০৬. কান্তিমতীর অন্বেষণ
কান্তির যাত্রা দক্ষিণ মুখে। হাওড়া স্টেশনে মাদ্রাজ মেল দাঁড়িয়েছিল, তুলে দিতে এসেছিল অনুত্তম, সুজন, তন্ময়। বাড়ির লোক কেউ আসেনি। তাদের অমত। তাই বাড়ি থেকেও কিছু আনা হয়নি। বন্ধুরা জোগাড় করে যা দিয়েছিল তাই তার সম্বল।
‘এই ভালো।’ কান্তি বলল ব্যথা চেপে, ‘বোঝা আমার হালকা। যেমন ভ্রমণে তেমনি জীবনে। হৃদয় আমার ভারাক্রান্ত নয়। হবেও না।’
ট্রেন চলে গেল তাকে বহন করে দক্ষিণ ভারতে। সেখানে তার বছর আড়াই কেমন করে যে কেটে গেল তার হিসাব রাখে না সে নিজে। দক্ষিণী নৃত্যকলা মন্দিরকেন্দ্রিক। মন্দিরে মন্দিরে দেবদাসীদের নাচ দেখে গুরুস্থানীয়দের কাছে ভরতনাট্যম শিখে নৃত্য সম্বন্ধে তার ধারণার আমূল পরিবর্তন হল। সে ভেবেছিল ওটা সামাজিক জীবনের অঙ্গ। তা নয়। ওটা দেবতার সঙ্গে কথোপকথনের ভাষা। একপ্রকার দেবভাষা বলতে পার। তেমনি ব্যাকরণশুদ্ধ, সূত্রবদ্ধ। দেবতা স্বয়ং নর্তক। নটরাজ। রঙ্গনাথ। বিশ্বরঙ্গমঞ্চে, গ্রহনক্ষত্রের নাটমন্দিরে তিনিও নৃত্যপর। সৃষ্টিকর। প্রলয়ংকর।
ভরতনাট্যম কোনোরকমে আয়ত্ত করে কথাকলি শিখতে কোচিনে গেল কান্তি। কথাকলি মন্দিরকেন্দ্রিক নয়, গ্রামকেন্দ্রিক। তার জন্যে দল চাই, পৌরাণিক কাহিনি জানা চাই, পালার বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর অভিনয়ের ভাষাও বিভিন্ন। সে ভাষা মুদ্রাময়। কিন্তু কিছু দিন দেখে ছেড়ে দিল। কারণ নর্তক তৈরি করা যেমন কঠিন তার চেয়েও কঠিন দর্শক তৈরি করা। দর্শক যদি মুদ্রার অর্থ না বোঝে তা হলে নর্তকের মনের কথাই বুঝল না।
কথাকলিতে ভঙ্গ দিয়ে কান্তি চলল উত্তর মুখে। গুজরাতের গরবা তার কাছে বেশ সহজ লাগল। তার প্রকৃতির সঙ্গে মিল ছিল বলে সহজ। মিল ছিল রাজস্থানের লোক নৃত্যেরও। সেও যেন ব্রজের গোপযোগীদের একজন। সেও যেন আদিম ভিল উপজাতির মতো বন্য। মাস কয়েক কাটিয়ে দিল কাঠিয়াবাড়ে, রাজপুতানায়। মথুরায়, বৃন্দাবনে। তারপরে উত্তর ভারতের নাগরিক বিলাসনৃত্যে গা ঢেলে দিল। বাইনাচ, কথকনাচ। হাস্য-লাস্য বিলোপ কটাক্ষ। শৌখিন, সম্ভ্রান্ত, ক্ষীয়মাণ, ক্ষয়িষ্ণু। অমন করে আপনাকে দুর্বল করা ক-দিন চলতে পারে? বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে কান্তি কলকাতা ফিরে গেল। সেখান থেকে গেল মণিপুর।
মণিপুরে অপেক্ষা করছিল তার জন্যে সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। হ্যাঁ, এরই নাম কেলি, এরই নাম লীলা। দক্ষিণের মতো ক্লাসিকাল নয়, উত্তরের মতো নাগরিক নয়, পশ্চিমের মতো লোক নয়, পূর্ব প্রান্তের এই নৃত্যপদ্ধতি রসেভরা নৈসর্গিক। এর ছন্দ ধরতে কান্তির মতো অভিজ্ঞের তিন-চার মাস লাগার কথা, কিন্তু এর লালিত্য তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল, ধরা দিল না বারো-চোদ্দো মাসের আগে। রাসলীলার রাত্রে কৃষ্ণনৃত্য করে তার অঙ্গ শীতল হল। মধুর, মধুর, অতি মধুর। কলামাত্রেরই সার কথা মাধুর্য। কান্তির মনে হল সে উত্তীর্ণ হয়েছে।
মধুরেণ সমাপয়েৎ। মণিপুর থেকে সে কলকাতা ফিরে এল। কিন্তু স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকা তার ধাতে নেই। একটা বিদেশি নটসম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারতব্যাপী সফরে বেরিয়ে সে তাদের পরিচালন কৌশল শিখে নিল। তাদের নৃত্যপ্রকরণের সঙ্গেও পরিচিত হল। তাদের সঙ্গে ইউরোপে যাবার সুযোগ জুটেছিল, কিন্তু তার পক্ষপাতীরা তাকে যেতে দিল না। তাকে নিয়ে তারা একটা সম্প্রদায় গড়ল বিদেশি ছাঁচে। দেশ ক্রমশ নৃত্যসচেতন হচ্ছিল। ভদ্রঘরের মহিলারাও যোগ দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু নৃত্যকে তাঁদের সারাজীবনের সাধনা করতে তখনও প্রস্তুত হননি। সারাজীবনের জন্যে ঘরগৃহস্থালি। দু-দিনের জন্যে নৃত্য।
মুম্বই-এর ভাটিয়া পারসি গোয়ানিজ তরুণ-তরুণীদের নিয়ে সেই যে সম্প্রদায় গঠিত হল তার মূলধন ছিল উৎসাহ। তাই নিয়ে তারা শুরু করে দিল কথাকলি মণিপুরি ও ভরতনাট্যমের সমাহার। নিন্দুকরা বলাবলি করল এটা পাশ্চাত্য ব্যালের অনুকরণ। তা শুনে নাচিয়েরা বলল, চলো আমরা বিশ্বভ্রমণে যাই, পাশ্চাত্যের লোক দেখে বলুক এটা তাদের অনুকরণ কি না। এ পোড়া দেশে গুণের আদর নেই। এরা আমাদের চিনবে না।
কিন্তু জহুরি যারা তারা চিনল ঠিকই। দেখতে দেখতে একটির পর একটি কন্যারত্নের বিবাহ হয়ে গেল। তাদের যারা নৃত্যসহচর তারা মাথায় হাত দিয়ে বসল। নেচে সুখ কী যদি একা নাচতে হয়। দক্ষিণ ভারতের যিনি নটরাজ তাঁর সঙ্গেও একটি পার্বতী দেওয়া হয়েছিল। উত্তর-দক্ষিণ সমন্বয়। তিনি তো মনের দুঃখে বিবাগী হয়ে গেলেন। আর নাচবেন না বললেন। ভাঙা দল নিয়ে কান্তি কী করে সাগর পাড়ি দেয়? মণিপুরি কৃষ্ণের সঙ্গে গুজরাতি রাধা সাজবে কে? সুমতি এখন বউ হয়ে চলে গেছে সুরতে। সেখানকার এক তুলোর ব্যাপারীর কনিষ্ঠ পুত্রবধূরূপে।
সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিল এ ধরনের দল টিকতে পারে না। ভদ্রঘরের তরুণীরা বিয়ে একদিন করবেই। গুরুজনের ইচ্ছা, নিজেদেরও অনিচ্ছা নেই। তখন তাদের নৃত্যসহচরদের নাচের তাল কেটে যাবে। নতুন সহচরীর অভাব হবে না, কিন্তু তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে সময়ের অভাব হবে। ততদিন তাদের সঙ্গে ‘চলি চলি পা পা’ করতে করতে নিজেরাই পা ভুলে যাবে। তার তো ততদিন ধৈর্যই থাকবে না। তার বন্ধু শাপুরজি কিন্তু অবুঝ। বলে, ‘বাঙালিরা একটুতেই হাল ছেড়ে দেয়। সমস্যা তো আছেই, তার মীমাংসাও আছে নিশ্চয়। ধীরে সুস্থে করো। প্রথম ধাক্কায় কাত হয়ে পড়ছ কেন?’
কান্তি ভাবতে আরম্ভ করেছিল এসব নৃত্য দক্ষিণ ভারতে দেবদাসীরা, উত্তর ভারতে বাইজিরাই রক্ষা করে এসেছে প্রধানত। গড়তে হলে তাদের নিয়েই সম্প্রদায় গড়তে হবে। তারা বিয়ে করবে না, বিয়ে করবামাত্র নাচ ছেড়ে দেবে না। সারাজীবনের, সাধনাকে তারা ঘরগৃহস্থালির চেয়ে ভালোবাসে। শাপুরজি একথা শুনে লাল। ‘তোমরা হিন্দুরা চিরকাল এই করে এসেছ, এই করতে থাক চিরকাল। আমরা এর মধ্যে নেই। গোপনে যাই করি না কেন, প্রকাশ্যে একপাল বারবনিতা নিয়ে ঘুরতে পারব না। বিশ্বভ্রমণ দূরের কথা, ভারত ভ্রমণেরও দুঃসাহস নেই। পারসি থিয়েটার আজকাল চলে না কেন? লোকে ওসব পছন্দ করে না।’
তারপর ভট্টজি বললেন, ‘আমরা সেকেলে মানুষ, আমরাও এটা কল্পনা করতে পারিনে। আমরা বাইজিদেরও নাচতে দেখিনি ভদ্র পুরুষদের সঙ্গে। তুমি যদি ভদ্রাদের বাদ দিতে চাও ভদ্রদেরও বাদ দাও। নইলে ভদ্রদের মান ইজ্জত যাবে। ভারতীয় নৃত্যেরও পুনরুদয় হবে না।’
একেলে মানুষ মগনভাই বলল, ‘কান্তি, তুমি নৃত্য নৃত্য করে বাউরা হলে। তাই আর একটা দিক তোমার নজরে পড়ছে না। ভদ্রঘরের মেয়েদের সঙ্গে নাচলে আমরাও নিরাপদ থাকি। নইলে আমাদেরও একটির পর একটির পতন হত। তোমারও।’
কান্তি বাধা দিয়ে বলল, ‘না, আমার না।’
কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না তার কথা। যেখানে মুনিদেরও মতিভ্রম সেখানে কান্তির মতি স্থির থাকবে! শোনো, শোনো।
দল ভেঙে গেল। কারণ কান্তিই ছিল তার প্রাণ। সে একদিন নিরুদ্দেশ হল সঙ্গে কিছু না নিয়ে। বোঝা হালকা হলেই সে বাঁচে।
অন্য কারণে তার মন ভারী ছিল। সে-কথা কাউকে বলতে পারে না। বলত মন্ত্রীপুত্র কোটালপুত্র সওদাগরপুত্রদের। কিন্তু কোথায় তারা কে জানে! কে কার খোঁজ রাখে!
তার কান্তিমতীর অন্বেষণ ক্ষান্ত ছিল না। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে, নৃত্যের সুযোগ হয়েছে তাদের সকলেই তো কান্তিমতী। কেই বা নয়! কারো কেশ ভালো লেগেছে, কারও বেশ ভালো লেগেছে, কারও চাউনি, কারও চলন। কারো হাসি ভালো লেগেছে, কারও কান্না ভালো লেগেছে, কারও কোপনতা, কারও শরম। কারও মুদ্রা ভালো লেগেছে, কারও ভঙ্গি ভালো লেগেছে, কারও পদপাত, কারো পরশ।
না, সে বলতে পারল না যে এরা কেউ কান্তিমতী নয়, কান্তিমতী হচ্ছে এক এবং অদ্বিতীয়। তার বহুচারী মন কোনোখানে স্থিতি পেল না। যদিও ঠাঁই পেল সবখানে। প্রীতিও পেল কোনো কোনোখানে। এই তো সেদিন সুমতির কাছে। সুমতির বিয়ের খবর সে-ই জানত সকলের আগে। খবর দিয়েছিল সুমতি স্বয়ং। বলেছিল, ‘এ বিয়ে আমি করতে চাইনে যদি আর একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়।’
‘আর একজনটি কে?’ প্রশ্ন করেছিল কান্তি।
‘তুমি কি জান না যে আমাকে লজ্জার মাথা খেয়ে জানাতে হবে? বাধাও তো নেই।’
‘বাধা আছে। যে পাখি আকাশের তাকে আমি নীড়ে ভরতে গেলে আকাশ তো যাবেই, নীড়ও যাবে। আর আমাকেই বা সে নীড়ে ধরে রাখতে পারবে কেন? সুমতি, তুমি বিয়ে করতে চাও করো, কিন্তু বিয়ে না করলেই আমি সুখী হতুম।’
‘বিয়ে না করেই সারাজীবন কাটবে, এ কি কখনো সম্ভব! জান তো, রূপযৌবন দু-দিনে ঝরে যায়। তারপরে নাচবে কে? নাচ দেখবে কে? বাকি জীবন কী নিয়ে কাটবে? কাকে নিয়ে? বিয়ে তোমাকে করতেই হবে, কান্তি। আজ না হয়, বিশ বছর বাদে। ততদিন আমি কি তোমার সঙ্গে নাচতে পারব? রূপযৌবন থাকলে তো?’
সব সত্যি। তবু কান্তি বলেছিল, ‘এখন তুমি বিয়ে না করলেই সুখী হতুম, সুমতি। হয়তো ততদিন অপেক্ষা করতে পারতে না, কিন্তু কিছুদিন অন্তত পারতে। তবে অপেক্ষা করে ফল হত না, ঠিক। বিয়ে আমি করতে চাইতুম না কখনো। করব না কোনো দিন। করব না কাউকেই।’
সুমতি বিশ্বাস করল না। মুচকি হেসে চলে গেল। বলল, ‘আমি তো বাঙালিই নই।’
মধ্যভারতের এক মহারাজা তখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নৃত্যবিদ আনিয়ে তাদের সহযোগিতায় তাঁর নিজের খেয়ালখুশি মতো পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যাপৃত ছিলেন। বাইজি শ্রেণি থেকেই তাঁকে নর্তকী সংগ্রহ করতে হয়েছিল। এঁরা যেমন-তেমন বাইজি নন, শিক্ষায় সহবতে সাধনায় ও পরিশ্রমে এক-একটি নক্ষত্র। দরবার থেকে এঁদের বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল, সুতরাং ইতরবৃত্তির প্রয়োজন ছিল না। তবে লোকে বলে রাজকীয় অতিথিদের সঙ্গে রানি না থাকলে এঁরাই রানির মর্যাদা পেতেন।
কান্তির নাম ইতিমধ্যেই মহারাজের দরবারে পৌঁছেছিল। মানুষটিকে দেখে মহারাজ তৎক্ষণাৎ নিয়োগপত্র দিলেন। বললেন, ‘তোমাকেই আমি খুঁজছিলুম। তুমি এলে, এখন অঙ্গহানি দূর হল। মন দিয়ে লেগে যাও। কেউ হস্তক্ষেপ করবে না।’
নৃত্যের স্টুডিয়ো ছিল কান্তির স্বপ্ন। সুসজ্জিত স্টুডিয়োর অভাব সে পদে পদে বোধ করছিল। মহারাজের স্টুডিয়ো নেই, যা আছে তাকে স্টেজ বলা যায়। কান্তি বলল, ‘ইয়োর রয়্যাল হাইনেস, ভয়ে বলি কী নির্ভয়ে বলি।’
‘বলো, বলো, কী বলতে চাও বলেই ফেলো।’
‘জাঁহাপনা, এ যে স্টুডিয়ো নয়। এ যে স্টেজ।’
‘হাঁ, হাঁ, ইস্টেজ, ইস্টেজ। ইস্টুডিয়ো ক্যা চিজ?’
‘আমার কাছে ফোটো আছে। দেখাব। রাশিয়ান ব্যালের জন্যে ডিয়াগিলেফ যা ব্যবহার করতেন। নিজিনস্কি যেখানে অনুশীলন করতেন।’
‘ডিয়াগিলেফ কৌন আদমি? নিজিনস্কি কৌন আওরত?’ মহারাজ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের দিকে তাকান আর দাড়ি চোমরান।
কেউ বলতে পারে না। কান্তিই বলে, ‘নিজিনস্কি আওরত নন, পুরুষ। এ যুগের শ্রেষ্ঠ নর্তক। বোধ হয় পূর্বজন্মে গন্ধর্ব ছিলেন। ইদানীং পাগলা গারদে। আর ডিয়াগিলেফ সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি ছিলেন রাশিয়ান ব্যালে’র পরিচালক।’
সাঙ্গোপাঙ্গরা ধরা পড়ে অপ্রতিভ হলেন। মহারাজ ফোটো দেখে তাজ্জব বনলেন। তারপর স্টুডিয়ো নির্মাণের ফরমান বার হল। কান্তি যেমনটি চায়। তিন মাসের মধ্যে বাড়ি তৈরি। চার মাসের মধ্যে কাঠের মেঝে। ছ-মাসের মধ্যে সাজসরঞ্জাম। তার পরে শুরু হল কান্তির পরিচালনায় নতুন ধরনের তালিম। সে কেবল শেখায় না, দেখায়। লালিত্যে ও মাধুর্যে সে-রাজ্যে তার সমকক্ষ ছিল না। আগন্তুকদের মধ্যেও না।
তার নৃত্যসহচরী হল লায়লা জান। রাজনর্তকী মেহের জান যার মা। লায়লার সঙ্গে কোনো ভদ্র যুবক আর কখনো নাচেনি, লায়লা যেন কৃতার্থ হয়ে গেল, ধন্য হয়ে গেল। ধন্য হয়ে তার শ্রেষ্ঠ যা কিছু তাই এনে দিল নৃত্যবেদিতে। তার নটীর পূজার অর্ঘ্য। আর কান্তি আপনাকে ভাগ্যবান মনে করল সত্যিকারের একজন শিল্পীর সাহচর্য পেয়ে। যাকে পাখিপড়া করে শেখাতে হয় না, যার ভুল দেখে বিরক্ত হতে হয় না, যে কাঠের পুতুল নয় যে, তার দিয়ে বেঁধে নাচাতে হবে। লায়লার তুলনায় সুমতি যেন মানুষের তুলনায় পুত্তলিকা।
একজন ভাগ্যবান, আর একজন ধন্য। নাচ যা জমল তা দেখে তৃপ্তি। লায়লার প্রখর বুদ্ধি। এক পদ্ধতির সঙ্গে অপর পদ্ধতির সংমিশ্রণে নীর বাদ দিয়ে ক্ষীর নিতে সে কান্তির চেয়েও সুদক্ষ। বরং কান্তিকেই চাইতে হয় তার পরামর্শ, তার সমালোচনা। শ্রদ্ধায় কান্তির মাথা নুয়ে আসে। ভারতের বিভিন্ন ও বিচিত্র নৃত্যের সমন্বয় একটু এখান থেকে, একটু ওখান থেকে নিয়ে জুড়ে জুড়ে হবে না। হবে একটি বিশেষ ঐতিহ্যকে ঘিরে, একটি বিশেষ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে, তার চারদিকে আর সমস্তকে বিনুনির মতো বুনে।
কিন্তু এর চেয়েও বড়ো কথা, লায়লার নৃত্যে এমন একটা দরদ ছিল যা হাজার তালিম সত্ত্বেও সুমতির নৃত্যে আসত না। হাজার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কান্তির নৃত্যে আসবে না। এটা সাধনলব্ধ নয়। কান্তি একদিন লায়লাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘লায়লি, এ তুমি কোথায় পেলে?’
সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। ধীরে ধীরে সজল হল তার সুরমা-আঁকা আঁখি-পল্লব। ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘জীবনের কাছে।’
‘তোমার জীবন কি—’ কান্তি বলতে বলতে থেমে গেল।
‘কান্তি’, সে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল, ‘তুমিই একমাত্র পুরুষ যে আমাকে ঘৃণা করেনি, হীন জ্ঞান করেনি, মৌখিক ভদ্রতা জানায়নি, ক্ষুধা মেটাবার খাদ্য মনে করেনি। তোমার কাছে আমার গোপন করবার কী আছে?’
কান্তির চোখে জল এলো। মুখে কথা জোগাল না। কান সজাগ হল।
‘বড়ো দুঃখের জীবন আমাদের। মহারাজার কখন কে অতিথি আসবেন, তার জন্যে আমরা বাঁধা। নিমক খাই, হারামি করতে পারি কি?’
কান্তি যে জানত না তা নয়। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল এটা একটা প্রথা। সইতে সইতে সব প্রথার মতো এটাও গা-সওয়া হয়ে যায়। নইলে নৃত্যকলা রক্ষা পাবে কী করে? রক্ষিতারাই রক্ষা করে এসেছে। আবার রক্ষিতাদের রক্ষক হয়েছে রাজ্যের রাজা, মন্দিরের ব্রাহ্মণ। পাপ? এর মধ্যে পাপ যদি থাকে তবে পাপের শোধন হয়ে যায় নটরাজের উপাসনায়, কলাদেবীর আরাধনায়।
কিন্তু লায়লা যা বলল, যেমন করে বলল, তাতে কান্তির বহুদিনের বদ্ধমূল ধারণার মর্মে আঘাত লাগল। হু-হু করে উঠল তার হৃদয়। চোখের জলে মুখ ভেসে গেল। নারীর অপমানের উপর যার প্রতিষ্ঠা সে কীসের শিল্প, সে কীসের সাধনা। লায়লা কি নারী নয়? তার কি অপমানবোধ নেই? কান্তিমতী রাজকন্যা কি আর সব নারীতে আছে, লায়লাতে নেই?
আছে। আছে। এও সেই কান্তিমতী। কখনো রাধানৃত্যে, কখনো পার্বতীনৃত্যে, কখনো অপ্সরানৃত্যে সে তার চিরন্তন সৌন্দর্য উন্মোচন করে দেখিয়েছে। তখন মনে হয়েছে সে শাশ্বতী নারী। যে নারীর প্রতিরূপ ভারতের চেতনায় রাধা, গৌরী, উর্বশী। ইরানের চেতনায় লায়লা। গ্রিসের চেতনায় হেলেন। জুডিয়ার চেতনায় মেরি। ইটালির চেতনায় ম্যাডোনা।
কান্তি বলল, ‘তোমার জন্যে আমি কী করতে পারি, লায়লি?’
‘কিছুই না। সব আমার নসিব।’ সে দার্শনিকের মতো শান্ত।
কিন্তু কান্তির জীবনের তাল কেটে গেল। তার নৃত্যেরও। একদিন সে কাউকে কিছু না বলে কারও কাছে বিদায় না নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। না, ভারতের নৃত্যকলার পুনরুদয় ওভাবে হবে না। সমাধানের জন্যে অন্য উপায় দেখতে হবে। অতীতে যা কার্যকরী হয়েছে বর্তমানেই তার কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে, ভবিষ্যতে কি তা বৃদ্ধি পাবে? না। নারীকে পতিতা করে তার পতনের উপর যা দাঁড়িয়েছে তা মন্দিরই হোক আর প্রাসাদই হোক তা পতনোন্মুখ। কান্তি তার সঙ্গে আপন ভাগ্য যোগ করে পতিত হবে না। ভারতের নারী যদি নর্তকী হয়ে গ্লানি বোধ করে তবে নারীকে সে ডাকবে না সারাজীবনের জন্যে নৃত্যসাধনা করতে।
অশান্ত হৃদয় নিয়ে সে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াল, ভুলে গেল যে সে শিল্পী। ক্রমে বুঝতে পারল আদর্শ অবস্থার জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না। সুমতিদের নিয়ে, লায়লাদের নিয়ে কাজে লেগে যেতে হবে। পরে যারা আসবে তাদের জন্যে বসে থাকলে কাজ হবে না। আসবে তারা একদিন, আসবেই। যেমন এসেছে ইউরোপে আমেরিকায় তেমনি আসবে ভারতে। আধুনিক নারী। যে পতিতা নয়, যে শিল্পের খাতিরে অবিবাহিতা কিংবা বিবাহ করলেও শিল্পচর্চায় নিবেদিতা।
আবার সম্প্রদায় গঠন। এবার কলকাতায়। যা সে আশা করেনি তাই ঘটল। দলে যোগ দিল একটি দু-টি করে বেশ কয়েকটি বিবাহিতা মেয়ে, তাদের স্বামীরাও। এরা অবশ্য কিছুতেই লায়লার মতো মেয়েদের আসতে দেবে না। তা ছাড়া আর কোনো খেদ রইল না কান্তির মনে। কী করে লায়লাকে উদ্ধার করবে এ চিন্তা তাকে অনবরত পীড়া দিচ্ছিল।
এবার দেখা দিল নতুন এক সমস্যা। তার নৃত্যসহচরী হল মীনাক্ষী। তাতে শ্যামলের আপত্তি। শ্যামল ওর স্বামী। বেচারার নাচতে শখ। কিন্তু নাচে নিজের খেয়ালে। আড়াই বছরের শিশু ভোলানাথের মতো। মীনাক্ষীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে এই তার নাচের যোগ্যতা। কান্তি তার নাচের দাবি নাকচ করায় সে দারুণ দুঃখ পেল। কিন্তু তার বিয়ের দাবি নাকচ করা অত সহজ নয়। সে হল স্বামী। স্বামী যদি অনুমতি না দেয় তা হলে স্ত্রী কেমন করে অপরের সঙ্গে নাচবে?
কান্তি তাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলল, ‘শ্যামল, তোমার মনে যে শঙ্কা জাগছে সেটা অমূলক। আমার নৃত্যসহচরী কোনোদিন নর্মসহচরী হবে না। কোনখানে লাইন টানতে হয় সে আমি জানি। যদি না জানতুম তা হলে এতদিন সব প্রলোভন তুচ্ছ করলুম কোন মন্ত্রবলে?’
শ্যামল অভিভূত হয়ে বলল, ‘কান্তিদা, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ওই যে তোমার পণ—বিয়ে করবে না, ওর তাৎপর্য কী?’
এরূপ প্রশ্ন এই প্রথম। অবাক হল কান্তি। তখন শ্যামল বলে চলল, ‘ওর তাৎপর্য কি এই নয় যে তোমার জন্যে আমি বিয়ে করব, আর তুমি আমার বিয়ের সুযোগ নেবে?’
সর্বনাশ! মানুষের মনে কত ময়লা যে আছে! কান্তি কী উত্তর দেবে ভাবছে, শ্যামল আবার বলল, ‘তুমিও বিয়ে করে ফেলো, কান্তিদা। নইলে দল রাখতে পারবে না। তারপর তোমার যদি পছন্দ হয় তুমি মীনাক্ষীর সঙ্গে নাচবে, আর আমি নাচব বউদির সঙ্গে। কেমন? অন্যায় বলেছি? এটা কি অন্যান্য স্বামীদেরও মনের কথা নয়?’
হা ভগবান! কান্তি একবার আকাশের দিকে তাকাল। একবার শ্যামলের দিকে। তারপর বলল, ‘শ্যামল, আমাকে বিশ্বাস করো। আমি যখন যার সঙ্গে নাচি তখন তার সঙ্গে আমার নিষ্কাম সম্পর্ক। সৌন্দর্য ভিন্ন আর কিছু আমি দেখিনে। ফুল দেখে আমি আনন্দ পাই, ছিঁড়তে যাইনে। এর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি নেই, চাতুরী নেই, শ্যামল। ভুল বুঝো না আমাকে।’
শ্যামল নিরস্ত হল। কিন্তু কয়েক মাস পরে কান্তির নিজেরই টনক নড়ল। মীনাক্ষী তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল যার অর্থ, যদস্তি হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব।