1 of 2

পৌষ মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা

পৌষ মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা

এক ব্রাহ্মণীর বড়ো কষ্ট, পাঁচটি ছেলে আর একটি মেয়ে। মেয়েটি বড়ো; ছেলেগুলি ছোটো, তাদের বাপ নেই, কাজেই অতিকষ্টে একবেলা একমুঠো অন্ন জোটে। একদিন মেয়েটি বললে, ‘মা! তুমি মামির কাছে যাও না, যদি তিনি কিছু পয়সাকড়ি দেন।’ তখন কোলের ছেলেটিকে কোলে করে ব্রাহ্মণী আপনার ভাজের কাছে গেলেন। ভাজ বললেন, ‘কীগো! কী মনে করে?’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘আর বোন, খেতে পাইনি, ছেলে-মেয়ে না-খেতে পেয়ে মারা গেল। বউ, দাদা যদি দয়া করে কিছু দেন তাই এসেছি।’ বউ বললেন, ‘তাঁকে আর এসব কথা কী বলব, তুমি রোজ এসে আমার কাজকর্ম করে, চালডাল ঝেড়ে দিয়ে যেও, আর খুদ-কুঁড়ো যা পড়বে নিয়ে যেও।’ ব্রাহ্মণী পেটের জ্বালায় রোজ রোজ তাই করেন। একদিন তিনি বললেন, ‘বউ! দুটি লাউ পাতা দেবে?’ বউ বললেন:

ঢোলা ঢোলা লাউয়ের পাতা।
তোমার ভাইয়ের গোণা গাঁথা।।

তবে, ‘যদি আমার মাথার দুটো উকুন বেছে দিয়ে যেতে পারো, তাহলে দুটো লাউ পাতা দেব।’ ননদ বললেন, ‘বউ! আজ লক্ষ্মীবার উকুন যে দেখতে নেই, কাল এসে উকুন বেছে দেব, ছেলেরা আমার সমস্ত দিন না-খেয়ে আছে, আমি এখন যাই বউ।’ তখন লাউ পাতা দেওয়া দূরে থাক; খুদগুলিও আঁচল থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘মর আবাগী, নিজের মঙ্গলটি জানো আর ভাইয়ের মঙ্গল খোঁজো না? আজ লক্ষ্মীবার, বাড়ি থেকে খুদগুলো বার করে নিয়ে যাচ্ছ?’ ননদ তখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির বার হয়ে চলে গেলেন।

পথে যেতে যেতে তিনি ভাবলেন, আজ যা সামনে পাব তাই খাব। দেখেন একটা খুব খুব বড়ো কেউটেসাপ মরে পড়ে আছে। সেই সাপটাকে নিয়ে বাড়ি গেলেন, মনে করলেন, আজ এই সাপটাকে সিদ্ধ করে খেয়ে সবাই মরব। কুটি কুটি করে কুটে একটা নতুন হাঁড়িতে করে উনুনে চড়িয়ে জ্বাল দিতে লাগলেন। যতই জ্বাল দেন ততই সোনার ফেনা উঠে, ক্রমে ঘর-দরজা সব ভরে গেল। আহ্লাদে আর তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই। বড়ো ছেলেটি এক খুরি ফেনা নিয়ে সেকরার দোকানে গেল, সেকরা এক খুরি টাকা দিলে। সেই টাকায় চাল, ডাল, নুন, তেল সব কিনে আনলে। তখন তাঁদের লক্ষ্মীপূজা করবার ইচ্ছা হল। গিন্নি বললেন, ‘আজ লক্ষ্মীবার, যখন আমাদের এত টাকা হল তখন মা লক্ষ্মীর পূজা করি।’ এই ঠিক করে তিনি স্নান করে এসে শুদ্ধ আচারে রান্না করলেন; ঘরে চৌকি পেতে আলপনা দিয়ে নতুন ধান এনে পিঠে-পায়েস করে মা লক্ষ্মীর পূজা করলেন; ব্রাহ্মণ খাওয়ালেন, পাড়ার সকলকে প্রসাদ দিয়ে শেষে নিজেরা খেলেন। সেই সোনাতে সকলের দুঃখ-কষ্ট দূর হল। ক্রমে দাস-দাসী, লোক-লশকর, হাতি, ঘোড়া, রাজার বাড়ির মতো বাড়ি হল, ছেলেদের বিয়ে হল, প্রতিমার মতো বউ এল; মেয়েটিকে সে দেশের রাজার ছেলে বিয়ে করে নিয়ে গেলেন। আর কোনো কষ্ট নেই, সকলে সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন। ভাজ এইসব কথা শুনে ভাবলেন, ঠাকুরঝি এর মধ্যে এত বড়োমানুষ কী করে হল? একদিন তাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। তাদের বউ-ঝি সকলেই গায়ে এক-গা গয়না পরে, নিজেদের ঘরে খেয়ে, পালকি চড়ে নিমন্ত্রণ রাখতে গেল। তারা আসতেই বউ ‘ভাগনি, ভাগনি’ বলে বউদের মুখে চুমু খেয়ে আদর করে ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর আসন পেতে ঠাঁই করে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ভাত বেড়ে দিলেন। বউয়েরা গায়ের সব গয়না খুলে আসনের উপর রেখে বলতে লাগল:

সোনা-দানার বড়ো মান্য,
সোনার কল্যাণে নেমতন্ন।
ঢোলা ঢোলা লাউয়ের পাত,
খাও সোনা পিঠে ভাত।

তখন ব্রাহ্মণীর ভাজ বললেন, ‘ঠাকুরঝি! তোমার ঝি-বউয়েরা সব কী বলছে গো? ওরা কিছু খাচ্ছে না কেন?’ ননদ বললেন, ‘তুমি ত ওদের খেতে বলোনি? সোনা-দানাকেই নিমন্ত্রণ করেছ। যখন আমার দুঃখ-কষ্ট ছিল, দুটো লাউয়ের পাতাও দিতে পারোনি, আঁচল থেকে খুদগুলি পর্যন্ত ঢেলে নিয়েছিলে, মনে আছে কি?’ তখন ভাজ ননদের হাত ধরে কাঁদতে লাগলেন; সুখের সময় ভাই-ভাজ আপনার হল। তিনি আপনার বউ-ঝি নিয়ে ঘরে গেলেন। কিছুকাল সুখে-স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে তিনি স্বর্গে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, ‘তোমরা সব আমার মতো মা লক্ষ্মীর পূজা করবে, তাহলে তোমাদের কখনও কোনও কষ্ট হবে না।’ সেই অবধি পৃথিবীতে লক্ষ্মীপূজা প্রচার হল।

পৌষ মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *