অগ্রহায়ণ মাসের কুলুই মঙ্গলবারের কথা
এক ব্রাহ্মণের ঘরে মঙ্গলচন্ডীর ঘট ছিল। ব্রাহ্মণের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়েটি আইবুড়ো, সে ফুল তুলত, চন্দন ঘষত, ঠাকুর-ঘরের পাট করত—মঙ্গলচন্ডীর প্রতি তার বড়োই ভক্তি ছিল। একদিন পুজোর আয়োজন করতে গিয়ে সে দেখলে, একটি যমককলা ঠাকুরঘরে রয়েছে। কলাটি পাঁচ বার নেড়ে চেড়ে দেখে মনে করলে, এ কলায় তো ঠাকুরপুজো হবে না, তবে আমি এটি খাই। এইবলে কলাটি খেয়ে ফেললে। কিছুদিন পরে মেয়ের চোখের কোলে কালি পড়তে লাগল—অরুচি, কিছু খায় না। বাপ বলে, আমার মেয়ের কী হল! মা বলে কী হল! পাঁচজন গিন্নিকে দেখান হল—সকলেই কানাকানি করে। তার মধ্যে একজন বললে, ‘সর্বনাশী করেছিস কি! তোর মেয়ে যে পোয়াতি! এত বড়ো আইবুড়ো মেয়ে ঘরে থাকতে, পেটে ভাত যায় কেমন করে?’ মা-বাপ কী করেন, সমাজের ভয়ে মেয়েটিকে বনবাস দিয়ে এলেন। বনে থাকে, থাকতে থাকতে দশমাস দশদিনে চাঁদের মতো যমক ছেলে হল। মা মঙ্গলচন্ডী বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশে দেখা দিলেন, পোয়াতিকে বনের ভেতর একটি কুঁড়েঘরে নিয়ে গিয়ে রাখলেন।
ছেলে দুটি চাঁদের মতো দিন দিন বাড়ে। অরণ্যবিজন-বন, নদীর ধারে চন্ডীতলায় মা-চন্ডী ছেলে দুটিকে নিয়ে থাকেন। মা-চন্ডী আদর করে ছেলে দুটির নাম রাখলেন আকুলী ও সুকুলী। নদী দিয়ে মহাজনী নৌকা যায়, যার যে মাল থাকে সবাই চন্ডীতলায় সব রেখে যায়। আকুলী-সুকুলী একদিন নদীর ধারে গাছের তলায় খেলা করছে, এমন সময় এক বেনে সওদাগর সাতডিঙা ধন নিয়ে বাণিজ্য করতে যাচ্ছে। আকুলী-সুকুলী তাকে ডেকে বললে, ‘তোমাদের নায়ে কী আছে ভাই? দিয়ে যাও না, আমাদের বড়ো ক্ষিদে পেয়েছে।’ বেনে বললে, ‘আমাদের নায়ে কিছুই নাই, কেবল লতাপাতা আছে, খাবি?’ ‘তোমাদের তাই হোক’ বলে আকুলী-সুকুলী হাসতে হাসতে চলে গেল। সওদাগর চেয়ে দেখে, নৌকার ধন-কড়ি, জিনিসপত্র কিছুই নাই, কেবল চারিদিকে সাপ ফোঁস ফোঁস করছে। তখন সওদাগর ছুটে গিয়ে ছেলেদুটির পায়ে ধরে বললে, ‘বাবা, আমার সর্বনাশ হয়েছে, রক্ষা করো। তোমরা কে বাবা বলো, তোমাদের অর্ধেক ধন দেব, আমার ভালো করে দাও।’ আকুলী-সুকুলী বললে, ‘আমরা কেউ নই, আমরা ভালো করতেও জানি না, মন্দ করতেও জানি না। আমাদের মায়ের কাছে চল, দিদিমা আছেন, তিনি তোমাদের ভালো করবেন।’ এইবলে মা মঙ্গলচন্ডীর ঘরে নিয়ে গেল। মা মঙ্গলচন্ডী বললেন, ‘জানিস না, আমার ব্রতদাসের অপমান কচ্ছিস! যা, ঘরে গিয়ে কুলুই চন্ডীর পুজো করগে যা। অগ্রহায়ণ মাসের চারটে মঙ্গলবারে উঠানে আলপনা দিয়ে কুলগাছের ডাল বসিয়ে, ঘট স্থাপনা করে, জোড়াকলা, জোড়াফুল, চিঁড়ে, পাটালি দিয়ে, ধান দূর্বার অর্ঘ্য গড়ে পুজো দিবি। পাঁচ এয়ো এক জায়গায় বসে আকুলী-সুকুলীর কথা শুনে সেই ঘটের কাছে বসে ফলার করবে, যে-যা কামনা করবে, তার সেই কামনা পূর্ণ হবে। দেখগে যা, তোর নৌকাতে যেমন ধন ছিল তেমনি আছে।’ সওদাগর সেখানে গিয়ে দেখে যে, সবধন ঠিক আছে। তখন সে ঘরে গিয়ে মা মঙ্গলচন্ডীর পুজো প্রচার করলে। আর সেইবনে মায়ের মন্দির করে দিলে। এখানে মা মঙ্গলচন্ডী একদিন আকুলী-সুকুলী আর তার মাকে সঙ্গে করে সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘তোমার মেয়ে সতী-সাধ্বী, জোড়া কলা খেয়েছিল বলে এই আকুলী-সুকুলী দুটি ছেলে হয়েছে। এ দুটি আমার ব্রতদাস। এদের যে অযত্ন-অভক্তি করবে, তার সর্বনাশ হবে। তুমি এদের নিয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না করো।’ এই বলে মা মঙ্গলচন্ডী অন্তর্ধান হলেন। সেই দেশের রাজাকে মা-চন্ডী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, ‘অমুক ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলের বিয়ে দেবে। তা-না হলে তোমার ছেলে বাঁচবে না।’ রাজা তখন ভয়ে ভয়ে সেই ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে খুব ঘটা করে নিজের ছেলের বিয়ে দিলেন। আকুলী-সুকুলীকে সকলে দেবতার মতো পুজো করতে লাগল। ব্রাহ্মণের খুব ধন-দৌলত হল। চন্ডীর মাহাত্ম্য দেখে সকলে অগ্রহায়ণ মাসে কুলুই মঙ্গলবারের ব্রত করতে লাগল। এই রকমে পৃথিবীতে কুলুই মঙ্গলচন্ডীর ব্রত প্রচার হল। এ ব্রত করলে কখনও কুলে কলঙ্ক হয় না; সুতরাং সকল স্ত্রীলোকেরই এ ব্রত করা উচিত। নিম্নের কথাটি বলে জল খেতে হয় :
‘আটকাটি ষোল মুটি
সোনার মঙ্গলচন্ডী রূপার ভারা
কেন মা চন্ডী এত বেলা!
হাসতে খেলতে, পাটের কাপড় পরতে,
সোনার দোলায় দুলতে,
নির্ধনীকে ধন দিতে, অপুত্রের পুত্র দিতে,
আইবুড়োর বিয়ে দিতে, অন্ধের চক্ষু দিতে,
অন্তকালে স্বর্গ পেতে করোনা ছলা।।’
অগ্রহায়ণ মাসের কুলুই মঙ্গলবারের ব্রতকথা সমাপ্ত।