অরণ্য ষষ্ঠীর কথা
এক ব্রাহ্মণীর তিন ছেলে, তিন বউ। ছোটো বউটির বড়ো নোলা, সে লুকিয়ে মাছ দুধ খেয়ে বলত যে, বেড়ালে খেয়ে গেছে। তাদের বাড়িতে একটি কালো বেড়াল ছিল, তারই নামে সে দোষ দিত। সেটি ষষ্ঠীর বাহন, তার নামে মিছে করে রোজ রোজ দোষ দিতে, সে মা ষষ্ঠীর কাছে গিয়ে বলে দিলে। বউ কিন্তু রোজ খায়, আর বেড়ালের নামে দোষ দেয়। কিছুদিন পরে ছোটো বউ পোয়াতি হল। দিন যায়, মাস যায়, দশ মাস দশ দিনে চাঁদের মতো একটি ছেলে হল। রাত্রে ছেলে কোলে করে পোয়াতি শুয়ে আছে, সকালে উঠে দেখে যে ছেলে নেই। ছোটো বউ কেঁদে কেটে আকুল হল। সকলে আনাচে কানাচে খুঁজলে, কোথাও ছেলে পাওয়া গেল না। এমনি করে ক্রমে ক্রমে সাতটি ছেলে আর একটি মেয়ে হল, কিন্তু সবই গেল। তখন সকলে বলতে লাগল, ‘তাইতো, গো! একি আশ্চয্যি! রোগ নয়, বালাই নয়, ছেলে কোথায় যায়? তবে বউটা বোধ হয় রাক্ষসী! রাত্রে ছেলেগুলিকে খেয়ে ফেলে, আবার সকালে লোক-দেখানো মায়াকান্না কাঁদে। এমন মেয়ে মানুষ ঘরে রাখতে নেই বাপু! ওর বাতাস গায়ে লাগলেও দোষ হয়।’
ছোটো বউ আড়াল থেকে সেই কথাটি শুনতে পেলে, তখন সে মনের ঘেন্নায় দুঃখে বনে চলে গেল। বিজন বনে বসে বসে কাঁদছে, দেখে মা ষষ্ঠীর বড়ো দয়া হল। তিনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে এসে বললেন, ‘কে তুমি গা! কাদের মেয়ে!’ ছোটো বউ কেবল কাঁদে, কিছুই বলে না। মা ষষ্ঠী কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোমার কী হয়েছে বাছা, বল না? তুমি কাঁদছ কেন? ঘরে যাও, এখনি বাঘ ভালুকে খেয়ে ফেলবে।’ ছোটো বউ তখন চোখের জল মুছে বললে, ‘তুমি কে গা মা! তোমার কি ছেলে পুলে আছে?’ ষষ্ঠী বললেন, ‘ষাট ষাট, আছে বই কী।’ ছোটো বউ বললে, ‘তবে আমার মুখ দেখো না মা, আমি বড়ো পাপিষ্ঠা। আমার সাত ছেলে এক মেয়ে, তার একটিও নেই। সংসারে সকলে আমায় ঘেন্না করে, তাই এই বনে বসে বসে কাঁদছি। বাঘ ভালুকে খায় তো খাক, আর যন্ত্রণা সহ্য হয় না। বড়ো জ্বালায় জ্বলছি মা।’ তখন ষষ্ঠী বললেন, ‘ও আবাগির বেটি। বড়ো যে লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ দুধ খেয়ে বেড়ালের নামে দোষ দিতিস, তাই তোর অমন হয়েছে।’ ছোটো বউ তখন তাঁর পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়ল, বললে, ‘মা, তুমি কে মা। দয়া করে আমায় বলো:
আমি খেয়েছি কোণে,
তুমি থাক বনে,
এ কথা জানলে কেমনে?
তুমি কে মা আমায় বলতে হবে। আর যাতে আমার সে পাপের খন্ডন হয়, তাও করতে হবে।’ তখন মা ষষ্ঠী বললেন, ‘ওই পথের ধারে একটা পচা বেড়াল পড়ে আছে। এক হাঁড়ি দই এনে তার গায়ে ঢেলে দিয়ে আবার সেই দই চেটে চেটে হাঁড়িতে তুলে নিয়ে আসবি। তাহলে তোর ছেলেকে বাঁচিয়ে দেব। কী করে, ছোটো বউ প্রাণের দায়ে এক হাঁড়ি দই এনে সেই পচা বেড়ালের গায়ে ঢেলে দিলে। গায়ে দই দিতেই পোকা বিজ বিজ করে উঠল। সেই পোকাশুদ্ধ দই জিব দিয়ে চেটে হাঁড়িতে তুলে নিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে এল। ছোটো বউয়ের যতগুলি ছেলে হত, বেড়ালে মুখে করে এনে সব মা ষষ্ঠীর কাছে দিত। মা ষষ্ঠী সেই সাতটি ছেলে একটি মেয়ে এনে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও বাছা! তোমার ছেলেগুলি নিয়ে ঘরে যাও, আর এই দইয়ের ফোঁটা সকলের কপালে দাও। আর কখনও চুরি করে খেয়ে বেড়ালের নামে দোষ দিও না। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল ষষ্ঠীতে পিটুলির কালো বেড়াল গড়ে, পিটুলির কঙ্কন গড়ে, ফল-মূলের বাটা সাজিয়ে, ছয়টা পান, ছয়টা সুপারি, ছয়টা কলা, আর বাঁশপাতায় হলুদের নেকড়া জড়িয়ে, ছয়গাছি সুতা পাকিয়ে তাতে বাঁধবে। এই সুতাকে সাট সুতা বলে। তারপর তেল-হলুদ-দই দিয়ে অরণ্য ষষ্ঠীর পুজো করবে। পুজোর পর সেই সাট সুতা প্রত্যেক ছেলের কপালে হলুদ ছুঁইয়ে ডান হাতে বেঁধে দেবে। যতগুলি ছেলে ততগুলি সুতা চাই। তারপর কথা শুনে ফল-মূল খাবে, ফলার করবে। সেদিন ভাত খাবে না। আর ছেলেদের কখনও বাম হাতে মেরো না, আর মরে যা বলে গালাগালি দিও না। বেড়ালকে কখনও চুরি করে লাথি মেরো না, আর কখনও চুরি করে খেয়ে তার নামে দোষ দিও না। সকলকে যত্ন করবে, তা হলে জ্যাঁচ* পোয়াতি থাকবে। এই কথা বলেই মা ষষ্ঠী অন্তর্ধান হলেন।’
ছোটো বউ তখন কোলে কাঁকে, আগে পাছে ছেলেদের নিয়ে ঘরে গিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শাশুড়িকে ও জায়েদের সকলকে সব কথা বললে। তখন ছোটো বউকে সকলে ভালোবাসতে লাগল, ছেলে দেখে সকলে আশ্চয্যি হল, স্বামীও খুব ভালোবাসতে লাগল। জায়েদের ছেলে হয়নি, তারা ছোটো বউয়ের কাছ থেকে ষষ্ঠীর পুজো জেনে নিয়ে পুজো করতে লাগল। ক্রমে তাদেরও ছেলে-মেয়ে হল। এখন ছোটো বউয়ের আর সুখ ধরে না। ছোটো বউ ঘটা করে ছেলেদের বিয়ে পৈতে দিলে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে জামাই আনলে। জামাইকেও ছেলেদের মতো প্রতি জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠীর দিন দইয়ের ফোঁটা দিলে, আম কাঁঠালের বাটা দিলে। তাই দেখে জায়েরাও ছেলের মতো জামাইকে বাটা দিতে লাগল। ক্রমে ওই দিনটা জামাই ষষ্ঠী, বা ষষ্ঠীবাটা কথা হয়ে উঠলো। মা ষষ্ঠীর কৃপায় বাড়িশুদ্ধ সকলে সুখে-স্বাচ্ছন্দে ঘরকন্না করতে লাগল। দেশ-বিদেশে এই ছোটো বউয়ের কথা রাষ্ট্র হল। ক্রমে চারিদিকের লোকেরা মা ষষ্ঠীর পুজো করতে লাগল। এই রকমে অরণ্য ষষ্ঠীর পুজো পৃথিবীতে প্রচার হল।
অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতকথা সমাপ্ত।
______________________
* যে মায়ের একটিও ছেলে বা মেয়ে মরে নাই, তাকে জ্যাঁচ পোয়াতি বলে ।