১০. অনুত্তম ও পদ্মাবতী

অনুত্তম ও পদ্মাবতী

রওশন তার বোরখা খুলে ফেলেছিল। অন্ধকার রাত। ঘোড়ার গাড়ি। একরাশ কালো চুল অনুত্তমের গায়ে এসে পড়ছিল। আহা! শিয়ালদা থেকে শ্যামবাজার যদি লক্ষ যোজন দূর হত, যদি সহস্র বর্ষের পথ হত।

দু-রাত দু-দিন তাদের চোখে পলক পড়েনি। কেবল কি পুলিশের ভয়ে, গোয়েন্দার ভয়ে? না পুনর্দর্শনের আশা নেই বলে? একজন আরেক জনের গায়ে ঢুলে পড়ছিল। কেবল কি ঘুমের ঘোরে? না বিচ্ছেদ আসন্ন বলে? কেউ কারুর নামটা পর্যন্ত জানে না। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের সহযাত্রা শেষ হয়ে যাবে। শেষ যদি হয় তবে হোক না একটু দেরিতে। সেইজন্যে ওরা ট্যাক্সি নেয়নি।

বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে রওশন বলল, ‘কাল আসবেন?’

অনুত্তম চিত্তচাঞ্চল্য দমন করে বলল, ‘কখন?’

‘দুপুরের দিকে। রওশন বললে কেউ চিনবে না। আমার নাম নয়নিকা।’

‘নয়নিকা? কী মধুর নাম!’

‘আপনার নাম যদি কেউ জানতে চায় তা হলে কী বলবেন?’

‘অনুত্তম।’

‘অনুত্তম! মনে রাখবার মতো নাম। মনে রাখবও।’

‘আমিও কি ভুলব নাকি? নয়নিকা আমার নয়নে থাকবে। ধ্যাননেত্রে।’

‘আবার তা হলে দেখা হবে?’

‘নিশ্চয়। নিশ্চয় দেখা হবে।’

ঘোষ লেনের মোড়ে নয়নিকা নেমে গেল। অনুত্তম শুধু ঘোড়ার গাড়ির দরজাটা খুলে ধরল। হিন্দু পাড়ায় মৌলবির সাজ পরে নামতে তার সাহস ছিল না অত রাত্রে। বিশেষত নারী নিয়ে। ইচ্ছা থাকলেও নয়নিকা তেমন অনুরোধ করল না। বরং বোরখাটা ফেলে গেল গাড়িতে।

কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের দোতলায় অনুত্তমের পুরোনো আস্তানা। বন্ধুদের অনেকের জেল হয়ে গেছে। যে দু-এক জন ছিল তাকে আশ্রয় দিল। ওদিকে কিন্তু গাড়োয়ান গিয়ে পুলিশের কানে তুলল যে চট্টগ্রাম মেল থেকে শিয়ালদায় নেমেছেন এক মৌলবি সাহেব ও তাঁর বিবিসাহেবা। বিবি উতরে গেলেন শ্যামবাজারের হিন্দু পাড়ায়, মৌলবি তশরিফ নিয়েছেন কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের দোতলায়।

রাত তখনও পোহায়নি, অনুত্তম সুখস্বপ্ন দেখছে, এমন সময় হানা দিল পুলিশ। বেচারার পরণে তখনও মৌলবির পোশাক। বদলাবার অবকাশ পায়নি, কোনোমতে চারটি মুখে দিয়ে বিছানা নিয়েছে। হাতেনাতে ধরা পড়ে কবুল করতে বাধ্য হল যে সে মুসলমান নয়, হিন্দু। নইলে ওরা হয়তো মুসলমানির লক্ষণ মিলিয়ে দেখত।

তারপর কলেজ স্ট্রিট থেকে লালবাজার। লালবাজার থেকে হরিণবাড়ি। হরিণবাড়ি থেকে বহরমপুর। বহরমপুর থেকে রাজশাহী। অদৃষ্টপুরুষ তাকে নিয়ে পাশা খেলছিলেন। এক একটা দান পড়ে আর ঘুঁটি এগিয়ে চলে দু-ঘর চার ঘর। পেছিয়েও যায়। একটা বড়ো দান পড়ল, দশ দুই বারো। রাজশাহী থেকে দেউলি। সে দান উলটে গেল। দেউলি থেকে রাজশাহী। এরপরে রাজশাহী থেকে বকসা। বকসা থেকে আবার রাজশাহী। অবশেষে অন্তরিন।

অন্তরিন হয়ে তানোর, মান্দা, বদলগাছি, নন্দীগ্রাম, সিংড়া, লালপুর, চারঘাট এমনি সাত ঘাটের জল খেয়ে সে সত্যি সত্যি ছাড়া পেল। কিন্তু ছাড়া পেলেও ছাড়ন নেই। টিকটিকি সঙ্গ নেয় যখনই যেখানে যায়। তবে বাংলাদেশের বাইরে গেলে রেহাই। সুভাষচন্দ্র তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কর্ণধার। তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে অনুত্তমকে পাঠালেন বাংলার বাইরে কুটনৈতিক কাজে। ডিপ্লোম্যাট হয়ে লোকটার চেহারা ও চালচলন গেল বদলে।

সাত বছর ধরে সে দু-টি নারীর ধ্যান করেছে শয়নে স্বপনে জাগরণে। ভারতমাতা, যাঁর জপমন্ত্র বন্দে মাতরম। পদ্মাবতী, যার তপোমন্ত্র বন্দে প্রিয়াম। দু-জনের জন্যেই তার দুর্ভোগ। শুধু একজনের জন্যে নয়। তাই দু-জনের ধ্যানে তাঁর দুর্ভোগ মধুর। হ্যাঁ, আনন্দ আছে মায়ের জন্যে দুঃখ সয়ে, প্রিয়ার জন্যে দুঃখ পেয়ে। আরও তো কত রাজবন্দি সে দেখল। তাদের আনন্দ তার মতো ষোলো আনা নয়। ষোলো কলা নয়। তার আছে নয়নিকা, তাদের কে আছে?

‘অনুত্তম? মনে রাখবার মতো নাম। মনে রাখবও।’ বলেছিল তার নয়নিকা। একটি মেয়ে তাকে মনে রাখবে বলে কথা দিয়েছে। মনে রেখেছে নিশ্চয়। এইখানে তার জিত। তার সাথিদের উপরে জিত। তারা নিছক রাজবন্দি। সে রাজপুত্র। রাজকন্যা তাকে মনে রেখেছে। তার সাথিদের দিকে তাকায়, আর অনুকম্পায় ভরে ওঠে তার মন।

ছাড়া পেয়ে তার প্রথম কাজ হল সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। দ্বিতীয় কাজ নয়নিকার অন্বেষণ। খোঁজ নিয়ে যা শুনল তার চেয়ে শক্তিশেল ছিল ভালো। নয়নিকার বিয়ে হয়ে গেছে। সে যে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে তা নয়। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে গিয়ে এত লোককে বিপদগ্রস্ত করে যে পার্টির কর্তারা প্রাণের দায়ে তার বিয়ের ফতোয়া দেন। পার্টির আদেশ লঙ্ঘন করলে সাজা আছে। অগত্যা বিয়ে করতে হয়। এক বিলেতফেরতা ডেনটিস্ট তাকে বিনা পণে উদ্ধার করেন। তার গুরুজন তো বর্তে যান। পুলিশের দাপটে তাঁদের স্বস্তি ছিল না।

হায় কন্যা পদ্মাবতী! এই ছিল তোমার মনে! অনুত্তম বুকের ব্যথায় আকুলিবিকুলি করে। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না! হলে যাকে দেখব সে তো আমার পদ্মাবতী নয়! আমার মতো হতভাগ্য কে! যাদের আমি অনুকম্পা করেছি তারা একে একে বিয়ে করছে, কর্পোরেশনে কাজ পাচ্ছে, আমিই তাদের অনুকম্পার পাত্র। তোমাকেই বা দোষ দিই কী করে! পার্টির আদেশ। গুরুজনের নির্বন্ধ। ক-জন পারে অগ্রাহ্য করতে!

অনুত্তম ভেবে দেখল, সে নিজেও যে বিয়ে করতে চেয়েছিল তা নয়। দেশ যতদিন না স্বাধীনতা পেয়েছে বিয়ে করার স্বাধীনতা তার নেই। তা বলে কি নয়নিকা তত দিন অপেক্ষা করত? বাংলার কুমারী মেয়ে বাপ মা-র অমতে ক-দিন একলা থাকবে? কে তাকে পুষবে যদি তাঁরা না পারেন? তাঁরা যদি তত দিন বেঁচে না থাকেন? নয়নিকা যা করেছে ঠিকই করেছে। সে এখন পরস্ত্রী। তার দিকে তাকাবার অধিকার অনুত্তমের আর নেই। এমনকী প্রেরণার জন্যেও না।

এইখানেই সুজনের সঙ্গে তার তফাত মুম্বইতে সেদিন সুজনের সঙ্গে আবার দেখা হয়। কান্তিকে জাহাজে তুলে দিতে গিয়ে। দুই বন্ধুতে এ নিয়ে বোঝাপড়ার দরকার ছিল। হল ফেরবার পথে। নয়নিকার বিয়ে হয়ে গেছে জানলে অনুত্তম তার ধ্যান করত না সাত বছর, যা করেছে তা ভুল ধারণা থেকে করেছে। বকুলের বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও সুজন তার ধ্যান করেছে দশ বছর। দেশে থাকতে ও দেশের বাইরে। যা করেছে তা ঠিক ধারণা থেকে করেছে। দু-জনের বোঝাপড়া হল, কিন্তু বনিবনা হল না। সুজন কলকাতা চলে গেল, অনুত্তম থাকল ওয়ার্ধায়।

ওদিকে বল্লভভাইয়ের সঙ্গে বনিবনা হয়নি, গান্ধীর সঙ্গেও হল না। ব্যর্থ, ব্যর্থ, সব ব্যর্থ। তাঁদের অমতে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হলেন, কিন্তু তাঁদের সহযোগিতা পেলেন না। ইস্তফা দিলেন। তারপরে যেসব কেলেঙ্কারি ঘটল তাতে অনুত্তমের মন উঠে গেল দু-পক্ষের উপর থেকে। সে যোগ দিল কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট দলে। জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে। আর বাংলায় ফিরল না। যুদ্ধের প্রথম দিকে কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে, কিন্তু তার পরে দ্বিতীয় পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করে। ইতিমধ্যে জয়প্রকাশ ও অনুত্তম দু-জনেরই যুদ্ধবিরোধী ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যায়। দু-জনেই গ্রেপ্তার হন।

জেলে তো আরও অনেক বার থেকেছে, কিন্তু এবারকার মতো অসহ্য বোধ হয়নি। এবার নিছক রাজবন্দি। এমন কোনো নারী নেই যে তাকে মনে রাখবে বলে কথা দিয়েছে, মনে রেখেছে। যে তার পদ্মাবতী। সে যার রাজপুত্র। হায় কন্যা পদ্মাবতী! কেমন করে তোমার ধ্যান করব!

ওদিকে কত বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটছে বিশ্বরঙ্গমঞ্চে। ধূমকেতুর পুচ্ছ লেগে ফ্রান্স পর্যন্ত টলে পড়েছে। ইংল্যাণ্ড ক-দিন টাল সামলাবে! এর পরে আসছে রাশিয়ার পালা! সোভিয়েটের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে নাতসি দানব। সোভিয়েট পালটা ঝাঁপ দেবে, না পিছু হটতে হটতে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে দানবকে তার গহ্বরে? আমেরিকা কী করবে? আর জাপান?

অনুত্তমের ভিতরে যে সৈনিক ছিল সে এক দন্ড স্থির থাকতে পারছিল না। সে চায় যুদ্ধে যোগ দিতে। যোদ্ধা হতে। অস্ত্র ধরতে। অহিংসায় তার আস্থা ছিল না। ইতিহাসে ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ যেখানে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চলছে অহিংস রণপদ্ধতির, এ বিশ্বাস তার অন্তর্হিত হয়েছিল। দুনিয়ার আর দশটা দেশের মতো হাতিয়ার হাতে যুদ্ধে নামতে হবে, মারতে হবে, মরতে হবে, এই হচ্ছে পুরুষার্থ। কিন্তু অধীনের মতো নয়। মিত্রের মতো। তা যদি না হয় তবে শত্রুর মতো।

সম্মানের সঙ্গে যা সে করতে পারে তা যুদ্ধে সহযোগিতা নয়, তা বিদ্রোহ, সশস্ত্র বিদ্রোহ। তা করতেই হবে। নইলে সে পুরুষ নয়। কেনই-বা কোনো মেয়ে তাকে মনে রাখবে! আজকের বিশ্বরঙ্গমঞ্চে নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতো বসে থাকতে তার প্রবল অনিচ্ছা। জীবনটা কি কারাগারে কারাগারেই কেটে যাবে? অসহ্য! অসহ্য! অসম্ভব! খাঁচায় বন্ধ বাঘ যেমন খাঁচাটাকে ভেঙে চুরমার করতে পারলে বাঁচে, ভীষণ আক্রোশে গাঁক গাঁক করে গজরায় আর দারুণ নৈরাশ্যে গুমরোয়, অনুত্তম তেমনি তার ইচ্ছাশক্তির ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে চায় জেলখানার দেয়াল, খেপে গিয়ে অনর্থ বাঁধায়, কাতর হয়ে মরার মতো পড়ে থাকে। কত বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটছে বাইরে। সে কিনা সাক্ষীগোপাল!

জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনায় ভারতের নেতাদের সঙ্গে একটা মিটমাটের জন্যে ইংল্যাণ্ড থেকে উড়ে এলেন ক্রিপস। তার আগে নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁদের দলবলকেও। কিন্তু অনুত্তমদের নয়। সে আশা করেছিল ছাড়া পাবে। হতাশ হল। হতাশা থেকে জাগল মরীয়াভাব। ওয়াপস যান ক্রিপস। কে চায় আপস! আমরা চাই অ্যাকশন, আমরা চাই বিদ্রোহ। অনুত্তমের মনে হয়, এই হচ্ছে লগ্ন, বিদ্রোহের লগ্ন, বিপ্লবের লগ্ন। এমন লগ্ন ভ্রষ্ট হলে ভারত কোনোদিন স্বাধীন হবে না। এখনই, কিংবা কখনো নয়। বেঁচে থেকে হবে কী যদি এ জন্মে স্বাধীন ভারত দেখে যেতে না পারি!

মন পুড়ছিল। মনের আগুন লেগে দেহ পুড়ল। সিভিল সার্জন দেখে বললেন, সর্বনাশ! এ যে গ্যালপিং থাইসিস! একে হাসপাতালে সরানো উচিত। হাসপাতাল-গুলোতে তখন বর্মাফেরতের ভিড়। বেড খালি পেলে তো অনুত্তমকে সরাবে। অগত্যা খালাসের হুকুম হল। অনুত্তম যা চেয়েছিল তাই। সে তার এক ডাক্তার বন্ধুর আমন্ত্রণে শোন নদের ধারে তাঁর প্রতিবেশী হল। শোনের হাওয়ায়, বন্ধুর যত্নে, বিপ্লবের প্রেরণায় অনুত্তমের দেহের আগুন নিভল। কিন্তু মনের আগুন?

ক্রিপস ততদিনে ওয়াপস গেছেন। আপস হয়নি। গান্ধীজি কী একটা করতে চান, কিন্তু জাপানি আক্রমণের মুখে ইংরেজের সঙ্গে লড়তে গেলে হিংসাপন্থীরা তার সুযোগ নেবে, তখন ইংরেজ বলবে এরা সকলে জাপানের পঞ্চম বাহিনী, বিশ্বময় বদনাম রটাবে, কুকুরকে বদনাম দিয়ে ফাঁসিতে লটকাবে। এই আশঙ্কায় তাঁর সহকর্মীরা ম্রিয়মাণ। তিনি কিন্তু বেপরোয়া। তিনি যদি নিষ্ক্রিয় থাকেন তা হলে কে জানে হয়তো বর্মায় যা ঘটেছে ভারতেও তাই ঘটবে! মালিক বদল। পোড়ামাটি। কুরুক্ষেত্র। এর চেয়ে কিছু একটা করা ভালো। তাতে এমন কী ঝুঁকি! ইচ্ছা করলে বড়োলাট তাঁকে বুঝিয়ে নিরস্ত করতে পারেন।

প্রথমে জহরলাল তাঁর সঙ্গে একমত হলেন সাতদিন একসঙ্গে থেকে। তারপরে আর সব নেতা। ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি গ্রহণ করল। গান্ধীজি লিনলিথগোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন, তার আগেই লিনলিথগো তাঁকে বন্দি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আর সবাইকে। সংবাদ পেয়ে অনুত্তম মুহূর্তকাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হল। তারপর বলল, ‘নিষ্ক্রিয় আমরা থাকব না। জোর করে আমাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখবে এমন শক্তি কার আছে? চলো, একটা কিছু করি। নয়তো মরি।’ তার ডাক্তার বন্ধু তার হাত চেপে ধরলেন, সে তাঁর হাত ছাড়িয়ে ছুটে চলল বাইরে।

কোন দিকে যাবে নিজেই জানত না। গেল যেদিকে দু-চোখ যায়। কে জানে কোনখান থেকে পেল অমানুষিক তেজ। পায়ে হেঁটে পার হল মাইলের পর মাইল। শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। নেই ব্যথাবোধ। দেখল হাজার হাজার স্ত্রী-পুরুষ কাতারে কাতারে চলেছে। তারই মতো অবিকল। যেন বৃষ্টির জলের ঢল নেমেছে। ঢল দেখতে দেখতে স্রোত হল। স্রোত দেখতে দেখতে নদী হল। নদী দেখতে দেখতে সমুদ্র হল। সমুদ্র গর্জে উঠল, ‘রেল লাইন তোড় দো। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।’

অনুত্তমকে কেউ সে অঞ্চলে চিনত না। কিন্তু বিপ্লবের দিন জনতা যেন রূপকথার রাজহস্তী। কী জানি কী দেখে চিনতে পারে, শুঁড় দিয়ে তুলে নিয়ে পিঠের হাওদায় বসায়। যে-দেশে রাজা নেই সে-দেশে রাজা চিনতে পারে রাজহস্তী। যে-দেশে নেতা নেই সে-দেশে নেতা চিনতে পারে জনতা। কখন একসময় একপাল লোক এসে অনুত্তমকে কাঁধে তুলে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, ‘সজ্জনো, বঙ্গাল মুলক আজাদ বন গিয়া। বোস বাবুনে আপকো ভেজ দিয়া। ছোটা বাবুকি জে!’ অনুত্তম তো বিস্ময়ে হতবাক। কাঁধ থেকে মাথায়, মাথা থেকে আশমানে তুলে ওরা তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে। জনতা দেখছে আর হাঁক ছাড়ছে, ‘ছোটা বাবুকি জে!’

এই সব নয়। কেউ শোর করছে, ‘ছোটা বাবুকা হুকুম। আগ লগাও’ কেউ গোল করছে, ‘ছোটা বাবুকি বাত। ডব্বা লুট লেনা।’ অনুত্তম তো হতভম্ব। আবার তেমনি নিষ্ক্রিয় সাক্ষী। যা ঘটবার তা ঘটে যাচ্ছে। তার ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা রাখছে না। স্টেশন দাউ দাউ করে জ্বলছে। দুটো একটা মানুষও যে না জ্বলছে তা নয়। নেভাতে যাও দেখি, অমনি ঠেলা খেয়ে জ্বলবে। নেতা বলে কেউ রেয়াৎ করবে না। মালগাড়ি ভেঙে বস্তা বস্তা চিনি বয়ে নিয়ে পিঁপড়ের সার চলেছে। ঠেকাতে যাও দেখি। অমনি বাড়ি খেয়ে মরবে। নেতা বলে কেউ কেয়ার করবে না।

খন্তা কোদাল শাবল গাঁইতি যার হাতে যা জুটেছে তাই দিয়ে লাইন ওপড়ানো হচ্ছে। স্লিপার পর্যন্ত উঠিয়ে দিচ্ছে। ছোটোখাটো পুল একদম সাফ। বড়ো বড়ো পুলে বড়ো বড়ো ফাঁক। তবে রেল দুর্ঘটনা ঘটছে না। ড্রাইভার টের পেয়ে ইঞ্জিন থামিয়ে পিটটান দিচ্ছে। যাত্রীরা নেমে পড়ছে। জনতা তাদের খেতে দিচ্ছে মালগাড়ি থেকে সরানো আটা ময়দা ঘি দিয়ে তৈরি পুরি কচুরি। দাক্ষিণ্যের অভাব নেই। কার কী জাত, কার কোন ধর্ম, কেউ জানতে চায় না, কেউ মানতে চায় না। সকলে সকলের স্বজন। দুশমন শুধু সেই যে বিবেকের প্রশ্ন তোলে, যে বাধা দেয়।

কয়েকটা দিন যেন নেশার ঘোরে কেটে গেল। সৈন্য চলাচল বন্ধ। পুলিশের পাত্তা নেই। নবগঠিত গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রাম শাসন করছে। সরকারি কর্মচারী দেখলে তারা আনুগত্য আদায় করে। নয়তো বন্দি করে। অনুত্তম যেখানেই যায় সেখানেই সংবর্ধনা পায়। লোকে প্রশ্ন করে, ইংরেজ কি আছে না গেছে? আছে শুনলে জেরা করে, আছে যদি তো ফৌজ পাঠায় না কেন? পুলিশ পাঠায় না কেন? নেই শুনলে বলে, আর ভাবনা কীসের! আজাদি তো মিলে গেছে!

অনুত্তমের তখন একমাত্র ধ্যান বিপ্লবী নায়িকা। হায় কন্যা পদ্মাবতী! তুমি কোথায়? কবে তোমার দেখা পাব এখন যদি না পাই? আর তুমি কী চাও? গুলি চালনা? রক্তপাত? বারুদের গন্ধ? হাহাকার? গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করা? গ্রামনেতাদের গাছে লটকানো? এসব না হলে কি তোমার আবির্ভাবের পূর্বলক্ষণ প্রকট হবে না? হায় কন্যা বীর্যশুল্কা! কে দেবে এই শুল্ক?

অনুত্তম যা আশঙ্কা করেছিল তাই হল। ফৌজ এসে পড়ল। রেলপথ মোটরপথ না হয় নেই, কিন্তু আকাশপথ তো আছে। টেলিগ্রাফের তার না হয় নেই। কিন্তু বেতার তো আছে। ইংরেজের মিলিটারি অফিসারদের হুকুমে গ্রামকে গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল। মানুষ মরল জাঁতায় পড়ে ইদুরের মতো। লোকের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে দেখে অনুত্তমের উদ্বেগ এক-শো পাঁচ ডিগ্রি উঠল। তার মনে হল এ যাত্রা সে বাঁচবে না, যদি দেশের লোককে বাঁচাতে না পারে।

এমনি এক সন্ধিক্ষণে তার দর্শন পায়। তার পদ্মাবতীর। নীল চশমা চিনতে ভুল করে না।

কাশ্মীরি মেয়ে তারা। কানপুর থেকে এসেছে। তারার মতো জ্বলজ্বল করছে তার চোখ। কিন্তু ধীরস্থির অচঞ্চল তার চাউনি। অনুত্তম অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে শুনে তারা এল তাকে দেখতে। তার কপালে হাত রেখে শিয়রে বসে থাকল অনেকক্ষণ। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘অত উদ্বেগ কীসের! যে খেলার যা নিয়ম। আমরা ওদের রাজত্ব ধ্বংস করতে গেছি। আর ওরা আমাদের গ্রাম ধ্বংস করবে না? আমরা ওদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা তছনছ করেছি। ওরা আমাদের মুক্তি প্রচেষ্টা তছনছ করবে না? তা সত্ত্বেও আমরা জিতব। ইতিহাস আমাদের পক্ষে।’

ভারতের কোথায় কী ঘটছে অনুত্তম সব কথা জানত না। তারা জানত। একে একে জানাল। সিপাহীবিদ্রোহের পরে এত বড়ো বিদ্রোহ আর হয়নি। সারা ভারতের উপর দিয়ে যেন একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে। ইংরেজ এখনও ছিন্নমূল হয়নি তা সত্য। কিন্তু তার মাজা ভেঙে গেছে। আরেকবার এ-রকম একটা বিদ্রোহ ঘটবার আগেই সে সন্ধি করবে। এখন শুধু দেখতে হবে লোকে যাতে এলিয়ে না পড়ে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে না ফেলে। মহাত্মা যখন অনশন আরম্ভ করবেন তখন যেন আরেকবার ঝড় ডেকে যায়।

তারা যে কোথায় থাকে, কোথায় খায়, কোনখানে কাপড় ছাড়ে কিছুই ঠিক নেই। তার বেশ হরদম বদলায়। বাস হরদম বদলায়। এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে অনবরত ঘোরে, মিলিটারির নজর এড়ায়, অভয় দেয় মেয়েদের, প্রেরণা দেয় পুরুষদের। আর যখনই একটু নিরিবিলি পায় মানচিত্র নিয়ে বসে। তাতে ছোটো ছোটো পতাকা আঁটা তার একটা কাজ। ফৌজ কোন কোন গ্রামে ঘাঁটি গেড়েছে, কোনখানে তাদের সংখ্যা কত, কোন দিন কোন দিকে তাদের গতি, গতিপথে ক-খানা গ্রাম উজাড় হল, ক-জন মানুষ সাবাড় হল, এসব তথ্য তার নখদর্পণে। তার নিজের একটা চর বিভাগ আছে। খবর পায় সে রোজ সময়মতো।

তারাকে দেখলে মনে ভরসা ফিরে আসে। মরণাপন্নও বেঁচে ওঠে। যার দিকে একটিবার সে তাকায় তার অবসাদ কেটে যায়। অনুত্তম শয্যা ছেড়ে কাজে লেগে গেল। যেকোনো দিন মিলিটারির গুলিতে তার মরণ। প্রাণ হাতে করে ঘোরাফেরা। তবু নিরুদবেগ। কত কাল পরে সে পুনরায় ধ্যান করতে পারল। ধ্যান করল পদ্মাবতীর। বীর্যবতী নারীর। যে নারীর ভয় নেই, ভাবনা নেই, উদ্বেগ নেই, যে নারী সবসময় প্রস্তুত, সব কিছুর জন্যে প্রস্তুত, সব তথ্য যার আঙুলের ডগায়।

মাঝে মাঝে তাদের দু-জনের দুই পথ এক জায়গায় ছক কাটে। কয়েক মিনিটের জন্যে দেখা। অনুত্তমের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারার চোখে দীপ্তি ফোটে। ওরা যেন একে অপরকে বলতে চায়, এই যে তুমি! ওঃ কতকাল পরে। আবার কবে।

ফেব্রুয়ারি মাস এল। মহাত্মার অনশন শুরু হল। এইবার আসছে আরেকটা সাইক্লোন। সারা ভারত জুড়ে এর তান্ডব। অনুত্তম কান পেতে শোনে, শোঁ শোঁ শোঁ শোঁ। কিন্তু ওটা ওর কল্পনা। বিদ্রোহ করবার মতো সামর্থ্য এত বড়ো দেশটার কোনোখানেই একরত্তি ছিল না। একটি একটি করে দিন যায়, মহাত্মার জন্যে দুর্ভাবনা বাড়তেই থাকে, এক এক সময় মনে হয় তিনি এ যাত্রা বাঁচবেন না, অথচ ইংরেজ রাজত্ব বাঁচবে। তারার সন্ধানে ছুটে যায়, বহু কষ্টে সাক্ষাৎ পায়। সেও তেমনি দিশাহারা। কই, ঝড় তো উঠল না! মহাত্মার অনশন কি ব্যর্থ গেল!

চঞ্চল হয়ে ওঠে তারা। পাগলামিতে পায় তাকে। মহাত্মা মারা যেতে বসেছেন। তবু কেউ কিছু করবে না। সব চুপচাপ নিঝুম। ডরে ভয়ে আড়ষ্ট। কিছু একটা করতে বললে ওরা চোরের মতো লুকোয়। গ্রামের মোড়লরা ইতিমধ্যে সরকারের অনুগত প্রজা হয়েছেন। গণপঞ্চায়েত বসে না। ডাকলে কেউ আসে না। ঘরে ঘরে গিয়ে তারা ওদের পায়ে ধরে সাধে। করো, করো একটা কিছু মহাত্মার প্রাণরক্ষার জন্যে। ওরা বলে, আমাদের সাধ্য থাকলে তো করব! কেন তিনি অনশন করছেন! না করলেই পারতেন। ইংরেজ প্রবল। সে কি কোনোদিন নড়বে!

বেচারি তারা অনুত্তমের কাছে ছুটে আসে। একটা সহানুভূতির জন্যে। আর কী বলবার আছে অনুত্তমের! অনশন তো ঝড়ের সংকেত হল না। যা মনে করেছিল তা নয়। এটার অন্য উদ্দেশ্য। এ দিয়ে তিনি পৃথিবীকে জানালেন যে তিনি হিংসার জন্যে দায়ী নন। হিংসা-প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে তাঁর স্থিতি। অনুত্তম স্বীকার করল, সত্যি আমরা তাঁর অহিংসার সুযোগ নিয়েছি। হিংসা থেকে এসেছে প্রতিহিংসা। তার থেকে জনগণের অক্ষমতা।

‘এর চেয়ে জেলে যাওয়া ভালো।’ তারা বলল কর্তব্য স্থির করো। অনুত্তম বলল, ‘চলো একসঙ্গে জেলে যাই।’ ততদিনে ওরা বেশ একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *