দশম খণ্ড — হজ্জ
হজ্জের বর্ণনা
হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি। হজ্জ-এর আভিধানিক অর্থ, সংকল্প করা। পারিভাষিক অর্থে হজ্জের মাসে নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ্ শরীফ ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ যিয়ারত ও বিশেষ কার্যাদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করাকে হজ্জ বলা হয়।–(কাওয়াইদুল ফিকাহ্)।
.
হজ্জের পটভূমি
হজ্জের রয়েছে দীর্ঘ পটভূমি। এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। বেহেশত থেকে দুনিয়াতে আগমণের পর হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা পরস্পরকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তাঁরা আরাফাতের ময়দানে পরস্পর মিলিত হন। তারই ক্বতজ্ঞতা স্বরূপ আদম-সন্তানগণ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে। তারা তাদের হৃদয়মন দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে।
এভাবে সাফা মারওয়ার মধ্যে সাঈ, মীনায় শয়তানকে কংকর মারা এবং কোরবানীর প্রেক্ষাপট, যা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও বিবি হাজেরা এবং তাঁদের পূণ্যবান সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বারা রচিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে। এভাবে হযরত আদম (আঃ) থেকে আজ পর্যন্ত সর্বযুগের আল্লাহপ্রেমিক, আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ নবী-রাসূল, ওলী-আবদাল তথা আল্লাহর নেকবক্ত বান্দাদেরর পরম ব্যাকুলতার সাথে আল্লাহর ঘর তাকওয়াফের দ্বারা হাজার হাজার বছরের আত্মনিবেদনের মাধ্যমে রচিত হয়েছে হজ্জ ও যিয়ারতের সুবিশাল প্রেক্ষাপট।
সর্বপ্রথম হযরত আদম (আঃ) বায়তুল্লাহ্ শরীফে হজ্জ আদায় করেছেন। এরপর হযরত নূহ্ (আঃ) সহ অন্যান্য নবী-রাসূলরা সকলে বায়তুল্লাহর যিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেন।
হাদীসে বর্ণিত আছে, বায়তুল্লাহ শরীফের পুনঃনির্মাণের কাজ সমাধা করার পর হযরত জিরাঈল (আঃ) হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে এ পবিত্র গৃহের তাওয়াফ ও হজ্জ করার জন্য বললেন। এ নির্দেশ পেয়ে হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ.) উভয়েই তাওয়াফ সহ হজ্জের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমাধা করলেন। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা হুকুম করলেন, হে ইবরাহীম! তুমি গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও। এ মর্মে পবিত্র কালামে ইরশাদ হয়েছে :–(আখবারে মক্কা)
وانين في الاس بالحج يأتوك رجالا وعلى كل ضامر يين من گل
فج عميق
উচ্চারণ : অআযযিন ফিন্না-ছি বিলহাজ্জি ইয়া’তূকা রিজ্বালাও অ’আলা কুল্লি দোয়া-মিরিই ইয়াতীনা মিন কুল্লি ফাজ্জিন আমীক্ব।
অর্থ : এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও; তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা হাজ্জ, ২২ঃ২৭)
তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) একটি উঁচুস্থানে আরোহণ করলেন এবং ডানে-বামে পূর্ব-পশ্চিমে ফিরে হজ্জের ঘোষণা করলেন। বললেন :
ايها الناس كتب عليكم الحج إلى البيت العميق فاجيبوا ربكم
উচ্চারণ : আইয়ুহান্ না-সু কুতিবা আলাইকুমল হাজ্জা ইলাল বাইতিল আমীকি ফা আজীবূ রব্বাকুম।
অর্থ :হে লোকেরা সকল! বায়তুল্লাহ্ শরীফের হজ্জ তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের রবের আহবানে সাড়া দাও। এ আহ্বান শুনে পূর্ব দিগন্ত হতে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত যাদের হজ্জ নসীব হবে তারা সকলেই এ 4 ti হাযির হে প্রভু! আমরা সকলেই হাযির’ বলেছে। কেউ সাড়া দিয়েছে একবার, আবার কেউ সাড়া দিয়েছে একাধিকবার। যারা একবার সাড়া দিয়েছে, তাদের একবার হজ্জ ভাগ্যে হয়। আর যারা একাধিকবার সাড়া দিয়েছে, তাদের একাধিকবার হজ্জ ভাগ্যে হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পর যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন তারা সকলেই বায়তুল্লাহর যিয়ারত করেছেন, হজ্জব্রত পালন করেছেন।-(আখবারে মক্কা, পৃঃ ৬৭-৬৮)
জাহিলিয়াতের যুগের লোকেরাও বায়তুল্লাহ্ শরীফের তাওয়াফ এবং যিয়ারত করতো। কিন্তু তারা তা করতে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে। নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তাধারার আলোকে জাহিলী বহু কর্ম তারা হজ্জের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল, হজ্জের মৌসুমে কুরায়শরা অন্যান্য হাজীদের ন্যায় আরাফায় না গিয়ে মুযদালিফায় অবস্থান করতো। তারা বলতো, আমরা হুস। আমাদের একটা স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য রয়েছে। তাই অন্যান্যদের মত আমরা সেখানে যেতে পারি না।
বস্তুত কালের বিবর্তনে হজ্জ তার আপন পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যতা খেল-তামাশা এবং অশ্লীল চিত্তবিনোদনের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল তখন। সে সময় তারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কা’বা গৃহের তাওয়াফ করতো।–(বুখারী শরীফ)
ইসলাম জাহিলী যুগের এসব কুসংস্কার চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে নতুনভাবে হজ্জের ফরযিয়াতের বিধান প্রবর্তন করে।
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :
ولله على الناس و البيت من استطاع إليه سبيد
উচ্চারণ : ওয়া লিল্লাহি আলান্না-সি হিজুল বাইতি মানিস তাত্বোয়া’আ ইলাইহি সাবীলা-।
অর্থ : মানুষের মধ্যে যার যেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। (সূরা আলে ইমরান, ৩ : ৯৭)।
ইসলামী বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সকল মুসলমান সমান। কাজেই অন্যান্য লোকেরা যেমন, আরাফা পর্যন্ত যায়, তদ্রূপ কুরাইশদেরকেও আরাফা পর্যন্ত যেতে হবে।
এরশাদ হয়েছে।
ثم أفيضوا من حيث أفاض الناس واستغفروا الله إن الله غفور
رحيم—
অর্থ : তারপর অন্যান্য লোক যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে, তোমরাও সে স্থান হতে প্রত্যাবর্তন করবে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বস্তুত আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।–(সূরা বাকারা, ২ঃ ১৯৯)
হজ্জকে জাহিলী যুগের বাকযুদ্ধ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
اباء كم او اشد زکرا
فاذا قضيتم منا سککم فاذكروا الله
অর্থ : তাপর তোমরা যখন হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শেষ করবে তখন আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষকে স্মরণ করতে অথবা তার চেয়েও অধিক আন্তরিকতা সহকারে।–(সূরা বাকারা, ২ঃ ২০০)
এরশাদ হয়েছে :
, , , , , , , , ,
فلا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحج
অর্থ : হজ্জ অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলন, অন্যায় আচরণ এবং ঝগড়া-বিবাদ অবৈধ। –(সূরা বাকারা, ২ঃ ১৯৭)
জাহিলী যুগের মুশরিক লোকেরা উপাস্য দেব-দেবীর নামে পশু বলি দিত এবং গোশত দেব-দেবীর সামনে রেখে দিত আর গায়ের রক্ত ছিটিয়ে দিত। বস্তুত এ ধরনের কার্যকলাপ বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনঃ
لن ينال الله لحومها ولا وماؤها ولكن يناله التقوى منكم
অর্থ : আল্লাহর নিকট না পৌঁছে তাদের গোশত আর না রক্ত, বরং পৌঁছে তাদের তাকওয়া।–(সূরা হাজ্জ, ২২ ও ৩৭)।
জাহিলী যুগের আরেকটি হাস্যকর রেওয়াজ ছিল, হজ্জের নিয়্যত করার পর দরজা পথে ঘরে প্রবেশ করাকে তারা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মনে করত। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল হজ্জ নষ্ট করে দেওয়ার নামান্তর। পবিত্র কোরানে এ সম্বন্ধে এরশাদ হয়েছে :
وليس البر بأن تأتوا البيوت من ظهورها ولكن البر من اثقی
وأتوا البيوت من أبوابها واتقوا الله لعلكم تفلحون–
অর্থ : এবং পশ্চাৎ দিক দিয়ে তোমাদের গৃহে প্রবেশ করাতে কোন পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে তাকওয়া অবলম্বন করলে। সুতরাং তোমরা দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ কর, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমরা সফলকাম হতে পারে। (সূরা বাকারা, ২ঃ ১৮৯)।
মুশরিক লোকদের আরেকটি বাড়াবাড়ি হল, তারা হজ্জের সফরে প্রয়োজনীয় পাথেয় সাথে নিয়ে যাওয়া তাকওয়াক্কুলের পরিপন্থী মনে করতো। তাদের যুক্তি ছিল, আমরা আল্লাহর মেহমান। সাথে করে কিছু নিয়ে যাওয়া মেযবানের অপমানেরই নামান্তর। অপরদিকে তারা আবার অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতেও কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হতো না। বরং এটাকে তারা অহংকার দমনের সাধনা বলে চালিয়ে দিত। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের এ চতুরতার পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে ঘোষণা করলেন :
وتردوا فإن خير الزاد التقوى
অর্থ : এবং তোমরা পাথেয় সাথে করে নাও। তবে মনে রেখ তাকওয়াই উত্তম পাথেয়। –(সূরা বাকারা, ২ : ১৯৭)
হজ্জের সময় মুশরিকরা তারা উলঙ্গ অবস্থায় বায়তুল্লাহ্ শরীফের তাওয়াফ করতো। তাদের যুক্তি ছিল যে, এই পোশাক পরিধান করে বছর ভর আল্লাহর নাফরমানী করেছি। সুতরাং এ পোশাক পরিধান করে তাওয়াফ করতে পারি না। বস্তুত এটা ছিল রুচিবিরোধী অশ্লীল কাজ। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তা’আলা বনী আদমকে সম্বোধন করে বলেন :
يبني أدم دوا زينتكم عند كل مسجد
অর্থ : হে বনী আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে। –(সূরা আ’রাফ, ৭ঃ ৩১)
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে বিদায় হজ্জের এক বছর পূর্বে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে, আগামী বছর থেকে কোন মুশরিক বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে পারবে না এবং উলঙ্গ অবস্থায়ও কেউ তাওয়াফ করতে পারবে না। মোটকথা, এই সুদূরপ্রাসরী গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামী শরীয়াত হজ্জকে আবার সুন্নাতে ইব্রাহীমীর দিকে ফিরিয়ে আনল। ফলে যাবতীয় শিরক, বিদ্আত ও জাহিলী কর্ম হতে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে হজ্জ আবার তাওহীদের প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। -(আরকানে আরবাআ),
.
মক্কা শরীফ
মু’মিনের হৃদয়ে পবিত্র মক্কা নগরীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আবহমানকাল থেকে চলে আসার ফলে এ নগরীর নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে শ্রদ্ধাপূর্ণ বিশেষণ। তাই মক্কা কেবল মক্কাই নয়, মক্কা হলো মুকারমা, মক্কা শরীফ। পবিত্র কোরআনেও এ নগরের বিভিন্ন বিশেষণ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলার বাণী :
وكذلك أوحينا إليك قرانا عربيا تور ام القرى ومن حولها
অর্থ : আর এভাবে আমি আপনার প্রতি কোরআন নাযিল করেছি আরবী ভাষায় যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন নগরসমূহের মা মক্কা ও তার চতুর্দিকের লোকজনকে। –(সূরা শূরা, ৪২ : ৭)
উক্ত আয়াতে মক্কা শরীফকে উম্মুল কুরা-নগরসমূহের মা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্য আয়াতে এ নগরীকে নিরাপদ নগরী বলে অভিহিত করে এর কসম করেছেন স্বয়ং রাব্দুল আলামীন। এরশাদ হয়েছে।
والتين والزيتون وطور سينين وهذا اللي الأمين
অর্থ : কসম তীন, যায়তুন, সিনাই পর্বত এবং এ নিরাপদ নগরীর। –(সূরা তীন, ৯৫ঃ ১-৩)
এককভাবে মক্কা নগরীর কসম উচ্চারিত কোরআনুল করীমেঃ
أقسم بهذا البلد واثت بهذا البلد
অর্থ : কসম এ নগরীর, আর আপনি এ নগরীর অধিবাসী।–(সূরা বালাদ, ৯০ : ১-২)
পবিত্র কোরআনে এ নগরীকে বাক্কা (মক্কা) নামে অভিহিত করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছেঃ
إن أول بيت وضع للناس إلى ببة بركا وهدى لتوين
অর্থ : নিশ্চয় মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায় এটা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। (সূরা আলে ইমরান, ৩ ঃ ৯৬)
এ নগরীকে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাই হিজরতের সময় মক্কা ত্যাগ কালে তিনি আফসোস করে বলেছিলেন?
، أخرجوني منك ما
الله لا ان قومی احرجونی سس
كنت غيرك
অর্থ : তুমি কতই না উত্তম নগরী এবং আমার নিকট কতই না প্রিয় নগরী, আমার সম্প্রদায় যদি আমাকে বের করে না দিত, তবে তোমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও আমি বসবাস করতাম না।
এ সেই পূতপবিত্র নগরী, যার জন্য আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দোয়া করেছিলেন,
وإذ قال إبرهم رب اجعل هذا بلدا انا وارزق اهله من الثمرات من
أمن مهم
অর্থ : স্মরণ কর, যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলেছিলেন, হে আমার রব! একে তুমি নিরাপদ নগরী কর এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতে ঈমান আনে তাদেরকে ফলমূল থেকে জীবিকা দান কর। (সূরা বাকারা, ২ : ১২৬)
এ সেই নগরী, যেখানে মহানবী (ছঃ) জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁর বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত করে বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন, জীবনের তিপ্পান্ন বছর এ নগরীতেই তিনি কাটিয়েছেন। এখানেই তিনি ওহী ও নবুওয়াত লাভ করেছেন। এখান থেকেই তিনি মিরাজে গমন করেছেন। আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বা শরীফ এ পবিত্র মক্কা নগরীতেই অবস্থিত, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নিজের ঘর বলে অভিহিত করে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন।
إن طهرا بيتى للطائفين والكفين والركع الجوي
অর্থ : তোমরা দু’জনে আমার ঘরকে পবিত্র কর তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূ সিজদাকারীদের জন্যে।–(সূরা বাকারা, ২ : ১২৫)
উপরন্তু আল্লাহর ঘর কা’বা হচ্ছে, পৃথিবীর সর্বপ্রথম মসজিদ। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
ان اول بيت وضع للناس اللي ببه برگا وهدى العلمين فيه
أي بين مقام إبرهيم ومن تله كان أيئا
অর্থ : নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্যে সর্বপ্রথম যে গৃহটি নির্মিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা তো বাক্কায়, তা বরকতময় ও বিশ্ব জাহানের জন্যে পথের দিশারী। তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে, (যেমন) মাকামে ইব্রাহীম। আর যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে সে নিরাপদ। –(সূরা আলে ইমরান, ৩ : ৯৬-৯৭)
বায়হাকীর উদ্ধৃত এক হাদীসের বরাতে আল্লামা ইবন কাসীর (রঃ) বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহ্ তা’আলা জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তাদেরকে কা’বা ঘর নির্মাণের আদেশ দেন। সে মতে তা নির্মিত হওয়ার পর তাদেরকে তা তাকওয়াফের নির্দেশ দেয়া হয় এবং বলা হয়, আপনি সর্বপ্রথম ব্যক্তি এবং এ ঘরটি সর্বপ্রথম ঘর, যা আদম জাতির জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
কোন কোন বর্ণনায় জানা যায়, হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগের মহাপ্লাবন পর্যন্ত এ ঘরটি অক্ষত ছিল। মহাপ্লাবনে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তারপর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুরাতন ভিতের উপর তা পুনর্নির্মাণ করেন।
এরূপ মর্যাদার কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করেন :
جعل الله الكعبة البيت الحرام ټيما لناس
অর্থ : আল্লাহ্ তা’আলা কা’বাকে সম্মানিত গৃহ এবং মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত করেছেন।–(সূরা মায়িদা, ৫ ও ৯৭)।
নবী করীম (ছঃ) বলেন :
إنما أمرت أن اعبد رب هذا البيت الى حرمها
অর্থ : আমি আদিষ্ট সেই গৃহের রবের ইবাদত করতে, যাকে তিনি হারাম-সম্মানিত করেছেন।
নবী করীম (ছঃ) আরও বলেন :
لا تزال هذه الأمة بخير ما عظموا هذه الحرمة حق تعظيمه فاذا
ضيفوا ذلك هلكوا ۔
অর্থ : আমার উম্মাত ততদিন পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত তারা মক্কার যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করবে। যখন তারা এর অন্যথা করবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
.
পবিত্র মক্কার আদব
মক্কা শরীফ ও কা’বা ঘরের সম্মান করা এবং এ ব্যাপারে সম্ভ্রমপূর্ণ আচার-আচরণ অবলম্বন করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। তাই ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে মক্কা প্রবেশের পূর্বে গোসল শিরোনামে হাদীস বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবন উমর (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে?
كان ابن عمر كان لا يقدم مكة إلا بات بذي طوى حتى يصبح
مكة وينگر آن نبي الله صلى الله عليه
ويغتسل ويصلى في وسلم كان يفعل ذالك
অর্থ : হযরত ইবন্ উমর (রাঃ) যখন পবিত্র মক্কায় আসতেন, তখন যী-তুওয়া নামক স্থানে রাত যাপন করতেন। ভোরে গোসল করতেন এবং সেখানে ফজরের নামায আদায় করতেন। পরে পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করতেন এবং এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করতেন যে, নবী আল্লাহ্ (ছ.) এরূপই করতেন।
হারাম শরীফের সীমানায় শিকার করা এমনকি শিকারীকে শিকারের ব্যাপারে পথপ্রদর্শন বা কোনরূপ সাহায্য সহয়োগিতা করা যে অবৈধ, তা এই হারাম শরীফের সম্মানের কারণেই। আবহমানকাল থেকেই হারাম শরীফের নিরাপদ ও সম্মানিত স্থান বলেই গণ্য হয়ে আসছে।
যুদ্ধরত আরব গোত্ৰসমূহ সেই জাহিলিয়াতের যুগেও শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও হারাম শরীফের সীমায় বধ করতে না বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতো না। হারাম শরীফের সম্মান কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকবে। নবী করীম (ছঃ) বলেন
فهو حرام بومة الله إلى يوم القيامة لا يعضد شوكه ولا يفر
صيده
অর্থ : কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্ প্রদত্ত সম্মানের ভিত্তিতে সম্মানিত। সুতরাং হারাম শরীফের এলাকায় কাঁটাযুক্ত গাছও কাটা যাবে না এবং তার শিকার জন্তুকে হাঁকানো হবে না।
মক্কা মুয়াযযমায় প্রবেশের সময় গোসল করা সুন্নাত, তা জিদ্দায় সেরে আসলেও সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। আহকামুল হাজ্জ ওয়াল উমরা, মুক্তী মুহাম্মদ শফী (রঃ)
ফিকাহ্ শাস্ত্রের বিশ্বখ্যাত হিদায়া গ্রন্থে আছে :
وإذا عاين البيت كبر وهتل
অর্থ : যখন বায়তুল্লাহ্ শরীফ দৃষ্টিতে আসবে তখন আল্লাহু আকবার এবং লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ উচ্চারণ করবে। হযরত ইবন উমর (রাঃ) ঐ সময় বলতেন : « L। বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার।
বাবুস সালাম দিয়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করা উত্তম।
নবী করীম (ছঃ) মসজিদুল হারাম দর্শনকালে দু’হাত উর্ধ্বে তুলে এরূপ দোয়া করতেনঃ
اللهم زد هذا البيت تثيا وتشريفا وتكريما ومهابة وزد من
شرفه و گروه ممن حجة واعتمره تشريفا وتكريما رتعظيما
অর্থঃ হে আল্লাহ! এ ঘরের মান-মর্যাদা সম্ভ্রম বৃদ্ধি করুন এবং যারা এ ঘরে হজ্জ বা উমরা করেন, তাদের মান-মর্যাদা, সম্ভমও বৃদ্ধি করুন কা’বা শরীফের দরজায় প্রবেশের সময় ডান পা প্রথমে রাখবে এবং দুরূদ শরীফ পাঠ করে এ দোয়া করবেঃ
اللهم افتح لي أبواب رحمتك وټل لنا أبواب رژقك
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ফতাহলী আবওয়া-বা রাহমাতিকা অ সাহলিল লানা–আবওয়া-বা রিযক্বিকা
অর্থ : হে আল্লাহ! আমার জন্যে আপনার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিন এবং রিযকের দরজাসমূহ সহজ করে দিন।
মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম কাজ হলো তাওয়াফ। এখানে তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ নফল নামায পড়তে হয় না।
.
হজ্জের ফযীলত ও গুরুত্ব
হজ্জ ইসলামের পঞ্চ বেনার একটি বিশেষ বেনা। এর ফরযিয়্যাত অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত। এর ফরযিয়্যাত অস্বীকার করা কুফরী। জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। বিশুদ্ধমতে হজ্জ ফরয হওয়ার পর বিলম্ব না করে আদায় করা অবশ্য কর্তব্য।
হজ্জই হচ্ছে এমন ইবাদত যা সম্পাদন করতে জান-মাল উভয়েরই প্রয়োজন হয়। হাদীসে। শরীফে হজ্জের ফযীলতের কথা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
অন্য এক হাদীসে আছেঃ
عن أبي هريرة رضي الله عثة قال سئل النبي صلى الله عليه ولم أي الأعمال افضل قال إيمان بالله ورسوله قيل ثم ماذا قال
جهاد في سبيل اللوقيل ثم ماذا قال مبرور
অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (ছঃ)-কে প্রশ্ন করা হল যে, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। প্রশ্ন করা হল, তারপর কোন্টি? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। পুনরায় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, এরপর কোন্টি? জবাবে তিনি বললেন, হজ্জে মাবরূর অর্থাৎ মাকবুল হজ্জ। -(বুখারী ও মুসলিম)
অন্য হাদীসে আছেঃ
الحين المبرور ليس له جزاء إلا الجئة
অর্থ : মাকবুল হজ্জের প্রতিদান বেহেশত ছাড়া কিছুই নয়।
অপর এক হাদীসে আছেঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه
وسلم من حج لله فلم يرفث ولم يفسق رجع كيوم ولدته امه
অর্থ : হযরত আবু হোরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করল, হজ্জের কার্যাবলী আদায়কালে স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত থাকল ও গুনাহের কাজ করল না, সে মাতৃগর্ভ হতে নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে।
নবী করীম (ছঃ) আরো বলেন, বাহ্যিক কোন কারণ, যালিম বাদশাহ কিংবা অসুস্থতা হজ্জ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি হজ্জ আদায় না করে মারা যায়, তবে সে ইয়াহূদী হয়ে মৃত্যুবরণ করুক কিংবা খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক। (তাতে কিছু আসে যায় না)।
.
হজ্জের গুরুত্ব
আল্লাহ্ তা’আলা হাকীম ও প্রজ্ঞাময়। তার কোন কাজই হিমত ও রহস্য থেকে খালি নয়। গবেষক আলিমরা অনেকেই হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা আলোচনা করে কিতাব লিখেছেন। বস্তুত হজ্জের মধ্যে মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। হজ্জের প্রতিটি আমলের মধ্যে এ দু’টি দৃশ্যের প্রকাশ সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়, ১. হজ্জ পরকালের সফরের এক বিশেষ নিদর্শন এবং ২. হজ্জ আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশের এক অনুপম বিধান।
মুহাক্কিক আলিমরা হজ্জের সফরকে আখিরাতের সফরের সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, মানুষ যখন হজ্জের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বের হয়, তখন আত্মীয়-স্বজন, বাড়ি-ঘর, বন্ধু-বান্ধব ত্যাগ করে তারা যেন পরাকলের সফরে বের হয়। মৃত্যুর সময় যেমন বাড়ি-ঘর, দোকান-মাকান ত্যাগ করতে হয়, অনুরূপভাবে হজ্জের সময়ও এ জাতীয় সবকিছু ত্যাগ করতে হয়। যানবাহনে আরোহণ হাজীকে খাঁটিয়ায় সাওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহ্রামের দু’টুকরা শ্বেত-শুভ্র কাপড় হজ্জ যাত্রীদের মনে কাফনের কাপড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহরামের পর লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলা কিয়ামতের দিন আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেয়ার সমতুল্য। সাফা-মারওয়ার সাঈ হাশরের ময়দানে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করার সমতুল্য। সে দিন যেমন মানুষ দিশেহারা হয়ে নবী-রাসূলদের নিকট ছুটরাছুটি করবে তদ্রপ হাজীরাও সাফা-মারওয়া পর্বতদ্বয়ের মাঝামাঝি স্থানে দৌড়াদৌড়ি করে থাকে। আরাফার ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের অবস্থান হাশরের ময়দানের নমুনা বলে বোধ হয়। সূর্যের প্রচণ্ড তাপের মধ্যে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় এ ময়দানে। এক কথায়, হজ্জের প্রত্যেকটি আমল থেকেই পরকালের সফরের কথা ভেসে উঠে হজ্জযাত্রীর হৃদয়ে। এটাই হলো হজ্জের প্রধানতম তাৎপর্য ও রহস্য।
দ্বিতীয়ত, হজ্জ হল আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশ করার এক অনুপম বিধান। অর্থাৎ প্রেমাস্পদের আকর্ষণে মাতোয়ারা হয়ে প্রেমিক ছুটে চলে যিয়ারতে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে। কখনো মক্কায়, কখনো মদীনায়, কখনো আরাফায়, আবার কখনো বা মুযদালিফায় হাযির হয়ে হাজী কান্নাকাটি ও গড়াগড়ি করছে মহান আল্লাহর দরবারে। দাঁড়াবার সুযোগ নেই তাঁর কোথাও। এভাবে ছুটাছুটি করে উত্তপ্ত হৃদয়ের প্রশান্তি লাভ করাতেই সদা সে সচেষ্ট। হজ্জের প্রত্যেকটি আমলেই আমরা দেখতে পাই প্রেমের প্রক্বষ্ট নিদর্শন। কেননা, বন্ধু-বান্ধব, বাড়ি-ঘর এবং আত্মীয়-স্বজনের মায়া ছেড়ে দিয়ে প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া এবং তাঁরই তালাশে বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত এবং সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পবিত্র মক্কা ও মদীনার অলিতে-গলিতে দৌড়াদৌড়ি ও ছুটাছুটি করা এ একমাত্র প্রেমিকেরই কাজ।
ইহরাম বাঁধা প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক জ্বলন্ত নিদর্শন। না আছে মাথায় টুপি, না দেহে। জামা, না সুন্দর পোশাক, না আছে সুগন্ধি বরং ফকীরের বেশে সদা চঞ্চল ও উদাসীন মনে সেলাইবিহীন শ্বেত ও শুভ্র বস্ত্রে আচ্ছাদিত মুহরিমের সে কি এক অপূর্ব দৃশ্য! লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলতে বলতে ছুটে চলছে তারা মক্কা ও মদীনার পানে। প্রভু, বান্দা হাযির, হাযির আমি তোমার দরবারে’-এই বলে কান্নাকাটি করে হাজী মক্কা ও মদীনায় পৌঁছে মনে করে আমি আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে গেছি। কারণ বিচ্ছেদের অনলে দগ্ধ একটি অন্তর যখন প্রিয়তমের নৈকট্য লাভে ধন্য হয়, তখন তাঁর আবেগ সমুদ্র কত যে তরঙ্গায়িত হতে থাকে, তা প্রেম পাগল ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো বোঝা বড়ই দায়। এমনিভাবে হজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, মুলতাযাম জড়িয়ে ধরা, কা’বার চৌকাঠ ধরে কান্নাকাটি করা এবং মৌমাছির মত বায়তুল্লাহ্ শরীফের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা সবই ইশকে ইলাহীর আনুপম দৃশ্য প্রেম ও ভালবাসার চরম বিকাশ ঘটে জমরাতে কংকর নিক্ষেপের সময়। কেননা, প্রেমিকের আবেগ যখন চরমে পৌঁছে তখন প্রেমাস্পদকে লাভ করার পথে যে-ই বাধা হয় তাকেই সে এলোপাথাড়ি পাথর নিক্ষেপ করে। তদ্রূপ, জমরাতে এসে হাজীরাও তা-ই করে থাকে।
এরপর পশু কোরবানী করে প্রেমানুরাগের শেষ মঞ্জিল অতিক্রম করে নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ অবস্থায় ফিরে আসে হাজীরা নিজ নিজ মুসাফিরখানায়। তখনও মাহবুবের দেশে পুণরায় যাওয়ার অনির্বাণ শিখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে তাঁর অন্তরে। সারকথা, আল্লাহ্ প্রেমিক মানুষ আল্লাহ্ পাকের মহব্বতেই পবিত্র বায়তুল্লাহর যিয়ারতে বের হয় এবং এটাও হজ্জের অন্যতম উদ্দেশ্য।–(ফাযাইলে হজ্জ)।
.
হজ্জের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
হজ্জ নিতান্তই ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হজ্জ করে থাকে। তা সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হজ্জের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। বস্তুত হজ্জের মৌসুম এমন এক বসন্ত মৌসুম, যার আগমনে নতুন প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মুসলিম উম্মাহ্। আর এজন্যই হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ বনী আদম হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে বায়তুল্লাহর যিয়ারতে ছুটে আসে। যারা হজ্জে গমন করে তারা তো ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত থাকেই, তদ্রূপ তাঁদের আত্মীয়-স্বজন যারা হাজীদের বিদায় সম্ভাষণ এবং ফেরার পর অভ্যর্থনা জানায় এবং হাজীদের নিকট হজ্জের বিস্তারিত অবস্থা শুনে তাদের মধ্যে ধর্মীয় দিক থেকে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে।
এমনিভাবে হাজীদের কাফেলা যে স্থান দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে তাঁদের দেখে এবং তাঁদের লাব্বাইক আওয়াজ শুনে সেখানকার কতো মানুষের দিল ধর্মীয় ভাবধারায় আপ্লুত হয়ে উঠে এবং কত মানুষের অচেতন আত্মায় হজ্জ করার উৎসাহ জেগে উঠে, তা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন দেশ হতে আগত হজ্জ যাত্রীদের দৈহিক কাঠামো ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, কিন্তু মীকাতের নিকটে এসে তাঁরা নিজেদের পোশাক খুলে একই ধরনের পোশাক পরিধান করে, তখন তাঁদের মধ্যে একই ইলাহ্-এর বান্দা হওয়ার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। সকলের মুখে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে। তারপর মক্কা ও মদীনার পবিত্র ভূমিতে কাফেলা সমবেত হয় এবং সকলে একই পদ্ধতিতে একই ইমামের পেছনে নামায আদায় করে। এভাবে সমবেত মুসলিম জনতা ভাষা, জাতি এবং দেশ ও গোত্রের ক্বত্রিম বৈষম্য ভেঙ্গে দিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিরাট সুযোগ পায়। প্রকৃতপক্ষে, হজ্জের এ বিশ্ব সম্মিলত হয়, 9.5_JJ LI ১০।মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই–এর বাস্তব নমুনা। হজ্জের মৌসুমে এ চেতনা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদের উন্নতি ও তরীর জন্য বিভিন্ন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদরা যদি সমষ্টিগত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চান, তবে হজ্জের মৌসুমই এর জন্য উত্তম সময়।
হজ্জের মৌসুমে আলিম-উলামা এবং সূফী ও সংস্কার করা পবিত্র মক্কা ও মদীনায় সমবেত হয়ে থাকেন। তাই এ সময় উম্মাহর সঠিক অবস্থা পর্যালোচনা করা, তাদেরকে শিরক ও বি’আতের অভিশাপ হতে মুক্ত করা এবং মুসলিম বিশ্বে তা’লীম ও তাবলীগী মিশন প্রেরণের বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যায়।
হজ্জ যেহেতু মুসলিম উম্মাহর এমন এক বিশ্ব সম্মিলন, যেখানে সব শ্রেণীর মানুষই এসে একত্রিত হয়। তাই এ সময়ে বিশ্বশান্তি স্থাপনে এবং জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মিটিয়ে, লড়াই-ঝগড়ার পরিবর্তে ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
হজ্জ সম্মিলন মুসলিম উম্মাহর এক বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর শান-শওকতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিক্ষিপ্ত শক্তিসমূহ সংহত হয়। দিকে দিকে উম্মাহর সুখ্যাতি ও গৌরব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়াও বহু কল্যাণ, উপকারিতা এবং হিম্মত হজ্জের মধ্যে নিহিত রয়েছে।–(ফাযাইলে হজ্জ)
.
হজ্জের সময়
হজ্জ-এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়মীমা রয়েছে। এর বাইরে হজ্জ আদায় করা নাজায়েয। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :
الحج أشهر معلوم
হজ্জের মাসসমূহ সুবিদিত।–(সূরা বাকারা, ২ : ১৯৭)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেন :
ذی الحجة
قال ابن عمر أشهر الحج شوال و ذوالقعدة وعشر ما
অর্থ : হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা.) বলেন, হজ্জের মাসসমূহ হচ্ছে শাওয়াল, যিলক্বদ এবং যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিন।–(বুখারী শরীফ)
তাফসীরে মাযহারীতে বর্ণিত আছে, হজ্জের মাস শাওয়াল হতে শুরু হওয়ার মানে হচ্ছে এর পূর্বে ইহরাম বাঁধা নাজায়েয। কোন কোন ইমামের মতে শাওয়ালের পূর্বে হজ্জের ইহরাম বাঁধলে হজ্জ আদায়ই হবে না। ইমাম আযম আবূ হানীফা (রঃ)-এর মতে অবশ্য হজ্জ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মাকরূহ হবে।–(মা’রিফুল কোরআন)
.
হজ্জ ফরযের শর্তসমূহ
১. মুসলমান হওয়া। ২. বালেগ হওয়া। ৩. সুস্থ মস্তিষ্ক হওয়া। ৪. স্বাধীন হওয়া। ৫. হজ্জ পালনের দৈহিক ও আর্থিক সচ্ছলতা থাকা। ৬. হজ্জের সময় হওয়া। ৭. হজ্জে যাত্রা পথের নিরাপত্তা। ৮. বিধর্মী শত্রু রাষ্ট্রের নও মুসলিমের পক্ষে হজ্জ হওয়ার জ্ঞান থাকা।
.
হজ্জের প্রস্তুতি
হজ্জ যাত্রার প্রস্তুতির দু’টি দিক রয়েছে, একটি ধর্মীয় ও মানসিক প্রস্তুতি, অপরটি দুনিয়াদারী বা বাহ্যিক প্রস্তুতি। একে আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতিও বলা যেতে পারে।
ক. ধর্মীয় ও মানসিক প্রস্তুতি
১. পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে তাকওয়া অবলম্বন তথা ইসলামী জীবন যাপনের উপদেশ প্রদান করা।
২. কারো সাথে কোন লেনদেন থাকলে তা যথাসাধ্য চুকিয়ে ফেলা এবং পুরাপুরি চুকানো। গেলে তা লিখে রাখা এবং কয়েকজন সাক্ষী রাখা।
৩. অতীতের গুনাহসমূহ জন্যে আল্লাহর তা’আলার দরবারে তাওবা করে নেয়া। তাওবার মর্ম হচ্ছে?
ক. পাপের কাজ ছেড়ে দেয়া। খ. গুনাহের জন্য অনুশোচনা করা ও সর্মিন্দা হওয়া এবং গ. ভবিষ্যতে আর গুনাহ্ না করার জন্য দৃঢ় এরাদা করা
৪. কারো ধনসম্পদ জমি-জিরাত বা অন্য কোন হক্ নিজের জিম্মায় থাকলে তা আদায় করা। উপরন্তু কারো কোনরূপ মনোকষ্টের কারণ ঘটিয়ে থাকলে তার জন্যেও মাফ চেয়ে নিয়ে দায়মুক্ত হওয়া।
৫. হালালভাবে অর্জিত মালের ব্যবস্থা করা। কেননা, নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ
إن الله تعالى طيب لا يقبل إلا طيبا
অর্থ : আল্লাহ্ তা’আলা নিজে পবিত্র, পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু তিনি কবুল করেন না। নবী করীম (ছঃ) আরও বলেছেন : কোন ব্যক্তি যখন তার হালালভাবে অর্জিত সম্পদ নিয়ে হজ্জে বের হয়, বাহনে চড়ে, সে উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়ে আল্লাহর দরবারে হাযিরা দেয়। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’–হাযির প্রভু তোমার দরবারে হাযির। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তার জবাবে বলেন : লাব্বাইক ও সা’দায়িক-আমিও হাযির, তোমার অনুকূলে আমি আছি, তুমি সৌভাগ্যের অধিকারী। কেননা, তোমার পথ খরচা, তোমার বাহন সবকিছু হালাল উপায়ে উপার্জিত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হারাম মাল নিয়ে হজ্জে বের হয়, তার লাব্বাইক উচ্চারণের জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেন : লাব্বাইক ওয়া লা সা’দায়িক–আমি তোমার জন্যে হাযির নই, তোমার অনুকূলেও নই, তোমার সৌভাগ্য নেই। কেননা, তোমার হজ্জ উপলক্ষে ব্যয়িত সম্পদ হালালভাবে উপার্জিত নয়।–(তাবরানী)
৬. যাঞ্চা করা থেকে বিরত থাকা। অনেকে হজ্জকে উপলক্ষ করে যাঞ্চা করতে থাকে, এটা খুবই নিন্দনীয়।
৭. নিয়্যত বিশুদ্ধকরণ–হজ্জ হবে একান্তই আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে। নামধাম ও জৌলুস প্রকাশের জন্যে নয়।
৮. হজ্জ ও উমরার মাছ’আলাসমূহ শিক্ষা করা। কেননা রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন :
خذوا عني مناسككم
অর্থ : আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়ম-কানুন শিখে নাও।
৯. উত্তম সফরসঙ্গী নির্বাচন, কেননা, উত্তম সফরসঙ্গী এবাদত বন্দেগীর সহায়ক হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিদেশ-বিভূঁয়ে আপদে-বিপদে সংযমী, সহানুভূতিশীল বিবেকবান সফরসাথী ছাড়া বিশেষ অসুবিধা হয়। হজ্জের মাছআলা জানা অভিজ্ঞ আলিম ও সুন্নাতের পূর্ণ অনুসারী সাথী মকবুল হজ্জ হাসিলের বিশেষ সহায়ক।
১০. নিজকে সর্বতোভাবে পাপ কাজসমূহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা। কেননা, অশ্লীল কার্যাদি ও অশ্লীল কথাবার্তা থেকে বিরত থেকে হজ্জ পালনকারীর জন্যেই কবুলিয়ত ও জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে।–(মুআল্লিমুল হুজ্জা)
১১. মাতাপিতা জীবিত থাকলে এবং তাদের সেবা শুশ্রূষার প্রয়োজন থাকলে বা পথ বিপজ্জনক হলে তাদের অনুমতি নেয়া।
আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতিঃ
১. হজ্জের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধিন, কাজেই তাদের জারীক্বত নির্দেশাদি ও তাদের বিলিক্বত পুস্তিকা ও ইশতেহারাদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ে সে মতে কাজ করা।
২. যথাসময়ে হাজী ক্যাম্পে পৌঁছে স্বাস্থ্যগত আনুষ্ঠানিক বিষয়, ইনকেজশন ও স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট ইত্যাদি গ্রহণ করা।
৩. ইহরামের কাপড় (এক জোড়ার স্থলে দু জোড়া নেয়াই উত্তম), প্রয়োজনীয় দোয়া দুরূদ ও অযীফা পুস্তক, হজ্জের মাছয়ালা সংক্রান্ত পুস্তক ও প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি, কাপড়-চোপড় ও হাল্কা বিছানাপত্র (মশারী সহ), রঙিন চশমা, খাতা, কাগজ ও কলম, অভঙ্গুর ও হাল্কা বাসনপত্র, মিস্ওয়াক, কুলুখের কাপড় বা টয়লেট পেপার, ক্ষৌর সামগ্রী ও আয়না, সুতলী, দড়ি, ছাতা সর্বোপরি তালা চাবিসহ একটি মজবুত সুটকেস বা ব্যাগ, জরুরী কাগজপত্র ও টাকা-পয়সা রাখার মত একটি প্রশস্ত কোমরাবদ্ধ সাথে নেয়া। খাদ্যদ্রব্য সঙ্গে নেবেন না।
৪. বাক্স ও ব্যাগে নিজের নাম ঠিকানা পরিষ্কারভাবে লিখে বা লিখিয়ে নেয়া যাতে হারিয়ে গেলে সহজে পাওয়া যায়।
৫. পাসপোর্ট ও সার্টিফিকেট ও বিমানের টিকিট ইত্যাদি সাবধানে রাখার ব্যবস্থা অবলম্বন।
৬. মহিলাদের বোরখা সাথে নেয়া, জেওরাদি যতদূর সম্ভব কম নেয়া উত্তম। কেননা, অনেক সময় তা বিপদের ও পেরেশানীর কারণ হয়ে যায়।
৭. প্রয়োজনীয় আরবী কথোপকথন শিখে নেয়া, যাতে টুকটাক কথা বলা ও বোঝা যায়।
৮. মক্কা, মদীনা, আরাফাত ও মীনায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও হজ্জ মিশনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা।
.
হজ্জের প্রকারভেদ
হজ্জ তিন প্রকারঃ
১. ইফরাদ–হজ্জের মাসে উমরা ছাড়া শুধুমাত্র হজ্জ করা। এরূপ হাজীকে মুফরিদ বলা হয়ে থাকে।
২ তামাত্তু–হজ্জের মাসে প্রথমে উমরা এবং পরে হজ্জ করা। এরূপ হাজীকে মুতামাতত্তো’ বলা হয়ে থাকে।
৩. কিরান–হজ্জ ও উমরা একত্রে মিলিয়ে করা। এরূপ হাজীকে কারিন বলা হয়ে থাকে। কিরান হজ্জই উত্তম। কেননা, এতে এক ইহরামে দীর্ঘদিন থাকতে হয় বলে কষ্ট বেশি হয়। নবী করীম (ছঃ)-এর বিদায় হজ্জ কিরান হজ্জই ছিল।–(মেশকাত শরীফ)
.
হজ্জের আহকাম
হজ্জের ফরয তিনটিঃ
১. ইহরাম বাঁধা বা আনুষ্ঠানিকভাবে হজ্জের নিয়্যত করা।
২. আরফাতে অবস্থান ৯ই যিলহজ্জের সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে ১০ই যিলহজ্জের ফজরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় মূহূর্তের জন্য হলেও।
৩. তাকওয়াফে যিয়ারত, ১০ই যিলহজ্জের ভোর হতে ১২ই যিলহজ্জ পর্যন্ত যে কোন দিন কা’বা শরীফ তাওয়াফ করা।
এ তিনটি ফরযের একটি যদি ছুটে যায় তবে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে এবং পরবর্তী বছরে তার ক্বাযা আদায় করা ফরয হয়ে যাবে।
.
হজ্জের ওয়াজিবসমূহ
১. মীকাতের আগেই ইহরাম বাঁধা।
২. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে উকূফ করা।
৩. কিরান বা তামাত্তু হজ্জ আদায়কারী ব্যক্তির শোর আদায় করা এবং তা রমী ও মাথা মুণ্ডানোর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা।
৪. সাফা মারওয়ার মধ্যে সাঈ করা এবং সাফা থেকে সাঈ শুরু করা।
৫. মুযদালিফায় অবস্থান করা।
৬. তাকওয়াফে যিয়ারত আইয়্যামে নহরের মধ্যে শেষ করা।
৭. শয়তানকে কংকর মারা।
৮. মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাটা। আগে শয়তানকে কংকর মারা ও পরে মাথা মুণ্ডানো।
৯. মীকাতের বাইরে লোকদের জন্য-তাকওয়াফে সদর বা বিদায়ী তাওয়াফ করা।
এগুলোর কোন একটিও বাদ পড়লে হজ্জ হয়ে যাবে তবে দম দিতে হবে। অর্থাৎ কাফফারা স্বরূপ কোরবানী দিতে হবে।
এছাড়া হজ্জের অন্যান্য কার্যাদি সুন্নাত, মুস্তাহাব বা হজ্জের আদব পর্যায়ের।
.
হজ্জের সুন্নাত
১. মীকাতের বাইরের লোকদের মধ্যে যারা ইফরাদ বা কিরান হজ্জ করেন তাদের জন্যে তাকওয়াফে কুদুম করা।
২. তাকওয়াফে কুদূমে রমল করা। এ তাকওয়াফে রমল না করে থাকলে তাকওয়াফে যিয়ারত অথবা বিদায়ী তাকওয়াফে তা করে নিতে হবে।
৩. ইমামের জন্য তিন স্থানে খুৎবা প্রদান করা। অর্থাৎ ৭ই যিলহজ্জ মক্কা মুকাররমায়, ৮ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতে মিনায় অবস্থান।
৪. ৮ই যিলহজ্জ দিনগত রাতে মিনায় অবস্থান।
৫. ৯ই যিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফায় গমন।
৬. আরাফাতের ময়দান থেকে ইমামের যাত্রা করার পর রওনা দেয়া।
৭. আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে মুযদালিফায় রাত যাপন করা।
৮. আরাফাতে গোসল করা।
৯. মিনার কাজকর্ম সম্পাদনকালে মিনায় রাত্রি যাপন করা।
১০. মিনা থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে মুহাস্সাব নামক স্থানে স্বল্পক্ষণের জন্যে হলেও অবস্থান করা।
.
মীকাত
হজ্জের মীকাত বিভিন্ন দেশের হাজীদের জন্যে বিভিন্ন। তাই এক এক দিক থেকে আগত হাজীদেরকে এক একটি মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাঁধতে হয়।
মীকাত সীমার বাইরের লোকদের জন্য মীকাত পাঁচটিঃ
১. যুল হুলায়ফা বা বীরে আলী–মদীনাবাসী ও মদীনার পথে হজ্জে আগমনকারীদের জন্য।
২. যাতে ইক-ইরাকবাসীদের এবং সেদিক থেকে আগমনকারীদের জন্য।
৩. জুহফা-সিরিয়াবাসীদের এবং সেদিক থেকে আগতদের জন্য।
৪. কারণ–নজদবাসী এবং নজদের দিক থেকে আগমনকারীদের জন্যে।
৫. ইয়ালামলাম-ইয়ামনবাসী এবং বাংলাদেশ, পাক-ভারত উপমহাদেশ তথা প্রাচ্য থেকে সাগর পথে আগত হজ্জযাত্রীদের জন্যে।
নবী করীম (ছ.)-এর হাদীসে এ মীকাত নির্ধারণ করা হয়েছে।–(হিদায়া ও কিতাবুলু হাজ্জ)
মীকাতের ভেতরে অথচ হারাম শরীফ এলাকার বাইরে বসবাসকারীদের জন্য সমগ্র হিল এলাকাই মীকাতস্বরূপ। অর্থাৎ হারাম শরীফ এলাকার চৌহদ্দীর বাইরের যে কোন স্থান থেকে তাদের ইহরাম বাঁধা চলে। তবে তাদের নিজেদের ঘর থেকে ইহরাম বাঁধাই উত্তম। এমন এলাকার লোকদের প্রত্যেকবারই হারাম শরীফে প্রবেশের জন্যে ইহরাম বাঁধা জরুরী নয়। কেবল হজ্জ ও উমরার জন্যেই তাদের ইহরাম বাঁধা জরুরী, আর যারা হারাম শরীফের সীমানার মধ্যেই অবস্থান করেন তারা হজ্জের জন্যে হারাম শরীফ এলাকার যে কোন স্থানেই ইহরাম বাঁধতে পারেন। তবে উমরার জন্য তাদেরকে হারাম সীমার বাইরে হিল এলাকার যে কোন স্থান থেকে ইহরাম বেঁধে আসতে হবে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এবং তার ভাই হযরত আবদুর রহমানকে উমরার জন্যে তানঈম থেকে ইহরাম বাঁধতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মীকাতের বাইরে বসবাসকারী হজ্জ, উমরা বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে হারাম শরীফে গেলে তার জন্য মীকাত থেকে ইহরাম বেঁধে আসা ওয়াজিব।
.
ইহরাম
নামাযের উদ্দেশ্যে যেমন তাহরীমা বাঁধা হয়, হজ্জের জন্য ঠিক তেমনি ইহরাম বাঁধা হয়। এটি হজ্জের আনুষ্ঠানিক নিয়্যত। তাহরীমা ও ইহরাম একই ধাতু থেকে নির্গত একই অর্থবোধক শব্দ। এ দুটি শব্দের অর্থই হচ্ছে হারাম করা। নামাযী যেমন তার নিয়্যতের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থার হালাল অনেক ব্যাপারই নিজের জন্য হারাম করে নেয়, তেমনি একজন হজ্জযাত্রীও ইহরাম বাঁধার মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় যা তার জন্য বৈধ যেগুলো হজ্জ পালনকালে বা ইহরাম অবস্থায় নিজের জন্য হারাম করে নেন।
ইহরাম বাঁধার আগেই গোঁফ, বগল ও নাভীর নিচের ক্ষৌর কার্যাদি শেষ করে, নখ কেটে, গোসল করে পাক সাফ হয়ে যেতে হয়। এমন কি ঋতুমতী স্ত্রীলোকদেরও এ সময় গোসল করা মুস্তাহাব। (হিদায়া) ইহরামবাঁধার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, আমি নিজে নবী করীম (ছঃ)-এর ইহরাম বাঁধার পূর্বে তাঁকে সুগন্ধি মাখিয়ে দিতাম।–(বুখারী ও মুসলিম)
গোসল করা সম্ভব না হলে ওযূ করে নিলেও হবে। অনুরূপ চুল কাটার দরকার না থাকলে চিরুনী করে চুল বিন্যস্ত করে নিতে হয়। তারপর দু’ রাকাআত নামায ইহরামের নিয়্যতে পড়তে হয়। এতে প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরা কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস মিলানো মুস্তাহাব। ইহরামের দু’ প্রস্ত সেলাইবিহীন কাপড় একটি লুঙ্গির মত এবং অপরটি চাঁদরের মত গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়। কাপড়গুলো নতুন হওয়া উত্তম। (হিদায়া)
কিবলারোখা হয়ে বসা অবস্থায় এ ইহরামের কাপড় দু’টি পরতে হয় এবং ইফরাদ, তামাত্তু বা কিরান অথবা উমরা করার জন্য এ ইহরাম বাঁধা হচ্ছে, তার নিয়্যত করতে হয়। সাথে সাথে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করতে হয় যে, তিনি তা পালন করা সহজ করে দেন এবং কবুল করেন। মুখে নিয়্যতের কথা বলা উত্তম তবে জরুরী নয়। কেননা, নিয়্যত একান্তই অন্তরের ব্যাপার। নিয়্যতের সাথে সাথে তালবিয়া পাঠ করলেই ইহরাম সম্পন্ন হয়।
যদি ইহরাম ইফরাদ হজ্জের জন্য হয় তবে তিনি বলবেনঃ
اللهم إلي أريد الحج فيښژه لئ وتقتله مني
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফাইসসিরুহু লী অ তাকাব্বালহু মিন্নী।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি হজ্জের নিয়্যত করলাম, তুমি তা আমার জন্য সহজসাধ্য করে দাও এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল কর।
যদি কিরান হজ্জ হয় অর্থাৎ হজ্জ ও উমরার জন্য একত্রে নিয়্যত করা হয় তাহলে হজ্জযাত্রী বলবেন।
اللهم إني أريد الحج والعمرة فيسرهمالى وتقبلهمامي
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা অল উ’রাতা ফাইয়াস সিরহুমা-লী অ তাকাব্বাল হুমা-মিন্ন।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি হজ্জ ও উমরার নিয়্যত করছি, তুমি আমার জন্য এগুলো সহজসাধ্য করে দাও এবং কবূল কর।
কেবল উমরার উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধলে নিয়্যতে কেবল হজ্জের নিয়্যতে উক্ত (উরীদুল হাজ্জা)-এর স্থলে Aaj, (উরীদুল উমরাতা) বলতে হবে। তামাত্তু’কারী একবার উমরার জন্যে এবং পরে হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন। একাধিক উমরার ক্ষেত্রে হারাম শরীফ থেকে নিকটবর্তী মীকাত হচ্ছে তাঈম। হারাম শরীফের বাইরে অন্যত্র থেকেও ইহরাম বাঁধা চলে। তবে মক্কাবাসীরা বা বহিরাগত হাজীরা সাধারণত তানঈমে গিয়েই ইহরাম বেঁধে আসেন। ইহরাম বদলী হজ্জের উদ্দেশ্যে হলে দোয়া শেষে 19 Ji (তাকাব্বাল মিন্নী) না বলে ১৭ Ji (তাকাব্বাল মিন) বলে যার বদলে হজ্জ করছেন তার নাম বলতে হবে।
.
ইহরামকারীর করণীয়
ইহরামকারী ইহরাম বাঁধার সাথে সাথেই সশব্দে তিনবার তালবিয়া পাঠ করবেন এভাবেঃ
لبيك اللهم لبيك لا شريك لك لبيك إن الحمد والثمة لك والملك
لا شريك لك
উচ্চারণ : লাব্বাইকা আল্লা-হুম্মা লাব্বাইকা লা-শারীকালাকা লাব্বাইকা ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা-শারীকা লাকা।
অর্থ : হাযির হে আল্লাহ্, তোমার দরবারে হাযির। আমি হাযির, তোমার কোন শরীক নেই। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, সমস্ত নিয়ামত এবং রাজত্ব তোমারই, তোমার কোন শরীক নেই।
তারপর দুরূদ শরীফ পাঠ করে নিজের ইচ্ছেমত দোয়া করবেন। ইহরাম বাঁধার পর এ দোয়া পাঠ করা সুন্নাত।
اللهم اني اسئلك رضاك و الجنة واعوذبك من غضبك و الار
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা রিদ্বোয়াকা ওয়াল জান্নাতা ওয়া আউযুবিকা মিন গাদ্বোয়াবিকা ওয়ান্না-রি।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের আশা করছি এবং তোমার অসন্তুষ্টি ও জাহান্নাম থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।
.
ইহরামকারীর জন্য নিষিদ্ধ কাজ
ইহরামের অবস্থায় নিম্নোক্ত কার্যাদি নিষিদ্ধঃ
১. যৌন মিলন ও সে সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা করা।
২. পুরুষের জন্য সেলাইযুক্ত কাপড় পরা, মহিলাদের জন্য তা নিষিদ্ধ নয়।
৩, মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা, তাঁবু ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়। মহিলারা মাথা ঢাকতে পারেন তবে মুখ অনাবৃতই রাখবেন।
৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫. চুল বা পশম কাটা বা উপড়ানো।
৬. নখ কাটা, তবে ভাঙ্গা নখ ভেঙ্গে ফেলায় ক্ষতি নেই।
৭. কোন পশু শিকার করা। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :
۸, , , ۸ و م م م و
به پایها الذين آمنوا لا تقتلوا الصيد و انتم حرم
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! ইহরামরত অবস্থায় শিকার করো না।–(সূরা মায়িদা, ৫ঃ ৯৫)
তদ্রুপ শিকারকে হাঁকানো বা কাউকে দেখিয়ে শিকারের কাজে সহযোগিতা করা বা যবেহ করাও নিষিদ্ধ।
৮. নিজের দেহ বা মাথা থেকে উকুন বা উকুনজাতীয় প্রাণী বধ করা। সাপ, মশা, মাছি, ডাশ, গিরগিটি, ইঁদুর, পাগলা কুকুর ইত্যাদি মারা দুরুস্ত আছে।
.
ইহরামের মাকরূহ বিষয়
১. শরীর থেকে ময়লা পরিষ্কার করা, মাথা অথবা দাড়ি ও শরীর সাবান দিয়ে থোয়া।
২. মাথায় চুল বা দাড়ি চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো। এমনভাবে ওগুলো চুলকানোও মাকরুহ যাতে উকুন পড়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয়।
৩. দাড়ি খিলাল করাও মাকরুহ, তবে দাড়ি পড়ে যায় না এমনভাবে খিলাল করায় কোন ক্ষতি নেই।
৪. লুঙ্গি অর্থাৎ নিম্নাঙ্গের কপড়ের সামনের দিক থেকে সেলাই করা। তবে কেউ সতর ঢাকার নিয়্যতে এরূপ করলে দম ওয়াজিব হয় না।
৫. গিরা দিয়ে চাদর অথবা লুঙ্গি পরা, সুঁই পিন ইত্যাদি লাগানো বা সূতা ও দড়ি দিয়ে তা বাঁধা।
৬. সুগন্ধি ধরা বা ঘ্রাণ নেওয়া, সুগন্ধি লাভের উদ্দেশ্যে সুগন্ধি বিক্রেতার দোকানে বসা, সুগন্ধিযুক্ত ফল অথবা ঘাসের ঘ্রাণ নেয়া।
৭. মাথা ও মুখ ব্যতীত শরীরের অন্যান্য অংশে প্রয়োজন ছাড়া পট্টি বাঁধা। প্রয়োজনে পট্টি বাধা মাকরূহ নয়।
৮. কা’বা শরীফের পর্দার নিচে এমনভাবে দাঁড়ান যে তা মাথায় বা মুখে লেগে যায়।
৯. লুঙ্গি কে ফিতা লাগাবার মত ভাঁজ করে তা সূতা বা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
১০. নাক, থুতনী ও গাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। হাত দিয়ে ঢাকা দুরুস্ত।
১১. বালিশের উপর মুখ রেখে উপুর হয়ে শোয়া। মাথা বা গাল বালিশে রাখায় ক্ষতি নেই।
১২. রান্নাবিহীন সুগন্ধি খাবার খাওয়া। তবে রান্না করা সুগন্ধি খাবার মাকরূহ নয়।
.
তাওয়াফ ও তার ফযীলত
হজ্জের অন্যতম কাজ হল, বায়তুল্লাহ্ শরীফের তাওয়াফ করা। তাওয়াফ শব্দের অর্থ চতুর্দিকে চক্কর দেয়া। হজ্জের কার্যাদির মধ্যে যদিও আরাফায় অবস্থান করা প্রধানতম রুকন কিন্তু সে তো মাত্র একদিনের ব্যাপার। হজ্জে সবচাইতে বেশি যে কাজটি করা হয়ে থাকে তা হচ্ছ এই তাওয়াফ। তাই এ তাওয়াফ সম্পর্কে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় রয়েছে। এর নিয়মকানুন, প্রকারভেদ এবং মাসয়ালা মাসায়েল প্রত্যেক হজ্জযাত্রীর জানা থাকা উচিত।
তাকওয়াফের ফযীলত অনেক। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা বায়তুল্লাহ শরীফের উপর প্রতিদিন একশ বিশটি রহমত নাযিল করেন, তন্মধ্যে ষাটটি কেবল তাওয়াফকরীদের উপর, চল্লিশটি সেখানে নামায আদায়কারীদের উপর এবং অবশিষ্ট বিশটি ঐ সব লোকের উপর যারা বায়তুল্লাহ্ দর্শনে রত থাকে। অন্য এক হাদীসে তাকওয়াফের প্রতি কদমে একটি গুনাহ্ মাফ হওয়া, একটি নেকী লাভ করা ও একটি মর্যাদা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ রয়েছে।
নামায বা অন্যান্য ইবাদত পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে আদায় করা যায়, কিন্তু তাওয়াফ এমনি একটি ইবাদত যা কেবল বায়তুল্লাহ্ শরীফে হাযির হয়েই আদায় করতে হয়। এ হিসাবে আমলটির এক ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।
.
তাকওয়াফের নিয়ম পদ্ধতি
হাজরে আসওয়াদকে ডানদিকে রেখে ডান কাঁধ হাজরে আসওয়াদের পশ্চিম প্রান্তের কাছে রেখে সেইমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে নামাযের তকবীরে তাহরীমা উচ্চারণকালীন অবস্থার ন্যায় দু’হাত দুলে এ দোয়া পড়তে হয়।
بسم الله الله أكبر لا إله إلا الله ولله الحمد و الشلوة و الشتم على رسول الله اللهم إيمانا وصديقا كتاب ووفاء بعهدك و اتباعا لسنة نبيك محمد صلى الله عليه وسلم
উচ্চারণ : বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবারু লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অ লিল্লা-হিল্ হামদু অচ্ছলা-তু অস্ সালা-মু আলা-রাসূলিল্লা-হি। আল্লা-হুম্মা ইমা-নামবিকা অ তাছদীক্বান্ বিকিতা-বিকা অ ওয়াফা-আন বিআহদিকা অত্তিবা-’আন্ লিসুন্নাতি নাবিয়্যিকা মুহাম্মাদিন্ ছল্লা ল্লা-হু আলাইহি অ সাল্লিম্।
তাকওয়াফের সময় কা’বা শরীফের সম্মুখস্থ ঘেরাও দেয়া হাতীম নামক অংশটিও প্রদক্ষিণ করতে হয়। এর ভিতর দিয়ে গেলে তাওয়াফ পূর্ণ হবে না, কেননা, এ অংশটিও কা’বা শরীফের অন্তর্ভুক্ত।
তাকওয়াফের সময় কোন নির্দিষ্ট দোয়া পড়ার কথা নেই। তবে এ সময়টি দোয়া ও যিকিরের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় দোয়া কবুল হয়। তবে হাদীসে দুটি দোয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। একটি হাজরে আসওয়দ ও রুকনে ইয়ামানীর মধ্যপথ অতিক্রম করার সময়। আর তা হলো :
ربنا اتنا في الدنيا حسنة وفي الآخرة حسنة وقنا عذاب النار
উচ্চারণ : রব্বানা–আ-তিনা ফিদুনইয়া–হাসানাতাঁও অফিল আ-খিরাতি হাসানাতাও আকিনা–আযা-বান্না-র।
অর্থ :হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখিরাতে মঙ্গল দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্না থেকে রক্ষা করুন। অপর দোয়াটি হাজরে আসওয়াদ ও হাতীমের মধ্যখানে পড়তে হয়। আর তা হলো :
اللهم قيرغنى بما رزقتنى وبارك لي فيه واخلف على گل غائبة لي بخير إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شئ قدير
উচ্চারণ : আল্লা–কাননি’নী বিমা–রাযাক্বতানী অ বা-রিকলী ফীহি ওয়াখলুফ আলা-কুল্লি গায়িবাতিন লী বিখাইরিন লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু লাহুল মুলকু অলাহুল হামদু অহুয়া আলা-কুল্লি শাইয়িন কাদীর।
অর্থ :হে আল্লাহ্! আমাকে যা দান করেছেন তাতে আমাকে তুষ্ট রাখুন এবং তাতে বরকত দিন। আমার সন্তান-সন্তুতি ও ধনসম্পদ যা আমার সামনে নেই, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে আপনিই আমার স্থলবর্তী হোন, একক লা-শরীক আল্লাহ্ ছাড়া অপর কোন ইলাহ্ বা উপাস্য নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং সকল স্তুতিও তাঁরই এবং তিনি সব কিছুর উপর শক্তিমান।
বিশ্বখ্যাত হিদায়া গ্রন্থে ইমাম মুহাম্মদ (রঃ)-এর মাবসূত’-এর বরাতে লিখিত হয়েছে যে, হজ্জের বিভিন্ন স্থানে কোন দোয়াকে সুনির্দিষ্ট করা ভাল নয়। হাজী তার প্রয়োজন ও রুচি মোতাবেক যা ভাল মনে করেন তাই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে আরয করবেন। গতানুগতিক দোয়া কালামের মধ্যে অনেক সময়ই অন্তরের আকুতির অভিব্যক্তি ঘটে না। তবে তাকওয়াফের দোয়ারূপে প্রচারিত দোয়াগুলোর অধিকাংশই রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) থেকে বর্ণিত মাসূরা দোয়া যদিও সেগুলো তাকওয়াফের জন্যেই কেবল নির্ধারিত নয়। যদি কারো দোয়াগুলো মুখস্থ থাকে এবং এগুলোর অর্থ বুঝে বুঝে তিনি পড়েন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তাকওয়াফের মধ্যে বই খুলে বা কোন মু’আল্লিমের সাহায্যে তা আওড়াতেই হবে তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই উপমহাদেশের মুক্তীয়ে আযম মুফতী মুহাম্মদ শফী (র.) বলেন, তার চাইতে নিজের ভাষায় নিজের মনের আকুতি প্রকাশই বরং উত্তম।–(আহকামুল হাজ্জ অল উমরা)
তাকওয়াফের পর দু’রাকাত নামায আদায় করা ওয়াজিব। (হিদায়া)
তাওয়াফ নফল হলেও ঐ দু’রাকাত নামায ওয়াজিব। এ দু’রাকাত মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে আদায় করা সুন্নাত ও উত্তম।–(বুখারী-মুসলিম)।
মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে নামায আদায় করার এ নির্দেশটি স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে দিয়েছেনঃ
واتخذوا من مقام ابرهيم مصلى
অর্থ : তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ কর। –(সূরা বাকারা, ২৪ ১২৫)
এ আয়াতের নির্দেশ অনুসারে মাকামে ইব্রাহীমের যত নিকটবর্তী স্থানে নামায আদায় করা যায় ততই উত্তম। তবে ভিড়ের কারণে কিছু দূরবর্তী স্থানে নামায আদায় করলেও ক্ষতি নেই। তবে হারাম ওয়াক্তসমূহে (সূর্যোদয়, সূর্যাস্তকাল এবং ঠিক মাথার উপর যখন সূর্য থাকে) নামায আদায় করা যায় না। কিন্তু তাওয়াফ তখনো জায়িয থাকে। তাই কয়েক তাওয়াফ করে প্রতি তাকওয়াফের জন্যে দু’ রাক’আতের নামায আদায় করতে হয়।
তাকওয়াফের দু’রাকাতের নামায মাকামে ইব্রাহীমের নিকট আদায় করা যদি কোনভাবেই সম্ভব না হয় তবে হাতীম বা হারাম শরীফের যে কোন স্থানে তা আদায় করে নেবে। এতে ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। কিন্তু হারামের বাইরে তা আদায় করা মাকরুহ।
পূর্বেই হজ্জের সুন্নাতসমূহের আলোচনায় বলা হয়েছে, তাকওয়াফে কুদূমের প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নাত। তাকওয়াফে কুদূমে তা করা না হলে তাকওয়াফে যিয়ারতে অথবা বিদায়ী তাকওয়াফে তা করে নিতে হবে। রমল করার সময় ইযতিবাও করা সুন্নাত।
তাওয়াফ শেষে যমযম কূপের নিকট গিয়ে বায়তুল্লাহমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে পানি পান করা মুস্তাহাব। পানি পানের শুরুতে বিসমিল্লাহ্ এবং শেষে আল-হামদুলিল্লাহ্ বলাও মুস্তাহাব।
.
ইযতিবা ও রমল
বিখ্যাত ফিকহ্ গ্রন্থ হিদায়া-এ ইযতিবা ও রমল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ইযতিবা হচ্ছে চাদর ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপরে রাখা। অর্থাৎ চাঁদরের দু’ পাশই বাম কাঁধের উপর থাকবে এবং ডান কাঁধ খোলা থাকবে।
আর রমল হচ্ছে চলার সময় মুজাহিদের মত বীরদর্পে দু’ কাঁধ দুলিয়ে দ্রুত চলা।
আর এর পটভূমি হচ্ছে মক্কার মুশরিকরা যখন বলাবলি করছিল যে, ইয়াসরিবের (মদীনার) আবহাওয়া মুসলমানদেরকে দুর্বল ও রুগ্ন করে ফেলেছে। মুশরিকদের এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য নবী করীম (ছঃ) এ নির্দেশ দেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর যুগে এবং পরেও এ বিধান অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। নফল তাকওয়াফে রমল ও ইযতিবা নেই। (হিদায়া)
.
তাকওয়াফের হুকুমসমূহ
তাকওয়াফের আরকান ৩টি
১. তাকওয়াফের অধিকাংশ চক্কর পূর্ণ করা।
২. তাওয়াফ বায়তুল্লাহ্ শরীফের বাইরে মসজিদুল হারামের ভেতরে করা।
৩. নিজে তাওয়াফ করা, কোন কিছুর উপরে সাওয়ার হয়ে হলেও।
তপাওয়াফের শর্ত ৬টিঃ
এ শর্তসমূহের মধ্যে তিনটি সর্বাবস্থায়ই প্রযোজ্য। সেগুলো হচ্ছে, ১. মুসলমান হওয়া, ২. নিয়্যত করা, ৩. তাওয়াফ মাসজিদুল হারামের ভেতরে হওয়া।
অপর তিনটি শর্ত শুধু হজ্জের মধ্যে তাকওয়াফে যিয়ারতের ব্যাপারেই প্রযোজ্য। সেগুলো হচ্ছে, ১. নির্দিষ্ট সময় হওয়া, ২. তাওয়াফ ইহরামের পরে হওয়া, ৩. আর উকূফে বা অবস্থান আরাফার পর হওয়া।
তাকওয়াফের ওয়াজিব ৮টিঃ
১. পাক পবিত্র হওয়া।
২. সতর ঢাকা–যে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনাবৃত রাখা নিষিদ্ধ সেগুলো আবৃত রাখা।
৩. সক্ষম ব্যক্তিদের পায়ে হেঁটে তাওয়াফ করা।
৪. নিজের ডান দিকে অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ থেকে বায়তুল্লাহর দরজার দিকে অগ্রসর হওয়া।
৫. হাতীমের বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করা অর্থাৎ হাতীমকে তাকওয়াফের ভেতরে রাখা।
৬. হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ আরম্ভ করা। তবে অধিকাংশ আলিম একে সুন্নাত বলেছেন।
৭. হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ আরম্ভ করা।
৮. তাওয়াফ আরম্ভ করার সময় হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ রাখা।
৯. বিরতি না দিয়ে তাকওয়াফের চক্করগুলো সম্পন্ন করা।
১০. শরীর এবং পরিধেয় বস্ত্র নাজাসাতে হাকীকী থেকে পবিত্র হওয়া।
তাকওয়াফের মুস্তাহাব ১২টিঃ
১. তাওয়াফ হাজরে আসওয়াদের ডান দিক থেকে এমনভাবে আরম্ভ করা যাতে তাওয়াফকারীর গোটা দেহ হাজরে আসওয়াদের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার বরাবর হয়ে যায়।
২. হাজরে আসওয়াদকে তিনবার চুম্বন করা এবং তার উপর তিনবার কপাল ঠেকিয়ে নিজের আকুতি প্রকাশ করা।
৩. তাওয়াফ কালে হাদীসে বর্ণিত দোয়া মাসূরাসমূহ পাঠ করা।
৪. ভিড় না থাকলে এবং কারো কষ্ট হওয়ার আশংকা থাকলে পুরুষদের জন্য বায়তুল্লাহর পাশ ঘেঁষে তাওয়াফ করা।
৫. মহিলাদের জন্য রাতে তাওয়াফ করা।
৬. তাকওয়াফের সময় বায়তুল্লাহর দেওয়ালের নিম্নভাগকেও এতে শামিল করা।
৭. যদি কেউ মাঝপথে তাওয়াফ ছেড়ে দেয় বা মাকরূহ পন্থায় তাওয়াফ সম্পন্ন করে তাহলে পুনরায় প্রথম থেকে তাওয়াফ আরম্ভ করা।
৮. মুবাহ্ বা বৈধ কথাবার্তাও না বলা।
৯. একাগ্রতার বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা।
১০. দোয়া ও যিকির আস্তে আস্তে পড়া।
১১. রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা করা।
১২. আকর্ষণীয় বস্ত্র সামগ্রীর দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা।
.
তাকওয়াফে মুবাহ্ কাজ ৯টি
১. সালাম করা।
২. হাঁচি দেয়ার সময় আলহাম-দুলিল্লাহ্’ বলা।
৩. শরীয়াত সংক্রান্ত মাসয়ালা জানতে চাওয়া বা কাউকে জানিয়ে দেয়া।
৪. প্রয়োজনবশত কথা বলা।
৫. কোন কিছু পান করা।
৬. নির্দোষ কবিতা আবৃত্তি।
৭. পাক সাফ জুতা পরিহিত অবস্থায় তাওয়াফ আরম্ভ করা।
৮. ওযরবশত তাকওয়াফে সাওয়ারীর সাহায্য নেয়া।
৯. কোরআন তিলাওয়াত নিঃশব্দে করা।
.
তাকওয়াফে নিষিদ্ধ কাজ ৯টি
১। গোসল ফরয অবস্থায় বা হায়েয ও নিফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা।
২. বিনা ওযরে কারো কাঁধে চড়ে বা সাওয়ারী হয়ে তাওয়াফ করা।
৩. বিনা ওযূতে তাওয়াফ করা।
৪. বিনা ওযরে হাঁটুতে ভর দিয়ে বা উল্টোভাবে তাওয়াফ করা।
৫. হাতীমকে বাদ দিয়ে তাওয়াফ করা অর্থাৎ হাতীমের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাওয়া।
৬. তাকওয়াফের কোন এক চক্কর বা তার একাংশ ত্যাগ করা।
৭. হাজরে আসওয়াদ ছাড়া অন্য কোন জায়গা থেকে তাওয়াফ আরম্ভ করা।
৮. তাকওয়াফের সময় বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করা। অবশ্য শুরুতে হাজরে আসওয়াদকে সম্মুখে রেখে দাঁড়ানোর কথা স্বতন্ত্র।
৯. তাকওয়াফের কোন ওয়াজিব তরক করা।
.
তাকওয়াফের মাকরূহ ১৫টি
১. অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা।
২. ক্রয়-বিক্রয় বা সে সংক্রান্ত বাক্যালাপ।
৩. হামদ-নাত বিহীন কবিতা আবৃত্তি, কোন কোন আলিম সাধারণভাবে কবিতা আবৃত্তিকেই মাকরূহ্ বলেন।
৪. দোয়া অথবা কুরআন তিলাওয়াত এত উচ্চস্বরে করা যাতে অন্যদের নামাযে বা তাকওয়াফে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।
৫. নাপাক কাপড় পরিহিত অবস্থায় তাওয়াফ করা।
৬. রমল অথবা ইযতিবা বিনা ওযরে ছেড়ে দেয়া।
৭. হাজরে আসওয়াদের চুম্বন না করা।
৮. তাকওয়াফের চক্করসমূহের মধ্যে অধিক বিরতি।
৯. নামাযের মাকরূহ সময় ছাড়া অন্য সময় দু তাকওয়াফের মাঝে নামায আদায় না করে দু তাকওয়াফের নামায একত্রে আদায় করা।
১০. তাকওয়াফের নিয়্যতকালে তাবীর না বলেই দু হাত উপরে উঠানো।
১১. খুতবা বা ফরয নামাযের জামায়াত আরম্ভের সময় তাওয়াফ করা।
১২. কোন কিছু খাওয়া।
১৩, পেশাব-পায়খানার বেগ নিয়ে তাওয়াফ অব্যাহত রাখা।
১৪. ক্ষুধার্ত ও ক্রুদ্ধ অবস্থায় তাওয়াফ করা।
১৫. তাকওয়াফের সময় নামাযের মত হাত বেঁধে রাখা বা কাঁধে হাত তুলে রাখা।
.
তাকওয়াফের প্রকারভেদ
তাওয়াফ ৭ প্রকার। এর মধ্যে প্রথম ৩ প্রকার হজ্জের সাথে সম্পৃক্ত।
১. তাকওয়াফে কুদুম–মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী লোকদের থেকে যারা শুধু হজ্জ অথবা কিরান আদায় করবে তাদের জন্যে এই তাওয়াফ সুন্নাত। মক্কা শরীফে প্রবেশ মাত্রই এ তাওয়াফ করতে হয়।
২. তাওয়ফে যিয়ারাত–এ তাওয়াফ ফরয। আর তা ১০ই যিলহজ্জের সুবহে সাদিক হতে ১২ই যিলহজ্জের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা ওয়াজিব। এতে রমল ও ইযতিবা আছে। যদি ইহরাম খুলে ফেলে, তবে ইযতিবা লাগবে না। এ তাকওয়াফের পর সাঈ করতে হয়। তবে তাকওয়াফে কুদূমে রমল ও সাঈ করে থাকলে পুনরায় রমল ও সাঈ করবে না।
৩. বিদায়ী তাওয়াফ বা তাওয়াফে সদর–মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী হাজীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে এ তাওয়াফ করা ওয়াজিব, একে তাওয়াফে সদরও বলা হয়ে থাকে। এ তাওয়াফে রমল ও ইযতিবা বা এরপর সাঈ নেই।
অপর ৪ প্রকার তাওয়াফ হচ্ছে :
৪. উমরার তাওয়াফ–এ তাওয়াফ উমরার বেলায় রুকন ও ফরয। এতে ইযতিবা ও রমল এবং পরে সাঈ করতে হয়।
৫. মানতের তাওয়াফ–এ তাওয়াফ মানত হজ্জ পালনকারীদের মধ্যে ওয়াজিব।
৬. তাওয়াফে তাইয়্যা-মসজিদুল হারামের প্রবেশকারীর জন্যে এ তাওয়াফ মুস্তাহাব, তবে কেউ অন্য কোন প্রকার তাওয়াফ করে থাকলে সেটিই তার জন্য উক্ত তাওয়াফের স্থলাভিষিক্ত হবে।
৭. নফল তাওয়াফ–এ তাওয়াফ যখন ইচ্ছা আদায় করা যায়। এ তাওয়াফে রমল, ইযতিবা নেই এবং সাঈও নেই।
.
সাঈ
সাঈ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ দৌড়ানো। হজ্জের পরিভাষায় সাঈ হচ্ছে, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে বিশেষ নিয়মে সাত চক্কর দৌড়ানো। এটা হজ্জের অন্যতম ওয়াজিব। সাঈ পায়ে হেঁটে করতে হয়। ওযরবশত বাহনের সাহায্যও নেয়া যায়। তবে বিনা ওযরে বাহন ব্যবহার করলে দম দেয়া ওয়াজিব হবে।
সাঈ-এর রুকন
সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাঈ করাই সাঈ-এর রুকন। কেউ সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাঈ করে এদিক ওদিন করলে সাঈ সহীহ্ হবে না।
সাঈ-এর শর্তসমূহ
সাঈ-এর শর্ত ৬টিঃ
১. নিজেই সাঈ করা। অবশ্য কারো কাঁধে চড়ে অথবা কোন পশুর উপর সাওয়ার হয়ে অথবা অন্য কোন বাহনে আরোহণ করে সাঈ করলেও শর্ত পূর্ণ হয়ে যাবে। সাঈর মধ্যে প্রতিনিধিত্ব দুরুস্ত নেই। তবে কেউ ইহরামের পূর্বে সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলে এবং সাঈর সময় পর্যন্ত সংজ্ঞা ফিরে না পেলে তার পক্ষ হতে অপর কোন ব্যক্তি সাঈ করতে পারবে।
২. পূর্ণ তাওয়াফ অথবা তাকওয়াফের অধিকাংশ চক্কর শেষ করার পর সাঈ করা। কেউ তাকওয়াফের চার চক্কর পূর্ণ করার পূর্বে সাঈ করলে সাঈ সহীহ্ হবে না।
৩. সাঈ-এর পূর্বে হজ্জ অথবা উমরার ইহরাম বাঁধতে হবে। কেউ ইহরামের পূর্বে সাঈ করলে তা তাকওয়াফের পরে হলেও সহীহ্ হবে না।
৪. সাঈ সাফা হতে শুরু করে মারওয়াতে সমাপ্ত করতে হবে। কেউ মারওয়া হতে শুরু করলে প্রথম চক্কর সাঈ হিসেবে গণ্য হবে না।
৫. সাঈ-এর অধিকাংশ চক্কর শেষ করা। কেউ অধিকাংশ চক্কর শেষ না করলে সাঈ আদায় হবে না।
৬. সাঈ-এর নির্ধারিত সময়ে সাঈ শেষ করা। এটি হজ্জের সাঈ-এর জন্য শর্ত।
উমরার সাঈ-এর জন্য শর্ত নয়। অবশ্য হজ্জে কিরান বা তামাত্তু আদায়কারী ব্যক্তি উমরা পালন করলে তার উমরার সাঈ-এর জন্যও নির্ধারিত সময় হওয়া শর্ত। হজ্জের সাঈ-এর সময় হচ্ছে হজ্জের মাসসমূহ শুরু হওয়া।
সাঈ-এর ওয়াজিবসমূহ
সাঈ-এর ওয়াজিব ৬টিঃ
১. এমন তাকওয়াফের পর সাঈ করা যা জানাবাত অথবা হায়েয ও নেফাস হতে পবিত্র অবস্থায় করা হয়েছে।
২. সাঈ সাফা হতে শুরু করা এবং মারওয়াতে শেষ করা।
৩. যদি কোন ওযর না থাকে, তবে পায়ে হেঁটে সাঈ করা। যদি বিনা ওযরে সাওয়ার অবস্থায় সাঈ করে তবে দম ওয়াজিব হবে।
৪. সাত চক্কর পূর্ণ করা। অর্থাৎ ফরয চার চক্করের পর আরো তিন চক্কর পূর্ণ করা। যদি কেউ এই তিন চক্কর ছেড়ে দেয়, তবে সাঈ সহীহ্ হবে, কিন্তু প্রতি চক্করের পরিবর্তে পৌনে দু’ সের গম অথবা এর মূল্য সাদাকা করা ওয়াজিব।
৫. উমরার সাঈ-এর ক্ষেত্রে উমরার ইহরাম সাঈ শেষ করা পর্যন্ত বহাল থাকা।
৬. সাফা এবং মাওয়ার মধ্যবর্তী পূর্ণ দূরত্ব অতিক্রম করা।
সাঈ-এর সুন্নাতসমূহ সাঈ-এর সুন্নাত ৯টিঃ
১. হাজরে আসওয়াদের ইস্তিলাম করে সাঈ-এর উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হওয়া।
২. তাকওয়াফের পর পরই সাঈ করা।
৩. সাফা ও মারওয়ার উপরে আরোহণ করা।
৪. সাফা ও মারওয়ার উপরে আরোহণ করে ক্বিবলারেখা হওয়া।
৫. সাঈ-এর চক্করসমূহ পরপর সমাপন করা।
৬. জানাবত এবং হায়েয থেকে পবিত্র হওয়া।
৭. এমন তাকওয়াফের পরে সাঈ করা যা পবিত্র অবস্থায় শেষ করা হয়েছে এবং কাপড়, শরীর ও তাকওয়াফের জায়গাও পবিত্র ছিল আর ওযূও বহাল ছিল।
৮. সবুজ বাতিদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে দ্রুত চলা।
৯. সতর ঢাকা।
সাঈ-এর মুস্তাহাবসমূহ
সাঈ-এর মুস্তাহাব ৫টিঃ
১. নিয়্যত করা।
২. সাফা ও মারওয়া-এর উপরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা।
৩. বিনয় ও নম্রতা সহকারে তিন তিনবার করে যিকির ও দোয়া পড়া।
৪. সাঈ-এর চক্করগুলোর মধ্যে যদি বিনা ওযরে বেশি ব্যবধান হয়ে যায় অথবা কোন চক্করে বিলম্ব হয়ে যায়, তাহলে নতুন করে সাঈ আরম্ভ করা।
৫. সাঈ শেষ করার পরে মসজিদে গিয়ে দু’ রাক’আত নফল নামায আদায় করা।
সাঈ-এর মাকরূহ কাজসমূহ
১. সাঈ-এর অবস্থায় এমন ধরনের ক্রয়-বিক্রয় এবং কথাবার্তা বলা যার দরুন মনের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায় এবং দোয়া কালাম করতে অসুবিধা হয় অথবা সাঈ-এর চক্করগুলো লাগাতার সমাপন করা সম্ভব হয় না।
২. সাফা ও মারওা-এর উপর আরোহণ না করা।
৩. বিনা ওযরে সাঈকে তাওয়াফ হতে অথবা কোরবানীর দিনগুলো হতে বিলম্বিত করা।
৪. সতর খোলা অবস্থায় সাঈ করা।
৫. সবুজ বাতিদ্বয়ের মাঝখানে তাড়াতাড়ি না চলা।
৬. চক্করগুলোর মধ্যে অধিক ব্যবধান করা।
সাঈ-এর সুন্নাত তরীকা
যে তাকওয়াফের পর সাঈ করতে হয় তা শেষ করে অষ্টমবারের মতো হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করে তাওয়াফ সমাপ্ত করে নবমবার সাঈ-এর জন্যে চুম্বন করা মুস্তাহাব। তারপর বাবু সাফা দিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে প্রথমে সাফা পাহাড়ের নিকটে পৌঁছে
أبدأ بما بدأ الله به ان الصفا والمروة من شعائر الله
উচ্চারণ : আরদা-বিমা-বাদাল্লা-হু বিহি ইন্না ছছফা–অলমারওয়াতা মিন্ শা’আ-মিরিল্লা-হ্।
আল্লাহ্ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমিও তা দিয়েই শুরু করছি। সাফা ও মারওয়া নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম বলে সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে কা’বা শরীফের দিকে তাকিয়ে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে তিনবার হামদ ও সানা পড়ে উচ্চস্বরে তিনবার তাকবীর ও তাহলীল (আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) উচচারণ করবে। তারপর দুরূদ শরীফ পড়বে। তারপর নিজের জন্য ও সকলের জন্য দোয়া করবে।
নিম্নরূপে দোয়া করলে একত্রে সবগুলো আদায় হয়ে যেতে পারে?
الله اكبر الله أكبر الله أكبر ولله الحمد الحمد و على ما هد إن الحمد لله على ما أدينا الحمد لله على ما ألهمنا الحمد له الذي هدانا لهذا وما كنا لنهتدي لولا أن هدانا الله لا اله الا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد يحيي ويميت وهو حي لا يموت بيده الخير وهو على گل شي قوي–
إله إلا الله وحده صدق وعده لا إله إلا الله و نعبد إلا إياه مخلصين له الين ولو كره الكفرون–اللهم كما هديتى الإسلام اسئلك إلا تزعه متى حتى توقان وانا مسلم
شبين الله والحمد إله إلا الله و الله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله العلي العظيم. اللهم هي على سيدنا محمد وعلى أيم وصحبه وتباعه إلى يوم الين . اللهم اغفرلي ولوالدي ولمشایخی وللمسلمين أجمعين وشم على المرسلين والحمد لله رب
উচ্চারণ : আল্লা-হু আকবারু আল্লা-হু আকবারু আল্লাহু আকবারু অলিল্লা-হিল্ হামদু আল হামদুলিল্লা-হি আলা-মা-হাদা-না–আল্হামদু লিল্লা-হি আলা-মা–আদ্দাইনা–আল্ হামদু লিল্লা-হি আলা–মা–উল হিমনা–আলহাম-দু লিল্লা-হীল্লাযী হাদা-না–লি হা-যা–অমা–কুন্না লিনাহ্তাদী লাওলা–আন্ হাদা নাল্লা-হু লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারীকালাহু লাহু লাহুল মুলকু অলাহু হাম্দু ইউহ্য়ী অ ইউমীতু অহুয়া হাইয়ু লা–ইয়ামুতু বিয়াদিহিল্ খাইরু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু ছদাক্বা ওয়াদাহু লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অলা-না’বুদু ইল্লা-ইয়্যা-হু মুখলিছিনা লাহুদ্দীনা অলাওকারিহাল কা-ফিরুন–আল্লা-হুম্মা–কামা–হাদাইতানী লিল্ ইসলামি আসআলুকা আল্লা–তানযাহু মিন্নী হাত্তা–তাওয়া ফ্ফানী–অ আনা মুসলিমূন্।
সুবহা-নাল্লা-হি অলহামদু লিল্লা-হি লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু আকবার অলা-হাওলা অলা-কুওয়াতা ইল্লা-বিল্লা-হিল আলিয়্যল আজীম্। আল্লা-হুম্মা ছল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন্ অ আলা–আ-লিহী অছোয়াহ বিহী লিত্তিবা–ইহি ইলা–ইয়াও মিদ্দীন। আল্লা-হুম্মাগফিরলী অলিওয়ালি দাইয়্যা অলিমাশায়িখী অলি মুসলিমীনা আজ্বমাঈনা অ সালা-মু আলাল মুরসালীনা অল্ হামদু লিল্লা-হিরব্বিল আলামীন।
এছাড়া প্রয়োজনীয় অন্যান্য দোয়া ও তালবিয়া পড়া যায়। পঁচিশ আয়াত তিলাওয়াত পরিমাণ সময় সেখানে দাঁড়াবে। তারপর দোয়া দরূদ করতে করতে স্বাভাবিক গতিতে সাফার দিকে অগ্রসর হবে। সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী সবুজ চিহ্নিত স্থানে পৌঁছে গতি দ্রুত করবে এবং এ দোয়াটি পড়বে :
رب اغفر وارحم أنت الأعتر والإكرم
উচ্চারণ : রব্বিগফির ওরহা ওয়া আন্তা আআয্যু অল্ আকরাম্।
তবে মহিলাদের জন্যে এখানে দ্রুতগতিতে দৌড়ের মত অতিক্রম করার এ বিধান প্রযোজ্য নয়। সবুজ চিহ্নিত স্থানটুকু অতিক্রম করার পর পুনরায় স্বাভাবিক গতিতে অবশিষ্ট স্থান অতিক্রম করে মারওয়া পর্যন্ত পৌঁছবে। তারপর পাহাড়ের উপরে আরোহণ করে একটু ডান দিকে ঝুঁকে বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দাঁড়াবে এবং সেখানেও সাফা পাহাড়ের কার্যাদির অনুরূপ করবে। সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত গমনে একটি চক্কর তারপর পুনরায় সাফায়, আবার মাওয়ায় এভাবে সাতবার সম্পন্ন করার পর মসজিদুল হারামে গিয়ে দু’রাক’আত নামায আদায় করবে।
এ নামায মাতাফ বা তাকওয়াফের স্থানের নিকটে আদায় করা মুস্তাহাব।
.
জ্ঞাতব্য
সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে আরোহণের সময় একেবারে শীর্ষ দেওয়াল পর্যন্ত উঠা মকরূহ হজ্জের সাঈ তাকওয়াফে কুদূমের পরে এবং তামাত্তুর সাঈতে তালবিয়া পাঠ করবে না। সাত চক্করের প্রথম চারটি ফরয এবং বাকীগুলো পূর্ণ করা ওয়াজিব। পরবর্তী চার চক্কর আদায় না করলে প্রতি চক্করের বদলে পৌনে দুই সের করে গম বা উহার মূল্য সাদক করা ওয়াজিব।
সাঈ চলাকালে নামাযের জামায়াত বা জানাযা শুরু হলে সাঈ অপূর্ণ রেখেই তাতে যোগ দিতে হবে। অসম্পূর্ণ সাঈ পরে পূর্ণ করবে। সাঈসমূহের মধ্যে তেমন ব্যবধান সৃষ্টি করে না এমন পানাহার বা একাগ্রতা নষ্ট করে না এমন প্রয়োজনীয় কথাবার্তা মুবাহ্ বা বৈধ।
সাঈ যদি হজ্জের হয় আর তা আরাফায় অবস্থানের পূর্বে হয়, তাহলে তা ইহরাম পরিহিত অবস্থায় হবে। আরাফায় অবস্থানের পরে হলে ইহরাম না থাকাই মুস্তাহাব। সাঈ তাকওয়াফের অধীন, তাই তাকওয়াফের পরেই করতে হয়।–(হিদায়া)
.
রমী করা
রমী শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, নিক্ষেপ করা বা কোন কিছু ছুঁড়ে মারা। হজ্জের পরিভাষায় রমী হচ্ছে, মিনায় শয়তানের উদ্দেশ্যে কংকর নিক্ষেপ করা। এটি ১০ই যিলহজ্জে মিনায় প্রথম করণীয় ওয়াজিব।
হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্ (আঃ) যখন তাঁর প্রিয় শিশুপুত্র হযরত ইসমাঈলকে নিয়ে তাকে কুরবানী করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন, তখন শয়তান মিনার তিনটি স্থানে তাকে কুপ্ররোচনা দিয়ে পিতার কুরবানীর মহৎ উদ্দেশ্যকে পণ্ড করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে ঐ তিনটি স্থানেই শয়তানকে তাড়ানো হয়েছিল। হজ্জের রমীর বিধান দ্বারা সেই পবিত্র স্মৃতিকে জাগরূক রাখা হয়েছে।
আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে মুযদালিফা থেকে ১ম দিন অর্থাৎ ১০তারিখে শয়তানকে নিক্ষেপের কাঁকর কুড়িয়ে নেয়া মুস্তাহাব। অন্য স্থান থেকে এ কাঁকর নিলেও চলে। তবে জামারা বা কংকর নিক্ষেপের স্থান থেকে নেয়া উচিত নয়। কেননা, হাদীসে আছে, জামারায় পড়ে থাকা কাকরগুলো হচ্ছে ঐসব কাঁকর যেগুলো কবুল হয় নি। ককূল হওয়াগুলো ফিরশতারা উঠিয়ে নেয়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের নিক্ষেপের পাথর মুযদালিফা থেকে নেয়া সুন্নাত নয়। (যুবদাহ্ এর বরাতে আহকামুল হজ্জ ওয়াল উমরা)।
জামারা বা কংকর নিক্ষেপের স্থান ৩টিঃ
১. জামারাতুল আকাবা ও মক্কার দিকে মসজিদুল খাইফের সবচেয়ে নিকটবর্তী কংকর নিক্ষেপ স্থল। একে জামারাতুল উখরা এবং জামারাতুল কুবরাও বলা হয়। ১০ই যিলহজ্জ এখানের সাতবার কংকর নিক্ষেপ করে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দিতে হয়। অন্য দু’ জামারায় ঐ দিন কংকর নিক্ষেপ করতে নেই। করলে তা বি’আত হবে।
২. জামারাতুল উস্তা বা মধ্যম জামারা।
৩. জামারাতুল উলা বা প্রথম জামারা।
১১ ও ১২ই যিলহজ্জ তারিখে প্রতিটি জামারাই ৭টি করে কংকর মারতে হয়। তারপর মিনা ত্যাগ করা চলে। কিন্তু ১৩ তারিখ পর্যন্ত মিনায় রয়ে গেলে ১৩ তারিখেও তিন জামারাই কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১০ তারিখে মিনায় আসার পর সর্বপ্রথম রমী করাই মুস্তাহাব।
১২ই যিলহজ্জের সুবহে সাদিক পর্যন্ত জামারাতুল আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করা না হলে দম ওয়াজিব হয়ে যায়।
জামারার অন্তত পাঁচ হাত দূরে থেকে যতটুকু উঁচু করলে বগল অনাবৃত হয়ে যায় ততটুকু হাত উঁচু করে কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। পাঁচ হাতের কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে কংকর নিক্ষেপ মকরূহ। বেশি দূরত্বে ক্ষতি নেই। কংকর খেজুর বীচি বা ছোলার আকারে হওয়া চাই। মুযদালিফা থেকে ৭০টি কংকর কুড়িয়ে নেয়া মুস্তাহাব। বড় পাথর ভেঙ্গে ছোট করা মাকরূহ।
বৃদ্ধাঙ্গুলি ও শাহাদত অঙ্গুলি দিয়ে ধরে কংকর মারা মুস্তাহাব। শরীয়গ্রাহ্য ওযরের কারণে একজনের রমী অন্যজনেও করতে পারেন। তবে নিজের রমী’ শেষ করে অন্যেরটা করতে হয়। একই সময়ে নিজের পক্ষ থেকে একটি এবং অন্যের পক্ষ থেকে আরেকটি ককংকর নিক্ষেপ মাকরূহ। মিনাকে বাম দিকে ও কা’বা শরীফকে ডান দিকে রেখে কংকর নিক্ষেপ করতে হয় এবং সাথে সাথে এরূপ বলা মুস্তাহাবঃ
بسم الله الله اكبر رغما للشيطان رضى الرحمين اللهم اجعله
حجامبرورا وذنبا مغفورا وسعيا مشكورا
উচ্চারণ : বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার রাগমান্ লিশ শাইত্বায়া-নি রিদ্বোয়ান্ লিররাহমান–আল্লা-হুম্মা জ্ব আলহু হাজ্জন মাবরূরান অযাম্বান্ মাগফুরান্ অ সা’ইয়ান মাশকুরা-।
.
কোরবানী
কিরান ও তামাত্তু হজ্জ আদায়কারীদের উপর কোরবানী ওয়াজিব। ইফরাদ হজ্জ আদায়কারী ব্যক্তির জন্য তা মুস্তাহাব।
মিনায় জামারাতুল আকাবায় ১০ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপের পর এ কোরবানী আদায় করতে হয়। কিরান বা তামাত্তুকারী হাজীর যদি কোরবানী দেয়ার সঙ্গতি না থাকে, তবে আরাফার দিনের পূর্বেই তিনটি রোযা রাখবে এবং পরে দেশে ফিরে আরও সাতটি রোযা নিজের সুবিধামত সময়ে রাখবে। আরাফাতের দিন পর্যন্ত তিনটি রোযা রাখতে না পারলে কোরবানী দেয়াই ওয়াজিব হবে এবং সে কোরবানী না দিয়েই কসর বা হলক করে ফেললে আরেকটি কোরবানী–মোট দু’টি কুরবানী আদায় করা ওয়াজিব হবে।–(আহকামুল হাজ্জ ওয়াল উমরা, সূত্র : (যুবদাতুল মানাসিক))
.
কুরবানীর নিয়ত ও দোয়া
لوتى وشكي ومحياي ومماتي لله رب
اللهم وث وإليك ا العلوين. شريك له وبذلك أمرت وأنا أول المسلمين. اللهم تقبل من من بين ممكن–بسم الله الله اكبر.
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা মিনকা ওয়া ইলাইকা ইন্না ছলা-তী ওয়া নুসুকী, ওয়া মাহইয়া-ইয়া ওয়া মামাতী, লিল্লা-হি রব্বিল আলামীন। লা-শারীকালাহু ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু ওয়া আনা আউয়্যাল মুসলিমীন। আল্লা-হুম্মা তাকাব্বাল মিন্ ফুলানিবনি ফুলানিন। বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার।
কোরবানীর অংশ ও গোশত বন্টন
ভেড়া, বকরী ও দুম্বা এক নামে একটি দিতে হবে। আর উট, গরু ও মহিষ একটিতে সাত নামে কুরবানী করা জায়েয আছে। তবে সাত নামের কম অংশেও কোরবানী করা দুরুস্ত হবে। কোরবানীর অংশের সাথে আকীকার অংশ দেয়াও জায়েয আছে।
কোরবানীর গোশতের তিনের এক অংশ গরীবদেরকে দান করবে। আর তিনের এক অংশ আত্মীয় স্বজনকে দেবে, বাকী এক অংশ নিজের জন্য রাখবে, তবে প্রয়োজনে এর ব্যতিক্রম করা জায়েয আছে।
কোরবানীর পশুর চামড়া পাকা করে জায়নামাযস্বরূপ ব্যবহার করা দুরুস্ত আছে, তবে তা বিক্রি করে গরীবকে দান করে দেয়া উত্তম। আর মান্নত কোরবানীর গোশত নিজেরা খাবে না। তা গরীবদেরকে বন্টন করে দেবে অথবা রান্না করে তাদেরকে খাওয়াবে। কোন ধনী লোককে দেবে না, এটা দুরুস্ত নেই।
.
হলক ও কসর
হলক হচ্ছে মাথা মুণ্ডানো এবং কসর হচ্ছে চুল ছাটা। হলক কেবল পুরুষের ব্যাপারেই প্রযোজ্য। মহিলাদের জন্য মাথা মুণ্ডন করা হরাম। চুল ছাটা নারী-পুরুষ সকলের জন্যেই বৈধ। সম্পূর্ণ মাথার চুল আঙ্গুল পরিমাণ ছাঁটতে হয়। এক-চতুর্থাংশ চুল ছাঁটলেও ছাঁটা হয়ে যায়। হলক করাতে যেহেতু পূর্ণ বিনয় প্রকাশ পায়, তাই দুররুল মুখতার’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে, পুরুষের জন্য পূর্ণ মাথায় হলক করা উত্তম।
তামাত্তু হজ্জ আদায়কারীরা তাকওয়াফে কুদূমের পর সাঈ অন্তে মাথা মুণ্ডন করে বা চুল হেঁটে ইহরাম মুক্ত হয়ে যাবে।
৮ই যিলহজ্জ তারিখে হজ্জের ইহরাম বাঁধার পর ১০ই যিলহজ্জে জামারাতুল আকাবায় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ ও কুরবানী আদায়ের পর আবার মাথা মুণ্ডন করে বা চুল হেঁটে ইহরাম মুক্ত হওয়া বিধেয়। কুরবানী না দিয়ে হলক করা বা চুল ছাঁটা নাজায়েয। হলক করা বা চুল ছাঁটা ১২ তারিখ পর্যন্ত বিলম্বিত করাও। কোরবানী ও হলক বা কসর করে ইহরামমুক্ত হলেও ১২ তারিখ তাকওয়াফে যিয়ারত না করা পর্যন্ত যৌন সম্ভোগ করা নাজায়েয। কোরবানীর পর ১২ তারিখ পর্যন্ত হক, কর, ক্ষৌর কার্যাদি করা ওয়াজিব, না করলে দম দোয়া ওয়াজিব হবে।
.
হজ্জের ব্যস্ততম ৫ দিন (৮ই যিরহজ্জ থেকে ১২ই যিলহজ্জ)
৭ই যিলহজ্জ যোহরের ছলাতের পরে মসজিদুল হারামের ইমামের হজ্জের আহকাম অর্থাৎ পরবর্তী পাঁচ দিনের করণীয় সম্পর্কে খুৎবা প্রদান সুন্নাত। হাজীদের তা মনোযোগ সহকারে শোনা এবং সে ভাবে আমল করা উচিত।
অনুরূপ বর্ণনা সংক্রান্ত খুৎবা ইমাম আরাফাতের ময়দানের মসজিদে নামিরায় ৯ই যিলহজ্জ তারিখে এবং মিনার মসজিদুল খায়ফে ১১ই যিলহজ্জ তারিখে দেবেন।
তামাত্তু হজ্জ আদায়কারীরা যারা ইতিপূর্বে তাকওয়াফের ইত্যাদি সম্পন্ন করে ইহরাম খুলে ফেলেছিলেন এবং মক্কা শরীফের অধিবাসীরা ৮ই যিরহজ্জ তারিখে উযূ গোসল করে দু’ রাকাআত নফল নামায আদায় করে ইহরাম বাঁধবে এবং তালবিয়া পাঠ আরম্ভ করবে। এ ইরাম মসজিদুল হারামে বাঁধা মুস্তাহাব। হরম সীমানার অন্য কোথাও বেঁধে নেওয়াও দুরুস্ত আছে। ৮ তারিখের পূর্বেও কেউ ইহরাম বাঁধবে এবং তালবিয়া পাঠ শুরু করবে। এ ইম মসজিদুল হারামে বাঁধা মুস্তাহাব। হরম সীমানার অন্য কোথাও বেঁধে নেওয়াও জায়েয। তারিখের পূর্বেও কেউ ইহরাম বাঁধতে চাইলে তাতে আপত্তি নেই।
এ তারিখে যে ইহরাম বাঁধবে তিনি যদি তাকওয়াফে যিয়ারতের পূর্বেই হজ্জের সাঈ সেরে নিতে চান তাহলে তাঁকে ইযতিবা ও রমলসহ একটি নফল তাওয়াফ করেই সাঈ করতে হবে। পরে আর তাওয়াফে যিয়ারতের পর তার সাঈ করার প্রয়োজন নেই। তবে সাঈ তাওয়াফে যিয়ারতের পরে করাই উত্তম।
৮ই যিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর মিনায় যেতে হবে। সুন্নাত অনুযায়ী গোসল করে ইহরামের চাদর পরে মসজিদুল হারামে আসবে। মুস্তাহাব হলো যে, এক তাওয়াফ করবে এবং দ্বিতীয় তাওয়াফ আদায়ের পর ইহরামের জন্য দু’রাকাআত নামায আদায় করে এভাবে হজ্জের নিয়্যত করবেঃ
اللهم اني اريد الحج فيسره لى وتقبله وی
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী-উরীদুল হাজ্জা ফাইয়াসৃসি রুহলী–অতাক্বাবালহু মিন্নী।
ইফরাদ ও কিরান হজ্জের জন্যে নতুন ইহরামের প্রয়োজন নেই।
ইহরাম ও নিয়্যতের সঙ্গে সঙ্গেই তালবিয়া পাঠ করতে করতে মক্কা শরীফ থেকে তিন। মাইল দূরবর্তী মিনায় চলে যেতে হবে। পরবর্তী দিন অর্থাৎ ৯ই যিলহজ্জ ফজর পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা সুন্নাত। ৮ই যিলহজ্জের দিবাগত রাত মক্কা শরীফে অবস্থান বা সরাসরি আরাফাতে গিয়ে পৌঁছা মাকরূহ।–(আহ্কামুল হজ্জ অল উমরাহ)।
৮ই যিলহজ্জ তারিখটি শুক্রবারে হলে দুপুরের আগেও মিনায় যাওয়া চলে। তবে দুপুর পর্যন্ত না গেলে মক্কা শরীফেই জুমু’আ আদায় করা ওয়াজিব এবং জুমু’আর নামায আদায় না করে মিনায় যাওয়া নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য, হজ্জের দিনগুলোতে মিনায় জুমু’আর নামায আদায় করা যায়। মিনায় মসজিদুল খায়ফের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করা মুস্তাহাব।–(তিরমিযী)
৯ই যিলহজ্জ হচ্ছে আরাফাত দিবস। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন : adge–হজ্জ হচ্ছে আরাফাত। ঐ দিন সকালেই হজ্জের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রুকন উকুফে আরাফা’ এর উদ্দেশ্যে মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হয়।
দ্বিপ্রহরের পূর্বে গোসল বা অন্তত উযূ করে ময়দানে যাওয়া মুস্তাহাব। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার সাতে সাথেই মসজিদে নামিরায় ইমাম মুয়াযযিনের আযান শেষে খুতবা শুরু করবেন। সে খুৎবায় হজ্জ, কুরবানী, হলক, কসর, মিনায় কংকর নিক্ষেপ, তাওয়াফে যিয়ারত প্রভৃতি করণীয় বিষয়সহ বিশ্ব মুসলিমের করণীয় বিষয়াদি সম্পর্কে সকলকে অবহিত করবেন। বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করবেন। তারপর ঐ একই আযানে এবং দু’ এক্বামতে পর পর যোহর ও আসরের জামা’আত সম্পন্ন হবে। ঐ একটি ক্ষেত্রে যোহরের নামাযের সাথে যোহরের সময়সীমার মধ্যেই আসরের নামাযও জামাআতে একসাথে আদায় করার বিধান। ইমাম মুকীম হলে উভয় নামাযই পূর্ণ চার রাকা’আত করে আদায় করেন, তবে হানাফী মতে ঐ নামায ইমামের পেছনে আদায় করা জায়েয হবে না। তাই নিজেদের তাবুতেই যোহর ও আসরের সময় পৃথক পৃথকভাবে এ নামায আদায় করতে হবে। উভয় নামায একসাথে আদায়ের ক্ষেত্রে মাঝখানে বা যোহরের পূর্বে সুন্নাত পড়ার বিধান নেই।
নামাযের আদায়ের পর মাগরিব পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানের যে কোন স্থানে অবস্থান করা এবং যতদূর সম্ভব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দোয়া দুরূদ ও কান্নাকাটি করা মুস্তাহাব। তবে বসা অবস্থায় বা অন্য যে কোন অবস্থায় অবস্থান করা জায়েয। এ সময় সশব্দে তাবীর, তাহ্লীল ও তালবিয়া ঘন ঘন পাঠ করবে। আরাফাতের ময়দানের দোয়া কবুল হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে সর্বোত্তম হজ্জ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বলেন, সর্বোত্তম হজ্জ হচ্ছে জোরে জোরে তালবিয়া বা অন্যান্য দোয়া করা এবং কোরবানীর রক্ত প্রবাহিত করা।
হাদীস শরীফে আছেঃ
أن النبي صلى الله عليه وسلم مازال يلبي حتى اتي جمرة
العقبة
অর্থ : নবী করীম (ছঃ) জামারাতুল আকাবায় যাওয়া পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করতে থাকতেন। -(আবূ দাউদ, তিরমিযী)
উকূফ বা আরাফাতে অবস্থানকালে দোয়া দাঁড়িয়ে ও হাত তুলে করা সুন্নাত। ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে যাবেন এবং হাত নামিয়েই দোয়ায় রত থাকবেন। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি হাত উঠিয়ে তিনবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লা-হিল হামদ উচ্চারণ করে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করেছেন :
إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد اللهم اهدني
بالهدى وتنى بالتقوى و اغفرلى في الآخرة والأولى
উচ্চারণ : লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু লাহুল মুলকু অ লাহুল হামদ। আল্লা-হুম্মা ইহুদিনী বিল্ হুদা–আনাক্বক্বিনী বিত্তাক ওয়া-ওয়াগফিরলী ফিল আ-খিরাতি অল উলা-।
অর্থ :আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং সমস্ত প্রশংসাও তারই। হে আল্লাহ্! তুমি আমাকে হিদায়তের পথ দেখাও এবং তাকওয়া দ্বারা আমাকে পরিচ্ছন্ন কর এবং আমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষমা কর। এ দোয়া পড়ার পর আলহাম-দু সূরা পাঠের পরিমাণ সময়ের জন্য হাত ছেড়ে দিয়ে পুনরায় হাত তুলে বারবার এ দোয়া করতে হয়।–(যুবদাহ)
রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, আরাফাতের দিন যে সব দোয়া আমি পাঠ করি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীরা করেছেন তন্মধ্যে সর্বোত্তম দোয়া হচ্ছে।
لا إله إلا الله وحده لاشريك له له الملك وله الحمد وهو على كل
شيئ قدير
উচ্চারণ : লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারীকালাহু লাহুল মুলকু অ লাহুল হামদু অ হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।–(তিরমিযী, আহমাদ)
এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি আরাফাতের দিন উকূফকালে ক্বিবলামুখী হয়ে উল্লিখিত দোয়া একশত বার, একশত বার সূরা ইখলাস এবং একশত বার দুরূদ–
اللهم صلى على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم
وعلى أل ابرايم إنك حميد مجيد وعلينا معهم.
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ছল্লি আলা-মুহাম্মাদিওঁ অ’আলা-আ-লি মুহাম্মাদ, কামা-ছাল্লাইতা আলা–ইব্রাহীমা অআলা–আ-লি ইব্রাহীম ইন্নাকা হামীদুম্ মাজীদুন্ অআলাইনা মা আহুম।
পড়বে। আল্লাহ তা’আলা তখন বলেন, হে আমার ফিরিশতাকূল আমার এ বান্দার কী প্রতিদান পেতে পারে, যে তাসবীহ, তাহলীল ও তামজীদ তথা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে আমার হামদ ও সানা পাঠ করেছে, ও আমার নবীর প্রতি দুরূদ পড়েছে? জেনে রেখো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। তার নিজের ব্যাপারে প্রার্থিব সবকিছু তাকে দিয়ে দিলাম, তার দোয়াসমূহ কবূল করলাম। আর আমার বান্দা যদি সমগ্র আরাফাতে অবস্থানকারীদের জন্যও সুপারিশ করে, তাহলেও আমি তা কবুল করব।
মোটকথা, আরাফাতের ময়দানে দুনিয়া ও পরকালীন যাবতীয় মঙ্গলের জন্যে নিজের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব গোটা মুসলিম জাতি তথা গোটা বিশ্ববাসীর হিদায়াত ও রহমতের জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করা উচিত।
দোয়া কবুলের এমন সুযোগ জীবনে আর নাও আসতে পারে। মাগরিবের পূর্বে আরাফাত ত্যাগ করলে দম ওয়াজিব হবে। (যুবদাহ)
.
মুযদালিফায় রাত্রিযাপন
সূর্যাস্তের পর ইমামের আরাফাত ত্যাগের পর মুযদালিফার পথে যাত্রা করতে হবে। কোরআন শরীফে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :
فإذا أفضتم من عرفت قاذكروا الله بين المشعر الحرام
আরাফাত থেকে ফেরার মাশআরুল হারাম’-এর নিকট তথা মুযদালিফায় পৌঁছে তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করবে।–(সূরা বাকারা, ২ঃ ১৯৮)
ইমাম আযম আবু হানীফা (রঃ)-এর মতে, মুযদালিফাতে রাত যাপন করা ওয়াজিব–যা বিনা কারণে তরক করলে দম ওয়াজিব হবে। কিন্তু অসুস্থতা বা কোন কারণবশত তথায় অবস্থান না করে মিনায় চলে গেলে কোন দম দিতে হবে না।–(বজলুল মাজহুদ)।
মুযদালিফা থেকে জামারাত সমূহে রমী করার জন্য ৭০টি কংকর কুড়িয়ে নেয়া মুস্তাহাব।
হলক বা কসরের সঙ্গে সঙ্গে বগলের লোম, নাভির নিচ ও নখ ইত্যাদি পরিষ্কার করাও মুস্তাহাব।
তাওয়াফে যিয়ারত–যা হজ্জের অন্যতম রুকন।–(মুসলিম)
ইফরাদ কারীর কোরবানী ওয়াজিব নয় বিধায় কোরবানীর পূর্বেই হলক করলেও দম ওয়াজিব হয় না। অন্যদের তারতীব বা ক্রমের ব্যতিক্রম করলে দম ওয়াজিব হবে।
তাওয়াফে যদি প্রথম তিনটির পূর্বেও করে ফেলে তবে দম ওয়াজিব হবে না। তবে সুন্নাতের খেলাফ হবে।
তাওয়াফে যিয়ারত ১২ তারিখের সূর্য ডুবার পূর্ব পর্যন্ত দেরী করা জায়েয।
১১ ও ১৩ই যিলহজ্জ তিন জামারায়-ই ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১৩ তারিখ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করলে ১৩ তারিখেও তদ্রূপ কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। তবে সাধারণত হাজী সাহেবরা ১২ তারিখেই মক্কা শরীফে চলে যান।
যে তাড়াতাড়ি করে দু’দিনে চলে যেতে চায়, তাতে তার গুনাহ্ হবে না। আর যে বিলম্বিত করবে, তারও কোন গুনাহ্ হবে না। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) ১০ তারিখেই তাওয়াফে যিয়ারত সম্পন্ন করে পুনরায় মিনায় চলে যান এবং ১১ ও ১২ তারিখ তিন জামারায়-ই কংকর মারেন।
১১ ও ১২ তারিখে অথবা ১৩ তারিখে কংকর নিক্ষেপ করবে সূর্য ঢলে পড়ার পর। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) যোহরের পর তিন জামারায়ই ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেন এবং জামারাতুল আকাবা’ ছাড়া অপর দু’ জামারায়ই অনেকক্ষণ অবস্থান করে তাকবীর, তাহলীল ও দোয়া দুরূদ করেছেন, কিন্তু জামারাতুল আকাবায়’ অবস্থান করেন নি।–(হিদায়া)।
তারপর মক্কা শরীফে গিয়ে তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করলে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। তবে বর্তমানে মোটর গাড়িতে চলতে হয় এবং ভিড়ের মধ্যে ইচ্ছেমত আসা বা যাওয়ার সুযোগ খুব কমই থাকে। এ অক্ষমতার জন্যে যেতে না পারলেও কোন অসুবিধা নেই।–(যুবদাহ, সূত্র : আহকামুল হাজ্জ ওয়াল উমরা)
মক্কা শরীফে ফেরার পথে মুহাসসাব’ নামক স্থানে কিছুক্ষণ থাকা মুস্তাহাব।
.
তাওয়াফে বিদা
তাওয়াফে বিদা বহিরাগতদের জন্যে ওয়াজিব। বিদায়ী তাওয়াফের পরও যদি কোন কারণে মক্কা শরীফে থাকতে হয়, তবে বিদায়কালে পুনরায় তাওয়াফ করা মুস্তাহাব।-(যুবদাহ)
বিদায়ী তাওয়াফের সময় কোন মহিলা ঋতুবতী বা নেফাসগ্রস্ত হলে তার উপর এ তাওয়াফ ওয়াজিব নয়। তার উচিত মসজিদে প্রবেশ না করে দরজার নিকট দাঁড়িয়ে দোয়া করে যাত্রা করা।–(হায়াতুল কুলুব)
বিদায়ী তাওয়াফের পূর্বে মক্কা শরীফে থাকাকালে অধিকবার তাওয়াফ উত্তম নাকি পুনরায় উমরা করা উত্তম এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে প্রখ্যাত ফকীহ্ মোল্লা আলী কারী (রঃ) অধিক তাওয়াফকে অধিকতর ছাওয়াবের কাজ বলেছেন। তবে কেউ উমরা করতে চাইলে নিকটবর্তী মীকাতে গিয়ে ইহরাম বেঁধে আসতে হবে।–(আহকামুল হাজ্জ ওয়াল উমরা)।
.
বদলী হজ্জ
বিখ্যাত ফিকহ গ্রন্থ হিদায়া-র ভাষ্যমতে, এবাদতসমূহ বিভিন্ন প্রকার।
১. একান্তভাবে আর্থিক–যেমন যাকাত,
২. একান্তভাবে দৈহিক–যেমন নামায,
৩. দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের মিশ্রণ-যেমন হজ্জ।
ইচ্ছাকৃতভাবে বা কারণবশত প্রয়োজনে উভয় অবস্থায়ই প্রথম ধরনের এবাদতে প্রতিনিধিত্ব করা চলে। কেননা, প্রতিনিধি দ্বারা কার্য সম্পাদনের মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের এবাদতে প্রতিনিধিত্ত চলে না। কেননা, এ জাতীয় এবাদতের উদ্দেশ্য দৈহিক ক্লেশবরণ, অতএব এতে প্রতিনিধি দ্বারা উদ্দেশ্য সাধিত হয় না।
তৃতীয় প্রকারে সামর্থ্য থাকলে প্রতিনিধিত্ব চলে না। কেননা, তাতে শারিরীক ক্লেশবরণ অনুপস্থিত। তবে অক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব চলে। তার জন্য শর্ত হচ্ছে আমৃত্যু স্থায়ী অসমর্থ।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে :
إن امرأة من خشم قالت يا رسول الله إن أبی شي كبير عليه فريضة اللي في الحج وهو لا يستطيع أن يشتوى على ظهر بعيره فقال النبي صلى الله عليه وتم حجى عثة
অর্থ : খাশ আম গোত্ৰীয় জনৈক মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমার পিতা অতি বৃদ্ধ। তার উপর আল্লাহর ফরযকৃত হজ্জ অনাদায় অবস্থায় রয়েছে। অথচ তিনি তাঁর উটের উপর সোজা হয়ে বসতেও পারেন না। তখন নবী করীম (ছঃ) বললেন, তাহলে তুমিই তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করে নাও।
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও হজ্জ আদায়ের বিধান রয়েছে। হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে আছেঃ
إن امرأة من جهينة جائث إلى النبي صلى الله عليه وسلم
فقالت ان ای ندرت آن تح قلم تحج كی ماتث أقام ها قال حي عثها رأيت وكان على أتم وين أكثت قاضية أقضوا الله فالله أحق بالوفاء
অর্থ : জুহায়না গোত্রীয় জনৈক মহিলা নবী করীম (ছঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমার মা হজ্জের মানত করেছিলেন, কিন্তু তা আদায়ের পূর্বেই তিনি ইতিকাল করেছেন। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ করবো? জবাবে নবী করীম (ছঃ) বললেন, হ্যাঁ। তার পক্ষ থেকে তুমি হজ্জ করবে। আচ্ছা, যদি তার কোন ঋণ থাকতো, তাহলে কি তুমি তার ঋণ পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর ঋণ পরিশোধ কর। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলাই পাওনা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার।
বলাবাহুল্য, মানতের হজ্জের ক্ষেত্রে যেখানে বদলী হজ্জ করার আদেশ হুযুর (ছঃ) দিয়েছেন, সেখানে ফরয হজ্জের ব্যাপারটির গুরুত্ব যে কত বেশি, তা সহজেই অনুমেয়।
যে ব্যক্তি নিজে হজ্জ করেনি, তার দ্বারা বদলী হজ্জ করানো মাকরূহু তানযিহী। এমন ব্যক্তি যদি হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও হজ্জ না করে থাকে, তবে তার দ্বারা বদলী হজ্জ করানো মাকরূহ তাহরীমী অর্থাৎ হারামের কাছাকাছি পর্যায়ের।–(বাজলুল মাজহূদ)।
উত্তম হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজে হজ্জ করেছে এমন ব্যক্তিকে দিয়ে বদলী হজ্জ করানো। -(শরহে মুসলিম)
যে সমস্ত কারণে বদলী হজ্জ করানোর প্রয়োজন হয়, সেগুলো হচ্ছে।
১. মৃত্যু, ২. বন্দীত্ব ৩. জীবনে আরোগ্য লাভের আশা নেই, এমন পীড়া যেমন পক্ষাঘাত, অন্ধত্ব, ৪. খোঁড়া হয়ে যাওয়া, ৫. এত বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া, যাতে বাহনের উপর বসারও ক্ষমতা থাকে না, ৬. মহিলাদের জন্যে সাথে মাহরাম না থাকা, ৭. পথের নিরাপত্তা না থাকা।
উপরোক্ত কারণসমূহ আমৃত্যু থাকা অক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার শর্ত। চোখে ছানি পড়া, পা মচকে যাওয়া ইত্যাদি অস্থায়ী বা সাময়িক কারণ বদলী হজ্জের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ মৃত্যুর পূর্বে দূর হয়ে গিয়ে হজ্জ পালনের অক্ষমতা দূর হয়ে গেলে নিজে হজ্জ করা ওয়াজিব হবে। অবশ্য যদি এমন রোগের কারণে বদলী হজ্জ করানো যায়, যা সচরাচর ভাল হয় না যেমন অন্ধত্ব, তবে ওর অবস্থা প্রক্বতিগতভাবে দূর হয়ে গেলে পুনরায় হজ্জ করা ওয়াজিব হবে না। হজ্জ করতে রওয়ানা দেয়ার পর কার মৃত্যু হলে তার বদলী হজ্জেরও প্রয়োজন নেই। হাদীস শরীফে আছে, এমন ব্যক্তির আমল নামায় কিয়ামত পর্যন্ত প্রতি বছরই হজ্জের ছাওয়াব লিখিত হতে থাকবে।
কারণবশত আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে যেতে পারেন নি, তার উচিত মৃত্যুর পূর্বে ওয়ারিসদেরকে বদলী হজ্জের জন্য অসিয়্যত করে যাওয়া। যদি অসিয়ত করে না যায়, তবে ওয়ারিসদের উপর তার জন্যে বদলী হজ্জ করানো ওয়াজিব হবে না বটে, তবে এমতাবস্থায় যদি তার আওলাদ বা ওয়ারিস বদলী হজ্জের ব্যবস্থা করে, তবে তার হজ্জ আল্লাহ্ তা’আলা গ্রহণ করে নেবেন বলে আশা করা যায়।–(মু’আল্লিমুল হুজ্জাজ)
.
হজ্জে বাধাপ্রাপ্ত হলে
পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে :
واتيمموا الحج والعمرة لوقان أحصرتم فما اشتيسر من الهدى
হজ্জ ও উমরাহ্ পূর্ণ কর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। কিন্তু তোমরা যদি বাধাপ্রাপ্ত হও, তবে সহজলভ্য কোরবানী আদায় করবে। (সূরা বাকারা, ২ঃ ১৯৬)
এ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া (ইহসার) দু’ ধরণের হতে পারে। একটি হলো রোগ জাতীয় বাধা। আরেকটি শত্রু বা প্রতিপক্ষ শক্তির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। ইমাম আযম হযরত আবু হানীফা (রঃ)-এর মতে উভয় বাধাই ইহসার এর মধ্যে গণ্য।-(মেশকাত)।
মুফতী আযম মুহাম্মদ শফী (রঃ) উল্লিখিত আয়াতের প্রেক্ষাপট বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেন, এ আয়াতটি হুদায়বিয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) ও সাহাবীরা তখন ইহরাম অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু মক্কার কাফেররা তাঁদেরকে হরম সীমানায় প্রবেশ করতে দেয়নি। ফলে তাঁরা উমরা আদায় করতে পারেননি। তখন আদেশ হলো ইহরামের ফিদিয়াস্বরূপ একটি করে কোরবানী কর। কোরবানী করে ইহরাম ভেঙ্গে ফেল। কিন্তু সাথে সাথে পরবর্তী আয়াত :
ولا تلقوا ؤگم حتى يبلغ الهدى مجلة
যে পর্যন্ত কোরবানীর পশু তার নির্ধারিত স্থানে না পৌঁছে তোমরা মাথা মুণ্ডন করবে না। (সূরা বাকারা, ২ঃ ১৯৬) এ আয়াত দ্বারা বলে দেওয়া হয়েছে যে, মাথা মুণ্ডন করা ততক্ষণ পর্যন্ত জায়েয নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কোরবানীর পশু যথাস্থানে না পৌঁছবে।
ইমাম আযম আবু হানীফা (রঃ)-এর মতে কোরবানীর নির্ধারিত স্থান হচ্ছে হরমের সীমানা। নিজে সেখানে পৌঁছতে না পারলে অন্যের সাহায্যে পৌঁছাতে হবে ও যবেহ করাতে হবে। এ আয়াতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে শত্রু কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হওয়া বা প্রাণনাশের আশংকা থাকা। কিন্তু ইমাম আযম আবু হানীফা (রঃ) অসুস্থতা জনিত অপারগতাকেও এর আওতাভূক্ত করেছেন। তবে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, কোরবানী করেই ইহরাম ছাড়তে হবে। কিন্তু বাতিলক্বত হজ্জ বা উমরা ক্বাযা করা ওয়াজিব। যেমনটি রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) ও সাহাবীরা পরবর্তী বছর উল্লিখিত উমরার ক্বাযা আদায় করেছিলেন।–(মা’আরিফুল কোরআন)
হযরত ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে,
خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم قال كفار قريش تون البيت قتر النبي صلى الله عليه وسلم هديه وحلق وقصر أصحابهة
অর্থ : তোমাদের মধ্যে কেউ হজ্জ করতে বাধাগ্রস্ত হলে সে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও সাফা মারওয়ার সাঈ করবে। তারপর সে সবকিছু থেকে হালাল হয়ে পরের বছর হজ্জ করবে। (সাঈর পর) সে কোরবানীর পশু যবেহ্ করবে অথবা রোযা রাখবে যদি কোরবানীর পশু না পায়। -(বুখারী শরীফ)
অর্থাৎ আরাফাতে পৌঁছে হজ্জ করতে বাধা হলে সে তাওয়াফ ও সাঈ করে একে উমরার রূপ দান করবে।–(মেশকাত (বঙ্গানুবাদ), ৫ম খণ্ড পৃঃ ৩৫২)
.
হজ্জের ত্রুটি-বিচ্যুতি
হজ্জ পালনকালে অনিচ্ছায়ও অনেক সময় ত্রুটি-বিচ্যুতি বা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে যায়। এগুলোকে হজ্জের পরিভাষায় জিনায়াত বলা হয়। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতির কোনটি গুরুতর আবার কোনটি একান্তই মামুলি ধরণের। এ ত্রুটির গুরুত্ব ও লঘুত্ব অনুসারে এগুলোর প্রতিবিধানেও প্রার্থক্য রয়েছে। তাই কোন ত্রুটির জন্যে পূর্ণ একটি গরু বা উট কাফফারাস্বরূপ কোরবানী দিতে হয়। একে হজ্জের পরিভাষায় বুদনা বলা হয়। বুদনা কেবল দুটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
১. জানাবত (গোসল ফরয) অবস্থায় অথবা ঋতুবতী ও নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করলে।
২. উকুফে আরাফার পরে মুণ্ডনের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে।
কোন কোন ত্রুটির ক্ষেত্রে প্রতিবিধানস্বরূপ সাধারণভাবে দম দিতে বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে একটি বকরী, ভেড়া বা দুম্বা কোরবানী করা। উট বা গরুর এক-সপ্তমাংশও হতে পারে।
কোন কোন ক্ষেত্রে একের অধিক দমও দিতে হয়। যেমন ইহরাম অবস্থায় কিরান পালনকারী হাজীকে তার ত্রুটির জন্য হজ্জ ও উমরার একত্রে নিয়্যতের কারণে উমরার পূর্বেই দু’টি দম দিতে হয়।
সাধারণভাবে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলো বা হারাম এলাকায় নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে প্রতিবিধান স্বরূপ দম আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সাদাকা দিতে হয়। সাদাকারও আবার তিন প্রকার। কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য সাদাকা দিতে হয়। তা এক দু’মুষ্টি গম দিয়েও আদায় হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে পৌনে দু’ সের (১ কেজি ৭৫০ গ্রাম) গম বা আটা, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সাড়ে তিন সের (৩ কেজি ৫০০ গ্রাম) গম বা আটা সাদাকা দিতে হয়।
.
ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতিবিধান
১. কোন সুস্থ মস্তিষ্ক ও বালেগা ইহরামকারী যদি কোন বড় অঙ্গ যেমন মাথা, উরু, দাড়ি, হাত, হাতের তালু প্রভৃতি যে কোন একটিতে পূর্ণাঙ্গভাবে এক অঙ্গের কিছু বেশি স্থানে সুগন্ধি লাগালো, তবে দম ওয়াজিব হবে। আর যদি কোন পূর্ণ অঙ্গে আংশিকভাবে লাগালো অথবা কোন ছোট অঙ্গে যেমন নাক, কান, ঘাড়, আঙ্গুল বা কজায় লাগায় তবে সাদকা ওয়াজিব হবে বা কোন সুগন্ধিযুক্ত ফলের গ্রাণ নেয়ার কারণে কোন কাফফারা ওয়াজিব হবে না। তবে এরূপ করাটা মাকরূহ। অঙ্গ ছোট-বড় হওয়ার কারণে পার্থক্য তখনই হবে যখন সুগন্ধির পরিমাণ বা তীব্রতা কম হবে। কিন্তু কস্তুরীর মত তীব্র সুগন্ধি যে কোন অঙ্গে সামান্য পরিমাণ ব্যবহার করলেও দম ওয়াজিব হবে। ওযরের ক্ষেত্রে তিনটি রোযা রাখা অথবা ছয়টি ফিরা পরিমাণ সাদকাও দেয়া যেতে পারে।–(যুবদাহ)
বিভিন্ন অঙ্গে মাখা সুগন্ধির পরিমাণ একটি বড় অঙ্গের সমপরিমাণ হয়ে গেলে দম ওয়াজিব হবে।–(মু’আলিমুল হুজ্জাজ)
২. যদি অসুস্থতার জন্য সেলাই করা বস্তু পরিধান করে অথবা চুল কেটে বা মাথা অথবা চোহারা ঢাকে অথবা মহিলা কাপড় দ্বারা তার চেহারা এমনভাবে ঢাকে যে, সে কাপড় তার চোহারা স্পর্শ করে এসব অবস্থায় পূর্ণ ত্রুটির ক্ষেত্রে দম দেবে অথবা তিনটি রোযা রাখবে অথবা ছয়জন মিসকীনকে ফিৎরা পরিমাণ সাদকা দেবে। অর্থাৎ পত্যেক মিসকীনকে পৌনে দু সের (১ কেজি ৭৫০ গ্রাম) করে গম বা সমমূল্য দেবে।
পূর্ণ ত্রুটি না হলে তিনটি রোযা রাখবে অথবা ছয়জন মিসকীনকে ফিরা পরিমাণ সাদকা দেবে। তিন অথবা দুটি বিষয়ে শুধু ওযরের অবস্থায় এ সুযোগ রয়েছে। বিনা কারণে করা হলে পূর্ণ ত্রুটির ক্ষেত্রে ম’ এবং আংশিক ত্রুটির সময় সাদকা নির্ধারিত রয়েছে। রোযা দিয়ে কাফফারা হবে না। শায়িত অবস্থায় মাথা ঢেকে গেলে সাদকা ওয়াজিব হবে। এক-চতুর্থাংশ মাথা বা চেহারা ঢাকা সমস্ত মাথা বা চেহারা ঢাকার শামিল।–(যুবদাহ)
৩. সুগন্ধি যুক্ত কাপড় পরলে সুগন্ধির পরিমাণ যদি অধিক হয় আর তা দু বিঘত বা বিঘতের বেশি পরমাণ স্থানে লেগে থাকে এবং যে কাপড় সারা দিন বা সারা রাত পরে থাকে, তাহলে দম ওয়াজিব হবে। সুগন্ধির পরিমাণ সামান্য হলে যা এক দু বিঘতের কম স্থানে লেগেছে এরূপ লেগেছে এরূপ ক্ষেত্রে সাদাক ওয়াজিব হবে। একদিনের কম সময় ধরে পরা ক্ষেত্রেও সাদকা প্রযোজ্য।–(যুবদাহ)
৪. সুগন্ধি মিশিয়ে করা খাবার গ্রহণে কিছুই ওয়াজিব হয় না। অবশ্য খাদ্য গ্রহণকালে সুগন্ধি আসলে তা মাকরূহ হবে। কিন্তু অরান্নাক্বত সুগন্ধি যেমন চাটনী, আচার ইত্যাদিতে যদি অধিক হয় এবং তা থেকে সামান্য পরিমাণ খেয়ে থাকে, তাহলে সাদকা দিতে হবে, যদি সুগন্ধি না আসে। কিন্তু এ ধরনের খাবার কয়েকবার খেয়ে দম ওয়াজিব হবে। কিন্তু রান্না করা ছাড়া খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে যদি সুগন্ধি মিশিয়ে এবং ঐ খাদ্যদ্রব্য অধিক পরিমাণও হয়, তবে অধিক পরিমাণ খেলেও কিছুই ওয়াজিব হবে না। কিন্তু যদি সুগন্ধি আসে তবে মাকরূহ হবে। –(আহকামুল হাজ্জ ওয়াল উমরা)
৫. বোতলে সামান্য সুগন্ধি মিশিয়ে পানীয় এক আধ বার পান করলে সাদকা ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি তা কয়েকবার পান করে, তবে দম ওয়াজিব হবে।
৬. হাজরে আসওয়াদে সুগন্ধি লাগানো থাকলে আর তাতে চুমু দিতে গিয়ে অধিক পরিমাণ সুগন্ধি মুখে বা হাতে লেগে গেলে ইহ্মকারীর উপর দম ওয়াজিব হবে। পরিমাণ কম হলে সাদকা ওয়াজিব হবে।
৭. ইহরাম অবস্থায় মাথা, হাত অথবা দাড়িতে মেহদী লাগান নিষিদ্ধ। যদি পূর্ণ মাথা, ম্পূর্ণ দাড়ি অথবা এক-চতুর্থাংশ মাথা অথবা এক-চতুর্থাংশ দাড়িতে মেহদী লাগান হয়, তবে মেহদী খুব গাঢ় না হলে হালকা হলে দম ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি গাড়ভাবে লাগান হয়, তবে দুটি দম ওয়াজিব হবে, একটি সুগন্ধির কারণে অপরটি মাথা অথবা চেহারা ঢাকার কারণে। কিন্তু মহিলাদের জন্যে একটি দম ওয়াজিব হবে। কেননা, তার জন্যে মাথা ঢাকা নিষিদ্ধ নয়। সম্পূর্ণ হাতের উপর মেহদী লাগালে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দম ওয়াজিব হবে।
ইহরাম অবস্থায় ফুলের মালা গলায় দেয়া মাকরূহ। কিন্তু এতে দম বা সাদকা কিছুই ওয়াজিব হবে না।
৮. পায়ের উপরে মধ্যভাগ পর্যন্ত ঢেকে ফেলে এমন জুতো বা এরূপ মোজা পূর্ণ এক দিন বা পূর্ণ এক রাত পরে থাকা একটি পূর্ণ ত্রুটিরূপে গণ্য বিধায় এ জন্য একটি দম ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি এর চেয়ে কম হয় সাদকা ওয়াজিব হবে। সেলাইকৃত কাপড় পরে ইহরাম বেঁধে বা ইহরাম অবস্থায় পরে এক দিন অথবা এক রাত থাকলে দম ওয়াজিব হবে, এর কম সময় থাকলে সাদকা ওয়াজিব হবে।
৯. এক-চতুথাংশ মাথা বা এক-চতুর্থাংশ দাড়ি অথবা এর চেয়ে বেশি অংশের চুল হক বা কর (মুণ্ডন বা ছাঁটা) করলে অথবা কোন লোমনাশক ঔষধের দিয়ে তুলে ফেললে পূর্ণ ত্রুটিরূপে গণ্য হবে এবং দম ওয়াজিব হবে।
অনুরূপভাবে যদি বগলের লোম পুরোপুরি পরিষ্কার করে ফেলে অথবা নাভির নিচের সমগ্র পশম পরিষ্কার করে ফেলে অথবা সমগ্র গর্দানের চুল কেটে ফেলে, তবে দম ওয়াজিব হবে।
১০. যদি দু’ হাত বা দু পায়ের নখ এক বৈঠকে কাটে অথবা এক পা ও দু হাতের নখ কাটে, তবে পূর্ণ ত্রুটি হবে এবং দম ওয়াজিব হবে। পাঁচ আঙুলের কমের নখ কাটলে প্রতি নখের জন্য সাদকা ওয়াজিব হবে। হাত-পায়ের মিলিয়ে পাঁচটি নখ কাটলেও ঐ হুকুম। –(হেদায়া)
১১. মুহরিম ব্যক্তি অন্যের এক-চতুর্থাংশ বা ততোধিক মাথা মুণ্ডন করলে তার উপর সাদাকা এবং যার মাথা মুন্ডন করেছে তার উপর দম ওয়াজিব হবে।–(হেদায়া)
যদি দু’তিনটি চুল মুণ্ডন করে বা কর্তন করে তবে প্রতিটি চুলের জন্য এক মুঠো গম বা এক টু রুটি সাদকা করবে এবং তিনটি চুলের অধিক হলে একটি ফিৎরা পরিমাণ সাদকা ওয়াজিব হবে।-(যুবদাহ)।
১২. ইহরামের অবস্থায় স্থলজ শিকার, শিকার জন্তুকে আহত করা, তার দুধ বের করা, শিকার করার জন্যে ইঙ্গিত করা বা অন্যকে দেখিয়ে দেয়া, হরমের ঘাস বা গাছ কাটা ইত্যাদি সবকিছুই নিষিদ্ধ। এ সকল অবস্থায় দম ওয়াজিব হবে। কিন্তু এ অবস্থায় গৃহপালিত জন্তু যবেহ্ করা ও খাওয়া জায়েয। মিনা ও মুযদালিফা হরম সীমানার অন্তর্ভুক্ত বিধায় এসব স্থানে গাছ বা ঘাস কাটলেও দম দিতে হবে।
১৩. ইহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করলে পুনরায় মীকাতে গিয়ে ইহরাম বেঁধে আসা ওয়াজিব হবে। মীকাতে ফিরে না গিয়েই ইহরাম বেঁধে নিলে দম ওয়াজিব হবে।
১৪. বিনা ওযূতে সমস্ত বা অধিকাংশ তাওয়াফ করলে দম ওয়াজিব হবে। যদি তাওয়াফে কুদূম অথবা তাওয়াফে বিদা অথবা নফল তাওয়াফ অথবা অর্ধেকের কম তাওয়াফে উযুবিহীন অবস্থায় থাকে, তাহলে প্রতিটি তাওয়াফের জন্য সাদাকাতুল ফির পরিমাণ সাদকা ওয়াজিব হবে। ওযূ করে পুনরায় সে সব তাওয়াফ করে নিলে কাফফারা ও দম লাগবে না। -(আলমগীরী)
১৫. কোন ব্যক্তি যদি কামভাব সহকারে স্ত্রীকে চুমু দেয় বা স্পর্শ করে তবে তার উপর দম ওয়াজিব হবে। উকুফে আরাফার পূর্বে মিলন করলে হজ্জ ফাসিদ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও একটি ছাগল কোরবানী করতে হয় এবং অন্যান্য হাজীদের মত সবকিছু করে যেতে হয় এবং পরবর্তী বছরে হজ্জের ক্বাযা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।–(হেদায়া)।
চুল মুণ্ডানোর পর স্ত্রী সহবাস করলে একটি ছাগল কোরবানী দিতে হয়। কেননা, স্ত্রী সহবাসের ব্যাপারে তার ইহরাম তখনো বাকী থাকে, যদিও সেলাই যুক্ত কাপড় ইত্যাদির ব্যাপারে তার উপর কোন বাধা থাকে না।
১৬. তাওয়াফে সদর বা বিদায়ী তাওয়াফে তিন চক্কর বা তার কম চক্কর ওযূ ছাড়া থাকলে সাদক দ্বারা আর তাওয়াফে যিয়ারতে তিন চক্কর বা তার চাইতে কম ছেড়ে দিলে বকরী কোরবানী দিয়ে তার প্রতিবিধান করতে হবে।–(হেদায়া)
১৭. উমরার জন্য তাওয়াফ শেষে সাঈ বিনা ওযূতে করে থাকলে এবং হালাল হয়ে গিয়ে থাকলে (ইহরাম ত্যাগ করে) মক্কা থাকাকালে ওগুলো পুনরায় করে নিতে হবে। ফলে কিছুই ওয়াজিব হবে না। কিন্তু ওগুলো পুনরায় না করে দেশে ফিরে গেলে সাঈ তরকের জন্য দম ওয়াজিব হবে।
১৮. সাফা ও মারওয়ার সাঈ বা উকুফে মুযদালিফা তরক করলে ওয়াজিব তরকের কারণে দম ওয়াজিব হবে।
১৯. কংকর মারার দিনসমূহে কংকর মারা তরক করলেও দম ওয়াজিব হবে।
২০. ইমামের পূর্বে আরাফাতের ময়দান থেকে চলে গেলে দম ওয়াজিব হবে। সূর্যাস্তের পর পুনরায় সে ব্যক্তি আরাফাত ফিরে গেলেও দম থেকে অব্যাহতি পাবে না। অবশ্য মাগরিবের পূর্বেই ফিরে গেলে তার ব্যাপারে মতানৈক্য আছে।–(হেদায়া)
২. এক দিনের কংকর নিক্ষেপ না করলেও দম ওয়াজিব হবে। আর তিন জামারায় কোন একটিতে কংকর নিক্ষেপ ছেড়ে দিলে সাদাকা ওয়াজিব হবে।
অনুরূপভাবে কুরবানীর দিন (১০ তারিখ) জামারাতুল আকাবায় কংকর নিক্ষেপ ত্যাগ করলেও দম ওয়াজিব হবে। একটি, দু’টি বা তিনটি কংকর নিক্ষেপ ত্যাগের জন্য প্রতিটি কংকরের বিনিময়ে পৌনে দু’ সের গম বা আটা (১ কেজি ৭৫০ গ্রাম) সাদাকা করা ওয়াজিব হবে।
২২. স্থলজ প্রাণী শিকার করলে বা তার শিকারে অন্যকে পথ দেখালে বা প্ররোচিত করলে ঐ প্রাণীর মূল্যের সমপরিমাণ সাদকা করা ওয়াজিব।
.
উমরার ফযীলত ও আহকাম
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীস পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে :
এক উমরা থেকে অপর উমরা পর্যন্ত ক্বত পাপরাশির কাফফারা উমরা দ্বারা হয়ে যায়।
কোরআন শরীফে হজ্জ ও উমরার উল্লেখ পাশাপাশি করা হয়েছে। যেমন :
واتموا الحج والعمرة
এবং আল্লাহরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করবে।–(সূরা বাকারা, ২ঃ ১৯৬)
রমযান মাসে উমরা পালন মুস্তাহাব। এতে এক হজ্জের ছাওয়াব মিলে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন, রমযানের উমরা এক হজ্জের তুল্য যা আমার সাথে সমাপন করা হয়েছে। উমরা শব্দের অর্থ যিয়ারত বা দর্শন। শরীয়াতের পরিভাষায় কতক সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের সাথে বায়তুল্লাহর যিয়ারতকে উমরা’ বলা হয়ে থাকে।
হজ্জ ও উমরাকে একই পর্যায়ে রেখে পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করায় ইমাম মালিক ও শাফিঈ (রঃ)-এর মতে উমরাও হজ্জের মতই ফরয। কিন্তু ইমাম আযম আবু হানীফা (রঃ)-এর মতে উমরা সুন্নাত। তিনি বলেন, কোরআন শরীফে উমরা আরম্ভ করার পর তা পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই শুরু করা উমরা পূর্ণ করা ফরয। তাঁর মতে এর স্বপক্ষে তিরমিযী শরীফের একটি সহীহ্ হাদীস রয়েছে, যাতে আছে হযরত জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! উমরা কি ফরয? জবাবে তিনি বললেন, না। তবে উমরা করা উত্তম।–(মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী (রঃ) অনুদিত মিশকাত শরীফ হজ্জ পর্বের ভূমিকায়)।
.
উমরা আদায়ের নিয়ম
মীকাত থেকে হজ্জের ইহরামের মত ইহরাম বেঁধে ইহরামের নিষিদ্ধ ও মাকরূহ বিষয়াদি পরিত্যাগ পূর্বক আদব-কায়দার দিকে পূর্ণ খেয়াল রেখে তালবিয়া পাঠ করতে করতে মক্কা। মুকাররামায় প্রবেশ করতে হয়। বাবুস্ সালাম মতান্তরে বাবুল উমরা ধরে মসজিদুল হারামের প্রবেশ করে রমল ও ইযতিবাসহ তাওয়াফ করতে হয়। হাজরে আসওয়াদে প্রথম চুম্বনের সঙ্গে সঙ্গে তালবিয়া বন্ধ করে দিতে হয়। তাওয়াফ শেষ দু’ রাকাআত নামায আদায় করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করে বাবুস্ সাফার পথে সাঈ-এর জন্যে বের হয়ে এসে যথা নিয়মে সাঈ সম্পন্ন। করতে হয়। সাঈ-এর পর পুনরায় মাতাফে এসে দু’ রাকাআত নামায আদায় করে মারওয়ায় ক্ষৌর কার্য শেষ করে ইহরাম ছেড়ে হালাল হয়ে যেতে হয়। এভাবে উমরা আদায় করতে হয়। মক্কা মুকাররামা থেকে ইহরাম পালনকারীদের জন্য হিল এলাকা মীকাত হলেও তানঈম ও জি’রানা থেকে ইহরাম বাঁধা উত্তম।
উমরার ইহরাম, শর্তাবলী ও আহকাম হজ্জের মতই। তবে হজ্জ ও উমরার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে হজ্জের সময় সুনির্ধারিত। উমরা বছরের যে কোন সময় করা যায়। কেবল ৯ই যিলহজ্জ থেকে ১৩ই যিলহজ্জ এ পাঁচদিন উমরা নিষিদ্ধ, মাকরূহ তাহরীমী।
উমরায় আরাফাতে বা মুযদালিফায় অবস্থান, দু’ ওয়াক্তের নামাযের একত্রীকরণ, তাওয়াফে কুদূম, তাওয়াফে বিদা, কংকর নিক্ষেপ প্রভৃতি নেই। এ ছাড়া উমরার মীকাত পর্বত এলাকা অর্থাৎ হরম শরীফের সীমানার বাইরে থেকেই ইহরাম বেঁধে উমরা করা চলে কিন্তু হজ্জের জন্য সুনির্দিষ্ট মীকাত রয়েছে। উমরাতে তাওয়াফ করার সঙ্গে সঙ্গে তালবিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হজ্জের ক্ষেত্রে কংকর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত তালবিয়া আব্যাহত রাখতে হয়।
.
উমরার মাসাইল
উমরার ফরয দু’টি ইহরাম ও তাওয়াফ। ইহরামের মত তালবিয়া ও নিয়্যত উভয়ই ফরয। কিন্তু তাওয়াফের জন্যে কেবল নিয়্যতই ফরয।
উমরার ওয়াজিব দুটি : ১. সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাঈ করা, ২, মাথার চুল মুণ্ডন করা বা ছাঁটা।
আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোতে ৯ই যিলহজ্জ থেকে ১৩ই যিলহজ্জ পর্যন্ত পাঁচ দিন উমরা পালন মাকরূহ তাহরীমী, কাজেই এ সময় উমরার নিয়্যতে ইহরাম বাঁধলেও তা তরক করা ওয়াজিব। কিন্তু এ দিনগুলোর পর উমরা ও দম উভয়টাই ওয়াজিব হবে। আর যদি ঐ সময়ে উমরা করেও ফেলে, তবুও মাকরূহ কাজ করার কারণে একটি দম ওয়াজিব হবে।
অধিক সংখ্যক উমরা পালনের চেয়ে অধিক সংখ্যক তাওয়াফ পালনেই ছাওয়াব বেশি।
.
মদীনা শরীফ যিয়ারত
মদীনাতুন্নবী (ছঃ) বা নবীর শহর বিশ্ব মুসলিমের আবেগ উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রস্থল। মক্কার কুরায়শরা যখন সাইয়্যেদুল মুরসালীন ও খাতামুন্নাবিয়্যীন তথা মানবকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)-এর সাথে নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ করে দেশ ছাড়া করেছিল, তখন যে পবিত্র ভূমি তাকে তার কোলে আশ্রয় দিয়ে চিরধন্য হয়েছিল সেই পবিত্র নগরী হচ্ছে এই মদীনা তুন্নবী বা নবীর শহর। তার পবিত্র দেহকে ধারণ করে এ নগরী লাভ করেছে পৃথিবীর বুকে জান্নাতের মর্যাদা।
পবিত্র কোরআন এ নগরীকে আখ্যায়িত করা হয়েছে আরদুল্লাহ্ (আল্লাহর ভূমি) আরদুল হিজর(হিজরতের ভূমি), আদদার–বিশিষ্ট বাড়ি এবং বিশ্বাস ভূমি বলে। এ কারণেই ইমাম মালিক (রঃ) মদীনাকে দুনিয়ার সকল শহরের সেরা ও সর্বোত্তম শহর বলতেন।–(কুরতুবী)
ভূপৃষ্ঠে মদীনা তাইয়্যেবার মত এত অধিক নাম বিশিষ্ট জনপদ আর একটিও নেই। কোন কোন আলিম সযত্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে এ পবিত্র নগরীর প্রায় একশটি নাম বের করেছেন। -[জায়ফুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব ও মাওলানা আবদুল হক দেহলবী (রঃ)]
মহানবী (ছঃ)-এর পবিত্র চরণ স্পর্শে ধন্য হয়েছে এর প্রতিটি অলিগলি; এর আকাশে বাতাসে মিশে রয়েছে তাঁর পবিত্র নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সুবাস। তাই আরবী প্রেমিক কবি বলেন। (বঙ্গানুদ)
নূর নবীর সুবাস নিয়ে সুবাসিত ইহার পবন,
কস্তুরী ও কর্পূর সুবাস পরাজিত সুবাস চন্দন।
মদীনার প্রতি নবী করীম (ছঃ)-এর এ পরিমাণ আকর্ষণ ছিল যে কোন সফর থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন কালে তিনি উটের গতি বাড়িয়ে দিতেন। কেননা, তখন তিনি মদীনায় প্রবেশের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল থাকতেন। মদীনায় পৌঁছে তাঁর হৃদয়মন জুড়াতো, এবং তিনি চাদর না খুলতেই বলতেন, আহ্! কী মনোরম এ বাতস!
মদীনার যে ধুলোবালি তাঁর মুখমণ্ডলে এসে পড়তো তা তিনি পরিষ্কার করতেন না। কোন সাহাবী ধুলোবালি থেকে রক্ষার জন্য মুখ আবৃত্ত করলে তিনি তাদেরকে নিষেধ করতেন এবং বলতেন-মদীনার মাটিতে নিরাময় রয়েছে।
সহীহ্ হাদীসে আছেঃ
أمينة تنتمي بين الرجال كما تنقي الكير خبث الحديد
অর্থ : মদীনা মানুষের পঙ্কিলতা ধ্বংশ করে যেমনটি ধ্বংস করে কর্মকারের হাপার লোহার মরিচা।
বুখারী শরীফে আছেঃ
إنما طيبة تنفي الذنوب كما ينفي الكير خبث الحديد
এ শহর পবিত্র, এটা গুনাহসমূহকে দুরিভূত করে যেমনটা করে হাপার লোহার মরিচাকে।
হযরত আলী (রাঃ)-এর বর্ণিত রিওয়ায়েতে আছে, একদা নবী করীম (ছঃ) ওযূ অবস্থায় ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে এরূপ দোয়া করেছিলেন : হে আল্লাহ্! ইব্রাহীম তোমার বান্দা ও খলীল, তিনি মক্কার কল্যাণ ও বরকত নাযিলের দোয়া করেছিলেন। আমিও তোমার বান্দা ও রাসূল, আমি মদীনাবাসীদের জন্য দোয়া করছি। হে আল্লাহ! তাদের মুদ ও সা’তে বরকত দাও যেমনটি মক্কাবাসীদের দিয়েছ। বরং মদীনাবাসীদেরকে মক্কাবাসীদের তুলনায় দ্বিগুণ দাও।
বর্ণিত আছে মদীনায় জ্বরের খুব প্রকোপ ছিল। প্রথম দিকে মক্কা থেকে আগত মুহাজিররা জ্বরে আক্রান্ত হতেন। তারপর নবী করীম (ছঃ)-এর দোয়ার বরকতে তা জুহফায় স্থানান্তরিত হয় তখন সেখানে সেরা মুশরিকদের আবাস ছিল।
মদীনার মাটিতে রোগ নিরাময়ের গুণ রয়েছে। এর ফলমূল খেয়ে রোগ নিরাময়ের কথা বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে।
যে ব্যক্তি মদীনার সাতটি আজওয়া খেজুর খালি পেটে খাবে, যাদু ও বিশেষ ক্রিয়া তার মধ্যে হবে না।–(বুখারী) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) মাথাঘোরা রোগে তা খেতেন। হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রিওয়ায়েতে আছেঃ
كان أحب التمر إلى رسول الله صلى الله علي وسم الأجوة
অর্থ : রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর সর্বাধিক প্রিয় খেজুর ছিল আজওয়া।
ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ কুবার মসজিদ, পয়গাম্বরদের সর্বশেষ মসজিদ। নবী করীম (ছঃ)-এর মিম্বর ও কবরের মধ্যবর্তী রিয়াযুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান, জান্নাতের পাহাড় ওহুদ পাহাড়, হযরত হামযা (রাঃ)-এর কবর, নবী পরিবারের বিশিষ্ট সদস্যবর্গ ও বিশিষ্ট ছাহাবীদের কবর সম্বলিত জান্নাতুল বাকী প্রভৃতি এই মদীনা শরীফেই অবস্থিত।
রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) মদীনার ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
النميرية مهاجری وفيها مشجعى و فيها مبعث حقق على متری جفظ چيزان ما اجتنبوا الكبار من حقهم گنت له شهيدا
وفيما يوم القيامة ومن يحفظي
من طينة الجبال
অর্থ : মদীনা আমার হিযরত স্থল, এখানে আমার শয়ন স্থল, এখান থেকেই আমার পুনরুত্থান হবে। আমার উম্মতের কর্তব্য আমার পড়শীদের হিফাযত ও সম্মান করা, যে পর্যন্ত তারা কবীরা গুনাহ্ থেকে দূরে থাকে। আমি তাদের সম্মান, হিফাযত ও সুপারিশকারী হবো। যে তাদের হিফাযত ও সম্মান করবে না তাকে দোযখের চৌবাচ্চা তীনাতুল জিবাল থেকে রক্ত ও পুঁজ পান করানো হবে।
সহীহ্ মুসলিমে আছেঃ
من أراد أهل المدينة بشؤ اذابه الله كما يذوب الملح في الماء
অর্থ : যে কেউ মদীনাবাসীদের অনিষ্ট প্রয়াসী হবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে ঠিক তেমন দ্রবীভূত করবেন যেমন লবণ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে থাকে।
সাঈদ ইব্ন মুসায়্যিব (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে আছে : একদা নবী করীম (ছঃ) উভয় হাত আকাশের পানে হাত তুলে দোয়া করেছেন :
اللهم من أرادني وأهل بلدى بؤ فعل هكه
অর্থ : হে আল্লাহ! যে আমার ও আমার নগরীর ক্ষতি সাধন করতে চায় তুমি তার ধ্বংস ত্বরান্বিত কর।
তাই কেউ মদীনার কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। এমন কি আখেরী যামানার কানা দাজ্জালও মদীনার সীমানায় ঢুকতে পারবে না বলে হাদীসে এসেছে। হাদীসে আছে :
إن الإيمان ليار إلى المدينة كما تأزر الحية إلى حجرها
অর্থ : ঈমান মদীনায় এসে নিজেকে গুটিয়ে নেবে যেমনিভাবে সাপ নিজেকে গুটিয়ে গর্তে ঢুকে পড়ে।–(বুখারী শরীফ)
.
নবী করীম (ছঃ)-এর রওযা শরীফ যিয়ারত
রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর রওযা মুবারক যিয়ারত যে পরম সৌভাগ্য ও শ্রেষ্ঠ ছাওয়াবের কাজ এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই কোন কোন আলিম সঙ্গতিসম্পন্ন লোকদের জন্য নবী করীম (ছঃ)-এর রওযা মোবারক যিয়ারতে যাওয়াকে ওয়াজিবরূপে গণ্য করেছেন।–(মুআল্লিমুল হুজ্জাজ)
স্বয়ং নবী করীম (ছঃ) ফরমান :
من زارنی معتمدا كان في جواري يوم القيمة
অর্থ : যে ব্যক্তি স্ব ইচ্ছায় আমার যিয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন সে আমার আশে পাশে থাকবে।–(মেশকাত, পৃঃ ২৪০)
তিনি আরো বলেন :
من حج فار قبرى بعد موتی کا گمث ارني في حياتي
অর্থ : যে ব্যক্তি হজ্জ করল এবং আমার মৃত্যুর পর আমার কবর যিয়ারত করল, সে যেন জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাত করল।–(প্রাগুক্ত)।
সুতরাং এ পরম সৌভাগ্য অর্জনের জন্যে আমাদের সচেষ্ট থাকা উচিত। অন্য এক হাদীসে আছে, নবীজী বলেন :
تان
من حج إلى مئة ثم قصدني في مشجری گتبث له
مبرورتان
অর্থ : যে ব্যক্তি মক্কায় হজ্জ সমাপন করে আমার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আমার মসজিদে আসে তার জন্য দুটি মকবুল হজ্জের ছাওয়াব লিখিত হয়।–(জায়াফুল কুলুব ইলা দিয়ারে রাসূল)
.
যিয়ারতের আদব
নবী করীম (ছঃ) বলেন।
من جاء نی زارا لا تعمله حاجته إلا زيارتي كان حقا على أن
ان له شفيعا يوم القيامة
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার নিকট আসে, তার অন্য কোন প্রয়োজন থাকে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য সুপারিশকারী হব।
খালিস নিয়্যতে একান্তই যিয়ারতের উদ্দেশ্যে দরবারে নববীতে উপস্থিত হতে হবে। নবী করীম (ছঃ)-এর যিয়ারতের সাথে মসজিদে নববীর যিয়ারতের নিয়্যত থাকা মুস্তাহাব বলেই প্রতীয়মান হয়। কেননা, মসজিদে নববীতে নামায আদায়ের জন্য স্বয়ং রাসূলে করীম (ছঃ) উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন :
صلوة في مسجدي هذا خير من ألف صلوة فيما سواه من
لمساجد الا المسجد الحرام
অর্থঃ আমার এ মসজিদে এক নামায মসজিদুল হরম ব্যতীত অন্যান্য মসজিদে এক হাজার নামায আদায় অপেক্ষা উত্তম।–(বুখারী শরীফ)
ইবন মাজা শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, মসজিদে নববীতে এক নামায পঞ্চাশ হাজার নামাযের চাইতেও উত্তম।
এমতাবস্থায় নবী করীম (ছঃ)-এর যিয়ারত সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথকভাবে মসজিদে নববীর যিয়ারতের নিয়্যত করে নেয়া উত্তম এবং মসজিদের নিয়্যতকে যিয়ারতের নিয়্যতের পরিপূরক বলা চলে।
যিয়ারতের ভ্রমণে অধিকাংশ সময় আল্লাহর যিক্র ও নবী করীম (ছঃ)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাম পাঠে অতিবাহিত করা চাই। এক হাদীসে আছে, আল্লাহ্ তা’আলা একদল ফিরিশতা সৃষ্টি করেছেন যাঁরা যিয়ারত ইচ্ছুকদের সালাত ও সালাম রাসূলে করীম (ছঃ)-এর নিকট পৌঁছিয়ে দিয়ে আরয করেন অমুকের পুত্র অমুক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসছে এবং সে এ সালাম প্রেরণ করেছেন। রাসূলে করীম (ছঃ)-এর নিকট তার ও তার পিতার নাম উচ্চারিত হবে এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে?
মদীনায় পৌঁছার পর দুরূদ ও সালামে আবেগের মাত্রা বাড়িয়ে দেবেন। হাদীস শরীফে আছে যিয়ারতকারী মদীনার নিকটবর্তী হলে রহমতের ফিরিস্তারা তাঁকে অভ্যর্থনার জন্যে এগিয়ে আসেন। এ সময় যিয়ারতকারীর কোনরূপ অঙ্গবঙ্গি বা সোরগোল করা উচিত নয়। যুল-হুলায়ফা বা বীরে আলী নামক স্থানে পৌঁছলে সম্ভব হলে দু’রাকাত’আত নামায আদায় করবেন। মদীনায় নগরপ্রাচীর দৃষ্টিতে পড়ামাত্র দুরূদ পাঠ করে পড়বেন।
اللهم هذا حرام نبي فاجعة إلى وقاية من النار وأمانا من
العذاب وسود للجاب
অর্থ : হে আল্লাহ্! এ যে তোমার নবীর হরম, একে আমার জন্যে দোযখ থেকে রক্ষার উপকরণ এবং আযাব ও হিসাব নিকাশের কঠোরতা থেকে নিরাপত্তার কারণ বানিয়ে দাও।
নগরীতে প্রবেশের পূর্বে সম্ভব হলে গোসল বা ওযূ করে নেবে। তারপর নতুন কাপড় পরিধান করে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে কিন্তু সাবধান অতিভক্তি বলে ইহরাম পরবে না বা তার অনুকরণ করবে না, কেননা, এটা কেবল বায়তুল্লাহ্ শরীফের জন্যই খাস। নগর তোরণে উপস্থিত হয়ে নিম্নের দোয়া পড়বে
بسم الله ماشاء الله لا حول ولا قوة الا باللور أثخثنى مثل صدق وأخرجني مخرج وتي وارزقني من زيارة رسولك ما رزقت أولياء وأهل طاعتك و أنقذى من التمار واغفرلي وارحمني ياخير مشتول اللهم اجعل لنا فيها قرارا ورزقا حسنا
উচ্চারণ : বিসমিল্লা-হি মা-শা-আল্লা-হু লা–হাওলা অলা–কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লা-হি রব্বি আদখিলনী মুদখালা ছিদ্কিওঁ ওয়া আখরিজনী মুখরাজা ছিদ্কিওঁ ওয়ার যুকুনী মিন্ যিয়া-রাতি রাসূলিকি মা–রাযাক্তা আওলিয়া–আকা ওয়া আহলা ত্বোয়া–আতিকা ওয়া আক্কিযনী মিনান্না-রি ওয়াগফিরলী ওয়ার হামনী ইয়া–খাইয়ারা মুসউলিন্। আল্লা-হুম্মাজ আল্ লানা ফীহা–কারা–রান্ অরিযক্কান্ হাসানা-।
নগরে প্রবেশের পর সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে প্রথমে ডান পা রেখে অত্যন্ত বিনয় সহকারে প্রবেশ করবে এবং বিসমিল্লাহ্’ বলে পড়বেঃ
اللهم صلى على محمد وصحبه وسلم اللهم اغفریی دوبی
وافتح لى أبواب رحمتك
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিও অছোয়াহবিহী অসাল্লিম। আল্লা-হুম্মাগফিরলী যুনূবী ওয়াফতাহলী আবওয়া-বা রাহমাতিক।
মসজিদে প্রবেশ করে নিষিদ্ধ সময় না হয়ে থাকলে মিম্বরে ও কবর শরীফের মধ্যবর্তী রিয়াযুল জান্নাত’ অংশে দু’রাকাআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করবে। এ নামায রাসূলে করীম (ছঃ)-এর মিহরাবে আদায় করা উত্তম, নতুবা পার্শ্ববর্তী যে কোন স্থানে আদায় করে নেবেন। তারপর শুকরিয়া স্বরূপ আরও দু’রাকাআত নামায আদায় করবে এবং উত্তমরূপে যিয়ারতের তাকীফের জন্য দোয়া করবে।
যিয়ারতের পূর্বে কিছু দান খয়রাত করা মুস্তাহাব। ভাবগম্ভীর পরিবেশে অত্যন্ত আদবের সাথে মধ্যম আওয়াজে রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-কে এভাবে সালাম পেশ করবেনঃ
السلام عليك يا رسول الله الشم علي ياحبيب الله ، السلام عليك يا خير خلق الله، السلام عليك يا خيرة الله من جميع خلق الله الشم عليك يا سيد ولي أم، السلام عليك ايها الى رحمة اللوبركاته، یا رسول الله إني أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له و اشهد انك يا رسول اللوقد بلغت الرسالة واديت الأمانة ونصحت الأمة وكشفت القمة فجزاك الله عنا خيرا وجزاك الله عنا أفضل
جزى نبيا عن ايه اللهم ايه الوسيلة والفضيلة والدرجة
وأكمل
إنك لا تخلف الميعابي–
الرفيعة وابعثه المقام المحمود الزئ وتم وأنزلة المنزل المقب عثك إنك سبائك و الفشل العظيم
উচ্চারণ : আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লা-হ, আসসালা-মু আলাইকা ইয়া-হাবীবা-ল্লাহ্ আসসালা-মু আলাইকা ইয়া খাইরি খালকিল্লা-হ, আসসালা-মু আলাইকা ইয়া-খাইরাতি ল্লা-হি মিন জামীই’ খালকিল্লা-হ, আসসালা-মু আলাইকা ইয়া–সাইয়্যিদা উলদি আ-দামা, আসসালা-মুআলাইকা আইয়ুহান্নাবিয়ু অ রাহমাতুল্লা-হি বারাকাতুহ ইয়ারাসূলাল্লা-হি ইন্নী–আশহাদু আল্লা–ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারীকালাহু অ আশহাদু আন্নাকা ইয়া রাসূলাল্লা-হি কাদ বালাগতার রিসালাতা অ আদ্দাইতাল আমা-নাতা অ নাছোয়াহ্তাল্ উম্মাতা অ কাশাফতাল গুম্মাতা ফাজাযাকাল্লা-হু আন্না–খাইরা-’ অ জাযা-কা ল্লা-হু আন্নাআফদ্বোয়ালা অ আকমালা জাযা–নাবিয়্যা–আন উম্মাতিহ্, আল্লাহ-হুম্মা আ-তিহি ল্ অসীলাতা অলফাদ্বীলাতা অদ্দারাজাতার রাফী আতা অব আছহুল মাক্বা-মা মাহমূদা ল্লাযী অ আত্তাহু ইন্নাকা লা-তুখলিফুল মী’আ-দ’ অ আনযিলহুল মুনযিলাল মুকাররাবা ই’ন্দাকা ইন্নাকা সুবহা-নাকা যুলফাদ্বলিল আযীম্।
কোন মুসলমান নবীজীকে সালাম পৌঁছানোর জন্য বলে, তাদের পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছানো জায়েয আছে।
নবী করীম (ছঃ)-এর উপর সালাম পাঠ করার পর ডান দিকে এক হাত পরিমাণ সরে এসে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর কবর বরাবর দাঁড়িয়ে এভাবে সালাম দেবেঃ
السلام عليك يا خليفة رسول الله وثانيه في الغار ورفيقه في الأسفار و امينه على الأسرار أبا بكر الصديق جزاك الله عن أمة
উচ্চারণ : আস্সালামু আলাইকা ইয়া খালিফাতু রাসুলিল্লা-হি অ ছা-নীহি ফিল গা-রি, অ-রফিক্বাহু ফি আস্ফা-রি অ আমীনাহু ফিল আরারি–আবা-বাকারিনিছ ছিদ্দীকি জাযাকাল্লা-হু আন উম্মাতি মুহাম্মাদিন খাইরা।
তারপর আরো ডান দিকে সরে হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর কবর সোজা দাঁড়িয়ে নিম্নোক্তভাবে সালাম দেবেঃ
السلام عليك يا أمير المؤمنين عمر الفاروق الذي اعز الله به
الإسلام إمام المسلمين مرضيا كا وميتا جزاك الله عن أمة محمد
يا محلى الله علو وتم
উচ্চারণ : আসসালাম-মু আলাইকা ইয়া আমীরাল মু’মিনীন উমারাল ফারূক্কা ল্লাযী আআয ল্লা-হু বিহিল ইসলা-মা ইমামুল মুসলিমীনা মারদ্বিয়া হাইয়্যান্ অ মাইয়্যিতা জাযাকাল্লা-হু আন উম্মাতা মুহাম্মাদিন খাইরা (ছঃ)।
হযরত আবু বকর ও উমর (রাঃ)-কে সালাম জানানোর পর পুনরায় রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর রওযা মুবারকের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে এবং আল্লাহ্ তা’আলার হামদ ও প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর প্রতি সালাম ও দুরূদ পাঠ করে তার উসীলা দিয়ে নিজের জন্য এবং সকল আত্মীয়-স্বজনের জন্য দোয়া করবে।
.
মদীনা মনোয়ারায় করণীয় ও দর্শনীয়
মদীনা শরীফ হচ্ছে রাসলে করীম (ছঃ)–এর কর্ম জীবনের পবিত্র স্মৃতি বিজড়িত নগরী। এখানকার অলিতে গলিতে তার হাজারো স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে। তাই যিয়ারত ছাড়াও এখানে অনেক করণীয় রয়েছে।
সর্বাধিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানটি হচ্ছে মসজিদে নববী যা ছিল তাঁর ধর্ম-কর্ম, এবাদত-বন্দেগী, শাসন-শৃংখলা সংক্রান্ত আদেশ-নিষেধ জারী, বিভিন্ন গোত্রে মু’আল্লিম ও মুবাল্লিগ প্রেরণ, বিশ্বের সেরা রাজা-বাদশাদের কাছে দূত প্রেরণ ও বিভিন্ন যুদ্ধে তাঁর বাহিনীসমূহ প্রেরণ প্রভৃতি সর্বপ্রকার কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র। এ মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রদত্ত তাঁর খুতবাসমূহ বিশ্ব মুসলিম তথা বিশ্বমানবের পথের দিশারী হয়ে রয়েছে। এ সমস্ত স্মৃতি ও শিক্ষাবলীকে অন্তরে জাগরুক করে তোলা হচ্ছে মদীনা শরীফের অন্যতম করণীয়।
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রঃ) হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার মসজিদে একাধারে ৪০ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে তার জন্যে দুটি মুক্তি রয়েছে। একটি দোযখ থেকে তার মুক্তির এবং অপরটি আযাব ও নিফাক (মুনাফেকী) থেকে মুক্তির। এ জন্য মসজিদে নববীতে একাধারে ৪০ ওয়াক্ত নামায আদায় মদীনা শরীফে বিশেষ করণীয়।
রিয়াযুল জান্নাত’ বা জান্নাতের বাগান বলে রওযা শরীফ ও রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর মিম্বরের মধ্যবর্তী অংশে দু’ রাকাআত নামায সকলেই আদায় করতে চান, তাই ওখানে সংক্ষিপ্তভাবে নামায আদায় করে অন্যদের জন্যে স্থান করে দেয়া বাঞ্ছনীয়।
.
কুবার মসজিদ
নবী করীম (ছঃ) প্রতি শনিবার কুবার সেই ঐতিহাসিক মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতেন যা মদীনায় হিজরতের পরেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন। মুসলিম শরীফে হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন দীনার (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে যাতে তিনি বলেন :
ان ابن عمر كان يتی قباء كل سبت و كان يقول رأيت رسول الله
صلى الله عليه وسلم يوكل سبت–
হযরত ইব্ উমর (রাঃ) প্রতি শনিবার কুবায় যেতেন এবং তিনি বলতেন আমি প্রতি শনিবারে রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে কুবায় যেতে দেখেছি।–(মুসলিম্ পৃঃ ৪৪৮)।
অপর হাদীসে আছে, কুবার মসজিদে নামায উমরা তুল্য ছাওয়াব মিলে।
পবিত্র কোরআনে কুবার মসজিদকে ss। 1 wei তাকওয়ার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত’ মসজিদ এবং আদি মুসল্লীদের শানে।#15 3–J, , ; যেখানে এমন সব লোক রয়েছে যারা পবিত্রতাকে পসন্দ করে’ বলে প্রশংসা করা হয়েছে।
.
মসজিদে জুমু’আ
কুবার নতুন রাস্তার পূর্বদিকে রান্না উপত্যকার বুৎওয়ানুল জাযা-এর নিকট এ মসজিদের নিকট বনী সলিমা গোত্রের বসবাস ছিল। নবী করীম (ছঃ) সর্বপ্রথম জুমু’আর নামায এ মসজিদেই আদায় করেছিলেন বলে এর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
.
মসজিদে গামামা
এর অপর নাম মসজিদে মুসাল্লা। এ স্থানটিতে নবী করীম (ছঃ) উভয় ঈদের নামায আদায় করতেন।
.
মসজিদে সুরাইয়া
বাবে আম্বয়ার নিকট রেল স্টেশনের ভেতরে একটি গম্বুজ রয়েছে, এ গম্বুজটিকে কুব্বাতুর রাউস বলা হয়ে থাকে। এখানে সুফাইয়া নামক একটি কূপও রয়েছে। বদর যুদ্ধে গমনকালে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এখানে নামায আদায় করে, মদীনাবাসীদের জন্যে বরকতের দোয়া করেছিলেন।
.
মসজিদে ফাতহ
সালা পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এ স্থানটিতে খন্দক যুদ্ধের সময় পরিখা খনন করা হয়েছিল। তখন নবী করীম (ছঃ) সমস্ত কাফের গোত্রের অবরোধের মুখে এখানে অবস্থান করে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে বিজয়ের দোয়া করেন। মুসলমানরা যুদ্ধে জয়ী হন। এ জন্য এ মসজিদকে মসজিদ ফাতহ্ বা বিজয়ের মসজিদও বলা হয়ে থাকে।
.
মসজিদে যুবাব
ওহুদ যাওয়ার পথে সানিয়াতুল বিদা থেকে অবতরণ করে রাস্তার বাম পাশে যুবাব পর্বতের উপরে এ মসজিদটি অবস্থিত। খন্দকের যুদ্ধকালে এখানে রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর তাঁবু টানানো হয়েছিল এবং এখানে তিনি নামায আদায় করেছিলেন।
.
মসজিদে কিবলাতাইন
কিলা পরিবর্তনের সংবাদ শুনে নামাযরত অবস্থায়ই মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিক থেকে কা’বা শরীফের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এ ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল যে মসজিদে। এ মসজিদটি মদীনা শরীফের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত আকাল উপত্যকার নিকটবর্তী একটি টিলার উপর অবস্থিত। এখনও তাতে বায়তুল মুকাদ্দাস ও মক্কা শরীফ অভিমুখী দুটি মিহরাব রয়েছে। এ জন্য এ মসজিদটিকে মসজিদে কিলাতাইন’ বা দু’ কিলার মসজিদ বলা হয়ে থাকে।
.
মসজিদুল কাযীহ
মদীনার উঁচু এলাকার উত্তর দিকে অবস্থিত এ মসজিদে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ইয়াহূদী বণু নযীর গোত্রকে অবরোধকালে নামায আদায় করেছিলেন। কাযীহ্ হচ্ছে খেজুর থেকে তৈরী মদ। হযরত আবু আইউব আনসারী (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী এখানে কাযীহ পানরত অবস্থায় মদ হারাম হওয়া সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হলে তারা সমস্ত পানপাত্র ও মদের মা ভেঙ্গে ফেলে তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন। এ স্মৃতির সাথে জড়িত বলে এ মসজিদটির এরূপ নামকরণ করা হয়। উঁচু স্থানে অবস্থিত বিধায় এ মসজিদে সূর্যোদয় সর্বাগ্রে দৃশ্যমান হয় বলে এ মসজিদটিকে মাসজিদুল শামস্ সূর্যের মসজিদও বলা হয়ে থাকে।
.
মসজিদে বনু কুরায়যা
ইয়াহূদী বনু কুরায়যা গোত্রকে অবরোধকালে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এখানে অবস্থান করেন। ইয়াহূদীরা হযরত সা’দ ইবন মু’আয (রা.)-কে বিচারকরূপে মেনে নিলে তিনি এখানে বসেই তাঁর রায় গোষণা করেন। এ মসজিদটি মসজিদ কাযীহ্ থেকে সামন্য উত্তরে অবস্থিত।
.
মসজিদুল ইজাবা
জান্নাতুল বাকী-এর উত্তর দিকে বুস্তানুস্ সাম্মাম’-এর নিকটে অবস্থিত এ মসজিদটিতে অবস্থানকালে একদা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) উম্মতের জন্যে তিনটি দোয়া করেছিলেন যার দুটি ককূল হয়েছিল। এজন্য একে মসজিদুল ইজাবা বা দোয়া কবুলের মসজিদ বলা হয়ে থাকে। ঐ দোয়া দু’টি ছিল, গোটা উম্মাত যেন দুর্ভিক্ষে এবং পানিতে ডুবে ধ্বংস না হয়। তৃতীয় যে দু’আটি ককূল হয়নি তা হল, তারা যেন আত্মকলহে লিপ্ত না হয়।
এছাড়াও মসজিদে সাজুদ, মসজিদে উবাই, মসজিদে বারাখ, মসজিদে মুসাল্লার নিকটবর্তী মসজিদে আবু বকর ও মসজিদে আলী এবং মসজিদে ইব্রাহীম প্রভৃতি স্থানেও রাসূলুল্লাহ (ছঃ) নামায আদায় করেছেন।
এছাড়াও রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর স্মৃতি বিজরিত অনেকগুলো কূপ। যতদূর জানা যায় নবী রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর আমলে মদীনার ১৭টি কূপ ছিল। সে সব কূপের মধ্যে বীরে আবস, বীরে জুমা’আ, আবু তালহা (রাঃ)-এর স্মৃতি বিজরীত বীরে রুহ (বর্তমানে নাম বীরে উসমান) প্রভৃতি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। মদীনাবাসীদের সহিত সম্মানজনক ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে নবী করীম (ছঃ) ও তার প্রতিবেশীদের হক আদায় করা উচিত। তাদের কোন আচার ব্যবহারে কোনরূপ ফাঁক ফোকর থাকলেও ধৈর্যধারণ করা উচিত।
কেননা রাসূলুল্লাহ(ছঃ)-কে আশ্রয় দানকারী নবী প্রেমিক সাহাবীদের বংশধর ও উত্তরাধিকারীরূপে গোটা উম্মাত তাঁদের কাছে ঋণী রয়েছে।
.
হজ্জ থেকে ফেরা ও করণীয়
মদীনা শরীফ থেকে বাড়ি প্রত্যাবর্তনের পূর্বে মসজিদে নববীতে হাযির হয়ে মিহরাবে নববীতে বা নিকটবর্তী স্থানে দু’রাকাআত নামায আদায় করে রওযা মুবারকে হাযির হয়ে অত্যন্ত আদবের সাথে যিয়ারত সম্পন্ন করে দোয়া করবেনঃ
تجعل هذا ا:.
دا اخر العهد بنبيك و مسجده وحرمه ويسر لی
العود اليه والعكوف لديهم وارزقنى العفو و العافية في الدنيا والآخرة ورونا إلى أهلنا سالمين غانيين أين برحمتك يا ارحم الراحمين
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা লা–তাজআল হা-যা–আ-খিরাল আহদি বিনাবিয়্যিকা অ মাসজিদিহি অ হারামিহি অ ইয়াসসির লিল উ’দা ইলাইহি অল উ’কূফা লাদাইহি অরযুক্বনিল আফওয়া অল্ আ-ফিয়াতা ফিদ্দুনিয়া—অল আ-খিরাতি অরাদ্দিনা–ইলাহ্ লিনা–সা-লিমীনা গা-নিমীনা আ-তিনা বিরাহমাতিকা ইয়া–আরহামার রাহিমীন্।
বিরহ বিধুর মনে কান্নাকাটি করবেন। দেশে ফিরে বাড়িঘর বা গ্রাম দৃষ্টিগোচর হলে নিম্নের দোয়া পড়বেনঃ
&14 45, 33156503; (আ-য়িবূনা তা-য়িবূনা লি রব্বিনা-হা-মিদূনা)
সম্ভব হলে দিনের বেলা বাড়ি ফেরা উত্তম। নিজ গ্রামে বা জনপদে প্রবেশ করে ঘরে প্রবেশের পূর্বেই সর্বপ্রথম মসজিদে গিয়ে দু’রাকাআত নামায আদায় করবেন। ঘরে প্রবেশ করেও সর্বপ্রথম দু’রাকাআত নামায আদায় করে দোয়া করবেন।
توبا توبا لربنا أوبا يغادر علينا كوبا
উচ্চারণ : তাওবান তাওবান্ লিরাব্বিনা–আওবান লা–ইয়ুগা-দিরু আলাইনা হূবান্।
হাজীদের বাড়ি ফেরার পর তাঁদের সাথে মুসাফাহা ও মুআনাকা দ্বারা গুনাহ মাফ হয় বলে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই যথাসম্ভব সকলের সাথে মুসাফাহা ও মুআনাকা করবেন। হাজী সাহেব হজ্জের পবিত্র স্মৃতি বুকে ধারণ করে অবশিষ্ট জীবন একজন পরিশুদ্ধ মুসলমানের গুনাবলীসহ কাটাবার চেষ্টা করবেন।