যাত্রারম্ভ
তারা স্থির করেছিল বেরিয়ে পড়বে, কিন্তু কীসের অভিমুখে তা স্থির ছিল না। তাদের লক্ষ্য স্থির করে দিলেন জীবনমোহন। অতি দূর সে লক্ষ্য। কোনোদিন সেখানে পৌঁছোনো যাবে কি না সন্দেহ। স্বয়ং জীবনমোহন কি পৌঁছেছেন!
সে-কথা কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেনি। শুধু তন্ময় তাঁকে আপন মনে গুন গুন করতে শুনেছে, ‘হায় কন্যা শামারোখ।’
শোনা অবধি কী যে হয়েছে তন্ময়ের, থেকে থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে, আর বলে, ‘হায় কন্যা রূপমতী!’
এ নিয়ে পরিহাস করে কান্তি। বুক চাপড়ে বলে, ‘হায় কন্যা কান্তিমতী!’
অনুত্তম তা শুনে বলে, ‘এ আবার কী নতুন খেলা শুরু হল! আমাকেও হা-হুতাশ করে বলতে হবে নাকি, হায় কন্যা পদ্মাবতী, হায় কন্যা পদ্মিনী!’
মুখচোরা সুজন মুখফুটে কিছু বলবে না। নইলে তাকেও বলতে শোনা যেত, ‘হায় কন্যা কলাবতী!’
কান্তি গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘তন্ময়কে তা বলে প্রশ্রয় দিতে পারিনে। একদিন তার মোহভঙ্গ হবে। কষ্ট পাবে।’
‘কেন বল দেখি?’ তন্ময় প্রশ্ন করে।
‘কেন?’ কান্তি বলে যায়, ‘চিরন্তনীকে কেউ কোনোদিন রূপের আধারে পায়নি।
পাবি কী করে? সে তো রূপে নেই, আছে রূপের ইঙ্গিতে। কোনো মেয়ের চাউনিতে, কারও হাসিতে, কারও কেশপাশে, কারও কন্ঠস্বরে। রূপের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে, আভাস দিয়ে যায়, কারও ক্ষণিক পরশ, কারও ক্বচিৎ সঙ্গ। তুই আশা করছিস একজন কেউ আছে যে তিলোত্তমার মতো সুন্দরী। একজন কেউ আছে যাকে ধরা যায়, ধরে রাখা যায়, দিনের পর দিন, সারাবছর, জীবনভর!’
‘নিশ্চয়’। তন্ময়ের বচনে অবিচলিত প্রত্যয়। ‘কেন আশা করব না? কতটুকু দেখেছি এই পৃথিবীর! সেইজন্যেই তো আমি দেখতে বেরিয়েছি দেশ-বিদেশ। দেখতে বেরিয়েছি তাকে যার নাম দিয়েছি রূপমতী। সে আছে। এবং আমি তাকে ধরবই, ধরে রাখবই, ঘরে ভরবই। তবে হ্যাঁ, দশ-বিশ বছর সময় লাগতে পারে। খুঁজতে খুঁজতে, খুঁজতে খুঁজতে আয়ু ফুরিয়ে আসবে হয়তো। সেইজন্যেই তো বলছি, হায় কন্যা রূপমতী! একবার দয়া করে ঠিকানাটা তোমার জানাও।’
হাসির কথা। কিন্তু হাসতে গিয়ে হাসি পায় না একজনেরও। তন্ময়ের ব্যাকুলতা তাদের অভিভূত করেছিল।
সুজন বলে, ‘সে আছে বই কী। তবে তার রূপ তার দেহের নয়, তার আত্মার, তার অন্তরের। কাচের আড়ালে যেমন আলো থাকে, সে আলো কাচের নয়, সে আলো শিখার, এও তেমনি। আমি যার ধ্যান করি সে শুকতারার মতো প্রভাময়ী, তার প্রভা কোনো অদৃশ্য আলোকবর্তিকার। কিন্তু তাকে আমি কোনোদিন পাব এ আশা আমার নেই। এযেন তারকার জন্যে পতঙ্গের তৃষা।’
এবার অনুত্তমের পালা। ‘আমার পদ্মাবতী’, বলে অনুত্তম, ‘ভরা পদ্মার মতো রূপসি। রূপ তার দেহে নয়, আত্মায় নয়, শতধার ইঙ্গিতে নয়, রূপ তার গতিবেগে, রূপ তার ক্রিয়ায়। আমি যার ধ্যান করি সে সুন্দরী নয়, কিন্তু কাজ তার সুন্দর। দেশের জন্যে মাথার চুল কেটে দিতে পারে কে? পদ্মাবতী। আগুনে ঝাঁপ দিতে পারে কে? পদ্মিনী। তাকে কি পাওয়া যায় যে আমি পাব! তবে সে আছে নিশ্চয়।’
চার জনের লক্ষ্য এক, কিন্তু ধ্যানরূপ বা রূপধ্যান চতুর্বিধ। এটা আরও স্পষ্ট হয় যখন তন্ময় বলে, ‘চিরন্তনী নারী বলতে বোঝায় আগে নারী তার পরে চিরন্তনী। যে নারীই নয় সে চিরন্তনী হবে কী করে। আমি যাকে চাই সে আমার সঙ্গিনী, আমার জায়া, আমার সন্তানের জননী। সে আমাকে আনন্দ দেবে, তাকে নিয়ে আমি সুখী হব। এই-সব কারণে তাকে আমার পাওয়া দরকার। ধরে রাখা দরকার। আমি চাই সহজ স্বাভাবিক জীবন, যাকে বলে গার্হস্থ্য আশ্রম। কিন্তু এই সব নয়। এর উপরে চাই রূপলাবণ্য, যার বিকাশ দেহবৃন্তে। অনুপম রূপলাবণ্য, অসাধারণ সৌন্দর্য। যা কোনোদিন শুকিয়ে যাবে না, আশি বছরেও তাজা থাকবে।’
‘অ্যাঁ! বলিস কী রে!’ কান্তি তামাশা করে। ‘কেবল রূপ নয়, যৌবন! তাও পাঁচ-দশ বছর নয়, আশি বছর! ষোড়শী কোনো দিন জরতী হবে না! এই মাটির শরীরে এও তুই আশা করিস।’
‘তন্ময় কিনা তন্ময়।’ টিপ্পনী কাটে অনুত্তম।
সুজন অন্যমনস্কভাবে বলে, ‘না, না। চিরন্তনী নারী বলতে বোঝায় আগে চিরন্তনী, তার পরে নারী। আগে অন্তর, তার পরে বাহির। আগে আত্মা, তার পরে দেহ। আমি যার ধ্যান করি সে যদি আমার সঙ্গিনী না-হয় তা হলেই বা কী আসে যায়! সে যেখানেই থাকুক, যত দূরেই থাকুক, তার কিরণ এসে আমার গায়ে পড়ছে। পড়তে থাকবে। তাকে বিয়ে করতে পারলে ধন্য হতুম। কিন্তু তা কি সম্ভব! আর কাউকে বিয়ে করে তার ধ্যান করাও সম্ভব নয়। কাজেই আর কাউকে বিয়ে করাও অসম্ভব।’
কান্তি আবার রঙ্গ করতে যায়, কিন্তু অনুত্তম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমার মনে হয় সুজন জোর দিতে চায় চিরসৌন্দর্যের উপরে, শাশ্বত সুষমার উপরে, যা মূর্ত হয়েছে নারীতে, নারীর নারীত্বে। আর তন্ময় জোর দিতে চায় নারীত্বের উপরে, নারীর রূপযৌবনের উপরে, যা পার্থিব হয়েও চিরন্তন। আমি বলি, চিরন্তনী নারী হচ্ছে সেই নারী যে প্রাত্যহিক জীবনে নিতান্ত সাধারণ অথচ সংকট মুহূর্তে একান্ত অসাধারণ। যার ঘোমটা খসে যায়, মুখ দেখতে পাওয়া যায় ঝড়ের রাতে বিজলির ঝিলিকের মতো। সে আর কতটুকু সময়ের জন্যে! সেইটুকু সময় যদি দীর্ঘতর সময়ে পরিণত করার মন্ত্র জানা থাকত তা হলে ওই মন্ত্র পড়ে আমি তাকে বিয়ে করতুম। তা কি আমি জানি যে বিয়ের স্বপ্ন দেখব।’
‘বিয়ে! বিয়ে!’ কান্তি এবার বিরক্তির স্বরে বলে, ‘ছেলেভোলানো ছড়া থেকে বুড়োভোলানো কবিতা পর্যন্ত সব জায়গায় দেখি বিয়ে! আচ্ছা বিয়ে পাগলা দেশ যাহোক। আমি কিন্তু বিয়ের মহিমা বুঝিনে। বিয়ে আমি করব না। আশি বছরের আয়েষাকেও না, আশমানের শুকতারাকেও না, অচপল চপলাকেও না। কোনো মেয়েকেই না। আমার চিরন্তনী নারী এক আধারে নেই, সকলের মধ্যে আছে। তিলোত্তমা নয়, তিলে তিলে ছড়ানো।’
তারপর নিজেই নিজের রসিকতায় হেসে ওঠে। ‘একজনকে বিয়ে করলে আর পনেরো হাজার ন-শো নিরানব্বই জনের উপর অবিচার করা হয়। আমি তো দ্বারকার শ্রীকৃষ্ণ নই যে ষোলো হাজার জনের উপর সুবিচার করব। আমি বৃন্দাবনের কানু, সুবিচারের ভয়ে সবাইকে ছেড়ে যাই, এমনকী রাধাকেও।’
তন্ময় ব্রাহ্ম পরিবারে মানুষ হয়েছে। এসব কথা তার সংস্কারে বাধে। প্রাণে বাজে। সে কানে আঙুল দিয়ে বলে, ‘আমার জীবনের সূত্র একমেবাদ্বিতীয়ম।’
সুজন ব্রাহ্ম না হলেও ব্রাহ্ম সমাজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনা করেছে, খেলাধুলা করেছে। ওদের উৎসবে যোগ দিয়েছে, উপাসনায় চোখ বুজেছে। সেও আঘাত পেয়ে বলে, ‘আমি নিরাকারবাদী।’
অনুত্তম গান্ধীশিষ্য। পিউরিটান। সেও মর্মাহত হয়। বলে, ‘কান্তি, তুই নাচতে যাচ্ছিস, এই যথেষ্ট স্বৈরাচার। আর বেশি দূর যাসনে। গেলে পতন অবধারিত।’
‘তোরা বড়ো বেশি সিরিয়াস। লীলা কাকে বলে জানিস নে। ভয়ের দিকটাই দেখিস। কিন্তু যারা নাচতে জানে তারা সাপের মাথায় ভেকেরে নাচায়। আমি সহজিয়া।’ এই বলে কান্তি যবনিকা টেনে দেয়।
জীবনমোহন তখনও ছিলেন পুরীতে। তাদের চার বন্ধুর বিতর্ক তাঁর কানে পৌঁছোল। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘নুনের পুতুল যখন সমুদ্র অন্বেষণে যায় তখন কী হয়? কী বলেছেন রামকৃষ্ণদেব? তোমরাও যাচ্ছ সাগরের মতো আকাশের মতো চিরন্তনের সন্ধানে। যদি কোনোদিন তাকে দেখতে পাও যা দেখবে তা তোমাদের কল্পনার অতীত। ধ্যানের অতীত। তাকে নিজের প্রতিমার ছাঁচে ঢালাই করতে চেয়ো না। চাইলে দেখবে সে রূপমতী বা কলাবতী নয়, পদ্মাবতী বা কান্তিমতী নয়। সে কে বলব? সে তন্ময়িনী বা সুজনিকা, কান্তিরুচি বা অনুত্তমা।’
তারপর হাসি ছেড়ে বললেন, ‘তাকে পাওয়া না পাওয়ার চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। আকাশকে কেউ কোনোদিন ধরতে পেরেছে? ঘরে ভরতে পেরেছে? অথচ ঘর জুড়ে রয়েছে আকাশ নয় তো আর কে? পাব, একথা জোর করে বলতে নেই। পাব না, একথাও মনে করতে নেই।’
ওরা তাঁকে ঘিরে বসে শুনতে লাগল। তিনি বলতে লাগলেন, ‘অনুত্তম, কান্তি, তন্ময়, সুজন। এ অন্বেষণ সুখের অন্বেষণ নয়। একে যেন সুখের অন্বেষণ করে না তোল। সুখ যে কোনোদিন আসবে না তা নয়। আপনা হতে আসবে, আপনা হতে যাবে। তার আসা-যাওয়ার দ্বার খোলা রেখো। অনুত্তম, তোমাকে এসব না বললেও চলত। বরং এর বিপরীতটাই বলা উচিত তোমাকে। না, এটা দুঃখের অন্বেষণও নয়। আর সুজন, তোমাকেও বলার দরকার ছিল না। তুমিও তো সুখের চেয়ে দুঃখের প্রতি প্রবণ। আর কান্তি, তোমাকে যা বলেছি তাই যথেষ্ট। শুধু তন্ময়, তোমার জন্যেই আমার ভাবনা। মনে রেখো, সুখের অন্বেষণ তোমার জন্যে নয়। তোমার জন্যে রূপের অন্বেষণ। তুমি তার জন্যে।’
ওরা চার জনে নত হয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিতে গেল। তিনি বললেন, ‘থাক, থাক, হয়েছে, হয়েছে। আমি এর পক্ষপাতী নই।’ তারপর ওদের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।’
যাত্রা? যাত্রার জন্যে ওরা ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু ওদের ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল যে কেউ কারও সহযাত্রী হবে না। সেইজন্যে যাত্রার দিন বিনা বাক্যে পেছিয়ে দিচ্ছিল। ওদিকে ওদের পরীক্ষার ফল বেরিয়ে গেছিল। কাজেই কালহরণের তেমন কোনো অজুহাত ছিল না। সুজন ও তন্ময় পাস করেছে, অনুত্তম ও কান্তি করেনি। এইরকমই হবে ওরা জানত। কান্তি তো ইচ্ছা করেই শূন্য খাতা দাখিল করেছিল কয়েকটা পেপারে। পাস করলে পাছে তার গুরুজন তাকে যেতে না দেন গন্ধর্ব-বিদ্যা শিখতে গন্ধর্ব হতে। আর অনুত্তম সময় পেল কখন যে পরীক্ষার পড়া করবে!
যাত্রার প্রসঙ্গে পরিকল্পনার প্রশ্ন উঠল আবার। কান্তি বলল, ‘আমাদের পরিকল্পনায় সেই যে ফাঁক ছিল সেটা কি তেমনি আছে না ভরেছে? কীসের যেন অভাববোধ করছিল কেউ কেউ? এখনও কি করে?’
অনুত্তম তাকাল তন্ময়ের দিকে, তন্ময় সুজনের দিকে। সুজন বললে, ‘না, আমার তো আর অভাববোধ নেই। পেলেই যে অন্তর ভরে তা নয়। না পেলেও ভরে যদি জ্ঞাননেত্র খুলে যায়। জীবনমোহন আমাদের নেত্র উন্মীলন করেছেন। তিনি আমাদের গুরু।’
‘আমারও অভাববোধ নেই,’ স্বীকার করল তন্ময়। ‘পেতে চাই। পাইনি। তবু আমার অন্তর পূর্ণ। যার অন্বেষণে যাচ্ছি সেই জুড়ে আছে অন্তর। জুড়ে থাকবেও।’
‘আমি যে কাকে চাই তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। হয়তো এ জীবনে কোনোদিন তার দেখা পাব না, তবু আমার অভাববোধ থাকবে না।’ বলল অনুত্তম।
কান্তি বলল, ‘অভাবের কথা আর যেই তুলুক আমি তুলিনি। অভাববোধ করা আমার স্বভাব নয়। কেমন করে যে আমার সব অভাব মিটে যায় আমিই কি তা বুঝি! জীবন দেবতা সদয়।’
তারপর তাদের কথাবার্তা আর একটু অন্তরঙ্গ পর্যায়ে উঠল। তন্ময় বলল, ‘আমার পরিকল্পনা মোটের উপর তেমনি আছে। বিলেত যাব, বিলেত থেকে ফিরে একটা কাজকর্ম জুটিয়ে নেব। বিয়ে করব, ঘর সংসার পাতব। তবে কাকে বিয়ে করব এখন তা ঠিক হয়ে গেছে। রূপমতীকে।’
‘এটা জীবনমোহনের ঘটকালিতে।’ এই বলে কান্তি হেসে আকুল হল।
‘এখন কেবল একটা নিমন্ত্রণপত্র বাকি।’ টিপ্পনী কাটল অনুত্তম।
‘তোদের কেবল হাসি, কেবল ঠাট্টা!’ তন্ময় কপট রোষ প্রকট করল।
‘তারপর, সুজন, তুই চুপ করে রইলি যে! বোধ হয় ভাবছিস কাকে বিয়ে করা উচিত তা তো ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু তার বাপের মত নেই আর সে নিজে পর্দার আড়ালে।’ কান্তি পরিহাস করল।
‘না, পর্দার আড়ালে সে নয়। ছাতার আড়ালে সুজন।’ রহস্য করল অনুত্তম।
‘তা হলে,’ তন্ময় ফুর্তি করে বলল, ‘আমাকেও হাটে হাঁড়ি ভাঙতে হচ্ছে। এই নীল চশমাটি কীসের জন্যে? বেড়াল চোখ বুজে দুধ খায় আর ভাবে কেউ টের পাচ্ছে না।’
সুজন শেষে মুখ ফুটে বলল, ‘না, আমার পরিকল্পনায় বিয়ের জন্যে স্থান সংরক্ষিত নেই। বিয়ে যদি হয়ে যায় তো হয়ে যাবে একটা আকস্মিক ঘটনার মতো। আমিও আশ্চর্য হব। তোরাও হবি। আকস্মিকের জন্যে তখন জায়গা ছেড়ে দিতে হবে।’
কান্তি রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘তার মানে ন্যাড়া, খাবি? না হাত ধোব কোথায়?’
অনুত্তম গম্ভীরভাবে বলল, ‘ছদনাতলায়।’
হেসে উঠল চার জনেই। সুজন স্বয়ং।
এরপরে এল অনুত্তমের পালা। তন্ময় বলল, ‘অনুত্তম যাই বলুক না কেন আমি বিশ্বাস করব না যে ও চিরকাল দেশের কাজ নিয়ে থাকবে।’
‘কে বলল চিরকাল দেশের কাজ নিয়ে থাকব?’ অনুত্তম প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘দেশ যতদিন পরাধীন ততদিন দেশের কাজ আমার পরিকল্পনায় প্রধান অংশ নেবে। তার পরে যেমন সর্বত্র হয়ে থাকে তেমনি এখানেও হবে। সৈনিক ফিরে যাবে নিজের কাজে। আমি কেন ধরে নেব যে দেশ চিরদিন পরাধীন থাকবে? স্বাধীন ভারত আমাদেরই হাত দিয়ে হবে।’
‘তার পরে তুই কী করবি? ঘরসংসার? বিয়ে?’ প্রশ্ন করল তন্ময়।
‘করতেও পারি’, উত্তর দেয় অনুত্তম। ‘করতে আমার অনিচ্ছা নেই যদি ঝড়ের রাতের চলবিদ্যুৎকে বাতিদানের স্থিরবিদ্যুতে পরিণত করার কৌশল জানি। কিন্তু বিদ্যুৎ যদি তার বিদ্যুৎপনা হারায় তা হলে তাকে নিয়ে আমি কী করব। বিয়ে যারা করে তারা বিদ্যুৎকে করে না, খদ্যোতকে করে। বিদ্যুৎ আপনি খদ্যোত হয়ে যায়। সেইজন্যে আমি ওকথা ভাবতে চাইনে, তন্ময়।’
এর পরে কান্তি। ‘কান্তি তো বিয়ে করবে না বলে ঘোষণা করেছে। ওকে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া উচিত নয়।’ তন্ময় বলল বিজ্ঞ সমাজপতির মতো।
‘বটে!’ কান্তি খোশমেজাজে বলল, ‘মেয়েরা তা হলে মিশবে কার সঙ্গে? বিয়ে তো মাত্র একজনের সঙ্গে হয়। সেই একজন ছাড়া আর কারও সঙ্গে মিশতে পারবে না?’
তন্ময় সহসা উত্তর খুঁজে পেল না। সুজনের দিকে তাকাল। সুজন বলল, ‘কান্তির পরিকল্পনায় বিয়ের জন্যে স্থান নেই; আকস্মিকের জন্যেও সে জায়গা রাখেনি। কিন্তু নারীর জন্যে আসন আছে। তন্ময়ের এটা ভালো লাগছে না। অনুত্তম তো একে স্বৈরাচার বলেছে। আমি নীতিনিপুণ নই, তবু আমারও কী জানি কেন কোথায় যেন বাধছে। কান্তি, আমি তোকে বিচার করতে চাইনে। কিন্তু কথাটা একটু ভেবে দেখিস।’
কান্তি ভাবুকের মতো মুখ করে বলল, ‘তোদের তিন জনেরই মনের কথা এই যে নারী তোদের জন্যে নীড় বাঁধে। যে পাখি আকাশের সে হয় নীড়ের। উড়ে যার সুখ, সে উড়তে ভুলে যায়। নারীর নিজের মনের কথা কিন্তু তা নয়।’
অনুত্তম মশকরা করে বলল, ‘শোনো, শোনো।’
তন্ময় বলল, ‘আচ্ছা, শুনি।’
কান্তি বলল, ‘আমাদের চার জনের পরিকল্পনায় সংগতি থাকলে খুশি হতুম আমিই সব চেয়ে বেশি! কিন্তু তা হবার নয়। তবে আমাদের চার জনেরই জীবনের মূলসূত্র এক। কী বলিস, সুজন?’
সুজন কান্তিকে দুঃখ দিতে চাইল না। বলতে পারত, স্বৈরাচার তো মূলসূত্রবিরোধী। বলল, ‘মোটামুটি এক।’
‘তবে আর কী!’ কান্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিদায়ের দিন এই কথাটাই মনে থাকবে আমাদের যে আমরা সব রকমে স্বাধীন, তবু একসূত্রে গাঁথা। সেই অদৃশ্য সূত্রই আবার আমাদের টেনে নিয়ে আসবে যেমন করে টেনে আনে আকাশ থেকে ঘুড়িকে।’
‘হ্যাঁ, আবার আমরা মিলব।’ বলল অনুত্তম।
‘মিলব একদিন-না-একদিন। হয়তো দশ বছর পরে।’ বলল সুজন।
‘হয়তো কেন?’ তন্ময় বলল তার স্বভাবসিদ্ধ ঐকান্তিকতার সঙ্গে। এখন থেকে একটা দিন ফেলা যাক। এটা ১৯২৪ সাল। ঠিক এক দশক পরে ১৯৩৪ সালে আমরা যে যেখানে থাকি এইখানে এসে মিলিত হব। এই সাগরতীরে। এই আষাঢ় পূর্ণিমায়।
‘সে কি সম্ভব?’ অনুত্তম আপত্তি জানাল। ‘যদি জেলে থাকি সে সময়?’
‘তার আগেই’ সুজন বলল প্রত্যয়ভরে, ‘দেশ স্বাধীন হয়ে থাকবে।’
‘বলা যায় না। যে শক্তির সঙ্গে আমাদের বিরোধ তার হাতে কেবল অস্ত্রবল আছে তা নয়, তার পাতে বিস্তর রুটির টুকরো, মাছের কাঁটা। গোটাকয়েক ছুড়ে ছড়িয়ে দিলে আমাদেরই মধ্যে কামড়াকামড়ি বেধে যাবে। অনায়াসে আরও দশ-বিশ বছর।’
‘বেচারা অনুত্তম!’ কান্তি দরদের সঙ্গে বলল, ‘তোর জন্যে সত্যি খুব দুঃখ হয়। কেন যে তুই নামতে গেলি পলিটিকসে।’
‘তা হলে এখন থেকে দিনক্ষণ স্থির করে ফল নেই,’ তন্ময় বলল নিরাশার সুরে। ‘তবে চেষ্টা করতে হবে দশ বছর পরে মিলতে। কেমন, রাজি?’
‘আচ্ছা।’ বলল অনুত্তম, সুজন, কান্তি।
‘তবে’, কান্তি এটুকু জুড়ে দিল, ‘তন্ময়ের তন্ময়িনী আর সুজনের সুজনিকা এঁদের ‘আচ্ছা’র উপর নির্ভর করছে আমাদের ‘আচ্ছা’। কী বলিস, অনুত্তম?’
‘তুইও যেমন। ভেবেছিস এ জন্মে ওদের বউ জুটবে?’ অনুত্তম বলল সংশয়ের সুরে। ‘জীবনমোহন যা খেপিয়ে দিয়েছেন তার জের চলবে জীবনভোর। আমার আশঙ্কা হয় এ অন্বেষণ ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে আরও কঠিন, আরও সময়সাপেক্ষ।’
বেচারা তন্ময়! সে কী যেন বলতে চেয়েছিল, বলতে পারল না। গলায় পাথর চাপা।
তখন সুজন বলল,
‘মরব না কেউ তন্ময়িনী সুজনিকার শোকে।
রূপমতী কলাবতী আছেন মর্ত্যলোকে।’
তা শুনে সকলে হেসে উঠল। এবার তন্ময় তার বাকশক্তি ফিরে পেল। বলল, ‘এখন থেকে যে যার নিজের ইষ্টদেবীর ধ্যান করবে। কার কপালে কী আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। পুরুষস্য ভাগ্যম। কে জানে হয়তো আমার রূপমতী পৃথিবীর ওপিঠে আছে। ওপিঠে গেলেই দেখতে পাব।’
‘ওপারেতে সব সুখ!’ অনুত্তম ব্যঙ্গ করল।
‘থাক, থাক। ও প্রসঙ্গ আর নয়।’ কান্তি ওদের থামিয়ে দিল। ‘এখন থেকে আমরা স্বতন্ত্র। সত্যি কেউ কি জোর করে বলতে পারে কার বরাতে কী জুটবে—পূর্ণতা কী শূন্যতা কী মামুলি এক উকিল-দুহিতা, সঙ্গে বারো হাজার টাকা পণযৌতুক!’
আর এক দফা হাসির ঢেউ উঠল। ‘তোর ভ্যালুয়েশন বড়ো কম হয়েছে। তন্ময় কখনো ব্যারিস্টারের নীচে নামবে না, যদি নামে তবে বত্রিশের কমে নয়। মানে বত্রিশ হাজারের।’ বলল অনুত্তম।
‘অনুত্তম’, তন্ময় হাসতে হাসতে বলে, ‘তুই তোর নিজের চরকায় তেল দে। ওই চরকার দৌলতে যদি স্বরাজ হয় তা হলে স্বরাজের দৌলতে তোরও একটা হিল্লে হয়ে যাবে। বিনা পণে বিয়ে করবি সে আমি লিখে দিতে পারি। কিন্তু শ্বশুর নির্বাচনে কৃতিত্বের পরিচয় দিবি। কোনো এক সর্বত্যাগী দলপতি যাঁর দুয়ারে বাঁধা হাতি।’
‘এখন থেকে আমরা স্বতন্ত্র।’ কান্তির এই উক্তির পুনরুক্তি করল সুজন। ‘কাজেই ও প্রসঙ্গ থাক। তা ছাড়া জীবনমোহনের কাছে আমরা যে অঙ্গীকার করেছি তার সঙ্গে ও প্রসঙ্গ মানায় না। লক্ষ্য আমাদের উচ্চ। আমাদের উঠতে হবে সেই উচ্চতায়। আমি তো দেখছি আমাদের প্রত্যেকের ভাগ্যে দুঃখ আছে। এসব হালকা কথার দ্বারা কি দুঃখকে উড়িয়ে দেওয়া যায়! তার চেয়ে বল, আমরা দুঃখের জন্যে প্রস্তুত, কিন্তু আমরা রাজপুত্র। রাজকন্যা ভিন্ন আর কাউকে বিয়ে করব না, করতে পারিনে। তার অন্বেষণেই আমাদের যাত্রা। আর কারও অন্বেষণে নয়।’
তন্ময়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কোনোমতে বলল, ‘সুজন, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তোকে আমি মিস করব।’
‘হে সুজন, শ্রীকান্তির লহ নমস্কার। আমাদের বাণীমূর্তি তুমি।’ কান্তি তাকে হাত তুলে নমস্কার করল।
আর অনুত্তম? সে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘জীতা রহো।’
অবশেষে সেই রাতটি এল যার পরের দিন তাদের যাত্রা। চার কুমার চারদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাবে না। পিছনে পড়ে থাকবে এই বৃক্ষ—এই পুরীর সিন্ধুতীর।
বার বার চোখে জল এসে পড়ে, গলা ভারী হয়ে যায়, দীর্ঘনিঃশ্বাস ওঠে। একজন আরেক জনের হাত চেপে ধরে, ছেড়ে দেয় না। উদাস কন্ঠে বলে, ‘আবার কবে আমাদের দেখা হবে? কবে? কোন অবস্থায়?’
‘মনে রাখিস। ভুলে যাসনে।’ তন্ময় বলল কান্তিকে। ‘তোর যা ভোলা মন।’
‘চিঠি লিখিস, যেখানেই থাকিস।’ অনুত্তম বলল তন্ময়কে। ‘তোর যা কুঁড়ে হাত।’
‘লেখাটেখা কাগজে ছাপা হলে মাঝে মাঝে পাঠিয়ে দিস।’ কান্তি বলল সুজনকে। ‘তোর যা লাজুক স্বভাব।’
‘এবার তো গান্ধী ফিরেছেন। গ্রামে গিয়ে কাজ করতে বলবেন। কলকাতায় এলে খবর দিস।’ সুজন বলল অনুত্তমকে। ‘তোর যা অফুরান ব্যস্ততা।’
চার জনে চার জনকে কথা দিল, ‘নিশ্চয়। নিশ্চয়। সে আর বলতে!’
কিন্তু কথা দিলে কী হবে! প্রত্যেকেই মনে মনে বুঝল যে, কথা দেওয়া সহজ, কথা রাখা কঠিন। তারা যে ঘাটের নৌকা। ঘাট ছেড়ে ভাসতে শুরু করলে কে যে কোথায় ভেসে যাবে নিজেই জানে না। যোগাযোগ রাখবে কী! তবু বলতে হয়, ‘নিশ্চয়। নিশ্চয়।’
পরিকল্পনাও কি ঠিক থাকবে? মূলসূত্র। তার কি কোনো এদিক-ওদিক হবে না? হরি! হরি! মানুষ করবে জীবনের উপর খোদকারি! তবু ওরা পরস্পরকে আশ্বাস দিল যে ওদের এত কালের জল্পনাকল্পনা আলাপ-আলোচনা ব্যর্থ হবে না। এত পরিশ্রম করে যে ভিত গড়া হয়েছে তার গাঁথুনি পাকা।
‘কে কী পাবে না পাবে, করবে না করবে, হবে না হবে, কেউ জোর করে বলতে পারে না। কিন্তু আমরা বোধ হয় গর্ব করে বলতে পারি যে আমাদের জীবনের বনেদ কাঁচা নয়। কী বলিস রে, সুজন?’
‘যা বলেছিস, অনুত্তম।’
‘কান্তির কী মনে হয়?’
‘আমারও তাই মনে হয়।’
‘তন্ময়?’
‘আমিও সেই কথা বলি।’
চার জনে চার জনের হাতে রাখি বাঁধে। যদিও রাখিপূর্ণিমার দেরি আছে।
তার পরে উঠল যে-কথা তাদের সকলের মন জুড়ে রয়েছে, অথচ একান্ত নিভৃতে। রাজকন্যার কথা।
‘অতীত ব্যর্থ হয়নি, কিন্তু ভবিষ্যৎ ব্যর্থ হবে,’ বলল সুজন, ‘যদি রাজকন্যার অন্বেষণ ছেড়ে অন্যের অন্বেষণ ধরি।’
‘যেমন অন্নের অন্বেষণ।’ কান্তি ইঙ্গিত করল।
‘কিংবা ক্ষমতার।’ তন্ময় মন্তব্য করল।
‘কিংবা সুখের।’ অনুত্তম সতর্ক করে দিল।
কথা যখন নিভে আসছে কথার সলতে উসকে দেয় দু-জন। ‘যাকে আমরা খুঁজতে যাচ্ছি সে হয়তো হাতের কাছে। হয়তো পৃথিবীর ওপিঠে। আমি তাকে হাতের কাছেই খুঁজব। তন্ময় খুঁজবে দেশ-দেশান্তরে।’
‘আর আমি খুঁজব’, কান্তি বলে, ‘রামধনুর রঙে। সব ক-টা রং এক ঠাঁই থাকে না। সব ঠাঁই মিলে এক ঠাঁই।’
‘আর আমি খুঁজব সংকটের সংঘাতের মধ্যে। দৈনন্দিনের মধ্যে নয়।’ অনুত্তম বিপ্লবের আভাস দেয়।
আবার সুজন অগ্রণী হয়। ‘লক্ষ্যের’ ’পর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে। যেমন ছিল অর্জুনের দৃষ্টি। দ্রোণ যখন পরীক্ষা করলেন যুধিষ্ঠির বললেন, পাখি দেখছি। অর্জুন বললেন, পাখির চোখ দেখছি। পাখি দেখতে পাচ্ছিনে। তেমনি আমরাও অনেক কিছু দেখতে পাব না। অনেক কিছু দেখলে আসল লক্ষ্যটাই ধোঁয়া হয়ে যাবে।’
‘সেইটেই হল ভয়ের কথা।’ তন্ময় বলে কান্তির দিকে ফিরে।
‘সত্যি তাই।’ কান্তি কবুল করে।
‘আমার সে ভয় নেই। কেননা আমি যে পরিস্থিতিতে তাকে দেখতে পাব সে পরিস্থিতির জন্যে দেশকে তৈরি করছি।’ ইতি অনুত্তম।
রাত অনেক হয়েছিল। সমস্ত রাত জাগলেও কথা কি ফুরোবার! তন্ময় থাকে হোটেলে। তাকে গা তুলতে হল। অগত্যা আর তিন জনকেও। এই তাদের শেষ রাত্রি, অনির্দিষ্ট কালের জন্যে। বিজয়ার দিন যেমন করে তেমনি কোলাকুলি করে তারা বিদায় নিল ও দিল।
‘আবার দেখা হবে।’ সকলের মুখে এক কথা। ‘যেন সঙ্গে দেখি রূপমতী কলাবতী পদ্মাবতী কান্তিমতীকে।’
চার জনে চারখানা রুমাল ভাসিয়ে দিল সমুদ্রের জলে। ‘এই রইল নিশান।’ তারপরে চার ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।