সুজন ও কলাবতী
সুজনের মনে একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল যে তার পরমায়ু বেশি দিন নয়। যে ক-দিন বাঁচবে সে ক-দিন কলাবতীর অন্বেষণে কাটাবে। অন্বেষণ কিন্তু মিলনের অন্বেষণ নয়। বকুলের সঙ্গে মিলন কোনোদিন হবে না। কলাবতীর অন্বেষণ হচ্ছে কলাবিদ্যার অন্বেষণ, যে বিদ্যা অতি সাধারণ লেখককে অসাধারণ করে। সঙ্গে সঙ্গে চিরন্তনীর অন্বেষণও বটে, যে নারী তারার মতো সুদূর, অথচ তারার মতো তার প্রভাব পড়ে জীবনের উপরে।
এর কিন্তু একটি প্রচ্ছন্ন শর্ত আছে। নিষ্ঠা রাখতে হবে কেবল কলাবিদ্যার প্রতি নয়, কলাবতীর প্রতিও। আর কাউকে বিয়ে করা চলবে না, আর কাউকে ভালোবাসা চলবে না। দ্বিচারিতা করলে অন্বেষণে ছেদ পড়বে। তারপর আর ক-টা দিনই বা সুজন বাঁচবে! কীই-বা দিয়ে যাবে সাহিত্যে! স্বল্প যার পরমায়ু সে কি অমন করে আয়ুক্ষয় করতে পারে! বাবা যদি বুঝতেন তা হলে কি তার মতো দেশকাতুরে লোক দেশান্তরী হত! তিনি অবুঝ বলেই না তাকে তার জীবনের পরিকল্পনা বদলাতে হল। শান্তশিষ্ট সুস্থির প্রকৃতির মানুষটি ধীরেসুস্থে কোঁচা দুলিয়ে কাছা ঝুলিয়ে ঢিলেঢালা জামা পরে থপ থপ করে কলকাতার রাস্তায় হাঁটত। আঁটসাঁট লাউঞ্জ সুট পরা ত্বরিতগতি করিৎকর্মা এ কোন পুরুষ তালে তালে পা তুলে পা ফেলে লণ্ডনের পথে-ঘাটে চলেছে!
স্বপ্নবিলাসী বলে ভাবালু বলে তার বন্ধুরা তাকে খোঁচা দিত। ‘ওঃ সুজন! ওকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। একটা টেলিগ্রাম কেমন করে পাঠাতে হয় তা ও জানে না।’ এখন তাকে যেই দেখে সেই তারিফ করে জোগাড়ে বলে চটপটে বলে। দেশে থাকতে মিশনারিদের বাংলা রচনা ঘষামাজা করতে হয়েছিল কয়েকবার। তাঁদের একজন লণ্ডনে তাকে তাঁর ধর্মশাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ পরিমার্জনের জন্যে দেন। সে তো কোনোরকম পারিশ্রমিক নেবে না। পাদরিসাহেব তাই তাকে চাকরি জুটিয়ে দিলেন সুপারিশ করে। বেতন এমন কিছু নয়, কিন্তু সুবাদ যথেষ্ট। সে বাংলার অধ্যাপক এই সুবাদে ব্যবসায়ী মহল থেকে অর্ডার পায় ইংরেজি বিজ্ঞাপন বাংলায় তর্জমার জন্যে। ওষুধের কৌটোয় পথ্যের শিশিতে সুজনের কীর্তি তার দেশবাসীর গোচর হয়।
দু-চার জায়গায় ঘোরাঘুরির পর সুজন রাসেল স্কোয়্যার অঞ্চলে গ্যারেট নেয়। রাত্রে শুতে আসে সেখানে। বাকি সময়টা বাইরে বাইরে কাটায়। বাইরেই খায়। খানাপিনায় তার বাছবিচার নেই। গোপালের মতো যা পায় তাই খায়। অথচ কী খুঁতখুঁতে ছিল দেশে থাকতে! সারাদিন খেটেখুটে রোজ সন্ধ্যা বেলা থিয়েটারে হাজির হওয়া তার চাই। যেদিন থিয়েটারে যায় না সে-দিন কনসার্টে যায়। যেদিন কনসার্টে যায় না সে-দিন যায় কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তৃতায়। লণ্ডনে বারো মাস ত্রিশ দিন এতরকম আকর্ষণ যে দেখে ক্লান্তি আসে না। শুনে শ্রান্তি আসে না। নিত্যনূতনের নেশায় মশগুল থাকে সুজন।
কেবল রবিবারটা বাদে। সেদিন সে রাতকাপড়ের উপর ড্রেসিং গাউন চড়িয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে দেশের চিঠি কাগজ পড়ে আর দেশের লোকের জন্যে প্রবন্ধ লেখে। তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়ে যায় বুড়ি ল্যাণ্ডলেডি মিসেস কলোনি। বিকেলের দিকে সুজন তার সেরা পোশাক গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সামাজিকতা করতে। যার জন্যে সময় পায়নি সপ্তাহের অন্য কোনোদিন। কয়েকটি বিশিষ্ট বাঙালি পরিবারে তার বাঁধা নিমন্ত্রণ। তাঁদের ওখানে গেলে একঝাঁক বাঙালি যুবক-যুবতীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মনে হয় বাংলায় ফিরে গেছি বিদেশি বেশবাসে। কথাবার্তা গল্পগুজব সব কিছু বাংলায়। বাংলা গান বাংলা সুর। বাংলা খাবার। বাঙালির রান্না।
মুখচোরা মানুষ। আলাপ করতে তার লজ্জাবতী লতার মতো সংকোচ। এমন যে সুজন বিদেশে তার হঠাৎ মুখ খুলে যায়। অপরিচিতকে—অপরিচিতাকেও—হাত বাড়িয়ে দিয়ে শুধায়, ‘এই যে। কেমন আছেন?’ সাহিত্যিক বলে তার নাম অনেকে জানত। যারা জানত না তারাও অনুমান করত তার চেহারা ও কথাবার্তা থেকে। থিয়েটার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি খবর রাখত বলে সহজেই তার চার দিকে ভিড় জমত। যেসব থিয়েটার পাবলিকের জন্যে নয়, যেখানে যেতে হলে মেথর হতে হয় বা মেম্বরের অতিথি হতে হয় সেখানেও তার গতিবিধি। কেবল অভিনয়ে নয়, মহড়ায়। সেসব গল্প শুনতে কার না আগ্রহ! কাজেই সুজনের আসাটা আরও অনেকের আসার কারণ ছিল। গৃহকর্ত্রীরা এটা জানতেন। কিন্তু রবিবার ভিন্ন আর কোনোদিন তার সময় হত না। সেদিন পালা করে সে বিভিন্ন পরিবারে নিমন্ত্রণরক্ষা করত।
যা হয়ে থাকে। তরুণীরা তাকে একটু বেশিরকম পছন্দ করতেন। কিন্তু তার সঙ্গে আলাপ যেমন সুলভ ছিল অন্তরঙ্গতা ছিল তেমনি দুর্লভ। দুর্লভ না বলে অসম্ভব বললেও চলে। তার জীবনের গল্প সে কাউকে বলত না। প্রশ্ন করলে পাশ কাটাত। নারীসংক্রান্ত কোনোরকম দুর্বলতা কেউ তার আচরণে লক্ষ করেনি। সে সকলের সঙ্গে সমানে মেশে, কিন্তু কোনো মেয়ের সঙ্গে বিশেষ করে মেশে না। যদি কেউ তার কাছে বিশেষ পক্ষপাত আশা করে তবে নিরাশ হতে বেশি দিন লাগে না। তার দিক থেকে সৌজন্যের অভাব নেই। সে যে সুজন। তার সৌজন্য ওষ্ঠগত নয়। সহৃদয়। কিন্তু যতই সহৃদয় হোক, ওটা সৌজন্যই। সৌজন্যের অধিক নয়। ভালোবাসা অন্য জিনিস। তার প্রথম কথা পক্ষপাত। একজনের প্রতি পক্ষপাত।
লণ্ডনের অফুরন্ত কর্মপ্রবাহে দিন কেমন করে সপ্তাহ হয়ে যায়, সপ্তাহ কেমন করে মাস, মাস কেমন করে বছর। সুজন ধ্যানের অবকাশ পায় না। তবু যখনই একটু অবসর পায় বকুলের ধ্যান করে। তার কলাবতীর। তার একমাত্র নারীর। যে নারী বিশ্বসৃষ্টির পূর্বেও ছিল, বিশ্বপ্রলয়ের পরেও থাকবে। যে নারীর স্থিতি দেহনিরপেক্ষ। যে নারী গৃহিণী হয়েও গৃহিণী নয়, জননী হয়েও জননী নয়। যে বিশুদ্ধ সৌন্দর্য, বিশুদ্ধ জ্যোতি, তারায় তারায় দীপ্যমান। অন্ধকার যাকে আরও উজ্জ্বল করে ফোটায়। বিরহ যাকে আরও নিকট করে। বিরহের সাধনায় করতে হয় যার অন্বেষণ, মিলনের স্বপ্নে নয়।
সুজন মিলনের স্বপ্ন দেখে না। এ জন্মের মতো যা হবার হয়ে গেছে। ক-টা দিনেরই বা জীবন! দেখতে দেখতে সাঙ্গ হবে। বিরহেই কেটে যাবে দিন। বিরহেই ভরে উঠবে হৃদয়। উপচে পড়বে কবিতা। রচা হবে নব মেঘদূত। নতুন ডিভাইন কমেডি। মানবের মধুরতর গানগুলি মিলন থেকে আসেনি, এসেছে বিরহ থেকে। এই যে সুজন প্রেরণা পাচ্ছে লিখতে, সাত দিনে একদিন যদিও, এ কি মিলন থেকে না বিরহ থেকে? মিলন তাকে মূক করত মাধুর্যে, মূঢ় করত বিস্ময়ে। যার চার দিকে অন্ধকার নেই সেই সূর্যের দিকে তাকালে সে অন্ধ হয়ে যেত আনন্দে। এই সন্ধ্যাতারা তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করছে না, সে অপরের দিকে তাকাতে পারছে, আর দশ জন মেয়ের সঙ্গে মিশতে পারছে, সৌজন্যের পাত্রী পেয়ে সুজন হতে পারছে। এই ভালো, এই ভালো।
দেশে তার লেখার আদর বাড়ছিল। বিদেশে যদিও লেখক বলে কেউ চিনত না তবু গোটা দুই লিটল থিয়েটারের অভিনয়ে মহড়ার আড্ডায় হাজিরা দিতে দিতে কতকটা নিজের অজ্ঞাতসারে সে একজন নাট্যসমালোচক হয়ে উঠেছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও তার অভিমত জানতে চাইতেন। তার অভিমতকে যথেষ্ট ওজন দিতেন। জলহাওয়ার গুণে ওদিকে তার ওজনও বাড়ছিল বেশ। দেখে মনে হত লোকটা কেবল সমঝদার নয়, ওজনদারও বটে।
মনের অতলেও তার পরিবর্তন হচ্ছিল। এত গভীরে যে সে নিজে টের পাচ্ছিল কি না সন্দেহ। কলাবতীর প্রতি একনিষ্ঠতা, বকুলের প্রতি একনিষ্ঠতা তার মূলমন্ত্র কিন্তু একনিষ্ঠতা বলতে কাল যা বোঝাত আজও কি তাই বোঝায়? আজ যা বোঝায় কালও কি তাই বোঝাবে? সুজনের একনিষ্ঠতার ব্যাখ্যা বদলে যাচ্ছিল। এই যে এতগুলি মেয়ে এসেছে তার জীবনে এরা দু-দিন পরে এসেছে বলে কি এদের কারও সঙ্গে কোনোরকম সম্বন্ধ পাতানো যায় না? কেবল মেলামেশা পর্যন্ত দৌড়? সে গন্ডী অতিক্রম করলে একনিষ্ঠতার মর্যাদা থাকে না?
সুজনের সঙ্গে যাদের পরিচয় তাদের মধ্যে তিন জনের সঙ্গে তার মেলামেশা ক্রমে মন জানাজানির পর্যায়ে পৌঁছোল। মন দেওয়া-নেওয়া নয় কিন্তু। তার বেলা সুজন অতি সজাগ। ঊর্মিলা তাকে সোজাসুজি সুজন বলে ডাকত। বরাবর ইংল্যাণ্ডে মানুষ হয়েছে। বাঙালির মেয়েদের মতো দূরত্ব বজায় রেখে চলতে জানে না। সিলভিয়া তাকে আরও ছোটো করে জন বলে ডাকে। সেও বলে সিলভি। ইংরেজের মেয়ে, কিন্তু বাংলায় জন্ম। বেশ বাংলা বলে। অনেকটা বাঙালি মেয়ের মতো হাবভাব। এরা দু-জনে কুমারী। আর ম্যাদলিন বিবাহিতা। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে থিয়েটারে দেখা হত। ফরাসি মহিলা, বয়সে বড়ো। ভদ্রতা করে সুজন তাঁকে তাঁর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিত ফেরবার পথে। তাঁর স্বামী দরজা খুলে দিতেন। তাঁর সঙ্গে এক পেয়ালা কালো কফি না খেলে তিনি ছাড়তেন না। তাঁর ধনুর্ভঙ্গ পণ তিনি ইংরেজি বুলি বলবেন না, আর কেউ বললে বুঝবেন না। অগত্যা সুজনকে ফরাসি শিখতে হয়।
ঊর্মিলা, সিলভি, ম্যাদলিন এদের কাছে তার জীবনকাহিনি অজানা ছিল না। তার কাছে এদের যে অন্তরঙ্গতা সুজন অন্যের বেলা এড়াতে পেরেছে তা এদের বেলা পারেনি। এইটুকু বিশেষত্ব। এরা তার বন্ধু। যেমন বন্ধু কান্তি, তন্ময়, অনুত্তম। ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের বন্ধুসম্বন্ধ যেমন, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের বন্ধুসম্বন্ধ তেমনি। এটা নর-নারীর সম্বন্ধ নয়। সুতরাং একনিষ্ঠতার আদর্শে বাধে না। বকুল জানলে কিছু মনে করত না। করলে ভুল করত। সুজন বকুলকে চিঠিপত্র লেখে না, নয়তো নিজেই তাকে জানত। বকুল ভিন্ন আর কোনো মেয়ের সঙ্গে তার আর কোনোরকম সম্বন্ধ থাকবে না, থাকলে একনিষ্ঠতায় চিড় ধরবে, এটা স্বীকার করে নিতে তার আপত্তি ছিল। বরং তলিয়ে দেখলেই এইটেই তার কুমার জীবনকে সহনীয় করেছে। এক দিকে যেমন বকুলের প্রতি আনুগত্য তাকে অক্ষত রেখেছে আর এক দিকে তেমনি ঊর্মিলা, সিলভি, ম্যাদলিনের সঙ্গে সৌহার্দ্য তাকে অক্ষত থাকতে সাহায্য করেছে। নইলে তার নিঃসঙ্গ জীবন দুর্বহ হত। তার অন্বেষণে অবসাদ আসত। ভালোবাসা এ নয়। কারণ এতে মন দেওয়া-নেওয়া নেই। সুজন একনিষ্ঠই রয়েছে।
তিন বছর পরে সে ডক্টরেট পেল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নাট্যরীতির তুলনা করে সে একটি থিসিস লিখেছিল। সেটি প্রকাশ করতে আরও বছর খানেক লেগে গেল। এর পরে তার দেশে ফেরার কথা। দেশের জন্যে তার মন কেমন করছিল সেই প্রথম বছর থেকে। তার মতো দেশকাতুরে লোক যে এতদিন ধৈর্য ধরতে পেরেছে এই যথেষ্ট। ফিরে যাবার জন্যে প্যাসেজ কিনবে এমন সময় একখানা চিঠি এল। লিখেছেন একজন হবু শ্বশুর। চিঠির সঙ্গে একখানি ফোটো ছিল। হবুমতীর। তার সঙ্গে ছিল কয়েক ছত্র উপদেশামৃত। ওটুকু সুজনের পিতার। ব্রহ্মচর্যের পরের ধাপ গার্হস্থ্য। বিবাহ না করে গৃহস্থ হওয়া যায় না। বিবাহকাল সমুপস্থিত। এখন কেবল দেখতে হবে উপযুক্ত সহধর্মিণী কে? আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করো আমি উত্তর দেব—হবুমতী। এমন কনে কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
কাজেই সুজনের দেশে ফেরা হল না। লণ্ডন ছাড়ল সে ঠিকই। কিন্তু কলকাতার জন্যে নয়। নাটকের নেশা তখন তাকে পেয়ে বসেছে। চলল প্যারিসে। ইতিমধ্যে ফরাসি ভাষাটা তার উত্তমরূপে আয়ত্ত হয়েছিল। চাকরি জুটে গেল এক আমদানি-রপ্তানির কারবারে। ইংরেজি থেকে ফরাসিতে, ফরাসি থেকে ইংরেজিতে দলিলপত্র ভাষান্তর করতে হয়। সাধারণ অনুবাদকের চেয়ে আর একটু বেশি দায়িত্বজ্ঞান দরকার। দেশে থাকতে সুজন আইন পড়েছিল। সেটা কাজে লাগল। মাইনে মন্দ দেয় না। Place de la Republique অঞ্চলে হোটেলে থাকা পোষায়। ফরাসি প্রযোজকদের মধ্যে যাঁরা ইংরেজি জানতেন তাঁরা তার মুদ্রিত থিসিস উপহার পেয়ে তাকে ঢালাও অনুমতি দিলেন। মঞ্চের আড়ালে তার অবাধ প্রবেশ। তার মন্তব্য শুনতে তাঁদের প্রচুর আগ্রহ।
লঙ্কায় গেলে নাকি রাবণ হয়। তা হলে লণ্ডনে গেলে হয় চটপটে জোগাড়ে ফিটফাট ছিমছাম। আর প্যারিসে গেলে? প্যারিসে গেলে হয় রুচিমান চতুর বাকপটু দিলখোলা। যাই বল ইংরেজরা এখনও পিউরিটান প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রঙ্গালয়েও না। ফরাসিদেরও বালাই নেই। খোলাখুলি আবহাওয়ায় সুজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভন্ডামির মুখোশ আঁটতে হল না। বছরের পর বছর কাটে। দেশে ফেরার নাম করে না। দেশ থেকে অনুরোধ এলে লিখত, যেখানে দানাপানি সেখানে বীণাপাণি। এখানে যতদিন চাকরি আছে ততদিন শিল্পসৃষ্টিও আছে। দেশে গেলে তো বেকার হতে হবে। কিংবা দরবার করতে হবে যত সব হঠাৎ নবাবের হঠাৎ মোড়লের কাছে। শিল্পসৃষ্টি শিকেয় তোলা থাকবে। আসল কথা বিয়ে করতে তার একটুও স্পৃহা ছিল না। বুড়ো বাপ বেঁচে আছেন শুধু ওইটুকুর জন্যে। কিন্তু কী করে তাঁকে বাধিত করা যায়? একজনকে বিয়ে করে, আর একজনের প্রতি অনুগত থাকবে, সার্কাসে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার চেয়েও এটা শক্ত। সুজনের বিচারে এটা দ্বিচারিতা, রাধার বিচারে যাই হোক।
এখনও কি সে বকুলের ধ্যান করে? বকুলের মুখখানি মনে পড়ে তার? তেমনি ভালোবাসে? হাঁ, এখনও। বকুলকে আড়াল করেনি আর কারও মুখ। তবু তলে তলে পরিবর্তন চলছিল। একনিষ্ঠতার ব্যাখ্যা লণ্ডনে যেমন ছিল প্যারিসে তেমন ছিল না। মন জানাজানি থেকে মন দেওয়া-নেওয়ায় পৌঁছেছিল। দেহ ও মনের মাঝখানে স্পষ্ট একটা বেড়া আছে, সকলের চোখে পড়ে। যেখানে দেহের ব্যাপার সেখানে সুজন সব সময় সতর্ক। কিন্তু বন্ধুর ভালোবাসা ও প্রেমিকের ভালোবাসার মাঝখানে পরিষ্কার কোনো ভেদরেখা নেই। যতই সজাগ থাকো না কেন সীমানার ওপারে গিয়ে পড়া একান্ত স্বাভাবিক ও সহজ। প্যারিসে এসে এই অভিজ্ঞতা হল। শুরু হয় বন্ধুতারূপে। বকুলের প্রতি একনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ রেখে। কিন্তু এমন এক সময় এল যখন সুজন বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করল যে বন্ধুতার রাজ্য পিছনে পড়ে আছে, পায়ের তলায় প্রেমের রাজ্যের মাটি। মেয়েটির নাম সোনিয়া। হোয়াইট রাশিয়ান। অনেক দুঃখ পাওয়া অনেক পোড় খাওয়া বিদগ্ধ কলাবিদ। বেহালা বাজিয়ে বেড়ায়। লণ্ডনে সুজন তার রিসাইটালে যেত। তখন আলাপ হয়নি। পরে আলাপ হল প্যারিসে।
সোনিয়ার বিয়ে ভেঙে গেছে। সে আর বিয়ে করবে না। বিয়েকে তার ভয়। সুজনও বিয়ে করতে চায় না। বকুলের প্রতি দ্বিচারিতাকে তার ভয়। একনিষ্ঠতার আদর্শ এই এক জায়গায় অটল ছিল। কিন্তু সুজন যখন ধ্যান করতে বসে বকুলের রূপ ক্রমে সোনিয়ার রূপ হয়ে দাঁড়ায়। বিষণ্ণ বিদগ্ধ অনিকেত অনাথ সোনিয়া। দুনিয়ায় আপন বলতে কেউ তার নেই। ঘর নেই, দেশ নেই, ধন নেই, সঞ্চয় নেই। আছে ওই বেহালাটি। আর আছে প্রতিভা। যেখানে যখন ডাক পড়ে সেখানে তখন যায়। সুজনকে বলে যায়, আবার দেখা হবে। সুজন বসে থাকে পথ চেয়ে। বিরহ বোধ করে। এ বিরহ বকুলের জন্যে নয়। এ বিরহে মিলনবাসনা মেশানো। মিলন অবশ্য চোখে দেখা, কাছে থাকা, হাতে হাত ধরা, দৈবাৎ ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ানো। এও কি দ্বিচারিতা? সুজনের মন বলে, না। দ্বিচারিতা নয়। বরং তলিয়ে দেখলে এরই দ্বারা দ্বিচারিতা নিবারিত হচ্ছে। নয়তো তার কুমারজীবন অসহন হত। বকুল এর কী বুঝবে! তার তো এ সমস্যা নেই। তবু তাকে বুঝিয়ে বললে সে বুঝত। কিন্তু বোঝাবে কী করে? চিঠি লেখালেখি নেই। শুধু বড়োদিনের সময় কার্ড পাঠায়, কার্ড পায়। তাতে দু-এক ছত্র হাতের লেখা জুড়ে দেয় দু-জনেই।
দেহের সঙ্গে মনের সেই যে সুস্পষ্ট ব্যবধান সেটাও ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে এল। কোথায় দাঁড়ি টানবে? কী করে থামবে! সুজন বুঝতে পারল এবার যা আসছে তা বিয়ে নয়, তবু বিয়ের থেকে অভিন্ন। তার থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পন্থা পালানো। তাকে প্যারিস ত্যাগ করতে হবে। তার মানে সোনিয়াকে ত্যাগ। বেচারি সোনিয়া! তার জীবনটা ত্যাগে ত্যাগে জর্জর। যেই তাকে ভালোবেসেছে সেই তাকে ত্যাগ করেছে। সুজনও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাবতে সুজনের ব্যথা লাগে।
হ্যাঁ, আছে বটে আর একটা উপায়। বাসনা কামনাকে বশ করা। ইন্দ্রিয়ের রাশ টেনে ধরা, দেহের প্রতি নির্মম হওয়া। সোনিয়া যখন ঠোঁট বাড়িয়ে দেবে সুজন তখন ঠোঁট বাড়িয়ে দেবে না, সুজন ঠোঁট সরিয়ে নেবে। খেলার ছলে নয়, সত্যি সত্যি। ত্যাগ না করার একমাত্র শর্ত ভোগ না করা। ভোগ করতে গেলেই ত্যাগ করতে হবে। এ বড়ো নিষ্ঠুর ন্যায়শাস্ত্র। সোনিয়া সব কথা শুনে বলল, ‘বেশ, তাই হোক। তোমার শর্তে আমি রাজি। তুমি যেয়ো না।’ সুজন বেঁচে গেল। তাকে প্যারিস থেকে পালাতে হল না। সোনিয়াকে ত্যাগ করার গ্লানি বহন করতে হল না। কিন্তু নিত্য নিত্য সংগ্রাম করতে হল নিজের বাসনা-কামনার সঙ্গে। তার চেহারা বিশ্রী হয়ে গেল। মাথায় টাক পড়ল। ভুঁড়ি ফাঁপতে লাগল। আয়নায় নিজের মূর্তি দেখে সে আঁতকে উঠল। ওদিকে সোনিয়ার তেমন কোনো রূপান্তর ঘটল না কিন্তু।
দীর্ঘকাল ইউরোপে বাস করে সুজনের জীবনের প্রত্যাশা দীর্ঘতর হয়েছিল। বিয়ে যদি তাকে কোনোদিন করতে হয় তবে তত দিনে তার আকার ও আকৃতি হোঁদলকুতকুতের মতো হয়ে থাকবে বলে তার ভয়। কলাবতীর অন্বেষণ তাকে সুন্দর না করে অসুন্দর করবে এই-বা কেমন কথা! চিরসৌন্দর্যের ধ্যান থেকে আসবে চরম কুরূপ! কোথায় তা হলে সে ভুল করেছে? সাধনার কোন পদক্ষেপে? প্রকৃতি এভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে কেন? সুজন ভাবে আর ভাবে। হঠাৎ তার মনে হয় একনিষ্ঠতাকে সে একটা ফেটিশ করে তুলেছে বলে তার এই দশা। যেখানে প্রেম সর্বদা সক্রিয় সেখানে একনিষ্ঠতা আপনাআপনি আসে। বকুলের প্রতি তার প্রেম অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো এখনও বিদ্যমান, কিন্তু বহতা নদীর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। একনিষ্ঠতা এক্ষেত্রে নিজেকে বঞ্চিত করা। প্রকৃতি কেন ক্ষমা করবে?
এমন সময় দেশ থেকে চিঠি এল সুজনের বাবার শক্ত অসুখ। বোধ হয় বেশি দিন বাঁচবেন না। ছেলেকে তিনি দেখতে চান। সোজা বাংলায়—যাবার আগে ছেলের বউ দেখে যেতে চান। এবার সুজন বেঁকে বসল না। বরং একপ্রকার স্বস্তি বোধ করল। বিয়ে যদি হয় তবে মরণাপন্ন পিতার অন্তিম ইচ্ছায় হোক। তার নিজের ইচ্ছায় নয়। তার নিজের ইচ্ছা যে কী তাই সে জানে না ও বোঝে না। পরমায়ু যদি প্রকৃতই দীর্ঘ হয়ে থাকে তবে বকুলের প্রতি একনিষ্ঠতার খাতিরে সোনিয়ার প্রেম পাওয়া সত্ত্বেও অনবরত তাকে অন্তর্দ্বন্দ্ব চালিয়ে যেতে হবে অবশিষ্ট জীবন। হ্রস্ব পরমায়ু ছিল ভালো। তার যখন কোনো লক্ষণ নেই তখন পরাজয় বরণ না করে উপায় কী! কিন্তু তার আগে একবার বকুলের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হয়। কলম্বো হয়ে দেশে ফিরবে সুজন। যদি দেখে বকুল সুখে আছে তা হলে সে তার বুড়ো বাপকে শেষ ক-টা দিন সুখী করবে। আর যদি লক্ষ করে বকুলের মনে সুখ নেই তবে কোন প্রাণে সে নিজের সুখ বা তার পিতার সুখ খুঁজবে! না, তেমন হৃদয়হীন সে নয়। কোনোদিন হবেও না। বকুল যদি অসুখী হয়ে থাকে তবে তার জন্যেই হয়েছে, তারই কথা ভেবে। অসুখীকে আরও অসুখী করবে কে? সুজন? প্রাণ গেলেও না। প্রাণ থাকতে তো নয়ই!
সোনিয়ার কাছ থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়ে কলম্বোগামী জাহাজে চড়ে বসল সুজন। সে কাউকে বঞ্চনা করেনি। নিজেকেই বঞ্চিত করেছে। কেউ যেন তার উপর অভিমান পুষে না রাখে। সোনিয়া যেন না ভাবে সুজন তাকে ত্যাগ করেছে। সুখী হোক, সার্থক হোক সোনিয়া। এমন কেউ আসুক তার জীবনে যে তার সাথি হবে অনন্তকাল। বিদায়, প্রিয়ে! বিদায়, সোনিয়া!
কলম্বোয় মোহিত তাকে নিতে এসেছিল জাহাজ থেকে বাড়িতে। বকুল আসতে পারেনি কোলের ছেলে ফেলে। মোহিত তাকে পুরোনো বন্ধুর মতো জড়িয়ে ধরল। বিজয়ী প্রতিযোগীর মতো নয়। বকুল তার জন্যে প্রতীক্ষা করছিল। শুকতারার মতো উজ্জ্বল তার চোখ। প্রজ্ঞাপারমিতার মতো ভাস্বর তার মুখ। মা হয়ে বকুল আরও সুন্দর হয়েছে। যেটুকু বাকি ছিল তার সৌন্দর্যের সেটুকু ভরে গেছে। ভরন্ত গড়ন। রাজরানির মতো চলন। এই আট-নয় বছরে বকুল বিকশিত হয়েছে শতদলের মতো। আর সুজন? সুজন হয়েছে ক্ষতবিক্ষত বঞ্চিত বিদগ্ধ।
মোহিত আর বকুল দু-জনের অনুরোধে সুজনকে থেকে যেতে হল সিংহলে দিনের পর দিন, পিতার জন্যে উদ্বেগ নিয়ে। তার ভালো লাগছিল থাকতে। বকুলকে তার জীবনের গল্প শোনাতে। তার ভবিষ্যতের কল্পনা জানাতে। কোনো কথা সে গোপন করল না, হাতে রাখল না। বকুলের জন্যে সে নিজের সুখ বিসর্জন দেবে যদি নিশ্চিত বুঝতে পারে যে বকুল এ বিবাহে সুখী হয়নি। নয়তো একজন সুখী হবে, আরেক জন অসুখী হবে, একেই কি বলে একনিষ্ঠতা? সুজন আশা করেছিল বকুল তার কাছে মন খুলবে। কোনো কথা গোপন করবে না, লুকিয়ে রাখবে না। তা কি হয়! বকুলের স্বামী আছে, স্বামীর ঘরে বসে কেমন করে স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধের কথা খুলে বলবে সে পরপুরুষকে!
বকুল বলল, ‘আমি সুখী হয়েছি। এবার তুমি সুখী হলেই আমার আফশোস যায়। বিয়ে কোরো, সুজিদা। ভুলে যেয়ো আমাকে। ফরগেট মি, প্লিজ।’