১২. পারিবারিক জীবন (১২তম খণ্ড)

১২তম খণ্ড – পারিবারিক জীবন

পারিবারিক জীবনের ইসলামী বিধান

স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, পিতামাতা, ভাইবোন প্রভৃতি একান্নভূক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংক্ষিপ্ত মানব পরিমণ্ডলকে পরিবার বলে। সমাজ জীবনের প্রথম ভিত্তি ও বুনিয়াদ হলো পরিবার। মানব জীবনের যাত্রা থেকেই এই পরিবার সূত্রের শুভ সূচনা। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ)-এর দ্বারাই এর প্রথম বিকাশ। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

ویادم اسكن أنت وزوجك الجنة فكلا من حيث شئتما ولا تقربا

هذه الشجرة فتكونا من الظلمين

অর্থ : হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী বেহেশতে বসবাস কর এবং যেখানে ইচ্ছে আহার কর; কিন্তু এ গাছের নিকটেও যেও না। তাহলে তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে। –(সূরা আ’রাফ : ১৯)

এতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল পারিবারিক সূত্রের পথ ধরেই। যে পরিবারের প্রথম বিন্যাস ছিল স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে। তারপর তা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়েছে। এক আদম (আঃ)-এর পরিবার থেকে উৎসারিত হয়েছে অগণিত বনী আদমের বিন্যস্ত সংসার। তাই দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়, পরিবারই সমাজ জীবনের ভিত্তি প্রস্তর। পারিবারিক পবিত্রতা ও সুস্থতার উপরই নির্ভর করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বময় মানব জাতির পবিত্রতা ও সুস্থতা।

.

মানব জাতির সম্প্রসারণ মহান আল্লাহর অনুগ্রহ

দুনিয়ার সকল মানুষের সৃষ্টি এক আদম (আঃ) থেকে। আল-কুরআনে এরশাদ হচ্ছেঃ

كم من نفس واحدة و خلق

م پایها الناس اتقوا ربک

ونساء واتقوا الله الذي تساء

منها زوجها وبث منهما لون به في الأرحام إن الله كان عليكم رقيبا

অর্থ : হে মানব! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা থেকে স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়েছেন; এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা এক অপরের কাছে যাচনা কর এবং সতর্ক থাক জাতি বন্ধন সম্পর্কে নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। –(সূরা নিসা : ১)

এ আয়াতটিতে মানব বংশের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনটি বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে–(১) দুনিয়ার সমস্ত মানুষের সৃষ্টি এক আদম (আঃ) থেকে। (২) হযরত হাওয়া  (আঃ)-কেও হযরত আদম (আঃ) থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে (তার বাম পাঁজরের হাড় থেকে)। (৩) তারপর তাদের থেকেই পৃথিবীর সকল নর-নারীর সৃষ্টি। –(মাআরিফুল কোরআন খণ্ড তাদাব্বুরে কোরআন ২য় খণ্ড)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছেঃ

ايها الناس إنا خلقنكم من ذكر وأنثى وجعلنكم شعويا و

قبائل لتعارفوا إن أكرمكم عند الله اتقكم إن الله عليم خبير

অর্থ : হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে। তারপর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ্ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। (সূরা হুজুরাত ১৩)

কাজেই এ কথা সন্দেহাতীতভাবেই সত্য যে, আজকের সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত অগণিত মানব প্রজন্ম, অভিনব আবিষ্কার, রহস্যময় শত শিল্পে সজ্জিত, বলিষ্ঠ সমাজ বন্ধনে প্রতিষ্ঠিত এ সৃষ্টি সৌন্দর্য দয়াময় রবের এক অপার অনুগ্রহ। তিনি দয়াপরবশ হয়ে হযরত আদম (আঃ) থেকে সৃষ্টি করেছেন এ বিশাল মানব সংসার। তারপর এক পিতা ও এক মাতার রেহেম সূত্রে গেঁথে দিয়ে সকল মানুষকে করেছেন পরস্পরে অনুগ্রহশীল। এ তাঁর অসীম ক্বদরতের বিন্দুবিকাশ।

.

বিয়ে-শাদী : পরিচিত ও তাৎপর্য

আরবি নিকাহ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ বিয়ে-শাদী, বিবাহ। আভিধানিক অর্থ দলিত করা, সংযুক্ত করা। ইসলামী পরিভাষায় সেচ্ছায় একজন নারীর সারা শরীর দ্বারা আস্বাদিত হওয়ার আ’-কে বিয়ে-শাদী বলা হয়।

বিয়ে সংঘটিত হয় ইজাব ও কবুল দ্বারা। এ দুটি বিয়ের রুকন এবং উভয়টি ক্রিয়াপদ হতে হবে। এবং উভয়টি অতীত কাল প্রকাশক হবে অথবা একটি অতীত কাল ও অপরটি ভবিষ্যত কাল হলেও চলবে। বিয়ে, বিয়ে দান, উপহার দান, মালিক বানানো ইত্যাদি শব্দ দিয়েও বিয়ে সংঘটিত হতে পারে। বিয়ে জায়েয হওয়ার জন্যে শর্ত হলো দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন নারী সাক্ষীর উপস্থিতিতে আদ সংঘটিত হতে হবে। সাক্ষীদেরকে আযাদ, বুদ্ধিমান, বালেগ ও মুসলমান হতে হবে।–(হিদায়া ও কিতাবুননিকাহ পৃঃ ২৮৫)

দুনিয়ার সকল মানুষকে আল্লাহ্ তা’আলা নারী-পুরুষ রূপে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বেঁধে দিয়েছেন দয়া ও মায়ার বাঁধনে। এরশাদ হয়েছে :

ومن أيته أن خلق لكم من أنفسكم ازواجا تشكنوا إليها وجعل

بينكم مودة و رحمة

অর্থ : তিনি তোমাদের জন্যেই তোমাদের থেকেই তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে পয়দা করেছেন যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি পয়দা করেছেন তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া।–(সূরা রূম : ২১)

সৃষ্টির প্রক্রিয়া যেন অব্যাহত গতিতে বহমান থাকে সে ব্যবস্থাও করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা মানব প্রজন্মের অবিরাম আগমনধারা সুনিশ্চিত করার জন্যেই মানুষের রক্ত-মাংসে যৌন ক্ষুধা দিয়েছেন। আর সে যৌন ক্ষুধা চরিতার্থ করার বৈধ পন্থাও দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বিয়ের বহু ফযীলত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন :

تزوجوا الولود الودود فإني مكاثر بكم الأمم

অর্থ : তোমরা প্রেমময়ী, অধিক সন্তানসম্ভবা নারীকে বিয়ে করা। কেননা, আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মাতের উপর গর্ব করবো।-(আবূ দাউদ ১ম খণ্ড পৃঃ ২৮৫)

মানুষের মধ্যে যে যৌনক্ষমতা রয়েছে এর সৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন নয়। বরং মানব বংশের বৃদ্ধিই এর লক্ষ্য। আর সে জন্যই নারীর সৃষ্টি। নারীকে দেয়া হয়েছে গর্ভধারণের ক্ষমতা, সন্তান প্রসবের ক্ষমতা। আর মানুষ যেহেতু পশু নয় তাই তাকে উচ্ছংখলভাবে যত্রতত্র যৌনক্ষুধা নিবারণের অনুমতি দেয়া হয়নি। বরং নিয়ম-নীতির আলোক সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে সম্মানজনক পন্থায় কাম-চাহিদা পূরণ ও তা ফলপ্রদ করার পুণ্যময় রীতি প্রণয়ন করেছে শরীয়াত। আর তারই নাম বিয়ে-শাদী। যার অবর্তমানে যেভাবে মানুষ ও পশুতে ভেদাভেদ থাকে না, বিয়ের লক্ষ্য (সন্তান জন্ম দেয়া) সাধিত না হলেও থাকে না মানব বংশের অস্তিত্ব। সুতরাং মানব জীবনের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতার জন্যে বিয়ে এক গভীর তাৎপর্যময় সত্য।

.

বিয়ের ফযীলত ও প্রয়োজনীয়তা

বিয়ে একজন সুস্থ মানুষের প্রাক্বতিক প্রয়োজন। মানুষের স্বভাবগত পরিচ্ছন্নতা, মানসিক ভারসাম্যতা ও চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের অন্যতম পন্থা বিয়ে। এ জন্যই অনিন্দ্য সুখের জন্যই জান্নাতে বসেও যখন হযরত আদম (আঃ) একাকিত্তে ভুগছিলেন তখনই আল্লাহ্ তা’আলা মা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করলেন তাঁর জীবন সঙ্গিনীরূপে। নর ও নারীর যুগল বাঁধনে শুরু হলো মানব জীবন। রক্তমাংসে সৃষ্ট এ মানুষের মধ্যে যে প্রভূত যৌনক্ষধা জমে উঠে বয়সের পরতে পরতে তা একান্তই বাস্তব। সুতরাং ক্ষুধা যিনি দিয়েছেন সে ক্ষুধা নিবারণের পথও তিনিই দেখাবেন। আর তা হল বিয়ে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেনঃ

يامعشر الشباب من استطاع منكم البأة فليتزوج فإنه أغض البصر وأحصن للفرج ومن لم يستطع فعليه بالصوم فإنه له وجاء

অর্থ : হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা, বিয়ে দৃষ্টি আনত রাখতে ও গুপ্তাঙ্গের রক্ষণাবেক্ষণে অধিক কার্যকর। আর যে ব্যক্তি বিয়ে করতে অক্ষম সে যেন রোযা রাখে। কেননা, রোযা তার যৌনক্ষুধাকে অবদমিত করে।

মানুষ যে খাবার গ্রহণ করে তা থেকে উৎপাদিত শক্তি নির্যাস হলো যৌনক্ষমতা। বিয়ের মাধ্যমে যা যথার্থ প্রবাহিত হতে পারে। কোন ব্যক্তি বিয়ে করার, স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করার ক্ষমতা না রাখলে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) তাকে রোযা রেখে শক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনেও অনুরূপ আদেশ দিয়েছেন মহান রব্বুল আলামীন।

এরশাদ হয়েছে :

وانكحوا الأيامى منكم و اللحين من عبايكم و إماؤكم إن

يكونوا فقراء يفنهم الله من فضله و الله واسع عليم

অর্থ : তোমাদের মধ্যে যে সকল ছেলেদের স্ত্রী নেই এবং যে সকল মেয়েদের স্বামী নেই তাদের এবং তোমাদের দাস দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দাও! (সূরা নূর : ৩২)

যারা বিয়ে অসমর্থ তাদেরকে দিয়েছেন ধৈর্যধারণের বিকল্প উপদেশ। এরশাদ হয়েছে :

ما حتى يغنيهم الله من فضله

وليستعفف الذين لايجدو

অর্থ : যাদের বিয়েতে অসমর্থ আল্লাহ্ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে। (সূরা নূর ও ৩৩)।

সারকথা, খানাপিনা যেভাবে মানব জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজন, আহার নিবাসের প্রয়োজনীয়তা যেভাবে যুক্তিতর্কের উর্ধ্বে, একজন যৌবনদীপ্ত মানুষের সুস্থ জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রয়োজনীয়তাও তেমনই। আর এ জন্যই কোরআন ও হাদীসে নির্দেশসূচক শব্দে উত্তীর্ণ করা হয়েছে বিয়ের আহবানকে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে-শাদীর ফযীলতও অসামান্য। বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করে নবী করীম (ছঃ) বলেন :

من أراد أن يلقى الله طاهرا طهرا فليتزوج الحرائر

অর্থ : যে ব্যক্তি পূতপবিত্র অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত প্রার্থী সে যেন আযাদ নারীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।–(ইবন মাজা, পৃঃ ১৩৫।)

অন্য হাদীসে বলা হয়েছে।

عن أبي أيوب رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه

وسلم أربع من سن المرسلين الحياء والعطر والسواك والكاح

অর্থ : হযরত আবু আইউব (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, নবী-রাসূলদের সুন্নাত চারটি; লজ্জাবোধ, সুগন্ধি ব্যবহার, মিস্ওয়াক করা এবং বিয়ে-শাদী করা। -(তিরমিযী পৃঃ ১২৮)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, সাহাবী হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর কয়েকজন সাহাবী একবার তার জীবন সঙ্গিনীদের খেদমতে এস তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইল। নবী করীম (ছঃ)-এর এবাদতের কথা শোনে তারা যেন তা একটু কম মনে করল, সাথে সাথেই তারা বলে উঠলো, তিনি কোথায় আর আমরা কোথায়? তার তো পূর্বাপর সকল ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের একজন বললেন, আমি কোন নারীকে বিয়ে করবো না। অন্যজন বললেন, আমি কখনো গোশত খাবো না। আরেকজন বললেন, আমি আর শয্যা গ্রহন করে ঘুমাবো না। ঘটনাটি শুনে নবীজী (ছঃ) বললেন, লোকদের কি হলো! তারা এই এই বলে। অথচ আমি নামায আদায় করি, ঘুমাই, রোযা রাখি আবার ইফতারও করি এবং নারীদেরকে বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে আমার দলভূক্ত নয়।–(মুসলিম শরীফ)

সারকথা হলো :

 ১। বিয়ের মাধ্যমে একজন মু’মিন বান্দা আল্লাহর সমীপে পবিত্র হয়ে ওঠার পথ পায়।

 ২। বিয়ে করা সকল নবী রাসূলের সুন্নাত।

৩। বিয়ে করা রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর আদর্শ।

এক কথায়, বিয়ের পবিত্র ঘেঁয়ায় পরিচ্ছন্ন জীবন লাভ করে বিবাহিত মর্দে মু’মিন। নবীজীর আদর্শের রৌশনীতে আলোকিত হয়ে ওঠে তার কর্মময় জীবন। এ কারণেই নবীজী বলেছেনঃ

عن أنس رضي الله تعالی عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا تزوج العبد فقير استكمل نصف الدين فليتق الله في

الصف الباقى

অর্থ : সাহাবী হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, কোন বান্দা যখন বিয়ে করল তখন তো সে দীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করল। অতঃপর সে যেন অবিশষ্ট অর্ধেকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে।-(মিশকাত শরীফ)।

মানবিক প্রাক্বতিক চাহিদার কারণেই মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অথচ শরীয়াত এটাকে সম্পূর্ণ দীনের অর্ধেক বলে অবিহিত করেছে। কারণ শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ ও পবিত্রতা নির্ভর করে এর উপর। কেননা, সমস্ত এবাদতের ক্ষেত্রে অবশ্য কাম্য, যে মানসিক ও চারিত্রিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন তার অধিকাংশটাই উৎসারিত হয় বৈধ যৌনমিলনের মাধ্যমে, যার ভিত্তি হলো বিয়ে।

.

যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলামি শিক্ষা

জীবন ও যৌনতার বাস্তবতাকে ইসলাম অকপটে স্বীকার করে। তবে পাশবিক বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেয় না। বিশ্ব মানবতাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে তুলে আনার লক্ষ্যেই আমাদের প্রিয় নবী (ছঃ)-এর আবির্ভাব হয়েছিল। কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন, চিন্তা-চেতনা, স্বভাব-চরিত্র সকল ক্ষেত্রেই তিনি অন্ধকার দূর করে আলোর পথ প্রদর্শন করিয়েছিলেন। যে যৌনক্ষমতার মূল লক্ষ্য হলো মানব বংশের বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ সে ক্ষমতা যেন যথার্থ স্থানে প্রবাহিত হয় তদুপরি সে তাড়নায় যেন মানুষ উন্মাদনার শিকার না হয়; সে জন্যই বিবাহ প্রথার প্রতি এতটা জোর দিয়েছে ইসলাম। শুধু তাই নয়, যে সব কারণে যৌনস্থলনের সৃষ্টি হয় সে সবেরও প্রতিবিধান করেছে অত্যন্ত কঠোরভাবে। এককথায় ইসলাম যৌনকাক্ষা পূরণের বৈধ প্রয়োজনকে করেছে অত্যন্ত সহজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেনঃ

إن أعظم النكاح بركة ايره مؤنة

অর্থ : যে বিবাহে খরচ কম ও সহজ সে বিবাহই অধিক বরকতপূর্ণ।–(বায়হাকী)

যুবক সম্প্রদায়কে সামর্থ্য থাকলে বিয়ে করার আহবান জানিয়ে রাসূলে কারীম (ছঃ) বলেছেন, এতে করে দৃষ্টি আনত থাকবে আর যৌনাঙ্গ থাকবে পবিত্র। যে যৌন ক্ষমতার যথার্থ প্রবাহের উপর নির্ভরশীল মানব অস্তিত্ব ও তার পবিত্রতা সে যৌনতার ব্যাপারে স্থলনের সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইসলাম। লোভাতুর দৃষ্টি ও অবাধ মেলামেশা যেহেতু যৌনাপরাধের মূল উৎস তাই এগুলো ইসলাম সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করে দিয়েছে।

সুশৃঙ্খল ও সুনির্ধারিত পথে যৌনচাহিত পূরণের মাধ্যমে মানুষের বংশ বৃদ্ধির কল্যাণময় বিষয়ে অংশ নেয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ

له حق على الله عونهم المكاتب الذي يريد الأداء والثاكح الزي

يريد العفاف والمجاهد في سبيل الله–

অর্থ : তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য : (১) স্বাধীন চুক্তিবদ্ধ গোলাম–যে তার, রক্তমূল্য আদায় করতে চায়, (২) পবিত্রতার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি, (৩) আল্লাহর পথে জিহাদকারী।

মূলকথা, ইসলাম মানুষের যৌনক্ষমতা ও তার চাহিদাকে স্বীকার করে। তবে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে পোষণ করে স্বচ্ছ, পবিত্র ও সুশৃঙ্খল ধারণা। মানুষ সকল সৃষ্টির সেরা। সুতরাং তার যৌন ক্ষুধা নিবারণ পদ্ধতি ও যৌন সম্পর্ক সকল কিছুই হবে অন্য সকল প্রাণী থেকে পৃথক। যে পথে যৌন কামনা পুরণ হবে কিন্তু সভ্যতা ভুলুণ্ঠিত হবে না।

.

পর্দার গুরুত্ব ও উপকারিতা

মুসলিম নারীর সৌন্দর্য পর্দা। পর্দা নারীর মান-সম্মান ইজ্জত-আবরুর হেফাজতকারী। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’ ঘোষণার মাধ্যমে নারীকে মহিমান্বিত করেছে যে ইসলাম, নারীর মহামহিম মর্যাদা রক্ষায় পর্দার অপরিহার্যতাকেও সেই ইসলামই অনিবার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছে।

হযরত মাওলানা থানবী (রঃ) পর্দাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :

১। সর্বনিম্ন পর্দা–মুখমণ্ডল এবং হাতের কব্জি ছাড়া নারীর সমুদয় দেহ পর্দাবৃত রাখা। ভিন্ন মতে টাখনুর গিরা পর্যন্ত পায়ের পাতা ব্যতীত গোটা দেহ আবৃত রাখা ফরয।

২। মাধ্যমিক স্তর–মুখমণ্ডল, হাত এবং পাসহ সবকিছুই বোরকা দিয়ে ঢেকে রাখা।

৩। সর্বোচ্চ স্তর –মহিলার শরীর পর্দায় আবৃত করার সাথে সাথে তার পরিধেয় বস্ত্রও আবৃত রাখা।

পর্দার এ স্তরগুলোও কোরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। প্রথম স্তরের পর্দার আবশ্যকতা সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে :

قل للمؤمنين يغضضن من أبصارهن ويحفظن فروجهن ويبدين زينتهن إلا ما ظهر منها وليضربن بخمرهن على جيوبهن ولايبدين زينتهن إلا لبعولتهن أو آبائهن أو أباء بعولته أو ابنائه

او ابناء بعولتهن أو إخوانهن او بنى اخوانهن أو بني اخوتهن او

نائهن أو ما ملكت أيمانه أو التبعين غير أولي الإربة من الإجال أو الفل الذين لم يظهروا على عورت التساء و يشربن بارجه يثلم ما يخفين من زينتهن وتوبوا الى الجميعا أيه المؤمنون

لعلكم تفلحون

অর্থ : মু’মিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনাহীন পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের অলঙ্কার প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন অলঙ্কার প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর : ৩১)

2 kL-এর অর্থ হচ্ছে, মুখমণ্ডল ও কব্জি পর্যন্ত উভয় হাত। ফিক্হ বিজ্ঞান কিয়াস করে পা’কেও এ দু অঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ কোন মহিলার জন্যেই মুখমণ্ডল, উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত এবং উভয় পা ছাড়া কোন অঙ্গ গায়রে মাহরামের (যাদের সাথে বিবাহ হারাম নয়) সামনে খোলা বৈধ নয়। যুবতী ও বৃদ্ধা সকলেই এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসা বা এ জাতীয় শরীয়াত সমর্থিত ওর ছাড়া কারও সামনেই সতর খোলা দুরুস্ত নেই। -(পর্দাকে শরঈ আহকাম।)

লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এখানে এ4 kJL(যা তারা প্রকাশ করে) বলা হয়নি বরং L L; 4 যা তাদের থেকে প্রকাশিত হয়ে যায় বলা হয়েছে অর্থাৎ কর্মব্যস্ততার কারণে কোন মহিলার উপরোক্ত অঙ্গগুলো থেকে কাপড় সরে গেলে কোন গুনাহ্ নেই। সুতরাং এই অনুমতির অর্থ যে এ কথা নয়, এসব অঙ্গ প্রদর্শনী করে বেড়াবে এটা সহজেই অনুমেয়।

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন :

یا اسماء إن المرأة إذا بلغت المحيض لن يصلح أن يرى منها

إلا هذا وهذا وأشار الى وجهه وكفيه

অর্থ : হে আসমা! কোন মহিলা প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তখন তার এই এই অর্থাৎ মুখমণ্ডল ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত ব্যতীত অন্য কোন অঙ্গ দেখা দুরুস্ত নেই।–(আবূ দাউদ)

দ্বিতীয় স্তরের পর্দা সম্পর্কে কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে।

ينين عليهن من جلابيبهن

অর্থ : তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। –(সূরা আহযাব, ৩৩ ঃ ৫৯)

১.–ULT এর বহুবচন। অর্থ বিশেষ ধরনের লম্বা চাদর। এই চাদরের আকার-আক্বতি সম্পর্কে হযরত ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) বলেন, এই চাদর ওড়নার উপর পরিধান করা হয়। মুহাম্মদ ইব্‌ন সীরীন (রহঃ) বলেন, আমি হযরত উবায়দা সালমানী (রহঃ)-কে এই আয়াতের উদ্দেশ্য এবং জিলবাব’-এর আকার-আক্বতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি মস্তকের উপর দিক থেকে চাদর টেনে মুখমণ্ডলের উপর ঝুলিয়ে দিলেন এবং মুখমণ্ডল ঢেকে ফেললেন এবং শুধু চোখ খোলা রেখে +JJ-এর ব্যাখ্যা বাস্তবে দেখিয়ে দিলেন।

এতে এ কথা প্রতীয়মান হয়, মহিলারা নিতান্ত প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে লম্বা চাদর সমস্ত দেহ আবৃত করে বের হবে এবং চাদরটি মাথার উপর দিক থেকে ঝুলিয়ে মুখমণ্ডলও ঢেকে ফেলবে। প্রচলিত বোরখাও এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। -(মাআরিফুল কোরআন (সংক্ষিপ্ত) পৃঃ ১০৯৭–৯৮)।

নবী করীম (ছঃ) বলেন :

ترى المرأة الإزار شبرا فقالت أم سلمة إيزا تكشف أقدامهن

قال فيرخين زراعا–

অর্থ : মহিলারা তাদের পায়ের ইযার তথা চাদর (পায়ের নালার) এক বিগত নীচে ঝুলিয়ে পরবে। পরে উম্মে সালামা (রাঃ) বললেন, তবে তো তাদের পা অনাবৃত হয়ে পড়বে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) তখন বললেন, তাহল একহাত ঝুলিয়ে পরবে।

দ্বিতীয় স্তরর পর্দা সম্পর্কে 4 41 L 24:0; }; (তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রকাশ না করে) আয়াতটিও আলেমরা দেখিয়ে থাকেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) বলেন, L, 4 5 L অর্থ মহিলাদের গায়ের কাপড় ও বড় চাদর। অর্থাৎ এর দ্বারা সেই সব কাপড়কে বুঝানো হয়েছে যেগুলো শরীরের সাধারণ পোশাকের উপর পর্দার জন্যে অতিরিক্ত হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

তৃতীয় স্তরের পর্দা সম্পর্কে আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে :

وقرن في بيوتكن ولا تبرجن تبرج الجاهلية الأولى

অর্থ : এবং তোমরা নিজগৃহে অবস্থান করবে, প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না।–(সূরা আহযাব, ৩৩ : ৩৩)

উল্লিখিত আয়াত থেকে এ কথা স্পষ্ট প্রতিয়মান হচ্ছে যে, আল্লাহর নিকট নারীদের বাড়ি থেকে বের না হওয়াটাই কাম্য। গৃহকর্মের জন্যেই তাদের সৃষ্টি। এ নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকবে। মূলত শরীয়াতের কাম্য প্রকৃত পর্দা হলো গৃহের অভ্যন্তরে অনুসৃত পর্দা। শরীয়াত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া তাদের জন্য বৈধ নয়।-(মা’আরিফুল কোরআন)

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

وإذا سالتموهن متاعا فسئلوهن من وراء حجا

অর্থ : তোমরা তার (অন্যের) স্ত্রীদের নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। –(সূরা আহাব, ৩৩ ঃ ৫৩)

পর্দা সম্পর্কে হাদীস শরীফে আছেঃ

عن أم سلمة رضى الله تعالی عثها إنها كانت بعث رسول الله صلى الله عليه وسلم وميمونة إذ أقبل عبد الله ابن أم مكتوم رضی الله عنه دخل عليه فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم إحتجبا مثه فقالت يا رسول الله اليس هو أعمى لايبصرنا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم اعوان أنتما الشتا تبصرانه

অর্থ : হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি ও মায়মূনা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর দরবারে ছিলাম। এমতাবস্থায় (দৃষ্টিহীন সাহাবী) আবদুল্লাহ্ ইবন উম্মে মাকতুম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর নিকট আগমন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, তোমরা পর্দার অন্তরালে চলে যাও। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ইনি কি দৃষ্টিহীন নন? ইনি তো আমাদেরকে দেখছেন না। জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বললেন, তোমরা কি তাকে দেখো না?

অন্য একটি বর্ণনায় আছেঃ–(মিশকাত পৃঃ ২৬৯)

المرأة عورة فإذا خرجت إستشرقها الشيطان

অর্থ : নারী গোপনযোগ্য। যখন সে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে দৃষ্টি দিতে থাকে।

হাদীসের স্পষ্ট ভাষ্য, পর্দার ভেতর থাকাটাই নারীর জন্যে শোভণীয়। যদি কোন নারী বিনা দরকারে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান পুরুষের মনের মধ্যে প্রলোভন সৃষ্টি করে যেন সে নারীর রূপ-লাবণ্যের প্রতি খারাপ দৃষ্টিতে তাকায় এবং তার দেহ সৌন্দর্য ক্ষুধার্থ দৃষ্টিতে উপভোগ করে।

ফিকাহের দৃষ্টিতে ফিৎনার সম্ভবনা থাকলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রকারের পর্দা ওয়াজিব। ফিৎনার সম্ভবনা না থাকলে ওয়াজিব নয়। কিন্তু কোথায় ফিত্নার সম্ভবনা আছে আর কোথায় নেই তা আল্লাহ্ পাকই বলে দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছেঃ

والقواعد من البناء التي لا يرجون نكاحا فليس عليهن جناح أن يضعن ثيابه غير متبرجت بزينة وان يستعففن خيرته و الله شوي عليم

অর্থ : বৃদ্ধা মহিলা যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্যে অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বহির্বাস খোলে, তবে এটা না করাই তাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।–(সূরা নূর, ২৪ : ৬০)

অর্থাৎ যেসব মহিলার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে তারাই এই আয়াতের প্রতিপাদ্য বিষয়। তারা যদি তাদের পরিধেয় বস্ত্রের উপরের চাদর খুলে ফেলে তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু যুবতী কিংবা মধ্যবয়সী মহিলারা এমনটি করতে পারবে না। কেননা, তাদের ক্ষেত্রে ফিৎনার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।-(পর্দাকে শারঈ আহকাম পৃঃ ১৫-২০।)

কোরআন-হাদীসের আলোকে উল্লিখিত পর্দা সম্পর্কে শরীয়াতের বিধান থেকে অনুমান করা যায় ইসলামে পর্দার গুরুত্ব কতখানি। মূলত কোন পুরুষ যখন কোন নারীর প্রতি দৃষ্টি দেয় তার। সৌন্দর্য দেখে, এবং তার শরীরের কামোত্তেজক অঙ্গগুলো প্রত্যক্ষ করে তখন সেই পুরুষের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে কামনার অগ্নি শিখা। সে শিকার দহনে অবিরাম দগ্ধিভূত হতে থাকে সে। নিরাশায় ভাবতে থাকে কল্পনার স্বচ্ছ দর্পনে অঙ্কিত সেই রমণীর দেহ সৌন্দর্য নিয়ে। কত ঘুম তার নষ্ট হয় সেই ভাবনার আঘাতে। কত রাত কাটে বিনিদ্র কল্পনার জাল বুনতে বুনতে। কল্পনার সেই ছোট ছোট ঢেউ এক সময় বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের সৃষ্টি করে তার যৌবন দরিয়ায়। সে তরঙ্গে অনাথের মত হারিয়ে যায় সমাজ সভ্যতা নামের সকল বাধা-বিঘ্ন। স্বপ্নের নীল আকাশে সে তখন উড়তে থাকে কল্পনার পাখায় গা এলিয়ে বিলাসী বিহঙ্গের মত। তার স্বপ্নের রমণীকে একান্তে পাবার ক্ষীপ্র বাসনায় ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মত হিংস্র হয়ে ওঠে সে। তারপর যা ঘটে তা আমরা প্রতিনিয়ত প্রতক্ষ করি চোখের সামনে। অথচ ভেবে দেখি না এর উৎসটা কোথায়?

শরীয়াত সেই উৎসটাই সমূলে উপড়ে ফেলতে চায়। যেই কামময় দেহদর্শন শত অনিষ্টের মা। শরীয়াত সেই দেহ সৌন্দর্যকেই ঢেকে রাখতে হুকুম করেছে। শরীয়াত সমর্থিত প্রয়োজন ব্যতকবীরেকে নারী ঘরের বাইরে যেতেই পারবে না। প্রয়োজনে বের হবে পুরো পর্দার আড়ালে, যেন তার উপস্থিতি কোন পুরুষের কামচেতনায় অযথা ঝড় না তোলে। বলা বাহুল্য, নারীর সতীত্ব সম্ভম ও নাজুক মর্যাদার সুরক্ষায় পর্দার বিকল্প নেই। এর গুরুত্ব বাস্তবসিদ্ধ ও প্রশ্নাতীত। এর লংঘন শরীয়াত বিরোধী ও সামাজিক মর্যাদার পরিপন্থী।

পর্দার উপকারিতা অনেক। যে সমাজের নারীরা পর্দায় থাকে সে সমাজ আশা করতে পারে একটি পূত পবিত্র মা জাতির। যে জাতি সমাজকে উপহার দেবে একটি পরিচ্ছন্ন আলোকময় নতুন প্রজন্ম। যাদের পরশে সোনা হয়ে ওঠবে সমাজ সভ্যতা ও দেশ। গোলাপ বিলায় মদির সুরভি, গোবর ছড়ায় দুর্গন্ধ। এতো বাস্তবতা। সভ্য সতী নারী যে সমাজে নেই সভ্য প্রজন্ম সে সমাজ পাবে কোথা থেকে? তাছাড়া সভ্য প্রজন্ম ব্যতীত কি কোন সমাজ সভ্য হতে পারে?

.

বিয়ে না করার অপকারিতা

বিয়ে না করার অপকরিতা প্রচুর। প্রথমেই যাদের সামর্থ্য আছে, বিয়ের প্রতি আকর্ষণ আছে আল্লাহ্ পাক তাদেরকে বিয়ে করার হুকুম দিয়েছেন। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, বিবাহ রাসূলদের সুন্নাত।

হযরত মাওলানা থানবী (রঃ) লিখেছেন, বিবাহ স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী। (আহকামুল ইসলাম আকল কী নযর মে, ৩য় খন্ড)। সুতরাং প্রয়োজন সত্ত্বেও বিবাহ না করাটা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

কারো কারো পক্ষে যৌন উন্মাদনাকে রোযা কিংবা অন্য কোন সাধনার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখন চারিত্রিক স্খলন অবস্যম্ভাবি হয়ে পড়তে পারে।

.

ব্যভিচারঃ কুফল ও বিধান

 ব্যভিচার ধর্মীয়, সামাজিক ও আদর্শিক সকল মাপকাঠিতেই একটি জঘন্য অপরাধ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সকল ধর্ম ও সকল দেশেই ব্যভিচার অন্যায় বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে। ইসলাম এ অপরাধকে সর্বাধিক ঘৃণিত বিবেচনা করে।

নারীর সতীত্বের হিফাযত ও খিয়ানতের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যত প্রজন্মের পবিত্রতা। নারীর গর্ভেই জন্ম নেয় রাজা-রাণী, গবেষক-পণ্ডিত, সমাজ সংস্কার থেকে শুরু করে যুগ শ্রেষ্ঠ মনীষীবৃন্দ। অনাগত প্রজন্ম যেন একটি সুরক্ষিত পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে সে জন্যই বিয়ের ব্যবস্থা। এতে সুনির্ধারিত পিতামাতার শাসন-স্নেহে সন্তান মানুষ হওয়ার সুযোগ লাভ করবে, মানব বংশের উন্নতি ও প্রতিষ্ঠার জন্যে মহান রবের এ ব্যবস্থাপনা।

পক্ষান্তরে, ব্যভিচার নারীকে মর্যাদার আসন থেকে পতিত করে। বিয়ে বহির্ভূত সন্তানরা পৃথিবীতে পা রাখে পিতৃপরিচয়হীন ঘৃণার পাত্র হয়ে। ব্যভিচারের ভয়াবহ পরিস্থিতির হাত থেকে মানব জাতিকে হেফাজত করার লক্ষ্যেই এর কঠিন শাস্তি বিধান করেছে ইসলাম। এ অপরাধজনক কাজটি যেমন জঘন্য, শাস্তিও টিক তেমন কঠোর। ব্যভিচারী নারী-পুরুষের একশ’টি বেত্রাঘাত অবস্থাভেদে পাথর মেরে মৃত্যুর শাস্তির বিধান রয়েছে ইসলামী শরীয়াত। এর মূল উদ্দেশ্য হল, পাপের উৎসমূল চির রূদ্ধ করে দেয়া। ব্যভিচারী যদি অবিবাহিত আযাদ ব্যক্তি হয় তাহলে তার শাস্তি বিধান সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :

الزانية والژانی قاجدوا كل واحد منهما مائة جلدة ولاتأبهما

رأفة في دين الله إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الأخر.

অর্থ : ব্যভিচারী-নারী পুরুষ উভয়কে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়। যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাক।–(সূরা নূরঃ ২)

বিবাহিত নারী-পুরুষ যদি ব্যভিচার করে তাদেরকে অবশ্যই প্রস্তরাঘাত করে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।

অবশ্য এ শাস্তি প্রয়োগ হওয়ার জন্য, উপযুক্ত সাক্ষী অথবা অপরাধীর স্বীকারোক্তিমূলক স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়ার শর্ত সম্পৃক্ত। সাক্ষী কমপক্ষে চারজন হতে হবে। স্পষ্টভাষায় ঘটনার বিবরণ দিতে হবে। কোথায় কখন কার সাথে কী ভাবে ব্যভিচার হতে দেখেছে তা পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। সুরমাদানীর কাঠি সুরমাদানীর মধ্যে যেভাবে প্রবিষ্ট করে সেভাবে প্রবিষ্ট করতে দেখেছি’ এই জাতীয় স্পষ্ট বক্তব্য সকল সাক্ষীকে দিতে হবে। তদ্রপ স্বীকারোক্তির ক্ষেত্রে চারবার স্পষ্টভাষায় অপরাদের ব্যাখ্যামূলক বিবৃতি দিতে হবে। বিচারক এ ক্ষেত্রে বরং এভাবে টলাতে চেষ্টা করবেন, তুমি হয় তো ব্যভিচার করনি। চুমু খেয়েছে, ধরেছে ইত্যাদি। তাতেও যদি না দমে বরং নিজের অপরাধ অকপটে স্বীকার করে তবেই তাকে উপরোক্ত দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।-(হেদায়া, ২য় খন্ড)।

এই বিধান বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া খোলা ময়দানে যদি নারী হয় তবে অবক্ষ গর্ত করে আর পুরুষ হলে এভাবেই মাটিতে ফেলে দণ্ডাদেশ কার্যকর করতে হবে। প্রথমে সাক্ষীদেরকে পাথর মারতে বলা হবে। তারা অস্বীকার করলে পুরো শাস্তিই রদ বলে বিবেচিত হবে। সাক্ষীর পর বিচারক, তারপর অন্যান্য মানুষ পাথর মারবে।

উল্লেখ্য, স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দানের পর শাস্তি কার্যকর হওয়ার পূর্বে যদি বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয় তবে শাস্তি রহিত হয়ে যাবে। শাস্তিটি অত্যন্ত কঠিন বিধায়ই তার বাস্তবায়নে এতটা সতর্কতা ও শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুধণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার জন্যে বিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আরও কিছু গুণ থাকাও আবশ্যক। যেমন : বিকেবান হওয়া, আযাদ হওয়া, প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুসলমান হওয়া, বিবাহিত স্ত্রীর সাথে যৌনমিলনে আস্বাদিত হওয়া।

ইসলামী হুকুমত এসব শাস্তি বাস্তবায়ন করবে। এসব শর্ত এ জন্যে আরোপ করা হয়েছে যে, এগুলো সবই আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। এগুলো এমন মহান বৈশিষ্ট্য যার পরশে একটি মানুষ এমনিতেই সুস্থ হয়ে যায়। উপরন্তু যে যৌণ শৃঙখলার সে শিকার তা চরিতার্থ করার উপযুক্ত পাত্রও তার রয়েছে। এরপরও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ। আল্লাহর আইনের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা ও বিদ্রোহের শামিল তাই এর শাস্তিও বিধান করা হয়েছে অত্যন্ত কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক।

.

বিয়ে সম্পর্কে শরীয়াতের নির্দেশ

বিয়ে-শাদীর হুকুম নির্ভর করে ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। তাই বিয়ের হুকুম সকলের ক্ষেত্রে একই রকম নয়। বরং বিয়ে-শাদী ব্যক্তি ভেদে ফরয, ওয়াজ্বি,

সুন্নাতে মুয়াক্বাদা, হারাম, মাকরূহ ও মুবাহ্ বলে বিবেচিত।

ফরয : বিয়ে করা ফরয হওয়ার শর্ত–১. যদি কেউ বিয়ে না করলে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে বলে নিশ্চিত আশংকা থাকে, ২. ব্যভিচার থেকে বাঁচার জন্যে রোযা রাখতেও অক্ষম ৩. বাদী গ্রহণেরও সুযোগ নেই এবং ৪. হালাল পথে স্ত্রীর মোহর ও ভরণ-পোষণেও সক্ষম এমন ব্যক্তির জন্যে বিয়ে করা ফরয।

ওয়াজিবঃ বিয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ আছে, ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়ারও ভয় আছে কিন্তু ব্যভিচারে পড়েই যাবে এমন বিশ্বাস নেই, অধিকন্তু হালাল অর্থে স্ত্রীর মোহর ও ভরণ-পোষণ করতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির জন্যে বিয়ে করা ওয়াজিব।

সুন্নাতে মুয়াক্কাদা : বিয়ের প্রতি আকর্ষণ প্রবল কিন্তু তবে এ কারণে ব্যভিচারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তির জন্যে বিয়ে করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

হারাম : যদি ইয়াকীন ও বদ্ধমূল বিশ্বাস থাকে যে, বিয়ে করলে তাকে অন্যায়ভাবে অন্যের প্রতি যুলুম ও নিপীড়ন করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, তবে এ ক্ষেত্রে বিবাহ করা হারাম। কেননা, বিবাহের উদ্দেশ্য হলো রিপুকে পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখা ও পূণ্য হাসিল করা।

মাকরূহ : যদি বিবাহের কারণে অন্যের প্রতি যুলুম অত্যাচার করবে বলে ভয় হয়। (ইয়াকীনের পর্যায়ে না হয়।) তবে বিয়ে করা মাকরূহে তাহরীমী।

মুবাহ্ ঃ বিয়ের প্রতি ঝোঁক আছে, তবে না করলে ব্যভিচারী হওয়ার আশংকা নেই এটাই মুবাহ্। এ ক্ষেত্রে যদি নিজেকে পাপমুক্ত রাখা কিংবা মানব বংশ বৃদ্ধির নিয়্যত করে তবে বিয়ে করা সুন্নাত বলে বিবেচিত হবে। এখানে মুবাহ্ ও সুন্নাতের পার্থক্য নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল।

.

বর-কণে নির্বাচন

বর-কণে নির্বাচন বিয়ে-শাদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দাম্পত্য জীবনের পরিধি যেমন খুবই ব্যাপক, এর সমস্যাও অনেক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি স্পষ্ট বাহ্যিক-সামাজিক দৃষ্টিতে প্রকট কোন ব্যবধান ও অসামঞ্জস্য থাকে অনেক ক্ষেত্রেই তা আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। যে কারণে, বিয়ের পূর্বেই বর-কনে নির্বাচনের সময় এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত। হাদীস শরীপে আছেঃ

عن ابي هريرة رضي الله تعالى عنه قال جاء رجل إلي الثبي صلى الله عليه وسلم فقال إني تزوجت إمرأة من الأنصار قال فانظر إليها فان في أعين الأنصار شيئا.

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তির নবী করীম (ছঃ)-এর কাছে এসে বলল, আমি একজন আনসারী মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। (রাসূল (ছঃ)) বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও! আনসারীদের চোখে আবার সমস্যা থাকে।২৪

আলোচ্য হাদীসে নবী করীম (ছঃ) কনে নির্বাচনের পূর্বে তাকে দেখে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, যেন পরবর্তীতে সমস্যা না হয়। অধিকন্তু কনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি কি বিষয়ে লক্ষ্য করা বাঞ্চনীয় সে কথাও অন্য হাদীসে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাসায় বর্ণিত হয়েছে।

عن أبي هريرة رضي ا الله عليه وسلم تنكح المرأة لأربع لمالها وجمالها وحبها ولدينها فاظفر بذات الوين

অর্থ : আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, সাধারণত চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে কোন মেয়েকে বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার সৌন্দর্য ও তার দীনদারী। তবে তোমরা দীনদারীকেই অগ্রাধিকার দেবে।

এই হাদীসে নারীর সম্পদ, বংশ গৌরব, রূপ সৌন্দর্য ও দীনদারীকে এমন বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে যার আলোকে তাকে নির্বাচন করা হয়ে থাকে। তবে ধর্মপরায়নতাই সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয়।

.

যাদের সাথে বিয়ে হালাল ও যাদের সাথে বিয়ে হালাল নয়

শরীয়াত নির্ধারিত কিছু নারী ছাড়া যেহেতু সকল নারীর সাথেই বিয়ে হালাল তাই আমরা যাদের সাথে বিয়ে হালাল নয় তাদের বিবরণ এখানে পেশ করছি। সে আলোকেই দেখা যাবে কাঁদের সাথে বিয়ে হালাল। যাদের সাথে বিয়ে হালাল নয় তাদের সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

بنت الاخت وامهتكم ال

حرمت عليكم أمهم

و بنتكم واخوتهم وعشتكم وخلتكم

ارضعنکم واخوتكم من الرضاعة وامهت نسائكم وتراكم التي في حجوركم من يساء كم

جناح عليكم وي

التي تختم به فإن لم تكونوا تختم به

ابنائكم البنين من أشبگم و أن تجمعوا بين الأختي الأماقة سلق إن الله كان غفورا ژیا۔

অর্থ : তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, কন্যা, ভগ্নি, ফুপু, খালা, ভ্রাতুস্পুত্রী, ভাগ্নী দুধমা, দুধবোন, শাশুড়ি ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সঙ্গে মিলিত হয়েছ তার পুর্বস্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত কন্যা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, তবে যদি তাদের সাথে মিলিত না হয়ে থাক তাতে কোন অপরাধ নেই। এবং তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ও দু’ ভগ্নিকে একত্র করা। পূর্বে যা হয়েছে তাতো হয়েই গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।–(সূরা নিসা : ২৩)।

এছাড়া ও সধবা মহিলাকে বিয়ে করাও হারাম। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

والمحصنت من البناء الا ما ملكت ايمانگم

অর্থ : এবং নারীদের মধ্যে তোমাদের অধিকারভূক্ত দাসী ছাড়া সকল সধবা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ।–(সূরা নিসা, ৪ঃ ২৪)।

উল্লেখ্য, এখানে যে চৌদ্দ প্রকার নারীর সাথে বিয়ে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে তার প্রত্যেকটি বিধান ও প্রক্বতি সর্বাঙ্গীনভাবে এক নয়। কোনটি স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্যে হারাম আবার কোনটি হারাম সাময়িক সময়ের জন্যে। চিরস্থায়ীভাবে বিয়ে হারাম প্রমণিত হওয়ার কারণ তিনটি। আত্মীয়া, বিবাহ বন্ধন ও দুধপান।

 আত্মীয়তার কারণে বিয়ে হারামঃ

এর স্তর তিনটি?

১. ব্যক্তির উসূল ও ফুরূ’। উসূল অর্থ মূল। অর্থাৎ মা, মায়ের মা, নানীর মা; তদ্রূপ দাদী, পিতার দাদী, দাদীর দাদী থেকে তদূর্ধ মহিলারা। ফুরূ’ বলতে নিজের কন্যা, কন্যার কন্যা, নিজের ছেলের কন্যাসমূহ ও তদনিন্ম মহিলারা।

২. বাবা-মার ফুরূ’ : অর্থাৎ বোন। নিজের আপন বোন কিংবা শুধু বাপের ঔরসজাত অথবা শুধু মায়ের গর্ভজাত বোন। তদ্রপ ভ্রাতুষ্কন্যা ও তদনিম্ন কন্যারা।

৩. দাদী-দাদী ও নানা-নানীর ফুরূ’ঃ খালা–ফুপু ইত্যাদি।

বিয়ের কারণে যাদেরকে বিয়ে করা হারাম

১. যে স্ত্রীর সাথে মিলন হয়েছে তার কন্যা। তবে যে নারীর সাথে শুধু বিয়ে হয়েছে মিলন হয়নি এমন নারীর কন্যাকে বিয়ে করা বৈধ।

২. স্ত্রীর উসূল শাশুড়ি, শাশুড়ির মা ইত্যাদি।

 ৩. পিতা যে নারী সাথে মিলিত হয়েছেন।

দুগ্ধপানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সূত্রও এ ক্ষেত্রে জন্মসূত্রের মতই। জন্মসূত্রে যাদের সাথে বিয়ে হারাম এই সূত্রেরও তাদের সাথে বিয়ে হারাম। যেমন : দূধবোন, দুধমা, দুধকন্যার সাথে দুগ্ধপিতা ইত্যাদি।

পাঁচটি কারণে সমাময়িকভাবে বিয়ে হারাম

১. একই সাথে দু দুধবোনকে বিয়ে করা হারাম। অবশ্য প্রথমজন কোন কারণে ছিন্ন হয়ে পড়লে স্ত্রীর বোনকে বিয়ে করাতে কোন নিষেধ নেই।

২. মালিকানা। নিজের দাসের সঙ্গে কোন মহিলা বিয়ে হতে পারে না।

 ৩. শিরক। অর্থাৎ মুশরিকের সাথে মুসলিমের বিয়ে হারাম।

৪. তিন তালাক। অর্থাৎ নিজের স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দিলে অন্যত্র বিয়ে সম্পাদনপূর্বক তালাকপ্রাপ্তা না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামীর সাথে পুনঃ বিয়ে হারাম।

৫. যে নারী অন্যের। এ অবস্থায় অন্য কোন পুরুষের সাথে তার বিয়ে হারাম।

বলাবাহুল্য, স্থায়ী ও অস্থায়ী বিয়ে হারাম হওয়ার যে সব কারণ এখানে আলোচিত হয়েছে এসব কারণ নেই এমন যে কোন মহিলার সাথে বিয়ে হালাল।

.

অমুসলিমদের সাথে বিয়ে

বিয়ের ক্ষেত্রে অমুসলিমরা দু’ভাগে বিভক্ত। আহলে কিতাব এবং যারা আহলে কিতাব নয়। আসমানী কিতাবের অনুসারীরা আহলে কিতাব হিসাবে গণ্য। যেমন ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান। কোরআন শরীফে এ দু সম্প্রদায়কে আহলে কিতাব নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। –(সূরা আনআম, ৬ঃ ১৫৬)

মহান আল্লাহ্ মুসলিম পুরুষদেরকে কেবল আহলে কিতাব নারী বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

والمخضت من الذين أوتوا الكتب من قبلكم

অর্থ : এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সচ্চরিত্রা নারী তোমার জন্য বৈধ করা হল।–(সূরা মায়িদা : ৫)।

কোন মুসলিম নারীর কোন আহলে কিতাব পুরুষ বিয়ে করা সম্পূর্ণ হারাম। মুসলমানদের জন্য আহলে কিতাব নারী বিয়ে করা বৈধ হলেও স্থান-কাল-পাত্রভেদে তা অপসন্দনীয় বলে ফকীহরা মত প্রকাশ করেছেন।

যারা আহলে কিতাব নয় তারা মুশরিক এবং কাফের তা যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন। এ পর্যায়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, নাস্তিক, অগ্নিউপাসক সকলেই এ পর্যায়ভূক্ত। কাদিয়ানীরা মুশরিক না হলেও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য অনুযায়ী কাফের। তাদের সাথে মুসলিম নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন চিরতরে, সর্বতোভাবে ও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

وتثوا المشركت حتى يؤمن ولامة مؤمنة خير من مشركة ولو أعجبتكم ولا تنكحوا المشركين حتى يؤمنوا و لعبد مؤمن خير من مشرك و لو اعجبكم

মুশরিক নারীরা ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা তাদেরকে বিয়ে করবে না। মুশরিক নারী তোমাদের মুগ্ধ করলেও নিশ্চয়ই মু’মিন ক্রীতদাসী তার চেয়ে উত্তম। মুশরিক পুরুষরা ঈমান না আনা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে তোমরা (তোমাদের নারীদের) বিয়ে দেবে না। মুশরিক পুরুষ তোমাদের মুগ্ধ করলেও, নিশ্চয় মু’মিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম।–(সূরা বাকারা : ২২১)

.

কুফূ (পাত্র-পাত্রীদের সমতা)

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন দু’জন নারী-পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হোক যাদের দাম্পত্য জীবনে প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কে গড়ে উঠার আশা করা যায়। এমন দু’জন নারী-পুরুষকে কুফূ (সমকক্ষ) বলে যারা মুসলমান বংশ মর্যাদায় সমান, স্বাধীন এবং পেশা, ধর্মানুরাগ, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি পরস্পর সমপর্যায়ের। বিয়ের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াত কুফূর প্রতি লক্ষ্য রাখা ভালো বিবেচনা করেছে, কিন্তু একে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্ব সময়ই কুফূ বিবেচনার বিষয় হতে পারে, বিয়ের পরে এর বিবেচনা অনাবশ্যক।

.

বিয়ের রুকন

 বিয়ের রুকন দুটি : ঈজাব (প্রস্তাব) ও কবূল (গ্রহণ)। বিয়ের পক্ষদ্বয়, নারী ও পুরুষের বা তাদের অভিভাবক অথবা প্রতিনিধিদের ইজাব-কবুল মৌখিক বা লিখিত আকারে হতে পারে। ঈজাব-কবুলের শব্দাবলী সুস্পষ্ট অর্থজ্ঞাপক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদ অতীত কালের হতে হবে। যেমন প্রথম পক্ষ বলল, আমি নিজেকে আপনার নিকট বিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য আমি কবুল করালাম। উল্লেখ্য যে, বালেগ ও বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন নারী-পুরুষের স্বেচ্ছাসম্মতি ছাড়া বিয়ে বৈধ হয় না।

.

বিয়ের শর্তাবলী

 বিয়ের জন্য পাত্র ও পাত্রীকে (১) মুসলমান, প্রাপ্ত বয়স্ক ও বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। (২) তাদের স্বেচ্ছাসম্মতিতে বিয়ে হতে হবে এবং ঈজাব-কবুল নিজ কানে শুনতে হবে। তবে অভিভাবক বা প্রতিনিধির মাধ্যমে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তা নিজ কানে শোনা আবশ্যক নয়। (৩) বিয়ের অন্তত দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক ও বুদ্ধিমান মুসলিম পুরুষ অথবা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম পুরুষ এবং দু’জন প্রাপ্ত বয়স্কা ও বুদ্ধিমতী মুসলিম নারীকে সাক্ষী থাকতে হবে।

.

বিয়ের শ্রেণীবিভাগ

শরীয়াতের দৃষ্টিতে বিয়ে তিন প্রকার–১. সহীহ্ বিয়ে, ২. ফাসিদ বিয়ে, ৩. বাতিল বিয়ে।

সহীহ্ বিয়েঃ বিয়ের রুকন ও শর্তাবলী পূর্ণরূপে পালন করে যে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তাকে ছহীহ্ বিয়ে বলে। ছহীহ্ বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য বিয়ের বিধানাবলীর অনুসরণ বাধ্যতামূলক হয়ে যায় এবং পরস্পরের প্রতি যেসব অধিকার ও কর্তব্য বর্তায় তাও পালন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ফাসিদ বিয়েঃ বিয়ে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিয়ের রুকন ও শর্তাবলীর কোন একটি অপূর্ণ থাকলে উক্ত বিয়ে ফাসিদ বিয়ে হিসাবে গণ্য হয়। যেমন সাক্ষীহীন বিয়ে। ফাসিদ বিয়ের ত্রুটি সংশোধন করে নিলে তা ছহীহ্ বিয়ের রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন সাক্ষীহীন বিয়ের ক্ষেত্রে বিয়ে-পরবর্তীকালে সাক্ষী নিয়োগ করা হলে উক্ত বিয়ে ছহীহ্ হয়ে যায়।

বাতিল বিয়েঃ বিয়ে অনুষ্ঠানকালে বিয়ের এমন কোন শর্ত বাদ পড়লে যা পরে সংশোধনযোগ্য নয়, সেইরূপ বিয়েকে বাতিল বিয়ে বলে। যেমন দু’ মাহরাম আত্মীয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিয়ে, কোন নারীর স্বামী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তাকে বিয়ে করা, তিন তালাক দেয়া স্ত্রীকে তাহলীল ব্যতীত পুনরায় বিয়ে করা ইত্যাদি বাতিল বিয়ের অন্তর্ভুক্ত। কোন বিয়ে বাতিল প্রমাণিত হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে তৎক্ষণাৎ পৃথক হয়ে যাবে। বাতিল বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি কোনরূপ অধিকার এবং শর্ত সৃষ্টি হয় না।

.

টেলিফোন, ট্যালেক্স, ফ্যাক্স বা ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে বিয়ে

পাত্র-পাত্রী বিয়ে অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত না হয়ে নিজ নিজ প্রতিনিধির মাধ্যমে বিয়ে করতে পারে। এ অবস্থায় নিযোগকর্তা প্রতিনিধিকে মৌখিকভাবে নিয়োগ করতে পারেন অথবা পত্র মাধ্যমেও নিয়োগ করতে পারেন। টেলিফোন, ট্যালেক্স ও ফ্যাক্স হল ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম। এগুলো সরাসরি মানুষের প্রতিনিধি হতে পারে না। অতএব উক্ত মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বিয়ে ফাসিদ বিয়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে যদি পাত্র-পাত্রী তাদের পক্ষ থেকে কাউকে টেলিফোন ইত্যাদির মাধ্যমে উকিল বা প্রতিনিধি নিয়োগ করে এবং ঐ প্রতিনিধি যদি সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাক্ষীর সামনে বিয়ে কাজ সম্পাদন করে তবে তা ছহীহ্ বিয়েতে পরিণত হবে।

ছেলেমেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হলেই ওলীর প্রয়োজন হয়। অন্যথায় পর্যায়ক্রমে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা অপ্রাপ্ত বয়স্কের ক্ষেত্রে ওলী হবেন : (১) পিতা (২) দাদা ও তদুর্ধগণ (৩) সহোদর ভাই (৪) বৈমাত্রেয় ভাই (৫) আপন ভ্রাতুস্পুত্র (৬) সৎ ভ্রাতুস্পুত্র (৭) আপন চাচা (৮) আপন চাচাতো ভাই (৯) সৎ চাচাতো ভাই প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, প্রথম ওলীর অবর্তমানের দ্বিতীয়জন ওলী হতে পারে। দূরতর ওলী নিকটতর ওলীর বর্তমানে অপ্রাপ্তবয়স্ককে বিয়ে দিলে উক্ত বিয়ে নিকটতর ওলীর সম্মতির উপর নির্ভরশীল হবে।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাত্র-পাত্রী প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত বিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তার এই আইনগত ইখতিয়ারকে খিয়ারুল বুলুগ বলে। তবে এ ক্ষেত্রে উক্ত ইতিয়ার বা অধিকার প্রয়োগ দ্বারা সরাসরি বিয়ে বাতিল হয় না বরং আদালতের নিদের্শেই বিয়ে বাতিল হয়।

.

দেনমহর

বিয়ে উপলক্ষে স্বামী বাধ্যতামূলকভাবে স্ত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রূপা বা স্থাবর সম্পতির আকারে যে মাল প্রদান করে সেই মালকে মহর বলে। দেনমহর স্বামীর একটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য। আল্লাহ্ তা’আলা সম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে পুরুষকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছেন।

وأتوا البناء ثقتهن نحلة

অর্থ : তোমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নারীদেরকে তাদের মহর প্রদান কর।–(সূরা নিসা : ৪)

সর্বনিম্ন পরিমাণ মহর দেশ দিরহাম। মহনবী (ছঃ) বলেন :

الأمهر دون عشرة دراهم

অর্থ : দশ দিরহামের কম মহর হতে পারে না।–(হিদায়া, ২য় খণ্ড পৃঃ ৩০৪)

মহরের সর্বোচ্চ পরিমাণের সীমা নির্ধারিত নেই। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন এরশাদ হয়েছে :

واژ اردتم استبدال وچ مان تي في أتيتم إخه قثطارا قد

تأخذوا منه شيئا۔

অর্থ : তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণের ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাকলে তবুও তা থেকে কিছুই প্রতিগ্রহণ করো না।–(সূরা নিসা : ২০)

মহর দু’ শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা : ১. মহরে মুসাম্মা (নির্ধারিত) ২. মহরে মিসাল।

বিয়ে সম্পাদনকালে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত মহরকে মহরে মুসাম্মা’ বলে। যদি বিয়ের সময় মহরের উল্লেখ না থাকে অথবা মহর আদৌ নির্ধারণ করা না হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর পিতৃকুলের অন্যান্য নারীর মহরের পরিমাণ বিবেচনায় রেখে তার জন্য যে পরিমাণ মহর নির্ধারণ করা হয় তাকে মহরে মিসাল বলে।

পরিশোধের সময়সীমার দিক থেকে মহরে মুসাম্মা’ দুভাগে বিভক্ত : ১. মহরে মু’আজ্জাল ( U La) অর্থাৎ বিয়ের সময় যে মহর নগদ আদায় করা হয় তাকে মহরে মু’আজ্জাল’ বলে। ২. মহরে মুওয়াজ্জাল (২) অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে বিচ্ছেদ অথবা তাদের কোন একজনের মৃত্যুর কারণে যে মহর পরিশোধ তক্ষণাৎ বাধ্যতামূলক হয় তাকে মহরে মুওয়াজ্জাল’ বলে। মহর কখন পরিশোধযোগ্য হবে সে সম্পর্কে বিয়ের সময় কিছু উল্লেখ্য না করা হলে সম্পূর্ণ মহর দাবী করা মাত্র আদায়যোগ্য হবে।

মহর না দেয়ার শর্তে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে শর্তটি বাতিল গণ্য হবে এবং মহরে মিসাল প্রদান অপরিহার্য হবে।

বিয়ে হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী একত্রে নির্জনে মিলিত হওয়ার পূর্বে তালাক সংঘটিত হলে এবং মহর পূর্বে নির্ধারিত হয়ে থাকলে স্ত্রী অর্ধেক মহর পাওনা হবে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :

قتموهن من قبل أن تمسوهن وقد فرضتم لهن فريضة

فنصف ما فرضتم۔

অর্থ : তোমরা যদি তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দাও, অথচ তাদের মহর ধার্য করেছ, তবে যা তোমরা ধার্য করেছ তার অর্ধেক।–(সূরা বাকারা : ২৩৭)

উপরোক্ত অবস্থায় যদি মহর ধার্য হয়ে না থাকে তবে স্ত্রী মহর পাওনা হবে না। বরং যে মুতয়া স্বরূপ পরিধেয় বস্ত্র পাবে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন :

جناح عليكم إن طلقتم النيساء مالم تمشوهن أو تفرضوا تهن

و او تا

تمسوهن

অর্থ : যে পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের স্পর্শ করেছ এবং তাদের জন্য মহর ধার্য করেছ, তাদেরকে তালাক দিলে তোমাদের কোন পাপ নেই। তোমরা তাদেরকে মাতা’ (কিছু উপহার সামগ্রী) প্রদান করবে।–(সূরা বাকারা : ২৩৬)

এখানে নির্জনে মিলন বলতে স্বামী ও স্ত্রীর এমন স্থানে একত্র হওয়া বুঝায় যেখানে তাদের মিলনে লিপ্ত হতে দৈহিক, প্রাক্বতিক ও আইনগত কোন প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান নেই।

মহর মূলত দেনাস্বরূপ, তা আদায় না করলে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর এই অধিকার রহিত হয়। সে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে নিজের মহর উসূল করে নিতে পারে। এমন কি সে তা আদায় করার জন্য স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিজ দখলে রাখতে পারে। মৃতের ওয়ারিসদের উপর নিজ নিজ অংশ মুতাবিক মহরের দায় বর্তাবে।

.

বিয়ের মসনূন তরীকা

 ইসলামী আইনে বিবাহকার্য ও বিবাহ অনুষ্ঠান একটি পবিত্র ও এবাদতের অনুষ্ঠান। বিয়েতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয় রাজি হওয়ার পর প্রকাশ্য মজলিসে আব্দ অনুষ্ঠান হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (ছঃ) বলেন :

أعلنوا هذا النيكاح واجعلوه في المساجد

অর্থ : তোমরা বিয়ের প্রচার করবে, বিবাহকার্য মসজিদে সম্পন্ন করবে। -(মিশকাত পৃঃ ২৭২)

আব্দ অনুষ্ঠানের সময় খুৎবা পাঠ করা সুন্নাত। নবী করীম (ছঃ)-এর সকল বিয়েতে খুতবা পাঠ করা হয়েছে। আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী করীম (ছঃ)-এর একটি খুৎবা উল্লেখিত আছে। বিয়ে অনুষ্ঠানে সামর্থ্য অনুযায়ী খুরমা বিতরণ সুন্নাত।

.

নবী করীম (ছঃ)-এর শাদী মুবারক

নবী করীম (ছঃ) মোট এগারজন রমণীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা সকলে উম্মুল মুমিনীন হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন। তাদের মধ্যে দু’জন রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর জীবদ্দশায় ইনতিকাল করেন চার-এর অধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান কেবল নবী করীম (ছঃ)-এর জন্যেই রাখা হয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা নবী করীম (ছঃ)-এর সহধর্মিনীদেরর মর্যাদা ঘোষণা করে বলেন :

النبي اولى بالمؤمنين بين أنفسهم وأزواجه امهتهم

অর্থ : নবী মু’মিনদের জন্য তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীরা তাঁদের মাতা।–(সূরা আহযাব : ৬)

মহানবী (ছঃ) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এসব বিয়ে করেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, আমি জিবরাঈল (আঃ) কর্তৃক আল্লাহর পক্ষ থেকে আনীত ওহীর দ্বারা আদিষ্ট হয়েই সমস্ত বিয়ে করেছি এবং আমার কন্যাদেরকে বিয়ে দিয়েছি। –(সীরাতুল মুস্তাফা ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩০০)

হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর প্রথম স্ত্রী এবং তিনিই প্রথম মহিলা মুসলমান। নবীজী (ছঃ)-এর বয়স যখন পঁচিশ বছর এবং হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর বয়স চল্লিশ বছর, তখন নবী করীম (ছঃ)-এর চাচা আবু তালিবের মধ্যস্থতায় তাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করেন। বিয়ের মহর নির্ধারিত হয় পাঁচ দিরহাম। খাদীজা (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে একটি গরু যবেহ করে ওলীমা (বিবাহভোজ)-এর ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর গর্ভে নবী করীম (ছঃ)-এর চার কন্যা ও দু’ পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। পুত্রদ্বন দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় মারা যান। নবী করীম (ছঃ) ও হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত মধুর এবং আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। দু’জনের মধ্যে পারবারিক বিষয়ে কখনো সামান্য বিরোধ হয়েছে বলেও ইতিহাসে কোন নবীর নেই। তাঁর ইতিকালের পরও নবী করীম (ছঃ) আজীবন তাঁকে স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হতেন।

তিনিই ছিলেন নবী করীম (ছঃ)-এর দুর্দিনের সাথী। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে তিনি যে অমানুষিক নির্যাতনের সম্মুখীন হন, সেই করুণ মুহূর্তগুলোতে হযরত খাদীজা (রাঃ) ছিলেন তার আশ্রয়, সান্ত্বনা লাভের কেন্দ্র। তিনি তাঁর অঢেল সম্পদ নবী করীম (ছঃ)-এর দাওয়াত প্রচারের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেন। নবুওয়াতের দশম বর্ষে অর্থাৎ হিজরতের তিন বছর পূর্বে তিনি ইনতিকাল করেন।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদা (রাঃ) হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর ইতিকালের পর রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) খুবই মর্মাহত অবস্থায় দিন কাটান। তাঁর কন্যারা ছিলেন ছোট। তাঁদের পরিচর্যা ও লালন-পালন তার জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সেহেতু সাওদা বিনত যামআ (রাঃ)-কে বিয়ে করেন। তাঁর মহর ছিল ৪০০ দিরহাম।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)। নবুওয়াতের দশম বর্ষে শাওয়াল মাসে নবী করীম (ছঃ)-এর সাথে তার বিয়ে হয়। তাঁর মহর ছিল চারশ’দিরহাম। মদীনায় হিজরতের পরে নবী করীম (ছঃ)-এর গৃহে আগমন করেন। তখন তার বয়স নয় বছরের কিছু বেশি তিনি ছিলেন নবী করীম (ছঃ)-এর জ্ঞানের ধারক ও বাহক। যে সাতজন সাহাবী সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। আজীবন তিনি হাদীসের শিক্ষাদানে রত থাকেন। তাঁর ঘরখানা একটি শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রাঃ)। নবুওয়তের পাঁচ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তৃতীয় হিজরীতে নবী করীম (ছঃ)-এর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন হযরত উমর (রাঃ)-এর কন্যা। তাঁরও মহর ছির ৪০০ দিরহাম।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযাইমা (রাঃ)। অত্যন্ত দানশীল হওয়ায় তার উপাধি হয় উম্মুল মাসাকীন (সম্বলহীনদের মাতা)। হিজরীর তৃতীয় বছর নবীজীর (ছঃ)-এর সাথে তার বিয়ে হয়। তার বিয়ের মহর ছিল ৫০০ দিরহাম।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা (রাঃ)। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বামী আবু সালামা (রাঃ) ইতিকাল করলে তিনি আল্লাহর নিকট তার চেয়েও উত্তম স্বামী কামনা করেন। আল্লাহ্ তাঁর দোয়া কবূল করেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে স্বামী হিসাবে লাভ করেন। চতুর্থ হিজরীর শাওয়াল মাসে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয় এবং নবী করীম (ছঃ) তাঁকে মহরানা হিসাবে দশ দিরহাম মূল্যের মাল দান করেন।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) আবদুল মুত্তালিবের কন্যা। পরমা সুন্দরী এ মহিলার প্রথম বিয়ে হয় নবীজী (ছঃ)-এর পালক পুত্র যায়িদ ইবন হারিসা (রাঃ)-এর সাথে। একজন মুক্তদাসের সাথে কুরাইশ বংশীয়া এ সম্ভ্রান্ত মহিলার বিবাহ দাম্পত্য জীবনে জটিলতার সৃষ্টি হয়। হযরত যায়িদ (রাঃ) ও যয়নবের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) তাকে বিয়ে করেন। তাঁর মহর ছিল ৪০০ দিরহাম।

উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে হাবীবা (রাঃ)। আবু সুফিয়ানের কন্যা, মূল নাম রামলা। স্বামী সহ তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে স্বামী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে মুর্তাদ হয়ে যায়। নবী করীম (ছঃ) আমর ইবন উমাইয়্যা আদ্ দামরী (রাঃ)-কে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাবশায় পাঠান এবং তাঁকে উকীল নিয়োগ করেন। হাবশারাজ নাজ্জাশী সকল মুসলমানকে একত্র করে বিয়ের খুৎবা দেন, চারশত দীনার মহর প্রদান করেন এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে ভোজের আয়োজন করেন। তিনি অতঃপর মদীনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর সাথে মিলিত হন। এ সময় তার বয়স ছিল ৩৭ বছর।

উম্মুল মু’মিনীন হুযরত জুওয়াইরিয়া (রাঃ) মুস্তালিক গোত্রের নেতা আল-হারিসের কন্যা। ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে এ গ্রোত্রের বিরুদ্ধে মহানবী (ছঃ) যে যুদ্ধাভিযান চালান তাতে তিনি গোত্রের অন্যান্যদের সাথে বন্দী হন। আযাদ করার পর নবীজী (ছঃ) তাঁকে বিয়ে করেন। তার মহর ৪০০ দিরহাম প্রদান করেন।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাফিয়্যা (রাঃ)। তিনি ছিলেন ইয়াহুদী বনী নাদীর গোত্রপতি হওয়াই ইব আখতারের কন্যা এবং হযরত হারুন (আঃ)-এর বংশধর। ষষ্ঠ হিজরীতে খায়বারের যুদ্ধে তার স্বামী নিহত হয় এবং তিনি মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তাঁকে মুক্তিদান করে নবী করীম (ছঃ) বিয়ে করেন এবং বন্দীত্ব মুক্তিই তাঁর মহর হিসাবে নির্ধারণ করা হয়। যুদ্ধশেষে পনির ও খেজুর সহকারে বিবাহভোজের আয়োজন করা হয়।-(বুখারী ও মুসলিম)।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মূনা (রাঃ)। সপ্তম হিজরীতে উমরাতুল ক্বাযা পালনকালে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-র মধ্যস্থতায় এবং ৫০০ দিরহাম মহর নির্ধারণ করে নবী করীম (ছঃ) তাঁকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) ও খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ (রাঃ)-র খালা। ঐতিহাসিক ইবন সা’দের মতে তিনিই ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর সর্বশেষ স্ত্রী। অতঃপর তিনি আর কাউকে বিয়ে করেননি।

এছাড়া মিসর রাজ কর্তৃক উপঢৌকন স্বরূপ প্রদত্ত মারিয়া কিবৃতিয়ার গর্ভে নবী করীম (ছঃ)-এর এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করেন। তাঁর নাম ছিল ইব্রাহীম। যিনি শিশু বয়সেই ইনতিকাল করেন।–(সীরাতুল মুস্তাফা)

.

হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর শাদী মুবারক

 হযরত ফাতিমা (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (ছঃ)-এর প্রিয় কন্যা কলিজার টুকরা। দ্বিতীয় হিজরীর যুলকাদায় হযরত আলী মুর্তাযা (রাঃ)-এর সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। মহানবী (ছঃ) বলেন, ফাতিমাকে আলীর সাথে বিয়ে দিতে আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। -(তাবারানীর আল-মু’জাম)

তখন ভয় বয়স ছিল পনের। বিয়ের মহর ছিল ৪৮০ (মতান্তরে ৫০০) দিরহাম। বদর যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) যে লৌহ বর্মটি পেয়েছিলেন তা বিক্রয় করে তার মূল্য নবী করীম (ছঃ)-এর নিকট দেন। তিনি পোশাক পরিচ্ছদ কেনার জন্য তা থেকে কিছু অর্থ হযরত আলী (রাঃ)-কে ফেরত দেন। মসজিদে নববীতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয় এবং উপস্থিত লোকদেরকে খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মহানবী (ছঃ) খুৎবা পড়ে বিয়ের আদ সম্পন্ন করেন। তিনি বিয়ের উপঢৌকন হিসাবে নবদম্পতিকে একটি খাট, দু’টি তোষক, একটি কম্বল, দু’টি ইয়ামনী চাদর, একটি বালিশ, পানির মশক, একটি কলস ও একটি যাতা দান করেন। হযরত ফাতিমা (রাঃ) উহুদ যুদ্ধের পর স্বামীগৃহে যান। তাদের দাম্পত্য জীবন পরিপূর্ণ সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয়।–(ইসলামী বিশ্ব কোষ)

.

ওলীমার আয়োজন

বিয়ে অনুষ্ঠানের পর আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে পানাহার করানো মুন্নাত। তবে বাহুল্য ব্যয় অবশ্যই বর্জনীয় এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তা করতে হবে। ধারকর্য করে  বিয়ের ভোজের আয়োজন করা অন্যায় এবং সূদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করে উক্ত অনুষ্ঠান করা নিষিদ্ধ। বিয়ের ভোজের আয়োজন করার জন্য কাউকে চাপ প্রয়োগ করা বা বাধ্য করা পাপের কাজ।

নবী করীম (ছঃ) নিজের বিয়ের ওলীমা অনুষ্ঠান করেছেন। তিনি হযরত যয়নব (রাঃ)-কে বিয়ে করে বীর গোশত ও রুটি দ্বারা মেহমানদের তৃপ্তি সহকারে আহার করান। হযরত সাফিয়া (রাঃ)-র বিয়েতে তিনি হায়্যন নামক এক প্রকার খাদ্য মেহমানদের সামনে পেশ করেন। তিনি হযরত উম্মে সালাম (রাঃ)-র বিয়েতে বার্লি দ্বারা ওলীমা অনুষ্ঠান করেন। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রাঃ)-কে বলেন, একটি বক্রী দিয়ে হলেও ওলীমার ব্যবস্থা কর।

ওলীমা অনুষ্ঠানে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলকে দাওয়াত দিতে হবে। কেবল বেছে ধনীদের দাওয়াত করা গর্হিত কাজ। আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলেন :

شر الطعام طعام الوليمة يدعى لها الأغنياء ويترك الفقراء

অর্থ : যে ওলীমায় কেবল ধনীদের দাওয়াত দেয়া হয় এবং গরীবদের উপেক্ষা করা হয় সেই ওলীমার খাদ্য সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট খাদ্য।-(মেশকাত শরীফ)

বিবাহ ভোজের দাওয়াত কবূল করা সুন্নাত। নবী করীম (ছঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দাওয়াত কবুল করা ত্যাগ করেছে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যাচরণ করেছে।–(মেশকাত শরীফ)

তবে দাওয়াত না পেয়েও ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদান করা অপরাধমূলক কাজ। মহানবী (ছঃ) বলেন :

من دخل على غير دعوة ل ارقا وخرج مغيرا

অর্থ : যে ব্যক্তি বিনা দাওয়াতে ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদান করে সে চোররূপে প্রবেশ করে এবং লুণ্ঠনকারীরূপে প্রত্যাবর্তন করে।–(আবূ দাউদ শরীফ)

দাওয়াতী বাড়িতে শরীয়াত বিরোধী কোন অনুষ্ঠান হতে দেখলে তা থেকে বিরত থাকতে বলা উচিত। উপদেশে কর্ণপাত না করা হলে তথায় অবস্থান করা উচিত নয়। নবী করীম (ছঃ) ফাসিক ব্যক্তির দাওয়াত কবূল করতে নিষেধ করেছেন।

.

বিয়ে-শাদীতে প্রচলিত কুপ্রথা

বিয়ের অনুষ্ঠানে উপদেশমূলক ও শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু সম্বলিত কবিতা, আবৃত্তি, গযল পরিবেশন ও আমোদ ফুর্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান কালে ইসলামী শরীয়াত সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ায় আনন্দ অনুষ্ঠানে নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা ও পাপানুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে। হিন্দুদের দেখাদেখি স্ত্রীকে মহরানা প্রদানের পরিবর্তে বরপক্ষ যৌতুকের নামে মোটা অঙ্কের টাকা ও জিনিসপত্র কণে পক্ষ থেকে আদায় করে। এটা শরীয়াতে জায়েয নয়। অনন্তর অর্থের অপচয় করে আঁকজমকপূর্ণ খানা-পিনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাইক বাজিয়ে অবৈধ ও অশালীন গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন, যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশার কারণে একটি সুন্নাত কাজ পাপানুষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। স্থানভেদে বিয়ে উপলক্ষে আরও নানারূপ কুসংস্কার দেখা যায়। এসব কুসংস্কার অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

.

প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের অমতে বিবাহ দেয়া

হাদীস–১৮ঃ হযরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, একটি কুমারী যুবতী আল্লাহর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাযির হয়ে অভিযোগ করল যে, আমার পিতা আমাকে জোরপূর্বক এক ছেলের সাথে বিবাহ দিয়েছে, সে ছেলে আমার মনঃপুত নয়। তার এ কথা শুনে আল্লাহর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তুমি ইচ্ছে করলে বিবাহ বহাল রাখতে পার আবার ভেঙ্গেও দিতে পার। (আবূ দাউদ)

এই হাদীস দ্বারা বোঝা গেল যে, প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েকে তার অমতে জোরপূর্বক বিবাহ দেয়া জায়েজ নয়।

.

সন্তানের প্রতি পিতার দায়িত্ব

হাদীস-১৯ : আবু সাঈদ ও ইবনে আব্বাছ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে পিতার ওপর তিনটি দায়িত্ব অর্পিত হয় : (১) সন্তানের ভাল নাম রাখা, (২) সন্তানকে সুশিক্ষা দান করা ও (৩) বালেগ হওয়ার পর বিবাহ দেয়া। নতুবা সে কোন গুনাহ্র কাজে লিপ্ত হলে পিতা তার জন্য দায়ী থাকবে। (বায়হাকী)

সুতরাং মাতা-পিতার উচিত, বালেগ হওয়ার সাথে সাথে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেয়া। অনর্থক বিলম্ব একদিকে যেমন শরীয়তের বিধান লংঘিত হয়, অপরদিকে চরিত্রহীন হওয়ারও ভয় থাকে।

.

যুবতী কন্যার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

হাদীস-২০ঃ হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ও আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত–আল্লাহর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তাওরাত কিতাবে আছে যে, মেয়ের বয়স বার বছর হওয়া সত্ত্বেও যদি তার মাতা-পিতা তাকে বিবাহ না দেয়; তবে সে কোন গুনাহে লিপ্ত হলে মাতা-পিতাই তার জন্য দায়ী থাকবে। (বায়হাকী)

ভেবে দেখা দরকার যে, পিতা-মাতার জন্য কত বড় দায়িত্ব। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে কোন পরোয়াই করি না। অথচ দৈনন্দিন বিভিন্ন ঘটনাই প্রমাণ করে যে, বিবাহের উপযুক্ত মেয়েদেরকে বিবাহ না দেয়া কত মারাত্মক ক্ষতিকর। বহু মেয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে চরিত্র হারিয়ে জারজ সন্তান জন্ম দেয় কিংবা পরপুরুষের সাথে পালিয়ে যায়। এ সবই আমাদের অনুভূতিহীনতা ও শরীয়তের বিধান লংঘনের অশুভ পরিণতি। বালেগ হওয়ার পর মেয়েদেরকে ঘরে বসিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। যৌতুক দিতে না পারলে পেরেশানীর কোন কারণও নেই। কেননা, যৌতুক কোন জরুরী ব্যাপার নয়। খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) কি দিয়েছেন? আমাদের মেয়েরা কি খাতুনে জান্নাত ফাতেমা (রাঃ) থেকেও বেশী মর্যাদাবান? সুতরাং দ্বীনদার ও চরিত্রবান ছেলে দেখে যথা শীগ্র এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া উচিত।

.

স্বামীর-স্ত্রীর অধিকার

মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং তাদের একজনের উপর অন্য জনের রয়েছে বিশেষ অধিকার।

এ সম্পর্কে নবী করীম (ছঃ) বলেন, তোমরা জেনে রেখ, তোমাদের যেমন–তোমাদের স্ত্রীদের উপর অধিকার আছে। আর তেমনি তোমাদের স্ত্রীদেরও অধিকার আছে তোমাদের উপর। তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যে অধিকার আছে তা হলো, তোমরা যাদের অপসন্দ কর তারা তোমাদের শয্যা মাড়াবে না। অনুরূপভাবে তোমরা যাদের অপসন্দ কর না তাদেরকে তোমাদের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না। আর জেনে রেখ, তোমাদের উপর তাদের অধিকার হল, তাদের খাওয়া ও পরার ব্যাপারে তাদের প্রতি তোমরা মহানুভবতা ও অনুগ্রহমূলক আচরণ করবে।

নবী করীম (ছঃ) এ পর্যায়ে আরো বলেছেন, তোমরা স্ত্রীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। -(বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ)

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

ولهن مثل الذي عليهن بالمعروف وللرجال عليهن درجة

অর্থ : নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। কিন্তু নারীদের উপর পুরুষের মর্যাদা আছে।–(সূরা বাকারা : ২২৮)

.

স্বামীর অধিকার

 নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, আমি যদি কাউকে সিজদা করার আদেশ দিতাম, তবে স্ত্রীদের তাদের স্বামীকে সিজদা করতে বলতাম। কেননা, আল্লাহ্ তাদের উপর স্বামীদের অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছেন।-(তিরমিযী)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি আরয করল, কোন্ মহিলা উত্তম? তিনি বললেন, সেই নারী যার প্রতি স্বামী নয়র করলে সে খুশী করে দেয়, যে স্বামীর কথামত চলে, নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ করে না এবং স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সম্পদ খরচ করে না।-(মেশকাত)

হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, কোন মহিলা যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযানের রোযা রাখে এবং নিজের সতীত্ব রক্ষা করে ও স্বামীর কথা মান্য করে, তবে সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।-(মেশকাত)

রাসূলে করীম (ছঃ) বলেছেন, স্বামী যখন তার স্ত্রীকে সহবাসের জন্য ডাকে, তখন তার ডাকে সাড়া দেয়া উচিত, যদিও সে চুলায় কাজ করতে থাকে।-(মেশকাত)

এ কথা অনস্বীকার্য যে, আল্লাহ্ প্রদত্ত সহজাত যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার কারণে স্ত্রীদের তুলনায় পুরুষদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়, আবার স্ত্রীরাও অনেক সময় সম্পূর্ণ অকেজো ও স্থবির হয়ে পড়ে, আর তখন সে অপরের সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব, স্তন্যদান, শিশু লালন-পালন প্রভৃতি বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়।

শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী (রঃ) স্ত্রীদের উপর স্বামীর প্রাধান্য সম্পর্কে লিখেছেন, স্বামীকে তার স্ত্রীর উপর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করা একান্ত আবশ্যক। আর স্ত্রীর উপর এ প্রাধান্য স্বভাব সম্মতও বটে। কেননা, নারীদের তুলনায় পুরুষ জ্ঞান বুদ্ধিতে অধিক সুদক্ষ, এবং প্রতিরোধের কাজে সুদৃঢ়। বাসস্থানের ব্যবস্থা করে বলে স্ত্রীর উপর পুরুষের এ নেতৃত্বও প্রাধান্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।–(হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা ২য় খণ্ড)

আল্লামা বায়যাবী (রঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা পুরুষদেরকে স্ত্রীদের তুলনায় দু’টো কারণে প্রাধান্য ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। একটি আল্লাহর দান, অপরটি অর্জিত। আল্লাহর দান হল, আল্লাহ্ স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন, বিপুল কর্মশক্তি প্রভৃতি গুণাবলী পুরুষদেরকে দান করেছেন। এজন্যে সামাজিক নেতৃত্ব, শাসন ক্ষমতা, জিহাদ, বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্ব কেবল পুরুষের উপরই অর্পিত হয়েছে। আর অর্জিত কারণটি হল, মহরানা দান, ভরণ-পোষণ ও পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় দায়িত্ব পুরুষকেই পালন করতে হয়। তবে স্বামী যদি শরীয়াত বিরোধী কোন কাজের আদেশ করে, তবে তা পালনে স্ত্রী বাধ্য নয়।

.

স্ত্রীর অধিকার

স্ত্রীর উপর স্বামীর যেমন অধিকার স্বীক্বত তেমনি স্বামীর উপরও স্ত্রীর অধিকার স্বীক্বত। হযরত মু’আবিয়া কুশাইরী (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের উপর আমাদের স্ত্রীদের কি অধিকার রয়েছে :জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, তুমি যখন খাবে তখন তাকেও খেতে দেবে। তুমি যখন পরবে তখন তাকেও পরতে দেবে। আর মুখের উপর প্রহার করবে না। তাকে অশ্লীল কথা বলবে না এবং ঘরের ভেতরে তার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করবে না। -(আবূ দাউদ, ইবনে মাজা, মুসনতে আহমদ)

স্ত্রীর অন্ন ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করা স্বামীর দায়িত্ব। এই পর্যায়ে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছেঃ

وعلى المولوي كه رزقهن وشوهن بالمعروف

অর্থ : জনকের কর্তব্য যথাবিধি তাদের ভরণ-পোষণ করা।–(সূরা বাকারা : ২৩৩)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

على الموسع قدره و على المقتر قدره متاعا بالمعروف

অর্থ : বিত্তবান তার সাধ্যমত এবং বিত্তহীন তার সামর্থানুসারে বিধিমত খরচপত্রের ব্যবস্থা করবে।–(সূরা বাকারা : ২৩৬)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

ن عينه ومن قدر عليه رزقة فلينفق مما أته

بمعة ما

ع

يثوق دو

অর্থ : বিত্তবান নিজ সামর্থ্যানুসারে ব্যয় করবে এবং যার জীবন উপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা হতে ব্যয় করবে।–(সূরা তালাক : ৭)

স্ত্রী থেকে স্বামী আনুগত্য না পেলে তাকে আল্লাহর বিধানের কথা বুঝাবে। যদি সে এতেও অগ্রসর না হয়, তবে রাতে শয্যা গ্রহণে তার সাথে সম্পর্কে ছিন্ন কর পদ্ধতি অবলম্বন করবে। তাতেও ঠিক না হলে তাকে হাল্কা প্রহার করবে। তবে মুখের উপর প্রহার করবে না।

ফিকহবিদরা বলেছেন, চারটি কারণে স্ত্রীকে প্রহার করার অধিকার স্বামীর আছে, ১. স্ত্রীর সাজসজ্জা পরিহার করা অথচ স্বামী তা চায়। ২. সহবাসে আহবান করার পর বিনা কারণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। ৩. নামায আদায় না করা। ৪. স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে যাতায়াত করা। ইমাম মুহাম্মদ (রঃ) বলেন, নামায তরক করলে কিংবা হায়েযের গোসল না করলে স্ত্রীকে স্বামীর প্রহারের অধিকার নেই।

আর স্ত্রীকে অশালীন ভাষায় গালমন্দ করবে না। এ ধরনের গালমন্দ পারিবারিক জীবনের মাধূর্যকে বিনষ্ট করে। কাজেই এ ধরনের গালমন্দ ইসলাম পসন্দ করে না।-(মাআলিমুস্ সুন্নাহ)

.

স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

বিবাহের মাধ্যমে ইসলাম স্বামীকে স্ত্রীর অভিভাবক ও পরিচালক বানিয়ে দেয়। সুতরাং অভিভাবক, পরিচালক ও কর্তা হিসেবে স্ত্রীর উপর স্বামীর যেমন মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতা রয়েছে তেমনি স্ত্রীর প্রতি রয়েছে তার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। যথা :

১. মহরঃ স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সন্তুষ্টির সাথে মহর পরিশোধ করে দেয়া। মহর বিয়ের অন্যতম শর্ত। বিনামহর বিয়ে হয় না। ইসলাম মহর পরিশোধ করাকে স্বামীর উপর ফরয করে দিয়েছে।

২. ভরণ-পোষণঃ স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ।

এরশাদ হচ্ছেঃ

الجال قومون على النساء بما قل الله بعضهم على بعض

وبما أنفقوا من أموالهم

অর্থ : পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাদের একজনকে অপরজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষ তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে।–(সূরা নিসা : ৩৪)।

৩. সদ্ব্যবহারঃ স্বামীর অপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। বস্তুত সদ্ব্যবহার পাওয়া স্বামীর উপর স্ত্রীর একটি বিশেষ অধিকার বটে। কেননা, বৈবাহিক সম্পর্কটাই হচ্ছে, প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার সম্পর্ক। স্বামী স্ত্রীকে আন্তরিকভাবে ভালাসবে, চমৎকার সান্নিধ্যে স্ত্রীকে করে তুলবে একান্ত আপন।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছেঃ

وعاشروهن بالمعروف

অর্থ : তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে।–(সূরা নিসা : ১৯)

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম।-(তিরমিযী)।

৪. স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠাঃ যদি কোন মু’মিন ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী থাকে তবে তাদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক আচরণ করা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

قد تميلوا محل الميل فتذروها كالمعلقة

তবে তোমরা(তোমাদের স্ত্রীদের) কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না ও অপরকে ঝুলিয়ে রেখো না।–(সূরা নিসা : ১২৯)

যদি ইনসাফ কায়েম করা সম্ভব না হয়, তবে কেবলমাত্র একজন স্ত্রী গ্রহন করার অনুমতি রয়েছে।

ইমাম ইবন কুদামা আল-মাকদিসী (রঃ) মিনহাজুল কাসেদীন’ গ্রন্থে কুরআন ও হাদীসের আলোকে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নিম্নোক্ত কর্তব্য সমূহের কথা উল্লেখ করেছেন।

১. স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করা। তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা।

২. স্ত্রীর সাথে সহাস্য ও খোলামেলা আচরণ করা।

 ৩. লজ্জাশীলতার প্রতি লক্ষ্য রাখা।

৪. সন্দেহজনক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা।

 ৫. ভরণ-পোষণের ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা।

৬. স্ত্রীকে দীনী শিক্ষা দেয়া।

৭. একাধিক স্ত্রী হলে তাদের সাথে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক আচরণ করা।

৮. স্ত্রীর মধ্যে অবাধ্যতা দেখা দিলে তাকে উপদেশ দান করা। এতে সংশোধন না হলে হাল্কা প্রহার করা, তবে মুখমণ্ডলে নয়।-(ইসলামে পারিবারিক বিধান)

.

স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যেরূপ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তদ্রূপ স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা যেহেতু স্বামীকে স্ত্রীর উপর মর্যাদাবান করেছেন, ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সর্বোপরি স্ত্রীর উপর তাকে পরিচালক নিযুক্ত করেছেন, সেজন্য স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বহুবিধ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

তার অন্যতম দায়িত্ব হলো স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার হক রক্ষা করা। এর দুটি দিক। একটি, সে নিজেকে সর্ববিধ অশ্লীলতা ও অপকর্ম থেকে রক্ষা করবে। দ্বিতীয়টি হল, স্বামীর অর্থ-সম্পদের আমানত হেফাজত করা।

স্বামীর খিদমত করা স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য কাজ। স্বামীর সন্তুষ্টি বিধান স্ত্রীর দায়িত্ব। স্ত্রীর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব যেভাবে পুরুষের উপর ন্যস্ত করে দেয়া হয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রীর উপর স্বামীর খিদমত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

মহিলা ছাহাবীরা পরম আনন্দে ও ধৈৰ্য্য সহকারে স্বামীদের সেবা করতেন এবং নিজ হাতে ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন। হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) বলেন, আমি আমার স্বামী যুবায়রের খিদমত করতাম। হযরত ফাতিমা (রাঃ) নিজ হাতে যাঁতা চালিয়ে গম পিষতেন। ইসলাম মূলত স্ত্রীকে স্বামীর ঘরের পরিচালিকা ও দায়িত্বশীলা বানিয়েছে। কাজেই স্বামীর খিদমত এবং ঘরের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা স্ত্রীর জন্য বাঞ্ছনীয়।

স্ত্রীর অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে, স্বামীর যৌন দাবি পূরণ করা। একমাত্র শরয়ী ওযর ছাড়া স্বামীর আহবান প্রত্যাখ্যান করা স্ত্রীর জন্য জায়েয নয়। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, স্বামী যখন স্ত্রীকে শয্যাগ্রহণের আহবান করে তখন সে যদি স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয়, তবে সকাল হওয়া পর্যন্ত ফিরিশতারা তার প্রতি অভিশম্পাত করতে থাকে। নবী করীম (ছঃ) আরো বলেছেন, স্বামী যখন (যৌন) প্রয়োজনে স্ত্রীকে ডাকবে, তখন সে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও সাথে সাথে স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়া উচিত।

.

একাধিক বিয়ের প্রয়োজনীয়তা ও শর্তাবলী

ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক জীবনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, নর-নারীর নৈতিক পবিত্রতা সংরক্ষণ। আর এ জন্যে যেমন বিয়ে করার আদেশ করা হয়েছে, তেমনি পুরুষের জন্যে এ অনুমতি দেয়া হয়েছে যে, বিশেষ কোন ওযরে যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তবে সে তা করতে পারে। তবে তার শেষ সীমা হচ্ছে চারজন পর্যন্ত। একত্রে চারজনের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে

فايروا ما طاب لكم من النيساء مثنى وثلث وربع

তবে তোমরা বিয়ে করবে নারীদের মধ্য যাকে তোমাদের ভাল লাগে, দু’, তিন অথবা চারজন। (সূরা নিসা : ৩)।

কখনও কখনও এমন বহু ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে, যার কারণে এক একজন পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে হয়। বস্তুত এক স্ত্রীই যে উত্তম তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ জন্য বুদ্ধিমান বিবাহিত লোকেরা অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া একাধিক বিয়ের কথা চিন্তাই করে না। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী বহু বিবাহের যৌক্তিকতা বিচার করা যেতে পারে।

.

বহু বিয়ের যৌক্তিকতা

 ১. কোন কারণে মানব সমাজে যদি নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অধিক হয়ে যায়, যেমন উত্তর ইউরোপে বর্তমানে রয়েছে। ফিনল্যাণ্ডের জনৈক চিকিৎসক বলেছেন, সেখানে প্রত্যেক চারটি সন্তানের মধ্যে একটি হয় পুরুষ আর বাকী তিনটি হয় নারী। এরূপ অবস্থায় একাধিক স্ত্রী গ্রহণ এক নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য হয়ে পড়ে। কেননা, এক স্ত্রী গ্রহণের রীতিতে সেখানে বহু মেয়ে অবিবাহিত থেকে যাবে, যাদের কোন দিন বিয়ে হবে না। তাদের কোন আশ্রয় স্থল বা কোন বৈধ সন্তান থাকবে না। তারা আগাছা-পরগাছার ন্যায় লাঞ্ছিত জীবন যাপন করবে। তাদের এ রকমের উপেক্ষিতা জীবনের চেয়ে একজন নির্দিষ্ট স্বামীর অধীন অপর নারীর সাথে একত্রে ও সমান মর্যাদায় জীবন যাপন কি অধিকতর কল্যাণকর নয়? -(পরিবার ও পারিবারিক জীবন)

মনীষী টমাস বলেন, প্রত্যেক সামর্থ্যবান পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতি দিতে হবে। এর ফলেই বিপদ কেটে যাবে এবং আমাদের মেয়েরা ঘর পাবে, স্বামী পাবে। -(প্রাগুক্ত)

 ২. সর্বধ্বংসী যুদ্ধের ফলে কোন দেশে যদি পুরুষের সংখ্যা কমে যায় আর নারীরা থেকে যায় অনেক বেশি, তখনও যদি সমাজের পুরুষদের পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি না, থাকে, তাহলে বেশির ভাগ মেয়ের ভাগ্যে কখনও স্বামী জুটবে না। ইউরোপে বিগত দু’টো বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ যুবক হারিয়েছে, এ কারণে যুবতী মেয়েদের মধ্যে খুব কমই বিবাহিতা হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ফলে এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে যে, হয় বিবাহিত পুরুষেরা আরও এক, দুই, তিন জন করে স্ত্রী গ্রহন করবে, নয় বিবাহিত যুবকরা নিজেদের স্ত্রীদের অগোচরে স্বামীহীনা মেয়েদের যৌন পরিতৃপ্তি দানের জন্য প্রস্তুত হবে।–(সুবুলুস সালাম)

৩. মানব প্রক্বতিতে বহু স্ত্রী গ্রহণের প্রবণতা অনেক বেশি এবং তীব্র। তবে কেউ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে অথবা কারো যদি দু’, তিন কিংবা চারজন স্ত্রী থাকলে স্ত্রীদের যা কিছু অধিকার, স্বামী তার সবকিছুই পূর্ণ সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা ও পূর্ণ সমতা সহকারে যথারীতি আদায় করবে। পোশাক পরিচ্ছদ, বাসস্থান, খাদ্য, সঙ্গদান ইত্যাদি সব বিষয়ে ও সকল ক্ষেত্রেই সমতা রক্ষা করে সকল স্ত্রীর অধিকার আদায় করা স্বামীর জন্য কর্তব্য। যে আয়াতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সে আয়াতেই উল্লেখ রয়েছে :

وإن خفتم ألا تقسطوا في اليثمي فانكحوا ما طاب لكم من النساء

مثنى وثلث وربع فإن خفتم الا تعينوا فواحدة

অর্থ : তোমারা যদি এমন আশংকা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে, তবে তোমরা বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাকে ভাল লাগে, দু, তিন অথবা চার; আর যদি আশংকা কর যে, সুবিচার করতে সক্ষম হবে না, তবে একজনকে।–(সূরা নিসা, ৪ : ৩)

সুবিচারপূর্ণ বন্টনের পর্যায়ে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সংখ্যা ও পরিমাণ ইত্যাদির দিক দিয়ে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করার কথা এখানে বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, প্রত্যেক স্ত্রীর অধিকার সাম্য ও প্রয়োজনানুপাতে দরকারী জিনিস পরিবেশনের কথা। কেননা, একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সকলের প্রয়োজন, রুচি ও পসন্দ যে একই ধরনের হবে এমন কোন কথা নেই। কেউ হয়ত রুটি খায়, তার প্রয়োজন রুটির। আর কেউ ভাত খায়, তার প্রয়োজন ভাতের। কেউ যদি মোটাসোটা হয়, তার জামা ও পরিধেয় বস্ত্রের জন্যে বেশি কাপড় দরকার। আর কেউ হালকা-পাতলা গড়নের হলে তার প্রয়োজনীয় কাপড়ের পরিমাণ অপেক্ষাক্বত কম। কাজেই আদল’ সুবিচার ও সমতার অর্থ হল, সকলের প্রতি সমান খেয়াল রাখা, যত্ন নেওয়া এবং প্রত্যেকের দাবী যথাযথভাবে পূরণ করা। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের উল্লিখিত শর্ত পূরণ করতে পারবে না বলে যদি কারো আশংকা হয়, তবে তার উচিত আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী একজনমাত্র স্ত্রী গ্রহণ করা। পবিত্র কোরআনে এ কথাই বলা হয়েছে :

فإن خفتم ألا تعدلوا فواحدة

অর্থ : আর যদি আশংকা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে। –(সূরা নিসা, ৪ : ৩)

 স্ত্রী যদি এমন কোন দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক বা স্বাভাবিক ঘৃণার উদ্রেককারী রোগে আক্রান্ত হয়, যার দরুন স্বামীর পক্ষে তার সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব নয়, এ ক্ষেত্রে স্বামীর সামনে দুটো বিকল্প থাকে, হয় সে তার স্ত্রীকে তালাক দেবে। এতে না থাকে কোন সৌজন্যবোধ ও মানবিকতা, আর না থাকে এতো দিনের প্রেম-ভালবাসার কোন মূল্য। বরঞ্চ একজন রুগ্না নারীকে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেয়া হয় অমানবিকভাবে। দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো, সে আরেকটি বিয়ে করে পূর্বতন স্ত্রীর স্বামী ও অভিভাবক হিসেবে বহাল থাকতে পারে। সে তাকে স্ত্রীর অধিকারও দেবে এবং চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যয়ভারও বহন করবে। রুগ্না স্ত্রী ও তার স্বামী উভয়ের জন্যই যে এই শেষোক্ত বিকল্পটিই অধিক সম্মানজনক, মহানুভবতার পরিচায়ক ও সুখশান্তির নিশ্চয়তা বিধায়ক, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

স্ত্রী যদি এত বেশি বিরাগভাজন হয় যে, তালাকের পূর্বে দু’ পক্ষের সালিশদের সমঝোতা প্রচেষ্টা, প্রথম তালাক, দ্বিতীয় তালাক এমনকি ইদ্দতের বিরতিও সেই বিরাগ নিরসনে সফল না হয়, তখনও স্বামীর সামনে দুটি মাত্র বিকল্প অবশিষ্ট থাকে। প্রথমত, স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য কোন নারীকে বিয়ে করা, দ্বিতীয়, সকল আইনানুগ অধিকার সহ তাকে স্ত্রী হিসেবে বহাল রাখা এবং দ্বিতীয় বিয়ে করা। এখানেও দ্বিতীয় বিকল্পটিই প্রথম স্ত্রীর জন্য অধিকতর সম্মানজনক, স্ত্রীর প্রতি নৈতিক মহানুভবতার প্রতীক এবং বিশেষত একাধিক সন্তানের জননীর কল্যাণের জন্য অধিকতর নিরাপত্তা দানকারী, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। কাজেই শর্তসাপেক্ষে ও প্রয়োজনে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা যায়।

.

তালাক

তালাক (5) শব্দের আভিধানিক অর্থ বাঁধন খুলে দেয়া, ত্যাগ করা, বিচ্ছিন্ন করা। শরীয়াতের পরিভাষায়, তালাক মানে বিয়ের বন্ধন খুলে দেয়া। স্বামী কর্তৃক সরাসরি অথবা প্রতিনিধির দ্বারা নির্দিষ্ট বাক্যে অথবা ইঙ্গিতে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করাকে তালাক বলে।

ইমামুল হারামাইন (রঃ) বলেছেন, তালাক শব্দটি ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগে ব্যবহৃত পরিভাষা। ইসলামও এক্ষেত্রে এ শব্দটিই ব্যবহার করেছে।

.

তালাকের উদ্দেশ্য

ইসলামে তালাকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তারা পরস্পর মিলেমিশে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সহকারে জীবন যাপন করার কোন সম্ভাবনাই দেখতে পায় না, এমন কি এরূপ অবস্থার সংশোধন বা পরিবর্তনের শেষ আশা ও বিলীন হয়ে যায়, যার ফলে বিয়ের উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন উভয়ের ভবিষ্যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও তিক্ততা-বিরক্তির বিষাক্ত পরিণতি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে উভয়ের মধ্যে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক অপসন্দনীয় কাজ। এ কাজকে কোন দিক দিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহিত করা হয়নি। বরং এ হচ্ছে নিরূপায়ের উপায়। দাম্পত্য জীবনে মিলেমিশে থাকার সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন এ ব্যবস্থার সাহায্যে উভয়ের স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগত সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য। তালাক যে ইসলামে কোন পসন্দনীয় কাজ নয়, এ কথা হাদীসের স্পষ্ট ঘোষণা থেকেই প্রমাণিত। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা তালাকের চেয়ে অধিক ঘৃণ্য কোন জিনিস হালাল করেননি।-(আবূ দাউদ)

অন্য হাদীসে আছে, আল্লাহর কাছে যতগুলো হালাল কাজ আছে তন্মধ্যে সর্বাধিক অপসন্দনীয় কাজ হচ্ছে তালাক।-(প্রাগুক্ত)

হযরত আলী (রাঃ) বর্ণিত নবী করীম (ছঃ)-এর নিমোক্ত বাণী থেকে তালাক যে অপসন্দনীয় কাজ তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা, তালাক দিলে তার দরুন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।-(তাফসীরে কুরতুবী)

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) আরও বলেছেন, তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা আল্লাহ পাক সে সব স্বামী-স্ত্রীকে পসন্দ করেন না, যারা নিত্য নতুন বিয়ে করে স্বাদ গ্রহন করতে অভ্যস্ত।–(আহ্কামুল কোরআন)

.

তালাকের প্রকারভেদ

 পদ্ধতিগত দিক থেকে তালাক দু’ প্রকার–১. সুন্নাত তালাক ও ২. বিদঈ তালাক। ফলাফলের দিক থেকেও তালাক দু’ প্রকার–১. রাজঈ তালাক ও ২. বাইন তালাক।

সুন্নাত তালাক আবার দু’ প্রকার–১. আহসান তালাক ও ২. হাসান তালাক। বাইন তালাকও দু’ প্রকার–১. বাইন তালাক সুরা ও ২. বাইন তালাক কুবরা বা মুগাল্লাযা তালাক।

উপরে বর্নিত বিভিন্ন প্রকার তালাকের বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।

সুন্নাত তালাক : নবী করীম (ছঃ) ঠিক যে সময় এবং যে পদ্ধতিতে তালাক দেয়ার শিক্ষা দিয়েছেন তদানুরূপ তালাককে সুন্নাত তালাক বলে। তবে সুন্নাত তালাকের অর্থ এ নয় যে, এ ধরনের তালাক দানে ছাওয়াব রয়েছে। কারণ তালাক কোন এবাদতের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং এর অর্থ নবী করীম (ছঃ) ও তাঁর ছাহাবারা সুন্নাত নিয়মে তালাক দেয়া পসন্দ করেছেন। এর বিপরীত পন্থায় তালাক দিলে গুনাহ্ হবে।

বিদঈ তালাকঃ স্বামী তার স্ত্রীকে একই তুহরে এক বা একাধিক শব্দের একাধিক তালাক দিলে অথবা সহবাসকৃত তুহরে এক তালাক দিলে তাকে বিদঈ তালাক বলে। -(মু’জামুল লুগাতিল ফুকাহ)

অনুরূপভাবে, যে তুহরে মিলন হয়েছে সে তুহরে একসাথে দু’ বা তিন তালাক দিলে তাও বিদঈ তালাকের অন্তর্ভুক্ত হবে, তা একবাক্যে দেয়া হোক কি পৃথক পৃথক বাক্যে। -(বাদায়িউস্ সানায়ি)

 রাজঈ তালাক : তালাক শব্দ উচ্চারণ পূর্বক স্বামী স্ত্রীকে এক বা দু’ তালাক দিলে এবং তার সঙ্গে বাইন শব্দ যোগ না করলে তাকে রাজঈ তালাক বলে। উল্লেখ্য, স্ত্রীকে ইদ্দতের ভেতরে ফিরিয়ে না নিলে ইদ্দত শেষে তা বাইন তালাক পরিণত হয়।

বাইন তালাকঃ তালাক শব্দের সাথে বাইন শব্দ যোগ করে স্ত্রীকে এক বা দু’ তালাক দিলে তাকে বাইন তালাক বলে। এ ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং সহবাসও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ইদ্দত চলাকালে বা ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর পররস্পরিক সম্মতিতে তাহলীল ব্যতীত সম্পূর্ণ নতুনভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যায়।

আহসান তালাক : যে তুহরে মিলন হয়নি এবং এর পূর্ববর্তী তুহরেও তালাক দেয়া হয়নি সেই অবস্থায় স্ত্রীকে একটি রাজঈ তালাক প্রদানের পর ইদ্দত পূর্ণ হতে অথবা গর্ভ খালাস হতে দিলে তাকে আহসান তালাক বলে।

হাসান তালাক : সহবাস বর্জিত তুহরে স্ত্রীকে একটি রাজঈ তালাক দেয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তুহরে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তালাক প্রদানকে হাসান তালাক বলে।–(ঐ)

নিম্নোল্লিখিত দলীলের ভিত্তিতে এটি সুন্নাত তালাকের অন্তর্ভূক্ত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

فطلقوهن لعدتهن

অর্থ : তাদেরকে তালাক দিও ইদ্দাতের প্রতি লক্ষ্য রেখে।–(সূরা তাহরীম, আ : ১)।

নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, সুন্নাত তালাক হল, তুমি তুহরকে সামনে রেখে প্রতি তুহরে একটি করে তালাক দাও।-(বায়হাক)।

বাইন তালাক সুগরাঃ তালাক শব্দের সাথে বাইন শব্দ যোগ করে স্ত্রীকে এক অথবা দু’ তালাক প্রদান করলে তাকে বাইন তালাক সুরা বলে।

বাইন তালাক কুবরা (মুগাল্লাযা তালাক)ঃ একই সময়ে অথবা বিভিন্ন সময়ে এক বা একাধিক শব্দে স্ত্রীকে তিন তালাক প্রদান করলে তাকে বাইন তালাক কুরা বা মুগাল্লা তালাক বলে। অর্থাৎ তিন তালাক দেয়ার ফলে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ রূপে ছিন্ন হয়ে যায়। তদ্রুপ, উভয়ের একসঙ্গে বসবাস করাও হারাম হয়ে যায়। ইদ্দত শেষ হওয়ার পরও স্বামী তাকে স্ত্রী হিসেবে ফিরিয়ে নিতে পারে না এবং উভয়ে নতুনভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তবে তালাকপ্রাপ্তা মহিলার যদি অন্য কারও সাথে বিবাহ হয় এবং কোন কারণে আবার বিচ্ছেদ ঘটে অথবা শেষোক্ত স্বামী মারা যায়, তবে উভয়ে পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে এই শর্তে যে, তারা উভয়ে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে

له من بعد حتی تنکح زوجا غيره فان

فان طلقها قلات

ا ان يقيما حدود الله

طلقها فلا جناح عليهما أن يتراجعا آن

অর্থ : অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে সে তার জন্য বৈধ হবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য কোন স্বামীর সাথে সঙ্গত না হবে। অতঃপর সে যদি তাকে তালাক দেয় এবং তারা উভয়ে মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমা রক্ষা করতে পারবে, তবে তাদের পুনর্মিলনে কারও কোন অপরাধ হবে না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা।–(সূরা বাকারা, ২ঃ ২৩০)

.

ইদ্দত

তালাক অথবা মৃত্যুজনিত কারণে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর যে সময়সীমার মধ্যে কোন নারী পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না, তাকে ইদ্দত বলে।

যে সব ক্ষেত্রে ইদ্দত পালন বাধ্যতামূলক?

ক. সহীহ্ বিবাহের ক্ষেত্রে সঙ্গত অথবা নির্জনে মিলনের পর বিবাহ বিচ্ছেদ হলে।

 খ. ফাসিদ বিবাহের ক্ষেত্রে সঙ্গত বা নির্জনে মিলনের পর বিবাহ বিচ্ছেদ হলে।

 গ. সহীহ্ অথবা ফাসিদ বিবাহের পর স্বামী মারা গেলে।

তবে শর্ত হচ্ছে, নির্জনে মিলন বা সঙ্গতের পূর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ইদ্দত পালন করতে হবে না।

.

ইদ্দতের সময়সীমা

১. প্রাপ্ত বয়স্কা নারী যার নিয়মিত হায়েয হয় তার ইদ্দত কাল তিন হায়েয। হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া হলে ইদ্দত কাল হবে তার পরের তিনটি পূর্ণ হায়েয।

২. অল্প বয়স, বার্ধক্য, রোগ-ব্যধি বা অন্য কোন কারণে কোন নারীর যদি হায়েয বন্ধ থাকে, তবে তার ইদ্দত হবে পূর্ণ তিন মাস।

৩. কোন স্ত্রীর স্বামী মারা গেলে তার ইদ্দত কাল হবে চার মাস দশ দিন।

৪. কোন স্ত্রীকে রাজঈ তালাক দেওয়ার পর তার ইদ্দত কাল চলাকালে স্বামী যদি মারা যায়, তবে স্বামীর মৃত্যুর তারিখ থেকে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে।

৫. গর্ভবতী স্ত্রীর ইদ্দত কাল গর্ভ খালাস হওয়া পর্যন্ত এবং বিবাহ বিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর অন্তঃসত্ত্বা প্রকাশ পেলে তার ইদ্দত কাল হবে গর্ভ খালাস হওয়া পর্যন্ত।

.

খুলা

খুলা (5) শব্দের আভিধানিক অর্থ খুলে ফেলা, ছিন্ন করা। শরীয়াতের পরিভাষায়, স্ত্রীর দ্বারা প্রদত্ত সম্পদের বিনিময়ে সমঝোতার ভিত্তিতে স্বামী খুলা বা অনুরূপ অর্থবোধক শব্দের প্রয়োগে স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করলে তাকে খুলা বলে।

আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন।

فإن خفتم ألا يقيما حدود الله فلا جناح عليها فيما اشتدت په

অর্থ : যদি তোমরা আশংকা কর যে, তারা আল্লাহর সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না। তবে যদি স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে মুক্তি পেতে চায় তবে তাতে তাদের কারও কোন অপরাধ নেই।–(সূরা বাকারা : ২২৯)

এ আয়াত থেকে খুলা তালাক প্রমাণিত হয় এবং এ প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে তালাক গ্রহণ করে এবং স্বামী যদি সে অর্থ গ্রহণ করে, তবে তাতে কোন দোষ হবে না।

ইমাম আবূ বকর আহমাদ আল-জাস্সাস (রঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা খুলা তালাক সম্পর্কে এরশাদ করেন :

وان اردتم استبدال زوج مكان زوج و أتيتم إحداهن قنطارا قلا

تاوا منه شيئا أتاخونه بهتانا و امامبيا

অর্থ : আর তোমরা যদি এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহনের ইচ্ছা করেই থাক, তবে তাকে এক স্তূপ সম্পদ দিয়ে থাকলেও তা থেকে কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তোমরা কি দোষারোপ করে ও সুস্পষ্ট যুলুম করে তা ফেরত নেবে?–(সূরা নিসা : ২০)

আরও এরশাদ হয়েছে :

ولا يحل لكم أن تأخذوا مما أتيتموه شيئا الا ان يخافا إلا

يقيما حدود الله–

অর্থ : তোমরা স্ত্রীদের যা কিছু দিয়েছ, তা থেকে বিন্দু পরিমাণও ফেরত নেয়া তোমাদের জন্য বৈধ হবে না। তবে তারা দুজনই যদি আল্লাহর নির্ধারিত সীমাসমূহ রক্ষা করতে পারবে না বলে ভয় করে, তবে …।–(সূরা বাকারা ২২৯)

মহরের সমপরিমাণ অথবা তার কম বেশি পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে স্বামী তার স্ত্রীকে খুলা তালাক দিতে পারে। বিভেদ-বিসম্বাদ স্বামীর পক্ষ থেকে হলে খুলা’র বিনিময়ে অর্থ গ্রহন করা তার জন্য মাকরূহ।-(হেদায়া, ২য় খণ্ড)

আর যদি বিভেদ-বিসম্বাদ স্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘটে থাকে, তবে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত মালের বেশি গ্রহন করাও মাকরূহ।–(বাদায়েউস্ সানায়ে’, ৩য় খণ্ড)

স্বামী ইচ্ছা করলে বিনিময় ছাড়াও খুলা প্রদান করতে পারে। নবী (ছঃ) বলেছেন, খুলা প্রার্থিনী স্ত্রীর নিকট থেকে তাকে তোমার প্রদত্ত মালের সমপরিমাণ গ্রহণ করতে পার, তার বেশি নয়।–(বায়হাকীর সুনানুল কুবরা, ৭ খণ্ড)

.

খুলা’র বিনিময়ের ধরন

যে সব বস্তু মহর হিসেবে প্রদান করা যায় তা খুলার বিনিময় হিসেবেও প্রদান করা যাবে। খুলা প্রদানকারী স্বামীকে প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ্য বুদ্ধির অধিকারী হতে হবে।

.

খুলা’র হুকুম

খুলার মাধ্যমে একটি বাইন তালাক সংঘটিত হয়, এমন কি দু’ তালাকের নিয়্যত করলেও। কিন্তু তিন তালাকের নিয়্যত করলে তিন তালাকই সংঘটিত হবে। খুলাপ্রাপ্তা নারী ইদ্দতকালীন খোরপোষ ও বাসস্থান পাবে যদি ভিন্নতর কোন চুক্তি না হয়ে থাকে, তবে সে উপহার সামগ্রী পাবে না। খুলা মূলত একটি বাইন তালাকের অন্তর্ভূক্ত। -(হেদায়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮৪; আলমগীরী, ১ম খণ্ড)

তবে তিনি তালাকের নিয়্যত করলে তিন তালাকই কার্যকর হবে।–(আলমগীরী, ১ম খণ্ড)

.

যিহার

আরবী ভাষায় যিহার (%) শব্দটি 4 (যাহরুন) থেকে নির্গত। এর প্রচলিত অর্থ সাওয়ারী, যার উপর সাওয়ার হওয়া যায়। তাই জন্তযানকে আরবীতে ৭ ৮ বলা হয়। জাহিলিয়াতের যুগে আরব দেশে এ ধরনের বাক্য তালাকে পরিগণিত হতো। কেননা, তাদের নিকট এর অর্থ ছিল, তাশরীকের দিনসমূহ না আসে। কেউ যদি যিহারের কাফফারা রোযা রাখতে আরম্ভ করে ভুলবশত দিনে যিহারকৃত স্ত্রীর সাথে সঙ্গতে লিপ্ত হয়ে পড়ে অথবা রাতে স্বেচ্ছায় জেনেশুনে কিংবা ভুলক্রমে সঙ্গতে লিপ্ত হয়, তবে ইমাম আযম আবূ হানীফা ও মুহাম্মদ (রঃ)-এর মতে, তার পরের দিন হতে নতুন করে রোযা রাখা আরম্ভ করতে হবে। আর যদি দিনে স্বেচ্ছায় সহবাস করে, তবে সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী তার পরের দিন হতে রোযা রাখতে হবে।

কেউ যদি যিহারের কাফফারা বাবদ ধারাবাহিক দু মাস রোযা রাখতে অপারগ হয়, তবে ষাটজন মিসকীনকে দু বেলা খাওয়াবে। এ খাদ্য মধ্যম মানের হতে হবে। এ খাদ্য দান। চলাকালে যদি কেউ যিহারকৃত স্ত্রীর সাথে সঙ্গতে লিপ্ত হয়, তবে নতুন করে খাদ্য দান করতে হবে না। কেউ যদি একজন মিস্কনেকে ষাট দিন দু বেলা তৃপ্তি সহকারে খাওয়ায়, তবে কফফারা আদায় হবে।–(আলমগীরী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫০৫)।

.

যিহারের হুকুম

কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত পরিপূর্ণ সঙ্গত অথবা সহবাস সংঘটিত হতে পারে, এমন কাজ করা নিষিদ্ধ। যদি কাফফারা আদায়ের পূর্বে যিহারকৃত স্ত্রীর সাথে যিহারকারী সঙ্গতে লিপ্ত হয়, তবে ইসৃতিগফার করবে এবং তার উপর প্রথম কাফ্ফারা ব্যতীত অন্য কিছু বর্তাবে না। -(আলগীরী, ১ম খণ্ড পৃঃ ৫০৬)

স্বামী যদি যিহারকৃত স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, তারপর স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে, তারপর সে যদি প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে প্রথম কাফফারা আদায় ছাড়া তার সাথে সঙ্গত করা জায়েয হবে না।–(ঐ) পৃঃ ৫০৭]।

আর যদি তারা উভয়ে মুরতাদ হয়ে যায়, তারপর উভয়ে ইসলামে দীক্ষিত হয়, তবে ইমাম আযম আবূ হানীফা (রঃ)-এর মতে, তারা যিহারের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।-(ঐ)।

উপরিউক্ত হুকুমসমূহ যিহারে মুতলাক বা যিহারে মিয়াদী সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

.

ঈলা

ইমাম আবূ বকর আহমাদ আল-জাস্সাস (রঃ) বলেন, ঈলা (১) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলফ বা কসম করা। আরবী ভাষায়?—self

শরীয়াতের পরিভাষায় ঈলা হচ্ছে, যৌন সঙ্গম না করার হলফ করা, যার পরিণতিতে নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় স্ত্রী আপনা আপনি তালাক হয়ে যায়। এমন কি যখন বলা হবে, অমুক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ঈলা করেছে, বোঝা যাবে সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। –(আহকামুল কুরআন, জাস্সাস (বাংলা অনুবাদ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫৫)

যদি কোন স্বামী শপথ করে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে চার মাস বা তার অধিক কাল যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হবে না এবং সে যদি যৌন সম্ভোগ হতে বিরত থাকে, তবে চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর তা একটি বাইন তালাকে পরিণত হবে।

.

যে কাজ করলে ঈলাকারী হয়

 হযরত আলী ও ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) থেকে হাসান ও আতা (রঃ) বর্ণনা করেন, যে ঈলাকারী হবে সে যদি কসম করে বলে, সে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করবে না ক্ষতি হওয়ার আশংকায়।

হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রঃ) বলেন, ঈলা সঙ্গতকে কেন্দ্র করেই হয়। যেমন, যদি কেউ শপথ করে, সে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলবে না, তবে সে ঈলাকারী হলো। –[আহকামুল কুরআন, জাস্সাস (বাংলা অনুবাদ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫৫]

যে লোক চার মাসের কসম করল ইমাম আযম আবূ হানীফা, যুফার, আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ ও সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেছেন, সে ঈলাকারী হবে। অতঃপর মেয়াদের মধ্যে তার স্ত্রীর নিকট গেলে এবং ইতোমধ্যে ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে ইলার কারণে স্ত্রী বাইন তালাক হয়ে যাবে।

.

কাফফারা

দাসমুক্ত করতে হবে। অপারগতায় দশ জন মিসকীনকে দু বেলা মধ্যম মানের খাদ্য দিতে হবে। এতে অপারগ হলে পর পর তিনটি রোযা রাখতে হবে।-(শারহে বেকায়া)

.

হুকুম

ঈলা করার পর চার মাসের ভিতরে স্ত্রীকে ফিরিয়ে না আনলে সময়সীমা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটি বাইন তালাক সংঘটিত হয়ে যায় এবং বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতের নির্দেশের প্রয়োজন হয়।

.

লি’আন

লি’আন (5 ) শব্দের আভিধানিক অর্থ, তাড়িয়ে দেয়া, আল্লাহর রহমত থেকে দূরে নিক্ষে করা, পারস্পরিক অভিসম্পাত করা ইত্যাদি।

লি’আন-এর পারিভাষিক অর্থ, আল্লাহর নামে কসম দিয়ে এমন কতিপয় বাক্যকে লি’আন বলে যেগুলো অভিসম্পাত যুক্ত হয় এবং যা স্বামীর ক্ষেত্রে অপবাদের শাস্তি এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে ব্যভিচারের শাস্তির স্থলাভিষিক্ত হয়।–(শারহে বেকায়া গ্রন্থের প্রান্তটিকা, অনুচ্ছেদ ও লি’আন)

ইনায়া গ্রন্থাকার বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অভিশাপ ও গযব শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠানকে লি’আন বলে। মোদ্দাকথা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে ব্যভিচারের অপরাধে অভিযুক্ত করা হলে শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী বিচারক স্বামীকে চারবার কসম এবং পঞ্চমবারে নিজের উপর অভিশাপ দেয়ার নির্দেশ দেবেন। তারপর স্ত্রীকে চারবার কসম এবং পঞ্চমবারে মিথ্যাবাদীর উপর অভিশাপ দেয়ার নির্দেশ দেবেন। শরীয়াতের পরিভাষায় একে বলা হয় লি’আন। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে এরশাদ হয়েছে :

والذين يژمون آژواجهم ولم يكن لهم شهداء إلا أنفسهم فشهادة أحدهم اربع شهدت بالله إنه لمن الشرقي والخامس أن لعنت الله عليه إن كان من الكذبين ويذرؤا عثها العذاب أن تشهد اربع شهدت بالله إنه لمن الكذبين والخامسة أ غضب الله عليها إن كان من الشيقين

অর্থ : যারা নিজেদের স্ত্রীদের প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেয় অথচ নিজেরা ছাড়া তাদের কোন সাক্ষী নেই, তাদের প্রত্যেকের সাক্ষী এরূপ হবে, সে (স্বামী) আল্লাহর নামে চারবার কসম করে বলবে, সে অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চমবারে বলবে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ পতিত হবে। তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে, যদি সে চারবার আল্লাহর নামে কসম করে সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্বামীই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবারে বলে, তার স্বামী সত্যবাদী হলে নিজের উপর আল্লাহর গযব পতিত হবে।–(সূরা নূর : ৬-৯)

.

লি’আন করার পদ্ধতি

স্বামী নিম্নেল্লিখিত বাক্যে চারবার কসম করবে, আমি আল্লাহর নামে কসম করে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি এ নারীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের যে অভিযোগ উত্থাপন করেছি সে ব্যাপারে আমি অবশ্যই সত্যবাদী; পঞ্চমবারে অভিযুক্ত নারীর প্রতি ইশারা করে বলবে, আমি এ নারীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের যে অভিযোগ উত্থাপন করেছি সে ব্যাপারে আমি মিথ্যাবাদী হলে আমার উপর আল্লাহর গযব পতিত হোক।

স্ত্রীও নিমোল্লিখিত বাক্যে চারবার কসম করবে, আমি আল্লাহর নামে কসম করে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এ ব্যক্তি আমার প্রতি ব্যভিচারের যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভূক্ত। পঞ্চমবারে বলবে, এ ব্যক্তি আমার প্রতি ব্যভিচারের যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে সে ব্যাপারে সে সত্যবাদী হলে আমার উপর আল্লাহর গযব পতিত হোক।

স্বামী যদি কসম করতে অস্বীকার করে, তবে তাকে হাজতবাসে আটক রাখা হবে যে পর্যন্ত সে কসম না করে অথবা বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা বলে স্বীকার করে।

স্বামী যদি তার অভিযোগ মিথ্যা বলে স্বীকার করে, তবে তার অভিযোগ ক্বাযাফ (কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ) হিসেবে গণ্য হবে এবং অভিযোগকারীর দণ্ড হবে আশি বেত্রাঘাত।

স্ত্রী কসম করতে অস্বীকার করলে তাকেও হাজতবাসে রাখা হবে, যে পর্যন্ত সে কসম না করে অথবা তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য বলে স্বীকার করে।

উভয়ে লি’আন করার পর আদালত তাদের বিবাহ বাতিল করে দেবে এবং তারা আর কখনও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। তবে এ শর্তে পারবে যে, স্বামী তার মিথ্যার অভিযোগ মিথ্যা বলে স্বীকার করলে কাফের শাস্তি আশি বেত্রাঘাত খাওয়ার পর তারা পুনর্বিবাহে আবদ্ধ হতে পারবে।

.

লি’আনের শর্ত

 স্ত্রী লি’আন চাইবে। স্বামী যদি তা অস্বীকার করে, তবে বিচারক তাকে গ্রেফতার করবে যে পর্যন্ত না সে লি’আন করে অথবা নিজকে মিথ্যাবাদী বলে স্বীকার করে। যদি সে নিজেকে মিথ্যাবাদী বলে স্বীকার করে, তবে তাকে অপরাধের শাস্তি হিসেবে আশিটি বেত্রাঘাত করা হবে। যদি স্বামী লি’আন করে, তবে স্ত্রীর উপর লি’আন ওয়াজিব হবে। স্ত্রী যদি লি’আন করতে অস্বীকার করে, তবে বিচারক তাকে গ্রেফতার করবে যে পর্যন্ত না সে লি’আন করে, কিংবা স্বামীর কথা সত্য বলে স্বীকার করে।

.

লি’আনের হুকুম

 স্বামী-স্ত্রী যখন লি’আন হতে আলাদ হয়ে যায়, তখন পরস্পরের মধ্যে সহবাস হারাম হয়ে যায়। কিন্তু লি’আন দিয়ে উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় না, যে পৰ্মন্ত স্বামী স্ত্রীকে বাইন তালাক না দেয়। আর যদি স্বামী নিজেকে মিথ্যাবাদী বলে স্বীকার করে নেয়, তবে বিবাহ নবায়ন ব্যতীতই সহবাস হালাল হয়ে যায়।

ইমাম আযম আবূ হানীফা (রঃ) বলেন, লি’আন দ্বারা উভয়ের মধ্যে বিবাহ ভেঙ্গে যায় এবং তা এক তালাকে বাইন হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *