১২. অন্বেষণের অপরাহ্ণ

অন্বেষণের অপরাহ্ণ

১৯৪৯ সালের বড়োদিন। তন্ময় এসেছে সপরিবারে কলকাতায়। উঠেছে পৈত্রিক বাসভবনে। বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে। কান্তি এসেছে সদলবলে। অতিথি হয়েছে এক মহারাজার প্রাসাদে। মধ্যপ্রদেশের মহারাজা। অনুত্তম এসেছে নোয়াখালি থেকে, সহকর্মী সংগ্রহ করতে। সুজন তাকে ধরে নিয়ে গেছে অশ্বিনী দত্ত রোডে, নিজের বাড়িতে। বাড়িখানা ছোটো দোতলা। কিন্তু তার চার দিকে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। দাঙ্গা বাধলে আর যেখানেই বাধুক এ পাড়ায় না। নেহাত যদি বাধেই দেয়ালের হেঁয়ালি সমাধান করতে পারবে না।

‘আগে নিরাপত্তা। তার পরে অন্য কথা। যে টাকায় তেতলা হত সে টাকায় মাজিনো ওয়াল হয়েছে বলে সীতার সঙ্গে আমাদের ঝগড়া। বলে, এটা অবন ঠাকুরের অশোকবনের আইডিয়া।’ সুজন বলছিল অনুত্তমকে।

‘নোয়াখালিতে’ বলছিল অনুত্তম, ‘যে গাঁয়ে সবচেয়ে বিপদ সেই গাঁয়েই আমার কুঁড়ে ঘর। গুণ্ডারা আমাকে ঘিরে রয়েছে, তাই আমি সবচেয়ে নিরাপদ।’

সুজনের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ‘অ্যাঁ! বলিস কী! তা হলে তো, ভাই, তোকে ফিরে যেতে দেওয়া চলে না। বিয়ে হয়নি বলে কি তোর প্রাণের মূল্য নেই? তোর স্ত্রী থাকলে কি তোকে আদৌ যেতে দিতেন?’

‘স্ত্রী থাকলে কী করতেন জানিনে, কিন্তু যার অন্বেষণে বাহির হয়েছি তিনি যে আমাকে বিপদের দিকেই টানছেন। যেন সেইখানেই মিলনের সংকেতস্থল।’

সেদিন ওরা দুই বন্ধু অপর দুই বন্ধুর প্রতীক্ষা করছিল। আগে পৌঁছোল তন্ময়। তিনজনে কোলাকুলি করে নীরব রইল কিছুক্ষণ। তারপরে সুজন বলল, ‘সীতা বাড়ি নেই। আফশোস জানিয়েছে। ওর বোনের সন্তান হবে বলে রাত জাগতে হবে।’

‘আমার কিন্তু রাত করে ফিরতে মানা। রেবা একটুও রাত জাগতে পারে না।’ মুরগিতে ঠোকরানো স্ত্রৈণ স্বামীর মতো সভয়ে বলল তন্ময়। তার মাথার চুল চোদ্দো আনা সাদা। কিন্তু শরীর আগের চেয়ে চিকণ। একটি বড়ো মাপের খোকা পুতুলের মতো চেহারা। গৃহিণীর হাতযশ সর্বাঙ্গে। স্বচ্ছন্দে আশি বছর বাঁচবে।

ওদিকে সুজনের মাথাজোড়া টাক। সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু ঘরনির হেফাজতে তন্ময়ের যেমন চেকনাই হয়েছে সুজনের তেমন হয়নি। ওকে যেন তুলোয় মুড়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সাবধানে থাকলে সুজনও আশি বছর বেঁচে থাকতে পারে। দাঙ্গাবাজদের রুখতে যেমন দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুলেছে অদৃশ্য ব্যাধিবীজদের রুখতে তেমনি তুমুল আয়োজন করেছে। তিন চার আলমারি ওষুধে বোঝাই।

অনুত্তম চুল ছেঁটেছে কদম ফুলের মতো। ছোটো ছোটো খোঁচা খোঁচা চুল। দাড়ি কিন্তু রক্তবীজের ঝাড়। চাঁচলে বাপ মানে না বলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বোধ হয় নোয়াখালির মোল্লাই ফ্যাশন। চোখে সেই বিখ্যাত নীল চশমা। শরীরটা মাংসবহুল নয়, পেশিবহুল। শিরাগুলো ঠেলে বেরোচ্ছে। শক্ত গাঁথুনি। যৌগিক ব্যায়াম করে। গায়ে কোর্তার বদলে চাদর জড়ানো, ধুতিও সংক্ষেপিত। হ্যাঁ, খদ্দরের। দৃঢ়তার ব্যঞ্জনা প্রতি অঙ্গে। পরিচ্ছদে।

মহারাজার মোটরে করে এল কান্তি। ও গাড়ি কখনো এত ছোটো বাড়ির সামনে দাঁড়ায়নি। কিন্তু এটা রাজপুরী না হোক দুর্গ তো বটে। ছোটোখাটো ফোর্ট উইলিয়াম। লাফ দিয়ে ফুর্তি করে ছাদে উঠল কান্তি। বলল, ‘শীত কোথায় কলকাতায়! এইখানে বসা যাক কফির পেয়ালা নিয়ে। আর, সুজন, তুই আয়। অনুত্তম, তন্ময়, তোরাও বদ্ধ ঘরে বসে থাকিস নে, বুড়ো হয়ে যাবি।’

চির তরুণ। নানা রঙের রেশমি পোশাক। বাবরি চুল। ফুলের মালা। যেমনটি ছিল পঁচিশ বছর আগে তেমনটি আছে পোয়া শতাব্দী পরে। তবে মুখভাবে একপ্রকার কঠোরতা এসেছে। চরিত্রের কঠোরতা। তার তপোভঙ্গ করা মেনকার অসাধ্য।

‘পড়েছি এক মহারাজার পাল্লায়।’ রগড় করে রসিয়ে রসিয়ে বলল কান্তি। ‘খরচ বেঁচেছে। কিন্তু জান বাঁচে কি না সন্দেহ।’

‘তার মানে? কৌতূহলী হল তন্ময়।

‘দু-বেলা শুনতে হচ্ছে নতুন এক স্লোগান। এক স্বামী এক স্ত্রী। দেশটা দিন দিন হল কী! রাজাগুলোও ধুয়ো ধরেছে এক স্বামী এক স্ত্রী। সরদার বল্লভভাই এমন হাল করেছেন যে একটির বেশি পুষতে পারে না। পন্ডিত জহরলালই বা কম কীসে! ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট একটি রানিকেই দেবেন, আর সব রানিদের সাধারণ পাসপোর্ট। বিপ্লব হবে না? প্যালেস রেভলিউশন শুরু হয়ে গেছে। মহারাজা এর মধ্যেই তাঁর রক্ষিতাদের বিদায় করে দিয়েছেন। রানিদের একটিকে রেখে বাকি তিনটিকে স্বাধীন জীবিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। একটিকে হয়তো আমার দলে যোগ দিতে বলবেন। সেইরকম তো শুনছি।’

‘দেখিস, ভাই। পদচালনা করতে গিয়ে পদস্খলন না হয়।’ অনুত্তম বলল গম্ভীর স্বরে। ‘মহারানি শুনে মহাভয় লাগছে।’

‘হা হা!’ কান্তি অনুত্তমের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘তেমনি কাঠখোট্টা আছিস। রসকষ একফোঁটাও নেই। ওরে, আমার কাছে ময়রানিও যা মহারানিও তাই। মাজুরকা নেচে এলুম পোল্যাণ্ডের চাষানিদের সঙ্গে, পোলকা নেচে এলুম চেকোস্লোভাকিয়ার মজুরনিদের সঙ্গে। আমেরিকার ক্রোড়পতিদের দুহিতাদের সঙ্গে নেচে এলুম ফক্সট্রট আর ট্যাঙ্গো। ইংল্যাণ্ডের কাউন্টেস ও ব্যারনেসদের সঙ্গে নেচে এলুম সার রজার ডি কভারলি। কোনোখানেই পা ফসকায়নি। শেষে কিনা চৌকাঠের উপর আছাড় খেয়ে পড়ব!’

‘তবু’, মন্তব্য করল সুজন, ‘সাবধানের মার নেই।’

‘তা হলে’, কান্তি সুর নামিয়ে বলল, ‘খুলে বলি। কারো সঙ্গে আমি রসের সম্পর্ক ভিন্ন আর কোনো সম্পর্ক পাতাইনে। কিন্তু রস বলতে আমি রতিরঙ্গ বুঝিনে। বুঝি লীলাকমলের নির্যাস। এর ফলে বার বার ফলস পজিশনে পড়তে হয়েছে। তেমন অবস্থায় পড়লে আমার নিয়ম হচ্ছে, দে দৌড়। দৌড়োতে দৌড়োতে আমি এত দূর এসেছি। আমার জীবনটাই একটা ম্যারাথন রেস।’

হো-হো করে হেসে উঠল তন্ময়। টিপে টিপে হাসল সুজন। অনুত্তম গম্ভীরভাবে বলল, ‘ম্যারাথন রেসে পতনও ঘটে।’

কান্তি বলল সকৌতুকে, ‘তা বলে চেহারাটাকে সজারুর মতো করে অর্ধেক সমাজের কাছে ঘোষণা করব না, ছুঁয়ো না আমাকে।’

হাসতে হাসতে তন্ময় গড়িয়ে পড়ল সুজনের গায়ে, সুজন মুখ ফেরাল।

তারপর কান্তি তাদের সবাইকে মাতিয়ে রাখল নিজের জীবনের কাহিনি বলে। ঘড়িগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হল কেউ যাতে টের না পায় রাত কত হয়েছে। ওদিকে রেবা হয়তো ছটফট করছে। তা একটু করলই-বা। এদিকে সুজনও তো ছটফট করছে সীতার জন্যে।

কান্তির কাহিনির অনেকখানি আমাদের জানা। সে অংশের পুনরাবৃত্তি করব না। যেটুকু অজানা সেটুকু এই।

কান্তিরা যখন ইউরোপে যায় তখন মহাযুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে। তার কালো ছায়া সকলের জীবনে। তা বলে নাচবে না, নাচ দেখবে না, তেমন বেরসিক ইউরোপের লোক নয়। কান্তিরা পরম সমাদর লাভ করে। কিন্তু হিটলারের চালচলন দেখে হিতৈষীরা পরামর্শ দেন, আসল শিবতান্ডব শুরু হলে নকল শিবতান্ডব দেখবে কে! মাঝখান থেকে আটকা পড়বে তোমরা। সময় থাকতে আমেরিকায় সরে পড়ো। আটলান্টিক পেরিয়ে দেখে সেখানেও থমথমে ভাব। তবে অঢেল টাকা। কান্তিরা ঝম ঝম করে নাচে আর ঝন ঝন করে টাকা ঝরে। টাকার গাছে নাড়া দিয়ে ফল কুড়োতে ব্যস্ত। খেয়াল নেই যে জাপানিরা পার্ল হারবারে হানা দিয়েছে। যখন টনক নড়ে তখন দেখে দেরি হয়ে গেছে! দেশে ফেরবার জলপথ আকাশপথ বন্ধ। স্থলপথের তো কথাই ওঠে না।

সঞ্চয় ভেঙে ক-দিন চালাতে পারে! যে যেখানে পারে চাকরি নেয়। যেকোনো চাকরি। রত্না গেল মেয়েদের অক্সিলারি কোর-এ। কান্তি গেল অ্যাম্বুল্যান্সে। মুথুলক্ষ্মী ফিরোজা বাবনজি মিশিরজি এঁরা ছড়িয়ে পড়লেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে। বিচিত্র কার্যে। যুদ্ধশেষে একে একে ফিরে এল অনেকে। যারা ফিরল না তাদের মধ্যে রত্না। সে বিয়ে করে সেখানকার এক সিন্ধিকে। আবার দল গড়তে হল। গড়তে হল নতুন লোক নিয়ে। পুরোনোরা ধনের স্বাদ পেয়েছে, মোটা তনখা না পেলে আসবে না। এসে করবেই-বা কী! নাচতে তো ভুলে গেছে। নতুন যারা এল তাদের তালিম দিতে দিতে বছরের পর বছর গেল গড়িয়ে। এই সম্প্রতি কান্তি সদলবলে আসরে নেমেছে। কিন্তু অনভ্যাসের দরুন অনায়াস নয় পদক্ষেপ। মনের মতো সাথি নেই বলে লীলায়িত নয় ভঙ্গি। রত্না তার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট ছোটো ছিল। এরা তো তার মেয়ের বয়সি। এদের সঙ্গে নাচা যেন খোকাখুকুর নাচন। পশ্চিম থেকে কৌশল শিখে এসেছে প্রচুর। জীবনের অভিজ্ঞতাও প্রভূত। কিন্তু রূপ দিতে গিয়ে দেখছে এক হাতে হয় না। মহারানি কি সত্যি যোগ দেবেন?

এরপর তন্ময়ের কাহিনি। তার প্রায় সবটাই আমরা জানি। বাকিটুকু এক নিঃশ্বাসে বলা যায়। তন্ময়কে রাজ একবার টেলিফোন করে তার ক্লাবে। কী একটা খবর ছিল, সাক্ষাতে জানাবে। তন্ময় তার সঙ্গে দেখা করেনি, তাকে দেখা করতেও দেয়নি। কিছুদিন বাদে শুনতে পায় রাজ আবার বিয়ে করেছে। বিয়ে করে চলে গেছে তিব্বতে। যার সঙ্গে গেছে সে একজন ফরাসি বৌদ্ধ লামা। রক্তাম্বর সম্প্রদায়ের লামাদের বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। তিব্বতে বহুকাল কাটিয়ে ওরা এখন হিমালয়ের কোন এক উপত্যকায় অজ্ঞাতবাস করছে। এদিকে ঘোরতর বিষয়ী হয়ে উঠেছে তন্ময়। মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। ছেলেকে বিলেত পাঠাচ্ছে। স্ত্রীর জন্যে বাড়ি কিনছে লণ্ডনের উপকন্ঠে।

তন্ময়ের পরে অনুত্তম। তার কাহিনির অধিকাংশ আমরা জানি। অবশিষ্ট লিখছি। অনুত্তম ও তারা একই দিনে ছাড়া পায়। কংগ্রেস আবার প্রাদেশিক সরকারের ভার নিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা নিয়ে ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে দরদস্তুর চলছে। তারা বলে, সংগ্রাম করতে আর ভালো লাগছে না। দরকারও দেখছিনে। এসো, চুপচাপ একসঙ্গে থাকি। মানুষের কি ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই? দেশের ভার আর যেই নিক, অনু, ঘরের ভার তুমি আমি নিই। অনুত্তম বুঝতে পারে তারার মনে কী আছে। বিয়ে। ঘরসংসার। ছেলে-মেয়ে। বয়সও তো হল কম নয়। লবণ সত্যাগ্রহের সময় থেকে দেশের কাজে নেমেছে। বড়ো ঘরের মেয়ে। বাপ মা-র কথা শোনেনি। বিয়ে করেনি। অনুত্তমেরও কি সাধ যায় না সুখী হতে, শান্তি পেতে! তারার মতো সঙ্গিনী পাবে কোথায়! তার পরম সৌভাগ্য, তারা তাকে মনোনয়ন করেছে। সে স্বয়ংবর সভার বীর।

কিন্তু অনুত্তমের যে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। দেশ স্বাধীনতা না পেলে সেও স্বাধীনতা পাবে না। বিয়ে করবে না ততদিন। তার পরে যাকে করবে সে নিভন্ত সলতে নয়, জ্বলন্ত শিখা। বেচারি তারা যে এখন থেকেই নিবু নিবু। সে তেজ নেই। সে দাহ নেই। এ কি সেই তারা! সেই পদ্মাবতী! মনে তো হয় না। অনুত্তম বলে, আমি ধন্য। কিন্তু নিরুপায়। তারা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

তারাকে কানপুরে পৌঁছে দিয়ে অনুত্তম দিল্লিতে কয়েক মাস কাটায়। কলকাতার দাঙ্গা তাকে বিচলিত করে, কিন্তু বল্লভভাই তাকে অন্য কাজে লাগান। নোয়াখালির ডাক শুনে সে আর স্থির থাকতে পারে না। গান্ধীজির সঙ্গে যোগ দেয়। তখন থেকে নোয়াখালিতেই তার স্থান। গান্ধীজি নেই, তবু কাসাবিয়াঙ্কার মতো সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আগুনলাগা জাহাজের ডেক-এ। কোথায় তার পদ্মাবতী! কবে ফুটে উঠবে পদ্ম ফুলের মতো কন্যা আগুনের পালঙ্কে!

অনুত্তমের পর সুজন। সুজনের কাহিনির অল্পই আমাদের অজানা। সেটুকু বলি। বিদেশ থেকে ফিরে সুজন দেখে তার বাবা কোনোমতে নিঃশ্বাস ধারণ করে রয়েছেন বউমার কোলে মাথা রেখে নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন এই আশায়। তাঁর যন্ত্রণার অবসান হবে সে যদি তাঁর কথামতো বিয়ে করে। নইলে তাঁর যন্ত্রণা দীর্ঘতর হবে। ছেলের মুখে ‘না’ শুনলে হয়তো তিনি তৎক্ষণাৎ হার্ট ফেল করে মারা যাবেন। এমন বিপদেও কেউ পড়ে! সুজন চোখ বুজে বিয়ে করল। আর বাবা বউমার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজলেন। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য।

বিয়ে মোটের উপর সুখের হয়েছে। সীতা সেকালের সীতার মতো পতিব্রতা। নিজের জন্যে কিছু চায় না। ঝি-চাকর রাখতে দেয়নি। নিজেই রাঁধে। সেইজন্যেই সুজনের হাতে টাকা জমতে পেরেছে। অধ্যাপনা করে, সিনারিও লেখে, অভিনয়ের মহড়ায় উপস্থিত থেকে নির্দেশ দেয়। এইসব করে সুজন একরকম গুছিয়ে নিয়েছে। একটি সন্তান হয়েছিল। বাঁচল না।

মধ্যে একদিন ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে বকুলের সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা। সুজন প্রথমটা চিনতে পারেনি। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কাঠ কয়লার মতো কালো হয়ে গেছে বকুল। কী একটা সাংঘাতিক অসুখ করেছিল তার। ছ-বছর ভুগতে হয়েছে। বহু দেশ বেড়িয়ে এখন একটু ভালো বোধ করছে। বকুল যদিও বলল না তবু সুজন বুঝতে পারল কী সে অসুখ। কে তার জন্যে দায়ী। বকুলের চাউনি এড়াবার জন্যে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিল। সে চাউনি বঞ্চিতা নারীর। বকুল বিশ্বাস করেনি যে সুজন সত্যি সত্যি বিয়ে করবে আরেকজনকে। মুখে অনুমতি দিয়েছিল বটে। মন থেকে তো দেয়নি। জ্বলেপুড়ে মরছে।

চার জনের কাহিনি সাঙ্গ হলে চার দিক নিস্তব্ধ হল। রাত তখন অনেক। ঘড়ি আনিয়ে দেখা গেল বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। তন্ময় লাফ দিয়ে উঠল। সুজন তাকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা বছরের শেষ রাত্রি। একটু পরে আরম্ভ হবে নববর্ষ।’

‘সিলভেস্টার!’ কান্তি চমকে উঠে বলল, ‘নাচতে ইচ্ছা করছে যে।’

তন্ময়েরও ইচ্ছা করছিল নাচতে। দুই বন্ধুতে হাত ধরাধরি করে নাচতে শুরু করে দিল। ওদের বেহায়াপনা দেখে অনুত্তম বিষম অপ্রসন্ন হল। সুজন গেল সাপার আনতে। খেতে খেতে বারোটা বাজিয়ে দেওয়াই রেওয়াজ।

‘যত সব বিদঘুটে কান্ড!’ অনুত্তম ফেটে পড়ল যখন লক্ষ করল সুজন দুই হাতে দুই গ্লাস তরল পদার্থ নিয়ে উঠে আসছে।

ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। ততক্ষণে ওরা স্যাণ্ডউইচ পনির ও বিস্কুট খেতে বসেছে। অনুত্তমের জন্যে গরম দুধ। আর সকলের জন্যে দ্রাক্ষারস। চার জনেই চার জনকে বলল, ‘নববর্ষ সুখের হোক।’

কান্তি বলল, ‘আজ থেকে আবার আমাদের যাত্রারম্ভ। যে জীবন পিছনে পড়ে রইল তার দিকে ফিরে তাকাব না। যে জীবন সামনে তার দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাব!’

‘তোর সঙ্গে যতক্ষণ আছি’, তন্ময় বলল, ‘ততক্ষণ মনে হচ্ছে আমার বয়স বিশ-একুশ বছর। তা তো নয়। একটু পরে যেই বাড়ি ফিরব অমনি মালুম হবে ষাট বাষট্টি বছর। জীবনের আর ক-টা বছর বাকি আছে যে নতুন করে যাত্রারম্ভ করব! কার অভিমুখে পদক্ষেপ? তাকে যে, ভাই, চিরকালের মতো হারিয়েছি। আমার রূপমতীকে।’

‘আমিও আমার কলাবতীকে।’ বলল সুজন। ‘কেন বেঁচে থাকব, কীসের প্রত্যাশায় বেঁচে থাকব, সেইটেই বুঝতে পারছিনে। লিখতে বসলে লেখা আসে না। সাহিত্যের পাট চুকে গেছে। পয়সার জন্যে এ যা করছি এ তো ব্যবসাদারি। বয়সটা আমার আজ পঁচিশ বছর কমে গেছে, কিন্তু কাল বকুলের দিকে তাকালে হু-হু করে বেড়ে বাহাত্তর হবে। যাত্রারম্ভ আমার জন্যে নয়।’

‘এই ক-বছরে আমার বুকে শেল বিঁধেছে।’ বলল অনুত্তম। ‘শেল বিঁধে রয়েছে। দেশ ভগ্ন। লক্ষ লক্ষ মহাপ্রাণী নিহত, উন্মুলিত, ধর্ষিত, নষ্ট। মহাগুরু নিপাতের পাপে জাতীয় শরীর বিষাক্ত। বেঁচে আছি বলে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। তবু বাঁচতে হবে। এখনও তার সঙ্গে শুভদৃষ্টি বাকি। আমার পদ্মাবতীর সঙ্গে। তা বলে যাত্রারম্ভ! না, ভাই। সে উৎসাহ নেই। বয়স আমার কমেনি। আজকের দিনেও।’

কান্তি ভেবে বলল, ‘আমাদের উপর ভার পড়েছে আমরা আদি কাল থেকে চলে আসতে থাকা একটি অন্বেষণের ধারাকে বহমান রাখব। অন্বেষণ সার্থক হলে তো ফুরিয়েই গেল। কিন্তু বিধাতার অভিপ্রায় নয় যে ফুরিয়ে যায়। তাঁর সৃষ্টি যেমন অসামান্য আমাদের অন্বেষণও তেমনি। অন্বেষণ চলতে থাকবে। আরও লক্ষ লক্ষ বৎসর। নিরবধি কাল।’

‘আমি কিন্তু এ ভার বইতে পারছিনে, ভাই।’ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল তন্ময়। ‘আমি সরে দাঁড়ালুম। অন্বেষণ চলতে থাক। আমি অচল। রাজ যেদিন চলে যায় সেই দিন থেকে অচল। সেদিন আমার উচিত ছিল তার অন্বেষণ করা, তার পশ্চাদ্ধাবন করা। সব সহ্য করে তার সঙ্গে লেগে থাকা। তা তো আমি পারলুম না। আমি এক হিসাবে অসমর্থ পুরুষ। নেহাত মিথ্যে বলেনি সে। দৈহিক অর্থই একমাত্র অর্থ নয়।’

‘আমারও ভুল হয়েছিল বকুলের মুখের কথাকে মনের কথা ভেবে তার অন্বেষণ ছেড়ে দেওয়া, তার পশ্চাদ্ধাবন ত্যাগ করা।’ সুজন বলল অনুশোচনার সঙ্গে। ‘বিবাহের বাসনা প্রবল হয়েছিল, বৃদ্ধ পিতার মৃত্যুযন্ত্রণা সইতে পারিনি। তখন তো বুঝতে পারিনি যে বকুলের জীবনের মূলে কুড়ুলের কোপ লেগেছে। বকুল এখন ছিন্নমূল। আমিও তাই। অন্বেষণের ধারা বহমান রাখা কি আমার কাজ! অনুত্তম, কান্তি, তোরা দু-জনে এগিয়ে যা। তোদের দু-জনের মধ্যেই সার্থক হব আমরা দু-জন। তন্ময় আর আমি।’

‘আমার দৌড় কতটুকু!’ অনুত্তম বলল ভাঙা গলায়। ‘মহাত্মা বলে রেখেছিলেন তিনি ভ্রাতৃহত্যার জীবন্ত সাক্ষী হবেন না। আমিও বলে রেখেছি যে আর একটা সাম্প্রদায়িক নরমেধ ঘটলে আমি প্রাণ দেব। অন্বেষণের ধারা বহমান রাখা আমার পক্ষে কী করে সম্ভব! আমাকেও বাদ দে। ওই কান্তিই আমাদের সকলের যৌবন। ওর সার্থকতাই আমাদের সার্থকতা।’

তখন ওরা কান্তিকে ঘিরে বসল। বলল, ‘কান্তি, তুই আমাদের সকলের তারুণ্য। তোর সার্থকতায় আমাদের সার্থকতা। অন্বেষণের ধারা অব্যাহত থাকবে তোর মধ্যে, তোর অন্বেষণের মধ্যে। জীবনমোহনের যোগ্য উত্তরসাধক তুই, কান্তি। আমরা নই।’

কান্তি অভিভূত হল। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার ঘর নেই। আমি অনিকেত। আমার সংসার নেই। আমি অসংসারী। আমার সঞ্চয় নেই। আমি অসঞ্চয়ী। সম্বল বলতে আমার একটা সুটকেস ও একখানা কম্বল। কোথাও বাঁধা পড়ব না বলে বিয়ে করিনি ও করব না। বিবাহই একমাত্র বন্ধন নয়। তার চেয়ে বড়ো বন্ধন সুরত। সে বন্ধনও আমি পরিহার করেছি ও করব। কিন্তু নারীকে আমি পরিহার করিনি। করব না। তার রস আস্বাদন করেই আমি ক্ষান্ত। নারীর মধ্যে চিরন্তন হচ্ছে তার রস। তার রসকলি।’

‘তাই কি!’ অনুযোগ করল অনুত্তম। ‘চিরন্তন হচ্ছে তার শক্তি। তার সিঁথির সিঁদুর।’

‘চিরন্তন তার অন্তর্দীপ্তি। তার তুলসীতলার প্রদীপ।’ নিবেদন করল সুজন।

‘তার অঙ্গসুষমা। তার নীবিবন্ধ।’ অভিমত দিল তন্ময়।

কান্তি হেসে বলল, ‘এ সেই অন্ধের হাতি দেখার মতো হল। আমরা চার জনে চার জায়গায় হাত রেখেছি। চার জনের সত্য যদি এক জনের হয়, চার জন যদি হয় এক জন, তা হলে আমাদের সকলের কথা হবে এক কথা। পাই আর না পাই, হারাই আর না হারাই, আমরা কেউ ব্যর্থ হইনি। আমাদের চারটি কাহিনি মিলে একটি কাহিনি।’

‘সে কাহিনি একই রাজকন্যার, যে কন্যা সব নারীর কল্পরূপ।’ বলল সুজন।

‘যে নারী চিরন্তনী।’ বলল অনুত্তম।

‘যে চিরন্তনী ক্ষণিকা।’ বলল তন্ময়।

কান্তি তার বন্ধুদের হাত নিজের হাতের ভিতর টেনে নিল। বলল, ‘পিছন ফিরে তাকাব না। কিন্তু যদি তাকাই তা হলে যেন একককেই দেখতে পাই, একাধিককে নয়। যখনি তাকাই তখনি যেন দেখতে পাই সেই এককের অফুরান সৌন্দর্য।’

‘অফুরন্ত প্রীতি।’ ইতি সুজন।

‘অসীম সাহস।’ অথ অনুত্তম।

‘অপার করুণা।’ অতঃপর তন্ময়।

রাত গভীর হয়ে আসছিল। আর দেরি করা যায় না। সুজনের উনি যেকোনো সময় এসে পড়বেন। তন্ময়ের ইনি ক্ষমা করবেন না। অনুত্তমের চিটাগং মেল সকাল ছ-টায়। কান্তিকে মহারাজা প্রাতরাশের নিমন্ত্রণ করেছেন। মহারানির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন।

কান্তি বলল, ‘সামনের দিকে তাকালেও সেই একককেই দেখতে পাব। তন্ময়ের ঘরে তিনিই এসেছেন। সুজনের ঘরেও তিনি। কোনো খেদ রাখব না। ধন্যবাদ জানাব পদে পদে, কথায় কথায়।’

‘শত শত ধন্যবাদ।’ জানাল অনুত্তম।

‘শত সহস্র ধন্যবাদ।’ জ্ঞাপন করল তন্ময়।

‘সহস্র সহস্র ধন্যবাদ।’ শেষ করে দিল সুজন।

একা কান্তি যাত্রা করল চার জনের হয়ে। অন্বেষণের ধারা বহমান রাখতে। যৌবনের প্রান্তে উপনীত হয়ে তন্ময় সুজন অনুত্তম আবিষ্কার করল যৌবন ফুরিয়ে যায়নি। যৌবনের স্বপ্ন মিলিয়ে যায়নি। যেখানে অস্ত সেখানেই উদয়। যেখানে অন্ত সেইখানে আদি। যেমন বর্ষশেষ ও বর্ষারম্ভ।

(১৯৫২-৫৩)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *