গানের দরদী – পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
সঙ্গীতের মানচিত্রে যুগে যুগে, কালে কালে বহু শিল্পীর আবির্ভাব হয়৷ আবার কালের নিয়মে তাঁরা চলেও যান এক সময়ে৷ কিন্তু কখনও এমনও কিছু কিছু শিল্পী আসেন, যাঁদের গান সারা জীবন ধরে মনের কোণে চিরস্থায়ী আসন করে নেয়৷ আর এই অনুভূতিই যখন পৃথিবীর কোণে কোণে বহু মানুষের হৃদয়ে জেগে ওঠে, তখন ভালবাসার সেই শিল্পীই হয়ে ওঠেন কালজয়ী৷ তেমনই এক ক্ষণজন্মা শিল্পী মান্না দে৷ মান্না দে’র মতো শিল্পীর সাঙ্গীতিক মূল্যায়ন করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই৷ বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ শ্রোতার মধ্যে আমিও একজন৷ কিন্তু যখন ভালবাসার অনুরোধ এল ‘মান্নাবাবুর স্মরণে কিছু অন্তত লিখুন…’�ফেলতে পারলাম না৷ বাংলাদেশ আমার পিতৃভূমি৷ সেই দেশের মানুষ আমার আত্মার পরিজন৷ তাঁদের অনুরোধ— আমার কাছে আদেশ৷ সেই আদেশ শিরোধার্য, কলম ধরছি হৃদয়ের শিল্পী মান্না দে’র প্রতি প্রণাম জানাতে৷
একটা সময় ছিল যখন বাংলার মানুষ অপেক্ষা করে থাকতেন দুর্গাপুজোর গানের জন্য৷ এখনকার মতো হাজার হাজার শিল্পী আর গানের ভিড় তো তখন আর ছিল না৷ আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম সেই ‘শারদ অর্ঘ্য’ বই আর গুটিকয়েক পুজোর রেকর্ড-এর জন্য৷ সত্যি বলতে, রেকর্ড কিনে বাজাবার মতো সামর্থ্য আমাদের পরিবারে সেই সময় ছিল না৷ এটা ষাটের দশক হবে৷ পাশের বাড়িতে একটা ‘ফিয়েস্তা’ ছিল৷ আমরা সেই বাড়িতেই ভিড় করতাম পুজোর গান শুনতে৷ রেকর্ডের গানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ওই পাশের বাড়ির ‘ফিয়েস্তা’র মাধ্যমেই৷ সেই বাড়ি থেকেই একদিন ভেসে এল অপূর্ব এক কণ্ঠস্বর— অদ্ভুত সুন্দর এক গান— ‘তুমি আর ডেকো না…’৷ সত্যি বলছি, গান শেষ হয়ে যাবার বহুক্ষণ পরেও কিরকম যেন ঘোর থেকে গেল৷ পরে জেনেছি, গানটা ওঁর আধুনিক বাংলা গান গাইবার প্রথম দিককার গান, অন্য গানগুলোর সঙ্গে সেটাও বাজানো হচ্ছিল৷ সেই ক্ষণ যেন মান্না দে’র জন্যই নিবেদিত ছিল৷ একের পর এক রেকর্ড বাজতে থাকল— ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে— আমার অবুঝ বেদনা…’— জানলাম শিল্পীর নাম মান্না দে৷ গান আমি ছোটবেলা থেকেই গাইতাম— শেখা-রেওয়াজ সবই তখন চলছে জোর কদমে৷ সঙ্গীতের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে সুরের আনাগোনা৷ গানে অলঙ্কার বিন্যাস এগুলোই আকর্ষণ করত বিশেষভাবে৷ গান শুনলে সুরটা যেন কীভাবে মনে থেকে যেত৷ যা শুনতাম সেই সুরটাই গুন গুন করতাম সারাদিন৷ কিন্তু মান্নাবাবুর এই গানগুলো শোনার পরে খুব অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করলাম— শুধু সুর নয়, কথাটাও মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে৷ শিল্পী যেন কী এক জাদুবলে গানের কথাগুলোকেও মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন৷ কেন এমন হল? এমন তো আগে হয়নি কখনও৷ আমার কিশোর মনের গভীরে কী যে আলোড়ন! নিজের মনে নিজেই মজে থাকার সেই কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে৷ আরও বেশি শুনতে লাগলাম মান্নাবাবুর গান— ‘কথা দাও আবার আসবে…’ বিশেষত ‘…আবার নদীর কূল ভাসবে’ গাইবার সময় ছোট একটা তান উনি নিয়েছেন অদ্ভুত সাবলীলতায়— কিন্তু সে তান কখনই কথাকে ছাপিয়ে যায়নি, বরং সেই তানে রয়েছে নদীর দু’কূল ছাপিয়ে জলের উছলে পড়ার তরঙ্গ৷ আজও ভাবলে অবাক হই— কী অদ্ভুত ব্যালান্স— এ যেন কথা আর সুরের শুভ পরিণয়৷ শিল্পী তার তন্ত্রধারক৷
আমি ধীরে ধীরে বোধের এক ধাপ ওপরে উন্নীত হলাম৷ বাংলা কাব্যগীতি মানে কী? গান কি শুধু সুর? না শুধু কথা? কতটা সুর? কতটা কথা? নাকি অব্যক্ত অন্য কোনও কিছু? উত্তর খুঁজতে লাগলাম মনে মনে৷ আর শুনতে থাকলাম আরও আরও গান৷ ‘পারো যদি ফিরে এসো…’, ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে…’, ‘সেই তো আবার কাছে এলে…’৷ ততদিনে জানতে পারছি মান্না দে’র বহু বহু জনপ্রিয় গানের সুরকার তিনি নিজেই৷ ‘সেই তো আবার কাছে এলে…’ কথাটি আমি বহুবার সুর ছাড়া বলে দেখেছি যে, কথার নিজস্ব সুরই এ গানের সুর হয়ে উঠেছে— আলাদা করে সুরারোপ করার প্রয়োজন হয়নি৷ মান্না দে এখানেই নিজস্বতায় স্বতন্ত্র৷
সময়ের সঙ্গে চলতে চলতে আমিও একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছি৷ স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমি তখন কলেজে ঢুকেছি৷ গুরুজি অর্থাৎ গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে শেখাও চলছে জোর কদমে৷ রাগ-রাগিণী ও তাল-লয়-ছন্দে ডুবে থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গান শোনার, বোঝার, বিশ্লেষণ করার ও গাইবার অভ্যেসও শুরু হয়ে গেছে তখন থেকেই৷ জানতে পারলাম বহুকাল আগে থেকেই মান্নাবাবু মুম্বইবাসী হয়ে বলিউডের হিন্দি ভাষার ছবিতে গান গাইছেন জোর কদমে৷ কলেজের ফাঁকে ফাঁকে কখনও সখনও এক-আধটা হিন্দি ছবিও দেখছি৷ সেই সময়েই রাজেশ খান্না-অমিতাভ বচ্চন জুটির বিখ্যাত ছবি ‘আনন্দ’ দেখলাম৷ সলিল চৌধুরির সঙ্গীত পরিচালনা করা অসাধারণ এই ছবির বেদনার মূল সুরটা যেন আরও নিবিড় হয়েছিল মান্না দে’র গাওয়া সেই বিখ্যাত গানে৷ ‘জিন্দগী ক্যায়সী ইয়ে পহেলী হায়…’ ছবিতে রাজেশ খান্না আর মান্নাবাবুর কণ্ঠ যেন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল৷ আজও গানটা শুনলে রাজেশ খান্না’জি-র মুখটা ভেসে ওঠে মনের আঙিনায়৷ তিনিও পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন কিছুদিন হল৷ এই সুযোগে তাঁকেও প্রণাম জানিয়ে রাখলাম৷ আরও কত কত অমর গান শুনেছি মান্নাবাবুর কণ্ঠে৷ শুনেছি কাওয়ালি ‘ইয়ারী হ্যায় ইমান মেরা…’ বা ‘এ্যায় মেরে জোহরা জবী…’৷ শুনেছি কিশোরকুমার’জি-র সঙ্গে ডুয়েট গাওয়া ‘পড়োশন’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার, বড়া হোঁশিয়ার…’৷ এ গান তো প্রায় ইতিহাস হয়ে গেছে৷ একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে ভাবতে অবাক লাগে মান্না দে’র মতো একজন সিরিয়াস গায়ক কীভাবে নিজেকে ভেঙেছেন, নতুন করে গড়েছেন এবং গেয়েছেন৷ অনবদ্য, অবিস্মরণীয় এই কমেডি গান৷ পরে মান্নাবাবুর কাছেই শুনেছি টানা সাত দিন রিহার্সাল হওয়ার পর অষ্টম দিনে এ গান লাইভ রেকর্ড করা হয়েছিল৷ যে Seriousness নিয়ে আগে কাজ হত, আজকের দিনে তা অবশ্য কল্পনাই করা যায় না৷ পাশাপাশি সহ-শিল্পী মহঃ রফি, কিশোরকুমারের জন্য তাঁর যে অকুণ্ঠ প্রশংসা— আজকের সমস্ত শিল্পীদের সেটা শেখা উচিত৷ এই সময়েই শুনি ওনার ‘পুছোনা ক্যায়সে ম্যায়নে র্যায়ন বীতাই…’৷ শুনে মনে হয়েছিল এ তো ‘অরুণ কান্তি কে গো যোগী ভিখারী’র সুর৷ অবশ্য অন্তরা থেকে এ গান ভিন্ন পথগামী৷ এ ছাড়াও ‘ছম ছম বাজে রে পায়েলিয়া’ বা ‘ঝনক ঝনক তোরী বাজে পায়েলিয়া…’� এসব গান বহুবার শুনেছি, মুগ্ধ হয়েছি, গেয়েওছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে৷ সত্যি কথা বলতে, সেই সময়ে বলিউডে রাগাশ্রয়ী কোনও গানে পুরুষ কণ্ঠ মানেই মান্নাবাবুর একচ্ছত্র আধিপত্য৷ নিজের যোগ্যতা-দক্ষতায় এমনই এক স্বতন্ত্র স্থান তিনি করে নিয়েছিলেন৷
কলেজ জীবন থেকেই আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করার সুযোগ আসতে শুরু করে৷ খেয়াল ঠুমরি— অর্থাৎ রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান তো করতামই, সেই সময়কার বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীদের জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠানও করতাম প্রচুর৷ বলে রাখি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব অনুষ্ঠানের সুনিশ্চিত পারিশ্রমিক ছিল লুচি-তরকারি, কপাল ভাল থাকলে কখনও কখনও রিকশা ভাড়াও জুটে যেত৷ তবু গাইতাম— অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের তাগিদে— আর বহু মানুষের ভালবাসার আবদারে৷ এই সময়ই শুনি মান্নাবাবুর গাওয়া ‘লগা চুনরী মে দাগ…’৷ গানটা শিখে ফেলতে দেরি করিনি মোটেই৷ কারণ গানের শেষে ছোট্ট একটা তরানা আছে যে৷ আমি রাগ সঙ্গীতের ছাত্র, গানের শেষে তরানা মানে তো হাতে চাঁদ পাওয়া৷ রেকর্ডের ছোট্ট তরানাটুকু নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে ছন্দে-বোলে তানে সরগমে প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে গাইতাম৷ আর সেটাই হত আমার অনুষ্ঠানের শেষ গান এবং আমার তুরুপের অব্যর্থ তাস৷ পাড়ায় পাড়ায় কত যে অনুষ্ঠানে এই গান গেয়েছি আর দীর্ঘ দীর্ঘ হাততালির মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করেছি তার ইয়ত্তা নেই৷ আজ বসে ভাবতে অবাক লাগে, কার গাওয়া গান— আর কে হাততালি কুড়োয়? এইসব রসিকতার মানে কেবল ভগবানই জানেন!
এতদিন রেকর্ড শুধু শুনতাম৷ এবার একদিন সময় এল— রেকর্ডে আমার গানও ছাপা হল৷ ঈশ্বরের আশীর্বাদে, গুরুদের কৃপায় আমার প্রথম রেকর্ড HMV থেকে প্রকাশিত ‘নানারঙের গান’ শ্রোতাদের অকুণ্ঠ ভালবাসা, আশীর্বাদও পায়৷ এটা ১৯৮১ সাল, সেই রেকর্ডে আমার সঙ্গে তবলা সঙ্গত করেন আমার স্বপ্নের তবলিয়া শ্রী রাধাকান্ত নন্দী— মান্নাবাবুর অধিকাংশ গান তাঁরই বাজানো৷ আমি খবর পাই, আমার রেকর্ডটি প্রকাশিত হবার আগেই রাধুবাবু সেটি মান্নাবাবুকে শোনান— সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে ও আমার প্রতি অফুরন্ত স্নেহের তাগিদে৷ মান্নাবাবুও নাকি রেকর্ডটি শুনে খুবই প্রশংসা করেন৷ অবশ্য এটা আমার শোনা কথা৷ মনে রাখতে হবে এই সময় আমি সারাদেশে রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠানও করছি৷ গুরুজি ও আমার উস্তাদ, উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছে কঠোর তালিম-রেওয়াজও চলছে৷ প্রথমবার দূরদর্শনের আমন্ত্রিত প্রোগ্রামে গাইলাম— রাগ দেশ৷ উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান তখন আমার ঈশ্বর৷ পাশাপাশি আমার গুরুজির কথায় সুরে রাগাশ্রয়ী গানের প্রথম রেকর্ড অত্যন্ত সমাদর পাওয়ায় তখন বাংলায় আমার একটা বিশেষ পরিচিতিও হয়েছে৷ নিয়মিত রেকর্ড বেরনো, অনুষ্ঠান, টিভি ও ছবিতে গাইবার সুযোগ— সবই আসতে লাগল৷ এমন সময় একদিন রাধুবাবু বললেন, ‘কাইল আসিস, তরে মান্নাদার কাছে লইয়্যা যাইব৷’ মনে মনে শিহরিত হলাম৷ গুরুজি বলতেন—
‘গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?
তোর অতীত গুরু পথিক গুরু, গুরু অগণন৷’
মান্নাবাবুকে মনে মনে গুরুর আসন দিয়েছিলাম বহু আগেই৷ তাঁর গান শুনে শিখেছি কীভাবে গানের কথায় প্রাণ সঞ্চার করতে হয়, উচ্চারণের শুদ্ধতা, ইমোশন আরও কত কিছু! খেয়াল-ঠুমরি-ভজন যখন গাওয়ার গেয়েছি, কিন্তু যখনই হারমোনিয়াম হাতে গাইতে বসেছি, মান্নাবাবু প্রভাব খাটিয়েছেন অলক্ষ্যে৷
তবে কি এবার দূরের এক শিষ্য ও মানসগুরুর মুখোমুখি সাক্ষাৎ হবে? যাই হোক, পরের দিন যেখানে রাধুবাবু অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম, আশঙ্কা পাছে দেরি হয়! কিন্তু রাধুবাবুর তো দেখা নেই, প্রায় দু-আড়াই ঘণ্টা হয় হয়— তবুও তিনি আসেন না৷ তখন তো যত্রতত্র এত ফোনের সুবিধাও ছিল না, তাই উপায়ও কিছু নেই৷ না:! এলেন না রাধুবাবু৷ আমি মনে মনে ভাবলাম— ‘এত দূর যখন এসেছি, নিজেই যাই একবার মান্না দে’র বাড়ি— যা হয় হবে৷’
পা রাখলাম উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়ার সেই বিখ্যাত বাড়িতে৷ লম্বা দালান, প্রচুর লোকের ভিড়৷ অভ্যাগতদের প্রায় বেশির ভাগই অনুষ্ঠানের জন্য বায়না করতে এসেছেন৷ কেউ মেদিনীপুর থেকে তো কেউ ঘাটশিলা, কেউ বর্ধমান থেকে তো কেউ জলপাইগুড়ি৷ আমি ভয়ে ভয়ে বসলাম সবার শেষে— Last but not the least. মান্নাবাবু তখন মধ্যগগনের সূর্য৷ সকলের সঙ্গে কথা বলছেন৷ এমন সময় আমার পালাও এল৷ জলদগম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে ভাই আপনি?’ এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল— পাশের বাড়ির ফিয়েস্তা, ‘লগা চুনরী মে দাগ…’ শেষে হাততালির রেশ— ভিড়ে ঠাসা প্যান্ডেলে কোনওমতে ঢুকে গান শোনা— ‘একি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়…’৷ দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, ‘আমার নাম অজয় চক্রবর্তী, আমি গান করি, আপনাকে একবার প্রণাম করব বলে এসেছি৷’ কয়েক সেকেন্ড থমকে গেলেন মান্নাবাবু৷ প্রশ্ন করলেন— ‘আপনি কি সেই অজয় চক্রবর্তী যিনি ক’দিন আগে টিভিতে ‘দেশ’ গাইলেন?’ মাথাটা নিচু করে বললাম ‘হ্যাঁ’৷ মান্নাবাবু বললেন, ‘দাঁড়ান! ভাবতে হবে, আপনি আমায় প্রণাম করবেন, নাকি আমি আপনাকে প্রণাম করব৷’ চমকে উঠলাম, লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম৷ উনি বলে চললেন— ‘মহারাষ্ট্রে ক্ল্যাসিকাল গানের যা অবস্থা— তাতে অনুষ্ঠান হলে, EXIT-এই ভিড় হয় বেশি৷ শুনে রাখুন, আপনি যদি ভারতবর্ষের এক নম্বর গাইয়ে না হতে পারেন, তবে I will be the first person to Kill you.’ একথা বলেই উপস্থিত অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের বললেন— ‘এঁকে চিনে রাখুন— একটা দিন আসবে যখন আপনারা এঁর date পাবেন না৷’ মান্নাবাবুর সঙ্গে আমার তেত্রিশ বছর বয়সের ব্যবধান৷ নির্ভুল হিসেবে পিতা-পুত্রের বয়সের ব্যবধান৷ নিজে সঙ্গীত জীবনের মধ্য গগনে থাকাকালীন নিজের পুত্রসম এক শিল্পীকে প্রথম সাক্ষাতে এত বড় আসন দেওয়া কি মুখের কথা? পরবর্তীকালে, বহুবার উনি আমায় বলেছেন ‘সুযোগ পেলে গানটা আপনার কাছেও শিখতাম৷’ প্রিয় পাঠক! আমার নিজের গুণপনা জাহির করছি ভেবে ভুল করবেন না৷ বলতে পারেন মনটা ঠিক কত বড় হলে এমন কথা সর্বসমক্ষে জোর গলায় বলা যায়? আমার জীবনে এ এক বিরাট শিক্ষা৷ পুত্রের গুণের কাছে পিতাকেও নতজানু হতে শিখতে হয়৷ তাতে পিতার আসন নামে না, বরং আরও কিছুটা উঁচুতেই ওঠে৷ আমরা যদি পরবর্তী প্রজন্মকে সাদরে স্থান করে দিই— তাতে আমরাই সমৃদ্ধ হব৷ মান্নাবাবু এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত৷
এরপর থেকে প্রায়শই দেখা হত ওনার সঙ্গে; কখনও কলকাতায়, কখনও মুম্বইতে বা অন্যত্র৷ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করব— যা মান্নাবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল তা পাঠকদের বুঝতে সাহায্য করবে৷ তখন সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমির ছোট্ট একটা ঘরে আমি থাকি৷ সামনে লাগোয়া একফালি বারান্দা৷ একদিন সন্ধেবেলায় দেখি সেই বারান্দায় অন্ধকারে এক মহিলা বসে আছেন৷ পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় তিনি একটি চিঠি আমার হাতে দিয়ে বললেন ‘মান্না দে’ পাঠিয়েছেন৷ দেখলাম মান্নাবাবুর সই করা সেই চিঠিতে লেখা—
‘অজয়বাবু, এই মহিলা বনশ্রী সেনগুপ্ত৷ ইনি অত্যন্ত সুরে গান করেন৷ আপনি যদি অনুগ্রহ করে এনাকে গান শেখান তাহলে ইনি উপকৃত হবেন৷ – ইতি মান্না দে৷’
বনশ্রীদি সেই সময় যথেষ্ট পরিচিত একজন অভিজ্ঞ শিল্পী৷ আমি ওনার ছোট ভাই-এর মতো৷ কাজেই মান্নাবাবুর অনুরোধ রাখতে পারিনি৷ আজও বনশ্রীদি’র সঙ্গে দেখা হলে, ওই দিনের কথা নিয়ে আলোচনা হয়৷ কিছু স্মৃতি সততই সুখের৷
মান্নাবাবুর সঙ্গীত জীবনের ষাট বছর পূর্তি অনুষ্ঠান, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে৷ আমি গাইছি, ‘ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল না…’৷ গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো৷ রাগ সঙ্গীতের চর্চার ফসল স্বরূপ আমি সব সময়ই চেয়েছি, পুরনো গানকে নিজের মতো করে গাইতে৷ গুরুদের কাছে প্রত্যক্ষভাবে পরোক্ষভাবে যা শিখেছি— যা চিন্তা করেছি— তাতে একই গান রোজ নতুন করে গাইতে চেয়েছি৷ সেদিনও ওই গানটি আমি গেয়েছিলাম নিজের মতো করেই৷ গানের পর মান্নাবাবু নিজে এসে বলেছিলেন, ‘আমি বহুবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, আমি কি কখনও পারতাম এ গান এভাবে গাইতে? উত্তর পেয়েছি, ‘না’৷’ মান্নাবাবুর আমার প্রতি এক অহেতুক স্নেহ-ভালবাসা ছিল— যা তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল৷
আরেকটি ঘটনার কথা বলি— মান্নাবাবুর জীবন নিয়ে লেখা বই ‘জীবনের জলসাঘরে’ উদ্বোধন হবে বিড়লা সভাগৃহে৷ উদ্বোধন করতে হবে আমাকেই— এই দাবি নিয়ে বাড়ি এসেছেন আনন্দবাজারের সাংবাদিক শ্রী মানস চক্রবর্তী৷ বললেন মান্নাবাবুরও একান্ত ইচ্ছে— এ বই আমার হাতেই উদ্বোধন হোক৷ রাজি হয়ে গেলাম৷ দিনক্ষণ সব লিখেও রাখলাম ডায়েরিতে৷ অনুষ্ঠানের ঠিক তিন দিন আগে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে অনুরোধ এল— দিল্লিতে আমার আর উস্তাদ আমজাদ আলি খান-এর অনুষ্ঠান৷ আর যে দিন মান্নাবাবুর বই উদ্বোধন— দিল্লির অনুষ্ঠানও সেদিনই৷ প্রেসিডেন্ট-এর অনুরোধ রাখতে পারিনি৷ মান্নাবাবু আমার কাছে অনেক আগে৷ যাই হোক পৌঁছলাম অনুষ্ঠানে৷ শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পি. কে. ব্যানার্জি— আরও কত বিশিষ্ট মানুষ সেদিন উপস্থিত ছিলেন৷ আমার আসন ঠিক মান্নাবাবুর পাশেই৷ জানি না ঠিক কীভাবে উনি জানতে পেরেছিলেন যে আমি প্রেসিডেন্ট-এর অনুষ্ঠানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে এসেছি৷ উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনি এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য President-কে refuse করলেন?’ আমি বলেছিলাম ‘President পাঁচ কি বড় জোর দশ বছর থাকবেন৷ আপনি আমার সারা জীবনের৷’ উনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে Royal Bengal Tiger তাহলে এখনও আছে?’ কথাগুলো কানে এখনও বাজছে৷ এই অনুষ্ঠানে সকলের বক্তব্যের পর আমায় একটা গান গাইতে বলা হয়৷ আমার গানের পর মান্নাবাবুর বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হবে৷ এমনি ঠিক ছিল৷ আমি গাইলাম আমারই গুরুদেব গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের গান৷ যাঁর দয়ায় আমি সঙ্গীত বুঝতে শিখেছি, তাঁরই শিক্ষায় সবার মধ্যে ভাল খুঁজতে শিখেছি৷ আমার মানসগুরু মান্না দে’র প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এর চেয়ে ভাল কোনও ফুল সেদিন আমি আর পেলাম না৷ ‘যদি কণ্ঠ দাও, আমি তোমার গাহি গান…৷’ সত্যি বলছি, খুব অন্তর থেকে সেদিন আমি চেয়েছিলাম সুরে সুরে আমার সকল গুরুদের চরণ ছুঁতে— মান্নাবাবুও তাঁদের একজন৷ খানিক গাইবার পরেই লক্ষ্য করলাম মান্নাবাবুর দু’চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়ছে৷ শিশুর সারল্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তিনি কাঁদছেন৷ গান এক সময় শেষ হল৷ পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে পিন পতনের নীরবতা৷ অদ্ভুত এক পরিবেশ৷ মান্নাবাবুকে কিছু বলতে বলা হল— বলতে পারলেন না৷ গলা ধরে এল৷ অনেক চেষ্টায় আবেগ সামলে বললেন— ‘আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সঙ্গীতের আকাশে শ্রী অজয় চক্রবর্তীর নাম যেন সবার ওপরে লেখা থাকে৷’ অর্বাচীন আমি, আরও ধুলোয় মিশে গেলাম৷ অন্তরে অপার স্নেহ-ভালবাসা না থাকলে কেউ এমন কথা বলতে পারেন!
কলকাতার বুকে ঈশ্বর আমায় দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান করিয়েছেন— ‘শ্রুতিনন্দন’৷ সেখানে ভারতবর্ষের সমস্ত গুরুদের সমস্ত ভালগুলোকে একত্রিত করে এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করার চেষ্টা করেছি, যার মূল প্রেরণা আমার গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ৷ সেখানে আমার পুত্র-কন্যাদের মনেও মান্নাবাবুকে গুরুর আসনেই বসাবার চেষ্টা করেছি৷ শ্রুতিনন্দন ধন্য হয়েছে শ্রী মান্না দে’র পদধূলিতে৷ বেশ কিছু সময় তিনি এখানে কাটিয়েছেন৷ পরমাত্মীয়ের মতো কত গল্প শুনিয়েছেন আমাদের৷ সমবয়সী বন্ধুর মতো আমার বাবা-মা-র সঙ্গে গল্পে মেতেছেন৷ শিশুর আগ্রহে একাধিক প্রশ্ন করেছেন আমার ছোটবেলার প্রসঙ্গে, আমার বেড়ে ওঠা প্রসঙ্গে৷ প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছেন আমার কন্যা কৌশিকীকে৷ ভালবেসেছেন আমার শ্রুতিনন্দনের পুত্র-কন্যাদের৷ এ আমার বিরাট পাওয়া৷
আমি ঠিক জানি না, হয়ত পেশাদার লেখকরা সত্যিটা বলতে পারবেন৷ এমন আলোড়িত স্মৃতি নিয়ে কিছু কি গুছিয়ে লেখা যায়? শিল্পী মান্না দে কত বিচিত্র ধরনের গানই না গেয়েছেন৷ শুধু শ্রোতারা নন, যাঁদের গান গেয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তাঁরাও কি মান্নাবাবুর এই বিস্ময়কর বৈচিত্র্যের কোনও বিশ্লেষণ করতে পারবেন! গানের একটা ছবি হয়, যেমন ছবির মধ্যেও ছবি হয়, অনেকটা তেমনই৷ মান্না দে-র গানে রবীন্দ্রনাথের গানের মতো কোনও গভীর তত্ত্বকথা নেই, বিরাট মাপের কোনও জীবনদর্শনও নেই৷ বাংলা গানের সেই কথায় আছে আমি-তুমির প্রেম বা প্রেম জড়ানো সুখ-দুঃখ৷ কিন্তু সেই সপ্রেম সুখ-দুঃখের ছবিটাই গায়কীর মরমি দক্ষতায় শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন ক’জন শিল্পী? মান্নাবাবু গানটা গাইলেই শ্রোতাদের মনে গানের কথায় লেখা ছবিটা দুলে উঠত৷ উদাহরণ যদি দিতে হয়, তাহলে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে, যেমন— ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে’, ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছো’, ‘আমায় একটু জায়গা দাও’৷ এই তালিকা সংক্ষেপ রাখাই কঠিন৷ কথার প্রসঙ্গ যখন লিখছি, তখন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ মান্নাবাবুর জীবনে গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সার্থক উপস্থিতি না ঘটলে আমরা শিল্পীকে হয়ত এমন বিরাট বৈচিত্র্যে পেতাম না৷
বাংলা কাব্যগীতি, সিনেমার গানের সঙ্গেই তাঁর হিন্দি সিনেমার গানের প্রসঙ্গ এসে যায়৷ সেখানেও তিনি ছবির গানের অন্তর্নিহিত ছবিই প্রাোজেক্ট করে গেছেন৷ কারও দয়া বা হাত ধরে নয়, সেই সেকালের বম্বেতে তিনি স্থান করে নিয়েছিলেন একেবারে নিজস্ব প্রতিভায়৷ তিনি সেখানে হিন্দি সিনেমার পরিচালক, সঙ্গীত-পরিচালকদের দেখেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন৷ সেখানে বৈচিত্র্যময় গানের শিল্পী তিনি, সেখানেও কণ্ঠের মাধ্যমে পিকচারাইজেসন অফ লিরিক করে গেছেন৷
ঠিক কী করে গানের কথা বলতে হবে, কথার মধ্যস্থিত নাটকীয়তা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক শিক্ষার পরিচয় আছে ওঁর গানে৷ ‘আছে’ লিখলাম এই জন্য যে, যাঁরা সঙ্গীতের উৎসাহী ছাত্র তাঁরা মান্নাবাবুর গানের রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডি বাজিয়ে এখনও এই সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন৷ তাঁর গানে যেভাবে বলা হয়— ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’, ‘আমি কোন পথে যে চলি’, তাতে এই নাটকীয়তা সার্থকভাবে ধরা আছে৷ সাধারণ কথ্যভাষা গানের সুরের মধ্যে ধরার এই চেষ্টা সিনেমার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠে৷ সারাজীবন ধরে ওঁর গান শুনে এগুলো শেখার চেষ্টা করেছি৷ আগেই লিখেছি, ওঁর বাংলা ও হিন্দি গান একদা নিয়মিত অনুষ্ঠানে গাইতাম৷ বলতে পারি, গানগুলোর জনপ্রিয়তার জন্য গাইতেই হত৷
একদা রাগাশ্রিত গান বলে এক ধরনের গান এই বাংলায় জনপ্রিয় ছিল৷ অনেক অসাধারণ গান এই ধরনের গানের নির্মাণে সৃষ্টি হয়েছিল৷ অভিজ্ঞ শ্রোতারা ইচ্ছে করলেই সেইসব গানের তালিকা স্মৃতি থেকে বলতে পারবেন৷ সবিনয়ে বলি, এই বাংলা রাগাশ্রয়ী গানের ক্ষেত্রে আমারও অন্তত শতকরা পাঁচভাগ অবদান আছে৷ সহজ স্বীকারোক্তিতে জানাই, সেই ধরনের গান গাওয়ার ক্ষেত্রে রাগগুলোর প্রতি আকর্ষণই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু মান্না দে-র ক্ষেত্রে ঘটনাটা একটু অন্য চরিত্রের৷ উনিও সার্থকভাবে রাগাশ্রয়ী গান গেয়েছেন, অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গেই গেয়েছেন, কিন্তু ওঁর গাওয়াতে গানের কথাগুলোই আশ্চর্যভাবে প্রাধান্য পেয়েছে৷ লিরিকের প্রতি আন্তরিকভাবে যত্নশীল না হতে পারলে এইভাবে গাওয়া যায়?
মাঝে মাঝে এ জীবনে নিজস্ব প্রাপ্তির হিসেব করে দেখেছি তার পরিমাণও কম নয়৷ মান্নাবাবু দীর্ঘদিনের পরিচয়ের জন্য অসম্ভব স্নেহ করতেন৷ আমাদের বয়সের পার্থক্যে উনি আমার বাবার বয়সী৷ অথচ একটা সময়ে পৌঁছে উনি প্রশ্রয় দিতেন, আমরা তখন সমবয়সীদের মতো রঙ্গ-রসিকতাও করেছি৷ দিলখোলা মানুষ ছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে৷ একটা দিনের স্মৃতি এই লেখার মুহূর্তে আলাদা করে মনে পড়ছে৷ আমার মতো করে গেয়ে শোনাচ্ছি ওঁরই গান— ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে…’ গাইতে গাইতে দেখি ওঁর চোখ থেকে জল ঝরছে৷ আমিও বেশ খানিকটা বিহ্বল৷ পরিবেশটা হালকা করার জন্য আমি বলেছিলাম— ‘মান্না, এমন গাইতে পারবি?’ উনি হেসে বলেছিলেন— ‘সারাজীবনে না৷’ এসব তো রসিকতার কথা৷ কিন্তু গানের কথাগুলো হৃদয়তন্ত্রে পৌঁছে দিতে উনিই শিখিয়েছেন ওঁর গানে৷ গান গাইবার সময় সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে গাইতে আমি অন্তত আর কাউকে দেখিনি, সেটা যেন ওঁর স্পেশাল জার্নি ফর্ম মাইন্ড টু হার্ট৷
অনেকে জিজ্ঞাসা করেন মান্নাবাবুর কোন গানগুলো আমার বিশেষ প্রিয়৷ নিখাদ ভালবাসায় এবং অন্তহীন বোকামিতে আমিও মনে মনে গান বাছতে শুরু করে দিতাম৷ প্রথম সমস্যা ছিল বাংলা ও হিন্দি গান আলাদা করে বাছার ক্ষেত্রে৷ পরে আলাদা করা যাবে— এমন ভাবনায় যদি শুরু করি— ‘আনন্দ’ ছবির ‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ দিয়ে, তাহলে পরেরটাই হয়ত— ‘এ কী অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা’, তারপর যদি ‘লাগা চুনরি মে দাগ’, তাহলে পরেরটা নিশ্চয়ই ‘ললিতা ওকে আজ’ এবং কী করে ভুলব— ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, এরপর নিশ্চিত সিদ্ধান্তে লিখতে হয়— এই তালিকা কখনও সাতটা বা দশটায় সীমাবদ্ধ থাকবে না৷ অনেক বিখ্যাত শিল্পী আছেন, যাঁদের নাকি অসংখ্য হিট গান আছে, কিন্তু নির্ভেজাল সত্যি হচ্ছে কঠিন পরীক্ষার মেজাজ নিয়ে বাছলে দেখা যাবে সেই অসংখ্যর তালিকা আটটা-দশটায় পৌঁছে থেমে যাচ্ছে৷ মান্নাবাবুর ক্ষেত্রে সেই তালিকা অনায়াসে তিরিশটায় পৌঁছে যাবে৷ একজন শিল্পীরই তিরিশটা অবিস্মরণীয় গান— এই স্বীকৃতি প্রায় অসম্ভবের মতোই দুর্লভ ঘটনা৷
পুরস্কার, স্বীকৃতি ও তথাকথিত জনপ্রিয়তার বিচারে বেঁধে রাখার স্তর বহুকাল আগেই পেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ সঙ্গীতের জগতের বন্ধুদের হারিয়ে শেষদিকে কেমন যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন বলে শুনেছি৷ তবে চিরকালই ওনার কলকাতার প্রতি একটা বাড়তি টান ছিল৷ শুনেছি শেষ জীবনে কলকাতায় এসে থাকতে চেয়েছিলেন৷
ওঁনার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ যখন আমি ব্যাঙ্গালোরে যাই ওঁনার বাসায়৷ ২৪ ঘণ্টা টিভি চ্যানেলের তরফে Life Time Achievement Award ওঁনার হাতে তুলে দিতে৷ মান্নাবাবু নিজেই চেয়েছিলেন এ Award যাতে আমার হাত থেকে দেওয়া হয়৷ সে সময় উনি খুব দুঃখ করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘আমি ভাল নেই৷ আমার আর বাঁচতে ভাল লাগছে না৷’ শুনে খারাপ লেগেছিল৷ আমি বলেছিলাম— ‘আপনি কলকাতায় চলে আসুন৷ আমরা সবাই আপনার পাশে আছি৷ সেখানে মানুষ এখনও আপনাকে সব থেকে বেশি ভালবাসে৷’ পরে অবশ্য আমাদের রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে গিয়ে মান্নাবাবুকে ‘বঙ্গবিভূষণ সম্মান’ প্রদান করে এই একই অনুরোধ করেন— ‘আপনি কলকাতায় চলে আসুন, দেখবেন ভাল থাকবেন৷’ তা আর হল না৷ কোন অজ্ঞাত কারণে বাংলার প্রাণের শিল্পী থেকে গেলেন এমন এক শহরে যেখানে বাংলার কোনও সংস্রব তো নেই-ই, হিন্দি সংস্রবও খুবই ক্ষীণ৷ মান্নাবাবুর শেষ নিঃশ্বাস বাংলায় পড়ল না— এটা বাংলার দুর্ভাগ্য, মান্নাবাবুরও দুর্ভাগ্য বটে৷ এপার-ওপার দুই বাংলার মানুষের মনে মান্নাবাবুর প্রয়াণে যে আবেগ উথলে উঠেছিল— তাতে একটা মহাকাব্য হয়ত লেখা যেত৷ মান্নাবাবুর অনেক পাওয়া এই জীবনে হয়ত এইটুকুই না পাওয়া রয়ে গেল৷
তাই ওঁনার গানের সুরেই বলি—
‘…দরদি গো, কি চেয়েছি আর কি যে পেলাম?’