1 of 2

মনসার কথা

মনসার কথা

এক বেনে সওদাগর, তাঁর সাত বউ। সকলকার বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্ব আসে, কেবল ছোটো বউয়ের তত্ত্ব আসে না। এইজন্যে গিন্নি তাকে দেখতে পারেন না। ছোটো বউ মনের দুঃখে চুপ করে থাকে, কারও সঙ্গে কথা কয় না। একদিন ঝম ঝম করে জল পড়ছে, আকাশ মেঘে অন্ধকার হয়ে রয়েছে, সওদাগরের বউয়েরা বসে বসে গল্প করছে। কেউ বলছে, ‘এই বাদলায় বেশ গরম গরম খিচুড়ি হত!’ কেউ বলছে, ‘না ভাই, এ সময় চাল কলাই ভাজা বেশ লাগে।’ এই রকম যার মনে যা এল বলতে লাগল। ছোটো বউ কিছুই বললে না। তখন ছয় জায়ে পীড়াপীড়ি করে বললে, ‘বলনা ভাই, তোর কী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?’ ছোটো বউ পোয়াতি, তার কিছুই খেতে ইচ্ছে হয় না; অনেক ভেবে চিন্তে বললে, ‘আমার কেবল মাছের অম্বল দিয়ে দুটি পান্তাভাত খেতে ইচ্ছে করছে।’ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হল। তখনও টিপ টিপ করে জল পড়ছে। সব বউয়েরা বললে, ‘চল ভাই, কাপড় কেচে আসি।’ তখন সকলে পুকুরের কাপড় কাচতে গেল।

সওদাগরের বাড়ির কাছে একটা বন ছিল। বনের মধ্যে অষ্টনাগ বাস করত। একদিন বনে আগুন লাগাতে অষ্টনাগ বন থেকে পালিয়ে পুকুরে মাছের ঝাঁক হয়ে রইল। সে দিন সন্ধ্যাবেলা সাত জায়ে যখন কাপড় কাচছে, তখন ছোটোবউ ওই মাছের ঝাঁক দেখতে পেলে। অমনি গামছা দিয়ে সেইগুলিকে ধরে নিয়ে এল। তখন সকলে বললে, ‘ওই দেখছিস লা, ছোটো বউয়েরই সাধ মিটল।’ ছোটো বউ আহ্লাদে আটখানা হয়ে সেগুলিকে একটি কলসির ভিতর জলে রেখে দিলে। তার পরদিন ছোটো বউ অম্বল রাঁধবার জন্য মাছ আনতে গিয়ে দেখে সর্বনাশ! সেই মাছগুলি আটটি সাপ হয়ে রয়েছে। ছোটো বউ তাই দেখে ভয় না পেয়ে, সাপগুলিকে পুষতে লাগল। তাদের রোজ আট পো করে দুধ, আর আটটি করে কলা খাওয়াতে লাগল। সাপের ছানারা রোজ রোজ সেই দুধ কলা খেয়ে ভারি খুশি হল। একদিন তারা পরামর্শ করলে, ‘ভাই! ছোটো বউ আমাদের যেমনি খাওয়াচ্ছে, তেমনি এর কিছু উপকার করতে হবে।’

কিছুদিন পরে তারা একটু বড়ো হতেই মা মনসার কাছে চলে গেল। মা মনসা স্বর্গে থাকেন। ছেলেদের না দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি করছিলেন, এমন সময় ছেলেরা সেইখানে যেতে, তিনি বললেন, ‘এতদিন তোরা কোথায় ছিলি?’ ছেলেরা বললে, ‘মা! আমরা বড়ো বিপদে পড়েছিলুম। এক সওদাগরের ছোটো বউ আমাদের এ যাত্রা বাঁচিয়েছে।’ এই সব কথা তারা মা মনসার কাছে বললে। তখন তিনি শুনে ভারি দুঃখিত হলেন। তাঁর দুঃখ দেখে অষ্টনাগ বলতে লাগল, ‘মা! ছোটো বউকে এখানে আনতে হবে, তার শাশুড়ি তাকে ভারি কষ্ট দেয়।’ এই কথা শুনে মা মনসা বললেন, ‘তাকে আনা হবে না বাপু। কারণ তোমরা ভারি খল জাত, কথায় কথায় রাগ করো। আর সে বেচারি নরলোক হতে আসবে, পদে পদে অপরাধ করবে, আর তোমরা তাকে খেয়ে ফেলবে। তাহলে আমার অভয়া নামে কলঙ্ক হবে।’ এই কথা শুনে অষ্টনাগ বললে, ‘না মা, আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, তা কখনই হবে না। আমরা তাকে কিচ্ছু বলব না। আহা! তার ভারি কষ্ট! তার শাশুড়ি বলে, ছোটো বউয়ের বাপের বাড়ির সবাই মরেছে, কেউ কখনো খোঁজ করে না। তা মা, তুমি তার মাসী হয়ে যাও, গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে এসো। না আনলে আমরা খাব না।’

তখন মা মনসা স্বর্গ হতে মর্ত্যে এলেন। তিনি শাঁখা, সিঁদুর-চুবড়ি, নোয়া ও নথ নিয়ে সওদাগরের বাড়িতে গেলেন। গিন্নি তখন ছেলেদের কাছে বসে বসে সব বউদের নিন্দে করছিলেন। এমন সময় মনসাকে দেখে বললেন, ‘কে গা তুমি, কোথা থেকে এলে?’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি তোমার ছোটো বউয়ের মাসি গো, আমার বোনঝিকে নিতে এসেছি।’ গিন্নি বললেন, ‘সে কি গো! এত দিন কেউ কোথাও ছিল না, এখন মাসি-পিসি কোথা থেকে এল? যা হোক বাপু, তোমাদের মেয়ে তোমরা নিয়ে যাও।’ গিন্নি এই কথা বলতেই মা মনসা একখানি রথ আনলেন। ছোটো বউ সকলকে নমস্কার করে সেই রথে গিয়ে বসল। মা মনসা বললেন, ‘মা, তুমি চোখ বুজিয়ে বসে থাকো, আমি যখন চোখ খুলতে বলবো, তখন চোখ খুলবে।’ ছোটো বউ সেই রকম করে বসে রইল। এদিকে রথ গিয়ে স্বর্গে পৌঁছল। তখন মা মনসা চোখ খুলতে বললেন। ছোটো বউ চোখ খুলে দেখে, সুন্দর বাড়ি; আর সেই আটটি নাগ সেইখানে রয়েছে। ছোটো বউ দেখেই অবাক। মা মনসা বললেন, ‘দেখো মা, তুমি রোজ আমার পুজোর আয়োজন করবে, আর তোমার এই আট ভাইয়ের জন্যে দুধ গরম করে রাখবে। আর একটি কথা এই—তুমি কখনো দক্ষিণ দিকে চেও না।’

এই রকমে কিছুদিন যায়। একদিন ছোটো বউ হঠাৎ দক্ষিণ দিকে চেয়ে দেখলে যে মা মনসা নৃত্য করছেন। সেই অপরূপ নাচ দেখে ছোটো বউ অবাক হয়ে গেল। তখন আর অষ্টনাগের দুধ রাখা হল না। তারপর নৃত্য ভেঙে যেতেই তাড়াতাড়ি এসে দুধ গরম করে রাখলে। অষ্টনাগ এসে সেই গরম দুধে মুখ দিতেই তাদের মুখ পুড়ে গেল। তখন তারা ভারি রেগে বললে, ‘আজ আমরা ওকে খেয়ে ফেলবো।’ এই বলে তারা বাড়ির চারিদিকে পড়ে রইল। কেউ বা মনসাকে বলবার জন্যে রাস্তায় এগিয়ে রইল। মা মনসা এসেই ছেলেদের অবস্থা দেখে বললেন, ‘তখনি তো বলেছিলুম, যে মানুষেরা পদে পদে অপরাধ করে, তখন তোমরা কেউ আমার কথা শুনলে না, এখন আর রাগ করলে কী করব।’ এই কথা শুনে ছেলেরা বললে, ‘তা হোক, আজ আমরা ওকে খাব, আমাদের মুখ পুড়ে গেছে।’ তখন মা মনসা বললেন, ‘তা হবে না, আমার সামনে তোমরা কেউ ওকে খেতে পারবে না। আমি ওকে ওর শ্বশুরবাড়ি রেখে আসি।’ এই বলে তিনি ছোটো বউয়ের এক এক অঙ্গে এক একখানা সব রকম গয়না দিয়ে রথে চড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি রেখে এলেন। আসবার সময় বলে এলেন, ‘দেখো মা! তোমার ভাইয়েরা তোমার ওপর ভারি রেগেছে। তুমি তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ভাইয়েদের খুব সুখ্যাতি করবে, তাহলে তারা আর রাগ করবে না।’ এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন। এদিকে অষ্টনাগ আনাচে কানাচে থেকে শুনতে লাগল, বেনেবউ তাদের নিন্দে করে কি না।

ছোটো বউ বাড়ি যেতেই সকলেই চোখ ঠারাঠারি করে বলাবলি করতে লাগল—‘ওমা! এ কী গো, এক অঙ্গে সোনা পরা, এ আবার ক ঠাট!’ বেনেবউ বুঝতে পেরে বললে:

‘বেঁচে থাক আমার আড়োন নাগ, পাড়োন নাগ,
ঢোঁড়া, বোড়া, পুঁয়ে;
বেঁচে থাক আমার আরুল পারুল কেউটে,
যাদের পাকেন মাসি নিয়ে।

বেঁচে থাক আট ভাই যার,
সোনার নূপুর পায়ে তার।
এবার এসেছি এক অঙ্গে পরে,
আবার আসব দু অঙ্গে পরে।

আমার গয়নার ভাবনা কি, তাড়াতাড়ি আসতে সব পরা হয়ে উঠল না।’ জায়েরা সকলে শুনে অবাক, ভয়ে কেউ কিছু বললে না। সাপেরা তখন ফিরে গিয়ে বললে, ‘মা! দিদিকে আর খাওয়া হল না। সে আমাদের কত সুখ্যাতি করছে, কত আশীর্বাদ করছে। তাকে আবার এনে আর এক অঙ্গের গয়না দাও, নইলে নিন্দে হবে।’ মা মনসা তখন খুশি হয়ে গয়না ও কাপড় নিয়ে বললেন, ‘না বাবা! তোমাদের আর আনতে গিয়ে কাজ নেই, আমিই যাচ্ছি, এই সব দিয়ে আসব এখন।’ এই বলে তিনি স্বর্গ থেকে সওদাগরের বাড়িতে গেলেন। ‘কোথায় গো বিয়ান!’ বলে ডাকতেই, ছোটো বউ তখন ‘মাসিমা এসেছেন!’ বলে পায়ে লুটিয়ে পড়ল। মা মনসা একে একে সব গয়না ও কাপড় পরিয়ে দিলেন। যাবার সময় বললেন, ‘মা! আমি তোমার মাসি নই, আমি মনসা। তুমি এই পৃথিবীতে আমার পুজো প্রচার করবে। আমি ফণীমনসা গাছে সর্বদা থাকি। দশহরা ও নাগপঞ্চমীর দিনে ওই গাছ এনে আমার পুজো করবে, আর ভাদ্র মাসে অরন্ধনের দিন শুদ্ধাচারে পুজো করে আমাকে পান্তা ভাতের সাধ দেবে। যে আমাকে ওই রকম পুজো করবে, তার কখনো সাপের ভয় থাকবে না।’ এই কথা বলে তিনি সওদাগরের বাড়ি থেকে অন্তর্ধান হলেন। তারপর ছোটো বউ, শাশুড়ি ও জায়েদের কাছে এই সব কথা আগাগোড়া বলতে লাগল। এই সব শুনে শাশুড়ি ছোটো বউকে খুব ভালোবাসতে লাগল, স্বামী সোনার চক্ষে দেখলেন, ছোটো বউয়ের সুখ আর ধরে না। সেই থেকে তাঁরা মা মনসার পুজো করতে লাগলেন। ক্রমে পাড়াপড়শীরাও পুজো করতে লাগলেন। এই রকমে মা মনসার পুজো পৃথিবীতে প্রচার হল।

মনসার কথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *