পারো যদি ফিরে এসো – সুরজিৎ সেনগুপ্ত

পারো যদি ফিরে এসো – সুরজিৎ সেনগুপ্ত

আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন অন্য কোনও স্কুল থেকে বরুণ এসে ভর্তি হল আমাদের ক্লাসে৷ বরুণ ভারী সুন্দর গান গাইত, তাই আমার সঙ্গে ভাব হল অচিরেই৷ আমার বাড়িতে একটা গান-বাজনার পরিবেশ ছিল৷ না, আমাদের পরিবারে কোনও বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ছিল না, তবে বাবা-মায়ের প্রবল আগ্রহে বাড়িতে ছিল গান-বাজনার চর্চা৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত তো ছিলই, সঙ্গে ছিল হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা৷ মা-বাবার অতি প্রিয় একটা মার্ফি রেডিও ছিল যার সুবাদে তিনটে অনুষ্ঠান নিয়মিত শোনার সুযোগ পেতাম— শুক্রবারের বাংলা নাটক, অনুরোধের আসর আর রম্যগীতি৷ ফলে, বাংলা আধুনিক গানের প্রতিও আমাদের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু আমাদের বাড়ির বড়দের মধ্যে সেই অর্থে মান্না দে-র ভক্ত বলে তেমন কেউ ছিল না৷ মান্না দে তখনও বোধহয় তেমনভাবে বাংলা গান গাইতে শুরুও করেননি৷

আমরা দুই সঙ্গীতপ্রিয় বন্ধু স্কুলের কাজের পাশাপাশি গান শুনতে শুনতে বড় হতে লাগলাম৷ খেলাধুলোর ব্যাপারে যতখানি আগ্রহ ছিল, প্রায় ততখানিই আগ্রহ ছিল গানের ব্যাপারে৷ আর একটু বড় হয়ে বুধবার রাত্রি আটটায় রেডিও সিলোন-এ বিনাকা গীতমালা-র ভক্ত হয়ে উঠলাম৷ দেবব্রত বিশ্বাস আর মহম্মদ রফি প্রায় সবটা আকর্ষণ যখন টেনে নিচ্ছে তখনই বরুণের উৎসাহে শুনে ফেললাম মান্না দে-র গাওয়া ‘চাঁদের আশায় নিভায়েছিলাম যে দীপ আপন হাতে…’৷ অদ্ভুত এক ভাল লাগার অনুভূতি হল৷ বরুণ ইতিমধ্যে মান্না দে-র অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছে, তারই প্রভাব আমার মধ্যেও পড়তে শুরু করল৷

আরও একটা কথা সঙ্কোচের সঙ্গে বলে ফেলতে হচ্ছে৷ বাড়িতে রেকর্ড, রেডিও বা দাদা-দিদিদের মুখে গান শুনে শুনে আমিও গান গাইতে পারছিলাম এবং আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে প্রচুর শ্রোতাও তৈরি করে ফেলেছিলাম৷ আমার এক মামার বিয়েতে মামাদের প্রতিবেশীরা আমাকে আর আমার ভাইকে রসগোল্লার লোভ দেখিয়ে গান শুনতে চাইত৷ মান্না দে-র গান যত শুনতে শুরু করলাম, বুঝলাম ইতিমধ্যে মান্না দে-র ভক্তসংখ্যা বাড়ছে৷ অনুরোধের আসরে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেতে শুরু করল৷ ততদিনে আমরাও বড় হয়ে উঠেছি, প্রেম করতে শুরু করেছি৷ এই সন্ধিক্ষণে এসে মান্না দে আমাকে আরও বেশি আকৃষ্ট করলেন৷ হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত— এই দুইয়েরই প্রভাব মান্না দে-র গানে ছিল বলে সে গানে আকৃষ্ট হতে আমাদের সময় লাগেনি৷ তার ওপর আবার অধিকাংশ গানেই পরাজিত বা আহত প্রেমিকের কথা তৎকালীন প্রেমিকাদের খুব ভাল লাগত৷ ‘আমি নিরালায় বসে’, ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘পারো যদি ফিরে এসো’, ‘তুমি নিজের মুখেই বললে যেদিন সবই তোমার অভিনয়’ ইত্যাদি গান আহত প্রেমিকের গান৷ অনেক প্রেমের গান এমনও গেয়েছেন মান্না দে যা ওঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে— ‘আমার না যদি থাকে সুর’, ‘ও আমার মন যমুনার’, ‘আমার একদিকে শুধু তুমি, পৃথিবী অন্যদিকে’ ইত্যাদি৷

স্কুল ছেড়ে কলেজ, কলকাতার খেলার মাঠ হয়ে এগোতে এগোতে আমারও পরিচিতি হল৷ ইতিমধ্যে মান্না দে বলিউডে বেশ কিছু ‘হিট’ গান গেয়ে ফেলেছেন৷ রাজকাপুরের লিপে একাধিক, মেহমুদের লিপে একাধিক, বলরাম সাহানির লিপে ‘অ্যায় মেরি জ্যাহের জবি’, জনি ওয়াকারের লিপে ‘কিসনে ছিলমন সে মারা’, অশোক কুমারের লিপে ‘পুছো না ক্যায়সে’— আরও বেশ কিছু৷ ফলে, মান্নাদা-কে বম্বেতে গিয়ে পাকাপাকিভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে হয়৷ সেই সময়েই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ হয়৷ কারণ, আমি তখন বছরে অন্তত একবার করে বম্বে যেতে শুরু করেছি রোভার্স কাপ খেলার জন্য৷ আর এটা প্রায় সর্বজনবিদিত যে সেই সময় বলিউডের চলচ্চিত্র বা সঙ্গীত শিল্পীদের প্রায় সকলেই রোভার্স কাপ এবং ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সম্পর্কে অবহিত ছিল৷ বাঙালি বা অবাঙালি নির্বিশেষে কলকাতার ফুটবল দল নিয়ে আগ্রহী ছিল৷ তাদের মধ্যে যারা ফুটবলপ্রেমী তারা তো বটেই, যারা তা নয় তারা শচীন দেববর্মনের মতো কিছু পাগল ফুটবল-ভক্তের প্রভাবে রোভার্স কাপের সময়ে সিনেমার চেয়ে ফুটবল নিয়েই বেশি মেতে উঠত৷ ৭৩ বা ৭৪ সালে আমি রোভার্সে গেছি মোহনবাগানের হয়ে৷ সেই সময় মান্না দে দু’একবার আমাদের ক্যাম্পে এসেছেন, কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচয় হয়নি৷ ৭৫ সালে যখন আমি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে রোভার্স খেলতে গেলাম তখন প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয় মান্নাদা-র সঙ্গে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ফাইনাল খেলা দেখতে এসেছিলেন এস ডি বর্মনের সঙ্গে৷ সেই পরিচয় পরে একাধিক সাক্ষাতে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে উৎসবে-অনুষ্ঠানে বা হঠাৎ পথে-ঘাটে দেখা হলে উনি আমায় চিনতে পারতেন, আমি তো চিনতামই৷

একবার আমরা ভারতীয় ফুটবল দলের হয়ে শুভেচ্ছা সফরে যাচ্ছিলাম আফ্রিকা৷ এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি থেকে নেমে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছি, হঠাৎ দেখি গাড়ি থেকে নামছেন মান্না দে আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তি৷ সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন, ওদেরও বেশ বড় দল, অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন৷ কথা হল, জানা গেল আমরা দু’দলই ‘কিনি এয়ারওয়েজ’-এর ফ্লাইটে লুসাকা যাচ্ছি৷ আমরা যখন প্লেনে উঠলাম মান্নাদা-রা বসে পড়েছেন৷ আমাকে ডেকে ঠিক পিছনের সিটে বসতে বললেন আড্ডা মারতে মারতে যাবেন বলে৷ আমাদের আড্ডার মাঝপথে সামনের সিট থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসলেন নৃত্যশিল্পী গোপীকিষান৷ মান্নাদা আলাপ করিয়ে দিতে আমি ওঁর দু-একটা নাচের দৃশ্যের উল্লেখ করতে উনি যারপরনাই খুশি হলেন৷ আড্ডা চলতে চলতে রসিক মান্নাদা বললেন, ‘গোপীজি’র খুব দুশ্চিন্তা, ও ক্রমশ মোটা হয়ে যাচ্ছে৷ সুরজিৎ, তুমি কিছু ফিট থাকার টিপস দিয়ে দাও৷’ মান্নাদা রসিকতা করলেও গোপীকিষানজি খুব সিরিয়াসলি আমার কাছ থেকে কিছু ব্যায়াম শিখে নেওয়ার চেষ্টা করলেন৷

মান্নাদা-র রসবোধের পরিচয় আরও কিছুটা পাওয়া গেল কয়েক ঘণ্টা পরে৷ ভোর হয়ে এসেছে, বিদেশের সময় অনুযায়ী তখনও অন্ধকার৷ আমাদের তো ভারতীয় ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী ভোরের চা-এর দরকার হয়ে পড়েছে৷ সবার আগে জাগলেন মান্নাদা আর বেল টিপে হোস্টেসকে চা দিতে বললেন৷ সে চা আর আসে না৷ মান্নাদা-র সঙ্গে সঙ্গে আমিও একবার বেল টিপলাম, চায়ের প্রতিশ্রুতিও পেলাম, কিন্তু চা পেলাম না৷ মান্নাদা বিরক্ত হচ্ছেন, অধৈর্য হচ্ছেন, কিন্তু রসবোধ যায়নি৷ বেশ উঁচু স্বরেই আমায় বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো সুরজিৎ, এটা কিনি এয়ারওয়েজ নাকি দুখিনি এয়ারওয়েজ?’

মান্না দে মানুষ হিসেবে ছিলেন খুবই ঋজু চরিত্রের৷ খুব পরিষ্কার কথা বলতে পছন্দ করতেন৷ অনেকে ভাবত তাঁকে অনেকে অপছন্দ করত৷ কিন্তু এমনটা কখনই শোনা যায়নি যে তাঁর অনেক শত্রু ছিল৷ মান্না দে যে স্পষ্ট কথা বলতে ভালবাসতেন তা দু-একটা টিভি সাক্ষাৎকার দেখে আন্দাজ করা যায়৷ তাঁর যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তা সবাই জানে৷ তবু তিনি রবীন্দ্রনাথের গান স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেননি৷ এ ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কণ্ঠ থাকলে তিনি সে কথা ভেবে দেখতেন৷ বলিউডে প্রায় একই সময়ে প্রতিযোগী গায়ক হিসেবে কাজ করা সত্ত্বেও যখনই মহম্মদ রফি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে মান্নাদা বলেছেন যে রফিই শ্রেষ্ঠ৷

মান্না দে-র চরিত্রের আর একটা বৈশিষ্ট্য আমি প্রত্যক্ষ করেছি৷ বড়ই নরম মনের মানুষ ছিলেন তিনি৷ কেউ ভাল গান গাইলে, সে তাঁর থেকে বয়সে অনেক ছোট হলেও অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন৷ কোনও ভাল গান শুনলে, সে গান যে-ই গান না কেন, এমনকী নিজে গাইলেও তিনি আবেগবিহ্বল হয়ে পড়তেন, চোখের কোণ চিকচিক করত৷ একবার মহাজাতি সদনে একটা অনুষ্ঠান শুনতে গিয়েছিলাম৷ এর দিন তিনেক আগে শ্রদ্ধেয় সুরকার নচিকেতা ঘোষ প্রয়াত হয়েছিলেন৷ মঞ্চে উঠে প্রথমেই শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে মান্না দে বললেন আজ যেন তারা কোনও অনুরোধ না করে, আজ যেন তাঁকে নিজের মতো করে গাইতে দেওয়া হয়৷ সে অনুষ্ঠানের স্মৃতি আজও আমার কাছে অম্লান৷ আর একটা অনুষ্ঠানে মঞ্চে ওঠার বেশ কিছুটা আগে যখন মান্নাদা গ্রিনরুমে রিহার্সাল করছেন তখন তপা (মান্নাদা-র ভাইপো) আমায় সেখানে নিয়ে গেল৷ যথারীতি উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম, বসে গেলাম রিহার্সাল শুনতে৷ এমনই মজে গেলাম যে মনে হচ্ছিল অনুষ্ঠান যত দেরিতে শুরু হয় ততই ভাল৷ মান্নাদা অদ্ভুত অদ্ভুত গান একটু একটু করে গাইছিলেন৷ আমি অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য একটা গানের অনুরোধ করে বসলাম— ‘নথনি সে টুটা মোতি রে, কাজরারি আঁখিয়া রহে গই রোতি রে’৷ শুনে মান্নাদা হারমোনিয়াম থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ও রাধুবাবু, শুনুন, সুরজিৎ কীসব গান শুনতে চাইছে৷ সুরজিৎ, অনুষ্ঠানে নয়, তুমি বাড়িতে এসো, জমিয়ে গান-বাজনা হবে৷

সে সুযোগ আর আমার কপালে জোটেনি৷ তবে, দেখা হয়েছে পালে পার্বণে, কুশল বিনিময় ছাড়া কথা হয়েছে দু’চারটেই৷ শেষ যেবার দেখা হয় তখন তিনি আশি পেরিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়েছেন৷ তবু, কলকাতার কিছু শ্রোতা গান শোনার জন্য ডাকছে, মনের মতো করে গাইতে পারবেন না জেনেও ভালবাসার ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি৷ সেবার দু’চার কথায় বুঝতে পেরেছিলাম রোভার্স কাপের খেলা দেখা অনেকদিন ছেড়েছেন৷ ‘শচীনদা মারা যাওয়ার পর ধীরে ধীরে মাঠে যাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিল৷ ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের খেলা তো আর শুধুই খেলা নয়, ওটা একটা কালচার৷ ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে শচীনদার আমাকে সঙ্গে নেওয়া বা আমার শচীন দা-র সঙ্গে যেতে রাজি হওয়া কি শুধুই খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য? নো, ইট ওয়াজ মাচ মোর দ্যান জাস্ট উইনেসিং এ ফুটবল ম্যাচ৷ সুরজিৎ, এখন কলকাতার ফুটবলের কী খবর?’

সেবার কথা বলে মনে হয়েছিল মান্নাদা যেমন ফুটবল কালচারটা মিস করতেন, ঠিক তেমনই আজকের প্রবহমান বাংলা গানের সংস্কৃতি নিয়েও তাঁর কিছু রিজার্ভেশন ছিল যা সৌজন্যের কারণে সব সময়ে প্রকাশ করতেন না৷ স্পষ্ট বক্তা হয়েও মান্নাদা ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্র ও মার্জিত বাঙালি৷ আমিও বাঙালি হয়েই বলি— পারো যদি ফিরে এসো, তোমারই থাকবো আমি তখনও৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *