০৩. কলাবতীর অন্বেষণ

০৩. কলাবতীর অন্বেষণ

বন্ধুরা চলে গেল যে যার রাজকন্যার অন্বেষণে। কেউ দক্ষিণ ভারত, কেউ সবরমতী, কেউ বিলেত। সুজন ফিরে গেল কলকাতা। তার রাজকন্যার অন্বেষণে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হতে হবে না। ট্যামার লেনের মাইল খানেক উত্তরে তার রাজকন্যার মায়াপুরী। মানে ছোটো একখানা চাঁপা রঙের বাড়ি।

চাঁপা রঙের বাড়িতে থাকে বকুল নামে মেয়ে। বেথুন কলেজে পড়ে। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় ব্রহ্মসংগীত গায়। সুজনের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে আলাপ। সুজনকে ডাকে সুজনদা। সুজিদা। সুজি। ময়দা। ছোটোবোনের মতো।

বকুল কিন্তু জানে না যে সুজন তাকে পূজা করে। বকুল জানে না, তন্ময় জানে না, অনুত্তম কান্তি এরাও জানে না। জানে কেবল পূজারি নিজে। জানলে কী হবে, তার নিজের মন নিজের কাছেও স্বচ্ছ নয়। কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয় বকুলের সঙ্গ, বকুলের কথা, বকুলের গান। সে কি কাছে না দূরে? যোজন যোজন দূরে। মাটিতে না আকাশে? সাঁঝের আকাশে। সে কি মানুষ না তারা? সন্ধ্যাতারা।

সুজন তার মনের কথা মনে চেপে রাখে। মুখফুটে জানায় না। কিন্তু চোখেরও তো ভাষা আছে। পড়তে জানলে চাউনি থেকেও বোঝা যায়। বকুল কি বোঝে না? কী জানি! হয়তো বোঝে, কিন্তু ভাবে না, ভাবতে চায় না। সে তার নিজের জগতে বাস করে। তার নিজের ভাবলোকে। সেখানে আছে গান আর গুঞ্জরণ আর স্বরসাধনা। আছে বই পড়া আর পরীক্ষা পাস করা। আছে সামাজিকতা আর পারিবারিক কর্তব্য।

আর পূজা কি তাকে ওই একজন করে!

সুজন জানে ওর আশা নেই। সেইজন্যে আরও জোরে রাশ টানে। চিত্তবৃত্তিকে অসম্ভবের অভিমুখে ছুটতে দেয় না। সে পূজা করেই ক্ষান্ত। প্রেম তার কাছে নিষিদ্ধ রাজ্য। ভালোবাসতে তার সাহস হয় না। দেবীকে ভালোবাসার স্পর্ধা কোন পূজারির আছে! সুজন একটু দূরে দূরেই থাকে। রবিবারে রবিবারে ব্রাহ্মসমাজে যায়। কোনো বার বকুলের নজরে পড়ে, কোনোবার পড়ে না। কিন্তু মাঘোৎসবে মিলেমিশে মন্দির সাজায়। সেই ছেলেবেলার মতো। তখন তো সুজনও গান করত।

পুরীতে চার বন্ধুর মিলিত হবার আগে এই ছিল সুজনের অন্তরের অবস্থা।

তারপর বন্ধুদের সঙ্গে ভাববিনিময়ের ফলে স্থির হয়ে গেল জীবনভোর সে একজনের অন্বেষণ করবে। তার নাম কলাবতী। জীবনে আর কারও অন্বেষণ নয়। কলাবতী কে? বকুল। বকুলের মধ্যেই কলাবতী আছে। খুঁজতে হবে সেই কলাবতীকে। সুজনের অন্বেষণ দেশ থেকে দেশান্তরে নয়। প্রতিমা থেকে প্রতিমার অভ্যন্তরে। পূজারি হবে ধ্যানী। হবে সাধক। দেবী হবে শাশ্বতী নারী। চিরসৌন্দর্যের প্রতীক।

পুরী থেকে যে ফিরে এল সে আরেক সুজন। বাইরে থেকে বোঝা যায় না তফাত। বড়ো জোর এইটুকু বোঝা যায় যে তার ছাতাখানা হারিয়ে গেছে। এখন তাকে ছাতা মাথায় পথ চলতে দেখা যায় না। আগে তো ছাতা মাথায় ছবিও তোলাতো। সারা কলেজে সে ছিল একচ্ছত্র। সেসব দিন গেছে। তন্ময়ও নেই, কান্তিও নেই, অনুত্তমও নেই। সুজন এখন একা। নতুন কোনো বন্ধুও জুটছে না তার। অবশ্য আলাপীর লেখাজোখা নেই।

মাঝে মাঝে জীবনমোহনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। মুখফুটে বলতে পারে না কী ভাবছে, কী অনুভব করছে। বলতে হয় না। তিনি বুঝতে পারেন। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি দেখতে পান। উৎসাহ দেন।

‘তুমি যাকে খুঁজছ’, জীবনমোহন বলেন, ‘সে তোমার হাতের কাছে। কেন তুমি তীর্থ করতে যাবে, কেন যাবে হিমালয়ে! তোমার বন্ধুরা গেছে, যাক। তাদের জন্যে ভেবো না। তাদের তুলনায় নিজেকে ভাগ্যহীন মনে কোরো না। কার্তিক তো ব্রহ্মান্ড ঘুরে এল। এসে দেখল গণেশ তার আগে পৌঁছে গেছে। অথচ গণেশকে কোথাও যেতে হয়নি। কেবল মা-র চার দিকে একবার পাক দিয়ে আসতে হয়েছে।’

সুজন বল পায়। মনে মনে জপ করে, এই মানুষেই আছে সেই মানুষ। এই নারীতেই আছে সেই নারী। তার সন্ধান জানতে হবে।

সন্ধানের জন্যে সে রাজ্যের বই পড়ল। দেশি-বিদেশি কোনো সাহিত্য বাদ গেল না। শুধু সাহিত্য নয়, দর্শন। শুধু দর্শন নয়, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, সেকালের ও একালের ভ্রমণবৃত্তান্ত। তারপর রাজ্যের ছবি দেখল। মূর্তি দেখল। স্টুডিয়োতে স্টুডিয়োতে ঘুরল। অবনী ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়ের ওখানে হানা দিল। তারপর গান বাজনার আসরে ও জলসায়, ইউরোপীয় সংগীতের রিসাইটাল-এ হাজির হল। রাজ্যের গ্রামোফোন রেকর্ড কিনে শেষ কপর্দকটি খরচ করল।

আর বকুল? বকুল জানত না যে সুজন তার জন্যে দুশ্চর তপস্যা করছে। সে তপস্যা ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে যোগাসনে বসে নয়, চোখ-কান-প্রাণ খোলা রেখে যোগাযোগ স্থাপন করে। বকুলের সঙ্গে দেখাশোনা সাত দিন অন্তর হত, যেমন হচ্ছিল। কিন্তু উপাসনার পর আলাপ বড়ো একটা হত না। দু-জনেই অন্যমনস্ক।

দু-জনেই? হ্যাঁ। ওদিকে বকুলেরও অন্য ভাবনা ছিল। বি এ পাস করার পর তার আর পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল না। সে চায় সংগীত নিয়ে থাকতে। কিন্তু তার গুরুজনের সায় নেই। তাকে হয় মাস্টারি করতে হবে, নয় বিয়ে করতে হবে। দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে সময় লাগে। সে সময় নিচ্ছিল। তার হাতে সময় ছিল। তার সময়ের সুযোগ নিচ্ছিল সুজনের সমবয়সি উদ্যোগী যুবকরা। কেউ সন্ধ্যা বেলা গিয়ে গান শুনতে বসত। কেউ দুপুর বেলা গিয়ে স্বরলিপি লিখে দিত। সুজন এদের এড়িয়ে একা বকুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কি দেখা পেত? দু-একবার চেষ্টা করে দেখেছে, এদের দৃষ্টিবাণে বিদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছে। বাক্যবাণেও। নির্দোষ পরিহাসকেও সে ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে করে সংকুচিত হত।

সুজন একদিন শুনতে চেয়েছিল অতুলপ্রসাদের ‘আ মরি বাংলা ভাষা।’ বকুল মুখ খোলবার আগেই একজন শুরু করে দিল, ‘মোদের খোরাক মোদের পুঁজি আ মরি ময়দা সুজি!’ বেচারা সুজন তা শুনে অপমানে রাঙা হয়ে দু-হাতে মুখ ঢাকল।

সুজন যদি একটু কম লাজুক হত, যদি একখানা চিঠি লিখে একটুখানি আভাস দিত তা হলে কী হত বলা যায় না। কিন্তু বকুলের জীবনের সন্ধিক্ষণে সুজনের এই আত্মগোপন দু-জনের একজনের পক্ষেও কল্যাণকর হল না। বকুল শেষপর্যন্ত বিয়ের দিকেই ঝুঁকল। তবে এখন নয়, এখন বাগদান। ছেলেটি বিলেত যাচ্ছিল, বকুলের আঙুলে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেল। একদিন সুজনের চোখে পড়ল সে আংটি। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এল, কিন্তু তাড়াতাড়ি সুজন সেখান থেকে সরে গেল।

কিন্তু তার তপস্যায় ছেদ পড়ল না। বিয়ে? বিয়ে এমনকী বাধা যে তার দরুন অন্বেষণ ব্যর্থ হবে? বিয়ের পরেও বকুল বকুলই থাকবে, কলাবতী কলাবতীই থাকবে। বিয়ে না করলেও যা বিয়ে করলেও তাই। সুজন গভীর আঘাত পেল, কিন্তু আঘাতকে উপেক্ষা করল। মনে মনে জপ করল, ‘আরও আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারও।’

বাগদানের পর বকুল চলে গেল শান্তিনিকেতন। সেখানে সংগীতচর্চা করতে। এটা তার ভাবী পরিণেতার ইচ্ছায়। সুজনের সঙ্গে দেখা হল না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল। তবু সুজনের তপস্যায় ছেদ পড়ল না। অদর্শন? অদর্শন এমন কী বাধা যে তার জন্যে অন্বেষণ বন্ধ হবে? দৃষ্টির অন্তরালেই বকুল বকুলই থাকবে, কলাবতী কলাবতীই থাকবে। সুজন কি দিনের বেলা সন্ধ্যাতারা দেখতে পায়? তা বলে কি সন্ধ্যাতারা সন্ধ্যাতারা নয়? সুজন গভীর আঘাত পেল, কিন্তু কাতর হল না। মনে মনে জপ করল, ‘এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়ো।’

পূজার বন্ধে বকুল বাড়ি এল। ব্রাহ্মসমাজেও তাকে আবার দেখা গেল। সুজন তাকে দেখে স্বর্গ হাতে পেল। চোখের দেখাও যে মস্ত বড়ো পাওয়া। এ কি উড়িয়ে দেওয়া যায়! কলাবতী কি কেবল ধ্যানগোচর? চক্ষুগোচর নয়? দেবতা কি কেবল নিরাকার? সাকার নন? আত্মপরীক্ষা করে সুজন হৃদয়ংগম করল যে নিরাকার উপাসনার মতো সাকার উপাসনাও চাই। নইলে এত লোক দর্শন করতে যেত না।

বকুল আবার অদর্শন হল। এমনি চলতে থাকল কয়েক বছর। এম এ পাস করে সুজন হল একখানা বিখ্যাত মাসিকপত্রের সহকারী সম্পাদক। তার তপস্যা তাতে আরও জোর পেল। এত দিন যাকে পড়তে পড়তে দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে খুঁজছিল এখন থেকে তাঁকে খুঁজতে লাগল লিখতে লিখতে। ঠিক যে এখন থেকে তা নয়। আগেও তো সে লিখত। তবু এখন থেকেই। কেননা এই পরিমাণ দায়িত্ব নিয়ে লেখেনি এর আগে।

বকুল কেমন করে টের পেল তার জন্যে একজন সাধনা করছে। বোধহয় দেবতারা যেমন করে টের পান যে মর্ত্যে তাঁদের ভক্তরা তাঁদের একমনে ডাকছে। একদিন খুব একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। বকুলের দিদি পারুল ডেকে পাঠালেন সুজনকে। পারুলদির ওখানে সে বকুলকে দেখবে আশা করেনি। গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেল। পারুলদি কখন এক সময় উঠে গেলেন তাদের দু-জনকে একা রেখে। বেশ কিছুক্ষণ একা ছিল তারা।

এই সুযোগই তো এক দিন অভীষ্ট ছিল সুজনের। অবশেষে জুটল। কিন্তু জুটল যদি, মুখ ফুটল না। বোবার মতো, বোকার মতো বসে রইল সুজন। একটি বার বলতে পারল না, ‘ভালোবাসি।’ শুধোতে পারল না, ‘তুমি আমার হবে?’ বকুল যেন নিঃশ্বাস রোধ করে মিনিট গুনছিল, সেকেণ্ড গুনছিল। আজ তার জীবনের একটা দিন। বাগদান ভঙ্গ করা অন্যায়। কিন্তু বকুলকে যারা চেনে যারা জানে তারা তাকে ক্ষমা না করে পারত না। এমনকী স্বয়ং মোহিত ক্ষমা করত তাকে। বকুল এমন মেয়ে যে তার উপর রাগ করে থাকা যায় না।

সুন্দরী? হাঁ, সুন্দরী বটে। কিন্তু রূপ তার দেহের নয় ততটা, অন্তরের যতটা। মুখে চোখে আলো ঝলমল করছে। সে আলো কোন অদৃশ্য উৎস থেকে আসছে কত লক্ষ-কোটি যোজন দূর থেকে। মাঝে মাঝে তার উপর ছায়া পড়ছে। সামাজিকতার ছায়া। তখন মনে হচ্ছে এই বকুল কি সেই বকুল! ছায়া সরে যাচ্ছে। গান আসছে তার কন্ঠে। তখন মনে হচ্ছে, এই তো আমাদের চিরদিনের বকুল। এই অচেনাকে চেনার শিকলে কে বাঁধবে! বকুল, তুমি স্বর্গের ছাতি! তুমি দিব্য।

সুজন তাকে বিনা বাক্যে বন্দনা করল। কিন্তু কোনো মতেই বলতে পারল না যে সে যেন সুজনের হয়। অন্যের বাগদত্তা না হলে কথা ছিল। কিন্তু আজ বাদে কাল যার বিয়ে সে কি বর পরিবর্তন করতে রাজি হবে! তা ছাড়া আছেই বা কী সুজনের! অবস্থা ভালো নয়। হবেও না কোনোদিন। সে সাহিত্য সৃষ্টি করেই জীবন কাটিয়ে দেবে শত অভাবের মধ্যে। বিয়ে তার জন্যে নয়। তাকে বিয়ে করা মানে দারিদ্র্যকে বিয়ে করা। বকুলের কেন তাতে রুচি হবে! বকুল, তোমাকে যেন মাঝে মাঝে দেখতে পাই। এর বেশি আশা করিনে। করতে নেই।

ওরা দু-জনে এত কাছাকাছি বসেছিল যে একজনের নিঃশ্বাস পড়লে আরেকজন শুনতে পায়। নিঃশ্বাস পড়ছিল অনেকক্ষণ বিরতির পর। সে বিরতি উৎকন্ঠায় ভরা। আগে কথা বলার পালা সুজনের, কিন্তু সুজন যখন কিছুতেই মুখ খুলবে না তখন বকুলকেই অগ্রণী হতে হবে।

‘তারপর, সুজিদা,’ বকুল বলল সকৌতুকে, ‘তুমি নাকি কার জন্যে তপস্যা করছ।’

‘কে, আমি?’ সুজন বলল চমকে উঠি। ‘তপস্যা করছি! কই, না!’

‘হ্যাঁ, সেইরকমই তো মালুম হচ্ছে।’ হেসে বলল বকুল, ‘কিন্তু কোন দেবতার জন্যে? কোথায় তিনি থাকেন? স্বর্গে না মর্ত্যে? মর্ত্যেই যদি থাকেন তবে তো একখানা চিঠিপত্তর দিতে পারতে। বিল্বপত্তর, তুলসীপত্তর দিয়ে কী হবে?’

সুজন এর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। বকুলের সঙ্গে তার যা সুবাদ তাতে একখানা কেন দশখানা চিঠি দেওয়া চলে। কিন্তু কী লিখবে চিঠিতে? লিখতে হাত কাঁপে। অথচ এই সুজনেরই লেখায় মাসিকপত্রের পৃষ্ঠা পূর্ণ।

‘দিয়ো। বুঝলে?’ বকুল একটু পরে বলল।

এই ঘটনার কয়েক মাস বাদে আর একটা ঘটনা ঘটে। তবে সেটা খুব একটা আশ্চর্য ঘটনা নয়। বকুলের বিয়ে। মোহিত বিলেত থেকে ফিরে কলম্বোতে চাকরি পেয়ে কলকাতা এসে বকুলকে বিয়ে করে। কন্যাযাত্রীদের দলে সুজনকে দেখা যায়। তার বুক ফেটে যাচ্ছিল ঠিকই। যদিও মুখ দেখে বোঝবার জো ছিল না।

এমন একজনও বন্ধু ছিল না যে তার মনের ভিতরটা দেখতে পায় বা যাকে সে তার মনের মণিকোঠার দ্বার খুলে দেখাতে পারে। কান্না ঠেলে উঠছে বুক থেকে চোখে, তবু তার চোখের কোণে জল নেই। আর পাঁচ জনের মতো সেও সুখী যে বকুলের বেশ ভালো বিয়ে হয়েছে। বকুল সুখী হবেই। না হয়ে পারে না। সুজনের সঙ্গে বিয়ে হলে কি পাঁচজনে সুখী হত? বরং এই ভেবেই অসুখী হত যে মেয়েটা কী ভুলই না করেছে।

বকুলের মা বাবা ভাই বোন সকলেই সুখী। কেবল পারুলদির ব্যবহার একটু কেমনতরো। শান্তশিষ্ট সরল মানুষটি কেমন যেন থ’ হয়ে গেছেন। বোধহয় ভাবছেন এটা কি ঠিক হচ্ছে না ভুল হচ্ছে বকুলের? সে কি সত্যি পারবে সারাজীবন মোহিতের ঘর করতে? মোহিতের ছেলে-মেয়ের মা হতে? পারবে না কেন? তবে খুশি না দায়ে পড়ে? পারুলদি বার বার সুজনের দিকে তাকান আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

আর বকুল? সে চিরদিন যেমন আজও তেমনি সপ্রতিভ। এটা যে একটা বিশেষ দিন, যাকে বলে জীবনে একটা দিন, এর জন্যে সে বিশেষ সুখী বা বিশেষ অসুখী বলে মনে হয় না। তার ভাবখানা যেন—বিয়ে হচ্ছে নাকি? আচ্ছা, হোক।

সে যেন সাক্ষী। নিষ্ক্রিয় সাক্ষী।

বকুলরা কলম্বো চলে যাবার পর সুজনের জীবনযাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না। কলাবতীর অন্বেষণ সমানে চলল। কলাবিদ্যায় বিদ্বান হয়ে উঠল সুজন। তার রচনায় মাধুর্য এল, এল প্রসাদগুণ, এল ফোটা ফুলের সুষমা। আর অতি সূক্ষ্ম সুগন্ধ। পালিয়ে যাওয়া, মিলিয়ে যাওয়া, অ-ধরাছোঁয়া সুগন্ধ। যারা পড়ে তারা হাতড়ে বেড়ায়, হাতে পায় না। বার বার পড়ে। মুগ্ধ হয়। চিঠি লিখে সুজনকে জানায় ধন্যতা।

চিঠি লেখে মেয়েরাও। সমবয়সি, অসমবয়সি, বিবাহিতা, অবিবাহিতা, দূরস্থিতা, অদূরস্থিতা। কেউ কেউ দেখা করতে চায়। দেখা করেও। অটোগ্রাফের ছলে। তর্ক-বিতর্কের ছলে। সুজন উত্তর দেয় বই কী। উত্তর দেয় দু-চার কথায়। কিন্তু হৃদয় ভেঙে দেখায় না। দেখাতে পারেও না।

বকুলকে, কলাবতীকে কেউ আচ্ছন্ন করবে না। সন্ধ্যাতারা ঢাকা পড়বে না কোনো নীলনয়নার কালো কেশপাশে। শাশ্বত সৌন্দর্য হতে ভ্রষ্ট হবে না ভ্রমর। বিয়ে করবে না সুজন। আজীবন? হ্যাঁ, যত দূর দৃষ্টি যায়, আজীবন।

জীবন এমন কিছু দীর্ঘ নয়। তার মা বেঁচেছিলেন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। সেও হয়তো তেমনি বছর পঁয়ত্রিশ বাঁচবে। তার বাবা জীবিত। মেদিনীপুরে কাজ করেন। সামনেই তাঁর অবসরগ্রহণ। কলকাতার বাসায় সুজন থাকে ছোটো ভাইবোনদের নিয়ে। তারা পড়াশোনা করে। অভাবের সংসার। বিয়ের জন্যে চাপ দিচ্ছে না কেউ।

কলম্বোতে বকুল কেমন আছে কে জানে! খবর নেয়নি সুজন। চিঠি লিখতে পারত, কিন্তু কী লিখবে? বকুলও চিঠি লেখে না। কেনই বা লিখবে? ইচ্ছা করে পারুলদিকে জিজ্ঞাসা করতে, কিন্তু ব্রাহ্মসমাজে গেলে তো। পূর্বের মতো ধর্মভাব নেই, কোথায় অন্তর্হিত হয়েছে।

জীবনমোহনের কাছে যায়। তিনিই তার ধর্মযাজক। রবিবারেই সুবিধা। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি থাকেন। সুজনকে সঙ্গ দেন। ধর্মের ধার দিয়ে যান না। অবশ্য লৌকিক অর্থে। কিন্তু যা নিয়ে আলোচনা করেন তা ধর্ম নয় তো কী!

‘সুজন, তোমার কবিতায় রং লেগেছে।’ বলেন জীবনমোহন। ‘লিখে যাও, দোস্ত। তুমি হবে বাংলার হাফিজ।’

সুজন তা শুনে সংকোচ বোধ করে। কতটুকু তার অনুভূতির ঐশ্বর্য। সামান্য পুঁজি নিয়ে কারবারে নামা। তাও যদি ভাষায় ব্যক্ত করতে জানত। পনেরো আনাই অব্যক্ত থেকে যায়। নিজের অক্ষমতায় সে নিজেই লজ্জিত। সমালোচকরা বেশি কী লজ্জা দেবে। কিন্তু কেউ সুখ্যাতি করলে সে সংকোচে মাটিতে মিশে যায়। বিশেষত জীবনমোহনের মতো জীবনরসিক।

‘এ তোমার বুকের রক্ত। পাকা রং।’ বলেন জীবনমোহন।

পারিবারিক পেষণে বাধ্য হয়ে সুজনকে মাসিকপত্রের কাজ ছেড়ে কলেজের চাকরি নিতে হল। এ-রকম তো কথা ছিল না। এটা তার পরিকল্পনার বাইরে। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। যা ভয় করেছিল তাই। পড়া আর পড়ানো, খাতা দেখা আর প্রিন্সিপ্যালের ফাইফরমাশ খাটা, এই করে দিন কেটে যায়। রাতও। সৃষ্টি করবে কখন? ছুটির সময়ও ছুটি মেলে না। এগজামিন বা অন্য কিছু। সুজনের লেখা কমে এল, কমতে কমতে প্রায় বন্ধ হতে বসল। হাতও খারাপ হয়ে গেল পাঠ্যপুস্তক লিখে।

বিপদ কখনো একা আসে না। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। চাকরি হতে-না-হতেই আসতে লাগল বিয়ের সম্বন্ধ। একটার পর একটা সম্বন্ধ উলটিয়ে দেবার ফলে বাপের সঙ্গে বাধল খিটিমিটি। তিনি পেনশন নিয়ে বেকার বসে আছেন। হাতে কাজ নেই। নিষ্কর্মা হলে যা হয়। প্রত্যেকটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা চাই। ‘কেন তুমি বিয়ে করবে না? লেখাপড়ায় ভালো, গৃহকর্মে নিপুণ, সুশ্রী, সচ্চরিত্র, ভদ্রলোকের মেয়ে। তার উপর কিছু পণযৌতুকও আছে। কেন তা হলে তোমার অমত? তোমরা ক-ভাই যদি বিয়ে না কর, যদি পারিবারিক তহবিলে কিছু আমদানি না হয় তা হলে ছোটো বোনগুলির বিয়ে দেবে কী করে? ইতিমধ্যে যে রপ্তানিটা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হবে কী উপায়ে?’

এ যুক্তি খন্ডন করা শক্ত। সুজন পারতপক্ষে বাপের ছায়া মাড়ায় না। বাবা আসছেন শুনলে চোঁচা দৌড় দেয়। যঃ পলায়তি স জীবতি।

শেষকালে তিনি তাকে ফাঁপরে ফেললেন। কোথায় একটি মেয়ে দেখতে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন। সুজনকে জানতেও দিলেন না যে তার বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে। ছাপাখানায় গিয়ে শুনতে পেল তার বিয়ের চিঠি ছাপা হচ্ছে। দেখে তার চক্ষুস্থির। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করবে তেমন বীরপুরুষ নয় সে। বাপের সামনে মুখ তুলে কথা কইতে জানে না। তা হলে কি বিয়েই করতে হবে তাকে? কলাবতীকে ভুলতে হবে?

কদাচ নয়। সেই দিনই সুজন তার প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করে পাঠ্যপুস্তকগুলোর কপিরাইট বেচে দিল। তারপর রাতারাতি পাসপোর্ট জোগাড় করে চাঁদপালঘাটে জাহাজ ধরল লণ্ডনের। জাহাজ যাবে কলম্বো হয়ে। চিঠি লিখল বকুলকে।

কলম্বোর জাহাজঘাটে অপেক্ষা করছিল বকুল ও তার স্বামী। সুজনকে বলল, ‘চলো আমাদের সঙ্গে। জাহাজ ছাড়তে দেরি আছে।’

আবার যখন জাহাজে উঠল ততক্ষণে মোহিতের সঙ্গে সুজনের খুব জমে গেছে। বিলেতে কোথায় উঠবে, কী খাবে, এইরকম এক-শো রকমের টুকিটাকি নিয়ে আলাপ। বকুল আশা করেছিল সুজন তার দিকে একটু মনোযোগ দেবে। কিন্তু যে জেগে ঘুমোয় তাকে জাগাবে কে? সুজন অমনোযোগের ভান করল। কিন্তু লক্ষ করল যে বকুলকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।

এ সৌন্দর্য সাজপোশাকের নয়, প্রসাধনের নয়, দেহচর্যার তো নয়ই, রূপচর্যার নয়। এ কি তবে গন্ধর্ববিদ্যা অনুশীলনের ফল? কোনখানে এর উৎপত্তি? সংগীতলোকে? যে সংগীত আকাশে আকাশে, গ্রহতারায়, আলোকে আগুনে, বিশ্বসৃষ্টিতে? প্রাচীনরা যাকে বলতেন দ্যুলোকের সংগীত?

অথবা এর মূল বিশুদ্ধ নির্মল মানবাত্মার? যার আভা সব আবরণ ভেদ করে ফুটে বেরোয়? অক্ষয় অব্যয় অব্রণ। এ কি তবে অনির্বচনীয় আত্মিক সৌন্দর্য।

সুজন ভাবে, শেলি যাকে বলেছেন ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি সে কি এই নয়?

জাহাজ যখন ছাড়ি ছাড়ি করছে, জাহাজ থেকে দর্শকদের নামবার সময় হয়েছে, তখন বকুল বলল, ‘সুজিদা, মনে রেখো।’ ইংরেজি করে বলল, ‘ফরগেট মি নট।’

কী যে ব্যাকুল বোধ করল সুজন! মনে হল আর দেখা হবে না হয়তো। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল জাহাজ থেকে, জাহাজঘাটের দিকে। ধীরে ধীরে আড়াল হয়ে গেল সব। ফুটে উঠল শুধু একখানি মুখ। সাঁঝের তারার মতো।

এই সেই কলাবতী, যার ধ্যান করে এসেছে সুজন। চিরন্তনী নারী। এর সৌন্দর্য যে উৎস থেকে আসছে তার নাম চিরন্তন নারীত্ব। পৃথিবীতে যখন একটিও নারী ছিল না, যখন পৃথিবীই ছিল না, তখনও তা ছিল। বিশ্ব যখন থাকবে না তখনও তা থাকবে।

সুজনের জাহাজ লণ্ডনে পৌঁছোল। সেখানে সে একটা কাজ জুটিয়ে নিল। স্কুল ফর ওরিয়েন্টাল স্টাডিস নামক প্রতিষ্ঠানে। সঙ্গে সঙ্গে পি এইচ ডি-র জন্যে থিসিস লিখতে উদ্যোগী হল। দেশে ফিরতে তাড়া ছিল না। ইচ্ছাও ছিল না। ফিরে এলে আবার তো সেই বিয়ের জন্যে ঝোলাঝুলি শুরু হবে। বাপের সঙ্গে ঝগড়া।

সেই সুদূর প্রবাসের শূন্য মন্দিরে মনে পড়ে একখানি মুখ। চিরন্তনী নারী। শাশ্বত সৌন্দর্য। অমনি আর সকল মুখ মায়া হয়ে যায়। ইংরেজ মেয়ের মুখ, ফরাসি মেয়ের মুখ, প্রবাসিনী বাঙালি মেয়ের মুখ, কাশ্মীরি মেয়ের মুখ ছায়া হয়ে যায়, মায়া হয়ে যায়। সুজন মেশে তাদের সঙ্গে, মিশবে না এমন কোনো ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নেই তার। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে আড়াল হতে দেয় না তার সন্ধ্যাতারাকে, তার বকুলকে। সে যে কলাবতীর অন্বেষণে বেরিয়েছে। আর কারও সন্ধানে নয়।

সুজন যখন ইংল্যাণ্ডে যায় তার আগে তন্ময় সেখান থেকে চলে এসেছে। দুই বন্ধুর দেখা হল না। শুনতে পেল তন্ময় নাকি বিয়ে করেছে। কিন্তু কাকে, কবে, কোথায়, কী বৃত্তান্ত কেউ সঠিক বলতে পারে না। তন্ময়ের ঠিকানায় চিঠি লিখবে ভাবল। কিন্তু আর দশটা ভাবনার তলায় সে ভাবনা চাপা পড়ে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *