হরিষ মঙ্গলচন্ডী
বৈশাখ মাসের
এক ব্রাহ্মণীর এক গোয়ালিনী সই ছিল। ব্রাহ্মণী বৈশাখ মাসের মঙ্গলবারে হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করতেন। গোয়ালিনী কোনো ব্রত করত না। একদিন গোয়ালিনী বললে, ‘সই! এ ব্রত করলে কী হয়?’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘এ ব্রত করলে কখনো চক্ষের জল পড়ে না, চিরকাল মনের হরিষে কাটে।’ এই কথা শুনে গোয়ালিনী বললে, ‘তবে আমিও এ ব্রত করব।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘এ বড়ো কঠিন ব্রত, তুমি গয়লার মেয়ে, এ ব্রতের নিয়ম পালন করতে পারবে না। তোমার এ ব্রত করে কাজ নেই।’ গোয়ালিনী বললে, ‘সই! তা হবে না, এমন ব্রত আমি করতে পাব না? যত কষ্ট হোক, আমি এ ব্রত করবই।’ তখন ব্রাহ্মণী ব্রতের নিয়ম বলে দিলেন। গোয়ালিনী বৈশাখ মাসের মঙ্গলবারে ব্রত আরম্ভ করলে। দুই এক বার ব্রত করতেই মা মঙ্গলচন্ডীর অনুগ্রহ হল। তাঁর কৃপাদৃষ্টিতে গোয়ালিনীর আর সুখ ধরে না; ধন ঐশ্বর্যের সীমা নেই। হঠাৎ এত সুখ গয়লার মেয়ের আর সহ্য হল না। কাঁদবার জন্যে তার প্রাণ আকুল হয়ে উঠল।
একদিন গোয়ালিনী ব্রাহ্মণীর কাছে গিয়ে বললে, ‘সই! আমার বড়ো সুখ, একবার কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে।’ ব্রাহ্মণী শুনেই অবাক। বললেন, ‘সে কি! তোমার এক সৃষ্টিছাড়া বায়না। আমি তোমায় তখনি তো বলেছি যে, এ ব্রত করলে কখনো চোখের জল পড়ে না। এই জন্যই এ ব্রতের নাম ‘হরিষ মঙ্গলচন্ডী।’ গোয়ালিনী বললে, ‘তা হবে না, আমি কাঁদব, আমার বড়ো কান্না পারছে। না কাঁদলে আমার প্রাণ আর থাকে না।’ তখন ব্রাহ্মণী বললেন, ‘তোমার যদি এত কাঁদতে ইচ্ছা হয়ে থাকে, তবে এক কাজ করো,—ওই বেনেদের ক্ষেতে লাউগাছ হয়েছে, তুমি তাই কেটে আনো। যখন তারা তোমায় খুব গালাগালি দেবে, তখন তুমি মনের দুঃখে খুব কেঁদো।’ গোয়ালিনী তাই করলে; কিন্তু ব্রতের মাহাত্ম্যে তার শরীর শুদ্ধ হওয়ায়, তার হাত লাগতেই, লাউগাছ খুব গজিয়ে উঠল। সকলে বলতে লাগল, ‘ইনি তো সামান্য মেয়ে নন, স্বয়ং লক্ষ্মী ঠাকরুণ!’ তারপর তারা গয়লার মেয়ের বাড়িতে অনেক লাউ, লাউশাক দিয়ে এল। গোয়ালিনীর আর কাঁদা হল না। সে ব্রাহ্মণীর কাছে গিয়ে বললে, ‘সই! সব উলটো হল,—লাউগাছ আরও গজিয়ে উঠল, তারা সব লাউ, লাউশাক আমাকে দিয়ে গেল। এতে সুখ আরও বেড়ে গেল সই, আমার তো কাঁদা হল না।’
ব্রাহ্মণী বললেন, ‘তাই তো! তবে আর এক কাজ করো। রাজার হাতিটা মারা গেছে, সেটা পাঁদাড়ে পড়ে আছে, তুমি ওই হাতিটার গলা ধরে মড়া কান্না কাঁদগে।’ সে তাই করলে, কিন্তু ব্রত্যের মাহাত্ম্যে তার হাত হাতির গায়ে লাগতেই, হাতিটা বেঁচে উঠল। সকলে আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘ইনি তো সামান্য মেয়ে নন, স্বয়ং ভগবতী।’ রাজা এসে গোয়ালিনীর অনেক স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন। তারপর সোনা-দানা, হাতি-ঘোড়া দিয়ে গোয়ালিনীর বাড়ি-ঘর ভরিয়ে দিলেন। এবারও গোয়ালিনীর সুখ বেড়ে গেল, আর কাঁদা হল না। তখন সে আবার ব্রাহ্মণীর কাছে গিয়ে বললে, ‘সই! আমার যে ক্রমাগতই সুখ বেড়ে যাচ্ছে, কাঁদা তো হল না।’ ব্রাহ্মণী সব শুনে বললেন, ‘তাই তো! আচ্ছা, আর এক কাজ করো। যদি তোমার এতই কাঁদতে ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে সাপের বিষ মাখিয়ে লাড়ু তৈরি করে তোমার মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দাও।’ গোয়ালিনী তাই করলে, সত্যি সত্যি লাড়ু তৈরি করে, তাতে বিষ মাখিয়ে, ছেলেকে দিয়ে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলে। ছেলে হাঁড়িটা নিয়ে যেতে যেতে, বৈশাখ মাসের দারুণ রোদে ঘেমে আর চলতে পারলে না। না পেরে, একটা পুকুরপাড়ে হাঁড়ি রেখে নাইতে গেল। মা মঙ্গলচন্ডী দেখলেন, আমার ভক্তের দুর্মতি হয়েছে। তবে যতদিন আমার ব্রত করবে, ততদিন ওর চোখের জল ফেলতে দেব না। এই বলে, তিনি অমৃত দিয়ে, বিষের লাড়ু অমৃতের লাড়ু করে দিলেন।
ছেলে স্নানকরে উঠে হাঁড়ি থেকে একটা লাড়ু বার করে খেলে। খেয়ে বললে, ‘আহা! মা আমার এমন লাড়ু তৈরি করতে জানেন, দিদি খেয়ে কত সুখ্যাতিই করবে।’ এই বলে সে পুকুর থেকে জল খেয়ে, সেই হাঁড়ি নিয়ে দিদির বাড়ি গেল। গিয়ে বললে, ‘দিদি, মা কেমন চমৎকার লাড়ু তৈরি করে দিয়েছেন—খেয়ে দেখো!’ মেয়ে, জামাই ও বাড়ির সকলে সেই অমৃতের লাড়ু খেয়ে খুব সুখ্যাতি করতে লাগল, সকলেই ধন্যি ধন্যি করতে লাগল। এদিকে গোয়ালিনী কাঁদবার জন্যে এলোচুল করে হাঁ করে পথ পানে চেয়ে আছে,—কখন ছেলে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলবে যে, মা, দিদি মরে গেছে। কিন্তু হায় হায়, সকলি উলটো হল। খানিক পরে ছেলে এসে বললে, ‘মা কি চমৎকারই লাড়ু করেছ, বাড়িশুদ্ধু লোকে খেয়ে কত সুখ্যাতি করতে লাগল। তারা আবার চেয়েছে। আমাকে ওই রকম লাড়ু করে দাও মা।’ গোয়ালিনী বললে, ‘সর্বনাশ! কিছুতেই কাঁদা হল না।’ তখন সে রেগে সইয়ের কাছে গিয়ে বললে, ‘সই! এ কী হল? কিছুতেই কাঁদতে পেলুম না! এবার না কাঁদতে পেলে আমি মরে যাব।’ ব্রাহ্মণী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এক কাজ করো, তুমি আর মঙ্গলবার করো না।’ গোয়ালিনী বললে, ‘সেই ঠিক, কাল মঙ্গলবার, কাল থেকে আর পুজো করছি না!’
এই ঠিক করে গোয়ালিনী মঙ্গলবারের ব্রত উপবাস বন্ধ করে দিল। মা মঙ্গলচন্ডী বিরূপ হলেন। অমনি তার লোকজন, হাতি, ঘোড়া, ছেলে, মেয়ে সব মরে গেল! তখন গোয়ালিনী কেঁদে হাহাকার করে পাড়া মাথায় করে তুললে। তার কান্না শুনে কেউ আর তিষ্ঠুতে পারলে না। সে দিবা-রাত্রি কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে আবার সইয়ের কাছে গেল। বললে, ‘সই! আমার সর্বনাশ হয়েছে—আমার সব মরে গেছে! আর কাঁদতে পারি না, আমার এ কী হল সই! তুমি রক্ষা করো।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘সে কী! তোমার এত দিনের সাধ, এখন প্রাণ ভরে কাঁদো।’ গোয়ালিনী বললে, ‘আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে—আর কথা কইতে পাচ্ছি না। তুমি আমায় বাঁচাও, নইলে এই দেখো, আমিও মরি।’ এই বলে গোয়ালিনী বুক চাপড়াতে লাগল। তখন ব্রাহ্মণীর দয়া হল—বললেন, ‘আসছে মঙ্গলবার পর্যন্ত এই ক-টা দিন অপেক্ষা করো। যেন মড়া পুড়িও না, যে-যেখানে যেমন আছে তেমনি থাকুক। তুমি রোজ মা মঙ্গলচন্ডীর স্তব পাঠ করো, পুজো করো। তারপর মঙ্গলবারে উপোস করে ঘটের জল সব মড়ার গায়ে ছড়িয়ে দিও। তাহলে যদি তাঁর দয়া হয়।’ গোয়ালিনী তাই করলে—ভক্তি করে রোজ মা মঙ্গলচন্ডীর পুজো করতে লাগল, স্তব পাঠ করতে লাগল, মনের সহিত মাকে ডাকতে লাগল। এই রকমে ক-টা দিন কাটিয়ে, মঙ্গলবার উপোস করে একমনে ঘট ধরে কাঁদতে লাগল। তখন মার দয়া হল। মা আর থাকতে পারলেন না। অমনি আকাশ থেকে দৈববাণী হল—‘এই ঘটের জল সব মড়ার উপর ছড়িয়ে দে।’ অমনি গোয়ালিনী তাড়াতাড়ি উঠে সকলকার গায়ে ঘটের জল ছড়িয়ে দিতেই, সবাই বেঁচে উঠল। তখন সে আহ্লাদে ব্রাহ্মণীর বাড়ি গিয়ে, তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে, হাসিমুখে বললে, ‘যথার্থই মা মঙ্গলচন্ডী দয়াময়ী। এমন না হলে মার দয়া! সই! তোমার আশীর্বাদে মার দয়া হয়েছে,—সবাই বেঁচে উঠেছে।’
গোয়ালিনীর এই ব্যাপার দেখে, পাড়াশুদ্ধ লোক সকলেই হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করতে লাগল। সেই থেকে দেশ-বিদেশে এই ব্রত প্রচার হল। বৈশাখ মাসে এই হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত যে ভক্তি করে করে, সে চিরকাল মনের হরিষে থাকে। তার কখনও চোখের জল ফেলতে হয় না। এই হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রতকথা যে-বলে বা শোনে, তারও মঙ্গল হয়।
হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রতকথা সমাপ্ত।