সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে – শমীন্দ্র রায়চৌধুরি

সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে – শমীন্দ্র রায়চৌধুরি

কিংবদন্তিদের কেমন দেখতে হয়?

কোন ভাষায় কথা বলেন?

খুশি বা দুঃখ প্রকাশ করেন কীভাবে?

এতসব প্রশ্নের উত্তর দিলেন মান্না দে৷ মুখোমুখি বসে কথা, রেকর্ডিংয়ে তাঁর হটপট থেকে ডিম রুটি, ফোনের ও প্রান্ত থেকে কথা বলা, এমনকী তাঁর জন্য গান লেখা! এই ছিল আমার গণ্ডি৷ আট দশকের শেষে পরিচয় সাংবাদিক হিসেবে৷ জুহুর কর্নার প্লটের বাড়ি ‘আনন্দম’৷ অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এই রাস্তাতেই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে মান্না দে’র রেওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন অমিতাভের বাবা হরবনশ রাই বচ্চন! এই বাড়ির ছাদ থেকেই মহম্মদ রফির ঘুড়ি কেটে দিতেন মান্না দে? দীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারে মান্না দে বলেছিলেন, সরকার জমি দিলে কলকাতায় বাড়ি করে থাকবেন৷ যা অবশ্য কোনওদিন হয়নি৷ আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে বাঙালির রেষারেষির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওঁর গানের বাংলা উচ্চারণ খেয়াল করেছেন? কত মোলায়েম করে বলেন? আমি তো শিখি তাঁর থেকে৷’ সে সময় তাঁর ইচ্ছে ছিল, কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র নামে কলকাতায় এক আকাদেমি তৈরির কথা৷ সেখানে একজন শিক্ষার্থী তৈরি হবেন৷ সর্বভারতীয় মানের গায়ক হিসেবে৷ যেভাবে নিজেকে তিনি গড়েছিলেন৷ অবশ্য বাস্তবে এ স্বপ্নও রূপায়িত হয়নি৷

মান্না দে’র মধ্যে গায়ক সত্তার পাশাপাশি ছিল শিক্ষক সত্তা৷ যন্ত্রশিল্পী হিসেবে প্রায় পঁচিশ বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন গিটারিস্ট স্বপন সেন৷ তাঁর দেখা, লতা মঙ্গেশকর থেকে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি পর্যন্ত যে কারও সঙ্গে মান্না দে ডুয়েট গেয়েছেন, অভিভাবকের মতো তাঁদের গাইড করেছেন৷ একবার এক কমবয়সি শিক্ষার্থীকে বাবা-মা নিয়ে আসেন মান্না দে’র আশীর্বাদের জন্য৷ উনি তাকে বলেছিলেন, ‘তোমার প্রতিভা যতই থাক শুধু রেওয়াজ করে যাও৷ অন্য কিছু নিয়ে ভেবো না৷’

আবার সেই একই কথা বলেছিলেন স্বপন সেনকেও৷ গিটারিস্ট হিসেবে যার তখন বিস্তর সুনাম৷ তাকেও বলেন, আমার কাছে আসার আগে রেওয়াজ না করে আসবে না৷ এই একটি ব্যাপারে মান্না দে’র নিষ্ঠা যে কতখানি তা তাঁর ঘনিষ্ঠরাই জানেন৷ মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে রেওয়াজের সময় ভুল করে ঢুকে পড়া জলসার উদ্যোক্তাদের দূর দূর করে কতবার যে তাড়িয়েছেন মান্না দে তার ইয়ত্তা নেই৷ টাকা পয়সা নয় ভাল করে গান করাটাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য৷ এই প্রসঙ্গে যন্ত্রশিল্পীদের অন্যতম তবলিয়া দীপঙ্কর আচার্যর দেখা এক ঘটনা এই রকম৷

শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠান, আয়োজকদের সঙ্গে কথা পাকা৷ অনুষ্ঠানের একদিন আগে দীপঙ্করকে মান্না দে জানান, কালকে শিলিগুড়িতে যাব না৷ উদ্যোক্তাদের কথা দেওয়া হয়েছে, প্লেনের টিকিট কাটা তারপরও কেন এই সিদ্ধান্ত? দীপঙ্করের প্রশ্নের জবাবে মান্না দে জানান, ‘ওরা যে টাকা আমাকে দেবে বলেছিল, গতকাল ফোন করে বলছে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা বেশি দেবে৷ মনে হয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়৷ সুতরাং আমি যাব না৷’ নির্ধারিত দিনে দীপঙ্করের অভিজ্ঞতা, কলকাতায় অনুষ্ঠান করলেন মান্না দে৷ কোনওরকম পারিশ্রমিক ছাড়াই৷ বরং মিউজিশিয়ানদের টাকা দিলেন নিজের পকেট থেকে৷ এরকম আর এক ঘটনা৷ বাঁশি বাজিয়ে মানব মুখোপাধ্যায়ের কাছে শোনা, লোডশেডিংয়ে স্টুডিওর কাজ বন্ধ৷ সেদিনই বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে যাবার কথা মান্না দে’র৷ অবস্থা দেখে নিজেই টাকা দিয়ে জেনারেটরের ব্যবস্থা করলেন৷ ফ্লাইট বাতিল করলেন৷ কাজ শেষে মিউজিশিয়ানদের মিষ্টি খাওয়ালেন৷ আসলে গান তাঁর কাছে ছিল পুজোর মতো৷ ভক্ত যে মন নিয়ে ভগবানকে ডাকে, উনি সেই পবিত্রতায় গান গাইতেন৷ একটু এদিক-ওদিক হলে কি হয় তা বোঝা যাবে শান্তিনিকেতনের ঘটনায়৷ ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে সবাই চলেছেন৷ এর মধ্যে কামরায় উঠলেন এক স্থানীয় বাউল ‘ভোলা মন’ বলে সে এক লম্বা টান দিতেই গল্প থামিয়ে মান্না দে সঙ্গী দীপঙ্করকে বললেন, ওকে ডেকে আনো৷ বাউল কাছে আসতেই মান্না দে তাঁর খুব তারিফ করলেন আর দিলেন একশো টাকা৷ আর একটা গান শোনাতে বললেন৷ দ্বিতীয় গানের পর দীপঙ্কর সেই বাউলকে বললেন, জানেন কাকে গান শোনালেন? পরিচয় জানার পর সেই বাউল তো সাষ্টাঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মান্না দে’র পায়ের কাছে৷ তারপর অতি উৎসাহে সেই বাউল নিজস্ব স্টাইলে শোনাতে শুরু করলেন, ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’, বলে আবার একটা টান! যা সে গানে থাকার কথাই নয়৷ মান্না দে এবার তাকে থামালেন৷ বেশ হয়েছে বলে আর শুনলেন না সে গান৷ আসলে গানের ব্যাপারে মানুষটির পরিমিতি বোধ ছিল লক্ষণীয়৷ যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি বা কমে ছিল আপত্তি৷ অযথা কালোয়াতি একেবারেই পছন্দ করতেন না৷ গান নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা৷ তাঁর মনোভাব বোঝাতে উত্তর কলকাতার ঘটনাটা শোনানো যেতে পারে৷ স্থানীয় এক বিধায়কের উদ্যোগে বাংলা গানের বিরাট আয়োজন, অনেক শিল্পীই ছিলেন সে রাত্রে৷ বাড়ি থেকে অনুষ্ঠানে যেতে যেতে দীপঙ্কর তাঁকে বললেন, ‘আসরটা কিন্তু বাংলা গানের৷ আপনি কিন্তু হিন্দি গান গাইবেন না৷’ কথা শুনেই রেগে উঠলেন মান্না দে৷ বললেন, ‘ওসব আমি বুঝব! তোমাকে কিছু বলতে হবে না৷’ মঞ্চে মান্না দে উঠলেন৷ ‘শুরুতেই জানতে চাইলেন বাংলার পাশাপাশি আমি যদি হিন্দি গান গাই আপনাদের আপত্তি নেই তো’? মান্না দে’র মুখে এ কথা শুনে দর্শকরা একবাক্যে তাদের সমর্থনের কথা জানিয়ে দিল৷ গান ধরার আগে দীপঙ্করের দিকে একবার শুধু তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি কতটা ঠিক৷ সেই সন্ধ্যায় হিন্দি গানের অনুরোধ জানিয়ে যে ক’টা স্লিপ এসেছিল তাও তিনি দিয়ে দিচ্ছিলেন দীপঙ্করকে৷ আসলে মান্না দে’র কাছে গানের সংজ্ঞা কেবল ভাল গান৷ উর্দু, হিন্দি, মারাঠি, পাঞ্জাবি বা বাংলা বলে আলাদা কিছু নয়৷ গানের কথা নিয়ে মান্না দে’র খুঁতখুঁতুনি ছিল দারুণ৷ নিজেই যেমন বলেছিলেন, আমি সুর করতে পারি তবে— গানের কথা পছন্দ না হলে নয়৷ এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলা দরকার৷ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর আচার্য মান্না দে’র মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে গিয়েছিলেন, পুজোর গান তৈরির জন্য৷ ছিয়াশি সালের সেই গানের একটি ছিল, ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে’৷ গানের কথা শুনে মান্না দে দারুণ রেগে গেলেন!

পুলকবাবু, মৃণালবাবুকে বললেন, এসব কি কথা লিখেছেন? পুলকবাবু গানের মানে বোঝানোর চেষ্টা করতেই মান্না দে তাঁকে থামিয়ে দিলেন৷ বললেন, ‘আপনি এ ধরনের গান লিখেছেন জানলে সুলোচনা আর আপনাকে বাড়ি ঢুকতেই দেবে না৷’ পুলকবাবু মৃণালবাবুর কোনও আপত্তি তো মান্না দে শুনলেনই না বরং সেদিন আর গান না করে উঠে গেলেন৷ পাঠকদের মনে থাকতে পারে সেই গানটি পরে কিশোরকুমার গেয়েছিলেন৷ ‘তুমি কত সুন্দর’ ছবির জন্য৷ আরও এক ঘটনা, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গান শেখানো চলছে ‘মা আমার মা’ অ্যালবামের জন্য৷ গানের কথায় ছিল, ‘যখন এমন হয় পৃথিবীটা মনে হয় ব্যস্ত আবর্জনা, মনে হয় গঙ্গায় ঝাঁপ দি, রেলের লাইনে মাথা রাখি…৷’

গানের কথা শুনে মান্না দে আবার রেগে গেলেন, কিছুতেই সে গান করবেন না! দুজনকেই প্রচণ্ড ধমকালেন৷ তারপর পুলকবাবু অনেক বুঝিয়ে সে গান গাওয়ান তাঁকে দিয়ে৷ আর, অ্যালবাম প্রকাশের কিছু মাস পরই গঙ্গায় আত্মহত্যা করেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বন্ধুর সে চলে যাওয়া তাঁকে যে কতটা বেদনাবিদ্ধ করেছিল ঘনিষ্ঠরা তা জানেন৷ এরপর যত অনুষ্ঠান করেছেন, বারবার বলেছেন ‘পুলকের চলে যাবার কথা’৷ বন্ধুকে নিয়ে গানও গেয়েছেন৷ প্রসঙ্গত, গাইয়ে মহলে গান তোলানোর কথাটা চালু আছে৷ কথা প্রসঙ্গে কেউ বলেন, গান তুলতে হবে বা গানটা এসে তুলিয়ে নিয়ে যেও৷ মান্না দে তথাকথিত ‘গান তোলায়’ বিশ্বাস করতেন না৷ সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষের অভিজ্ঞতা, ‘উনি বলতেন গানটা শিখিয়ে দিও৷’ সুরকারের বয়স যাই হোক, গান শেখানোর সময় তার কর্তৃত্ব বারবার স্বীকার করেছেন মান্না দে৷ একটা গান শেখার সময় বারবার এবং বারবার সুরকারকে বলতেন গানটি গাইতে৷ সুরকার কেমন ভাবে গানটির কথা বলছেন সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন৷ প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে ওঁর নাটক বা দক্ষতার কথা সকলেরই জানা৷ নার্গিস, রাজকাপুর, মেহমুদের মতো শিল্পীদের জন্য বহু গান করেছেন তিনি৷ সারা দেশ যখন তাঁর দক্ষতার কথা জানে, অভিজ্ঞতাতেও প্রবীণ তখনকার এক ঘটনা৷

দীনেন গুপ্তর ছবি, সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ‘নিশি তৃষ্ণা’ ছবির রেকর্ডিংয়ে গান করার আগে মান্না দে জানতে চান, কার লিপে গানটি থাকবে? মনোজ মিত্র গাইবেন বলার পর তাঁকে ডেকে পাঠানো হল স্টুডিও-তে৷ অভিজ্ঞতার সাক্ষী মানব মুখোপাধ্যায় বলছেন— ‘গান গাওয়া ছেড়ে মান্নাদা মনোজবাবুর সঙ্গে গল্প শুরু করলেন৷ তার বেশ পরে গান রেকর্ড করা হল৷ বুঝলাম, মান্নাদা মনোজবাবুর কথা বলার ভঙ্গি বা ঢং বোঝার পর গান গেয়েছেন৷’ মান্না দে’র নকল করার ভঙ্গি যে কেমন ছিল তা তাঁর সঙ্গে গল্প না করলে বোঝাই যেত না৷ কলামন্দিরে সংবর্ধনার আসরে নবদ্বীপ হালদারের গলা নকল করে শুনিয়েছিলেন৷ গান শিখতে বসা হৈমন্তী শুক্লাকে কীভাবে গানের এক্সপ্রেশনকে সংবৃদ্ধি করা যায় শিখিয়েছেন৷ একাধিক সুরকারের সহযোগী হিসেবে গান শেখানোর ফলে নিজেও বোধহয় শিক্ষিত হয়েছেন৷ প্লেব্যাক গান তো শুধু স্কিল নয় তাহলে তো যে-কোনও ধ্রুপদীয়া বা খেয়ালিয়া-কে নিলেই চলত! এর সঙ্গে প্রয়োজন এক্সপ্রেশনের৷ সেই নাটকীয়তার সক্ষমতা না থাকলে চলবে কেন?

গান বা কথার ব্যাপারে যে মানুষটি এত খুঁতখুঁতে তিনি কীভাবে রোজগারের ব্যাপারে বেখেয়াল হতেন তা শোনা দীপঙ্করের কাছে৷ মান্না দে’র ভাইপো তপা মারা যাওয়ার পর বেশ কিছুটা সময় আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলতেন দীপঙ্কর৷ তার অভিজ্ঞতা ‘মান্নাদা ফাংশনে যেতে রাজি হলে আগেই মুখে বলে দিতেন বা ‘কনসেন্ট লেটার’ দিয়ে দিতেন৷ অধিকাংশ গাইয়েরা যেমন অগ্রিম নেন তা তিনি নিতেন না৷ যা হবে ফাংশনের পরে৷’ সুরকার অজয় দাস বা মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ডিংয়ের আগে টাকাপয়সা দিতে গেলেও, বলতেন ‘ওসব পরে হবে’৷ এর ফলে ওঁর যে অভিজ্ঞতা হত তাও সুখের নয়৷ কারণ, তাঁকে যে সবসময় প্রতিশ্রুতি মতো টাকা দেওয়া হত এমন নয়৷ উদ্যোক্তারা যা দিতেন মান্না দে না গুনে সে টাকাই নিয়ে নিতেন৷ বহুবার দেখা গেছে বেশ কিছু টাকা কম দেওয়া হয়েছে৷ জানার পর উনি বলতেন তবে তার বেশি কিছু নয়৷ সেক্ষেত্রে ফাংশনের পর আয়োজকরা হয়ত তাঁকে পুরো টাকা দিতে পারেননি, জানার পর তাও উনি নেননি৷ মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশে গিয়েও তাঁর এমন অভিজ্ঞতার কথা জানেন দীপঙ্কর৷ কম বয়স থেকে মান্না দে’র কুস্তি ও বক্সিংয়ের ব্যাপারটা অনেকেই জানেন৷ কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র আমন্ত্রণে মদন ঘোষ লেনে এসেছিলেন কুস্তিগির গোবর গুহ৷ খেতে বসে নজরে পড়ে মান্নাকে৷ নিজেই কৃষ্ণচন্দ্রকে বলেছিলেন ‘ওকে আমার আখড়ায় পাঠিয়ে দেবেন৷’ সেই শুরু শরীর চর্চার৷ পঁচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত সকালে উঠে খানিকটা সময় ব্যায়াম না করে হারমোনিয়মে বসতেন না তিনি৷ শরীর চর্চার এই নিয়মের কথা মান্না দে স্বয়ং গল্প করেছেন স্বপন সেনের কাছে৷ শিল্পী মহলে মান্না দে’র শরীর চর্চা এক বিশেষ আদর্শ৷ গানের জগতে কম বয়সে ঢুকলেও মান্না দে’র প্রতিষ্ঠা অনেক পরে৷ শচীনকর্তার কাছে গান শিখে সে গান পরে মহম্মদ রফিকে তোলাতে হয়েছে এমনও হয়েছে! তবু সেই মানুষটি আক্ষেপ করলেও নিজের কাজ থেকে কখনও বিরত হননি৷ গানের সহকারী পরিচালক হিসেবে তাঁর সেই অভিজ্ঞতা বরং তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল৷ সেই সময় থেকে নিজস্ব এক নোটেশন ফলো করতেন৷ গানের কথার ওপরে লিখে নিতেন সেই সরগম৷ দারুণ জনপ্রিয় ‘কফি হাউস’ গানটির তেইশ বছর পর দ্বিতীয় পর্ব ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ লেখার সুযোগ হয়৷ তার রেকর্ডিংয়ে দেখা মান্না দে কীভাবে মিউজিক চলাকালীন নিজে নোটেশন লিখে নিচ্ছেন৷ লেখার পর আর এক দফা রিভিশন৷ তারপর গিয়ে বসলেন রেকর্ডিং চেম্বারে৷ সুপর্ণকান্তি ঘোষ সুরারোপিত দ্বিতীয় পর্বের গানটির রেকর্ডিংয়ে মান্না দে আসেন বেলা দশটায়৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা চলে সেই গান! পরের দিন রেকর্ড করেন অ্যালবামের অন্য গানগুলি৷ প্রসঙ্গত তখন তাঁর বয়স ৮৩ বছর৷ দ্বিতীয় দিন রেকর্ডিংয়ের পর মান্না দে সুপর্ণকান্তিকে বলেন, ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ আমি আর একবার রেকর্ডিং করব, কারণ গানের এক্সপ্রেশন আমার মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি৷ ফলে তাঁর কথামতো আবার রেকর্ড করা হল গানটি৷ যার সাক্ষী ইন্দ্রনীল সেন, শান্তনু বোস, সুপর্ণকান্তি ঘোষ প্রমুখ৷ এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা বলি৷ যা দেখে মনে হয় কেন তিনি কিংবদন্তি৷

মানুষটির বয়সের কথা ভেবে কফি হাউস দ্বিতীয় পর্বের গানটি তুলনায় একটু কম লয়ে’র রাখেন সুরকার সুপর্ণকান্তি৷ যে লয়টি কিছুতেই মনের মতো হচ্ছিল না মান্না দে’র৷ দেখা গেল, নিজেই গান গাইতে গাইতে হাত দিয়ে ইশারা করছেন লয়-এর মাত্রা বাড়াতে৷ যে মাত্রা ঠিক হওয়ার পর উনি ও-কে করলেন তা দেখে উপস্থিত সুপর্ণকান্তি, শান্তনু, ইন্দ্রনীলরা তো অবাক! জানতে পারলাম তেইশ বছর আগে মান্না দে যে কফি হাউস গানটি গেয়েছিলেন তার মাত্রা যা ছিল, দ্বিতীয়বারও তা এক! প্রতিভা, নিষ্ঠা, অভিজ্ঞতার পরও হয়ত কিছু থাকে যা একান্তভাবে গায়কের নিজস্ব সংযোজন৷ এই ঘটনা সম্ভবত তারই প্রমাণ৷ এমন চমৎকারিত্ব যা সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *