পাক নামটি বেশি বেশি পড়লে, শত্রুতা আপনা হতেই কমে যাবে।
-ইয়া-আযীযু! (হে প্রতাপশালী!)
যার স্ত্রী-পুত্রাদি কথা শোনে না, সে ব্যক্তি প্রতিদিন বাদ ফজর এ পাক নামটি ১০০ বার করে পড়লে অচিরেই তারা তার বাধ্য হয়ে উঠবে। এছাড়া অন্য সবাই তাকে ভক্তি করবে।
–ইয়া-জাব্বা-রু! (হে অজেয় শক্তিশালী!)
(১) হিংস্র জন্তু বা শত্রুর সম্মুখীন হয়ে এ নামটি মনে মনে পড়তে থাকলে সেই হিংস্র জন্তু ও শত্রু তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
(২) সূর্য যখন লাল হতে শুরু করে, তখন থেকে সম্পূর্ণ সূর্য উঠে যাওয়া পর্যন্ত প্রত্যহ শত্রুর চেহারা স্মরণ করে ইয়া-জাব্বারু পড়লে সেই শত্রু তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমন কি, শয়তানও কুমন্ত্রণা দিতে পারবে না।
–ইয়া-মুতাকাব্বিরু! (হে গৌরবময়!)
নব বিবাহিত পুরুষ আল্লাহর এ গৌরবময় নামটি পড়তে পড়তে বাসরঘরে প্রবেশ করলে। নববধূর সাথে প্রথম দৃষ্টি-বিনিময়ে সরবে একবার পাঠ করলে বধু আজীবন স্বামীর সাথে আত্ম-অহঙ্কার প্রকাশ করবে না এবং এ ঘরে সন্তান হলে পিতৃভক্ত হবে।
-ইয়া–খা-লিকু (হে স্রষ্টা!)
(১) কোন প্রকার দুশ্চিন্তা বা বিপদে জড়িয়ে পড়লে, আল্লাহর এ নামটি পাঠের দ্বারা সে চিন্তা ও বিপদ দূর হয়ে যায়।
(২) এ নাম পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে বিজোড় সংখ্যা (৩, ৫, ৭, ৯ ইত্যাদি যে কোন সংখ্যা) আজীবন পাঠ করলে, আল্লাহ তাআলার এক শ্রেণীর ফেরেশতার কিয়ামত পর্যন্ত ইবাদতের সওয়াব সে ব্যক্তির আমলনামায় যোগ করে দেন।
–ইয়া বারীউ! (হে মুক্তিদাতা!)
(১) নতুন পাতিল ভাঙ্গা চাড়ার উপর মাবুদের এ পাক নামটি খোদাই করে ক্ষেতের কোণে মাটির নীচে পুঁতে রাখলে, সেই ক্ষেতে অধিক ফসল উৎপন্ন হবে এবং কীট-পতঙ্গে তার ফসল নষ্ট করতে পারবে না।
(২) এ নাম সকাল-সন্ধ্যায় ৪১ বার পাঠ করলে বুদ্ধি ও জীবনী শক্তি বৃদ্ধি পায়। 1220-ইয়া মুছোঁয়াওয়িরু! (হে শ্রেষ্ঠ শিল্পী!)
বন্ধ্যা নারীরা এ নামটি (নিজের বন্ধ্যাত্বের কথা স্মরণ হতেই) বিজোড় সংখ্যায় (৩ বা ৫ বার) পড়লে, সন্তানের মা হবে। মৃত বৎসারা ঐ নিয়মে পাঠ করতে থাকলে, তাদের সন্তান আর মরবে না।
-ইয়া-গাফফা-রু! (হে পাপ ক্ষমাকারী!)।
(১) শেষ রাতে ৪১ দিন পর্যন্ত এ নামটি ১০০০ বার করে পাঠ করলে, সমগ্র জীবনের গুনাহ্ আল্লাহ মাফ করে দেন–যদি তার পাপ সমুদ্রের ফেনাপুঞ্জের সমানও হয়। [ আল্-হাদীস]
(২) এ নামটি জুমআর দিন ওযূ করে মসজিদে যাত্রা করার আগে ১০০ বার পাঠ করে নামাযে গেলে, তার যে কোন আরব্ধ কাজের কাঠিন্য দূর হয়ে যাবে।
–ইয়া কাহ্হা-রু! (হে কঠিন শাস্তিদাতা!)
(১) অবাধ্য স্ত্রী-পুত্রদেরকে বশে আনার জন্য তারা যতবার চোখে চোখে চায়, ততবারই যদি মনে মনে এ পাক নামটি পাঠ করতে থাকে, তবে অচিরে তারা বাধ্য হয়ে উঠবে। এতে বাধ্য না হলে সূর্যোদয়ের সময় তাদের কপালের উপরিভাগের চুলগুচ্ছ ধরে ৩ বার এ নাম পাঠ করতে হবে।
[দ্রষ্টব্য ও দাঁতের উপর দাঁত চেপে ধরে এ নাম পাঠ করবেন।]
(২) যারা যাদুর খেলা দেখায়, তাদের সীমারেখার ভিতরে গিয়ে বাম হস্তের কনিষ্ঠা অঙ্গুলির অগ্রভাগে ঐ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ দ্বারা চিটি কেটে ধরে আল্লাহর এ নাম মনে মনে পড়তে থাকলে, সে যাদুগীর কিছুতেই তার যাদুর খেলা প্রদর্শন করতে পারবে না।
–ইয়া-রাম্যাকু! (হে রিযিকতাদা!)
(১) প্রত্যেক নামায অন্তে এ নাম ১০০ বার করে পড়লে, কখনও সে ব্যক্তি উপোষ থাকবে, রিক্তহস্ত হবে না।
(২) একখণ্ড কাগজে এ পাক নাম লিখে তাবিজ করে শস্যক্ষেতের বেড়ার সাথে বেঁধে দিলে পোকার উপদ্রব হতে শস্য রক্ষা পাবে।
-ইয়া-ফাত্তা-হু! (হে উন্মুক্তকারী!)।
(১) নতুন কাজ আরম্ভের সময়, প্রথম চাকরিতে যোগদানের দিন, বছরের প্রথম বীজ বপন করতে যাওয়ার পূর্বে ও নতুন ব্যবসায় খোলার দিন এ পাক নাম ১০১ বার পাঠ করে কাজ আরম্ভ করলে আল্লাহ সে কাজ সুফলপ্রসূ করে দেন।
(২) সূর্যোদয়ের সময়ে উভয় হস্ত বুকের উপর চেপে ধরে ৭ বার এ নাম পাঠ করলে, পাঠকারীর আরব্ধ কঠিন কাজও আল্লাহ্ সহজসাধ্য করে দেন।
–ইয়া-“আলীমু (হে মহাজ্ঞানী!)
শেষ রাতে উঠে ২১ দিন পর্যন্ত একদিনও বাদ না দিয়ে এ নাম ১০০০ বার করে পাঠ করলে আল্লাহর দয়ায় সে ব্যক্তির জাগতিক মোহ কেটে যাবে এবং গায়েবী জ্ঞানে তার অন্তর পূর্ণ হয়ে উঠবে।
–ইয়া-কৃাবিদ্যু! (হে করায়ত্তকারী!)।
(১) এ নাম অজিফা করে নিলে জীবনে অন্নকষ্ট হয় না।
(২) চীনামাটির নতুন বাসনের ওপর যা এখনও ব্যবহৃত হয়নি। এ নাম ১০১ বার জান কালি দিয়ে লিখে গোলাপ পানিতে ধৌত করে সে পানি যাকে পান করিয়ে দিবে, সে-ই ক্রীতদাসের মত বাধ্য হয়ে থাকবে।
[ কুবাসনায় এ কাজ করলে ফল পাওয়া যাবে না, বরং পাপ হবে। কেননা, এটা আল্লাহরই একটি পাক নাম ]
–ইয়া-বা-সিতু! (হে প্রসারতাদানকারী!)
প্রত্যেক মুনাজাতে মুখ মোছার সময় ৩ বার এ নাম উচ্চারণ করলে, কখনও তাকে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
–ইয়া-খা-ফিছু! (হে সঙ্কোচনকারী!)
এ নামের আমলের তাসিরে আল্লাহর অজস্র রহমত বর্ষিত হতে থাকে, শত্রুরা শত্রুতা ছেড়ে দেয়, চাকরিহীনের চাকরি হয়।
–ইয়া-রা-ফিউ! (হে উন্নীতকারী!)
বিদেশে যাওয়ার সময় ৭০ বার এ নাম পড়ে রওয়ানা দিলে পথে কোন দুর্ঘটনা ঘটে না এবং আশা পূর্ণ হয়।
–ইয়া-মুইযযু! (হে ইজ্জতদাতা!)
প্রত্যহ এশার নামাযের পর মুনাজাতের আগে জায়নামাযের উপর দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হুযুরিদিলে এ নাম ১০০ বার যিকর করলে, হারানো গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়।
–ইয়া-মুযিলু! (হে অপদস্তকারী!)
আগের দিন সূর্যাস্তের সময় ১০১ বার এ নাম পাঠ করে, পরদিন হাকিমের চেহারার দিকে চেয়ে মনে মনে এ নাম পাঠ করতে থাকলে, আল্লাহর রহমতে হাকিম তার প্রতি সদয় হয়ে উঠবেন।
–ইয়া-সামীউ! (হে সর্বশ্রোতা!)
জুমআর রাতে (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে) ১১ বার এস্তেগফার, ১১ বার দুরূদ শরীফ, ১১ বার আয়াতুল কুন্সী ও পুনরায় ১১ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করে : ১০০০ বার ইয়া-সামীউ নাম পড়ে প্রথম ওয়াক্তে ফজরের দু রাকআত সুন্নত আদায় করবেন। অতঃপর ফরয নামাযের আগে পুনরায় ১১ বার দুরূদ শরীফ, ১১ বার আয়াতুল কুরূসী ও শেষদিকে ১১ বার দুরূদ শরীফ পড়ে স্বীয় বাসনা পূর্ণ করে দেয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করবেন। তারপর যথাসময়ে ফজরের দুরাকআত ফরয নামায আদায় করবেন। এভাবে এগার দিন একাদিকক্রমে আমল করলে অসম্ভব আশাও পূর্ণ হয়। যদি প্রথম ১১ দিনের মধ্যে আপনার আশা পূর্ণ না হয়, তবে দ্বিতীয় ১১ দিনের মধ্যে আল্লাহ সে আশা অবশ্যই পূর্ণ করে দিবেন। (পরীক্ষিত ]
–ইয়া বাছীরু! (হে সর্বদ্রষ্টা!) প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পর কিছুক্ষণ কোরআন মজীদ তিলাওয়াত করে ১০০ বার আল্লাহর এ সিফাতী নামটি পড়লে, পাঠকের রাতকানা দোষ দূর হয়ে যায়, সাংসারিক বুদ্ধি প্রবল হয় এবং আল্লাহ তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
–ইয়া-হাকামু! (হে ফয়সালাকারী!)
এ নাম দিনে স্মরণ রাখলে রাতের কাজ সহজ হয়ে যায় এবং রাতে স্মরণ রাখলে পরবর্তী দিনের কাজ সহজতর হয়ে উঠে।
–ইয়া-আলু! (হে সূক্ষ্ম বিচারক!)
(১) ভ্ৰষ্টা স্ত্রীর কপালের উপরিভাগের একগুচ্ছ চুল ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুলে পেঁচিয়ে ক্রমাগত ৩ দিন পর্যন্ত সূর্যাস্তের সময় ৩ বার করে সরবে এ নাম উচ্চারণ করলে তার গুপ্ত-প্রণয়ী হাতে হাতে ধরা পড়বে। যে কোন শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম আরম্ভ করতে হবে। পরবর্তী শনিবারের আগে সে ধরা না পড়লে দ্বিতীয় শনিবার হতে পুনরায় তিন দিন এ আমল করতে হবে। যদি দ্বিতীয় সপ্তাহেও ধরা না পড়ে, তৃতীয় সপ্তাহে অবশ্যই ধরা পড়বে।
(২) জিলহজ্জ চাঁদের শেষ শুক্রবার জুমআর নামাযের নিয়তে ওযু-গোসল করে নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে আতর লাগাবেন। তারপর একখণ্ড চতুষ্কোণ কাগজের চার কোণায় আরবী অক্ষরে লিখবেন JAঃ; কাগজটির মাঝখানে লিখবেন এli; তারপর পিতল কিংবা রৌপ্য অর্থাৎ যে কোন এক প্রকার ধাতু নির্মিত তাবিজের মধ্যে সে কাগজখানা সযত্নে পুরে কাবামুখী হয়ে ঘরের ভিটিতে পুঁতে দিবেন। অতঃপর কারো সাথে (বাড়িতে বা পথে কোনরূপ) আলাপ না করে দুরূদ শরীফ পড়তে পড়তে মসজিদে গিয়ে জুমআর নামায আদায় করবেন।
আল্লাহর রমহমতে সে ঘরের ভিটিতে তাবিজ থাকা অবধি চোরের সাধ্য নেই যে, কোন জিনিস চুরি করে নিতে পারে। (পরীক্ষিত ]।
–ইয়া লাতীফু! (হে অনুগ্রহকারী!)।
(১) যেসব যুবক-যুবতাদবীর বিবাহ হচ্ছে না বা মনোমত পাত্রী কিংবা পাত্র মিলছে না, তারা পবিত্র অবস্থায় এক টুকরো কাগজে আরবি অক্ষরে a. h। ৫ লিখে তাবিজের মত গুটিয়ে ঘরের জানালায় নতুন সুতো দিয়ে এমনভাবে বেঁধে ঝুলিয়ে দিবে–যেন বাতাসে এটা দোল খেতে পারে। আল্লাহর দয়ায় অচিরেই তাদের আশা পূর্ণ হয়ে যাবে।
(২) কঠোর প্রাণ মনিবের দিকে চেয়ে অত্যাচারিত দাস-দাসী বা অধীনস্থ লোকেরা মনে মনে উক্ত নাম পড়লে, সে মনিব তাদের প্রতি রহমদেল হয়ে উঠবে।
-ইয়া-খাবীরু! (হে সর্বজ্ঞ!)
(১) পরীক্ষার্থীরা কিংবা কোন কঠিন সমস্যায় পতিত লোকেরা ৭ দিন ধরে সুবেহ্ সাদিক হতে সুর্যোদয় পর্যন্ত (ফজরের নামাযের আগে ও পরে) আল্লাহর এ নাম ১০০১ বার পাঠ করলে, অবশ্যি সুফল লাভ করবে।
(২) কোন জিনিস চুরি বা হারানো গেলে একখণ্ড কাগজে এ নাম (ওযু অবস্থায়) লিখে সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষের (যে কোন একটি) পাতার সাথে বেঁধে দিলে, সে জিনিস ফিরে পাওয়া যাবে, যদি এর পূর্বেই তা নষ্ট হয়ে না থাকে।
[হারানো জিনিস হলে উক্ত কাগজটির নিচে জিনিসটির নাম এবং চোরে নিলে সন্দিগ্ধ চোরের নাম লিখে দিতে হবে।
–ইয়া-হালীমু! (হে পরম ধৈর্যশীল!)
(১) এ নামের আমল করলে ধন-জন, রূপ-গুণ ও সর্দারী স্থায়ী থাকে।
(২) অব্যবহৃত চীনা মাটির বাসনে জান কালি দিয়ে এ নাম ৩৬৫ বার লিখে তা ধুয়ে সে পানি ক্ষেতে ছিটিয়ে দিলে শস্যাদি কীটের আক্রমণ হতে রক্ষা পায়। ব্যবসায়ীর দাঁড়িপাল্লায় ছিটিয়ে দিলে বেচা-কেনা অধিক হয়।
–ইয়া-আযীমু! (হে মহীয়ান!)
চাকরী হারা লোক ও স্বামী কর্তৃক অবহেলিতা রমণী ৭ দিন পর্যন্ত সূর্যোদয়ের সময়ে ১০০০ বার হিসাবে উক্ত নাম পাঠ করলে, তাদের আশা আল্লাহ তাআলা অবশ্যই পূর্ণ করে দিবেন।
–ইয়া-গাফুরু! (হে ক্ষমাশীল!)
দেশে কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেলে, অবিবাহিত যুবকরা মিলে এশার নামায বাদ এ পাক নাম সূর করে পড়তে পড়তে সমস্ত গ্রাম ঘুরলে, আল্লাহ তাআলা দয়া করে সে রোগ দূর করে দেন।
ইয়া-শাকূরু! (হে শ্রেষ্ঠ গুণগ্রাহী!)
(১) কন্যাদায়গ্রস্ত ও ঋণদায়গ্রস্ত ব্যক্তিরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ৭ দিন পর্যন্ত ২১ বার করে আকাশের দিকে মুখ রেখে এ নাম পাঠ করলে শীঘ্রই ওসব দায়মুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়।
(২) রুক্ষ স্বভাব সম্পন্ন মাতা-পিতা ও শিক্ষকের দিকে চেয়ে চেয়ে এ নাম পড়লে, অচিরেই তাঁদের প্রিয় হয়ে উঠা যায়
–ইয়া-আলিয়ু! (হে সমুন্নত!)
এ নাম সকাল-সন্ধ্যা পড়লে, ধূর্ত ও চোগলখোর ললাখেরা কোন ক্ষতি করতে পারে না।
-[-ইয়া-কাবীরু! (হে মহিমান্বিত!)
এ নাম আমলে রাখলে, সব রকম বিপদ হতে বেঁচে থাকা যায়। এ নাম কয়েক বার পাঠ করে খাদ্যদ্রব্যের উপর তিনটি ফুঁক দিয়ে সেই খাদ্য একই বরতনে স্বামী-স্ত্রীতে আহার করলে, ঝগড়াটে-স্ত্রীও প্রগাঢ় প্রণয়ে আবদ্ধ হয়ে যায়।
–ইয়া হাফীযু! (হে হেফাজতকারী!)
এক টুকরো কাগজের চার কেণে চারজন প্রধান ফেরেশতার নাম হযরত জিবরাঈল, হযরত মিকাঈল, হযরত ইরাফিল ও হযরত আযরাঈ (আ)] লিখে কাগজটির মধ্যখানে ইয়া আল্লাহু একবার ও ইয়া-হাফীযু একবার লিখে তাবিজ করে সাথে রাখলে, বাঘ-ভালুক, ভূত-প্রেত তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এ ব্যক্তি আগুণে বা নৌকাডুবিতে পড়বে না।
–ইয়া মুক্বীতু! (হে শক্তিদাতা!)
প্রবাসী ব্যক্তি এ নামটি নতুন মৃৎপাত্রে লিখে তা পানিতে ধুয়ে পান করলে, বিদেশে থাকার চাঞ্চল্য ও অশান্তি দূর হয়ে যাবে।
–ইয়া-জালীলু! (হে শক্তিদাতা!)
এ নাম সীনার উপর শাহাদৎ অঙ্গুলির ইশারায় লিখে বিসমিল্লাহ বলে ঘর হতে বের হলে, প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত আল্লাহ তাকে সর্ববিষয়ে নিরাপদ রাখেন।
–ইয়া-কারীমু! (হে করুণাময়!)
এ নাম হামেশা পাঠকারি কখনও বিপদাপন্ন হয় না।
–ইয়া রাকীবু! (হে তত্ত্বাবধানকারী!)।
(১) এ নাম প্রত্যহ পাঠ করলে, আকস্মিক বিপদ, দৈবমৃত্যু প্রভৃতি হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
(২) মৃতবৎসা রমণী প্রত্যহ এ নাম পাঠ করলে গর্ভপাত হয় না।
(৩) এ নাম ওযূর সাথে ৭ বার পড়লে, হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়। এতে না পাওয়া গেলে ২১ বার পড়তে হবে। যদি এতেও পাওয়া না যায়, তবে ৬৩ বার পড়তে হবে। এতেও পাওয়া না গেলে ১৮৯ বার পড়তে হবে। যদি এতেও পাওয়া না যায়, তবে বুঝতে হবে জিনিসটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে বা নাগালের বাইরে চলে গেছে।
–ইয়া-মুজীবু! (হে প্রত্যুত্তরদাতা!)
(১) এ নাম ১০০ বার পড়ে মুনাজাত করলে, তখনই তা কবূল হয়ে যায়।
(২) যারা এ নামকে জপমালা করেন, তাদের অন্তর আল্লাহর মহব্বতে পূর্ণ হয়ে যায়। লোক সমাজে ইজ্জত বেড়ে যায়।
–ইয়া ওয়াসিউ! (হে প্রশস্তকারী!)
(১) সর্বদা এ নাম পাঠ করলে, ধন-জন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
(২) তাহাজ্জুদ নামায বাদ এ নাম ১০০০ বার হিসেবে পাঠ করতে থাকলে, কালবের মধ্যে আল্লাহর নূর চমকিতে থাকে। (কাওলুল জামীল
-ইয়া-হাকীমু! (হে বিজ্ঞানময়!)
(১) যারা সকাল সন্ধ্যায় এ নাম ১০০ বার হিসেবে পাঠ করেন, তাদের গুণাহগুলো আল্লাহ গোপন রেখে নেকগুলোক বৃদ্ধি করে দেন।
(২) ১০০ বার এ নাম পাঠ করে পরীক্ষা দিতে আরম্ভ করলে, পরীক্ষার্থী সফলকাম হয়। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
–ইয়া-ওয়াদূদু! (হে পরম বন্ধু!)।
(১) এ নাম একখণ্ড কাগজে ২১ বার (আরবি অক্ষরে) লিখে (তাবিজে ভরে) ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে বা গলায় বেঁধে দিলে নিদ্রাকালে আর পেশাব করবে করবে না।
(২) অশান্ত ও অবাধ্য ছেলেমেয়েদের শিরোপরি হাত বুলাতে বুলাতে ৭ বার এ নাম পাঠ করতে থাকলে, ক্রমে ক্রমে তারা বাধ্য ও শান্তশিষ্ট হয়ে উঠবে।
(৩) এ নাম ১০০১ বার পাঠ করে এক গ্লাস শরবতের উপর একটি ফুঁক দেবেন। তার পর। ৩ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করার সময় তিন বার তিনটি ফুঁক দিয়ে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের মুখ হতে টেনে টেনে নিয়ে অর্থাৎ কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলবেন। আল্লাহর দয়ায় উভয়ে উভয়ের জন্য প্রেম-পাগল হয়ে যাবেন।
-ইয়া-মাজীদু! (হে মহীয়ান!)
প্রত্যেক চাঁদের ১৩, ১৪ তারিখে এ নাম ৭০ বার করে পড়লে, ধবল রোগ (শ্বেত রোগ) ভাল হয়ে যায়।
–ইয়া-বা-য়িছু! (হে পুনরোত্তলনকারী!)
যাদের মেধাশক্তি কম, কিছুই মনে থাকে না, তারা প্রথম দিন একবার, দ্বিতীয় দিন তিন বার, তৃতীয় দিন ৫ বার এভাবে প্রত্যহ সূর্যোদয়কালে বুকের উপর হাত রেখে বিজোড় সংখ্যায় বাড়িয়ে পড়তে পড়তে ১০১ বারের সংখ্যা পৌঁছবেন। আল্লাহ স্মরণশক্তি বাড়িয়ে দিবেন।
–ইয়া-শাহীদু! (হে সাক্ষ্যদাতা!)
কিছুদিন পর্যন্ত ফজরের নামাযের আগে ও পরে এ পাক নাম ১০১ বার পাঠ করে অবাধ্য স্ত্রী বা অবাধ্য ছেলে-মেয়েকে বাধ্য করে দেয়ার জন্য আল্লাহর স্মরণে মুখ হয়ে অর্থাৎ মুখে কিংবা মনে মনেও কিছু না বলে কিছুক্ষণ আকাশ পানে মুখ তুলে চেয়ে থাকবেন। আল্লাহ দয়া করে তাদেরকে বাধ্য করে দিবেন।
–ইয়া-হাক্কু! (হে সাক্ষ্যদাতা!)
সুবহে সাদিকের সময় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দু হাত উপরের দিকে লম্বা করে উঠিয়ে আকাশ পানে চেয়ে এ নাম পাঠ করলে, নসীব বুলন্দ হয়।
–ইয়া ওয়াকীলু! (হে সহায়তাকারী!)
(১) এ নাম পাঠ করতে করতে যানবাহনে আরোহণ করলে, দৈব-বিপদ হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
(২) বিদেশে এ নাম পড়লে, মনে শান্তি পায়।
–ইয়া কৃাওয়িয়ু! (হে অপরাজেয়!)
আটা দিয়ে ১০০১টি গুলি তৈরি করে আল্লাহর এ সিফাতী নামটি পড়বেন এবং এক একটি গুলীর উপরে একটি করে ফুঁক দিয়ে যাবেন। এভাবে পড়া শেষ হলে, গুলীগুলো কাক, মোরগ প্রভৃতি পাখীদের খেতে দেবেন। ওরা যখন তা হুড়াহুড়ি করে খেতে থাকবে, তখন আপনি হাত তুলে মুনাজাত করবেন–হে আল্লাহ! আমার শত্রুকে দমিয়ে দিন। যদি সে ব্যক্তি অনর্থক বা অন্যায়ভাবে শত্রুতা করে, তবে অবশ্যই দমিত হবে। শত্রুতা বা ঝগড়া যদি ন্যায্য হয়, তবে কিছুই ফল হবে না।
–ইয়া-মাতীনু! (হে অবিচল!)।
এ নাম নতুন চীনা মাটির বাসনে ২১ বার জাফরান দিয়ে লিখে তা ধুয়ে অতি কাঁদুনে ছেলেকে খাওয়ালে কান্না স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যে স্ত্রীলোকের স্তনে অসময়ে দুধ কমে যায়, তাকে এরূপ পানি কিছুটা পান করালে ও বাকীটুকু স্তনে মেখে দিলে আল্লাহর দয়ায় দুধ বৃদ্ধি পায়।
–ইয়া ওয়ালিয়ু! (হে রক্ষাকারী!)
একাদিকক্রমে ৭ দিন এশার নামায বাদ একবার দরূদে তাজ ও ১০০ বার এ নাম পাট করে নতুন ব্যসায়ে হাত দিলে, নতুন বাড়ি-ঘর বানানো শুরু করলে ও বিবাহের কাজ আরম্ভ করলে, আল্লাহর ফজলে তা সফলপ্রসূ হয়।
–ইয়া-হামীদু! (হে প্রশংসিত!)
এ নাম আমলকারীকে সবাই ভালবাসে এবং তার দেহ ও মনের সব রোগ দূর হয়ে যায়।
–ইয়া-মুছিয়ু! (হে শুমারকারী!)
(১) ইবাদত করতে যাদের মনে কোন মজা বা আগ্রহ লাগে না, তারা প্রত্যেক শুক্রবার রাতে (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে) এ নাম ১০০ বার পড়ে ঘুমাবেন ইনশাআল্লাহ ইবাদতে একাগ্রতা আসবে।
(২) এ নাম ৭ বার পড়ার সাথে সাথে পুরোন পাট বা লাল সুতোর উপর একটি করে ৭টি ফুঁক ও ৭টি গিঁট দিয়ে যাবেন। তারপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবেন। এভাবে ৩ দফে ৩ বার দুরূদ পড়া খতম করে ২১টি গিঁট দেয়া সেই পাট বা সুতো দুগ্ধবতী গাভী বা ছাগীর গলায় বেঁধে দিলে, কারোবদনজর লাগতে পারবে না।
–ইয়া-মুবদিয়ু! (হে আদি স্রষ্টা!)
প্রথমে ১০০ বার দুরূদ শরীফ তারপর ১০০ বার ইয়া মুবদিয়ু এবং তারপর পুনরায় ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করে নতুন কাজে হাত দিলে, সে কাজ সহজসাধ্য হয়ে যায়।
–ইয়া-মুঈদু! (হে স্থিতিদানকারী!)।
(১) যাদের পারিবারিক আচার-ব্যবহার খারাপ হয়ে গিয়েছে, আধুনিকতার প্রকোপে রোযা-নামায বাদ হয়ে যাচ্ছে, যাদের পরিবারের যে ব্যক্তি পরহেজগার ও নামাযী, সে ব্যক্তি প্রতিশ্বাসে একবার করে প্রত্যহ ১০০ বার এ নাম পাঠ করতে থাকলে, পুনরায় তারা ইসলামী ভাবধারায় ফিরে আসবে।
(২) যেসব হাফেয কোরআন পাকের অংশবিশেষ ভুলে গেছেন, তাঁরা এ নাম বেশি বেশি পাঠ করলে, বিস্মৃত অংশ আবার স্মরণে আসবে।
(৩) কথা বলতে মূল বক্তব্যের খেই হারিয়ে ফেললে, ইয়া মুঈদু পাঠ করবেন। ইনশাআল্লাহ তা মনে পড়বে।
-ইয়া-মুহয়ি! (হে জীবিতকারী!)
(১) যে কোন বিপদে পড়ে এ নাম পাঠ করলে উদ্ধার পাওয়া যায়।
(২) এক টুকরো কাগজের মাঝখানে একটি দুরূদ শরীফ লিখুন। এটার তিন কোণে লিখুন অপর কোণে লিখুন, তারপর এ কাগজখানা তাবিজে ভরে মৃতবৎসার বাম-বাজুতে বেঁধে দিন। ইনশাআল্লাহ সন্তান আর নষ্ট হবে না।
–ইয়া-মুমীতু! (হে মৃত্যুদাতা!)
যে বিবাহিত পুরুষ বদখেয়ালে বাইরে বাইরে বেশি ঘুরে, ঘরের স্ত্রীকে দেখতেই পারে না, তার স্ত্রী প্রত্যেক শুক্রবার দিন সকালে ফজরের নামায ঠিক সময়ে আদায় করে সে ওযূতেই স্ব হস্তে আটার রুটি প্রস্তুত করবেন। এরপর সে রুটি হাতে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে নজর রেখে রুটির উপর ডান হাতের শহাদৎ অঙ্গুলি ঘুরাতে ঘুরাতে ৩ বার। পড়বেন–ইয়া-মুমীতু। তারপর উপর দিকে নজর রেখেই অশ্রু বিজড়িত কণ্ঠে বলবেন–“হে আল্লাহ! আমার স্বামীর বদভ্যাস দূর করে দিন। তাঁকে সুমতি ফিরিয়ে দিন। অতপর স্বামী যখন নাশতা খেতে বসবে তখন ঐ রুটি দ্বারা তাঁকে নাশতা খেতে দিবে। এভাবে ৩ দিনের চেষ্টায় সুফল পাওয়া না গেলে ৫, ৭, ৯ দিন চেষ্টা করতে হবে। ইনশাআল্লাহ অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে।
–ইয়া-হাইয়ু! (হে চিরজীবন্ত!)
এ নাম চিরদিনের জন্য অজিফা করলে, স্বাস্থ্য, ধন-দৌলত ও সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকে।
–ইয়া-কাইয়ুমু! (হে সর্বত্র বিরাজমান!)
যখন কেউ চা, দুধ বা সরবৎ পান করতে উদ্যত হয়–এখনো ওতে চুমুক দেয়নি, ঠিক এমন সময় মনে মনে ইয়া কাইয়ুমু ৩ বার পড়ে তার পানীয়ের উপর (সে না দেখে, এমনভাবে) একটা ফুঁক দিয়ে দিলে, সে ঠুকদানকারীকে ভুলতে পারবে না।
সাবধান! গুপ্ত-প্রণয়ীর সাথে এরূপ করা নিষিদ্ধ; এরূপ করলে পাপই হবে, ফল হবে না। স্ত্রী-পুত্রাদির সাথে করা যাবে।
–ইয়া-ওয়াজিদু! (হে সৃষ্টিকারী!)
বিয়ের পর নববধূ যখন প্রথম স্বামীর বাড়িতে শুভযাত্রা করে, তখন মেয়ের পিতা, মাতা বা সহোদর বড় ভাই (যদি তারা কেউ না থাকে, তবে চাচা, মামা বা অন্য কেউ), পরিধানের শাড়ীর আঁচলের একটি কোণা হাতে নিয়ে ৭ বার এ নাম পাঠের সাথে সাথে ৭টি ফুঁক দিয়ে একটি শক্ত গিঁট দিয়ে দিলে, তাকে কোনদিন জিন-পরীতে আছর করতে পারবে না এবং শ্বশুরবাড়ির সকলের কাছেই প্রিয় হয়ে উঠবে।
–ইয়া-ওয়াহিদু! (হে একক!)
প্রর্তেক মাসে যেদিন আকাশে নতুন চাঁদ দেখা দেয়, সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে (চাঁদ উঠার) মুনাজাত করার পর মুখ মুছবার সময় ৩ বার এ নাম সরবে উচ্চারণ করলে, সারা জীবনেও হাত একদম খালি হবে না।
–ইয়া-আহাদু! (হে অদ্বিতীয়!)
(১) এ নাম সর্বদা পাঠ করলে, অন্তরে আল্লাহর নূর চমকাতে থাকে। বদ কাজের প্রতি ঘৃণা ও সৎ কাজের প্রতি আসক্তি জন্মে।
(২) শেষ রাতে উঠে এ নাম পড়তে থাকলে, তার নেগাহবানীতে নিয়োজিত ফেরেশতারা এবং ভ্রাম্যমান ফেরেশতারাও তার সাথে এ নাম পড়তে থাকেন। ফেরেশতাদের পড়ার সওয়াবও এ ব্যক্তির আমলনামানায় লিখে রাখা হয়। [আল-হাদীস]
(৩) শুক্রবার শেষ রাতে (জুমআর রাতে) আগে পিছে ১১ বার করে এস্তেগফার ও দুরূদ শরীফ পড়ে ১০০ বার ইয়া আহাদু নাম পাঠ করলে, সুবেহ সাদিক শুরু হওয়ার আগেই এ ব্যক্তির সমগ্র জীবনের গুণাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। [ হিসনে হাসীন ]
–ইয়া-ছোঁয়ামাদু! (হে স্বয়ংসম্পূর্ণ!)
(১) যাদের শুধুই মেয়ে সন্তান হচ্ছে, তারা স্বামী-স্ত্রীতে পৃথক পৃথক জায়নামাযে ওয়াক্তিয়া নামায আদায় করার পর একই জায়নামাযে বসে উভয়ে ১০০ বার করে এ নাম পড়তে থাকলে, আল্লাহর দয়ায় ছেলে সন্তান হবে।
(২) কোন মানুষকে টাকা-পয়সা হাওলাতে দেয়ার সময় ৭ বার ইয়া-ছোঁয়ামাদু পড়ে টাকা-পয়সার ওপরে ৭টি ফুঁক দিয়ে দিলে, সে ব্যক্তি শীঘ্রই তা পরিশোধ করে দেবে। [পরীক্ষিত)।
–ইয়া-কা-দিরু! (হে সর্বশক্তিমান!)
ওযূর পর সেখানেই দাঁড়িয়ে ৩ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করবেন। তারপর উপর দিকে চেয়ে আপনার যে সাধ পূর্ণ হচ্ছে না, তার কথা মনে রেখে ৩ বার পাঠ করুন ইয়া-কা-দিরু, ইনশাআল্লাহ অচিরেই আপনার সাধ পূর্ণ হয়ে যাবে।
–ইয়া-মুতাদিরু! (হে সর্বশক্তির উৎস!)
(১) বদমেজাজ ও বেপরোয়া লোকদের চোখে চোখে চেয়ে সরবে এ নাম উচ্চারণ করতে থাকলে, স্বামীর আদরিণী হয়ে উঠবে।
(২) যারা বিদেশে গিয়ে যে-কোন কারণে আটকা পড়ে গেছে, তারা প্রত্যেক জুমআর রাতে ১০০০ বার করে এ নাম পড়তে থাকলে, শীঘ্রই বাড়ি ফিরার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
–ইয়া-আউয়ালু। (হে অনাদি!)
(১) যে স্ত্রী স্বামীর অনাদরে পিত্রালয়ে অজিজ্ঞাসিতভাবে পড়ে আছে, সেই স্ত্রীলো প্রত্যেক ওয়াক্ত নামায বাদ নামাযের বিছানা উঠাতে উঠাতে স্বামীর চেহারা খেয়াল করে ৩ বার উক্ত। নাম পাঠ করবে। এভাবে কিছুদিন পাঠ করতে থাকলে, স্বামীর আদরিণী হয়ে উঠবে।
(২) যারা বিদেশে গিয়ে যে কোন কারণে আটকা পড়ে গেছে, তারা প্রত্যেক জুমুআর রাতে ১০০০ বার করে এ নাম পাঠ করতে থাকলে, শীঘ্রই বাড়ী ফিরার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
–ইয়া-আ-খিরু! (হে অনন্ত)
কোন কাজে বার বার বিফলমনোরথ হলে, প্রত্যহ সুবেহ সাদিকের সময় খোলা মাঠে হাঁটতে হাঁটতে এ নাম পাঠ করবেন। ইনশাআল্লাহ সে কাজ সফল হয়ে যাবে। [ পরীক্ষিত ]
–ইয়া-যোয়া-হিরু! (হে প্রকাশ্য!)
এ নাম সূর্যোদয়কালে ১০০ বার, পূর্ণিমা রাতে ১০০ বার ও প্রতি শুক্রবার দিন নামাযের নিয়তে মসজিদের ভিতর ঢুকতে প্রথম পদক্ষেপের উপর দাঁড়িয়ে থেকে ১০০ বার পড়ার অভ্যাস। করলে, তার কুালবে আল্লাহর নূর এমনভাবে চমকিতে থাকবে যে, আল্লাহ যেন তার চোখের সামনে, ডানে-বামে ও আগে-পিছনে হরদম হাজির-নাযীর আছেন।
–ইয়া-বা-ত্বিনু! (হে গুপ্ত!)
(১) রাতকানায় ধরলে অর্থাৎ চলতি-পথে অন্ধকারে পথের দিশা করতে না পারলে, ইয়া বা-ত্বিনু পাঠ করতে থাকবে। শীঘ্রই পথের দিশা পেয়ে যাবেন।
(২) প্রত্যেক জুমআ রাতের শেষভাগে দু রাকআত নফল নামাযের প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরাহ ইখলাছ ৩ বার পড়ে নামায আদায় করুন। এরপর ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করে মুনাজাত করুন–হে আল্লাহ! দয়া করে আমার কৃালবে আপনি স্থায়ী হোন। ইনশাআল্লাহ। আপনার সে আশা পূর্ণ হয়ে যাবে।
(৩) সূর্য লাল হয়ে উঠতে যতক্ষণ সময় লাগে, ঐ সময়টুকুতে সূর্যের দিকে শাহাদৎ অঙ্গুলির ইশারা দিতে দিতে যে কয়বার সম্ভব ইয়া বা-ত্নিনু পাঠ করুন। তারপর সূর্য উঠে গেলে তার দিকে পেছন দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে আরবী পেশ করুন–হে মাবুদ! কে আমার বিরুদ্ধে এমন শত্রুতা করছে, দয়া করে জানিয়ে দিন। অচিরেই সে অজ্ঞাত শত্রু ও তার চক্রান্ত প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
–ইয়া-ওয়ালিয়ু! (হে সাচ্চা অভিভাবক!)।
(১) যারা হামেশা এ নাম পাঠ করেন, শত্রু তার কোন ক্ষতি করতে পারে না।
(২) বিপুল ধারায় গর্জন, বর্ষণ ও তুফান আরম্ভ হয়ে গেলে এ নাম একখণ্ড কাগজে লিখে ভরা কলসীতে ডুবিয়ে রাখুন। ইনশাআল্লাহ এ বিপদে অপনি সপরিবারে নিরাপদে থাকবেন।
–ইয়া-মুতাআ-লী! (হে মহামহীম!)
(১) একখণ্ড কাগজকে ত্রিকোণাকারে কেটে প্রত্যেক কোণায় ৩ বার করে মোট ৯ বার এ নাম লিখুন। তারপর লোহার তাবিজে ভরে তা ঘরের টুয়ার সাথে বেঁধে দেন। চোর মালপত্রাদি চুরি করে নিয়ে যেতে পারবে না।
(২) এ নাম যত বেশি সংখ্যায় কেউ পড়বে, দেশের মানুষ তত বেশি তার বাধ্য হয়ে উঠবে।
–ইয়া-বাররু! (হে শান্তিদাতা!)
শিশু ছেলে-মেয়েরা যখন খেলতে থাকে, এমন সময় মা-বাপ বা বড় ভাই-বোনদের সামনে দেখতে পেয়ে যখন তারা ইচ্ছা করে কাছে ছুটে আসে সোহাগের আশায়; তখন ওদের ইয়া বাররু বলে ফুঁক দিয়ে কোলে উঠিয়ে নিলে, ওরা সুস্থ চাঙ্গা হয়ে উঠে। কিন্তু নিজে ডেকে এনে ঐরূপ তদবীর করলে ফল হবে না। ]
–ইয়া-তাওয়া-বু! (হে তওবা কবুলকারী!)
(১) আসামী হাকিমের প্রতি লক্ষ্য করে এ নাম পড়তে থাকলে, হাকিম তার প্রতি সদয় হয়ে উঠে।
(২) এ নামের গুণে আল্লাহ পাঠকারীর জীবনের গুণাহ্ মাফ করে দেন।
–ইয়া-মুনতাক্বীমু! (হে প্রতিশোধ গ্রহণকারী!)
দুর্দান্ত শত্রুকে পরাস্ত করতে হলে জুমআর দিন ঠিক দ্বিপ্রহরের সময় উঠানের মধ্যস্থলে শত্রুর পিতার নাম লিখুন। এ নামের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে দুটি রেখা গুণ চিহ্নের মত টেনে দিন। রেখা দুটির উপর আপনার শত্রুর নাম লিখুন। অতঃপর মুখে ইয়া-মুনতাকুমু পড়ন এবং শহাদৎ অঙ্গুলীর নখ দ্বারা শত্রুর নামের উপর কয়েকটি করে আঁচড় কাটুন। এভাবে ৭ দফে ৭ বার আঁচড় কেটে উধ্বমুখ করে বলুন। হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে আত্মসমর্পণ করলাম। এভাবে ৭ জুমআ চেষ্টা করার পূর্বেই শত্ৰুটি শত্রুতা ক্ষান্ত দিতে বাধ্য হবে।
–ইয়া-রাউফু! (হে অকৃত্রিম বন্ধু!)
(১) নিরাশ রোগীর শিয়রে বসে এ নাম ১০০১ বার পাঠ করলে (যদি হায়াত থাকে) রোগী ভাল হয়ে উঠবে।
(২) যতক্ষণ স্বামী আহার করতে থাকেন, ততক্ষণ স্ত্রী মনে মনে এ নাম পাঠ করতে করতে পাখা করতে থাকলে, স্বামী তার প্রেমে আকণ্ঠ মগ্ন হয়ে পড়বেন। (একদিনে তা না হলে, বেশি দিন এ চেষ্টা করুন।)
(৩) আঁতুর ঘরে সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে মা যখন প্রথম চোখ ফিরায়, তখন সশব্দে 6 তিন বার উচ্চারণ করলে, সে সন্তান অত্যন্ত মাতৃভক্ত হয়।
–ইয়া-রব্বু! (হে প্রতিপালনকারী!)
এ নাম যাদের মুখে মুখে থাকে তাদের গোলা ভরা রিযিক থাকে।
–ইয়া-মুকসিতু! (হে ন্যায়বিচারক!)
যারা কিছুতেই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না, তারা শনি-মঙ্গলবারে সূর্য যখন লাল হয়ে ডুবতে আরম্ভ করে, ঠিক সে সময় ঐ সূর্যের দিকে চেয়ে পাঠ করতে থাকবেন ইয়া-মুকসিতু! সূর্য ডুবে গেলে নিঃশব্দে ঘরে ফিরে আসবেন। শীঘ্রই সে অত্যাচারী ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
–ইয়া-জা-মিউ! (হে সমাবেশকারী!)
(১) এ নাম আমলে রাখলে স্বজনেরা অনুগত থাকে, অভাবিতভাবে টাকা-পয়সা হাতে আসে, হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া যায়, আল্লাহ খুশি থাকেন।
(২) প্রভাতে শিশির-বিন্দু সংগ্রহ করে তা কেরোসিনের কুপির শিশের সাথে মিশিয়ে কালি তৈরি করুন। এ কালি দ্বারা এটা কোন শুকনো পাতার উপর ভ্ৰষ্টা স্ত্রীর নাম লিখুন। এ নামের উপরে-নিচে, ডানে ও বামে লিখুন–০; তারপর পাতাটি আপনার বিছানার নিচে (শিয়রের দিকে) রেখে দিন। অচিরই সে ভ্রষ্টা স্ত্রীর গুপ্ত-প্রণয়ী ধরা পড়ে যাবে।
(৩) যে বিবাহিত যুবতী স্বামীর বাড়ি যেতে চায় না, গুপ্ত প্রণয়ীর প্রণয়ের আশায় থাকে কিংবা রূপ ও বিদ্যার দেমাগে স্বামীকে উপেক্ষা করে চলে, ওদের স্বামীরা স্ব-স্ব স্ত্রীর ঘুমের সময় শিয়রের দিকে বসে তার প্রত্যেকবার শ্বাস টানার সাথে সাথে ইয়া-জা-মিউ নামটি উচ্চারণ করে নাকের সামনে এমনভাবে একটা কুঁক দিয়ে দিবেন যেন তার শ্বাস টানার সাথে আপনার ফুকটি ভেতরে ঢুকে যায়। এভাবে ১০১ বার হিসাবে ৩ দিন এ আমল করলে, তার দেমাগী দূর হয়ে যাবে। যদি এতে যায়, তবে ৭ দিন এভাবে চেষ্টা করবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় অবশ্যই সেবাধ্য হয়ে উঠবে।
–ইয়া-গানিয়ু! (হে অমুখাপেক্ষী!)
এ নাম পড়লে, আল্লাহর প্রেমে অন্তর পূর্ণ হয়ে উঠে। তদুপরি আল্লাহ তদস্তী দূর করে দেন। এ নাম যে পড়ে তার কোন সদিচ্ছাই অপূর্ণ থাকে না।
–ইয়া-মুগ্নিয়্যু! (হে অভাব দূরকারী!)
(১) স্ত্রীসহবাসের সময় শ্বাস ভিতরে দিকে টেনে নেয়ার সময় ইয়া-মুগ্নিয়্যু পাঠ করে সেই শ্বাস যথাসম্ভব ভিতরে আটকে রাখলে, সহজে বীর্যপাত হয় না।
(২) বিছানায় শয়ন করতে যাওয়ার পূর্বে একটি ছোট পেয়ালায় গুণে গুণে ২১ ফোঁটা খাঁটি মধু ঢালবেন। তারপর ২১ বার ইয়া-মুগ্নিয়্যু পাঠ করার সাথে সাথে সে মধুতে ২১টি ফুঁক দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে চেটে-চেটে তা খাবেন। তারপর স্ত্রীসহবাস করলে সহজে বীর্যস্খলন হবে না।
(৩) গোসলের পর গোসলের ভিজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যহ ৩ অঞ্জলী পানি ৩ বার করে এ নাম পাঠ করে খুঁকে ফুঁকে পান করবেন। স্বাস্থ্য অটুট থাকবে। পৌরুষ বেড়ে যাবে।
–ইয়া-মুত্বিয়্যু! (হে অনুপম দাতা!)
যে কাজ হয়–হয় হয় না, এমন কাজে সফলতা লাভের জন্য এশার নামায বাদ ১০০ বার এ পাক নাম পাঠ করলে, অতি সত্বর তা সমাধা হয়ে যাবে।
–ইয়া-মা-নিউ! (হে প্রতিরোধকারী!)
প্রত্যহ বাদ ফজর ইয়া-মা-নিউ ১০০ বার হিসেবে, এস্তেগফার ১১ বার, দুরূদ শরীফ ১১ বার আউযু বিল্লা-হিস সামিইল আলীমি মিনাশ শাইতত্বা-নির রাজীম ৭০ বার ও হাসবিইয়াল্লাহ-হু ১০০০ বার পড়লে, ধূর্ত-মানব, জিন-পরী ও শয়তানের কি সাধ্য আছে যে, এ ব্যক্তির তিল পরিমাণ ক্ষতি সাধন কররতে পারে?
–ইয়া-দ্বোয়া-র্রু! (হে অনিষ্টকারী!)
কোন রোগ বা মুসিবতে পড়লে, ১০০ বার করে প্রতিদিন সকালে এ নাম পাঠ করতে থাকুন। নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে এ বিপদ থেকে রেহাই দেবেন। অজিফার নিয়মে পাঠ করলে পাপাসক্ত মনও পুণ্যসক্ত হয়ে উঠবে।
–ইয়া-না-ফিউ! (হে উপকারদাতা!) (১) এ নাম পড়লে কারবারে অসম্ভব উন্নতি হয়।
(২) চীনা বাসনের মধ্যে আরবি অক্ষরে এ নাম ১০১ বার জাফরান দিয়ে লিখে, তা ধুয়ে সে পানি কারবারের মালের উপর ছিটিয়ে দিলে, অজিজ্ঞাসিত মালেও প্রচুর লাভ হয়–যদি চোরাকারবারের মাল না হয়, অর্থাৎ হালাল ব্যবসায়ের মাল হয়।
–ইয়া নূ-রু! (জ্যোতির্ময়!)।
শেষ রাতে (তাহাজ্জুদ নামাযের পর ও সুবেহ সাদিকের আগে) ক্বালবের দিকে তাওয়াজ্জুহ্ হয়ে এ নাম ১০০০ বার পাঠ করলে, আল্লাহর নূরে হৃদয় আলোকিত হয়ে উঠে। চেহারায় জান্নাতী জ্যোতি ফুটে উঠে।
–ইয়া-হা-দিয়ু! (হে সৎপথপ্রদর্শক!)
সর্বদা এ নাম পড়লে গোমরাহী কেটে গিয়ে ইলমে-লাদুন্নীতে (গায়েবী ইলমে) অন্তর পূর্ণ হয়ে উঠে। সাবান যেমন দেহ ও কাপড়ের ময়লা দূর করে দেয়, এ নামের যিকিরও তেমনি হৃদয়ের ময়লা ছাফ করে দেয়। প্রত্যহ তাহাজ্জুদ নামায বাদ ১০০০ বার করে এ তাসবীহ পাঠ করলে, অলি-আল্লাহর দরজা লাভ করা যায়।
–ইয়া-বাদি্য়্যু! (হে বিনানুকরণে স্রষ্টা!)
(১) পুত্রহীন লোকেরা স্বামী-স্ত্রী মিলে রোযা-নামাযে পাবন্দ হয়ে প্রত্যেক নামায বাদ ১০০ বার এ নাম পাঠ করলে, আল্লাহর রহমতে তাদের সন্তান হবে।
(২) বেকারগণ এ নাম পড়লে, লোক চাকরী বা উপার্জনের ব্যবস্থা হবে।
–ইয়া-বা-ক্বিইয়্যু! (হে চির অক্ষয়!)
(১) মাগরিবের নামায বাদ যতক্ষণ পরিশ্চমাকাশের লালিমা থাকে, ততক্ষণ এ নামের যিকর করলে, যিকরকারী বদাচ রক্তহস্ত হয় না।
(২) সর্বদা পাঠ করলে পাঠকারী কোনরূপ আকস্মিক বিপদে পতিত হয় না।
–ইয়া-ওয়ারিছু! (হে স্বত্বাধিকারী!)
(১) কেউ সম্পত্তি আত্মসাৎ করে ফেললে এ নামের আমল করলে ফিরে পাওয়া যায়।
(২) সূপোর তকতির উপর এ পাক নাম খোদিত করে দুধের শিশুর গলায় বেঁধে দিলে টাকুরা রোগ অর্থাৎ আছেব-নজর লাগতে পারে না।
-ইয়া-রাশীদু! (হে সৎপথ প্রদর্শক!)
(১) এ নাম পড়ে নিয়মিতভাবে তওবার নিয়তে এতেগফার ও দুরূদ শরীফ পড়তে থাকলে, মনের পাপ-বাসনা দুর হয়ে যায় এবং নেক কাজে আসক্তি জন্মে।
(২) বেনামাযী ছেলে-মেয়েরা দিন-রাতের মদ্যে যতবার মা-বাপের চোখে চোখে চায়, ততবারই তার মা-বাপ মনে মনে ইয়া রাশীদু নাম পড়লে ওসব ছেলে-মেয়ে নামাযী হয়ে উঠে।
–ইয়া-দুবৃরু! (হে ধৈর্যশীল!)
এ নাম যিকরকারিগণ শীঘ্রই বিনয়ী, সংযমী, প্রিয়ভাষী ও ধনবান হয়ে উঠে।
–ইয়া-সাত্তা-রু! (হে গুনাহসমূহ গোপনকারী!) সর্বদা এ নাম যিকির করলে, আল্লাহ তাআলা যিকিরকারীর যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেন, সকাজ করার তৌফিক দান করেন। বান্দার প্রতি করুণা প্রকাশক নামগুলোর মধ্যে এটি মাবুদের অনন্য একটি বিশিষ্ট নাম।
–ইয়া-মা-লিকা মুকি! (হে জগতের মালিক!)
এ নামের যিকির দ্বারা সত্বর ধনবান হওয়া যায়।
–ইয়া যাল্জালা-লি ওয়াল্ ইক্রা-মি! (হে মহত্ত্ব ও গৌরবের অধিকারী!)।
আল্লাহ তাআলার সিফাতী নামসমূহের মধ্যে এটি অতীব বুজুর্গীওয়ালা একটি নাম। কোন কোন বুজুর্গানে দীনের ধারণা যে, এটিই ইসমে আযম! এজন্য এ নাম যিকির করলে অপরিসীম নেকী লাভ হয়। আশাতীত উন্নতি হয়। কোঃ জাঃ]
–ইয়া-গাফফা-রু ইগফিরলী যুনূবী! (হে গুনাহ ক্ষমাকারী! আমার গুণাহসমূহ ক্ষমা করুন।)
.
ঈমানের পরিচয়
ঈমান শব্দের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস বা আস্থা স্থাপন করা এবং ইসলামী পরীভাষায় তার অর্থ হচ্ছে মুখের স্বীকারোক্তিসহ আল্লাহ তাআলা ও তার গুণাবলী সম্পর্কে অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ও আল্লাহ তালার তরফ হতে তাঁর বান্দাদের কাছে যাকিছু পৌঁছেছে তা সমস্তই সত্য ধারণা করতঃ বিশ্বাস স্থাপন করা, এবং তদানুযায়ী আমল করা। একেই সাধারণ অর্থে ঈমান বা সংক্ষিপ্ত ঈমান বলা হয়। ইসলামী শরীয়ত একে ঈমানে মুজমাল নামে আখ্যায়িত করেছে। তা নিম্নরূপ :
.
ঈমানে মুজমাল
أمنت بالله كماهو باسمائه وصفاته وقبلت جميع أحكامه واركانه–
উচ্চারণ : আ-মান্তু বিল্লা-হি কামা-হুওয়া বিআসমা-য়িহী ওয়া ছিফা-তিহী ওয়া কাবিলতু জামীআ আহকা-মিহী ওয়া আরকা-নিহী।
অর্থ : আমি আল্লাহর প্রতি ও তাঁর যাবতীয় নামসমূহ ও গুণাবলীর প্রতি যথাযথভাবে বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং তাঁর সকল প্রকার আদেশ নির্দেশ ও বিধানসমূহ মেনে নিলাম।
মিশকাত শরীফে হযরত ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছে রাসূলে করীম (ছঃ) হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর প্রশ্নের জওয়াবে ঈমানের যেই ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, তাকে ঈমানে মুফাচ্ছাল বলা হয়। তা নিম্নরূপ :
.
ঈমানে মুফাস্সাল
أمن بالله وملئكته وكتبه ورسله واليوم الآخر والقدر خيره وشره
من الله تعالى والبعث بعد الموت .
উচ্চারণ : আ-মান্তু বিল্লাহি ওয়া মালা-য়িকাতিহী ওয়া কুতুবিহী ওয়া রুসুলিহী-ওয়াল ইয়াওমিল আ-খিরি ওয়াল কাদরি খাইরিহী ওয়া শাররিহী মিনাল্লা-হী তাআলা-ওয়াল বাআছি বাদাল মাওত।
অর্থ : আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর ফেরেশতাদেরর প্রতি এবং তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলদের প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি এবং তকদীরের ভাল-মন্দ আল্লাহর নিকট হতে এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের প্রতি।
এ সাতটি বিষয় হল ইমানের মূল অঙ্গ। এছাড়া ঈমানের আরও বহু শাখা প্রশাখা রয়েছে, যেমন–
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে?
الإيمان بضع وسبعون شعب أفضلها قول اله الا الله وأدناها إماطة
الأذى عن الطريق–والحياء شعبة من الإيمان–
অর্থ : ঈমানের সত্তরটিরও বেশী শাখা রয়েছে। তার শ্রেষ্ঠটি হচ্ছে, এ কথা বলা যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ উপাস্য নেই এবং নিম্নতমটি হচ্ছে রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু (কাটা) অপসারণ করা এবং লজ্জাবোধ করাও ঈমানের একটি শাখা।
ঈমানে মুফাচ্ছালের মধ্যে যে ৭টি বিষয়ের প্রতি ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, তার প্রথমটি হল, আল্লাহর প্রতি ঈমানএখন বাকী ৬টি ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করছি।
.
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
আল্লাহর সৃষ্ট ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনা বা বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ পাক স্বীয় আজ্ঞাবহ হিসাবে নূর দ্বারা পয়দা করেছেন। আমরা যদিও তাদেরকে দেখতে পাই না, তথাপি তাদের প্রতি ঈমান রাখতে হবে। তাদেরকে অবিশ্বাস করা আল্লাহ তাআলাকে অবিশ্বাস করার তুল্য। যেহেতু আল্লাহ পাক সূরা ফাতির এর প্রথম আয়াতে এরশাদ করেন।
অর্থ : যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের স্রষ্টা, এবং দু দু, তিন তিন ও চার চার পাখা (বাহু) বিশিষ্ট ফেরেশতাদেরকে সংবাদ বাহক রূপে নিয়োজিত করেছেন। তিনি ইচ্ছা করলে তাদের (আকৃতিতে, ও সংখ্যার প্রয়োজনে) বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সর্ব বিষয় ক্ষমতাবান।
ফেরেশতারা নিষ্পাপ। তাদের পানাহার, তন্দ্রা-নিদ্রা ও কু-প্রবৃত্তি নেই। তারা সর্বদা আল্লাহ। পাকের নির্দেশ ও তসবীহ্ তাহলীল পাঠে নিমগ্ন থাকেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিভিন্ন আকৃতির ধারণ করার শক্তি প্রদান করেছেন। অতএব, তাহারা প্রয়োজন মাফিক যে কোন আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম।.তা ছাড়া আল্লাহ পাকের হুকুমের বাইরে কিছুই করেন না। আল্লাহ তাআলা যাকে যেরূপ হুকুম করেন তারা তাই পালন করে থাকেন। তারা পুরুষও নন এবং স্ত্রীও নন, তাদের কোন কামরিপু নেই। তাদের সংখ্যা অগনিত আল্লাহ ব্যতীত কেউই তাদের সংখ্যা অবগত নয়। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির মাঝে নানা প্রকার কাজে নিয়োজিত করে রেখেছেন।
.
আল্লাহর কিতাবসমূহের উপর ঈমান
মহান পালনকর্তা আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলদের নিকট ফেরেশতাদের মাধ্যমে জিন ও ইনসানের হেদায়াতের জন্য তাঁর অনুমোদিত পথে জীবন নির্বাহের জন্য যে সকল হুকুম-আহকাম পাঠিয়েছেন তাকেই আসমানী কিতাব বলা হয়।
এসব আসমানী কিতাব আল্লাহ পাক জিন ও ইনসানের উপকারার্থে ফেরেশতার মাধ্যমে নবী-রাসূলদের নিকট অহী রূপে প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূলরা তা জিন ও মানব জাতাদবীর নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ পাক যে যুগে যে নবী রাসূলের প্রতি তাঁর বান্দার জন্য যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সে কিতাব সে যুগের বান্দাদের জন্য উপযোগী ছিল। সে যুগ ও নবী শেষ হবার পরে আল্লাহ তাআলা পরবর্তী যুগে নতুন নবীর প্রতি নতুন কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং পূর্ববর্তী কিতাবের হুকুম-আহকাম ও বিধানসমূহ রহিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ পাক এ প্রকারে যুগে যুগে নবীদের প্রতি মোট একশত চারখানা কিতাব নাজিল করেছেন। এগুলোর মধ্যে চারখানা কিতাব প্রধান, যথা : (১) যাবুর, (২) তওরাত, (৩) ইঞ্জিল ও (৪) ফোরকান বা কোরআন।
।তন্মধ্যে আল্লাহ তাআলা (১) হযরত দাউদ (আঃ)-এর নিকট যাবুর প্রেরণ করেছেন। (২) হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি তাওরাত নাজিল করেছেন। (৩) হযরত ঈসা (আঃ) এর নিকট ইঞ্জিল প্রেরণ করেছেন এবং সর্বশেষে (৪) হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)-এর নিকট সর্বশেষ কিতাব কোরআন শরীফ নাজিল করেছেন। অতঃপর আর কোন নবী-রাসূল দুনিয়ায় আগমন করবেন না এবং কোন আসমানী কিতাবও নাজিল হবে না। হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) হচ্ছেন সর্বশেষ প্রেরীত নবী ও রাসূল এবং কোরআন শরীফই হচ্ছে তাঁর প্রতি সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এ কোরআন শরীফ এবং এর হুকুম-আহকামসমূহ কেয়ামত পর্যন্ত অটুট ও বলবত থাকবে। অতঃপর আল্লাহর তরফ হতে আর কোন নবী-রাসূল বা কিতাব অবতীর্ণ হবে না। দুনিয়া যতদিন পর্যন্ত থাকবে, ততোদিন হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)-এর যুগ এবং তাঁর আদর্শ ও বিধানসমূহ বলবত থাকবে।
আল্লাহ পাকের প্রেরীত কিতাবসমূহ এবং তার ভেতরে যা কিছু আছে তা সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। এটা ঈমানের একটি অন্যতম শাখা। আর আল্লাহ পাকের প্রেরীত কোন কিতাব বা তার কোন হুকুম বা বিধানকে অবিশ্বাস করলে কুফরীর মধ্যে শামিল হবে এবং এটা অবিশ্বাসকারী কাফের হবে।
.
নবী-রাসূলদের উপর ঈমান
নবী শব্দের অর্থ, সংবাদ দাতা। আর ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায়, আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের হেদায়াতের জন্য সর্বপ্রকার গুণে গুণান্বিত করে সৎ সভাব ও সৎ চরিত্রে অলঙ্কৃত করে যাবতীয় জ্ঞান বুদ্ধিতে পরিপূর্ণ করে অহী প্রেরণ করতঃ জিন ও মানব জাতাদবীর পথ প্রদর্শনের জন্য যাদেরকে মনোনীত করেছেন বা প্রেরণ করেছেন, তাদেরকেই নবী বলা হয়। নবী শব্দের বহুবচন হল আম্বিয়া। নবীদের সংখ্যা নিয়া মতভেদ আছে, কারো মতে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার, আবার কারো মতে দু লক্ষ চব্বিশ হাজার। এ নবীদের মধ্যে যাদের নিকট আল্লাহ্ তাআলা অহীর মাধ্যমে কিতাব প্রেরণ করেছেন তারা হচ্ছেন রাসূল।
আল্লাহ রাব্বল আলামীন অহীর মাধ্যমে যেই রাসূলকে যে হুকুম আহকাম ও বিধি-বিধান দিয়েছেন, তাঁরা সে মোতাবেক তাদের উম্মতদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। এতে তারা কোন ভুল-ত্রুটি করেননি বরং তাঁদের মধ্যে অনেকেই মানুষের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। আল্লাহর নবী-রাসূলরা নিষ্পাপ ও দোষ-ত্রুটি মুক্ত, সত্যবাদী ও ন্যায় পরায়ণ ছিলেন। তারা অন্যান্য মানুষের ন্যায় সামাজিকভাবে জীবন-যাপন করেছেন। তাঁরা বিবাহ-সাদী করেছেন, তাঁদের সন্তানাদিও ছিল, হালাল রুজীর জন্য তারা রোজগার করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যও করেছেন। নবী-রাসূলরা আমাদের মতই মানুষ ছিলেন, তবে পার্থক্য হল, তাঁদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে হতে অহী নাজিল হয়েছে এবং তারা নিষ্পাপ ছিলেন।
মহান প্রতিপালক আল্লাহ্ তাআলা নবীদেরকে মুজিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। যথা–হযরত মূসা (আঃ)-কে তাঁর আসা অর্থাৎ লাঠিকে সর্পে পরিণত করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জিন্দা করার শক্তি লাভ করেছিলেন এবং আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন। তিনি তাঁর নবীদের ভেতরে অনেককে অনেক খেতাবে ভূষিত করেছেন। যেমন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে খলীলুল্লাহ্, হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে জবীহুল্লাহ, হযরত মূসা (আঃ)-কে কালীমুল্লাহ, হযরত ঈসা (আঃ)-কে রুহুল্লাহ এবং হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)-কে রহমাতুল্লিল আলামীন খেতাবে অলংকৃত করেছিলেন। তাই আমাদেরকে নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয। তাদের কাজ কর্মকে সন্দেহ করলে বা অবিশ্বাস করলে, সে কাফের হয়ে যাবে।
.
আখেরাত বা পরকালের উপর ঈমান
আখেরাত বা পরকালের প্রতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ। দুনিয়ায় মানুষের সুখ-দুঃখের সীমা আছে এবং শেষও আছে কিন্তু পরকালে অর্থাৎ আখেরাতে সুখ-শান্তি ও দুঃখ-কষ্টের কোন সীমা নেই। পরকালে হাশর ময়দানে শেষ বিচারের পরে যারা বেহেশতে প্রবেশ করবে তারা তথায় অনন্তকাল সীমাহীন সুখ-শান্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে সমস্ত কাফের বেঈমান শেষ বিচারের পরে দোযখে নিক্ষিপ্ত হবে, তারা তথায় চিরদিন কঠোর আজাব ভোগ করতে থাকবে। দুনিয়াবী জিন্দেগী অস্থায়ী আর আখেরাতের জিন্দেগী চিরস্থায়ী। এ নশ্বর দুনিয়া হচ্ছে পান্থশালা, এটা আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র। ইহকাল হচ্ছে নেকী কামাইয়ের কর্মস্থল, সঞ্চয়ের স্থান। আর পরকাল হচ্ছে ভোগ করার স্থান।
এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় কেউই চিরস্থায়ী নয়, কিছুদিন বসবাস করার পর মৃত্যুবরণ করতেই হবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে এরশাদ করেছেন (কুলু নাফসিন যায়িকাতুল মাওত) “প্রত্যেক মানুষই মরণশীল। অর্থাৎ পৃথিবীতে যার জন্ম হয়েছে, তাকে মরণের স্বাদও গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃত পক্ষে মরণের পর হতেই পরকাল শুরু হয়ে যায়। যেমন দাফনের পরে কবর আজাব, মুনকার-নকীরের সওয়াল, কেয়ামত সংঘটিত হয়ে হাশর ময়দানে গমন করা, তথায় হাশরের আজাব, আল্লাহর শেষ বিচারের পরে মুমিন লোকের ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত হওয়া এবং কাফের বে-ঈমানের আমলনামা বাম হাতে পেছন দিক হতে পাওয়া। অতঃপর নেকী ও বদী ওজন করার জন্য মীযান (পাল্লা) কায়েম হওয়া, পুলসিরাত অতিক্রম করা এবং বেহেশতে দাখিল হওয়া এবং দোযখে নিক্ষিপ্ত হওয়া ইত্যাদির প্রতি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অঙ্গ এবং তাকেই পরকাল বলা হয়। অতএব, পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অঙ্গ এবং এটা ফরয। আল্লাহ তাআলা কেয়ামত সম্পর্কে কোরআন শরীফে সূরা হজ্জের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন :
অর্থ :হে মানবমণ্ডলী! স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর। নিশ্চয়ই কেয়ামতের কম্পন অতি ভীষণ ব্যাপার। যে দিবসে তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সে দিবসে সমস্ত স্তন্যদায়িনী মাতা তাদের সুন্যপায়ী সন্তানকে ভুলে যাবে এবং সমস্ত গর্ভবতী মহিলা সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই নিজ নিজ গর্ভপাত করবে। আর আপনি [ মুহাম্মদ (ছঃ)] মানুষদেরকে মাতালের ন্যায় দেখতে পাবেন অথচ তারা মাতাল হবে না। বস্তুতঃ আল্লাহর আজাব অতি কঠোর।
.
তাকদীরের উপর ঈমান
হাদীছ শরীফে আছে, হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) ফরমান–আমার উম্মতের মধ্য হতে যারা তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস করে না, তারা অগ্নিপূজক সমতুল্য; এ শ্রেণীর মানুষেরা রোগাক্রান্ত হলে তোমরা তাদেরকে দেখতে যাবে না। এরা মৃত্যুবরণ করলে তোমরা তাদের জানাযায় শরীক হবেনা।–(মেশকাত) এক হাদীছে আছে, হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন : কোন ব্যক্তি ততোক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে চারটি বিষয়ের প্রতি ঈমান আনবে যথা : (১)আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নাই এটা বলে সাক্ষ্য দেয়া এবং ঘোষণা করা। (২) আমি যে, আল্লাহর রাসূল এবং তিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, (এর প্রতি ঈমান আনা)। (৩) মরণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অর্থাৎ মওত আল্লাহর তরফ হতে এবং মরণের পরে পুনঃরুত্থান হওয়া, (এটা বিশ্বাস করা)। (৪) তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
তাক্দীর আরবী শব্দ কাদারুন থেকে নিষ্পন্ন। এর অর্থ নির্ধারণ করা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। পরিভাষায় তাকদীরের সংজ্ঞা হল :
هو تحديد گل مخلوق حيره الذي يوجد مث خشن وقبح وقع
وضو ومايحويه من زمان أمكان وما يترتب عليه من ثواب وعقاب–
অর্থ : সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় তথা ভালমন্দ, উপকার-অপকার ইত্যাদির স্থান-কাল এবং এসবের শুভ ও অশুভ পরিণাম পূর্ব থেকে নির্ধারিত হওয়া।
–(শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা, পৃঃ ৮২)
দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু তথা মানুষ ও জিনসহ যত সৃষ্টি রয়েছে সবকিছুর উৎপত্তি ও বিনাশ, ভাল ও মন্দ, উপকার ও অপকার ইত্যাদি কখন কোথায় সংঘটিত হবে এবং এর পরিণাম কি হবে, প্রভৃতি মাখলুক সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ্ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। জগতে যা কিছু ঘটছে এবং ঘটবে সবই তাকদীরে লিপিবদ্ধ আছে। তাকদীরের বাইরে কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :
كل شئ يقر حتى العجز والكيس–
প্রত্যেক জিনিসই তাক্দীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। এমনকি অক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তাও।–(মেশকাত, পৃঃ ১৯)।
কাদার শব্দের সাথে সাধারণত আরেকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়, তা হল কাযা। কাযা শব্দের আভিধানিক অর্থ মিমাংসা করা, হুকুম দেয়া ইত্যাদি। পরিভাষায় কাযা বলা হয়:
الإرادة الأزلية المتعلقة بالموجودات الكائنة فيمايزال–
অনন্তকাল ধরে সৃষ্টবস্তু সম্বন্ধে আল্লাহ্ তাআলার অনাদি ইচ্ছা বা পরিকল্পনাকে কাযা বলা হয়। আর কাদার হচ্ছে ঐ সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনার বিস্তারিত ও বাস্তব রূপ।
-(কাওয়াইদুল ফিকহ, পৃঃ ৪৩১)
মোটকথা, কোন বস্তুই তাকদীরের বাইরে নয়। তবে তাকদীর মানুষের কর্মের কারণ নয় এবং তাক্দীর লিপিবদ্ধ আছে বলেই মানুষ ভালমন্দ ইত্যাদি করছে বিষয়টি এমনও নয়। বরং মানুষ ভবিষ্যতে যা করবে আল্লাহ্ তাআলা যেহেতু তা পূর্ব হতেই জানেন তাই তিনি তা পূর্বেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন বলে মানুষ করছে, এ কথা ঠিক নয়। বিষয়টি বোধগম্য করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যায়। ধরা যাক, একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার তার রোগীর অবস্থা জানেন বলে তার ডায়রিতে লিখে রাখলেন যে, এ রোগী অমুক সময় অমুক অবস্থায় মারা যাবে। অবশেষে যদি তাই হয়, এক্ষেত্রে ডাক্তারের লিখন তার মৃত্যুর কারণ নয়। ঠিক তদ্রূপ আল্লাহ্ তাআলা মানুষের অবস্থা জানেন বলে সব লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তবে এ লিপিবদ্ধকরণ মানুষের কর্মের কারণ নয়। মানুষের কর্মের কারণ মানুষের ইচ্ছা বা সংকল্প। কাজেই ভালমন্দ কাজের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী হবে।
–(মেশকাত (বাংলা), ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৭)।
কারো কারো মতে, তাক্দীর দু প্রকার–মুবরাম ও মুআল্লাক। যে তাক্দীর অপরিবর্তনীয় না তাকে তাকদীরে মুবরাম বলে। আর যে তাকদীরে পরিবর্তনীয় তাকে তাকদীরে মুআল্লাক বলে। যেমন : ঔষধ ও দোয়ার দ্বারা তাক্দীর পরিবর্তন হওয়া। প্রকৃতপক্ষে তাক্দীর সবই মুবরাম–অপরিবর্তনশীল।
-(শারহু শারহিল আকাইদ)
তাকদীরের বিষয়টি কখন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এ সম্বন্ধে হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ্ তাআলা সৃষ্টির তাক্দীর লিপিবদ্ধ করেছেন। তখন তাঁর আরশ ছিল পানির উপর।
-(মেশকাত শরীফ)।
হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন।
إيمان بالقدر نظام التوجي؛ فمن أمن وكذب بالقدر فقه نقض
إلتوحيد
আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া তাকদীরের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। কাজেই যে ব্যক্তি ঈমান আনল কিন্তু তাক্দীরকে স্বীকার করল না প্রকৃতপক্ষে সে একত্ববাদকেই প্রত্যাখ্যান করল।
–(তরজুমাস সুন্নাহ)।
তাকদীরে বিশ্বাস না করা এমন গুরুতর অপরাধ যে, রাহমাতুললিল আলামীন (ছ.)-ও তাদেরকে লানত করেছেন। তাকদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকা ফরয। রাসূলুল্লাহ্ (ছ.) বলেন, আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ কেউ যদি আমার নির্ধারিত তাকদীরের উপর সন্তুষ্ট না থাকে এবং বিপদে ধৈর্যধারণ না করে তবে সে যেন আমি ছাড়া অন্য কাউকে রব বানিয়ে নেয়।
–(তানযীমুল আশতাত শারহে মেশকাত, ১শ খণ্ড)
.
তাকদীর সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিমত
আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে, বান্দার কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। সৎকর্ম করলে তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। আর অসৎ কর্ম করলে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা হবে। (শারহুল আকাইদিন নাফিয়্যা) ইমাম আযম আবু হানীফা (রঃ) বলেন।
أن التكليف أمر بين البين لا جبر و قدر ولا كره ولا تسليط
মানুষষকে শরীআত পালনে দায়িত্বশীল করার বিষয়টি মাঝামাঝি ধরনের একটি বিষয়। এখানে যেমন পূর্ণাঙ্গ মাজবূরী ও বাধ্যবাধকতা নেই তেমনি পূর্ণ ইখতিয়ার বা স্বাধীনতাও নেই।
-(শরহে মেশকাত, ১ম খণ্ড)
মানুষকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কার্যের এমন একটি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা খালেক তথা সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু কাসব তথা অর্জনের ক্ষমতা রাখে। মানুষের মধ্যে এই কাসবের ক্ষমতা আছে বলেই ভালোর জন্য প্রতিদান এবং মন্দের জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হবে। আবার এ ক্ষমতাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় মানুষকে নিজ ইচ্ছা ও কর্মের স্রষ্টা বলে অভিহিত করা যায় না। তদ্রূপভাবে মানুষের মধ্যে এ শক্তি আছে বলে তাকে শক্তিহীন জড়পদার্থের মতও গণ্য করা যায় না। হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) বলেন, বান্দার ইখতিয়ার এবং স্বাধীনতা তো আছে তবে এ ইখতিয়ার আল্লাহ্ তাআলার ইখতিয়ারের অধীন। অর্থাৎ কর্মের ইচ্ছা এবং কর্মের শক্তি মানুষের মধ্যে আছে কিন্তু এর সাথে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটলে কোন কিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না।
মানুষ এবং মানুষের কর্ম সবই আল্লাহ্ তাআলা সৃষ্টি কছেন। এরশাদ হয়েছে :
والله خلقكم وما تعملون
উচ্চারণ : ওয়াল্লাহু খালাক্বাকুম ওয়ামা তামালূন।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা তৈরি কর তাও। (সূরা সাফফাত, ৩৭ঃ ৯৬)
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
الله خالق كل شئ وهو على كل شئ وكيل
উচ্চারণ : আল্লাহু খা-লিকু কুল্লি শাইয়িও ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িও ওয়াকীল।
আল্লাহ্ তাআলা সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সব কিছুর কর্মবিধায়ক।
–(সূরা যুমার, ৩৯ ও ৬২)
.
তাক্দীর লিপিবদ্ধকরার তাৎপর্য
সৃষ্টির পূর্বেই তাক্দীর লিপিবদ্ধ করার পেছনে বিশেষ হিকমত নিহিত রয়েছে। তা হল, মানুষ যেন সুখ ও সফলতায় অত্যধিক আনন্দিত না হয় এবং দুঃখ ও বিপদে চরমভাবে ভেঙ্গে না পড়ে। কেননা, মানুষ সাধারণত সুখ ও সফলতা পেলে আনন্দে মেতে ওঠে এবং দুঃখ ও ব্যর্থতায় চরমভাবে ভেঙ্গে পড়ে। মানব চরিত্রের এ দুটি অবস্থা মানুষকে আল্লাহ্ বিমুখতার দিকে ধাবিত করে। তাই এ দুটি অবস্থাকে নৈতিক দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করা যায়। তাকদীরে বিশ্বাস মানুষকে এ দুধরনের দুর্বলতা থেকে হেফাজত করে। কারণ, তাকদীরে বিশ্বাসী ব্যক্তি এ কথা নিশ্চিতভাবে অবহিত আছে যে, মানব জীবনে যা কিছু ঘটছে তার সবই তাকদীরে লিখিত আছে। তাকদীরের বাইরে কিছুই ঘটছে না। কাজেই সুখ ও দুঃখ কোন অবস্থাতেই সে আল্লাহর রহমত থেকে বিমুখ হয় না। বিপদে ধৈর্যধারণ করে এবং সুখের অবস্থায় তাঁর শোকর আদায় করে। এরশাদ হয়েছে।
ما أصاب من جيبة في الأرض ولا في أنفسكم إلا في بيت من قبل أن نبرها ان ذلك على الله يسير كيتوا على ما فاتكم ولا تفرحوا يا اثم والله يحب كل متال قوي .
পৃথিবীতে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপদাপদ আসে তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই লিপিবদ্ধ থাকে; আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ, এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য হর্ষোৎফুল্লা না হও। আল্লাহ্ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে।–(সূরা হাদীদ, ৫৭ ও ২২, ২৩)
.
তাকদীর ও তদবীর পরস্পর সংঘাত মুক্ত
কর্ম সম্পাদনের জন্য আসবাব তথা উপায়-উপকরণ অবলম্বন করাকে তদবীর বলা হয়। তাকদীরের সাথে তদবীরের কোন সংঘাত নেই। কাজেই আসবাব অবলম্বন করা তাকদীরে বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। কেননা, তাকদীরে এ উপায় উপকরণ অবলম্বনের কথাও লিপিবদ্ধ আছে। একবার এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যে ঝাড়ফুক করিয়ে থাকি, চিকিৎসায় ঔষধ করে থাকি অথবা আত্মরক্ষার জন্য যে উপায় অবলম্বন করে থাকি তা কি তাকদীরের কোন কিছুকে রদ করতে পারে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বললেন, তোমাদের এ সকল চেষ্টাও তাকদীরের অন্তর্ভুক্ত।
–(মেশকাত, পৃঃ ২২)
হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী (রঃ) বলেন, তাকদীর ও তদবীরের মধ্যে কোন সংঘাত নেই। সংঘাত তখনই দেখা দিত যদি তাদবীর তাকদীরের আওতা বহির্ভূত হত অথবা তাকদীরের মধ্যে তদবীরের বিষয়টি লিপিবদ্ধ না থাকত। তাক্দীর এবং তদবীরের মধ্যে সংঘাত নেই এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুরআন শরীফে বর্ণিত হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর ঘটনার মধ্যে দেখা যায়। তিনি নিজ সন্তানদেরকে মিসর পাঠানোর প্রক্কালে আপাতদৃষ্টিতে যে সমস্যা অনুভব করেছিলেন এর থেকে সন্তানদেরকে রক্ষা করার লক্ষ্যে তাদেরকে অসিয়ত করে বলেছিলেন :
يبني لا تخلوا من باب واجد و الخلوا من ابواب متفرقة
উচ্চারণ : ইয়া-বানিইয়্যা লা-তাদখুলু মিম্ বা-বিওঁ অ-হিদিওঁ অদখুলু মিন্ আবৃঅ-বিম্ মুতাফারিক্কাতিন;
হে আমার পূত্ররা! তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।–(সূরা ইউসুফ : ৬৭)
হযরত ইয়াকবু (আঃ) সন্তানদেরকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে হেফাজতের জন্য এ তাদবীর অবলম্বন করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে তাকদীর সম্বন্ধে অবহিত করে বলেছিলেনঃ
وما أغنى عنكم من الله من شئ أن الحكم الله عليه توكلت
وعليه فليتوكل المتوكلون
উচ্চারণ : অমা–উগনী আনকুম্ মিনাল্লা-হি মিন্ শাইইন; ইনি হুমু ইল্লা–লিল্লা-হি; আলাইহি তাঅক্কালতু, অ আলাইহি ফাইয়াতাঅক্কালি মুতাঅক্কিলূন।
আল্লাহর বিধানের বাইরে আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারি না। বিধান আল্লাহরই। আমি তার উপর নির্ভর করি এবং যারা নির্ভর করতে চায় তারা আল্লাহরই উপর নির্ভর করুক।
–(সূরা ইউসুফ : ৬৭)
এ ক্ষেত্রে হযরত ইয়াকূব (আঃ) তাক্দীর ও তাদবীর-এর মধ্যে যে সমন্বয় সাধন করেছেন এটি আমাদের জন্য উত্তম নমুনা।–(তরজমানুস সুন্নাহ)
মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী (রঃ) বলেন, মানুষ বলতে পারে না যে, কোন্ বিষয়ে তার তাকদীরে কি রয়েছে। সুতরাং আল্লাহর দেয়া ইখতিয়ার তার হুকুম অনুযায়ী তদবীর দিয়ে করে যাওয়াই হচ্ছে মানুষের কর্তব্য। তদবীরের চরম সীমায় পৌঁছে এ কথা বলা যায় না যে, এ কাজটি হবে না বা এটি আমার তাকদীরে নেই। এ জন্যই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ছঃ) মানুষকে কাজ করার জন্য এত তাকীদ করেছেন। তাকদীরের উপর ভরসা করে বসে থাকতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর কর্মবহুল জীবনই এর উত্তম আদর্শ। (মেশকাত)
তাকদীরকে ওযর হিসাবে পেশ করা বৈধ নয়। কেননা, আল্লাহ তাআলা মানুষকে কর্ম সম্পাদনের শক্তি দিয়েছেন। আর এ কারণেই তাদের উপর শরীয়াতের বিধি-বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
.
তাকদীর সম্পর্কে বিভিন্ন বিতর্ক
তাক্দীর সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। তাকদীরের উপর ঈমান রাখা আবশ্যক। এ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া ঠিক নয়। বরং এ বিতর্ক অনেক ক্ষেত্রে কুফরী ও নাস্তিকতা পর্যন্ত হেলে দেয়। হাদীসে এরূপ বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে নবী করীম (ছঃ)-এর অসন্তুষ্টির কথা বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বের হয়ে আমাদের নিকট আসলেন। আমরা তখন তাক্দীর সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত ছিলাম। এ দেখে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) আমাদের উপর এত রাগ করলেন যে, রাগে তার চেহারা মুবারক রক্তিম হয়ে গেল, যেন তার গণ্ডদেশে আনারের দানা নিংড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর তিনি বললেন :
তোমাদের কি এ বিষয়ে হুকুম দেয়া হয়েছে না কি আমি এ নিয়ে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি। তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি তোমাদেরকে কসম দিয়ে বলছি, আবার কসম দিয়ে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে কখনো বিতর্কে লিপ্ত হবে না।-(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২২)।
অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তাকদীর সম্পর্কে আলোচনা করবে, পরকালে তাকে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এ সম্পর্কে আলোচনা করবে না তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে না।-(মেশকাত, ১ম খণ্ড, ২৩)।
বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেন, তাক্দীর সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন। তিনি বললেন, এ পথ অন্ধকার, এ পথে চলবে না। পুনরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, গভীর সমুদ্র, এতে প্রবেশ করবে না। আবারো প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, এ হলো আল্লাহর অদৃশ্য রহস্য, তা তোমার থেকে অদৃশ্য রাখা হয়েছে। সুতরাং তুমি এ নিয়ে অতিরিক্ত অনুসন্ধান করবে না।–(দরসে মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৮৭)
.
আখেরাত বা পরকালের প্রতি ঈমান
আখিরাত অর্থ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন বা পরকাল। পরকাল বলতে মৃত্যুর পর থেকে অনন্তকালের জীবনকে বুঝায়। কবর, হাশর, হিসাব, পুলসিরাত এবং বেহেশত-দোযখ সবকিছুই এর অন্তর্ভূক্ত। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে পরকালের জীবনকে দু পর্যায়ে বিন্যাস করা হয়ে থাকে, ১. মৃত্যু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত। ২. কিয়ামত থেকে অনন্তকাল অবধি। সেখানে মৃত্যু ও ধ্বংস নেই। প্রথম পর্যায়ের নাম বরযখ বা কবরের জীবন। মৃত্যুর পর মানব দেহ কবরস্থ করা হোক কিংবা সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হোক অথবা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হোক বা অন্য কোনভাবে ধ্বংস করে দেয়া হোক সব অবস্থাই তার জন্য বরযখ। আর দ্বিতীয় পর্যায় হল, কিয়ামত, হাশর-নশর তথা অনন্তকালের জীবন। কিয়ামত বলতে এমন এক সময়কে বোঝায় যখন আল্লাহর নির্দেশে জগতের সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর যখন আল্লাহ্ তাআলার ইচ্ছা হবে তখন তিনি আবার সকলকে জীবন দান করবেন, সকলেই পুনরুত্থিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। এরপর সকলের কাছ থেকে জাগতিক জীবনের সব হিসাব নেয়া হবে। হিসাব-নিকাশের মানদণ্ডে আল্লাহর যে সব বান্দা উত্তীর্ণ হবেন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করান হবে। আর যারা অনুত্তির্ণ হবে তাদেরকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। এ পর্যায় হতেই মানুষ অনন্তকালের জন্য বেহেশতে বা দোযখে অবস্থান করতে থাকবে।
.
পরকালের উপর ঈমান আনার প্রয়োজনীয়তা
পরকালে বিশ্বাস ইসলামের আকীদাসমূহের মধ্যে অন্যতম। পরকালের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া ঈমান বিশুদ্ধ হয় না। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
وبا الأخرة هم يوقنون
অর্থ : আর যারা পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে।–(সূরা বাকারা : ৪)
আরো এরশাদ হয়েছে :
ليس البر آن تولوا وجوهكم قبل المشرق والمغرب و لكن البر
من أمن بالله واليوم الآخر والمملكة والكتب والبيين
অর্থ : পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফিরানোতে কোন নেকী নেই কিন্তু নেকী আছে কেউ আল্লাহ্, আখিরাত, ফিরিশতাদের, সমস্ত আসমানী কিতাব এবং নবীদের উপর ঈমান আনলে।–(সূরা বাকারা : ১৭৭)
যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারা ভ্রান্ত। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
ومن يكفر باللو ومملكته وكتبه وشله واليوم الآخر فقل
يمن بعيدا۔
অর্থ : কেউ ফিরিশতাদের এবং তাঁর কিতাবসমূহে, তাঁর রাসূলদের এবং পরকালকে প্রত্যাখ্যান করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।–(সূরা নিসা : ১৩৬)।
ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান ও আদর্শের উপর নিজেকে সুদৃঢ় রাখার জন্য পরকালের উপর বিশ্বাসী হওয়া আবশ্যক। কারণ মৃত্যুর পর আরেকটি জীবন শুরু হবে এবং সে জীবনে পুরস্কার কিংবা শাস্তি, সফলতা কিংবা ব্যর্থতা ইহকালের কর্মকাণ্ডের উপরই নির্ভরশীল, এ কথার উপর আস্থাই মানুষকে পার্থিব জীবনে সত্যপথের অনুসারী বানায় এবং আমলে ছলিহের পথে উদ্বুদ্ধ করে। পরকালের বিশ্বাস মানব মনে সত্যের প্রতি আনুগত্য এবং অসত্য পরিহার করার মনোভাবের জন্ম দেয়।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
الهكم إله واحد فالذين يؤمنون بالأخرة قلوبهم منكرة و هم
مستكبرون
এক ইলাহ্, তিনিই তোমাদের ইলাহ্, সুতরাং যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহংকারী।–(সূরা নাহলে, : ২২)।
আল্লাহ তাআলা কোরআন শরীফে সূরা মূলক এর পনরতম আয়াতে এরশাদ করেন :
ولا فامشوا في مناكبها وكوا من ژقه
هوالى جعل لكم الأرض
ط وإليه الشور–
উচ্চারণ : হুওয়াল্লাযী জাআলা লাকুমুল আরদোয়া যাল্লা ফামশুফী মানা-কিবিহা-ওয়া কুমিররিযূক্বিহী; ওয়া ইলাইহি নুশূর।
অর্থ : তিনিই তোমাদের জন্য যমীনকে অনুগত করে দিয়েছেন, তাই তোমরা তার দিক দিগন্তে বিচরণ করছে এবং তারই রুযী-রোযগার হতে আহার্য গ্রহণ করছে এবং তারই নিকট পুণরুত্থান।
আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতের-এর নবম আয়াতে পুনঃরুত্থান সম্পর্কে এরশাদ করেন :
والله الذي أرسل الريح تثير سحابا قشقنه إلى بلي ميت فاحيينا
به الأرض بعد موتها ط ذلك الشور–
উচ্চারণ : ওয়াল্লা-হুল্লাযী আরসালার রিয়াহ ফাতুছীরু সাহা–বান্ ফাসুক্কনা-হু ইলা-বালাদিন্ মাইয়্যিতিন্ ফাআহ্ইয়াইনা-বিহিল্ আরদ্বোয়া বাদা মাওতিহা-। কাযা-লিকান্ নুশূর।
অর্থ :এবং আল্লাহই,যিনি বায়ু প্রবাহিত করেন, অতঃপর তাকে মেঘমালারূপে উড্ডীন করেন তারপর আমি তাকে মৃত জনপদের দিকে সঞ্চালিত করি; আর তা দিয়ে যমীনকে মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করি; এই রূপেই পুনঃরুত্থান হবে।
অতএব, মৃত্যুর পর কবর থেকে মানুষকে ইসরাফীল (আঃ)-এর সিঙ্গার ফুৎকারের মাধ্যমে হাশর ময়দানে সমবেত করা হবে। এ পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের একটি অন্যতম অঙ্গ বা শাখা। ইসরাফীলের (আঃ) ফুৎকারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পুনরুত্থিত হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় দৌড়িয়ে হাশর ময়দানে সমবেত হবে। তখন সূর্য মানুষের মস্তকের সামান্য উপরে অবস্থান করবে, সূর্যের প্রচণ্ড তাপে ঘর্ম নির্গত হয়ে কারো পদদ্বয়ের গিরা পর্যন্ত, কারো হাটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত আবার কারো বা গলা পর্যন্ত ডুবে যাবে। আবার কোন কোন মুমীন আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করিবে। সে দিন মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব হবে, আমলনামা ওজন করা হবে। যাদের নেকীর পাল্লা ভারী হবে তারা বেহেশতে গমন করতঃ অনন্তকাল সুখ-শান্তি ভোগ করতে থাকবে এবং যাদের বদীর পাল্লা ভারী হবে তারা দোযখে প্রক্ষিপ্ত হয়ে চিরকাল আযাব ভোগ করতে থাকবে। সুতরাং উপরোক্ত বিষয়সমূহের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, এটা ঈমানের অঙ্গ। তাকে অবিশ্বাস করা কুফরী; যে অবিশ্বাস করবে সে কাফের হয়ে যাবে।