প্রেমের গানের সম্রাট – অমিতাভ চৌধুরি
মান্না ডাকনাম, আসল নাম প্রবোধ দে৷ স্ত্রী কেরল-কন্যা সুলোচনা এবং দুই মেয়ে— সুরমা ও সুমিতা৷ উত্তর কলকাতায় বাড়ি৷ বাবা পূর্ণচন্দ্র দে৷ কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে— যিনি কে সি দে নামেই সারা ভারতের সঙ্গীতজগতে বেশি পরিচিত এবং যাঁর প্রভাব মান্না দে-র ওপর সবচেয়ে বেশি৷ জন্ম ১৯২০ সালের পয়লা মে৷ ১৯৩৬ সালে স্কটিশ চার্চ থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস৷ ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগরে পড়ে লেখাপড়ার পাঠ শেষ৷ তার পর কেবল সঙ্গীতচর্চা৷
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সুরকার হিসেবে সঙ্গীতজীবন শুরু৷ তাঁরই সুরে শালেন রায়ের লেখা একটি গান রেকর্ড করেন৷ সুপ্রীতি ঘোষ৷ ১৯৪২ সালে বোম্বাই যান কাকা কে সি দে-র সহকারী হিসেবে৷ ১৯৪৩ সালে করেন সিনেমায় প্রথম প্লে-ব্যাক৷ সুপাইয়ার সঙ্গে দ্বৈতকমে ‘তমন্না’ ছবিতে৷ একক প্লে-ব্যাক ‘রামরাজ্য’ ছবিতে৷ ইতিমধ্যে কাকার কাছে গান শেখা ছাড়াও ওস্তাদ আমান আলি খান, আবদুর রহমান খান, দবির খান, গুলাম মুস্তাফা খানের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালিম নেন৷ সহকারী সঙ্গীত পরিচালকের কাজ কে সি দে ছাড়াও আরও অনেকের সঙ্গে করেছেন৷ যেমন অনিল বিশ্বাস, প্রেমচাঁদ প্রকাশ, শচীন দেববর্মন৷ গায়ক হিসেবে প্রভুত সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শচীন দেববর্মণের সুরে ‘মশাল’ ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি গেয়ে৷ ‘আওয়ারা’ ছবিতে গান গাওয়ার সূত্রে রাজ কাপুরের সঙ্গে সখ্য৷ সেই সখ্যের ফসল ‘ববি’ পর্যন্ত রাজ কাপুরের ছবিগুলিতে তাঁর একের পর এক গান৷ তার পর দীর্ঘ দীর্ঘ বছর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর রেখে গেছেন৷ সলিল চৌধুরির সঙ্গেও সখ্য ছিল৷ ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিতে গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেন৷ বিমল রায়ের ‘পরিণীতা’ ছবিতে ‘বলে রাধারানী’ গান তা আজও অবিস্মরণীয়৷ তা ছাড়া গান গেয়েছেন বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালম, তেলুগু, ওড়িয়া, অসমিয়া, পাঞ্জাবি ইত্যাদি ভাষায়৷
প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করেই পান জনসাধারণ সাফল্য, গান দুটি ছিল ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ এবং ‘হায় হায় গো৷’৷ বাংলা ছবিতে উত্তমকুমারের ঠোঁটে প্রথম নেপথ্য সঙ্গীত ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে৷ রাজ কাপুরের বাংলা ছবি ‘একদিন রাত্রে’-তে ‘সব সত্যি’ গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে দেন৷ বাংলা ছবি ‘ডাকহরকরা’ ছবিতে বাউল শান্তিদেব ঘোষের নাচের সঙ্গে তারাশঙ্করের লেখা গান — ‘লাল পাগুড়ি বেঁধে মাথে’ বাঙালি আজও মনে রেখেছে৷ ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে গান গেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন৷ ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতেও তাই৷ ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গানের জন্য নেপথ্য গায়কের পুরস্কার পান এবং ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে গানের জন্য পান শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়কের পুরস্কার৷ তা ছাড়া ১৯৭১ সালে পান ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব৷ সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন কয়েকটি ছবিতে৷ যেমন ‘রামধাক্কা’, ‘লোলিতা’, ‘রিস্তে কি দিবার’ ইত্যাদি৷ সব গানেই ছিল তাঁর অনায়াস প্রতিভা — রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে কাওয়ালি৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে’ এবং ‘ওগো স্বপ্নস্বরূপিনী’ ও আরও তিনটি তাঁর গাওয়া গান অসাধারণ জনপ্রিয়তা পায়৷
কণ্ঠস্বরের মাদকতা, ত্রিসপ্তকে স্বচ্ছন্দে বিচরণের দক্ষতা, মীড়ের নৈপুণ্য তাঁর গাওয়া গানে গভীর মাত্রা যোগ করেছে৷ বিশেষ করে প্রেমের গানে এক ধরনের বিষণ্ণতা ও আবেগ সহজেই তিনি ছড়িয়ে দিতে পারতেন৷ রাগাশ্রয়া গান হলে তাঁকেই আগে ডাকা হত৷ ‘পুছোনা ক্যায়সে’, ‘লাগা চুনরি মে দাগ’, ‘ছমছম বাজেরে পায়েলিয়া’, ‘ছনক ছনক তোরে বাজে’, ‘তেরে নয়ন গোরি তোরে’ ইত্যাদি গানে তিনি ছিলেন অত্যুত্তম৷ তাছাড়া পশ্চিমি সুরের আদলে ‘এ ভাই জারা দেখ কে চলো’, ‘আও টুইস্ট করে’, ‘প্যার কি আগমে তব বদন জ্বল গিয়া’ ইত্যাদি গান বারবার শোনার মতো৷ তাছাড়া বাংলা গানে তো কথাই নেই৷ একের পর এক গান গেয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন বঙ্গসমাজকে৷ ‘আমার না যদি থাকে সুর’, ‘এ কী অপূর্ব প্রেম দিলে’, ‘ভোমরা রে’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ মান্না দে-র গলায় অপূর্ব মহিমা পেয়েছে৷ তিনি সন্ন্যাসী রাজা, তিন ভুবনের পারে, মর্জিনা আবদুল্লা, বিলম্বিত লয়, স্ত্রী, নিশিপদ্ম, মৌচাক, বসন্তবিলাপ, ছদ্মবেশী ইত্যাদি ছবিতে গান গেয়েছেন৷ ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘বাজে গো বীণা’, ‘বেঁধো না ফুলমালা ডোরে’, ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’, ‘বড় একা লাগে’, ‘কেন ডাকো মিছে পাপিয়ার মতো, ‘আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না’, ‘জীবনে কি পাব না’, ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’ ইত্যাদি গান বাঙালির মনে অক্ষয় হয়ে আছে৷ বিভিন্ন গানে নাটকীয় মহিমা দিতে পারতেন তিনি৷ সুর রচনায় তিনি নতুন স্টাইল এনেছিলেন৷ আশা ভোসলের গাওয়া ‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম’ কিংবা হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘সুখের দিনগুলি দূরে চলে যায়’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়৷ তবে সুর রচনায় যতটা, তার চেয়ে বেশি তিনি জনপ্রিয় তাঁর গাওয়া গানে৷ ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’ দারুণ হিট গান৷ নজরুলের গানেও তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন৷ তবে আসলে তিনি প্রেমের গানে সম্রাট৷
তাঁর প্রিয় গায়ক মহম্মদ রফি এবং গায়িকা লতা মঙ্গেশকর৷ তবে সকলকে ছাড়িয়ে তাঁর প্রিয় গায়ক ও সঙ্গীতগুরু কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে৷ তিনি প্রায়ই বলতেন— ‘কাকার ভাইপো আমি, ওঁর ছায়ায়ই তো আমি মানুষ হয়েছি৷’
তিনি বিদেশ সফর করেছেন বেশ কয়েকবার৷ গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আফ্রিকা, মরিশাস, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রভৃতি দেশে গান গাইতে গিয়েছিলেন৷