সেজকাকু – সুদেব দে

সেজকাকু – সুদেব দে

এমন স্মৃতিকথা লেখার কথা আগে কখনও ভেবে রাখিনি৷ গোটা দেশের ‘মান্না দে’ শুধু আমার প্রাণপ্রিয় সেজকাকু নয়, তিনিই আমার সঙ্গীতগুরু৷ তাঁকে নিয়ে আমার জীবন জুড়ে এত কথা জমে আছে যে কোথা থেকে, কীভাবে শুরু করব তা বুঝতে পারছি না৷ সব হিসেবই গুলিয়ে যাচ্ছে৷ এই লেখা লেখার সময় চোখ চলে যাচ্ছে আমার ঘরে থাকা সেজকাকুর ছবিটার দিকে৷ এখন সবকথাই স্মৃতিকথা৷ তাদের সংখ্যাও কম নয়৷ সব কথা সাজিয়ে লেখা প্রায় অসম্ভব৷ পেশাদার কোনও লেখক হয়ত কাজটা করতে পারতেন৷ সমস্যা আছে আরও, দেশের একজন স্মরণীয় শিল্পী হিসেবে এখন আর কোনও কথাই আর অজানা নেই৷

আমাদের বাড়ির পরিবেশের কথা বোধহয় একটু বলা দরকার৷ সেই বিবরণ হয়ত সকলেই জানেন না৷ নিজেদের বাড়িতে মানুষ মান্না দে খুব স্বাভাবিক সম্পর্কে কারও বাবা, কারও কাকা, কারও ভাই এবং অবশ্যই কারও ছেলে৷ এই মুহূর্তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে৷ বাড়ির ছোটদের সব ধরনের আব্দার মেটানো মানুষটাকে আর কখনও কাছে এসে দাঁড়াতে দেখব না৷ কী ভীষণ শূন্যতা, শব্দহীন হাহাকারে ছেয়ে যাচ্ছে মন৷ আমাদের বাবা-কাকারা সকলেই বড় মাতৃভক্ত ছিলেন৷ কিন্তু ডাকাডাকির ক্ষেত্রে কিছু মৌলিকত্ব আছে৷ আমাদের ঠাকুমাকে আমরা ডাকতাম ‘ঠাকুমা-দিদিভাই’৷ আমাদের বাবা-কাকারা তাঁকেই ডাকতেন ‘বুড়ি’ বলে৷ কিন্তু কাউকে তো মা বলতেই হবে, বাবা-কাকারা ‘মা’ বলে ডাকতেন তাঁদের ঠাকুমাকে৷ সেই গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি-কে আমরা ডেকেছি ‘গিন্নিমা’ বলে৷ বুঝতে পারছি এই ডাকাডাকির প্যাঁচটা কোনও কোনও পাঠকদের কাছে বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে৷ বড় নয়, খুব বড়দের কথা এসে গেল৷ এই কারণে বলা প্রয়োজন আমি আমার ঠাকুর্দা, বাবুজি (কৃষ্ণচন্দ্র দে) আর ‘গিন্নিমা’-কে দেখিনি৷ আমার বাবা (প্রয়াত প্রণব দে) ছিলেন বাড়ির বড় ছেলে৷ তাঁর দিন শুরু হত একেবারে আক্ষরিক অর্থে তাঁর মায়ের ‘পা ধোয়া’ জল খেয়ে৷ এবং এটা ঘটত রোজই, নিয়ম করে৷

আমার ছোটবেলাতেই সেজকাকা ভারত বিখ্যাত মান্না দে৷ এবং তিনি বম্বেতে থাকেন৷ কিন্তু টেলিফোন করা ছাড়া প্রায় প্রতিমাসেই একবার আসতেন৷ তিনি এলেই বাড়ি সরগরম, যেন কোনও মিনি উৎসব৷ খুব স্বাভাবিক কারণে সেদিন আমাদের বাড়িতে জ্ঞানী-গুণীদের আসা-যাওয়া চলত৷ কথাবার্তার মধ্যেই থাকত রেকর্ডিংয়ের নির্ধারিত সময়৷ যদি রেকর্ডিং তাহলে তার আগে কিছু কাজ জড়িয়ে থাকত৷ নিয়ম করে গান তোলা, অনেক বার গাওয়া এবং ঘড়ি ধরে স্টুডিওতে পৌঁছে যাওয়া৷ আমরা, বাড়ির ছোটরা সবাই হাঁ করে সবই দেখে যেতাম৷ কোনওরকম দেখানোপনা নেই৷ সেই ছোটবেলা থেকে সেজকাকুর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি৷ বড় হওয়ার সময়েও কিছু উদাহরণ বুঝতে শিখতে হয়৷ কেন একজন মানুষ বড় হয়ে ওঠেন তার জীবন্ত ছবি৷ বুঝেছি প্রতিভার সঙ্গে বেসিক ডিসিপ্লিন থাকাও জরুরি৷ হয়ত কলকাতা থেকে অনেক দূরে অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়েছিলেন, ফিরতে অনেক রাত হয়েছে, কিন্তু তবুও কখনও দেখিনি পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে বা রেওয়াজে বসতে দেরি হয়েছে৷

যখন সেজকাকা বম্বে থেকে বেশ কিছুদিনের জন্য এসে কলকাতায় থাকতেন, তখন যেন বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত৷ সেই জোয়ার বা তার বড় বড় ঢেউয়ের কারণ কী তা বাড়ির সকলেই বুঝতেন৷ গানের সুর যেমন সারা বাড়িতে ঘুরে বেড়াত, তেমন হাসি-ঠাট্টার সঙ্গতও থাকত৷ রবিবার পড়লেই মাংস এবং আমার ছোটকাকা (প্রভাস দে) ছিলেন অনবদ্য কুক৷ কাকে রান্না করা হবে, তার শরীর কেমন তা-ও জানা দরকার৷ ছোটকাকা তাই নিজে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে গোপালের দোকান থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনতেন৷ অনেক স্বজনের বাড়ি, সুতরাং সেই মাংসের পরিমাণ দাঁড়াত বারো-চোদ্দ কিলো৷ এর পরে শুরু হত সাড়ম্বর জোগাড়ের পালা৷ দিদিরা সকলেই ছোটকাকুর স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট৷ কেউ পেঁয়াজ, কেউ রসুন, কেউ আলু নিয়ে ব্যস্ত৷ মাংসের আলাদা বাসনপত্র, তাদেরও নির্দিষ্ট লগ্নে মাচা থেকে নামানো হত৷ কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে ছোটকাকা কাঁধে গামছা ফেলে যুদ্ধে নেমে পড়তেন৷ অনেকের জন্য রান্না, সুতরাং অ্যাসিস্ট্যান্টদেরও পরিশ্রম করতে হত৷ ছোটকাকার একনম্বর সহকারী ছিল আমার বড়দাদা (মুকুল দে)৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই মাংসের গন্ধে গোটাবাড়ি ম ম করত৷ দমদম থেকে অন্য কাকারাও আসতেন৷

পাঠকদের মনে হতেই পারে আমি প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে কোনও পারিবারিক পিকনিকের কাহিনী লিখছি৷ কিন্তু তা নয়, আমার একদা কুস্তিগির সেজকাকা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে অদ্ভুত আকুলতা মিশিয়ে আহ্বান জানাতেন— ‘ভেলু! আর কতদূর?’ ভেলু আমার রন্ধনশিল্পী ছোটকাকার ডাকনাম৷ সেইসব দিন কিছুটা অনাথ হয়ে স্মৃতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সোনায় মোড়া দিন৷ পৃথিবীতে কোথাও যেন কোনও দুঃখ নেই৷ যদি থাকেও, তাহলে তারা উত্তর কলকাতার সিমলেতে ঢুকতেই পারত না৷ কখনও কখনও সেজকাকা বিকেলে বাড়ির সকলের জন্য ‘চাচা’-র ফাউল কাটলেট আনাতেন৷ কী তার স্বাদ আর কী তার গন্ধ৷ সেজকাকা কলকাতায় থাকলে সবই সম্ভব৷ মাতৃভক্ত সেজকাকা কখনও কোনও দিন বাড়ির মেয়েদের ভুলে যেতেন না৷ মাঝে মাঝেই মা, কাকিমা, পিসিমাদের নিয়ে যেতেন থিয়েটার দেখাতে৷

সুতরাং শ্রীযুক্ত মান্না দে ওরফে সেজকাকা মানেই আনন্দ৷ হুজুগ, হই হই ছাড়া যার যা-কিছু প্রয়োজন শুধু একবার সেজকাকুর কানে পৌঁছে দিলেই হল, সঙ্গে সঙ্গে গ্রান্টেড৷ একেবারে বাস্তবিক অর্থে বাড়ির সকলের সমান অধিকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ দিদিরাও তাদের আব্দার-পদ্ধতিতে বাড়িতে টিভি আনিয়েছিল৷ ভোর বেলার রেওয়াজ পেরিয়ে দিনের সকাল হলে সেজকাকার নানা প্রয়োজনের আলাপ শুরু হত৷ চা, জলখাবার, জামা-কাপড়— সব কিছু জোগাড় ও সরবরাহের ভার আমাদের পিসিমার ওপর৷ সেই সব হুকুম বাড়ির প্রায় সকলেই শুনতে পেত— ‘বীণা চা দে, বীণা পান দে, বীণা এটা আনা, ওটা আন৷’ সেজকাকা বাড়ির অন্য কাউকে কিন্তু খুব একটা ফরমাইশ করতেন না৷ তবে ভোরবেলার একেবারে প্রথম চা-টা দিতেন আমার মা৷ কখনও ভোরেই স্নান করে বেরোতে হলে গরম জলও দিতেন আমার মা৷ আমার মা-কে চিরকালই যেন বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতেন সেজকাকা৷ সেজকাকাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো বা শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় জানানোর দায়িত্বও ছিল আমার মা নীহারিকা দে-র ওপর৷ মাঝরাতে বাড়ি ফিরলে তিনিই দরজা খুলবেন, ভোরবেলায় বাইরে যাওয়ার সময় সদর দরজা খুলেও জল ছিটিয়ে দিয়ে আসতেন সেই নীহারিকা দে৷ আমার দিদি (মমতা দে) ছিলেন দুপুর আর রাতের রান্নার ইনচার্জ৷ এখানে জানানো প্রয়োজন, আমার সব খুড়তুতো-পিসতুতো দিদিরাই অসাধারণ রন্ধনশিল্পী ছিলেন৷ তাঁদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বৌদিদের ওপর রান্নার দায়িত্ব পড়ে৷

বোধহয় সকলেই জানেন সেজকাকা ছিলেন বিশেষভাবে খাদ্যরসিক৷ বাঙালিদের প্রিয় পদগুলোর সবই পছন্দ করতেন৷ ছোটবেলায় বম্বে থেকে সেজকাকুর সঙ্গে সেজকাকিমা ও দুই দিদিরা এলে আমরা ঘড়ির হিসেব রাখতে পারতাম না৷ সব স্মৃতিই এখন যেন অন্যরকম এক প্রাোজেক্টর থেকে মনের পর্দায় এসে পড়ছে৷

অ্যাডলফ হিটলারকে আমি কখনও চোখের সামনে দেখিনি৷ বাস্তবিকভাবে তা সম্ভবও ছিল না৷ কিন্তু সিমলের মদন ঘোষ লেন-এর ৯ নং বাড়ির হিটলারকে স্বচক্ষেই দেখেছি সারা বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবন জুড়ে৷ সেই হিটলারমশাই আমার শ্রদ্ধেয় পিতৃদেব (প্রণব দে)৷ তাঁর মেজাজ সম্পর্কে লেখার আগে কিছু অন্য কথাও জানানো প্রয়োজন৷ নিজের যোগ্যতাতেই তিনি ছিলেন একজন কৃতী সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব৷ আমার বাবা-কাকারা চার ভাই ও এক বোন৷ আমার বাবাই ভাই-বোনদের মধ্যে বড়৷ বাইরের নাম প্রণব দে হলেও তিনিও পরিচিতদের মধ্যে ‘নিলু’ নামে জনপ্রিয় ছিলেন৷ তাঁরও সঙ্গীতগুরু ছিলেন তাঁর ছোটকাকা স্বনামধন্য কৃষ্ণচন্দ্র দে৷

আমাদের বংশলতিকার আংশিক পরিচয় এখানে লিখে দিলে অনভিজ্ঞ বা তরুণ পাঠকরা হয়ত উপকৃত হবেন৷

দাদুরা তিন ভাই: পূর্ণচন্দ্র দে/হেমচন্দ্র দে/কৃষ্ণচন্দ্র দে

পূর্ণচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী মহামায়া দে-র চারটি সন্তান: প্রণবচন্দ্র দে (নিলু)/প্রকাশচন্দ্র দে (পেকা)/প্রবোধ দে (মানা)/প্রভাস দে (ভেলু)/বীণাপাণি দে (শীল)৷

সকলেই চলে গেছেন৷ এখন একমাত্র জীবিত আছেন আমার পিসিমা (বীণাপাণি শীল)৷

আমার বাবা বাংলা সিনেমার প্রথম আত্মপ্রতিষ্ঠার সময়ে একজন কৃতী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন৷ সেই আমলে নিউ থিয়েটার্স-এ এক নম্বর স্টুডিওতে কাজ করতেন রাইচাঁদ বড়াল এবং নিউ থিয়েটার্স-এর দু-নম্বর স্টুডিওতে কাজ করতেন প্রণবচন্দ্র দে৷ জানি না বাংলা ছায়াছবির সেই সময়ের ইতিহাস কোথায়, কীভাবে সযত্নে লেখা হয়েছে৷ যাঁরা শতাব্দীপ্রাচীন তাঁরা হয়ত এখনও সঙ্গীত পরিচালক প্রণবচন্দ্র দে-কে মনে রেখেছেন৷ বাবার সঙ্গীত পরিচালনার বিখ্যাত হওয়া কয়েকটা ছবির নাম— ‘কঙ্কাল’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘বকুল’, ‘সুধার প্রেম’ ইত্যাদি৷

সিমলের দে পরিবারের হিটলার মশাইয়ের মেজাজের কাহিনীর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আমার জীবনের প্রাথমিক পর্ব৷ ছোটবেলায় ভাবতাম আমিও মেজকাকার মতো ডাক্তার হব৷ তিনি (ডাঃ প্রকাশচন্দ্র দে) তখন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক৷ কিন্তু রক্তের প্রভাব কিনা জানি না, কিছুদিনের মধ্যেই অন্যরকম ঘটনা ঘটতে শুরু করল৷ সেজকাকার গান এড়িয়ে বাঁচাই সম্ভব ছিল না তখন৷ মনে হত গানগুলো যেন সারাক্ষণ আমাকে তাড়া করছে৷ প্রথমে একা একা গুনগুন, তারপরে স্কুলে বেঞ্চি বাজিয়ে একক অনুষ্ঠান৷ সাহস বাড়তে থাকল৷ পরে বাড়িতে গাইতে আরম্ভ করলাম৷ এ-ঘর থেকে ও-ঘরে আসতে-যেতে গাইছি৷ সবই সেজকাকুর গান৷ সেইসব অসাধারণ সঙ্গীত পরিবেশন কখনও স্বয়ং সেজকাকুর কানেও পৌঁছত৷ কিন্তু বাবা বা সেজকাকুর কাছে গিয়ে কিছু বলার সাহস নেই৷ অথচ স্কুলের বন্ধুরা বলছে যে আমি দিব্যি গাইতে পারি৷ কেন যে শিখছি না ইত্যাদি ইত্যাদি৷ বাবার কাছে ইচ্ছেটা পেশ করতে মা-কে ধরলাম৷ মায়েরা চিরকাল সবক্ষেত্রে বিশ্বস্ত দূত৷ কিন্তু বাবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া— ‘দূর দূর, ও কী গান শিখবে, ভাল করে পড়াশোনা করতে বলো৷’ এরপরের শাসন ছিল অবধারিত ঠ্যাঙানি৷

মাতৃভক্তদের পরিবার বলে আমি মা-কেই আবার ধরলাম সেজকাকুকে একবার গান শেখার প্রস্তাবটা দিতে৷ মা সহজ করে সেজকাকুকে একদিন বলল— ‘দেখ না একবার, আমাদের সুদুয়াটা (অর্থাৎ আমি) তো খুবই উৎসাহ নিয়ে গান শিখতে চায়৷’ তখনও মাধ্যমিক পরীক্ষা দিইনি৷ সেজকাকুর সবই খেয়াল থাকত৷ তিনি মা-কে জবাবে বলেছিলেন— ‘ঠিক আছে, ওকে বলো আগে মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করতে৷ তারপরে গান শেখা হবে৷’ ব্যস, আমরা মানে বাড়ির ছোটরা সকলেই জানতাম সেজকাকা কিছু বলা মানে সেটা হবেই৷ সে কী আনন্দ আমার! মাধ্যমিকে রেজাল্ট ভাল হয়েছিল৷ স্টার অবশ্য পাইনি৷ কিন্তু তাতে আনন্দ কমেনি৷ কারণ সেই রেজাল্টেই সেজকাকুর কাছে যেতেই হাসি মুখে ঘড়িই দিলেন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী৷ আর পেলাম গান শেখার সুযোগও৷

আগেই লিখেছি বাবাকে ভয় পেতাম খুব৷ আমার হিটলারের মতো ভয়াবহ মেজাজের বাবার কাছে এবার আবেদন জানালেন স্বয়ং মান্না দে৷ আজও ঠিক জানি না বাড়ির এ-ঘর থেকে দূরের কোনও ঘর পর্যন্ত পৌঁছনোর সময়ে গাইতে থাকা আমার সেই অশিক্ষিত পটুত্বের গান কখনও সেজকাকার পছন্দ হয়েছিল কিনা৷ সেজভাইয়ের অনুরোধ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ফেলতে পারেননি বাবা৷ ‘নাড়া’ বাঁধলাম সেই বাবার কাছেই৷ রাগ-রাগিণীর সঙ্গে পরিচয় হতে শুরু হল৷ কয়েক মাস পরে বাবার ব্যস্ততার জন্য আমার তালিমের দায়িত্ব দেওয়া হল সারেঙ্গিবাদক পণ্ডিত মহেশপ্রসাদ মিশ্রর কাছে৷ কেন একজন সারেঙ্গিবাদক? বাবা ও সেজকাকু উভয়েই একমত ছিলেন যে একজন যন্ত্রশিল্পীর কাছে তালিম নিলে কানে সুরটা ঠিকমতো বসবে৷ গান শেখা চলছে, মানে স্বপ্নের সিঁড়িতে এক-পা এক-পা করে উঠছি৷ তখনও ভাবতাম গান শিখছি যখন, তখন একদিন নিশ্চয় দাদা, বাবা ও সেজকাকার মতো গাইব৷

কিন্তু গাওয়ার প্রশ্নে একটু সাবালক ভাবনায় আরও কয়েক মাস পরে বুঝলাম সেজকাকার মতো গান আমি কোনওদিনই গাইতে পারব না, সেটা সম্ভব নয়৷ ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা না থাকলে তা কখনও সম্ভব নয়৷ এখনকার সুদেব নয়, সেই সদ্য কলেজে পড়া ছেলেটাও পরিষ্কার বুঝেছিল ঈশ্বরকে পেতে গেলে যে ধরনের সাধনা করতে হয়, প্রায় সেই ধরনের সাধনা করেছিলেন সেজকাকু৷ সুর-তাল-লয় ছাড়া বিরল মেজাজও ছিল তাঁর আয়ত্তে৷ সঙ্গীতই ছিল তাঁর প্রাণ, সঙ্গীতকে আত্মস্থ করতে তিনি দিনের পর দিন সাধনা করেছেন৷ বম্বে থেকে কলকাতায় এলেও তাঁর নিজস্ব রুটিনের কোনও পরিবর্তন হতে দেখিনি৷ আজ গভীর দুঃখের মধ্যেও সেই ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে৷

মান্না দে-র ভাইপো হওয়ার সৌভাগ্যে সারা জীবন ধরে নানা মহল থেকে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে৷ সেজকাকুর গান নিয়ে আমার পছন্দ ও ভালবাসারও যেন আলাদা একটা মূল্য আছে৷ একদিক থেকে সেই সব উৎসুক প্রশ্নকারীদের কোনও অপরাধ নেই৷ কারণ, এইসব পছন্দ ও ভালবাসার প্রশ্নের মধ্যে একটা গোপন ইচ্ছে মিশে থাকে, সেই ইচ্ছে নিজের নিজের পছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ায়৷ সেজকাকুর গাওয়া আমার প্রিয় বাংলা গানের মধ্যে আছে—

১. আবার হবে তো দেখা, ২. আমি নিরালায় বসে, ৩. তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে, ৪. অভিমানে চলে যেও না, ৫. এ-জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি, ৬. চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম৷ দুটো সিনেমার গান, একটা বিশেষ মেজাজের ভক্তিগীতি ও একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতও আমি চিরকাল ভালবেসেছি— ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ (রবীন্দ্রসঙ্গীত), ‘মা মাগো মা, আমি এলাম তোমার কোলে’ (ভক্তিগীতি) এবং সিনেমার গান দুটো— ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ (‘শঙ্খবেলা’), ‘কেন ডাকো মিছে পাপিয়া’ (‘সুদূর নীহারিকা’)৷

এই পছন্দের কথাবার্তায় যদি সেজকাকুর হিন্দি ছবিতে গাওয়া গানগুলোর প্রসঙ্গ না আনি, তা হলে বোধহয় শ্রোতারা আমায় দেশ থেকেই তাড়িয়ে দেবেন৷ সেই ছোটবেলায় শোনার শুরু, তারপর থেকে গানগুলো যে কতবার শুনেছি, শুনতে বাধ্য হয়েছি তার কোনও হিসেব নেই৷ কেন বাধ্য হয়েছি তা-ও লেখা দরকার৷ সিনেমায় পরিস্থিতি অনুযায়ী গান তৈরি করতে হয়৷ বিশেষভাবে রাগাশ্রয়ী যে-গানগুলো শিল্পীদের গাইতে হয় সেখানে গানটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রক্ষা করার প্রশ্নেও দক্ষতার আসল পরীক্ষা দিতে হয়৷ আমি, একজন সামান্য শিল্পী হিসেবে বলতে পারি সেজকাকুর এই গানগুলো আমাকে প্রায় হাতে ধরে শিখিয়েছে ঠিক কীভাবে গাইতে হয়৷ আবেগ ও রাগের সমারোহে এই তালিকা দীর্ঘ হওয়াই উচিত, কিন্তু বাধ্য হয়ে আমাকে ছোট করতে হবে—

১. পুছো না ক্যায়সে (আহির ভৈরব)

২. লাগা চুনরি মে দাগ (ভৈরবী)

৩. সুর না সাজে (পিলু)

৪. কেতকী গুলাব জুহি চম্পক (বসন্ত বাহার)

৫. কাল কা পাহিয়া ঘুমে (কাফি)

৬. তুম গগনকে চন্দ্রমা (কলাবতী)

৭. রে মন সুর মে গা (ইমন কল্যাণ)

শুধু রাগাশ্রয়ী গানই নয়, কতরকম গানই যে সেজকাকু শ্রোতাদের স্মৃতিতে অমর করে রেখেছেন৷ ‘গীত’ ছায়াছবির ‘নথনী সে টুটা মোতি রে’ ও ‘আনন্দ’-এর ‘জিন্দেগী ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ কি কোনওদিন ভোলা সম্ভব? অথবা ‘জ্যোতি’-র ‘সোচ কে ইয়ে গগন ঝুমে’ গানটাও যেন সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির দরজায় এসে দাঁড়ায়৷ অন্য শিল্পীদের জন্য গান তৈরি করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও সেজকাকুর দক্ষতা আমাকে চিরকালই মুগ্ধ করেছে৷ সেই তালিকাও খুব ছোট হবে না, কিন্তু লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে সেই তালিকাও ছোট করতে হবে—

১. আমি খাতার পাতায় — আশা ভোঁসলে

২. যে গান তোমায় আমি — আশা ভোঁসলে

৩. কাঁদে কেন মন — সুমন কল্যাণপুর

৪. আমার বলার কিছু ছিল না — হৈমন্তী শুক্লা

৫. এ আমার স্বপ্ন না সত্যি — কবিতা কৃষ্ণমূর্তি

৬. আমায় তুমি যে ভালবেসেছো — আশা ভোঁসলে

এই তালিকা তৈরির কাজটা রীতিমতো কঠিন ও গোলমেলে৷ অন্যদের (অর্থাৎ প্রিয় শ্রোতৃবৃন্দ ও পাঠকবৃন্দ) কথা ছাড়াও কিছুক্ষণ পরে নিজের সঙ্গেই নিজের ঝগড়া বেধে যায়৷ দুটো বাংলা সিনেমায় সেজকাকুর সুরের দুটো গান— ‘দেখো না আমায় ওগো আয়না’ (লতা মঙ্গেশকর/’রামধাক্কা’) আর ‘এত সুখ কেন চলে যায়’ (হৈমন্তী শুক্লা/’কত ভালবাসা’) কী করে ভুলে যাব?

আমার অকল্পনীয় সৌভাগ্য যে আমিও বেশ কিছু গান সেজকাকুর সুরে গেয়েছিলাম৷ প্রবল ব্যস্ততার সেই দিনগুলোর মধ্যে আমি কাকুকে অনুরোধ করলে তিনি আমার আবেদন ফেলতে পারেননি৷ সেই তালিকার বেশ কয়েকটা গান লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘চলে যাবে যাও ক্ষতি নেই’/’এলো চুলে কেন দাঁড়ালে’/’তোমার নামটা সারাদিন’/’বেশ আছো চাঁদ তুমি’৷ অন্য গানগুলোর মধ্যে আছে জহর মজুমদারের কয়েকটা গানও— ‘কী যে তুমি চাও’/’কুঁড়ির স্বপ্ন হবে ফুল’/’তোমার কারও কাছে’/’মিঠে মিঠে কথায় আর’/’তোমার পৃথিবী তোমার হৃদয়’৷ এই তালিকাও ততটা সংক্ষিপ্ত নয়৷ জীবন কখনও থেমে থাকেনি৷ ‘জুড়াইতে চাই’ নামের ভক্তিমূলক গানের অ্যালবামের দুটো ট্র্যাডিশনাল গান নতুন করে কম্পোজ করে ফেলে গাইবার জন্য ভয়ে ভয়ে সেজকাকুকে অ্যাপ্রাোচ করে ফেললাম৷ সেজকাকু চিরকাল সোজা ভাষায় স্পষ্ট করে কথা বলে এসেছেন৷ একটা মজাদার মুখ টিপে হাসার ভঙ্গি ছিল৷ কিন্তু সেটা দেখে বোঝার কোনও উপায় ছিল না যে এর পরে ঠিক কী ধরনের জবাব আসবে৷ আমার আবেদন শুনে বললেন— ‘গানের কম্পোজিশন যদি মান্না দে-র গাইবার মতো হয়, তবেই রেকর্ড করব, আমার ভাইপোর সুর বলেই কিন্তু আমি গাইব না৷’ শেষ পর্যন্ত গান দুটো শুনে অনুমতি দিলেন— ‘হ্যাঁ, আমি গাইব৷’ অবশেষে স্বামীজির কণ্ঠের দুটো বিখ্যাত গান— ‘তুঝসে হামনে দিলকো লাগায়া’ আর ‘সদানন্দময়ী কালী’ কাকু রেকর্ড করলেন৷ সঙ্গীতের ছাত্র হিসেবে আমার জীবনও ধন্য হল৷ উৎসাহিত হয়ে কাকুর সঙ্গে আমার গাওয়া একটা সিডি, যার নাম ‘হরেকৃষ্ণ মহানাম মন্ত্র’৷ শুনেছি সেটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে৷ নিজেরই রেকর্ড বা সিডি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করার জন্য এই লেখা আমি লিখতে বসিনি৷ কিন্তু সেখানে সেজকাকুর কণ্ঠের জাদু জীবন্ত হয়ে আছে, সেটাই এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা৷

জীবনের অনেক অনেক দিন একজন অতবড় কৃতী মানুষের কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য সকলের হয় না৷ কেন সেজকাকু কলকাতায় এলেই আমাদের বাড়িতে আনন্দের হাট বসে যেত তার অন্তত গোটা পঞ্চাশেক কারণ উল্লেখ করা যায়৷ সেই তালিকা এখন থাক৷ একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার একটা মানুষকে যৌথ পরিবারের সকলেই যথাসাধ্য ভালবাসলে সেই পরিস্থিতি কেমন হয় তা দেখার সৌভাগ্য ও অভিজ্ঞতা— দুই-ই আমার হয়েছে৷ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বাড়ির মা-কাকিমা-দিদিদের ভালবাসা দেওয়া-নেওয়ার সহজ পদ্ধতি যে খাওয়া— এই তথ্য সকলেই জানেন ও বোঝেন৷ একদা কুস্তিগির সেজকাকু প্রকৃত অর্থেই একজন খাদ্যরসিক ছিলেন৷ বাঙালি পরিবারের সনাতন পদের অনেকগুলোই তাঁর প্রিয় ছিল৷ যেমন— লুচি-বেগুনভাজা, সাদা আলুর তরকারি, পটলের দোরমা, ভেটকি মাছের ফ্রাই, সুক্তো, চিংড়ি মাছ, সেনমহাশয়ের ঘি, সীতাভোগ, মিহিদানা ও দইবড়া৷ তবে প্রকৃত খাদ্যরসিক হলেও খাওয়ার পরিমাণ থাকত কম৷ শরীরের প্রশ্নে চিরকালই সংযমী এবং সময়ের ক্ষেত্রে সর্বদা পাংচুয়াল৷

যেসব জরুরি কথা বলতেন তা তাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ পারফেকশন ও ডেডিকেশন তো তাঁর পরামর্শে শোনা যেত৷ সেজকাকু জীবনে নিজে কতদূর ‘পারফেকশনিস্ট’ সেটা তাঁকে কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না৷ ছোটবেলায় শরীরচর্চা ও কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন, তেমনই ওস্তাদ ছিলেন ঘুড়ি ওড়ানোয়৷ শুনেছি একটা সময়ে রফি সাহেবও সেজকাকুর বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন৷ একই আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ির লড়াইয়ের প্যাঁচে সেজকাকু ক্রমাগত রফি সাহেবের ঘুড়ি কেটে দিতেন৷

স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছ থেকে একটা বিশেষ পদ্ধতির শর্ট-হ্যান্ড নোটেশন করার পদ্ধতি শিখেছিলেন আমার বাবা ও সেজকাকু৷ তাঁর গান শেখার, মানে গান তোলার পদ্ধতি যিনি দেখেননি, তিনি কখনও ভাবতেও পারবেন না কী অসাধারণ স্তরের দক্ষতা থাকলে অত দ্রুত গানের নোটেশন করে গানটি আত্মস্থ করতে পারতেন৷ অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি যে যে-কোনও না শোনা গান যদি কেউ গাইতে শুরু করেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই নোটেশন করে নিতে পারতেন এবং সেটা হারমোনিয়াম ছাড়াই৷ অথচ এই অসামান্য যোগ্যতা নিয়ে তাঁকে কোথাও কখনও অহঙ্কার করতে দেখিনি৷ যে-কোনও নতুন গান গাইবার সময় মিউজিক ডিরেক্টরকে বলতেন— ‘গানটা আমায় শিখিয়ে দেবেন৷’ আমাদের বাড়িতে আমি যতটুকু দেখার সুযোগ পেয়েছি তাতে দেখেছি বিভিন্ন গানের সুরকারবৃন্দ সেজকাকুর সঙ্গীতের অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা দেখে একেবারে হতবাক হয়ে যেতেন৷

মানুষটাকে সারাটা দিন, সন্ধে ও রাত পর্যন্ত শুধু একটা কাজ দিয়েই আটকে রাখা যেত৷ গান গাওয়াতেই তিনি ক্লান্তিহীন ছিলেন৷ নিজেই বলতেন— ‘গাইতে গাইতেই যেন আমার মৃত্যু হয়৷’ অসুস্থ হয়ে ব্যাঙ্গালোরে জীবনের শেষ প্রহরগুলোতেও হয়ত তাঁর মনে আজ নিজেরই গাওয়া গানের কোনও কলি ঘুরে বেড়িয়েছে, সেটা হয়ত ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ অথবা ‘মেরা সব কুছ মেরে গীত রে, গীত বিনা কৌন মেরা মিত রে’৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *