০৮. তন্ময় ও রূপমতী

তন্ময় ও রূপমতী

বিয়ের দিনটা নিছক আনন্দের দিন। তন্ময় কিন্তু সে-দিন অবিমিশ্র আনন্দ বোধ করেনি। বাসররাত্রি জেগে কাটিয়েছে অপলক দৃষ্টিতে। তার বধূর দিকে চেয়ে। তার ঘুমন্ত রাজকন্যার দিকে। যে রাজকন্যা তার ঘরে, তার শয্যায়, তার বাহু উপাধানে, তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিঃশ্বাস মিশিয়ে প্রথম আত্মসমর্পণের পর পরম নির্ভরতার সঙ্গে প্রষুপ্ত।

পরিপূর্ণ সৌন্দর্য। রমণীয় রূপ। বিকশিত যৌবন। সদ্য প্রস্ফুটিত সুগন্ধ। তনুসুরভি। এ কি কখনো স্থির থাকতে পারে একরজনীর বাহুবন্ধনে! এ চলবে। এর পিছন পিছন চলতে হবে তন্ময়কেও। অনুসরণই অন্বেষণ। অন্বেষণে ক্লান্তি এলে ক্ষান্তি দিলে রূপমতী চলে যাবে দৃষ্টির আড়ালে। দাঁড়াবে না, পায়চারি করবে না, ফিরে আসবে না। তা হলে আমার সুখ! —তন্ময় ভাবে।

সুখের জন্যে বিয়ে করতে হলে করতে হয় তাকে যে থাকতে এসেছে। যে স্থির থাকবে। কিন্তু সে তো রূপমতী নয়। তার সঙ্গে ঘর করে সুখী হওয়া যায়, কিন্তু এর সঙ্গে নিঃশ্বাস নিয়ে স্বর্গ ছুঁয়ে আসা যায়। ধন্য হয়েছি আমি, ধন্য একে পেয়ে। —তন্ময় ভাবে। কিন্তু কতক্ষণের জন্যে! এখন থেকে মিনিট গুনতে, ঘণ্টা গুনতে, দিন গুনতে হবে। গুনতে হবে সপ্তাহ আর মাস। বছর পুরবে কি না কে বলতে পারে! হ্যাঁ, বছর পুরবে, বছরের পর বছর পুরবে, তন্ময় যদি ক্লান্ত না হয়; ক্ষান্ত না হয়। হ্যাঁ, আয়ুষ্কালও পুরবে তন্ময় যদি জীবনভর অনুসরণ করে, অন্বেষণ করে।

কিন্তু সুখ! সুখ কই তাতে? সেই অন্তহীন অনুকরণে? মন চায় স্থিতি। পরমা নিশ্চিতি। দেহ চায় বিশ্রাম। সবিশ্রাম সম্ভোগ। অনুসরণের জন্যে প্রতিনিয়ত প্রস্তুত কে? আত্মা? আত্মারও কি শান্তির আকিঞ্চন নেই? সেও কি একদিন বিনতি করবে না, রূপমতী, দৃষ্টির আড়ালে চলে যেয়ো না, দাঁড়াও? রাজা সংবরণের মতো সূর্যকন্যাকে বলবে না, তপতি, আমি যে আর ছুটতে পারছিনে, থামো।

রাজ, প্রিয় রাজ, তুমি যদি দয়া করে ধরা না দাও আমার সাধ্য কী যে আমি তোমায় ধরি! এই যে তুমি ধরা দিয়েছ এ কি আমার সাধনায়! এ তোমার করুণায়। আমার সুখ আমার হাতে নয়। তোমার হাতে। —তন্ময় ভাবে। এক চোখে আনন্দ এক চোখে বিষাদ নিয়ে দু-চোখ ভরে দেখে। আহা, এই রাতটি যদি অশেষ হত, যদি কোনো মায়াবীর মায়াদন্ডের ছোঁওয়া লেগে অ-পোহান হত, যদি হাজার বছর কোথা দিয়ে কেটে যেত কেউ হিসাব না রাখত, তা হলে রূপ আর সুখ একে অপরকে ঘরছাড়া করত না, এক সঙ্গে বাস করত অনন্তকাল। এক বৃন্তে ফুটে থাকত রূপমতী নারী আর সুখীতম পুরুষ। কোনোদিন ঝরে পড়ত না।

রূপমতী নারী। চিরন্তনী নারী। এই নারীতে আছে সেই নারী। এ যদি একটি রাতও থাকে, তার পরে না থাকে, তা হলেও চিরন্তনের চিহ্ন রেখে যাবে তন্ময়ের জীবনে। পরশ-পাথরের পরশ লেগে সোনা হয়ে যাবে তার অঙ্গ। সোনা হয়ে যাবে তার মন। তন্ময়ের এক রাত্রের অভিজ্ঞতা সারাজীবনের রূপান্তর ঘটাবে। পরবর্তী জীবন অন্যরূপ হবে। তাতে সুখ থাকবে না ঠিক, রূপমতী কোলে না থাকলে সুখ কোথায়, নিত্য অনুসরণে সুখ থাকতে পারে না। তবু সে ধন্য, সে সার্থক, সে অসাধারণ ও অসামান্য। তন্ময় তার বিয়ের রাতটিকে তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে। এক জীবনে এমন রাত্রি দু-বার আসে না। কাল বেঁচে থাকবে কি না তাই-বা কেমন করে জানবে!

বাসরের পরে মধুমাস। মধুমাস যেন ফুরোতে চায় না। দু-জনে দু-জনের মুখে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়ে কখন একসময়। উঠে দেখে বেলা হয়ে গেছে। মুখোমুখি বসে কফি খায়। তারপর যে-যার সাজপোশাক পরতে যায়। দিনের বেলা তাদের ছাড়াছাড়ির পরে আবার মিলজুল হয়। প্রথম আবিষ্কারের পুলক নিয়ে তারা পরস্পরের দিকে তাকায়।

‘তন্ময়। তন্ময়। কোথায় তুমি? এসো আমার কাছে।’

‘রাজ। রাজ। এই যে তুমি। কত কাল পরে তোমায় দেখছি।’

‘কেন? কত কাল কেন? এখনও তো একঘণ্টা হয়নি।’

‘তোমার ঘড়িতে এক ঘণ্টা। আমার ঘড়িতে এক হাজার ঘণ্টা।’

‘ও ডারলিং!’

‘ও ডিয়ার!’

মধুমাসটা ফ্রান্সে কাটিয়ে ওরা ইংল্যাণ্ড যায়। চাকরির চেষ্টায় একটু বেশি ছাড়াছাড়ি হয়, একটু কম মিলজুল। তাতে রাতগুলি আরও মধুর হয়। ঘুম পথ ছেড়ে দেয় চুম-কে। কাজ জুটল। ফিরল ওরা স্বদেশে। ঘর বাঁধল পুনায়। সংসার শুরু হল। মধু, মধু, সব মধু। ধোপার খাতা, গয়লার হিসাব, দরজির মাপ, তাসখেলার দেনা—মধু, মধু, সব মধু।

প্রথম বছরটা ওরা এমনি করে কাটিয়ে দেয় নিজেদের নিয়ে। মাটিতে পা পড়ে না। তন্ময় এমনিতেই বেশ সুপুরুষ। রাজের সঙ্গে যখন সে বেরোয় তখন তাকে আরও সুদর্শন দেখায়। টেনিস খেলতে যখন সে নামে তখন ভিড় দাঁড়িয়ে যায় তাকে দেখতে। তার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে এগিয়ে আসেন রাজারাজড়া সাহেবসুবো, হাত বাড়িয়ে দেন তাঁদের মহিলারা। আর রাজ তো সমাজের আলো। পার্টির প্রাণ। সে না থাকলে উৎসবের উৎসাহ নিবে যায়। ক্লাবে, মেসে, লাটভবনে, রেসকোর্সে রাজ একটি অনুপম আকর্ষণ।

তারপরে কবে কেমন করে মনোমালিন্য সঞ্চার হল। পূর্ণিমার আকাশে ছোটো এক টুকরো কালো মেঘ। রূপমতী তার রূপচর্যা নিয়ে থাকে, রূপচর্যার পরের অধ্যায় সামাজিকতা। সংসারের প্রতি নজর নেই। স্বামীর প্রতি নজর থাকলেও সেটা তেমন আন্তরিক নয়। সেটা যেন একটা কর্তব্য করে যাওয়া। তন্ময় বুঝতে পারে পার্থক্য। দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে আর ভাবে, বিশ্বের হাত থেকে ওকে ছিনিয়ে রাখতে পারব সে ক্ষমতা কি আমার আছে! বল কষাকষি করতে গেলে দেখব আমি অবল।

তন্ময়ের অধিকার একে একে খর্ব হল। যখন-তখন গায়ে হাত দিতে পারবে না। বুকে হাত দেওয়া একেবারে বারণ। দু-জনের দুটো আলাদা বিছানা। এক বিছানা থেকে আরেক বিছানায় যেতে অনুমতি লাগে। রূপমতী সকাল সকাল শুতে যায়, যদি না কোনো নিমন্ত্রণ আমন্ত্রণ থাকে। ঘুমের মাঝখানে তাকে বিরক্ত করা চলবে না। তার নিদ্রা নিয়মিত, তার আহার পরিমিত, তার ব্যায়াম দৈনন্দিন, তার স্নান ও প্রসাধন অন্তহীন। তার গড়ন, তার ডৌল, তার সুমিতি, তার সৌষ্ঠব তার কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন। তন্ময়ের যেমন চাকরি বজায় রাখা রূপমতীর তেমনি রূপলাবণ্য অটুট রাখা। সতীর সম্বল যেমন সতীত্ব, গায়িকার সম্বল যেমন গীতসিদ্ধি, রূপসির সম্বল তেমনি রূপ। লবণ যেমন লবণত্ব হারালে কোনো কাজে লাগে না, লাবণ্যবতী তেমনি লাবণ্য হারালে কারও কাছে আদর পায় না। সমাজের কাছে তো নয়ই, স্বামীর কাছেও না। তখন তার দর ভূষিমাল হিসেবে। গিন্নিবান্নি বলে। তখন ধারে কাটে না, ভারে কাটে।

তারপর তন্ময় বুঝতে পারল রাজ কোনোদিন মা হবে না। মা হলে তার ফিগার খারাপ হয়ে যাবে। তা হলে সে আর রূপমতী থাকবে না। তন্ময় কি তখন তাকে পুঁছবে! পুরুষের ভালোবাসা রূপটুকুর জন্যে। রূপটুকু গেল তো ভ্রমর উড়ল। কথাটা স্পষ্ট করে খুলে না বললেও রাজ যা বলে তার ও ছাড়া আর কোনো অর্থ হয় না। তন্ময় অবশ্য অকালে বাপ হবার জন্যে লালায়িত নয়, কিন্তু কস্মিনকালে হবে না এ তো বড়ো বিষম কথা। অপত্যকামনা কোন পুরুষের নেই! কোন নারীর!

এমনি করে তাদের দু-জনের মধ্যে মনোমালিন্যের সূচনা হল; কিন্তু তন্ময় এ নিয়ে একটি কথাও বলল না। সংসারে নজর নেই তো কী হয়েছে! এতগুলো চাকর রয়েছে কী করতে! তারাই চালিয়ে নেবে। স্বামীর প্রতি নজর আন্তরিক নয় তো কী হয়েছে! স্বামী কি নিজের দেখাশোনা নিজে করতে পারে না! আর সন্তান যদি না হয় তা হলেই-বা কী এমন দুর্ভাগ্য! এই তো অমুক অমুক নিঃসন্তান। রোজ ওদের সঙ্গে দেখা হয়। কই, দেখে তো মনে হয় না খুব অসুখী। সন্তান হলে মশাই অনেক ঝামেলা। বাঁচিয়ে রাখো রে, মানুষ করো রে, সম্পত্তি দিয়ে যাও রে। কোথায় এত তালুক বা মুলুক! রোজগারের টাকা তো মাসকাবারের আগে হাওয়া হয়ে যায়। ও ভালোই হয়েছে। ছেলে হয়নি বা হবে না। তবু যদি হত!

হায় রে সুখের আশা! স্বামী স্ত্রী সন্তান নিয়ে একটি সম্পূর্ণ পরিবার। অল্পে সন্তুষ্ট একটি স্বাভাবিক জীবন। অথচ রূপমতী নারীর চিরনূতন সঙ্গ। চিরন্তনী নারীর রূপময় প্রকাশ। দু-দিক রক্ষা হয় কী করে? তন্ময় চায় সুখ এবং রূপ এক বৃন্তে দুই ফুল। শুধু রূপ নিয়ে সে সুখী হবে না। শুধু সুখ নিয়ে থাকতে চাইলে রূপ চলে যাবে। তার সদা শঙ্কা, গঙ্গা যেমন চলে গেল শান্তনুকে ফেলে রাজ তেমনি চলে যাবে তন্ময়কে ছেড়ে, যদি একটি কথা বলে তন্ময়। গঙ্গা তার সন্তানকে নদীর জলে বিসর্জন দিয়েছিল। রাজ তার সন্তানকে গর্ভে আসতে দিল না।

রূপমতীর সৃষ্টি কারও সুখের জন্যে নয়। তন্ময় বলে একজন মানুষকে সুখ বলে একটা পদার্থ দেবার জন্যে সে পৃথিবীতে আসেনি। সে এসেছে অলোকসামান্য রূপ নিয়ে সর্বমানবের সৌন্দর্যতৃষা শীতল করতে। তন্ময়ের প্রতি তার অসীম অনুগ্রহ বলে সে তার ঘরনি হয়েছে। থাকুক যত দিন আছে। —ভাবে আর কাঁদে তন্ময়। কাঁদে। হ্যাঁ, পুরুষের মতো পুরুষ বলে যার প্রসিদ্ধি সেই বিখ্যাত খেলোয়াড় মনের দুঃখে চোখের জল ঝরায়। কেউ দেখতে পায় না। ওদিকে তার মাথার চুলে সাদা নিশান ওড়ে।

জীবনদেবতার কাছে এমন কী বেশি প্রার্থনা করেছে তন্ময়? কেন তা হলে তার কপালে সুখ নেই?—সে নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয়, যাদের তিনি সুখ দিয়েছেন তাদের কেউ কি পেয়েছে উত্তমা নায়িকার সঙ্গ? কেউ কি পেয়েছে রূপমতী নারীর স্পর্শ? তারপর সুখ? সুখ কাকে বলে! এই যে ওরা দু-টিতে মিলে একসঙ্গে আছে, দু-জনেই নিঃসন্তান, দু-জনেই সংসারবিরাগী, এও কি সুখ নয়? স্বার্থপরের মতো জনক হতে চাও তুমি, আরেক জন যে বন্ধ্যা হল, তার বেলা? তোমার চিহ্ন থাকবে না, তারও কি থাকবে? আহা, যদি একটি মেয়ে হত! এমনি রূপবতী।

মোট কথা, কেবলমাত্র রূপ নিয়ে তন্ময় তৃপ্ত নয়। সে চায় সুখ। জীবনমোহন তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, সে তা মনে রেখেছে, তবু তার মন মানে না। এটা সে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে যায় স্ত্রীর কাছে। রাজ জানে সবই, বোঝে তন্ময় কী পেলে তৃপ্ত হয়। কিন্তু তারও তো স্বধর্ম আছে। সৌন্দর্যের কাছে সুন্দরী নারীর দায়িত্ব কি প্রতিভার কাছে প্রতিভাবানের দায়িত্বের মতো নয়? সেই সর্বগ্রাসী দায়িত্বের খর্পর থেকে যেটুকু ব্যক্তিগত সুখ উদ্ধার করা যায় সেটুকু কি সে তন্ময়ের সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করছে না? সে কি নিজের জন্যে অতিরিক্ত সুখ দাবি করছে? জগতে রূপের চেয়ে চপল আর কী আছে? যা প্রতি মুহূর্তে পালিয়ে যাচ্ছে তাকে প্রতি মুহূর্তে ধরে রাখা কি সবচেয়ে কঠিন নয়? রূপের সাধনায় লেশমাত্র অবহেলা সয় না, পরে হাজার মাথা খুঁড়লেও হারানো রূপ ফিরে আসবে না। রাজ এই নিয়ে বিব্রত ও বিমনা। তন্ময় যেন তাকে ভুল বুঝে দুঃখ না পায়, দুঃখের ভাগী না করে। সন্তান! সন্তান কি সকলের হয়? আর কারো সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকলে কি সন্তান নিশ্চিত হত? অতটা নিশ্চিত যদি তো করো আর কাউকে বিয়ে, ছেড়ে দাও আমাকে। —রাজ বলে আভাসে ইঙ্গিতে। টুকরো কথায়।

তবু তো তারা একসঙ্গে ছিল। কিন্তু ক্রমে দেখা গেল রাজের মন পুনরায় টিকছে না। সুযোগ পেলেই সে মুম্বই বেড়াতে যায়, রাত কাটিয়ে ফেরে বান্ধবীদের বাড়িতে। বলে, ‘তোমাকে একা ফেলে যেতে কি আমার মন চায়? কিন্তু আমি জানি তোমার যা কাজ তার থেকে তোমাকে টেনে বার করা যায় না। তা বলে কি আমি একটু তাজা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারব না? এই পচা হাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যাব?’

তন্ময় একটা বদলির দরখাস্ত করে দিল। তাতে কোনো ফল হল না। তার পরে করল লম্বা ছুটির দরখাস্ত। স্ত্রীকে নিয়ে ইউরোপে যাবার জন্যে। লম্বা ছুটি মঞ্জুর হল না। কদাচ এক-আধ দিন খুচরো ছুটি মেলে। তখন মুম্বই যায় দু-জনে। কিংবা তন্ময় থাকে পুনায়, রাজ যায় মুম্বই। গৃহিণী অনুপস্থিত থাকলে গৃহ বলে একটা কিছু থাকে যদিও, তবু তাকে গৃহ বলা চলে না। কারই বা ভালো লাগে তেমন গৃহে একা দিনপাত করতে! দিন যদি-বা কাটে রাত কাটতে চায় না। একা শোওয়ার অভ্যাস তার বহু দিন থেকে। সে-জন্যে নয়। কিন্তু কাছাকাছি আর একজন যে নেই—যে উত্তমা নায়িকা, যার অস্তিত্ব তাকে পরমা তৃপ্তি দেয়, যেমন দেয় তার খোঁপার ফুলের গন্ধ। নেই, নেই, সব শূন্য।

যে থাকবে না তাকে ধরে রাখবে কোন মন্ত্রবলে? বিয়ের মন্ত্রে? বেঁধে রাখবে কোন বন্ধনে? সংসার বন্ধনে? অসহায় তন্ময়! এমন কাউকে জানে না যার কাছে বুদ্ধি ধার করতে পারে। জীবনমোহন যদি থাকতেন। কিন্তু বহু দিন তাঁর কোনো খোঁজখবর নেই। অনুত্তম, সুজন, কান্তি যে-যার নিজের ধান্দা নিয়ে কে কোথায় আছে। কারও সঙ্গে কারো যোগাযোগ নেই। একজনের সমস্যা আরেক জনের দুর্বোধ্য। তন্ময়ের সমস্যা তো এই যে সে তার রূপমতীর অনুসরণে মুম্বই যেতে পারছে না। যেতে হলে চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়। তার পরে সংসার চলবে কী উপায়ে?

মুম্বই-এর বড়োলোকদের তন্ময় বলত বোম্বেটে। বোম্বেটেরা তার বউকে লুট করে নেবে, এ আশঙ্কা তার অবচেতনায় ছিল। লুট অবশ্য গায়ের জোরে নয়। দৌলতের জোরে, দহরম মহরমের জোরে। কোনোদিন কিন্তু কল্পনা করেনি যে রাজ অভিনয় করতে জানে। একটা শখের অভিনয়ে তাকে নামতে দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে যায়। শহরময় ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। সে নিজে অতটা প্রত্যাশা করেনি। তার বান্ধবীরাও করেনি। আর একটা শখের অভিনয়ের মহড়া চলেছে এমন সময় এক হিন্দি ফিলম কোম্পানি থেকে প্রস্তাব এল রাজ যদি নায়িকা সাজে তা হলে কোম্পানি তার সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি। হোটেলের সুইট তারাই জোগাবে। বিল তারাই মেটাবে। তাদের মোটর থাকবে চব্বিশ ঘণ্টা মোতায়েন। এ ছাড়া মাসে দু-হাজার টাকা হাতখরচা।

তন্ময়ের অনুমতি না নিয়ে রাজ চুক্তি করতে নারাজ। তন্ময় বলল, ‘তুমি যা ভালো মনে করবে তা করবে। আমি কি কোনোদিন কিছু বলেছি যে আজ বলব?’

‘না, না, তুমি বলবে বই কী। তুমি যদি বারণ কর আমি যাব না।’

‘আমি যদি বারণ না করি?’ তন্ময় বলল চোখে চোখ রেখে।

রাজ চোখ নামিয়ে বলল, ‘থাক।’

তন্ময় বুঝতে পেরেছিল রাজ ক্রমেই তার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। তাকে দাঁড়াতে বললে সে দাঁড়াবে না, থামতে বললে সে থামবে না, ফিরতে বললে সে ফিরবে না। একমাত্র পন্থা তার পিছু পিছু যাওয়া, তাকে সব প্রলোভন থেকে রক্ষা করা, সব সম্মোহন থেকে উদ্ধার করা। কিন্তু তা হলে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। তারপরে কী করে চালাবে? স্ত্রীর হোটেলের সুইটে স্ত্রীর পোষ্য হয়ে কাটাবে? না স্ত্রীর সুপারিশে কোম্পানির পোষ্য? কিছুদিন পরে যখন চুক্তির মেয়াদ ফুরোবে তখন কি রাস্তায় দাঁড়াবে?

অনুসরণ করতে হলে যতটা ঝুঁকি নিতে হয় ততটা ঝুঁকি নিতে বিয়ের আগে সে তৈরি ছিল, বিয়ের পরে তৈরি নয় দেখা গেল। এখন সে একজন মান্যগণ্য ভদ্রলোক, দস্তুরমতো পদস্থ সরকারি কর্মচারী। টেনিসের কল্যাণে স্বয়ং লাটসাহেবের প্রিয়পাত্র। মাঝে মাঝে তার ডাক পড়ে লাটসাহেবের সঙ্গে খেলতে। যখন তিনি পুনায় থাকেন। পুরুষ তার পৌরুষ বিসর্জন দিয়ে স্ত্রীর অনুগত হয়ে জীবনপাত করবে? রূপমতী রাজকন্যার এই কি শর্ত? তাঁর কাঁদতে ইচ্ছা করে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেও। দেখতে ইয়া জোয়ান আসলে একটি অসহায় শিশু।

মাথার উপর সাদা নিশান উড়ল। তন্ময় তার স্ত্রীর সম্মানে মস্ত একটা পার্টি দিয়ে নিজের পরাভব উৎসবময় করল। অভিভূত দয়িতাকে বলল, ‘রাজ, রাজার মতো জয়যাত্রায় যাও।’

রাজ বুঝতে পেরেছিল এটা তার বিদায় সংবর্ধনা। তন্ময়ের কষ্ট দেখে তার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু যে শক্তি তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সে-শক্তির তুলনায় পিছুটান কিছু নয়! বলল, ‘তোমার অনেক কাজ। নইলে তোমাকে আমি এখানে একা থাকতে দিতুম না, প্রিয়তম। আমার মন পড়ে থাকবে তোমার কাছে। আসব আমি যখনি ছাড়া পাব। লণ্ডন নয়, প্যারিস নয়, যাচ্ছি তো মুম্বই। তিন ঘণ্টার যাত্রা। এটা কি একটা যাওয়া যে তুমি মন খারাপ করবে!’

রাজ সেদিন খোশ মেজাজে ছিল। তন্ময়ের কোলে আপনি এসে ধরা দিল। বলল, ‘এ ধন তো তোমার রইলই। এ কোনোদিন চুরি যাবে না। আমি তোমার হয়ে পাহারা দেব। ভেবো না।’ এই বলে তাকে সে-রাত্রে আশাতীত সুখ দিল।

এটা কি যাওয়া যে এই নিয়ে তন্ময় মন খারাপ করবে? বলতে পারল না বেচারা যে পুনা থেকে মুম্বই হলে মন খারাপ করত না, কিন্তু এ যে ঘরসংসার থেকে রঙ্গমঞ্চে, সমাজ থেকে অসমাজে। ক্রমে ক্রমে দৃষ্টির পরপারে। এ একপ্রকার মৃত্যু। যদিও বলতে নেই।

যাত্রাকালে একান্ত নম্র নত বিনীতভাবে সে তার পত্নীর করচুম্বন করল। বলল, ‘পাছে তুমি চলে যাও সেই ভয়ে কোনোদিন তোমাকে কোনো কথা বলিনি। এখন তো তুমি আপনা হতে চললে। এখন আমার অন্তরে শুধু একটি কথা ঘুরে ফিরে আসছে।’

‘সে কথাটি কী কথা?’

‘সে কথাটি—’ বলবে কী বলবে না করে অবশেষে বলেই ফেলল তন্ময়, ‘সে-কথাটি এই কথা যে আমি তোমার কাছে কোনো অপরাধ করিনি। কেন তবে তুমি আমাকে ছেড়ে চললে?’ বলতে বলতে তন্ময়ের চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ল।

‘ওঃ ননসেন্স!’ রাজ তার কপালে গায়ে চিবুকে ঠোঁটে চুম্বনের পর চুম্বন এঁকে দিল।

‘তোমাকেই যদি ছাড়ব তবে কার জন্যে বাপ-মা জাতধর্ম ছেড়ে এলুম? তুমি আমারই। আমি তোমারই। কেউ কোনো অপরাধ করেনি। করছে না। করবে না। স্থির হও।’

হিন্দি ফিলমে নামবার সময় রাজ একটা ছদ্মনাম নিল। বসন্তমঞ্জরী। তার আবির্ভাব চিত্রজগতের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি আনন্দের হিল্লোল তুলল। পুনায় যারা তাকে চিনত তারা এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল তন্ময়কে। নিজের স্ত্রীকে পরের নায়িকারূপে অভিনয় করতে দেখা কি সামান্য সৌভাগ্য! দেখতে গিয়ে তন্ময় ঠিক আর সকলের মতো তন্ময় হতে পারল না। মাঝখানে অন্যমনস্ক হল। নায়ক-নায়িকার প্রণয়দৃশ্য যথেষ্ট সংযমের সঙ্গে দেখানো হয়েছিল। তবু একঘর লোক এমনভাবে নিল যেন সব কিছু হতে যাচ্ছে। আর কী বিশ্রী নাগরালি ওই নায়কটার!

তন্ময় আবার ছুটির দরখাস্ত করল। এবার তার ছুটির হুকুম এল। সে প্যারিসে যাবার আয়োজন করে রাজকে জানাল। রাজ বলল, ‘এখন কী করে সম্ভব? ওরা আমাকে ছাড়লে তো? আমি যে একটা চুক্তি সই করেছি।’

চুক্তির খেলাপ করলে কিছু টাকা ঘর থেকে বেরিয় যেত। তন্ময় রাজি ছিল ও টাকা দিতে। কিন্তু রাজ বলল, ‘প্রশ্নটা টাকার নয়। দেশের লোক চায় আমাকে দেখতে। রূপ যদি ভগবান আমাকে দিয়ে থাকেন তবে আমার দেশবাসী তার থেকে বঞ্চিত হবে কেন? লোকে যখন তোমার টেনিস খেলা দেখতে চায় তখন তুমি কি পাহাড়ে চলে যাবার কথা ভাবতে পার?’

বেচারার ছুটি নেওয়া হল না। যথাকালে নতুন ফিলম দেখতে হল। সেই নায়কটাই যেন মৌরসিপাট্টা নিয়েছে। যেখানেই বসন্তমঞ্জরী সেখানেই কিষণচন্দর। তন্ময় শুনতে পেল এটা যে কেবল স্টুডিয়োতে তাই নয়। হোটেলে রেসকোর্সে ক্লাবে। পার্টিতে। ওদের একসঙ্গে দেখতে দেখতে অপরিচিতরা ধরে নিয়েছে যে ওরা কেবল অভিনয় করে না। আর পরিচিতরা অবাক হয়ে ভাবছে তন্ময় কেন এতটা সহ্য করছে!

একদিন তন্ময়ের অনুযোগের উত্তরে রাজ বলল, ‘ও আমার প্রোফেশনাল পার্টনার। তোমার যেমন টেনিস পার্টনার মিস উইলসন। এতে দোষের কী আছে? আমাকে তোমার যদি এতই সন্দেহ তুমিও একটি মিসট্রেস নিলে পার। আমি কিছু মনে করব না।’

শক পেয়ে স্তম্ভিত হল তন্ময়। অনেকক্ষণ পরে বাকশক্তি ফিরে পেয়ে বলল, ‘যে উত্তমা নায়িকার স্বাদ পেয়েছে সে কি অপরা নায়িকা আস্বাদন করতে পারে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *