১১. কান্তি ও কান্তিমতী

কান্তি ও কান্তিমতী

ইন্দ্রসভার নর্তক-নর্তকীদেরও নাচতে নাচতে তাল কেটে যায়। ইন্দ্র তাদের শাপ দিয়ে বলেন, ‘যাও, মানুষ হয়ে জন্মাও।’ তখন স্বর্গ হতে বিদায়।

কিন্তু কেন তাল কেটে যায়? কারণ তাদের হৃদয় আছে। ঠিক মানুষের মতো। হৃদয় যদি বশ না থাকে চরণ কী করে বশ মানবে! তখন গন্ধর্বলোক থেকে নরলোকে অবতরণ।

কান্তির জীবনেও এমন এক দিন এল যেদিন তার মনে হল তার নৃত্যের তাল কেটে যাবে। যাবে মীনাক্ষীরও। একঘর দর্শকের সুমুখে অপদস্থ হবে তারা দু-জনে। ধরা পড়বে সমঝদারদের চোখে। একালের ইন্দ্ররাজ তেমন কোনো শাপ দেবেন না, তবু শাপভ্রষ্ট হবে তারা অন্যভাবে। নাটবেদি থেকে অকালে অবসর নেবে। আর নৃত্য করবে না।

মীনাক্ষী যদি অন্যপূর্বা না হত তা হলেও কান্তি তাকে নিয়ে রাসমঞ্চ থেকে প্রস্থান করত না। কান্তির জীবনের পরিকল্পনায় নিত্য রাস। মীনাক্ষী যদি তার সঙ্গে নৃত্যে যোগ দিতে চায় তবে লক্ষ রাখতে হবে যাতে তাল কেটে না যায়। মীনাক্ষীর কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি নেই। সে মর্ত্যসুখী। শাপকেই সে বর মনে করে। সে অপ্সরা নয়, মানবী।

সংকটে পড়ল কান্তি। জনান্তিকে বলল, ‘মীনু, যারা নাচবে তারা ভালোবাসবে না। এই তার অলিখিত শর্ত।’

মীনাক্ষী লজ্জিত হল। বলল, ‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না?’

‘কী জানি! আমার তো আশঙ্কা হয় একদিন তাল কেটে যাবে। তখন নৃত্য থেকে অপসরণ। কী নিয়ে আমি থাকব তার পরে! বিয়ে আমার কুষ্ঠিতে লেখেনি। তা ছাড়া বিয়ে করতে চাইলেও দুস্তর বাধা।’

‘কিন্তু তাল কেটে যাবেই-বা কেন? যদি-বা যায় তবে নৃত্য থেকে অপসরণ কেন? আর যেসব কথা বললে তার প্রশ্নই ওঠে না। ভালোবাসলেই বিয়ে করতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? আমি তো ভাবতেই পারিনে।’

কান্তির এত চিন্তা, কিন্তু মীনাক্ষীর একটুও নেই। তার জীবনে যেন বসন্ত এসেছে। দেখতে দেখতে তার তনুমন পল্লবিত মুকুলিত পুষ্পিত প্রস্ফুটিত হচ্ছে। তাল কেটে যাবে বলে তার পরোয়া নেই। ধরা পড়ার ভয়ে হৃৎকম্প নেই। নাটবেদি থেকে অবসর নিলে তার পরে কী নিয়ে থাকবে এ বিষয়ে হুঁশ নেই। তার জীবনের কোনো পরিকল্পনাই নেই। ফুল ফুটলে ঝরে পড়ে। সেও ঝরে পড়বে যখন বসন্ত ফুরোবে। যখন ভালোবাসা মিটবে।

ওদিকে কান্তির ভিতরে অবিরাম বোঝাপড়া চলছিল। দিনের পর দিন যারা রাধাকৃষ্ণ সেজে নাচবে তাদের দু-জনের সম্বন্ধটা আসলে কীরকম হবে? শুধু মঞ্চের সম্বন্ধ! হৃদয়ের নয়? আত্মার নয়? তারা বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে নিখুঁত আঙ্গিকে অভ্রান্ত পদক্ষেপে নাচবে, কিন্তু নাটবেদির বাইরে বাঁচবে না, ভালোবাসবে না? সেখানে তারা পর? তারা পরকীয়?

নিতান্ত অপরিচিতাকেও যে মাসি পিসি দিদি বলে ডাকে, নেহাত নিঃসম্পর্কীয়ার সঙ্গে যে নানা বিচিত্র সম্পর্ক পাতায়, সেই কান্তি যদি বলে যে মীনাক্ষী তার কেউ নয়, ওর সঙ্গে সে কোনোরকম সম্পর্ক পাতায়নি, তা হলে বন্ধুরা পর্যন্ত অবিশ্বাস করবে। কেন? এই একটিমাত্র মেয়ের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক পাতায়নি কেন? বন্ধুরা শুধোবে।

বন্ধুরা হয়তো বলবে, ভাই-বোন সম্পর্ক কী দোষ করল? ভাই-বোন! কান্তি হেসে উড়িয়ে দেবে। না। ভাই-বোন সম্পর্ক নয়। রাসনৃত্য ভাই-বোনের নয়।

তা হলে স্বামী-স্ত্রী? সর্বনাশ! মীনাক্ষীর যে জলজ্যান্ত স্বামী রয়েছে! না থাকলেও কান্তি ছাদনাতলায় যেত না। না। রাসলীলা স্বামী-স্ত্রীর নয়।

তা হলে সখা-সখী? কান্তি চিন্তা করবে। না। রাসরঙ্গ সখা-সখীর নয়। তাদের জন্যে হোলি। পার্থক্য আছে।

তা হলে আর কী বাকি থাকে?

ভাবতে ভাবতে কান্তাভাব মনে জাগে। কান্ত আর কান্তা।

কান্তি শিউরে উঠে। মানুষের মন মানুষ নিজেই জানে না। জানতে পেলে চমকায়। কান্তি বার বার মাথা নাড়ে। না, না, কান্তাভাব নয়। আমি যে শ্যামলকে কথা দিয়েছি। আমি কি তাকে ধোঁকা দিতে পারি।

সবচেয়ে ভালো কোনোরূপ সম্পর্ক না পাতানো। ইন্দ্রসভার নর্তক-নর্তকীর মতো। ওদের হৃদয়ের বালাই ছিল না। তাই ওদের তালভঙ্গ হত না। কিন্তু মাঝে মাঝে হত বই কী। তার থেকে বোঝা যায় ওরাও একেবারে নিঃসম্পর্কীয় ছিল না। হৃদয়হীন ছিল না।

কান্তি ভেবে দেখল নৃত্য করে কে? অঙ্গ না হৃদয়? হৃদয়ের ভাব ব্যক্ত করার জন্যে বা হৃদয়ের ভাব থেকে মুক্ত হবার জন্যে কেউ লেখে কবিতা, কেউ আঁকে ছবি, কেউ গায় গান। ঘটলই বা ছন্দপতন। সেটাকে এত ভয় কেন? মোটের উপর একটা কিছু সৃষ্টি হয়ে উঠছে। বিশ্বসৃষ্টির মতো।

তা হলে মীনাক্ষীর সঙ্গে নাচলে ক্ষতি কী? ক্ষতি এই যে অন্যের অলক্ষ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হয়তো নিজের অলক্ষ্যে। কান্ত আর কান্তা। শ্যামল ক্ষমা করবে না। শ্যামল যদি ভদ্রতা করে সরে যায় তা হলে মীনাক্ষীকে বিয়ে করার বাধ্যবাধকতা জন্মাবে, নইলে মীনাক্ষী ক্ষমা করবে না। একজনের সঙ্গে নাচতে গেলে যদি অবশেষে তাকে বিয়ে করতে হয় তা হলে তার সঙ্গে নাচতে চাইবে কোন মূঢ়! এ কী সংকট, বলো দেখি!

কান্তি স্থির করল মীনাক্ষীর সঙ্গে আর নাচবে না। একই কারণে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে নাচবে না। নৃত্য বলতে এখন থেকে একক নৃত্য। কিন্তু সে নিজে চাইলে কী হবে, লোকে চায় না তার একার নাচ। তারা চায় রাধাকৃষ্ণের যুগল নৃত্য। হরপার্বতীর যুগ্ম নৃত্য। নর-নারী উভয়ের সংযুক্ত পদক্ষেপ, সুসমঞ্জস পদক্ষেপ।

না, একক নৃত্য জমবে না। কান্তি ভেবে পায় না আর কী সমাধান আছে। আর কী সম্ভবপর! এরূপ স্থলে আগে যা করেছে এবারেও তাই করল। পলায়ন। দৌড়। এক দিন কাউকে কিছু না বলে একরকম একবস্ত্রে বেরিয়ে পড়ল। যেদিকে দু-চোখ যায়।

স্টুডিয়ো আর স্টেজ নিয়ে তন্ময় ছিল। জীবনের দিকে ফিরে তাকাবার ফাঁক পায়নি। যাদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে তারা দর্শক। তারা যেন মানুষের একজোড়া চোখ, গোটা মানুষটা নয়। জীবনের বহমান স্রোতে ঝাঁপ দিয়ে কান্তি সমগ্রতার স্বাদ পায়।

রসের সায়র। প্রতিদিন তাতে ডুব দিয়ে ওঠে আর নতুন হয়ে যায়। যাই দেখে তাই নতুন লাগে। যাকে দেখে সেই তার চোখে নতুন। পরম বিস্ময় নিয়ে কান্তি এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। হাতের কাছে যে কাজ জোটে সে কাজ করে। বাড়ি তৈরি হচ্ছে, রাজমিস্ত্রির সাগরেদ চাই। আচ্ছা, রাজি। কাঠ চেরাই হচ্ছে, করাতির সাথি আসেনি, মদত চাই। আচ্ছা, রাজি। জাহাজ মেরামত হচ্ছে, রং করছে একদল লোক, কান্তি তাদের ওখানে হাজির।

পথে-বিপথে রকমারি মেয়ের সঙ্গে দেখা। কেউ বা কোকেন চালান দেয়, কেউ চোরাই মাল পাচার করে। কেউ পান বেচে, কেউ জাহাজিদের সঙ্গে নিকা বসে। কেউ পরের ছেলে দেখিয়ে ভিখ মাগে। কেউ রং মেখে সং সেজে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের কার সঙ্গে কোন সম্পর্ক পাতাবে কান্তি! মানুষের অভিধানে ক-টাই বা শব্দ আছে! মানুষ আছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

বিয়ের জন্যে কেউ ঝোলাঝুলি করে না। বিয়ের কথা কেউ মুখে আনে না। বিয়ে একটা সমস্যাই নয়। সমস্যা হচ্ছে আত্মিক সম্বন্ধ। আত্মিক সম্বন্ধ স্থির না হলে কায়িক সম্বন্ধ শুরু হতে পারে না। কিন্তু তার আগেই কান্তি উধাও হয়। কাউকেই ধরা-ছোঁয়া দেয় না। কী জানি কী আছে তার ভিতরে নারীকে যা চুম্বকের মতো টানে। কিন্তু ফি বারেই সে আপনাকে ছাড়িয়ে নেয়। সঞ্চারিণীর বন্ধনী এড়ায়।

পূর্বেই তার প্রত্যয় জন্মেছিল একজনের হওয়া মানে আর সবাইকে হারানো। একদিন একজনের হলে আর সব দিন আর সব জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ। ক্রমে তার প্রত্যয় হল মুক্ত থাকতে হলে শুদ্ধ থাকতে হয়। কে কতটা মুক্ত সেটা নির্ভর করে কে কতটা শুদ্ধ তার উপর। তা বলে জীবনের ধূলিকাদা থেকে সন্তর্পণে সরে থাকার নাম শুদ্ধি নয়।

এতকাল যত্ন করে সে নৃত্য শিখেছিল। কিন্তু জীবনের সঙ্গে তার যোগ ছিল না। রসের দীক্ষা তার হয়নি। এই বার ঘুরতে ঘুরতে তার রসের দীক্ষা হল। যার কাছে হল সে এক রঙ্গিণী নারী। ছইলা গোপিনী।

ছইলা তাকে শেখাল কেমন করে গাই দুইতে হয়, কেমন করে চিড়ে কোটে, মুড়ি ভাজে, কেমন করে ঘুঁটে দেয়, ঘর নিকোয়। সারাদিন একটা না একটা কাজে হাত জোড়া থাকে ছইলার। তার সঙ্গে বসে গল্প করতে হলে তার হাতের কাজে হাত লাগাতে হয়। প্রথম প্রথম কান্তির লজ্জা করত। এসব যে মেয়েলি কাজ। কে কী মনে করবে! বলবে, বা রে পুরুষ! কিন্তু ধীরে ধীরে তার গায়ের চামড়া মোটা হল। কে কী বলে তার গায়ে বাজে না। সে মুচকি হাসে। আর কাজে মন দেয়। ছইলার কাজ হালকা করাই তার কাজ।

কয়েক মাস কাটলে পরে ছইলা বলল, ‘ঠাকুরপো, তুমি যে এত কিছু করলে, বলো দেখি আমার কাছ থেকে কী পেলে।’

কান্তি বলল, ‘সেকালের শিষ্যরা ঋষিদের গোরু বাছুর চরিয়ে যা পেত তাই। ব্রহ্মবিদ্যা। ঠিক ব্রহ্মবিদ্যা নয়, তার কাছাকাছি। আত্মবিদ্যা।’

জ্যোৎস্নারাত্রে পাশাপাশি বসেছিল তারা, নদীর জলে পা ডুবিয়ে। কে দেখল, না দেখল, ভ্রূক্ষেপ নেই।

‘বউদি’, কান্তি বলল ইতস্তত করে, ‘তোমার সঙ্গে থেকে আমি কী শিখেছি, বলব?’

‘বলো।’

‘শিখেছি, আমি পুরুষ নই।’

‘ওমা, তবে তুমি কী?’

‘আমি না-পুরুষ।’

ছইলা হেসে আকুল। বলল, ‘আর আমি?’

‘তুমি? তুমি নারী নও।’

‘নারী নই? ঠিক জান?’

‘তুমি না-নারী।’

ছইলা হাসতে হাসতে দম আটকে মারা যাবে মনে হল। হাসির চোটে জল এল চোখে। মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘প্রথম ভাগ শেষ করেছ। এখন আর কিছু দিন থেকে যাও।’

এরপরের কয়েক মাস ওরা দুধ দই বেচতে হাটে-বাজারে পসরা মাথায় বাঁক কাঁধে ঘুরে বেড়াল। লজ্জায় কান্তির মাথা কাটা যায়। লোকের চোখে চোখে টরেটক্কা। ছইলার কী! সে তো সংসারের বাইর। তা ছাড়া সে মধ্যবয়সিনী। খেলবার বয়স নয়। খেলাবার বয়স।

‘আর কিছু পেলে, ঠাকুরপো!’ ছইলা শুধোয় তারায় ভরা আকাশের তলে।

‘পেয়েছি, বউদি।’ কান্তি বলে আত্মস্থ হয়ে। ‘আমি পুরুষ নই, কিন্তু আমার পুরুষভাব।’

‘আর আমি?’

‘তুমি নারী নও, কিন্তু তোমার নারীভাব।’

এবার ছইলা হাসল না। তার চোখে জল এল কি না আঁধারে দেখা গেল না। স্নিগ্ধস্বরে বলল, ‘আর কিছু দিন থেকে গেলে হয় না?’

‘কেন?’ এবার রহস্য করল কান্তি। ‘তৃতীয় ভাগ পড়তে হবে?’

ছইলা উত্তর দিল না। কান্তি যাবার জন্যে ছটফট করছিল। সে নাচিয়ে মানুষ। কত কাল নাচ ছেড়ে থাকতে পারে! তবু তাকে থাকতেই হল। কালিদাসকেও থাকতে হয়েছিল বিদ্যানগরের গয়লানির ঘরে রসের পাঠ নিতে। কান্তির বিদ্যানগর উৎকলে।

ছইলার সঙ্গে গোরুর গাড়িতে করে গেল কুটুমবাড়ি, নৌকায় করে গেল মেলায়। পরের ঘরে হল ঘরের লোক। গাছতলার আস্তানায় আপনজন। মানুষের বুকে কত যে মধু, তার স্বাদ নিল। দু-দিনের চেনা। মনে হয় জন্মজন্মান্তরের। পাঁজির হিসাবে দু-টিমাত্র দিন। হৃদয়ের হিসাবে চিরদিন। কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না, বিদায় নিতে গেলে কেঁদে ভাসায়।

মধু, মধু, মধু। মানুষ মধু, পৃথিবী মধু, মধুময় পৃথিবীর ধূলি।

মাস কয়েক পরে ছইলা বলল, ‘আর কিছু পেলে কি?’

কান্তি বলল, ‘পেয়েছি, পেয়েছি।’

‘কী পেয়েছ?’

‘রস’।

ছইলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে নীরবে শুনে যেতে থাকল, কান্তি বলে যেতে লাগল, ‘বন্ধনের ভয়ে কখনো কারো সঙ্গে রসের সম্পর্ক পাতাইনি। রসের সম্পর্ক আপনা থেকে পাতা হচ্ছে দেখে দৌড় দিয়েছি। এখন আমার ভয় ভেঙে গেছে।’

‘কী করে ভাঙল?’

‘তোমার সঙ্গে থেকে। তুমি নারী নও। অথচ তোমার সত্তা নারীসত্তা। আমিও পুরুষ নই। অথচ আমার সত্তা পুরুষসত্তা। তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ তোমার সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক।’

কান্তির প্রয়োজন শেষ হয়েছিল, সে তার সমস্যার সমাধান পেয়েছিল। এবার সে ফিরে যাবে, ফিরে গিয়ে নাচের দল গড়বে, নাচবে, নাচাবে, ভয় পাবে না, ভয়ের কারণ হবে না। মীনাক্ষী যদি তার নৃত্যসহচরী হয় তবে ওর সঙ্গে তার সম্পর্ক হবে বিশুদ্ধ রসের। সে সম্পর্ক হৃদয়কে বাদ দিয়ে নয়, হৃদয়ই তো রসের মধুচক্র। কিন্তু নারীকে বাদ দিয়ে। পুরুষকে বাদ দিয়ে। অথচ নারীসত্তাকে রেখে, পুরুষসত্তাকে রেখে।

ছইলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কান্তি কলকাতা গেল। যা ভেবেছিল তাই। দলের অস্তিত্ব নেই। নতুন করে গড়তে হবে। কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, আবার খুঁজে পেতে ধরে আনতে হবে। মীনাক্ষীর খোঁজ নিয়ে জানতে পেল সে ঘর-সংসার করছে, সুখে আছে। আর নাচবে না। তার স্বামীরও আর উৎসাহ নেই। সে পলিটিক্সে নেমেছে।

ইতিমধ্যে দিন বদলে গেছে। নয়া জমানার দর্শকরা কলকারখানার ছোঁয়াচ চায়, কিষান মজদুর কী করে না করে ওরা তা খেতেখামারে দেখবে না, নাটবেদীতে দেখবে। কান্তিও তো কিছুদিন রাজমিস্ত্রি, করাতি, রং মিস্ত্রি হয়েছে, গোরুর খুরে নাল বসিয়েছে, বাঁক কাঁধে করে হাটে গেছে। এসব অভিজ্ঞতা নৃত্যে রূপান্তরিত করা নিয়ে তার মনে ভাবনা জেগেছিল। কল্পনা তার উপর রং ফলাতে শুরু করেছিল। নতুন ধরনের নাচ দিয়ে সে দেশের লোকের মনোহরণ তা করবেই, দুঃখীদের দুঃখমোচনও করবে। তামাশা নয়। গান দিয়ে সেকালের গুণীরা আকাশ থেকে বর্ষা নামাতেন। অনাবৃষ্টির দিন গাইয়েরাই ছিলেন মানুষের শেষ আশা। একালের নাচিয়েরাই বোধ হয় মানুষের শেষ ভরসা।

কান্তির দল বরফের গোলার মতো দিন দিন বেড়ে চলল। করাত নৃত্য, বাঁক নৃত্য ইত্যাদি আনকোরা নাচ দর্শকদেরও টেনে আনল। একজন ক্যাপিটালিস্ট মুগ্ধ হয়ে ধনসম্পদ উৎসর্গ করলেন। তবে ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনিই হলেন। অনুতাপে বিনম্র হয়ে ধনিক পরিবারের কন্যারাও মজুরনি কিষানি সাজতে এগিয়ে এলেন। নয়া জমানা। সেকালের যাত্রায় হাড়িডোমের উচ্চাভিলাষ ছিল রাজা মন্ত্রী সাজতে। একালের ফিলমে উঁচু ঘরানাদের সাধ অচ্ছুৎ-কন্যা সাজতে।

ভারতের পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ প্রদক্ষিণ করে কান্তির দল অশ্বমেধ ঘোড়ার মতো ইউরোপের দিকে পা বাড়াল। তাদের জাহাজ যেদিন মুম্বাই ছাড়বে সেদিন হঠাৎ চার বন্ধুর পুনর্মিলন। অনুত্তম, কান্তি, তন্ময়, সুজন। রূপকথার চার কুমার।

সাফল্যের নেশায় কান্তির মাথা ঘুরে গেছিল। তা হলেও কোনোদিন সে ভুলে যায়নি যে সে কান্তিমতী রাজকন্যার অন্বেষণে বেরিয়েছে, যে রাজকন্যা তার হাতের কাছে, অথচ নাগালের বাইরে। অন্তরে অন্তরে তার ব্যথা জমছিল। বাইরে যদিও অন্তহীন ফুর্তি।

কেন ব্যথা? কারণ তার নৃত্যসহচরী হবার জন্যে আজকাল দস্তুরমতো প্রতিযোগিতা। তাই সবাইকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্যে সে সকলের সঙ্গে নাচে। গোপী সকলেই। রাধা কেউ নয়। রসের সম্পর্ক পাতিয়ে এক সমস্যার সমাধান হল, কিন্তু আরেক সমস্যা নতুন করে দেখা দিল। সে তো কৃষ্ণের মতো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নয় যে একই সময়ে দশটি গোপীর সঙ্গে রাসনৃত্য করতে পারবে। দশটির মধ্যে একটির সঙ্গেই সে তা পারে। কিন্তু তা হলে একজনকে প্রাধান্য দিতে হয়। মীনাক্ষীর স্থান দিতে হয়।

সাফল্যের দিনে অত বড়ো একটা ঝুঁকি নিতে তার সাহসে কুলোয় না। আছে একটি মেয়ে তার নজরে। খুবই অল্পবয়সী। কুমারী। কিন্তু রত্নাকে সে যদি রাধার সম্মান দেয় গোপীরা তাকে ক্ষমা করবে না। দলে ভাঙন ধরবে। তা না হয় হল। কিন্তু রত্না নিজেই স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করবে সম্পর্কটাকে অক্ষয় করবার জন্যে। নাটবেদিতে তো বটেই, বিবাহবেদিতেও। শেষকালে ওই রত্নাকেই কেন্দ্র করে ঘুরবে তার জীবন, তার জীবিকা, তার শিল্প, তার দল। ওই রত্নাই হবে তার দলের একমাত্র সম্বল। মুথুলক্ষ্মী, খুরশিদ, ফিরোজা, ইন্দিরা, হানসা—এরা কি থাকবে!

বিয়ে যখন করবেই না তখন রত্নাকে রাধার ভূমিকা না দেওয়াই ভালো। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এড়াতেই হবে। নীড় রচনার স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যাক। রত্না শিখুক আকাশে উড়তে, আকাশেই বিশ্রাম করতে। তা যদি না পারে তবে অন্য কাউকে বিয়ে করুক। কান্তিকে নয়।

কিন্তু একথা ভাবতেও যে তার কষ্ট হচ্ছিল না তা নয়। রত্না এক দিন বড়ো হবে, তার বাপ মা তার বিয়ে দেবেন, তার মতো সুন্দর মেয়ের জন্যে পাত্রের অভাব হবে না। দূর হোক অপ্রীতিকর ভাবনা। আপাতত ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে আসা যাক। দিগবিজয়ীর মতো।

মুম্বই-এর কয়েকটা ঘণ্টা বন্ধুদের সঙ্গে খেয়ে গল্প করে ফোটো তুলিয়ে কেটে গেল। ভাব বিনিময়ের জন্যে সময় ছিল না। উপাখ্যান বলার জন্যে তো নয়ই। জাহাজ ধরতে হবে। এক-শো রকমের খুঁটিনাটি। মনটা ভারী হয়ে রয়েছে সুমতির জন্যে। সেও চেয়েছিল সহযাত্রিণী হতে। তার তুলোর ব্যাপারী স্বামী বাদ সাধলেন। তবে মনটা খুশ আছে আরেকটা খোশ খবরে। প্যারিসের বিখ্যাত নর্তকী ইভেৎ তার দলে যোগ দিতে উৎসুক।

জাহাজ ছাড়বে, জাহাজ থেকে নেমে যাবার সময় সুজন বলল, ‘প্যারিসে হয়তো সোনিয়ার সঙ্গে দেখা হবে। তাকে লিখব তোর কথা।’

কান্তি বলল, ‘বেশ, বেশ। যদিও জানিনে কে তিনি। আহা! শোনা হল না তোর কাহিনি! তন্ময়েরটা মোটামুটি শুনেছি। আর অনুত্তম, তোরটাও শোনা হল না। সুজন তবু হেডলাইনটা শুনিয়ে রেখেছে। সোনিয়ার নাম করে। তুই কিন্তু একটুখানি আভাস পর্যন্ত দিসনি।’

ওইখান দিয়ে চলাফেরা করছিল রত্না। কান্তি তার গলা জড়িয়ে ধরল এক হাতে। অমনি মনে হল দলের লোক ঠাওরাবে সে অপক্ষপাত নয়। তখন আরেক হাত বাড়িয়ে দিল ফিরোজার কাঁধে। নিজের অপক্ষপাতিতায় নিজেই তৃপ্ত হয়ে সে তার বন্ধুদের বলল, ‘পুনর্দর্শনায় চ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *