স্মৃতি নিয়ে তাঁর…- সুপর্ণকান্তি ঘোষ
আমি যখন জন্মাই, তখন সব কিছুর বনিয়াদ ছিল অনেক গভীরে৷ ঘর বাড়ির যেমন ছিল পাকা ভিত, মোটা দেওয়াল, চওড়া খিলান, পেল্লাই পাল্লার জানালা দরজা আর উঁচু সিলিং, তেমনই প্রস্থে-উচ্চতায়, ঘাড়ে-পাঞ্জায়, কৌলীন্যে-কেতায়, মর্জি-মেজাজে আর মাঞ্জায় দূর থেকেই চেনা যেত বনেদি বঙ্গজদের৷ আভিজাত্যের মাপ হত রতি-ভরিতে, আট আনা চার আনায় নয়৷ সব ক্ষেত্রেই ছিল সেরাদের রাজ্যপাট, রাজায় রাজায় ওঠা বসার দিন৷ মুড়ি ও মিছরি নিজের নিজের দামে আলাদাই বিকোত৷ কৌলীন্য কথাটা তখনও কৌলীন্য হারায়নি, ওটা পরম্পরাই ছিল৷ বিষয়টা হঠাৎ গরম পড়ার মতো কিছু ছিল না৷ আমার পরম সৌভাগ্য আমি এমন এক নক্ষত্রের আত্মজ, যাঁর সূত্রে গুণে-গরিমায় ভুবনজোড়া আসন পাতা শ্রুতকীর্তি সেই সব মানুষেরা আমার কাকা পিসি হয়ে গিয়েছেন জন্মসূত্রেই৷ এটাও তো ওই সময়েরই আবির-চন্দন৷
অনেকবারই জীবনের কোনও বাঁকে নির্জনে নিজের কাছে দু’দণ্ড বসলে ঈশ্বরের ওপর অভিমান করেছি জীবনে অনেককে হারিয়েছি বলে৷ বারো বছর বয়সে মা-কে, সতেরোয় বাবা৷ জীবনের মহার্ঘ এত কিছু হারিয়ে আমার যৌবনকেও হারিয়ে ফেলেছি দৈন্যে, অনটনে৷ ছোট ছোট দুই বোনকে নিয়ে আমার অনাথ সংসারের চাকা যাতে গড়ায়, তার তেল জল জ্বালানির বন্দোবস্ত করতে গিয়ে যৌবনের মৌবন বলে যে কিছু আছে তা টেরই পাইনি আর পাঁচজনের মতো৷ আড্ডা কাকে বলে জানতামই না৷ অথচ কী আশ্চর্য, গৌরীকাকাকে (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) চেপে ধরে আড্ডা নিয়ে একটা যুগান্তকারী গান গড়িয়ে তাতে সুরও বসিয়ে ফেললাম এক ছিলিম আড্ডা না মেরেই৷ তাও আবার ইতিহাস হয়ে গেল৷
আমার এই জীবন পূর্ণ হয়েছে মানাকাকুর (শ্রদ্ধেয় মান্না দে) কাছেই৷ আমি পরম বিশ্বাস থেকেই স্বীকার করি মানাকাকুকে (আমার বাবার চাইতে উনি বয়সে বড় হলেও আবাল্য আমি ওঁকে ‘মানাকাকু’-ই বলি, আর উনি আমায় ‘খোকা’ নামেই ডাকেন) না পেলে এই সুপর্ণ সম্পূর্ণই হত না৷ আজ বেশ বুঝি, আমি আদতে কিছুই হারাইনি৷ আমার মা, আমার বাবা, আমার ‘সারা জীবনের গান’, আমার না-মারতে-পারা ‘কফি হাউসের আড্ডা’, মাঠে না নেমেও আমার ‘খেলা ফুটবল খেলা’— সব ওই একজনের মধ্যে আমি পেয়ে গিয়েছি৷ এমনকী রাধাকান্ত নন্দী, টোপাদা, গৌরীকাকা, পুলককাকা— আমার জীবনের যা কিছু, সব৷ হি ইজ অল ইন ওয়ান ফর মি৷
মানাকাকুকে প্রথম কবে দেখেছি তার সাল মাস মনে পড়ছে না, তবে এটুকু মনে আছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি হবে৷ ‘ছোটা সা সওয়াল’ নামে একটা হিন্দি ছবির রেকর্ডিং-এ৷ অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেই ছবির প্রযোজক, আর আমার বাবা নচিকেতা ঘোষ সঙ্গীত পরিচালক৷ মানাকাকু এলেন৷ আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি৷ মানাকাকুর মাথার চুল তখনও অতটা ফাঁকা হয়নি৷
মানাকাকু বান্দ্রায় থাকতেন৷ বান্দ্রার বাড়ির অনেক গল্প আমি শুনেছি, কিন্তু সে বাড়িতে কোনও দিন যাইনি৷ এরপর মানাকাকু বাড়ি করেন ভিলে পার্লেতে৷ বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘আনন্দন’৷ আমি ওটাকে বাড়ি বলি না, বলি স্বপ্নপুরী৷ মানাকাকু মানুষটার অনুপম সৌন্দর্যচেতনার একটা রূপ যেন ‘আনন্দন’৷ ওর স্থাপত্য শৈলীর কাছাকাছি একটা বসতবাড়ি আজও আমার চোখে পড়েনি৷ মর্মরে আমর্ম খচিত ‘নন্দন’-এর আলোছায়া, মাধুর্য ও লাবণ্য জড়ানো ওই আনন্দন৷ সে বাড়িতে বেশ ক’বার গিয়েছি বাবার সঙ্গে৷ শুধু গিয়েছি বললে সবটা বলা হবে না৷ গিয়েছি এবং থেকেওছি৷ সেই সূত্রে আজও স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে রসনার কিছু অনাঘ্রাত স্বাদ৷ আন্টির (মানাকাকুর স্ত্রী) হাতে কলাপাতা দিয়ে মুড়ে রাঁধা ভাপা পমফ্রেট মাছ৷ আমি পেটুক মানুষ৷ ভোঁদড়ের চেয়েও মাছ খেতে বেশি ভালবাসি৷ এতদিন পরেও আন্টির রাঁধা আরও নানারকম ফাটাফাটি মেনু খাওয়ার পরেও ওই পমফ্রেটের স্বাদ আমার স্মৃতিতে কোনও এক অসামান্য গানের মতোই রয়ে গিয়েছে৷
মানাকাকু তখন বম্বেতে থাকেন৷ আমরাও তখন সেখানেই৷ এরপর কলকাতায় ফিরে বাবা প্রথম বাংলা ছবিতে সুর করেন ‘শেষ থেকে শুরু’৷ আমার মনে হয়, ওই প্রথম ছবি থেকেই বাবা একান্ত নিজস্ব একটা টিম ছকে নিয়েছিলেন মানাকাকু, গৌরীকাকাদের (এবং পরে পুলককাকা) নিয়ে৷ পোটেনশিয়াল ক্রিয়েটিভ মানুষদের তো নিজের একটা ‘ষড়জ’ থাকে, ওটা কারও জন্যই আপস করে পৌনে সওয়া করে নিতে তাঁদের সয় না৷ ‘মেজাজটাই আসল রাজা’ যাঁদের, তাঁরা বিক্রি হন না আধুলি সিকি আনায়৷ সৃষ্টির রতিতে মগ্ন থাকতে তাই তাঁরা সর্বদাই বেছে নেন ষড়জ মিলিয়ে মনের মানুষ৷ মানাকাকু, গৌরীকাকা বাবার সেই ষড়জ মেলানো মানুষ৷ চিরদিনই৷ কী আশ্চর্য দেখুন, এর পরের ছবিই হল ‘চিরদিনের’৷ সেই মানাকাকু, সেই গৌরীকাকাকে নিয়ে বাবার অবিস্মরণীয় সৃষ্টি৷ বাকিটা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে আপনারাও কিছু কম জানেন না৷
এভাবে পরপর ধারাবাহিক ভাবে লিখতে গেলে গোটা একটা বইয়েও কুলোবে না৷ যদিও বাংলা ছায়াছবির আর নন-ফিল্মি (যাকে বেসিক গান বলা হয়) গানের অকথিত ইতিহাসে এই ধারাবাহিকের প্রতিপদেই জড়িয়ে আছে পূর্ণিমার অনন্য বিচ্ছুরণ৷ প্রতিটি গানের বাণীর (গৌরীকাকা) পরতে পরতে জড়ানো সুরের (বাবা) বিচ্ছুরণ আর গায়নের (মানাকাকু) গহন থেকে উঠে আসা এক অবিস্মরণীয় আলেখ্য, যার লিপে অনিবার্যভাবেই উত্তমকাকু৷ এই ষড়জ মেলানো অভূতপূর্ব টিমের অতুলনীয় সৃষ্টিশীলতায় কখনও লম্পট জমিদার, কখনও মাতাল উকিল, কখনও কাজ পাগল সদাশয় ডাক্তার, আবার কখনও বা অন্তর্মুখী প্রেমিকের নানা মুখের নানা রঙের নানা শেডের নানা বাংলা গান গড়ে উঠেছে৷ এমন দ্বিতীয় নমুনা ভারতে কেন, বিশ্বেও বিরল৷ অজিত গাঙ্গুলির পরিচালনায় ‘অগ্নিভ্রমর’ ছবিতে বাবা মানাকাকুকে দিয়ে গাওয়ালেন একটিই গান, চার চারটি আপাত বিরোধী চরিত্রে৷ এর আজও কোনও তুলনা আছে কি?
প্রতিটি গানের নেপথ্যে মিশে আছে এক একটি রত্নময় আখ্যান৷ শুধু তাই নয়, আজকের এই অক্ষমের বিক্রমের বেপথু দিনের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে ওই সব রাজার মতো মানুষদের রুচি, শিক্ষা, চেতনা৷ প্রদর্শিত নয়, সহজাত৷ ছেলেবেলা থেকে সব দিক থেকেই বিরাট মাপের সেই সব মানুষদের নিয়ত নিরবিচ্ছিন্ন সঙ্গ করে আজ টের পাই ছেলেবেলায় বহুবার শোনা ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ’ আপ্তবাক্যটি নিছক কথার কথা নয়৷ ‘দু’কাল গিয়ে তিন’ কালে পা দিতেই যে তার ‘ফল’ ফলতে শুরু করেছে৷ এখন টের পাচ্ছি, চন্দনের বনে বাস করেছি বলেই আজ শ্যাওড়ার বন থেকে শত হস্ত দূরে থাকি৷ এ শিক্ষাও তো পেয়েছি সেই সঙ্গ করেই৷ আমার শৈশবের প্রতিটি দিনই উৎসবের হয়ে উঠত এই চন্দন-সঙ্গে৷ বিশেষ করে মানাকাকু যেদিন আসতেন৷
এত চেনা, এতবার ঘরোয়াভাবে সঙ্গ পাওয়া মানাকাকুর প্রতিবারই সামনে আসাটা আমার কাছে অনিবার্যভাবেই আনন্দময় হয়ে উঠত৷ সে তিনি সাফারি স্যুট পরেই সামনে আসুন, বা শার্ট-ট্রাউজার পরে অথবা আটপৌরে বাঙালির পাজামা-ফতুয়াতে৷ ওঁর উপস্থিতিটাই রাজার৷ ওই মাপের সর্বভারতীয় গানবাজনার আন্তর্জাতিক এই মানুষটির মধ্যে উত্তর কলকাতার সাবেক বাঙালিয়ানার শিকড় ছিল অটুট, অক্ষয়৷
ভারতবর্ষে বহু শিল্পী জন্মেছেন, কিন্তু আমার জীবনপরিধিতে দেখা ও শোনা মানাকাকুর মাপের শিল্পী কোনও দিক থেকেই আর একজনও নেই৷ শিল্পী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও ওঁর জুড়ি নেই৷ ভাবতে পারেন, কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জীবন্ত কিংবদন্তি এই মানুষটিকে তাঁর গানের সুরকারকে চিরদিন বলে আসতে শুনেছি— গানটা কবে শেখাতে আসবেন? অথবা, অমুক দিন ঠিক করুন, গানটা আমি গিয়ে শিখে আসব৷ একদিনও তাঁর মুখে শুনিনি ‘গান তুলে নেব’ বা ‘গানটা দেখিয়ে দিন’— এই ধরনের বাক্যবন্ধ৷ আমার বাবার গানঘরে এসেও শুনেছি তাঁকে বলতে, ‘নচিবাবু, গানটা শিখিয়ে দিন’ বা মজা করে ‘গানটা আমারে শিখাইয়া দেন’৷ আবার পুত্রবৎ এই আমার সুরে পঞ্চাশটিরও বেশি গান গাইবার আগে বলেছেন, ‘অমুক দিন এসে খোকা গানটা ভাল করে আমাকে শিখিয়ে দাও৷’
এখন সুরকারের কাছ থেকে ক্ষমাঘেন্না করে গান ‘তুলে নেওয়া’ই এখনকার স্বঘোষিত শিল্পীদের দস্তুর৷ আগে সহ্য হত না৷ পরে নিজেকে সহ্য করতে শিখিয়েছি এমনটাই ভেবে নিয়ে যে, যে যেমন, যার ভেতরে যেমন, তেমনই তো বের হবে তার মুখ দিয়ে৷ গান যিনি প্রথাগত বিধি মেনে, অনুপুঙ্খ তালিম নিয়ে শিখেছেন, তাঁর কাছে গান বিষয়টা তো জীবনভর শিখে নেবারই৷ আর যারা এদিক সেদিক থেকে খুঁটে খুঁটে গান তুলে এসে শিকে ছিঁড়ে মাচা পেয়ে গেছে, তাদের কাছে গান তো তুলে নেবারই বিষয়৷ সব কিছুই যে আদতে শিকড়ের৷ ভেতরের৷
তো, তখন আমি বাবার গানে রিহার্সাল থেকে ফ্লোরে বাজাই রিদম৷ আমি আশৈশব আর এক অসামান্য মানুষের ভক্ত৷ তিনি পঞ্চমদা (রাহুল দেববর্মন)৷ মানাকাকু আমাদের ভবানীপুরের প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাসায় আসতেন আর কাজকর্মের ফাঁকে যখন বাবার সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলতেন, আমি তখন ওঁদের মধ্যে বসে চুপ করে সব কথাগুলো গিলতাম৷ বোম্বাইয়ের নানা গল্প৷ কে কেমন কাজ করছেন, কে কী গাইছেন৷ আজও মনে আছে, ‘সীতা অউর গীতা’ ছবির ‘অভি তো হাথ মে জাম হ্যায়’ মানাকাকু তাঁর মুগ্ধতার কথা বলেছিলেন৷ শচীন দেববর্মনের সুরে লতাজির গাওয়া ‘খায়ি হ্যায় রে হমনে কসম’ গানটাও মানাকাকুর দারুণ ভাল লেগেছিল৷ সবে স্কোরিং হয়েছে, ছবি তখনও মুক্তি পায়নি৷ এখনও মনে আছে, লতাজির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মানাকাকু৷ পঞ্চমদার কাজ যা চলছিল, তারও নানা সুখ্যাতি৷ আমি হাঁ করে শুনতাম৷ কী যে মুগ্ধতায় মাখা সেই সব রঙিন স্মৃতি৷ আমার তখন পড়াশুনো চলছে, সেই সঙ্গে চলছে বাজানো৷ আস্তে আস্তে বাবার রিদম অ্যারেঞ্জ করছি৷ মাথার মধ্যে পঞ্চমদা সদা জাগ্রত৷ ওঁর রিদম পার্টগুলো ইনকর্পোরেট করতে চেষ্টা করছি বাবার গানে৷ তখন বাবার কাজ চলছে ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘সেই চোখ’ ছবিগুলোর৷ ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবিতে ‘মুশকিল আসান’ গানটার রিদমটা করছি বাবার বকুনি শুনেও৷ মনে আছে, গৌরীকাকার লেখা ‘ফল পাকলে মিঠে, মানুষ পাকলে তেতো’ গানটার কথা৷ বাড়িতে রিহার্সালের সময় বাবা কিছু বলতেন না৷ ফ্লোরে কিন্তু বাবার অন্য রূপ৷ কিছুতেই স্কোরিং-এ আমার রাত জেগে মাথা খাটিয়ে তৈরি করা রিদম প্যাটার্নটা বাবা মানছেন না, বলছেন, ‘ছাড় ওই সব পিড়িং-পুড়ুং করা৷ রাধু (রাধাকান্ত নন্দী), তুই নিজের মতো বাজা তো৷ আমার গান আমার করা সুরেই দিব্যি দাঁড়িয়ে যায়’৷ রাধুবাবু খুশি, হাত খুলে বাজাবার সুযোগ পেয়ে; আর আমার দারুণ মন খারাপ৷ বাবার ওপরে কথা বলার সাহস কারোরই ছিল না, সেখানে আমি তো নস্যি৷ মানাকাকু দূর থেকে ব্যাপারটা বুঝে এগিয়ে এসে বাবাকে বললেন, ‘দিন না বাচ্চা ছেলেটাকে ওর কাজটা করতে৷ ভালই তো লাগছিল, শুনলাম’৷ মানাকাকুর কথা বাবা ফেলতে পারতেন না৷ এখানেও আমার জীবনে মানাকাকু জড়িয়ে গেলেন৷ আমার যে কী ভাল লেগেছিল সেদিন, ওই রকম বোল্ড পার্সোনালিটির মধ্যে একটা ছোট ছেলের জন্য এরকম মিহি স্নেহের প্রশ্রয়টুকুর জন্য৷ সেই বোধহয় রাজার মতো ওই মানুষটাকে আমার ভীষণ কাছের মনে হওয়া৷ মনের একান্তে৷
‘স্ত্রী’ ছবির কাজে এক আকাশে দুটি সূর্যের মতো কাজ করলেন মানাকাকু আর হেমন্তকাকু, বাবারই অনন্য-সাধারণ সুরে৷ এই ছবিতে বাবার গানে বাঁধা পড়েছিল তিন জোড়া নক্ষত্র৷ মানাকাকু ও হেমন্তকাকুর কণ্ঠে গীতিকার হিসেবে গৌরীকাকা ও পুলককাকা, আর অতুলনীয় সেই সব গানগুলির লিপে উত্তমকাকু এবং সৌমিত্রবাবু৷ এমন বিরল ঘটনাও বোধহয় অতীতে ঘটেনি৷ তার পরেও ঘটেছে বলে জানা নেই৷ এরপর ‘আনন্দমেলা’ ছবিটা৷ ‘সন্ন্যাসী রাজা’ তো তারও আগে৷ ভাবুন তো, মানাকাকুর কণ্ঠে বাবার সুরে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে গৌরীকাকার লেখা চার লাইন করে সেই গোটা পাঁচেক গানের কথা৷ সেও তো সর্বকালের ইতিহাস৷
বাবার শেষ ছবি ‘ব্রজবুলি’-তে উত্তমকাকুর লিপে মানাকাকুর একটা গান ছিল৷ গানটা তোতলামো করে গাওয়া৷ কী শক্তিশালী মানুষ এঁরা ভাবুন৷ যেমন গৌরীকাকা, তেমন বাবা, তেমনই মানাকাকু৷ পুরো গানটা তোতলামো কিন্তু হালকা চটুলতার বেসাতি হয়নি৷ ‘মৌচাক’ আর ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবি দুটোর কাজ চলছিল একসঙ্গে৷ এখানেও, আমার মতে, বাংলা গানের চিরদিনের শ্রেষ্ঠ সেই কম্বিনেশন৷ মানাকাকু, গৌরীকাকা আর আমার বাবা৷ ছবি দুটোর গান রেকর্ডিং হয়েছিল বম্বেতে৷ মনে আছে, মানাকাকুর তখন একটা ফিয়াট গাড়ি ছিল৷ নিজেই চালিয়ে আসতেন৷ তখন থেকে শেষ রেকর্ডিংয়েও দেখেছি, আদ্যোপান্ত অকৃত্রিম এই মানুষটা তাঁর গাইবার গানটি শিখে নিতে থাকেন নিজে হাতে গোটা গোটা করে নোটেশন করে নিতে নিতে৷ সুরকারের একান্ত নিজস্ব অনুভবের ‘কড়ি ও কোমল’কে সমান শ্রদ্ধা দিয়ে নোটেশনে অনুপুঙ্খ এঁকে নিয়ে তবে মানাকাকু গাইতে বসেন রেকর্ডে৷
প্রযোজকদের প্রবল ইচ্ছে ছিল ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবির ‘কিচিমিচি কিচিমিচি’ গানটা কিশোরকুমারকে দিয়ে করানোর৷ বাবা ঠিক করেছিলেন গানটা মানাকাকুই গান৷ শেষ পর্যন্ত ‘ঘটনাচক্রে’ মানাকাকুকে দিয়েই রেকর্ড করান বাবা৷ বেশ মনে আছে, রেকর্ডিং শেষ হলে মানাকাকু নিজেই তাঁর ফিয়াট চালিয়ে বাবাকে আর আমাকে লাঞ্চ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বম্বেতে তখন সদ্য সদ্য খোলা ‘কপার্স চিমনি’ রেস্তোরাঁয়৷
১৯৭৬৷ আমি সে বছর সিনিয়র কেমব্রিজ (Indian School Leaving Certificate) দেব৷ বাবা চলে গেলেন৷ সবচেয়ে ছোট বোন তখন ক্লাস সিক্সে৷ খবর পেয়ে মানাকাকু বাড়িতে এলেন৷ ঘরে উত্তমকাকু, হেমন্তকাকু-সহ অনেকে বসে আছেন৷ মানাকাকু ঘরে ঢুকে বাবার সামনেটায় গিয়ে দাঁড়ালেন৷ দু’গাল বেয়ে চোখের জলের ঢল৷ চুপ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ছোট বোনকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েই রইলেন৷ অনেকক্ষণ৷ অঝোরে কেঁদেই চলেছেন৷
মাথার ওপর থেকে বটবৃক্ষের ছায়াটা সরে যেতেই আমি হঠাৎ কঠিন এক সময়ের মুখোমুখি হলাম৷ টিউশন করে কোনও মতে সংসারের হাঁ ভরছি৷ বাইরেটা যতই শতচ্ছিন্ন হোক, ভিতরে তো বইছে নীল রক্তের উত্তরাধিকার৷ চাঁদের অলখ টানের মতো সেখানে যে নিরন্তর জোয়ার ঢেউ তুলছেই৷ ওই টানাটানির মধ্যেও সুরের সেই অলখ টান দু’দণ্ড জিরোতে দেয়৷ শ্বাস নিই সুরের সেই আশ্বাসে৷ বাবার দেরাজ খুলে একদিন পেলাম গুপ্তধনের সন্ধান৷ বাবার বাতিল করে দেওয়া অজস্র গানের ভাণ্ডার৷ এর মধ্যে অধিকাংশই পুলককাকার রচনা৷ বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার গৌরীকাকার বেশ কিছু অসামান্য গানও রয়েছে তার মধ্যে৷ বেশ বুঝতে পারি, এ গানগুলির সুর না পাওয়ার পিছনে অনাভিজাত্যের এতটুকু কালি নেই, বরং কৌলীন্য রয়েছে মহার্ঘ পিতৃত্বের৷ এমন রত্নময় সম্পদের রাশি ক’জন বাবা রেখে যেতে পারেন তার সন্ততিদের জন্য৷ কৃতজ্ঞতায় আমর্ম আপ্লুত হতে হতে আজ মনে হয়, ফ্ল্যাট, গাড়ি, অর্থের চেয়েও ঢের ঢের মহার্ঘ উত্তরাধিকার বাবদ পাওয়া দেরাজভরা ওই গানগুলি, আর তাঁর মেজাজি কৌলীন্য৷ আজীবন যা ভাঙিয়ে খাব৷ চুরি যাওয়ার ভয় নেই, ভয় নেই আয়কর, সি বি আই হানার৷ সারাদিন কাজ সেরে রাতে এসে একান্তে বসি সুরের সঙ্গে সহবাসে৷ সেই গানগুলি থেকে বেছে নিয়ে সুরের আদর জড়াই সদ্য যৌবনের রাজশাহি উষ্ণতায়৷
সাংবাদিক অজয় বিশ্বাস মারফত মানাকাকু খবর পেয়েছিলেন, আমিও সুর করছি৷ একদিন ডেকে পাঠালেন তাঁর মদন ঘোষ লেনের বিখ্যাত বাড়িতে৷ আমার তৈরি গান শোনাতে বললেন৷ দু’একটা গান শোনালাম, ভাল লাগল৷ তারপর আমার হাতে একটা লেখা দিয়ে বললেন, ‘শোনো, তোমায় একটা লেখা দিচ্ছি৷ আরও দু’একজনকে দিয়েছি, তারাও সুর করেছে৷ খোকা, যদি তোমার সুর আমার ভাল লাগে তবেই গানটা গাইব, নচেৎ নয়৷ তুমি মন খারাপ কোরো না তখন৷ গত বছর পুজোয় কাকার (কৃষ্ণচন্দ্র দে) গানগুলো করেছি৷ এ বছর নতুন কিছু করতে চাইছি৷ সুর করো’৷
বেলা বারোটা নাগাদ মানাকাকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা টু-বি বাসে এসে উঠলাম৷ ভিতরে একটা উত্তেজনা৷ ফাঁকা আড়াইতলার একেবারে সামনের সিটটায় গিয়ে বসলাম৷ হাতে মানাকাকুর দেওয়া গানের পাতাটা৷ হু হু করে হাওয়া এসে লাগছে চোখে-মুখে৷ আমি মধ্য দিনে বাসের বিজন বাতায়নে বসে ক্লান্তিহরা এক বিলাসখানি ভোরের আলো মাখছি যেন ভিতরে মনে৷ জীবনে প্রথম সুর করার দায়িত্ব পেয়ে গুনগুন করতে করতে চলেছি, ‘মার স্নেহ কাকে বলে জানি না/বাবার মমতা কি বুঝতে না বুঝতে/এ বিরাট পৃথিবীতে দেখলাম/সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই…’ মুখড়ার সুরটা হেদুয়া ছেড়ে বাসটা ভবানীপুরে পৌঁছানোর আগেই এসে গেল৷ বসেও গেল৷ বাকি সুর এসে গেল তারপর দিন দুই-তিনের মধ্যেই, সব কাজ ফেলে ওই গানটাকে সময় দিতে৷ তখন সবে বি কম অনার্সে নাম লিখিয়েছি; ক’খানা টিউশনি করি তিন ভাইবোনের সংসারটা কোনও রকমে চালাতে৷
মাসখানেক বাদে মানাকাকু কলকাতায় এলেন এবং একদিন ফোন করে বললেন গানটা শোনাতে যেতে৷ আমি গিয়ে গানটা শোনালাম৷ মানাকাকু চুপ করে বসে গানটা মন দিয়ে শুনলেন৷ গান শেষ হতে দেখি মানাকাকুর চেখে জল৷ বললেন, ‘অপূর্ব৷ খোকা, তুমি অনেক দূর যাবে৷ আমি এবার পুজোয় এটা রেকর্ড করব’৷ সেই শুরু সুপর্ণকান্তির নিজের পথে হাঁটতে শেখা৷ এবং হয়ত বাংলা আধুনিক গানে ‘ব্যালাড’-এর সঙ্গে আমার নামটাও জুড়ে যাওয়া৷ তবে যেভাবে বললাম, ভাববেন না শুরুটা তত মসৃণ ছিল৷ মানাকাকুর মতো মাপের শিল্পী আমার মতো একেবারেই নবীন এক সুরকারের সুরে পুজোয় গাইছেন খবরটা জানাজানি হতেই বাধা এল৷ কথার ঝড়ও উঠল৷ আজ বলতে দ্বিধা নেই, বাধা দিয়েছিলেন মূলত দু’জন৷ একজন গ্রামোফোন কোম্পানির তৎকালীন কর্তাব্যক্তি স্বনামধন্য বিমান ঘোষ৷ অন্যজন ওই গানটির গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এঁদের আপত্তির মোদ্দা বয়ানটা ছিল: ‘আপনার মতো একজন শিল্পীর পুজোর গানের সুর করা কি পোলাপানের কাজ?’ মানাকাকু পাত্তা দিলেন না কারও কথায়৷ সোজা বলে দিলেন, ‘আমি এবার খোকার সুরেই গাইব৷’ আমার না বললেও চলবে গানটার জনপ্রিয়তা নিয়ে৷ সকলেই সাক্ষী সেই ইতিহাসের৷
গানটা রেকর্ড করেছিলেন প্রখ্যাত শব্দমুদ্রণ শিল্পী সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এর এক সপ্তাহের মধ্যে ফোন পেলাম ভূপেন হাজারিকার৷ সুশান্তদার কাছে আমার ওই গানটা শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ওঁরও একটা পুজোর গানে আমায় সুর করে দিতে হবে বলে জানালেন৷ বাবার সেই বাতিল গানের ভাণ্ডার থেকে গৌরীকাকার লেখা ‘ও মালিক’ গানটায় সুর দিলাম৷ তার জনপ্রিয়তাও সর্বজনবিদিত৷ নচিকেতা ঘোষ আমার জন্মদাতা পিতা৷ আর মানাকাকু আমার জীবনে পিতাস্বরূপ৷ ‘প্রাপ্তেতু ষোড়শ বর্ষে…’ শ্লোকে পিতা-পুত্রের যে সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, তা আমি অনুপুঙ্খ বুঝে পেয়েছি মানাকাকুর মাধ্যমে৷ ষোলোয় জন্মদাতা পিতাকে হারিয়ে ষোলোআনা সম্পূর্ণ হতে পেরেছি মানাকাকুকে পিতার ভূমিকায় পেয়েই৷
১৯৭৯-তে মানাকাকু করলেন ‘সারা বছরের গান’৷ ১৯৮০-তে পুলককাকা লিখলেন ‘সারা জীবনের গান’৷ মানাকাকুকে দেখাতেই তিনি বললেন, ‘খোকাকে দিন, ও গানগুলো সুর করবে’৷ এরপর আমায় ফোন করে বললেন, ‘পুলকবাবু সাতটা গান নিয়ে যাবে৷ তুমি সুর করো, আমি এবার পুজোয় গাইব গানগুলো’৷ সুর করলাম৷ মানাকাকু শুনলেন৷ একটা নোটও পাল্টালেন না সাতটা গানের কোথাও৷ এমনকী মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের কোথাও এতটুকু প্রশ্ন তোলেননি৷ হে আমার সহৃদয় পাঠক, টের পাচ্ছেন কি, সন্তানের জন্য একজন পিতা কতখানি স্নেহময় হয়৷ নাকি মানাকাকু নিজেই বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁর খোকা তার সুরের গহনে বুনোনে বয়ানে যে নিজস্ব ভাস্কর্য গড়ে, তা চেতনে অবচেতনে তাঁরই জন্য, শরণাগত নিবেদনে৷ মানাকাকু দারুণ প্রশংসা করলেন আমার কুড়ি ছোঁয়া বয়সে সুর করা ‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়’ গানটার সুরের বিতত বিন্যাসে, ‘আমায় চিনতে কেন পারছ না মা’ গানটায় কীর্তন না শিখেই বাংলার কীর্তনের মেজাজ গেঁথে ফেলায়৷
আমি মানাকাকুর মুখে আমার একের পর এক গানের প্রশংসা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, অমন মানুষের কাছ থেকে যে সুরের জন্য প্রশংসা পাচ্ছি, আর জীবনে (তথাকথিত) গ্র্যামি পুরস্কারের চেয়েও সহস্রগুণ মহার্ঘ স্বীকৃতি পাচ্ছি, সেই সুরগুলো কী করে এল আমার মতো ‘পোলাপানের’ নাগালে! অনুভব করলাম, জগতের কোনও মহার্ঘই তৈরি করা যায় না৷ সেটা আসে, আর তা অর্জন করতে হয় শরণাগত হয়ে তাঁর সঙ্গে ষড়জটা মিলিয়ে৷ মেলানও তিনি, গুরু মারফত৷ মানাকাকু আমার সেই গুরু৷
আজ এই অমার্জিত অসংস্কৃতির দিনে ‘গুরু’ শব্দটাও অযোগ্য ব্যবহারের দোষেই তার প্রার্থিত ওজন ও সম্মান হারাতে বসেছে৷ ‘গুরু’র সংখ্যা এত বেড়েছে যে তাকে ‘মহাগুরু’তে কোয়ালিফাই করতে হচ্ছে তাকে গ্লোরিফাই করতে৷ আমি তাই নিকৃষ্ট অর্থে ব্যবহৃত ‘গুরু’ ব্যবহার না করে শব্দটার আদি, অকৃত্রিম মর্মার্থটা হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ধরে বলি ‘মাস্টার’৷ যেমন নিবেদিতা তাঁর গুরুকে বলেছিলেন, ‘মাই মাস্টার’৷ মানাকাকু ইজ মাই মাস্টার৷ আমি একলব্যের মতো তাঁরই শরণাগত৷
এরপর মাস্টার ডিগ্রি করেছি, পেয়ে গিয়েছি একটা চাকরিও৷ চাকরিতে প্রাোমোশন নিইনি কলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে হবে বলে৷ সেও তাঁরই পরামর্শে৷
মানাকাকু ওঁর উচ্চতায় থেকেও প্রতিবারই আমার সুরে গান রেকর্ড করার আগে স্বভাবমতোই আমায় বলেছেন, ‘খোকা, গানটা শিখিয়ে দিয়ে যেও’৷ ওঁর কথামতো শেখাতে গিয়ে নিজেই কত শিখেছি৷ ওঁর মতো মানুষের শিখে নেওয়াটাও শিক্ষণীয়৷ একটা গান কী করে শিখে নিতে হয়, কোনখানে তার হৃদয়টা থাকে, যা শিখে নিলে হাত পা আঙুল-সহ শরীরের সবটা জানা হয়ে যায়৷ মানাকাকুকে গান শেখাতে গিয়ে পূর্ণ অবগাহন করেছি সঙ্গীতের অতলান্ত গহনে৷ এমন ছাত্র পাওয়াও যে-কোনও শিক্ষকের সাতপুরুষের ভাগ্য৷
‘বাবা মেয়ের গান’ শিরোনামে একটা অ্যালবামের কাজে মুম্বই গেলাম মানাকাকু আর সুমিতাকে (মানাকাকুর মেয়ে) গান শেখাতে৷ সকালে মানাকাকুর বাড়ি গেলাম, ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্নও রয়েছে৷ পৌঁছাতে দেরি হল খানিকটা৷ গিয়েই গানে বসে গেলাম৷ ওদিনটায় মানাকাকুরা নিরামিষ খান৷ এক সময় বললেন, ‘খোকা, তুমি সুমিতাকে গানটা শেখাও, আমি এখুনি আসছি’৷ খানিক পরে ফিরেও এলেন৷ দুপুরে খাবার টেবিলে বসে আন্টি জানালেন, আমি একেবারেই নিরামিষ খেতে পারি না বলে মানাকাকু তখন বেরিয়ে ক্লাব থেকে আমার জন্য চিকেন রেশমি কাবাব নিয়ে এসেছেন৷
কত কথা, কত অনুষঙ্গ, কত গান৷ কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি৷ ‘দশ বছরের বংশী, মুচির ছেলে’ গানটা লিখে পুলককাকা খুব আহলাদ করেই মুম্বই গিয়েছিলেন মানাকাকুকে শোনাতে৷ মানাকাকু ও লেখা দেখে বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছিলেন, ‘দূর মশাই, ওইসব মুচি-ফুচির গান আমি গাই না৷ আমি প্রেমের গান গাই, জানেন না?’ পুলককাকা বিরস মনে ফিরে এসে গানটা আমায় দিলেন৷ আমার বিষয়টা মন্দ লাগেনি৷ সুর করে ফেললাম৷ মানাকাকু ক’দিন পরে কলকাতায় এসে যেমন ডেকে পাঠান তেমনি ডাকলেন৷ নতুন কী গান করেছি জানতে চাইলে ওই গানটার কথা বললাম৷ প্রথমে বিরক্ত হলেও সুরটা শোনাতেই বলে উঠলেন, ‘বাঃ, বেশ করেছ তো, মন্দ লাগছে না’৷ গানটা রেকর্ড করলেন৷ রেস্ট ইজ হিস্ট্রি৷ এমনই মানুষ মানাকাকু৷ অসম্ভব জেনুইন৷
১৯৮৩-তে গৌরীকাকাকে দিয়ে একরকম গায়ে পড়েই লিখিয়েছিলাম ‘কফি হাউস’ গানটা৷ মানাকাকুকে শোনাতেই অসম্ভব খুশি হয়ে নিজেই গৌরীকাকাকে ফোন করে গানটা গাইতে চান জানালেন৷ বলতে ভুলে গিয়েছি, ১৯৮০-র ষোলোই আগস্ট ইডেনের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় একটা অসামান্য কবিতা লিখলেন, ‘খেলা ফুটবল খেলা’৷ তাতে সুর করলাম৷ মানাকাকুকে শোনাতে উনি দারুণ চার্জড হলেন৷ রেকর্ড করলেন৷ কী অসামান্য গাইলেন ওই ব্যালাডটির ইনার ড্রামার সবকটা শেড৷ মুগ্ধ হয়ে ভারি, শ্রুতিশুদ্ধ সুরের তাবৎ স্ফুরণের তো কথাই নেই, ভাব ও নাট্যের এমন অভূতপূর্ব প্রকাশেও আমার কাছে মানাকাকু একমেবাদ্বিতীয়ম৷ ফুটবল নিয়ে এর আগে বাঙালির একটাই জনপ্রিয় গান ছিল— বাবার সুরে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে মানাকাকুরই গাওয়া ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’৷
বছর তিনেক আগে বাংলার লোকায়ত ছড়া নিয়ে আমার প্রাোজেক্টটায় মানাকাকুকে দিয়ে রেকর্ড করালাম কটা ছড়ার গান৷ সঙ্গে সংলাপও৷ ফোন করে মানাকাকুকে বিষয়টা জানাই৷ ব্যাঙ্গালোর থেকে যেদিন এলেন, সেদিনই সন্ধেয় যেতে বললেন গানটা শেখাতে৷ গান শুনে চিরদিনের স্বভাবমতো নিজের হাতে গোটা গোটা করে নোটেশন করে নিলেন৷ অমন ডিটেলে নোটেশন করতে আমি আর কাউকে দেখিনি৷
আগেই কথা হয়েছিল রেকর্ডিংয়ের দিন উনি বেলা এগারোটায় স্টুডিওয় আসবেন৷ আমি এবং আমার সহকারীরা প্রাক-প্রস্তুতি নিতে সকাল সকাল পৌঁছে গিয়েছি৷ বকেয়া কাজ কিছু সেরেও নিচ্ছি৷ ঠিক এগারোটায় স্টুডিওর দরজা ঠেলে মানাকাকু ফ্লোরে ঢুকলেন৷ ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘খোকা, ঘড়িটা মিলিয়ে নাও, এখন এগারোটাই বাজে’৷ ঘড়ি মেলাব কি— এত বছর ধরে দেখছি, মানুষটা জীবনে কোথাও পৌঁছাতে একদিনও এক মিনিটও এদিক ওদিক করেননি৷ আমি সব দিক থেকে এমন সম্পূর্ণ মানুষ আর একটাও দেখিনি৷ উনি এলেন, বসলেন, কানে হেডফোনটা লাগালেন, আর নিজের হাতে তৈরি করা নোটেশনের কাগজটা চোখের সামনে ধরে নিখুঁত অনায়াস নৈপুণ্যে ছড়াগানটা গেয়ে ফেললেন৷ এরপর, আমার প্রতি ওঁর অকুণ্ঠ স্নেহের সহজ অধিকারে ওঁকে একটি সংলাপও বলতে বলেছিলাম (জানা নেই, মানাকাকুকে অমন বেআদপ আর্জি জানাবার মতো আর কেউ আছেন কিনা)৷ মানাকাকু আমার কথামতো সংলাপটি বলে দিলেন মাইক্রোফোনের সামনে৷ একটা টেকেই ও কে হল৷ আমার সেই বেআদপ আর্জিটা কী ছিল, শুনবেন? আমি ওঁকে সংলাপটা অতীতের স্বনামধন্য কৌতুকাভিনেতা নবদ্বীপ হালদারের নকল করে করতে বলেছিলাম!
এক ঘণ্টার মধ্যে মানাকাকু কাজ সেরে উঠে যাওয়ার আগে আমি একসঙ্গে দুটো কাগজে ওঁর সই চাইলাম নিয়ম মতো৷ কলমটা চেয়ে নিয়ে প্রথম কাগজটায় কী জন্য তা জানতে চাইলেন৷ আমি বললাম, ‘আপনার এন ও সি ফর রিলিজিং দি অ্যালবাম’৷ এটা শিল্পীদের দিতে হয়, জীবনভর দিয়েও এসেছেন৷ খসখস করে সই করে দিলেন৷ তারপর অন্য কাগজটা দেখিয়ে বললেন, ‘আর এটা?’ আমি ততক্ষণে পকেট থেকে মাত্র পাঁচ হাজারের একটা নতুন নোটের বান্ডিল বের করেছি৷ এখানে বলে রাখি, কাজটা করছিলাম ‘লিভার ফাউন্ডেশন’-এর সাহায্যার্থে৷ ‘আপনার সম্মান মূল্য দেওয়ার মুরোদ আমাদের নেই৷ সামান্য কিছু…’ বলার আগেই মানাকাকু কলমটা রেখে সটান উঠে দাঁড়ালেন৷ বললেন, ‘তোমাদের এই মহৎ প্রাোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, এর চেয়ে বড় পাওনা আর কিছু হয় না৷ এরপর টাকা নেওয়ার কথা ভাবতেই পারি না’৷ এই বলে সকলকে বিদায় জানিয়ে রাজার মতোই ফ্লোর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মানাকাকু৷
সেই ছেলেবেলা থেকেই মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালেই আমার চারপাশটা ভরে যেত উৎসবের বর্ণময়তায়৷ আর যে মুহূর্তে উনি চলে যেতেন, যত ভিড়ের মধ্যেই থাকি না কেন, খাঁ খাঁ শূন্য হয়ে যেতাম৷ সেদিনও নব্বই ছুঁই ছুঁই মানাকাকু চলে যেতেই ফাঁকা হয়ে গেল ফ্লোরটা৷ নাকি, আসলে আমার ভিতরটাই৷ দু’চোখ ভরে জল আসছিল, বারবার৷ এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, আমার চাওয়াগুলো তাঁর দেওয়া অকৃপণ প্রাচুর্যের কাছে কেমন হার মেনে যায়৷ ভাবছিলাম, আমার পঞ্চান্ন বছরের জীবনে শুধু মানাকাকুর জন্য সুর বেঁধেছি পঞ্চাশটার মতো গানে৷ পরক্ষণেই ভাল একটা সুরের মুখড়া পাওয়ার মতো খুশি হলাম এই যোগাযোগটুকুর জন্য— তা হলে, আমার এ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি বছরই যেন এক একটি গানের অর্ঘ্য হয়ে গিয়েছে আমার ‘মাস্টার’ মানাকাকুর জন্য৷
আমি প্রতিদিন সন্ধেয় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে স্নান করে এসে ঢুকি আমার গানের ঘরে৷ প্রতিদিন আমার হারমোনিয়ামটাকে টেনে নিই কোলের খুব কাছে৷ বেলোটা খুলে এক বুক শ্বাস নিয়ে আমার আঙুলগুলো প্রথম যে রীডেই পড়ুক, এই ‘পূরবী’ জীবনে পৌঁছে বেশ টের পাই, হাতটা আসলে আমার মানাকাকুর চরণেই পড়ে৷ পড়ে এসেছে আজীবন, আমার এই জীবনের সন্ধ্যাহ্নিকে৷