1 of 2

মৌনী অমাবস্যার ব্রতকথা

মৌনী অমাবস্যার ব্রতকথা

এক গ্রামে এক বিধবা ব্রাহ্মণী আর এক গোয়ালিনী বাস করত। তাদের দুজনের খুব ভাব থাকায় সই পাতিয়েছিল। গোয়ালিনী ধন, ঐশ্বর্য, স্বামী পুত্র নিয়ে খুব সুখে ছিল। ব্রাহ্মণীর কেবল একটি মেয়ে। স্বামী, পুত্র, ধন, ঐশ্বর্য কিছুই ছিল না। একদিন একজন অতিথি এসে ভিক্ষা চাইলে, ব্রাহ্মণীর মেয়েটি ভিক্ষা দিতে গেল। ভিক্ষা দেবামাত্র অতিথি বললে, ‘আহা এমন কন্যার অদৃষ্টে বৈধব্য-যন্ত্রণা!’ এই কথা বলে অতিথি চলে গেল। মেয়েটি তার মায়ের কাছে এসে বললে, ‘মা! অতিথি কী বলে গেল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।’ তার মা এই কথা শুনে বড়োই চিন্তিত হলেন, আর বললেন, ‘আবার যদি সে অতিথি কখনও আসে তো আমায় বলিস।’ কিছুদিন পরে আবার সেই অতিথি এসে ভিক্ষা চাইলে। ব্রাহ্মণী একটু আড়ালে থেকে মেয়েটির হাতে ভিক্ষে দিয়ে অতিথির কাছে পাঠালেন। মেয়েটি ভিক্ষা দেবামাত্র অতিথি বললে, ‘আহা এমন মেয়েটির কপালে বৈধব্য-যন্ত্রণা!’ এই কথা শুনে ব্রাহ্মণী অতিথির পায়ে পড়ে বললেন, ‘প্রভু! আমার কন্যার দুঃখ যাতে না হয়, তার উপায় আপনি করুন।’

এই কথা শুনে অতিথি বললে, ‘যদি কেউ মৌনী অমাবস্যার সাতটি ব্রত করে থাকে, সে যদি সেই ফল তোমার মেয়েকে বিয়ের রাতে উৎসর্গ করে দেয়, তাহলে তোমার জামাই আবার জীবন পাবে। কিন্তু যে ওই ব্রতের ফল উৎসর্গ করে দেবে, তার বড়ো অমঙ্গল হবে।’ এই কথা শুনে ব্রাহ্মণী আবার অতিথিকে বললেন, ‘তার দুঃখ দূর হবার কি কোনো উপায় নেই প্রভু?’ তখন অতিথি বললে, ‘নিকটে এই বনের ভেতরে একজন কুটে রোগী বসে আছে, তার মাথায় এক ভাঁড় দই ঢেলে দিয়ে, আবার জিব দিয়ে চেটে সেই দইয়ের ভাঁড় পূর্ণ করলে তার আবার ধন, ঐশ্বর্য, স্বামী, পুত্র লাভ হবে।’

এই কথা শুনে ব্রাহ্মণী মনে মনে ভাবলেন, আমার গোয়ালিনী সই সাতটি ব্রত করেছে; তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবে আমার মেয়ের মঙ্গল হবে। এই ভেবে রোজ ভোরের বেলায় সইয়ের বাড়িতে গিয়ে তাদের ঘর-দোর সব পরিষ্কার করে আসে। গোয়ালিনী ভাবে রোজ আমার ঘরদোর কে পরিষ্কার করে যায়, আজ আমাকে লুকিয়ে দেখতে হবে। ব্রাহ্মণী যেমন ভোরের বেলায় ঘর-দোর সব সেই রকম করে পরিষ্কার করছে, এমন সময় গোয়ালিনী ব্রাহ্মণীকে ধরে বললে, ‘এ কি সই! তুমি এ রকম করছ কেন? তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে, আমি হলুম গোয়ালার মেয়ে, আমার যে ছেলেপুলের অকল্যাণ হবে।’ এই কথা শুনে ব্রাহ্মণী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার একটি বিপদ থেকে তোমায় রক্ষা করতে হবে। তোমার মনস্তুষ্টির জন্যে আমি রোজ এই রকম করি, আর চিরকাল তোমার হুকুমে চলব। আমার মেয়ে বিবাহের রাত্রে বিধবা হবে, তুমি যদি অনুগ্রহ করে মৌনী অমাবস্যার ব্রতফল সাতটি আমার কন্যাকে দান করো, তবে আমার জামাই আবার বেঁচে উঠবে।’ গোয়ালিনী শুনে বললে, ‘সেকী সই! কেন দেব না! তোমার মেয়ে আর আমার মেয়ে কি তফাৎ?’ গোয়ালিনী রাজি হল।

কিছুদিন পরে ব্রাহ্মণী মেয়ের বিয়ে দিলেন, বিয়ের রাতে জামাই-এর হঠাৎ মৃত্যু হল। ওই সময়ে গোয়ালিনী তাকে সাতটি ব্রত উৎসর্গ করে দিলে। ব্রাহ্মণীর জামাই তখন আবার বেঁচে উঠল, কিন্তু গোয়ালিনীর বড়ো অমঙ্গল হল। ধন, ঐশ্বর্য সব গেল, স্বামী পুত্রের মৃত্যু হল। তখন ব্রাহ্মণী গিয়ে গোয়ালিনীকে বললেন, ‘সই, তুমি, কেঁদো না, এক ভাঁড় দই নিয়ে আমার সঙ্গে এসো; বনের ভেতরে যেখানে ওই কুটে অতিথি আছে, সেখানে চল।’ ব্রাহ্মণীর কথায় গোয়ালিনী কাঁদতে কাঁদতে সেইখানে গেল। তখন ব্রাহ্মণী বললেন, ‘এর মাথায় দই ঢেলে দিয়ে চেটে আবার দইয়ের ভাঁড় পূর্ণ করো।’ এই কথা শুনে গোয়ালিনী কিছুমাত্র ঘৃণা না করে, সেইরকম করে দইয়ের ভাঁড় পূর্ণ করলে। অমনি সেই কূটের শরীর ভালো হল। তখন কুটে ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আমি তোমাদের একাগ্রতা আর বারব্রতে ও ধর্মে বিশ্বাস আছে কি না দেখবার জন্যে এরকম ছলনা করে বসে আছি। তোমার মৌনী অমাবস্যার ব্রতফলে তোমার স্বামী, পুত্র বেঁচে উঠেছে, তোমার ধন-ঐশ্বর্য যেমন ছিল তেমনি হয়েছে। আমিই সেই ব্রতের ফলদাতা নারায়ণ।’ তখন ব্রাহ্মণী ও গোয়ালিনী তাঁর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল, অমনি তিনি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধরে চতুর্ভুজ মূর্তিতে তাদের দুজনকে দেখা দিয়ে বললেন, ‘ধর্মে মতি রেখো, দিনান্তেও একবার আমাকে ডেকো।’ এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। তার পর দুই সইয়ে বাড়ি এসে দেখলেন গোয়ালিনীর সব ঠিক হয়েছে। তখন তাঁরা মৌনী অমাবস্যার মাহাত্ম্য প্রচার করলেন। তাঁরা কিছুদিন সুখে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে, ছেলেমেয়েদের বারব্রত করবার উপদেশ দিয়ে, সংসার বুঝিয়ে দুজনে স্বর্গে গেলেন।

মৌনী অমাবস্যার ব্রতকথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *