০৪. রূপবতীর অন্বেষণ
বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে জীবনমোহনকে প্রণাম করে তন্ময় যাত্রা করল পশ্চিমমুখে। কানে বাজতে থাকল তাঁর শেষ উক্তি, ‘উত্তমা নায়িকার সাক্ষাৎ লাভ করো। জীবনে যা কিছু শেখবার যোগ্য সে-ই তোমাকে শেখাবে। অন্য গুরুর আবশ্যক হবে না।’
ইংল্যাণ্ডে গিয়ে দেখল অক্সফোর্ডে তার জন্যে আসন রাখা হয়েছে। সুবিখ্যাত ক্রাইস্টচার্চ কলেজ। সেখানকার সে আবাসিক ছাত্র। খেলোয়াড় সর্বত্র পূজ্যতে। দেখতে দেখতে তার এনগেজমেন্ট ডায়েরি ভরে গেল আমন্ত্রণে আহ্বানে। টেনিস খুলে দিল বনেদি সমাজের দ্বার। যে দ্বার বিদ্বানের কাছেও বন্ধ থাকে।
যার দরুন তার এত খাতির সেই খেলার উপর জোর দিতে গিয়ে অন্য কিছু হয় না। হয় না উত্তমা নায়িকার অন্বেষণ। অনায়াসে যাদের সঙ্গে ভাব হয় তাদের সঙ্গ তাকে ক্ষণকালের জন্যে আবিষ্ট করে। তারপরে রেখে যায় তীব্রতর তৃষা। কোথায় তার রূপমতী, কোথায় সেই একমাত্র নারী, যে ছাড়া আর কোনো নারী নেই ভুবনে।
এমনি করে বছর ঘুরে গেল। কেম্ব্রিজকে খেলায় হারিয়ে দিয়ে নাম কিনল যারা তন্ময় তাদের একজন। পক্ষপাতীদের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে হাতে ব্যথা ধরে গেল তার। র্যাকেটখানা বগলে চেপে স্কার্ফ গলায় ঘুরিয়ে বেঁধে ক্রিম রঙের ফ্ল্যানেল ট্রাউজার্স পরা ছ-ফুট লম্বা দোহারা গড়নের নওজোয়ান বিশ্রাম করতে চলল প্যারিসে।
বিশ্রামের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা বটে প্যারিস। সেখানেও খেলার জন্যে আহ্বান, আহারের জন্যে আমন্ত্রণ। খেলোয়াড়দের না চেনে কে। ছোটো ছেলেরা পর্যন্ত তাদের ছবি কেটে রাখে। যেই রাস্তায় বেরোয় অমনি কেউ-না-কেউ দু-তিন বার তাকায়, একটুখানি কাশে, তারপর কাছে এসে মাফ চায় ও বলে, আপনি কি সেই বিখ্যাত—?
মিথ্যে বলতে পারে না। স্বীকার করে। তখন কথাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় খেলোয়াড়রা এসে হাতে হাত মেলায় আর বলে যুদ্ধং দেহি। হাতে ব্যথা শুনেও কি কেউ ছাড়ে! এনগেজমেন্ট ডায়েরি আবার ভরে যায়। এবার শুধু টেনিস কোর্ট ও ক্লাব নয়। কাফে রেস্তরাঁ ক্যাবারে নাচঘর। ব্যথা ধরে যায় কোমরে ও পায়ে।
বনেদি ঘরের না-হোক, ঘরের না-হোক, কত স্তরের কতরকম রঙ্গিণীর সঙ্গে পরিচয় হল তার! রূপের ঝলক, লাবণ্যের ঝিলিক, লাস্যের ঝলসানি লাগল তার নয়নে, তার অঙ্গে, তার মানসে, তার স্বপ্নে। কিন্তু কই, রূপমতী কোথায়! কোথায় সেই একমাত্র নারী, যে সূর্যের মতো প্রতিবিম্বিত হচ্ছে এইসব শিশিরবিন্দুতে, ঝিকিমিকি করছে এইসব মণিকণিকায়! এরা নয়, এরা কেউ নয়।
বিশ্রামের হাত থেকে বিশ্রাম নেবার জন্যে তাকে দৌড় দিতে হল দক্ষিণ ফ্রান্সের রিভিয়েরায়। নিসের কাছে ছোট্ট একটি না-শহর না-গ্রাম। সেখানকার সমুদ্রের গাঢ় নীল তার চোখে নীলাঞ্জন মাখিয়ে দিল। আর সে কী হাওয়া! একেবারে ঘুমের দেশে নিয়ে যায়। ঘুমপাড়ানি গেয়ে শোনায় পাইন বন, জলপাই বন। শুয়ে শুয়েই কেটে যায় দিন। একটু কষ্ট করে খেতে বসতে হয়। এই যা কষ্ট।
ছুটি ফুরিয়ে যাবার পরেও তন্ময় ফিরে যাবার নাম করে না ইংল্যাণ্ডে। অকারণে শুয়ে শুয়ে কাটায় রিভিয়েরায়। একজন ডাক্তারও পাওয়া যায় যে তাকে শুয়ে থাকতে পরামর্শ দেয়। যাতে তার ব্যথা সারে। মন বলে, সময় নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মনের অতল থেকে ধ্বনি আসে, স্থির হয়ে থাকো। ঘুমন্ত পুরীর রাজপুত্রের মতো নিষ্কম্প, অতন্দ্র।
ঘুম পায়, তবু ঘুমোতে পারে না। শুয়ে থাকে, তবু ঘুমোয় না। এইভাবে কত কাল কাটে। পাঁজির হিসাবে যা আড়াই মাস ঘুমন্ত পুরীর হিসাবে তা আড়াই বছর। জেগে থেকে তন্ময় যার ধ্যান করে সে কোন দেশের রাজকন্যা কে জানে! কোন যুগের তাও কি বলবার জো আছে! যুগনির্ণয়ের একটা সহজ উপায় বেশভূষা অঙ্গসজ্জা। কিন্তু তন্ময় যার ধ্যানে বিভোর সে দিগবসনা।
বড়োদিন এসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এল একঝাঁক টুরিস্ট।
কেউ-বা তাদের ফরাসি, কেউ ইংরেজ, কেউ আমেরিকান, জার্মান, ওলন্দাজ। একদল ভারতীয় উঠল তন্ময়ের হোটেলে। দল ঠিক নয়, পরিবার। পাগড়ি বা দাড়ি দেখে মালুম হয় শিখ। বাপ আর ছেলে, মা আর দুই মেয়ে। এ ছাড়া একজন সেক্রেটারি ভদ্রলোক। ইনি বোধ হয় শিখ নন, তবে পাঞ্জাবি। যে টেবিলে তাঁদের বসতে দেওয়া হয়েছিল সেটি তন্ময়ের টেবিল থেকে বেশ কিছু দূরে। নানা ছলে সে তাঁদের লুকিয়ে দেখছিল। তাঁদের দৃষ্টি কিন্তু তার উপর পড়ছিল না। পড়লে কি সে খুশি হত? না, সে লুকিয়ে থাকতেই চায়। এই প্রথম সে তার চেহারার জন্যে লজ্জিত হল। এঁদের না দেখে কে তার দিকে তাকাবে!
সমুদ্রের ধারে যেখানে সাধারণত সে শুয়ে থাকত সেখানে যেতেও তার অরুচি। সেটা সকলের নজরে পড়ে। তা বলে তো ওঘরে বন্ধ থাকা যায় না। তন্ময় তা হলে কী করবে? পালাবে? না, পালাতেও পা ওঠে না। ভাবল ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে আপনাকে গোপন করবে। কিন্তু সাদা মানুষের ভিড়ে কালো মানুষের মুখ ঢাকা পড়ে না। ভারি অস্বস্তি বোধ করছিল তন্ময়। কিন্তু তার চেয়েও অস্বস্তি বোধ করছিল তার টেবিলের জনা কয়েক ভারতফেরতা শ্বেতাঙ্গ। তারাই তলে তলে ষড়যন্ত্র করে তাকে চালান করে দিল ভারতীয়দের টেবিলে। হোটেলের ম্যানেজার স্বয়ং তাকে অনুরোধ জানালেন তার স্বদেশীয়দের সঙ্গ দিয়ে তাঁকে অনুগৃহীত করতে।
শিখ ভদ্রলোক তাকে বিপুল সমাদরে গ্রহণ করলেন ও পরিবার পরিজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমাদের মহারাজ ফরাসি সভ্যতার পরম ভক্ত। ফরাসিতে কথা বলেন, ফরাসিতে উত্তর শুনতে ভালোবাসেন। আমরা যাঁরা তাঁর আমির-ওমরাহ আমরাও ফরাসি কেতায় দুরস্ত। বছরে দু-বছরে একবার করে এদেশে আসি এদের চালচলনের সঙ্গে তাল মেলাতে। আমার বড়ো মেয়ে ‘রাজ’ এই দেশেই মানুষ হয়েছে। ছোট মেয়ে ‘সুরজ’ এখন থেকে এদেশে পড়বে। বড়ো মেয়ে আমাদের সঙ্গে ফিরে যাবে। কিন্তু একমাত্র পুত্র মাহীন্দরকে নিয়ে মুশকিলে পড়েছি। সে চায় অক্সফোর্ডে বা কেম্ব্রিজে যেতে। কিন্তু মহারাজের অভিপ্রায় তা নয়।’
ভদ্রলোক চাপাগলায় বললেন, ‘ইংরেজ আমাদের পায়ের তলায় রেখেছে, সে-কথা কি আমরা এক দিনের জন্যেও ভুলতে পেরেছি। শিক্ষার জন্যে আর যেখানেই যাই, ইংল্যাণ্ডে নয়। ফরাসিতে কথা বলে মহারাজ ইংরেজকে অপ্রতিভ করতে ভালোবাসেন। ওরা তাঁকে ইংরেজিতে কথা বলাতে পারেনি। আমরা অবশ্য ইংরেজিও জানি ও বলি। সেটা তাঁর পছন্দ নয়।’
তন্ময় শোনবার ভান করছিল। কিন্তু শুনছিল না। তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তার পার্শ্ববর্তিনীর প্রতি। পার্শ্ববর্তিনী বলেছি, বলা উচিত দক্ষিণ পার্শ্ববর্তিনী। কেননা বাম পাশে বসেছিলেন সরদার রানি। উঁহু। বলা উচিত সে বসেছিল সরদার রানির ডান পাশে। আর তার ডান পাশে ‘রাজ’।
কী চোখে যে দেখল তাকে তন্ময় তার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই মনের ভিতর থেকে ধ্বনি উঠতে লাগল, যাকে এতদিন খুঁজছিলে রাজপুত্র, এই সেই রাজকন্যা রূপমতী। সে ধ্বনি এতই স্পষ্ট যে হঠাৎ মনে হয় কাছে কোথাও সোনার শুক আছে, তারই কন্ঠস্বর।
এই আমার রূপমতী। এই আমার অদৃষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে হল তন্ময়ের। আনন্দ করবে কী। বিষাদে ভরে গেল অন্তর। মনে পড়ল জীবনমোহনের আর একটি উক্তি, সুখের অন্বেষণ তোমার জন্যে নয়। তোমার জন্যে রূপের অন্বেষণ। তুমি তার জন্যে। সুখ যে কোনোদিন আসবে না তা নয়। আপনি আসবে, আপনি যাবে, তার আসা-যাওয়ার দ্বার খোলা রেখো।
এই আমার অদৃষ্ট। অদৃষ্টের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থ হয়ে গেল তন্ময়। একে পাব কি না জানিনে, পেলে ক-দিন ধরে রাখতে পারব, যদি আপনা থেকে ধরা না দেয়। অথচ এরই অনুসরণ করতে হবে চিরদিন ছায়ার মতো। এখন থেকে অনুসরণই অন্বেষণ। অন্বেষণের অন্য কোনো অর্থ নেই।
‘রাজ’ ফরাসি ভাষায় কী বলল তন্ময় বুঝতে পারল না। তখন ইংরেজিতে বলল, ‘শুনতে পাই বাঙালিরা নাকি ভারতবর্ষের ফরাসি। সত্যি?’
‘সেটা আপনাদের সৌভাগ্য।’ তন্ময় বলল কৃতার্থ হয়ে। ‘তবে পাঞ্জাবিদের কাছে কেউ লাগে না। তারা ভারতের খড়্গবাহু।’
সরদার সাহেব তা শুনে হো-হো করে হাসলেন। ‘তা হলে ভারত পরাধীন কেন?’
সরদার রানি মন্তব্য করলেন, ‘বাংলার সঙ্গে পাঞ্জাবের যোগাযোগ ছিল না বলে।’
‘তা হলে’, সরদার বললেন, ‘আজ থেকে যোগাযোগ স্থাপন করা হোক।’ এই বলে বাংলার ‘স্বাস্থ্য’ পান করলেন।
এর উত্তরে পাঞ্জাবের ‘স্বাস্থ্য’ পান করতে হল তন্ময়কে।
এমনি করে তাদের চেনাশোনা হল। তন্ময়ের আর তার রূপমতীর। কথাবার্তার স্রোত কতরকম খাত ধরে বইল। কখনো টেনিস, কখনো ঘোড়দৌড়, কখনো ভাগ্যপরীক্ষা ও জুয়োখেলা যার জন্যে রিভিয়েরা বিখ্যাত। কখনো শিকার, কখনো মাছ ধরা, কখনো বাচ খেলা যার জন্যে অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিখ্যাত। কখনো দোকানবাজার, কখনো পোশাক পরিচ্ছদ, কখনো আমোদপ্রমোদ যার জন্যে প্যারিস বিখ্যাত।
বিকেলে ওরা একসঙ্গে বেড়াতে গেল। দু-জনে মিলে নয়, সবাই মিলে। তন্ময় বেশিরভাগ সময় মাহীন্দরের কাছাকাছি। রাজকে আর একটু ভালো করে দেখবার জন্যে দূরত্ব দরকার। যতই দেখছিল ততই বুঝতে পারছিল এ সৌন্দর্য হীরা-জহরতের নয়, নয় নীল বসনের, নয় আঁকা ভুরুর, নয় রাঙানো গালের। মিলো দ্বীপের এ ভিনাস মানুষের হাতে গড়া নয়, প্রকৃতির কৃতি। কোনোখানে এতটুকু অনাবশ্যক মেদ নেই, অনাবশ্যক রেখা নেই, অনুপাতের ভুল নেই, সুষমতার খুঁত নেই। দীঘল গড়ন। দুধবরন। মিশকালো চুল বাবরির মতো ছাঁটা। কাঁটা বা ক্লিপ বা ফিতে লাগে না। মিশকালো চোখ ঘন পদ্মে ঢাকা। তাকায় যখন আসমানে তারা ফোটে। আর চলে যখন মাটিতে ঝরনা বয়ে যায়।
রূপসি? হাঁ, অনুপম রূপসি। লাবণ্যবতী? হ্যাঁ, অমিত লাবণ্যবতী। এই আমার রূপমতী। আমার উত্তমা নায়িকা। আমার অদৃষ্ট। এরই অনুসরণ করতে হবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। বিয়ের আগে তো বটেই, বিয়ের পরেও বটে। যদি বিয়ে হয়। হবে কি? কে জানে! তন্ময় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। সবচেয়ে ভাবনার কথা রূপমতীর যদি আর কারও সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। যদি না হয় বাজ বাহাদুরের সঙ্গে। অশ্রুবাষ্পে অস্পষ্ট দেখতে পায় তন্ময়, তার কোলে তার রূপমতী আর তার ঘোড়ার পিঠে সে বাজ বাহাদুর। ঘোড়া ছুটছে বিজলির মতো, বজ্রের মতো গর্জে উঠছে সরদার সাহেবের বন্দুক। পিছনে ধাওয়া করছে শিখ ঘোড়সওয়ার দল।
বর্ষশেষের রাত্রে ফ্যান্সি ড্রেস বল হল হোটেলের বলরুমে। তন্ময় সেজেছিল বাজ বাহাদুর। কেউ জানত না কেন। আর রাজ সেজেছিল রাজপুতানি। সেটা তন্ময়ের ইঙ্গিতে। গ্র্যাণ্ড মোগল সেজে সরদার সাহেবের মেজাজ খুশ ছিল। আর সরদার রানির হাসি ধরছিল না মমতাজ মহল সেজে। সে রাত্রের উৎসবে কে যে কার সঙ্গে নাচবে তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না, বাছবিচার ছিল না। তন্ময় আর্জি পেশ করল, রাজ মঞ্জুর করল। বাপ-মা কিছু মনে করলেন না। নাচে তন্ময়ের কিছু স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতা ছিল। রাজ পছন্দ করল তাকেই বার বার। রাত বারোটা বাজল, নতুন বছর এল, উল্লাসমুখরিত কক্ষে কেউ লক্ষ করল না এদের দু-জনের ঘোড়া ছুটেছে কোন অজ্ঞাত রাজ্যে, কোন দুর্গম দুর্গে, কোন নিভৃত কুঞ্জে। তন্ময় কানে কানে বলল, ‘এই গল্পের শেষে কী? বিচ্ছেদ না মিলন?’ রাজ কানে কানে বলল, ‘যেটা তোমার খুশি।’ তন্ময়ের বুক দুলে উঠল। সে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বলতে পারল, ‘জগতের সবচেয়ে সুখী পুরুষ আমি। কিন্তু বলেই তার মনে হল, ‘তাই কি? এত রূপ নিয়ে কেউ কখনো সুখী হতে পারে?’
সরদার সাহেবরা এর পরে জেনেভায় চললেন। তন্ময় ফিরে গেল অক্সফোর্ডে। কিন্তু সেখানে তার একটুও মন লাগল না। খেলতে গিয়ে বার বার হারে, পড়তে গিয়ে আনমনা থাকে। কেউ ডাকলে যায় না, গেলে চুপ করে থাকে। ওদিকে চিঠি লেখালেখি শুরু হয়েছিল। ওরা জেনেভা থেকে প্যারিস হয়ে দেশে ফিরছে শুনে তন্ময় বুঝতে পারল এই তার শেষ সুযোগ। এখন যদি বিয়ের প্রস্তাব করে তা হলে হয়তো একটুখানি আশার আমেজ আছে। দেশের মাটিতে যেটা দিবাস্বপ্ন প্যারিসের আবহাওয়াতে সেটা সত্য হয়ে যেতেও পারে।
সুরজকে প্যারিসে রেখে মাহীন্দরকে জেনেভায় দিয়ে রাজকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে ফিরে যাচ্ছেন তাদের মা-বাবা। তন্ময় গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করল। তাঁরা বললেন, ‘তুমি ছেলেমানুষ। তুমি আমাদের ছেলে। তাই ছেলের মতো আবদার করছ। কিন্তু, বাবা, এমন আবদার করতে নেই। তোমার জানা উচিত যে আমাদের সমাজে এটা অচল। আর আমরা তো সত্যি ফরাসি নই, আমরা শিখ। তোমাকে আমরা কলকাতায় খুব ভালো ঘরে বিয়ে দেব। সেও খুব সুন্দরী হবে।’
‘আমি যদি আপনাদের ছেলে হয়ে থাকি,’ তন্ময় বলল বুদ্ধি খাটিয়ে ‘তা হলে আমাকে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন আপনাদের রাজ্যে। সেখানে একটা কাজকর্ম জুটিয়ে দেবেন। আপনাদের কাছাকাছি থাকব।’
‘সে কী!’ সরদার সাহেব অবাক হলেন, ‘তুমি অক্সফোর্ডের পড়া শেষ না করেই সংসারে ঢুকবে! কোনো বাপ কোনো ছেলেকে এমন পাগলামি করতে দেয়!’
সরদার রানি বললেন, ‘তোমার বাবা আমাদের ক্ষমা করবেন না, বাচ্চা।’
তন্ময় কিন্তু সত্যি সত্যিই তল্পি তল্পা গুটিয়ে তাঁদের সঙ্গে জাহাজে উঠে বসল। তার মন বলছিল এই তার শেষ সুযোগ, সুযোগভ্রষ্ট হয়ে অক্সফোর্ডে সময়পাত করা মূর্খতা। একটা পন্ডিতমূর্খ হয়ে সে করবে কী! সবাই যা করে তাই? চাকরি, বিয়ে, বংশবৃদ্ধি? সেটা তো রূপমতীর অন্বেষণ নয়, সেটা রৌপ্যবতীর অন্বেষণ।
রাজ সুখী হয়েছিল তন্ময়ের নিষ্ঠায়। কিন্তু তার মা-বাবার মুখ অন্ধকার। এ আপদ কবে বিদায় হবে কে জানে! এ যদি মেয়ের মন পায় তা হলে সে কি আর কাউকে বিয়ে করতে রাজি হবে? তন্ময় কল্পনা করেনি তাঁদের আরেক মূর্তি দেখবে। কথা বলবেন কী, লক্ষই করেন না তাকে। আমলেই আনেন না তাঁর অস্তিত্ব। সে যদি গায়ে পড়ে ভদ্রতা করতে যায় এমন সুরে ধন্যবাদ জানান যে মুর্দাবাদ বললে ওর চেয়ে মিষ্টি শোনায়। বেচারা তন্ময়!
আত্মসম্মান যার আছে সে করাচীতেই সরে পড়ত, কিংবা বড়োজোর লাহোর পর্যন্ত গিয়ে কেটে পড়ত। কিন্তু তন্ময়ের গায়ের চামড়া মোটা। সে মান-অপমান গায়ে মাখল না। সরদার সাহেব তাকে নিয়ে করেন কী! অক্সফোর্ডক ফেরতা ভদ্রলোকের ছেলেকে তো সকলের সামনে ধমকাতে পারেন না। শুধু তাই নয়, সে নামকরা খেলোয়াড়। খেলোয়াড়কে তিনি সমীহ করেন। ছেলেটি তো দেখতে-শুনতে খারাপ নয়, গুণীও বটে। জাতে বাধে, নইলে মন্দ মানাত না মেয়ের সঙ্গে। গৃহিণীও সেই কথা বলেন।
চলল তন্ময় শিখ রাজ্যে। অতিথি হয়ে। তারপর মহারাজার খেলোয়াড় দলে টেনিসের ‘কোচ’ নিযুক্ত হয়ে সে হোটেলে জাঁকিয়ে বসল। তার খরচের হাত দরাজ। যা পায় ফুঁকে দেয় আদর আপ্যায়নে। খোশ গল্পে তার জুড়ি নেই। স্বয়ং মহারাজ তাকে ডেকে পাঠান তার ‘কিসসা’ শুনতে। বাঙালিকে সেখানে বোমারু বলেই জানে পাঁচজনে। খাতিরটা ওর দৌলতেও জুটল। তবে পুলিশের খাতায় নাম উঠল।
ওদিকে যে জন্যে তার এতদূর আসা সে জন্যেও তার চেষ্টার অবধি ছিল না। রাজ আর কাউকে বিয়ে করবে না বলে তাকে বাক্য দিল। কিন্তু মা বাপের অমতে তাকেও বিয়ে করবে না বলে মাফ চাইল। তন্ময় দেখল এটা মন্দের ভালো। মেয়ে চিরকুমারী থাকে কোন বাপ মা-র প্রাণে সয়! এঁরাও মত না দিয়ে পারবেন না।
হলও তাই। মহারাজার নির্বন্ধে বিয়ের অনুমতি পাওয়া গেল, কিন্তু ভারতে নয়। আবার যেতে হল ফ্রান্সে। সেখানে বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম না করে। হানিমুনের জন্যে আবার গেল নিসের কাছে সেই না-শহর না-গ্রামে। আবার সেই হোটেল, সেই সমুদ্রতীর, সেই পাইন বন, জলপাই বন।
তন্ময়ের মতো সুখী কে? জগতের সুখীতম পুরুষ তার প্রিয়ার দিকে তাকায় আর মনে মনে জপ করে, এ কি থাকবে? এ কি যাবে? এ সুখ কি দু-দিনের? এ কি সব দিনের? আসা-যাওয়ার দ্বার খুলে রাখতে বলেছেন জীবনমোহন। খোলা রাখলে কি সুখ থাকে? আর রূপ? সেও কি শাশ্বত?
রাজ যদি এত সুন্দর না হত তা হলে হয়তো তন্ময় চিরদিন সুখী হবার ভরসা রাখত। কিন্তু সে যে বড়ো বেশি সুন্দর। সৌন্দর্যের ডানা আছে, সেইজন্যে সেকালের লোক সুন্দরী আঁকতে চাইলে পরি আঁকত। পরির অঙ্গে ডানা জুড়ে বোঝাতে চাইত, এ থাকবে না। উড়ে যাবে। একে ধরে রাখতে গেলে যাও বা থাকত তাও থাকবে না।
রাজের অঙ্গে ডানা নেই, কিন্তু ডানার বদলে আছে মানা। তার গায়ে হাত দিতে সাহস হয় না। স্পষ্ট কোনো নিষেধ আছে তা নয়। মুখফুটে কোনোদিন সে ‘না’ বলেনি। তবু তন্ময় জানে যে-খেলার যা নিয়ম। এ খেলার নিয়ম হচ্ছে, দেখতে মানা নেই, ছুঁতে মানা। মিলো দ্বীপের ভিনাসের গায়ে কেউ হাত দিক দেখি? হইহই করে তেড়ে আসবে গোটা লুভর মিউজিয়াম। অথচ দেখতে পার যতক্ষণ ইচ্ছা, যতবার ইচ্ছা। সুন্দরী নারীর স্বামীও একজন দর্শকমাত্র।
মধুমাসের পরে ওরা ইংল্যাণ্ডে গেল। সেখানে তন্ময়ের জনকয়েক লাট-বেলাট মুরুব্বি ছিলেন। তাঁর খেলার সমঝদার। তাঁদের সুপারিশে তাঁর একটা চাকরি জুটে গেল ইন্ডিয়ান আর্মির পুনা দপ্তরে। পুনায় ঘর বাঁধল তারা দু-টিতে মিলে। অত বড়ো সৌভাগ্য দু-জনের একজনও প্রত্যাশা করেনি। রাজ খুশি হয়েছে দেখে তন্ময়ের খুশি দ্বিগুণ হল। অফিসের মালিক আর ঘরের মালিক, দুই মালিকের মন জোগাতে গিয়ে মেহনতও হল দ্বিগুণ।
বছর দুই তাদের শিস দিতে দিতে ছুটে চলল বম্বে মেলের মতো। তারপরে আর মেল ট্রেন নয়, প্যাসেঞ্জার ট্রেন। পুনায় তন্ময়ের কাজ, কিন্তু রাজ থাকে বেশিরভাগ সময় মুম্বাইতে। সেখানে তাকে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় ঘোড়দৌড়ের মাঠে আর উইলিংডন ক্লাবে। তার বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে শখের নাটক করলে তাকে ধরে নিয়ে যায় অভিনয় করতে। অভিনয়ে তার সহজাত প্রতিভা ছিল। হিন্দি ফিল্ম স্টুডিয়ো থেকে তার আহ্বান এল। সে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যদি বারণ কর আমি যাব না।’ তন্ময় বলল, ‘আমি যদি বারণ না করি?’ রাজ চোখ নামিয়ে বলল, ‘থাক।’
তন্ময় বুঝতে পেরেছিল তার উত্তমা নায়িকা স্বাধীনা নায়িকা। ভালোবাসা না বাসা তার মর্জি। বিবাহ করেছে বলে কর্তব্যবোধ জন্মেছে, কর্তব্যের দাবি মানতে সে রাজি। কিন্তু তাতে তার মর্জির এদিক-ওদিক হয়নি। সে-দিক থেকে সে অবিবাহিতা, অবন্ধনা। কর্তব্য যদি মর্জিকে গ্রাস করতে যায় বিবাহের বেড়া ভাঙতে কতক্ষণ! তন্ময় শিউরে উঠল।